গুম
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
গুম
আহাদ আদনান
আলো যখন বাড়ে বাড়তেই থাকে। দিন যখন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, প্রদোষের হাতছানিতে তলানিতে ঠেকে দৈনন্দিন সূর্যটার জ্বালানি, তখনো যদি আলো বাড়তেই থাকে তাহলে ধন্দে পড়ে যেতে হয়। এমন হয় কখনো সখনো। গরুর দল ঘরে ফিরতে যেয়ে দেখে আলো উপচে পড়ছেই আর পড়ছেই। হলুদ আলো নয়, লাল আলো নয়, এমনকি জীবনানন্দের কমলা রঙের রোদও নয়, এ রোদ বর্ণনাতীত। এ রোদ রংতুলি হাতে সুলতানকেও করে দেয় হতবুদ্ধি।
অনেকদিন পর, ঠিক কতদিন জানা নেই, চোখে এমন আলো পড়তেই ভয়ে জড় হতে থাকে অরুণ। সে ভাবেনি কোনোদিন আর সূর্য নক্ষত্রটার চেহারা দেখতে পাবে। নক্ষত্র বিষয়ক কিছু মিথ শুনে শুনে সে বড় হয়েছে। আলোকবর্ষ নামের জটিল কিছু গাণিতিক হিসেব কষে কষে কেটেছে তার দিন। যদিও নক্ষত্রের চেয়ে প্রিয় ছিল উপগ্রহ। চাঁদটা তার কাছে শুধুমাত্র একটা ঘূর্ণায়মান উপগ্রহই ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার অবলম্বন।
আলোটা আরও বাড়ছে। বেগুনি একটা আভা ছিল এতক্ষণ। সেটাও কেটে যাচ্ছে। এখন এর একটা রঙ বোঝা যাচ্ছে। কমলা রঙের রোদ। রোদের রঙটা বুঝতেই অরুণের কাঁধে ভর করে জীবন বাবু। একটি মেয়েকে সে চিরদিন ভালোবেসেছিল, অথচ মেয়েটা তার মুখ কোনোদিন দেখেনি। সে মেয়েটা পৃথিবীতে এসেছে কি? এতদিনে জন্ম নেওয়ার কথা। তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।
রোদটা আরেকটু মাথাচাড়া দিতেই অরুণ ভয় পেয়ে যায়। দিন কি আসলেই শেষ হচ্ছে, না-কি শুরু হচ্ছে? সূর্যটা ডুবতে গিয়ে আবার উঠছে কি? পশ্চিম দিক থেকে উঠছে? এখন কি কেয়ামত হচ্ছে? পৃথিবীটার আর দেরি নেই বুঝি? অথচ সবাই কত স্বচ্ছন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কালো গাড়িটা ট্রাকটাকে ওভারটেক করে উঠে গেল মহাসড়কে। ছোট মেয়েটা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে শপিং মলে। লুঙ্গি পরা খাটোমত একটা লোক বিড়ি টেনে ভুকভুক করে ধোঁয়া ছেড়ে গেল। অরুণ খুব টান দিয়ে শ্বাস নিল। কোন গন্ধ তার নাকে ঢুকছে না। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে কি এখনো বেঁচে আছে?
আরও কিছুক্ষণ পার হয়ে গেছে। সূর্যটা এখন মাথার উপর। অরুণ নিশ্চিত, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। চিৎকার করে কথাটা সে সবাইকে বলতে থাকে। কেউ শুনতে পায় না তার আহ্বান। তার শব্দের কোনো প্রতিধ্বনি হয় না। সে ছুটতে থাকে দিগি¦দিক। কারও গায়ে ধাক্কাও লাগে না। চুম্বকের উত্তর মেরু হয়ে ছুটে চলা অরুণ নিজেকে আবিষ্কার করে আরও অৎস্র উত্তর মেরুর জনসমুদ্রে। প্রবল বিকর্ষণে সে সরে যেতে থাকে সবার কাছ থেকে।
অরুণ বুঝতে পারে তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। যদিও শরীর বলছে অন্যকিছু। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। না হলে সে বুঝতে পারত তার ব্যথাগুলো চলে গেছে। কালশিটে পড়া উরুর মাংসগুলো দৃঢ় হচ্ছে। বাহুতে ভর করছে দানবিক শক্তি। টেকো মাথাটার জ্বলজ্বলে ময়দান ক্রমশ ঢাকা পড়ছে। শম্বুকের মত শুরু করা সময়টা যতই পার হচ্ছে, সে ‘ফিরে পাচ্ছে’ চিতার গতি। ফিরে পাওয়া ব্যাপারটা অবশ্য তার জানা নেই। গতকালটাও এখন পূর্বজন্মের মত। অচেনা, অজানা, অনুভবের বাইরে। সবাই কি জাতিস্মর হয়?
সূর্যটা আরেকটু পূবে যেতেই অরুণ পরিবর্তনটা টের পায়। বিশাল একটা দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে সে থমকে দাঁড়ায়। এ কে? সদ্য যুবক ছেলেটা কি সে নিজে? ওকে চিনে অরুণ। তখন পৃথিবীতে কোনো চাপ ছিল না। দায়িত্ব, প্রেম, সংসার ছিল না। রাজনীতি ছিল না, শত্রুতা ছিল না। পুলিশ, গ্রেফতার, রিমান্ড ছিল না। গুম ছিল না। এগুলো তার পার হয়ে আসা অতীত। এগুলো দেখেছে সে। রিমান্ডে দাঁত ভেঙে যাওয়া, মলদ্বারে উষ্ণ ডিমের অস্তিত্ব, মরিচ-জ্বলে শিশ্ন-স্নান, অন্তকোষে বিদ্যুতের ঝলকানি সব মনে পড়ে তার। মনে পড়তেই লুঙিটা খুলে ফেলে সে। এতক্ষণ লুঙ্গি ছিল গায়ে, এটাই তার মনে ছিল না। নগ্ন অরুণ শক্ত হাতে খাবলে ধরে অন্তকোষ। কঠিন তালুতে ঘষে নেয় উন্নত দৃঢ় শিশ্ন। যৌবনের প্রথম প্রহরে ভাবনার কেয়ামতটা উপভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে।
রোদটা মিহি হয়ে এসেছে। উলঙ্গ অরুণের কোনো লজ্জা করছে না। গ্রামের দিকে পুকুরে আরও কয়েকটা আদুল ছোকরার সাথে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরের জলে। আহা, কতদিন পর এই উদ্দাম সাঁতার। পুকুরটা আর শেষ হয় না। তার শক্তিও আর ফুরায় না। সব ছেলেকে পেছনে ফেলে সে দেখে কখন যেন পুকুরটা নদী হয়ে গেছে। কিংবা সমুদ্র, মহাসমুদ্র। এতকিছু ভাবতে বয়ে গেছে তার। এটা ভাবনার বয়স না। এই সময় শুধুই উদযাপনের।
এই লালচে আভাকেই কি সুবহে সাদিক বলে? জল থেকে উঠে অরুণ হাঁটছে মখমলের গালিচায়। এটা মাটি, না মায়ের কোল? ঘুম পাচ্ছে অরুণের। একটু শুয়ে পড়লে কেমন হয়? কে যেন বলছে, ওঠ অরুণ ওঠ। এখন ঘুমুতে নেই। ওঠ। বেলা হয়ে যাচ্ছে। এখন ঘুমুলে আর উঠতে পারবি না। কে বলছে এসব? মা? বাবা? অন্য কেও? কণ্ঠটা পুরুষ না মহিলা? কিছুই মাথায় আসছে না। মাথায় ঢোকানোর চেষ্টাও করছে না অরুণ।
এখন অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পৃথিবীতে কোনো ঘড়ি কাজ করছে না। সময়, সূর্য, নক্ষত্র, নক্ষত্র বিষয়ক মিথ কিছুর অস্তিত্ব নেই এখন। তন্দ্রা, স্বপ্ন, কল্পনা, কুহক, পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা মিলে মিশে একাকার এখানে। ব্যথাটা ফিরে এসেছে আবার। ফেটে যাওয়া খুলিটা থেকে কিছু মগজ বের হয়ে এসেছে। ঝোপের মত একটা কিছুতে পড়ে আছে অরুণ। হাতটা কাজ করলে, ধরতে পারলে সে বুঝতে পারত শিশ্ন, অন্তকোষ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শরীরটা এখন শুধুই থ্যাঁতলানো মাংসপি-। দৃষ্টি ফিকে হয়ে আসছে। শ্রবণশক্তি ভোঁতা হয়ে আসছে। এক দুই তোলা মস্তিষ্কের কোষ কাজ করছে বোধহয়। এই অন্ধকারে আলো দেখছে ওরা। আলোর একটা ধর্ম আছে। যখন বাড়ে বাড়তেই থাকে। এই নিয়ম এখন চলছে না কেন?
‘ওই, অর্ডার আসছে। আর খোঁচাইতে হবে না। গুলি কর। মাথা, মুখ ঝাঁঝরা কইরা দে। দেখলে যাতে চেনা না যায়। তারপর নদীতে ভাসাইয়া দিবি। গুম কইরা দে’।
সূর্যটা এবার সত্যি উঠে গেছে। পূর্ব দিক থেকেই উঠেছে। কেয়ামতের দেরি আছে তাহলে। আলো ছড়াচ্ছে। ছড়াতেই থাকে। এটাই আলোর ধর্ম।
ঝকঝকে আলোতে নদীর জলে খুলিবিহীন নগ্ন একটা লাশ ভাসতে থাকে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।
মুখোশ
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
মুখোশ
রায়হান আজিজ
”হ্যালো, আব্বা ! আমি স্টেশনো আয়া ফরসি”, শাহীনের কণ্ঠে উত্তেজনা ।
দুপুর বারোটা নাগাদ মানিকখালী স্টেশনে এসে পৌঁছেছে শাহীন। সে ময়মনসিংহ শহর থেকে এসেছে বাবার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে। বাবার সাঙ্গপাঙ্গরা আগেই স্টেশনে উপস্থিত ছিল। বাবা লুতফর মিয়া এবার বুরুদিয়া ইউনিয়নের মেম্বার প্রার্থী, পুরু গোঁফ, দাপুটে চেহারা, মেজাজও তিরিক্ষি।
শাহীনও স্বভাবে একটু উগ্র, আর দেখতেও ষ-ামর্ক চেহারার। ট্রেন থেকে নেমে অদূরে মসূয়া বাজারে বসে সিগারেট ধরাল সে। এ সময় সে দেখল, কিছু ছোকরা তার বাবার প্রতিদ্বন্দ্বী আলাউদ্দিনের পোস্টার লাগাচ্ছে। সে তাদের ধমকে ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিল।
বিকেলে আলাউদ্দিনের বাড়িতে বৈঠক বসল। মধ্যমণি বাবরি চুলওয়ালা আলাউদ্দিন ।
”লুতফইরা আর অর ফুতেরে একটা শিক্কা দেওন লাগব। এত বড় সাহস, আমার ফুশটার ছিরে। কী কইন আমনেরা’’?
