একজন কানাডিয়ান কবি
উইলিয়াম ব্লিস কারম্যান
একজন কানাডিয়ান কবি
ভাষান্তর : আকিব শিকদার
উইলিয়াম ব্লিস কারম্যান একজন কানাডিয়ান কবি। তিনি ১৫ এপ্রিল, ১৮৬১ সালে কানাডার নিউ ব্রান্সউইকের ফ্রেডেরিকটনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তিনি ছিলেন একজন কানাডিয়ান সামুদ্রিক প্রদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের আঞ্চলিক কবি।
ব্লিস কারম্যান ফ্রেডেরিকটন কলেজিয়েট এবং নিউ ব্রান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি ১৮৯০ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে যান এবং দুই দশক ধরে বিভিন্ন জার্নালে সম্পাদকীয় কাজ করে জীবিকা অর্জন করেন।
তিনি প্রায় ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, ৩টি নাটক, ৮টি গদ্য সংকলন ও বেশ কয়েকটি অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেন। ব্লিস কারম্যান মর্মস্পর্শী প্রেমের কবিতা এবং প্রকৃতি নির্ভর কবিতার জন্য স্মরণীয়। তিনি প্রকৃতি, শিল্প এবং মানব ব্যক্তিত্বের উপর বেশ কিছু গদ্যও লিখেছেন।
১৯০৬ সালে ব্লিস কারম্যান ইউএনবি এবং ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি ১৯২৫ সালে কানাডার রয়্যাল সোসাইটির সংশ্লিষ্ট ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে ইউএনবি ক্যাম্পাসে স্থাপিত একটি ভাস্কর্য দ্বারা কারম্যানকে সম্মানিত করা হয়। ফ্রেডেরিকটনে “নিউ ব্রান্সউইকের ব্লিস কারম্যান মিডল স্কুল” এবং টরন্টোতে “অন্টারিওর ব্লিস কারম্যান সিনিয়র পাবলিক স্কুল” তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
০৮ জুন ১৯২৯ সালে ৬৮ বছর বয়সে ব্লিস কারম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান।
গ্রীষ্মের ঝড়
ঝড়ো বাতাসের আনাগোনায়
পাহাড় চূড়ায় বৃক্ষগুলো অবনত,
অনুচ্চ, ধূসর মেঘ ভিড় বাধে
বরষার অস্ত্রপাতি নিয়ে
মহড়ায় ব্যস্ত যুদ্ধ-বিমানের মতো।
নাকাড়া-বাদক বাতাস সঙ্কেত দিলে
এগিয়ে আসে মেঘ, দাগে অদৃশ্য কামান
গাভীগুলো দাঁড়ায় পাশাপাশি, ভয়ে উচাটন,
রাখাল ছুটে ঘরমুখে,
প্রথম বজ্রটি পড়ে জানালা ভাঙে।
কামান দাগায় শান্ত ফলের বাগানে,
মুহূর্তে তছনছ নাশপাতি ফল;
উপত্যকা ছিড়ে খুড়ে ঝড় ছুটে আসে,
আলেড়িত হয় পুকুরের কালো জল,
তারপরই রোদ এসে করে সব দখল।
প্রথম কম্পন
তার স্পর্শে প্রথম কেপে উঠেছিলাম আমি
যেন এক প্রকা- কাসার থালায়
কেউ সজোরে করেছে আঘাত।
সে কম্পন আজও স্পন্দিত হয় হৃদয়ে আমার
কিশোরী মেয়ের কানের দোল
যেমন কাপে মাটিতে পা ফেলার তালে তালে।
এই অনুভূতি রক্তশিরায় থাকবে আমার
যতদিন পৃথিবীতে সূর্য ছড়াবে আলো।
গয়নার নৌকা
গয়নার নৌকা
শফিক নহোর
অপ্র্যতাশিত ভাবে মুন্নির সঙ্গে আমার ফিজিক্যাল রিলিশিনশিপ গড়ে ওঠে। তার থেকে মুন্নি আমাকে খুন করার জন্য লোক ভাড়া করে। আমি ফেরারি আসামীর মত পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। ঘরের ছোট ছিদ্র দিয়ে আলো আসলেও ভয় করতো কেউ বুঝি আমাকে দেখে ফেলল। এই ভয়কে উপেক্ষা করে একদিন বৃষ্টিভেজা দুপুরে মুন্নি আতœহত্যা করেছে শুনে দৌড়ে গেলাম।
আমি তখন নানা বাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। মুন্নি আমাকে ভয় দেখাত, আমাকে বিয়ে না করলে বড় মামার কাছে বিচার দেবে?’ আমার সামনে এসে এ কথা কখনো বলেনি। তবে সালমা আমাকে বলত, কিরে মুন্নিকে নাকি তুই বিয়ে করবি, আমার কাছে বল না সত্যি কথা।
আমি সালমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
এই তাকিয়ে থাকাটা অন্যায় কিছু না সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় অনন্ত একশ বছর। ছুটির দিনে চরদুলাই বটগাছের নিচে বসে আছি। আমি গয়নার নৌকায় পাড় হবো। বাড়ি থেকে খবর এসেছে মায়ের শরীর ভালো না। বড় মামা আমাকে প্রায়ই বলে,
-সেলিম তোকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে।
আমি মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি; তালা ঝুলানো আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হল না। মামার কথা শুনে আমার চেহারা ম্লান হয়ে যেত; আমি বাণিজ্যবিভাগ নিয়ে লেখাপড়া করছি, আমার দিন কাটে ডেবিট-কেডিট চুড়ান্ত হিসেব নিয়ে। ডাক্তার হবো কীভাবে? কি সব ভাবনা ভাবে মামা আল্লাই ভালো জানেন। সেদিন বাড়ি পাতালক শিশুর মত মামার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম।
আমি যে টিনের ঘরে পড়তাম, সেই ঘরের জানাল ছিল না। নতুন ঘর টিন কেটে রেখেছে, জানালা লাগলোর জন্য সেই ফাঁকা জায়গায় শীতের দিনে পাটের বস্তা দিয়ে রেখে দিতাম। যাতে বাহির থেকে কুয়াশা ও ঠা-া বা-তাস না আসে। একদিন সেই খোলা জানালা দিয়ে মুন্নি আমার রুমে এসে মুখ আটকিয়ে ধরল, আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন প্রকার শব্দ বের করতে পারছি না। আমার হাতে হালকা একটা কামড় দিয়ে চলে গেল। অথচ কিছুই বলল না। আমি ফিসফিস করে জানতে চাইলাম,
-এখানে কেন এসেছিস?
মুন্নি কোন কথা না বলে জানালার ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে চলে গেল। সাপের মতো ওর পা নড়ছে, আমার শরীর কাঁপছে, যদি কেউ দেখে ফেলে তবে বেশি ভয় পেতাম মামা যদি কিছু বলে। সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। আমার লেখা পড়ার খরচ যদি বন্ধ করে দেয়। এই ভাবনাটা আমাকে ব্যথিত করত, অসহায় করে তুলতো প্রায় সময়। নিজের না থাকলে পরের দিয়ে কিছু হয়না এাঁ মামা বাড়ি পড়তে না গেলে বুঝতে পারতাম না।
পরের দিন সন্ধ্যায় সালমা এসে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু একটা বলতে চেয়ে আবার থেমে গেল। চলন্ত ট্রেন যেমন করে থেমে যায় ঠিক তেমন। মনে হচ্ছিল অনেক দ্রুত কিছু একটা বলকে বাস্তবে কিছুই বলছে না।
মুন্নি আমাকে বলল,
-তোর ব্যাকারণ বইখান দে। কাল সকালে দিয়ে দেবো।
-আমার বই নাই, আমি সালমার বই নিয়ে পড়ি।
মুন্নি কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।
ছোট মামা বিলে কারেন্ট জাল পেতেছে। কৈ, পুটি মাছ পেয়ে কলপাড়ে মাছের বালতি থেকে পানি ঢেলে আবার নতুন পানি দিচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে যেতেই সালমা আগ কেটে গিয়ে মুন্নীকে বলল,
-ভালোই তো চলছ, আমি সব জানি।
-জানিস ভালো কথা। সব জানিস তা আমাকে বলছিস কেন? তোর নাঙকে গিয়ে বল।
-খুব জ্বলছে তাই না। বই কিনে নিতে পারিস না।
-পারি কিনব না, তোর কোন সমস্যা? তুই আমার পেছনে লেগে কিছুই করতে পারবি না।
সেলিম, তোকে কোনদিন ও বিয়ে করবে না। ‘নদীর মাছ সাগরে পড়লে যা হয়।’
-এতো ভাব দেখাচ্ছিস কেন রে মাগি।
-তোর চেয়ে কি আমার চেহারা কম সুন্দর!
মুন্নী ও সালমার ধারালো ছুড়ির সেই কথাবান আমার কানের সদরদরজায় ঠকঠক কড়া নাড়তে শুরু করল।
মনোযোগ না দিয়ে বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি তখন রাজীব এসে বলল,
-ক্রিকেট খেলা শুরু হয়ে গেছে। তুই এখনো বসে আছিস। দ্রুত রেডি হয়ে নে।
মাঠ থেকে রাজীব আমাকে ডাকতে এসেছে। রাজীব অভিযোগ করে বললো,
-মাস্টারের ছেলে খেলতে দেবে না। ওরা না কি মাঠের পাশের জমিতে গম বুনছে, খেতের আইলে বল গিয়ে পড়লে। যে আনতে যাবে তার নাকি ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে ?
-বলা সহজ, করা কঠিন। চামড়ার মুখে মানুষ কত কথা বলে। আজকাল কথা বলতে পারলেই মানুষ নিজেকে বীরবাহাদুর ভাবে।’ আসলে সমাজে যাদের কাছে এখন টাকা নেই তাদের কোন দাম নেই, চেয়ারম্যানের ছাওয়াল দলের অধিনায়ক। চল দেখি, কার ঠ্যাঙ কে ভাঙে? সময় হলে সবি বিড়াল হয়ে যাবে।
মাগরিবের আজান হচ্ছে খেলা শেষ। বাড়ি এসে কলপাড়ে হাতমুখ ধুচ্ছি তখন মুন্নি জগ ভরতে এসেছে, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে। কোন কথা বলছে না। আমার শরীর ঘেঁসে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল ধরল, আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো। আঁধার গাঢ় হতে লাগলো। জগ থেকে পানি নিয়ে হালকা ছিটিয়ে দ্রুত চলে গেল। বুকের ভেতর হাহাকার অনুভব করলাম।
নয় ছয় ভাবনা ভাবতেই সালমা চলে আসলো। ওর মুখের দিকে তাকাতেই জগতের মেঘ ওর মুখ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মলিন চেহারা, ঠোঁটে হাসি নেই, সাপের মত ফুলে ফেপে থাকত সে স্বভাব এখন নেই। শান্ত অবুঝ বালিকার মত আমাকে বলল,
-এখন খুব খুশি হয়েছিস তাই না? আমি জানতাম তুই কিছুই বলবি না। তোর সাহস আছে? আমাকে আজ রাতে পালিয়ে নিয়ে যেতে।
কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। আমি মাটির দিকে চেয়ে আছি, ছালমার চোখ বেয়ে অশ্রু মাটিতে গড়িয়ে পড়লো এই মহুর্তে ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছি না। কাঁপা কণ্ঠে জিগ্যেস করলাম।
- তোর কি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
- সেটা জেনে তোর কি? তুই তো একটা কাপুরুষ!
- মৃদু পায়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। বড় মামি বলল,
-জানিস, কাল না ছালমার বিয়ে!
- আচ্ছা মামি মেয়েদের কি অল্প বয়সেই বিয়ে দিতে হয়।
- ধূর পাগল, মেয়ে মানুষ কি ঘরে তুলে রাখার জিনিস। ভালো ছেলেপক্ষ পেলেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। তুই এ সব বুঝবি না। বুঝিনা বলেই তো আমার মুখের সামনে সালমা কাপুরুষ বলতে পারে? মুন্নির স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে, আমাকে অস্থির করে ফেলে। কি এমন ভুল ছিল আমার। এতো তাড়াতাড়ি তার নিজস্ব একটা কালো অন্ধকার ভুবন হবে। তাকে আর কখনো দেখবো না। কথা বলতে পারব না। এই আপরাধবোধ আমাকে পাগল করে দেয়। ভেতরের কষ্টটা আমি কাউ বলতে পারি না। মুন্নি চলে যাবার পর থেকে ছোট মামি আমার সঙ্গে কথা বলে না। অথচ প্রতিদিন রাতে সে আমার জন্য খাবার টেবিলে রেখে যায়। আমি অশ্রুজলে সিক্ত হই। এই বেদনার করুন সুর আমার বুকের ভেতর মুন্নি বলে যে চিৎকার করে ওঠে। তা তো আমি কাউকে দেখাতে পারি না, বলতে পারি না। সেচ্ছায় অগ্নিদহনে নিজেকে জ¦ালিয়ে অন্তর আতœাশুদ্ধ করা গেলেও বেদনার ক্ষত নিজেরই রয়ে বেড়াতে হয় অনন্তকাল। মুন্নির স্মৃতির সঙ্গে অন্য কারো স্মৃতি আমার জীবনে যুক্ত হোক আমি চাই না। মুন্নি অসাধারণ রুমাল সেলাই করত, আমাকে বলেছিল, তোর নামের প্রথম অক্ষর আর আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে রুমাল তৈরি করবো শেষ হলে তোকে দেবো! আজ হঠাত পুরনো আলমারি খুঁজতে গিয়ে সেই রুমাল পেলাম। একটি রুমাল এত ওজন হতে পারে আমি হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ রাখতে পারিনি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।
আজ সালমার বিয়ে গয়নার নৌকা ঘাটে চলে আসছে পাশের বাড়ির কে যেন সংবাদ দিয়ে গেল।
মামি আমাকে ডাকছে,
-জামাই নামাতে হবে। তোর বড় মামা এই অসময়ে বাজারে গেল কেন? দেখতো।
- আমি রুম থেকে বের হবো এমন সময় দেখি মুন্নি দাঁড়িয়ে আছে। আমি চিৎকার করে মামিকে ডাক দিলাম। মামি দেখে যাও মুন্নি বাড়ি ফিরে এসেছে।
তার পর আমার আর কিছুই মনে নেই, হেমায়েতপুর থেকে সাতাশবছর পর ফিরে এসে দেখি, পরিচিত মুখগুলো নেই। নেই সেই গয়নার নৌকা, আমার মানসিক সমস্যা হয়েছিল। আগের সেই স্মৃতি মনে করতে পারি না। তবে ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে মুন্নী তোকে ভালোবাসতো খুব।
ঘটনাক্রমে মানুষ এবং আমুর একজীবন
ঘটনাক্রমে মানুষ এবং আমুর একজীবন
ইয়াকুব শাহরিয়ার
আমি একটি অবরুদ্ধ ঘোড়া কিংবা সাদা কবুতরের মতো। কথাটি কেনো বললাম তার একটু ঘোর থেকে যাক্। চালাক কিংবা ‘সমজদার’ পাঠকেরা সেটা বুঝে নিবেন নিজ দায়িত্বে। নিজেকে নিয়ে ইদানিং আমি যা-তা মন্তব্য করে ফেলছি। আগ-পিচ কিছুই ভাবছি না। যেমনটি ভাবেননি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ ও ‘টকিস্ট’ জনাব মিরা হামিদ। মিরা একটি মেয়েলি নাম কিন্তু এখানে মি. মিরা একজন পুরুষ। টকিস্ট মানে টকশোতে যিনি নিয়মিত কথা বলে থাকেন। একবার দেশের নামকরা সব সাংবাদিকদের সামনে বলে উঠলেন ‘কিছু মানুষ ঘটনাক্রমে মানুষ হয়ে জন্মেছেন, হয়তো তার পশু হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কোনো এক ঘটনার পটভূমিতে তিনি মানুষ হয়ে জন্মেছেন। বর্তমানে তার অবয়ব টিক মানুষের মতো। হতে পারে তার পেশাগত পরিচয় শিক্ষক, সাংবাদিক কিংবা ডাক্তার। কিন্তু সে মানুষ। তার হাত আছে। পা আছে। মাথা, মাথার চুল, বড় বড় গোঁফ, পাওয়ারফুল চশমা অনেক কিছুই আছে। আর এসব কারণেই সে মানুষ।’ মাথায় মগজের জায়গায় যদি ‘মানুষের বিষ্টা’ অথবা গোবর থাকে তাও সে মানুষ। মি. মিরা’র অনেক কথাই কানে এসেছিলো সেদিন, কিন্তু একটি কথা আমার কানে আজও বাজে। ‘মানুষ কখনো কখনো ঘটনাক্রমে মানুষ হয়ে জন্মায়।’
আমার মনে এসব দর্শন তত্ত্বের কথাবার্তা উদ্রেক হওয়ার কোনো কথা না। আমি সাধারণ একজন মানুষ। চৌহাট্টায় বসে থাকি। রিকশা গুনী। মানুষের হাটাহাটি দেখি। লেবু মিয়ার আদা-চিনি মিশ্রিত রং চা খাই। চায়ে হাল্কা লবণের ফ্লেভার থাকে। কুকুর দেখি। মাঝে মাঝে মানুষ দেখি। আমার দেখার শেষ নেই। দেখতে দেখতেই আমি ক্লান্ত প্রাণ এক। দার্শনিক চিন্তার সময় কোথায়? মাঝে মাঝে ভাবি বই পড়বো। কখনো ভাবি পত্রিকা পড়বো। কিছুই করা হয় না আমার। এই ভাবনা পর্যন্তই আটকে থাকে আমার ভাবনার জগত। আবার কখনো চিন্তা করি ‘মাস্টার সাহেব’ হয়ে যাই। পরক্ষণেই আবার এই চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসি। এ পেশায় যাওয়া যাবে না। এই পেশার অনেক ওজন। যাচ্ছে তাই মানুষ মাস্টারিতে গেলে পেশার ওজন কমে। তাই আমার মতো পাতলা মানুষ ভারী এ পেশায় যাওয়া যাবে না। যেমন-তেমন নীতি হীন বা লাজ লজ্জাহীন মানুষ এই পেশায় ঢুকেছে বলেই পেশাটার এমন দশা! নীতিনৈতিকতার স্খলন ঘটেছে মাতরাত্মকহারে, ছাত্ররা শিক্ষক পেটায়। তাই ভাবছি এই পেশায় যাওয়া যাবে না। আমি বরং চৌহাট্টাতেই বসে থাকি। এখানে বসে গান গাই, রিকশা গুনী। লেবু মিয়ার রং চা খাই।
হঠাৎ করে বিমানের স্পীডের মতো ধুম করে আমার সামনে এসে একটি রিকশা থামলো। রিকশাটির হুড তোলা ছিলো। রিক-াবী বাজারে দিক থেকে এসেছে। হুড ফেলে রিকশাতে থেকেই কুসুম বলছে ২৫ টাকা দাও। আমার কাছে টাকা আছে কিন্তু বললাম নাই। মন মরা হয়ে বসে আছি। ড্রাইভার মামা ২ শ’ টাকার নোট ভাংতি করে ৩০ টাকা রেখেছে। কুসুম এসেছে নবাব রোড থেকে। কুসুম আমার প্রেমিকা। আমাকে সে ভালোবাসে আবার বাসে না। আমিও তাকে ভালোবাসি আবার বাসি না। এসব কথার মানে হয় তো সাধারণ পাঠকরা বুঝবেন না। যারা বুঝেন তারা অস্বাধারণ পাঠক। ঊর্ধ্ব শ্রেণিক পাঠক হওয়ার জন্য তাঁদেরকে একটি বিশেষ সম্মাননা দেওয়া উচিৎ, তবে আমি দিতে পারবো না। কারণ আমার টাকা নাই। টাকা ছাড়া কি আর সম্মাননা দেওয়া যায়? আমার প্রথম এবং দ্বিতীয় সত্তা বলবে, সম্মানের প্রশ্নে টাকা কোনো কিছুতেই মেটার করে না। কিন্তু মি. মিরা হয়তো টাকাকে প্রাধান্য দেবেন। কারণ তিনি আইনজ্ঞ কিন্তু মিথ্যা ছাড়া আদালতে তার দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। তিনি বুদ্ধিজীবী তার মানে তিনি মিথ্যা কথা প্রায় বেশিরভাগ সময় শিল্প রূপ দিয়ে বলেন। তিনি টকিস্ট মানে টাকার বিনিময়ে কোনো একটি পারপাস তিনি সার্ভ করেন। স্বার্থ হাসিল করে টিভি টেলিভিশনে এসে জাতিকে ছাত্র বানিয়ে দক্ষ শিক্ষকের মতো তিনি নৈতিক কথাবার্তার আড়ালে অনৈতিকতার চাষবাস করেন। মি. মিরা’র মতো টাকা হলে আমি দক্ষ পাঠকদের পুরষ্কৃত করবো।
কুসুম আজ আর থাকবে না। আমার হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে চলে যাবে। আমি তাকে যেতে দিবো না। কারণ সে আজ আমার পছন্দের নীল শাড়ি পড়েছে। হাতে নীল চুড়ি, খোঁপায় গাঁদাফুলের মালা। পায়ে কিছুটা হাই হিলের জুতা। আজ তাকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে। হাতে আল মাহমুদের সোনালী কাবিন। পড়েছে কি না সে কথা জানি না। এ যুগে এসে মেয়েরা বই নিয়ে হাটে ভাবতেও ভালো লাগে। কুসুম মি. মিরাকে পছন্দ করে না। কারণ বুদ্ধিজীবী টাইপের এই লোকটা আসলে বুদ্ধিজীবী না। খাটাশ। খাটাশ একটা গালি। বেতালা রকমের অপমানজনক ভদ্র গালি। আরো অনেক ভালো মানের গালি আছে কিন্তু সব গালি সবাইকে দেওয়া যায় না। যেমন ধরুন, কুকুর। কাউকে কুকুর গালি দিলে কুকুর জাত খুশি হয়। কিছু বলে না। কিন্তু মি. মিরা টাইপের খাটাশ প্রকৃতির ছদ্মবেশী লোকদের কুকুর গালি দিলে শহরের কুকুরগুলো আবার প্রতিবাদ করে উঠবে। বলবে, আমরা নিকৃষ্ট প্রাণি হতে পারি, কিন্তু কিছু কিছু মানুষের চেয়ে আমরা ভালো। তাদেরকে গালি দিতে চাইলে আমাদের সাথে তুলনা করতে পারবেন না।
কুসুম দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিকশা মামাকে ডাক দিলাম। দু’জন উঠে বসলাম রিকশায়। হুড তুলতে চাইলাম কিন্তু কুসুম তুলতে দিলো না। আমাদের রিকশা ছুটে চললো দাড়িয়ার পাড়ার ছোট গলি হয়ে ক্বীনব্রিজের দিকে। সেখানে সুরমাপাড়ে বসে সুরমার গোলা পানিতে দেখবো তথাকথিত স্বচ্ছ মানুষদের নোংরা চেহারা। কুসুম তখন গপাগপ পুচকা গিলতে থাকবে। আমি মনের বেখেয়ালি হয়ে চটপটি খেতে থাকবো। কারণ, আমি মনে করি পুচকা মেয়েলি খাবার আর চটপটি পুরুষালি। অনেক কিছুরই কারণ থাকে না। আমরা এই ভাবনারও কোনো কারণ নেই।
সুনামগঞ্জ
পদাবলি
যৈবতীনাভি
নীহার মোশারফ
আগামীতে কেমন হবে কবিতার ভাষা?
ফাগুন, আগুন, বর্ষা বাতাস, শরতের কাশ
ঢেকে দিবে ছাইচাপা কথা? থাকবে না পাখির গান?
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীর অপেক্ষা খুব...
এখন আর আগের মতো খোলামেলা যাবে না চলা
নারীদের পরতে হবে বোরকা, শাড়ির সুতো ভেদ করে
দেখা গেলে যৈবতীনাভি, শূলে চড়বে কেউ কেউ;
চোখের দৃষ্টি বেহায়া হলে পুরুষ বেওয়ারিশ হবে।
মুফতির ফতোয়ায় দ- ভয়ানক।
কার কথায় নারী ঘরের বের হয়? চাকরির নামে
অফিসে গেলে হাওয়া লাগে বুকে বারবার, ধুঁকে ধুঁকে মরে কত
কাপুরুষ হৃদয়। পালটে দাও কবিতা বিষয়। ছন্দ, মাত্র, লয়
বিদ্যালয়ে প্রতীকী সংসদ অধিবেশন বসলে দূর হবে অবক্ষয়
এসো নতুন করে গানের কবিতা লিখি। নতুন পঙ্ক্তিতে সাজাই দেশ
শরতের শুভ্র আকাশে গ্রাফিতিতে গ্রাফিতিতে ভাঙি নীরবতা
সময় এসেছে নতুনদের হাল ধরার, পেছনে ফেউ আছে জানি
তবুও পথ দেখাতে হবে ওদের। আমার মাথার ওপর ছায়া সুশীতল।
প্রাচীন হরিকেল জনপদ ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষ
রুদ্র সাহাদাৎ
প্রাচীন হরিকেল জনপদ ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষ
কিসের ভয় দ্যাখাতে চাও
বুঝি মুখ ও মুখোশের তফাৎ
বুঝি ঘৃণা আর ভালোবাসার খেলা
বুঝি বৈশাখী হাওয়া- বৈশাখীঝড়-
আমাকে কিসের বাণী শোনাতে চাও
জিততে জিততে হেরে যাওয়া আমি আর আমার চোখ
অনেক দ্যাখেছি একজীবনে
প্রাচীন হরিকেল জনপদ ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষ
চেয়ে দ্যাখি উড়ে যাওয়া লালনীল রঙিন ফানুস...
ভীষণ দুঃসময়ের পদধ্বনি
হিলারী হিটলার আভী
সামনের শতাব্দীগুলো শতবর্ষী ভীষণ ক্রুসেডের
সামনের বছরগুলো ভীষণ খরা ও ঝরা’র
সামনের মাসগুলো ভীষণ কষ্টের ও নষ্টের
সামনের পক্ষগুলো ভীষণ অর্ধাহার ও অনাহারের
সামনের সপ্তাহগুলো জীবনক্ষয়ী বুলেট ও বোমা’র!
সামনের দিনগুলো ভীষণ দূর্দিনের
সামনে সময়গুলো ভীষণ দুঃসময়ের
সামনের ঘণ্টাগুলো ভীষণ শব্দময়ের
সামনের মিনিটগুলো ভীষণ নাভিশ্বাসের!
সামনের সেকেন্ডগুলো ষাট ভাগে বিভক্ত হবে
এক-একটি ভাগ এক-একটি ডিনামাইট হবে
অর্থাৎ বিশ্বে এক সেকেন্ডে ষাটটি করে স্থাপনা নিশ্চিহ্ন হবে!
সুদিন
হাফিজুর রহমান
তুমি এসো
আমার জন্যেই আসবে,
আসতেই হবে একসময়- একদিন;
না-হলেও ভালোবেসে!
আশাহত, হতে দিও না আমাকে।
ছোট হতে দিও না
হতে দিও- না কখনও অপমান,
বাঁচতে দিও সম্মানটুকুই নিয়ে-
মানুষ হিসেবে ধরে রাখতে মর্যাদা;
উপভোগ করাতে এ জীবনটাকে।
মায়ের হাসি
সোহান মেহরান
কেউ পারে দিতে? মায়ের হাসিতে থাকে যতটুকু সুখ!
ও হাসিতে তার সুখ সমাহার দেখলেই ভরে বুক।
রোজ ভোরে হাসে মেঘেদের পাশে সোনালী রবির আলো,
উঠি তাই গেয়ে সে হাসির চেয়ে মায়ের হাসিটা ভালো।
ও হাসিতে তাই মনটা ভরায় সুবাস ছড়ায় ভারি,
ভেসে ওঠে মনে ঘুম জাগরণে ভুলতে না কভু পারি।
ও হাসি রঙিন চির অমলিন থাকে হৃদয়ের পাতা,
মায়ের ও হাসি কত ভালোবাসি রূপোলী মলাটে গাঁথা।
যাই যত দূর ও হাসি মধুর কানে রিনিঝিনি বাজে,
পূর্ণ কোমল নেই কোনো ছল মায়ের হাসির মাঝে।
ঐ হাসি খাঁটি খুব পরিপাটি সেরার চেয়েও সেরা,
মায়ের হাসিতে এই পৃথিবীতে থাকি মমতায় ঘেরা।
মুগ্ধতা সারা হাসির ফোয়ারা অপলক দেখি আমি,
সোনা বা রূপার দাম নেই তার, মা’র হাসি যত দামি।
ও হাসি সরল নিবিড় তরল দুঃখ লুকিয়ে হাসে,
হাসি তার শোভা কীযে মনোলোভা হৃদয় গহীনে ভাসে।
বেদনাবলয়
আজিজ বিন নুর
অমন গহীন বেদনাবলয় এঁকে দিয়েছো দুই চোখে
পৃথিবী- প্রবাসে আমি নোনাজল নোনামুখে
আবৃত্তি করি অমিয় মৃত্যুর সুধা
বিষাদের পিঠে চড়ে নিষেধের দ্বিধা নিয়ে
ভাসায়-ডোবায় আমায় করুণার বসুধা।
ধোঁয়াশার দিগন্তে টানিয়েছো নিষেধের নিয়ন
পথের ভীড়ে আমি হারিয়েছি পথ
সুখের ভীড়ে আমি সুখ
হারিয়েছি আমাকেই- বেদনার বাথানে
আমি এক চির হাঁড়িমুখ...
যুদ্ধের ভেতর আমায় আরেক যুদ্ধ ডাকে
বরণ করে নিতে পরাজয়-
দৈন্যতার প্রেয়শ খদ্দের আমি
ডেকে ডেকে দিয়েছে শূন্যতার প্রলয়
কষ্টের হিমালয় কাঁধে চেপে বলে
‘নুয়ে পড়ো, হেরে যাওয়ার হয়েছে সময়’
অমন গহীন বেদনাবলয় এঁকে দিয়েছো দুই চোখে
পৃথিবী- প্রবাসে আমি নোনাজল নোনামুখে
আবৃত্তি করি অমিয় মৃত্যুর সুধা
বিষাদের পিঠে চড়ে নিষেধের দ্বিধা নিয়ে
ভাসায়- ডোবায় আমায় করুণার বসুধা।
গভীর রাতের প্রেম
মিজান ফারাবী
শিশিরের টুপটাপ শব্দে নেমে আসা ভোর। এই রাত থেকে ভোর অব্দি কেবলই তোমার ভাবনা। হৃদয়ের সমস্ত আকুলতা নিয়ে প্রার্থনায় হাজির হই গভীর রাতের প্রেমে। এ যেন তোমাকে আরো কাছে পাবার, আরো কাছ থেকে দেখার অস্থিরতা বুক জুড়ে। জোছনার এই তারাসুদ্ধ রাতের আকাশ জানে আমার আকুলতা, আমার প্রেম ও আবেদন। আমি দরদ নিয়ে আওড়াতে থাকি- এই একটা রাতই তো তোমার হতে চেয়েছি। তুমি শান্তি পাও, আমায় একান্তে ভালোবাসো।
সন্তুষ্ট
মিনহাজ উদ্দিন শপথ
আজ আমার কুকুরটার কী যে হলো। কিছুই বুঝি না। খায় না ঘুমায় না। ঘেউ ঘেউ করে মাতিয়ে তোলে না সারা ঘর। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে- চোখে। সকাল-দুপুর-সন্ধে যে হয়ে এলো। এখন কী করি কোথায় যাই। রিতা এলো চুল ছড়িয়ে গন্ধ বিলিয়ে দেখালো নাচ হিজিবিজি- উলঙ্গ জোছার ঢেউ। মুগ্ধমুখ। ওফ! কুকুরটা এবার শান্ত হলো ঘুমাল সারারাত।
শব্দমালা : শোভন মণ্ডল
শব্দমালা
শোভন মণ্ডল
শূন্য এ বুকে...
যত এগোই জীবনের দিকে
মৃত্যু ছায়া ফেলে পায়ের নিচে
যতই আলোর দিকে মুখ করে থাকি
অন্ধ করে দিতে চায় এই প্রিয় চোখ
আমাদের চলা আসলে হেঁটে যাওয়া হোঁচট খেতে খেতে
বিছানো লাল-নীল মার্বেল পাথরে ঘষে নেওয়া এ শরীর
ঝলমল করে, সারা জীবন ধরে
কোথাও কি আঁচল ভরে গেছে উপহারে?
কোথাও কি মুঠোর মধ্যে ধরা আছে স্নেহ আর ভালবাসাখানি?
এ প্রশ্ন করতেই হবে
যতই এগিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে
জীবন আলিঙ্গন করে শূন্য এ বুকে
শরীর
ঘামের বিন্দুগুলো বুকের আনাচে লুকোয়
দেখেছি আদর-বেলায়
শুধু এক প্রেমের আখ্যানে আরও কিছু বাকি থাকে দেহ
মন্ত্রের মত নিটোল সন্দেহ
চোখের ঘেরাটোপে মেঘ নামে
পুরনো জানালায় পর্দা ওড়ে হাওয়ায়
সে সব তো অছিলার মত মেলা থাকে সাজ
ব-দ্বীপে সাজিয়ে রাখা চর
আর ছোট ছোট লতা-গুল্ম-গাছ
উড়িয়ে দেওয়া যায় সব
সবই তো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়
এই মাত্র পাখির পালক উড়তে উড়তে নেমে এল ঝিলে
জলে কোনও সত্যিকারের ছায়া নেই
সবটাই মায়া বলে মনে হয়
এক এক দিন শুধু ঘুমিয়ে থাকে মন
মনে হয় এভাবে কেটে গেলে বেলা
আমাদের আর হেরে যাওয়ার গল্প থাকবে না
ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবো কষ্টের পালক
শুধু মায়াগুলো উড়ে যাবে আকাশ গঙ্গায়...
ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২১৬
তারুণ্যের শিল্প সরোবর । ধানশালিক। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২১৬
শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল সানী ১৪৪৫ ।
সৈয়দ শামসুল হকের রচিত কবিতা
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন সৈয়দ হক। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয় সৈয়দ শামসুল হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
একেই বুঝি মানুষ বলে
নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।
তুমিই শুধু তুমি
তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।
করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভূমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।
বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি-
নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।
এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব-
যেদিকে যাই-তুমিই শুধু-তুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!
এপিটাফ
আমি কে তা নাইবা জানলে।
আমাকে মনে রাখবার দরকার কি আছে?
আমাকে মনে রাখবার?
বরং মনে রেখো নকল দাঁতের পাটি,
সন্ধ্যার চলচ্চিত্র আর জন্মহর জেলি।
আমি এসেছি, দেখেছি, কিন্তু জয় করতে পারিনি।
যে কোনো কাকতাড়–য়ার আন্দোলনে,
পথিক, বাংলায় যদি জন্ম তোমার,
আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে।
তালাক
তালাক
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
১
কলমি সারাদিন গতর খেটে খায়। কেউ কেউ আবার এই গতর খেটে খাওয়ার অন্যরকম মানে খুঁজতে যাবেন না যেন। এই গতর খেটে খাওয়ার মানে হল, কায়িক পরিশ্রম করে খাওয়া। সম্রাট নাসিরুদ্দিন হোজ্জা সহ অনেক রাজা বাদশাগণই রাজকোষ থেকে কোন অর্থ গ্রহণ না করে নিজেরা কায়িক পরিশ্রম করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। রাজা কিংবা বাদশা হয়েও যখন কোনো ব্যক্তি টুপি অথবা মানুষের জুতো সেলাই করেন, তখন বিষয়টি আর সাধারণ থাকে না। আর এই অসাধারণ মানুষেরাই মরে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকেন, বেঁচে থাকবেন। অবশ্য আমাদের কলমি তেমনি অসাধারণ কেউ নন। সে একজন অতি সাধারণ গাঁও-গেরামের গরীরের ঘরের মেয়ে। অবশ্য এখন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল, এখন সে ছক্কু মিয়ার বউ। এখানেও কেউ ভুল বুঝবেন না। ছক্কু মিয়া এমন কোনো বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ব্যক্তি না যে, নাম নেয়া মাত্রই তাকে সারা বাংলাদেশ চিনতে পারবে! আচ্ছা যাক। সে বৃত্তান্তে আমরা পরে আসব। আপাতত কলমির গন্ধভরা জলের ইতিবৃত্ত কিছুটা অন্তত জেনে নেওয়া যাক।
কলমিকে সারাদিন কেবল ঘানি টানার মধ্যেই থাকতে হয়। এই যেমনি স্বামীর সংসারের ঘানি তেমনি পাড়া প্রতিবেশিদের ঘানি। আরও উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে চাইলে বলতে হবে মরা ঘাটের পানি। যদিও এই ঘানি টানার দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। সুতরাং সংগত কারণেই আমাদের এই প্রজন্ম ঘানি কি জিনিস হাতি না বলদ তা জানে না। তাদের জানার কথাও নও। অবশ্য তারাও মাঝে মধ্যে হয়ত বাপ-চাচাদের মুখে কুলুর বদলের নাম শুনে থাকবে। কারণ আজকাল অনেক পুরুষ মানুষকেই সংসারের প্রতি বেজায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলতে দেখা যায়, সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি রে ভাই। অনেকটা ‘মনমাঝি তো বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারছি না.... এই টাইপ কথাবার্তা। কলমির যাপিত জীবনও এইরকমই। তারও হররোজ একই রুটিন। রোজই নাকের জল আর চোখের জল সামনাসামনি হয়। কাপড় কাছো, ঘর-দোর মোছো, বাটনা বাটো, সবজি কাটো, উনুনে হাড়ি চাপাও, চাল, তেল-জল, মশলা, লবণ দাও...! শুধু এখানেই শেষ নয়; গোছগাছ কর, দোকান থেকে এইটা সেইটা কিনে দিয়ে যাও ইত্যাদি ইত্যাদি। অতঃপর স্বামী সন্তানের সেবায় লেগে যাও। আবার রাঁধ, আবার বাড়, সবাইকে খাওয়াও। অত:পর পাতিলের নিচে অবশিষ্ট কিছু পড়ে থাকলে নিজে খাও। আর না থাকলে না খাও। শুধু এইটুকুতে শেষ অইলে কলমি অখুশি অইতো না। এইসবের সাথে যখন যুক্ত হয় সাহেবদের বউ-ঝিদের বকুনি খাও, সাহেবের কামুক চোখের চাহনি খাও, পথে-ঘাটে হাজারো মানুষের দুই চক্ষের বিজলি খাও, স্বামীর মন জুগাও; তিন তিনটা সাওয়াল-পাওয়াল সামলাও, ইভ টিজিং সামলাও, বাচ্চাদের ইস্কুলে নিয়ে যাও, নিয়ে আসো... আরও কত্ত কী! এসব কেচ্ছা কাহিনি একদিন প্রাগৈতিহাসিক ছিলো, এখন প্রতিদিনই নগদা-নগদি হয়। কানের লতি ঘেঁষে সবেগে তেরছা বুলেট যেভাবে ক্ষিপ্র গতিতে সাঁই করে চলে যায়, কলমিরও সেভাবেই দিনলিপি লেখা হয়। কলমির অসুখ-বিমুখ কেবল নামেই হয়। বাস্তবে সুস্থ থাকুক আর অসুস্থ থাকুক- কাজ করেই যেতে হয়। কাজ করেই খেতে হয়। অবশ্য তার অভ্যস্ত শরীর কোনোদিন না করে না। যেমন পেটানো লোহা কামারকে না বলতে জানে না তেমন।
একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আমরা বাঙালিরা সাধারণত সবকিছুই সাদৃশ্যপূর্ণ এবং মিলঝিল পর্যায়ের আশা করে থাকি। এই যেমন আমরা বলি, যেমনে তেমন মিলে শুটকি মাছ আর বেগুনে মিলে। এই ধরনের আরও অনেক কথা আমাদের সামাজিক জীবনে প্রচলিত আছে এবং আমরা এইসবের বাইরে যেতেও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনা। এর একটি বড় উদাহরণ হল, কলমি এবং ছক্কু মিয়ার বিবাহ। পাড়ার লোকজন এই বিবাহ কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি। কারণ এই বিবাহ নাকি শুটকি মাছ আর বেগুনের মত মানানসই হয় নাই। পাড়ার ছেলেছোকরা তো এই বিবাহ আটকানোর জন্য রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত নামিয়েছিল। কিন্তু মিয়া বিবি রাজি তো কিয়া করবে কাজি? কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত ছক্কু মিয়ার গলাতেই কলমির মত নগদ মুক্তার মালা উঠল। কিন্তু কী এমন কারণ যার জন্য এতো কা--কারখানা? আসল কথা হল, সবাই মনে করে আধা ল্যাংড়া ছক্কু মিয়া কলমির সোয়ামি হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। কলমি হইল আসমানের একটা পূর্ণিমা চান। এই চান কি যার-তার ঘরে মানায়? কোনোদিন না। কলমির রূপ মাধুরীর বর্ণনা করতে গিয়ে কতজন যে কতরূপে তাকে প্রকাশ করেছে; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গণমানুষের মতামত অইল ছক্কুর ঘরে কলমি যেন শুধুই কলমি না। সরোবরে পদ্মফুল ফুটে থাকলে এই দৃশ্য যেমন মনোহর লাগে কলমিকেও ঠিক ঠিক তেমনি মনোরমা লাগে। সরাসরি বললে কলমি একটা ফুটন্ত গোলাপ। গাঢ় উজ্জ্বল গায়ের রঙ। সাড়ে পাঁচ ফিটের একটু বেশি উচ্চতা। তার নাক-মুখ-চোখের উপর কে যেন লাবণ্যের পর লাবণ্য মাখিয়ে দিয়েছে। গোল-গাল মুখখানি যেনো কোনো শিল্পীর হাতে তৈরি পুতুলের চেয়ে কোনোঅংশে কম নয়। তাই সবার ধারণা হল, কলমির মত অপরুপা সুন্দরী মেয়ে কোনো রাজা-বাদশাহর ঘরেই কেবল মানায়। এই ল্যাংড়া ছক্কু মিয়ার ঘরে কোনোমতেই কলমি রে মানায় না। কিন্তু মানুষের চাওয়া আর না চাওয়ায় কি সবকিছু হয়? হয় না। আসল কথা হইল, ভাগ্য। আমরা চাই বা না চাই একটা পর্যায়ে ভাগ্য আমাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। আমরা মূলত ভাগ্যের হাতের পুতুল।
এই ভাগ্যের নির্মম রসিকতায় কলমি নিজেই তার নিজের শত্রু। বলতে পারেন, এইটা আবার কেমন কথা বাপু? কিন্তু এইটাই আসল কথা। কলমির এই বেপরোয়া রূপ-যৌবনই তার আসল প্রতিপক্ষ। কলমি যদি আরেকটু কম সুন্দরী অইত... তাইলে কিন্তু এইসব কোনো ঝামেলাই তাকে মোকাবেলা করতে হতো না। এজন্যই জ্ঞানী মানুষেরা বলে থাকেন, কলমির এই বেসামাল রুপটাই হয়েছে তার সাক্ষাৎ কালপুরুষ। এখানে কালপুরুষ মানে কাল জয়ী মহাপুরুষ নন। কাল কেউটের মতোন পুরুষ। কলমি রাস্তাঘাটে হাঁটতে পারে না...ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে তাকে যেন ঢক ঢক কইরা গিইল্যা খায়। গিইল্যা খাইতে চায়। কৈশোর কাল থেকে এইসব অত্যাচার সহ্য করতে করতে কলমির একেবারে অসহ্য হয়ে গেছে। তার আর এসব ভাল্লাগে না। রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় শরীর ঘিন ঘিন লাগে। মাঝে মধ্যে অজপাড়া গাঁয়ের কলমিও বিদ্রোহী অইতে চায়। সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। তার কেবলই ফুলন দেবী অইতে মন চায়। কেউ তাকালেই চোখ দুটি খুইল্লা নিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে সে কিছুই পারে না। মাথা নিঁচু করে রাস্তার একধার ঘেঁষে নীরবে- নিভৃতে হেঁটে যায়। আর মনে মনে বলে, ছক্কু আর তার বাপ ছাড়া পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষেরা যদি কানা অইয়া যাইতো!
২
ছক্কু মিয়া আধা ল্যাংড়া হলেও মানুষ হিসাবে তেমন একটা খারাপ না। সারাদিন একপায়ে রিকশা চালায়। বিয়ের পর পর এই বিষয়টা কলমিকে খুব কষ্ট দিত। তাই একদিন রাইতে স্বামীর বুকের উপর আধশোয়া অবস্থায় কলমি ছক্কু মিয়াকে বলল, একখান কথা কইলে রাখবেন?
ছক্কু মিয়া বলল, কি কথা ক হে কলমি...
আপনের কিন্তু আমার কথা রাখতেই হবে। আমার কথা কিন্তু ফেলাইয়া দেওয়া যাব না।
ঠিক আছে তুই ক দেহি। রাখবার মত কথা অইলে তো রাখবই
কলমি স্বামীর আরও ঘনিষ্ঠ হল। তার বুকে পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনি আর রিকশা চালাইতে পারবেন না কইলাম। আপনার শরীরের যে অবস্থা তাতে রিকশা চালানোর কাজ আপনার জন্য না।
কলমির কথা শোনে ছক্কু মিয়ার এক ফালে আসমানে উইঠা যাওয়ার উপক্রম অইল। তার প্রতি কলমির এই যে ভালোবাসার প্রকাশ ছক্কু মিয়া নিজের কানে শুনলো, নিজের চক্ষে দেখলো... তার ঋণ সে কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবে না। তবুও যদি কিছু টা শোধ হয়, সেই আশায় কলমিকে বুকের সাথে সাথে পিষতে পিষতে বলল, আমি রিকশা না চালাইলে কি খাবি রে কলমি?
কলমি বলল, সে চিন্তা আপনার করতে হবে না। আমি আগে থাইক্যাই সেই ভাবনা কইরা রাখছি।
ছক্কু মিয়া বলল, কী ভাবনা?
কলমি বলল, আমি মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করমু।
কাজ কইরা যে টাকা পাইমু সেখান থাইক্যা সংসার খরচের পরে কিছু কিছু জমাবো। সেই জমানো টাকা দিয়া আপনে একটা দোকান দিবেন। তাইলে আপনার আর রিকশা চালাইতে অইব না।
কলমির পরিকল্পনা শোনে ছক্কু মিয়ার পরানডা খুশিতে ভইরা গেল। আধা ল্যাংড়া সোমামির প্রতি কলমির এই যে ভালোবাসা তা কম বড় কথা নয়। অন্তত ছক্কুর কাছে তো এর দাম সমগ্র দুনিয়ার চাইতেও বেশি। মনে মনে সে নিজেকে বড় ভাগ্যবান ভাবতে ভাবতে কলমি কে আরও জোরে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর বুদ্ধিটা অনেক সুন্দর কলমি। কিন্তু মাননের উপায় নেই। সারাদিন দোকানে বইসা থাকলে আমার যে ডায়াবেটিস হইয়া যাইব। তাছাড়া লোকে আমারে এমনিতেই ল্যাংড়া বলে ডাকে, তখন বাদাইম্যা বলেও ডাকবে।
কলমি বলল, লোকের কথায় আমাদের কিছু আসব-যাব না। মানুষে আমাদেরকে না খাওয়াবে আর না পরাবে। আমার কথা আপনাকে রাখতেই হবে বইল্যা দিলাম কিন্তু!
কলমির এই আলটিমেটাম শুনে ছক্কুর মন আরও অনেক অনেক বড় হয়ে গেল। কিন্তু নিজের বউ মানুষের বাসায় কাজ করে খাবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিবে না। যত গরীবই হোক না কেন; সে তার আত্মমর্যাদা কখনও বিসর্জন দিতে পারবে না। তবে মুখে বলল, ভিন্ন কথা। আচ্ছা, তুই যখন এত কইরা কইতাছিস তাহলে তোর কথাটা ভেবে দেখব নে।
ছক্কুর মিয়ার কথা শোনে কলমি নিজেকে বিজয়ী ভাবতে লাগলো আর বিড়ালের মতো ছক্কুর শরীরে নিজের মুখ ঘষতে লাগলো।
৩
এভাবেই ছক্কু মিয়া আর কলমির সংসারে ডালপালা গজাইতে লাগলো। অসুখের কারণে ছক্কু মিয়া তার আত্মমর্যাদা হাওড়ের পানিতে বিসর্জন দিতে বাধ্য অইল। আর যা-ই হোক নিজেরা না হয় দুই, একবেলা না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তো আর উপোস রাখা যায় না। তার উপর রোগ-শোকের ব্যাপার আছে। এইসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে কলমি এখন মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে। যদিও ছক্কু এখনো রিকশা চালানো বাদ দেয় নাই। দুইজনের সম্মিলিত ইনকামে এখন আর তাদের কপোত- কপোতীর সংসারে কোনো দু:খ নাই। অবশ্য এমনিতেও কলমি খুব শক্ত নার্ভের মানুষ। তার গোটা জীবনে খুব বেশি দু:খ নেই। সব মিলিয়ে মাত্র একটা দু:খ আছে। আর তা হল, তার দিকে পুরুষ লোকদের চোখ মারা।
অবশ্য এখন এইসব দু:খও একপ্রকার গা সওয়ার মত হয়ে গেছে। কলমির সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে এইজন্য যে, প্রায় সব পুরুষ মানুষই কোনো না কোনোভাবে লুইচ্চা। কেউ মুখ লুইচ্চা, কেউ চোখ লুইচ্চা, কেউ হাত লুইচ্চা, আবার কেউ কেউ আছে যে একেবারে আপাদমস্তক লুইচ্চা। তবে দুই একটা যে ভালো নাই ব্যাপারটা এমনও নয়। যেমন ছক্কুর কথা ধরা যাইতে পারে। সে একজন কমপ্লিট ভদ্র এবং ভালো মানুষ। তার মধ্যে লুইচ্চামি তো দুরের কথা; এর লেশ মাত্রও নাই। সে সারাদিন গতর খাটে। রাইত- বিরাইতে বাসায় ফিরে আসে। ফিরেই একটা হাঁক দেয়, আমার পরী কইরে..। পরী হল কলমির ছোটমেয়ের নাম। যেমন বুদ্ধিমতী তেমন মায়ের মতন রুপবতী। এই একরত্তি বয়সেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পকেট হাতড়ায়। খাবার খুঁজে। খেলনা খুঁজে। ছক্কু কিছুক্ষণ বাচ্চাদের সময় দেয়। তারপর সবাই মিলে একত্রে খায়। তারপর চলে বাচ্চাদের ঘুমানোর জন্য অপেক্ষার পালা। কলমি ঘুম পাড়ানি গান গায়। এই ফাঁকে ছক্কু মিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি টানে। কিছুদিন ধরে বিড়ি টানলে ছক্কুর কাশি হয়। তবুও বিড়ি টানা ছাড়ে না। ছাড়তে পারে না। কলমি তারে রোজ রাইতে শপথ করায়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। আজ বিড়ি টানতে টানতে ছক্কু হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়। কী সুন্দর আর নির্মল! বিড়ি টানা শেষ করে ছক্কু ঘরের ভেতরে ঢুকে। কলমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাধ্য চুলে বিনুনি দিচ্ছে। কলমিকে যেন রুপকথার রাজকন্যার মতন দেখতে লাগছে। ছক্কু মিয়ার আর সহ্য হয় না। রোজকার মতন কলমির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্য আদরে আদরে কলমি প্রতিদিনই স্বর্গের সুখ পায়। অতঃপর কোথা থেকে ক্লান্তি আর অবসাদ আসে। দু’চোখের সুড়ঙ্গে রাজ্যের ঘুম ঢেলে দিয়ে যায়।
৪
