স্বপ্নবাজ বাবা

স্বপ্নবাজ বাবা


স্বপ্নবাজ বাবা

কবির কাঞ্চন

বুয়েট থেকে বাড়ি ফেরার সময় বেশকিছুক্ষণ ধরে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিপন। এতো এতো গাড়ির ভীড়ে বাসায় যাবার মতো একটি গাড়িও পাচ্ছে না। একটুপর একটি রিক্সাকে কাছে আসতে দেখে সে হাত উঁচিয়ে থামায়। তার বাসা পর্যন্ত রিক্সা ভাড়া কত জিজ্ঞেস করলে রিক্সাওয়ালা ৮০ টাকা বলল। রিপন আর কোন কথা না বাড়িয়ে রিক্সায় চড়ে বসলো। রিক্সায় বসে সে মনে মনে ভাবতে লাগলো- পলাশী মোড থেকে আমার রিক্সা ভাড়া কম করে হলেও ১০০ টাকা। কিন্তু লোকটা চাইলো মাত্র ৮০ টাকা। মনের মধ্যে একটা খটকা লাগলো। রিক্সায় উঠার সময় লোকটার দিকে ভালোভাবে খেয়াল করে সে।বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ হবে। গায়ে যেনতেন একটি জামা আছে। মাথায় গামছা প্যাঁচানো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মুখমণ্ডল দেখে মনে হচ্ছে রোদে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।  তবে রিপনের চোখে চোখ পড়তেই মনে হয় সে চোখে জগতের অসীম স্বপ্ন। কৃষ্ণবর্ণের মুখমণ্ডল জুড়ে শুরু থেকেই অকৃত্রিম হাসি লেগে আছে। রিক্সা যখন রিপনদের বাসার কাছাকাছি চলে আসে তখন সে কৌতুহল বশতঃ তাকে জিজ্ঞেস করলো,- চাচা, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?লোকটা উত্তর দিলো,- নোয়াখালীতে।- নোয়াখালী'র কোথায়?- হাতিয়া উপজেলায়।রিপন একটু নড়েচড়ে বসে বলল,- কি বলেন! আমাদের বাড়িও তো নোয়াখালীর হাতিয়ায় ছিল।এই কথা শোনার পর লোকটা পিছন ফিরে রিপনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,- আমার বাড়ি আফাজিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশে।ফরায়েজি গ্রামে। আপনাদের গ্রামের নাম কী?- গ্রামের নাম কী ছিল আমি তা বলতে পারবো না। তবে আমার আব্বু-আম্মু জানেন। আসলে ঈদে কিংবা লম্বা কোন ছুটি পেলে আমরা দুই-তিন বছর পরপর দাদুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। আমার জন্মের পর থেকে আমরা এখানেই সেটেল্ড। - আপনার আব্বুর কি নাম?- ছৈয়দ মিয়া।- আপনার দাদুর বাড়ি কী ছৈয়দিয়া বাজারের পাশে।- হ্যাঁ, আমার মনে পড়েছে। দাদুদের বাড়ির পাশেই ছৈয়দিয়া বাজার আছে।- তাহলে চিনতে পেরেছি। আপনার দাদার নাম মোতালেব মিয়া। এলাকায় উনার বেশ নামডাক আছে।অল্পসময়ের মধ্যে রিপনের কাছে লোকটাকে খুব আপন বলে মনে হতে লাগলো। এরপর রিক্সাওয়ালা লোকটা রিপনকে জিজ্ঞেস করলো,- প্রতিদিন কি এইপথ দিয়ে ক্লাসে যাওয়া-আসা করেন?- না, আমি পাস করেছি ৩ বছর হলো।- ওহ্ আচ্ছা! এখন কি করেন?"- চাকরি করি। - বেশ! আমার ছেলেও বুয়েটে পড়ে। এবার ফাইনাল ইয়ারে। লোকটার কথাগুলো শুনে রিপনের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কতো কষ্ট করে রিক্সা চালাচ্ছেন। আবার বলছেন তার ছেলে নাকি বুয়েটে পড়ে। রিপন লোকটার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,- বুঝলাম না, চাচা। আপনার ছেলে বুয়েটে পড়ে!- হ্যাঁ, বাবা।রিক্সায় বসে বসে রিপন লোকটার কথার অংক মিলাতে পারছে না। তাই আরেকটু একটু পরিষ্কার হতে  ডিটেইলস জানতে চাইলো,- চাচা,  ও কোন ডিপার্টমেন্ট পড়ে?- সে সিভিলে পড়ে।