সময়ের পদাবলি

সময়ের পদাবলি




 আমার বয়স
খালেদ হোসাইন

আমাকে তুমি মনে করিয়ে দাও আমার বেশ বয়স হয়েছে। শুনে আমার হাসি পায়। আমি এই তো সেদিন জন্মালাম। আমার মা উঠোনের কোনায়- ছটিঘরে- মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করলো। চিরবিদায় নিলো সবার কাছ থেকে। আমি ভুবনডাঙার আলায় চিৎকার করে উঠলাম। মা নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকলো। পুকুরের পাড়ে তালগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে কেউ আজান দিলো। এই তো সেদিনের কথা, আমার সব মনে আছে।

তুমি বলো, আমার গোঁফ পেকে গেছে- একটি-দুটি চুল। শরীর কত ভারী হয়ে গেছে। তুমি চাও আমি আমার সকল আকাক্সক্ষার মাথা মুড়ে দিই। তাদের ডানা ছেঁটে দিই। তাদের পায়ে শেকল পড়াই। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তা আমি বুঝতেই পারি না! এই দেখ, আমার শরীর এখনো ভেজা- বাবা আমাকে পুকুরের জলে সাঁতার শেখালেন একটু আগে। আমি তাঁকে জোর করে ধরে রাখতে চাইলাম, তিনি আমাকে ঠেলে দিলেন গভীর জলে- আমি হাত-পা ছুঁড়তে থাকলাম। ভাবলাম, বাবা আমাকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দিলেন। না, তিনি বড় একটা মাছের মতো আমাকে পাঁজা কোলে করে তুলে আনলেন, মুখে হাসি।
আমি যখন ডুবে যেতে থাকি, কেউ আর এখন আমাকে রক্ষা করে না। তবু দেখ, আমার পায়ে পুকুরপাড়ের সেই কাদা।

না, আমার তেমন বয়স হয়নি। এই তো কিছুক্ষণ আগে আমার বড় বোন আমাকে পরীদের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গেল। বিশাল সরোবরের চারপাশে আমরা পরীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম। তারা আমাকে খাওয়ালো টকটকে লাল সিরাপ-দেয়া পাঙ্খা-বরফ- ছুঁয়ে দেখো, কলজেটা এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে। তারা আমাকে বানিয়ে দিলো ফিনফিনে ফড়িঙের পাখার মতো কাগজের ঘুড়ি- তাকাও আকাশে, ওই যে-  এখনো তা মেঘলোক স্পর্শ করেনি। এই যে আমার পায়ে ঘাসের চপ্পল- তা পরীদের দেয়া। আমার কপালের চুল যখন হঠাৎ উড়ে যায়, তুমি বুঝতে পারো না, আয়াতুল কুরসি পড়ে মা আমার কপালে ফুঁ দিচ্ছেন।

আসলে, আমার জন্মানোর কথা ছিলো অনেক আগে। অন্তত কয়েক শতক। যখন আকাশ আরো নীল ছিলো, ঘাসে আরো গন্ধ, নদীতে আরো জল, বুকে আরো ভালোবাসবার তৃষ্ণা। কিন্তু আমার দেরি হলো, তাই আমার বয়স হলো না।      


ফাদি আবু সালাহ্
লতিফুল ইসলাম শিবলী

তোমাকে দেখার আগে জানা ছিল না-
মানুষের পা কেড়ে নিলে তার পিঠে গজায় ডানা,
আর হাঁটতে বাধা দিলে মানুষ শিখে যায় উড়তে।

ওরা শুরু করেছিল তোমার পায়ের নিচের মাটি থেকে,
তাই প্রথমে ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার জমিন।

দেশ নামের যে এক চিলতে জেলখানায় তুমি থাকতে
সে জমিন শত শত শহীদের ভিড়ে কবেই হয়ে গেছে মর্ত্যের জান্নাত।

এরপর ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার শৈশব,
অথচ তুমি কখনোই শিশু ছিলে না,
তুমি ছিলে সেই জান্নাতের সবুজ আবাবিল।

আব্রাহার হস্তি বাহিনীর উপর কঙ্কর ছুড়ে যেভাবে তছনছ করে দিয়েছিল,
আজ তাবৎ পৃথিবী জানে তুমিই সেই আবাবিল,
একই কায়দায় ছুড়ে মারো কঙ্কর আব্রাহাম ব্যাটেল ট্যাঙ্কের দিকে।

তোমাকে তো ছেড়ে দেয়া যায় না-
এরপর ওরা কেড়ে নিলো তোমার তারুণ্য,
তোমাকে জেলে পুরে ওরা ভেবেছিলো
শুকনা পাতার নিচে ওরা লুকিয়ে রাখবে আগুন।

আটলান্টিকের এপার ওপার হয়ে সে আগুন ছড়িয়ে পরেছে
সাতটি সাগর মহাসাগরের কুলে উপকুলে

আর তোমার দৃপ্ত পদভারে যখন কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করেছে
জেরুজালেমের প্রাচীন দেয়াল
ঠিক তখনি ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার অনিন্দ্য সুন্দর পা জোড়া।

সাধ্য আছে কার
কি ভাবে থামাবে ওরা তোমার চার চাকার হুইল চেয়ার,
ওরা জানত হুইল চেয়ারে বসেও বৃদ্ধ ইমাম শেখ ইয়াসিন ছিলেন কতটা অপ্রতিরোধ্য,
সেই বৃদ্ধকে হত্যা করতে যারা হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে মিজাইল ছুড়তে পারে,
তারা তোমার এই উদ্ধত যৌবনের কাছে কেমন অসহায় কাপুরুষ।

ওরা জেনে গেছে তোমার প্রাণশক্তির উৎস,
ওরা জেনে গেছে এই ফিলিস্তিনের মাটিতেই ডেভিডের ছোড়া ঢিলের আঘাতে
কি ভাবে পরাজিত হয়েছে জালিম গোলিয়াথ

হে ফাদি আবু সালাহ্, হে পাথর ছোড়া আবাবিল-
তাই আজ ওরা কেড়ে নিলো তোমার জীবন।

আহা, জান্নাতের সবুজ পাখি
তোমাকে দেখার আগে জানা ছিলো না
পা’হীন মানুষের পিঠে গজায় এমন উড়াল ডানা।

আমরা জানি তুমি ফিরে আসবে বলেই দিয়েছ এই উজাড় উড়াল,
আমরা প্রতীক্ষায় আছি, ঝাঁকে ঝাঁকে
ফিরে আসো, আবাবিল; ঝাঁকে ঝাঁকে...

একমুঠো শৈশব
সোহেল বীর

দু’হাত পেতে আছি, একমুঠো শৈশব পাওয়ার আশায়-
হলুদ সর্ষে ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলা শৈশব
ছেলেমেয়ের প্রভেদ ভুলে বউছি আর গোল্লাছুট খেলার শৈশব
পুতুলের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার শৈশব
বর্ষায় কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেওয়ার শৈশব
কাগজের উড়োজাহাজ বানিয়ে আকাশ ছোঁয়ার শৈশব
বাবার কাঁধে চড়ে বাজারে যাওয়ার শৈশব
মায়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানোর শৈশব
নানীর কাছে রূপকথার গল্প শোনার শৈশব!

একমুঠো শৈশব আমায় ভুলিয়ে দেয় যান্ত্রিকতার দহন
আমি ভুলে যাই এই শহরের যত সব কৃত্রিমতা
ভুলে যাই নন্দিনীর বিশ্বাস ঘাতকতা !

