ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪২

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪২
তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪২
শুক্রবার, ১৩ মার্চ ২০২০


























লেখিকা হওয়ার গল্প

লেখিকা হওয়ার গল্প




লেখিকা হওয়ার গল্প
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

মানুষের জীবনে হঠাৎ করেই এমন কিছু মোড় আসে, যা তার জীবনটা বদলে দেয়। এমনকি বদলে যায় তার পরিচিতি। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমি ছিলাম একজন ষোড়শী যুবতী। তখনই আমার বিয়ে হয় আর আমি লাল শাড়ি পরে হয়ে গেলাম একজন নারী। বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পর আমার নামটাও বদলে যায়। বাবার দেওয়া নাম সোনালী ইসলাম থেকে তখন স্বামী আসিফ রহমানের নামের শেষাংশ গ্রহণ করে হয়ে গেলাম সোনালী রহমান। বছর ঘুরতেই আমাদের প্রথম সন্তান জারিন এবং ঠিক তার দুই বছর পর দ্বিতীয় সন্তান তৌসিফের জন্ম। খুব দ্রুতই হয়ে উঠি দুই সন্তানের জননী। সংসার ও সন্তান সামলাতে গিয়ে লেখাপড়া একদম শিকে উঠে কিন্তু আমার বই প্রীতি ঠিকই থেকে যায়। যখনই সুযোগ পেতাম, আমার প্রিয় লেখকদের বই পড়তাম। তবে সাংসারিক চাপে বই পড়ার সুযোগ খুবই কম পেতাম। বিয়ের পাঁচ বছর পর স্বামীর হাত ধরে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাই স্বপ্নের দেশ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। সেখানে শুরু হয় সম্পূর্ণরূপে এক নতুন জীবন। বলতে গেলে নতুন করে একটা জীবন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে গা ভাসিয়ে কখন যে বাঙালি ললনা থেকে আমেরিকান মেম হয়ে গেলাম, সেটাই টের পাইনি। এক সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ হয়ে গেলাম পুরোদস্তুর আমেরিকান। যদিও আমাদের মতো মাইপ্রেট করা নাগরিকদের এখানে বাঙালিই বলা হয়ে থাকে। এটা বলাটাই খুব স্বাভাবিক কারণ আমাদের পরিচয় বদলে নিলেও অনেকেই মনেপ্রাণে ষোলো আনা বাঙালি থেকে যায়। তাদের মধ্যে আমিও একজন। শাড়ির প্রতি আমার ভীষণ টান, প্রায়ই ছুটির দিনে জীবনানন্দের বনলতা সেন সেজে আয়নার সামনে বসে থাকি।

স্বপ্নের দেশ আমেরিকা থাকলেও সবার জীবন স্বপ্নের মতো রঙিন হয় না। কারো কারো জীবনের রঙ বেদনার ধূসর রঙে ঢেকে থাকে। এক কথায় বলা যায়, কষ্টের সাথে বারোমাস বসবাস। কষ্টকে নিয়তি মেনে চরিত্রহীন মাতাল স্বামীর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেও শেষ পর্যন্ত আর সংসার টিকিয়ে রাখা গেল না। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে নরক থেকে মুক্তি নিয়ে নতুন করে শুরু করি আরেক জীবন যুদ্ধ। আমার সন্তানেরা বড়ো হয়ে গেছে। তারা তাদের নিয়েই থাকে মহাব্যস্ত আর আমি কাজকর্মের ফাঁকে বইয়ের রাজ্যে। মাঝেমধ্যে সময় পেলে ফেসবুকেও কিছু সময় কাটাই কিন্তু ততোটা সময় হয়ে উঠে না। ফেসবুকে অনেক নামীদামি বাঙালি লেখক-লেখিকার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে তাদের লেখা গল্প ও কবিতা ছাপা হয়। আমি তাদের লেখাগুলো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। মাঝেমধ্যে নিজেও ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখি করতে চেষ্টা করতাম কিন্তু তেমন পেরে উঠতাম না। তাই আমার অধিকাংশ লেখাই ফেসবুকে ‘অনলি মি’ করে রেখে দিতাম। তবে হ্যাঁ, আমার পরিচিত বন্ধুদের কেউ কেউ আমার কিছু লেখা পড়ে বেশ প্রসংশা করে। যদিও ওই লেখাগুলো ছিল নিউইয়র্কে আমার চলার পথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মজার ঘটনাবলি। আমার কষ্টের জীবনে এসব লেখা লিখে এক ধরণের মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতাম। তবে নিজে কখনো যে একজন লেখিকা হয়ে উঠবো, সেটা স্বপ্নেও কল্পনাও করিনি। যেদিন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য পাতায় আমার লেখা গল্প ছাপা হলো, সেটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার বন্ধুরা তো রীতিমতো ঠাসকি খেয়ে যায়। এমনকি ফেসবুকে আমার নামীদামি লেখক-লেখিকা বন্ধুরাও অবাক হয়ে যায়। তাদের অনেকেই ধারণা করেছিল, আমি হয়তো কোন ভাবে ম্যানেজ করে আমার লেখা গল্পটি ওই পত্রিকায় ছেপেছিলাম। নয়তো আমার লেখা কেন ছাপাবে? আমি তো কোন ভাবেই লেখিকা নই। ফেসবুকে মাঝেমধ্যে কিছু রম্য টাইপের লেখালেখি করি। এসব লিখে তো কেউ আর লেখিকা হতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, এক সময় দেখা গেল বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো শীর্ষস্থানীয় জাতীয় পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে আমার লেখা গল্পগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতে থাকে। ধীরে ধীরে কিভাবে যেন আমিও একজন নামীদামি লেখিকা বনে গেলাম। এখন সবাই আমাকে ‘লেখিকা’ বলেই সম্বোধন করে। তবে হ্যাঁ, আমি লেখিকা হয়ে উঠার পেছনে একজন লেখকের গল্প জড়িয়ে আছে। যার একান্ত প্রচেষ্টায় আমার লেখিকা হয়ে উঠা।



ফেসবুকে সাঈদ জামানের সাথে আমার পরিচয়। তিনি খুব ভালো লিখেন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত ভাবে তার লেখা প্রকাশিত হয়। আমি ছিলাম তার লেখার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। ফেসবুকে তার প্রতিটি লেখাই আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। মাঝেমধ্যে আমার মুগ্ধতার কথা জানিয়ে মন্তব্য করতাম। হঠাৎ একদিন ফেসবুক নোটিফিকেশনে দেখলাম আমার একটি পোস্টে সাইফ জামান মন্তব্য করেছেন। আমি খুব উত্সাহ নিয়ে সেই মন্তব্য পড়ে অবাক হয়ে কয়েক মিনিটের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে ছিলাম। তিনি মন্তব্য করে ছিলেন, ‘আপনার লেখায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। লেখাটা অব্যাহত রাখুন। মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম। ‘এমন মন্তব্য পড়ে ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো এমনিতেই আমার মতো ভক্তকে খুশি করতে এই মন্তব্য করেছেন। তবুও মনের কৌতুহল থেকে উনার ইনবক্সে গিয়ে নক করলাম।
কেমন আছেন। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনার মন্তব্যটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
মেসেজ লিখে অপেক্ষায় রইলাম দীর্ঘ সময় ধরে কিন্তু তিনি অনলাইনে আসছেন না। অনলাইনে এসেও আমার মেসেজ পড়লেন না। মন খারাপ করে উত্তরের আশা ছেড়ে দিলাম। হঠাৎ দুদিন পর দেখি উনার মেসেজ।
প্রথমেই দুঃখিত, আপনার মেসেজ পড়তে দেরি হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আমি কখনো মিথ্যা কিংবা বাড়িয়ে মন্তব্য করি না।
তাই নাকি! তাহলে কী সত্যি সত্যিই আমার ওই লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে?
শুধু ভালো নয়, ভীষণ ভালো লেগেছে। আপনার বেশ কয়টি লেখা পড়ে ওই মন্তব্য করে ছিলাম।
আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি তো আর আপনার মতো লেখক নই।
আমার চাইতেও অনেক ভালো লিখতে পারবেন। আপনি সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত।
জ¦ী একদম ঠিক বলেছেন। আমি উনার অন্ধ ভক্ত। তবে আপনি সেটা কিভাবে বুঝলেন?
আপনার লেখা পড়েই বুঝতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, আপনার লেখায় নিজেস্ব ধাঁচ আছে। সেটাও আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে।
কি বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আমার লেখার নিজেস্ব ধাঁচ আপনাকে আকৃষ্ট করেছে।
নিজের উপর আস্থা রাখুন, নিয়মিত লেখালেখি করুন। আপনার রম্য লেখার হাত আছে। এইদিকে খুব ভালো করতে পারবেন।

