পদাবলি

পদাবলি



ক্যানভাসার
ইলিয়াস বাবর

সিরিয়াসলি বলছি,
মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না লোকটার সাথে তোমাকে দেখতে- আরেকটু স্মার্ট, আরেকটু গর্জিয়াস কেউ

আরে এখন কী আর বোকাটি আছি- দিনভর বসদের আদেশে স্থির থাকে মাথা এ ডেস্ক, ও ডেস্ক- আর্দশ কেরানি বটে ফরমাল লুকে ঘেমে যায় বুক পেকে যায় বুকের চারা, মাথার লাট!

তিন সত্যি করে বলছি, খচ্চরটা তোমার সাথে যায় না মোটেও আগুনসুন্দরীদের চাই হারবাল কোম্পানির নায়ক নিদেনপক্ষে বাবা-ব্যবসায়ী।

ওসব বাদ দিয়ে অন্যপৃষ্টায় যাই তবে ওহে, পড়াশোনাটা কমপ্লিট করো চাকরিটা ছেড়ো না কিন্তু পারলে সেরে এসো হানিমুনপর্ব

আরে না না, নিজেরটা কি আর বলা যায়! বলছি না, তোমার যোগ্য ছিলাম তবে ও-ব্যাটার চেয়ে আমাকেই মানাতো ঢের বিশ্বাস না-হয় ধরে দেখো এই হাত!


আয়না কষ্ট বোঝে না
সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

দেখা যাক, আয়নাটা কতক্ষণ
ঝাপসা হয়ে থাকে?
আমিও চিরুনির দাবি পূরণে
বাধ্য থাকবো না।

মাথার কেশের গোড়া
আঁচড়ানো- কোনো দায় তো
আয়নাকে লিখে দেইনি...


যতবার শরতের রাতে নেমেছি
জোবায়ের মিলন

সমগ্র পাপের বোঝা নামিয়ে
যে রাতে মিশেছিলাম মনের খেয়ালে, সুখে, আনন্দে
সে রাতে শরতের রাত, জোয়ার হয়ে নেমেছিল উঠানে-
রাশি রাশি ফুল এঁকে ভরিয়ে দিয়েছিল বাড়ির দেয়াল,
ঘরের মেঝ, বিছানার সুতা
ড্রেসিংটেবিল, পানির ঝাড়।
নিষ্পাপ আঁতর গন্ধ সে রাতে ছড়িয়ে পড়েছিল মহল্লার
মোড়ে মোড়ে, সে গন্ধে দিশাহীন হতে দেখেছি
অনেককে।

-যতবার শরতের রাতে নেমেছি একা
নিঃসঙ্গতার সাথে সহবাসে
ততবার পৃথিবী বৃষ্টি ধৌত হয়ে উঠেছে জেগে
সহস্রাব্দের কালো ঝরিয়ে হয়েছে দেবীর শরীর।

-মৌন অন্ধকার খুঁড়ে কখনোই যাইনা ফাল্গুন অথবা
গ্রীষ্মের কাছে। সব নামে রাম থাকেনা, শুনেছি প্রবাদে।
নীলাম্বরী রাতেই পেয়ে যাই জন্ম সুখ, সাধের সুখ-
শরত ছেড়ে কোনো হাতেই রাখিনা তাপান্বিত হাত;
হয়ে উঠিনা শিশুতোষ অবুঝ মাতাল; পাপহীন হইনা-
আর কোনো রজনীর সাথে। শরতের কাছেই খুলে রাখি
পৃথিবীর সমস্ত বস্ত্র।







যমুনা যাত্রা
জান্নাতুল ফেরদৌস লিসা

দুই বছর প্রেমের পর
বাবা যেইদিন আমাদের চার হাত এক করে দিলেন,
পুরো এলাকা লাল নীল আলোয় ভরে উঠেছিলো।
বাবা খুব খুশি হয়ে আয়োজন করেছিলেন।
কত কল্পনা খেলা করছিলো ভাবনায়!
সেই যে বৃষ্টি ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলে
প্রতি বর্ষায় ভিজবো আমরা,
মনে আছে তোমার?
আচ্ছা আমাকে দেয়া কথাটা হারিয়ে গেছে,
নাকি সেই বর্ষা?
হিসেবটা আজ বড্ড গোলমেলে।
আচ্ছা এখন কি তাকে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস চলে?
বৃষ্টিকেই ভাসাও বুঝি প্রেমের জোয়ারে?
আচ্ছা, সে কি তোমায় প্রতিদিন এত্ত এত্ত পয়সা দেয়
তোমার মদের গ্লাস পূর্ণ করতে?
মনে আছে, বিয়ের ছয় মাসের মাথায়
একদিন সব গয়না নিয়ে গেলে,
যেখানে মায়ের শেষ স্মৃতিটাও বাদ যায়নি।
আচ্ছা, এখনো তোমার সাথে অফিসের সেই বস আসে-
তোমার বউকে ছুঁয়ে দিতে?
মনে আছে, আমি তাকে চড় মেরেছিলাম বলে
তুমি আমায় কি বলেছিলে?
মনে আছে, তাকে চড় মেরেছিলাম বলে -
কিভাবে আমার গলা চিপে দিয়েছিলে?
আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দেখেছিলাম তোমার লাল চোখ
যেই চোখে একদিন প্রেম পড়েছিলাম,
পড়েছিলাম তোমার মনের কথা।
মনে আছে, আমার নিথর দেহটা
কেমন পাঁচ টুকরো করে বস্তায় ভরে যমুনার বুকে ফেলে দিয়েছিলে।
সেদিনো কেমন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো,
তুমি আমি আবারো ভিজলাম।
না পারলাম তোমায় কিছু বলতে,
না পারলাম তোমার হাতে হাত ছুঁতে।
আমার শরীরে প্রাণ থাকলে তোমায় এত কষ্ট করতে দিতামনা।
কত কষ্টে ভারি বস্তাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলে।
বৃষ্টিতেও কেমন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিলো তোমার কপালে!
বিশ্বাস করো, নিজে গা ভাসাতাম যমুনায়।
আচ্ছা, সে কি তোমায় এত্ত এত পয়সা দেয়?
তোমার লম্পট বসের চাহনির উত্তরে মুচকি হাসি দেয়, মদের গ্লাস ভরে?
সুখেই আছো বলো?



