গাঙ ভাঙা চরে বুক ভাঙা মানুষ !


গাঙ ভাঙা চরে বুক ভাঙা মানুষ

মিসির হাছনাইন 


তখন মাঘ মাসের মাঝামাঝি। উত্তরের বাতাস মনে হয় চলমান মানুষটাকে উড়িয়ে নি যেতে পারবে। ভরদুপুরে সুরেলা গাছের পাতা কণ্ঠে একটানা ডেকেই যাচ্ছে ঘুঘুপাখি। উত্তাল মেঘনা কেমন শান্ত এক পুকুর, পরিষ্কার জলের গায়ে কতগুলো বক উড়ে উড়ে নদীটা পাড়ি দিয়ে ঐ চরের কেওড়া বনে চলে গেল। নদীর জল জোয়ারেও খাল পর্যন্ত আসে না, জুতা পায়ে খাল পেরিয়ে গেলেই মাঠ, দশ কদম হাঁটলেই নদী। ঐ তো ভাঙা টিলার উঁচু জায়গায় বিন্দি জালে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরছে সবুজ মাঝি। তিনি এই গাঁয়ের জামাই, পুবের চর মানিকায় ঘর, সৎ বাপের ঘরে মায়ের ছলছল চোখ আর দেখবে না বলেইথ বছর দুয়েক আগে বর্ষার এক বৃষ্টিতে নৌকার গুন টানতে টানতে... এতদূর মায়ের দেশ নদীর পাশে বেড়ীবাঁধ, মামা ছলিমের নৌকায় ওঠে মাছ ধরতে যায় সাগরেরও আগে, যৌতুকের দেড় লাখে একখানা নৌকায় বিশ বছরের নয়া যৌবনের ঘর পেতেছে বাবলা গাছের তলে। আর কখনও সে চর মানিকায় গিয়েছিল কিনা তা অজানাই থাক। উচ্চতায় গুল্ম বৃক্ষের সমান, কালো গায়ের রঙ মেখে কত সহজসরল এই মানুষটা বছরের পর বছর ধানিয়াপুর গাঁয়ে বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁটে হেসে হেসে জীবন ভাঙছে মেঘনা নদীর কূলে।


তিন বছরের সংসার, বীণার বয়স পনেরো থেকে ষোলতে পড়েছে.. তখনই তাঁর বিয়ে হয়। লাজুক স্বভাবের এই ষোড়শী কখনও কোন পুরুষের ছায়ায় দাঁড়িয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল, কত সহজ, আর, কত ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া তাঁর। পড়াশোনা ক্লাস ফাইভ, কোন রকমে দুই বেলা খাওয়া তিন বোনের অভাবের সংসারে, মা তাঁরে উপজেলা শহরে কাজে দেয়থ পৌর কাউন্সিলর জলিল মুন্সীর ঘরে। মফস্বল শহরের হাওয়ায় বছর ঘুরতেই বীণাকে যে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না নদীর কূলে ঘর। বুকের ওড়না ভালোমতন জড়িয়ে নিতে গেল পাশের ঘরের কলেজ পড়–য়া রিপনের তাকিয়ে থাকা প্রেম লুকিয়ে রাখা চোখথ ধরা পড়ে গেলে বীণা চলে আসে গাঁয়ে। এর কয়েকদিন পরই বীণার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের বছরই তাদের প্রথম সন্তান মারা যায়, কখনও মনেই হয়নি, মৃত জন্ম দেওয়া ছেলে বুকে জড়িয়ে কেটে যাওয়া শোক মুছে বীণা আবার আগের মতন হাসবে, পরাণের স্বামীর জন্যে একলা ঘরে শুয়ে শুয়ে চেরাগ জ¦ালা আলোয় শ্যামলা মুখখানা অপেক্ষায় অপেক্ষার রাত জাগবে, বিছনার ফুল কত সুন্দর সাজবে।

বুকের শোক গোপন করে আবার মা হয় বীণা।

সেবার ইলিশের মৌসুম। নিজের ছোড নাওখান বেচে দিয়ে আবার মামার নৌকায় ওঠে সবুজ। নদীর এদিকটার চেয়ে সাগরের আগে নদীর ¯্রােতে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়। তার কারণে অনেক নৌকা এক মাসের খরচে সাগরের কাছাকাছি সামরাজ যায় মাছ মারতে। মামার নৌকা এক মাস পর, সামরাজ থেকে ফেরার দিনে মামাতো ভাই আকরামকে বলে সে চিটাগাং চলে যায়। ততদিনে ফোনে ফোনে কথা হতো বীণার সাথে, বীণাদের ঘর ছিল দুই ঘর পরেই, পনেরো দিন পর পর সবুজ দুই হাজার করে টাকা পাঠাতো। আন্তরিকতায় ভরপুর এই মানুষটা ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে, দূর দেশের মানুষকে করেছে আপন। বাপ মরা এতিম এই ছেলেটার কাহিনী আমি লিখছি.. তার আগে চলুন গায়ের মাঝখান থেকে ঘুরে আসি।


২.