সাঈদ জামানের সাথে কথা বলার পর গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে এক আড্ডায় সাঈদ জামানের সাথে যেসব কথা হলো, সেসব নিয়ে আলোচনা করলাম। তারা সবাই খুব হাসাহাসি করলো। আমাকে টিপ্পনী কেটে বললো, সম্ভবত ওই লেখক লেখাতে নয়, আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। লেখকদের চরিত্র এমনই হয়, ভুলিয়ে ভালিয়ে নারীদের মন জয় করা। ওদের কথায় সাঈদ জামানের প্রতি আমার ভীষণ রাগ হলো। এরপর থেকে বেশ কিছু দিন তার কোন লেখাও পড়িনি। হঠাৎ একদিন আমার ইনবক্সে সাঈদ জামানের একটা মেসেজ পেলাম। মেসেজ দেখেই চমকে উঠলাম। আমার লেখা একটা গল্প বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার রম্য ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। গুগুলে সার্চ দিয়ে দেখলাম ঠিক আছে। জীবনে এই প্রথম আমার লেখা কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেটাও কি-না এতো জনপ্রিয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে! তারপর সাঈদ জামানের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি জানালেন, আমার টাইম লাইন থেকে গল্পটি নিয়ে কিছু সংশোধন করে ওই পত্রিকায় ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়ে ছিলেন। তখন আমি উনার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলাম। কেন আমার অনুমতি ছাড়া আমার লেখা পত্রিকায় পাঠালেন। উনার আসল উদ্দেশ্য জানতে চাইলাম, কেন আমাকে ইম্প্রেস করতে চাইছেন। তিনি তখন ভীষণ বিরক্ত হলেন। আমাকে রাগান্বিত হয়ে বললেন, আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতেই তিনি লেখাটা ঠিকঠাক করে পত্রিকায় পাঠিয়ে ছিলেন। এখানে অন্য কোন উদ্দেশ্যে নেই। ধীরে ধীরে আমরা দুজন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে যাই। যদিও বয়সে সাঈদ জামান আমার চেয়ে বেশ ছোট কিন্তু তার ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ। লেখালেখির বিষয়ে আমাকে অনেক পরামর্শ দিত এবং বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করত। আমি তার পরামর্শ ও সহযোগিতা পেয়ে আমার চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা থেকে একের পর এক রম্য গল্প লিখে যাচ্ছি।

একদিন সাঈদ জামান আমার ইনবক্সে বেশ কিছু ইমেইল এড্রেস দিলেন। তিনি জানালেন, এগুলো বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের ইমেইল এড্রেস। আমি যেন আমার লেখা গল্পগুলো ইমেইলে পাঠিয়ে দিই। আমার ধারণা ছিল, আমার লেখা পত্রিকায় ছাপাবে না। তবুও সাঈদ জামানের চাপে গল্পগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় ইমেইলে পাঠিয়ে দিলাম। কিছু দিনের মধ্যেই সবগুলো লেখা প্রকাশিত হয়। তখন সাঈদ জামান আমাকে ইনবক্সে বললেন,
এবার তো আমি ইমেইলে লেখা পাঠাইনি। তবুও কিভাবে এতোগুলো পত্রিকায় আপনার লেখা গল্প গুলো ছাপা হলো? রহস্যটা কি বলুন তো?
আমি তখন বেশ লজ্জা পেলাম। সেই সাথে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কোন উত্তর না দিয়ে কিছু সময় চুপ করে রইলাম। তারপর উত্তর দিলাম,
নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। তবে শুধুমাত্র আপনার সহযোগিতার জন্যেই মনে হচ্ছে আমিও একদিন লেখিকা হয়ে উঠবো।
হা হা হা.. এখনো কী লেখিকা হতে পারেননি? আমার আর কোন সহযোগিতা আপনার দরকার নেই। আপনি এগিয়ে যান, শুভকামনা রইলো।
আমি সাঈদ জামানের মেসেজ পড়ে বেশ কষ্ট পেলাম। তিনি কেন যেন আমার থেকে দূরে সরে গেলেন। এদিকে পত্রিকা অফিস থেকে বিভিন্ন পত্রিকা অফিস থেকে আমার কাছে ইমেইল আসছে নতুন গল্প পাঠাতে। আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি। অনেক উত্সাহ উদ্দীপনা নিয়ে নতুন করে গল্প লিখে ইমেইলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার লেখাগুলো নিয়মিতভাবে ছাপা হচ্ছে। আমার ভক্তের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুজন প্রকাশক আমার লেখা গল্পগুলো দিয়ে বই প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করে। আমি তখন খুশিতে আত্মহারা। যথা সময়ে বই দুটি প্রকাশিত হয় এবং বইমেলায় ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। বইমেলা উপলক্ষে আমি বাংলাদেশে গিয়ে ছিলাম। তখন আমাকে নিয়ে আমার ভক্তদের আগ্রহ দেখে অবাক হয়ে যাই। এতো সাধারণ একজন মানুষ, যার লেখাপড়াও খুব বেশি নয়। সেই মানুষের কাছে অটোগ্রাফ নিয়ে ভক্তরা বই কিনছে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকরা এসে ইন্টারভিউ নিচ্ছে। এটা যেন আমার কাছে অকল্পনীয়। যে মানুষটির জন্যে অকল্পনীয় ব্যাপারটি বাস্তব হলো, সেই মানুষটির সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও তার দেখা পাইনি। বর্তমানে আমার পরিচয়, আমি একজন জনপ্রিয় লেখিকা। তবে আমার লেখিকা হওয়ার পেছনের গল্পটাই সবার কাছেই অজানা।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা



পাঠক

পাঠক



পাঠক
আসিফ আহমদ

অনেকটা আচমকা ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে মা কে বলল হাসান, তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও মেলায় যাব। মা ছানা বড়ার মত চোখ করে জিগ্যেস করল, মেলায় যাবি, কোন মেলায়? হাসান বলে উঠলো, কোন মেলায় আবার বই মেলায়। তুই না
গতকাল মেলা শেষ করে ফিরলি? এই কথা শুনা মাত্র হাসান আকাশ থেকে পরল মিন মিন করে বলতে লাগলো সত্যিই কি মেলা শেষ, নাকি সবি আমার কল্পনা মাত্র?