ক্ষুধার্থ মানচিত্রের কবি
জাকারিয়া প্রীণন

তোমার সাক্ষাৎ পাবো এই খবর জানে ধানফুল
গুপ্ত বাতাস ফাশ করেছে তোমার আগমন
তোমাকেই আসতে হবে তোমার উপেক্ষণে
নদী পেরিয়ে জলাশয় ছাড়িয়ে
কাশবনে উড়া প্রজাপতিটির মতো।

তোমার সম্রাজ্যের আন্দামানে আমি সে
গৃহহারা সৈনিক যার পিছুটাননেই কোনো
আমাদের যুগল জীবনের সমান্তরাল পথ ধরে
এই ক্ষুধার্থ কবির মানচিত্রে তোমাকে আসতেই হবে।


শতজন্ম
সৈয়দ শরীফ

হতেও পারে জন্ম আবার;
আমাদের দেখা হয়ে যাবে হয়তো একদিন
এই চিরচেনা অস্পষ্ট পথে- গতজন্মের সকল
অপ্রাপ্তিগুলো মিটিয়ে নেবো শৈল্পিক প্রণয়ে;

সন্ধ্যার তন্দ্রালোই যেহেতু দিনের অন্তিমক্ষণ,
সেহেতু এর আগেই দেখে নেবো নিজেদের;
ঢুকে পড়বো দু’জন দু’জনায়, গভীর থেকে
আরও গভীরে- শীতলভাবে মিলিয়ে নেবো সবকিছু;

হারিয়ে যাবো তো সহসাই এই পৃথিবীর পথ হতে,
আসবো ফিরে আবারও হয়তো নবজন্মের স্রোতে।



উত্তর পরাগায়ন
টিপু সুলতান

ছন্দ মিলুক না মিলুক-
এসব আমাকে পাগল করে ফেলে
কবিতার নতুন শব্দরা
আবেগে ঠাসা ঘোরতর উত্তরণ মুখের অনাধুনিক!
কখনো লিখছি মানুষের মুখাবয়ব, কখনো লাশের;
এসবে কেউ কাছে টানে। কেউ দূরে ঠেলে-
প্রত্যেকদিন আকাশের মতন
শাদা খাতায় আঙ্গুল নেড়ে
কালো কালিতে রক্ত ঝরায়, অরণ্য ও ফুলের ওপর
উত্তর পরাগায়নে; দু’হাত মেলে ধরে
সোনা-রোপা ঐশ্বর্যের রেখো প্রেম
সংসারে বাতির দিয়াশলাই।

গহীন অন্ধকারময়
সিঁড়িভাঙ্গা কালোর ভেতর থেকে মুঠো করে আনে
চেনা অচেনা মুখগহ্বর
সকলকে বলে ভয়ার্ত সাপ নয়-
ফুল ফোটানোর হলুদ রেণু
ফের আহবান! হাজার বছরের অনন্য জগৎ...


দগ্ধ ক্ষরণ
মারুফ আহম্মেদ নয়ন

সেই নামে মুগ্ধ হই, অমৃত গরল ধারা ঝরে পড়ে অবিরল। ঝরে পড়ে সুগন্ধী ফুল, তিক্ত বিষাদ, হৃদয় গ্রন্থি থেকে ক্রমাগত ঝরে বিষাক্ত লালা। সেই নামে শুরু করি প্রথম, হৃদয়ে দগ্ধ ক্ষরণ, প্রণয়ের প্রথম পাঠ, প্রথম পরিচ্ছেদ। সেই নামে পাঠ করি, হৃদয়গত ব্যাকরণ, পাখির ডানা ঝাপটানোর দৃশ্যে লিখে ফেলি, এই রকম হৃদয়ে দগ্ধ ক্ষরণ, প্রণয়ের প্রথম অভিধায় তোমাকে পাই, আমি মেলে ধরি আমার সমস্ত অসুখ, দীর্ঘতর ক্ষয়ক্ষতি।

নিশিকন্যা

নিশিকন্যা


 নিশিকন্যা
মাহমুদুল হক জালীস

অধুনা রাত এলে প্রায়ই উত্তেজনা বোধ করে আসিফ। যৌবনের প্রবল তৃষ্ণা অষ্টপ্রহরে বিদ্যুৎ চমকের মতো তড়িৎ গতিতে তার শরীরে প্রবাহিত হয়। যেদিন মাথায় ওই খারাব কাজের চিন্তা ঢোকে সেদিন আর ঘুম আসে না। চোখের পাতা শত চেষ্টায়ও এক করতে পারে না। চাহিদা মিটানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে। আজকেও তার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। গভীর রাতে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়ে। দিনের চিরাচরিত শহরটা রাতের অন্ধকারে ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কেমন যেন খুব অচেনা অচেনা। দিলের আলোর ভদ্রগোছের মানুষগুলো রাতের আঁধারে চরিত্র চেঞ্জ করে। প্রদর্শন করে ভেতরের আসল রূপ। আসিফ এসব ভাবতে ভাবতে গলির মোড়ে এসে রিক্সা নেয়। বয়োবৃদ্ধ এক লোক চালকের আসনে । জীবিকার তাগিদে হাড্ডিসার শূন্য দেহ নিয়েও রাত বিরাত কষ্ট করে যাচ্ছে এই সমাজের কত মানুষ। ঘোর অন্ধকারের ভেতর গন্তব্যে চলছে রিকশা। মাঝে মাঝে ক্রিং ক্রিং শব্দে ছেদ পড়ছে রাতের নিরবতার। ল্যাম্পপোস্টের  আবছা আবছা হলুদ আলো। কেমন যেন বিষাদমাখা। এ আলোতেই সে চলতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ তার কেমন যেন লাগছে। হয়তো আপেক্ষিক কিছু একটা ঘটার পূর্বাবাস। একটা গলির মুখে রিকশা থামিয়ে নেমে পড়ে আসিফ । ভাড়া চুকিয়ে গলির ভেতর হাঁটা ধরে। রাস্তার দুপাশে কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে খদ্দেরের খোঁজে। দেখতে বেশ পরিপাটি। সাজগোজর ঈষৎ আভা প্রত্যেকের শরীরে প্রতীয়মান। কথা বলছে কিছুটা উচ্চ আওয়াজে। নিজেদের দিকে আকর্ষণ করানোর নিমিত্তে। আসিফকে  দেখে মেয়েগুলো চিরচেনা সেই হাসি দেয়। তার কাছে নিজেদের লোভনীয় করার জন্য। আগে অনেকবার এই হাসি দেখেছে আসিফ। এদের হাসি থেকে শুরু প্রায় অধিকাংশের দেহের সাথেও তার পরিচয় রয়েছে। কিন্তু  আজকে তার গন্তব্য অন্য জায়গায়। ওদের দিকে ভ্রক্ষেপ না করে সে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা চৌকাঠের সাথে ভেজানো। হালকা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দেয় আসিফ। বিছানার উপরে অন্য দিকে ফিরে বসে আছে এক রমনী। সিগারেট টান দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধোঁয়ার কুন্ডুলী ছড়াচ্ছে। আড়চোখে বাঁকা দৃষ্টিতে দেহের গড়ন দেখে আসিফ। বেশ নাদুসনুদুস। শরীরের বাড়তি অংশও অনেকটা সুঠাম। পূর্বাভ্যাস থাকলেও সে ইতোপূর্বে এমন কাউকে দেখেনি। কেমন যেন দ্বিধা দ্বিধা লাগছে তার কাছে। টিপটিপ পায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার আশপাশ । মধ্যবয়ষ্ক এক মহিলা। চেহারা দেখে ভদ্রঘরের বলেই মনে হয় তার কাছে। শরীরের সৌন্দর্য কালের ঘাত-প্রতিঘাতে অনেকটাই শুষে নিয়েছে। তবুও ছিমছাম দেহের গড়নে সৌন্দর্য কিছুটা হলেও অনুমেয়। মহিলাটি তার দিকে তাকাচ্ছে না। কী যেন একা একা ভাবছে। আসিফের একটু অস্বস্তি লাগে। এপরিবেশের মহিলারা সাধারণত এমন হয় না। কী করবে সে? ভেবে পাচ্ছে না।  চিরচেনা পরিবেশটা আজ কেন জানি অচেনা অচেনা মনে হয়। আসিফ একটু গলা খাঁকারি দেয়। মাহিলাটি তার দিকে একনজর তাকায়। আসিফের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। মহিলাটির প্রতি কেন যেন ভীষণ মায়া হয় তার। ঐ কাজের চিন্তা তার মাথা থেকে উবে যায়। আগ বাড়িয়ে সে জানতে চায় তার এপথে আসার ইতিবৃত্ত ।

নিশীথ যামিনীতে চাঁদের ঝলমলে আলো পৃথিবীর আকাশজুড়ে খেলা করছে। যোজন যোজন দূর থেকে মিহি মিহি আলোকচ্ছটা কার্ণিশ ঘেঁষে রুমে ঢুকছে। ঘুলঘুলির ছায়াবিম্ব পড়ছে ফ্লোরে। আসিফ নিবিষ্ট মনে বসে আছে এক পাশে, অন্য পাশে নিশিকন্যা তার জীবনের বিড়ম্বনাময় আখ্যান নিয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। জোসনার আলো তার অবয়বের লাবন্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। কিছু সময় দুজনের মাঝে নিরবতায় কেটে যায়। মন ছুঁয়ে যায় আরেক মনকে।
নিরবতা ভেঙে আসিফ জানতে চায়- কী নাম আপনার? । তনু, মহিলাটি বলল।
এই তনুর ছোট সংসার ছিল। বাবা-মা, ভাই-বোন ছিল। ছোট ঘর ছিল। উঠোন ছিল। সোনালি ধান ছিল। মাঠভরা ফসল ছিল। পাখিদের কল-কাকলিতে মুখরিত ছিল ওদের বাড়ি। তখন কতই বা বয়স হবে
তনুর। চোদ্দ কি পনের। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে তনুদের বাড়িতে ডাকাত আসে। দরোজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে। সারা ঘরের মানুষ ভয়ে তটস্থ। ডাকাতদল সার্চ লাইটের আলোতে খোঁজাখুঁজি করে জিনিস পত্র, টাকাকড়ি, সোনা-গয়না।
সবশেষে ঘরের ভেতর যুবতীদের সন্ধানে নামে। খুঁজতে থাকে তাদের লালসা মেটানোর খোরাক। দৃষ্টি পড়ে খাটের ওপরে আঁটোসাটো হয়ে বসে থাকা তনুর দিকে। ঘরের অন্য লোকজনদের হাত পা বেঁধে, বিছানা থেকে তুলে আনে তনুকে। হিংস্র ডাকাতের ভয়ে কাচুমাচু হরিণের সাবক ওর মন। রাতের আঁধার বিদীর্ণ করা চিৎকার । ‘বাঁচাও বাঁচাও’ মুখের বুলি। প্রতিবাদ প্রতিরোধের হাতিয়ার নেই কাছে পিঠে কোথাও। নেই কোনো নৌজোয়ান বীর-পালোয়ান যে এক অবলা নিরীহ মেয়ে মানুষের সম্ভ্রম রক্ষা করবে। নারী জাতির চির মূল্যবান সম্পদ অক্ষত রাখবে। পালাক্রমে শরীরিক ও মানসিক অত্যাচারে তনুকে করে ছিন্নভিন্ন। রাতভর দেহের সাথে চলে হোলি খেলা। এ যেন এক কচি হরিণ শাবককে কামড়ে ছিঁড়ে খায় ক্ষুধার্ত একদল হিংস্র বাঘ। তনুর বস্ত্রহীন শরীর লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এভাবেই কয়েক ঘণ্টা কেটে যায় তনুর জীবনের পাতা থেকে।
তনুর বীরাঙ্গনা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এখন থেকেই শুরু। তারপর ঈশান কোণে কত যে মেঘ জমে ছিল! কিন্তু দুঃখের শ্রাবণ কেউ ঝরাবে কিনা জানা ছিল না তনুর। মৃত্যু তাকে গ্রহণ করেনি বলে জীবন ওকে শান্তি দেয়নি এক দ-ও। এ সব কিছু ভুলে তনু নতুন করে বাঁচতে চায়। জীবনে বাঁচার গান শুনতে চাই। মোছতে চায় মন থেকে সেই আতঙ্কিত রাতের কথা। এরেই মাঝে অনিক নামের এক ছেলে তার কাছের মানুষ হয়ে যায়। সবসময় আগলে রাখে তনুকে। ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখায়। ভালোবাসের বুলি শোনায়। ভুলিয়ে দিতে চায় তনুকে সে যে একজন ধর্ষিতা। অনিকের প্রতি আসক্ত হয় তনু। শরীরের জমিনে আবার ফসল বুনতে চায়। ভালোবাসার ফসল। ভালোবাসার নদীতে সাঁতার কাটবে দুজনে মিলে। ভুলে যাবে কিছুটা হলেও সেই বীভৎস রাতের কথা। অনিকের বিশ্বাসের নৌকায় জীবনের বাকী পথটুকু পাড়ি দিবে। এসব আশা বুকে নিয়ে অনিকে সাথে তনুর বিয়ে হয়। ছোট ইটের ঘরে চাঁদের আলোর প্লাবন। মনে মনে অনিক নামটিই জপে অহর্নিশ। সারাদিন  অপেক্ষায় থাকে অনিকের। কিন্তু সে জানে না অনিকেও যে বাটপার। এমন অনেক মহিলাকে ভালোবাসার কথা বলে, পরে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে। হঠাৎ এক রাতে অনিক বাড়ি ফিরছে না। অপেক্ষায় রাত জেগে বিছানায় তন্দ্রচ্ছন্নভাবে পড়ে থাকে তনু। দরজার আগলে গভীর রাতে খুট খুট শব্দ হয়। তনু ঘুম ঘুম চোখে দরোজা খুলে আবার শুয়ে পড়ে। আলো আঁধারীতে কে যেন ঘরের ভেতর ঢোকে। তার খুব পাশে এসে বসে। চোখ বুজেই কথাগুলো ছোড়ল তনু ‘এত দেরি কেন হইছে? ভাত খাইবা না?’ সে বলে, না। কাছে এসে তনুর শরীরে হাত বুলিয়ে যায় আলতোভাবে। কোন কথা নেই। তনুর শরীর হিম হয়ে আসে। চমকে উঠে সে? অনিক? এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে ওঠার চেষ্টা করে তনু। না পারে না। তনু স্তম্ভিত। বাকহারা। এখানেও সেই পশুর দল! শব্দহীন অসাড় তনু শুধু হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে। রেহাই পায় না। আগন্তুক তার পৌরুষ কাম চরিতার্থ করে ওঠে পড়ে। ডাকে অনিক, অনিক আয়, আমি যাই। তনুর চৈতন্যে ঝড় ওঠে । আর্তনাদ করে। ওর চিনতে বাকি থাকে না নব খরিদ্দার অনিককে। তারপর থেকে তনু প্রতিজ্ঞা করে যদি শরীর বেঁচেই খেতে হয় তা হলে নিজেই বেঁচুম। অন্যের বিবাহে থেকে নয়। সেখান থেকে বিভিন্ন পতিতালয় তনুর উঠাবসা। আর কিছু বলতে পারে না তনু। আসিফ তনুর হাতটা ধরে বের হয়ে পড়ে অজানা গন্তব্যে।

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : পর্ব ১২

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : পর্ব ১২


রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

(গত সংখ্যার পর)
আমি প্রাণভয়ে হাজারো গলি দিয়ে দৌড়াতে থাকি। এক সময় ধরা পড়ে যাই। ওরা আমাকে পাঁজাকোলা করে একটা পোড়াবাড়িয়ে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করছে আর নিরোপায় সব সহ্য করে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে ওরা প্লান করে, আমাকে মেরে ফেলবে। চাপাতি দিয়ে আমাকে টুকরো টুকরো করে মাংসপি-গুলো সারা শহরময় ছড়িয়ে দেবে। কাক-পক্ষীর খাদ্য বানাবে। অথবা মাংসগুলো প্যাকেটজাত করে কোনো রেস্তোরায় চালিয়ে দেবে। প্লান মোতাবেক ওরা যখন একটা নতুন গামছা আমার গলা দিয়ে ঠেসে ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে, ঠিক তখনই সজাগ হয়ে যাই।
কী যে দেখছেন, সে-তো আপনিই আমাদের চেয়ে বেশি জানেন।
বেশি জানি বলেই বিপদ। শামুক জীবন বেছে নিতে হচ্ছে। তবে এটাও এক প্রকার ভালোই আছি বলা যায়। ঘরে বসে একাকি মরমিচর্চা কি চাট্টিখানি কথা? তোমরা চাইলে আরো দুটো গান শোনাতে পারি, শোনাবো?
একজন বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে অবুঝ শিশুর মতো এমন সরল আহ্বান শুনে আমাদের এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। কেবলই পালাতে ইচ্ছে করে তখন। ইচ্ছে হয় আলো-বাতাস-রোদ সবকিছু থেকে পালিয়ে সূর্যের উল্টো পিঠে চলে যাই। যেখানে এসবের কিছুই চোখের সামনে পড়বে না। কখনো ইচ্ছে হয়, একটা লাথি এই গুমোট সময়টাকে সাত-সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে পাঠিয়ে দিই। পরক্ষণেই মনে পড়ে, কী ভাবছি এসব? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? এমনিতেই আমাদের সবুজ ছেলেরা অশুভ বাঁশির সুরে আসক্ত। কে কখন হারিয়ে যায় বলা যায় না। রশিদ চৌধুরীর যে-ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, সে আজ তিন বছর ধরে নিখোঁজ। ফারুক ভূঁইয়ার মেজো ছেলে দু’বছর ধরে নিখোঁজ। আরমান ব্যাপারির একমাত্র ছেলে এক বছর নিখোঁজ থেকে সেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়লো। পুলিশের বয়ান, সে নাকি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। আমরা এ-শহরের বাসিন্দা আজ পর্যন্ত কোনো উগ্রপন্থি দল আমাদের চোখে পড়েনি। তাদের কোনো নেতা-কর্মীরাও দাওয়াত নিয়ে আমাদের কাছে আসেনি। যা শুনি সবজান্তা পুলিশের মুখ থেকেই। আগেই বলেছি, পুলিশের মুখ থেকে শুনেই বিশ্বাস করতে হয় সব। এসব বাংলা-টিম, ইংরেজি-টিম, আরবি-টিমের সদস্যরাই নাকি অশুভ বাঁশির সুরে পাগল করে আমাদের ছেলেদেরকে অজ্ঞাতাবাসে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে চোরাবালির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশটাকেও।
এসব কথা কতোটুকু সত্য কিংবা কার স্বার্থে হচ্ছে এগুলো? কোনো কিছুই আমাদের মগজহীন মাথায় ঢোকে না। আসলে আছি তো অন্ধকারে, এজন্যই অন্ধকারের কোনো কিছু দেখতে পারি না। ঘটনাগুলো আলোতে ঘটলে ঠিকই বুঝতে পারতাম। কারণ, অন্ধকার থেকে আলোর সবটুকু দেখা যায়। কিন্তু অন্ধকারে থেকে অন্ধকারের কিছুই দেখা যায় না। তবে আন্দাজ করা যায়। ঘটনারও একটা গন্ধ আছে, সেটা অন্ধও টের পায়। আমরাও আন্দাজ করতে পারি পুলিশের সব কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, ‘কাজির খাতায় লেখা গোওয়ালে নাই’ বলে একটা কথা সমাজে বেশ চালু আছে। তারপরও অদৃশ্যের খবর বলে কথা। বিজ্ঞানের কষ্টি পাথরের প্রমাণ না মিললেও কিতাবের লেখায় বিশ্বাস রাখতে হয়। না রাখলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাবে যে। এসব ভেবে মাঝে-মধ্যে হতাশ হয়ে পড়ি। মনে হয় এটাই বুঝি আমাদের নিয়তি। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, অন্ধকার যতো ঘনিভূত হয় ভোর ততোই নিকটে। নবজাত শিশু যেমন তার মাকে মৃত্যুর হিমঘরে ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ খুশিতে ভরে দেয় সব, তেমনি করে আমরাও হয়তো অন্ধকারের অচেনা-অজানা হাজারো বাঁকা গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে ভোরের দেখা পেয়ে যাবো। যে-অন্ধকার থেকে পিতৃপুরুষেরা বেরিয়ে যেতে পারেনি, আমরা হয়তো পারবো। এমন একটা ক্ষীণ আশা যখন বুকে বেঁধে অপেক্ষার প্রহর গোনার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই শুনি হঠাৎ পত্রিকার কাটতি বেড়ে গেছে। ঘটনা কী? পরে শুনি ইলেকশনের তফসিল ঘোষণা করেছে। লোকে বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। নির্বাচন মানেই অস্ত্রের মহড়া, হুমকি-ধুমকিতে মোবাইল ফাটা। মহল্লার অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াবে মৃত্যুর মিছিল। পোস্টারে পোস্টারে ঢেকে দেয়া হবে সব বঞ্চনার দাগ। সে সাথে আমাদেরও কাজ বেড়ে গেলো। চোখ খোলা রেখে পাঞ্জাবির ফ্যাশন শো দেখতে হবে আর কান খাড়া করে মাইকের পাবলিসিটি শুনতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও শুনতে হবে। কোমরের ব্যথায় মরে গেলেও সোজা হয়ে ওঠে ফ্যাশন শো’র মডেলদের সাথে কোলাকুলি করতে হবে। এর সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলেই খবর আছে। আমি দেখি, লোকেরা কম চালাক না। ভোটের রেজাল্ট যে কী হবে তা জেনেও বিনা পয়সায় নুন চা পান করতে করতে বলে—ভাই, যদি হাত-পা নিয়া কোনো-মতে কেন্দ্রে যাইতে পারি, তাহলে মনে রাইখেন আপনি নিশ্চিত—। আমার ভাই তোমার ভাই—।
অভিনয় কাকে বলে? উহা কত ও কী কী? মহল্লার লোকদেরকে দেখলে অস্কারপ্রাপ্ত হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও লজ্জায় মিইয়ে যাবে।
লোকেরা অভিনয় করতে থাকে। সে-অভিনয় মিডিয়ায় প্রচারের জন্যে ঢাউস ঢাউস ক্যামেরা হাতে মিডিয়ার কর্মীরা ছুটে আসে। তাদের পেছনে ঘুর ঘুর করে। পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। চ্যানেলের সূচক বেড়ে যায়। বড়ো পর্দা, ছোটো পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তখন দীর্ঘদিনের ছুটি পেয়ে বাসায় বসে বসে উকুন মারে। ক্যামেরার চোখ তখন কেবলই ভোটারদের দিকে। তারা কীসব বলাবলি করে? কোথায় কোথায় যায়? শুনতে চায়। চোখের ভেতর, জবানের ভেতর কী লুকিয়ে রেখেছে? দেখতে চায়। কিন্তু ভোটাররা কিছুই প্রকাশ করে না। কেবল অভিনয় করে। কারণ তারা জানে, ক্যামেরার পেছনেও ক্যামেরা আছে। উল্টা-পাল্টা বললেই খবর...
ভাবটা যেনো এমন—কী দরকার অসময়ে জবান খরচ করে বিপদ ডেকে আনার? তার চেয়ে অভিনয় করা সহজ। ক্যামেরার সামনে অভিনয় করবে, ক্যামেরা চলে গেলে যা ইচ্ছে বলবে। উত্তর কুরিয়ার মৃত্যুদানব প্রেসিডেন্ট কিম জং উনকে নাকি সে-দেশের লোকেরা আড়ালে-আবডালে মটকু ডাকে। খাতার পাতায় তাঁর ছবি এঁকে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা তাতে থুথু নিক্ষেপ করে। পত্রিকায় খবরটা পড়ে মনে হলো, ওদের আর আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি দেখি আমাদের ভোটাররাও ক্যামেরার আড়ালে আমাদের সম্মানীত মটকু-মটকিদের নিয়ে অনেক বকাবকি করে। রাস্তার পাশে মটকু-মটকিদের ছবিযুক্ত ঢাউস ঢাউস ব্যানার-ফেস্টুন দেখে থুথু নিক্ষেপ করে। কেউ দেখে না। কেউ সামনে পড়লে সালাম দিয়ে ভালো মানুষের মতো পাশ কাটিয়ে চলে আসে। সেদিন তো প্রায় ধরা পড়েই যাচ্ছিলো। মর্নিং ওয়াক করে এসে কয়েকজন রহিম মিয়ার চা-দোকানে লবণ মেশানো আদা-চা খেতে খেতে সকালের পত্রিকায় চোখ রেখে বিশ্বরাজনীতির ময়না তদন্ত করছিলো। কেউ বলছিলো, মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুব করুণ। গণতন্ত্রের লেবাস পরে জান্তা সরকার যেভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে, সভ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে এমন নৃশংসতা কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। নোবেল কমিটির উচিত অং সান সুচির কাছ থেকে নোবেল পুরস্কার কেড়ে নেয়া। কেউ বলছিলো, শুধু সুচির নয়, পুরস্কার কেড়ে নেয়া উচিত বারাক ওবামার কাছ থেকেও। সে এক আইএস অস্ত্র দিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে শেষ করে দিয়েছে। সিরিয়াকে এখন কোনো দেশ বলা যায় না। বড়োজোর ওটাকে রুশ-মার্কিনের যুদ্ধক্ষেত্র বলা যেতে পারে। তাদের কথা শুনে আব্বাস বলে, এতো কথা বলো না তো, আল্লা যা করে ভালোর জন্যই করে। বিশ্বের দরবারে মুসলমান জাতটাই খারাপ। মুসলমানরা এখন আগের জায়গায় নাই। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথ ছাইড়া তারা এখন অন্যের হাতের দিকে চায়া থাকে। শিয়া-সুন্নি-মুতাজিলাসহ নানা মত-পথে বিভক্ত হয়ে গোড়া কৃমির মতো নিজেরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করে মরে। এজন্যেই তাদের এতো সিদ্দত। আজাইরা মানুষেরে দুইষ্যা লাভ নাই। এদেরকে সাইজ করবার লাগি খোদা নিজেই আইএস পাঠাইছে।
আব্বাসের কথায় কামাল কিছুটা ক্ষ্যাপে যায়। সে বলে, ‘দুরু! বাদ দেও তো এসব। নিজেদের কথা কও। ভোটের দিন বাসায় থাকবা নাকি মহল্লা ছাইড়া পালাইবা। আমি নিয়্যত করছি, ভোটের আগের দিন থেকেই উধাও হয়ে যামু।’ তখন মুখ খুলে ক্লাবের সাবেক সম্পাদক রতন মাহমুদ। সে বলে, ‘মহল্লা ছাইড়া পালাবা ক্যান? বাসায় বইয়া বইয়া টিভি দেখবা। মটকু-মটকিদের অভিনয় দেখবা। আমাদের অভিনয় দেখবা। ক্যান আমাদের অভিনয় ভালো লাগে না?’ তারা তখন হাসে। কী যে কও মিয়া। ভাল্লাবো না ক্যান? ভাল্লাগে। সবই ভাল্লাগে। এই যে রহিম মিয়া প্রতিদিন সকালে দোকান থিকা বাইর অইয়া ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবাইস’ বলতে বলতে উন্নয়নের ফিরিস্তি লেখা সাইন বোর্ডের গোড়ায় যায়া পেশাব করতে বয়, এই দৃশ্যও তো আমাদের ভাল্লাগে।
এসব নিয়ে যখন তারা হাসাহাসি করছিলো, ঠিক তখনই কয়েকজন সহযোগিসহ এক ক্যান্ডিডেট তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং তার কর্মীরা প্রত্যেকের হাতে হ্যান্ডবিল বিলি করতে থাকে। ছবিযুক্ত হ্যান্ডবিলে এক নজর তাকিয়ে তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার সাথে হাসি মুখে কোলাকুলি করে। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে, ‘আল্লা তোমার হায়াৎ দারাজ করুক এবং শরীর-স্বাস্থ্য ভালো রাখুক।’ কারণ তারা জানে, তার বিজয় নিশ্চিত। সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে খুনের হুমকি দিয়ে মহল্লা তো মহল্লা একেবারে শহর ছাড়া করে দিয়েছে। পুলিশ এসে দিন-রাত ঘুরে বেড়ায়। নিখোঁজ প্রার্থীর কোনো সমর্থক চোখে পড়লেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আতঙ্কে তাদের প্রচার তো দূরের কথা ছায়া পর্যন্ত তারা দেখতে পায় না। এখন সে বিজয়ী হয়েই তাদের কাছে এসেছে। এখন কেবল নির্বাচন কমিশনের মুখের ডিক্লিয়ারটা বাকি। আর সেটা শোনার বা শোনানোর জন্যে এই অভিনয়। ভোটাররাও কম যায় না। অভিনয় করে তারাও বলে, এগিয়ে যাও আমরা আছি...। খুশি হয়ে সে চলে যায়। সে চলে যেতে-না-যেতেই  রহিম মিয়া এক কাজ করে বসে। সবার হাত থেকে হ্যান্ডবিলগুলো নিয়ে চুলার ভেতর ঢুকিয়ে দেয় আর মুখে বলে, ‘হে তো পাশই এবং আগামী পাঁচ বছর তার কাছ থেকে আমরা কোনো সুবিধা পামু না। তাই হ্যান্ডবিল পুড়িয়ে লাকড়ি দুইড্যা বাঁচাইলাম আর কি। আপনেরা কী কন?’ তারাও তার সাথে দোহা টেনে বলে, ‘ভালো ভালো। একটা কাজের কাজ করেছো তুমি।’ ভাগ্যের কী খেলা। কথাটা বলে শেষ করতে পারেনি। ঠিক তখনই ক্যান্ডিডেটের এক কর্মী আবার তাদের সামনে যেয়ে উপস্থিত। ‘কী ব্যাপার কুদ্দুস! আবার কেনো?’ ভয়ে নাকি কেরামত কাকার ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে কাঠ।
চাচা, ভুলে এখানে এক বান্ডিল পোস্টার রেখে গিয়েছিলাম। নিতে এসেছি।
তারা তখন দোকানের ভেতর চোখ ঘোরায়। দেখে, বান্ডিলটা রাহিম মিয়ার চুলার ভেতর দাউ দাউ করে জ্বলছে। সর্বনাশ! এ-দৃশ্য কুদ্দসের চোখে পড়লে খবর আছে। সাথে সাথে তারা কয়েকজন সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে চুলাটাকে আড়াল করে রাখে। কিন্তু কাগজ পোড়ার গন্ধ তো কোনো-মতে দূর পারে না। সে-ভয়েই তাদের হাত-পা এক প্রকার কাঁপতে ছিলো। তবে আল্লার কি মর্জি, সে তার মুখের ভদকার গন্ধের কারণে বুঝতে পারেনি। কয়েক সেকেন্ড এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে চলে যায়। তারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এমনি নানা দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে একদিন দোর-গোড়ায় এসে কড়া নাড়ে ভোটের সকাল। যারা বেরোবার তারা বেরিয়ে পড়ে রাতেই। রাতে চলে আশ্চর্য কেনা-বেচা। বোধ-আত্মা-বেঁচে থাকা সব বিক্রি হয়ে যায় অমাবস্যার বাজারে। বিক্রি হয়ে যায় বঙ্গোপসাগরে এতোদিনের জমানো জলের ঘূর্ণিও। ব্লেডের মতো ধারালো নীল আলোর শপিং মলে বেচা-কেনা চলে লোভ-লালসা-হিংসা-জিঘাংসার মতো প্রিজর্ভেটিভমাখা পণ্যগুলিও।
আমরা তখন ঘুমোই। সে-রাতে আমরা কোনো স্বপ্ন দেখি না। কেবল মরা লাশের মতো বিছানায় শুয়ে থাকি। এটাই ছিলো অঘোষিত আদেশ। আমরা পালন করি অক্ষরে অক্ষরে। সকাল দশটা বেজে যায় তারপরও দরজা খুলি না। কারণ আমরা জানি, আমরা ভোট কেন্দ্রে না গেলেও ভোটবাক্স অপূর্ণ থাকবে না। দেবতাদের দৈবিক ক্ষমতায় সকাল দশটা কি সাড়ে-দশটার ভেতরেই বাক্স পূর্ণ হয়ে যাবে। শুধু আজকের জন্যে ক্যামেরার সামনে আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দেবতাদের খাসভক্তবৃন্দের মাধ্যমেই ক্যামেরার দৃষ্টি সীমানা পরিপূর্ণ। আজকের জন্যে তাঁরাই যথেষ্ট। আমাদের কাজ শুধু গৃহবন্দি থেকে টিভিতে তাঁদের অভিনয় দেখা। টিভি ছেড়ে অভিনয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। সব চ্যানেলে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে—’, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না—’ ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা—,’ ইত্যাদি দেশাত্মবোধক গান চলতে থাকে। দশটা-এগারোটা-বারোটা বাজে কোথাও খবর নেই।
তবে পায়ের চলার পথে সারিবদ্ধ বুটের আওয়াজ। কাঁদানি গ্যাসের ঝাঁজ। অক্ষমের বিলাপ। এসব সিম্পটম থেকেই আমরা আন্দাজ করতে পারি শহরের অলি-গলি খবরে ঠাসা। কিন্তু টিভিতে কিছুই দেখানো হচ্ছে না। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। ইন্টারনেটও বন্ধ। কোনোভাবেই খবরের জগতে ঢোকার সুযোগ নেই। তার মানে বিকেল চারটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিকেল চারটায় দেবতারা মর্তে আবির্ভূত হবেন। আমরা দেব-দেবী দর্শনে ধন্য হবো। তখন ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। বিজয় মিছিল করতে হবে। ইচ্ছে না থাকলেও মিছিলের পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে। মিছিল যাবে শক্তির উৎস সূর্যভবনের সামনে। আমরা সেখানে গিয়ে জড়ো হবো। মহাদেব-মহাদেবী ভাষণ দেবেন। আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনবো। আবেগে চোখের জল ফেলবো। তবেই না আমাদের পরিত্রাণ।
(চলবে)


