ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০৯

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০৯

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২০৯,

শুক্রবার, ০১ মার্চ ২০২৪, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩০, ১৯ শাবান ১৪৪৫।





























উঠতি বাজির ঘোড়া...

উঠতি বাজির ঘোড়া...

 


উঠতি বাজির ঘোড়া

মাহমুদ নোমান


যে লেখক লিখতে এসে কাগজের পর কাগজে নিজের ভাব বোধকে অক্ষরে তুলে ধরতে নিরলস সাধনায় মগ্ন থাকতেন, তিনিও আজ বার্ধক্যে এসে প্রাণপণে ফেইসবুকে কবিতা গল্প নিজের মতামত বুড়ো আঙুলে টিপে টিপে ঢেলে দিচ্ছেন। প্রতিজন লেখকের ফেইসবুকের সময়খাতাটি একেকটি সাহিত্য পাতা। কারও দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন মনে করি না। আগে পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে একখানা চিঠিও লিখতো, জীবদ্দশায় কখনও সাহিত্য সম্পাদকের সাথে সশরীরে দেখা হবে কীনা প্রশ্ন ছিল সেটি এখন বার্তাবক্সে সেরে যায়। উল্টো সাহিত্য সম্পাদকের পোস্টে লাইক কমেন্ট না করলে গোস্বাটি দ্বিগুণ ফুঁসে ওঠে আরেকজন লেখকের পোস্টে লাইক কমেন্টে বেশি প্রশংসা করতে দেখলে। ভীষণ অভিমানে লেখা আর ছাপেন না। এরমধ্যে সাহিত্য সম্পাদকের দাম বেড়েছে এই মর্মে সাহিত্য সম্পাদক আরও বেগবান বিস্তারে শক্তিশালী হয়ে উঠেন নিজে নিজে। লেখা ছাপা হবে না এই ভয়ে কেউ কেউ প্রকাশ্যে হঠাৎ ঝলকে আগল খুলে প্রকাশ্যে হে হে উচ্চকণ্ঠের মতামত রাখে। এসবের কসরতে পত্রিকায় ছাপা হওয়া লেখাটিই কবি ছবি তুলে কানে ধরে এনে বুড়ো আঙুলে চেপে মুখবইয়ের সময়খাতায় তুলে দেন, জাতি যেন হৈচৈ করে ওয়াও, নাইস, কংগ্রেটস্, কংগ্রেচুলেশন, অভিনন্দন জানান... অর্থাৎ মুখবইয়ের (ফেইসবুক) সময়খাতা (টাইমলাইন) একমাত্র সত্য, আসল....


সেই সময়ে এসে কেউ ছাপা হওয়া বইয়ের শিল্পকে বুকে লালন করবে, এটা হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখার মতোই। যখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হৈচৈ করে বাড়ছে প্রতিদিন। খাওয়ার জিনিস, পরার জিনিসের দাম যেখানে বাড়ছে বইয়ের কাগজের দাম না বেড়ে থাকেনি। আগেই বলেছি ফেইসবুক থাকতে সব ফেইক, ছাপা হওয়া বই কেন পড়বে যদি সেটি ফেইসবুকে পাওয়া যায়? অপরজনেরা মাংস চিবোচ্ছে প্রতিবেলা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া মানে বুঝে এখন অনেক টাকার মালিক হওয়া, আগে যেখানে মুরব্বিরা বলতো - মানুষ হও....

এই যে মানুষ হতে জ্ঞানীর কথা পড়তে হবে। সেসব জ্ঞানী ভালো মানুষ সব তো এখন ফেইসবুকে। সারাদিন দুর্নীতি করে ফেইসবুকে এসে কাউকে একটা কম্বল দান করছে সেটি পোস্ট দিয়ে ভালো মানুষ সাজে, ব্যস্ত ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ে ঘুম.....

এরপরে ঐ মুখস্থ করে ডিগ্রি অর্জন শুধু টাকা কামানোর জন্য আর টাকা কামাতে দুর্নীতি যে যেরকম চমৎকার করে পারে এইরকম ব্যাপার....

এই সময়ে ছাপা হওয়া বই করার স্বপ্ন যাঁরা দেখে অর্থাৎ লেখকের স্বপ্নকে সবার সম্মুখে তুলে ধরে যেসব মানুষ তাঁদেরকে সত্যিকারের মানুষ মনে হয়। আলাদা খুশবু পাই তাঁদের শরীর থেকে। আবার তাঁরা যদি হয় বয়সে চল্লিশের আগে, তাহলে এরা নিষ্পাপ....

এদেরকে লালন করার যতœ নেওয়ার সেই স্পর্ধা রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরও নেই, কেননা অপবিত্র হাতে এদের আগলে রাখবে কীভাবে!