যদিও ছক্কু মিয়া রিকশা চালায়; তবুও একটি পুরনো জরাজীর্ণ ভবনের দোতলায় থাকে। যদিও মাথার উপর ছাদ নেই। টিনের শেড দেওয়া। দুটি ছোট ছোট রুম। পাঁচ ফিট বাই দেড় ফিটের একটি মিনি বারান্দাও আছে। একটি টয়লেট। রান্না ঘর নেই। গ্যাস, কারেন্টও নেই। নিচতলা থেকে রান্না করে উপরে আনতে হয়। চরম বিরক্তিকর ব্যাপার। তবুও ভাড়া অনেক কম বলে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। সবকিছু ছাপিয়ে বারান্দাটি অসাধারণ। যেখান থেকে আকাশ ছোঁয়া যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশের মতন বিশাল বড় স্বপ্ন দেখা যায়। রাতের আকাশের নক্ষত্রের সাথে কথা বলা যায়। তারা খসা কিংবা উল্কা পতনের দৃশ্যও দেখা যায়। এখানেই কলমি আর ছক্কু মিয়ার স্বপ্নেরা বড় হচ্ছে। এই স্বপ্নদের নাম পরী, তিতলি আর জোহরা। এরাই একদিন বড় হবে। পুরুষ শাসিত সমাজের ঘাড় থেকে ধর আলাদা করবে। এসব ভাবতেই তাদের ভাঙা নৌকোর পালে হাওয়া লাগে। জোড়া শালিক পতপত করে উড়ে। ভালোবাসারা আরও মজবুত হয়ে তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। আর এই ভালোবাসা নিয়েই কলমির যত ভয়। কলমি জানে, ভালোবাসা যত বেশি, তার জ্বালাও তত বেশি। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে থাকবে না। সন্দেহের বিষবৃক্ষ সমস্ত জগত সংসার পুড়ে ছাইপাঁশ করে দিবে।
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলমি এসব ভাবতে ভাবতে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেও ঘামছে। কলমি জানে, তার এই একরত্তি মনে কোনো পাপ নেই। তার হৃদয়াকাশে ছক্কু মিয়া ছাড়া আর কারো কোনো স্থান নেই। লুলা হোক, ল্যাংড়া হোক...ছক্কুই তার প্রাণপতি। ছক্কুতেই বাঁচা, ছক্কুতেই মরা। ছোটবেলায় কলমি দাদীর মুখে শোনেছিল, লজ্জাস্থান মানুষ কয়জনকে দেখায়!! এইটুকু পর্যন্ত ভাবতে না ভাবতেই দরজায় ঠকঠক করে তিনবার শব্দ হয়। ছক্কু এসেছে ভেবে কলমি দৌড়ে যায়। সাথে সাথে আবার এটাও মনে হয় এখন তো ছক্কুর আসার কথা নয়। সে তো গ্রামের বাড়িতে যাবে বলে গিয়েছে। একটা সন্দেহের বীজ কলমির মনে দলা পাকে। তাহলে সেই খসরু কুত্তাটা নাতো? আজ সকালে তার বাসায় কাজ করার সময় কী জানি একটা বিড় বিড় করে বলেছিল! কলমি একেবারেই পাত্তা দেয়নি। তবুও একটা বাক্য তার কানের ছিদ্রের ভেতর বিষ ঢেলে দিয়েছিল-আজ রাইতে তোর বাসায় আসব কলমি। তোর দুখের দিন শেষ। আমি তরে রাণী করে রাখব। আল্লাহর কসম দিলাম, আমার কথা মিথ্যা না।
কলমি কোনো জবাব দেয়নি। রাগে, দু:খে, ঘৃণায় হাতের কাজ শেষ না করেই হনহন করে চলে এসেছিলো। আসতে আসতে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল, এই শুয়োরটার বাসায় আর কাজ করবে না। এখন দেখি সত্যি সত্যি সে এসে হাজির! এতোকিছুর পরেও কলমিও বুকে সাহস সঞ্চার করে। হাতে একটি পুরনো বটি। দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে?
সাথে সাথে জবাব পাওয়া গেলো, কলমি দরজা খুল। আমি খসরু চৌধুরী।
কলমির মাথায় খুন চড়ে বসলো। তড়াক করে দরজা খুলে দিয়ে বলল, হাতের বটিটা দেখতে পাচ্ছিস তো শুয়োরের বাচ্চা... এক কোপে ধর থেকে মাথা আলাদা কইরা দিমু।
কলমির এহেন রুদ্র মূর্তি দেখে খসরু আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। এমন সময় ছক্কু মিয়া বাসায় ঢুকলো। সিঁড়িতে খসরু চৌধুরীর সাথে তার দেখা। একটা সন্দেহের ঘুর্ণিঝড় তার আপাদমস্তকে তীরের মত বিদ্ধ হল। কিন্তু খসরুকে কিছুই বলল না। যা বলার কলমিকেই বলবে ভেবে দরজায় কড়া নাড়ল। কলমি জিজ্ঞেস করলো, কে?
ছক্কু মিয়া বলল, দরজা খুল মাগি। আমি তোর যম।
কলমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। হাত থেকে বটিটি নিচে পড়ে গেল। কলমিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছক্কু মিয়া রেগে-মেগে বলল, তোর সতীপনার প্রমাণ আজ আমি হাতে-নাতে পাইলাম কালনাগিনী। আমার খাস, আমার পড়স.... আর চৌধুরীর সাথে পরকিয়া করছ! তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যা মাগি। আমি তোরে তালাক দিলাম... এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক... বাইন তালাক।
এ যেন ভোজবাজির খেলা! কোথা থেকে বিজলির মতোন কী ঘটে গেল! কলমির আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। হঠাৎ এক ঝড় এসে কলমির সমস্ত আকাশ-বাতাস চুরমার করে দিয়ে গেল। ইতোমধ্যে পরী, তিতলি, জোহরা এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। কী ঘটেছে... ওরা কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ওদের এতটুকু বয়স হয়নি। ছক্কু মিয়া আবারও হুংকার ছাড়লো, বের হয়ে যা হারামজাদী। তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা...তোর মত ছেনালি মাগি যেন আল্লাহ আর কারো কপালে না দেয়-- !
৫
কলমি যেন একখ- পাথর। কিছুক্ষণ মাথানত করে নখ খুঁটল। এরপর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় কলমি দরজার দিকে পা বাড়ায়। পরী এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। কলমি পরীকে কোলে নিতে চাইতেই ছক্কু মিয়া জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুই বের হয়ে যা নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার...পরী আমার মেয়ে, সে আমার সাথেই থাকবে।
কলমির অনেক কিছুই বলার ছিলো। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বলেনি। বলা চলে বলতে পারেনি। কেবল দুচোখের কোণে আলোড়িত জলোচ্ছ্বাস নিয়ে নিরবে-নিভৃতে বের হয়ে গেলো।
পাদটীকা: প্রিয় পাঠক, আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, ঘটনার কয়েকদিন পরেই ছক্কু মিয়ার ভুল ভাঙে। কলমি কে আবার নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করে। কাকুতি মিনতি করে। এমন কি হাতে পায়েও ধরে। কিন্তু কলমির আর মন গলেনি। তার এক কথা, যে থুতু একবার মাটিতে পড়ে গেছে; সেই থুতু আর মুখ নেবো না।।
পরিচিতিঃ সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
পদাবলি
ভিখারি
নাসরিন জাহান মাধুরী
ভেতরের অবদমিত প্রতিজ্ঞা
শপথের বাক্য
যাও যাও যাও, এই বেলা তুমি যাও
তারপর যেতে থাকি যত দূরে যাওয়া যায়
যত দূরেই যাই
তোমার বৃত্তের পরিধি, ব্যাস, ব্যাসার্ধ
কিছুই ডিঙাতে পারি না
সাত রঙা পাহাড় ডিঙাই
ময়ূরাক্ষী নদীতে ভাসি
সাত সমুদ্র তেরো নদী
অনন্ত নক্ষত্র বহুকাল আগে যার আলো
কৃষ্ণ গহ্বরে বদলে গেছে তার আলো ডিঙাই..
যাও যাও যাও, এই বেলা তুমি যাও
তারপরও যেতেই থাকি
ব্যথার রাগিণী বেজেই চলে
যাও যাও যাও এই বেলা তুমি যাও
যেতেই হবে! যেতে হবেই!
চোখে বিস্ময় মনে বিস্ময় নিয়ে
চলে যাই চলে যাই অজানায়
সব অগ্রাহ্য করে
আর কোন মোহ নেই
নেই মায়া পাখি
নেই পিছু ডাক
কোন সীমা রেখা আর আটকাতে পারে না...
