ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১১০

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১১০
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১১০
বৃহস্পতিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯




















পদাবলি

পদাবলি






শিরোনামহীন
রেবেকা ইসলাম

মনটা আজ বিষাদগ্রস্ত হয়ে আছে
মনের অভ্যন্তরে বিষণœ দুপুর
শুষ্ক, নির্জলা চৈত্রের খরখরে আবহ,
কিসের তাড়নায় যেন তাড়িত
এক বর্ণনাতীত রিফ্লেক্সন,
অব্যক্ত ভাবনাগুলোর ক্রমাগত চাপ
মনের ক্যানভাসে কৌণিক আঁকিবুঁকি
ছোপছোপ দাগ, গড়িয়ে পড়া রঙ
গাঢ় কালচে-নীলের প্রাধান্য
যেন শিল্পীর আঁকা বিমূর্ত কোন চিত্র;
দুর্বোধ্য জটিল রহস্যময়,
ভাসা ভাসা, বোঝার সাধ্য নেই,
বুঝবে বিদগ্ধ কোন অহংকারী মন
শত সাধনায় পরিশুদ্ধ প্রাকৃতজন...
হয়ত সেই অপেক্ষায় বসে থাকা
সেই আশাতেই সময়কে না বেঁধে
অবিরাম চলতে দেয়া।


এলাহী বিচ্ছিন্নতা
সাদিক আল আমিন

রোদ ভালোবাসো। তবে তোমার কামুক কায়া ‘ভিটামিন ডি’র খোঁজ রাখেনি কোনোদিন। কোনোবেলা তুমি নিখোঁজ হতেই দশ নম্বর লেনের ভাঙাচোরা বাইক-অলা গুন্ডাটা সরদারি করতে করতে পুরো মহল্লা মাথায় তোলে। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে দমকল বাহিনী ডেকে ফেলে ক্ষণিকেই। নিত্যই, তুমি পায়রার পেখমে চড়ে বোটানিক্যালে যাও। তোমার উদ্যমপরায়ণ প্রতিষ্ঠিত স্বচ্ছল প্রেমিক সেখানে নিঃসাড় মনে বসে থাকে অদ্ভুত অপেক্ষায়।
জীবন যাপনের নির্দিষ্ট তালিকা করতে করতেই আবার গর্ভবতী হয়ে ওঠো। এখনো তো ভরপুর যৌবনের আমেজটুকুই কাটলোনা! তোমার বার্ষিকীতে বাইক-অলা গুন্ডাটা একবাক্স রোদ উপহার দেয়। তুমি হয়তো কি না কি আছে ভেবে সেই মোড়ক কখনো খুলেই দেখোনি!
সন্ধ্যাতারা সব থরে-বিথরে জেগে আছে দশতলা বাড়ির ওপর। আজ দুপুরে কড়া রোদ ছিলো তাই এখন ভরা-আকাশ তারা, প্রোজ্জ্বল মায়ায় তাকিয়ে। এই রাতে সাংসারিক কাজকর্মে ভীষণ ব্যস্ত তুমি। আমি দর্শক এক প্রেমিক হয়ে ব্যর্থপ্রেম কবিতা লিখি, চাঁদোয়া খেরোখাতায়।



ঘ্রাণ
লুৎফুন নাহার লোপা

একবার আকাশের নীল গন্ধেই
প্লাবিত হয়েছিল পুরোটা সমুদ্র,
প্রায়ই জল থেকে বেড়িয়ে আসতো
শুন্যতা, মাটির সম্পর্ক, গভীরতা,
দেখি, যতটুকু চাইতে পেরেছি আমি
একটি অসম্পূর্ণ রাতের আবহে
ঘুমহীন বিবৃতি-  
অথচ কতনা ঘ্রাণ সময় বিশেষে
ভুলে যেতে হয়েছে আমাকে,
বাতাসের কম্পনের ভেতর সময়
কেটে গেছে প্রেম, পরবর্তী দিনগুলো।


