পদাবলি

পদাবলি






 এই অধ্যায়ে
মোহাম্মদ জসিম

এই অধ্যায়ে তোমার চোখ আর চুল কিংবা গালভর্তি বসন্তের দাগ নিয়ে আলোচনা হোক ঋতি রায় উহ্য থাক স্মৃতিক্ষত, মনবদলের গল্পগাছা...

জোৎস্নায় যা কিছু সুন্দর- যেমন ধরো তোমার প্রশস্ত কাঁধ কিংবা বুক, বুকের উপত্যকায় লালরঙ তিল নিয়ে কথা হোক এই অধ্যায়ে; হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি-আর যত ঢেউ সবকিছু এড়িয়ে যাবো আজ।

নাভিতে নয়নতারা ফুটে থাকে- ক্রমাগত নিকটবর্তী হই সমুদ্ররেখার। এই সুসজ্জিত ভ্রমণের শেষভাগে লবনচাষীদের জন্য রেখে যাওয়া সুসংবাদ নিয়ে কথা হোক।

বিগত অধ্যায়সমূহে আলোচিত চিৎকারগুলো আপাতত লুকিয়ে রাখো খামারবাড়ির কালকুঠুরিত; খরা ও খরিপ যতগুলো মৌসুমি বাতাসের শব্দ আমরা জমিয়েছি বুকের গভীরে-আজ তার কিছুই ছোঁব না...

কথা পরম্পরায়- এই অধ্যায়ে আমরা শুধু গোলাপি কার্ডিগেন, তার লাল বোতাম আর অন্তায়মান সূর্য নিয়ে আলাপ করবো- যতটা গভীরে গেলে নীলরঙ উথলে ওঠে ততটা গভীরে যাবো না মোটেই।



সবকিছু সবার সয়না
মারুফ আহম্মেদ নয়ন

সবকিছু সবার সয়না। কেউ মেঘ না চাইতেই পেয়ে যায় জল। কারো কারো আজীবন খরা। কারো কারো ফাগুন সয়না, কারো বৈশাখ, কারো চৈত্র। কারো কারো বাগানে ফুল ফোটার আগেই ঝরে যায়। কেউ কেউ বোঝেনা, ঋতু বদলের খেলা। কারো হাঁটুজলে ডুবে যায় নৌকা, কারো থাকে ভেসে। কারো সুখ সয়না, কারো কারো দুঃখ। কেউ কেউ কিছু না বুঝেই থেমে থাকে মাঝপথে...

শুধুই প্রশ্নবিদ্ধ
তরণী কান্ত সুমন

কেঁদে উঠে মন!
যখন দেখি মানুষে মানুষে লাঠালাঠি হিং¯্রতা ছড়িযে দেয় বুক বরাবর।
মানুষের রক্তে পিপাসা মেটায় মানুষ, নিজের পশুত্বকে লালন করে বাহুবলে।
আঘাত হানে দূর্বল মানুষের পেশীতে!

বীরত্ব; জ্বালিয়ে দেয় অসহায় মানুষের
বেঁচে থাকার আশ্রয়। পোড়া গন্ধে ভেসে দেয় পশুত্বের বাহ্বা।
 লুঠিয়ে নেয় পশুত্বের আড়াচোখে যুবতীর শেষ সম্ভ্রম।
জিহ্বায় চটিয়ে দেয় রক্তের স্বাদ উন্মাদ করে দেয় বিবেকের মৃত্যু ।

শুধুই প্রশ্নবিদ্ধ হয়!!
এরা কি মানুষ? কে লড়বে এই বর্বরতা, প্রভুত্বের বিনাশ করবে?
 বিশ্বাস; একদিন ঈশ্বর হস্তে পশুত্বের বিনাশ ঘটবেই।

বোধ
শোয়াইব শাহরিয়ার

কুয়াশার চাদরে ঢুকে যাচ্ছে নদী। নদীর ভেতর ঢুকে যাচ্ছে দেহ।
দেহের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে নারী। নারীর ভেতর ঢুকে যাচ্ছে পুরুষ।
পুরুষের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে লোভ।

একটু ভেবে দেখো- তোমার কারণে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এমনকি তুমি নিজেও  শেষ হয়ে যাচ্ছো। পুরুষ, ভাবো।
তুমি বরং ভাবতে শেখো। তুমি বরং ভালোবাসতে শেখো।

তুমি আজ-
এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জ্বালাও মোমের আগুন
ভালোবাসা হয়ে গলতে গলতে পৃথিবী হবে বৈষম্যহীন।



পুনরাবৃত্তি
মোহাম্মদ অংকন

দু’চোখে অসম ঘুম; তবুও টেনে তোলে ব্যস্ততার এলার্ম।
চোখে দু’চিলতে জলের ছাপ মেওে ছুটতে হয়-
যেখানে জীবনের বাস্তবতা  অপেক্ষমান কিংবা ভবিষ্যৎ ডাকছে।

চেতনায় আসে; এখনই তো জীবনের দৌঁড়ানোর সময়।
পিছিয়ে পড়লে কেউ হাত বাড়িয়ে ডাকবেনা হয়তো;
উপলব্ধি করতে হবে তখন- নিগ্রহতার বোঝা কত ভারি।

দৌঁড়ানোর পালাক্রমে- দিন শেষে ক্লান্তগুলো ঝাঁপটে ধরে,
চোখেঅসম ঘুমের পসরা সাজায়; ঘুমিয়ে পড়ি অবচেতনে।
কেননা আবার সকালে ছুটতে হবে চোখে দু’চিলতে জলের ছাপ মেরে।