এর মধ্যে হঠাৎ কে যেন অনরগল ডেকে চলছে হাসান,, হাসান বলে।
হাসান স্পষ্ট  শুনতে পাচ্ছে।
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু,,
ধুসর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে গোটা ঘর
আর একবার হাসান বলে ডাকা মাত্র চোখ মেলে তাকাল, নাক বারাবর দাড়িয়ে আছে মা। সে বিছানায় শোয়া। গোটা শরীর ভিজে একাকার, বুঝতে পারলো সে ঘামছে, এর মধ্যে মা বলে উঠলো এখন কেমন লাগছে জ¦র কমেছে? এই বলে মার একটি হাত হাসানের কপালে ছুঁইয়ে দিল, হু অনেকটাই কমেছে।
সেই যে মেলা শেষ করে এসে মরার মত ঘুমলি আর কোন খবর আছে? এক ঘুমে একদিন পার করেদিলি এর মধ্যে আবার তোর গায়ে জ¦র আমি তো ভিষন দুশ্চিম্তায় পড়ে গিয়েছিলাম জাক আল্লাহ বাঁচিয়েছে। নে এবার তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে সামনের রুমে আয় তো দেখি।
এই বলে আম্মু হন হন করে হেটে চলে
গেল।
হাসান যেন অনেকটা পাগলের মত মাথা চুল কোতে চুল কোতে বলতে লাগলো বই মেলা কি কখনো শেষ হতে পারে?
যারা প্রকৃত পাঠক তাদের জন্য তো প্রতিটি দিন বই মেলা। তারা রোজ কিনবে নতুন নতুন বই। এক বসাতে তা শেষ করে কিনবে আরো কয়েকটি। এভাবে কিনতে শুরু করবে পড়তে শুরু করবে সমস্ত বই। যদিও বা তারা কিনবেনা জমজমাট সাজসজ্জল ময় কোন দোকান হতে ,কিনবেনা কোন মেলা থেকে কোন লেখকের অটোগ্রাফ নিয়ে। তারা কিনবে রাস্তার পাশে বসা পুরাতন বই বিক্রেতা থেকে পছন্দ মত বই। তারা দেখবেনা বইটা ছেড়া নাকি নতুন চকচকে বাইন্ডিং, আকর্ষণ ময় প্রচ্ছদ। তারা দেখবেনা লেখক নবীন না প্রবীন। তারা শুধু দেখবে ভেতেরের কালো লেখা গুলো।
কি আছে এই বই গুলোতে?

      আছে কি কিছু শেখার
      নাকি সব কিছু বেকার?


চোখের সামনে ভেসে উঠল একদল পাঠকের প্রতিচ্ছবি যারা নাওয়া খাওয়া সব ভুলেগিয়ে এক ধ্যানে পড়ে চলছে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা,এর মধ্যে সেও বসে আছে এক কোণায় বই হাতে। পড়ছে কিনা বুঝতে পারছেনা চেয়ে আছে শুধু এক ভাবে বইয়ের দিকে। একটি কথা হঠাৎ তার মাথায় জট পাকাতে শুরু করল দু,কলম লিখেই আজকাল লেখক স্বীকৃতি পায়।
কিন্তু একজন পাঠক হাজার বই পড়েও পাঠক স্বীকৃতি পায়কি? যারা বই পড়ে তারা কি জ্ঞানী না? নাকি যারা দু,হাতে যা ইচ্ছে তা লিখে তারাই মহা জ্ঞানী?? হাসান খুজে পায়না এই প্রশ্নটির উওর, ভেবে পায়না কি করবে? কাকে করবে এই প্রশ্ন, কেও পারবে উওর দিতে প্রশ্নটির?

এর মধ্যে আবার আম্মু এসে হাক দিল কিরে তোকে না বললাম মুখ হাত ধুয়ে সামনের রুমে আসতে আর তুই কিনা এখানও বিছানায় পাগলের মত বসে আছিস?
অনিচ্ছা সত্বেও উঠে পা বাড়ালাম সোচা ঘরের দিকে।

সামনের রুমে পা দিতেই চোখে পড়ল সোফায় বসা মোটা সোটা লোক একটি, উলটো দিক করে বসায় চেহারাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। হাল্কা গলা খাকানি দিতেই লোকটি পেছন ফিরে তাকাল হাসানের দিকে। লোকটিকে দেখা মাএ হাসানের চোখে মুখে ভেসে উঠলো এক বিস্মময় কর ছাপ, বড় মামা তুমি!
কি অবাক হলি? এইদিকে এসে বোস।
হাসান বসতে বসতে বলল, তাতো হবই।
তোকে অবাক করে দেবার জন্যই তো   
এভেবে হুট করে আসা।
শুধু আমাকে অবাক করে দেবার জন্য?
এনি ডাউট?
নো মামা, হাসান মনে মনে বলে উঠলো, আমি জানি মামা তুমি কাজ ছাড়া কখনও পা বাড়াও কোন দিকে, আর সেই তুমি কিনা শুধু মাএ আমাকে দেখার জন্য সুদুর সিলেট হতে পাড়িদিলে চিটাগং। ভাবতেই অবাক লাগছে!
আগে মাসান্তরে হলেও আমায়
একবার ফোন করতি, এখন তো তাও করিস না।
স্যরি মামা। বিভিন্ন যামেলার কারনে
ফোন করে উঠতে পারিনি
ওহ, তা কোন ব্যাপার না চিটাগং
আসলাম একটি জরুরি কাজে ভাবলাম
এসেছি যখন তোদের সাথে একটু দেখা করে যাই। তোর মার মুখে শুনলাম তোর নাকি জ¦র হয়েছে। এখন কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে। হাসান মনে মনে হেসে নিল এক অতৃপ্তি হাসি, অবশেষে তাহলে মুখ ফুটে বেরিয়ে আসলো এখানে আসার আসল কারণ।
আরো শুনলাম এবারের মেলায় নাকি তোর একটা বই বিরিছে? হাসান অনেকটা লজ্জিত স্বরে বললাম, হ্যাঁ ঐ আরকি।

মামার হাতের দিকে চোখ যেতেই নজরে পড়ল তার স্বরচিত বই খানা, হাল্কা জলপাই রঙ তার সাথে লালের সংমিশ্রণে বেশ ফুটে উঠেছে বইটির প্রচ্ছদ মামার হাতেও দারুন মানিয়েছে বইটি।এর মধ্যে মামা বলে উঠলো, আমি তো তেমন একটা বই-টই পড়িনা তবে দু,চার পৃষ্ঠা পড়ে যা বুঝলাম তোর লেখার হাত বেশ পোক্ত তা শিকার করতেই হয়, তার জন্য তোকে অসংখ্যা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা রইলো। তবে কি হাসান জানিস তোর বইয়ের বাইন্ডিংটানা আমার কাছে তেমন একটা ভাল লাগেনি. তার সাথে প্রচ্ছদ টাও আর বইয়ের পাতা
গুলো তো তারচেও বাজে।।