অনুরোধ
ইসমত জাহান লিমা

কোন এক খেয়ালী সন্ধ্যায়-
জোনাকির আলোর জ্যামে,
আমার চিরচেনা দু’টি চোখ দেখলে
তোমার কি খুব ভয় করবে পূজারী?
অথবা, তোমার রাখা স্মৃতি মনে করলে
আমায় কি শাপ দিবে?
তোমার উড়ন্ত মন পায়রার পালকগুলো
শৈত্যেপ্রবাহে খসে পড়লে
আমি অঞ্জলি ভরে ধরতে গেলে
সেই শাপে আমার হাত দু’টি কি পুঁড়ে যাবে?
নাকি হেলেঞ্চা লতায় দোলানে তোমার কাঁপা শরীর
বাতাসের বেগে ছুঁয়ে দিলে আমার পাপ হবে?
কিংবা সিঁড়ি ঘরের আবছা অন্ধকারে,
চাতক কৌতূহলে তোমায় ভাবলে কি আমার জাত যাবে?
পূজারী শোন,
যখন আমি থাকবো না-
একটা মরা শালিকের বুকে দূর্বাঘাসের বীজ বুনে দিও।
যখন শীতের খটখটে প্রেমে শুকনো বিলে
টুপ টুপ শিশির জমবে,
তখন আমাকে ভেবে একদম কাঁদবে না।
ভাবনার করিডোর খুলে দিও-
ডানার ঝাপটা মেরে উড়ন্ত বলাকারা
উড়ে চলে যাবে তোমার মনের অলিগলিতে।
তুমি শুধু বালুকা বাতাসে বুনো প্রেমের নাটাইটা ধরে রেখো,
বাঁশপাতা পুড়িয়ে অনুরোধের শীতার্ত হৃদয়ে
উষ্ণতার চাদর গায়ে ওম দিও।







অস্থির কোলাহল

অস্থির কোলাহল




অস্থির কোলাহল
আজাদ মণ্ডল

আজকের অভিমানটা কবি অর্নবের মনে হচ্ছে মন হতে নয় হৃদপি-ের কোন এক জায়গা হতে উৎপন্ন হয়েছে! তা না হলে সকালবেলার অভিমান দুপুর গড়িয়ে যাওয়া যাওয়া অবস্থা তারপরও বেটা থাকে কেমন করে?
বড় ধরনের চিন্তায় পড়ে গেলেন অর্নব। একজন কবির শরীরে সারাদিনমান অভিমান বয়ে বেড়ানো আর কচুগাছের সাথে গলায় দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়া একই কথা, মানে কথার কথা, দুটোই কেবল সময় অপচয়, এইসব আলতু-ফালতু বিষয় নিয়ে সময় অপচয় করা কী কোন কবিকে মানায়? কিন্তু অভিমান তো যাচ্ছে না, হৃদপি-ের দরফর করার সাথে বেটা কেবল এপাশ-ঐপাশ করছে! মন হতে উৎপত্তি হলে না-হয় নানারকম যুক্তি-টুক্তি দিয়ে কিংবা একটা কবিতায় অভিমান ফুটিয়ে  খালাস পাওয়া যেতো! নাহ্, এতো ভালোই যন্ত্রণা, যখন তখন যেখানে সেখানে আজকের অর্ন্তগত অভিমান তার ফুলে-ফেঁপে ভাপা পিঠা হয়ে যাচ্ছে আর সেই ভাপা পিঠার ধোঁয়ার সাথে বের হচ্ছে  আজকের দিন শুরুর বউয়ের সাথে অভিমান, মায়ের সাথে অভিমান, পাড়ার চায়ের দোকানদারের সাথে অভিমান!
বউয়ের সাথে অভিমান পর্বের ঘটনাঃ (কথোপকথন সেই সময় অনুযায়ী)
-আজকেও কী সর্বনাশের মেলায় যাবে?
সাতসকালে বিছানায় শুয়ে বউয়ের ভয়েচটোন শুনে অর্ণব প্রথমে ভরকে গেলেন, তার কাছে মনে হলো অভিনয়ের সময় যাত্রাদলে যে কূটনি রাণী থাকে এই ভয়েচ তার! নাহ্, যোগ্য জিনিস যোগ্য জায়গায় নাই! সাতসকালে একজন কবির বউয়ের কন্ঠস্বর থাকবে পৌষ মাসের রোদের মতো, কন্ঠস্বর শুনেই যেন মনে হবে একটা কবিতা লেখে ফেলি ! কিন্তু একি সাতসকালে কর্কশ রাণীর মতো ভয়েচ!
আর সর্বনাশের মেলা আবার কী? হচ্ছেটা কোথায়? আর ইতিপূর্বে সে তো সর্বনাশের মেলায় কখনও যাননি! কিন্তু বউয়ের কথা অনুযায়ী সেতো গেছেন, কিন্তু কবে কখন কিভাবে গেলেন,তার তো কিছুই মনে নেই! নাকি কানে সে ভুল শুনলো! তাই হবে হয়ত কিন্তু যদি সে ভুল শুনেই থাকে তবে তো সেটা মারাত্মক চিন্তার কথা, একজন কবির জন্য সবচেয়ে ইম্পটেন্ট শরীরীয় অঙ্গগুলোর মধ্য অন্যতম হলো কান! সেই কান যদি ভুল শুনে তবেতো বড় রকমের বিপদ!
-কী ব্যাপার, কথা কানে ঢুকছে না? নাকি মাইকিং করতে হবে?