আর এভাবেই প্রতিযোগিতায় টিকে রয়েছি;
প্রথম হওয়া হয়ে ওঠেনা চর্চার অভাবে। পুনরাবৃত্তি হয় না শৈশবের-
পুনরাবৃত্তি হয় শুধুবহমান সময় আর ক্লান্তবৃত্ত ঘুমের।


পৃথিবী থামবে কোথায়?
সাদ সাইফ

নিঃসঙ্গরা খুঁজতে থাকে একটু প্রশান্তির হলকা
সঙ্গ পারাবারে পানি থেকে মৃত্তিকার স্বগর্ববাণী।
ভড়কে গিয়ে হিমালয় হয় আগ্নেয়গিরি
চরম নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে একাকিত্বের অচলকে।
কোথাও নেই এতটুকু স্বস্তি কিংবা আশার বাণী
মোটিভেশনাল স্পিকাররাই মন জ্বলিত সমালোচক।
হতাশার বুদ্বুদ কড়া নামে আত্মাহূতির রাস্তায়
তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এক চিমটি বিবেক।
পাপ পূণ্যের হিসাব তখন আড়াল করে রাখে হতাশাকে
ঝাঁপিয়ে পড়ে মহাপ্রস্থান, মহাপাপে।

বৈশাখর তাপে
রুদ্র সুশান্ত

রোদ্দুরে বসে থাকা বুড়োটা,
গঙ্গাস্নানে যাবে আজ,
জলে নিমগ্ন করবে শরীর পুরোটা।

ছন্দের তালে বৈশাখ এসে
হা-হা-কার করে দিলো পুরো রাজ্যময়,
রাজ্যজুড়ে রোদ্দুর তাপে, 
রাজকুমারী খোলা চুলে শান্ত বাতাস খুঁজছে আজ;
এ যেনু আগুনের ফুলকি বৈশাখ নয়।

ব্যথার দাগ
আহমদ মেহেদী
(উৎসর্গ : মিষ্টি,  তাহার ডাকনাম)

জানি, এই ছোট্ট  জীবনে  আমার ফেলে আসা অতীতের বিছানায় ভুলের রক্ত বিন্দুর দাগগুলো;
আর মুছবেনা কিংবা কখনোই মুছার নয়, এই পৃথিবীর ছলনার অবশিষ্ট কোন রং দিয়ে।
তুমি রাঙাও তোমার শহর আমার কথা ভুলে।

আমি চেয়েছি পাথর- প্রেম তুমিই জয়ী হও চিরতরে, জয়ের লোভ আমার নেই; ছিলো ও না দুজনের সম্পর্কের কৈশোর থেকে আজ পর্যন্ত, মায়া-কান্নার আদুরে সিংহাসনের রাজা আমি- তুমি রাণী ছাড়া হতে পারিনা আর পারবোও না আমৃত্যু।

এই বেলায় জেনে গেছি অন্তর জমিনে এক বিন্দু সুখ চাষের প্রজা খুজতে যাওয়া বড্ড বেমানান; উড়ে চলে যাওয়া চাতক পাখির  অপেক্ষায় দিন গোনা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না, হয়তো কিছু ব্যাথার দাগ একদিন মাথা গুঁজে উঠবে ঐ অচিন হাশরের জলকেলিতে, কেননা করেছি পাথরের সাথে প্রেম আমি- তবুও আশায় থেকে থেকে চলে যাচ্ছে জীবন সেই পাথরের’ই খোঁজে।

পা ভেজাবো সাগর জলে
শর্মি ভৌমিক

একদিন এসো,
এসো এই সাগরবেলাভূমে;
আমি তোমার জন্য
অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বসে আছি
নিঃসীম বালুকাবেলায়;
কোন একদিন এ পথে তুমি আসবে বলে।

কি আবেগে অপেক্ষারত এই আমি!
প্রতি ভোরে এলোমেলো সামুদ্রিক হাওয়ায়,
খালিপায়ে একাকী নির্জনে হেঁটে হেঁটে
জমে যায় আমার উত্তাল প্রভাতফেরী;
জল আর শূন্যের মাঝামাঝি
অসংখ্য গাংচিলের দুরন্ত উড়াউড়ি!

সমুদ্রতীরে ঝরা পালকের গায়
নিবিড় দৃষ্টি মেলে চেয়ে থেকে,
খুঁজেফিরেছি আমি সহ¯্রবার 
আগমনী ফেলে যাওয়া
কোন স্মৃতিচিহ্ন তোমার।
নিঁখুত চাহনিতে
দেখতে চেয়েছি হয়ে অবুঝশিশু,
হয়তো লেখা আছে তাতে
তোমার আসার কথা কিছু!

কতো লোক আসে যায়,
কতো যুগল হাওয়ায় চুল উড়ায়!
তুমিতো জানো না,
কেউ রয়েছে তোমারই অপেক্ষায়!
আমি আজো ভেজাইনি পা,
নামিনি সেই গহন জলে!
অনুভূতিসব অভিমানে জমে জমে,
নয়ন জলে গড়েছে আরো একটি তটিনী বুঝি!

কতো রৌদ্রস্নান শেষে
হারিয়েছি হাওয়াদের আবেশে!
শুভ্র ঢেউরাশি আকুল হয়ে
সকাল-সন্ধ্যা ডেকে গেছে নিরবধি!
কল কল কয়েছে কথা,
নীরবে গিয়েছে হৃদয় চুমে।

তবুও যাইনি জলে,
কাতর হইনি কারো কৌশলে!
দু’জন মিলে সূর্যোদয় দেখার পরে
বালুকাবেলায় শুয়ে রৌদ্রস্নান শেষে,
হারাবো দু’জন দু’জনাতে;
তোমার হাতটি ধরে সূর্যাস্ত দেখা হলে,
জীবনের পূর্ণতা নিয়ে ঘরে ফিরবো বলে
আজো বসে আছি সুতীব্র প্রতীক্ষা নিয়ে,
আমি নামিনি ঐ সাগর জলে;
ভেজাইনি পা, তুমি আসোনি বলে!