রিক্সাওয়ালা লোকটার ঠিক ঠিক উত্তরে রিপন নির্বাক থাকে। আর মনে মনে ভাবে- আসলেই তো রিক্সাওয়ালা চাচার ছেলে  বুয়েটে পড়ে! কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চুপচাপ বসে থাকার পর সে নীরবতা ভেঙে বলল,- চাচা, আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?"- ২ ছেলে, ১ মেয়ে।- ওরা কী করে?- ছোটছেলে দশম শ্রেণিতে আর মেয়ে ইডেন কলেজে প্রাণিবিজ্ঞানে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। রিপন লোকটার সাথে যতোই কথা বলছে ততোই চমকিত হচ্ছে। আলাপ করতে করতে তারা একসময় বাসার কাছাকাছি চলে আসে। রিপন রিক্সা থেকে নেমে বলল,- আপনি আগে কি করতেন, চাচা?লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, - গ্রামের বাজারে আমার ছোটখাটো একটি কাপড়ের দোকান ছিল। ব্যবসায় হঠাৎ করে মন্দা শুরু হয়। এতোদিনে যা কিছু জমা ছিল সব শেষ হয়ে যায়। ঠিক সেইসময়ে আমরা নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ি। চারদিকের ধাক্কা সামলে দাঁড়াতে পারছিলাম না। শেষমেশ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে নিরুপায় হয়ে এই রিক্সা হাতে নিয়েছি। সেই থেকে এই রিক্সাই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে ধরা দিয়েছে। কিন্তু আঙ্কেল, রিক্সা চালানো নিয়ে আগে কেউ আমায় কিছু বলতো না। ইদানিং কিছুলোকে বলাবলি করে, "তোমার ছেলে তো এখন বুয়েটে পড়ে। তোমার আর রিক্সা চালানোর কি দরকার?"কিন্তু কেউ বুঝুক আর না বুঝুক আমারটা তো আমি বুঝি। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। সংসার খরচ চালাতে হয়। বড়ছেলে টিউশনি করে নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিলেও বাড়ির সবার সবকিছু আমায় দেখতে হয়।রিক্সাওয়ালা চাচার দুর্দিনের গল্প শুনে রিপন ব্যথিত হয়।তারপর কৌতুহলী হয়ে বলল,- আপনার বড়ছেলের বুয়েটে ভর্তি প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতেন। রিক্সাওয়ালা চাচা মাথার গামছা নিয়ে মুখমণ্ডল, কপাল মুছতে মুছতে হাসিমাখা কন্ঠে বললেন, - আমার ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভালো। ক্লাস ফাইভে ও এসএসসিতে বৃত্তি পেয়েছে। তারপর এইচএসসি-তে  বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। এইচএসসি পাস করার পর  শহরে এসে নিজে নিজে ভর্তি কোচিং করেছে। এরপর একে একে চুয়েট, কুয়েট, বুয়েটসহ আরো অনেক জায়গায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। শুনেছি সে সব জায়গায় টিকেছিল। ওর বুয়েটে টিকে যাবার খবর এলাকায় প্রচার হয়ে গেলে নানান জনে নানান মন্তব্য করতো। কেউ কেউ বলতো, " বাদ দাও, ওসব বড়লোকের ছেলেমেয়েদের জন্য। তুমি গরীব মানুষ। ওখানে পড়াতে বড়লোকেরাই রীতিমতো হিমশিম খায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দাও। তাহলে নিজেও চলতে পারবে। তোমার জন্যও কিছু পাঠাতে পারবে।" আবার কেউ কেউ বলতো, "বুয়েটে যখন টিকে গেছে তখন কষ্ট করে হলেও ভর্তি করিয়ে দাও। প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হলেও পরে দেখবে ও নিজেই দাঁড়িয়ে যেতে পারবে।"