বউয়ের দ্বিতীয় প্রশ্নেও অর্ণবের মনের মধ্য খচখচ রয়েই গেলো। কবিদের এই এক সমস্যা মনের মধ্য একবার খচখচানি শুরু হলে আর থামাথামি নাই, নদীর পানির মতো কেবল বইতেই থাকে বইতেই থাকে।
অর্ণব বিছানা থেকে উঠলেন, তার বিরোক্ত লাগছে আজ এই খচখচ কোন নদী হতে কোন নদীতে যায় কে জানে?
-কী ব্যাপার রূপবান, সাতসকালে তোমার কন্ঠে মনে হচ্ছে আক্ষেপের সুর? বিশেষ কোন অসুবিধা?
(অর্ণবের বউয়ের অরজিনাল নাম সারিয়া কিন্তু সে বউকে একেক সময় একেক নামে ডাকে, এই ডাক গৃহে শান্তির জন্য। আবার মাঝে মাঝে ঘোষেটি বেগম বলেও ডাকে তবে সেটা একান্ত গোপনে)।
 -আজাইরা সরবিকলা বাদ দাও! বলি তোমাদের সর্বনাশের মেলা শ্যাষ হইছে?
এইবার অর্ণব কান বিষয়ক চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারলো তার ময়না পাখি সর্বনাশের মেলা বলেই প্রথমে তাকে প্রশ্ন করেছিলেন আর তার কাছে সর্বনাশের মেলা বলতে অমর একুশের বই মেলা। কিন্তু সে সরবিকলা কেন বলছে? বলতেই যদি হয় তবে বলতে হবে ছলাকলা বা হবুকলা! অর্ণব বসে বসেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, আহ্, একই সমস্যা, উপযুক্ত জিনিস উপযুক্ত জায়গায় নাই! শব্দ ছন্দ নিয়ে যার নিত্যকাজ তার ঘরের মধ্যই ছন্দ পতন! আর একজন কবির বউ হয়ে সে কিভাবে পবিত্র বইমেলাকে সর্বনাশের মেলা বলছে? হাউ? অর্ণবের কেন যেন মনে হচ্ছে কবি বুদ্ধদেবের ( বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক) রাজপ্রসাদেও এই জাতীয় সমস্যা ছিলো আর এই জন্যই কবি মনের দুঃখে বনে চলে গিয়েছিলেন!
অর্ণবেরও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে বনবাঁদারে চলে যায়, কিন্তু সে যেতে পারে না, কারণ বান্দরের ভয়! এই পৃথিবীর অর্ণবের আর কোন কিছুতেই ভয় নাই, ভয় কেবল একটি মাত্র প্রাণীতে সেটা হলো বান্দর। বউকেও তার মাঝে মাঝে মনে হয় বান্দর!
-সখী তুমি কী, সর্বনাশের মেলা বলতে এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকরা যেখানে মিলিত হয়, শত সহস্র নতুন বইয়ের পাতার গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ করে, আর সেই সুবাসে আন্দোলিত হয়ে রঙ্গিন শাড়ির আদর গায়ে জড়িয়ে শত শত রমণীকূল মাথায় বিভিন্ন ফুলের মালা পড়ে ছুটে আসে, ছুটে আসে নর,  ছুটে আসে সবুজ বাংলার ভবিষৎ কর্ণধার সেই ছোট ছোট সোনামনিরা, সেই প্রাণের বইমেলাকে বুঝাতে চাচ্ছ?
-এতোক্ষণে কৃষ্ণ বাঁশীর সুর তবে খুইজ্যা পাইলো?
-বউ! তুমি কী বলছো এইসব? তোমার তো পাপ হবে, তুমি একজন কবির বউ হয়ে কী করে বইমেলাকে সর্বনাশের মেলা বলতে পারো? হাউ?