নদীভাঙা ধানিয়াপুর গাঁও। মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা পুবে মেঘনার বেড়ীবাঁধথ উত্তর-দক্ষিনে চলে গেছে নদী ঘেঁষে আর পশ্চিমে আনন্দ বাজার হয়ে উপজেলা শহরের দিক চলে যাওয়া রাস্তার দু ধারে পাশাপাশি নদীভাঙা মানুষের ঘর, এদের প্রায় সবাই ছিল এককালে কৃষক, সময়ের চলে যাওয়া দিনে এখন কেউ কেউ বাজারের ব্যাবসায়, তিন, চার ঘরের কেউ শিক্ষক, চৌকিদার, দলিল লেখক, গাঁয়ের মেম্বার। নদী থেকে বের হওয়া বিশাল বড় খালটা এখন বাঁধ দিতে দিতে হয়ে গেছে ছোট ছোট পুকুর। পুরো গাঁয়ে একশো খানা ঘর, বেড়ীবাঁধের উপর নদীর আয়ে খাওয়া মানুষের এক কালের কষ্ট, না খেয়ে থাকার দিন অনেকটা মুছে গেছে। এই একশো কি তার একটু বেশি পরিবারথ ধনিয়াপুর মতলব হাজী হাওলাদার জামে মসজিদে সব পেশার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক আল্লাহর উপসনায় নিজের জানা দুঃখে নীরবে কাঁদে, আহা! সবাই খোঁজে পরকালের সুখ। 


একটু আগে ঘরের সামনে রাস্তায় ওঠে পুকুরের ঐ পাড় মেম্বার বাড়ির ঘাটে, রতন মেম্বার দেখলাম বসে আছে। হঠাৎ হৈ চৈ আওয়াজ আর কান্নার বিলাপে আকরাম এক ভোঁ দৌড়ে চলে আসে মেম্বার বাড়ির উঠানে। মেম্বারকে কাঁধে ভর করে ঘরের বিছনায় শোয়ানো হল, ডাক্তার আসবে বাজার থেকে, একটু চেকাপ করে ওষুধ দিলেই ত সুস্থ, এর আগেও অনেকবার এই অবস্থায় পড়তে হয়েছিল তাঁকে। মাথায় তেলে পানি দিতে দিতে সিলিং ফ্যান ঘুরলেও অনেকে বাতাস দিচ্ছিল, হঠাৎ শোয়া থেকে ওঠে বসে, তারপর বমি করে, এবং চিৎকার দিয়া বলে- “ওরে বুকটা বুঝি গেলো রে”.... পুরো শরীর একবার ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ দিয়ে প্রাণপাখি উড়ে গেছে ঐ আকাশে। আহা! দিব্যি সুস্থ মানুষটা দুনিয়া থেকে পাড়ি দিল পরপারে। হায়রে!! মানুষের মৃত্যু, কত সহজ, কতটা সত্য 

যেমন দেখি না পিঠের দাঁগ, পোড়া হৃদয়।


শোকে ঢাকা পুরো গাঁয়ের পশুপাখি, গাছপালা দিনের সূর্য আর রাতের অমাবস্যা। চিটাগাং থেকে খবর পেয়ে সবুজ গাঁয়ে আসছে পরশু। বীণা পোয়াতিথ অন্য সবার মতন তাঁরও জানতে ইচ্ছা হয় পেটের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে।

তবে, যা হা হোক বীণা তাতেই খুশি। সেদিন সন্ধ্যায় ছোট ছোট চুল আর লাল রঙের শার্টে সবুজকে দেখেই বীণার শরম লাগে, এতদিনে সে তাঁর স্বামীর মুখ দেখেনি, শুধু হৃদয়ে খুঁজেছে, যখন তখন কাছে চেয়েছে, আজ হয়তো হঠাৎ দেখায় বুকের ভেতরকার শরম নাকি অন্যকিছুথ

বুঝে ওঠার আগেই বীণা মুখ লুকায়।

“আরো কয়দিন পরে আসতেন। আমি ত ভালোই আছি। দেখবেন, দেখবেন নকশিকাঁথা সেলাই করছি, এই যে ঐখানে দেখেন কতগুলো টাকা জমাইছি...আমগো বাবু হওনের সময় লাগবো, আপনে অনেক হুকায় গেছেন”। একদমে কথাগুলো বললো বীণা।

“হইছে হইছে তুমি এখন রেস্ট লও, এই যে ফল এগুলা খাবা, মামা আর তোমাদের ঘরের জন্যও আনছি, এখন শুয়ে থাকো, উঠতে হবে না, ফল ধুয়েমুছে কেটে দিচ্ছিথ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। ব’লে সবুজ একটা সিগারেট ধরায়, তারপর, বাজারে যায়।