বৈঠকে উপস্থিত সবাই এ ব্যাপারে একমত হল।
পেয়ার মুন্সী বলল, “ঠিহই কইসুইন” ।
”ওই কাজইল্যা, ব্যাকতের লেগা চা লয়া আয় ”। আলাউদ্দিন হুকুম করলেন তার বিশ্বস্ত চ্যালা কাজল কে। এই কাজলকে একটু বেশিই বিশ্বাস করেন লুৎফর । মেম্বারের সাথে থেকে কাজলও মোটামুটি ভালই পয়সা করেছে ।
আলাউদ্দিনের বৈঠকের খবর লুতফরের কানেও পৌঁছায়। শাহীন বলল, “আলাওদ্দি যেইতা কইতাসে, থানা ফুলিশই করন লাগব আব্বা”।
লুৎফর বললেন, ”আমরা কুনু মারামারিত যায়াম না” ।
রবিবার সকালে ধানক্ষেতে কাজ করতে যায় আমিন, শামীম, কাওসার ও আরও কয়েকজন ।
শামীমই প্রথম দেখে লাশটা- “কাওসার বাই, দেহুইন চাই, এইডা আলোদ্দী মেম্বর না ?”
পুলিশ ঘেরাও করে লুতফরের বাড়ি । ”ফুলিশ বাই, আমরা কিচ্চু জানিনা, আমরা এইতা করতাম ক্যারে”? বলল লুৎফর ।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? আটক হয় লুতফর ও শাহীন ।
অন্যদিকে মুচকি হাসে কাজল। আজ রাতে ওর ভালই ঘুম হবে ।
করিমুল্লারবাগ, পোস্ট- ফরিদাবাদ, থানা- শ্যামপুর, ঢাকা-১২০৪ ।
পদাবলি : ০১
হলাহল
সা’দ সাইফ
মনকে তো আমি বেঁধে রাখতে পারি না
সে তার মতই ভাবছে,
চ-ালের মত জীবন।
অচ্ছুৎ;
মন খারাপের দিনে এক আকাশসম দুঃখ আমাকে স্ফীত পীড়া দিয়ে যায়।
ডুকরে ডুকরে ব্যথা উগলে উঠছে।
চলমান পা-ও ধাবমান মড়ক।
কী থেকে কী হয়ে যাচ্ছে নির্নিমেষ,
চোখ খুলতেই কোণে এক ছটাক বৃষ্টি।
হয়ত পিঁজরাপোলের কেউ,
গ্রীবায় টান দিয়ে কেউ কেন নিয়ে যায় আস্তাবলে!
জোলো স্মৃতি মস্তকে গেঁথে থাকে,
আবার ধর্তব্যে না রাখার পণও ব্যর্থ।
ছ্যাঁত করে ওঠা মন,
ব্যথা দিয়ে যাওয়া লাগাতার ঢাল ঠেকাতে অপারগ,
অদৃশ্য শরে বিদ্ধ একটি মন-মন্দির।
আর আমি?
আর আমি সেই মন-মন্দিরের সমানুপাতিক সমার্থক।
ব্যাগ্রাউন্ড
নূরে জান্নাত
তোমার উঠানের শ্যাওলা জানে
কতোবার সেখানে স্লিপ কেটে
পড়েছিল বয়ঃসন্ধির সেই মুখ
যে মুখে তুমি নীল মেঘ সাদা বৃষ্টি
ঘিয়ে সংসার আর লাল রঙের
ঘুম এঁকেছিলে।
ধূলোমাখা পথের উঁচু নিচু কাঠামো
লজ্জাস্থানের মতো লুকিয়ে রাখে
সাইকেলের পেছনে তার স্কুল যাওয়ার স্মৃতি!
আমি জানি.. ভুট্টা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়–য়ার যেমন অতীত থাকে
তেমন অতিত ছিল তোমার
ছিলো আমারও অধর্ষিত ডালিমের চারা!
তবুও ভুলবসে আমরা জলের ক্যানভাসে জীবনে ডিঙ্গি ভাসিয়ে
ফিরে যায়;
তুমি যাও ফাইভে পড়া ডাঙ্গর পেঁপে গাছটার কাছে
আমি যায় দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দেওয়া বুক শ্মশানে
পড়ে থাকা ছাঁইয়ের কাছে!
যখন আমাদের শোদ ফিরে আসে
রেশমের কৌটা খুলে মাতি ভালোবাসাবাসিতে
চোখের মলাট উলটে পড়ে নিই
যা হবার, যা হয়েছে, যা হয়ে যাক
তবুও আমাদের দু ডালের পাখি হবার সাধ্য নেই!
শূন্যতা থেকে যায়
মজনু মিয়া
কত জল জলের উপর এসে আচড়ে পড়ে
কত বালি,ধূলা স্তরে স্তরে উপরে সাজায়,
আকাশের গায়ে মেঘ জমে,
পথের পরে পড়ে পায়ের পদাঘাত,
তব্ওু শূন্যতা থেকে যায় জনম জনম!
একদিন ভালোবাসা ছিলো ভাবতে অশ্রু ঝরে
বেদনারা হৃদমাঝারে কুঠারাঘাত করে,
তবুও যার জন্য ক্ষত সে পূরণ করে না!
গর্ত করে মাটি সরিয়ে নিলে যে গর্ত হয়
তাতে পূরণ করার চেষ্টা সেই মাটিতে বৃথা
এখানে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা পূরণ হয় না।
মানুষের ভেতরে ক্ষত বা শূন্যতার সৃষ্টি হয়
আর তা অপূরনীয় রয়ে যায়!
জনম মোহ
নাসিমা হক মুক্তা
নক্ষত্রের গায়ে আধুলি মাখে
কিছু অভিমানের জল তৃষা
মনের চৌকাঠে ডুবুরি হয়ে মেদুর মৌতাত
গলা উচু করে আকাক্সক্ষার যাত্রী- পোষাকে
ভোগ-পথ্য নিষ্প্রাণের মত দীর্ঘতম অপেক্ষায়
ডাগর- ডাগর চোখে কাক- কাক করে
গাছ থেকে ডগার সারস!
ফেরার পথে পা আটকে ধরে
এক টুকরো- জনম মোহ
যার পর্দায় প্রেমহীন সোনা মাছি নেশার উজ্জ্বলে
টুকরো টুকরো বরফ গুলানো মুখে
নিভৃতে- জীবন ছাইপাঁশ, জীবন ছাইপাঁশ বলে
চাষ করে অতৃপ্তির চিবুক
পরচুলা সুখ লুটোপুটি খায়
অমানিশার অন্ধকারে
প্রেমহীন সংসার মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রণা।
ফিলিস্তিন
মুহিব্বুল্লাহ ফুয়াদ
তোমার বুকে বোমা নিক্ষেপ হলে, আমি ছিন্নভিন্ন হই
তোমার কোলের কোনো শিশু স্তব্ধ হয়ে গেলে, আমার হৃদয় হাহাকার করে ওঠে
তোমার বোবা চিৎকারে, আমি ভেঙে পড়ি
তোমার উদরে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা দেয়াল ধ্বংস হলে,
আমি নিঃশেষ হয়ে যাই
কারণ,
তুমি’ই আমি- আমি’ই তুমি
তুমি আমাতেই মিশে আছো প্রিয় ফিলিস্তিন।
পদাবলি : ০২
লক্ষ যোজন দূরে...
ফজলুর রহমান
নির্জনে তোমাকে পাবো এমন বিশ্বাসেই কোলাহলে তোমাকে খুঁজি না আর। জলের ভিতর আলোর রেখা মিলিয়ে যাওয়ার আগে মীন সন্তানদের কানকোয় যে চঞ্চলতা ফুটে উঠে তেমন আকুলতা কী তুমি আমার মাঝে দেখ না? আঁশটে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ার আগে শিকারী কীভাবে বুঝে ফেলে মীনের গতি! এই যে বৈধব্য বেশ, আমিষ ছেড়ে দিয়ে নিরামিষ এ আসক্ত Ñ এই উপবাস কিংবা যৌবনকে কাঁচের বয়মে পুরে তোমার পায়ে বর্তে দেওয়াÑ এসবের বিনিময়ে বেহেশতে কী প্রগাঢ় প্রেম, চির তরুণ জীবন দেবে না আমায়? একটা তন্দ্রা টুটে যাওয়া ভোর, পুবাকাশে ঘোড়ার খুরের ছায়ার মতো মেঘ, সারারাত জেগে থাকা বেশ্যার ঘুঙুর ও তার করুণ মুখে, শারাবে নিমজ্জিত গালিবের চোখে তুমি কী দেখা দাও না? ভাসো না মেঘের শায়রে? ফেনায়িত ঢেউয়ে? তোমাকে কী পাওয়া যায় না ঝিনুকের শব্দে, বায়স্কোপের Ñ ‘কী চমৎকার দেখা গেল’ ছবিতে? ম্লান সাঁঝের আযানে, মন্দিরের ঘণ্টায়, গির্জার সুউচ্চ মিনারে? তোমাকে পাবো বলেই মোমবাতি হই। পুড়ে পুড়ে শেষ হই তবুও লালনের মতো ‘লক্ষ যোজন দূরত্ব’ ঘোচে না।
আমি যদি পাখি হতাম
বশির আহমেদ
সাঁঝের আলো অধরে মেখে কুলায় ফিরে যায়
সন্ধ্যা পাখি,
ইস আমি যদি পাখি হতাম।
ভোরের শিশির আমার স্বপ্নীল ঠিকানা
নতুন বইয়ের মলাটে খুঁজে পাই হেমন্তের ঘ্রাণ।
মানুষকে ভালোবেসে কাছে যেতে চাই যতটুকু আছি তার চেয়েও বেশি।
সদা প্রস্তুত মৃত্যুর পয়গাম সালাতে কামনা করি মার্জনা।
প্রলম্বিত জীবন হিসেবের খাতায় দোটানা তবুও
অন্তরে বপন করি সবুজ নীতি।
তুমি যা কর
মাজরুল ইসলাম
যখনই ভোট উৎসব আসে, তখনই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে
উচ্চকণ্ঠে বেদগান শোনাতে
সুরের ত্রুটি কর না।
নানা উপায়ে তুমি গোপন কথা, গোপন রেখে
অনায়াসে কাজের তালিকা পেশ কর।
নজর আলি, রবি রুইদাস উৎসবের মুখে খুব অন্তরঙ্গ
আর কাজ চাইলে
কাজের পরিবর্তে হাতকড়া পরাও।
তোমাকে মিথ্যাতেই বেশি মানায়।
রাস্তায় পড়ে থাকলে
দেখতে আসা তো দূরের কথা
খবর নেবার সময়টুকু পাও না।
তার পরেও- তুমি’ই এখন আবার
প্রধান পদে উন্নীত।
তুমি যা কর
তা যে কতটা সত্যি, সে কথা তুমিও জানো বোধহয়!