আমি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভালো মানুষদের কথামতো। খরচাপাতির ভয়ে আমার ছেলেও শুরুতে বুয়েটে ভর্তি হতে চায়নি। ও আমাকে একবার বলেই ফেলেছে, - বাবা, আমি তো ভার্সিতে টিকেছি। বুয়েটে পড়তে অনেক খরচ হবে। এতো টাকা তুমি কোথায় পাবে? তারচেয়ে ভালো- আমি ভার্সিটিতে কোন একটা বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয়ে যাই।ওর কথাশুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। আমি রেগে গিয়ে সেদিন ওকে বলেছিলাম, বুয়েটে যখন টিকেছো তখন চোখ বন্ধ করে বুয়েটেই ভর্তি হবে। কে কি বলল সেদিকে খেয়াল করার দরকার নেই।  একটা কথা শুধু মনে রাখবে, তোমার বাবার দেহে যতক্ষণ শ্বাস থাকবে ততক্ষণ খরচাপাতি নিয়ে তোমাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। আরেকটা কথা, বাড়ি নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করবে না। তুমি শুধু তোমার কাজটা করবে। মানুষের মতো মানুষ হবে। আমার কথা শেষ হতে না হতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে। তারপর ওকে বুয়েটে ভর্তি করিয়ে দেই। - চাচা, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আগে গ্রামে রিক্সা চালাতেন। কখন শহরে এসেছেন?- ছেলেকে বুয়েটে ভর্তি করানোর পর থেকে আমি রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। মাথায় সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা ভর করতো। না জানি কোন অঘটন হয়ে যায়। প্রতিদিন দুর্ঘটনার খবর শুনতাম। শহরে প্রতিদিনই কারো না কারো বুকের মানিক অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। এসব ভাবনা থেকে শহরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। শহরে এসে রোজ আমার ছেলেকে নিজে রিক্সা করে নিয়ে যাই। আবার রিক্সা করে নিয়ে আসি। দিনের বাকি সময়ে রিক্সা চালিয়ে যা পাই তা দিয়ে বউ-বাচ্চা সবাইকে নিয়ে পলাশী মোড সংলগ্ন ছোট্ট একটি রুমে সুখেই আছি। এতক্ষণ একজন আদর্শ স্রোতার মতো রিক্সাওয়ালা লোকটার কথা শুনলো রিপন। সে মনে মনে বিড়বিড় করে রিক্সাওয়ালা চাচাকে সেল্যুট জানায়।রিক্সা বাসার সামনে এসে থামলে রিপন রিক্সা থেকে নেমে বলল,- চাচা, আমার সাথে বাসায় চলেন। বাসায় আজ আব্বু-আম্মু নেই। দু'জনেই টঙ্গীতে আমার খালার বাসায় বেড়াতে গেছেন। আজ আপনি আমার সাথে ভাত খাবেন। আজ আমি নিজে রান্না করে আপনাকে খাওয়াবো। আপনি একজন গর্বিত পিতা। আপনি রিক্সাটা সাইড করে আমার বাসায় আসেন। রিক্সাওয়ালা লোকটা বললেন, - না, বাবা! তোমার আব্বু-আম্মু বাসায় নাই। আজ থাক, অন্য একদিন আসলে খাবো।রিপন প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা হাতে নিয়েদেখে সবমিলিয়ে পাঁচশ পঞ্চাশ টাকা আছে। সে সব টাকা রিক্সাওয়ালা লোকটার হাতে দিয়ে বলল,- এইটা আপনি রাখেন। টাকা হাতে নিয়ে লোকটা রিপনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,- এতো টাকা কেন, আঙ্কেল! আমাকে আশি টাকা দিন।রিপন হাসতে হাসতে বলল,- ওগুলো আপনার কাছে রেখে দিন। বেশিদিন নয়; আরমাত্র ৬ মাস! তারপর থেকে আপনার আর কষ্ট করা লাগবে না। আপনার ছেলে বুয়েটে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে! সামনে আপনার সুদিন।লোকটা রিপনের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।