-ওরে আমার পিতলা কবিরে! সর্বনাশের বললে পাপ হবে? বলি, কবিতা লেইখ্যা আর বইমেলায় দিনরাত শুয়ে থাইক্যা লাভটা কী? গত তিন বছর ধরে আমি তো কেবল সর্বনাশই দেখলাম রে পিতলা!
সাহিত্যে লাভ লসের বউয়ের হিসাব নিকাষের সুর শুনে অর্ণবের ভিষণ রকম অভিমান হলো, এই জন্যই মনে হয় কবি চ-িদাস বাবু বলেছিলেন মেয়ে মানুষ (বউ) আর ঢোল সর্বদাই মাইরের উপড় রাখতে হয়! কিন্তু অর্ণব বউকে কখনও দৃষ্টিগোচর মাইরের উপর রাখতে পারে না। সে যাই করে বেশির ভাগ সময়ই মনে মনে।
-মনি, তুমি একজন কবিকে অবজ্ঞা স্বরে নাম বিকৃত করে সাতসকালে বকাবকি করছো, তোমার তো অভিশাপ লাগবে! সেই অভিশাপের আগুনে তুমি তো ছারখার হয়ে যাবে!
-আমার কপালে আগুন তো সেই বাসর রাত হতে তুই কবিতা লিখে শুনানোর পর থেকেই শুরু হয়েছে রে বদ! আমি তোর ঢংয়ের কবিতার আগুনে পুড়ে তো সেই কবে থেকেই অঙ্গার হয়ে গেছি আর যাচ্ছিই!
এইবার আর অর্ণব বিছানায় বসে থাকতে পারলেন না, বউয়ের কন্ঠস্বর রেখটার স্কেলের দশ বরাবর উঠে গেলে সেখানে বসে থাকা তো দূরের কথা, দৌড়েই কূল পাওয়া যায় না! অনেক ক্ষণ, এলোমেলো কথাবার্তা বলার পড় তার বউয়ের কথার ব্যালেন্স জিরোতে নেমে তুই মুইয়ে চলে এসেছে!
অর্ণব  বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো, সাতসকালে তার গৃহে যে ঝড় উঠেছে তা সহসা থামবে বলে মনে হচ্ছে না, তা সে যতই ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলুক না কেন। থামবে তবে চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার হবার পর, পাশের রুমে আবার মা শুয়ে আছে, সমস্যা হচ্ছে বউয়ের সাথে সাথে অর্ণেবর মাও একজন কবির জন্য সম্মান হানীকর কথা বলে। আবহমানকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে বউ-শাশুড়ির মতামতের যে অমিল থাকে অর্ণবের গৃহে তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অর্ণব কিছুতেই বুঝতে পারে না একজন বউ আরেকজন মা তার কবিতা লেখার প্রতি এতোটা বিরোক্ত কেন?
মায়ের সাথে অভিমান পর্বের ঘটনাঃ (কথোপকথন সেই সময় অনুযায়ী)
অর্ণব বাথরুম হতে বের হয়েই জন্মধাত্রী জননীর সম্মূখীন হলেন। এ আরেক বিভীষিকা, অর্ণবের কাছে মনে হলো সে বউ নামের গুনার জাল হতে বের হয়েই মা নামক লোহার জালে আটকে গেলেন। বউতো তেমন অনেকক্ষণ পরে তুই-মুই বলে শুরু করেছিলেন কিন্তু মায়ের তো অনেকক্ষণ পরের দরকার পরে না, পেটের ছেলেকে সে যখন তখন শুধু তুই-মুই না সাথে চড়-থাপ্পর দিয়েও যদি  শুরু করে তবুও তো কিছু করার থাকে না! তাতে করে ছেলে কবি হলেই বা কী আবার দেশের প্রেসিডেন্ট হলেইবা কী!