একটি নির্জন আবর্জনা
ইয়াকুব শাহরিয়ার
আলো, বাতাস, রাস্তা-নদী
সব আছে, আছে ‘আন্তাজি’ ব্যস্ততা
জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার লাগামহীন দৌঁড়,
কাঠটুকরার মত টুকরে খাওয়া নষ্ট সমাজ,
সব আছে। এসব থেকে যেতে যেতে চলে যাবে-
পরের প্রজন্মে, খোলা খামে।
এক গ্লাস নেশা ধরা বৃষ্টি
পৃথিবীর মলাটের উপর পড়ে থাকবে প্রবল ঘৃণায়
কুকুর, শুয়োর, শেয়ালেরা হয়তো লজ্জিত হবে একদিন
মিথ্যার বেসাতি দেখে। রূপান্তরের মানুষগুলো
তবু বেলাজ হয়ে বসে থাকবে নিজস্বতার আশায়।
আহ! ছিঃ, লজ্জা, ঘৃণা
একটি নির্জন আবর্জনার গল্প
রচিত হতে থাকবে তথাকথিত মানুষের হাতে
প্রকৃত মানুষেরা হারাতে থাকবে কালের আবর্তে,
মহাকাল অতি আদরে লুকাবে তাদের, যারা-
স্বপ্ন বুনে সুন্দর সমাজের, অথচ তাদের মাড়িয়ে
গড়ে উঠবে আবর্জনার স্তুপ।
শব্দমালা
শব্দমালা
দেলোয়ার হোসাইন
খেয়াল
আমি ছেড়ে দিয়েছি উন্মুক্ত ঝড়ের মাঠ
তোমরা প্রসব করে যাও বঞ্চিত বেদনা,
আমি বর্গাচাষ করে জমিয়েছি জলের বৈভব
তোমরা ম্লান ঘরে কাপড় বদলে এসো...!
টার্গেট
আমরা যারা প্রতিনিয়ত ‘টার্গেট’ হই
তাকে আমরা সর্বদা মৃত্যু বলে মানি।
আপনারা এক সের দুধ বললেও, আমরা
আধা সের দুধ আর আধা সের পানি বলে জানি!
অনুগ্রহ
তপ্ত সময়, দীর্ঘ ব্যবধান। মাথার
উপর অনিশ্চিত এক পাহাড়!
আমি তো ঘুমের রেফারি, বাঁশি
হাতে ছুটছি অলৌকিক চূড়ায়...
লাশের যাপনচিত্র
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
লাশের যাপনচিত্র
মো. আরিফুল হাসান
হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে সে সহজেই পৌঁছুয়। তারপর আবার পেছন ফিরে চায়। ফেলে আসা পথে তার মায়া লেগে থাকে। পথের রোশনাই তার চোখে-মুখে ঝিকিমিকি করে। সে স্তব্ধ হয়ে ক্ষাণিক্ষণ দাঁড়ায়। তারপর আবার পথ চলতে থাকে। না, থামলে চলবে না। এ যাত্রা তার দূরপরবর্তী যাত্রা। এ যাত্রা তার চোখের বাঁধন।
যেতে যেতে সে কতকিছু তুলে নিতে চায়। কতকিছুতে হাত লাগায়, ছুঁয়ে দেয়। আবার হাত সরিয়েও নেয়। না, এ যাত্রা তার কোনকিছু নেবার নয়। এ যাত্রা তার দেবারও নয়। মন কাঁদে, কত অভাব অভিযোগ দেখে তার চোখ ভিজে আসে। সে নীরবে চোখ মুছে। পথের দূরত্ব তাকে দুঃখবোধের বেদনা হতে নিষ্কৃতি দেয়। সে আবারও পথ চলে। পথ চলতে থাকে এঁকেবেকে তার সাথে।
গ্রামের পরেই মাঠ। সেখান থেকে আরেকটু এগুলে জলা। সেখানে শীত থাকে। আর তার ওপাড়ে আছে বসন্ত। আপাতত মাঠের এই যাপনচিত্রটাকে সে অতিক্রম করে। দুপুরের রোদ তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে যায়। এক পশলা সবুজ বাতাস তাকে দোল দিয়ে আবার কোথায় মিলিয়ে যায়! সব মিলে সুন্দর এক যাত্রাপথে তার কেবল গ্রামের কথা ভাসে।
গ্রামে কে আছে তার? মেয়েটির নাম লুৎফা। বড় অভাবী পরিবারের মেয়ে। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে মানুষ। শিক্ষা কি জিনিস সে জানে না। ফলে ভালোবাসার কোনো ছকে বাঁধা সংজ্ঞা তার জানা নেই। তবে যেটুকু আছে, সেটুকু হৃদয় নিংড়ানো উজার করা প্রেম। সেখানে খামখেয়ালি থাকতে পারে, তবে তাতে প্রতারণা নেই। সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে তাতে কপটতা নেই। এ কথাটি জানা। তবু তাকে ফেলে যেতে হয় অনিবার্য কারণে। আর এই ছেড়ে যাওয়া পথটিই দীর্ঘতর হয়ে যায় বিস্তীর্ণ বিষাদের মতো। যে চিত্রটি যাপনের, তখন তা শুধু একটি লাশের শবযাত্রার অনুকূল।
এখান থেকে পেছনে ফিরলে সে লুৎফাকে হয়তো পেতে পারে। আবার নাও পেতে পারে সে। লুৎফা হতে পারে গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে, লুৎফা হতে পারে রূপচর্চার প্রসাধনহীন সাধারণ সুন্দর। কিন্তু তার মনের ভেতর যে ঐশ্বর্য, সেখানে পরাজিত না হয়ে পারা যায় না। আপনি ডুবে যায় তরী। কূল-তীর হারা গহীন গহনে ডুবতে ডুবতে তল পায় না শেষমেশ। তাই লুৎফাকে নিয়ে যত সহজভাবে ভাবার অবকাশ আছে, আছে ততটাই জটিলতা তাকে না পাবার। গ্রামের মন, একবার যদি না করে দেয় তাকে আর হ্যাঁ বলানোর সাধ্য আছে কার? সুতরাং দ্বিধায় পথ দ্বিধাবিভক্ত হতে থাকে।
পথ ফুরোলো না। রথ ফুরোলো না। দুপুরের সূর্যটা আগের মতোই চলতে থাকে। মাথার উপর ছায়া ফেলে ফেলে চলতে থাকে একটুকরো মেঘ। মেঘটিকে লুৎফা মনে হয়। না হলে এই হেমন্তের নভে, যাপনের মাঠে আসার সঙ্গ কি সে এমনি এমনি দিচ্ছে। মেঘটিকে মনে হয় জ্বরেরঘোরে লুৎফার হাতের জলপট্টি। আর রোদটাকে মনে হয় লুৎফার উষ্ণ আলিঙ্গন।
পথ অনেক দূরে। এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে একসময়। এই তো, অদূরেই তো জলাশয়। কিন্তু অদূরে নয়। যেতে যেতে পথের হিসেব যখন ধূলিকণা হয়, তখন এক কদমেও কয়েকশো প্রয়াস থাকে। বিশেষ করে মন যখন দ্বিধার চলক, তখন তো মন বলে চলো না, দ্বিধা বিভক্ত পাগুলো সরে যায় সামনে অথবা পিছে, বিপরিত গোলার্ধের অন্তরালে। তবু পথ যেতে হবে। এ পথ যে বিশাল। সবে মাত্র যাপনলোকের প্রস্তর শুরু হয়েছে। তারপর আছে মিহিদানার প্রান্তর।
এখানে মিহিদানার প্রান্তরে মানুষ শষ্য চাষ করে। এখনও চাষের কার্যক্রম চলছে। তবে হেমন্তচিত্রটি এখন আর মাঠে নেই। মাঠের হেমন্তের ফসল এখন কৃষকের ঘরে ঘরে জ্বলন্ত আগুনে সুস্বাধু হচ্ছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। অথবা তারা মহাজনের গদিতে জমা হচ্ছে আগত কোনো দুর্ভিক্ষের জন্য। কিংবা এমনিতেই জমা করছে মহাজনা। হয়তো বদমতলব আছে। হয়তো তারা দাম বাড়লে চড়া দামে বিক্রি করবে সেসব। তবে মাঠে যে হেমন্ত শষ্যের কোনো চিহ্ন নেই এ বিষয়টি নিশ্চিত। দুটো হাল দেয়া শুকনো খরখরে মাটিগুলো যুবতীর প্রতিক্ষিত জরায়ুর মতো উন্মুখ হয়ে আছে নতুন বীজ গ্রহণ করতে।
ক্ষেতের আলপথ ঘাসে ঢাকা। ঘাসের চাদরে পথ আটকে যায় পায়ে পায়ে। আলের দু পাশের জমিগুলোতে জৈষ্ঠ্যে যে ধান বুনা হয় তা হেমন্তে আসে। বর্ষার দিনে এ ধানগাছগুলো জলে ডুবে বেঁচে থাকে। জল সাঁতরে ভেসে থাকে। জল ফড়িঙেরা ধান গাছের পাতায় পাতায় উড়ে বেড়ায়। ইঁদুরেরা বাসা বানায় এসে ধানক্ষেতে। কৃষক জাল পাতে ধান গাছ ফাঁক করে। মেনি, টেংরা পুটি শিং, কখনো কখনো গজারটাও লেগে থাকে জালে। জাল তুলে এনে কৃষকেরা মাছ দেখিয়ে নতুন বৌয়ের হাসিমুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করে। বধুয়ারা মাছ কুটতে বসে যায়। কৃষকেরা জল খাবার খেয়ে আবার ছুটে ক্ষেতে। মাঠের ইঁদুর তাড়াতে হবে। না হলে আমন ধান রক্ষা করা কঠিন।
আমন ধানের চারাগুলো জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। কখনো কখনো দশ ফুট বারো ফুট পর্যন্ত হয়ে যায়। জল চলে গেলে ধানগাছগুলো বিছিয়ে পড়ে থাকে মাটিতে। কিছু দিনের মধ্যেই মোচার মতো শীষ আসে সারামাঠ হেসে। ধানের স্বপ্নে কৃষকের ঘুম চলে যায়। মোচা থেকে ধানফুল ফুটটে থাকে। ফুলগুলো দুধ হয়ে ধানের ভেতরে ঠাঁই নেই। তারপর পাকা ধানের সুবাসে কার্তিক অগ্রহায়ণ হেসে উঠে গোলায় গোলায়। নবান্ন উৎসবে মেতে উঠে চিরায়ত গ্রামবাংলা।
হেমন্ত উৎসব শেষ। এখন একটি যাপনের ভেতর দিয়ে শীতের ভেতর প্রত্যক্ষণ করা ছাড়া আর গতি নেই। কিন্তু ফিরে যাবারও কোনো জো নেই পেছনের দিকে। যদিও পেছন থেকে লুৎফার হাতছানি। যদিও পেছন থেকে নবান্নের প্রাণের উৎসব, কিন্তু কোনো উপায় নেই। যাপন পথের নিজের ভেরতটাকে দুচালকে রেখে জীবনের কাটা ঘোরানো সম্ভব নয়। এমনি অবশ্যম্ভাবী যাত্রায় যদি মন কাঁদে তবু সে ফিরে আসতে পারে না।