ভ্রমণ : লাউচাপড়া

 ভ্রমণ : লাউচাপড়া


 লাউচাপড়া
তৌহিদ আহাম্মেদ লিখন

ভ্রমণ মানুষের অন্যতম প্রিয় শখ। আর ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত একটি স্থান রয়েছে যার নাম লাউচাপড়া পিকনিক স্পট যা অনেকেই হয়তো জানেন না। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে কিংবা ঘন অরণ্য, পাহাড়ি ঝরনা, পাখির কিচিরমিচির ডাক, যান্ত্রিক কোলাহলমুক্ত মায়াঘেরা অঞ্চলে যেতে চায় না এমন মানুষ খুব কমই বোধ হয় পাওয়া যাবে।
আপনি যদি আপনার একাকিত্বকে দূর করতে চান, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চান, প্রকৃতির সাথে যদি কথা বলতে চান তবে আপনার জন্য সেরা জায়গাটি হতে পারে লাউচাপড়া ইকোপার্ক । আপনি চাইলেই ঘুরে যেতে পারবেন এই ঐতিহ্যবাহী লাউচাপড়া দিয়ে। ছোটবড় পাহাড়ের সঙ্গে সারি সারি গাছগাছালির ঘন অরণ্যর মোহনীয় রূপ আপনাকে মোহিত করবে। আর সঙ্গে যদি পরিবারপরিজন, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন থাকে তবে তো কথায় নেই। সুখের সাগরে ভাসতে থাকবেন কোনো বিকল্পই নেই। আবহাওয়া পরিবর্তন করতে চাইলেও আপনি চলে আসতে পারেন লাউচাপড়ায়।


কেন আসবেন লাউচাপড়াঃ

প্রতিটি জায়গা ভ্রমণ করার পিছনে যেকোনো একটি উদ্দেশ্য মানুষের থেকে থাকে। তেমনি লাউচাপড়া আসার জন্যও রয়েছে কিছু আশ্চর্যজনক কারণ যা আপনাকে অবশ্যই চমকিয়ে দিবে। আপনার ভিতর আগ্রহ জন্মাবে এখানে ঘুরে যাওয়ার জন্য। তবে এবার শোনা যাক সেই আশ্চর্যজনক ঘটনা কি !
প্রায় দেড়শ ফুট উঁচু অবকাশ কেন্দ্রের মাঝখানে নির্মিত হয়েছে ৬০ ফুট উঁচু টাওয়ার। যেখানে উঠলেই দেখতে পাবেন দিগন্তে সারি সারি ছোটবড় সবুজ পাহাড়। চোখের পড়বে সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য এবং দেখতে পাবেন ভারতের ছোট শহর মহেন্দ্রগঞ্জ।সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে এখানে একটি অদ্ভুত গাছ রয়েছে। গাছটির নাম হচ্ছে ধুতধুরাণী গাছ। প্রকৃতপক্ষে এ গাছের নামটি আঞ্চলিক বা উপাধি নাম। আবার কেউ কেউ এই গাছের নাম ঝুরঝুরাণী বলেও অভিহিত করে থাকেন। এই গাছের মূল রহস্য হচ্ছে অনেক বছর যাবৎ এ গাছের গোড়া হতে পানি আসছে। যা এখন পর্যন্ত বন্ধ হয়নি। বলা হয়ে থাকে এ পানি অনেক পবিত্র এবং এ পানি পান করলে শরীরের রোগমুক্ত হয় ও অনেক উপকার হয়। এই গাছের পাশেই রয়েছে একটি মাজার। অনেকেই এই মাজারে এসে নামাজ পরে, শিন্নি দিয়ে থাকেন ফলে মনের আশা পূর্ণ হয় বলে অভিহিত আছে। এই গাছের পানি দিয়েই এলাকার মানুষ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকেন ফলে তাদের কোনোপ্রকার নলকূপের প্রয়োজন হয়না। এছাড়াও চারপাশে রয়েছে রাবার গাছ। রাবার গাছের কষই হচ্ছে মূলত রাবার। রাবার কষ সংগ্রহ করে রাবার উৎপাদন করার কারখানাও রয়েছে এখানে। পুরো পাহাড় আর বনভূমি লাউচাপড়া ও ডুমুরতলা, এ দুটি মৌজায় বিভক্ত। কয়েকটা গ্রাম রয়েছে এখানে। এসব গ্রামে বাঙালিদের সাথে প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ গারো, কোচ, হাজং অধিবাসী পরিবার বাস করে। তাদের জীবনযাত্রাও উপভোগ করার জন্যও আসতে পারেন লাউচাপড়ায়।

যেভাবে আসবেন লাউচাপড়াঃ

জায়গাটি বর্তমান ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলায় অবস্থিত। জামালপুর জেলা সদর থেকে ৩৮ কিলোমিটার ঠিক উত্তরে বকশীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। বকশীগঞ্জ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত লাউচাপড়া। ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে চলে আসতে পারেন সরাসরি জামালপুর জেলায়। তারপর জামালপুর থেকে বাস অথবা সিএনজি দিয়ে বকশীগঞ্জ বা সরাসরি লাউচাপড়ায় আসতে পারেন। লাউচাপড়া আসার পথে দেখতে পাবেন পাকা রাস্তার দুপাশে গ্রামীণ জনপদ, ফসলের মাঠ ও সবুজ বৃক্ষ।

পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থাঃ

যারা দূর থেকে এখানে আসে, তাদের জন্য জামালপুর জেলা পরিষদের পক্ষ হতে ‘ক্ষণিকা’ নামে একটি পিকনিক স্পট নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে থাকার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা করা রয়েছে। তবে এখানে থাকতে গেলে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে আসতে হবে, তার জন্য রয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। তাছাড়া ‘ক্ষণিকা’ স্পটের পাশাপাশি অবকাশ কেন্দ্রের পাশেই রয়েছে ‘বনফুল’ নামে বেসরকারি একটি রিসোর্ট। এখানে আপনি পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারবেন। লাউচাপড়া, অন্যান্য নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মতোই নিরাপদ। তাছাড়া এর সাথেই রয়েছে বিজিবি ক্যাম্প। সকল প্রকার সতর্কবার্তা তারা দিয়ে থাকেন। ফলে আপনি অনেকটা নিশ্চিন্তে এখানে কয়েকদিন ঘুরে যেতে পারবেন।