-বউমা তো তোকে ঠিক কথাই বলছে রে গ্যাদা?
(মা, অর্ণবকে বরাবরই গ্যাদা নামে ডাকে, অর্ণব বড় হয়ে যে কেবল বিয়ে করেছে তা না, সে একজন কবি! এই সত্য শত চেষ্টা করেও অর্ণব তার মাকে বুঝাতে পারেনি)
সাতসকালে ফ্রেশ হয়ে বাথরুম হতে বের হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বড় রকমের কঠিন কাজ। কিন্তু মায়ের প্রশ্ন শুনে অর্ণবের হৃদয়ের অচেনা কোন গলি হতে একটি দীর্ঘশ্বাস যেন অটোমেটিক্যালি বের হয়ে এলো। সে কোন কথা বলতে পারলো না, মায়ের প্রশ্নের উত্তরে তার মন খারাপের মতো উত্তর সে একজন কবি হয়ে কিভাবে দিবে? শুধুমাত্র ছেলে হলে না হয় ডাইনি বুড়ি-টুরি বলা যেতে!
মৌনতা অবলম্বন করে অর্ণব মনে মনে ভাবতে লাগলো, ইস্ মাকে যদি কোনভাবে যে করেই হোক আরও অত্যন্ত একশো বছর বাঁচিয়ে রাখা যেতো, তবে হয়ত তার গ্যাদা যে পৃথিবীতে কী কর্ম করে বেড়াচ্ছে  সেটা সে স্বচোক্ষে দেখে যেতে পারতো। এই সময়ের মধ্য, স্কুুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের সাথে তার নাম-জন্মবৃত্তান্ত লেখা হয়ে যেতো, তাতে মা বইয়ের পাতায় তার নামটি দেখে গর্ববোধ করে আর বলতো, ওরে আমার গ্যাদা সোনারে আয় আমার বুকে, তোকে ছোট বেলার মতো আদর করি, আরে আয় লজ্জা কিসের, আয়। অর্ণব আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, আর মনে মনে বললেনঃ ‘আহ্ আমার প্রিয় জন্মধাত্রী জননী, আপনি আপনার গ্যাদার কৃর্তকর্ম স্বচেক্ষে দেখে যেতে পাললেন না, আপনাকে আমি কিছুই দেখাতে পারলাম না, আপনি আমায় ক্ষমা করুন।’
-এই যে ঘর-সংসার বাদ দিয়ে দিনরাত কেবল বই আর বইমেলা নিয়ে তুই পড়ে আছিস, এতে তোর কী লাভ হচ্ছে ? আমি মা হয়ে তো কিছুই বুঝতে পারিনারে গ্যাদা, কবিতা লেখার ভুত তোর মাথায় চাপলো কেমনে?
অর্ণব, এবারও কোন কথা বললেন না, কিছু বলা মানেই মায়ের তলপি-তলপা গোছানো শুরু আর তার বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া! এমনিতেই মা তার বাসায় আসতে চায় না।
-সংসারে কেবল টাকা পয়সার যোগান দিয়েই তো দায় সারা যায় না । তুই বউকে একা বাসায় রেখে সেই সকালবেলা বেপাত্তা হয়ে যাস, ফিরিস অনেক রাতে, এটা কেমন কথারে?
সাতসকালে বউ আর মায়ের সংসার বিষয়ক জ্ঞান নিয়ে অর্ণব হাঁপিয়ে উঠলো, একজন কবির সংসার বিষয়ক এতো জ্ঞানের কী দরকার? সে তো সংসদের মাননীয় স্পীকারনা যে, যুক্তিযুক্ত বক্তব্য হোক আর যুক্তিহীন বক্তব্য হোক ধৈর্য ধরে শুনতেই হবে। সে একজন কবি, একজন কবির পক্ষে যুক্তিহীন বক্তব্য শুনা তো একেবারেই নিন্ম শ্রেণীর কাজ।
বউ যেমন তেমন, মায়ের চোখের সামনে তো অভিমান প্রকাশ করা যায় না, অর্ণব রাস্তায় নেমে পড়লো, শীতের ঘনকুয়াশার ধোঁয়ার সাথে মনের দ্বিমুখী অভিমানের ধোঁয়া যদি বের হয়ে যায় তবেই তার মুক্তি। প্রিয়জনদের দেওয়া অভিমান দীর্ঘসময় বয়ে বেড়ানো সাধারণ মানুষের নিকট যদি যন্ত্রণা টু দি পাওয়ার হান্ড্রেড হয় তবে একজন কবির কাছ তা যন্ত্রণা টু দি পাওয়ার কোটি!