কথায় বলে না, আগে দর্শণদারী পরে গুন বিচারী। মামার কথা গুলো শুনে হাসানের ইচ্ছে করছে, ঘরের সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে। ইচ্ছে করছে, মামা কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিতে। তাকি কখনও সম্ভব? এই ভেবে চুপ হয়ে গেল, মনে মনে খুজতে লাগলো প্রকৃত পাঠকের ছবিটি।
কেন যেন খুজে পাচ্ছে না ছবিটি, কোথায় যেন হারি গেছে। তাহলে কি সে প্রকৃত পাঠক হয়ে উঠতে পারেনি? যদি প্রকৃত পাঠক হত তাহলে তো থেকে যেত ছবিটি তার হৃদয়ের চির গহীনে, চির স্থায়ী হয়ে। শত চেষ্টা করেও কেও মুছতে পারত না। এর মধ্যে নাস্তা নিয়ে উপস্থিত হল মা,
মামা ভাগনে মিলে খুব তো দেখছি আড্ডা জমিয়েছো আমায় বাদদিয়ে। কি এতো খোশ আলাপ হচ্ছিলো আমিও একটু শুনি? মামা এক চিলতে হাসি দিয়ে বলল, ও কিছুনা বোন। তোমার ছেলের বই নিয়ে একটু বল ছিলাম আরকি।
-- তাই বুঝি?
তা নয়তো কি? আমার ভাগনের বইটি গুণে, মাণে, কোন দিকে কমতি আছে, বলো দেখি?
মামার এমন দু,মুখো কথা শুনে হাসানের গোটা শরীর অগনী শিখার মত জ¦লে উঠল, হাসান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সোজা উঠে হেঁটে চলল দরজার দিকে, মা, মামা উভয়েই ডেকে উঠল হাসান হাসান বলে। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল হাসান, কোন এক নতুন ভূখন্ডের খোঁজে যে খানে থাকবে শুধু প্রকৃত পাঠক থাকবে হাসানও।
এই কথা ভাবতেই হঠাৎ হাসানের মনে হল তবে কি সে প্রকৃত পাঠক হয়ে উঠতে পারেনি? যদি প্রকৃত পাঠক হত তাহলে তো থেকে যেত ছবিটি তার হৃদয়ের চির গহীনে, চির স্থায়ী হয়ে অনন্ত কাল। শত চেষ্টা করেও কেও মুছতে পারত না। তবেকি কি সে প্রকৃত পাঠক নয়?
শুধু ঐ ছবির মানুষ গুলোই প্রকৃত পাঠক? খানিক বাদেই মনে পড়লো হাসানের, ছবিটিতে সেও তো ছিলো প্রকৃত পাঠক রুপে। খুজে না পেলে কি হয়েছে ছবি খানা?

তাহলে আমিও একজন প্রকৃত পাঠক এই ভেবে হাসান খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো, বলতে শুরু করল অনরগল, আমিও একজন প্রকৃত পাঠক, আমিও একজন প্রকৃত পাঠক, হাহা... হাহা...।


পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১



নারীর অবদান
সাজিয়া ইসলাম দিবা

পৃথিবী আজ যত সৃষ্টিতে হয়েছে মুখোরিতো,
তার সবটাতে নারীর অবদানে রেখেছে,
করেছে আলোড়িতো,

ডাক্তার, নার্স, কুটির শিল্পে রাখে সমান অবদান,
তবুও সব পায়না সর্বদা যোগ্য সন্মান,

পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিক সমান অবদান রাখে,
বৈদেশিক মুদ্রা উপার্যন করে রপ্তানি খাতে,

তবুও নারীর প্রতি চলে সহিংসতা,
কোথায় নেই তাদের আজ নিরাপত্তা,

শিশু হোক বা বৃদ্ধা,
পুরুষের লালসার শিকার হয় সহসা,

বাসে ট্রেনে বা মেলায়,
সর্বদা লাঞ্চিত হতে হয়,

মেয়ে হয়ে জন্মনিলে ফোটে না হাসি মুখে,
আবার মাতৃ গর্ভেই হত্যা করা হয় কন্যা শিশু কে,

তখন পুরুষ এ কথাটি যায় ভুলে,
জন্মনিয়েছিলো সেও এক মায়ের কোলে,

মা কত কষ্টে আদর যতেœ মানুষ করে শিশুকে,
তবু শিশু পরিচয় পায় বাবার পদবীতে,

সেই নারী কে আবার দেবী রূপে পুজো করে,
মানুষ রূপী অসুরদের না দোষ ধরে,

তাই শুধু নারী দিবসেই তাদের গুনগান না করি,
যোগ্য সন্মান দিয়ে সবাই বৈষম্য মুক্ত স্বদেশ গড়ি,

এগিয়ে যাবে নারী ভেঙে সব বাঁধা,
নারীর হাসিতে পূর্ণতা পাবে এই বসুন্ধরা...।



দুঃখের উপাখ্যান 
হাসান মাসুদ

দুঃখগুলো ছড়ায় না চারদিকে?
পাখির ঠোঁটে! চিঠির খামে!
নামে - বেনামে! দুর্দান্ত গতিতে!

চলো দুঃখগুলো উড়িয়ে দিই;
বইয়ের পাতায়! খাতায় খাতায়!
পাতায় পল্লবে!

দুঃখগুলো ঘুরে বেড়াক
মালিবাগ! শাহবাগ!
মাঠেময়দানে ! রাস্তায় রাস্তায়!
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে!

চলো দুঃখগুলো ছাপিয়ে দেই;
সকালের প্রতিটা কাগজের
পাতায় ছাপা হোক দুঃখ!
মিডিয়াজুড়ে চলুক কেবল
দুঃখের সংবাদ!

দুঃখে দুঃখে মুখরিত হোক চারিদিক
গড়ে উঠুক দুঃখ নগর!
চলো জীবনটা দুঃখময় করে তুলি।


চলে যাবে বলেই
রফিকুল ইসলাম

চলে যাবে বলেই
নিপুণ হাতে রঙ ঢেলে সাজালে
পাথরের বুকে বয়ে চলে রংধনু নদী,

চলে যাবে বলেই
পাথরের গায়ে জন্ম নেয় গুল্মলতা
কেন এত আয়োজন চলে যাবেই যদি।

চলে যাবে বলেই
নীরব দেয়ালে অনুভূতির ছবি আঁকে
অনুভবের দগ্ধ দহনে মধ্যাহ্নের রৌদ্দুরে

চলে যাবে বলেই
সন্ধ্যার মায়া আলো-আঁধারের ছায়া
ভোরের আলো ছড়ায় উপলব্ধির দুয়ারে।

চলে যাবে বলেই
সকালের ফুটা ফুল ঝরে পড়ে সন্ধ্যায়
পূর্ণিমা চাঁদ ডুবে যায় রাতের শেষ প্রহরে

চলে যাবে বলেই
স্মৃতিরা দু’হাতে পথ আগলে দাঁড়ায়
মনে হয় বসত করি সেই পুরাতন কুঠিরে।


সুইসাইড মেটিং
মোজাম্মেল সুমন

শীতের রাতে ফিসফিস কথা রোমাঞ্চিত চাদর,
নিশ্বাস শব্দে জেগে ওঠে ভালোবাসার আদর।
জ্যোৎস্নার রূপে রয় পানযোগ্য অনুভূতির সুধা,
আর ‘সুইসাইড মেটিং’ ভালোবাসার অসীম ক্ষুধা!

তোমাকে যে ভালোবাসি জীবনেরও চেয়ে,
আমি ধন্য হয়েছিলাম তোমায় কাছে পেয়ে ।
তুমি আমার রানি কিংবা ভালোবাসার সাবা,
আমি ভীষণ মুগ্ধ দেখে তোমার রূপের আভা ।

জোনাকির রূপ প্রেমেতে ঝিলিমিলি জ¦লতো,
আকাশের বুকে আমাদেরই ভালোবাসা বলতো ।
তেঁতুলকফি খেয়েছিলাম দুজনে এক রাতে,
এখন তোমার ছোঁয়া ভাবতে শূন্যতা পাই হাতে ।

রাত্রিজেগে কাঁদি! বালিশ রাখে দুঃখ পুষে।
ভোরের শিশির আমার কান্নাগুলোকে নেয় চুষে!
সকালবেলা তুমি হাঁটো কারোর হাতটি ধরে।
আমার চোখের চার দেয়ালের অশ্রুবিন্দু ঝরে
কাচের শরীর বেয়ে! তুমি খুশি শিশির ভেবে!
আমি ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরি! বলি আরও নেবে?
অথচ পাও না যে শুনতে- আমার কথা কোনো!
দেখি তুমি কারোর আঙুল ছুঁয়ে স্বপ্ন বোনো।

তারপর আমার উপস্থিতি বাকী থাকে যদ্দুর,
একেবারে বিনাশ করে দেয় সোনালি রোদ্দুর।
এমনকরে প্রতিদিন ঘটে আমার মরণ,
জীবন মানে ভালোবাসার বিসর্জনের ধরন।

একই ছাদের নিচে বাস না করলেও একই গগন
এর নিচে যে আমাদের বাস! একইভাবে গমন!
গগনপানে তাকালে পাই তোমার মুখের ছবি,
দীর্ঘশ্বাস ফেললেও আমি যে ভালোবাসার কবি।


স্বরলিপি
শারমিন সুলতানা রীনা

পৃথিবী বদল হয়
মানুষের মন আর কতটা বদলায়?

