এক টুকরো ভগ্ন দর্পণ

 


এক টুকরো ভগ্ন দর্পণ 

সুশান্ত কুমার দে


অনেক দিন আগের কথা আজও মনের ভেতর প্রতিধ্বনিত অনু কম্পিত ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ের গভীরে মোচড় দিয়ে ওঠে। আজও গাঁয়ের সেই ফেলে আসা দিন গুলোর কথা মাটির দেয়ালের ঘর গোলপাতার ছাউনী, নারা পল গুঁজে চালের মটকা মেরে ঘরটিতে থাকতে হতো।

অভাব অনটনের সংসার, তবুও সুখের ঘাটতি দেখা যায়নি।

ঘরের আসবাবপত্র আলমারি, আলনা, টিভি , ফ্রিজের কোন হদিস ছিল না।

মাটির তৈরি মেটের মধ্যে নতুন কাপড় চোপড় রাখতে হতো।

ঘরের খোলা বারান্দায় একটা মাদুর পেতে ঘুমাতে হতো। তীব্র গরমের সময় একটা তালপাতার পাখা ছিল গরম নিবারণের একমাত্র অবলম্বন।

তবে এখনকার মতো তখনকার দিনে গরমটা বুঝি অনেক কম ছিল। বাড়ির চারপাশে আম কাঁঠালের বাগ বাগিচা, খেজুর, তাল লিচু, বেল গাছের ছায়া পড়তো ঘরের চারপাশে, সবসময় শীতল হাওয়া প্রবাহিত হতো, এখন মতো বিদ্যুতের পাখা ছিল না তবুও গরমের অনুভূতি ততটা ছিল না।

এখন পৃথিবীর তাপমাত্রা কের্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কলকারখানার ধোঁয়ায় এবং নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে বায়ু দূষণের মাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে।

দাদুর কথা গুলো শুনে, কণা যেন একেবারেই থ মেরে গেল।

-তুমি সত্যিই বলছো দাদু?

-তখনকার দিনে তোমরা খুব কষ্টে ছিলে তাই না দাদু?

-না না দিদি ভাই, আমরা খুবই ভালো ছিলাম।

তখনকার দিনে কত আরাম আয়েশে দিন কাটতো, খেলার সময় খেলা পড়ার সময় পড়াশোনা। 

রাতের বেলা সবাই মিলে যাত্রা গান শুনতে যেতাম।

বায়োস্কোপ এ সিনেমা দেখেছি, বেদেদের  সাপ বানরের নাচ দেখে কতো মজা করতাম।

-তোরা পালকি দেখেছিস?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ দাদু, বইতে পড়েছি, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পালকির গান কবিতা পড়েছি, পালকি চলে, পালকি চলে।

-হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, ঐ পালকিতে চড়েই আমার বিয়ে হয়েছিল।

-হাঁ হাঁ দাদু, আমাকে একটু পালকিতে চড়াবে ?

-দূর বোকা পালকি কি এখন আর দেখা যায়?

-এখন পালকি দেখতে যাদুঘরে যেতে হবে।

-আমাকে একদিন যাদুঘরে নিয়ে যাবে দাদু?

-হ্যাঁ অবশ্যই নিয়ে যাবো।

-আরও মন দিয়ে শোন, আগে আমরা খবর শুনতাম রেডিওতে।

তাও আবার এক সাথে অনেক লোক একত্রে বসে।

-কেন, কেন দাদু?

-রেডিওর তখন অনেক দাম ছিল, যে কেউ কিনতে পারতো না।

আর চিঠি পত্রের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে হতো।

-চিঠি পৌঁছাতে কতো দিন সময় লাগতো দাদু?

-ধর, এক সপ্তাহের বেশি।

-তখন কতো কষ্ট করতে হতো তাই না দাদু?