অর্ণব রাস্তার মোড়ে মকবুলের চায়ের দোকানের বেঞ্চে আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে পড়লেন। আজ একজন কবি সকালবেলায় বাসায় খাবার থাকা সত্ত্বেও তা খেয়ে বের হতে পারেনি এর চেয়ে বড় অভিমানের ব্যাপার আর কী হতে পারে?
দোকানদার মকবুলের সাথে অভিমান পর্বঃ( কথোপকথন সেই সময় অনুযায়ী)
অর্ণব তার কবি জীবনে যেইসব মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়, মকবুল হলো সেই হিসেবের ক্রমিক নাম্বার-এক পর্যায়ের। কিন্তু বিধিবাম, অনিচ্ছা সত্ত্বেও একান্ত বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে মকবুলের নিকট তাকে আসতেই হয়। যেমন আজ সে এসেছে, সকালবেলার নাস্তা আর কিছু টাকা ধার নিতে! সাতসকালের বউ-মায়ের দ্বিমুখী বাক্যবানে জর্জরিত হয়ে সে যখন বাসা হতে তাড়াহুড়ো করে বের হয়েছে এর ফাঁকে মানিব্যাগ আর পকেটে ঢুকেনি।এ এক উপড়ের বিদিক খেলা! অর্ণব কিছুতেই বুঝতে পারে না, ফুটপাতের সামান্য একজন চা-সিগারেটের দোকানদারকে, রাজতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কৃষিশাস্ত্র, আইনবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ইত্যাদি ইত্যাদি দুনিয়ার তামাম বিষয় নিয়ে এতো এতো মাথা ঘামাতে হবে কেন? সবচেয়ে আশ্চর্য আর অবাক করার ব্যাপার হলো, অর্ণবকে সামনে পেলেই মকবুলের পদবী আর ফুটপাতের দোকানদার হিসেবে গণ্য করা যায় না, তখন তাকে গণ্য করতে হয় ‘ডক্টর অব ফিলসফি’ কিংবা বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দার্শনিক হিসেবে!
অর্ণবকে দেখেই, মকুুলের মুখে যে হাসি দেখা গেলো একজন কবি হিসেবে সেটা খুবই ভালো লাগার কথা, সাতসকালে কারো হাসি মুখ দেখা যেকোন কবির জন্যই, বাচ্চার মুখে হাসি দেখে মা যেমন তৃপ্ত হয় সেরকম হওয়ার কথা! কিন্তু অর্ণব কোন তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে কোনমতেই পারলেন না, সে চিন্তা করতে লাগলো অলরেডি দুটো অভিমান কাঁধের ঝুলিতে জমা পরে আছে, এই মকবুল আবার কোন অভিমান দান করবে নাতো?
- আরে, কবিদা যে, কেমন আছেন? আপনাকে তো আমি হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজতেছি!,
মকবুলের হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজার কথা শুনেও, অর্নব তার কারণ জানতে তেমন কৌতূহল অনুভব করলেন না। কৌতূহল প্রকাশ করা মানেই, তার আলতু-ফালতু দার্শনিক কথাবার্তার রূপসাগরের মাঝখানে বৈঠাবিহীন ভাসতে থাকা। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যাবে মাগার তীরের দেখা আর পাওয়া যাবে না!
-মকবুল, দোকানে রুটিকলা কই?
-এখনো আসেনি দাদা!
-ও, কিছু টাকা ধার দাও
-কতো দাদা?
-দাও, যতটা পারো,
মকবুল অর্ণবকে একশো টাকার একটা নোট বের করে দিলেন।