এই নগরীকে যদি আঁধারে ঢেকে দিতে চাও
তুমি কি পারবে সোনালি প্রভাতের আগমণ করে দিতে নাশ?
পাখির গান, নদীর ¯্রােত
ঝর্নার বয়ে যাওয়া
বৃষ্টির পা থেকে খুলে নিতে নুপুর

বুকের পাজরে থাকুক ব্যার্থতার স্বর লিপি
তবু চোখ ভরে তুলে নেবো
দিগন্তের সবুজ স্বপ্ন

কতটা কষ্ট  পেলে বাড়বে
তোমার পরমায়ু?



পথ থেকে পথে
হেমন্ত হাসান       

এভাবে পথ হারাতে হারাতে একদিন
আমি হারিয়ে ফেলব নিজেকে
আর নিজের সবটুকু।
পথের ভেতর হারিয়ে ফেলা পথ
কিংবা নিজের ভেতর হারিয়ে ফেলা
নিজেকে,
কতটুকুই আর ফিরে পাওয়া যায়?

কোন একদিন, মেঘেদের পথে হেঁটে
কুড়িয়ে পেয়েছিলাম,
তোমার ঠিকানার চিরকুট।
আপ্রান পথ হাতড়েছি আমি,
অথচ তুমি বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেছ
তোমার চৌকাঠে চুমুর আলপনা
আঁকার আগেই!
বৃষ্টি আমাদের বুকে শীতল ছোয়ায় বটে,
কিন্তু মাথার উপর মিলিয়ে যায় মেঘের ছায়াটুকু!
আমি জল চেয়েছি নাকি ছায়া
বৃষ্টি নাকি মেঘ
একবারও সেই ভাবনার পথে
এক পা এসে হাঁটোনি আমার পায়ে পায়ে!
তাইতো আমি পথে থেকেই পথ হারালাম,
আর নিজেকে হারালাম নিজের ভেতর,
যেভাবে হারালে আর ফিরে পাওয়া হয়না
ফুল ফোটাবার পথ!

বিষাদের রোদ মাখানো পথে পথে হাঁটা
আমার ফেরারী মন জানে,
একদিন তুমি বুকের আঁচল
দ্বিধাহীন বিছিয়ে বলবে,
এই পথে পাগল,
এই পথে হেঁটে আসো আমার বুকের উষ্ণ ছায়ায়!
কে জানে!
আমি হয়তো মাথা নিচু করে কিংবা
তোমার চোখের মনিতে
এক পলক তাকিয়ে থেকে বলব,
লাবণ্য,
আমি আর পথ হাঁটি না যে!



পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২




আম্মার মৃত্যুতে
কাজী রুপাই 

সেই দিন পৃথিবীর সবচেয়ে অমানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার চারিদিকটা এতোটায় বিদগ্ধময় ছিলো যে, মনে হয়েছিলো বিশ্বযুদ্ধময় একটা পরিত্যক্ত জলাশয়ের উপর ভাসছি আর আমি গোটা যুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি আহত মুক্তিযোদ্ধার মতো।

আমার পৃথিবী বাতাসহীন। ঢেউগুলি-ঢেউহীন কান্না আর ধুসর পায়রাগুলি অপার্থিব অগ্নির অগ্নি¯্রােতে অসহায় অথবা মৃত খরগোশের ছানা।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম মহাকাল আর পৃথিবীর শেষ নিশ্বাসের উপর। আমার হৃদপিন্ডটা মুহূর্তের জন্য
আটকে গিয়েছিল। আমার সমস্ত অবলোকনের শক্তি হারিয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল আমি যেনো পরকালের কোনো এক বারান্দায় ঝুঁলছি।

কুঁড়ি বছর পেড়িয়ে যাচ্ছে। মা তুমি নেই আমার
পৃথিবীতে। অন্ধকার সরাতে সরাতে কতো হেঁটেছি
আলোর পালংকে শুয়ে থেকে মনে হয়েছে; আমি যেনো অন্ধকারের ভিতরে অন্ধকারকেই তারাচ্ছি।

আমার সব আলো নিভে গিয়েছিল সেইদিন। সমগ্র
পৃথিবীটাকে মনে হয়েছিল একটা বধ্যভূমি। মহা
বিশ্বজুড়ে আজ কতো আলোর পেখম। নিদারুন
ভাবে উড়ছে। তবুও তুমিহীন সব আলোই আজ আমার কাছে এক একেকটা মৃত কোকিলের গান।

আমি জানি একদিন পৃথিবীর সব আলো নিভে যাবে। গলে যাবে মৃত্তিকার সমস্ত অহংকার। ম্লান হয়ে যাবে মানুষের তরতাজা হাসির ইতিহাস ।

তবুও বলবো সেই মুহুর্তে তোমার এক চিলতে হাসিতে হয়তো এই পৃথিবী আবার জেগে উঠবে। আমার নবীজির আহবানে। এ আমার আত্মবিশ্বাস


হৃদয় পোড়ার গন্ধ
রেজাউল রেজা

রুমি! রুমি! কি হলো তোর ঘরে?
আগুনের গন্ধ কেন?
কোথায় আগুন লাগল?
চিল্লাতে চিল্লাতে বাড়ির সবাই ছুটে এলো আমার ঘরে,
বড় ভাইয়া ইতোমধ্যেই ফায়ার সার্ভিসকে ফোন করে ফেলেছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাইরেন বাজাতে বাজাতে ফায়ার সার্ভিসের গোটা ছয়েক গাড়ি এসে হাজির!
কোথায় আগুন? কোথায় আগুন বলে চিল্লাতে লাগল তারা।
ভাইয়া ওদেরকে কি বলবে বুঝতেই পারছে না
অবশেষে কি যেন বলে বিদায় করল।
যে যার রুমে চলে গেল।
অতীতের তিক্ত স্মৃতি ভুলে যাব বলেই তার দেওয়া প্রথম প্রেমপত্রটিতে আগুন লাগিয়েছিলাম।
মৃত শিশু বুকে রেখে লাভ কি?
পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চেয়েছিলাম পরিত্যক্ত ভালোবাসার স্মৃতি নামক যন্ত্রণাগুলোকে।
পৃথিবীটা কত অদ্ভুত তাই না!
সামান্য এক টুকরো কাগজ পোড়ানোর গন্ধ সবাই বুঝতে পারে,
অথচ মসজিদসম হৃদয় পোড়ানোর গন্ধ কারো নাকে যায় না!
পুড়ে পুড়ে ছাই হলেও কারো কিছু আসে যায় না!!



