ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা

ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা


ভয়াল রাতের বিজয়মুখো যাত্রা
সকাল রয়

সে রাতে মেঝেতে ক’ফোটা রক্ত দেখে আতঁকে উঠেছিলাম!
তখনও ভাবিনি দেখতে হবে রক্তবন্যা। আমার হাত ধরে তুই আর আমাদের ছোট বোন অলকা ঠিক যেন একসাথে কেঁদে উঠেছিলাম। সে চিৎকারে তুই মুখ চাপা দিয়েছিলি। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা বাবার পাঞ্জাবী ভেজা ছিল রক্তে। দেখি মা ঠিক পুতুলের মতো মেঝেতে পড়ে রয়েছে। ঘরদোর এলোমেলো। যেন কোন ঝড় এসে খেলে গেছে তান্ডবলীলা।
বারান্দা পেরিয়ে কলতলায় এসে দেখি পড়ে আছে বড়’দি’র এক পাটি চটি, গতকাল বাবা যেটা খুঁজে খুঁজে কিনে এনে দিয়েছিল বড় বাজার থেকে। আমি শখের সে চটির পানে তাকিয়ে ভাবছি আর এক পাটি কোথায়? আর কোথায় আমাদের বড়’দি।

কিছুটা বিস্ময়ে আমি যখন গেছি তলিয়ে, তুই বললি চল নিষাদ দৌড়ে পালাই! আর এক মুহুর্তও নয়। আমি বলি বড়’দিকে নিয়ে গেছে যে; তাকে কি ফেলে যাব। তুই কিছু বলিসনি শুধু চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিলি কখনো কখনো এমন হয়। হয়তো সে একদিন ফিরে আসবে, সেদিন বিশ্বাস গেথেঁছিলাম তাবিজ করে গলায়।
সারারাত হাঁটা পথে চলেছি তিনজন। আমাদের চারপাশে কত রকমের মানুষ তখন দৌড়াচ্ছে। কত মানুষের ভীড়! একসাথে এত মানুষকে কখনো মরতে দেখিনি। পিকুদের ময়নার খাচাঁ উল্টে গেছে কেথায় যেন উড়ে গেছে স্বাদের সে পাখি। আমরা তিনটে প্রানী হেটে চলেছি কত চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে।
আমাদের হাটা পথ থেমেছিল গাঁয়ের এক বাজারের কাছে যেখানে ছাইপোড়া নগরী দেখে আতঁকে উঠলাম। আরও কত কি যে চোখ পড়লো তার নেই ইয়াত্বা। তারপর বাসে করে ভোর রাতের শেষে গ্রামের পথে পা রাখলাম।

গ্রাম আর পুরোনো রঙে নেই। আগুনের ছ্যাঁকা ছ্যাঁকা দাগে ভরা কৃষকের ঘরগুলো। দেখি লাউয়ের মাচায় ফুলগুলো কেমন চুপসে গেছে। কারা যেন একদল ছেলে বুড়োকে শুয়েই রেখেছে উঠোনের পাশে। কত রকম বিভৎস সে দৃশ্য। কারো কারো আর্তনাদ মাখা মুখ তখনও আগুন রেখেছে ধরে।

হরিদাস গেটে নেই। আমাদের সে বাংলো ঘর। সব কিছুতেই কেমন যেন শূন্যতা। তবে কি লাগলো পাকিদের আঁচড় এখানেও! আমার হৃৎকম্পন ছড়িয়ে যায় সবখানে। একমুহুর্ত থেমে আবার মিশে গেলাম ভীড়ে। আমরা তিনটে প্রানী উঠে বসে বসে থেমে থাকা ভীড়ে চিরে চ্যাপ্টা হবার জোগাড়।
ভীড়ের মাঝে ঠিক মনে নেই ক্যামন করে হাত ফস্কে দেখি অলকা নেই পাশে। আমি খুব করে খুঁজে নিই চারপাশ। কোথায় অলকা বোন আমার!  নোনা ধরা চোখে তখন নামছে ঝড়। অলকা হারিয়ে গেছে। কি যে ব্যথা আহ! তুই আমাকে শক্ত করে ধরে বললি কোথায় হারালি বোনকে?
অলকা, অলকা কোথাও নেই শুধু অপরিচিত মুখ গুলো আমাদের ফেলে-ফেলে যাচ্ছে।

আমাদের কেঁদে ফেলা দুপুরের পর তুই আমায় টেনে হিচরে নিয়ে গেলি নদীর ধারে। আমাদের সেই নদী যেখানে সাতরে দুজন করেছি কত এপার-ওপার। আজ সে নদী আর নদী ইেন, এক ভাসমান কবরখানা। লাশগুলো ভেসে ভেসে কোথায় যেন যাচ্ছে চলে। আমরা দুটো প্রানী পুরোনো বাঁশের সাঁেকা পেরিয়ে গেলাম মিশে শরনার্থীদের দলে। অনেকদিন ঘরবন্ধি ছিলাম। জানিনা কবে যেন কে বলে গিয়েছিল দেশটা স্বাধীন হবেই, আমরা ফের উড়াতে পারবো আমাদের প্রিয় লাল-হলুদ ঘুড়িগুলো। অপরিচিতজনের অবহেলায়-অবহেলায় কিছু খেতে আর ঘুমোতে দিয়েছিলো। তবুও মঙ্গল হোক ওদের। পাকিদের মতো জানে তো মারেনি আর!