কথা আছে
সাজ্জাক হোসেন শিহাব

বুক ভরা ভালোবাসা । অথচ আমার
দু’চোখ দেখেনা আজ জবার পাপড়ি !
অপেক্ষায় দিন চলে যায়, আত্নভোলে
রক্তজবা ফুল ! আমি জেগে থাকি একা,
একটা পুরনো পত্র পড়বো বলে ! এ-
চোখের কোণায় জমা হয় অশ্রুজল !
সেই জলে, যে জলের প্রেম বাতাসের
বুকে আয়ু নিয়ে ছোটে । বহুদিন একা
শুনি নাকো জীবনের এমন মায়াবী গল্প ।
আমার আকাশে আসেনি মানুষী;
আত্না-আত্না বিনিময় দিয়ে মুছে দিবে
বলে চির খরা দশা ! অথচ সময়
ঠিক জানে- কতো কথা তোমার আমার !


লোভ : ফাহমিদা বারী

 লোভ : ফাহমিদা বারী



 লোভ
ফাহমিদা বারী

জানালার পাশে রোদে শুকোতে দেওয়া বরইয়ের মিষ্টি আচার গুলো দেখে প্রাণটা একেবারে আঁইঢাঁই করে উঠলো। আহা! কী মিষ্টিই না দেখাচ্ছে! এক্ষুনি টপাটপ কয়েকটা মুখে পুরতে না পারলে প্রাণটাই বুঝি বেরিয়ে যাবে।
এদিক ওদিকে তাকিয়ে হাতটা আচারের বয়ামের দিকে বাড়াতেই কোথা থেকে যেন গিন্নি উড়ে এসে ছোঁ মেরে বয়ামগুলোকে সরিয়ে নিয়ে গেল। করলার তিতা গলায় মিশিয়ে বললো-
‘এমন ছোঁক ছোঁক স্বভাবের মানুষ জীবনে দেখিনি বাপু! মিষ্টি কিছু দেখলেই লোভে জিভ লকলক করে। ডায়াবেটিস কি আমার নাকি তোমার? লোভ সামলানো কাকে বলে সেটাও জীবনে শিখতে হয়, বুঝেছো?’
এমনি কিছু জ্বালাময় বাক্যবাণ ঝেড়ে গিন্নি সেই জায়গা ত্যাগ করলো। সাথে আচারের বয়ামগুলোকেও নিয়ে গেল। মনে মনে গিন্নির চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করলাম। খেতেই যদি না দেবে তাহলে এত নানা রঙের আচার বানানো কীসের জন্যে? আর সেগুলোকেও এত সাজিয়ে গুছিয়ে চোখের সামনে শুকোতে দেওয়ার উদ্দেশ্যটাই বা কী?
ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে গত বছর। কত আগে বাঁধিয়েছি তা জানি না। অবশ্য বয়সও কিছু কম হয়নি। চল্লিশের কোঠা ছুঁয়ে ফেলেছি ভালোভাবেই। এই বয়সে শুধু ডায়াবেটিস কেন, হার্ট কিডনী লিভার কোনোকিছুর অসুখই আজকাল বাদ যায় না।
যেদিন ডায়াবেটিস ধরা পড়লো, পাংশু মুখে ভাবতে বসলাম...জীবনের মিষ্টি স্বাদটা আজ থেকে চিরতরে বিদায় নিল। এমনিতেই ধাক্কা খাওয়া জীবনে ওটুকুই যা মিষ্টি অবশিষ্ট ছিল। বাকী সবই তো তিতাই তিতা!
রাস্তার ট্রাফিক জ্যাম, অফিসের বসের রক্তচক্ষু, বাজারে অগ্নিমূল্য, সহকর্মীদের ল্যাংমারা, আত্মীয় স্বজনের টিপ্পনী...এবং সেই সাথে গিন্নীর খ্যাঁচখ্যাঁচানি। জীবনে মিষ্টি বলতেই ছিল চমচম, সন্দেশ, পানতোয়া... আহা!
আর কী! এখন থেকে সেটাও নাই হয়ে গেল।
ডাক্তার আমার পাংশুটে মুখ দেখে ফিক করে হেসে ফেললেন,
‘আরে মশাই, তাও তো যৌবনকালটা ম-া মিঠাই প্রাণভরে চেখে দেখতে পেরেছেন। আজকাল বিশ-বাইশ বছরেও এই রোগ ধরে বসে, জানেন?’
আমি যেন কিছুটা সান্তনা খুঁজে পেলাম। যাক, আমি একাই এই ইহজগতে একমাত্র ভূক্তভোগী নই তাহলে! খুশি চেপে রেখে দুঃখ দুঃখ মুখ করে বললাম-
‘সত্যি নাকি? কী বলছেন ডাক্তার সাহেব!’
‘জি হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। বরং আমি তো বলবো একটা বয়সের পরে ডায়াবেটিস আশীর্বাদের মতো। কন্ট্রোল করার জন্য আর কাউকে ঠেলতে হবে না। এটাই আপনাকে ঠেলবে।’
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। মনে মনে বললাম- ‘তাই যেন হয়!’
কিন্তু কী হতে গিয়ে কী হলো! এর পরে থেকে আমি আর কী কন্ট্রোল করবো, গিন্নি ছেলেপুলে সবাই এখন আমাকে কন্ট্রোল করছে। যেটাতেই হাত বাড়াতে যাই, সাথে সাথেই আমার ডায়াবেটিসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিজেরা দেদারসে আমারই চোখের সামনে সমানে চব্য চোষ্য খেয়ে যাচ্ছে। আবার সেগুলোর জোগানদারও হলাম আমি। এমনই আমার পোড়া কপাল!
মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম, নিজে খেতে পারবো না তো কাউকে খেতেও দিব না। দেখি, আমার চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে আচার শুকোতে দেওয়া হয়।
ছুটির দিন বলে বেশ একটা ভাতঘুম দিয়ে উঠলাম। সপ্তাহের বাকী পাঁচদিন তো এই জিনিসের সাথে মোলাকাতই হয় না! বিকেলে চা খেয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসবো বলে বের হতে যাচ্ছি, এমন সময়ে গিন্নি এসে এক ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিলো। হাতে নিয়ে দেখি বেশ লম্বা ফর্দ। চালকুমড়া, চিনি, সরিষা তেল, বরই, তেঁতুল, জলপাই, কাঁচা আম...বাব্বাহ! এ যে একেবারে জিভে জল ধরানো সব জিনিসপত্র। গোমড়া মুখে বললাম-
‘সেদিনই না একগুচ্ছ এসব জিনিসপত্র এনে দিলাম! আজকে আবার কেন?’
গিন্নি ঠোঁট উল্টিয়ে আহলাদের সুরে বললো-
‘বাঃ! আচার, মোরব্বা বানালে কি একা একা খাবো? আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীকে না দিয়ে খাওয়া যায় নাকি?’
‘বাবাহ! আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীও ভাগ পাচ্ছে? কেবল নিজের পতিদেবতাকেই চোখে দেখতে পাচ্ছো না, তাই না?’
‘দেখ, এত বেশি লোভ ভালো না বুঝেছো? একটু আত্ম নিয়ন্ত্রণ করাও শিখতে হয়।’
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো।
পাশের বাসার ছোট মেয়েটা এসেছে। তার বাবা দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। চকলেট, খেলনা... ইত্যাদি বিস্তর জিনিসপাতি এনেছেন। কিছু জিনিস আমাদের ছেলেটার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সেগুলো হাতে নিয়েই গিন্নির ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেল। আমাকে ঠেস দিয়ে বললো-
‘এসব আর কিছু না, দেখানো...বুঝেছো? আমরা দিই আমের আচার, আর তারা দেয় বিদেশী চকোলেট। দেখাবে না তো কী! থাকলে দেখাবে নাই বা কেন? তোমার মতো তো আর খালি কলম পিষে না। তাদের অনেকদিকে আমদানী আছে!’
আমি হাওয়া বদলের পূর্বাভাস টের পেলাম। পাশের বাসার ভদ্রলোক বিশিষ্ট সরকারী আমলা। সচিবালয়ে বসেন। প্রায়ই কীসের যেন ট্রেনিং ফ্রেনিং করতে বিদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি তো বিদেশী চকোলেট আনতেই পারেন!
সেকথা গিন্নীকে অনেক বুঝিয়েছি। লাভ হয়নি। তার এক কথা,
‘বেশ তো! সে না হয় অফিস থেকে ট্রেনিংএ যাচ্ছে। আমরা নিজেদের টাকায় বিদেশ যাবো। তুমি তোমার আয় বাড়াতে পারো না, সেকথা বল!’
আবার যাতে প্রসঙ্গ সেদিকে না যায় তাই আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম-
‘কী যেন আনতে হবে বলছিলে... দেখি এগুলো বুঝিয়ে দাও! কতটুকু করে আনতে হবে?’
গিন্নি ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
‘কিচ্ছু আনতে হবে না। যাও... তুমি যে রাজকার্য করতে যাচ্ছিলে, সে কাজেই যাও!’

অফিসে জুন মাসের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে।
নিঃশ্বাস ফেলার জোঁ নেই। আমার টেবিলের ওপরে ফাইলের লম্বা চূড়া। দেখে শেষ করতে পারছি না। ভালোমত চেক না করে কোনো ফাইল ছাড়তেও পারছি না।
এই ভয়ানক ব্যস্ত সময়ের মধ্যেই পিয়ন এসে খবর দিল, বড় সাহেব সালাম দিয়েছেন। এই সময়ে কাজ বন্ধ রেখে উঠে যাওয়াও মুশকিল। ফিরে এসে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয়। আমি মুখ ভর্তি বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলাম-
‘এখনই যেতে হবে?’
‘জি স্যার, এই মূহুর্তেই!’
আর কী বলার আছে! ফাইলের স্তুপ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, বসের সাথে সাক্ষাত করে আসার জন্য।
আমার বসের চেহারা বেশ তেল চুকচুকে। বয়সে আমার চেয়ে ছ’সাত বছরের বড়। কিন্তু বেশ নধরকান্তি শরীর, আঁটোসাটো মুখ। আমার মতো চিমসে ধরা মুখ নয়। আর তা হবেই বা না কেন? খাওয়া দাওয়াতে তো আর কার্ফু জারী করা নেই, যে চেহারা চিমসে যাবে!
গিয়ে দেখি, বসের রুম আরো গোটা তিনেক লোক আগে থেকেই বসা। টিকাদার শ্রেণীর কেউ হবে বলে মনে হলো। প্রত্যেকের সামনে একটা করে  প্লেটে রসগোল্লা, সমুচা। আমি যেতেই বস সাদরে সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন-
‘এই যে, আসুন আসুন নিয়াজ সাহেব। আপনার কথাই হচ্ছিলো। কী ব্যাপার আপনাকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? খাওয়া দাওয়া করেন না নাকি?’
আমি বেশ অবাক হলাম। বসের মুখের এমন আদর আমার কপালে তেমন একটা জোটেই না বলতে গেলে। ইনি এখানে আসার পরে থেকেই সুযোগ খুঁজছেন, কীভাবে আমাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। আমিও মাটি কামড়ে পড়ে আছি। চাকরির পরে থেকে এই ডিভিশনেই আছি বেশ অনেক বছর। কেমন যেন বাপদাদার ভিটে বলে মনে হয়। চাইলেই কেউ ‘হঠ যা’ বলে হঠিয়ে দেবে এটা মানতে মন চায় না।
আমি চেয়ারে বসতে বসতে বললাম-
‘এই তো স্যার, খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করতে হয় তো, তাই আর কী!’
‘আহ হা! কেন কন্ট্রোল করবেন এই বয়সে? বসুন, মিষ্টি খান।’ বস পিয়নকে ডাকার জন্য বেল টিপতে যেতেই বললাম,
‘স্যার, মিষ্টি খাব না...আমার ডায়াবেটিস।’
বস যেন ভীষণ দুঃখিত হলেন এমন গলায় বললেন-
‘এঃ হে! ডায়াবেটিস বাঁধিয়ে বসেছেন! নিশ্চয়ই খুব বেশি অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া দাওয়া করেছেন আগে, সেজন্যই এই দশা। আমার দেখুন না, আলহামদুলিল্লাহ এই বয়সেও ওসব বাঁধে টাধেনি। একটু লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই হলো, বুঝলেন না?’
আমি বুঝলাম। এই জ্ঞান এখন আমাকে সবাই দেয়। ফ্রি সার্ভিসিং এর মতো। আমি কাউকে বোঝাতে পারি না যে, বাপ-মা’র ছিল তাই আমারও আছে। সবাই নিজের মতো করে জ্ঞান দিতে থাকে। আমিও নিতে থাকি।
বস এবারে গা ঝাঁকানি দিয়ে বললেন-
‘আচ্ছা, সে যাক...আপনার সাথে কি এনাদের আলাপ হয়েছে?’
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম, সবক’টাই পুরনো পাপী। ইতিপূর্বে বহুবার আমার রুমে এসে জ্বালা যন্ত্রণা দিয়ে গেছে। সেসব কিছু ভেঙ্গে না বলে বললাম-
‘জি, স্যার আলাপ হয়েছে।’
বস সম্পূর্ণ ভিন্ন আলাপে চলে গেলেন এরপরে। আমি ধারণা করছিলাম, এরপরে কী বলতে পারেন। কিন্তু আমার সেইসব চিন্তাভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তিনি বললেন-
‘আপনার কি বিদেশে টিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নিয়াজ সাহেব? পাসপোর্ট করা আছে? আজকাল পাসপোর্ট করা কি ঝক্কির কাজ সেটা জানেন? সারাদিন পার্সপোর্ট অফিসে গিয়ে বসে থাকতে হয়। তবুও বেশিরভাগ দিন কাজ হয় না। এই যে, আলম সাহেবকে দেখছেন...উনার এক ভাই আছেন পাসপোর্ট অফিসে। সেখানে গিয়ে শুধু উনার নাম বলবেন। সেকেন্ডেই কাজ করে দেবে।’
আলম সাহেব বসের কথার প্রমাণস্বরূপ ঘাড় নাড়িয়ে বললেন-
‘জি, স্যার। এসব তো কোন বিষয়ই নয়। আর বিদেশে যাওয়ার চ্যানেল ট্যানেলের সন্ধান চাইলেও দেওয়া যাবে স্যার। এই তো, স্যারকেই আগামী মাসে একটা সুযোগ করে দিলাম।’
আমি বসের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার মুখে মুচকি মুচকি হাসি। বলে কী? এই লোকের হাতে বিদেশে যাওয়ার চ্যানেল আছে? আমি বিষয়টা খোলাসা করে জানার জন্যই বললাম-
‘আপনি কীভাবে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবেন? ঠিক বুঝতে পারলাম না!’
‘হেহ হে... সেসব ভেতরের কথা। সব কি খুলে বলা যায়? আমি তো আর ব্যবস্থা করবো না, শুধু জায়গামত একটু নাড়া দিব...ইয়ে মানে বুঝতে পারলেন না? যাক, সেসব। শুধু কিছু দরকার থাকলে অবশ্যই বলবেন।’
এবারে আমার বস বললেন-
‘আরে আমাদের চাকরিতে মজাটা কোথায় বলুন? মাঝে মাঝে একটু দেশের বাইরে ট্যুর ফ্যুর না করতে পারলে এসব চাকরি করতে কি আর ভালো লাগে?
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলারাই তো সব সরকারী ট্যুরগুলো নিয়ে নিচ্ছে। আমরাও চাইলে আমাদের ডিপার্টমেন্টে কিছু বিদেশী ট্রেনিং এর ব্যবস্থা রাখতে পারি। আর এসবের জন্য আমাদের শুধুমাত্র একটু সঠিক জায়গাতে নক করতে হবে, বুঝলেন তো!’
আমি তেমন বেশি কিছু বুঝলাম না। তবু ঘাড় নেড়ে বললাম-
‘জি, স্যার বুঝেছি। তবে আপাতত স্যার আমার বিদেশ যাওয়ার তেমন কোনো চিন্তাভাবনা নেই। তাই এই মূহুর্তে পাসপোর্ট না করালেও চলবে। এবারে উঠি স্যার? মানে... অনেক ফাইল জমে আছে!’
‘আরে, করবেন ফাইলের কাজ! কাজ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! বসুন বসুন! এই যে আলম সাহেবের পাশে যাকে দেখতে পাচ্ছেন, তিনি হলেন মহিউদ্দিন সাহেব। আপনার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তির কাজ শেষ? যদি শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে ইনি আপনাকে হেল্প করতে পারেন।’
কথাটা শুনেই গিন্নির সেদিনের ফোঁসফোঁসানি মনে পড়ে গেল... ‘এই সরকারী চাকরির জোর খাটিয়ে কতজনে কত ভালো ভালো স্কুলে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করে। তুমি হচ্ছো একটা ঢোঁড়া সাপ। কিছুই করতে পারলে না জীবনে!’
আমার মুখের ভাব দেখে বস কিছু বুঝলেন কী না কে জানে, দ্বিগুণ উদ্যমে বললেন-
‘এই যে মহিউদ্দীন সাহেব... নিজাম সাহেবকে আপনার লিংকগুলো দিয়ে দেবেন আজই। আপনারা থাকতে আমরা কেন বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করতে এত ঝামেলা পোহাতে যাব, বলুন!’
মহিউদ্দীন সাহেব তার মুখের কথা কেড়ে নিয়েই বললেন-
‘জি স্যার। নিশ্চয়ই...নিশ্চয়ই!’



বস এক এক করে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। সাথে প্রত্যেকের অনন্য একেকটা ক্ষমতার সাথেও পরিচিত হলাম। শেষমেষ একটু জোর করেই উঠে পড়লাম। নির্দিষ্ট সময়ে ফাইলগুলো ছাড়তে না পারলে বসই একসময় আমাকে চিনতে পারবেন না।
‘এবার উঠি স্যার। অনেক গুলো ফাইল পড়ে আছে, কাজ একেবারে এলোমেলো... বড় সাহেব যেকোন সময় তাড়া দিবেন...।’
‘উঠবেন? আচ্ছা উঠুন। ইয়ে...নিজাম সাহেব...আপনার কাছে আজ তিনটি ফাইল গিয়েছে মনে হয়। আমি মার্ক করে দিয়েছি। দেখলেই বুঝতে পারবেন। ফাইলগুলো ছেড়ে দিয়েন। বেশিক্ষণ আটকে রাখবেন না। বুঝেছেন?’
এতক্ষণে বুঝলাম। এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। মালিক তো চাইলেই যেখান থেকে খুশি সেখান থেকেই ঘাস কাটতে পারেন। কিন্তু ঘোড়া যদি জেদ ধরে বসে থাকে, তাহলে তাকে তো একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে সরিয়ে দিতে হয়...নাহলে আরাম করে ঘাসটা কাটবে কীভাবে?
আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার রুমে ফিরে এলাম।

গিন্নির ক্যাচক্যাচানিতে ইদানীং বাসায় থাকতেই ইচ্ছে করে না। সারাক্ষণ কানের কাছে অভিযোগের ঘণ্টা বাজাতে থাকে ।
‘দিনরাত অফিসে পড়ে থাকো। অথচ যে লাউ সেই কদু! নিজের কিছুই পাল্টাতে পারলে না! না স্বভাবটা... না অভাবটা!’
‘লোকজন অল্প বয়সেই এপার্টমেন্ট কিনে ফেলে। এমনই আমার পোড়া কপাল, এপার্টমেন্ট তো দূর...একটা ইটও আজতক তুমি কিনতে পারলে না!’
‘দেশের বাইরে যাওয়া তো আর আমাদের ভাগ্যে নেই, বাড়ির কাছের কক্সবাজারে লোকে বছরে দুইতিন বার করে যায়। আর তুমি!
‘পাশের বাসার ভদ্রলোক যে চাকরি করেন তুমিও সেই একই রকম সরকারী চাকরিই করো। অথচ তার আছে ইয়া বড় গাড়ি আর তোমার আছে ইয়া বড় দড়ি!’
অভিযোগ অভিযোগ আর অভিযোগ। শুনতে শুনতে মাথার মধ্যে কেমন যেন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়।
স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি হারিয়ে ফেলি। অফিসে গিয়েই সব ফাইল ধুমধাম সই করে ফেলি। কোন বিল পে-িং রাখি না। সব আপডেটেড। ঠিকাদার যে আইটেমে যত টাকা ধরে দেয়, সব সই করে দিই। ঠিকমত চেকও করে দেখি না আর। কী হবে এত সাধু সেজে? গিন্নি যা চায়, তাই হোক!
স্যারের চিনিয়ে দেওয়া মহা কামিয়াব লোকদের সাথে তাল দিয়ে চলি। হাত কচলাতে কচলাতে একেকজন জিজ্ঞেস করে-
‘স্যার, কোন সেবা লাগবে কী না অধমকে একটু বলবেন।’
‘সেবা? আচ্ছা, বছরের এই সময়ে তো কক্সবাজারে হোটেল বুকিং পাওয়া যায় না...তাই না? ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’
‘কী বলেন স্যার? এইটা কোনো বিষয়? এক্ষুণি সব বন্দোবস্ত পাকা করে আপনাকে প্লেনে উঠিয়ে দিচ্ছি!’
যেমন বলা তেমন কাজ! আসলেই মহা মহা কামিয়াব লোক একেকজন। সোজা রাস্তায় যা মাথা কুটেও করতে পারা যায় না, এরা আঁকাবাঁকা পথে দু’মিনিটেই তা করে ফেলে।
প্রথমবার প্লেনে উঠে গিন্নি বিমোহিত। ছেলেমেয়েরাও পুলকিত! হোক না ডোমিস্টিক ফ্লাইট, তবু তো আসল প্লেন! এই প্লেনে চড়েই তো সাঁই করে বিদেশ যাওয়া যায়। এটুকু যখন হলো, ওটুকু আর হতে দেরি কোথায়?
বাসে চড়ে অফিসে যাওয়া খুব কষ্টকর। ভাবছি খুব তাড়াতাড়িই একটা গাড়ি কিনে ফেলবো। হুট করে সবকিছু করতে গেলে লোকজনের চোখ টাটাতে পারে। প্রথমে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড কিনে একটু আইওয়াশ করে নিতে হবে। কিছুদিন পরে ‘নষ্ট হয়ে গেছে’ বলে ফেলে দিয়ে নতুন একটা কিনে নিলেই হবে।
গিন্নির মেজাজ মর্জি ইদানীং খুব সহনীয় মাত্রায় থাকে। হাসি ছাড়া আর কথাই বলে না! গলার সুরে আহলাদ ঝরে ঝরে পড়ে।
ইতিমধ্যে এপার্টমেন্টেরও দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছে। আমিও আর বসে নেই। শুরু যখন করেইছি, আর দেরি করে কী হবে? একটা এপার্টমেন্টও তাড়াতাড়ি বুকিং দিয়ে ফেলতে হবে। বুড়ো বয়সে কি ভাড়া বাড়িতে থাকবো নাকি?
আমি আজকাল বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছি। কারো বলতে হয় না, নিজে থেকেই সবকিছু কন্ট্রোল করে চলি। তেল চর্বি মিষ্টি একেবারে ধরিই না বলতে গেলে!
বেশিদিন না বাঁচতে পারলে এই আয়েশ ভোগ করবো কীভাবে? ভোগের জন্যই তো এতকিছু! মরে গেলে আর কী কাজে আসবে?
আমাকে কন্ট্রোল করে চলতে দেখে গিন্নি আমার মহাখুশী। ডগমগে গলায় বলে-
এই তো, এতদিনে তুমি আমার মনের মতো হয়েছো! আগে তো বুঝতেই চাইতে না। কী যে ছেলেমানুষি করতে! এত লোভ করা ভালো নয়। সবসময় এভাবে লোভ সামলিয়ে চলতে হয়, বুঝেছো ?’



সৃষ্টি সুখের উল্লাসে...

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে...


সৃষ্টি সুখের উল্লাসে...
শরীফ সাথী


           প্রিয় কবি বিদ্রোহী কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জানা অজানা কিছু কথা বিভিন্ন তথ্যের আলোকে পাঠকের চোখে ছেড়ে দিলাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসনসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। কাজী’ হচ্ছে কবির বংশের উপাধী। পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের মুত্তাওয়াল্লি। কবি ইসলামী চিন্তা ও ভাবধারার ভিতর দিয়ে বড় হন। শৈশবে নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। কবির জন্মের পরে তার চার ভাইয়ের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে সংসারেও ছিল অর্থনৈতিক দুঃখ। কবির বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। কবি তখন গ্রামের মক্তবের ছাত্র। মাত্র দশ বছর বয়সে কবি সুমধুর কন্ঠে পবিত্র কোরআন তেলওয়াত করতে পারতেন।  বাল্যকালেই পবিত্র কুরআনের অর্থ ও তাঁর মর্মবাণী শিক্ষালাভ করেন। দশ বছর বয়সে আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে কবি প্রাথমিক পরিক্ষায় পাশ করেন। এসময় কবি কয়েকদিন গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন হয়ে সংসারের আর্থিক অনটন কিঞ্চিৎ লাঘব করার চেষ্টা করেন। চাচা করিম কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষাদান করেছিলেন।
শৈশব কাল থেকেই কবি ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির। স্কুলের ধরাবাধা নিয়ম কবির ভাল লাগেনি। পড়াশুনা ছেড়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে লেটোর দলে যোগ দেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। লেটো গানের দলে কোন অশ্লিল গান পরিবেশন হতো না বরং বিভিন্ন পালা গান, জারি গান, মুর্শিদী গান ইত্যাদি পরিবেশিত হতো। অসামান্য প্রতিভার জন্য কবি লেটো দলের প্রধান নির্বাচিত হন। লেটো গানের দলে থেকেই কবি বিভিন্ন বই পত্র পড়ে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। এসময় তিনি কয়েকটি কবিতা, ছড়া গান রচনা করে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন। তারপর আসনসোলের এক রুটির দোকানে মাত্র ৫ টাকা বেতনে কাজ নেন। রুটির দোকানে কাজ করার সময় একজন দারোগা সাহেবের সহায়তায় কবি ময়মনসিংহের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানেও কবির মন না বসায় কবি নিজ দেশে ফিরে শিয়ারসোল হাইস্কুলে ভর্তি হলেন এবং মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি বৃত্তি ও লাভ করেছিলেন। কবি দশম শ্রেণী পড়াকালীন বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়ে সৈনিক হিসাবে করাচি গমণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কবিতা ও সাহিত্য চর্চা থেমে যায়নি। করাচি সেনা নিবাসে সহকর্মী একজন পাঞ্জাবী মৌলিবী সাহেবের সাথে কবির পরিচয় হয়। তাঁর নিকট থেকে কবি ফারসী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন এবং মহাকবি হাফিজ, শেখ সাদী (রঃ) প্রমূখ বিশ্ববিখ্যাত কবিদের রচনাবলী চর্চা করেন। এরপর থেকেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা, গল্প, উপন্যাস, হামদ নাত, গজল, সাহিত্য ইত্যাদির ব্যাপক রচনার তাগিদ অনুভব করেন।
   পারিবারিক সীমাহীন দুঃখ দূর্দশার মধ্যেও আজীবন বাংলা কাব্য ও সাহিত্য চর্চায় ব্রতী ছিলেন, ছিলেন বিশ্ময়কর প্রতিভার অধিকারি, বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে প্রচন্ড বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জালেম শাসক গোষ্ঠির অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছিলেন। কবির কাব্য ও সাহিত্য ইসলামী ও ঐতিহ্য বলিষ্ঠ ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল। কবিতা, হাম্দ, নাত, গজল ও ইসলামী গান প্রায় প্রতিটি বাঙ্গালী মুসলিমের হৃদয়কে করেছে জাগরিত। কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক ছিলেন। যদিও কবি একাধিক কবির ন্যায় সোনার চামস মুখে দিয়ে জন্মলাভ করেননি। চুরুলিয়ার কাজী বংশ এককালে খুবই সম্ভ্রান্ত ছিল বটে; কিন্তু যে সময় কবি নজরুল ইসলাম শিশু হয়ে আভির্ভূত হন, সে সময় এ বংশটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানীর নানা রকম বঞ্চনা ও শোষনের শিকার হয়ে আভিজাত্যের পশ্চাৎপট থেকে সম্পূর্ণ স্ফলিত হয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমান দারিদ্রের মধ্য দিয়ে কবির বাল্য, কৈশোর ও প্রাক যৌবন কেটেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি শিশুদের কবি, নিপীড়িতের কবি, প্রকৃতির কবি ও প্রেমের কবি হিসেবেও সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি শিশুদের জন্য এত সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন, যা পড়ে শিশুরা বিমোহিত হয়ে পড়ে। যুদ্ধ থেমে গেলে আড়াই বছর সৈনিক জীবন শেষে পল্টন রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার পর কবি নিজ মাতৃভূমি চুরুলিয়া গ্রামে ফিরে আসেন। এরপর কবির শুরু হয় একনিষ্ঠ কাব্য চর্চা। কবির লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। দৈনিক বসুমতি, মুসলিম ভারত, মাসিক প্রবাসী, বিজলী, ধূমকেতু পত্রিকায় সে সময় প্রকাশিত প্রতিটি লেখা আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রার যোগ হয় নজরুলের কবিতা। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষ জাগরণে তারঁ কবিতা যেন অসাধারণ প্রবক্তা। ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে কবি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ যা সাহিত্য জগতে তাকে চির অমর করে রেখেছে বিদ্রোহী কবি হিসাবে। কবির অম্লান বাণী ‘ বল বীর বল চির উন্নত মম শির- শির নেহারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির’ আজো প্রত্যেকের হৃদয় শিহরিত করে তোলে।
    ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠির শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে দেশ প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলমকে অস্ত্র ও বুলেট হিসাবে ব্যবহার করলেন। ব্রিটিশ বিরোধী তুমুল আন্দোলন শুরু হলে কবি সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লিখতে লাগলেন। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য ও অসত্যের বিরুদ্ধে কবি লেখনীর মাধ্যমে প্রচন্ড বিদ্রোহ শুরু করেন।অতিতের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে শুনিয়েছেন মুসলিম জাতিকে জাগরনের বাণী এবং স্বদেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠি মুসলিম কৃষকদের নিঃস্ব করে ফেলেছিল। জমি ও ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রায় পথে বসেছিল কৃষককূল। কবি নজরুল শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজকে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়ে কৃষকের গান কবিতায় লেখেন-“ চল্ চল্ চল্! ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল, নি¤েœ উতালা ধরণী-তল, অরুণ পাতে তরুণ দল, চল্-রে চল্-রে চল।” বাংলাদেশ সরকার বর্তমান এ কবিতাটি রণসঙ্গীতের মর্যাদা দান করেছেন।
আধুনিক বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে মুসলিম সাধনার সবচেয়ে বড় প্রেরণা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ইসলামী বিষয়গুলোকে তিনিই প্রথম সত্যিকার সাহিত্যে রুপ দিয়েছেন। কবির আবির্ভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র কাব্য সাধনার দিগন্তে নবোদিত সূর্যের মহিমা বিকশিত হয়েছে। মুসলিম স্বাতন্ত্রবোধের বজ্রকন্ঠের বাণী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কবিরা তেমন ফলপ্রসু করে তুরতে পারেনি। কবির আল্লাহর প্রতি অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস ছিল। মানুষের প্রতি আল্লাহপাকের অশেষ নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে লিখেছেন-“ এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহের বাণী।।” কবি বহু হামদ নাত, গজল, আধুনিক গান, ইসলামী গান, গল্প, কবিতা, সাহিত্য ও উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর রচনার সংখ্যা কয়েক সহস্র। উল্লেখযোগ্য রচনাসূমহ অগ্নিবীণা, মৃত্যু ক্ষুধা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা চক্্রান্ত, সর্বহারা, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, নতুন চাঁদ, রিক্তের বিদন, ফনীমনসা, প্রভৃতি । ফারসী ভাষার মহাকবি হাফিজের কতকগুলি কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি ভাষায় ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের কিছু লেখার অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। ১৯৪২ সালে কবি চিরদিনের ন্যায় বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। অনেক চিকিৎসার পরেও সুস্থতা আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি জগত্তারিণী পুরুস্কার প্রাপ্ত হন। ১৯৬০ সালে কবি বারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে বিশ্ব ভারতী কবিকে ডিলিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে কবিকে ১৯৭২ সালে ঢাকায় আনা হয়েছিল। ধানমন্ডিতে কবির নামে একটি বাসা বরাদ্দ হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে কবি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘একুশে পদক’ দ্বারা সম্মানিত করা হয়। কবি ১৯৭৬ সালের ২৯মে আগষ্ট বাংলা ১৩৮৩ সালের ১১ই ভাদ্র ঢাকার পি.জি হাসপাতালে সকাল ১০টায় ইন্তেকাল করেন। তিনি অছিয়ত করে যান তাকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার জন্যে, যেন তিনি কবরে শুয়েও মুয়াজ্জিনের সুমধুর আযানের ধ্বনি শুনতে পান। তিনি লিখেছেন“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বে রাষ্টীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয়। মসজিদের পাশে কবি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। বাঙালী মুসলিম হৃদয়ে কবি অমর। কবি জীবদ্দশায় যেসব জায়গায় পদচারণ করে গেছেন, স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থানসমূহ ধন্য হয়েছে; ধন্য করেছে প্রতিটি মানুষের হৃদয় মঞ্জিল। ১১ই জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মদিনে উৎসবে সেজে ওঠে স্মৃতিভূমি।
      আমার চোখে যে আলোর আবির্ভাব থেকে দেখা। সে দেখা থেকে আমি বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় জ্যৈষ্ঠের মধুক্ষণে প্রদ্বীপ হয়ে আসা উজ্জ্বল নক্ষত্রের জ্যোতির্ময় আলো হয়ে ধরনীর বুকে বিকোশিত হয়ে ফোঁটা যেন..বিশ্ব দরবারে বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রাম্য নামটি
ফুঁটফুঁটে হাসিতে হেসে থাকা চিরকালিন।
২। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় “বয়স মাত্র আট” পিতা হারানো কষ্ট-বেদনা ব্যথা যন্ত্রনা সহেও মক্তবের ছাত্র হয়ে দশ বছর বয়সে পবিত্র কোরআন শরীফ তেলওয়াতে পারদর্শি যেন..ইসলামী আদর্শে বেড়ে ওঠা। দুঃখ অভাব অনটনে গড়ে উঠা জীবন যাপনের মায়া চিত্র গাঁথা।
৩। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় ছোট্ট বয়সেই রুটির দোকানে কামলা খেটে আহার যোগানো। ব্যথায় ভরা দুখু নামের ছেলেটি তাঁর লেখা সত্ত্বার উন্মেষ ঘটাতে যেন..শুধু মাত্র বার বছর বয়সেই গ্রাম-বাংলার সুপরিচিত লেটোগানের দলে যোগ দিয়ে তাঁর লেখনী চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশের জাত চিনিয়েছিলেন।
৪। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় প্রিয়মুখ, প্রিয়জন, প্রিয় নাম কাজী নজরুল ইসলাম। দুখু নামে ডাকা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অশান্ত ঢেউ নিয়ে বিদ্রোহী মনোভাবে লেখা যেন..বারবার অপলক চেয়ে দেখা। ঢেউ খেলানো কেশ, উত্তাল তরঙ্গ বাঁধভাঙ্গা লেখনির পরিবেশ; যে দেখার হয়না কখনো শেষ।
৫। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় ছোট্ট বয়স থেকেই সাহিত্যের প্রতিটি শিখায় জ্বলে একের পর এক নব নব উদ্দীপনাময় জাগরণের লেখায় সকলকে জাগিয়ে তোলা যেন.. তদানিন্তন ব্রিটিশের ঘোলা জল থেকে বাঙালিদের মুক্ত করার জন্য, নির্মম পরিহাস থেকে উত্তরণেএক একটি কালজয়ী বিদ্রোহীমূলক
সাড়া জাগানো আলোড়ন সৃষ্টিকারি ক্ষুরধার বজ্রলেখার দূর্দান্ত দাপট।
৬। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় ছন্দময় আনন্দময় আবেগময় গানের কথা মানের কথা
প্রাণের কথা জ্ঞানের কথা যেন..নিপেড়িত মানুষের সাহস যোগানো বৈপ্লবিক কথা।
৭। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় তাঁর রঁচিত গজলে মুসলিম সম্প্রদায়ের জাগরণ। তাঁর রঁচিত শ্যামা সঙ্গীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের জাগরণ যেন..বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন।
৮। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় সকল অশোভন আগ্রাসন থেকে মুক্তিলাভে বীরঙ্গণে বীর বাহুবলে অর্জিত রূপ নিয়ে জনগণকে স্বহস্তের লেখনী দিয়ে, মনন শক্তি দিয়ে যেন..ভক্তির সাথে বাঙালিকে একাগ্রতা করে গড়ে তোলা দূর্গ। শান্তির নীড় খুঁজে দেওয়া।
৯। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায়, হৃদয়পটে সমগ্র অস্থি মজ্জায় একটি অন্য রকম অধ্যায়। মিষ্টি করে সৃষ্টি করে বিরাজ করে যেন..আবহমান ধারায় চলে অবিরাম।
১০। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় তাঁর রঁচিত এক একটি কাব্যিক ছন্দশীল চেতনা উদ্বেলিত করে আলোচিত করে আলোকিত করে আলোড়িত করে জীবন্ত সত্ত্বায় যেন..আমরণ জাগরণ করে।
১১। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় জাগ্রত করে শোষিত বঞ্চিত নিপেড়িত লাঞ্চিত নির্যাতিত
পদতলেপৃষ্ঠ মানুষের যেন..জীবন যাপনের চিত্রকল্পের বাস্তবতার গল্পকথা।
১২। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় সামাজিক মানবিক দিকগুলো নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় নিখুঁতভাবে ফুঁটানো সমগ্র সাহিত্য সাধনা যেন..চেতনায় পরিস্ফুটিত পুষ্পের বিকাশ ঘটানো, প্রকাশ ঘটানো সুঘ্রাণের প্রাণের আবেশে, ভালবেসে মিশে মিশে হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির মনণে চক্ষুর দৃষ্টি খোলা সুফসলের বৃষ্টি।
১৩। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ধূমকেতুর মহাপ্রলয় আঁধারে অগ্নিশিখার জ্বলন্ত প্রদীপ ন্যায়ের, স্ব-পথের দিক-নির্দেশনার। উঁচুতে উঠানো তর্জনী যেন..
নতুন উদ্যমে নতুন দিগন্তের শান্তির প্রতিক।
১৪। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় ধ্যান-জ্ঞান, সাহিত্য-সাধনা আরাধনা, প্রার্থনা দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, ঈশ্বর প্রেমের যেন..বস্তুনিষ্ঠ লেখনির সতেজ মজবুত শেকড় উৎসাহি অনুপ্রেরণার বন্ধন।
১৫। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় নারী-পুরুষের সম-অধিকারের সুষম বন্টন। নেই কোন বিভেদ। জাতি বর্ণ ধর্ম কর্ম সব মানুষ এক যেন মনুষত্বের অম্লান নিদর্শন। চাওয়া পাওয়া আশা-আকাঙ্খার সুস্থ সুষ্ঠ প্রতিফলন।
১৬। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় দু’টি চোখে স্বর্নালী স্বপ্ন দিতে, দু'ঠোঁট ভরে হাসি দিতে, মনে প্রাণে শিহরণে দোলা দিতে, মায়া দিতে ছায়া দিতে ছোঁয়া দিতে যেন..পরস্পরের প্রতি সহানুভুতিশীল মনোভাব বজায় থাকে। সবাই সবাইকে আপন করে রাখে।
১৭। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় সত্যকে সত্য মিথ্যাকে মিথ্যা বলা। দিকভ্রষ্ট না হয়ে সামনে এগিয়ে চলা। আপোষহীন লেখা যেন..দু'চোখ ভরে দেখা। ভাবনার সাগরে ডুবে থাকা।
১৮। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় শিশুদের কথা, কৈশরের কথা, যৌবনের উদাত্ত্ব আহ্বানের তেজদৃপ্ত কথা, কুলি মজুর শ্রমিকের কথা যেন..জীবন সংগ্রামে দুরন্ত-দূর্বার পথ অতিক্রম করার কথা, গণ মানুষের জাগরণের কথা।
১৯। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় সীমাহীন দুঃখ দুর্দশা বিশ্ময়কর প্রতিভা বিকাশ থামাতে পারিনি। জালেম শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার। কারগার জীবন, সৈনিক জীবন, সাংসারিক জীবন, দেশপ্রেমিক জীবন, কবিতা,গল্প, উপন্যাস,নাটক, গান, গজল সাহিত্য জীবন যেন অমর হয়ে আছে আমাদের চোখে বাঙালির চোখে বিশ্ববাসির চোখে।
২০। বিদ্রোহী কবির দর্শন থেকে যা দেখতে পায় নির্বাক চাহনীর মায়া দৃষ্টি। জগত্তারিনী পদক, জাতীয় কবির মর্যাদা। একুশে পদক, সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধী। পি.জি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস । বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে চিরশায়িত যেন অনুভবে অনুভূতির হৃদস্পন্দনে তোলপাড়। কালজয়ী লেখনির কালজয়ী মানুষ।

মাহে রমজানের গুরুত্ব ও পবিত্রতা

মাহে রমজানের গুরুত্ব ও পবিত্রতা

মাহে রমজানের গুরুত্ব ও পবিত্রতা
মীম মিজান

আরবি বর্ষপঞ্জির নবম মাস মাহে রমজান। মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য একটি শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। মহান আল্লাহ্ তায়ালা এই রমজান মাসকে করেছেন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বছরের বাকী এগারটি মাসের থেকে এই মাসটি সমহিমায় উদ্ভসিত। এই মাসটি যে সকল কারণে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি হলো:
১. রমজান হলো কুরআন নাজিলের মাস : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: “রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।” (সূরা বাকারা : ১৮৫) রমজান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কুরআন একবারে নাজিল হয়েছে। সেখান হতে আবার রমজান মাসে অল্প অল্প করে নবী করিম (সা) -এর প্রতি নাজিল হতে শুরু করে। এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাজিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরাইল রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল (সা)-ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দুই বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহি মুসলিমের হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
২. এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। নবী (সা) বলেন : “রমজান মাসে এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০০)
৩. এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদেরর ন্যায় বরকতময় রজনী : মহান আল্লাহ বলেন, “লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’’ (সূরা আল ক্বদর : ৩-৫)
৪. এ মাস দোয়া কবুলের মাস : নবী (সা) বলেন, “(রমজানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোয়া কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমজান মাসে করে থাকে)।’’ (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, হাদিস নং ৭৪৫০)
৫. রোজার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন : একটি হাদিসে কুদসিতে রাসূল (সা) বলেন, আল্লাহ বলেন, “বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোজার কথা আলাদা, কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দেবো।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)
৬. রোজা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণ : রাসূল (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রামাদান মাসে রোজা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৯১০)
৭. রোজা জান্নাত লাভের পথ : রাসূল (সা) বলেন, “জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না, রোজাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’’ (সহীহ বুখারি, হাদিস নং ১৭৯৭)
৮. সিয়াম রোজাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে : রাসূল (সা) ইরশাদ করেন: “কিয়ামতের দিন রোজা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি;  সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেয়নি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ ’’ (মুসনাদ, হাদিস নং ৬৬২৬)
৯. রোজা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল : রাসূল (সা) ইরশাদ করেন : যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখে আল্লাহ তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে ৭০ বছরের দূরত্ব তৈরি করেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)
১০. এ মাসের রোজা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোজা রাখার সমান : রাসূল (সা) ইরশাদ করেন, “রমজানের রোজা দশ মাসের রোজার সমতুল্য, ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান, এ যেন সারা বছরের রোজা।”
১১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম : রাসূল (সা) বলেন, “যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)
১২. রোজা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায় : রাসূল (সা) বলেন, “রোজাদারের জন্য দুটো খুশির সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।’’ (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)
রোজার আরো ফজিলতের মধ্যে রয়েছে এতে ইচ্ছা ও সঙ্কল্পে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়, চারিত্রিক মাহাত্ম্য অর্জিত হয়, শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায় এবং সর্বোপরি তা মুসলিম উম্মাহ্ একতাবদ্ধ হওয়ার এক বাস্তব নিদর্শন।

উপর্যুক্ত গুরুত্বসমূহ ছাড়াও আরো যে সকল গুরুত্ব আছে সেগুলি হলো, দরিদ্র-অসহায়দের সহযোগিতার (দান-খয়রাত) মাস, বদরের মাস, জিহাদের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস, এতেকাফের মাস, যাকাত ও দান-সদকা বেশী বেশী দেয়ার মাস, চরিত্র গঠনের মাস, আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের শপথ নেয়ার মাস ইত্যাদি।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দেয়া তাঁর বান্দাদের জন্য গুনাহ্ মাফ করণের এ মাসের যেমন গুরুত্ব রয়েছে; ঠিক তেমনি সেই গুরুত্বসমূহ অর্জনের কতিপয় পবিত্রতা দাবী করে রমজান আমাদের কাছে। নইলে আমরা হব সেই মাঝির মতো যে কিনা নদীতে একটি মূল্যবান জিনিস ভাসতে দেখে সঠিক উপায় অবলম্বন না করে শুধু চিৎকার জুড়ে দিল আমি অমুক জিনিস দেখেছি, আমি অমুক জিনিস দেখেছি। আর মাঝি এতেই ভাবলো যে সে ওমুক বস্তু পেয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ এর বিপরীত।
এক হাদিসে আছে, “আমার উম্মত যদি জানতো রোজা কী জিনিস, তাহলে রোজা রাখা এতো কষ্টকর হওয়া সত্তেও সারা বছর রমজান মাসের কামনা করতো।” সূতরাং আসুন এই ফজিলতপূর্ণ রমজানের পবিত্রতা কিভাবে রক্ষা যায় তা জেনে নেই।
১.ফেইসবুক:
তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে আজ দূরত্ব হয়েছে জয়। আর দূরত্ব জয়ের জন্য যে সকল মাধ্যম আমরা ব্যবহার করি তার অন্যতমটি হল ফেইসবুক। কতিপয় উ™£ান্ত যুবক-যুবতীদের দেখা যায় নানা কুরুচি পূর্ণ ছবি টাইম লাইনে আপলোড দেয়। যা তার বন্ধুদের নিউজফিডে অনিচ্ছা সত্তেও চলে যায়। যা রোজাদার ফেইসবুক ব্যবহারকারীগণের রোজাকে করে হালকা ও রমজানের পবিত্রতাকে করে ক্ষুণœ। এহেন খারাপ ছবি পোস্ট থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে রমজানের পবিত্রতাকে রক্ষা করা যাবে।
২. টুইটার:

ফেইসবুকের ন্যায় আরেকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলো টুইটার। ঠিক এখানেও টুইটের মাধ্যমে রোজাকে হালকা করবে এমন ছবি আপলোড দেয়া হয়। টুইট করার ক্ষেত্রে বা ফলো করার ক্ষেত্রে এরকম অশালিনতা থেকে বিরত থেকে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করা যাবে।
৩. পত্র-পত্রিকার বিনোদন পাতা:
দৈনিক, সাপ্তাহিকসহ পত্র-পত্রিকার বিনোদন পাতা গুলিতে বিভিন্ন নায়িকাদের সাক্ষাৎকার প্রচার বা তাদের নিয়ে আলোচনার জন্য তাদের নানা ভঙ্গিমায় আবেদনময়ী ছবিগুলি তুলে ধরা হয়। যা যে কোনো বয়সের পুরুষের রোজাকে হালকা করতে পারে। সূতরাং এ রকম ছবি বিনোদন পাতাগুলিতে না ছাপালে রোজাদারদের মনের পবিত্রতা রক্ষা পাবে ও রমজানকে সম্মান করা হবে।
৪. পর্নোগাফি ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ:
উঠতি বয়সের যুব সম্প্রদায়সহ অনেকেই একটু আড়াল বা সুযোগ পেলেই পর্নোগ্রাফি সাইটগুলোতে ঢু মারে। অন্যান্য সময়ের মতই রমজান মাসে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। যা রোজাকে ভঙ্গ করবে এমন কাজে নিমগ্ন করবে। এক্ষেত্রে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় অন্তত এই পবিত্র মাসে এই সাইটগুলো বন্ধ করে রাখতে পারে। তাহলে পবিত্র রমজান মাস সমূহ পবিত্রতার সাথে পালন করা যেতে পারে।
৫.এফএম রেডিও ও কমিউনিটি রেডিওতে গান-বাজনা:
দেশে এখন অনেকগুলি এফএম রেডিও ও কমিউনিটি রেডিও আছে। যারা বছরের অন্যান্য সময় প্রায় সারাটাদিন বিভিন্ন ধরণের গান শুনিয়ে থাকে তাদের শ্রোতাদের। রমজান মাসেও এই রেডিও গুলিতে গান-বাজনা চলে সারাটা দিন ধরেই। শুধুই ইফতারের আগ মূহুর্তে কুরআন তেলায়াত প্লে করে। যদি এই রহমতের মাসে এই রেডিও সেন্টারগুলি এহেন গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকে ও সারাটা দিন কুরআন-হাদিস, ইসলামী সংগিত পরিবেশন করে তাহলে রোজাদারগণ পবিত্রতার সাথে রোজা পালন করতে পারেন।
৬. অর্ধনগ্ন ও রোজা হালকা করে এমন সিনেমা পোস্টার:
বছরের অন্যান্য সময় দেয়ালে দেয়ালে ছেয়ে যায় অর্ধনগ্ন সিনেমার পোস্টারে। আর মাহে রমজানেও তারা এ সকল ব্যবসা বন্ধ করেনা। যার ফলে নতুন নতুন সিনেমা তারা মুক্তি দেয় প্রেক্ষাগৃহ গুলিতে। যে গুলোর প্রচারের জন্য পোস্টারিং করে লোকজনের নজর অনায়াসে পড়ে এমন স্থানগুলিতে। রোজাদার সকল বয়সের মুক্তিকামী মুসলিমের রোজা গুলো হালকা করে এ সকল পোস্টারিং। অধিকন্তু রমজানের শেষের দিকে এসে ঈদকে উদযাপধের জন্য একবারেই নতুন সিনেমা মুক্তি দেয়া হয় প্রেক্ষাগৃহ গুলিতে যে গুলির ও রমরমা পোস্টারিং হয়। এ ধরণের অর্ধ উলঙ্গ পোস্টারিং থেকে বিরত থাকলে ও প্রেক্ষাগৃহ গুলি বন্ধ রাখলে রমজানের পবিত্রতা অনেক খানি রক্ষা হবে।
৮. সরকারি-বেসরকারি সকল টিভি চ্যানেলে গান-বাজনা:
এফ এম রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিওগুলির পাশাপাশি দেশীয় ও বিদেশীয় টিভি চ্যানেলগুলিতে দিনভর চলে গান, সিনেমা নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠান। এ সকল প্রোগামেও অর্ধনগ্ন নায়িকাদের আবেদনময়ীতা প্রদর্শন করা হয়। যে গুলি রোজাকে হালকা করে ও রমজানের পবিত্রতার বিপরীত। যদিও তারা নামমাত্র কিছু ইসলামিক প্রোগাম দেখায়। এ ধরণের প্রোগাম ও চ্যানেলগুলি মাহে রমজানে বন্ধ রাখলে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা পাবে।
৯. বিভিন্ন টকশো ও লাইভ প্রেগ্রামে মডেল কন্যা-নায়িকাদের অর্ধ উলঙ্গ কাপড় পড়ে আসা:
ঈদ উপলক্ষে কার কী কী সিনেমা, গান, নাটক ইত্যাদি রিলিজ পাচ্ছে সেগুলি নিয়ে চলে চটকদার লাইভ প্রোগাম বিভিন্ন টিভি চ্যানেল গুলিতে। আর এখানকার হটসিটে বসা মডেল কন্যারাও আসেন রমজানের পবিত্রতাকে ক্ষুণœ করে এমন পরিধেয় নিয়ে। তারা কিন্তু দাবী করছে যে তারাও তাক্বওয়াহ অর্জনকারী রোজা পালন করছে। এরকম প্রোগাম গুলি না করলে মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা পেয়ে মুসলিমগণ একনিষ্ট ভাবে তাদের সিয়াম সাধনা করতে পারেন।
এ ছাড়াও মদের বারগুলি বন্ধ রাখা, দিনের বেলা হোটেল রেস্তোরা বন্ধ রাখা, বেরোজাদারদের প্রকাশ্যে পানাহার থেকে বিরত থাকা, মহিলাদের শালীন পরিচ্ছদ ধারণ করা, মার্কেটে-মার্কেটে না ঘুরে এবাদত করা ইত্যাদি দাবী গুলোও রমজান আমাদের কাছে দাবী করে তার পবিত্রতা ও গুরুত্বের জন্য।
উপর্যুক্ত গুরুত্ব গুলি যদি আমরা গুরুত্বের সাথে পালন করি ও রমজানের পবিত্রতা কে ক্ষুণœ করে এমন কাজ গুলি থেকে বিরত থাকি তাহলে ইনশা আল্লাহ্ আমরা তাক্বওয়াহ্ অর্জন করে পবিত্র দেহ ও মন নিয়ে এ ধরাধাম ত্যাগ করতে পারব। যার ফলে ক্বিয়ামতের কঠিন বিচার দিবসে নিশ্চয়ই সফলকাম হয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে চিরসুখের আকাক্সক্ষীত জান্নাতে প্রবেশ করব। আমীন! সুম্ম-আমীন!