অর্ণব আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এতো ভালো একজন মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা আবোল তাবোল বকবক করে কেমন করে?
- আসি মকবুল। ও, আমাকে হারিকেন জ্বালিয়ে খোঁজতে ছিলেন কেন? সংক্ষেপে বলো, আমার একটু তাড়া আছে।
-সাতসকালে আপনার কিসের তাড়া?
-মকবুল, তাড়ার আবার সকাল বিকেল কী? থাকতে পারে না?
- তা ঠিক, আর আপনি হলেন কবি মানুষ, আপনার তাড়ার তো আগামাথা থাকার কথাও না। তাছাড়া, কবিদের তো সবসময়ই তাড়ার উপড় থাকতেই হয়, কত ধরণের চিন্তাভাবনা করতে হয়! কবিতা লেখা তো আর গাছ হতে পাতা ছেঁড়ার মতো না, যে ইচ্ছে হলো আর টপাটপ ছিঁড়ে ফেললাম! আমি চিন্তা করি দাদা আপনারা কবিতা কেমনে লেখেন?
-মকবুল, হারিকেন জ্বালিয়ে কেন খোঁজতে ছিলে, সেটা বলো।
- দাদা, আমি একটা কবিতা লিখেছি! নামঃ ‘মহুয়া বান্ধবী’
-কী বলো?
-হাঁ ,সময় লাগলো একমাস। এই একখান প্রেমের কবিতা লিখতে গিয়ে আপনাদের যে কী মাথা সেটা বুঝে ফেলেছি দাদা।বাপরে বাপ, কবিতা লেখা এতো কষ্ট!
- মকবুল আমি যাই।
- দাদা, কবিতাটি আপনাকে দেখাতে চাই,যদি একটু ঘষামাজা করে দেন খুব উপকার হয়।
- মহুয়াটি কে মকবুল? তুমি কী মহুয়া নামের কারো সাথে প্রেম করছো?
মকবুল এইবার আর কোন কথা বললেন না, তারমানে কী ঘটনা সত্য। কিন্তু মকবুলের তো ঘরে স্ত্রী আছে, আর তার নাম হলো আছিয়া।
অর্ণব পকেট হতে একশোটাকার নোটাটি বের করে মকবুলের দিকে ছুঁড়ে দিয়েই একবুক অভিমান নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে আরম্ভ করলেন। ঘরে স্ত্রী রেখে মকবুল বাহিরে কোন মহুয়ার সাথে প্রেম করছেন, তার জন্য আবার একমাস খাঁটাখাঁটুনি করে কবিতাও লিখেছেন এটা কেমন কথা? মকবুলের মতো এতো ভালো একজন মানুষ এমন হীন কাজ কেন করবে? আর করার পরে সে তাকে তা বলা বা দেখানোর সাহস কী করে পেলেন। একজন কবিকে সে কীভাবে এমন ছলনার কথা বলতে পারলেন,হাউ?
অভিমানে অভিমানে নষ্ট হয় ভালোবাসা। তবে সেই অভিমানের উৎপত্তিস্থল হতে হয় মন থেকে। অভিমানের উৎপত্তিস্থল যদি হৃদপিন্ডের কোন এক জায়গা হতে হয় তবে তাতে ভালোবাসা নষ্ট হয় না।
বউ, মা এবং মকবুলের প্রতি কবি অর্ণবের যে ভালোবাসা আছে, সেটা প্রায় অর্ধদিন গত হয়ে গেলেও অভিমানের কারণে তা নষ্ট হয়ে যায়নি এবং নষ্ট না হওয়ার অর্ণবের কাছে যথেষ্ট যুক্তিও আছে।