গল্প : দুপুরবেলা

গল্প : দুপুরবেলা


দুপুরবেলা
রুমানা নাওয়ার

সুনসান দুপুর। চারদিক নিস্তব্ধ। পথঘাট জনমানব শূন্য। মা বলতো এ সময়টায় সাবধান থাকতে। অঘটন গুলো এ সময় বেশী ঘটে। দু’একটা কাজ ছিলো হাতের সেগুলো শেষ করে শাওয়ার নিতে যাবো এমন সময় ডোর বেলটা বেজে উঠলো। আমল না নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলাম। আবার বেল পড়ার শব্দ। অনবরত বেজেই চললো। ফকির টকির তো ঢুকতে পারে না। তাহলে এ অবেলায় কে হতে পারে ? চিন্তার রেখা অদিতির কপালে। মহসীনও অফিস ট্যুরে বাইরে। তাহলে কে হতে পারে ? চিন্তা করতে করতে দরজাটা খুলল। এবং ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো অদিতি।
-শাওন তুমি?
-হুমম, আমি।
-কোত্থেকে হঠাৎ!
-এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমাকে একটু দেখে যাই। তাই আসা।
-এভাবে কিছু না বলে ?
-বাসায় কেউ থাকবেনা জানতাম। তাই আসা।
অদিতি একটু ভয় পেয়ে গেলো শাওনের কথায়। কি উদ্দেশ্যে আসলো শাওন? শাওন বুঝতে পারলো অদিতির মনোভাবনা। তাই প্রসঙ্গ ঘুরালো- কি একটু আপ্যায়নও করবেনা। বসতে বলবা না। প্রথম আসলাম তোমার বাসায়।
অদিতি লজ্জা পেল শাওনের কথায়- আরে বসো বসো। কি দেবো তোমাকে। জুস নাকি কফি?
-জুস দাও। বাইরে যে রোদ। একমাথা রোদ নিয়ে তোমার কাছে আসলাম। তেষ্টায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
অদিতি ভেতরে চলে গেলো। অতিথির আপ্যায়ন রসদ জোগাতে। শাওন অদিতির চলে যাওয়া দেখলো মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে। একটুও বদলায়নি মেয়েটি। বিয়ের পর আরো রুপবতী হয়েছে যেন। ঠিকরে পড়ছে রূপ মাধুরী তার। সাজহীন নিরাবরণ অদিতি। তবুও কত সুন্দর মায়াবী।
শাওন চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো পিছনের কথা। অদিতির সাথে পরিচয়, প্রেম-ভালোলাগা, প্রপোজ প্রথম চুমু সব সব স্মৃতিপটে জাবর কাটলো শাওন।
প্রথম প্রপোজটা অদিতির ছিলো। একটা চিরকুটে লেখা ‘ভালোবাসি’।
শাওন প্রথমে সায় দেয়নি ডাকে। ভেবেছিলো হয়তো কত অদিতিই প্রপোজ করবে। সবগুলোতে সাড়া দিতে নেই। কিন্তু যত দিন যায় অদিতির প্রতি ওর টানটা বাড়তে থাকে। ওর সঙ্গ পেতে ও চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে খুব। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। অদিতি শাওনের সাড়া না পেয়ে কেমন জানি বিমর্ষ মনমরা হয়ে থাকে সারাক্ষণ। কাউকে বুঝতে দিলোনা ওর ভিতর কি ক্ষরণ চলছে। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া চলতে লাগলো তার। শাওনকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। ওকে দেখলে একধরনের আড়ষ্টতা কাজ করতো ওর ভিতর। এর পর শাওন অনেকবার চাইছে অদিতির কাছ ঘেঁষতে। ভালোবাসি কথাটা বলতে কিন্তু পারেনি। ওর দূরেদূরে গা-ছাড়া ভাব দেখে।
অদিতি প্রমিজ করলো আর কোন ভালোলাগার পাত্তা দেবেনা। পড়াশুনা টাই মোক্ষ। সুন্দরী ছিলো বলে বিয়ের প্রপোজাল আসতে লাগলো অনার্স কমপ্লিট না হতেই। মহসীন বাবা মায়ের পছন্দের পাত্র। শিক্ষিত বুদ্ধিমান ভালো সরকারি চাকুরে। অদিতিরও পছন্দ হলো ওর পার্সোনালিটি আর ব্যাকগ্রাউন্ড সব।
অনেক ভালো মানুষ মহসীন। আজ এতবছর পর ও অদিতির প্রতি ওর ভালোবাসা বিন্দুপরিমাণও কমেনি। সে বিয়ের প্রথম দিনের মতো।



জুস আর ও নানা স্ন্যাক নিয়ে আসলো অদিতি।
শাওন গা এলিয়ে বসে ছিলো এতক্ষণ অদিতি আসাতে সোজা হয়ে বসলো।
জুসটা এগিয়ে দিলো অদিতি শাওনের দিকে। এক চুমুকে পুরো গ্লাস সাবাড় করে দিলো। বুঝা গেল খুব তেষ্টা পেয়েছে শাওনের। আপাদমস্তক দেখলো ওকে অদিতি। শাওন ব্রিলিয়ান্ট চৌকষ ছেলে ও একসময় ভালোবেসে মন পেতে চেয়েছিল। ভালো বক্তা ভালো লেখক এ সময়ের। এক নামে সবাই চেনে তাকে। শাওন হাসনাত। অদিতির ভালোবাসার মানুষ। একটু হেসে দিলো যেন। খেয়াল করলো শাওন।
-হাসছো কেন অদিতি?
-না এমনি।
-বিয়ে করছো না কেন?
-তোমার  মতো কাউকে পাচ্ছি না বলে।
-কি বলো তুমি। আমার চেয়ে ঢের সুন্দরী মেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি ডেকে দেখ।
-শাওন হাসনাত। বিশাল সেলিব্রেটি এখন।
কিন্তু আমি যে ভুল করেছি অদিতি সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো করতে হবে আমাকে। তোমায় পেয়েও আমি হারিয়েছি আমারই ভুলে। তুমি আমায় ক্ষমা করোনি আজও?
-আরে না। তোমার প্রতি আমার কোন রাগ বা ক্ষোভ নেই শাওন। আমি বর্তমান নিয়ে সুখী। মহসীন অনেক ভালো মানুষ।
শাওন কি যেন খুজে অদিতির চোখে। তারপর চোখ নামিয়ে ফেলে হঠাৎ করে।
অদিতি একটু তফাৎ নিয়ে বসে। শাওন চুপচাপ।
অদিতি কথা খুঁজে বলার জন্য।
-তোমার বাবা মা কেমন আছে ?
- ভালো সবাই ভালো। শুধু আমি ছাড়া।
- তুমি বিয়েটা করে থিতু হও। তারপর স্থিরতা আসবে জীবনে।
-আচ্ছা; আজ তবে আসি অদিতি। আবার যে কোনদিন হুট করে চলে আসবো তোমায় দেখতে। এ বলে সামনে পা বাড়ালো শাওন। অদিতিও এগিয়ে গেল বিদায় জানাতে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে অদিতির খুব কাছে চলে আসলো শাওন। কিছু বুঝে উঠার আগেই অদিতিকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে অদিতির।
-প্লিজ শাওন ছাড় আমাকে।
-না, অদিতি না। প্লিজ আমায় একটু আদর করতে দাও। কতদিন চেয়েছি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরবো। আদর করবো।
অদিতি না না যতো বলে শাওন ততো জোড়ে আঁকড়ে ধরে। শেষে আর না পেরে অদিতির ঠোঁট দুটো চেপে ধরে নিজের উত্তাল ঠোঁটে।
অদিতির হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়লো। ঠিক দুপুরবেলা যত অঘটনগুলো ঘটে।


গল্প : অপমৃত্যু

গল্প :  অপমৃত্যু


 অপমৃত্যু
নাজনীন সুলতানা নূহা

ছুটির ঘন্টা বাজে, হই হই করে ছাত্ররা ক্লাস থেকে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরে। প্রতিদিনের মতই রাকিব থাকে সবার আগে, তাকে কেউ ধরতে পারে না। কালামুন্সির ক্ষেতের আইল দিয়ে নেমে রাকিব পথ ছোট করার চেষ্টা করে। সাথে ক্ষেতের পাশের আম গাছটার আম কুড়ানোর সুবিধাটাও করে নেয়।

রাকিব আজকে খুব খুশি। একদম টসটসে পাকা দুইটা আম ধানের চারার ভিতরে পড়ে রয়েছে। তড়িগড়ি করে আম দুটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিযে সোজা বাড়ি। ভাইকে এভাবে আসতে দেখে মাহাদি ভাইয়ের পিছনে ছুটে। রাকিব রসুই ঘর থেকে দা নিয়ে বসে। মাহাদি বলে, আমারে দিবা? রাকিব চুপচাপ আম কেটে যাচ্ছে। বাটিতে রাখা আমের টুকরোগুলো মাহাদি একটা একটা করে গুনে রাখছে। রাকিবের কড়া নিষেধ, কাটা শেষ হবার আগে একটা ও মুখে দেওয়া যাবে না।

লাঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে শেফালি বেগম ছেলেদের কাছে আসেন, পিছনে আবদুল হামাগুড়ি দিয়ে মায়ের পিছু পিছু আসে। আজকাল আর আবদুলকে কোলে নিতে পারেন না তিনি । খুব কাহিল লাগে শরীরটা, অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠেন। সকালে রাকিবের বাবা ধরে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গেছেন, মনে হলো তখন যেন তিনি এক চুল নড়েতে পারছিলেন না। ছেলেদের দেখলেই যেনো একটু শক্তি পান। রাকিবকে আম কাটা দেখে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করেন, আম কোথা থেকে এনেছিস বাবা? রাকিব কালামুন্সির ক্ষেতের কথা বললে শেফালি বেগম ছেলেকে কাটা আম সহ আস্ত আমটি দিয়ে আসতে বলেন, সেই সাথে বলে দেন, ‘অনুমতি ছাড়া কারো গাছের কিছুতে হাত দেওয়া ঠিক নয়।’ রাকিব প্রথমে আপত্তি করলেও পরে মায়ের শীতল চোখের দিকের তাকিয়ে গোটা আমটা নিয়ে কালামুন্সির বাড়ির দিকে রওনা দেয় সাথে কাটা আমেটির টুকরো গুলোও। নাজমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ছেলে গুলো কী তার মানুষ হবে? অজানা আশঙ্কায় হৃদয় যখন মূর্ছিত তখন কোথা থেকে এক ক্ষীণ সরু আলোর রেখা ভেসে উঠে। একটি অস্পষ্ট মুখচ্ছবি ক্ষাণিক ভেসে আবার তলিয় যায়। এটা তো রাকিবই, তাই না!..
নাজমা বেগম ক্ষাণিক শক্তি সঞ্চয় করে ঘরের দিকে পা বাড়ান।