ছেলেবেলার কোরবানি

ছেলেবেলার কোরবানি


ছেলেবেলার কোরবানি
আহমদ মেহেদী 

কোরবানির ঈদের আর কয়েকদিন বাকি । আমি, সোহেল, সাঈদ,আনিস ও আবদুল্লা আজ স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ার পর মনে রাজ্যের আনন্দ নিয়ে নাওতলা কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলতে চলে গেলাম । আমরা তখন নাইনে পড়ি । টেনের সাথে খেলা হবে আজ। যেটা ভাবতাম সেটাই তখন করা চাই আমাদের । আমাদের খেলা শুরু করার সাথে সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল । সাঈদ স্কুল ড্রেস খুলে কোমরে বেধে নিল , সে প্রথম বল করবে । আহারে ! বৃষ্টিতে মাখামাখির সে সময় গুলো কোথায় হারিয়ে গেল ।
খেলা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । আমি নানা বাড়িতে থাকি । বইগুলো রেখেই আমি আর তাজু মসজিদের ঘাটলায় গোসল করতে নেমে গেলাম। সাঈদরা যে যার বাড়ি চলে গেছে । দুজনে পানিতে নেমে আছি ।
তাজু বলল-আরে কালতো রবিবার কোরবানির প্রথম হাট, যাবি ?
-যামুনা মানে , অবশ্যই যাব।
-চল সিনেমা দেখি আসি কাল । বারোটা থেকে তিনটা  তারপর সোজা কোরবানির হাটে ।
-আমার কাছে টাকা নাইরে দোস্ত ।
-তুর টাকা লাগবো না ,আমি দেব ।

শুনেছি নানা গরু কিনবে আগামী বুধবার । নানা একাই কোরবানি দেন। তাজুরা কোরবানি দিতে পারতো না বলে আমার মন খারাপ লাগতো খুব। কেন? সে ‘কেন,-র উত্তর খুজতে গিয়ে তখন নিজেকে অপরাধী মনে হতো । মামাদের সাথে গরু কিনতে যেতাম কিন্তু তাজুকে তখন বললেও আমার সাথে যেতো না। আমার এই ব্যাপারটা ভাল লাগতো না । গরু বাড়িতে আনার পর তার জন্য খড় আনতে যেতাম পাশের বাড়ি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম । কোরবানির আগ পর্যন্ত তাকে চোখে চোখে রাখতাম  । সন্ধ্যার আগে খেলার মাঠ থেকে আসার পর তাকে একনজর না দেখলে যেন পুরো পৃথিবীই বৃথা। কোরবানির আগের রাতে নাকি গরু স্বপ্নে দেখে তাকে জবাই করা হবে ! সে কথা ভেবে পশুরা কেঁদে উঠে । কাল ঈদ। সে দৃশ্য দেখার জন্য আমি আর তাজু অধীর আগ্রহে ছুটে গেলাম তার কাছে । এখনি মাগরিবের আজান দিবে এমন অবস্থা । তাজুর চোখে জল ! আমার চোখ ছলছল করে উঠল । সেদিন সত্যিই  এই পশুটির ভেজা চোখ দেখে আমাদের কচি মনে দাগ কেটে গেছে খুব। সে দাগের অস্তিত্ব এখনো আমি টের পাই।
 ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি এলাম। মসজিদের ইমাম এক রক্তমাখা বিশাল ছুড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। তিনি পাশের বাড়ি থেকে গরু জবাই করে এসেছেন । এবার আমাদেরটার পালা। আমরা শেষ বারের মতো একবার তাকে দেখে আসলাম, আদরও করলাম।  জবাই করার সময় সামনে থাকিনি । গোশত কুটাকুটি চলছে। এর ফাকে নানা কলিজাটা ভাগ করে একটা অংশ এবং কিছু গোশত রান্নার জন্য দিয়ে দিতেন। নানী ও মামানি আগে থেকেই মসলা বেটে রেডি করে রাখতো । আমি সবার আগে মামানির কাছে চলে যেতাম  কারন আমাকে সবার আগে খেতে হবে । রান্না ঘরের সামনের দেয়ালের কারনে কেউ আমাদের দেখছে না । সবাই ব্যস্ত। তাজুকে  বললাম-যা,আকতার ও বেলাল ডেকে নিয়ে আয় । মামানিও আমাকে অনেক আদর করতেন-আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারতেন। সে এক পেয়ালা গোশত দিয়ে বললেন- যা,পাক ঘরের পিছনে চলে যা, দেখিস তোর নানি যেন না দেখে । তাজুদের গোশত খাওয়াতে পেরে নিজেকে একটু হালকা লাগছে যেন। তাজুদের সাথে গোশত খাওয়ার সেদিনের দৃশ্য এখনোও আমি প্রতিটি ঈদে মিস করি খুব । ইচ্ছে করে আবার জীবনের ঐ পিছনের হাটে চলে যাই। একটা পেয়ালা  আর কয়েকটা হাত, সবার চোখে-মুখে অন্তরের নির্মল হাসির ঝলকানি সে তুলনায় হোটেল মিয়ামি আমার কাছে কিছুইনা ।


নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা

মোস্তাফিজুল হক’র গুচ্ছকবিতা

মোস্তাফিজুল হক’র গুচ্ছকবিতা
 

লুকোচুরি প্রেম

পাতার আড়ালে আঁকা লুকোচুরি প্রেম;
ভালোবেসে হয়ে ওঠে ইরানি গোলাপ!
শিউরে উঠার অনুভূতি সুখেথ
আমার এ প্রাণ রাঙিয়ে বিলীন!

গল্পের মায়াবীরাত ভাসে যমুনায়...
দুটোচোখে নীরবেই ধীরে নদী বয়!

চন্দ্রাবতী মন

মায়াবী পূর্ণিমারাত।
কারো কারো চোখে মেঘের তীব্রতা বাড়ে;
ঢেকে ফেলে চাঁদ!
ঘোলাটে দুচোখ যার, তখন দুচোখে তার
পূর্ণিমাও অমানিশা...
চন্দ্রপুকুরে যে ডুবে- তার চন্দ্রাবতী মন;
অমানিশা তারে কী করে ভোগায়?

বেসাতী প্রেম

কোম্পানিওয়ালা মন, ছককেটে প্রণয়-
বেসাতী সুখের প্রেম, মালিকানা হিস্যা।
এখানে ওখানে লাভ,
অঢেল পিরিতি ঋণ।
ছাপোষা নবিশ চোখ- খতিয়ান ভুল;
প্রণয়ের ভারে ক্ষতি,
সন্দেহে ছাঁটাই পিরিতের ক্লার্ক!
দুদিন উপোস রেখে পিরিতির যোগ,
খোলস পাল্টানো মুখ; স্বভাবে মুনাফাখোর।

খাতক

জলের প্রবাহে নদী ভাঙনের কথা বলে...
তার এ স্বভাব মেনে দুপাড়ে বসতি হয়।
স্রোতের করালগ্রাসে ভেঙে যায় ঘর;
ভাঙনের তোড়ে ভাসে মুখোমুখি বসা
মায়াবী উঠোন!
নোনাজল ফেলে দিয়ে নদীকে খাতক ভেবে ফিরে আসে কেউ...
ভেঙেচুরে নদীপাড় শ্রীহীন ভীষণ,
তবু কি অসুখী নদী?
চেতনার নদী তবে কেন সুখী নয়?