তার ঠিক সাতদিন পর, গভীর রাতে বীণার প্রচন্ড ব্যথা ওঠে। অনেক কষ্টে একটা অটো রিকশা জোগাড় করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল, সবুজের জমানো সব টাকা সে লুঙ্গির প্যাঁচে বেঁধে নেয়। সমস্ত টাকা আর সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়েও সেদিন বাঁচতে পারে নি বাণী ও তার পেটের ফুটফুটে নয়মাসের কন্যা সন্তান। কত অল্পতেই মিলে গেলো তার ছোট্ট সংসারের সুখ দুঃখের হাসিমাখা রাতদিন।

সবুজের বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া মুখ যে কেউ দেখলেই মনে হবে আকাশ ভাঙা অপরাধ তাঁর।

এক মাস পর বিয়ে করে রেজিনা নামের এক মেয়েকে।


রবি মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ, তিন মাস অবরোধ। এখন জেলেরা রাতদিন বাগদা পোনা ধরছে। একটা কম্বল গায়ে মুড়ে গুটিশুটি নদীর কূল ঘেঁষে উঁচু জায়গাতে যেখানে এক সময় বসতবাড়ি ছিল জোনাক জ¦লা আলোতে দক্ষিণা পিনপিনে বাতাসে সবুজ মাঝি বড় একটা প্লাস্টিকের বাটি থেকে থালাতে পানি নিয়ে হাতের চামচ দিয়ে বাগদা পোনা আলাদা করে পাশের ছোটো বালতিতে রাখছে। রাতদুপুরে পোনা বেশি পাওয়া যায়। একশো পোনার দাম পঁচিশ টাকা। হকার এসে পোনা নিয়ে যায়। রাতদিন মিলে হাজার পোনা ধরতে পারলেই চলে, মাঝেমধ্যে অনেকের পরিশ্রম আর মেধায় হাজার ছাড়িয়ে যায়।


বাগদাথগোলদা পোনা বৈধ ভাবে ধরা নিষেধ আছে, কারণ হাজার হাজার ছোট ছোট মাছ জালে আটকা পড়ে, শুধু পরিনিত পোনা রেখে বাকি জলসহ মাছ ডাঙায় ফেলে রাখে, ফলে সব মাছ মরে যায়। সরকারি ভাবে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও অনেকে চুরি করে মাছ ধরে।

এই সময় নদীতে কোস্টগার্ড নৌকা নিয়ে টহল দেয়। যখন তখন যে কেউ ধরা পড়তে পারে, তাই সবাই সতর্ক থাকে।

সবুজ মনে মনে রেজিনার কথা ভাবতেছিল, ঐ তো কাল রাতের ঘটনায় হাতের থালাভর্তি চোখে বাগদা চিংড়ির পোনা রাখতে রাখতে একটা বিড়ি ধরায়, হঠাৎ করে হা হা হা করে হাসে। কিন্তু, কেন হাসলো সে কথা বুঝতে পারে না সবুজ। চারদিকের অন্ধকার আর শীতের বাতাস বারবার  মনে পড়ছে রেজিনার মুখ। নদীর ঘোলা জলে লম্বা বাঁশের সাথে বাঁধা বিন্দি জাল, এক ঘন্টা পর পর টান দিয়ে তুলতে হয়, মাঝখানের বিশ্রামে মাঝির ছোট্ট টঙ ঘরে গিয়ে সোজা শুয়ে পড়েথাকতসব কি জানি হাবিজাবি দেখতেছিল হঠাৎ চোখ খোলে রেজিনাকে দেখতে পেয়ে সবুজ দৌড়ে পালায়।

কিছুদূর গিয়ে একটা উল্টে যাওয়া খেঁজুর গাছের গুড়ির উপর বসে একটা বিড়ি ধরায়। মনে মনে বলে- “শ্লার পুতের শান্তি নাই! কান্তি নাই! তারপর হা হা হা... করে হাসে। কেন যে বারবার হাসিটা চলে আসে বুঝতে গেলেই মনে পড়ে রেজিনার মুখ। না, না বীণার করুণ চোখ


কে যেনো ডাকে, এমন একটা ডাকে তাঁর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, এক জীবনে কত পাপ করেছে সে, এক নারীকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছে, পেতেছে সংসার গাঙ ভাঙা চরে, তবুও ছোট্ট বুকে কতটুকু আশা লয়ে মানুষ নদীর জলে গান গায়থ বুক পোড়া দুঃখে বেঁচে থাকে, তাকিয়ে থাকা চোখে কেমন মুখখানি দেখে দেখে মানুষটা জীবনভর হা হা হা... হাসে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট