ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১০৩

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১০৩
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১০৩
বৃহস্পতিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮



















পদাবলি

পদাবলি





তখনও আমি তোকে প্রশ্ন করিনি
মুহাম্মদ রাফিউল আলম

নীরব আর্তনাদে
ধস নেমেছিল যেদিন আমার শহরে-
শেষ নদীটাও দেউলিয়া হয়েছিল
দেনার দায়ে- তোকে নিয়ে লেখা
কবিতার অক্ষরগুলো ভেসে যাচ্ছিলো রক্তস্রোতে-
তখনও আমি তোকে প্রশ্ন করিনি।

সত্যের মূল্যে মিথ্যে বিক্রি করে
যেদিন রচেছিলি চক্রব্যূহ; কুরুক্ষেত্রের
ময়দানে লড়েছিলাম আমি একা-
একের পর এক তিরে বিদ্ধ হচ্ছিল আমার শরীর;
যন্ত্রনায় ভেঙে পড়েছিল আমার শেষ শক্তিটুকুও
তখনও আমি তোকে প্রশ্ন করিনি।

প্রশ্ন তো তাকেই করা যায়-
মূল্যবোধ ঠুকরে খায়নি যার শকুনি।
প্রশ্ন তো তাকেই করা যায়-
যে সত্যের মূল্যে কখনো মিথ্যে বেঁচেনি।

তাই তোকে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করিনি...




প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডাকে বান
আহেদুল ইসলাম আদেল

শোন হে মহাপ্রাণ
এখানে প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডেকেছে বান
লোলুপ পৃথিবী স্বপ্ন দেখিয়ে কেড়ে নেয় অন্ন বস্ত্র জান
সশস্ত্র পরাণের হাতে দেয় অবিশ্বাসের বিষাক্ত অস্ত্র
কৃপণ মানব অন্তরে পুষে বিধ্বংসী কালো চিত্র।
যে বীজ তলা যুগযুগ ধরে প্রস্তুত করেছ খেটে
ব্যথিত চিত্তে সেখানেই দেখি সর্বনাশের ভিটে
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তস্নানে পূত জননী
সেখানেই প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডাকে বান নিরবধি।
ভরদুপুরে নেমে এসেছিল নির্জনতার কালো
হে মহাপ্রাণ, এ মরুর বুকে সদ্যশিশুর অঙ্কুর তোলো
মরা নদের তীরে কূমন্ত্রণার যতো বিভীষিকাময় দৃশ্য
হে মহাপ্রাণ, একবার দৃষ্টি পাত এই বিবর্ণ গ্রাম নগরের ভীড়ে;
এখানে কতো মৃতমানবের কঙ্কাল, এখন পোকার দখলে
তাজা তাজা প্রাণ সহস্র নষ্ট জারজ সন্তান
কুকুর শিয়ালে নিচ্ছে টেনে নির্জন অরণ্যের ভীড়ে
শকুনের চাহনি পরেছে স্বৈরতন্ত্রের মুখে।
হাজার দীপ্ত চেতনা মৃত্য্যু খাটলিতে শুয়ে
লৌহ শাবল লাঙল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছে গ্রামে গঞ্জে
অন্ন তালাশে হারিয়েছি দিশা, বিপ্লবী চিত্তে লাল সবুজের পতাকা
পুঁজিপতির হিংস্র আঁধার স্বাধীন ভূমি গেছে ছেঁয়ে
আজও ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেমে আসে
অভাবের অত্যাধুনিক চিত্র
পচাশি শতাংশই আজও অন্ধকারেই ডুবন্ত;
দগ্ধ হৃদয় তবুও বাঁচতে চায়, জননীর কোলে শুয়ে
একজন চাষার অশ্রু অনলে পুরো পরিবারই জ্বলে
পুত্রের দীর্ঘশ্বাসে চেতনা মৃত্যুকে ডাকে বান
শোষক আর শাসকের বিষে আর হারাবে না কারো মান
রাষ্ট্র মাথা থেকে উচ্ছেদ হবে ক্ষমতা শৃঙ্খলিত করার প্রাণ
জনচক্ষুর আড়ালে পাতিও না আর স্বৈরতন্ত্রের খপ্পর।
আজও কি আমরা পরাধীন বাঙালি?
হে মহাপ্রাণ, আর একবার দৃষ্টি পাত
এই লোকালয় কংক্রিটের প্রাসাদে
মুখেতে মানব পূত ইনছান, অন্তর গেছে পুড়ে
এখানে মৃত্যু ডেকেছে বান, চেতনা চাষার মহাশশান।
এই গ্রাম গঞ্জের মেটোপথ ডোবা নদ
মিথ্যা পেতেছে ঘাঁটি, নির্জন অন্ধকারে অন্তর গেছে ভরি
এখানে পঁচে গেছে কতো, হিং¯্র আঁধার প্রাণ
জন্ম নিয়েছে বিশ্বাসী মহাপ্রাণ
সামনে পিছনে তবু মৃত্যু ঠেকানো দুষ্কর
সম্মুখে শুধু রক্ত লাল পাহাড়
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন পুনঃ লালিত সাধ
মৃত্যুর ফাঁদ পাতে পুঁজিপতি বারংবার
সোনা ফলা প্রাণ এ মৌসুমে তোকে করব না আর রোপণ
এই উর্বর কাঁদায় পুঁজিবাদকে পুঁতে
ডাকব সুখের বান, সাম্যবাদ সমাজ হবে হবেই কায়েম
প্রজ্জলিত পুত্রের চেতনা নিয়ে
এখানে চাষার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মৃত্যু ডাকে বান।

কাঠ গোলাপ
সৈয়দ ইবনুজ্জামান

কাঠগোলাপ মিশে যায় কফিনের মিছিলে
রয়ে যায় খোয়াবনামার ফসিল
প্রেমপত্র গুলো কর্পোরেটের আবেগী বিজ্ঞাপন
থেকে যায়-
শেষ না হওয়া কবিতার পংক্তি
যামিনীর ওষ্ঠে এঁকে দেয়া চুম্বনের প্রতিশ্রুতি
আরো কিছু!
লাশেরা ফেরে না
স্বপ্ন ফেরে কোন কালের জাতিস্বর হয়ে।



পথের ব্যথা
শ্রীমন্ত দে

পথের বাঁকে আটকে পড়ে মন
নিশুতি কথা ছটফটিয়ে মরে
এখানেই না কি হয়েছিল হোলি খেলা
সাক্ষীরা সব অন্ধ-বধির-শব।
দীর্ঘশ্বাস এখনও কম্পমান
অট্টহাসি আকাশ বাতাস ভাঙে
শোণিতের দাগ অশ্রুতে ধুয়ে গেছে
নির্জন পথে ভাঙা আরশির ব্যথা।


অপেক্ষার আগুন
কাজী রুপাই

পড়ে আছি শূণ্যের বারান্দায়; পকেটে আমার অসংখ্য
সংরক্ষিত মেঘের মাংস। ধারাবাহিক সন্ধ্যার নিয়মন্ত্র
ভেংগে ভেংগে  ছুটে চলছি রেইনট্রির অপার্থিব ছায়ার সাম্রাজ্যে

কালের পকেটে আটকে আছে কিছু রাসায়নিক পদার্থের আগুন
লেগে আছে মস্তিস্কের অনাবাদী কোষে কোষে;
বৈকালিক প্রজাপতির শৈল্পিক ডানার ক্যানভাসে একলক্ষ নক্ষত্রের স্ফুরণ

রোপন করা বীজের অঙ্গরোদগমনের অপেক্ষা এখন
মুখোশ পরিহিত অন্ধকারে উসকে দেওয়ার অপেক্ষা এখন ।




আমি তোমাকে ভালবাসি
আল মামুন

ঐ পাহাড়ের শীর্ষ ভাগে দাঁড়িয়ে
ইচ্ছে তো করে বলি গলা ফাটিয়ে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ আকাশের শূণ্যেতে ভেসে ভেসে
ইচ্ছে তো করে বলি লাজুক হেসে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ চোরাবালির ঢিবিস্থানে ওঠে
ইচ্ছে তো করে বলি কম্পিত ঠোঁটে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ নদী মোহনায় ডুবার আগে
ইচ্ছে তো করে বলি প্রচ- রাগে
আমি তোমাকে ভালবাসি...
ঐ চন্দ্রমাটির বুকে ঘর করে
ইচ্ছে তো করে বলি বিনয়ী স্বরে
আমি তোমাকে ভালবাসি...


শূণ্যতাবোধ
নাবিল তুরাব

বিশাল শূণ্যতাবোধ, দুধারে নদী, মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি। আল্পস থেকে আলাস্কা, আমুর থেকে হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহে ভেসে চলেছো। কোথায় তোমার তরী আর লাইফজ্যাকেট? শূণ্যতার অনলে পোড়ো তুমি। হিসেব কষতে কষতে একদিন আরো বেশি জেনে যাও শূণ্যতাই জীবন, শূন্যতাই সার।




ক্রোয়শী
অরণ্য

ত্রোয়শীর আজ ৩৩,
পেছেনের মায়া! স্বপ্নের ছায়া!
প্রশ্নের বর্ষন! নিরুত্তরের কায়া!

পেছনের গণ্ডিতে পা,
সে হারায়!
হারিয়ে বেড়ায় মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমতলার সেই বাগানের গেটে,
হারিয়ে বেড়ায় ঘুড়ি উড়িয়ে সেই আনন্দের ভেলার মাঝে,
আর শীতের সকালে পিঠা বানানোর সেই উৎসবের সাজে।
মা বলতো-
করিস না কোনো কাজ, দেখবি একদিন কিভাবে চলতে হয় কাজ করে খেটে খেটে।
আর স্কুল এর সেই মাষ্টার স্যার?
কোথায় সে আজ? আজো কি সে শুধু সেই সাদা শার্ট আর কালো প্যান্টাতেই হাটে?
আজো কি সে তার মতো অভাবী কাউকে ডেকে দু’টো অন্ন দেয়?
আর মায়াভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে-
কেমন আছিস রে? বাবার শরীর ভালো? মা ভালো আছে?

আজো কি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে
সবার সময় সেই গান গেয়ে কাটে?
আর নির্বাক আর রোদনের মতো দস্যুগুলো রাস্তায় চোর পুলিশ খেলার হল্লায় মাতে?
আর সন্ধ্যায়! সন্ধ্যায় কি আজো নিভৃত ভাই বাঁশি নিয়ে বসে?
সে সুর,
সেই বাঁশির ক্রুন্দন আজো কি ক্রোয়শীর মতো কাউকে বিষন্নতার মায়ায় ফেলে?
সে সুর কি আজো কথা বলে?
যে কথার প্রতিটি অর্থ ছিলো-
প্রেম যে বড় বিষময়! পথ ফসকোলেই যে মায়াভরা স্বপ্ন ধসে!
রাতে কি আজো সবাই একসাথে খেতে বসে?
যেমনটা তারা করতো?
যেখানে বাবা বলতো সারাদিনে অফিসের কাজের গভীরতা,
সেখানে তার চোখে থাকতো মাস শেষে মাইনেটা সময়মতো না পাওয়ায় দুঃখের নিবিড়তা।
যেখানে সে করতো: বৃষ্টির দিনে সারা পথ আর হেটেঁ আসবে না সেই প্রলাপ।
যেখানে মা বলতো ক্রোয়শী আর তার ভাই এর দস্যুপনার কীর্তিকলাপ।
সকালে পড়া ফাঁকি দিয়ে আমবাগানে দৌড়োনো,
আর ভাইয়ের লজেন্স নিয়ে খেয়ে ফেলে ক্রোয়শীর হাসির সেই কার্যকলাপ।
আর ছোট ভাইয়ের সেই আবদার- মা, সামনের ঈদে একটা খেলনা কিনে দিও।
আবদারের সময় সে কি মায়াভরা তার চাহনি!
আর ক্রোয়শী?  সে যে এই মধুর সময়ের লগ্নি না শেষ হওয়ার পথ খুঁজতো!
কি আশাভরা হৃদ যে ছিলো তার! তা যদি একবার কেউ বুঝতো!
সেখানে শুধু ছিলো মধুরতার ধ্বনি।
তার দৃষ্টিতে ছিলো সুখের পাতা,আর লিখতো অবিরাম তার স্বপ্নের খাতা।
আজো কি তার মতো সেখানে কেউ তার চঞ্চলতার রংয়ে মাতে?

ক্রোয়শীর মনে আজ স্মৃতির ভারী মেঘ,
মা-বাবা আজ নেই। না ফেরার দেশে তাদের বাস।
ত্রোয়শীর জন্য যে এ বড় সর্বনাশ, সর্বনাশ।
ভাইটাও বিদেশ, সময়রের টানে, অসময়ের আগুনে সে পড়ে আছে।
শিকড়ের মাটি যে ক্রোয়শীর প্রায় শেষ, প্রায় শেষ।
আজ সে মাটির ঘরে থাকে না, কিন্তু সে গন্ধ  তার স্মৃতির পাতায় আজো লেগে আছে।
নিজস্ব শিকড় কি আর ভোলা যায়?
এই স্মৃতি গুলোই যে তার কাছে পড়ে আছে।

কাল ও সূর্য উঠবে,
কাল ও কেউ নতুন করে স্বপ্ন দেখবে,
কাল ও কেউ প্রেয়সীর অপেক্ষায় থাকবে,
কাল ও কেউ আনন্দের বন্যায় সাঁতরাবে।
কাল ও কেউ হতাশায় ডুববে।
কাল ও নতুন করে পৃথিবী সাজবে,
কাটছে দিন তার এভাবেই কাটুক না! স্মৃতি গুলো জমে থাক হাহাকারের মাঝে।



দুর্গন্ধ
রেজাউল রেজা

খুন হওয়া হৃদয়ের নিঃশব্দ আর্তচিৎকার, ষোড়শী তরুণীর বুকে সর্বস্ব হারানোর হাহাকার।
সুখের সংসারে ভাঙনের সুর, সমাজ সচেতন বাবার একমাত্র সন্তান মাদকের নেশায় চুর!

রাত-দুপুরে ডিজে পার্টি, ওয়াটার কিংডমে যুবক-যুবতীর নাচানাচি, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা।
বাঙালীর সংস্কৃতি ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চর্চা, অতি আধুনিক হতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব।

দিনশেষে ভুল ভেঙে যাওয়া অতঃপর হাজী-হাজীয়ানী, সাধু-ঋষি সাজার ব্যাকুল প্রচেষ্টা।

চর্মচোক্ষে সুখী মনে হলেও, হৃদমাঝারে একরাশ শূণ্যতা। হৃদয়ের অলিগলিতে দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি, বড্ড দুর্গন্ধ!!


অলিখিত চোখের জল
শম্পা মনিমা

ধীর পায়ে আসে গোপনে বয়ে চলে
মৃত্যুর ভেতরে, সহ্য করতে পারেনা তা
ঘুমহীন রাতে না পাওয়ার তাড়িত আবেগে
রোজ অপেক্ষারত মধুময় বিরহের সঙ্গী।

রোজ সে হারিয়ে যায় ফিরে ফিরে আসে
সুযোগের অপেক্ষায়, যা জ্বালাতনের নামান্তর মাত্র
ঢেউ ওঠে শরীরবৃত্তীয় গানের অধরে,
যখন সে আরো পেতে আগ্রহী আদরের মুহুর্তে।

কেন সে আসে? সেকি বিস্তার পুরানো কোনো অসুখে?
নাকি, একটা অপেক্ষা হয়ে থাকা মননের
ভেতরে, নীরবে, না বলাতে চাওয়া আস্তিনের ভাঁজে
মুছে ফেলা কঠিন সত্যিগুলো, গুমরে মরে
অতঃপর তোমার না ফেরার অপেক্ষায়।।

কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়!

কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়!


কিছু স্বপ্ন সত্যি হয়!
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

ক’দিন হলো মেয়েটা খুব বায়না ধরেছে- ঘুরতে যাবে। মায়ের হাতে টাকা পয়সা নেই; তাই মা মিতুকে কোথাও নিয়ে যেতে পারেন না। মায়ের প্রতি মিতুর অভিযোগের কোনো শেষ নেই। মিতুর কাছে তার মা পৃথিবীর সবচেয়ে পচা। কিছুই কিনে দেয় না; কোথাও নিয়েও যায় না। ক্লাসের বন্ধুরা কত জায়গায় বেড়াতে যায়। পিকনিক করে। কিন্তু মিতুর শুধু বাসা আর স্কুল-এর বাইরে কোথাও সে যায় না। সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকতে তার একটুও ভালো লাগে না।
মিতু খুবই লক্ষ্মী মেয়ে। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনায়ও খুব ভালো। সে বাসায় একাকি পড়তে বসে, নিজে নিজে লেখে-সব হোমওয়ার্ক করে ফেলে। ছবি আঁকে। তবে শহরের ছবি। বিভিন্নপার্ক, শপিংমল, রাস্তার জ্যাম- তার ছবির বিষয় বস্তু। গ্রাম সে কখনো দেখেনি। তাই তার রংতুলিতে গ্রাম আসে না। বাবার খুব ছোট্ট চাকরি। মাসের বেশিরভাগ সময়ে অন্য শহরে কাজের জন্য থাকতে হয়। তাই সে বাবার দেখা পায়না বললেই চলে। মায়ের কাছেই মিতুর যত আবদার। কখনো কখনো মা বিরক্ত হন। খুব করে বকা দেন। মিতুর যে তখন কি মন খারাপ হয়! না দেখে শুধু লিখে বোঝানো যাবে না।
আজ মিতু মায়ের সাথে যমুনা ফিউচার পার্কে শপিং করতে গিয়েছে। এটাকে ঠিক শপিং বলা যাবে না। তারা বেড়াতে গিয়েছে। এত বড় মার্কেট সে আগে কখনো দেখেনি। আর দেখবেই বা কী করে ? এর আগে যে সে কখনো মার্কেটেই আসেনি। সে মায়ের সাথে দোকানগুলো ঘুরে কত কিছু দেখছে! মা তাকে একটি পুতলের দোকানে নিয়ে গেলেন। কী সুন্দর! এক একটা পুতুল। মিতুর ইচ্ছে হল সবগুলো কিনে নেবে। কিন্তু মা বললেন, একটা পছন্দ কর, তোমাকে কিনে দেব। পুতুল দেখতে দেখতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে বলে উঠল, মা দেখো, দেখো ঐ যে সাকিব, সাকিব আল হাসান। মা বিস্ময়ে সামনে তাকালেন।
নাহ, তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না। মার্কেট লোকে লোকারণ্য। একজনের সাথে আরেক জনের ঠেলাঠেলি লাগে; সাবধানে চলতে হয়। তাই মেয়ের কথায় তিনি কান দিলেন না। তবে মিতুর উচ্ছ্বাসের যেন শেষ নেই! ‘জানো মা, ক্লাসের মিস বলেছেন, সাকিব মস্ত বড় খেলোয়াড়। সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁর নাম। তাঁর মতো খেলোয়াড় বিশ্বে খুবই কম। বড় হয়ে আমি সাকিবের মতো নামকরা, বিশ্বখ্যাত হতে চাই।’ মা রাগ করতে গিয়েও কেন যেন থেমে গেলেন।
মেয়ে একদিন বিশ্ববিখ্যাত  হওয়ার স্বপ্ন দেখে ভেবে নিজের মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধ অনুভূত হতে লাগল। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করলেন না। মেয়ের কত রকম বায়না। তাদের ছোট্ট সংসার। স্বামী শহরের বাইরে থাকে। মানুষটা সারাদিন খেটেখুটে যা রোজগার করে তাই দিয়ে কোনো রকম দিন চলে। বাড়তি কোনো সঞ্চয় নেই। বিপদে-আপদে অন্যের কাছে হাতপাতা ভিন্ন অন্য কোনো উপায় থাকে না। এখন কেউ কাউকে আর সাহায্য করেনা, বিপদে দেখে না। মেয়েটাকে নিয়ে তাই মায়ের খুব স্বপ্ন; একদিন সে অনেক বড় হবে। সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। দেশের মানুষ তাকে মাথায় করে রাখবে।
হঠাৎ মেয়ের চিৎকারে মায়ের সংবিৎ ফেরে। মিতু চিৎকার করে বলছে, মা, মা... সামনে, সামনে তাকাও। মা বিস্ময়ে সামনে তাকালেন। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সামনে খুব ভীড়। সবাই কাকে যেন ঘিরে রেখেছে। উৎসুক জনতা। কেউ দামি ফোন বের করে ফটো তুলছে। কেউ বই, খাতা-কলম এমনকি হাত পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা সিগনেসার প্লিজ..। মা এই ভীড়ের মাঝখানে খুব শান্ত চেহারার মৃদু হাসিমাখা একটা মুখ দেখতে পেলেন। তার চোখ যেন আটকে গেলে। ক্রমেই ভীড় বাড়ছে। ‘সত্যি তো এ যে সাকিব আল হাসান!’
মা যেন নড়তে পারছেন না, কে যেন তাকে আটকে রেখেছে। নিজেকে তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চোখের সামনে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। মায়ের খুব ইচ্ছে হলো মেয়েকে নিয়ে আরও কাছাকাছি যেতে। একটু কথা বলতে। কিন্তু ভীড়ের কারণে সেটা সম্ভব নয়। সবাই যে এখন এই প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করছে। সেখানে মিতুকে কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া বিপদজনক। ভীড়ের মধ্যে যদি জটলা লাগে। দুর্ঘটনা তো আর বলে কয়ে আসেনা।
মিতু মায়ের সাথে বাসায় ফিরেছে। আজ সাকিবকে দেখতে পেয়ে তার খুব ভালো লেগেছে। মা তাকে একটি পুতুল, বেশ কিছু খেলনা, দুইটি গল্পের বই আর একটি ফটো কিনে দিয়েছেন। ফটোটি অবশ্য মিতু জোর করেই কিনে নিয়েছে। মা প্রথমে না বলে দিয়েছিল। কিন্তু মিতুর মন খারাপ হবে ভেবে, কী বুঝে মা শেষে কিনে দিলে। মিতু সেদিন রাতে বার বার ফটোটি দেখছিল। ফটোটির নিচে ক্যাপসন লেখা,‘ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।’
স্কুলে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করার জন্য প্রতি বছর মেধা উৎসবের আয়োজন করা হয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কোনো না কোনো ইভেন্টে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। মিতু আবৃতি, গান আর ড্রইং প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। আজ সমাপনী দিনে বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার বিতরণ করা হবে। পুরো স্কুল খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সবাই খুব উৎসুক। আগে থেকেই প্রচার করা হয়েছে আজ বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরষ্কার তুলে দিবেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তাই পুরো ক্যাম্পাস যেন কানায় কানায় পূর্ণ। তবে নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। এক শিক্ষার্থী এক অভিভাবক ধরে দাওয়াত কার্ড দেখে গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে।
মিতুর কাছে একটা কার্ড। বাবা অথবা মা যেকোনো একজন প্রবেশ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে বাবাকে একটু ছাড় দিতে হলো। মিতুকে নিয়ে মা ভেতরে প্রবেশ করলেন। আর যারা প্রবেশ করতে পারলেন না গেটের বাইরে তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল। সে কথা না হয় অন্য দিন বলবো।
চারদিকে উৎসবের আমেজ। সাকিব আল হাসানকে কাছ থেকে দেখা আজ সবার কাছে বাড়তি পাওয়া। আর এই সেলিব্রেটির হাত থেকে পুরষ্কার নিতে পারলে তো কথাই নেই। সারা জীবন তা স্মৃতি হয়ে থাকবে। পুরষ্কার বিতরণী শুরু হয়ে গেছে। খেলাধুলা, গল্পলেখা, আবৃত্তি, নাচ, গান এবং ড্রইং এ বিজয়ী প্রতিযোগিদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। মঞ্চ থেকে সামনে পুরো মাঠ শুধু মানুষ আর মানুষ।  বিজয়ী শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের উল্লাস চোখে পড়ার মতো।
এক এক করে ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠে বিজয়ীরা সাকিব আল হাসানের হাত থেকে পুরষ্কার গ্রহণ করছে। সবার কী যে আনন্দ! কিন্তু মিতুর মায়ের মুখ শুকিয়ে গেছে। এখনো কোনো পর্বে মেয়ের নাম ঘোষণা করা হলো না। তবে কী মিতু ঠিক মত পারফর্ম করতে পারেনি। কত কষ্ট করেই না মিতুকে সে তৈরি করেছে। তার বিশ্বাস কোনো না কোনো প্রতিযোগিতায় মিতু ভালো করবেই। আশায় বুক বাধে। আজ মনে হচ্ছে, এই প্রতিযোগিতা শুধু মেয়ের একার নয়। তার নিজেরও। ড্রইং এর ফলাফল তখনো ঘোষণা হয়নি।
হঠাৎ মাইকের শব্দে মায়ের সতর্কতা বাড়ল। ‘এখন ইন্টার স্কুল ড্রইং কম্পিটিশনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তার আগে একটি ঘোষণা দিতে চাই। আমাদের বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহোদয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী ড্রইংয়ে প্রথম পুরষ্কার প্রাপ্ত পেইন্টিংটি উপহার হিসেবে তুলে দেওয়া হবে সাকিব আল হাসানের হাতে। আর বিজয়ী শিক্ষার্থী পুরষ্কারসহ সাকিব আল হাসানের সাথে আজ ডিনার করার সুযোগ পাবে।’  ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে হাততালি আর উল্লাসে যেন সবাই ফেটে পড়ল। হাত তালির শব্দ থেমে  গেলে উপস্থাপক রুনা ম্যাডাম ঘোষণা দিলেন :
‘সাকিব আল হাসানের ছবি এঁকে এ বছর স্কুল ড্রইং কম্পিটিশনে প্রথম হওয়া সৌভাগ্যবান বিজয়ী ইসরাতুল জান্নাত মিতুসী ওরফে মিতু। মিতুকে মঞ্চে আসার আহবান জানাই।’ মা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মিতু ড্রইংয়ে প্রথম হয়েছে! মায়ের চোখ দিয়ে তখন ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। তবে এ জল আনন্দের। এ কান্না তৃপ্তির। এ উচ্ছ্বাস বিজয়ের!!

সময়ের আলোর ছায়ায় রাত্রির যাত্রী

সময়ের আলোর ছায়ায় রাত্রির যাত্রী





সময়ের আলোর ছায়ায় রাত্রির যাত্রী  
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

তখন রাত। তারা ভরা আকাশ। চাঁদের রূপ। অন্ধকার পৃথিবী। নিস্তব্ধ প্রকৃতি। সব যেন এলোমেলো। আলোর মাঝে যেন নির্ঘুম অন্ধকার।
মনটা ভালো নেই রাত্রির।
কেন ভালো নেই সে জানে না। কিন্তু বুঝতে পারে কিছু একটা তার সাথে ঘটবে বা ঘটেছে।
ঘটবে মানে ভবিষ্যত আর ঘেেছ মানে অতীত। কে জানে তার সাথে কোনটা হয়েছে। বাইরের বাতাসের ধাক্কায় দরজাটা খুলে যায়। হু হু করে অদৃশ্য কিছু একটা ঢুকে পরে। রাত্রির সারা শরীর থেমে থেমে কেঁপে উঠে। এর সাথে মনও।
অদৃশ্য ছায়াটা রাত্রির চারপাশে ঘুরতে থাকে, ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরতে চায় কিন্তু পারে না। রাত্রি বিষয়টা বুঝতে পারে কিন্তু মাথায় ঢুকেনা। কে যেন বাইরে থেকে নিচু স্বরে বলতে থাকে হায়রে ছায়া তোর কপালটাই খারাপ।
আর, মৌমাছিরা ফুলের চারপাশ ঘুরতে ঘুরতে একসময় ফুলের ভিতর ঢুকে মধু টেনে নেয়। ফুল হয় কলংকিত আর মৌমাছিরা আনন্দে নেচে উঠে। কিন্তু কেউ জানেনা এটা কি দুর্ঘটনা নাকি নিজের জীবনকে হারিয়ে ফেলা।
রাত্রির অদৃশ্য ছায়াটাকে চেনা চেনা মনে হয় কিন্তু অচেনায় থেকে যায়। রাত্রির এই অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি আজকের না। অনেকদিনের। এটা কি তবে প্রেম। মানুষের সাথে প্রেম হয় কিন্তু অদৃশ্য ছায়ার কি প্রেমে পড়া  যায়। ছায়ার সাথে প্রেম তাও আবার চোখে দেখা মেলে না এমন ছায়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ে রাত্রি। ইতিহাসের পাতার পর পাতা ঘাটে। নিজেকে মনে হয় ইতিহাসের একটা সময়ের ঘড়িতে আটকানো চরিত্র। কিন্তু সেই ইতিহাস তো রাত্রির জানা নেই। ইতিহাসের পাতায় পাতায় নিজের মুখটা দেখতে পায় রাত্রি। মুখোশও দেখে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না।
রাত্রির সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী আলো আর বন্ধু ধ্রুব। ধ্রুবকে সবাই ধ্রুব তারা বলেই ডাকে।
কিন্তু বন্ধুত্বের বাইরে এই তিনজনের কোথায় যেন একটা অদৃশ্য সুতোর টানাপোড়েন আছে। সেটা হয়তো সবাই বুঝে আবার হয়তো বুঝতে পারে না।
রাত্রির অদৃশ্য ছায়াটার প্রতি মনের টান বাড়ে। প্রাণ ব্যাকুল হয়। কিন্তু কোনো পথে খুঁজে পায় না।
এর সাথে ইদানিং আরেকটা বিষয় ঘটছে রাত্রির সাথে। গত মাসে রাত্রি একটা চিত্র প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলো। ওখানে একটা তরুণ ছেলের সাথে তার দেখা। কত বয়স হবে। উনিশ-বিশের মতো। নামটাও খুব সুন্দর। সময়।
সময় যেন সময়ের মতোই চঞ্চল। সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম মানতে সে নারাজ। রাত্রির চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মতো ছোট হবে হয়তো।
প্রতিদিন সময় টাইম ধরে ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে রাত্রিকে ফোন দিবে। শুভ সকাল। বলার পর এটা ওটা নানা কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার পর একটা কথা সময় বলবেই। এই লাভ ইউ। রাত্রি কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিবে।
রাত্রি সময়কে নিয়েও ভাবে। বাচ্চা পোলাপান মনে হয়। কিন্তু এতো গুছিয়ে, এতটা আবেগ দিয়ে কথা বলে যে রাত্রির মুখ থেকে কথা বের হতে চায় না। লজ্জায় গালগুলো লাল হয়ে যায়। কে জানে ছায়াটার মতো সময়ের প্রেমে হয়তো ডুব দিয়েছে রাত্রি।
খুব অস্থির লাগে রাত্রির। না পারে সইতে না পারে কইতে। মাঝে মাঝে গোলক ধাঁধায় পরে যায়।
ধ্রুব রাত্রিকে কি বলবে বলবে বলছিলো অনেকদিন ধরে। কিন্তু বলতে পারছিলো না। আলোও রাত্রিকে নিরিবিলি কি একটা গোপন কথা বলবে বলে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলো। কি বলতে চায় তারা। রাত্রি জানে না। কিন্তু কি যেন একটা অজানা আতংক ভর করে রাত্রির উপর।
রাত্রি এবার সিদ্ধান্ত নেয়। ধ্রুব আর আলোর সাথে বিষয়গুলো শেয়ার করবে।
রাত্রিদের পাশের বাড়িতে এক মহিলা ডাক্তার থাকেন। মানুষের মনের নাকি চিকিৎসা করেন। রাত্রি অনেকবার ভেবেছে তার কাছে যাবে। কিন্তু ভয়ও পেয়েছে মানুষ যদি ভাবে সে পাগলী হয়ে গেছে। মানুষগুলোও আমাদের যেন কেমন সেই পুরোনো আমলের। শরীরের  চিকিৎসার চেয়ে যে মনের চিকিৎসাটা বেশি দরকার এটা তারা বুঝেন না। হয়তো বুঝেও অবুঝ। মনের চিকিৎসা মানে যে পাগলের চিকিৎসা না এটা তাদের কে বোঝাবে। তারপরও দিন তো পাল্টাচ্ছে।
রাত্রি লোকজন এড়িয়ে মহিলা ডাক্তারের বাড়িতে যায়। মনোবিজ্ঞানী ক্যাথরিন। অনেক বছর আগে তিনি ইতালি ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন। মানুষের মনটা উনি খুব ভালো বুঝেন। 
রাত্রি ভিতরে ঢুকে। ছিমছাম বাড়ি। অদ্ভুত নীরবতা।
রাত্রি ক্যাথরিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্যাথরিনের পিছনের সাদা চুল ঝুলানো মাথাটা দেখতে পায়।
পিছন থেকে ক্যাথরিন বলে, রাত্রি আমার সামনের চেয়ারটাতে বসো। ছায়াটাও তো দেখছি তোমার সাথে।
রাত্রি অবাক হয়। এটা কি বাস্তব নাকি স্বপ্ন। সত্য নাকি মায়াবী জাদু। কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে তার ভিতরের সত্তা আরেকজন খুঁজে পেয়েছে হয়তো।
শরীরটা এলিয়ে দিয়ে রাত্রি চেয়ারটাতে বসে। ঘুম ঘুম চোখ। বিস্মিত মুখ।
রাত্রি চোখকে খোলা রাখার যুদ্ধ করে। মুখটাকে স্বাভাবিক অবস্থার ভিতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
হ্যালো ম্যাম। গুড মর্নিং।
ক্যাথরিন বলে, এখন তো রাত। গুড নাইট বলো।
রাত্রি অবাক হয় সে কি রাত দিন কি এটা ভুলে গেছে? রাত্রি বলে, আমার অনেক....।
থামিয়ে দিয়ে ক্যাথরিন বলে, সমস্যা!
ঠিক বলেছেন।
ক্যাথরিন বলে, আমি তো তোমার সমস্যা দেখছি না। বরং তুমি সমস্যা অন্যদের জন্য সমস্যা হয়ে গেছো
অবাক হয় রাত্রি। আমার সমস্যা নেই। আমি অন্যের জন্য সমস্যা হয়েছি। কি বলছেন?
ক্যাথরিন বলে, অনেকদিন ধরে তোমার কারণে কয়েকজন আমার চিকিৎসায় আছে। আমার জন্য, রাত্রি একটু ক্ষোভ নিয়ে বলে। আমি তো এসেছি আমার সমস্যার জন্য। আর আপনি বলছেন ঠিক তার উল্টো।
রাত্রি তোমার অতীত আছে আর ভবিষ্যত আছে। কিন্তু বর্তমান নেই।
ক্যাথরিন বলে, তোমার স্বামীর কথা কি মনে আছে?
তোমার স্বামী ছায়া। রাত্রি আবার অবাক হয় আমার স্বামী ছায়া। আমি তো বিয়েই করিনি।
করোনি মানে? এটা কে?
আমার ছেলে জিসান।
ক্যাথরিন জিজ্ঞেস করে নিজের ছেলে।
আমার নিজের ছেলে।
কিন্তু তুমি যে বলছো বিয়ে করোনি।
না করিনি।
এখনো বলছো করোনি।
না করিনি।
তাহলে তুমি জিসানকে নিজের ছেলে বলছো।
রাত্রি ভাবে আর ভাবে। কি আছে তার মনে যা সে জানে কিন্তু বলতে চায় না।
ক্যাথরিন বলে, জিসান তার বাবার সাথে আজ আমেরিকা চলে যাচ্ছে। আর কখনো ফিরে আসবে না।
রাত্রি কেঁদে উঠে, না এমনটা আমি চাই না। আমি বলছি তো আমি ওর মা।
ক্যাথরিন এবার বলে মা নাকি জিসানের মায়ের হত্যাকারী।
রাত্রি এবার চমকে উঠে।
রাত্রি আর যাত্রী দুই যমজ বোন। অবিকল দেখতে একই রকম। খুব গভীর সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে।
রাত্রি ভালোবাসতো ধ্রুবকে কিন্তু ধ্রুব ভালোবাসতো আলোকে।
যাত্রীর বিয়ে হয় ছায়ার সাথে। খুব সুখের সংসার। কিন্তু সে সংসারের উপর রাত্রির চোখ পরে। যাত্রী তখন সন্তান সম্ভবা। বোনের সেবাযতœ করবে বলে ছায়ার বাড়িতে জায়গা নেয়। দুইবোনকে নিয়ে ছায়ার মাঝে মাঝে বিভ্রান্তি হতো। কেন হবে না সব কিছুই যে এক।
যাত্রীর কাল সন্তান হবে। চোখে মুখে আনন্দ আর আনন্দ। যেন পৃথিবীর সব কিছু কাল পেয়ে যাবে যাত্রী।
রাত্রির কেমন যেন হিংসে হয়। রাগ চোখ, মুখ আর কান থেকে গরম বাস্প যেন বের হতে থাকে।
বাইরে কান্নার শব্দ। ছায়া আর যাত্রীর সন্তানের চিৎকার করে পৃথিবীতে আসার কান্না।
রাত্রি ফোন করে ছায়াকে জানায় সে আর দেশে থাকবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। কিছুক্ষণ পর ভিতর থেকে বের হয়ে আসে যাত্রী। কোলে সন্তান।
ছায়া আবেগে আপ্লুত হয়। চাঁদের হাসির বাঁধ যেন ভেঙে যায়। কিন্তু কোথায় যেন ফাঁক, অপূর্ণতা। ছায়া বুঝতে গিয়েও বুঝতে পারে না।
রাত্রি তো চলে গেছে। কিন্তু রাত্রি নামের একজন ধ্রুব ও আলোর সাথে ক্যাম্পাসের খোলা দিকটায় আড্ডায় বসেছে। তবে কি যাত্রী রাত্রির অভিনয় করে যাচ্ছে। কে জানে কেইবা বলতে পারে। সব কিছু ভাসা ভাসা নদীর জলে পদ্মের মতো।
রাত্রি না যাত্রী কে জানে কেইবা বলতে পারে। সব যেন রহস্য। ধ্রুব আর আলোকে জিজ্ঞেস করে,  কি বলবি বল।
না মানে....একটু লজ্জা, একটু বিব্রত, একটু অপ্রস্তুত হয়ে ধ্রুব বলে, আমি আর আলো বিয়ে করেছি।
সময় যেন থমকে যায়। দমবন্ধ হয়ে আসে রাত্রি কিংবা যাত্রীর।
ধ্রুব কথাটা বলে উঠে পরে।
এরপর কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে।
ধ্রুব একদিন পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে এসে বলে, আমার আলোকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।
কোথায় আলো আজ সব যেন অন্ধকার?
সময় একদিন ছায়ার বাড়িতে আসে। রাত্রিকে খুঁজে।
ছায়া বলে রাত্রি তো নেই। ওর বোন যাত্রী আছে।
সময় বলে তাহলে যাত্রীকে আপাকে ডাকুন। যাত্রী আসে। যাত্রী তো? সময়ের ফোন কথা বলা রাত্রি নাকি যাত্রী। কে জানে।
সময় বলে, যাত্রী ম্যামের সাথে আমার ফোন কথাবার্তা হতো। উনার জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল। যাত্রী জিজ্ঞেস করে কি?
উনার আমি বিয়ে ঠিক করেছি।
আমার চাচুর সাথে।
যাত্রী চমকে উঠে। যাত্রী তো? ঠিক বোঝা কঠিন।
সময় বলে আমি তো আগে থেকেই একটা মেয়ের সাথে এনগেজ। আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। অপেক্ষা করছি। সময়ের আর স্বপ্নের। কিন্তু আমি আর মেয়েটা রাত্রি আপাকে নিয়ে খুব ফান করেছি। প্রতিদিন আমি রাত্রি ম্যামকে বলতাম, আই লাভ ইউ। মেয়েটাকে মোবাইলে রেকর্ড করে কথাগুলো শুনাতাম।
এখন রাত্রি ম্যামের জন্য কষ্ট হচ্ছে। উনি মনে হয় আমাকে ভালোবেসেই ফেলেছে।
কষ্ট হলো তো। সেজন্য চাচুকে সব কথা বলতে উনি বিয়েতে রাজি।
ছায়া বললো রাত্রি তো চলে গেছে।
দিন গড়ায়।
একদিন সময়ের খোঁজে সময়ের মা-বাবা ছায়াদের বাসায় আসে।
খুঁজে পাচ্ছে না তাকে।
সবাই কি তবে হারিয়ে যাবে কিংবা যাচ্ছে।
ক্যাথরিন আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নার ভিতরে রাত্রিকে দেখতে পায়। খুব কুৎসিত একটা মুখ। মুখোশটা খসে পরে।
একটা প্রতিহিংসা পরায়ণ মুখ মুখোশ থেকে বেরিয়ে আসে।
রাত্রি নিজের বোনকে খুন  করে এখন যাত্রী।
রাত্রি নিজের বান্ধবী আলোকে খুন করে ধ্রুবকে পেতে চায়।
রাত্রি সময়কেও ভালোবেসেছিলো কিন্তু সময় তাকে নিয়ে খেলেছে।
এরপর সময়কে হত্যা।
রাত্রি এখন খুনি। কেউ জানে না।
ক্যাথরিন রাত্রির বিবেক।
রাত্রির বিবেক এসে থমকে দাঁড়ায়।
রাত্রি ভাবতে থাকে কি করবে সে।
রাত্রি এখনো ভাবছে।
কিন্তু সে কি রাত্রি না যাত্রী কেউ জানে না। এখন সে প্রকৃতির বিচারের অপেক্ষায় আছে।
তবে আরেকটা রহস্য এখনো অজানা। সেটা হলো বিয়ের রাতে যাত্রী নাকি পালিয়েছিলো।
আর রাত্রির সাথে ছায়ার বিয়ে হয়েছিল।
তবে এখনও পুরো বিষয়টা বুঝে উঠা কঠিন। অপেক্ষা সময়ের, মুখ আর মুখোশের।


চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমীতে

চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমীতে


চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমীতে
মুহাম্মাদ এমদাদুল্লাহ

ভোরের মৃদু বাতাস বইছে। ঝলমলে সূর্যের সোনালি কিরণ বাতাসের সঙ্গী। সুনসান নীরবতায় দু’পাশের সবুজ মেখে ছুটছে আমাদের গাড়ি।
পিচঢালা রাস্তা দু’ধারে কড়ই গাছের ছাউনি ঢাকা পরিবেশ। হালকা কুয়াশায় মোড়ানো স্বচ্ছ-নির্মল প্রকৃতি। মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক গলে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। যেন গাছের আবডালে লুকোচুরি খেলছে সূর্যশিশু।

গাড়িতে সবাই নীরব। আচ্ছন্নতায় ডুবে আছে সবাই। মুগ্ধ হয়ে দেখছে সবুজ মায়াঘেরা প্রকৃতি। বাইরে মনলোভা প্রকৃতির হাতছানি ভরে দেয় মন ও মনন। মৃদুমন্দ বাতাসে তাই হারিয়ে যাই ক্ষণিকের জন্য। নিজেকে আবিস্কার করি পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষগুলোর মাঝে। এই সুখ ও সুখের আবহে হয়তো কাটিয়ে দেয়া যাবে কয়েক জনমও। এ যে পরম প্রশান্তির ছোঁয়া!

এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গাড়িতে ঘটে গেলো  আরেক ঘটনা। গুলজার মোড় থেকে আমাদের গাড়ি ছেড়েছে। গাড়ি ছাড়ার পর প্রথম কিছু সময় ছিলো সম্পূূর্ণ শান্ত নীরব। কিন্তু কিছুদূর যেতেই শুরু হলো হৈ-হুল্লোড়। পর্যায়ক্রমে সেটা মাত্রা ছাড়ানোর উপক্রম। শেষে হলোও তাই। বিশ্রী একটা অবস্থার সৃষ্টি। কারো দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বিষয়টা অনেককেই বিষিয়ে তোলে। সহ্যই হচ্ছিল না একদম।

পাশে ছিলেন তারিক ভাই। তাকে বললাম, এই পরিবেশের সাথে এসব যায় না। কারণ এখানে প্রিন্সিপাল ম্যামসহ অনেক ডাক্তারগণ রয়েছেন। এসব না করলে...
আরো কিছু বলতে যাচ্ছি, পেছনে বসা এক ভদ্রলোক আমার কথায় চটে গেলেন। বললেন- ‘ভ-তে ভ্রমণ আর ম-তে  মাস্তি। সুতরাং  ভ্রমণে এগুলো হবেই।’

রাগ সত্ত্বেও হেসে দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। বললাম- দেখেন, এইসবের একটা লিমিট থাকা দরকার। আপনাদের অবস্থায় তো মনে হচ্ছে এটা একটা পাগলাগারদ। সিনিয়র-জুনিয়রের মাঝে একটা রেসপেক্টের ব্যাপার আছে। সেটা তো মনে হয় গুলিয়ে খেয়ে এসেছেন!
ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়লো। আমার কথা উপরে যুক্তি বসাতে চাইলেও পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। অযথা ঝামেলায় জড়ানোর কী দরকার! যা বলেছি, বিবেকবান হলে তাই কাফি।

কিছুদূর যেতেই ভদ্রলোকের যেন বোধোদয় হলো। মাইকের গ্যাঁ গ্যাঁ কতোক্ষণ আর ভালো লাগে! তার কাছেও হৈচৈটা এখন বাজে ঠেকছে মনে হয়। পরে ঠিকই অন্যদের লাফালাফিতে তিক্ত হয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ভদ্রলোক। কথায় আছে না, অতিভোজনে পেট নষ্ট! তার ক্ষিপ্ততায় বেশ মজা নিচ্ছিলাম আমরা দু’জন। ভদ্রলোক আমাদের মজা নিতে দেখে রাগে যেন ফায়ার করবে। চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। সেখান থেকে ঠিঁকরে পড়ছিলো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

তারিক ভাই আর আমি একই কলেজের ছাত্র। হাসিমাখা শান্ত স্বভাবের মানুষ। মনটা যেমন সরল তেমনি আন্তরিক। তাঁর সুবাদে অচেনা জায়গাগুলো চেনা আসান হয়েছে আমার। কারণ এসব এলাকা তার খুব ভালো মতো আয়ত্বে আছে।
কর্ণফুলীর পাশঘেঁষে ছুটে চলছে আমাদের গাড়ি। তারিক ভাই ইশারা করে করে চিনিয়ে দিচ্ছেন অনেককিছু । বিভিন্ন তথ্য-উপাত্বও জুড়ে দিচ্ছেন ফাঁকে ফাঁকে। কর্ণফুলী নদী, বড় বড় জুতো তৈরির কারখানা, সিমেন্ট কারখানা, তেলের গোডাউন ইত্যাদি দেখালেন। তেলের গোডাউনের একটা তথ্যে তো আমি অবাক! এখানকার একেকটা গোডাউন এতো বড় আর রিস্কি যে, কোন একটাতে যদি দুর্ঘটনাবশত আগুন ধরে তাহলে কয়েক কিলোমিটার এলাকা সম্পূূর্ণ ভষ্ম হয়ে যাবে।

দেখতে দেখতে বাঁ পাশের জলরেখা হারিয়ে সবুজ গালিচা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। আরো কিছুদূর যেতেই গাছ-গাছালী ভরা সবুজ গ্রামের হাতছানি। পথের দু’ধারে মাইলের পর মাইল বৃক্ষসারী। কোথাও কোথাও ঝোঁপ-ঝাঁড়। সামনে যেতেই নদী কূলঘেঁষা আঁকাবাঁকা পথ এসে পুনরায় ধরা দিলো। নদীর ওপার দেখতে পেলাম। যার শেষ প্রান্ত একেবারে দিগন্তরেখা ছুঁইছুঁই। পাশেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি  তালগাছ। যেন স্বাগত জানাতে এসেছে আমাদেরকে।
মোবাইল হাতে নিয়ে উইকিপিডিয়া ওপেন করলাম। ম্যাপে দেখছিলাম অবস্থান। আনোয়ারা এলাকায় লালরেখা চিহ্নিত স্থানকে জুম করি। পুরো এলাকা একনজরে চলে আসে। উত্তরে পটিয়া, দক্ষিণে বাঁশখালী, পূর্বে চন্দনাঈশ এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর। বন্দরের সাথেই বঙ্গোপসাগর। আনোয়ারার দেয়াং পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী বনভূমি বেশ বিখ্যাত। কাফকো পাহাড়, কেপিজেট এবং পারকীচর সী বিচও আনোয়ারার দর্শনীয় স্থান।
আনোয়ারা থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৭৬ সালে। উপকূলীয় এই থানার নামকরণের ইতিহাস সর্বজনবিদিত নয়। জনশ্রুতি আছে আনারা নামে এক মগ রাজা এই থানার কর্তা ছিলেন। পরে কালের আবর্তে উচ্চারণ পরিবর্তনে তা আনোয়ারায় পরিণত হয়। ১৯৮৩ সালে আনোয়ারা থানা উপজেলায় উন্নীত হয়।

কর্ণফুলীর উতলা ঢেউয়ে দোল খেলছে জাহাজগুলো। তাকিয়ে আছি আনমনে। কেমন যেনো ইচ্ছে করছিলো নাবিক হতে। কল্পনায় ভেসে ওঠে আমার নাবিক চেহারা। বিশাল জাহাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সম্মুখে ছুটে চলছি মহা আনন্দে। খেলছি সাগরের অথৈজলে সংগ্রামখেলা। ক্ষণিকের জন্য সমুদ্রের আকুলতা অনুরণন সৃষ্টি করে হৃদয়ের গভীরে।
কতো কী মনে মনে কোণে উঁকি দিতে দিতে আমরা চলে আসি আজকের ভ্রমণস্পট ‘বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির’ সামনে। কলেজের সকল শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় ধীরে ধীরে। ভেতরে প্রবেশ করি। হাঁটতে হাঁটতে এসে থেমে যাই একটি সাইনবোর্ডের সামনে। তাতে লেখা ‘গঅজওঘঊ অঈঅউঊগণ ঞজঅওঘওঘএ খঅকঊ’। ভেতরে চেয়ার টেবিল সাজিয়ে আয়োজন করে রেখেছে কলেজ কর্তপক্ষ।

বেলা তখন এগোরাটা। আজকের আয়োজনের অন্যতম বিষয় ক্রিড়া প্রতিযোগিতা। প্রথম প্রতিযোগিতা পর্ব শুরু হয় এগারোটায়। বিভিন্ন খেলার ইভেন্ট ঘোষণা হয়। প্রথম ইভেন্ট ‘মুরগী লড়াই’। মঞ্চ থেকে ঘোষণা এলো যে, ছেলেরা মাঠে নামবে। যাদের খেলার ইচ্ছা নেমে পড়লো। দর্শকের সারিতে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। হঠাৎ আমার দিকে কেমন করে যেন তাকালেন ডাঃ জলিল স্যার। চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি ‘ফাস্ট ইয়ারের’ ছাত্র না?
বললাম- জ্বী স্যার,
তিনি আমার হাতটা ধরে টেনে নামিয়ে দিলেন মাঠে। আমি তো পুরো ‘থ’ হয়ে গেলাম! এই খেলা কখনো খেলিনি। কী করি কী করি... সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই শুরু হয়ে গেলো লড়াই।
আমি পা ধরে দাঁড়িয়ে আছি এককোণে। প্রচুর ভয় করছে। অন্যদের কাঁধে কাঁধে ধাক্কা-ধাক্কি দেখে ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে গেলাম। পাশে একজন উৎসাহ দিলেন- কারো সাথে ফাইট করার দরকার নেই। যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকুন। মাঠ তখন পুরো গরম। আমাদের ফাস্ট ইয়ারের তোফাজ্জল ভাই সকলের দৃষ্টি কেড়ে করে নিলেন। কারণ তিনি সবার সাথে সুকৌশলে লড়ছেন। একে একে পড়ে যাচ্ছিলো সবাই। আর বাকি মাত্র পাঁচজন। এদের মধ্যে আমিও আছি। কিন্তু এভাবে সবার থেকে পাশ কাটিয়ে থাকা আর সম্ভব হয়নি। পেছন থেকে ঠেলে ডাঃ ওমর ফারুক স্যার মাঠের মাঝখানে পাঠিয়ে দিলেন। ভয়ে আমার মনের বাতি নিভু নিভু। কী হবে তা ভাবতে ভাবতে পেছন থেকে এসে দিলো ধাক্কা একজন। পায়ে খেলাম এক মোচড়। অসহায়ভাবে পড়ে গেলাম। শেষ পর্যন্ত প্রথম হলেন তোফাজ্জল ভাই।
ধাপে ধাপে ইভেন্টের আরো খেলার প্রতিযোগিতা চলে। কলেজের শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে অংশ গ্রহণ করে। মুরগী লড়াই, পরে শুরু হয় যেমন খুশি তেমন সাজো পর্ব, তারপর মিউজিক্যাল চেয়ার। এরপরে একজন চিকিৎসক রোগী নিয়ে শিক্ষণীয় চরিত্রে অভিনয়। এভাবে অনুষ্ঠান বর্ণিল হয়ে ওঠে। শিক্ষকগণ স্টুডেন্টদের অসাধারণ পারফর্ম দেখে যেমন খুশি হয়েছেন, তেমনই শিক্ষার্থীদেরও আনন্দে আনন্দে ভরে উঠেছে মন।

যোহরের নামাযান্তে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। ভোজনপর্ব শেষে শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কেউ অনুষ্ঠানে বসে আছে, আবার কেউ আশপাশের স্পটগুলোতে ঘুরছে। আমাদের ব্যাচের তারিক ভাই, তোফাজ্জল ভাই ও মুনির ভাইসহ আরো অনেকে গল্প জমেছি গাছতলায়। পুরো জায়গাটি কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি। জমে উঠেছে খোশগল্প। আড্ডায় আড্ডায় একসময় গড়িয়ে আসে বিকেল। বিকেলবেলা পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

আছরের নামায শেষ করে মেরিন একাডেমির দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। সারাটি দিন অনুষ্ঠান আর গল্পে কেটে গিয়েছে। তাই কিছুই দেখা হয়নি। আমাদের সঙ্গী ছিলেন আজিজ ভাই। তার সাথে নৌবাহিনীর বড় বড় গবেষণাকেন্দ্রগুলো দেখি। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে বিভিন্ন ফুলের বাগান, ভাষাশহীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার। প্রভাতী সূর্যের ন্যায় শহীদ মিনারের জড়িয়ে হাসছে কৃত্রিম একটি সূর্যপ্রতীক।

বিশাল একটি বোর্ড ঝোলানো। সেখানে লেখা হয়েছে মেরিন একাডেমি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য। এই একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একমাত্র নৌবাহিনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো এটি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো পাকিস্তান নৌবাহিনী। স্বাধীনতা লাভের পরে মেরিন একাডেমির পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত।

দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। সন্ধ্যার আগামনী বার্তা কড়া নাড়ে। গাড়িতে এসে একে একে বসে পড়ি আমরা সবাই। সব ক্লান্তি জড়িয়ে দিলাম সিটে। শুরু হয় ছুটন্ত পাখির স্বীয় নীড়ে ফেরা।

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৮

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৮

(গত সংখ্যার পর)
‘দায়ভার। মা সরস্বতীর দেখা পাবেন। মানুষ এমনটাই চায়। বিদ্যা। না হয় বিত্ত।’
উর্মিলা কথা বলে না। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। পিয়ন ডেকে প্যাকেট দুটো নিজের টেবিলে নিয়ে আসে।
দীপু ভাই কথা বলে না। উর্মিলা কথা বলে না।

ম্যানিলা যাবার আগের দিন বেবী আপা তার রুমে ডেকে নেয় উর্মিলাকে।
বেবী আপার চোখে মুখে ব্যস্ততার ছাপ!
‘তোমাকে তো কিছু বলা হয়নি। ম্যানিলা যাচ্ছি সাতদিনের জন্য। দীপু তোমাকে বলেনি?’
‘বলেছে।’
‘দীপু ভালো ছেলে। ওর প্রতি বিশ্বাস রেখো। লেখাপড়ায় মন রেখো। অফিসের কাজ শিখতে চেষ্টা করো। সামনে কত পথ পরে আছে!’
‘জি’
‘বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে? উনাকে বেড়াতে আসতে লিখে দাও। সমস্যা হলে জাকির সাহেবকে জানিও। তুমি যত তাড়াতাড়ি শিখবে, আমি কিছুটা মুক্তি পাব।’
উর্মিলা কিছুই বুঝতে পারে না। কিসের মুক্তি। বেবী আপার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অসীম এক মমতা যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। উর্মিলার মনে হয়, এমন মাতৃমুগ্ধ মুখ ও আর কখনও দেখেনি।’

০৯.

অফিস শূন্য মনে হয়। সুনসান নীরবতা। এই নীরবতার মধ্যে রংপুর কিলিং-এর আউট লাইন তৈরি করে ফেলে উর্মিলা। বারবার পড়ে। নিজেই আশ্চর্য হয়। এমন আউট লাইন ও নিজে তৈরি করেছে! হয় তো নাজনীন আপা বলবে, ‘উর্মিলা, ওয়েল ডান। তারপরও আইডেন্টিটির ইনফরমেশন নেই। এগুলো মোস্ট নেসেসারি। রিম্ববার ডিয়ার।’
ভাবতে ভাবতে উর্মিলা ত্রুটি ধরতে পারে। তাইতো! আইডেন্টিটির গ্যাপ থাকা উচিত নয়।
রংপুর মিশন নাজনীন আপা কোর্ডেনেট করবে। যেখানে উর্মিলার গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা রয়েছে। তবে বুকের ভেতর এক রকম স্বস্তি অনুভব করে। দুরুদুরু ভাব নেই। ক্রমেই অমিত অদৃশ্য বিশ্বাস উর্মিলার মনোচৈতন্যে ছায়া ফেলতে থাকে। সুরবালা দিদির কথা মনে হয়। চাচা তো বোন। বিয়ে হয়েছিল দূর গাঁয়। হিজলনগর। খসমের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। প্রতি রাত বাংলা মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত জামাই বাবু। খিটখিট করতে করতে একদিন সুরবালা দিদি অ্যানড্রিন খেয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর কেউ সুরবালা দিদির কথা মনে রাখেনি। জ্যাঠাও মনে রাখেনি। এমন বদ নসিব নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন।
উর্মিলার শুধু বুক পোড়ে। আর ওই বাবলা! মানসিক প্রতিবন্দী। সারা পাড়াময় বলে বেড়াত, ‘আমি উর্মি দিদিকে বিয়ে করব।’
ও পাড়ার রফিক ভাই। আহ! কী করুণ সুরে আড়বাঁশি বাজিয়ে মাঝনিশি তোলপাড় করে ফিরত। রফিক ভাই কী এখনো অমন করে সুর তোলে? কী বেদনা তার? অমন রোদনভরা কান্না এখনও বুকেতে আটকে আছে।
উর্মিলার শ্বাস খানেক আটকে এল। জোর করে নিঃশ্বাস নিতেই হাত পা ঘেমে ওঠে।
রুবীর ডাকে আচ্ছন্নতা কাটতে থাকে।
‘আমার মাথা আউল হইতাছে।’
‘কিসের আউল।’
‘এখন বুঝবে না বালিকা। দীপু ভাইয়ের বয়ানে কই।’
উর্মিলা দাঁত বের করে হেসে ওঠে।
‘হাসলি কেন?’
‘তোর এখন বিয়ে দেয়া উচিত।’
‘তাতো বলবেই। নাগর তো সরস। আর আমাকে বিয়ে করার জন্য মানুষের ঠেকা পরছে। আমি কী জুহি চাওলা?’
‘জুহি চাওলা নকল। তুই আসল।’
‘আসল নকল বুঝি না। রঙিলা শহরে কিছুই বোঝার উপায় নাই।’ রুবী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে।
দীপু ভাইয়ের দেয়া কলেজের বইগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখলেও বেবী আপার দেয়া বইয়ের প্যাকেট খুলেও দেখেনি। আর মাত্র এক সপ্তাহ পর কলেজ শুরু হবে। তার আগেই দীপু ভাই চলে আসবে। ইত্যাকার ভাবনা উর্মিলার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঘুরপাক খেতে থাকে।
লাঞ্চের পর জাকির সাহেব উর্মিলাকে ডাকে। এই প্রথম জাকির সাহেবের রুমে যাবে উর্মিলা। খুব বেশি অবাক হয়নি উর্মিলা। ভাবনায় এইটুকু ছিল। বর্তমানে অফিসের প্রধান ব্যক্তি। কাজে অকাজে ডাকতেই পারে।
শুধু রুবী একবার উর্মিলার দিকে তাকায়। উর্মিলার কোনো ভাবান্তর নেই। আগের মতো সহজ। ভাবলেশহীন। তড়িঘড়ি করে না। শুধু বুকের উড়নিটা একটু টেনে দেয়। করিডোর দিয়ে যেতে মিতালী শিকদার অযাচিতভাবে বলে উঠে, ‘হেই উর্মিলা।’
উর্মিলা বলে, ‘জি দিদি।’
‘সাবধান।’
উর্মিলা মাথা নাড়ে।
জাকির সাহেবের রুমে ঢুকতেই অনুভব করে সিগারেটের উটকো গন্ধ এসির শীতল হাওয়ায়। অস্বস্তিকর পরিবেশ করে রেখেছে। একটু বিব্রত হয়। দু’হাত তুলে নমস্কার জানায় উর্মিলা। জাকির সাহেব টেবিলের সামনে চেয়ার দেখিয়ে বলে, ‘বস উর্মিলা। আপা তোমার প্রতি আস্থাশীল। সুমি-নাজনীনের দেখলাম তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’
উর্মিলা লজ্জিত কণ্ঠে বলে, ‘স্যার, গ্রাম থেকে এসেছি তো তাই সবাই একটু করুণা করে।’
‘ছি ছি এ কথা কেন বলছ? সবাইতো গ্রাম থেকে আসে!’
‘জি স্যার।’ উর্মিলা জাকির সাহেবকে চোখের দিকে তাকায়। বেশ বলিষ্ঠ পুরুষ। চোখের পাতা দ্রুত ওঠানামা করে।
‘আপা তোমার প্রতি দৃষ্টি রাখতে বলেছেন। এসব কাজ ভালো লাগে?’
‘লাগে স্যার।’
‘গুড।’
এ সময় পিয়ন দু’কাপ চা রেখে যায়। জাকির সাহেব হাতের ইশারায় উর্মিলাকে চা নিতে বলে।
‘স্যার, আমি বেশি চা খাই না। অভ্যেস কম।’
‘এনেছে যখন। খাও।’
জাকির সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টাস করে শব্দ করে।
প্রায় মিনিট খানেক গড়ায়। জাকির সাহেবে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘অফিসে আমার সম্পর্কে কিছু শুনে থাকবে হয়তো।’
উর্মিলা বিস্ময় নিয়ে বলে, কেউ আমাকে কিছু বলেনি।’
‘বলবে বলবে। নতুন এসেছ তো!’
‘সমস্যা নেই, স্যার। বাবা বলেছেন, বস অলওয়েজ রাইট।’
‘প্রফেশন বড় কঠিন জায়গা। সবাইকে খুশি করা যায় না।’
‘জি স্যার।’ উর্মিলা মৃদু স্বরে বলে।
‘তুমি তো বেবী আপার মানুষ। তোমার প্রতি আমার দৃষ্টি থাকবেই।’
‘জি স্যার।’
‘অফিসে একটা নিজস্ব মানুষ লাগে না।’
‘জি স্যার।’
‘সমস্যা হলে অকপটে বলবে।’
‘বলব স্যার।’
‘দীপু ছোকড়া কি তোমার পেছনে ঘুরঘুর করে?’
‘না তো!’
উর্মিলা বুঝতে পারে দীপু ভাইকে জাকির সাহেব পছন্দ করে না।

‘সমস্যা নেই স্যার। আমার বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তার পূর্বপুরুষরা সাপের ওঝা ছিলেন। সাপের বিষ নামাতো। আমিও সেই বিদ্যেটা শিখেছি। সমস্যা করলে গোখরা দিয়ে কামড়ে দেব।’ শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে উর্মিলা।
জাকির সাহেব অনেকটা হতভম্ব হয়ে উর্মিলার দিকে তাকায়। পা থেকে চুল পর্যন্ত ভালো করে দেখে। ভয়ঙ্কর, অশুভ চোখ নিয়ে উর্মিলা তাকিয়ে আছে। জাকির সাহেব অস্বস্তি ফিল করে।
‘ঠিক আছে। তুমি যাও।’
কিছু না বলে উর্মিলা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। (চলবে)

দহন

দহন



দহন
আব্দুল্লাহ আল তানিম

আমার শাহানাজ আপু দেখতে যতটা সুন্দরী না কিন্তু তার চোখ দু’টো অসম্ভব সুন্দর। যতটুকু জানি চোখে কাজল দিলে নাকি মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে কিন্তু আমার আপু তাও দিতো না তবুও তার চোখ কেনো এতো সুন্দর। হয়তো এই চোখ দেখেই আবির ভাইয়া আপুকে ভালবেসেছিলো।  ভালবাসতো বললে ভুল হবে আজও ভালবাসে।

আপু আর আবির ভাইয়ার পরিচয় হয় মেডিকেলে।
আপু তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলো।  আপু সবসময় আব্বুর সাথে কলেজ যেত এবং আসতো । কারন আমার আপু ছিলো প্রচ- রকমের ভীতু একটা মেয়ে। সেদিন আপু একাই কলেজে যেতে বাধ্য হয় কারণ কলেজ বেতন এবং অন্যান্য যাবতীয় খরচ আজ শেষ তারিখ ছিলো। আর আব্বু বাসায় নেই বলে আপুকে একাই যেতে হলো।

যাওয়ার পথে আপু দেখলো একটা রিক্সা এক্সিডেন্ট হয় আপু গাড়ি থেকে নেমে এসে দেখে আব্বুর বয়সের একজন লোক আহত অবস্থায় পড়ে আছে। কেউ ধরছে ও না সবাই দাড়িয়ে দেখতে লাগলো কিন্তু আপু ওই লোকটার পকেট চেক করে একটা আইডি কার্ড বের করলো। উনি একজন ব্যাংক কমর্কতা ছিলেন।  আপু তখনি ওই লোকটিকে সিএনজিতে তুলে দিতে বললে কয়েকজন এসে তুলে দেয়। আপু তার পরিচিত একটা মেডিকেল নিয়ে যায়।

মেডিকেল নিয়ে গেলে ডাক্তার রোগীর সাথে তার সম্পর্ক জানতে চাইলে সে তার ডাক্তার বলে পরিচয় দেয়। ডাক্তার তাকে কিছু ফরম্যালিটি কাজ করতে দেয়। সে আইডি কার্ড থেকে নাম বয়স ঠিক করে লিখে দেয়। ভাগ্য ভালো তার কাছে টাকা একটু বেশি ছিলো।  ঐ যে কলেজ বাবদ খরচের টাকাগুলো। এমন সময় তার পরিচিত ডাক্তার খালা এসে বলে শাহানাজ তুমি এখানে তখন সে সব বললো ডাক্তার খালাকে। খালা বললেন উনার বাসায় কল করো। তখন তার পকেট থেকে মোবাইল যেটা পায় ওটা থেকে কল লিস্টে যার নাম্বার আগে ছিলো তাকেই কল দিলো।

শাহানাজ আপু কল দিয়ে সালাম দেয় আর ওপাশ থেকে একটা ছেলের কথা শুনা গেলো সে যানতে চাইলো কে আপনি ? আমার আব্বুর মোবাইল আপনার কাছে কেন ?? শাহানাজ আপু  তখন সব ঘটনা জানায়।

আপু মোবাইল ব্যবহার করতো না বিদায় বাসা থেকে কোন কল আসেনি তাই কিছু জানতে পারেনি।  অবশেষে ঐ লোকটির বাসার সবাই আসে তারা শাহানাজ আপুকে অনেক ধন্যবাদ জানায়। উনার জ্ঞান আসলো। তখন উনি কথা বলতে পারেননি বিধায় কোন কথা হয়নি আপুর সাথে। আপু চলে আসার পর শাহেদ সাহেব এর ডাক্তার এসে বলে আপনার  ভাইয়ের মেয়েটা কই ? ওহ বলা হলো না যিনি এক্সিডেন্ট করেছিলেন উনার নাম শাহেদ। তখন শাহেদ সাহেবের বড় ছেলে আবির বলে, উনি তো চলে গেছে কেনো ?? আর সে আমাদের রিলেটিভ না আমার বাবার জন্য মিথ্যা বলেছিলো তাই দয়া করে কিছু মনে করবেনা না।

ডাক্তার তখন বলে আজকাল নিজের সন্তান এতোটা করেনা যতটা এই মেয়ে করলো সে উনার জন্য তার কলেজ বেতন দিয়ে এডমিট করালো। তার টাকা গুলোও তো দেওয়া হলো না। জানিনা মেয়েটার কি হবে আজ। আবির এডমিট ফরম থেকে জানতে পারে তার নাম শাহানাজ। আবির তার বাবাকে ২ দিন পর বাসায় নিয়ে আসে। শাহেদ সাহেব এখন অনেক সুস্থ।  শাহানাজ আপু এরপর মেডিকেলে এসে আবার খোঁজ নেয় কিন্তু ডাক্তার বললো উনারা তো চলে  গেছেন।  তখন এটা শুনে আপুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

শাহানাজ তার পরিবারকে সব জানায় তার মা কিছু না বললেও বাবা খুব খুশি হয় মেয়ের কথা শুনে। শাহেদ সাহেব এখন পুরোপুরি সুস্থ। উনি এখন সবার সাথে শাহানাজকে নিয়েই কথা বলেন। পরিবার সবাই বলে, কই পাবে তাকে খুঁজে, আমরা তো তার মুখ ও দেখিনি মুখ হিজাব ছিলো তার চোখ ছাড়া কিছু দেখলাম না,  ঠিকানাও জানিনা। শাহেদ সাহেব তার বড় ছেলেকে ডেকে বলে বাবা তুমি কি শাহানাজ মুখ দেখছিলে? সে না সূচক জানালো । তবে সে বললো বাবা আমি খুঁজে বের করবোই তাকে কথা দিলাম।

তার মা রেহানা বেগম বলে, কি ভাবে ?? তখন আবিরের ছোট ভাই বলে, মা ভাইয়া পারবেই। কেননা ভাইয়ার রুমে আর্ট করা সেই আপুটির চোখ। আবির বলে, তুই চুপ করবি, রেহানা বেগম কিছু বলার আগেই আবির চলে যায়। রুমে এসে তার আঁকা চোখ আর তার সেদিন দেখা চোখ গুলো সত্যিই এক হলো কি ? আবির নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কত মেয়েকে কলেজ লাইফ দেখলাম এখন ভার্সিটিতেও দেখি কিন্তু এই চোখ কখনো দেখেনি। সে বলে কারো চোখে এতো মায়া কিভাবে থাকে আর এতটা সুন্দর তাও কাজল ছাড়া। টানা টানা চোখ এক কথায় মায়াবী কন্যা আবির শাহানাজের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরের দিন থেকেই আবির সেই এক্সিডেন্টের জায়গায় গিয়ে তাকে খুঁজতো, তার ধারনা সে তো এই রোড দিয়ে কলেজ যায় একদিন না একদিন ঠিক পাবে। এই ভাবে  আবির ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহ ৬ দিন ওই রোডে যেতো।  কিন্তু সে কি জানতো না শাহানাজ কলেজে যাওয়া জন্য অন্য রাস্তাও আছে যে রাস্তায় সে সবসময় যায়। এভাবে কেটে গেলো ২ বছর। শাহানাজ এখন অনার্স প্রথম বর্ষে  আর আবির এম বিবি এ পড়ছে।  আবির আজও আসে পাশের সেই রাস্তা গুলোর মাঝে খুঁজে তার মায়াবী কন্যাকে আর শাহেদ সাহেব ও মাঝে মধ্যে এই রাস্তায় আসেন তার না ডাকা মা মনির খুঁজে।
শাহানাজ আগের থেকে একটু পালটালো সে এখন বান্ধবীদের সাথে কলেজ যায় আর সে এখন মুখ বাঁধে না কারণ তার সমস্যা হয় ডাক্তার বারণ করেছে।  মাঝে মাঝে ক্লাস শেষ করে ফুচকা খেতে যায়।  আজ শাহানাজের জন্মদিন তাই বন্ধুরা মিলে সবাই খেতে গেলো তার প্রিয় রেস্টুরেন্ট-এ।

খাওয়া দাওয়া শেষে বান্ধবীরা মিলে খোলামেলা জায়গায় বসে আছে।  তাদের পাশের টেবিলে কয়টা ছেলে ফুচকা খাচ্চে আর একটি ছেলে বার বার শাহানাজ আপুর দিকে তাকাচ্ছে আবার চোখ সরিয়ে ফেলছে। এটা শাহানাজ আপুর বান্ধবী আরিতা খেয়াল করলো। সে শাহানাজ আপুকে বললো পিছনের একটা ছেলে বারবার তোর দিকে তাকাচ্ছে। শাহানাজ আপু আর তার বান্ধবীরা চলে যায় আর তার পিছু নেয় ঐ ছেলেটা। শাহানাজ আপু একবার তাকালো ওর দিকে আর সে চিন্তা করতে লাগলো খুব চেনা চেনা লাগছে ছেলেটিকে। কিন্তু কে হতে পারে হয়তো তার ভুল হচ্ছে কোথাও।

সব বান্ধবীরা যার যার পথে রওনা দিলে শুধু আরিতা আর শাহানাজ আপু রয়েগেলো, তারা আইসক্রিম খেতে বসলো একটা দোকানে। তারা দেখলো সেই ছেলেটি এখানেও আসলো । আরিতা বললো, দেখ ওই ছেলেকে প্রশ্ন করি কেন তোকে ফলো করছে।  তারা কিছু বলার আগেই ছেলেটি এসে মানে আবির এসেই বলে শাহানাজ আপুকে আপনি  হিজাব দিয়ে মুখটা বাধুন তো।  আরিতা আর শাহানাজ কথা শুনে অবাক হলো । সে আবির কে বলে, আপনি কে ? আমার পিছু কেনো নিচ্ছেন আর আপনার কথা কেন শুনবো আমি ? আবির খুব মিনতি করার পর শাহানাজ আপু রাজি হলো। সে মুখ হিজাব করলো, আবির কিছুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর বললো আপনি শাহানাজ ?