এ লোকটা শেষ হলেই শীতলোক। সেখানে লুৎফার বুনা সুয়েটারের মতো উষ্ণতা দরকার হয়। শীত নিবারণের জন্য চাই এক মালশা আগুন। যা লুৎফা রান্নার পর যতœ করে তুলে রাখে রাতের হীমের বিপরিতে। আরও দরকার হয় পান করার জন্য উষ্ণ পানিয়। যা কেবল লুৎফার কমলার কোয়ার মতো দু ঠোঁটেই পাওয়া যায়। এতকিছু ছেড়েও সে হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে এসে পৌঁছে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে আসতে হয়। আসতে বাধ্য করা হয়। লুৎফা যে গরিব ঘরের মেয়ে। কোনো ধনকুবেরের চোখে সে যদি পড়ে তবে আর তাকে তার প্রেমিক কখনো ফিরে পায় কি? লুৎফার বাবা বিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু লুৎফা মন থেকে ভালোবাসাকে মুছে ফেলতে পারে না। প্রস্তাব করে তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। শেষদিন, সে পায়ে পড়ে কাঁদে। এই বিরহের চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ জানায়। কিন্তু লুৎফাকে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে লুৎফাও অভিমান করে বিয়েতে রাজি হয়। জানা আছে, আবার যদি সে লুৎফার হাত ধরে, যদি বলে নিতে এসেছি, তাহলে লুৎফা বিবাহবাসর থেকে উঠে চলে আসবে। কিন্তু এ কথা বলতে সায় দেয় না মন। মনে হয়, বড় ঘরে লুৎফা নিশ্চয়ই সুখেই থাকবে।
পথ চলতে চলতে একদিন পথ ফুরায়। যাপন লোকের শেষ সীমানার কাছাকাছি এসে একটি সাপ মুখোমুখি হয় তার। সামনেই জলা। ভেবেছিলো জল থেকে কোনো ঢোঁড়া সাপ হয়তো উঠে এসেছে। কিন্তু ফণা তুলতেই দেখা গেলো তার মস্তকে বিষচক্রের ত্রিশূল। সাপটি ডানে বাঁয়ে দুলতে লাগলো বিপদজনক ভাবে। সামনের দিকে ঝুঁকে ছোবল মারতে থাকলো হিসহিস করতে করতে।
সাপটিকে হয়তো এড়ানো যেতো। কিংবা আঘাতে আঘাতে সাপটিকে হত্যা করা যেতো। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো যে সাপটিকে সে পোষ মানাতে চায়। ঠিক একই রকম মনে হয়েছিলো লুৎফাকে যখন প্রথম দেখেছে সে। লুৎফাও পোষ মেনেছে। বুকের গহীণে লুকিয়ে রয়েছে দুরন্ত সর্পিণী। কিন্তু কখনো তাকে ছোবল মারেনি। একবার মনে হলো, লুৎফা তো মানুষ, রক্তমাংসের গড়া আমারই মতো মানুষ, মানুষকে আদর করে বুকে রাখা যায়। তা বলে সত্যিকারের সাপকে কি পোষ মানানো উচিত? সমস্ত প্রশ্ন এবং দ্বিধার দেয়াল ভেদ করে সে আরেকটু এগিয়ে যায় সাপটির দিকে। কোনোকিছু চিন্তা না করে খপ করে ধরে ফেলে সাপটির ফনা। ফনাবদ্ধ সাপটি তার হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে যায়। বাঁ হাতে প্যাঁচ খুলে সে সাপটিকে ছেড়ে দেয় জামার ভেতরে নিজের বুকের মধ্যে। সমান্তরাল দুটো বিষবিন্দু হৃদপি-ের কাছাকাছি মৃত্যুঘুম ছড়াতে থাকে। ঠিক তখনই বিবাহের আসরে বিষপান করে আত্মহত্যা করে লুৎফা।
কুমিল্লা, বাংলাদেশ
ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৯৭
তারুণ্যের শিল্প সরোবর। ধানশালিক। । সংখ্যা ১৯৭,
শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ০৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ ।
গাঙ পাড়ের প্রেম
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
গাঙ পাড়ের প্রেম
মিসির হাছনাইন
চাঁদপুরের তিন কি সাত নদীর মিলিত ¯্রােত মেঘনা নাম নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। বেড়ীবাঁধের পুবে বিশাল বড় খরস্রোতা মেঘনা নদী আর পশ্চিমে গ্রাম উত্তর চাঁচড়া, যেখানে কয়েক সংখ্যক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বাস। আর এই বেড়ীবাঁধে ঘর তুলেছে হাজার হাজার ভূমিহীন পরিবার। এরা পুরোপুরি নদীর উপর নির্ভরশীল। নদীর মাছেই তাদের জীবন-জীবিকা।
পুবের মেঘনা মারমার করে ভাঙ্গছে, হয়তো পশ্চিমের তেঁতুলিয়া নদীর সাথে মিশতে চায়। ছোটকালে দাদীর মুখে শুনেছি মেঘনা আর তেঁতুলিয়া ভাইবোন। তাই মিলনের জন্যে দুপাশ থেকে সমান তালে ভাঙ্গছে।
গ্রামের মধ্যবিত্তরা উপজেলা শহরে কিংবা একটু পশ্চিমে গিয়ে ঘর তুলছে, আবার নতুন বেড়ীবাঁধ হয়, ভূমিহীন জেলে পরিবার আবার নতুন ঘর তোলে।
এই অঞ্চলেরই বেড়ীবাঁধে ঘর কাঞ্চন মাঝির। সেই দাদার আমল থেকে বেড়ীতে নিবাস তাদের। তাঁর চার ছেলে, দুই মেয়ে। ইলিয়াস সবার বড়, ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি, মনে আছে স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। তারপর ইলিয়াস আর পড়াশোনা করছে কিনা, জানি না, আমরা চলে গেছি উপজেলা শহরে।
তারপর যখন জেলা শহরে অর্নাসে পড়ি, তখন একবার গ্রামের বাড়ি আসা হয়, গাছ বিক্রির জন্যে, নদী তখন আমাদের বাড়ি ভাঙ্গে। সেবার ইলিয়াসের সাথে এই দেশ-গ্রামের নৌকা-নদীর নানান হাবিজাবি কথাবার্তায় খুব একটা ভালো খাতির হয়ে ওঠেছিল আমাদের। বলেছিলাম- সময় করে আবার আসবো। ইলিয়াস বলছিল- মিয়াভাই, বিয়া করলে ফোন দিমু, আপনারে আসতেই হইবো।
তার বহু বছর পর আজ ইলিয়াসের সাথে দেখা। সন্ধ্যার একটু পর বেড়ীবাঁধের উপর বসে নদী দেখছি- ঐ তো ওখানে ছিল আমাদের বসতভিটা, আজ তা নদীর পেটে, ইশ! নদী যদি আর না ভাঙতো, যদি নদীর ভাঙ্গন জাপানিদের মতন রোধ করা যেত, গ্রামের জেলেদের একি হাল অবস্থা, এসব হাবিজাবি চিন্তায় যখন সিগারেট টানছি হঠাৎ ইলিয়াস ডাক দেয়..
- কি অবস্থা শফিক ভাই, কেমন আছেন? দেশ গ্রামের কথা ত ভুলেই গেছেন। কবে আইলেন, কই থাকেন এখন। ঢাকাত নাকি অন্য জায়গায়.. আপনার আব্বা আম্মা কেমন আছেন..?? আর এখন....
আমি কথা না বললে হয়তো আরো শ খানেক প্রশ্ন শুনা লাগত। বললাম-
- ইলু ভাই, ভালো আছি, আব্বা-আম্মাও ভালো আছে। কাছে আইসা বসো। কথা বলি, সব বলবো। আগে বলো, তুমি ভালো আছো ত? শুনলাম- বিয়াশাদি করছো।
- হ, ভাই আছি, গরিবের আর ভালো। আপ্নে যে হে গেলেন আর বলছিলেন আবার আসবেন.. বিয়া করছি, আপনারে খবরও দিতে পারি নাই। খুব ইচ্ছা আছিল আমার বিয়েতে আপনারে দাওয়াত দিমু। পারি নাই!!
- আরে ব্যাপার না ইলু ভাই। ত ভাবী কেমন আছে? পরিবার নিয়া নাকি নতুন ঘর বাঁধছো।
- হ, ভাই। ঐ যে ঐডা আমার ঘর। আছে বেক্তে ভালা আছে। পোলা হইছে, নাম রাখছি লালচাঁন। আল্লাহর রহমতে ভালো রাখছে আল্লাহ।
তারপর নানান কথাবার্তায় আমাদের আড্ডা শুরু হয়, আমরা এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নদীর পাড়ে ইলু ভাইর নৌকায় গিয়ে বসলাম। পৃথিবীর সব মানুষের জীবন নিয়ে হয়তো লেখা যাবে এক একটা দীর্ঘ উপন্যাস, কত অদ্ভূত মানুষের জীবন, কত না জীবন চরিত্র পৃথিবীতে ঘুরছে। আমি এই মানুষটার ক্ষুদ্র জীবনের ঘটে যাওয়া অল্প কিছু দারুণ সত্য কাহিনী, সে বলেছে আমি লিখেছি। হয়তো একটা ছোটখাটো গল্পের মতন হয়ে যাবে। ইলু ভাই আপনি বলেন.. আমি লেখা শুরু করলাম-
ভাই, ওরে আমি প্রথম দেখি- আমগো ঘরের পাশে মামাগো ঘর, ওখানে উঠান বলতে বেড়ীবাঁধের ঢ্যালে নারিকেল গাছ তলায়। দেখার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে গেছি, ভাই, তামাম পৃথিবীটা মনে হয় উল্টে গেছে, বুকের ভিত্তে কেমন জানি করতে ছিল। শুধু মনে হইছে মেয়ে মানুষও এতো সুন্দর হয়!! কিছুক্ষণ পর, জেগে দেখি সেও আমার অজ্ঞান হওয়া দেখতে আইছে, আমি চোখ খুলেই তারে দেখলাম। উঠলাম, ভয়ে আমার বুক ধুকপুক করতেছিল, আমি ঘরে গেলাম। একটা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে দেখি, মামাতো বোন আর সে মামাগো পানিফল গাছের নিচে দাঁড়ায় আছে। আমার ভয় লাগতেছিল, যদি মেয়েটারে আমি আর না দেখি- আমি দৌড়ে গেলাম, আমার আসা দেখে সে দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।
আমি মামাতো বোনকে ডাকতে লাগলাম- লিপি, লিপি ও লিপি.. বাহিরে আয়.. লিপি আসলো, বললাম- ওরে ডাক দে, নিয়া আয়, বল যে ভাইয়া, কি কথা বলবে। লিপি চলে গেল, আমি দাঁড়ায় আছি, ভয় লাগতেছে যদি না আসে.. কিছুক্ষণ পর লিপি আসলো, বললাম, কিরে ও কই.?? লিপি বলে, ও আসতে চায় না, আমি বললাম, বল যে, জরুরি কথা বলবে, আসতেই হবে, জাস্ট দুই মিনিটের জন্যে, আর বলবি যে না আসলে আমি মারা যামু।
লিপি চলে গেলো, ভাই, কিছুক্ষণ পর সে আসলো.. আমার যে কেমন লাগতেছিল আপ্নারে কেমনে বুঝায়!!