এক ব্যথাতুর মাঝরাত
রায়হান কিবরিয়া রাজু

এক ব্যাথাতুর মাঝরাত
স্মৃতিরা ফুরোবার খুব আগেই সিগেরেট শেষ হয়ে যায়।
ঠোঁটে আচমকা ছেকা দিয়ে আবারও মনে করায়
সেই প্রথম যৌবনের দ্বিতীয় উর্বশীর কথা।
পরপর মনে পড়ে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত, মাঝরাতগুলো।
আবারও শেষ হয়ে যায় আগুন।
আবারও পুড়ে যায় ঠোঁট।
তারপর আবারও মনে পড়তে থাকে।

এভাবে মনে পড়তে পড়তে চোখে মুখে আসে ব্যথার লাবন্য
প্রেম আর অপ্রেমে বেড়ে যায় বুকের ভিতরের ব্যর্থ নোংরামি
আর কাউকে পেয়ে হারানোর মতো উদত্য অশালীনতা
এবং পরপর ছেড়ে যাওয়া কিশোরীর রেখে যাওয়া ঘৃণায়
থেকে থেকে নষ্ট হতে থাকে মাঝরাত।
ফুরোতে থাকে আগুন
পুড়তে থাকে ঠোঁট
পঁচতে থাকে ভিতরটা।

তখনও নির্লজ্জ্ বেহায়া মন কারো না কারোর স্মৃতিকে
লালন করে যায় স্বগর্বে
যৌবন পুড়িয়ে আলো দেয় অন্য কারোর অন্ধকার উঠোনে
অথচ তাদের অন্দরমহলে আলোর অভাব নেই
উঠোনে আসতেও তাদের দরকার পরে না
অন্যকারোর আলোয় তারা দিব্যি আলোকিত।



শূন্যফল
খোরশেদ পলাশ

কি করে পারো তুমি
এতটা সহজে,
“ভালোবাসি” লিখেছো
শুধুই কি কাগজে?

মন থেকে বলনি
একবারো তুমি
বুঝেছি এই কথা
এতপরে আমি।

মেসেজ আর চেটিংএ
মিথ্যে নোনা জল
ভালোবাসার রেটিংএ
শূণ্য ফলাফল।




পেত্মী

পেত্মী



পেত্মী
শফিক নহোর

বউরে আমি কালটি বলে ডাকতাম , এ ডাকটি ছিল তার কাছে বিষের মত। নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে মুখটা এমন কালো হয়ে যেত, মনে হত অমাবস্যার অন্ধকার রাত নেমে আসছে আকাশ থেকে তার মুখের রঙ পরিবর্তন হয়ে যেত সহজে। ‘সাত সকালে ভূতের মুখ দেখে ঘুম ভাঙলে কি সেদিন ভাল যায় ?’ কপাল পোড়া হলে যা হয়, ঠিক আমার ও তাই। তবে ও হাসলে দাঁতগুলো খুব চকচক করত। ওরে কখনো আদর করতে ইচ্ছে হয়নি, ভালবাসতে ইচ্ছে হয়নি , কখনো আপন করে কাছে পেতে ইচ্ছে করেনি। ওকে ভাত খাবার কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি, ওকে ভালো কাপড় কিনে দিতে কখনো ইচ্ছে হয়নি কেন তা আমি নিজেই জানিনা । ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। পৃথিবীর সমস্ত ইচ্ছে মরে গিয়েছিল। কপালে এমন পেত্মী মার্কা একটা বউ পেলে কারো ইচ্ছা কি বেঁচে থাকে ?’ ফোন করলে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগত প্রচন্ড রাগ হত ; আমি খুব রাগ করে মাঝেমাঝে লাইন কেটে দিতাম। আনকালচার একটা মেয়ে অসহ্য ! অফিস থেকে ফিরে
বাসায় এসে খুব রাগ করতাম ; ‘অসভ্য কতবার ফোন দিতে হয় অফিসে থাকলে।’ বেয়াদব, অনেক বকাবকি করতাম।’ প্রতিদিন পেত্মী দেখতে দেখতে পৃথিবীটা পেত্মী মনে হত আমার কাছে ; চারিদিকে সুডৌল বক্ষ সুন্দরী মেয়ে ঘুরে বেড়াত, শালা আমার কপালে জুটেছে পেত্মী ।
‘কেমন বমি বমি লাগত বউ রে দেখলে ওয়াক থু।’
আমি ওকে বলেছিলাম ;
খবরদার আমার জন্য কখনো না খেয়ে থাকবি না। ফালতু কোথাকার ?’ যখন রান্না হবে ঠিক তখনই খেয়ে নিবি। আমার দিকে বেহায়ার মত তাকিয়ে থাকত, আমার সঙ্গে যদি খাবার চেষ্টা করিস তাহলে কিন্তু তোকে গলাটিপে মেরে ফেলবো। বলদটা সুন্দর করে হাসতে ও পারত না, সুন্দর করে কথা বলতে পারত না। এমন কী কোন সাহিত্য আড্ড, কবিতা পড়তেও তার অপছন্দ!’ কিছু লিখতে জানে না আজকাল মেয়েরা কত সুন্দর স্ট্যাটাস দেয় ফেসবুকে। সুন্দর করে কথাও বলতে পারে না। ‘গেঁয়ো ভূত কোথাকার।’ জামাকাপড় সুন্দর করে পড়তে পারে না। এমন কী অতিথি আসলে কিভাবে কথা বলতে হবে তাও জানেনা। কচু জানে ? কচু ! কার সামনে কি কথা বলতে হবে, পানির গ্লাস কিভাবে দিতে হবে জানেনা। বিরিয়ানি রান্না করতে পারেনা, পরোটা বানাতে পারেনা। জীবনটা তেজপাতা বানাইয়া ফেলছে ফালতু কোথাকার ?
পেত্মী জুটছে আমার কপালে। ‘আমার ইচ্ছে করে ওরে ফ্যানের সঙ্গে এমন ভাবে বান্দা ফাঁসি দেই। প্রতিদিন একবার করে ফাঁসি দিলেও আমার দুঃখ মিটবেনা। ওর তিনবার ফাঁসি দেয়া উচিত না ছয়বার ফাঁসি দেওয়া উচিত না, নয় বার ফাঁসি দেওয়া উচিত ?’ ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে যেত, অফিসের সময় হয়ে যাবার আগেই বাসা থেকে বের হতাম।



কখন কার সঙ্গে কথা বলতে হবে কী কথা বলতে হবে কিভাবে কথা বলতে হবে কিছুই বুঝতে পারেনা। বিভিন্ন সময় দেখতাম উদাসী হয়ে থাকত। রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকত একাকী, অপলক দৃষ্টিতে এক দিকে তাকায় থাকত, মনে হত প্রতিবন্ধী। দেখলে এত রাগ হত কখনো আমার কাছে আসতে দিতাম না। আমার জামাকাপড় পরিষ্কার করে দিয়েছিল ; সে সব আমি একদিন ফেলে দিয়েছি। জামাকাপড় গুলো আর কখনোই পড়া হয়নি। বাসায় গেস্ট আসলে কী খেতে দিবে, কিভাবে বসতে বলবে কিছুই জানেনা একেবারে গেঁয়োভূত প্রচন্ড রাগ হত। মা, মাঝেমধ্যে রাগ করে বলত,
মেয়েটির উপরের এমন করিস কেন ?’
কিছুদিন যেতে দে আমাদের বাড়ির পরিবেশ বুঝে উঠবে তখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আমার জীবনটা একেবারে বিষিয়ে উঠেছিল। মাঝে মাঝে মনে হত ; আমি এখনই আত্মহত্যা করি। আমার কপালে তাই এরকম একটি পেত্মী বউ কোথাও নিয়ে যেতে পারতাম না আনস্মার্ট। বাবার বন্ধুর মেয়ে বলে জোর করে কিছু বলতে ও পারছিনা। মা বাবাকে বিশ্বাস করা আমার ঠিক হয়নি। তাঁরা এমন একটা মেয়ে আমার ঘায়ে চাপিয়ে দিল। এমন
মেয়ে কী এখন চলে আমার ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক হাই কোয়ালিটি দেশের বাহির থেকে পিএইচডি করছে; দেশের বাইরে নামি-দামি মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে অনেক বড় পোস্টে কাজ করছে। তাদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে?’
হঠাৎ একদিন আমার শরীর খারাপ করছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমার হাসপাতালে ভর্তির কথা শুনে এমন চিৎকার করে ছুটে এসেছিল ; ‘চিৎকারের শব্দটা আমার বুকের ভিতর টুংটাং টুংটাং এখনো বাজে।’ আমি একা বাথরুমে যেতে পারতাম না আমাকে হেল্প করত, সারারাত আমার পাশে জেগে থাকত। আমি খুব বিরক্ত হতাম, দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁয়িয়ে থাকত, যাতে আমি কখনো যাতে বুঝতে না পারি। একদিন অনেক রাতে হঠাৎ দেখি ও আমার পাশে নেই। বুকের ভিতরে ধড়ফড় করতে লাগল। আমি ওর নাম ধরে ডাক দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজার আড়াল থেকে ছুটে আসলো। ওকে জড়িয়ে ধরে আমি সেদিন কেঁদে ছিলাম। আহারে! কালো মানুষটা, আনস্মার্ট মেয়েটা আমাকে এতো ভালবাসে, আমাকে এত টেককেয়ার করে আর আমি তাকে অবহেলা করি।