শেষে নয়টি মাস পার হলে ডিসেম্বরের এক সকালে কাঙ্খিত বিজয় এলো। পৃথিবীর বুকে এক নতুন মানচিত্রে লেখা হলো বাংলাদেশের নাম। সবার ঘরে ফেরা দেখে তুই আমায় বললি, চল নিষাদ ঘরে ফিরি। আমাদের বাড়ি ফেরা। কত কিছু দেখতে দেখতে বাড়ি ফেরা। লাল সবুজ একটা পতাকা নিয়ে বাড়ি ফেরা। চারপাশে হাহাকার নিয়ে বাড়ি ফেরা।

এক সকালে বাড়ি এসে গেট পেরিয়ে দেখি; আমাদের সে ঘর পাড়ার সবচে’ খারাপ লোকটা দখল করে বসে আছে। পাড়ার লোকেরা ওকে রাজাকার বলে আর আমি বলি দু’মুখো সাপ। হয়তো তব্ওু কম বলা হয়ে যায়। মৃতপ্রায় মাতৃভূমি ছাড়া আমাদের তখন কিছুই নেই, শুধু ভাঙাচোরা এই স্মৃতি ছাড়া। আমার বড়’দিকে তো পাকিরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল সে রাতে। আজও পেলাম না। আর অলকা বোন আমার না জানি কোথায় আছিস? কখনো দেখা হবে কি তোর সাথে? নাকি তুই কোন ফটোগ্রাফারের ফটোতে হয়ে গেছিস অসহায় মৃত কোন শিশু। অলকা, বড়দি যেখানেই থাকিস তোরা ভালো থাকিস।

আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি

আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি


আমি রনাঙ্গণের কথা বলছি
ইকরামুল হাসান শাকিল

রমজানের প্রথম প্রহর। চারপাশ অন্ধকার। এখনো মুয়জ্জিনের কণ্ঠে ফজরে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনী উচ্চারিত হয়নি। গ্রামের নিরীহ মানুষগুলো যে যা পারছে তাই দিয়েই রমজানের প্রথম সেহরী খাচ্ছে। ভয়ে কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। আমরা আমাদের দীর্ঘ একটি রাত পার করছি আমাদের বয়ড়াতল ক্যাম্পে। ১নং কোম্পানী কমান্ডার লোকমান হোসেনের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছি। রাত জেগে নানান পরিকল্পনা আর আর্মস্ প্রস্তুত করছি। আজ ভোরে বল্লা পাক আর্মি ক্যাম্পে আক্রমণ করবো। কোম্পানী কমান্ডার লোকমান হোসেনের নির্দেশ মতো আমির হোসেনের নেতৃত্বে আমরা ২৫ জনের একটি দল আক্রমণের জন্য প্রস্তুত।
আমির হোসেন পাক আর্মি হাবিলদার ছিলেন। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। নকিল বিলের খাল দিয়ে নৌকায় করে আমাদের বল্লার কাছাকাছি নামিয়ে দেয়া হলো। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে যাই। একটি দল পাক আর্মি ক্যাম্পের উত্তর পাশে গোরস্থানে পজিশন নেয়। অপর দলটি বেলাবাড়ি পজিশন নেয়। আমি ছিলাম বেলাবাড়ির দলে। আমাদের কাজ ছিলো, আমরা এ পাশ থেকে ডিফেন্স করবো। আর অপর দলটি উত্তর পাশ থেকে আক্রমণ করবে।
চারপাশ অন্ধকার। ফজরের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে কানে। আমরাও প্রস্তুত। কমান্ড পেলেই ফায়ারিং শুরু করবো। আমাদের কাছে এল.এম.জি, রাইফেল, টু/থ্রি ইঞ্চি মর্টার, রকেট লংসার ও গ্রেনেড। আমার কাছে এল.এম.জি। আযান শেষে আমির হোসেন আমাদের কমান্ড দিলেন। আমরা ফায়ারিং শুরু করলাম। পাক সেনারাও পাল্টা ফায়ারিং করছে। চলছে তুমুল যুদ্ধ। চারপাশ গুলাগুলির শব্দে কাঁপছে। বারুদের গন্ধ আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছ।
আমাদের দলে আমিই সব থেকে কমবয়সী ছিলাম। সেই কারণেই হয়তো আমির হোসেন আমাকে তার পাশেই রেখেছিলেন। যাতে করে আমি সাহস পাই। ফায়ারিং করতে করতে হামাগুড়ি দিয়ে আমরা সামনে এগুচ্ছি। আমার বাম পাশে আমির হোসেন। হঠাৎ একটি বুলেট এসে আমির হোসেনের বুকের বামপাশে মিশে গেলো। সাথে সাথে তার শাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে গেলো। আমি তাকিয়ে দেখি আমির হোসেন আমার দিকে জলজ চোখে কি এক অমুগ বেদনায় তাকিয়ে আছে। আমিও ফায়ারিং থামিয়ে তার মাথা তুলে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি শুধু আমাকে একটি কথাই বললেন। ফায়ারিং।  
দু’পাশ থেকে আমরা আক্রমণ করছি। চারপার দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। আজো পাখির ডাকে ভোর হলো। কোনো অনিয়ম নেই। গাছের পাতারা ভোরের শীতল বাতাসে গা দুলিয়ে দুলতে থাকলো আপন মনে। মনে হলো এরাও জয়ের আনন্দে মাতম করছে। যুদ্ধ থেমে গেলো। আমরা বল্লা শত্রুমুক্ত করে ফেললাম। ছ’জন পাক আর্মি মারা যায়, দু’জন আহত আর বাকিরা সবাই পালায়। আমরা জয়বাংলা ধ্বনিতে চিৎকার করে উঠলাম।
এই যুদ্ধে আমরা দু’জন সহযোদ্ধাকে হারায়। আমির হোসেন ও রকেটকে। দিনের প্রথম আলোতে বাংলার সবুজ ঘাস বারুদে পোড়া লাল রক্তে রাঙিয়ে সহযোদ্ধাদের প্রাণহীন দেহ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলছি। যুদ্ধের এই কয়েক দিনে কত আপন হয়ে গিয়েছিলো তারা। আগে কারো সাথেই পরিচয় ছিলো না। আর আজ বুকের ভেতরটা ভাই হারানোর ব্যাথায় নিরব অশ্রুক্ষরণ করছে। যুদ্ধ ক্ষেত্র বলে চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না। শুধু প্রাণহীন দু’টি দেহ নিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলছি। কুয়াশা ভেজা সকালে আমরা বেতুয়া চলে আসি। এখানেই তাদের সমাহিত করে  আবার ক্যাম্পে চলে এলাম।   
দশম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় ১৯৬৬ সালে আয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতিতে ঢুকে পরি। তখন থেকেই মিটিং মিছিলে যুক্ত হই। এই মিটিং মিছিল আন্দোলনের কারণে পড়া-লেখার উপর প্রভাব পরে। সেজন্য বাবা-মার অনেক কথাও শুনতে হয়েছে। স্কুল জীবনেই যেহেতু ছাত্র রাজনীতি করেছি। কলেজে এসে থেমে থাকি কি করে। যেখানে পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণে, বৈশম্যের স্টীমরোলার চলছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট দেশটির উপর। সেখানে চুপ করে বসে থাকি কি করে? দেশটাতো আমার। তাই দেশকে রক্ষার দায়িত্বও আমার। তাই প্রতিবাদ করতে হলে রাজনীতি বাধ্যতামুলক। একা কোন বৃহত্তর স্বার্থের আন্দোলন হয় না।
শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সোনার ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এলো মায়ের আঁচল থেকে, বেরিয়ে এলো প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে, বেরিয়ে এলো বাবা সন্তানের ভালোবাসা থেকে, বেরিয়ে এলো নারী দেশকে ভালোবেসে। তেমনি করে সেদিন আমিও ঘর থেকে বাবা মা ভাইবোনদের রেখে বেরিয়ে এসেছিলাম। বসে থাকতে পারি নাই। যদিও প্রথমে আমি আমার পরিবারে না জানিয়ে পালিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর ফিরে এসে আবার পরিবারের অনুমোতি নিয়েই গিয়েছিলাম যুদ্ধে।
অনেক দিন হলো যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। মা বাবাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কমান্ডার লোকমান হোসেনকে বাড়ি যাওয়ার কথা বললাম। আমাদের কোম্পানীতে আমিই বয়সে তরুণ ছিলাম। লোকমান হোসেন আমার পিঠ চাপড়ে মুচকি হাসি হেসে বলো যাও। তবে সাবধানে যেও। আমি রাতে বাড়ি এলাম। আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ছিলো। তবে সেদিন গলা ছেড়ে কাঁদতে পারেনি মা। তার চেপে রাখা সেই কান্নার মধ্যে যে কষ্ট ছিলো তা আমাকে আরো সাহসী করে তুলেছিলো। মা তার আঁচল দিয়ে আমার মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলেছিলো-“আমি তোমার এই স্বাধীন দেশ দেখেই যাবো।”
একবার আমরা চাপরি বাজারে আক্রমণে যাই। সেখানে যাওয়ার আগেই রাজাকাররা খবর পেয়ে যায়। তাই আমরা সেখানে সফল হতে পারি নাই। পরে যুদ্ধ শেষের দিকে সেখানে থাকা তিনজন রাজাকারকে আমরা বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মায়ের কাছে ফিরে আসি। আমার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমানও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসে।

আলোকিত এক অধ্যায়

আলোকিত এক অধ্যায়



আলোকিত এক অধ্যায়
সেলিম রেজা

এই দিনে ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে যুদ্ধে জয় লাভ করে বিজয় অর্জন করেছি। তাই তো ১৯৭১ইং এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক আলোকিত অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। বাঙালির চেতনাজুড়ে ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতির জীবনে স্বাধীনতা পরবর্তী বিজয় দিবসের গুরুত্ব অনন্য ও অসাধারণ।  দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ ও ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই বিজয়। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, মুক্তির দিবস। নতুন  স্বপ্ন, প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞার দিন। যে মহান শহীদেরা সবার স্বাধীনতা-মুক্তির জন্য, নিশ্চিত-সুন্দর জীবনের জন্য যে সীমাহীন ত্যাগ -স্বীকার করে গেছেন, তাঁদের সম্মান করা পরবর্তী প্রতিটি প্রজন্মের জন্য একান্ত  কর্তব্য।
আর এই ৪৬ তম বিজয় দিবসে প্রতিজ্ঞাবন্ধ হয়ে শপথ নিই জাতীয় স্বার্থে কোন বিভেদ, অনৈক্য, বিভাজনবিমুখ কর্মকান্ডে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন মান উন্নত হয় সেইলক্ষ্যে কাজ করা। হিংসা-বিদ্বেষ-অহঙ্কার ছুঁড়ে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব থেকে সরে এসে যেন আমরা একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়াই। 



আমার দেখা ইতিহাস

আমি দেখেছি মায়ের বিষণœ মুখ রক্তাক্ত নদী
চোখের জলে ভেসে যাওয়া কিশোরী
সিঁদুর মুছে যাওয়া সূবর্ণার চেহারা
আগুন বারুদের আঘাতে যুবকের লাশ হয়ে ফেরা
সাতপুরুষের ভিটে মাটি উজাড় লেলিহান শিখায়
লুটেরার দল হিং¯্র থাবায় লুটে গোলাপকলি, শাপলা-শালুক
শালিক, দোয়েল, কোয়েল, কৃষ্ণচূড়া, কদম, বেলি, শিউলি
শান্তির ভিত নড়ে হারায় ঠিকানা
ক্ষুধার্ত পশুর নখরে ক্ষত-বিক্ষত শ্যামল ছায়া
ন্যুব্জ সময় বিধ্বস্ত ভূখ-ে লক্ষ লাশের সারি
রক্তের অৎ¯্র ঢেউয়ে ভাসমান ইতিহাস
হায়েনার বীভৎস অত্যাচারে শকুনের ঝাঁক
বদলায় প্রেক্ষাপট
গর্জে মিছিলের ধ্বনি প্রতিবাদী রক্ত শিরা-উপশিরায়
অবশেষে বিজয়; উনিশশত একাত্তর একটি ইতিহাস
একটি স্বপ্ন একটি দেশ
সবুজ জমিনে ঝরে পড়া রক্তজবা-বাংলাদেশ।


বুকের রক্তে লেখা বাংলাদেশ

তাজা রক্তের ¯্রােতে বহমান শত নদী, বধির সময়ে অধির মাটি ও মানুষ। রাজপথে মুক্তির মিছিল জয়ের মুকুট ছিনিয়ে আনার দীপ্ত শপথে। শত কন্ঠে একটি সুর, একটি গান মুখরিত একটি দেশ। পিশাচদম্ভের অবসান, সাক্ষী কালের করোটি; দামামা বাজিয়ে আছড়ে পড়লো সংগ্রামের ঢেউ, জেগে উঠলো বাংলা- হলাম বিজয়। উড়লো পতাকা মুক্ত আকাশে নিল শ্বাস। বুকের রক্তে লেখা বাংলাদেশ রচিত ইতিহাস......

বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ

বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ



বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ
সাদিক আল আমিন

বিজয় হলো একটি জাতির সর্বোচ্চ অসাম্প্রদায়িক রূপ। যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ কিছু সংস্কৃতিকথা, উচ্ছল মানবিকতা ও ব্রতপালন ফুটে ওঠে। যেই নয় মাস ব্যাপী ক্ষতবুক জখম নিয়ে বিজয় আমাদের বুকে স্থান পেয়েছে, তা নিয়েই দীর্ঘবছর ধরে বেঁচে আছে বাঙালী। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এক গুরুদায়িত্ব বহন করে এ বিষয়। সাহিত্যে এর প্রকাশ প্রকারান্তরে সম্পূর্ণই বলে মনে করি। কেননা একটি জাতির মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্র্যতা ও অনন্য রুপময়তা কেবল নিজের ভাষাতেই বোধগম্য এবং ভাব প্রকাশে সমর্থ ভাষাতেই ফুটে ওঠে ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির রুপলাবণ্য ও ব্যঞ্জনা।
‘৭১ এর সুস্মৃতির সাথে একজন বাঙালী খুঁজে পায় বৈষম্যহীন এক জাতির খোঁজ। সে নিজেকে বাঙালী ভেবে গর্ববোধ করে। ১৬ই ডিসেম্বরের বৃহস্পতিবার যেন মনে করিয়ে দেয় গুরুতর প্রতিশোধ-পরায়ণতা-পরবর্তী এক সুখকর বিলাসী  সৌন্দর্যের; ফিরিয়ে দেয় জাগতিক সমূহ সুখের উৎস, যার মাঝেই নিহিত থাকে হাজার হাজার বিজয়, যার স্রষ্টা লক্ষ কোটি বাঙালী।


লালরঙা চোখ

উপচে পড়া রক্ত থেকে হারিয়ে গেছে চোখ
ব্যস্তদিনের স্বপ্নগাঁথা পাখির মতো উড়ে যাও লীন
নির্জীব দেহে এঁকে ফেলো পতাকার চেনা রঙ
লাল কিংবা সবুজ- পিঞ্জরবদ্ধ প্রভাতে স্নানীয়
পটভূমিকা তার সমুজ্জ্বল খেলা দেখায়...
বিচিত্র জাদুর তুলিতে এঁকেছো বিজয় তুমি
হে মহা মনোহর সৈনিক...

মঞ্চস্থপূর্ব সফল নাটকের অভিনেতা সেজে
সমূহ কাহিনীর বুকে লেপেছো বিজয়-আস্তরণ
‘৭১ এর আকাশে, পাখিদের মিছিলে উড়িয়েছো
রঙিন পতাকার হৃদয়, যেখানে একদিন রক্ত ছিল
লাল বৃত্তাকার; হে মহা মনোহর সৈনিক-
নয়মাস পর এক শকুন খুঁজে পায় তোমার
স্বপ্নিল, যুদ্ধক্লান্ত হারিয়ে যাওয়া সেই লাল-চোখ


মানচিত্র

আসন্ন মজলিশ চত্তরে উল্টোমুখী দুঃখের কারাগান
গাইতে থাকে ক্ষতবুক জখমিত এক নিরীহ বাঙাল
অপেশাদার যোদ্ধার ঘামে আঁকা আছে যাদের নাম
যারা কর্তব্যরত আছে এই দীর্ঘ সময় ধরে- তারা
সময় বুঝে বানিয়ে ফেলে এক দৃশ্যমান স্মৃতিনাম
‘মানচিত্র'; আছে সেই সময় থেকেই- প্রতিবাদী শরীরে

বিজয় বলি তাকে

বিজয় বলি তাকে




বিজয় বলি তাকে
সৈয়দ শরীফ

বিজয় আমাদের খুব স্বাদের, খুব শখের, খুব পরিশ্রমের একটা রঙিন সূর্য। যাকে আমরা সহজে পাইনি; স্বাদরে পাইনি । আমাদের মহামূল্যবান এবং খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে কিংবা প্রতুল ত্যাগ স্বীকার করেই পেয়েছি এই বিজয় । তাই এই মহান বিজয় বাঙালীর কাছের সব চেয়ে দামী এবং গর্বের । বিজয় বলি তাকে-  বাংলা ভাষায় ‘আম্মা’ ডাকি আমারই আম্মাকে.. বিজয় বলি তাকে-  আমরা ভালোবাসছি সবাই বাংলা কবিতাকে..





একাত্তর একটি অভিধান

কিছু বুলেটের শব্দে ঝলসে গেলো রাত;
বুটের আঘাতে বিধ্বস্তসবুজ প্রান্তর !
মৃত্যুর মিছিলে বিভৎসিত প্রাণ-
স্বজনহীনতায় বুক চিরে খায় আত্মচিৎকার।
ঘুমন্ত ঘাসের তলে বেজে ওঠে মৃত্তিকার ক্রন্দন-
কেঁপে ওঠে বৃক্ষ ফুল শোভিত উদ্যান;
পাখির কণ্ঠে নেমে আসে মৌনতা;
ক্রন্দন ও হাহাকারেই এসে পরে রাতের কিনার।

রোদের ইশারায় ফুটে ওঠে রাত্রব্যাপি চিরে
খাওয়া নারীর বিভৎস শরীর-
(যেন ক্ষুধার্ত শকুনের খামচানো কোনো প্রাণী)
তারপর কিছু স্বপ্নের আহ্বানে একত্র বীর;
খোঁজা শুরু ‘স্বাধীনতা’ শব্দের মানে-
চোখে-মুখে মুক্তির পিপাসা; একাত্তরের অভিধানে
টানা ন’মাস অনুবাদ করে খুঁজে পাওয়া গেলো
শব্দার্থ হলো ‘বাংলাদেশ....’


মানচিত্রের কল্পনা

তারপর পৃথিবীর বুকে একটি মানচিত্রের কল্পনা;
বিশ্বের প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে দ্যাখানো হলো রক্তাক্ত সিনেমা-
অথচ তখনও পৃথিবী এটাকে শুটিং ভেবে তামাশা করছিল !
বিশ্বের কোনো এক রাষ্ট্রে তখনও কোনো হলরুম ছিল না;
রক্তের স্রোতে কল্পিত মানচিত্র তলিয়ে গ্যালো- পাঠানো হলো কিছু দমকল;
হঠাৎ খবর পাওয়া গ্যালো- যে দেশে তামাশা নামক কোনো হলরুম আছে,
সে দেশে স্রোত থামানোর কোনো দমকল নেই।

তারপর তলিয়ে যাওয়া মানচিত্রে কপাল ঠ্যাকালো দমকল;
মুক্তির সাথে হাত মিলিয়ে শুরু হলো স্রোত থামানোর চেষ্টা-
অতঃপর- স্বপ্নের স্রোতে ভেসে গ্যালো সে রক্ত !
শুধু রয়ে গ্যালো কিছু রঞ্জিত দাগ।
(বন্যার পরে কিছু দাগ তো লেগে থাকবেই)

স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষ আসলে কি স্বাধীন ?

স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষ আসলে কি স্বাধীন ?

স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষ আসলে কি স্বাধীন ?
মিসির হাছনাইন

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ। বিজয়ের লাল সবুজের পতাকার বুকে ষোলকোটি মানুষের বসবাস। বিজয়ের এই মাসে আমরা স্বাধীনতা খুঁজি, বিজয় খুঁজি ।
আমরা বাঙালী ভুলে যাই। স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষ আসলে কি স্বাধীন ?
প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে বেড়ে উঠুক আগামীর বাংলাদেশ। বিজয়ের এই আনন্দ বয়ে যাক দেশের ষোলকোটি মানুষের ঘরে ঘরে। ভালোবাসি বাংলাদেশ।






মুকিদ পাগল

কুড়িল বিশ্বরোড। মুকিদ পাগল। যাঁর চোখের ভিতরে ঢুকে গিয়ে দেখে এলাম আমার পরিচিত চাঁচড়া গ্রাম। সেখানে সাদা কালো ইচ্ছের রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ে।

মুকিদ বেসুর গলায় গান গায়। রাস্তায় ঘুমায়। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়, রোদে পুড়ে ছারখার হয়, নীল জোছনা প্রেমে মাতাল হয়। এই শহরের সমস্তটা তার নামে লেখা।মুকিদ স্বপ্ন দেখে না। তাঁর কোন ইচ্ছে নেই। যখন খুশি হাসে যখন খুশি কাঁদে। মুকিদ পাগল পেয়ে গ্যাছে একটা স্বাধীন দেশ আর আমি বা আপনারা স্বাধীনতা খুঁজি যত্রতত্র। মুকিদের ভিতরে আমি পেয়ে গ্যাছি আমার স্বদেশ।


মিছিল


দীর্ঘ রাতে মৃত্যুরা হাসে
বেসুরো সঙ্গীতের মাতম আর
ধ্বজ নৃত্যের ভাঁজে
মৃত্যুরা শোনায় যৌগিক মৃত্যুর গল্প
তাঁরা হাঁটে এবং পৃথিবীতে ছুঁড়ে 
মারে ভায়াল অধিক্ষেপ
চারদিক নন্দন সুরে আক্ষেপ
মৃত্যুরা মৃত্যুর অভিশাপ
দেশে দেশে মৃত্যু আসহাবে কাহাফ
এদিকে ওদিকে নৃত্যরত মিছিল।

এই বিজয় অনেক গর্বের

এই বিজয় অনেক গর্বের



এই বিজয় অনেক গর্বের
সুমন আহমেদ

বাঙালী জাতির জীবনে বিজয় দিবস অনন্য ও অসাধারণ একটি দিন। এই দিনটি আমরা খুব সহজে পাইনি। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে..... লক্ষ লক্ষ শহীদ বাঙালী,  মা, বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে  পেয়েছি; অনেক ত্যাগ- বিসর্জনের মধ্যে দিয়েই অর্জন করেছি এই বিজয়; এই স্বাধীনতা । বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ আজ মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে । তাই বাঙালী জাতি হিসেবে আমরা গর্ব করে বলতে পারি যে, আমাদের একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক; আমরা বিজয় । আর বাঙালী হিসেবে প্রত্যেক বিশেষ ভাবে সচেতন হতে হবে; যেন আমরা আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতার বিকৃত ব্যবহার না করি । 


স্বাধীন বাংলাদেশ

স্বাধীনতা তুমি- হিং¯্র দানবের শিকার শিশুর মতো উলঙ্গ
জননীর গায়ে পরিয়ে দিয়েছ বারো হাত শাড়ি; ধর্ষিতা জননীর
পিতৃহীন সন্তানকে গড়ে দিয়েছ মাথা গোঁজার ঠাঁই,
স্বাধীন বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা তুমি- দিয়েছ মা বলে ডাকার অধিকার,
শিখিয়েছ অন্যায়ের কাছে মাথা না করতে;
স্বাধীনতা তুমি- শোষকের শত অত্যাচার নির্যাতন অবহেলা,
মাথা নত করে উপেক্ষা করোনি- কন্ঠে প্রতিবাদের শ্লোগান,
হাতে তুলে নিয়েছ অস্ত্র করেছ শত্রুকে পরাস্ত।
স্বাধীনতা তুমি- পাক হায়েনার দালাল দেশদ্রোহী
ঘাতক রাজাকারদের নৈরাজ্যের দেশ বানাতে দাওনি,
বিশ্বের মানচিত্রে রেখেছ বাংলার স্থান- 
অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রগতিশীল একটি দেশ।



ভোরের রক্তিম সূর্যের আভায়

স্বাধীনতা তুমি আসবে বলে- কত অবলা স্বামীহারা হয়েছে
বিধবা; অঙ্গে জড়িয়েছে সাদা কাফনের কাপড়।

হায়েনার হিং¯্র থাবায় পারেনি রক্ষা করতে শেষ সংভ্রম,
ভাইয়ের সন্মুখেহে ধর্ষকের শিকার হয়েছে বোন।
সেদিন আকাশ কেঁপেছে বাতাস কেঁপেছে- সন্তানহারা
অসহায় জননীর বুকফাটা আর্তনাদে।

কতশত রাত প্রতীক্ষা করেছে একটি ভোরের প্রত্যাশায়;
যেই ভোরের রক্তিম সূর্যের আভায় মৃদু সমীরণে উড়িবে
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রাঙা, বিজয়ের লাল-সবুজের পতাকা।

বিজয়ের পদাবলি

বিজয়ের পদাবলি




বিজয়বোধ
সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

বিজয়ের বুক জুড়ে সুর আছে তাই,
অবিরত প্রেমমোহে গান গেয়ে যাই।
হাওয়ার শরীরে আঁকা কুহু কলতান,
ফুটে থাকে বুকে বুকে চেতনার গান।

প্রাণের বুলিতে আছে স্বচ্ছতা তাই,
বিজয় শিশিরে সব গতি খুঁজে পাই।
আজো ঘাস বুকে রাখে রক্তের ঘ্রাণ,
শহিদের খুন- তার রেখেছে প্রমাণ।

অতপর পলাশ আর শিমুলের বনে,
জেগে আছে- শহিদান দেশ স্মরণে।
কোকিলের গানে রবে বাংলা বহাল,
চিরচেনা কুহু সুর বাজে- চিরকাল।

বিজয়ের পোস্টার
শাহীন মাহমুদ

আজ বৃষ্টিতে ভিজে গেলো বিজয়ের পোস্টার
ভিজে গেলো বিজয় দিবসের একটি অনন্য কবিতা
যেখানে লিখা ছিল বীর শ্রেষ্ঠ সাত জনের নাম
লিখা ছিল নুর হোসেনের পিঠ থেকে ঝরে পড়া রক্তের কথা
লিখা ছিল অনাহারী মুক্তিযুদ্ধা সন্তানের কথা
লিখা ছিল রাশিয়ান সোলজারের কথা
লিখা ছিল তিব্বতি সোলজারের কথা
যারা প্রাণ দিয়েছিল এ দেশে এসে ।
মহান বিজয় ,স্বৈরাচার,অতঃপর আমার গণতন্ত্র
সাপুড়ে বীণ নর্তকীর নৃত্য; অতঃপর বাতের বড়ি
হাটুরে পথিক ঠেলে দাও সব ;যা আছে পকেটে
আজ অসময়ে বৃষ্টি কেন ?ভিজে গেলো আমার দেশ
ভিজে গেলো আমার বিজয়ের পোস্টার । 


ভিক্ষা মাগছো অরিন্দম হাতে
আকিব শিকদার

তুমি বাপু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, স্বজনহারা
তুমি আমাদের গর্ব, স্বাধীনতার প্রতীক।