যেমনঃ বউ এবং মা, ওনারাতো কোন কবি বা লেখক নন! যদি কবি বা লেখক হতেন, তবে তো তারা সাহিত্যে লাভ লসের হিসেব করতে পারতেন না। আর পবিত্র বইমেলাকে সর্বনাশের মেলাও বলতে পারতেন না। তাদেরও তো কিছু কাজ বা অভ্যাস অর্ণবের কাছে বিষের মতো লাগে, যেমন টিভিতে দুই শাশুড়ি বউয়ের পালা করে সিরিয়াল দেখা। এখন,টিভি সিরিয়ালের মধ্য তারা নিশ্চিত মজার কিছু খোঁজে পেয়েছেন যা অর্ণব পাননি,সুতুরাং তা অর্ণবের কাছে মনে হ”েছ সর্বনাশের!
মকবুলের ব্যাপারটা কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও, সাময়িক মতিভ্রমে তার উপড় অভিমান করাটাও অর্ণবের একেবারে ঠিক হয়নি। একজন কবির সামনে সামাজিক কোন ঘোরতর অন্যায় ঘটতেই পারে,কবি হিসেবে অর্ণবের উচিৎ ছিলো মকবুলকে বুঝানো।তাতে করে মকবুল একবার না বুঝলে তাকে শতবার বুঝানোর চেষ্টা করা যেত। চেষ্টায় চেষ্টায় কেষ্টফল অবশ্যই পাওয়া যেতো।
অবশেষে, নানারূপ যুক্তিতর্কের পরে অর্ণবের নিজে নিজের প্রতিই অভিমান হতে লাগলো। সম্পূর্ণ নিজের বোকামির ভুল অভিমানে বেলা দুটোর মতো বাজে এখনও তার কিছুই খাওয়া হয়নি। পকেটে একটা টাকাও নাই! অবশ্য বইমেলায় একবার ঢুকে পড়তে পারলেই সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে। নতুন বইয়ের পাতার মৌ মৌ সুবাসে উড়ে যাবে পেটের ক্ষুধা। কিন্তু বইমেলা শুরু হবে তো বিকেল তিনটে হতে। মাঝের এই এক ঘন্টা সময় সে কী করবে?রমনার একটি বটগাছের নিচে অর্ণব বসে পড়লো, আশ্চার্য ব্যাপার সাথে সাথেই অর্ণব খোঁজে পেলো তার সারাদিনের অভিমান, ক্লান্তি, ক্ষুধা নিবারণের সহজতম উপায়ঃ
যুগপৎ অভিমানে কেটেছে গেছে বেলা
হিসেবের কষাঘাতে গোল্লা যোগফল,
গরলের কাছে রেখে সরল গণিত
লাভ কী হবে বলো লসের ভ্রণ ছাড়া?
দিতে পারিনি কিছুই যেন সুপথ সুদূর
চেয়েছি আসল কেবল পেয়েছি অসুর,
দিব্যজ্ঞানে চোখ মেলে যখন চেয়ে দেখি
মরে গেছি হায় আমি ভুল বিবাগী।