পরগাছা

অশত্থ জড়িয়ে নেয় খেঁজুরের গাছ,
কাঁটার আঘাত তবু বোঝে না অশত্থ;
ভীষণ দাপিয়ে বাড়ে, প্রণয়ের ভারে!
নির্বিকার বিষকাঁটা নিয়ে
হাঁসফাঁস করে তবু বেঁচে থাকে গাছ।
সে গাছে আর কে বাঁধে কামনার হাঁড়ি?
ভূঁইপতির এদিকে মনযোগ নেই;
পতিত জমিতে বৃক্ষ বেড়েছে বাড়ুক।

প্রেরক:-
মোস্তাফিজুল হক
শেখহাটি, শেরপুর টাউন- ২১০০
জেলা- শেরপুর।
মোবাইল- ০১৭১৬৯৭৯৯৩৬
 

স্বজন দ্বিষৎ

 স্বজন দ্বিষৎ





স্বজন দ্বিষৎ

শফিক নহোর


আমি তখন মাল্টি-প্লানে ওয়েস্টার্ন আইটিতে কর্মরত, প্রতিদিন শত-শত কাস্টমার , পরিচিত অপরিচিত লোকজন আসছে ; প্রোডাক্ট কিনছে , কথা বলছে , সমাধান করা হচ্ছে কাস্টমারদের সমস্যা তবুও কেউ-কেউ অখুশি পৃথিবীতে সবাইকে খুশি রাখা সম্ভব না একজন নয়ন-অভিমুখে অকস্মাৎ বলে ওঠলো ,
- ভাই কেমন আছেন ?'
মুখে একটু মেকি হাসি এনে বললাম ,
- জ্বি ! ভালো আছি
এটা আছে , সেটা আছে , এটা দেন কিবোর্ডটা দেন , মনিটর নষ্ট হইছে ; ওয়ারেন্টি ছিল , দিচ্ছেন না কেন ওয়ারেন্টি ?'
নানা রকম কথা বলতে হয় কাস্টমারদের সঙ্গে আপনি তো দেয়ার আগে কত সুন্দর করে বলেছিলেন ;
- এটা একবছরের ওয়ারেন্টি , নষ্ট হলে নিয়ে আসবেন
-ভাই এক বছরের 'য়েক দিন পার হয়েছে ; দেখেন কোন সিস্টেম করে কোন কিছু করা যায় কিনা
কত রকমের আবদার যে থাকে মানুষের বিল পেপারে সবকিছু লেখা আছে তবু একের পর এক প্রশ্ন করে যাবে , একই জিনিস বারবার বলবে , '' একটা কথা আছে কাস্টমার অলওয়েজ রাইট " সেই মোতাবেক আমাদেরকে চাকরি করতে হয় সেলস-ম্যান হিসেবে
আমি কাস্টমারকে বিদায় দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একজন অপরূপা সুন্দরী দোকানে প্রবেশ করল,
-এক্সকিউজ মি ম্যাডাম , আই ক্যান হেল্প ইউ ?'
মেয়েটি মুসকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল , কোন জবাব দিল না আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম ; আমি মাথা নিচু করে অন্য কিছু খোঁজার ভান ধরলাম
মেয়েটি খবরের কাগজ উল্টো করে ধরে পড়ার চেষ্টা করছে , আমি তা দেখে ব্যঙ্গময় হাসি হেসে ঠোঁটের কার্নিশে ধরে রাখলাম কষ্ট করে
আমাকে লক্ষ্য করে বলল ,
- ওয়্যারলেস মাউস হবে কি ?'
- আমি মাথা নেড়ে তাকে সম্মতি জানালাম যে -হ্যাঁ হবে
- প্লিজ ! ওয়ান পিস
- হাউ মাচ প্রাইস ?'
- নাইন হান্ড্রেড ফিফটি টাকা অনলি ফর ইউ ম্যাডাম
কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম উনি বাংলাদেশে নতুন এসেছেন ;
কম্পিউটারের আনুষঙ্গিক কোন বিষয় প্রয়োজন হলেই উনি আমাদের দোকানে আসতেন একটা সময় ওনার সঙ্গে আন্তরিকতা গভীর হয় , বিশ্বাস বাড়ে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গাঢ় হয়

আমার ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত হয় মাঝেমধ্যে বেয়ারা কথা হতো ,আমার বিভিন্ন ছবিতে তার মন্তব্য থাকতো , আমি তাকে মন্তব্য করতাম কী আশ্চর্য একটি নাম , ইলিজা টাউন
অফিস থেকে বাসায় আসতে অনেক রাত হত , বউ রেগে থাকতো প্রতিদিন , আমি অসহায় মানুষের মত সবকিছু সহজে মনে নিতাম ছেলেমেয়ে , সংসারের কাজ রুপা , একাই সামাল দেয় মেয়ের সিপি রোগ , তিন-বেলা থেরাপি দেওয়া , ছেলেকে স্কুলে নেয়া আসা সংসারের অভাব অনটন রুপা , ট্রেলাসের কাজ করে , কিছু টাকা আসে প্রতিমাসে যা রুপার হাত খরচের টাকাপয়সা আর এক্সট্রা লাগে না তেমন তবুও আমি কখনো কখনো দুই চার বিশ-টাকা রেখে দেই ওর ভ্যানিটি ব্যাগে চেহারার দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয় ছেলেটি আজ দিন গরুর মাংস খেতে চেয়েছে ; হাতের যে অবস্থা ছেলেকে নয় ছয় বুঝ দিয়ে বললাম ,
-বাজান , আমি বেতন পেলে তোমার জন্য গরুর মাংসের তোহারি নিয়ে আসব এখন লক্ষ্মী ছেলের মত মায়ের কাছে একটু পড়তে বসো
কোনমতে ছেলেকে বুঝিয়ে , পাশের রুমে একটা বই নিয়ে পড়তে বসলাম আজকাল এত ব্যস্ত হয়ে গেছি ; বই নিয়ে বসবার সময় একদম নেই বউ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকবে ! সারাদিন টিপাটিপি কথা বলতে গেলেই ,
-তোমার সংসারের কোন কাজ ফেলে-তো আমি মোবাইল চালাচ্ছি না সংসারের কোন কাজটা তোমার দিয়ে হয় শুনি ?'
কথার পরে কথা বলতে গেলেই বাসায় অশান্তি শুরু হয়ে যাবে আমি চুপচাপ ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে অনেক অন্যায় আবদার মেনে নেই আমি নিজেই ভাবি , সংসারের জন্য ছোট চাকরি করে কি করতে পারলাম ঠিকমত সংসার চারাতে পারছি না , প্রতিমাসে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে মনে হচ্ছে দেশে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে ; কোরবানির ঈদ ছাড়া ঘরে গরুর মাংস উঠেনা বউয়ের পছন্দ মত কোনদিন বাজার করতে পারলাম না বউয়ের প্রতি আমার সত্যিকার অর্থে কোন অভিযোগ নেই অভিভাবক বিহীন একটি সমাজ, ধীরে ধীরে অতল গভীরে তলিয়ে যাবে সংসারের মত