‘মিনু এত খুশি হয়ে ছিল আমার কপালে চুমু খাওয়ার অনুমতি নিয়ে ছিল, স্বামীর কপালে চুমু খেতে অনুমতি লাগে শিশুর মতন আমার বুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়ল।’
তারপর একে একে অনেক কিছুই স্বাভাবিক হতে লাগলো আমরা রাতে দু’জন আলাদা বিছানায় থাকতাম তারপর থেকে আর কখনো আলাদা বিছানায় থাকনি একই সঙ্গে থাকা শুরু করি। মিনুকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম, ফেসবুক ব্যবহার করত, আমি কখনোই জানতে চাইতাম না। মানুষের এত সহজ সরল হওয়া ঠিক না যেমনটি মিনু, আমার পেত্মী বউটি। খুব ভালো মানুষ আমাকে এত ভালবাসে নিজেই বুঝতে পারতাম না। আমার পছন্দ অপছন্দ আমি কী খাই , না খাই আমার ভালো বন্ধু বান্ধবী সব লিস্ট করে রাখতো। তাদের জন্ম দিনে উইশ করতে, আমি জানতাম-ই না বন্ধু বান্ধবীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল আমার চেয়ে বেশি।
একদিন আমার বান্ধবী আমাকে ফোন দিয়ে বলছে,
তুই একটা আনস্মার্ট ছেলে তোর সঙ্গে কথা বলায় যায় না। তোর বউ এত স্মার্ট, কত সুন্দর করে কথা বলে। তুই এতো একটা লক্ষ্মী বউ পেয়েছিস। সত্যিই ভাবায় যায় না তোর বউ এত গোছালো এত রোমান্টিক এত ধর্মভীরু মানুষ এতো সুন্দর হয় তোর বউয়ের সঙ্গে না মিশলে বুঝতে পারতাম না।
মাঝেমধ্যে ও আমার পছন্দের খাবার রান্না করত, আমার জন্য শপিং করত, আমার বাবা মাকে খুব কেয়ার করত, বাবা মায়ের কাছে ও এতো জনপ্রিয় ছিল। আমার আপুরা ওকে সহ্য করতে পারতো না। মিনুকে নিয়ে এখন খুব গর্ব করতে ইচ্ছে করে। আমার একটা পেত্মী বউ আছে। এই পেত্মী—
বউটা আমার অহংকার।‘পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের একটা পেত্মী বউ থাকা দরকার।’



কোম্পানি থেকে আমাদের দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য দুইটা এয়ার টিকেট দিয়েছে, বেশ কিছুদিন ধরেই অফিসের কর্মকর্তা চাইছেন, আমি কোথাও থেকে ঘুরে আসি। স্যার আমার কাজে খুশি হয়ে সুইজারল্যান্ডের দুটি আপ-ডাউন টিকিট সহ ভিসা রেড়ি করে দিয়েছেন। বউকে রাতে খুশির সংবাদটা দিলাম। কিছুদিন অনেক আনন্দময় দিন কাটলো। যেদিন ফিরে আসবো এয়ারপোর্টে আসার সময় আমাদের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হল তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই !
ক’য়েক বছর পর!

লীনা আমার কন্যা গায়ের রং ঠিক ওর মায়ের মত কালো। সবাই ওকে দেখে হাসাহাসি করে, আড়ালে আবডালে। লীনা সব কিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করে, আমাকে খুব যত্ম নেয়। মেয়েরা ঠিক মায়ের মত হয়।

আমার মেয়ে লীনা আমাকে খুব যত্ম করে। আমি কখন অফিস থেকে ফিরি, কী খাই, কখন ঘুমাতে যাই। লীনার মা বেঁচে থাকলে আমাকে হয়তো এত কিছু ভাবতে হত না। ক্ষণে-ক্ষণে মিনুকে খুব মনে পড়ে। বিয়ের প্রথম বছরে বিচ্ছিরি খারাপ ব্যবহার করেছিলাম ।
লীনা বড় হচ্ছে লেখাপড়া, চাকরি সংসার সব কিছুই একদিন ও করতে পারবে একা কিন্তু ?’ ওর মা বেঁচে থাকলে এ ভাবনা গুলো আমাকে ভাবতে হত না। এ সমাজে একটা কালো মেয়ের কোন মূল্য নেই। আমাদের মত পুরুষ শাসিত সমাজে। মানুষের শিক্ষা বাড়ছে, আধুনিকতা বাড়ছে, মনের বিশুদ্ধতা বাড়ছে, না একদম। কালো মেয়ে মানুষ গুলো কি মানুষ না। কালো হলো জগতের আলো। কিছু তরণ অবুঝ ছেলেরা বর্ণ ভেদাভেদ সমাজে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। তাদের মানসিক সমস্যা আছে। গায়ের রঙ দিয়ে কিছুই হয় না। মনের সাদা রঙ দিয়ে পৃথিবী পরিবর্তন করে দেওয়া যায়।
আমি আজ কালো মেয়ের বাবা ! আমার মানসিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল আমার স্ত্রী মিনু।
পর জন্ম বলে যদি কিছু থাকে সৃষ্টিকর্তাকে বলবো হে সৃষ্টিকর্তা আমাকে পেত্মী বউটা দিও!’




সিরাজউদ্দৌলা

সিরাজউদ্দৌলা



সিরাজউদ্দৌলা
জাকি হোসেন কামাল

মুজিব বাইয়া যাওরে
নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগনের নাওরে
মুজিব বাইয়া যাওরে।
উর্মি গাইছে নিবিষ্ট মনে। মেয়ের কন্ঠটা চমৎকার। মেয়ের গান শুনে কাছে এসে বসলো মিতা। মায়ের মতই হয়েছে উর্মি। চঞ্চল, একরোখা। ক ‘দিন ধরেই উর্মি অস্থির। তাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আসবেন। কিভাবে তাঁকে বরণ করা হবে তার প্রস্তুতি চলছে স্কুলে। এই একটুকু মেয়েকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গলায় ফুলের মালা দেয়া হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উর্মি গাইবে এই গান। এইটুকু মেয়ের কন্ঠে এই গান এই সুর। নিশ্চিত সবাই তন্ময় হয়ে শুনবেন। বঙ্গবন্ধুও নিশ্চয়ই খুশি হবেন। ভাবতে থাকে মিতা।

