ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১২৭

ই-পেপার  : ধানশালিক  : সংখ্যা ১২৭
তারুণ্যের শিল্প সরোবর । । ধানশালিক ।। সংখ্যা ১২৭
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৯

















এখনো অনেক ক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে : ওলগা তোকারচুকের [সাক্ষাৎকার]

এখনো অনেক ক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে  : ওলগা তোকারচুকের [সাক্ষাৎকার]


এখনো অনেক ক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে !
 ....ওলগা তোকারচুকের

ওলগা তোকারচুক ও পিটার হ্যান্ডকে সম্প্রতি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের জন্য ওলগা তোকারচুক আর ২০১৯ সালের জন্য পিটার হ্যান্ডকে মনোনীত হয়েছেন। চলতি বছরের প্রারম্ভে লিটারেরি হাব'র জন ফ্রিম্যান লেখিকার সাথে তার উপন্যাস ফ্লাইটস নিয়ে কথা বলেছিলেন, মঞ্চে যেখানে অনুবাদক জেনিফার ক্রফট উপত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাঙলায়ন করেছেন মীম মিজান ।
জন ফ্রিম্যান: ফ্লাইটস মহাশূন্যে ও সময়ে বুদ্ধিদীপ্ত এবং রহস্যজনক ভাবে ঘুরছে। আপনি আটটি উপন্যাস, দু’টো ছোটগল্প সংকলন লিখেছেন। এগুলো কি শুধুমাত্র সেধরণের বই যা আপনি লিখতে পারেন? এটাকে সুযোগ দিয়েছেন; এবং কত ভ্রমণ এখানে সম্পৃক্ত; একবার ভ্রমণের সময় কি আপনি অদৃশ্য হওয়ার অভিজ্ঞতাটি পেয়েছিলেন? আমি উদগ্রীব, আপনি যদি সে বিষয়ে কিছু বলতেন?
ওলগা তোকারচুক: আমি যতক্ষণ না বুঝলাম যে ভীতিপ্রদ থাকা ভালো ততক্ষণ পর্যন্ত অদৃশ্য ছিলাম। হাসি অতঃপর সকলেই আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এবং জিগ্যেস করলো, কী হয়েছে?, অতঃপর আমি বর্ণনা দিলাম যে, এটা অনেক পুরাতন, পোলিশ চুলের স্টাইল। এটা এরকম যে, খুবই দেশীয় এবং সেরকমই। কিন্তু চোখ, আমি মনে করি নারীরা তাদের চল্লিশ পার করেছে, তারা অদৃশ্য জগতের একটি অংশ হয়ে গেছে। আর এরকমটিই আমি আমার বইয়ে বর্ণনা করেছি, এই অস্তিত্বের অবস্তার খুবই ভালো এবং আঁধার দিক ছিলো। ভালোটি হয়েছে যে, আপনাকে একজন উত্তম বর্ণনাকারী হতে হবে কেননা কেউই খেয়াল করবে না যে আপনি তাকে দেখছেন। তাই তুমি মুক্ত চোখের মতো, কোনো সম্মতি ছাড়াই গোটা পৃথিবীতেই ভ্রমণ করছেন বা সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছেন। এমনকি কোনো সতর্কতার বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। তাই এটা খুবই ভালো একটা অবস্তান।
জ ফ্রি: এই বইটি রূপকথায় পূর্ণ যা অনুভূত হয় সামগ্রিক ও প্যাঁচানো মতো। যেমন নবতর আবিষ্কার ও বলা যা আমাকে বিস্মিত করেছে। আপনি যদি কোনো একটা সুত্র দেন। কেননা বিভিন্ন বিষয়ে গল্পকথক একটি অপরিচিত বিদেশী শহর আর একজন পর্যটকের সাথে কথাবলা বন্ধ করে দিয়েছে। আপনি কি সেই প্রকৃত অবস্তার সত্যাসত্য আবিষ্কার করেছেন অথবা এবইয়ের অনেক ঘটনা বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর?
ও তো: একজন পর্যটক হিশেবে আমার প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার উপর অধিকাংশই। কিন্ত শেষান্তে নয় কেননা এবইয়ের গল্পকথক কল্পিত, সাজানো। তাৎক্ষণিকভাবে, প্রথম জিনিশটি হয়েছে একটি নক্ষত্রপুঞ্জের উপন্যাস লেখা। উপন্যাসটি ক্ষুদ্র বিষয়ের উপর নির্মিত। আপনার এমন কিছু বিষয় থাকতে হবে যা স্থায়ী। এই বইয়ের একটি স্থায়ী দিক। প্রথম থেকেই আমি অনুভব করেছি যে, এটাকে একজন পোক্ত গল্পকার হতে হবে। আর অবশ্যই আমি আমার নিজের ভিতর থেকেই এই গল্পকারকে সৃষ্টি করেছি, আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে, আমার যোগ্যতা ও অনুরূপ বিষয় থেকে।