-হ্যাঁ, ঠিকই তো, আমরা সাত আট মাইল পথ পায়ে হেঁটে  স্কুলে যেতাম। স্কুলের পড়া না করলে মাস্টারমশাই ভীষণ জোরে মার ধোর করতেন। আর এখন তোরা দিব্যি আরামে আছিস। রাত দিন মোবাইল ফোন নিয়ে সময় নষ্ট করিস। 

এখন শুনছি অনলাইনে ক্লাস করতে ইন্টারনেট ল্যাপটপ লাগবে।

হায়রে আমার কপাল, এই শেষ বয়সে এসে কতো কিছুই নতুন করে দেখছি ! এখন নাকি ডিজিটাল বাংলাদেশ। আগের দিনে আমাদের অসুখ বিসুখ হলে কোন ওষুধ পত্তর খেতে পারতাম না।

এক হোমিওপ্যাথি না হয় কবিরাজী  ওষুধ খেয়ে অসুখ বিসুখ সেরে যেত। সর্দি জ্বর হাঁচি কাশি হলে মা, গাছ গাছালির ছাল বাঁকড়ের রস করে খেতে দিতো। তাতেই সব অসুখ সেরে যেত।

আবার অনেকেই ঝাড় ফুঁকে বিশ্বাসী ছিল। আগের দিনে মানুষের বিশ্বাস ঝাড় ফুঁক দিয়ে অসুখ বিসুখ সারানো যায়, আবার ভূত পেত তাড়ানো যায়।

-দাদু, তখনকার দিনেও কি ভূত ছিল?

-ভূত পেত নিয়ে আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছি, দিদি ভাই? তবে আমি অনেক বার ভূতের মুখোমুখি হয়েছি। আমি ভূত বলে কখনো মানিনি, তবু ও আমাকে কয়েকবার ভূতে তাড়া করেছে।

-দাদু আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে, ভূতের গল্পটা এখন থাক?

-ও তাই নাকি, আচ্ছা ঠিক আছে আমি আর বলছি না?

-হ্যাঁ এখন যাও, স্কুলের সময় হয়ে গেল আর একদিন বাকি গল্প গুলো  না হয় বলবো?

-দাদু এতকাল তোমরা ছিলে অন্ধকার জগতে, কতো কষ্টে তোমাদের দিন কেটেছে। আর এখন আমরা আলোর সন্ধানে ছুটে চলেছি।এখন আমরা কতটা সুখী বলো দাদু?

-না না কণা, তখনকার দিনে আমরা সব সময় টাটকা শাকসবজি ফলমূল খেয়েছি। কোনো খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল কিংবা কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়নি। বিনা সারে কিংবা একটু আধটু জৈব সার প্রয়োগ করে ভালো ফসল পেয়েছি। আর এখন তোরা বিষাক্ত রাসায়নিক যুক্ত ভেজাল খাদ্য খাচ্ছিস? নিত্য নতুন অজানা রোগে দিন দিন কতো মানুষ অকালেই ঝরে যাচ্ছে। এখন দূষিত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফেসবুক, ইউটিউব ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠেছে , এতে করে উঠতি বয়সী ছেলে মেয়েদের চোখের বারোটা বেজে যাচ্ছে। এসব কি ভালো লক্ষণ মনে করেছিস কণা? তোরা এখন এতটুকু বয়সে মোবাইল থেকে কিছুটা দূরে থাকার চেষ্টা কর।

-হ্যা দাদু, তোমার কথা আমি মনে রাখবো। আমি আর মোবাইল ফোনে গেম খেলবো না, কার্টুন দেখবো না? আমি এখন নিয়মিত পড়াশোনা করবো, খাওয়া দাওয়া করবো, খেলাধুলা করবো অযথা মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকবো।

-এই তোমার মাথা ছুঁয়ে দিব্যি কাটছি। তবে দাদু, তুমি আমাকে কিন্তু জাদুঘর দেখাবে, আমি পালকি, ঢেঁকি, বায়োস্কোপ এ সব গুলোই দেখবো। আর একদিন পোড়াবাড়ীর ভিটেতে ভূত দেখাতে নিয়ে যাবে। 

দাদু বলল, ঠিক আছে দিদি ভাই, যতটা সম্ভব আমি তোমাকে সব দেখাবো।

কণা আনন্দে নাচতে লাগলো, খুব মজা হবে, খুব মজা হবে। আমি এবার স্কুলে যাই দাদু!



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পদাবলি