শাহানাজ বলে হ্যাঁ,  আমি-ই শাহানাজ আপনি কে ?? তখন আবির তার নাম বললো এবং পরিচয় দিলো।  শাহানাজ আবির কে চিনতে পেরে তার পরিবারের কথা জানতে চাইলো। তাদের মধ্যে অনেক কথা হলো।  কথা শেষ করে আবির শাহানাজ আপুর ফোন নম্বরটা চেয়ে নিলো, তারপর বিদায় নিলো।

যখন আপু রাতে ঘুমাতে যাবে তখন আবির কল দেয়।  তাদের মধ্যে পড়ালেখা, পছন্দ-অপছন্দ সব কিছু নিয়ে কথাবার্তা হয়। অবশেষে ভালবাসার মানুষ নিয়ে কথা হলে শাহানাজ জানায় তার এসব পছন্দ না আর আবির জানায় একজনকে সে খুব ভালবাসে আজ ৩ বছর ধরে কিন্তু এখনো বলা হয়নি ঐ মানুষটাকে।  অনেকক্ষণ কথা বলার পর আবির শুভ রাত্রি বলে ফোনটা রেখে দেয়।

পরের দিন শাহানাজ তার মাকে জানায় যে আজ সে তার নতুন ঐ নতুন আঙ্কেল এর বাসায় যাবে দেখা করতে।  তাই তাকে আবির কলেজ থেকে রিসিভ করে। শাহেদ সাহেব ওকে দেখে এতটা খুশি হলো তা বলে বুঝানো যাবে না। সবাই তাকে অনেক ধন্যবাদ দেয়। আবিরের ছোট ভাই রাকিব বলে, আপু আপনার জন্য দেবদাস ২ বছর বাস-টার্মিনাল ঘুরছে, অবশেষে খুঁজে পেলো তার মায়াবী কন্যাকে। আবির রাকিব কে বললো, তুই চুপ করবি। শাহানাজ আপু খুব বেশি লজ্জা পেলো। তারপর সবাই মিলে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। আবির বলে কাল তোমার জন্মদিন ছিলো রাতে বলেছিলে। আজ আমরা সবাই একসাথে আছি তাই আজ শুভেচ্ছা জানালাম।

আবিরের মা খাবার আনলেন টেবিলে, শাহানাজ আপু লক্ষ করলো টেবিলে রাখা খাবারগুলো তার পছন্দের খাবার। সে বুঝে ফেললো কাল রাতে কথার মাঝে পছন্দের খাবারগুলো আবির সব কেন জেনে নিয়েছিলো। খাবার শেষে আবিরের ছোট ভাই শাহানাজকে বলে, আপু আবির ভাইয়ার রুমে যাবো আসুন। তারা গেলো। রাকিব আবিরের আঁকা সে চোখের ছবি দেখালো। আর তার ভাই আবির দুই বছর ধরে কেন খুঁজছিলো সব বলে দিলো শাহানাজ আপুকে। আবির তার ডায়েরীর পাতায় শুধু শাহানাজকে নিয়েই লিখছিলো। রাকিব আবিরের ডায়েরীটা আপুর হাতে দিলো। আপু পড়ে নিলো ডায়েরীটা। তারপর আবির চলে আসে রুমে। এসে দেখে রাকিব আর শাহানাজ দুজনে চুপ হয়ে বসে আছে। আবির বুঝতে পারেনি এতক্ষণ কি হয়েছিলো এ রুমে।

শাহানাজ বুঝতে পারে ওই পরিবারটা তাকে খুব ভালবাসে। আপু আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে তার  মনের ভাষা বুঝতে পারে। আবির সবসময় শাহানাজ আপুর খোঁজ নেয় কিন্তু শাহানাজ কখনো একটি বারও নিজ থেকে খোঁজ দেয় না। দুপরিবারে অনেকটা সুখের মিল ছিলো।  কিন্তু আবির ও তার পরিবার একটি কথা জানে না তা হলো শাহানাজ এ পৃথিবীতে মাত্র কিছুদিনের অতিথি । তার থ্যালাসেমিয়া নামক একটি কঠিন অসুখ। আর তার মাথায় টিউমার আছে যা ভালো হওয়ার উপায় নেই বললেই চলে।

শাহানাজ তার পরিবারকে বাসা পাল্টাতে বলে আর সে কলেজও বদলে ফেলে এমন কি আবিরের পরিবার যেনো তাকে খুঁজে না পায় কারন আবির নামক ছেলেটি তার ভাবনার মাঝে মিশে যাচ্ছে... তাই সে চায় না তার সাথে আরেকটি জীবনকে জড়াতে। বাসা ছেড়ে চলে যায় তারা নতুন এলাকায় নতুন জায়গায়  মোবাইল সিম হতে সব কিছু বদলে ফেলে। অন্য দিকে আবির আর তার পরিবার খুঁজতে থাকে আগের মতই আবারো।  নীড় খোঁজের মাঝে চলে যায় পাঁচটি বছর।

এখন শাহানাজ পড়ালেখা করেনা। সে এখন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। হঠাৎ তার ইচ্ছে হলো পুরানো সেই রেস্টুরেন্ট যেতে আর পথ শিশুদের সাথে সময় কাটাতে। তাই তার মা তার বান্ধবী আরিতাকে কল করে। সে এসে নিয়ে যায় সাথে ছোট বোন শিফাও যায় সে একা একা বসে রইলো সেই নিরিবিলি জায়গাটিতে। হঠাৎ একজন তার পাশে বসে বলে উঠলো লুকাতে তো খুব ভালো পারো তা পেরেছো কি ? নাকি ভালবাসার মানুষ হিসেবে আমি খুব খারাপ নাকি আমার পরিবার খারাপ যে এত কষ্ট দিয়ে গেলে। জানো মা বেঁচে নেই তবে তার ছেলের বউয়ের জন্য সব পছন্দের জিনিস রেখে গেছে , চুপ কেনো ? কথা আসে না নাকি বোবা হয়ে গেলে ?

শাহানাজ আবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আর ভাবলো যে ছেলেটি এতটা স্মার্ট ছিলো কি স্টাইল ছিলো চুলের। আর আজ তাকে দেখতে দেবদাস ছবির হিরো কে হার মানালো। কতশত ভাবনা ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে পানি চলে এলো। চোখের জল মুছে সে আবির কে বলে, কেমন আছেন? আর আন্টির কি হয়েছিলো তখন আবির জানায়, উনি স্ট্রোক করেন আর সেইদিন ই যেদিন থেকে তোমরা বাসা ছেড়ে চলে গেছো... তখন বেঁচে গেলে পরের দিন মা একটা কাগজে লিখে রাখে বউ মাকে পেলে আমার এই গয়নাটা দিবি আবির ? শোন, শাহানাজকে ছাড়া তুই কাউকে বিয়ে করবিনা। আর রাকিব তোর ভাবিকে না আনার আগেই তুই বিয়ে করলে তোর খবর আছে। দেখিস একদিন তাকে খুঁজে পাবি। আর তোদের বাবার খেয়াল রাখিস। এই ছিলো মায়ের কথা আর তার কিছু সময় পর মা না ফেরার দেশে চলে যান।  তাই রাকিব তার মায়াবী ভাবি আর বাবা তার মা-মনি কে খোঁজে আর আমি ?? আমার কি অপরাধ ছিলো তা জানার জন্য মানুষটাকে খুঁজি।

আচ্ছা, কেমন আছো বলো তারপর আমার উত্তর জানতে চাইবো। শাহানাজ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে বলে, আমি ভালো আছি তবে আমি কোন উত্তর দিতে পারবো না। এটা বলে উঠে যেতে চাইলে আবির তার হাত ধরে এই প্রথম। প্রথমবারের মতো হাতে হাত রাখা শাহানাজ আপুর খুব ইচ্ছা করছে আবিরের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতে কিন্তু না সে পারবে না। কেননা তার ভাগ্যটা এতটা ভালো না।

আবির বলে উঠে আজ আমার কথা শুনতে হবেই আর সব প্রশ্নের জবাব চাই। বলো কি দোষ ছিলো আমার আর আমার মা-বাবার ছোট্ট চাওয়াতে যে তুমি না বলে চলে গেলে, হারিয়ে গেলে। কি অপরাধ ছিলো আমার পবিত্র ভালবাসাতে বলো ?? এমন সময় শাহানাজ আপুর বোন আর বান্ধবী এসে বলে ওর হাত ছেড়ে দিন ওকে এখন যেতে হবে । আপনি আবির সাহেব তাই না ?? আবির ভাইয়া আপুর হাত ছেড়ে দেন.. আপু হয়তো ব্যথা পাচ্ছে খুব। আবির বলে, ও ব্যাথা পাচ্ছে ঠিক কিন্তু ওর চেয়ে বেশি ব্যাথা আমি পাচ্ছি তার চুপ করে থাকাতে।

কিছুক্ষণ পর শাহানাজ নিচে পরে যায়। আবির তাকিয়ে রইলো আর সে পাগলের মতো কান্না করতে করতে বললো, শাহানাজ আমার আচরনে কষ্ট পেলে ক্ষমা করে দাও। চোখ খুলো কি হয়েছে তোমার ?? শিফা আর আরিতা দুজনে বলে, এজন্যই বলছিলাম আমরা আপুর হাতটা ছেড়ে দিতে। আপুর হাতে ওর মেডিসিন আর ইনজেকশনের সময় পার হয়ে যাচ্ছিলো। আবির ওদের কথা কিছু বুঝতে পারছে না। কি বলে এরা। শাহানাজ আপুকে তারা গাড়িতে তুলে মেডিকেল নিয়ে যায়।  ডাক্তার বলে, ওর আজ আবার এই অবস্থা ?? শিফা তুমি কি ইনজেকশন আর মেডিসিন খাওয়ানি ?? আবির ডাক্তারকে বলে, কি হয়েছে শাহানাজের ?? আমাকে বলুনতো। কিন্তু শিফা ডাক্তারকে বারন করাতে ডাক্তার কিছু বলেন নি। তারপর আবির আবার শিফাকে বলে, ওর কি হয়েছে বলো ?? শিফা কিছু না বলে তাদের বাসায় নিয়ে যায় আবিরকে আর হাতে একটা ডায়েরী দেয়।

আবির ডায়েরীটা পড়তে থাকে। ডায়েরীর মাঝ পৃষ্ঠায় কিছু লেখা পায় তা হলো এমনঃ
‘০৩/০৭/.... আজ বার বার এক জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। চোখ গুলোর মাঝে অদ্ভুত একটা নেশা ছিলো। খুব ইচ্ছে করছিলো তার চোখের মাঝে নিজেকে হারাতে। কিন্তু আমার মতো মেয়ের স্বপ্ন দেখতে নেই, ইত্যাদি। তারপর অন্য একটা পৃষ্টায় লেখা ছিলো আজ আবিরদের পরিবারের সাথে দেখা হয়ে বুঝলাম এমন পরিবার পাওয়ার জন্য সবাই স্বপ্ন দেখে। আমি জানি আমি পেতে যাচ্ছি  কিন্তু আমার পক্ষে তো সম্ভব না। আরও একটা পৃষ্টায় লেখা ছিলো আজ আমার ভালবাসার মানুষটিকে না বলা কথাগুলো রেখেই বিদায় নিচ্ছি। আমি তাকে বলতে পারছিনা কেনো চলে যাচ্ছি। আমি চাই সে খুব ভালো থাকুক আর সবসময় সুখে থাকুক। তাই তো তাকে নিজের বাঁধনে বাঁধতে চাই না আমি।

শাহানাজ আপু এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কিছুদিন পর খুব অসুস্থ হয়ে পরে। মেডিকেলে নিয়ে গেলে ডাক্তার জানায় তার থ্যালাসেমিয়া আর মাথায় টিউমার হয়েছে, যা তার সুখের দিন গুলোর পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন থেকে সে হাসিখুশির মাঝে নিজেকে রাখে। সে সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতো। কেউ জানতো না যে সে আর মাত্র কিছুদিনের অতিথি।  এর মাঝে এই তো আবির আসলো তার জীবনে আলোর প্রদীপ হয়ে। কিন্তু আপু জানতো তার আলো নয় অন্ধকার তাই আমার মনের খাঁচা থেকে তাকে মুক্ত করে দিলো। আপু জানে সময়ের সাথে সে হারিয়ে যাবে। আবির চাইলেও পাবে না খুঁজে, ভুলে ও যাবে হয়তো। হয়তো ভালোবাসি কথাটি কখনো আবির কে বলা হবে না।

আবির ডায়রিটা আর পড়তে পারছেনা তার চোখ দুটো ছল ছল করছে কিছু লোনা পানি জমে। সে মেডিকেল গিয়ে শাহানাজের রুমে গেলো। তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শাহানাজ চোখ মেলে তাকালো, ওর চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে পানি তার গাল বেয়ে পড়তে থাকে।  আবির বললো, আমার মায়াবী কন্যা আজ থেকে আর তার চোখের পানি ফেলবে না। ভালোবাসি কথাটি বলা হয়নি তবুও আমি তোমাকে ভালোবাসি আর বাসবো।  আমার বিয়ে পরশু আর তোমাকে আসতেই হবে। শাহানাজ বলে সত্যি তুমি বিয়ে করবে ?? আবির বলে হ্যাঁ পরশু করবো কাল তুমি মেডিকেল থেকে ঘরে যাচ্ছো তাই কাল নয় তবে পরশু বিয়ে করবোই।

আজ আবিরের বিয়ে সে শাহানাজের জন্য শাড়ী নিয়ে আসে তাদের বাড়িতে। শাহানাজ এখন কিছুটা সুস্থ। শাহানাজ আজ বউ সাজবে,  শিফা শাহানাজ কে শাড়ি পড়ায়।  আজ আবির শাহানাজের চোখে কাজল দেয়, কপালে টিপ আর চুলে খোপা আর সে খোপায় পড়িয়ে দেয় লাল গোলাপ। আবির নিজে সাজিয়ে শাহানাজ কে আয়নার সামনে নিয়ে বলে আমার বউকে কেমন লাগছে বলো তো ?? শাহানাজ চোখ খুলে দেখে সত্যি আজ তাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বিয়ের সাজে অবশ্য সব মেয়েকেই সুন্দর লাগে।

আবির আর শাহানাজের বিয়ে হয় খুব ধুমধাম করেই। আবির আর শাহানাজ এর আজ বাসর রাত।  শাহানাজ বসে আছে হাজারো ফুলের মাঝে এই রাতটি তার জীবনে আসবে সে ভাবেনি কখনো। আবির রুমে আসলো এসে শাহানাজ কে বলে, উঠো আর অজু করে আসো দু-রাকাত নফল নামাজ পরে নিলো দুজনে।  আবির কে সালাম করে নিলো শাহানাজ। আবির বলে, কি চাও বলো তো আজ তুমি যা চাইবে আমি তা দিবো। শাহানাজ বলে আমি চাই আমার যেটুকু সময় আছে তার মাঝে আমি তোমার সব সময়ের সাথী হতে। আর চাই আমার মৃত্যুর পর তুমি আবার খুব ধুম ধাম করে বিয়ে করে নিবে আর তোমার সেই বউকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবেসে তোমার বুকের মাঝে রাখবে।

আবির তাকে কিছু না বলে চুপ থাকে। শাহানাজ জেদি মেয়ে, শাহানাজ তাই তাকে হ্যাঁ বলাতে বাধ্য করে। আবির শাহানাজের সব সময় কেয়ার নেয় নিয়মিত ঔষধ খাইয়ে দেয়। রাকিব আর শাহেদ সাহেব শাহানাজ কে পেয়ে খুব খুশি তারা ও তার যতœ নেয়। কোথায় সে নিবে সবার খেয়াল আর উল্টো ওরা নিচ্ছে। শাহানাজ নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে, সে তার ডায়রিতে আজ ও লিখলো পৃথিবীর সব সুখ সে পেয়ে গেলো মা শব্দটি শোনা ছাড়া। এতদিনে হয়তো সে মা হয়ে যেতো কিন্তু সে চায়না সে চলে যাওয়ার সময় কিছু রেখে যাক আবিরের কাছে। কারণ, সে আবিরকে বলেছে নতুন বিয়ে করে সুখে থাকবে। সে তার নতুন সংসার সাজাবে। আবির একদিন দেখে শাহানাজ বাচ্চা না হওয়ার জন্য মেডিসিন খাচ্ছে। তখন জানতে চায় কেন সে এমন করলো ??  আবিরের বুঝতে বাকি রইলো না যে কেন শাহানাজ এমন করলো। সে হয়তো তার বাচ্চা কে অন্য কারোর উপর ভরসা করে দিতে চায়না। আবির তখনি শাহানাজ কে ওয়াদা করায়, সে যেন আর না খায় এই মেডিসিনগুলো।