ভাবতে ভাবতে মিতা চলে যায় আরো ন ‘বছর আগের দিনগুলোতে। মিতা তখন ছবিঘরের সদস্য। পাকিস্তান কালচারাল একাডেমী ছেড়ে হাসনা আপা, টিপু ভাই, ফজল-এ- খুদা ভাই ও কামাল ভাইদের নেতৃত্বে গড়ে উঠে ছবিঘর। ছবিঘরের পরিচালনায় দূর্বার চলছে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। এর মধ্যে হয়ে গেল একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সষ্টিটিউশান মিলনায়তেেন। অনুষ্ঠানটি সকল দর্শক শ্রোতার ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়।পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে কামাল ভাইয়ের নামও ছাপা হয়। তা দেখে কামাল ভাইয়ের বাবা অর্থাৎ মুজিব ভাই ছবিঘরের সদস্যদের দেখতে চান। তখন সবার মুখে মুখে মুজিব ভাই, আমাদের মুজিব ভাই। কামাল ভাইয়ের কাছে দেখা করার কথা শুনে সকলের মধ্যেই অস্থিরতা শুরু হয়। মিতারতো আর তর সইছেনা। কখন দেখা হবে মুজিব ভাইয়ের সাথে। তার দু ‘তিন দিনের মধ্যেই দেখা হয়েছিল মুজিব ভাইয়ের সাথে।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাসাতে, বসার ঘরে হৈ চৈ করে ঢুকতেই মুজিব ভাই উঠে দাঁড়িয়ে তাদের জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, আয় আয় তোরা সব এসে গেছিস?  তখন তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি যাও, আমি এখন ছবি সংঘের বন্ধুদের সাথে কথা বলবো। কামাল, তোর মাকে বল, নাস্তা দিতে। আগে খাওয়া দাওয়া, তারপরে কথা। মুজিব ভাইয়ের উষ্ণ অভিনন্দনে সকলেই অভিভুত।

ফজল ভাই বললেন আমরা আপনাকে দেখতে এসেছি।
আরে দেখবি দেখবি, যখন তোদের জন্য কিছু করতে পারবো। এখনো কিছুই করতে পারিনি। কেবল ছয় দফা দিছি। দেখি কী হয়। মুজিব ভাইয়ের ঝটপট জবাব।

সেদিন কত কথা হয় মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি সকলকে পেয়ে খুবই খুশি। মানুষকে এভাবে আপন করে নিতে পারে কেউ, কাছে থেকে না দেখলে বোঝার কোন উপায়ই নেই। সবাই যেন তার কতদিনের চেনা।


সেদিন একথা সেকথার পর মুজিব ভাই বললেন, তোরা নাচ করলি গান করলি, কিন্তু নাটক করলি না কেন? একটা অন্তত নাটক করা উচিৎ ছিল তোদের। নাটক করলে কথা বলার সাহস হয়। কথা প্রসঙ্গে মুজিব ভাই জানালেন, তিনি যখন ক্লাস সিক্সে পড়েন, সেসময় একবার ইন্সপেক্টরের তাঁদের স্কুল ভিজিটের কথা হয়। এ উপলক্ষে স্কুলে একটি অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়। ঐ অনুষ্ঠানে সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলা কে হবে? শেষ পর্যন্ত মাষ্টার মশাইরা কয়েকজনকে পরীক্ষা করে তাঁকে দিয়েই সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে অভিনয় করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্সপেক্টর আসেনি। আর নাটকটিও মঞ্চস্থ হয়নি। মুজিব ভাই দুঃখ করে বললেন, আর আমারও সিরাজউদ্দৌলা হওয়া হলোনা। একথা শুনেই মিতা বলে ওঠে, মুজিব ভাই, তবুও আপনিই আমাদের সিরাজউদ্দৌলা। কথা শুনে মুজিব ভাই যেন কিছুটা থতমত খেলেন। পরক্ষণেই হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, তোরা দোয়া কর, সিরাজউদ্দৌলা নয়, আমি যেন তোদের মুজিব ভাই হয়েই থাকতে পারি। আমি সবার মুজিব ভাইই থাকতে চাই, বাংলার দুঃখি মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গী হতে চাই।

সেই মুজিব ভাই এখন দেশের প্রেসিডেন্ট। সেদিনের সেই ঘটনার পর কতদিন চলে গেছে। মুজিব ভাইয়ের সাথে আর দেখা নেই। মিতারও ঘর সংসার হলো। মুজিব ভাইও ব্যাস্ত হয়ে গেলেন রাজনীতিতে। দেশ স্বাধীন হলো। মিতাও ব্যাস্ত থাকলো নিজেকে নিয়ে। এই ক ‘দিন  মুজিব ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে মিতার। মুজিব ভাই, সকলের মুজিব ভাই, বাংলার সিরাজউদ্দৌলা।

মিতার আজ খুব করে মনে পড়ছে মুজিব ভাইয়ের কথা। খুব শীঘ্রই মুজিব ভাই উর্মিদের স্কুলে আসবেন। মিতা সিদ্ধান্ত নেয়, স্কুলের অনুষ্ঠানে সে নিজেও থাকবে। ঠিক সোজা গিয়ে দাঁড়াবে মুজিব ভাইয়ের সামনে, তার সিরাজউদ্দৌলার সামনে। নিশ্চয়ই মুজিব ভাই তাকে দেখেই চিনতে পারবেন। মিতা জেনেছে, মুজিব ভাইয়ের স্মরণশক্তি অনেক প্রখর। আচ্ছা, মুজিব ভাইয়ের সামনে যাওয়া যাবে তো? এখনতো মুজিব ভাই দেশের প্রেসিডেন্ট। প্রটোকলের লোকজন তাকে কাছে যেতে দেবে তো? মিতা ভাবছে, নিশ্চয়ই দেবে। মিতা জেনেছে যে, মুজিব ভাই প্রটোকল মানেন না। সবার সাথে কথা বলেন তিনি। ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মিতা। হঠাৎ গুলির শব্দে না কি লোকজনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায় মিতার। মিতাকে বলছে নবাব, তুমি চলে যাও মিতা। ক্লাইভের সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। বিপদ এখন চারিদিকে। হুগলী, কাটোয়ার দূর্গ, অগ্রদীপ ও পলাশীতে আমাদের সৈন্যরা ইংরেজ সৈন্যদের পথরোধ করেনি। সেনাপতিরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মিতা দেখছে হাজার হাজার সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে এগিয়ে আসছে। এখানে ওখানে গোলার আঘাতে চিহ্নভিন্ন হচ্ছে চারিদিক। মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দূর্লভ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজ সৈন্যদের প্রতিরোধ না করেই দাঁড়িয়ে আছে তাদের অধীনস্থ সৈন্যরা। ইংরেজ সৈন্যরা আক্রমণ করছেন নবাবের দূর্গে, রাজধানীতে। একটি গোলা অগ্নিপিন্ডের মতো ধেয়ে আসছে মিতার দিকে। মিতা ওঠো- মামুনের চিৎকারে ঘুম ভাঙে মিতার। বুকটা ধড়পড় করছে মিতার।
মিতা ওঠো, বিপদ, দুঃসংবাদ ..। বলে যায় মামুন।
কী দুঃসংবাদ, বলো। স্বপ্নের রেশ কাটিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, রেডিওতে বলে যাচ্ছে এক মেজর।
কী বলো তুমি? চিৎকার করে ওঠে মিতা। তারপর চুপ হয়ে যায় মিতা। কোন কথা নেই। শুধু তার দু ‘চোখ বেয়ে নামে শ্রাবনের ধারা। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করে মিতা। কেন মুজিব ভাইয়ের নাম দিলাম সিরাজউদ্দৌলা। মিতা নিজেকে খুনি ভাবে, ভাবে অপরাধী।