সাধারনত রাকিব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে। বাবা ডেকে মসজিদে নিয়ে যান। আজকে মনে হচ্ছে বাহিরে রৌদ উঠে গেছে, তাহলে কী বাবা ডাকেনি? কিন্তু কেনো? বাবা তো এমন সচরাচর করেন না। হঠাৎ কী মনে পড়তে রাকিব উঠে এক দৌঁড়ে মায়ের ঘরে ছুটে যায়। ছোট খালা, মামা সবাই মায়ের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রাকিব মামার এক পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে সরাসরি তাকায়, তার মনে হয় মায়ের দৃষ্টি পুরো ঘরে শুধু একটি জায়গায় স্থির, আর মায়ের দৃষ্টির গভীরতা রাকিবকে ক্রমেই তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। রাকিব অস্ফুট স্বরে ডাকে ‘মা’। মায়ের চোখের পাতা একবার নড়ে উঠে।
তারপর অনেকদিন চলে যায়, কিন্তু রাকিব অবুঝ মনকে বুঝাতে পারেনি, সেদিন ঘুম থেকে উঠে কেনো সে মায়ের ঘরে গেলো? কেনোইবা মা বলে ডাকলো? যদি সেদিন সে না ডাকতো তাহলে হয়ত মা বেঁচে থাকতো, মায়ের চোখ তো খোলাই ছিলো, এভাবেই নাহয় থাকতো। এখন তো একেবারেই নেই! সত্যিই নেই? রাকিবের বুক শক্ত হয়ে উঠে, হালকা কাঁপুনি আসে। নাহ!.. আর ভাববে না সে সেই কালো দিনটির কথা।



রাকিবের অনেক দায়িত্ব, মেহেদি -আবদুল কে পড়াশোনা করাতে হবে, দেখে রাখতে হবে। মা মারা যাবার পর বাবাকে অনেকেই বিয়ে করতে বলেছে, ছোট বাচ্চা গুলো দেখে রাখার জন্য ঘরে একজন স্ত্রীলোক থাকা দরকার। কিন্তু ফারুক মিয়া খুব দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলো তিনি বিয়ে করবেন না, সন্তানদের যদি আপন বাবা দেখে রাখতে না পারেন, তবে সৎ মা কীভাবে দেখে রাখবে !.. ফারুক মিয়া বড্ড বেশি ভালোবাসতেন বউকে। তিনটি বছর ক্যান্সারে ধরে ঘরে শুয়ে থাকলে ও কখনো যতেœর ত্রুটি রাখেননি।


রাকিবের এখনো মনে আছে একদিন সন্ধ্যায় বড় ফুফু বাবাকে একটা মেয়ে ঠিক করছে বলে জানালেন।
বাবা তখন বললেন ‘নাজু, আমার শুধু বউ ছিলো না, প্রেমিকা ও ছিল; প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কত যুবক চিরকুমার থাকার নজির অহরহ আর আমি প্রেমিক কী বৈরাগী ও হতে পারবো না? সত্যিই বাবা বৈরাগী হতে মেয়ে চেয়েছিলেন কিন্তু ছেলেদের পিছুটানে তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। যতদিন মনে হলো ছেলেগুলো অবুঝ ততদিনই ছিলেন, রাকিবের এইচএসসির পর একদিন সব কিছু রাকিবকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন মায়ের কাছে।
আবদুলকে ছোট খালা নিয়ে যায়। মাহাদি কলেজের হোস্টেলে থাকে। বাবার রেখে যাওয়া দোকানের ভাড়া আর টিউশনের টাকায় রাকিব আর মাহাদির খরচ চলে। রাকিব খালাকে বলেছে অনার্স শেষ করেই একটা চাকরি নিয়ে আবদুলকে নিয়ে আসবে। তিনভাই মিলে একটা বাসা নিয়ে থাকবে। টিএসসি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাকিব এসব ভেবে যাচ্ছে। মাহাদিকে বুয়েটে ভর্তি করাতে কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাবে? আবদুলটাকে এখন থেকে একটু একটু স্বপ্ন দেখাতে হবে, আজকে বাসায় যাওয়ার সময় আবদুল এর জন্য খেলনার একটা স্টেথোস্কোপ নিয়ে যাবে।

মিথিলা পাশে এসে এক থাপ্পড় দিয়ে বলল; এই ভবঘুরে, কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি, এমন করে কী ভাবছিস? রাকিব স্বল্পভাষী মানুষ, বলে; খেয়াল করিনি। মিথিলা কফির অফার করে, রাকিব কাজ আছে বলে মিথিলাকে এড়িয়ে চলে যায়। রাকিব বুঝে যে মিথিলা কেনো এমন গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে, কিন্তু রাকিবের এসবে মনোযোগ নেই। আগে তো ঘর তোলা পরেই না ঘরনি ঠিক করা।
ঢাবি ক্যাম্পাসে চার বছর অথচ বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই রাকিবের। রাকিব জানে বাস্তববাদী মানুষের তেমন বন্ধু জোটে না। বন্ধুদের দেওয়ার মত তেমন সময়ও নেই তার। টিউশন, বই পড়া, মাঝে মাঝে ভাইদের দেখে আসা এসবে ব্যস্ত থাকতে হয়।
আজকে আবদুলকে দেখতে খালার বাসা মিরপুর যাবে রাকিব। নিউমার্কেট থেকে বাসে উঠবে। কয়েকটা বাস চলে যায় রাকিব উঠতে পারে না। বাসে তিল পরিমান জায়গা নেই। দিনদিন ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনভোগান্তি। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, রাকিব কোনোরকমে একটা বাসে উঠে দরজায় ঝুলে পড়ে। গাড়ি ছুটে চলছে, রাকিব আনমনা হয়ে ফেলে আসা পথটায় চেয়ে আছে। এমন করে রাকিব কতগুলো অতীত ফেলে আসছে। হঠাৎ পিছনে একটা বাস খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে দেখলো। রকিবের মনে হলো বাসটি কী একটু বেশিই জোরে চলছে না!