আমি বুঝতেছি আপনার অবস্থা! তারপর.. কি হল-
আমি খপ করে তাঁর হাত ধরলাম। তারপর বললাম, আমার চোখের দিকে তাকান, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে, হাত ধরেই বলতেছি, ‘আপ্নারে ছাড়া আমি বাঁচুম না’, আমি তার হাত আমার মাথায় দিয়া বলতেছি, বলেন- ‘আমারে ছাইড়া কোথাও যাইবেন না। আপ্নারে আমি সারাজীবনের জন্যে পাইতে চাই’। ভাই, সে এক ঝাটকা দিয়া হাত ছাইড়া ইশ! বলে দৌড় দিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকলো। চোখের পলকে হাওয়া। সেদিন তাঁর এই ভাবে চলে যাওয়াতে আমার প্রচুর রাগ হইছে। আমি কি সব ভাবতে ভাবতে আমগো ঘরের দিক গেলাম।
কিছুসময় পর আমি কি জানি ভেবে লিপির খোঁজে বের হইলাম। ডাকতে লাগলাম লিপিরে। ভাই, মনে এতো রাগ লাগতেছিল যে লিপিরে খুঁজে পাই না, দাঁতে দাঁত রাইখা- লিপির বাচ্চা লিপি কই গেলি!! শেষে দেখি, বেড়ীর উপরে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। আমি ডাক দিলাম, লিপি আসলো-
- কে রে এই মেয়েটা?? তোর সাথে এতো ভাব। তাড়াতাড়ি বল তাড়াতাড়ি বল..
- কেন তোরে কমু কেন?? তুই জেনে কি করবি??
- শুন লিপি, তুই ভাইয়ার কাছে এক জোড়া দুল চাইছিলি না, তোরে কালকেই আইন্না দিমু, বল না, কে এই মেয়ে..
- সত্যি দিবি ত..!! এর আগেও বলছিস দিবি কিন্তু দেস নাই।
- আরে দিমু, দিমু, দিমু। বলছি ত দিমু, তুই বল, কে ও, কোনহানে বাড়ি অগো..??
- আল্লাহ কেমন করতেছে, কইতেছি ত.. ওর নাম ঝুমুর। আমার লগে মাদ্রাসায় পড়ে। বাড়ি মাদ্রাসার পিছনে বেড়ীর উপরে, ঐ যে চুকু মাঝি আছে না হেইতের মাইয়্যা। এবার ক, আমার জন্যে দুল আনবি..?
- তুই এবার কোন ক্লাসে জানি পড়স?? আরে কইছি ত আইন্না দিমু।
- ক্লাস নাইনে উঠছি এবার।
- এখন হুন, ওরে কাইলকাও আমগো বাড়ির এদিকে নিয়া আইবি, বলবি যে কি জানি বলবে ভাইয়া। আমি আজকেই ছবিগঞ্জ হাঁটের তন তোর লাই দুল নিয়া আমু।
- ঠিকাছে, আমি যাই, মা সে কোনসুম থেকে ডাকতেছে।
লিপি দৌড় দিয়া ঘরে ঢুকলো.. আমি জোরে ডাক দিয়া বললাম, মনে কইরা নিয়া আসিস, ঝুমুররে..
মনে হয় একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে- আইচ্ছা।।
ভাই, আমি গিয়া গোসল করলাম। বুঝ হওয়ার পর থেকে আমি দুই এক শুক্রবার ছাড়া জীবনেও নামাজ পড়ি নাই। সেদিন আমি মসজিদে গেলাম, নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে কইলাম, আল্লাহ আমি যেন ওরে (ঝুমুররে) পাই। মাবুদ আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাই না, শুধু ওরে আমার করে দিও। মসজিদ থেকে বের হয়ে ঘরে গেলাম, ভাত খাইতে পারতেছি না, শুয়ে থাকতে পারতেছি না, শরীরডার মধ্যে খালি কেমন জানি করতেছিল, কেমনে বুঝাই ভাই, খালি মনে হইতেছে আমার কি জানি নাই..!!
আমি সিগারেট টান দিয়া তারে দিলাম। বললো, ভাই এখন খামু না, আপ্নে খান। কি বুঝে আবার কইল- দেন, দেন। দিলাম, একটান দিয়ে সিগারেট আমারে দিয়া কইল, হুনেন তারপর কি হইছে.. সেদিন রাতে আমি আর গাঙে যাই নাই, মা কয়- কিরে তোর কি হইছে, গাঙে যে গেলি না। বললাম, কিছু না, একটু খারাপ লাগতেছে, ঠিক হইয়া যাইবো। মা গায়ে হাত দিয়া দেখলো। তারপর চলে গেলো। আমি সারাটা রাত একটু ঘুমাইতে পারি নাই, শুধু ভাবছি কাল কি ও সত্যি আইবো, যদি না আসে.. ভাই এসব ভাবতে ভাবতে আর ঘুম আসে নাই। খালি চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় ওরে দেখি...। সকালে খেয়েধেয়ে মামাগো বাড়ি যাই, ডাকি, লিপি, লিপি ও লিপি। মামানি ঘর থেকে কয়, লিপি মাদ্রাসায় গেছি। আমি বলি, আচ্ছা মামানি, কখন আইবো??
আর কোন সাড়াশব্দ নাই, আমি এর কিছুক্ষণ পর গাঙে গেলাম। ভাই, কি মাছ ধরুম, আমার মন পইড়া রইছে কখন ঘাটে যামু.. লিপি বুঝি মাদ্রাসা থেকে চলে আসলো, এসে যদি না পাইলো!! আমি ঘাটে ভাগী মোল্লারে মাছ বিক্রি করতে দিয়া সোজা বাড়িতে আসলাম। প্রথমে লিপিদের ঘর তারপরই আমাদের ঘর। এসেই লিপি, লিপি ও লিপি। মামানি ডাক দিল, কিরে ইলিয়াস, মাছ পাইছস কয়ডা?? পাইছি চার হালি। লিপি কই মামানি?? লিপি ত মাত্র প্রাইভেটে গেছে।
আমি আমগো ঘরে গেলাম। হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে আব্বার পুরান সাইকেল দিয়া লিপির জন্যে ছবিগঞ্জ থেকে দুল নিয়া আসলাম। দুল নিয়া বেড়ীর উপরে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে আছি, কখন আইবো লিপি, কখন প্রাইভেট শেষ হইবো, ভাই, সময়ই কাটতেছে না, কেমন যে লাগতেছিল, মনে হয় পৃথিবীতে ঘড়ির কাটা আটকায় গেছে.. শেষে অনেক পরে আসরের একটু আগে দেখি লিপি একা একা আইতেছে..আমি দৌড় দিয়া লিপিরে জিগ্যেস করলাম, কিরে, ঝুমুর কই? তোরে না কইছি ওরে নিয়া আসতে...
- ভাইয়া, ঝুমুর আইতে চাইছে। অগো বাড়িতে ঢাকা থেকে ওর বড় দুলাভাই আইছে.. তাই স্যারের তন ছুটি লই আগে আগে চলি গেছে।
- এই ল তোর দুল। তোরে ঝুমুর কিছু কইছে..??
- অনেক সুন্দর। হ, কইছে তুই নাকি হেরে ছাড়া বাঁচবি না। তুই কি সত্যি ওরে ভালোবাসিস ভাইয়া..??
- ওরে লিপিরে তোরে বুঝাইতে পারুম না, আমি ঝুমুররে ছাড়া বাঁচুম না। তুই এখন যা.. ঘরে যা, সন্ধ্যা হয়ে গেছে.. কাইল মাদ্রাসা যাবি না??
- হ যামু ত। এই বলে লিপি ঘরে ঢুকবে, আমি আবার ডাক দিলাম, লিপি শোন, তোর খাতার কাগজে ভাইয়ার ফোন নাম্বার লিখে ঝুমুর রে দিয়া দিস। আর এই ল ওর জন্যেও একজোড়া দুল আনছি..
ভাই, আমি তখন একটা বাটন সেট চালাই। নদীত গিয়া আমার যা ইনকাম হইত তার পুরাটাই আমি খরচ করতাম, মাঝে মইধ্যে আব্বারে কিছু দিতাম আর মার জন্যে পানটান কিনে আনতাম। তখন বিড়ি সিগারেট কিচ্ছু খাই না। ভাই, রাইত ত শেষ হয় না, কখন লিপি যাইবো, ফোন নাম্বার দিবো, এসব চিন্তায় ঘুম আইয়ে না। তারপর কোনসুম যে আব্বা ডাক দিল, গাঙে যাইতে, গাঙে গেলাম.. গাঙ থেকে আইলাম দুপুরে.. এখন লিপি ত মাদ্রাসায়, আইবো আসরের সময়। ঘরে গিয়া ঘুমায় পরলাম।
ঘুম থেকে উঠছি সন্ধ্যার সময়। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে আমি ফোন দেখি, যে কোন ফোন আইছে কিনা। কই, কোন ফোন ত আসে নাই। আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে লিপি নাম্বার দেয় নাই, নাকি দিতে ভুলে গেছে বোধহয়। আমি তাড়াতাড়ি ওঠে মুখ না ধুয়েই মামাগো ঘরে গেলাম, দেখি- লিপি পড়তেছে.. আমি লিপির পাশে বসলাম, বললাম, কিরে নাম্বার দিসত নি? লিপি বলে- দিসি ত। ফোন দেয় নাই?? আমি কইলাম, কই না ত কোন ফোন টোন আসে নাই।
ভাই, ফোনটা বাজলেই এই বুঝি ঝুমুর ফোন দিছে। যখন দেখতাম না, এটা ঝুমুর না, মেজাজটা যা গরম হইত। আর কথাই বলতে ইচ্ছা হইত না। কি যে করি ঝুমুর কেন ফোন দিতেছে না, ভাবছি, ও ত পারে, ঘরের একটা ফোন থেকে একটু ফোন দিতে। আবার ভাবি, হয়তো ভয়ে ফোন দিতেছে না। এই বলে নিজেরে সান্ত¡না দিতেছি.. আর সারা দিন রাইত শুধু চোখের উপর ঝুমুররে দেখি, ভাই ওরে না পাইলে বোধহয় আমি মরা মানুষ এই রকম অবস্থা আমার।
এইরকম করে বিশাল এক অস্থিরতার মধ্যে আমার দিন কাটতেছে, দুইদিন কি তিনদিন লিপির কাছে ওর কথা শুনতেছি, কি কি বললো, ও নাকি শুধু, আমি কেমন আছি এই কথা জিজ্ঞেস করতো। আর আমি লিপিরে সবসময় বলতাম, ওরে আমগো এদিকে আসতে বলিস, আর বলিস আমি কেমন আছি নিজের চোখে দেইখা যাইতে। আমি দুইদিন ঝুমুর গো বাড়ির ঐদিকে গেছিলাম, কিন্তু ঝুমুরের দেখা পাই নাই। তারপর দুইদিনের জন্যে আমরা পুবের গাঙে গেছি মাছ ধরতে, ভাই, দিন গুলো যে কেমনে কাটাইছি আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে। পরে যেদিন আইছি দুপুরে, সাইকেল দিয়া মাদ্রাসায় গেছি, যাইয়া দেখি ছুটি হয়ে গেছে, পরে আসার পথে লিপির কাছ থেকে শুনি, ও নাকি দুইদিন যাবৎ মাদ্রাসায় আসে না। ভাই, হঠাৎ কি যে একটা খারাপ লাগা আমার ভিতরে শুরু হইলো, আমি ভাবলাম কোন অসুখ টসুক হইলো নাকি। আমি লিপিরে বললাম, লিপি তুই যা, ওর বাসায় যা.. হ, এখনই যা, আর এই ধর তিনশ টাকা, কিছু বিস্কুট টিস্কুট কিনে নিয়া যাইস।
সন্ধ্যার সময় ঘর থেকে বের হইছি। দেখি ঝুমুর আর লিপি আমগো বাড়ির দিকে আসতেছে.. আমি দৌড়ে গেলাম, বললাম, লিপি তুই ঘরে যা..
- আসসামুলাইকুম। কেমন আছেন..??
- আমি যে কেমন আছি, কেমনে বুঝাই তোমারে, রাইতে দিনে ঘুম আইয়ে না, নদীতে, ঘরে কোন জায়গায় মন টিকে না। শুধু তোমার কথা মনে আইয়ে.. তুই কেমন আছো, ঝুমুর??
- আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। ওমা! কি কন এগুলা।
- হাছা কইতাছি ঝুমুর, তোমারে ছাড়া আমি বাঁচুম না। আমার জান প্রাণ সব তুমি। মনডা চায় সারাক্ষণ তোমারে নিয়া থাকি।
- হাছা নি.? কয়দিন পর ত ভুলি যাবেন!!
- আস্তাগফিরুল্লাহ। কি কও এগুলা, আল্লাহ না শুনুক। লিপি তোমারে ফোন নাম্বার দিছে..??
- হ, দিছে, কিন্তু ভাবীর ফোন থেকে ফোন দিতে পারি নাই ডরে..
- এই লও, এই ফোন আজ থেকে তোমার। আমি নতুন একটা সিম কিনে লিপির কাছে দিমু। আর আমি বাজারে গিয়া নতুন ফোন কিনে নিমু।
- আইচ্ছা, ঠিকাছে, এখন যাই, ম্যালা রাইত হইছে।
- তুমি কি আজকে লিপিগো বাড়িত থাকবা..?
- হ, থাকমু।
- ঠিকাছে যাও। রাতে দেখা করবো...
এই কথা বলার আগেই ঝুমুর নাই, কি সাত পাঁচ ভেবে আর রাতে দেখা করতে যাই নাই। কখন যে ঝুমুর আমগো এদিক থেকে চলে গেছে নিজেও জানি না।
ভাই, সেদিনের মতন খুশি আমি আমার জীবনেও হই নাই। ঘুম থেকে ওঠেই বাজারে গেছি, ষোলশ টাকা দিয়া একটা নতুন ফোন আর একটা গ্রামীণ সিম কিনে আনছি। সারাদিনে মনে হয় হাজার বার ফোন দিছি, সন্ধ্যার একটু পর ফোন রিসিভ করছে, সেই প্রথম পাঁচ মিনিটের মতন কথা হইছে। ভাই, তারপর থেকে এই ফোনের পিছনে যে আমি কত টাকা খরচ করছি তার কোন হিসাব নাই। দোকানদার দুলাল ঐ যে কাটাখালীর ফ্লেক্সিলোড, ওরে বলে রাখছি- যখনই লোড লাগবে সাথে সাথে লোড দিতে, যত টাকাই হয় আমি দিনকে দিন পরিশোধ করে দিবো।
তারপর থেকে আমার ফোনে কথা কওয়া শুরু, একটু পর পর ফোন দেখতাম ইশ! কখন ঝুমুর মিস কল দিবে, কখন তার সময় হবে। ভাই, এই রকম চুরি করে কথা বলতে বলতে একদিন, ঝুমুর ওর ভাবীর কাছে ধরা পড়ে। আমি ওরে বললাম, তুমি তোমার ভাবীরে সব খুলে বলো। ও ভাবীরে সব বলছে, মিছা কথা কমু না ভাই, ওর ভাবী যথেষ্ট হেল্প করছে। তারপর থেকে আমাদের কথা বলা আরো বেড়ে গেছে.. খালি মনডা চাইত কখন ঝুমুররে কাছে পামু, একটু আদর করমু।
কত কথা যে ফোনে বলতাম, ভাই, আল্লাহ জানে এতো কথা কই থেকে নাযিল হইত। আমি ওরে নিয়া ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম, বলতাম, বেড়ীর উপরে আমাগো ঘরের পাশে আমাদের একটা নতুন ঘর হইবো, আর একটা নৌকা করবো, দেইখো- দুজনে কত সুখে থাকবো। ও শুধু বলতো, আল্লাহ, তাই যেন হয়।
ভাই আমি যেমন কইরা কইতাছি, আপ্নের তেমন কইরা লেখতে হইবো না, আপ্নে আপনার মন মতন সাজাই সাজাই সুন্দর করে লেখবেন।
একবার বলতে চাইছিলাম- ভাই, আমি ত লিখতেই জানি না, তারপর গুছিয়ে আবার সুন্দর করে কেমনে লিখবো!! তাও কোথাও কোথাও আঞ্চলিক আর বইয়ের ভাষায় গুরুচন্ডালী হয়ে যাচ্ছে।
তারপরও লিখছি, ইলু ভাই, আপনি বলেন...
২.
পরের কথা আর কইতে ভালো লাগতেছে না ভাই। আরেকটা সিগারেট ধরান। আমি সিগারেট ধরাই, এক টান দিয়া, ইলু ভাইরে দিলাম।
মনে মনে ভাবছি, ইলু ভাই যদি আর না বলে, আমি পাঠক রে কি বুঝ দিমু..!! এই পর্যন্ত শেষ.. পাঠক তো তা মেনে নিবে না। গল্পের শেষ চাইবে..
হঠাৎ ইলু ভাই বলে উঠলো...
ভাই, তারপরে আর কি কমু!! আমি ওর জন্যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম, এই জীবনে বহু কিছু আমি ওরে দিছি, শুধু এই পোড়া কলিজাডা খুলে দিতে পারি নাই, যদি দেওয়া যাইত, তা ও দিয়া দিতাম। ইলু ভাই দেখাইলো, বুকে আর হাতে এসিড দিয়া পুইড়া ‘ঊ+ঔ’ লিখছে। বললাম, ভাই কেমনে সম্ভব!! ভাই হাসে আর কয়, একটুও কষ্ট হয় নাই। বলে, আমি জানতাম, ও আমারে মন থেকে ভালোবাসছে.. আমিও ওরে প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবেসে ফেলছিলাম। তার কারণেই সব পারছি ভাই, আরো যে কত কি করছি, এতোকিছু আপনারে না কই, আপনার লিখতে কষ্ট হইবো।
আমি বললাম, আরে না, ইলু ভাই, আপনি বলেন.. সব লেখা হয়ে যাচ্ছে..তারপর কি হইলো, বলেন না, শুনি...
তারপর আর কি কমু ভাই। আমি দেখলাম ইলু ভাই তারপরের কাহিনী আর বলতে চাইতেছে না, জোর করবো? না। করলাম না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সিগারেটে টান দিয়া নদীর পানিতে ফেললো ফুস করে একটা শব্দ হলো। তারপর বললো ভাই, শুনেন..
- হ্যা, আমি শুনতেছি... আপনি বলেন..
এরপর ঝুমুর অনেক বার লিপিগো বাড়িত আইছে, আমি ওরে নিয়া মাঝ রাইতে নৌকার ভিতর শুইয়া ছিলাম অনেক রাইত শুধু আমি আর ঝুমুর, ভাই নদীর নৌকা আর নোনতা এই গাঙের পানি সাক্ষী .. এই ত, এই যে এখানে এই নৌকায় সারারাত আমরা নদীতে ভাসতাম, যদিও এসব কিছুর পিছনে লিপি যথেষ্ট হেল্প করেছে, ওর কারণেই সম্ভব হইছে।
ভাই, সত্য কইতাছি ঝুমুরের সাথে আমার সব হইছে.. বুঝছেন ত..?
- হ্যা, আমি বুঝছি, আপনি বলেন...
তারপর একদিন হুনি আমার বিয়া ঠিক হইছে। কবে, কই, কার সাথে কিচ্ছু জানি না। আমি মনে হয় আকাশ থেকে পড়লাম, আমার বিয়া আমারই খোঁজই নাই.. অথচ মেয়ে দেখাও নাকি হয়ে গেছে.. ঐদিনই আমি ঝুমুররে সব বলছি, ঠিক করলাম, আমরা পালিয়ে কোথাও চলে যাবো। ঝুমুর বলছিল, তুমি আমারে যেখানে নিয়া যাবা আমি সেখানে যাইতে রাজি এবং সবসময় এক পায়ে রেডি আছি।
আমি ওর কথা শুনে, হাসলাম।
ভাই, ভুলডা আমারই হইছে, আমি ঐদিন ঘরে শুয়ে শুয়ে কথা বলছিলাম, মনে হয় আব্বা হুনছে..
রাতে কথাটথা শেষ করে কখন যে ঘুমাইছি, ঘুম থেকে ওঠে দেখি আমার হাত পা সব চকির সাথে বাঁধা। পাশে ফোনও নাই..(পরে হুনছি ফোন নাকি আব্বা ভাইঙ্গা গুরা গুরা করে পানিতে ফালাইছে।) আব্বা বেড়ীর উপর থেকে চিল্লাইয়া কয়, ওর বান্ধন কেউ খুলবি না। যে খুলবি ওর কল্লা কাডি হালামু। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কাল রাতে ত ঝুমুররে বলছি আজকে বিকেলে লঞ্চ ঘাট থাকতে আমরা ঢাকায় চলে যামু। এখন কেমনে কি!! কিচ্ছু না বুঝেই আমি চোখ বুজে মারে ডাকলাম, সব ঘটনা খুলে বললাম।
-মা কয়, এই সম্পর্ক তোর বাপ জীবনেও মেনে নিবে না, হয় তোরে কাইট্টা নদীত ভাসাই দিবে।
- আমি কইলাম, তাহলে তাই করো, কাইট্টা কও নদীতে ভাসাই দিতে, মা খালি কাঁদতেছিল..
বললাম, ঝুমুর রে না পাইলে এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ। ভাই, এই কথা শেষ হইতে না হইতেই আব্বা বেড়ীর ঢ্যালে বেগুন ক্ষেত নিড়ানি দিতেছিল, ঐ কোদাল দিয়েই আমার মাথায় এক বাড়ি। তারপর মনে হয় আমি মরা গেছি, আমার কোন হুশ নাই..
(পরে জানছি, আমি যখন মায়ের পেটে তখন একবার গাঙে চুকু মাঝি নাকি আমগো জাল কাইট্টা নিয়া গেছে। এই নিয়া অনেক ঝামেলা হইছে, এলাকায় বিচার সালিশ শেষে থানা হাজত পরে নাকি মামলা মোকদ্দমাও হইছে। চুকু মাঝি নাকি কুড়াল নিয়া আব্বারে মারতেও আইছিল। ঘুস দিয়া আব্বারে জেলে পাঠাইছে... আমার জন্মের পরও ঘরে প্রচুর অভাব ছিল, এক বেলা খাইতে পারছি কি পারি নাই, মানষের বাড়িত গিয়া ভাতের ফেন খুঁজে খুঁজে মা আমগো সংসার চালাইছে..)
যেদিন আমার হুশ হইছে, মনে পড়ছে (ঝুমুররে যে বলছি) বিকেলে লঞ্চঘাটে যাইতে আমরা ঢাকা যামু। এর পর দেখি আমগো ঘরে লিপি, ভাই, আমার মামাতো বোন লিপি এখন আমার বিয়া করা বউ। আমি নাকি এই মুখ দিয়া কবুল বলে বিয়া করছি, খাতায় সই করছি। ভাই, বিশ্বাস করেন আমার মাথায় তখন কোন সেন্স ছিল না। আমি অন্য দুনিয়ার বাসিন্দা ছিলাম। তারপর, আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করতে পারি নাই। আমাদের নাকি বাসারও হইছে। শুধু মায়ের মুখের দিক চাইয়া আমি আর কিচ্ছু করি নাই। ত ভাই, মাঝে মাঝে মনে চায়, এই জীবন রাইখ্যা কি লাভ। এই যে দেখতেছেন বাঁইচা আছি, বিশ্বাস করেন ভাই, আসলেই আমি বাঁইচা নাই, যেদিন হুশ হইছে (ঝুমুরের কথা মনে পড়ছে) ঐ দিন থেকেই আমি মরা। জীবনেও ভাবি নাই, আমার জীবনডা এই রকম হইব। ভাই, বেশি স্বপ্ন দেখছি ত..
- ইলু ভাই, আসলে কি দিয়া আর কি বলে আমি আপনারে সান্ত¡না দিবো, আমি আসলেই বুঝতেছি না।
- আরে না, ভাই, ঠিক আছি। তো দেশের অবস্থাটা একটু ভালো হইলে আর গাঙে একটু মাছ পড়লে দুইচোখ যেদিকে যায়, সব ছাড়ি সেদিকেই চলি যামু.. মামতো বোন লিপিরে দেখলেই আমার কেমন জানি লাগে, ভাই। আর ভাল লাগে না, পোলাডার দিকে চাইয়া এখনও রইছি..
- আমি বললাম, ঝুমুরের সাথে কথা হয়নি আর??
- ভাই, আপনি নিজেই কন, কোন মুখে আমি ওর সাথে কথা কই! না, আর কথা হয়নি। ত, হুনছি খুবই ভালো জায়গায় ওর বিয়া হইছে। এখন চর জহিরউদ্দিন থাকে। স্বামীর বেশ ভালোই জায়গাজমি আছে, গরু মহিষ আছে, নৌকা আছে, ও আছে, হয়তো সুখেই আছে।
- আমি কি বলবো, বলার মতন কোন কথা খুঁজে পেলাম না। শুধু মনে মনে ভাবলাম- আসলেই সত্য, এই রকমই হয় মানুষের জীবন। মানুষ নিত্য ভালো থাকার অভিনয় করে আর এই ভালো থাকতে থাকতে এইভাবেই হয়তো কেটে যায় মানুষ জীবন
- ভাই, বাদ দেন এসব। এই লন সিগারেট লন। চলেন, আপনারে নিয়া আজকে গাঙে যামু..।
- আমি বললাম চলেন, যাই....।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রেম বুঝিনি বলে...
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
প্রেম বুঝিনি বলে...
যাকারিয়া মুহাম্মদ
রোকসানার সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল ঠিক। তবে সেটা আদৌ প্রেমের সম্পর্ক কি-না, ঢের আলাপ আছে। অবশ্য ঝকঝকে একটা প্রেমের গল্প আমাদের হতে পারত। সে সুযোগ ছিল। যেখানে রোদ থাকত, মেঘ থাকত, আলো-আধারের খেলা থাকত।
আমাকে সে-ই প্রথমে প্রেমের প্ররোচনা দিয়েছিল। আমি তখন নতুন কিশোর। প্রেম নিয়ে ভয়-কৌতুলহ দুই-ই কাজ করত একসাথে বুকের ভেতর। সে সুযোগ পেলেই আমার আশপাশ ঘুরঘুর করত, অকারণ। চুপেচুপে আমাকে দেখত। এবং জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত আমার আসা-যাওয়া পথের দিকে। আসলে সে কী চাইত, তখন ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে পারত না অপরিণত বয়স আমার।
একদিন জানালা দিয়ে আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল সে, সে জানালা কাঠের বানানো ছিল, কোনো শিক ছিল না তাতে, তাই মাথা বের করা যেত কী এক কারণে পেছন ফিরে তাকাতেই তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলি। তখন থেকে আমি অন্যরকম কিছু অনুভব করতে থাকি। এক তুমুল ঝড় যেন আমাকে এলোমেলো করে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে প্রেম বুঝতে শুরু করি। নিজের চেহারা, স্বাস্থ্য, জামাকাপড় ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ওঠি।
একদিন তার আশকারা পেয়ে দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে চাচির কাছে ‘ধরা খাই’। এটা আমাদের সম্পর্কের প্রথম বাধা। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, যেন একটা ফুল ফুটবার আগেই ঝরে যেতে থাকে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। যে-কারণে দীর্ঘ দিন দূরে থাকি, তার থেকে।
এর অনেকদিন পর দ্বিতীয়বার একইভাবে ‘ধরা খাই’ আম্মার কাছে। ফলত এপথে আর একটুও এগোনো হয়নি আমার। বরফে ধাক্কা খাওয়া টাইটানিকের মতো আমার জমানো প্রেম, খুচরো স্বপ্ন সবকিছু ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এবার এতবেশি ভয় পাই যে, আমার মনে কোনোদিন আর প্রেমের দখল চলেনি। তখন থেকে প্রেম জড়সড় হয়ে বুকের কোনো এক কোনায় বসে থাকে, এখনো যা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
এরপর আমি পাল্টে যেতে থাকি। যে-প্রেম শুরুর আগে এত প্রতিবন্ধকতা সামনে তার কী হবে, ভেবে শঙ্কিত হই। আর কোনোদিন প্রেমের চিন্তা মাথায় না-আনবার শপথ করি। অবশ্য পরে আরো বছর খানেক সময় রোকসানা ‘চেষ্টা’ করেছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। আমার কিশোর মনের শপথকে একটুও টলাতে পারেনি তার কিশোরী মনের আহ্বান।
এখন যখন রোকসানার বিয়ে হয়ে গেছে। ভাবি, তখন যদি আরেকটু সাহসী হতাম! গল্পটা অন্যরকম হতো হয়তো।
ছাতক, সুনামগঞ্জ
পদাবলি : ০১
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
মায়াবিনী
তামীম আল আদনান
আমাদের দেখা হলো
দুজনের চোখে থমকে গেলো সময়
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিলে একাকার হয়ে গেলো উত্তরের বাতাস।
তুমি চলে গেলে;
অথচ কথা বলার তীব্র পিপাসা নিয়ে আমি অনন্তকাল দাড়িয়ে আছি
এ-ই পথের দূর্বাঘাস, হলুদ পাখি, সোনালুফুল- সবাই এখন আমার ভীষণ পরিচিত।
কেবল অপিরিচিত্তের নোটিশ দিয়ে চলে গেলো একজোড়া মায়াবিনী চোখ।
পরম সুন্দর
নবী হোসেন নবীন
একটি সুন্দর বৃত্ত হতে আরও সুন্দর
আর একটি বৃত্ত আঁকা যায় না।
একটি গোলাপ হতে অধিক কোমল
আর একটি গোলাপ বৃন্তে ফুটে না।
চাঁদের স্নিগ্ধতা ছুঁয়েছে যে
সেই বোঝে জোছনা কতটা নরম।
আকাশের নীলিমা হতে অধিক নীলিম
আর কী আছে পরম?
চোখের জানালায় মনান্তরে দেখেছে যে
মনের আয়না
সেই বোঝে নদীর সুরতে নারী হতে সুন্দর
আর কিছু হয় না।
বৈষম্য
হুসাইন আহমদ
অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোমাকে পড়ছি
তুমি মূলত কী?
তোমার আদি উৎস কোন গহনে?