পরিজনদের মরতে দেখেছো চাক্ষুষ। হানাদারের দল
ধরলো তোমার বোনকে, বারান্দাতেই কাপড় ছিঁড়ে করলো তাকে ধর্ষণ।
পাশবিকতার চূড়ান্ততায় জ্ঞান হারালো সে যে। বোনের সে জ্ঞান
ফিরলো না আর একটি ক্ষণের তরেও।
তোমার বাবা সে কি বোকা, পাগল হয়েই গিয়েছিলেন...!
(মেয়ের আর্তচিৎকার) রুধতে গিয়ে পশুর ছোবল
বুলেট বোমার ফাঁদে নিজেই দিলেন প্রাণটি।
জন্মাবধি তোমার মা তো প্রবল স্বামীসেবক, রক্ত¯œাত
পতির ছিদ্র বুকে ঝাপটি দিলেন তিনি। তিনটে তাজা বুলেট-
সহমরণের নব নমুনা।

বউটি তোমার ধূর্ত বটে, এবং স্বার্থপর।
জানতে পেলো সতীত্ব তার নষ্ট হবে নিশ্চিত, আগেভাগেই
ঘরে ঢুকে দ্বারে দিলো ছিটকিনি।
ভাঙলো যখন দুয়ারখানা হানাদারের পদাঘাতেÑ
দেখলো তারা শিকার তাদের ঝুলে আছে ছাদে, গলায় দড়ি
প্রাণ দিয়েছে মানটি তবু দেয়নি।
তোমার যোগ্য ছেলে, সাহস আছে বলতে হবে। জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলো
পাকসেনাদের পিঠে, ফলাফলে মরতে হলো
বেয়নেটের খোঁচায়।
তোমার একটা ভাই ছিলো না একটু হাবাগোবা ...?
হানাদারের খায়েশ, আয়েশ করে মারবে তাকে। গাড়ি চাপিয়ে
ক্যাম্পে নিলো বাঁধতে বকুল ডালে। লাত্থি ঘুষি, লাঠিপেটা-
মজাই অন্যরকম...!
যাবার বেলায় বাড়ির ভিটায়
উসকে দিলো আগুন। সেই আগুনে ঘটলো একটা বিস্ময়কর কা-।
তোমার খুকি মায়ের মতোই বেজায় রকম চালাক-
ভীতির তোড়ে লুকিয়ে ছিলো আলমারিটার পাশে। আগুন তাকে
দেখিয়ে দিলো চিরঅজানার পথ।

নিজের হাতে দেশকে করলে স্বাধীন, শত্রু মুক্ত।
যদিও আচম্বিতে যুদ্ধকালে
খুইলে একটা পা, বাহুর পেশি গুলির চিহ্ন
করছে বহন আজও। বন্দুক চালানো আঙুলগুচ্ছ
ধরলো আকড়ে লাঠি।
ল্যাংড়া মানুষ, কে-ই বা দেবে কাজ, কে-ই বা দেবে খাদ্য-
বাধ্য হয়েই ভিক্ষা মাগছো অরিন্দম হাতে। যে দেশ তুমি করলে রক্ষা
সেই দেশেরই বাসিন্দাদের অট্টালিকার ফটক পাশে-
অবজ্ঞা আর করুণা কুড়ানো, এই কি তুমি চেয়েছিলে ...?

তুমি বাপু বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, জেনেছো স্পষ্ট-
তুমি আমাদের গর্ব, স্বাধীনতার প্রতীক।


আমি খেটে খাওয়া মানুষের দল থেকে উঠে এসেছি
দেলোয়ার হোসাইন

দাঁড়িয়ে আছি বলে ভেবনা থেমে আছি
কৃষকের ছেলে আমি, খেটে খাওয়া
মানুষের দল থেকে উঠে এসেছি...

আমার চরিত্রে নগ্নতার কোন কলঙ্ক নেই
যদিও উরুর উপরে লুঙ্গি কাছা মেরে
নাভি অবধি কাদায় ডুবে আমি তুলে
এনেছি সোনালী শস্যের দিন, ঘামে
ভেজা শরীরে সহজাত বোঝা কাঁধে
নিয়ে আমিও ছুটেছি ফেরাতে সুদিন...

নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিতে আমার
কোন লজ্জা নেই, যদিও ভোরের
কোলাহলে কৃষক বাবার সাথে নিজেকে
সপে দিয়েছি কামনার ভিতর, কড়া
রোদের দুপুরে ক্লান্ত অবয়বে আমিও
ঘুমিয়ে পড়েছি আলের উপর...

আমার বিশ্বাসে কোন সন্দেহ নেই
যদিও তোমাদের মুখের আদলে আমার
আর কোন মুখ নেই, তোমাদের লম্বা
হাতের মতো আমার কোন হাত নেই,
তোমাদের চোখের মতো আমার কোন
চোখ নেই, তোমাদের ঘরের মতো
আমার কোন ঘর নেই, তোমাদের
গল্পের মতো আমার কোন গল্প নেই...

কৃষকের ছেলে আমি, খেটে খাওয়া
মানুষের দল থেকে উঠে এসেছি...