সচরাচর মোবাইল ফোনের লক খোলা থাকে রুপা, সেদিন হুট করে আমার মোবাইলের বার্তা বিভাগে ঢুকে গিয়েছে , আমার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছিলো হঠাৎ এরকম মনে হল আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম কেমন যেন অস্বস্তি বোধ গ্রাস করছে আমাকে মানসিকভাবে দিন-দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছি ; নাকি আমার কোন ডাক্তার দেখানো উচিত নয় ছয় ভাবতে ভাবতেই হাত থেকে কাঁচের-গ্লাস পড়ে গেল ,
-রুপা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল ,
-সারাদিন বাল করে , সংসার ঠিকমত চালাতে পারেনা বউ চালাতে পারে না গ্লাস ভেঙে সংসার উদ্ধার করছে শায়াকাঠি ! আজ দিন ধরে বলছি , মাথার চুল গুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে , বাসায় আসবোর সময় নারকেলের একটা তেল নিয়ে এসো কথা বলতে গেলেই আমি খারাপ , ছোটলোক কত রকমের যে বাহানা দেখাবে
-কি হলো কিছু বলছো না যে , তোমার মোবাইলের ইনবক্স দেখলে ঘৃণা হয় , চরিত্র এত নিচে নেমেছে তোমার, লজ্জা হয় না মেয়ে দিনদিন বড় হচ্ছে , ছেলে কদিন পরে তোমার মত মোবাইল চালাতে চাইলে , আমার তো গলায় ধরি দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই


-বাতেন তুমি বলও , ইলিজা টাউন কে ?' যে তোমাকে বিভিন্ন অরুচি পূর্ণ বার্তা দিয়ে মোবাইলের গোডাউন ভরে ফেলছে ; তোমার সঙ্গে আমার সংসার করা উচিত না শুধু ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার করছি ; তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি
-রুপা সত্যি বলছি , সে আমাদের দোকানের কাস্টমার পাকিস্তানি দূতাবাসে চাকরি করে সে একজন পাকিস্তানি মেয়ে
রুপা কোন কথাই মানতে নারাজ , আমি পরের দিন ইলিজা টাউনের সঙ্গে দেখা করলাম অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম , সে ভাল বাংলা বলতে পারে এখন
-তুমি আমাকে এত নোংরা বার্তা দিয়েছও কেন ? আমার স্ত্রী দেখে আমার সম্পর্কে খুব বাজে ধারণা করছে , এখন তো আমার সংসার টিকে থাকা দ্বায়
-বাতেন এত ভয় পাবার কিছু নেই আমার সম্পর্কে তোমাকে একটু বলি , আমি সরকারি একটা চাকরি করি , এখন তোমাদের দেশে আছি আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে যেতে পারি আমার একটা বদভ্যাস আছে আমি মূলত একজন হ্যাকার বিভিন্ন মেয়েদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ছেলেদেরকে ভয় দেখাই কি ব্যাপার এত ভয় পেয়ে গেলে কেন ? আমি ঢাকাতে আসবার পর থেকে প্রায় তিন-হাজার আইডি হ্যাক করেছি ; তার সমস্ত তথ্য তোমাকে দেখাবো !
তোমাদের দেশের মেয়েরা প্রচুর পরকীয়া সম্পর্ক করে এবং তাদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে শুরু !
আমি অবাক !
-তুমি এসব কি বলছো , আমি কোন ভাবেই ইলিজা টাউনকে বিশ্বাস করতে পারছি না তথ্য গুলো যখন আমাকে এক এক করে দেখাতে লাগল , আমার গলা শুকিয়ে আসছে , মানুষ কি তাই এত বেহায়া হতে পারে আমি অনেক কিছু যোগবিয়োগ করি দেখতে দেখতে একটি আইডির লিংক চোখে বেধে গেল
ছিঃ রুপা তুমিও ?' চোখ ঝাপসা হয়েছে , আমি কিছুই দেখতে পারছি না আর আজ এলিজা টাউন , আজ ঢাকা ছেড়ে চলে গেল