ভুলে যেয়ো আমাকে
ম্স্তুফা হাবীব
মানবিকা, আমাকে ভুলে যেয়ো।
তুমি চেয়েছিলে স্বপ্নের গাছটিতে ফুল ফুটুক,
সুবাস ছড়াক বসন্তের সুহাসিনী বাতাসে।
আড়িয়াল খাঁর উন্মত্ত ঢেউয়ে
স্বপ্নগাছটির শেকড় থেকে মাটি সরে গেছে
আজও ফেরারি আসামির মতো সেই দুর্ভাগা স্বপ্ন
অচেনা প্রান্তরে পালিয়ে বেড়ায়।
তোমার রূপনগর আর দেখা হল না আমার
তিল শোভিত পাতাবাহার গালে হল না চুমু খাওয়া
জংধরা আরশিতে চোখ রেখে শুধু স্মৃতির আবাদ।
মানবিকা, চার দশকেরও অধিক সময়
বেয়ে যাচ্ছি কালের বৈঠা
আগুনমুখা নদীর উপাখ্যান লিখেও
আজও ভিড়তে পারিনি তোমার ঘাটে।
মানবিকা, ভুলে যেয়ো আমাকে
হৃদয়ের বিলবোর্ডে কেনো লিখে রাখো মুস্তফা হাবীব !
অস্তিত্ব
মুহম্মদ মহসিন হাবিব
একদিন তরতাজা কলমিলতা হয়ে
খাদকে রূপান্তরিত হবো
আর আমার স্বজাতিরা পোকা মাকড়ের কামড়ে জর্জরিত হবে
ফিরেও তাকাবে না কেউ
জীবন খিদে মেটাতে আমাকেও
রান্নার রেসিপি হতে হবে কোনো এক পছন্দের থালিতে
কিম্বা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ধুলি মাখা দেহে শিউলি পচা হয়ে
ঠাই মিলবে আস্তাকুড়ের লুকানো ঠিকানায়
ফুল মালার সমারোহ থাকবেনা;
থাকবেনা মাটি উৎসবের সমারোহ
শুধু থাকবে অন্ধকার আকাশে এক ফালি চাঁদের বিরাজমানতা।
কীর্তিনাশা নদীটি
নাঈমুর রহমান
কীর্তিনাশা নদীটি তারে আমি চিনি
চিনি আমি আগন্তুকের নাম।
চোখ জুড়ে তাঁর বনলতার কালিমা
কীর্তিনাশার ঢেউয়ে বহে কাজলরেখা।
সন্ধ্যা এলে আবার ফিরে শিরীষ গাছের বনে
হলুদ রঙের ডানা মেলে
কীর্তিনাশার বিস্তীর্ণ বুক জুড়ে।
আমি চিনি তাই,
চিনি আমি আগন্তুকের এলোচুলের হিজল-কমল।
কীর্তিনাশা গাহে, বহে অপরাহ্ণের সমুষ্ণ বাতাস,
খুব কাছাকাছি কলমির ফুলের দলে
সে আগন্তুক শাশ্বত নদীর মেয়েটি।
চিনি আমি কীর্তিনাশা
চিনি আমি আগন্তুকের নাম।
মুক্ত করে দিলাম
প্রণব কুমার চক্রবর্তী
স্বপ্ন তোকে আর পারছি না
চোখের সামনে ধরে রাখতে ...
ভাবনা তোকেও পারবো না
মনের ভেতরে দু হাতে ধরে রাখতে
খুব বেশী দিন...
আলো গিলে খাওয়া
অন্ধকারছন্ন মেঘের টুকরোটা
ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে-
সামনে
পেছনে
আমার চারপাশে ......
যাহ্ মন
তোকে পাখি করে উড়িয়ে দিলাম আজ
খুঁজে নিস
উড়ে গিয়ে
তোর বাসা বাঁধার মতো
নোতুন কোনও
সবুজ উন্মক্ত মাঠ
শালিকের মতো গুটি গুটি পায়ে
খুঁটে তুলে নিস
ঘাসের নীচে লুকিয়ে থাকা
জীবনের যথার্থ বর্ণমালা...
সময়গুলো বড় নিষ্ঠুর
জহিরুল হক বিদ্যুৎ
সময়গুলো বড় নিষ্ঠুর মমতায় হাত বাড়ায়
কখনো প্রচ- খরা হয়ে, কখনো ঘন কুয়াশা হয়ে।
দৃষ্টি নত হয়, দুর্ভেদ্য মনে হয় দূরের পারাপার
পথ হারায় কুহক চাদরে একঝাঁক শুভ্রকপোত।
বসুধায় কে আছে, যে বুক পেতে রাখে?
খুঁজি তারে, দেখি না তারে,
সে হারায় পথে-ঘাটে-প্রান্তরে, দূরের আবছা আলোয়
নিঃসঙ্গ খুঁজে যায় স্বর্গের অনন্ত সৌরভ,
চাতক পিপাসায় চেয়ে থাকে আকাশপানে
হায়! চোখের জলে কী স্বপ্নভাঙ্গার তৃষ্ণা মেটে?
স্বার্থের সূচকে বিশ্বে ভালোবাসার দরপতন
অসংখ্য কবিতারা দিয়ে যায় আত্মাহুতি;
শেষ ভগ্নাংশগুলো আর্তনাদ করে ওঠে বেদনায়
কবে ফুটবে ফুল কোন বসন্তে, শুদ্ধ মানবচেতনায়?
ঘৃণাগুলো আরো ঘৃণিত হয়ে উঠছে
বিষাদের কালোরঙে লেপ্টে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র।
বর্ণবৈষম্যে আজো জ্বলে পুড়ে মরে মানুষ
জাতিগত ভেদে সাম্প্রদায়িক নীল-নকশা আঁকে;
স্বাস্থ্য নিয়ে স্বার্থ খোঁজে অসুস্থ পুঁজিবাদিরা
মেতে ওঠে বিধ্বংসী অনুজীবের উত্থান-পতনে;
হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অচেনা অনুক্ষণ
কে তারে চিনতে পারে বিক্ষুব্ধ নগরে?
বিশ্বাস বিশ্বাস খেলা
ইয়াসিন আরাফাত
ক্যারম খেলায় অনেকের ভয় হতো আমার সাথে দাঁড়াতে।
বিস্তৃত হাওরের কিনারে ফুটবল খেলেছি বহু
গোল করিনি কখনও তবুও জিতেছি সতীর্থের গোলে।
আর অপ্রিয় খেলা ক্রিকেটে আমি পাকাপোক্ত নই।
এমন আরও অনেক খেলা খেলেছি আমি
গোল্লাছুট, চোর পুলিশ, বউচি, লাই, কপালটুকি আরও কত কী!
প্রচলিত বিধান অনুসারে কখনও হেরেছি কখনোবা জিতেছি।
সেইসব ভুলে গেছি শৈশবমূখর রাত পোহানোর আগে।
কেবল ভুলতে পারি না সহস্র রাত ধরে, বিশ্বাস বিশ্বাস খেলায়
মানুষকে বিশ্বাস করে জিততে পারিনি আজও!
মধ্যবিত্তনামা
মাজহারুল ইসলাম
তোমাকে লিখবো লিখবো করে
কত দিন কেটে যায় আমার!
সকাল দুপুর বিকেল গড়িয়ে
রাতের আঁধার সবকিছু কেমন গ্রাস করে নেয়
মোটা ভাত মোটা কাপড়ের অধিকারটুকু ও।
বেঁচে থাকার জন্য এই যা-
একমাত্র ‘মধ্যবিত্ত’ তকমাটা ছাড়া
আর কিছুই যে থাকে না !
তাইতো আগ-পিছ ভেবে-চিন্তে
তোমাকে আর লেখা হয় না!
জানো তো-
মধ্যবিত্তের জমি-জিরাত ঘর-দোর সবই থাকে
বাড়ির দক্ষিণকোণে শান বাঁধানো পুকুর থাকে
সুখ দুঃখ হাসি-কান্নার রক্ষণশীল গল্প থাকে
উন্মুখ প্রাপক থাকে শুধু প্রেরক থাকে মধ্যবিত্ত মননের !
নীরব নামতা
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ফুরিয়ে যাওয়া একটা দুপুরের মত
ফুরিয়েই যাচ্ছি, কোনো রকম আছি;
এটাকে বেঁচে থাকা বলে; ভালো থাকা নয়।
কিছু খুঁচরো আলো ছুঁতে গিয়ে
একশ জোনাকির মৃত্যু হয়েছিল; কেউ জানেনা-
সকালের ইতিহাস মনে রাখিনা; এভাবেও যে
পাঠ করে নিতে হয় নীরব নামতা; জানা ছিল না।
তুমি হয়ে গেলে আমার ভালো থাকা; বিরহ-
আমার নির্বাক কবিতার নির্মহ ঘ্রাণ;
তুমি ভাবো না কষ্মিন সময়ে-
অথচ কেউ না হওয়া এই আমি তোমার কেউ একজন।