কিন্ত আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এই গল্পকথককে অবশ্যই এমন কিছু উপাদানের হতে হবে যা এই বইয়ের প্রারম্ভের অনুচ্ছেদে আমি এই গল্পকথকের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টে উপস্থাপন করেছিলাম। তাই পাঠকেরা গল্পকথকের অবয়ব, উপাদান, শারীরিক অঙ্গের বিস্তারিত জানতে পারবে। এটা নিশ্চিত হতে যে, গল্পকথক বাস্তব। হ্যা, এসব আমার নিজস্ব ঢং ছিলো। তবে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে বাইরে রেখে অন্য একজনকে উপস্থাপন করার চেষ্টায় ব্রতি হয়েছিলাম। আর এটা লেখকের এক ধরণের স্বাধীনতা, যা সত্যিই আমি ভালোবাসি। এটা খুউব সম্ভবত এজন্য যে, আমি নিজেকে একজন মনোবিজ্ঞানী নয় লেখক হিশেবে উপস্থাপন করতে চাই।
জ ফ্র্রি: আমি জানতে আগ্রহী। ওলগা, আপনি যদি আপনার জীবনের সর্বপ্রথম ভ্রমণটির কথা বলতেন!
ও তো: যখন আমি শিশু ছিলাম আর যেসময় আমি বেড়ে উঠছিলাম যা বর্তমান সময় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। শিশুরা যেমন মুক্ত থাকতো। তারা উঠোনে যেতে পারতো, পার্ক থেকে বেশ দূরে যেখানে আমাদের চারপাশে কোনো অভিভাবকভীতি ছিলো না। আমি জানি না, এটা সম্পূর্ণই এক ভিন্নজগত ছিলো। একজন ছোট্ট বালিকা হিশেবে আমার নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার করতে খুউব ভালো লাগতো। আমি ছোট্টবড় অনেক শিক্ষাসফর করেছি। সেগুলির মধ্যে অন্যতম একটি ছিল ওডার নদীতে গমন। যেটা আমাদের এলাকার দু’কিলোর ভিতরেই ছিলো। তাই আমার বাড়ি থেকে প্রায় একমাইল।
আর আমার জীবনে প্রথম একটা অনুভূতি জাগলো যে আমি একজন বিজয়া। যা খুবই সাহসী কোনো ব্যক্তি বা নতুন কিছু কেউই আমার জন্য পূর্বে করেনি। একজন শিশু হিশেবে আমার সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা ছিলো। এভাবেই বিশ্বকে আবিষ্কার করা এবং নিরাপদ করা আর বিশ্বাসযোগ্য করা।
তাই আমি মনেকরি, এখনকার শিশুদের তাদের চারপাশের বিষয়াদি আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা নেই। আমার স্পষ্ট এখনো মনে আছে, যখন আমি নদীতে পৌঁছলাম নদীতে প্রচুর অয়ন আর কুহক ছিলো। এটা কিছু ছিলো। নিজেকে বললাম, আমি এটা করেছি। এটা মাত্র একমাইল ছিলো কিন্ত মানবিকতার জন্য ছিলো বিশাল ধাপ হাসি।
জ ফ্র্রি: এই বইটিতে এমন কিছু উপাদান সম্পর্কে বলা হয়েছে, জল যেগুলিকে আগমনী করে রেখেছে আর তিমি যারা সমুদয় বইয়ে সাঁতার কেটেছে। এটা আদপেই একটা বাস্তব ভ্রমণের অনুভূতি দেয়। ক্লাসিকাল ধারণায় পানিতে ভ্রমণ করে অথবা সমাপ্ত হয়। আপনি কি বিশ্বাস করেন যে, এখানে কিছু মিথ্যা আছে? যেগুলি আমরা নানাভাবে বিশ্বাস করি?
ও তো: হ্যা, অবশ্যই এটা। এটাই আমদের অবচেতনতার রূপক। এটা তুচ্ছ কিন্ত আমি মনেকরি এটা কাজ করছে: জল একটি সীমানা, একটি সীমানার চিহ্ন যা আমরা অতিক্রম করতে পারি। জাহাজ, নৌকো এগুলো আরেকধরণের চিহ্ন। তাই আমি মনেকরি জল অতিক্রম করা এখনো সাধারণ সচেতনতা, মার্কিনীদের উপলব্ধি।
আপনি আমাদের ইউরোপিয়ান প্রেক্ষিত থেকে জলের পিছনে। কিন্ত এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর পানিও সমান্তরাল, খানিক ভয়ানক, কিন্ত কিছুটা ফলপ্রসুও, আমাদেরকে সেই শক্তি দেয় যার দ্বারা চারাগাছ জন্মে।
তাই এটা একটা অন্তহীন অর্থের পাত্র। আর আমার ক্ষেত্রে, আমি মনেকরি যখন আমার শৈশবের মানচিত্রে আবিষ্কার করেছিলাম, অনেক ছোটবেলায় নদীর আকৃতি আর মানব দেহের স্নায়ুর আকৃতি হুবহু পেয়েছিলাম। এই বইটি ফ্রাক্টালিটির অনেক গহীনে চলেছে। আর এটাই বৃহৎ কিছু যা সবথেকে ক্ষুদ্রটির সমতুল্য। তাই আমরা ক্ষুদ্র বিশ্বে বসবাস করছি, যা আপনি জানেন যে অনেক কিছুর সাথে সম্পৃক্ত, অনেক পয়েন্টে তাই এটা ফ্রাক্টালিটির ধারণায় কিছুটা অধিবিদ্যাজাত।
জ ফ্রি: আমি জানতে চাই, এই বইটির গভীরে যাওয়ার পূর্বে আপনি মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছেন, আর তাই গল্পকথকের জীবনকে আবিষ্কার করেছেন। আর জাঙ, যাকে আমি পড়েছি তিনি কি আপনার জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কোন পন্তায় আপনার গল্পবলার উপর প্রভাব ফেলেছে?
ও তো: আমার মা পোলিশ সাহিত্যের একজন শিক্ষিকা ছিলেন। আমিও ছিলাম সাহিত্যের পাঠ নিতে আগ্রহী এবং সাহিত্যকেন্দ্রীক জীবন গড়তে একপায়ে খাড়া যেমনটি তিনি ছিলেন। কিন্ত হঠাতই তার সাথে আমার বয়ঃসন্ধিকালীন একটা ঝগড়া হয়। আমি পিতা-মাতার বিরুদ্ধাচরণ করলাম। প্রকৃতই মন তাতে শান্তি অনুভব করল। সিদ্ধান্ত নিলাম সাহিত্য পড়বো না। আর সাহিত্য নিয়ে কোনো কাজও করবো না। মনোবিজ্ঞান আমার ছিল, সত্যিই গভীরতর। আর আমিও সম্মত হলাম মনোবিজ্ঞান পড়তে। কিন্ত আপনার মনে রাখতে হবে যে এটা ছিল পোল্যান্ডে আঠারোর প্রারম্ভ। সত্যই এটা গভীর আঁধারের কাল ছিল। সেনা শাসন, দোকানে পণ্য নেই আর সাধারণভাবে গোটা পোল্যান্ড দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়া। তাই মনোবিজ্ঞান ছিল বাস্তবতা থেকে খানিক পালিয়ে বেড়ানো। মাধ্যমিকে অবশ্য আমি সিগমান্ড ফ্রোড পড়েছিলাম যা আমার উপর প্রভাব ফেলেছিল সেখান থেকেই মনোবিজ্ঞান।
আমি খুবই সাধারণভাবে চিন্তা করতাম যে, আমার সমগ্র পড়াশুনোই হবে সিগমান্ড ফ্রোড।
অবশ্যই না, কেননা এটা ছিল কমিউনিস্ট এবং প্রতিষ্ঠানের অধীনে, বিশ্ববিদ্যালয় জগৎ এমনকি মানুষের ব্যবহারিক বিষয়াদির উপর মনযোগী হলাম, মানুষকে বুঝতে বা উপলদ্ধি করতে শিখলাম। কিন্ত মনোবিজ্ঞান পড়ে আমি অতি দ্রুতই গ্রাহক এবং রোগীদের সাথে কাজ করা শুরু করলাম। আমি অনেক আগে থেকেই স্বেচ্ছাসেবক ছিলাম। আর সেখানেই ঢের আবিষ্কার করলাম: বাস্তবতাকে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকেই হৃদয়াঙ্গম করা যায়।
সম্ভবত এই একবিংশ শতাব্দীতে এটাকে মামুলি জ্ঞান করবে। কিন্ত অনেকবছর আগে এটা আমার জন্য একটা বিপ্লব ছিল। তাই এখানে কোনো নৈর্ব্যত্তিক কিছু নেই। কিন্ত আমরা এসকল দৃষ্টিকোণ থেকে অনুভূত হতে পারি। আর আমার মনে আছে, আমার প্রথম গ্রাহক- সেটা একটা পরিবার ছিলো। সেখানে দু’জন ভাই পেয়েছিলাম। তারা আমাকে তাদের পরিবারের গল্প বলতো। তারা তাদের গল্পবলা দিয়ে ওরকম পরিবারগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারনা আমার ভিতর জন্মিয়েছিলো। অতঃপর আমি বলেছিলাম, আচ্ছা? এটা বলতে কী বুঝায়? আমি মনেকরি, সেটাই ছিলো আমার লেখার প্রথম ধাপ। আমাকে এখনো লেখা জোরাজুরি করে সমাজের বিভিন্ন লোকের বাস্তবিক জীবনথেকে নেয়া উপাদান ও দৃষ্টিকোণ নিয়ে লিখতে যা প্রকৃতই অসংখ্য মানুষের কথা। আর লেখক হিশেবে আমাদের খুঁজে নিতে হবে নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ যা পরিপেক্ষিত বদলে দিবে, যা দেখাবে সেখানে নতুন কিছু আছে যা আমরা অনুভব করছি। বুঝতে পেরেছেন- বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলছি?

জ ফ্রি: প্রকৃতই স্পষ্ট। এই বইয়ের ব্যাপারে কী উল্লেখযোগ্য? এই কণ্ঠ কি আপনাকে পথনির্দেশ করে? অতঃপর তারা চতুর্দিক ঘিরে নেয়। প্রত্যেকজন পাঁচজনের জন্য ভ্রমণ করে। মাঝেমধ্যে কিছু পৃষ্ঠা, মাঝেমধ্যে অনেক...
ওলগা, এই বইয়ে মানবজাতির বিভিন্ন প্রকার নিয়ে অনেক নমুনা আছে। এটা কি ফরমালডিহাইড অন্তর্ভূক্ত অথবা কলায় নকল? যদিও তারা বিচ্ছিন্ন। আমি জিজ্ঞাসু যে- আপনি স্পষ্টতই আন্তরিকভাবে শরীরবিষয়ে আগ্রহী।
যখন আপনি এইগুলিকে রূপকশোভিত ও অধিবিদ্যার সাথে সংযোগ স্তাপন করতে চান উড্ডয়ন ও নড়াচড়ার প্রশ্নে, এবং এর জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করেন। কেননা আমার কাছে মনে হয় ঐ সংযোগ কখনওই তৈরিকরা সম্ভব নয়। মহাশূন্য ও সময়ে আমাদের জীবনকালে দৈহিক বৃত্তের, আর এটাকে নমুনা করে মৃত্যুহীন করার আমাদের যে প্রত্যাশা, আর পৃথিবীতে আমাদের নড়াচড়া এবং উপায়টি আমাদেরকে অন্তহীন অনুভূতি দেয়।
ও তো
আমি আশা করছি, এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারবো। কিন্ত সত্যি কথা বলছি, কখন এটা ঘটেছে আমি ভুলে গেছি, যখন আমি এই দুটো জিনিশকে একত্র করছিলাম। আমি মনেকরি, বইটি বারো বা তেরোবছর পূর্বে লিখিত। আমার মধ্যজীবনের সংকট থেকেই এই চিন্তার উদ্ভব বলে ভাবছি। আমার মনে হচ্ছে বিশ্রামকক্ষে আমি অপেক্ষারত। ডাক্তারের কাছে আমি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবো। যেমন, রক্ত পরীক্ষা ও তৎসংশ্লিষ্ট। সেখানেই আমি ভাবলাম যে আমিতো মহাবিশ্বের অনেককিছুই জানি। জানি আমাজনের ভিতরে কী কী আছে। এরকম আরো অনেক। কিন্ত আমার ভিতরে যকৃত কিভাবে কাজ করছে তাই জানি না। আমার পাকস্তলীর বর্ণ ক্যামন? আমার ত্বকের নিচেই শিরা-উপশিরাগুলি কিভাবে যাচ্ছে। আমি অনুভব করলাম যে, এটা জানার এক জঘন্য ঘাটতি। এবং অবশ্যই কিছু ভয়ানক ব্যধি হবে যা আমরা আমাদের শরীর থেকে জ্ঞাত হই না। অতঃপর ভ্রমণ করলাম আর এই বইয়ের জন্য গবেষণা করলাম। অবশ্য আমি এই ঘোরলাগানোগুলি সমস্ত নেদারল্যান্ডসথেকে সংগ্রহ করেছি যা বইটিতে প্রথিত। তারা তিনশো বছর আগের অনুভূত হতে লাগলো একই রকম অনুভূতি আমি এই বিশ্রামকক্ষে পেতে লাগলাম। তাই কী হচ্ছে আমাদের শরীরে? ক্যানো এটা আমাদের কাছে এধরণের রহস্যময়। অতঃপর আমি শরীরবিজ্ঞানের ইতিহাস পড়তে লাগলাম। প্রভুর নিকট কৃতজ্ঞতা যে আমি সেসময় আমস্টারডামে স্কলারশিপ নিয়ে গবেষণা করছিলাম। আর এবিষয়ে একবছর গবেষণা করলাম। আর এ বইটির খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট আমার দুর্ঘটনার মাধ্যমে আবিষ্কৃত হলো যে, একই সময়ে ১৫৭৪ সালে দুটো বড় বই আবির্ভূত হয়েছিলো, প্রকাশ হয়েছিলো। প্রথমটি হচ্ছে অন্যতম বিখ্যাত বই যাতে আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে মহাবিশ্বেরগঠন আর কিভাবে কাজ করছে। সামসময়িক কালে প্রকাশ হলো ভেসালিয়াস’র এটলাস অব হিউম্যান বডি। তাই পৃথক দুটো পয়েন্ট আর বছর সেই দুটো অনুবিশ্ব ছিলো সম্পৃক্ত।
আর অবশ্যই এই বইটি স্বজ্ঞার উপর ভিত্তি করে। তাই মাঝেমধ্যে আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে কিভাবে এটা সাজানো হয়েছে বা কী বুঝাতে চেয়েছি। কিন্ত হ্যা, এটাই এধরণের বই লেখার রহস্য যাতে আপনাকে আপনার স্বজ্ঞাকে বিশ্বাস করতে হয়। আর মাঝেমাঝে এই স্বজ্ঞা খুবই নিঠুর হয়। আর কিছুসময় আপনার মনে হবে আপনার ঘোরলেগেছে অথবা খুউব সম্ভবত আপনি রোগাক্রান্ত। যাহোক, আপনি এগিয়ে যাবেন।
জ ফ্র্রি: বইয়ের ভিতরের একজন শরীরবিজ্ঞানী শরীরব্যবচ্ছেদের পর, আমি ভুলে গেছি যে এটা মানুষ না পশু ছিলো- এটা এরকম যে পুনঃনিশ্চিত হওয়া আসলেই সে শরীরটি মাত্র একটি কলকব্জা। আর আমি আশ্চর্য যদি আপনি সেটার সাথে ঐক্যমত্য হন। আমি দেখেছিলাম একজন মারা গেলো আর আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিলো, আহ! এটা একটা পবিত্র মেশিনের মত, আর সেটাই ছিল শীতলতার ধরণ। কিন্ত আপনি সম্মত নন?
ও তো: না, আমি সম্মত নই। আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, এটা সম্পূর্ণ কক্ষপথীয় দৃষ্টিকোণ। যেমন আলোকিত হওয়ার প্রারম্ভিক কাল। যখন লোকেরা পৃথিবীকে কলকব্জা, খেলনা আর আচরণিক রীতির সমষ্টি হিশেবে ভাবতে শুরু করলো। কিন্ত আমি মনেকরি, এটা এখনো রহস্যময়। আমরা জানি না, যদিও আমাদের বিজ্ঞান আছে এবং আমরা কমবেশি জানি কিভাবে মস্তিষ্ক কাজ করছে। এখনো অনেক ক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। আমরা এখনো জানি না আমাদের সমকালের বড় বড় প্রশ্নগুলি। ক্যামন সতর্কতা কাজ করছে, এটা ক্যামন করে কাজ করছে? ক্যানো আমাদের এই অনুভূতি যে, আমরা অবশিষ্টাংশ বাস্তবতা থেকে মুক্ত? ক্যানো আমাদের এই অনুভূতি যে, আমরা একে অপরের থেকে পৃথক? হ্যা, আমি বলবো বোধ এখনো কিছু কিছু অস্পষ্ট।
জ ফ্র্রি: সেখানে প্লেনে একজন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নিয়ে একটি দৃশ্য আছে যিনি অন্ধকার বিষয়ে পড়াশুনো করছেন। এই বইটি অনেক সতর্কমূলক তথ্যদ্বারা পূর্ণ। আর সেই কথোপকথনে একটি অংশ হচ্ছে যে, এই মহাজগতে দৃশ্যমান বিষয়াবলীর থেকে অনেক অন্ধকার বিষয় আছে। আর তারপর পদার্থবিদ বাতায়ন দিয়ে বাইরে তাকায় এবং বলে, আমরা এটাও জানি না যে, কেনো এটা এখানে? অথচ উড়োজাহাজটি তখনো সেটির মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছিল। আর আমি আশ্চর্য হলাম- ওরকম তথ্য প্রশ্নের উত্থান করে যে, আমাদের এই চাঁদ ও অন্যান্য জ্যোতিষ্কদের আপাত ভ্রমণপথ মহাবিশ্বজুড়ে? এটা কি রহস্যের উপর স্থাপিত যা কিছুটা বিশ্বাস্য? মহাবিশ্বের প্রসন্নতার উপর বিশ্বাস অথবা এটা খুবই শিশুসুলভ?
ও তো: আমি জানি না। একজন লেখক হিশেবে আমার সাহসিকতা আছে প্রশ্ন করার, উত্তর খোঁজার নয়। কেননা তখন আমাকে আমার পেশা বদলাতে হবে আর একজন বিজ্ঞানী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এটাই সবথেকে উত্তম স্বাধীনতা লেখক হবার। শুধু জিগ্যেস করো আর বিস্ময়কর জিনিস দেখাও। হ্যা, অনুগ্রহ করে এই বইটি পড়ার চিন্তা করবেন। কেবল নিজেকে জিগ্যেস করবেন, কী হচ্ছে?
জ ফ্র্রি: আমি আরো একটি অথবা দু'টি প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, আর আমি ভাবছি আপনিও এরকমটি ভাবছেন। ফ্লাইটস সম্পর্কে একটি অবিশ্বাস্য বিষয় যে, কীভাবে খুব দ্রুতই এটি কতটি ভিন্নতর অস্তিত্ব তৈরি করছে। আর তাই বিশ্বাস্য। অতঃপর এমনভাবে এটিকে তুলে ধরে যে এটা খুবই সহজ বিষয়। এটা এমন একধরণের চলে যাওয়ার সময়কার এক পলকের চোখাচোখি যেখানে প্রকৃত আগ্রহী লোকদের সাথে মিথস্ক্রিয়া হয় যখন কোনো বিমানে উড্ডয়ন বা ট্রেনে গমনের সময় বিশ্রামাগারে তাদেরকে শুভ বিদায় বলতে হয়। তাদের কয়েকজনের বিষয়ে চিন্তা, একজন ব্যক্তি ছুটির দিনে ক্রোয়েশিয়ার কাছে একটি দ্বীপে তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে গেছেন। স্ত্রী ও শিশুটি নিখোঁজ হয়েছে।
সেখানে একজন ব্যক্তি যার পা কাটা। অধিকন্ত তার আছে আবছায়া পায়ের চিহ্ন। আরেকজন ব্যক্তি যার ঘোর আছে যোনিমুখের বিষয়ে আর সে ছবি তুলছে। আমি মনে করি, অপ্রাপ্ত বয়সী বালিকা। আবার একইসঙ্গে শরীরবিজ্ঞানের উপর গবেষণা করছে। এটা এরকম যে সে অনুসন্ধানী। আর এ বইয়ে অনেক ব্যক্তিই নিখোঁজ বিষয়াদির খোঁজ করছে। আর আমি বিস্ময়াভিভূত হব যদি আমাদের কল্পনার অনুপ¯ি’তি সম্পর্কে বলেন। আর কখন সেই কল্পনা ভেঙে পড়ে এবং তাক লাগায়? কেননা আমি মনেকরি, ঘোরলাগানো কল্পনার বিপরীত। তাকলাগানো একটি বাক্যকে বারংবার ব্যবহার করা। যেখানে কল্পনার কিছু বর্ণনা আছে।
ও তো: আমি আপনার সাথে সহমত নই। আমি মনেকরি তাকলাগানো একটি কল্পনা। কেননা সহানুভূতি পুনরাবৃত্তি। কিন্ত তাকলাগানো- আমি না, তাকলাগানো ছাড়া এই বইটি লেখা একবারেই অসম্ভব।
জ ফ্রি: আমিও তাই মনে করি! হাসি
ও তো: হ্যা, এমনকি আমার ভিতরে অনেকগুলো ধর্মানুষ্ঠান আছে যা আমাকে ঘোরলাগানোয় রেখেছে। আপনি জানেন যে, পথে এটা একধরণের সম্মোহন। আমার জীবনের সবথেকে বড় ঘোরলাগানো বিষয়টি আমি জ্যাকব'স বুক'এ লাগিয়েছি। দীর্ঘ আটবছর মেয়াদি ঘোর। আপনি কি ভাবতে পারেন? শুধুমাত্র আঠারো শতক সম্পৃক্ত বিষয়াদি পাঠে, শুধুমাত্র ইহুদি এবং ইহুদি সম্পর্কিত সংস্কৃতির আর ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা এবং মধ্য ইউরোপের আলোকিত হওয়ার প্রারম্ভ। কিন্তু এটা খুবই খুবই ঘোরলাগানো ছিল। প্রভুকে ধন্যবাদ যে আমি এটাকে জীবিত করেছি আর ঘোরলাগানোটির ফলই ছিল বইটি। তাই আমি প্রকৃতই ঘোরলাগানোতে বিশ্বাসী। এটা খুবই ইতিবাচক কিছু। আমরা জানি যে, ঘোরলাগানো এমনকিছু যে আমাদের নাশ করতে পারে। কিন্ত আমার দৃষ্টিতে ঘোরলাগানো হচ্ছে একটি বিন্দুতে শক্তি রাখা। আর এটা ঝামেলাপূর্ণ হতে পারে কিন্ত এটা খুবই ফলদায়কও।
জ ফ্র্রি: ওটা অবশ্য প্রার্থনার এক ভালো বর্ণনা, একটি পয়েন্টে শক্তি ধরে রাখা। যখন আমি এই বইটি পড়েছি দেখেছি যে, সেখানে অনেক লোক আপাতত আধ্যাতিœক খোঁজে। একজন ব্যক্তি ভারতে যেতে চান, কেননা সে সেই বৃক্ষটি খুঁজে পেতে চায় যেটির নিচে বুদ্ধ তার নির্বাণ পেয়েছিলো। আর সেখানে এমন কিছু লোক আছে যারা কথা বলছে অথবা জিগ্যেস করছে- আমি মনেকরি, প্রার্থনা প্রভু সম্পর্কে একটি প্রশ্ন করা আর কুবচন প্রভুর সাথে কথাবলা। আর এই বইটি পড়ে আমার মনের ভিতর একধরণের অদম্য ইচ্ছা জেগেছে আপনাকে জিগ্যেস করতে যে, আপনি কি প্রভুতে বিশ্বাস করেন?
ও তো: থেমে কোন ধরনের প্রভু? হাসি
জ ফ্র্রি: দেখুন, এটা এই বইটির প্রদর্শন! হাসি না, আমি বিশ্বাস করি না আমি বড় কিছু জানতে চেয়েছি, গাদিগাদি পুস্তকের সাথে লম্বা শ্মশ্রু আর বিদ্যুতের ঝলকানি, শাস্তি আর লজ্জা। কিছু শৃঙ্খলিত দৃষ্টিশীল শক্তি ধরনের-?
ও তো: হ্যা, নিশ্চয়তার জন্য। অবশ্যই আমি একজন বিশ্বাসী। কিন্ত নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, আমি মানবজাতির মতো একইরকম কিছুতে বিশ্বাসী নই। নিশ্চয়তার জন্য, না। সম্ভবত সে অথবা তিনি বা এটা বুঝেই না যে তার বা ওটার সম্পর্কে আমরা কী বলছি।
জ ফ্র্রি: একটা শেষ প্রশ্ন। যখন থেকে এই বইটিকে ফ্লাইটস বলা হচ্ছে, এটা আমাকে ভ্রমণে আগ্রহী করেছে কেননা এটি পবিত্র স্থানের যাত্রী হিশেবে ভ্রমণ নিয়ে অনেক কিছু বলেছে। আর যখন আপনি আপনার নিত্যদিনের গতায়াতে দেখবেন যে, একজন পবিত্র স্থানের ভ্রমণকারী হিশেবে সহসা ভিন্নভাবে পথের মধ্যে আবর্জনা। আর যদি আমরা উভয়েই বিশাল বড় শহরের বহির্গমন বোর্ডের সামনে দাঁড়াই, যেখানে আপনি দেখতে পাবেন একটি প্রায়ই অন্তহীন বোর্ড, সেই শহরটির নাম কী? কোনটি আপনাকে উড্ডয়নে সবথেকে বেশি টানবে?
ও তো: আমাকে খানিক ভাবতে হবে। প্রকৃতই আমি জানি না। এই দশ-বারো বছরে আমার অনেক হয়েছে। আর এখন পোল্যান্ডের দক্ষিণাংশে আমার একটি বাড়ি আছে যা ইউরোপের মানচিত্রে একটি ক্ষুদ্র লেজ। আর ইতিহাসে পোল্যান্ডের এই অংশটি কখনওই পোল্যান্ডের ছিল না। আমরা এই অংশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়াল্টা চুক্তি থেকে উপহার হিশেবে পেয়েছি। কেননা আমরা অনেক হারিয়েছি। পূর্বের জমি, আপনি জানেন। তাই আমি সেখানে বাসকরি আর সেখানে আমার একটি পুরনো বাড়ি আছে। আর সেই বাড়িটি এখন সংস্কারাধীন। আর প্রত্যহ আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমার স্বামীকে ফোন করে ছাদ, পাইপ, বাতায়ন আর এরকম কিছু সম্পর্কে জানতে চাই। তাই, আমি মনে করি আমি যদি- আমি স্বপ্ন দেখি সেখানে ফিরে যাওয়ার আর এসকল সংস্কারের দেখভাল করার। (হাসি) এক সম্পূর্ণ ভিন্নতর নির্দেশনা!

এক শিশি আতর

এক শিশি আতর


এক শিশি আতর
প্রকৌ. আমিনুল ইসলাম

আশিক চট্টগ্রাম যাবে। আগামীকাল তার এক বন্ধুর ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান। সে কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে এলো। বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। বাসটি কাউন্টারের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আশিক বাসের সুপারভাইজারকে বলল, ‘ভাই বাস কখন ছাড়বে?’
‘স্যার, জলদি উঠেন। গাড়ি এখনই ছেড়ে দিবে।’
‘ভাই, পুরো গাড়ি ফাঁকা দেখছি।’
‘স্যার, আপনি সিটে গিয়ে বসেন, যাত্রী কম হলেও গাড়ি ছেড়ে দিবে।’
আশিকের সিট নম্বর ই-ফোর। সে তার সিটে গিয়ে বসলো। ই-ফোর হলো মাঝামাঝি সিট, যেখানে ঝাঁকুনি কম লাগে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অনেক লম্বা জার্নি। মাঝের সিট হওয়ায় সে একটু আরামে যেতে পারবে। তাছাড়া গাড়ি এক্সিডেন্টে মাঝের সিটে ঝুঁকি কম থাকে। বাসের সুপারভাইজার আশিকের কাছে এসে বলল, ‘স্যার, আজ যাত্রী কম, আরামে যাবেন।’
‘যাত্রী কম কেন, ভাই?’
সুপারভাইজার মাথা নিচু করে বলল, ‘জানি না, স্যার।’
সুপারভাইজার সবকিছু জানে। ইচ্ছা করেই কারণটি বললো না। যাঁরা এখন গাড়িতে বসে আছেন কারণটি জানলে তাঁরাও নেমে যাবেন। তখন ড্রাইভার আর হেল্পারকে খালি গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম যেতে হবে।
গতকাল এই বাস পরিবহনের মালিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। দুটি গাড়ি থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপার পুলিশের কাছে স্বীকাররোক্তি দিয়েছে যে এই মাদক পাচারে গাড়ির মালিক জড়িত আছেন। এই খবরটি আজ সকল পত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো হয়েছে। আশিক আজ পত্রিকা পড়ার সময় পায়নি। তাই বিষয়টি জানে না। যেসব যাত্রী টিকেট কেটেছিল তাদের বেশিরভাগই টিকেট ফেরত দিয়েছেন। তাই গাড়িতে অল্প কয়েকজন যাত্রী হয়েছে। পুলিশ জায়গায় জায়গায় বাস থামিয়ে চেক করছেন। অনেক যাত্রীর অভিযোগ আছে- পুলিশ তাদের হয়রানি করছেন। যাত্রীদের হয়রানির কথাগুলো একটি টিভি চ্যানেলে প্রচার করেছে। এখন যেসব যাত্রী বাসে বসে আছেন তারা কেউই খবরটি জানেন না।
বাসটি পাঁচজন যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। আশিক অবাক হচ্ছে- এই কয়েকজন যাত্রী নিয়ে বাসটি সায়দাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করায়। বাসটি যাত্রাবাড়ী পৌঁছতেই পুলিশ থামিয়ে দিলো। রাস্তায় অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের একজন কনস্টেবল ও একজন অফিসার গাড়ির ভিতরে উঠলো। তারা সব যাত্রীকে তল্লাশি শুরু করলো। পুলিশ অফিসার আশিকের কাছে এসে বললেন, ‘আপনার ব্যাগ বের করে দেখান।’
আশিক তার মাথার উপর থেকে ব্যাগটি বের করে পুলিশের হাতে দিলো। পুলিশ অফিসার ব্যাগটি আবার আশিককে দিয়ে বলল, ‘ব্যাগটটি খুলে দেখান।’
আশিক তার ব্যাগ খুলে দেখাচ্ছে। পুলিশ ব্যাগের ভিতরে দুই-তিনটি কাপড় ও একটি বই পেয়েছেন। পুলিশের কনস্টেবল বলে উঠলো, ‘স্যার, এই লোকটা খুবই সন্দেহজনক। দেখেন তার চেহারাটা, চোর চোর ভাব। চোখগুলোও লালচে। মনে হয় ইয়াবা খোর।’
পুলিশ অফিসার আশিককে বললেন, ‘আপনার নাম কি?’
‘আশিক।’
‘শুধুই আশিক?’
‘আশিক চৌধুরী।’
‘আপনি হিন্দু না মুসলিম?’
‘দু’টো-ই।’
এবার পুলিশের কনস্টেবল জোরে বলে উঠলো, ‘স্যার, বলছিলাম না লোকটা সন্দেহজনক। কেউ কি হিন্দু-মুসলিম দুইটাই হতে পারে?’
পুলিশ অফিসার তাকে একটি ধমক দিয়ে বলল, ‘বাদল, তুমি একটু চুপ থাকো, ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দাও।’
পুলিশ অফিসারের ধমক খেয়ে কনস্টেবল বাদল চুপ হয়ে গেল। তবে সে আশিকের ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, সে বেশিক্ষণ চুপ থাকবে না, সুযোগ বুঝে আবারও কথা বলবে।
কনস্টেবল বাদল এমনিতেই বেশি কথা বলে। এটি তার বহু দিনের অভ্যাস। কথা বলার সময় তার কোনো লাগাম থাকে না। পুলিশ অফিসার ব্যাপারটি জানেন। কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা- একটি ছেলে থানায় এসেছে। কনস্টেবল বাদল ছেলেটিকে বলল, ‘তুমি কে?’
‘আমি পাশের কলেজের ভিপি।’
‘ও আচ্ছা। ছাত্র নেতা?’
‘জি¦।’
‘তুমি তো খুব রোগা-পটকা ছেলে, নেতা হইলা ক্যামনে?’
‘কি বললেন?’
‘বললাম, তুমি থানায় কেন এসেছো?’
‘ওসি স্যারের সাথে একটি মামলা নিয়ে কথা বলতে এসেছি।’
‘স্যার তো অফিসে নাই।’

ছেলেটির গালে একটি বড় দাগ আছে। এটি তার জন্মগত দাগ। এই দাগটির জন্য চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে।
কনস্টেবল বাদল ছেলেটিকে বলল, ‘তোমার গালের দাগটা মনে হচ্ছে চাপাতির কোপের দাগ। আল্লাহ বাঁচাইছে, কোপটা আরেকটু উপরে লাগলে কি যে হতো?’
‘মানে?’
‘মানে হলো- চাপাতির কোপটা যদি আরেকটু উপরে লাগতো তাহলে তোমার চোখ নষ্ট হয়ে যেতো। সবসময় আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া আদায় করবা। তিনি বড়ই মেহেরবান। তিনি চাননি তুমি অল্প বয়সে অন্ধ হয়ে যাও।’
‘এটি আমার জন্মগত দাগ। কেউ আমাকে কোপায় নাই। আপনি পুলিশ বলে মাফ পেয়ে গেলেন।’
বাদলের এইরকম অনেক ঘটনা আছে। সে কোথায় কি বলতে হবে জানে না। তবে মানুষটা কিন্তু ভালো।

পুলিশ অফিসার আশিকের পুরো শরীর তল্লাশি করে তার প্যান্টের পকেটে একটি সিগারেটের প্যাকেট পেল। তিনি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নাকে নিয়ে গন্ধ শুঁকছেন। এটি নিছক একটি সিগারেটের প্যাকেট। পুলিশ অফিসার সিগারেটের প্যাকেটটি তাকে আবার ফেরত দিলেন। তিনি আশিককে জিগ্যেস করলেন, ‘একজন মানুষ কি হিন্দু-মুসলিম দু’টো-ই হতে পারে?’
‘আমার মা হিন্দু। বাবা মুসলিম। তার মানে আমি দুটোই।’
‘আপনার মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই?’
‘না।’

আশিকের কাছে অবৈধ কিছু না পেয়ে পুলিশ অফিসার চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে কনস্টেবল মাথা ঝুকে আশিকের মুখের কাছে এলো। সে আশিকের মুখের গন্ধ শুঁকছেন। কনস্টেবল বলে উঠলো, ‘স্যার, লোকটাকে ছেড়ে দিবেন না। লোকটা বড়-ই সন্দেহজনক। মুখের গন্ধটা কেমন যেন লাগছে?’
পুলিশ অফিসার এবার তাকে আরো জোরে দমক দিলেন, ‘বাদল, তুমি বেশি কথা বলছো। তুমি নামো গাড়ি থেকে।’
‘দেখেন স্যার, লোকটা চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ছাড়বেন না।’

পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবল বাস থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। পুলিশের গাড়ি তল্লাশির কারণ আশিক এখনো জানে না। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার বন্ধু জাহিদকে ফোন দিলো, ‘দোস্ত, আমি বাসে উঠেছি। চট্টগ্রাম আসতে রাত এগারো-বারোটা বাজতে পারে। সমস্যা নাই তো?’
‘তোর যত রাতই হোক, কোন সমস্যা নাই। তুই বাসের ড্রাইভারকে বলবি, জিইসি মোড় নামিয়ে দিতে। আমি জিইসি মোড়ে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবো।’
‘আচ্ছা।’
সে জাহিদের সাথে আলাপ শেষ করে মোবাইলে একটি অনলাইন পত্রিকা পড়ছিলো। হঠাৎ একটি লেখায় তার চোখ আটকে গেলো- ‘প্রজাপতি পরিবহনের মালিক হানিফ গ্রেপ্তার।’ এটির নিচে ছোট করে লেখা আছে, ‘আজ থেকে প্রতিটি গাড়িতে চিরুনি তল্লাশি হবে, প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে আশিক আসল ঘটনা বুঝতে পারলো। যাত্রী কম হওয়ার বিষয়টিও তার পরিস্কার হয়ে গেল।
আশিক বাসের যাত্রী গুনে দেখলো মাত্র পাঁচজন। সে বাদে আরও চার জন যাত্রী আছে। মাত্র পাঁচজন নিয়ে একটি বাস চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এমনটি সচরাচর দেখা যায় না।


আশিক খুব ক্লান্ত। তার দু’চোখে রাজ্যের ঘুম। রাতে তার ভালো ঘুম হয় নি। তার উপর সকাল আট’টায় গাজীপুর থেকে রওয়ানা দিতে হয়েছে। তাই বাসের সিটে হেলান দিতেই তার ঘুম এসে গেল।
একটু পর বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির পানি জানালা দিয়ে বাসের ভিতরে ঢুকছে। এতে আশিকের ঘুম ভেঙে গেল। সে জানালা লাগিয়ে দিলো। বাসটি এখন কোথায় এসেছে তা বুঝতে পারছে না। বৃষ্টির কারণে বাহিরের কিছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। তবে গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটছে। আশিক মোবাইল বের করে গুগল ম্যাপে লোকেশন দেখলো গাড়িটি এখন দাঊদকান্দি অতিক্রম করছে। হাতের ঘড়িতে সময় দেখে সে বুঝতে পারলো- গাড়িতে দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে। টানা অনেকক্ষণ অঝরে বৃষ্টি হওয়ায় আশিকের হালকা একটু শীতও লাগছে।
বাসের পিছনের সিট থেকে একজন লোক এসে আশিকের পাশে বসলো। সে লোকটিকে দেখে অবাক হলো। আগে এই লোকটিকে সে বাসে দেখে নি। লোকটির শরীর থেকে তীব্র আতরের গন্ধ আসছে। তাঁর গায়ে সাদা আলখেল্লা, মাথায় সাদা টুপি, মুখে লম্বা সাদা দাঁড়ি। লোকটিকে দেখতে অনেকটা পীরের মতো লাগছে।
আশিক পুরো গাড়ির যাত্রী গুনে দেখলো, এখন ছয়জন যাত্রী। তার মানে লোকটি বাড়তি লোক। আশিক ভাবছে, লোকটি কখন বাসে উঠলো?
লোকটি আশিকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘আস্সালামু আলাইকুম।’
আশিক উত্তর দিলো, ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম।’
‘আমার জানালা ঠিক মতো লাগানো যাচ্ছে না। বৃষ্টি ঢুকছে। তাই আপনার পাশে বসলাম। কোন সমস্যা নাই তো?’
‘না। কোন সমস্যা নাই।’
‘আমি সিদ্ধেশ্বরী থেকে উঠেছি। আপনাকে তখন ঘুমাতে দেখেছি। আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাবেন?’
‘আমিও চট্টগ্রাম যাবো।’
‘ভালোই হয়েছে দুইজন কথা বলতে বলতে চলে যাবো।’
‘জি¦।’
‘ভাইজান, মাগরিবের সময় হয়েছে কি?’
‘জানি না।’
‘আপনার ঘড়িতে কয়টা বাজে?’
‘ছয় টা দশ।’
‘তাহলে নামাজের সময় হয়ে গেছে। আমি তিন রাকাত নামাজ পড়ে আপনার সাথে আলাপ করবো।’
আশিক ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। লোকটি গাড়ির সিটে বসেই নামাজ পড়ছেন। আশিক তার নামাজ পড়া দেখছে। লোকটি নামাজের সালাম ফিরিয়ে দেখলেন আশিক তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি আশিককে বললেন, ‘আমার নামাজ পড়া পছন্দ হয়েছে?’
আশিক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল।
লোকটি এবার বললেন, ‘আপনি নামাজ পড়বেন?’
আশিক ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না-সূচক উত্তর দিলো।
লোকটি আশিককে বললেন, ‘শুনুন ভাই সাহেব, নামাজ হলো বেহেশতের চাবি। নামাজ ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। সময় মতো নামাজ পড়বেন।’
সুপারভাইজার এসে বলল, ‘আমরা হোটেল বিরতিতে চলে এসেছি।’ এখানে মাত্র বিশ মিনিটের বিরতি। আমাদের গাড়ি নম্বর শূন্য সাত সাত সাত। আপনারা বিশ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে ফিরে আসবেন।’

আশিকের পাশে বসা সাদা আলখেল্লা পরিহিত লোকটি উঠে পিছনে চলে গেলেন। আশিক গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। এই সময় ভারি খাবার খাওয়া যায় না। তাই আশিক পরোটা ও সবজির অর্ডার দিলো। সে খেতে খেতে ভাবছে, আলখাল্লা পরিহিত লোকটিকে নাস্তা খেতে ডাকা উচিত ছিল। চট্টগ্রাম পৌঁছাতে আরো কমপক্ষে তিন-চার ঘন্টা লাগবে। লোকটা কি ততক্ষণ না খেয়ে থাকবে?
আশিক হালকা নাস্তা সেরে গাড়িতে ফিরে এলো। সে লোকটিকে আর গাড়িতে দেখতে পাচ্ছে না। সে ভাবছে লোকটি হয়তো কিছু খেতে নিচে নেমেছেন।
গাড়ির সুপারভাইজার ড্রাইভারকে বলল, ‘উস্তাদ সবযাত্রী চলে আইছে। গাড়ি ছাইড়া দেন।’
আশিকের মনে প্রশ্ন এলো, একটি লোক গাড়িতে নেই, তবু সুপারভাইজার বলছে সব যাত্রী চলে এসেছে। এটি কি করে সম্ভব?
সে লোকটির জন্য চিন্তা করছে। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আশিক যখনই সুপারভাইজারকে কিছু বলতে সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই লোকটিকে পিছন থেকে আশিকের কাছে আসতে দেখলো। তিনি আশিককে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে খুঁজছেন?’
‘জি¦।’
‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘গাড়িতে।’
লোকটির কথা শুনে আশিকের কেমন যেন লাগছে। কিছুক্ষণ আগেও লোকটি ছিল না। তাহলে লোকটি কে?
লোকটি আবারও আশিকের পাশে বসলো। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি তো আপনাকে গাড়িতে দেখতে পাই নাই।’
‘আমি পিছনেই ছিলাম।’
আশিক আবারও আতরের গন্ধ পাচ্ছে। ভয়ে তার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।
লোকটি আশিককে বলে উঠলো, ‘ভাই, আতর দিবেন? দামী আতর। মক্কার আতর। বড়ই পবিত্র জিনিস।’
‘আমি আতর দেই না।’
‘আরে ভাই, এটি সাধারণ আতর না।’
আশিক বলল, ‘আমি একটি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। আতর দেয়া ঠিক হবে না।’
‘এটি সাধারণ আতর না।’
‘তা বুঝতে পেরেছি।’
‘আপনি কখনো আতর দেন নাই?’
আশিক বলল, ‘ছোট বেলায় প্রতি শুক্রবার দাদার সাথে জুমার নামাজ পড়তে যেতাম। তখন আতর দিতাম। দাদা মারা গেছেন দশ বছর আগে। তারপর আর আতর দেই নি। তাছাড়া আমার মা আতরের গন্ধ পছন্দ করেন না।’
‘কি বলেন! আতর সব মুসলিমই পছন্দ করে।’
‘আমার মা একজন হিন্দু। হিন্দু ধর্মে আতরের ব্যবহার নাই।’
‘তাহলে আপনিও কি হিন্দু?’
‘আমি হিন্দু-মুসলিম দুটোই। কারণ আমার বাবা মুসলিম, মা হিন্দু। আমি দুটি ধর্মের রীতিনীতি জানি।’
‘এক সঙ্গে দুটি ধর্ম পালন করা যায় না। আপনাকে একটি গ্রহণ করতে হবে, আরেকটি বাতিল করতে হবে।’
‘আমার কাছে মা যেমন, বাবাও তেমন। কাকে বাদ দিবো?’
‘বাবা-মাকে বাদ দিতে বলি নাই। ধর্মের কথা বলেছি।’
‘আমি এতো কিছু বুঝি না। আমি আমার মতো থাকতে চাই।’

আশিকের কথা শুনে লোকটি অবাক হলেন। তিনি দীর্ঘ শ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘কি আজব দুনিয়া এলো। স্ত্রী হিন্দু আর স্বামী মুসলিম, ছেলে দুটোই। এটা কি করে হয়?’
লোকটি এক শিশি আতর বের করে আশিককে দেখিয়ে বললেন, ‘এই আতর কিছুদিন আগে মক্কা থেকে এনেছি।’
আশিক বলল, ‘আপনি মক্কা গেছেন?’
‘হ্যাঁ। অনেকবার গেছি। পবিত্র শহর।’
লোকটি তার আলখেল্লায় আতর লাগাতে লাগাতে বলে যাচ্ছেন, ‘এই আতর সাধারণ আতর না।’
হঠাৎ বাসটি হার্ড ব্রেক করলো। আশিকের শার্টে পুরো এক শিশি আতর পড়ে গেলো।
লোকটি আশিকের হাত ধরে বললেন, ‘আমি দুঃখিত ভাই। সব আতর আপনার গায়ে পড়ে গেল। তবে এই আতর সাধারণ আতর না।’
‘দুঃখিত হচ্ছেন কেন? আপনি তো ইচ্ছা করে ফেলেন নি।’
‘ভাই, গাড়িটা ব্রেক না করলে পড়তো না।’
‘সমস্যা নাই। আমি চট্টগ্রাম নেমে আরেকটি শার্ট পরে নিবো।’

আতরের গন্ধে আশিকের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আতরের গন্ধটি তার ভালো লাগতে শুরু করলো। আতরটির গন্ধ তীব্র হলেও অসাধারণ লাগছে।
আশিকের পাশে বসা লোকটি একটি তসবিহ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে জিগির করছেন। তসবিহর দানাগুলোও সাদা রংয়ের। আশিক ভাবছে, লোকটির মধ্যে নিশ্চয় আধ্যাতিœক কিছু আছে।
আশিক চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বাহিরে তখনো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। এমন বৃষ্টিতে ঘুমাতে ভালোই লাগে। তবে বাসায় কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাতে পারলে বেশি ভালো হতো। আশিক গাড়ির সিটে হেলান দিতেই ঘুম এসে পড়লো।
হঠাৎ তাদের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাছের সাথে ধাক্কা লাগলো। তখন গাড়ির গতি ছিল প্রায় আশি কিলোমিটার। ভেজা রাস্তায় বেশি গতিতে গাড়ি চালানো উচিত নয়। এতে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কঠিন। গাড়িটি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়লো। আশিক তখন ঘুমিয়ে ছিল। সে চোখ খুলেই দেখলো গাড়ির চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। সবাই গাড়ির ভিতরের মানুষদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। আশিক আলখেল্লা পরিহিত লোকটিকে আর দেখতে পাচ্ছে না।
লোকজন সব যাত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আশিকও হাসপাতালে এলো। তবে তার একটুও আঘাত লাগেনি। তার কোন চিকিৎসারও দরকার হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের বলছেন, ‘দুইজন যাত্রী মারা গেছেন, আর দুইজন মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে আছেন। আর একজন সৌভাগ্যবানের কোন আঘাত লাগেনি।’
বাসটির ড্রাইভার ও সুপারভাইজার পালিয়ে গেছে। বেশিরভাগ এক্সিডেন্টের ক্ষেত্রেই তারা পালিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানোর জন্যই বাসটি এক্সিডেন্ট হয়েছে।
আশিকের কোন আঘাত লাগেনি দেখে হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্স বিস্মিত হলেন। ডাক্তার সাহেব আশিককে বললেন, ‘আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ। এতো বড় এক্সিডেন্ট হলো অথচ আপনার কিছুই হলো না।’
আশিক আলখাল্লা পরিহিত লোকটিকে খুঁজছে। যে দুইজন মারা গেছেন সেখানে লোকটির লাশ নেই। আবার যে দুইজন যাত্রী আইসিইউতে আছেন সেখানেও লোকটি নেই। সে লোকটির ব্যাপারে কাউকে কিছু জিগ্যেস করতে পারছে না।
এক সময় আশিক ভাবছে, আসলেই কি আলখেল্লা পরিহিত কোন লোক বাসে ছিল? নাকি এটি তার স্বপ্ন ছিল?
সে বাসের সব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছে। তার অনেকক্ষণ ঘুমানোর কথা মনে পড়ছে। ঘুমের মধ্যে মানুষ অনেক বিচিত্র স্বপ্ন দেখে। এটি হয়তো একটি স্বপ্নই হবে।
আশিক হাসপাতালের আইসিইউতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে। একজন নার্স আশিককে বললেন, ‘ভাই, আপনি একটু বাহিরে যান।’
আশিক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো, ‘কেন?’
নার্স বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আপনার শরীর থেকে আতরের গন্ধ আসছে। আতর দিয়েছেন, ভালো কথা, তাই বলে এতো আতর দিবেন? খুব গন্ধ আসছে। আপনার আতরের গন্ধে কেউ থাকতে পারছে না।’
আশিকের মনে পড়লো লোকটির আতরের কথা। লোকটি এক শিশি আতর তার শার্টে ফেলে দিয়েছিল। আশিক বুকের কাছে নাক নিয়ে আতরের গন্ধ শুঁকছে। সে বলে উঠলো, ‘তাইতো! আতরের গন্ধ। সেই আতর।’
আশিক এখন বুঝতে পেরেছে লোকটি সত্যিই ছিল। কিন্তু সে লোকটির রহস্য উদঘাটন করতে পারছে না।

পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১



তিমির হননের গান
মিজান মনির

শোকের বিষে আগুন, দু’চোখে স্বজন হারানোর জল
পৈশাচিক থাবায় মানচিত্র ছিন্নভিন্ন; স্ফুরিত ঘৃণা অতল
ক্ষোভে ভারি ষোলো কোটি প্রাণ, দিগি¦দিক রক্তজ্বলা কবিতা-গান
দানব ধ্বংসের ঘন্টা বেজে উঠুক তৃষ্ণার্থ চোখের এ আহ্বান।

সোনালি আলোর মুক্ত আকাশ কেউ পাবে না কিনে
ফুলের উঠোনের আগাছা-ছত্রাক এবার নেবে চিনে
অসুর শক্তি নয় ভক্তি আর নয় গর্জনে মন হরণ
ভোরের লাবণ্যে সুখের উল্লাসে জেগে উঠুক শুভ্র বন।

মধু আহরণে প্রজাপতি মেলবে ডানা, মন জুড়াবে এবার
বিসর্জন নয়; সুরভিত গোলাপ হয়ে ফুটবে সহ¯্র আবরার
সত্যের নৌকা পাল ওড়াবে অবিরাম নেই বাধা কোনো ভয়
তিমির পাঠ নিপাত যাক, এ বারতায় ধ্বনিত হউক জয়।

পূর্ণাঙ্গ
জোবায়ের মিলন

কখনোই ভাবিনা, হোঁচট খেলে কেউ টেনে তুলবে
এও ভাবিনা, রোগ-শোকে সান্তনা দেবে কেউ।

পড়তে পড়তে উঠতে শিখেছি
শিখতে শিখতে এতো দূর এসেছি। পথ কি
শেষ হলো? মোটেও না।
এখনো মেঘ থেকে শিখি, রোদ থেকে শিখি
সন্ধ্যা থেকে শিখি, রাত থেকে শিখি;
এখনো কাউকে ভালোলাগলে তার থেকে শিখি
মন্দ লাগলে সেও শিখি-
এই শেখাটাই উঠতে বসতে কাজে লাগে, আর সব
উবে যায়, উড়ে যায়।

অন্য হাতের ভরসা করে পঙ্গু-বিকলাঙ্গ যারা
পূর্ণাঙ্গ তো তারা, যারা নিজেকে নিজেই
টেনে তুলতে পারে খাদ কিংবা
গিরিখাদ থেকে।

একটা লম্বা লাইন ও অন্যান্য
সুকান্ত ঘোষাল

একটা লম্বা লাইন - অসংখ্য মাথা
এ লাইন আমাকে দিয়ে বানানে
এর সামনে-পিছনে-মাঝে
একমাত্র আমি
কারণ আমার মতোই এর একই অসুখ
উপশম এক

কিংবা উল্লাসের উপরে
তুমি আমাকে যোগ্য ভেবেছো
যা এই তীর্যক করে এই অনুভব
আর কত দেবে
এই উপহার , গোল গোল মেডেল

চোখ দিয়ে শুনে
কান দিয়ে বেরিয়ে গেল শোক
তার চেয়ে এস ওই
ফাঁকায় আরেকটু দাঁড়াই
যেখানে সবকিছু ঠিক, সবাই নিপাট সাধুজন
                                   


কিছু কথা অথবা প্লাবন শুধু
আশরাফুল মন্ডল

ঝুলন্ত গাঁটছড়া
উড়ছে কথা কিছু

চারদিকে। ভুল সে ভুলই
কিনারা ভাঙা পতন সাতসমুদ্র

শোক নদী। কুঁড়েমি মোহনবেনু
বেলাশেষে। বিছানায় জাপটে ধরা
কিলবিল সোঁদারূপ। ফুটন্ত সামিয়ানা
অরণ্য রোদনে.....

নিহিত ভালোবাসা
সারিবাঁধা ভাটিয়ালি। পাল ওড়া মধ্যরাত
খুঁজে ফিরি অজানা বালির স্তুপ। ছোঁয়াছুয়ি
প্লাবন শুধু, তবুও.....

অন্ধকারের ফিনকি দেখে ডাঁসা আলো
বতর জাগানো গতর
কাঁপে। প্রভু সত্য হই.....

পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২


প্রাণভিক্ষা 
কাজী জুবেরী মোস্তাক

না রাষ্ট্রপতির কাছে আমি আমার প্রাণটা ভিক্ষা চাইবোনা
এখানে আইন টাকা আর ক্ষমতার কাছে জিম্মি
তাই বাঁচতে চাইনা
যে রাষ্ট্র আজও মিথ্যার চামচামি করে সে রাষ্ট্রে
প্রাণভিক্ষা চাইনা।

না এই সুউচ্চ প্রাচীর কিন্তু আমার সমাধীর জন্য
তৈরি করা না
এ জেলখানা কিন্তু অনেক বড় কিন্তু আমার ঘর
বেশি বড় না
আগামীকাল আবার জন্ম হবে আমার তাই আজ বাঁচতে চাইনা

বদ্ধভূমির জেলখানায় ঘুমটা আসলে বিশ্বাঘাতক
এক অপরাধী
আর কয়েদিরা একেকজন যেন ঘুমহীন একেকটা চাতক পাখি
আর জেল পুলিশগুলো পাখিদের উপরে রেখেছে
তীক্ষè নজরদারি ।

জেলখানার খুপরিঘর গুলোর দেয়ালে বন্দী রয়
চাপা আর্তনাদ
সু-উচ্চ প্রাচীরেই আটকে থাকে ভেদহীন শতশত
বন্দীর দীর্ঘশ্বাস
তবুও স্বপ্নগুলো কয়েদিদের দিচ্ছে বেঁচে থাকার
জন্য আশ্বাস।

যে সমাজটা আমার সু-শৃঙ্খল জীবনকে করেছে
উশৃঙ্খল সন্ত্রাসী
যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতি পদেপদে জন্ম দিচ্ছে আমার মতো সন্ত্রাসী
সে সমাজে বাঁচার জন্য অযোগ্য রাষ্ট্রে প্রাণভিক্ষা চেয়ে লাভ কি ?

আমাকে নাহয় বন্দীই করেছো এই সুউচ্চ প্রাচীর
ঘেরা জেলখানায়
কিন্তু আমার চিন্তা চেতনা মস্তিষ্ককে বন্দী করবে কোন জেলখানায়
মনে রেখো এই মৃত্যু চিরস্থায়ী নয় প্রতি সকালেই আমার জন্ম হয়।


মানুষের ধবলমুখ রক্তহীন
নূরনবী সোহাগ

জরায়ুর নিপুণ রক্তাক্ত পথ ছেড়ে নেমে এলাম
পৃথিবীর সহজ ও সুন্দর আলপথে
হরিৎ কারুকার্যে আমিই ঘুরে বেড়াই
বাসি রক্তের ঘ্রাণ নিয়ে।
জল বলতেই মনে হয়; গর্ভে ভেসে থাকা পবিত্রদিন
নেমে আসি জলের কাছে; পবিত্রতা শুঁকে
আঁজলা আঁজলা নরমডুব মাখি গায়ে
সরল তের আবদারে, ভেসে আসে
কাটামুখ, কাটাচোখ,কাটামাথা ও শরীর

রক্তের ঘ্রাণ পাই এখানেও।

পিছুছুটে পালাই নব্যসভ্যতার দিকে
মন ও মানুষের দিকে

শরীরপেষা চাকার মুখে মানুষের পরাজয় শুনি
ছায়া খুঁজি-খাদ্য খোঁজার মতো হন্যে হয়ে
দূরে দেখি রক্ত ফুটে আছে ছায়াসূত্র নিয়ে
ছোপ ছোপ রাস্তা ছেয়ে আছে দীর্ঘ রক্তে

মানুষের অন্তিম গন্তব্য জেনে
জীবন বন্দনা করি

যেদিকে তাকাই জরা-মৃত্যুর আস্তিনে ঢাকা
হলঘর, রাজপথ এমনকি জীবিত মায়ের বুক

আমি গর্ভদেশ খুঁজি
ধবল মানুষের রক্তহীন মুখ সরিয়ে

পদাবলি : ০৩

পদাবলি : ০৩


হেমন্তের তলপি তলপা সমূহ
দ্বীপ সরকার

সকালের কিনারে গিয়ে রোদ কেড়ে খাচ্ছি
মুড়ি মুড়কির সাথে-- আলো বাতাসের কি যে খেউর!
উঠোনে নিষ্কৃতি পাবার ছলে একজোড়া কবুতর
ভুল সংস্কৃতি থেকে সরে দাঁড়ালো
গরমের দিনকে আর পোষা যায়না

শিশিরের ঘাড় ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছে পানকৌড়ি
নিশানার কাছে পড়ে আছে নদীর তীর
ফুলকপির খোপে খোপে আটকে থাকা হিম--
গড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে শরীরে
পানকৌড়ি চেটে খাচ্ছে নদীর মাখন

আহা শীত! আহা হেমন্ত!
চাদরের ভাঁজে গুছিয়ে রাখা সমুদ্রের দিনলিপি
এবং বাতাসের তলপি তলপা সমূহ
পানকৌড়ি আর আমি ভাগ করে নেই

নবী মুহাম্মদ (সা)
মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন

 বিশ্ব যখনি অজ্ঞতা, অনাচার
কত কুসংস্কারে নিমজ্জিত।
মানবতার মুক্তির বার্তা নিয়ে,
মা আমেনার কোলে তখনি
আগমন করেন নবী মুহাম্মদ (সা)।
সৃষ্টি যদি তাঁকে না করত খোদা তাআলা,
সৃষ্টিই না হয়ত এই বিশ্ব জাহান।
হলেন যিনি সৃষ্টি জগতের সেরা,
মানবতার মুক্তি ও শান্তি স্থাপনে
করে গেছেন বিরল দৃষ্টান্ত।
কে ধনী, কে গরীব? 
কে হাবশী গোলাম, কে কুরাইশ?
নেই কোনো ভেদাভেদ।
এই মর্মে ঘোষণা দিলেন যিনি,
তিনিই নবী মুহাম্মদ (সা)। 

ধাগ্রস্ত হৃদে তবু হাঁটি
আহেদুল ইসলাম আদেল

আমি শতগ্রহের শোকের পলিতে অঙ্কুরিত চারা
তুমি বিষফুলে বিচ্ছুরিত দমকা হাওয়া
অভিমানের কপাট খুলে দেখ প্রিয়া
আমি সেই হারিয়ে যাওয়া শেষ ইচ্ছা।
দুরন্ত ছেলেবেলা, গাভীনক্ষেতের নিরব হিমকণা
নীল প্রজাপতির ঝাপটা ডানা
তুমি তবু কেন বুঝ না?
যে বসন্ত গেছে, একেবাড়েই কি গেছে?
প্রতি ফাগুনে ফের তো যুবতি রূপে আসে
তবে তুমি কেন চির দিধান্নিত থাকবে?
তোমার দিধাগ্রস্ত হৃদে তবু হাঁটি
যদি কোন বসন্তে বুঝ মিলে।

জলতরঙ্গ
অনিন্দিতা মিত্র

কিছু সংলাপ বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যায় জীবনের রিমঝিম জলতরঙ্গ, আহত পাখির ডানায় লাগে শূন্য হেমন্ত কালের আপাত বৈভবের ছবি। রূপাশালী ধানের বুকে জমা হতে থাকে শত শত বছরের নবান্নের আক্ষেপ । থেমে যেতে চায় বাউলের একতারার মেঠো সুর ,অবসন্ন দেহ নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকে তথাগত, কুশীনগরের পথে পথে শুধুই বিষ ধোঁয়া।সময়ের আল পথ ধরে বয়ে চলে করুণ মালকোষের  সুর। পুড়ে যায় জোছনা, জীবনযুদ্ধের বাঁকে পোড়ে মন। বিশ্বাস হারিয়ে যায় অবিশ্বাসী নক্ষত্রের ভিড়ে।  ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকে ক্ষয়িষ্ণু প্রত্যাশা। আমার কবিতা কখনও কবিতা হয়ে  ওঠে না, মূক হয়ে বেঁচে থাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতির আশায়।



অবহেলা
ইস্রাফিল আকন্দ রুদ্র


তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখবো এমন কোনো কথা কখনো ভাবিনি
তোমার প্রতীক্ষায় পথে প্রান্তরে অশ্বথের মতো দাঁড়িয়ে থাকি ওগো প্রেয়সী
ওগো প্রেয়সী, ওগো রূপসী, ওগো অবহেলা ভালবাসি, ভালবাসি তাই বুঝি কোরো হেলার মেলা!

ঘড়ির কাঁটার চেয়েও দ্রুত ভাঙ্গে, গড়ে আমাদের অভিমান-
অনড় বিশ্বাসে প্রতি নিঃশ্বাসে শব নিস্তাব শরীরে তুমি চির প্রতীক্ষমাণ।
ওগো প্রিয়তমা গুণবতী আমার, প্রেমের কসম নিও
হৃদয়ের নিভৃতে শুধু তোমার নিবাস তা তুমি জানিও!

অচিনপুর

অচিনপুর


অচিনপুর
আহমদ মেহেদী

মাঝেমধ্যে চলার পথে ভাংতি টাকা নিয়ে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সকাল বেলা টেক্সি ড্রাইভারকে যদি একশ অথবা পাঁচশ টাকার নোট দেওয়া হয়, ঘুষখোর পিয়নদের মতো মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলবে-আরে ভাই এত সকালে এত বড় নোটের ভাংতি পামু কই? ভাঙিয়ে দেন। তখন ভাংতির জন্য এখানে-ওখানে ছুটাছুটি করা খুবই বিরক্তিকর। লক্ষ করেছি যে সময় পকেটে ভাংতি টাকা থাকে সে সময় দরকার পড়েনা । যখন থাকেনা তখন দরকার বেশি পড়ে। শহরের দোকানদারেরাও ভারতীয় সিরিয়ালের সিআইডির মতো চশমার নিচ দিয়ে কেমনে জানি তাকায়। তখন ঠাস করে তাদের গালে একটি চড় মারতে ইচ্ছে করে। একজন মানুষ ত তোমার কাছে বিপদে পড়ে ভাংতির জন্য এসেছে, তুমি তাকে সহযোগিতা করবে এই যা! এটাই আশা করে একজন মানুষ মানুষের কাছে। কিন্তু সে তার দোকানে খরচ করা ছাড়া ভাংতি দিবে না? তাহলে ছেলেবেলা থেকে মানুষের প্রতি আমার যে ধ্যান-ধারনা লালন করে আসছি তা কী ভুল। কেন এমন হল এই পৃথিবীর মানুষের ! জাগতিক ভাবনার কারনে দিনে দিনে সবাই কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি না আমরা? জানো, শানু তুমি শুনলে অবাক হবে। সারাদিন চাকরির কাজে কত জায়গায় যাওয়া পড়ে। পাশের একটি দোকানে গেলে পানি চেয়েও পাওয়া যায় না মধ্যম আয়ের বাংলাদেশে। সোজাসুজি মুখের উপর বলে দেবে ব্যবস্থা নাই, মিনারেল ওয়াটার আছে দেব? সে দোকানদার আদৌ কি জানে কারো কারো পকেটে ঐ পনের টাকা কোন কোন সময় থাকেনা।
হইছে তুমি চুপ কর, অনেক হয়েছে। এখন ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি তরকারি গরম করব। ও তোমাকে বলতে ভুলে গেছি বাড়িওয়ালা এসেছিল বিকালে। টাকাটা দিতে পারবে এই মাসে?
দেখি কী করা যায়।
শানু পাশের রুম থেকে কথা বলছে তাই আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। মৃদু কণ্ঠে বলছে  কত করে বলি এসব খাইও না। তারপর ও কথা শুনবে না, শার্ট থেকেও সিগারেটের গন্ধ আসছে! যেদিন মরে যাব তখন বুঝবে বারন করার মানুষটি তোমাকে কত ভালবাসত। আমি ত চাইনা তোমার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হউক। ঘর্মাক্ত শার্ট-প্যান্ট কাঁধে নিয়ে বলতে বলতে বাথরুমে চলে যায় সে। বাসায় আর ভাল শার্ট-প্যান্ট নাই বিধায় তাই ধুয়ে রাতে শুকালে সকালে তা পড়েই আবার বের হতে হবে। শানু এলে একসঙ্গে ভাত খেলাম । খেয়েই বিছানায় একটু পিঠ লাগাতে ইচ্ছে হল। কালামের কাছ থেকে একটি বই ধার এনেছি পড়া হয়ে উঠেনি, দেখি আজকে শেষ করে ঘুমাব। কাল শুক্রবার, নো প্রবলেম। কালাম হারামজাদাটা বইটি ধার দিতে কেমন গড়িমসি করল অথচ আমার কাছ থেকে বই পড়তে নিয়ে সে আর ফেরত দেয়নি। তার মতো এমন অনেকেই আছে। স্কুলের পরীক্ষায় তাকে কত হেল্প করেছি। মনে নেই হয়তো। আমার সময় খারাপ যাচ্ছে তা শরতের আকাশের  করুণা দৃষ্টির দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। চারদিকে যখন মাতাল হাওয়া বইছে  হুমায়ূন আহমেদের মাতাল হাওয়া পড়তে পড়তেই  কখন ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না।
নেও এখানে এক লাখ টাকা আছে। তোমার মার অপারেশনটা কইরা ফালাইও কেমন। এই টাকা নিয়ে অনেক টেনশন করেছ তুমি।
শানু ! বাড়ি ভাড়ার টাকাতো অনেক জমা হয়ে গেছে।
সেটাও দিয়ে দিছি ।
আমাকে আরো পনের হাজার টাকা দিও। দোকান বাকিটা দিয়ে দেই আর একটা স্মার্টফোন কিনব। তোমার বাবার তো অনেক টাকা । আমার চাকরি হলে সব শোধ করে দেব।
অবশ্যই শোধ করবা। তবে আমার কাছ থেকে নিয়েছ আমার কাছেই দিবা ঠিক আছে ? ইদানিং তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ, ভোরে হাটাহাটি করবে, সিগারেট খাবেনা। সকালে একটা পরোটা আর একটা ডিম, দুপুরে এক প্লেট আর রাতে এক প্লেট ভাত খাবে কেমন। ফ্রিজে পাবদা আর শিং আছে ।
টাকা পয়সা হাতে থাকলেই খরচ করোনা। টাকা না থাকলে বুঝা যায় টাকা কি জিনিস! বাবার কাছ থেকে আনছি ঠিক আছে কষ্টও কম হয়নি। বুঝনা ভাইয়েরা এখন বিয়ে করেছে। জানি তোমার জীবন চলছে উইদআউট সুদ, তোমার চলতে কষ্ট হয়। তা সাময়িক , দেখ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এই মেহরাব কেই আমি চেয়েছি এবং পেয়েছিও। এই মেহরাবকেই আমি আমার জীবন থেকেও বেশি ভালবাসি।
ঠিক আছে শানু। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে গো জান ।
আমার মুচকি হাসি দেখে শানু আমার মাথার কাছে এস বসল। আমার কপালে হাত রাখল। এলোমেলো চুলগুলো টানতে লাগল। দেখলাম তার চোখে জল। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি মনে হল শরতের রাতও তার দুঃখে কাঁদছে । আকাশেও অন্ধকারের জল।
অনেকদিন পর শানুকে স্বপ্নে দেখেছি গতকাল। আমাকে একা করে দূর আকাশে চলে গেলেও প্রতিটি মুহুর্তে আমাকে শাসন করে বেড়ায় এখনো। বাবার অবাধ্য হয়ে আমাকেই ভালবেসে বিয়ে করেছিল।  সিংহাসন একটাই ; রাজা আমি আর রাণী ছিল সেই। শেষ বার বিসিএস পরীক্ষার সময়ে দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফু দিয়েছিল অদ্ভুত ভঙ্গিতে। প্রায়ই ইনবক্সে একটি এসএমএস পেতাম নামাজ পড়ব এখন, তোমার জন্য কি দোয়া করব বল ? তার নামের ফিক্সড ডিপোজিটের আমাকে নমিনি করে যায়। আমার জীবন অনেকটা পাল্টে যায়। আকাশের ইনবক্সে আমার ও তাকে একটি এসএমএস পাঠাতে ইচ্ছে করে-তোমাকে একনজর দেখার তৃষ্ণাটা মিটিয়ে দিয়ে যাও হৃদয়-রাণী! তুমি ছাড়া এই অন্ধকার সিংহাসনের রাজা থাকতে আমি চাই চাই না। চলে এস-একদিন তুমিই হেমন্তের বিকালে ঘাসের ওপর শুয়ে স্বপ্ন দেখেছিলে দুজনে মিলে হেমন্তের আকাশ-জমিতে একটি ফুলের বাগান করবে। আমি হব সে বাগানের মালী। কোদাল-কাঁচি প্রস্তুত। এপারে যানজট ; যানজট শেষ হলেই ফিরব তোমার সে বাগানে।’ আকাশের মাঝে তোমায় এখনো খুজি। ওপারে কেমন আছ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে হৃদয়-রাণী! তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটিবার আদর করতে ইচ্ছে করে এখনো। অবুঝ মনটাকে কি করে বুঝাই ? তাই যাব অচিনপুর।
নোয়াগাঁও , দেবিদ্বার, কুমিল্লা