আইসিউতে শুয়ে রাকিব মনে করার চেষ্টা করছে, লাস্ট কী হলো তার? কিন্তু সব কেমন যেনো ঝাপসা লাগছে, মাথা পুরা ব্লক, শরীরটা ভীষণ ভারি। আস্তে পা নাড়লো, হাত নাড়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু ডান হাতটা কেমন অপরিচিত লাগছে, দুইটা হাত নিয়েই তো রাকিব বাসে উঠছে। রাকিব এর খুব কষ্ট হয়, ঘেন্না হচ্ছে নিজের উপর!.. পঙ্গত্ব বরণ কত সহজে হয়ে গেলো, কিন্তু দুইটা ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করা কী সহজ হবে রাকিবের ?...
নাহ! পঙ্গত্ব নিয়ে আর রাকিব কে ভাইদের দায়িত্ব নিতে হয়নি। পৃথিবীর বুক আরেকবার নিঃস্ব করে দিয়ে রাকিব চলে যায় না ফেরার দেশে। আর একটি স্বপ্ন ঝরে যায় দুইটি চলন্ত বাসের প্রতিযোগিতায়। লিখে যায় আরেকটি অপমৃত্যুর গল্প।

চির ভাস্বর কবি নজরুল

চির ভাস্বর কবি নজরুল



চির ভাস্বর কবি নজরুল
মীম মিজান

লেখক সুভাষ বসুর নজরুলকে নিয়ে বলা একটি উক্তি দিয়ে শুরু করছি যে উক্তিতে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব- তখন নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব-তখনও নজরুলের গান গাইব।’ আমরা তাই নজরুল কে শুধু কবি পুরোধা দিয়ে আবদ্ধ করতে চাই না। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উচ্ছল যৌবনা নদীর ন্যায়। নদীর ঢেউ যেমন বয়ে চলে নিরবধি, ঠিক তেমনি নজরুল ও তাঁর কলমকে চালিয়েছিলেন সাহিত্যের সকল শাখায়। তিনি যেমন কবি, তেমনি একজন ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। যেমনি একজন সম্পাদক তেমনি একজন নাট্যকার ও অনুবাদক। প্রাবন্ধিক বা চলচ্চিত্র পরিচালকও তিনি।
এই ভাস্বর কবি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয়া পতœী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই এবং বোন। তার সহোদর তিন ভাই ও দুই বোনের নাম হল: সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। তিনি স্থানীয় মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম , দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তাঁর বাবা মারা যান তখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর।
এছাড়াও তাঁর শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, বৈবাহিক জীবন, সাংবাদিক জীবন, সাহিত্যিক জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে কমবেশী আমরা সবাই জ্ঞাত। বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭২ সালের ২৪শে মে ভারত সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৭৬ সালে কবিকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে কবি আক্রান্ত ছিলেন অনেকদিন, দেশ বিদেশের বহু জায়গায় চিকিৎসা করেও কবিকে সুস্থ করা সম্ভব হয়নি, জীবনের অনেক দশক তিনি নির্বাক ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট বাংলা সাহিত্যকে ঋণী করে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি তাঁর অনবদ্য সাহিত্য অবদানগুলির জন্যই আমাদের মনের মণিকোঠায় অনেক বড় স্থান দখল করে আছেন। সেগুলোর মধ্যে সব থেকে আবেদনমূলক সৃষ্টি হলো তাঁর কাব্য। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলির অন্যতম হলো,
অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা (কবিতা সংকলন), ফনী-মনসা, চক্রবাক, সাতভাই চম্পা, নির্ঝর, নতুন চাঁদ, মরুভাস্কর, সয়ন, সাম্যবাদী, দোলন-চাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, ছায়ানট, চিত্তনামা, সাম্যবাদী ইত্যাদি।
তিনি নিজে নিজে গান রচনা করে সেগুলিতে সুরারোপ করেছেন ও নিজ কণ্ঠে গেয়েছিলেন। সংগীত গীতিকার ও সুরকার হিসেবে সম্যক খ্যাত ছিলেন তিনি। তাঁর গানের সংকলনগুলি নজরুলগীতি হিসেবে বাংলায় প্রচলিত হচ্ছে। এরুপ গীতি সংকলনের অন্যতমগুলি হলো, বুলবুল, সন্ধ্যা, চোখের চাতক, নজরুল গীতিকা, নজরুল স্বরলিপি, চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদি। “নজরুল সর্বসমেত প্রায় তিন হাজারেরও বেশি সঙ্গীতের রচনাকার। পৃথিবীতে সঙ্গীত রচনার  ইতিহাসে এর চেয়ে বড় রেকর্ড আমার জানা নেই। রবীন্দ্র-প্রতিভা আনুমানিক দু’হাজারের কিছু বেশি গান রচনা করেছিল।” (নজরুল চরিত-মানস, ড. সুশীল কুমার গুপ্ত।) নজরুলের সঙ্গীত ভা-ারের অমূল্য সম্পদ হলো- ইসলামী সঙ্গীত। এ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট নজরুল গবেষক কবি আবদুল আজীজ আল-আমান তার “নজরুলের ইসলামী সঙ্গীত” প্রবন্ধে বলেন, “বাংলা সাহিত্যের আদি থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার মুসলিম কবি-সাহিত্যিক সম্মিলিতভাবে জাতির আশা-আকাক্সা রূপায়নে যা না করতে পেরেছেন। মাত্র শ’ দুই ইসলামী সঙ্গীত রচনা করে এক নজরুল ইসলাম নিশ্চিতভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছেন।”


‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- এই গানটির জনপ্রিয়তা সমকক্ষ আর একটি গান খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ গানটি ছাড়া বাঙালি মুসলমানদের ঈদুল ফিতর  উদযাপন প্রায় অসম্ভব।  এ গানটি রচনার ইতিহাসটি নিম্নে উল্লেখ করছি।

অমর কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদের ‘গীতিকার নজরুল’ প্রবন্ধে নজরুলের সাঙ্গীতিক প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে উক্ত গানটি রচনার ইতিহাস সম্পর্কে বলেন-
“কুচবিহার কলেজের ছাত্র আমি। স্কুল কলেজ মিলে প্রতি বৎসর মিলাদ করতাম। সেই মিলাদ মাহফিলে কবিকে আমন্ত্রণ করি। সেই থেকে পরিচয়ের সূত্রপাত। তিনি আমার গান শুনে আমাকে উৎসাহ দিলেন। বললেন, “সুন্দর মিষ্টি কণ্ঠ, কলকাতায় চল, তোমার গান রেকর্ড করা হবে।” ১৯৩০ সনে প্রথম গান রেকর্ড করে কুচবিহার চলে আসি। ১৯৩১ সনে আবার কলকাতায় যাই এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি। গ্রামোফোন কোম্পানি রিহার্সেল ঘর তখন চিৎপুর রোডে। শুনলাম- কাজী সাহেব সেখানে রোজই যান। এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, “কাজী সাহেব কোথায়?” তিনি বললেন, “পাশের ঘরে গান লিখছেন।” আমি ঢুকলাম। তিনি মহাউৎসাহে বলে উঠলেন, “আরে আব্বাস, তুমি কবে এলে? বস বস বস।” ... সামনে এগিয়ে গিয়ে কদমবুছি করলাম। তিনি বললেন, “সবাই আমাকে কাজী সাহেব বলে, তুমি কিন্তু কাজীদা বলে ডাকবে আমাকে হ্যাঁ, তোমার জন্য গান লিখতে হয়। আচ্ছা ঠিক হবে।”
“আচ্ছা ঠিক হবে” তো বললেন, কিন্তু যতবারই যাই গ্রামোফোন কাবে ততবারই দেখি তাকে ঘিরে রয়েছেন অনেকে। আমি সংকোচে কিছুই বলতে পারি না। পাশের ঘরে পিয়ারু কাওয়াল রিহার্সেল দিচ্ছেন উর্দু কাওয়ালী গানের। বাজারে সে সব গানের কী বিক্রি। আমি কাজীদাকে বললাম- এমনিভাবে বাংলা কাওয়ালী গান লিখে দিতে পারেন আমার জন্য?” গ্রামোফোন কোম্পানির বাঙালি সাহেব বললেন, “না, না, ও ধরনের বাংলা গান বিক্রি হবে না।” অবশেষে প্রায় এক বৎসর পরে সাহেব রাজী হলেন।  কাজীদাকে বললাম, “সাহেব রাজি হয়েছেন।” কাজীদা তখনি আমাকে নিয়ে একটা কামরায় ঢুকে বললেন, “কিছু পান নিয়ে এসো।” পান নিয়ে এলাম ঠোঙা ভর্তি করে। তিনি বলেন, ‘দরজা বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে বসে থাক।” ঠিক ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে লিখে ফেললেন, ‘ও মন রজমানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।” সুর সংযোগ করে তখনি শিখিয়ে দিলেন গানটা।”

নজরুল সঙ্গীত প্রতিভা সম্পর্কে আভাস পেতে উপরিউক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করলাম।

বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক সাহাবুদ্দিন আহমদ তার ‘বহুরূপে নজরুল’ গ্রন্থে বলেন-

“নজরুলের কবিতার মত নজরুলের সঙ্গীতের যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে সে কথাটা আমি জোর দিয়ে বলতে চাই। এবং আমার ধারণা নজরুলের গানগুলো গীতি হিসেবে নয় সঙ্গীত হিসেবেই পরিচিত হওয়া উচিত। কেননা আসলেই নজরুলের গান ভাব-মিশ্রিত। চিত্র-মিশ্রিত, সুর-মিশ্রিত গান; তাই তাকে গীতি অপেক্ষা সঙ্গীত হিসেবে চিহ্নিত করাই যুক্তিসঙ্গত।
ক্ষণজন্মা এ ভাস্বর ছোট গল্প রচনায় ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর ছোটগল্প গ্রন্থ গুলি হলো, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন ও শিউলি মালা।
সাহিত্যের বৃহৎ শাখা উপন্যাস ও লিখেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত সেই উপন্যাস গুলি হলো, বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা ও কুহেলিকা।


নাট্যকার হিসেবেও নজরুল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর অনবদ্য বিশ্বখ্যাত নাটক গুলি হলো, ঝিলিমিলি, আলেয়া, পুতুলের বিয়ে (কিশোর নাটক), মধুমালা, ঝড়। প্রবন্ধ এবং নিবন্ধের অঙ্গণেও মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করেছেন নজরুল। জ্ঞান বিদগ্ধ সেই প্রবন্ধ এবং নিবন্ধ গুলি হলো, যুগবানী, ঝিঙ্গে ফুল, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র মঙ্গল ও ধূমকেতু।
পবিত্র কুরআন থেকে শুরু করে বিশ্ব সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু গ্রন্থও তিনি সাবলীল অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদ গুলি হলো, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দিওয়ানে হাফিজ, কাব্যে আমপারা ও রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুররু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক- এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। এছাড়াও তিনি লাঙ্গল ও ধুমকেতু পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিষ্ঠার সাথে।
অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর সমসাময়ীক সাহিত্যবোদ্ধাগণ ও হিতৈষী প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্মাননা প্রদান করেছেন। নজরুলের সম্মাননাগুলো হলো, ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতায় অ্যালবার্ট হলে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয়ভাবে সংবর্ধনা জানানো হয়। ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে ‘‘জগত্তারিণী’’ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার নজরুলকে ‘‘পদ্মভূষণ’’ খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট প্রদান করে।