সহিফা কিংবা ক্বাদিম কিতাবের
পাতা ত নও বে শক
একটা স্থিতিশীল ঘোরের নাম দেই
প্রগলভতা
তারপর ছায়া ছুঁই
পালক ভেজা রাতে ভিষণরকম মায়া ছুঁই
অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোমাকে পড়ছি
মেয়ে চোখ মেলো, দ্যাখো-
পোড়াবসন্তে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় পীতাভ বর্ণের ঢেউ
আমাকে চিনেছে
পারভেজ হুসেন তালুকদার
আমাকে চিনেছে তটিনীর জল কলকলে ছুটা ঢেউ
চিনেছে সাগর চিনেছে পাহাড় তোমাদের কেউ কেউ
জীবন জেনেছে এই হৃদে জুড়ে কতটা স্বাধীন বেগ
আমাকে চিনেছে পাহাড়-চূড়ায় ভেসে থাকা সাদা মেঘ।
আফসোস নেই ক্ষুদে এই মনে তবুও অচেনা আমি
আকাশের কাছে চেনা এই মন নীলেদের মত দামি
আমি অচেনার দলে মিশে থাকি যারা চিনে চিনবার
নিশ্চিত যারা চিনে এই হাসি তারা প্রেমী কবিতার।
যুথীকে মিস করি
সৈয়দ নূরুল আলম
আয় বৃষ্টি আয়, আকাশ ভেঙে যখন-তখন
কুয়া-ডোবা শুকিয়ে আছে,
তৃষ্ণায় ছটফট।
উদাস মন উদাসী, ভিজতে চায় খামখেয়ালি
বন্ধুর খোঁজে বন্ধু আসবে জোসনা ভরা রাতে
বৃষ্টি হলে ধুয়ে মুছে যাবে
তোমার যত অহংকার।
তুমি আর, সেই তুমি নেই।
খুব মিস করি তোমাকে।
শূন্যতা
স্বপন গায়েন
হৃদয় তট শূন্য মরুভূমি
শিউলি ফুল, কাশের দোলা
সব আঁধার কেটে যায় তোমার আগমনে।
শিশির বিন্দুর অলীক স্পর্শে জেগে ওঠে ভোর
আলোর মিছিল শহর থেকে গ্রাম-
সব শূন্যতা কেটে যায় এক লহমায়।
মরা মানুষ বেঁচে ওঠে তোমার পদধ্বনির শব্দে
হৃদয়ের উপকূল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়
কিন্তু সে তো ক্ষণস্থায়ী।
সারা বছরের জমা কান্না কাব্য হয়ে যায়
শূন্যতা থেকে মুক্তি নেই মানুষের
তবুও তুমি আসবে বলে প্রহর গুনি প্রতিদিন।
পদাবলি : ০২
অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
রূপালী ইলিশের উপকথা
দীপঙ্কর ইমন
মাঝ পথে কথা থেমে যাবে সব
এমন কি অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠে স্বপ্ন দেখার বৈদিক তিথী।
রূপালী ইলিশ; চোখ বন্ধ করবে কি?
সমুদ্রে ধরেছে ফাঁটল... জল শুঁকাবার অপেক্ষায় আহত ঈশ্বর।
আবার মাছরাঙা খেয়ে নিবে ইলিশের সুস্বাদু দেহ
নিরব মৎস বিভাগ
ঝুলবে মুখস্ত তালা, দায়সাড়া মনিহারি।
আবার সব কথা থেমে যাবে
মাছরাঙার রাজত্বে ইলিশের চোখ বুঁজে যাবে
স্বয়ংক্রিয়।
পূর্ণিমার জোৎস্নারা আবারও ধর্ষিত হবে
বারোমাসি আমাবশ্যায়।
জীবনের আলপনা
এ বি ছিদ্দিক
ঠিক বিষুব রেখা বরাবর দাঁড়িয়ে
নৈমিত্তিক মুদ্রার পরিপাকতন্ত্র পরখ করি!
কাঁধে গার্হস্থ জোয়াল...
একটু আগপাছ হলেই দর্শনীয় যাদুঘর!
হলদে রঙের শাড়িতে ঝিঙে ফুলের রঙ
উপভোগ করার সময় থাকবে না এতটুকু!
চিরহরিৎ বৃক্ষ যেমন ঠায় দাঁড়িয়ে
তুগলকী ইতিহাস বিদ্যার পাঠ দেয়
ঠিক তেমনি নীল বাতিঘরে রান্না হয় সাত নম্বর ডাল!
প্রশস্ত বুকের জমিনে এঁকে যাই জীবনের আলপনা।
ভালোবাসা রঙিন, ভালোবাসা ধূসর!
তাওহিদ ইসলাম
ভালোবাসা রঙিন। অনবদ্য। প্রাণময়।
বেঁচে থাকার কারণ।
হাজারটা স্বপ্নের পর বিনম্র মিলন। ইচ্ছেদের অপ্রাপ্তির আধাঁর মুক্ত।
কখনো বা ধূসর!
ধূসরিত মলিন। অনাপ্রাপ্তির সুখ।
অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস মৃত্যু অব্দি।
অপূর্ণতার সাক্ষী।
অপেক্ষা, কান্না, আক্ষেপ বেলা ফুরিয়ে যাবার সাথে বয়স বৃদ্ধি।
শারিরীক প্রত্যাবর্তন। পাল্টে যাওয়া সব। পৃথিবীর রঙ। তবুও পুড়তে থাকা।
পিছুটান হয়ে ভুলতে না পারা।
স্মৃতির আদলে ভুলে যাওয়া মানুষটিকে সযতেœ আগলে রাখা।
একটু অদ্ভুত!
এই গল্পখানা ভালোবাসা।
ভালো সবাই বাসে। বাসতে চায়।
মনের ক্যানভাসের এক কোণে আগলে রেখে দিতে চায়।
আজন্মকাল। কেউ পেয়ে ধন্য হয়। পবিত্র বন্ধনে রবের দুয়ারে মাথা নত করে।
আবার কেউ?
ধূসরিত আক্ষেপে যাতনার সাগড়ে ডুবুরি হয়। মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে স্মৃতি চারণ।
কান্নার জলে নির্বিকার চিৎকার!
আহা!
ভালোবাসা দয়াহীন। কি নির্মম!
অতএব। এক জীবনে রব বিনে কাউকে ভালোবাসতে নেই। দুঃখজলে ডুবুরি হতে নেই।
কাফনে মোড়া জীবন
সুশান্ত হালদার
ঈগল থাবায় জীবন
তিন টেক্কায় জুয়াড়ি রেখেছে হাত
ভবঘুরে জীবন মেপেই চলে পথ
অথচ সময়ের হাত ধরে
ঈশ্বরকে ভ্রুকুটি করে চলে এক বদ্ধ উন্মাদ
চৈতন্য বোধে
যাদের কেটে যায় জীবন নির্দ্ধিধায়
পুকুর ভর্তি জলে তাদের কিইবা আসে যায়?
নদী প্রেম আচ্ছন্নতায় জীবন তুচ্ছ মনে হয়
অথচ পাতাঝরা রাত্রির কান্নায়
জেগে উঠে ফিলিস্তিন ইসরায়েল হামলায়
ঋষি বেশ
হাতে বজ্র চিহ্নিত তাসখন্দের আকাশ
মরুঝড়
হুঙ্কারিত বাংলাদেশের অবরুদ্ধ বাতাস
বুকে কুরুক্ষেত্র
সারাদেহে হিংস্র ব্যাধের ক্ষতবিক্ষত শরাঘাত
তবুও কাফন মোড়া জীবন আমার
দ্রোহে নজরুল
প্রেমে হাফিজ
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা উত্তর ‘বাংলাদেশ’!
আমেরিকান কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
আমেরিকান কবি
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
অনুবাদ : আকিব শিকদার
পরিচিতি
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ১৯৪২ সালের ২২ এপ্রিল নিউ ইয়র্ক সিটিতে জন্ম গ্রহন করেন। বাবা ড্যানিয়েল গ্লিক, আর মা বিয়েট্রিস গ্লিক।
তাঁর কবিতা অন্ত-কথন ধর্মী। মনেহয় যেন তিনি সরাসরি পাঠকের মুখোমুখি বসে পাঠকের সাথে কথা বলছেন। তাঁর কবিতায় আছে আত্ম-জিজ্ঞাসা, মানসিক সংঘাত, মৃত্যু, আকাক্সক্ষা ও প্রকৃতি প্রেম। তিনি দুঃখ ও একাকীত্বকে প্রকাশ করেছেন খোলামেলা-ভাবে। গ্রীক ও রোমান মিথোলজী আছে তাঁর কবিতায়।
লুইস গ্লিক সমসাময়িক কবিদের মধ্যে অন্যতম শুদ্ধ ও সফল গীতিকবি। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ফার্টসবর্ন’ বের হয় ১৯৬৮তে। ১৯৯৩ তে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে তিনি ১২তম সম্মানিত মার্কিন পোয়েট লরেট মনোনীত হন। কবিতার জন্য নোবেল পান ২০২০ সালে। তার কবিতাকে সরল ও সৌন্দর্যময় সুস্পষ্ট কাব্যিক কণ্ঠস্বর বলে আখ্যা দিয়েছে নোবেল কমিটি।
স্মৃতি
একটা অসুখ আমাকে ধরেছিলো
কী কারণে তা কেউ বলতে পারেনি।
যদিও দিনে দিনে জটিলতর হতে থাকলো রোগটা।
কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো স্বাভাবিক চলাফেরার অভিনয়, যে ভাবে
বুঝাবো সবাইকে ভাল আছি, আনন্দময় যাপিত জীবন...
পরবর্তী মুহূর্তগুলো এমন হলো যে, আমি শুধু
তাদের সংশ্রব চাইতাম যারা অবিকল আমারই মত;
খুব খেটে খুটে তাদের খুঁজে বের করতাম,
সহজসাধ্য ছিল না কাজটা।
তারা সবাই ছিলো আড়ালে, অচেনার আঁচল টেনে।
অবশেষে কিছু সহচর পেয়েছিলাম খুঁজে
যাদের সঙ্গে সময়ে-সময়ে আমি হাঁটতাম।
নদীর তীর ঘেসে একেক জনের সাথে, অকপটে আবার
কথোপকথন শুরু হলো, যা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম...
প্রায়ই আমরা থাকতাম নির্বাক। যা কিছু বলি না কেন
সব কথা ফেলে নদীটার কথা বলতে বেশী ভাল লাগতো...
নদীটির দুই কূলে লম্বা জলছোঁয়া তৃণলতা কেঁপে ওঠে
প্রশান্তিময় তরঙ্গের মতো শরতের সমিরনে।
আর মনে হত এই পরিবেশটা আমার আশৈশব চেনা।
যদিও আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে কোন নদী ছিল না,
শুধুমাত্র গৃহ আর আঙ্গিনা।
হয়তো তাই প্রত্যাবর্তণ করছিলাম আমি সেই সময়ে
যে সময় আমার শৈশবের পূর্ববর্তী,
হতে পারে বিস্মৃতির অতলে ঢাকা
এই সেই নদী যার কথা আমার স্মরণে আসে।
তৃষ্ণার্ত পাখি
পাখিটি আসে খুব প্রভাতে।
ডাকে এমন করুণ স্বরে, যেন তার
আপন জনের মৃত্যু হয়েছে।
অথচ কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই
তার সঙ্গী পাখিটি ফিরে আসে হন্তদন্তের মতো।
আমার হৃদয় একটি তৃষ্ণার্ত পাখি, যে প্রতিনিয়ত
ডাকছে প্রিয়ার নাম।
অথচ আমার প্রিয়া কোনোদিন
রাখে না তার পা আমার আঙিনায়।