দু-মাস পর শাহানাজ প্যাগনেন্ট হয়।  আবির খুব খুশি হয় সেটা জেনে। সে শাহানাজ কে আরও বেশি যতœ করতে লাগলো। তার মাঝে মাঝে ব্যথা ওঠে কিন্তু সে এতো খুশির মাঝে ভুলে গেলো যে তার আয়ু কমে আসছে।  খুব কষ্ট হয়েছিলো তবু এর চেয়ে কষ্ট হলো তাদেরকে ছেড়ে যেতে হবে।  কয়েক মাস পর তার একটি মেয়ে হয়, তার নাম রাখা হয় হিমু জাহান আলো। সে আলোর মতো আলোকিত ছিলো।

খুব সুখের মধ্যে দিয়ে শাহানাজের শেষ বিদায়ের দিন গুলো আসলো।  মেডিকেলে শুয়ে আছে পাশে আবির ও তার মেয়ে হিমু। শাহানাজ পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো এক এক করে, সবাই যেন পাথর হয়ে রইলো। আবির তার কপালে আলতো ভাবে চুমো দিয়ে বলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি ?? তোমার কি আমার জন্য কষ্ট হয়না ?? আমাকে একা রেখে আমার হাত ছেড়ে দিবে ??  তুমি তোমার মেয়ে হিমু কে ছেড়ে চলে যাবে ?? যাওয়ার কথা বললে বাবা মেয়ে আড়ি দিবো দুজনে কথা বলবো না তোমার সাথে। আবিরের কথা শুনে শাহানাজ আর চুপ রইলো না তার কান্না আর রাখতে পারলো না। সে আবির কে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার হিমুকে নতুন মা এনে দিবে তো কথা দাও ?? আর আমাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরো। তোমার বুকের মাঝে আমাকে আগলে রাখো। এই আমাকে একটি বার বউ বলে ডাকো, যেমনি সবসময় ডাকতে।

আবির তার প্রাণের প্রিয়সখী কে বউ বলে ডাকলো। তার কিছু সময় পর শাহানাজ শেষ নিঃশ্বাস নিয়ে পৃথিবী  ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলো। আবির বার বার মৃত দেহটাকে জড়িয়ে ধরছে আর বলছে, বউ এই বউ বৃষ্টিতে ভিজবে না তুমি ?? আসো বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে আজ ওরাও তোমাকে তাদের মাঝে মিশাতে চায়। তারপর আবির তার মেয়েকে বুকে নিয়ে বসে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করে তার কোন শব্দ নেই, শিফা আর রাকিব আবির কে ধরে উঠাতে গেলে আর উঠেনি। রাকিব আর শিফা তাকে ধরে তারা বুঝতে পারে আবির আর নেই। শিফা আর রাকিব আর নিজেদের কে কেউ সামলাতে পারলো না। এক সাথে দু দুটো মৃত্যু, ভালবাসার টানে দুজনে চলে গেলে।

আবিরের রুমে আজ সবাই বসে আছে শিফার কোলে হিমু। তখন আরিতা এসে ২ টা ডায়রি দিয়ে যায় ওকে আবির দিয়েছিলো হিমু হওয়ার দুদিন পর ...
ডায়রিতে লেখা ছিলোঃ-
প্রিয়তমেষু তোমার সব চাওয়া পূরণ করতে পারবো কিন্তু এই একটি চাওয়া বাদে তুমি বাসর রাতে বলেছিলে তুমি না থাকলে আরেকটি জীবন কে জড়াতে কিন্তু আমি পারবো না। হিমি হওয়ার পর বলতে ওর জন্য একটা নতুন মা আনতাম আমি হয়তো মা আনতে পারবো না তবে আমি তাকে আমার সবটুকু দিয়ে ভালবাসবো। আর জানো আমি ওর জন্য মা নয় চাচী আম্মু আনবো। তোমাকে তা সারপ্রাইজ দিবো তোমার জন্মদিনে।  তাকে তারা পৃথিবীর সব সুখ দিলো সবার ভালবাসায় বড় হলো আবির আর শাহানাজের ভালবাসার ফসল।

কি মা-মনি তোমার বাবা মায়ের গল্প শুনলে তো তুমি। বলেছিলাম তোমার ১৮তম জন্মদিনে শুনাবো।  শিফা খেয়াল করলো তার আদুরেরর হিমুর চোখে জল চল চল করছে। হিমু রাকিব আর শিপাকে জরিয়ে দরে বললো ভালবাসি তোমাদেরকে  অনেক বেশি ভালোবাসি। ’

ভালোবাসার মানুষ, সেই প্রথম দিনের চুম্বন, সেই প্রথম দিনের উষ্ণ আলিঙ্গন সব কিছুই হেরে গেল মৃত্যুর কাছে।

মানুষের জন্ম হয়, মৃত্যু হয়।  ভালোবাসার জন্ম হয়, মৃত্যুও হয়। সব স্বঁপ্ন পূরণ হয় না। সব স্বঁপ্ন পূরণ হতে নেই। 

আধুনিকতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

আধুনিকতায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর


আধুনিকতায়
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

মনোজিৎ কুমার দাস

ঊনিশ শতকের যুগসন্ধিক্ষণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের( ১৮২০- ১৮৯১) আবির্ভাব। ঊনিশ শতকের নবযুগের উদ্গতা ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলবন্ধনে সমাজ সংস্কারের পুরোধা তিনি। বাঙালি হিন্দু সমাজের বিবিধ বিধিবিধানের সংস্কারকর্মে  নিবেদিতপ্রাণ ঈশ্বরচন্দ্রের শিক্ষা ও কর্মজীবনের প্রতি আলোকপাত করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় তিনি কোন আঙ্গিকে তৎকালীন সমাজকে অন্ধকার বৃত্ত থেকে আলোকে নিয়ে আসবার সাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী। প্রাথমিক শিক্ষারম্ভ গ্রামের পাঠশালায়। ১৯২৮ সালে তিনি পিতার সঙ্গে পায়ে হেঁটে কলকাতায় আসেন এবং পরের বছর ১ জুন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। গ্রামের টোল খোলার উদ্দেশে ঠাকুরদাস ছেলেকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজে শিক্ষার্জন ছিল ঠাকুরদাসের কাজে সম্মানের বিষয়। কিন্তু যে ছেলে বাবার সঙ্গে কলকাতায় আসবার সময় পথের ধারের মাইল ফলক দেখে ইংরেজি সংখ্যা শিখে ফেলেন, তাকে কি টোলের ক্ষুদ্র গ-িতে আটকে রাখা যায়?  ঈশ্বরচন্দ্র একাধিকক্রমে ১২ বছর কাব্য, ব্যাকরণ, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায়, জ্যোতিষ প্রভৃতি পাঠ করে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হন। শুধু তাই নয়, ১৮৩৯ সালে হিন্দু ল’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। ১৮৪১ সালে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেডপ-িতের চাকরি পান। ওখানে তিনি ইংরেজি ও হিন্দি শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন।
কলকাতার বৃহত্তর পরিম-লে এসে তিনি দুটি বিবাদমান ভাবের সঙ্গে পরিচিত হলেন- একদিকে পাশ্চাত্য ভাবধারা গ্রহণে যুবসমাজের মধ্যে আকাঙ্খা, অন্যদিকে সতীদাহ ও অন্যান্য সামাজিক কুসংস্কারের প্রতি মোহ। পাশ্চাত্যের হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে বাংলার তরুণসমাজ আলোড়িত, বিভ্রান্তও খানিকটা। এক শ্রেণির তরুণদের মনে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হল যে,  পাশ্চাত্যের অনুসরণ ও অনুকরণই আধুনিকতা। এই পরিবেশের মধ্যে থেকেও ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দু ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা তাঁকে ভারতীয় ঐতিহ্যে উজ্জীবিত করেছিল। পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি কলকাতার বিদ্বৎসমাজে যাতায়াত করে হয়ে ওঠেন যুগোপযোগী এক মহান চরিত্রের অধিকারী। সে সময় কলকাতার বাঙালি তরুণ সমাজ ও প্রাচীনপন্থীদের মধ্যে চলছিল এক ধরনের টানাপোড়েন। এক দিকে, ডিরোজিও’র ভাবধারায় ¯œাত ইয়ংবেঙ্গলদের কালপাহাড়ি মনোভাব, অন্য দিকে, প্রবীণদের প্রাচীন সংস্কার আঁকড়ে থাকার আত্মঘাতী প্রয়াস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবস্থান ছিল এই দুইয়ের মাঝখানে। হিন্দু ঐতিহ্যের মধ্যে তিনি আধুনিকতার সন্ধানী ছিলেন।
এক পর্যায়ে ডিরোজিও’র চিন্তাধারায় প্রভাবিত রামগোপাল ঘোষ, হরচন্দ্র ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখ্যোপাধ্যায়, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের সখ্যতা গড়ে ওঠে। সে সময়  কলকাতার পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবধারায় বিভিন্ন সভাসমিতি গড়ে উঠতে থাকে। ডেভিড হেয়ারের স্মরণ সভায় বিদ্যাসাগরের চিন্তাধারার প্রথম স্ফুরণ দেখা যায়। তাঁর চরিত্রে পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের তেজোময় নির্ভীক ঋজুস্বভাব পরিলক্ষিত হয়। পুরুষকারে বলীয়ান ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দুধর্মের কুসংস্কারসমূহ বর্জন করে  পশ্চিমাসভ্যতার ভাল দিকগুলো গ্রহণে ব্রতী হলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সংমিশ্রণে নতুন পথের সন্ধানেও সচেষ্ট হলেন।  একথার স্বীকৃতি মেলে রবীন্দ্রনাথের কথা থেকে---- ‘ ঈশ্বরচন্দ্র পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য বিদ্যার মধ্যে সম্মিলনের সেতুস্বরূপ হয়েছিলেন। ’
সংস্কৃত ও হিন্দুধর্মের নানা শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্য লাভ করেও  ঈশ্বরচন্দ্র ইংরেজি ভাষায় পা-িত্য অর্জন করতে পিছিয়ে থাাকেননি। ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিলে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহ -সম্পাদক  হন কিন্তু কলেজের সংস্কার প্রস্তাব অগ্রাহ্য হবে এই শর্তে তিনি ১৮৫০ সালে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য-- অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৫১ সালের ২২ জানুয়ারি কলেজের নবসৃষ্ট অধ্যক্ষের পদে তিনি নিযুক্তি লাভ করেন। তিনি অচিরেই কলেজের পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচীতে পরিবর্তন আনেন। তিনি অচিরেই কলেজের সব বিভাগের সংস্কার সাধনে প্রবৃত্ত হন। কলেজের বিরতি দিবস পরিবর্তন, মাহিনা প্রবর্তন,পাঠ্যক্রম সংস্কার, মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের পরিবর্তে সহজবোধ্য নতুন ব্যাকরণ তৈরি, গণিতে ইংরেজির ব্যবহার, দর্শনে পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি এবং অব্রাহ্মণের প্রবেশাধিকার প্রভৃতি তাঁর সংস্কারের উদাহরণ। তাঁর আধুনিক মন পাশ্চাত্য ভাবধারার ভাল দিকগুলো গ্রহণে দ্ধিধা করেনি। তিনি জানতেন , বিদ্যার মধ্যে পূর্ব-- পশ্চিমের বিরোধ নেই। তিনি নিজে সংস্কৃতশাস্ত্রে মহাপ-িত হয়েও ইউরোপীয় বিদ্যার অভিমুখে ছাত্রদের অগ্রসর করতে উদ্যোগী হন।
সে --সময় শিশুশিক্ষার উপযোগী পাঠ্যবই, শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষকের অভাব ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র এ সকল বিষয়ে ভাবিত হন। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের আগে হাতে লেখা পুঁথির মাধ্যমে এদশের শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হত। ছাপাখানা স্থাপিত হবার পরও  শিশুদের পাঠ্যবই ছাপার ব্যবস্থা করা হয়নি। ছাপা বই পড়লে জাত যাবে এমন একটা ধারণা সে যুগের লোকদের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। এক পর্যায়ে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। এখান থেকে প্রকাশিত পাঠ্যবই সোসাইটি পরিচালিত পাঠশালা  এবং খ্রিষ্টান মিশনারি সোসাইটির পাঠশালাগুলোতে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়। শ্রীরামপুর মিশনারিরা শিশুদের উপযোগী কয়েকটি পাঠ্যবই প্রকাশ করে। হিন্দু কলেজের সঙ্গে স্থাপিত পাঠশালা এবং তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা কয়েকটি শিশুপাঠ্য বই প্রকাশ করে। শিশু পাঠ্য বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও নানা সমস্যা দেখা দেয়। নানা লেখক এবং শিক্ষা সোসাইটি প্রকাশিত শিশুবোধক, লিপিধারা, জ্ঞানরুণোদয়, অন্নদামঙ্গল, হিতোপদেশ প্রভৃতি বই শিশুদের পড়ানো হত।
ঈশ্বরচন্দ্র এসময় যুগোপযোগী শিশুপাঠ্য প্রণয়নে এগিয়ে আসেন। এখানে একটি কথা বলা দরকার , ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্র বেথুন সাহেবের অনুরোধে বেথুন বিদ্যালয়ের অবৈতনিক সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। সে সময় মদনমোহন তর্কালংকার এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মদনমোহন তর্কালংকার শিশুদের উপযোগী শিশুশিক্ষা নামে বই প্রকাশ করেন। ্এই বইয়ের প্রথম  ভাগে তিনি বেথুন সাহেককে উৎসর্গ করে ভূমিকায় লেখেন--- ‘ অনেকেই অবগত আছেন প্রথম পাঠোপযোগী পুস্তকের অসম্ভবে আমাদেশীয় শিশুগণের যথানিয়ম স্বদেশ ভাষা শিক্ষা সম্পন্ন হইতেছে না-----’
জানা যায়,শিশুশিক্ষা পাঁচভাগে প্রকাশিত হয়। প্রথম তিন ভাগ লেখেন মদনমোহন তর্কালংকার স্বয়ং, চতুর্থভাগ বোধদয় লেখেন ঈশ্বরচন্দ্র এবং পঞ্চমভাগ নীতিবোধ রচনা করেন রাজকুষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঈশ্বরচন্দ্র শিশুশিক্ষার বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সহজ রীতিতে শিশুপাঠ্য রচনার কথা ভাবতে থাকেন।  তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণ পরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ রচনায় তিনি প্রগাঢ় মনীষার স্বাক্ষর রাখেন। শিশুদের উপয়োগী করার জন্য তিনি এই বই দুটোতে সরল অক্ষর, ভাষা ও উচ্চারণ সংযুক্ত করে মেধা- মনন – ভাষাজ্ঞানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বর্ণ পরিচয় প্রথমভাগে বর্ণের দ্বারা সহজ সরল শব্দ নির্মাণ নি:সন্দেহে শিশুমনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে। উদাহরণস্বরূপ  এই শব্দগুলোর কথা বলা যেতে পারে।---- ‘ অচল অধম অপর।’ কোথায়ও ‘আ ’কার বা ‘ ও’ কার ব্যবহার ছাড়াই রচিত শব্দগুলোর মধ্যে ছন্দের দ্যোতনা  লক্ষ করা যায়। এই বইয়ের ছোট ছোট বাক্যগুলো শিশুমনে দোলা দেয়।‘ বড় গাছ। ভাল জল। হাত ধর। বাড়ী যাও।’ ইত্যাদির কথাও বলা যেতে পারে। বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয় ভাগে তিনি যুক্তাক্ষর ব্যবহার করে শব্দ  ও বাক্য রচনা করেন। বর্ণ পরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে তিনি নীতিকথা সন্নিবেশিত করেন, যা স্বত:সিদ্ধ সত্যের  পরিচায়ক। তাঁর লেখা বর্ণ পরিচয় দ্বিতীয় ভাগে ধর্মেরবাণীকে তুলে ধরেন ঐতিহ্যের আলোকে। ‘ সদা সত্য কথা বলিবে’, কাহাকেও কুবাক্য বলিবে না’ ইত্যাদি হিতোপদেশ তিনি আধুনিক আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। কিন্তু আজ বড়ই দু:খের বিষয় , আমরা অবলীলাক্রমে ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণপরিচয়কে বর্জন করেছি।
১৮২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার আইন করে সতীদাহ প্রথা বিলোপ করায় তৎকালীন বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গোঁড়া সমাজপতিরা এই আইন মেনে নিতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার জন্য ‘ ধর্মসভা’ স্থাপন করে তারা বিলাতের প্রিভি কাউন্সিলে সতীদাহ প্রথা বহালের আবেদন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র তখন সবে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছেন। বয়সও দশ বছরেরও কম। সতীদাহের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারলেও ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বিধাব বিবাহের জন্য এগিয়ে আসেন।
আগেই বলা হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত প-িত হয়েও হিন্দুধর্মের কুসংস্কারমূলক বিধিবিধানগুলো আঁকড়ে থাকেননি। ডিরোজিও’র শিষ্য  ইয়ং বেঙ্গলদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। হিন্দুসমাজের কুসংস্কার দূর করার লক্ষে গঠিত ‘ তত্ত্ববোধিনী সভা’র সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। পরবর্তীকালে ‘সর্বশুভকারী সভা’র মুখপত্র হিসাবে মতিলাল চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সর্বশুভকারী পত্রিকা’।  ঈশ্বরচন্দ্র এই পত্রিকায় ‘ বাল্যবিবাহের দোষ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে মেয়েদেরকে  লেখাপড়া শেখাতে হবে। তখন শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে স্্রীশিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দুর প্রাচীন শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে স্ত্রীশিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দুর প্রাচীন শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে আধুনিক জীবনে তাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সচেষ্ট হন। শাস্ত্র নির্দিষ্ট অর্থে এগিয়েই ঈশ্বরচন্দ্র বিধাবা বিবাহ প্রচলন ও বহু বিবাহ নিবারণের চেষ্টা করেন। তিনি বিচার বিবেচনা ছাড়া হিন্দুশাস্ত্রেও বিধিবিধান মেনে নিতে রাজি হননি।
আগেই বলা হয়েছে, ঈশ্বরচন্দ্র্রের সমাজ সংস্কারমূলক কাজের সূত্রপাত ১৮৫০ সালে ‘সর্বশুভকারী পত্রিকা’য় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখে,‘ স্মৃতিশাস্ত্র প্রতিপাদিত কল্পিত কালমৃগ তৃষ্ণায় মুগ্ধ হইয়া অস্মদ্দেশীয় মনুষ্যমাত্রই বাল্যকালের পাণিপীড়নের প্রথা প্রচলিত করিয়াছেন।----- লোকাচার ও শাস্ত্র ব্যবহারপাশে বদ্ধ হইয়া দুর্ভাগ্যবশত: আমরা বাল্যবিবাহ নিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ও দুরপনেয় দুর্দশা ভোগ করিতেছি।’ এই প্রবন্ধ থেকে দেখা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বাল্যবিবাহ সম্পর্কে হিন্দুধর্মের যুক্তিহীন বিধান মেনে নিতে পারেনি।
ঈশ্বরচন্দ্র যখন বিধবাবিবাহের সমর্থনে হিন্দুশাস্ত্রের বিধিবিধান সংগ্রহে রত, তখন বাংলার যুবসমাজে বিষয়টি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৮৫৩ সালের গোড়ার দিকে বিধাব বিবাহের সমর্থনে কলকাতায় তিনটির মত সভা হয়। ওই সব সভায় একদল যুবক বিধাব বিবাহকে সমর্থন করেন। পরবর্তীকালে তাদের অনেকেই আবার বিধাব বিবাহে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।
এক পর্যায়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিধাব বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় সমর্থন পান। ‘ পরাশর সংহিতা’য় তিনি বিধাব বিবাহের পক্ষে একটি বচনের সন্ধান পান। এই বচনটির সাহায্যে ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘ বিধাব বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এটি প্রকাশের পর পর হিন্দু সমাজে আলোড়ন দেখা দেয়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাবার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র  ওটার ১৫ হাজার কপি ছাপাতে বাধ্য হন। অন্য দিকে, ঈশ্বরচন্দ্র্রের বিরুদ্ধবাদীরা তাঁর বক্তব্য ঠিক নয় বলে একের পর এক পুস্তিকা প্রকাশ করতে থাকে। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসে  ঈশ্বরচন্দ্র লিখলেন দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘ বিধাব বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক দ্বিতীয়  সম্বাদ’। বিধাব বিবাহ আন্দোলনের বিপক্ষে হিন্দু সমাজের অনেকেই এককাট্টা হন। এক পর্যায়ে ঈশ্বরচন্দ্র অনুভব করেন, বিধাব বিবাহ চালু করতে গেলে সমাজ ও রােেষ্ট্রর সমর্থন প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় আইনের জোরেই সতীদাহ প্রথা নিবারণ করা সম্ভব হয়েছিল। তাই তিনি শাস্ত্র- সন্ধানে বিধাব বিবাহ আইন পাশের জন্য আবেদনপত্র রচনা ও স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অবতীর্ণ হন। ১৮৫৫ সালের ৪ অক্টোবর ভারত সরকারের বিবেচনার জন্য তিনি ৯৮৭ জনের স্বাক্ষরসংবলিত আবেদন পত্রটি প্রেরণ করেন।  বিধাব বিধাব আইন পাশের বিপক্ষে বিরোধীরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। তারাও সরকারের কাছে আবেদন করে যাতে আইনটি পাশ হয় না।১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই বিধাব বিবাহ আইন পাস হল, কয়েকমাসের মধে ধুমধাম করে কলকাতায় বিধাব বিবাহ বিয়েও হল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ঈশ্বরচন্দ্র্রের উদ্যোগে প্রথম বিধাবা বিবাহ করেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারতœ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মানবিক মূল্যবোধে জারিত মন বালবিধবাদের দু:খ- বেদনার ভারাক্রান্ত ছিল। হিন্দু বিধবাদের দু:সহ জীবনের করুণ চিত্র বিদ্যাসাগরের মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তিনি নিজ উদ্যোগে নিজ অর্থ ব্যয়ে বিধবা বিবাহ দেন এবং এক সময় এ কারণে তাঁকে ঋণভার বহন করতে হয়। তিনি ১৮৭০ সালে তাঁর পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে জনৈক বিধাবার বিবাহ দেন।  তিনি বহু বিবাহ রোধে এগিয়ে আসেন।  ১৮৬৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রাণনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরা বহু বহু বিধবা রোধে আইন তৈরির জন্য  সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। তার কিছুদিন পরে  দুর্গাচরণ নন্দী ও অন্যান্য সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি এ বিষয়ে সরকারের কাছে আরেকটি অনুরোধ করেন।বহু বিবাহ নিবারণে হিন্দুদের প্রয়াসকে ‘ফ্রে- অফ ই-িয়া পত্রিকা’ স্বাগত জানায়। ১৮৬৫ সালের ৩০ মার্চ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পত্রিকাটি বিদ্যাসাগরকে বহু বিবাহ বিরোধী উদারপন্থী হিন্দুদের নেতা হিসাবে চিহ্নিত করে। বহু বিবাহের পক্ষে রাধাকান্ত দেব ও তাঁর দলবল সোচ্চার হয়ে ১৮৬৬ সালে সরকারের কাছে বহু বিবাহ রোধ না করার জন্য আবেদন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বহু বিবাহ নিবারণে  শাস্ত্রীয় বিধি বিধান উল্লেখ করে একখানা বই লেখেন। তিনি এ বইতে কুলীনদের বহু বিবাহের একটা তালিকা লিপিবদ্ধ করেন। এই বই হিন্দু সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বহু বিবাহের পক্ষের লোকেরাও বসে রইলেন না। তারাও ঈশ্বরচন্দ্র্রের বইয়ের জবাব দিলেন তাদের পক্ষে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৭২ সালে তাদের বক্তব্যেও বিরোধিতা করে ‘ বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’ নামে দ্বিতীয় পুস্তক রচনা করেন। আইন করে বহু বিবাহ রোধ করা না গেলেও জনসাধারণের মধ্যে বহু বিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠে। ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্রজ্ঞ প-িত হওয়া সত্ত্বেও কখনোই কুলীনদের একাধিক স্ত্রী গ্রহণের পক্ষে মত দেননি।
সে সময় শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে মেয়েদের লেখাপড়ার দ্বার রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হয় এই অপব্যাখ্যাকে ঈশ্বরচন্দ্র কখনও মানতে পারেনি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। যে, হিন্দু সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহু বিবাহ নিবারণের অন্যতম উপায় হল মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। ঊনিশ শতকের সূচনাপর্বে বাঙালি সংস্কারকরা স্ত্রীশিক্ষার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। দু’একটি পুঁথিপড়া কূলীনসর্বস্ব প-িত নামধারীরা মেয়েদের অন্দরমহলের ঘেরাটোপে আবদ্ধ রেখে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করার ষড়যন্ত হিন্দুসমাজেকে কোন অতলে নিক্ষেপ করছে সে বিষয়ে ভাবিত ইয়ং বেঙ্গল ও রামমোহনপন্থীদের সঙ্গে একদল সংস্কারপন্থী প-িত হাত মেলালেন। তাঁদের বোধদয় হয় , মেয়েদের শিক্ষাদান ছাড়া হিন্দুসাজের কল্যাণ কোনক্রমেই সম্ভব নয়। এঁদের মধ্যে তারাশঙ্কর তর্করতেœর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮৪৯ সালে বেথুনের উদ্যোগে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের জন্য কলকাতায় বিদ্যালয় খোলা হলে বিদ্যাসাগর সর্বশক্তি দিয়ে এই বিদ্যালকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেন। সে সময় বেথুনের পাশে ছিলেন ইয়ং বেঙ্গল দলের রামগোপাল, দক্ষিণারঞ্জন আর শাস্ত্রজ্ঞ প-িতদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন বিদ্যাসাগর ।  বেথুনের বিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠাতে ব্রাহ্মসমাজের মধ্যমণি রবীন্দ্রনাখের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ডিরোজিও শিষ্য প্যারীচাঁদ , সংস্কৃতজ্ঞ মদনমোহন ইতস্তত করেননি। ১৮৫০ সালে বেথুন ঈশ্বরচন্দ্রকে সেক্রেটারি পদে নিয়োগ করেন।
 ঈশ্বরচন্দ্র মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রাম- গ্রামন্তরে ছড়িয়ে দেন। সরকার তাঁকে স্কুল ইনস্পেক্টও নিযুক্ত করলে গ্রামাঞ্জলে মেয়েদের স্কুল স্থাপনের সুযোগ এসে যায়। শিক্ষার্থীদেরকে বেত না মেরে ভালবেসে পাঠদানে ব্রতী করার জন্য তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।  তাঁর উদ্যোগে বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া ও মেদিনীপুরের বিভিন্ন গ্রামে একের পর এক বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ছোটলাট হ্যালিডের মুখের কথায় উৎসাহিত হয়ে ১৮৫৭ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ১৮৫৬ এর মে’র মধ্যে তিনি ৩৫টির মত বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মেয়েদের এই বিদ্যালয় স্থাপন করতে গিয়ে তাকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়।মেয়েদের  বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সরকারি নির্দেশ লিখিতভাবে না থাকার কারণে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ইয়ং বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলোতে অর্থ সাহায্যের বিরোধিতা করতে থাকেন। অনেক আবেদন নিবেদনের পর সাময়িকভাবে আর্থিক সাহায্য দিলেও স্থায়ী কোন অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়নি। কিন্তু এতে হতোদ্যম হননি তিনি। ১৮৭৮ সালে কোন কোনমহল থেকে মেয়েদেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবার বিরোধিতা হলে বিদ্যাসাগর ব্যথিত হন। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে চন্দ্রমুখী বসু বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বিদ্যাসাগর তাঁকে সম্ভাষণ জানান।১৮৭০ সালে কুলনি স্বামীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে কৃষ্ণমণি নামে একটি মেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। বিচারপতি নর্মান দায়িত্বহীন কুলীন স্বামীটিকে জেলে পাঠালে ‘ সনাতন ধর্মরক্ষণী সভা’র মত রক্ষণশীল সংগঠনের সদস্যরা নির্যাতিতা নারীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিদ্যাসাগর চুপ থাকতে পারেননি। আবার তিনি বহু বিবাহ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বহু বিবাহ বিবাহ বিষয়ক যে বইটির মুদ্রণ বন্ধ করে রেখেছিলেন তা আবার নতুন ভাবে মুদ্রণের ব্যবস্থা করেন।
পিতা যে পুত্রকে তাঁদের গ্রামের পাঠশালার প-িত হিসাবে গড়ে তোলার জন্য কলকাতায় এনে শাস্ত্রজ্ঞ করতে চেয়েছিলেন।, সেই ছেলেটি শাস্ত্রজ্ঞ হয়ে শাস্ত্রেও সারবত্তাকে সত্যসন্ধানী দৃষ্টিতে আবিষ্কার এবং তাকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করে হিন্দুসমাজের কুসংস্কার দূরীকরণ, বাল্যবিবাহ রোধ, বহুবিবাহ নিরোধ, বিধবার বিাবাহ প্রবর্তন এবং শিক্ষার আলোকবঞ্চিত মেয়েদের শিক্ষাদানে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণে জীবন নির্বাহ করতেন. যদি ইউরোপীয় ভাষা- সাহিত্যের চর্চা না করে পাশ্চাত্য ভাবধারা সম্পর্কে জানার্জন থেকে বিরত থাকতেন তবে হিন্দু সমাজের কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রথা নারী নমাজকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখত একথা নির্দ্ধিায় বলা যায়। নারীদরদী, নারীমুক্তি  আন্দোলনের পুরোধা, কালোত্তীর্ণ আধুনিক  ঈশ্বরচন্দ্র চিরকাল আমাদের নমস্য হয়ে থাকবেন।