১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে সম্মানসূচক ডি. লিট প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘‘একুশে ফেব্রুয়ারি স্বর্ণপদক’’ প্রদান করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম দু’জনই বাঙালি কবি এবং এ দু’জন বাংলা ভাষায় সৃষ্টি ধর্মী রচনা নির্মাণ করে গেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ একজন নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে এবং নজরুলকে মনে করা হয় নোবেল বিজয়ীদের একজন হওয়া উচিত ছিল, যদিও তিনি নোবেল পাননি। নজরুল ইসলাম মহাকবি হাফিজের ভাবশিষ্য। হাফিজ ও রুমীর প্রভাব তাঁর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়, পহেলা ফেব্রুয়ারি ২০০৬ইং তারিখে ইরানের রাজধানী তেহরানে ‘ফারসি ভাষা ও সাহিত্য সম্প্রচার কেন্দ্র’ মিলনায়তনে ‘‘নজরুল সেমিনার’’ অনুষ্ঠিত হয়; সেখানে হাফিজ ও নজরুলের ছবি পাশাপাশি ছিল। অনুষ্ঠান শুভ সূচনা হয়েছিলো হাফিজ ও নজরুলের কবিতার পঙক্তি দিয়ে।
তাঁকে নিয়ে দেশ-বিদেশে অসংখ্য গবেষণাকর্ম সম্পাদনা হয়েছে, হচ্ছে ও হবে। তাঁর জীবন ও সাহিত্য দর্শন নানামুখী। জীবন সংসারের প্রায় সকল বিষয় তিনি তাঁর সাহিত্য ও গীতিতে ধারণ করেছেন। তেমনি নজরুল জীবন ও কাব্যে ধর্ম মূল্যায়নে নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ‘‘নজরুলকে যারা সরল সহজ কবিতা বা কাব্য লিখিয়ে কবি বলে মনে করেন তাঁদের পক্ষেও এই জটিল রহস্যের উন্মোচন খুব সহজ হবে না মনে করি। এইসব কবিতার রহস্যময় কবিতার মর্মোঘাটন করতে পারবেন তারাই যারা একই সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র বিদ্যার বিশারদ, কাব্যশাস্ত্র বিশারদ, দার্শনিক ও কবি।’’
বাংলা সাহিত্যে মাইকেলই প্রথম বিদ্রোহী কবি। তবে আধুনিক যুগের প্রবক্তাকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্ব ব্যপী বাংলার বিদ্রোহী কবি হিসেবে যিনি খ্যাত তিনিই আমাদের নজরুল। একবার যারা নজরুলের পৃথিবীতে প্রবেশ করেছেন তারা প্রত্যেকে নজরুল আদর্শের সৈনিক হয়ে হেঁটেছেন এবং নজরুলের মতো আজীবন অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। কলম যে বন্দুকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে তা তিনি প্রমাণ করেছেন তার ক্ষুরধার আগুনঝরা লেখনীর দ্বারা। তাঁর কলমকে ভয় করতো ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী, এ জন্যে তাঁর পাঁচটি গ্রন্থ ও বেশকিছু কবিতা, প্রবন্ধ এবং গান ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। যে পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, সেগুলো হলো-(১) যুগবানী, (২) বিষের বাঁশি, (৩) ভাঙার গান, (৪) প্রলয় শিখা এবং (৫) চন্দ্রবিন্দু। নজরুল যেমন তাঁর আসল দুশমন চিনেছিলেন, এ জন্যে সেই দুশমনরা তার পেছনে লাগিয়েছিল গোয়েন্দা, তাকে পাঠিয়েছিল এই সুন্দর বসুন্ধরার ফুলে-ফলে ভরা সবুজ-শ্যামল গাছপালার অক্সিজেনযুক্ত আলো-বাতাসের পরিবেশের পরিবর্তে-হতশ্রীর আবছা আলো আবছা আঁধারে নিমজ্জিত কারাগারে। কিন্তু তারা (ব্রিটিশ শাসক) অসির চেয়ে ধারালো শক্তিশালী নজরুলের কলম বন্ধ করতে পারেনি। তিনি কারাগারে থেকেই ডাক দিয়েছিলেন-
‘‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকল পুজোর পাষাণবেদী
ওরে ও তরুণ ঈশাণ, বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদী’’

ভয়ঙ্কর-নিষ্ঠুর অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে এতকঠোর ভাষায় ইতিপূর্বে আর কোনো ভাঙালি কবি রুখে দাঁড়াননি।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলতে পারি যে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর হতে শিখিয়েছেন ও বজ্র্য কণ্ঠ হতে প্রেরণা যুগিয়েছেন। সাথে সাথে মানবতার প্রেমকে বুকে ধারণ করে সকলকেই ভালোবাসতে ও সমানচোখে দেখতে বলেছেন। তাঁর জীবনী ও সাহিত্য চর্চায় আমরা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে থাকা জরাকে ছুড়ে প্রগতির দিকে ধাবিত হই। তাইতো তাঁকে বাংলা সাহিত্যের চির ভাস্বর কবি বলা যুক্তিযুক্ত।