এসব প্রকাশকদের মধ্যে কয়েকজনের স্বপ্ন আমি জেনেছি, তাঁদের অসহনীয় কষ্ট দেখেছি, অনুভব করতে চেয়েছিও তাঁদের সাথে উঠাবসা করে তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে বেশ অগ্রসর মনে হলো এইসময়ে-


১. পেন্ডুলাম পাবলিশার্সে রুম্মান তার্শফিক:



রুম্মান তার্শফিক এখনও ত্রিশ ছুঁয়নি। এই বয়সে প্রকাশনার বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা আর এই জগতের ধুলাবালিও মেখে নিয়েছে পরম ভালোবাসায়; প্রকাশনাকে কীরকম অন্তস্ললে লালন করে, যেন সেখানে কোন দোষে বাহিত না করে। নিরলস প্রচেষ্টার মধ্যে প্রেসে প্রেসে ঘুরে এমনকি নিজের চোখেও দেখেছি প্রেসে, বাঁধাইয়ের ঘরের মেঝেতে অতো পুরুষের মাঝেও স্বতস্ফূর্তভাবে বসে পড়ে বইয়ের খুঁটিনাটি ঠিক করতে। লেখক লিখেন কিন্তু সেটাকে প্রচার-প্রকাশযোগ্য অর্থাৎ সমাজে রাষ্ট্রে যোগ্য করে উঁচিয়ে তুলে ধরার অভিভাবক বনে যান একজন প্রকাশক। কী পরম মমতায় লেখকের বই নিজের করে লালন করে রুম্মান তার্শফিক। সবাই জানেন- সৃজনশীল প্রকাশনায় ভবিষ্যৎ নেই’ এই অর্থে টাকা পয়সা নেই অথচ রুম্মান যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করে হতাশা মাড়িয়ে হাসে, প্রাণবন্ত থাকে সত্যিকার অর্থে সম্মানের যোগ্য। একজন কবিত্ব মনের অধিকারী হিসেবে এই প্রকাশনা শিল্পীর এমন আত্মত্যাগ আমাকে ঋণী করে.....


প্রকাশনা জগতে পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের উল্লেখযোগ্য কাজ -

আমরা হেঁটেছি যাঁরা (ইমতিয়ার শামীম), কন্যা ও জলকন্যা (জাকির তালুকদার), মান্টো কে আফসানে (অনুবাদ: কাউসার মাহমুদ), ফিফটিন গভর্নরস আই সার্ভড উইথ (অনুবাদ: আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), হোয়াই ইজ সেক্স ফান (অনুবাদ: সন্ন্যাসী রতন)।


২. উপকথা প্রকাশনের ফকির তানভীর আহমেদ:


নামের আগে ফকির- এটি নিয়ে তানভীর ভাইকে কখনও প্রশ্ন করিনি কিন্তু ভেবে পেয়েছি তিনি সত্যিকারের ফকির। অর্থাৎ ফানা হয়ে যাওয়া, আত্মত্যাগ শুধু যে শিল্পে; ফকির তানভীর ভাইয়ের পড়াশোনাও বেশ, মার্জিত বোধ সম্পন্ন প্রকাশনার প্রতিটি কাজ। উপকথা প্রকাশনাকে ইতোমধ্যে বেশ গাম্ভীর্যে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।


প্রকাশনা জগতে উপকথা প্রকাশনার উল্লেখযোগ্য কাজ -

সতীনাথ ভাদুড়ী রচনাবলি ৪ খন্ড, দারোগার দপ্তর ৩ খন্ড, বিমল কুমার সমগ্র ২ খন্ড, জয়ন্ত মানিক সমগ্র ৩ খন্ড,

তারাশঙ্কর রচনাবলি ২৫ খন্ডে ।



৩. চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের মঈন ফারুক:



ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ‘চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনকে বেশ নির্ভরযোগ্য জায়গায় নিয়ে গেছেন মঈন ফারুক। বেশ বুদ্ধিদ্বীপ্ত আর কৌশলে রয়েছে আন্তরিকতার ছাপ। হোঁচট খেয়ে দাঁড়ানোর মানসিকতা মঈন ফারুককে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়...


প্রকাশনা জগতে চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের উল্লেখযোগ্য কাজ-

উপন্যাস সমগ্র : মলয় রায়চৌধুরী, গল্প সংগ্রহ : মোহাম্মদ রফিক, জয়নালের ইতালিযাত্রা : জাহেদ মোতালেব, পয়েন্ট ওয়াই (থ্রিলার) : জয়নুল টিটো, তারাশঙ্কর : জাকির তালুকদার।


৪. জাগতিক প্রকাশনের রহিম রানা :



রহিম রানাকে সম্ভবত বেশি অনুভব করি স্নেহে ভালোবাসায়। সেটি রহিম রানার প্রাপ্য। রহিম চমৎকার রানার। প্রকাশনা জগতে কে কখন ল্যাং মারে সেখানে রহিম রানার দৃঢ়চেতা মনোভাব, সেই সাথে স্কিলফুল ফোর্স প্রকাশনার বিবিধ সৌন্দর্যে রহিম রানা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশনা শিল্প নিয়ে রহিম রানার স্বপ্নের নিজস্ব জগৎ বেশ বর্ণিল...


প্রকাশনা জগতে জাগতিক প্রকাশনের উল্লেখযোগ্য কাজ-

বিপ্লবী বাংলাদেশ (১৯৭১ সালে প্রকাশিত পত্রিকা), পুঁজি ও পুঁজিবাদ (নাওজীশ মাহমুদ), শাহবাগ। ধর্ম রাজনীতি চেতনা (বিধান রিবেরু), স্মৃতির খেয়ায় যাই ভেসে যাই (আনোয়ারা সৈয়দ হক), বধ্যভূমির পথে পথে (ড.সেলিনা রশীদ)।



শ্রাবণ অশ্রুতে ভেজে মন

 শ্রাবণ অশ্রুতে ভেজে মন


শ্রাবণ অশ্রুতে ভেজে মন 

রিতা আক্তার 


কিছুকিছু মানুষ দুঃখকে পুষে রাখে যতœ করে। গত আট টি বছর ধরে অর্কও মিতুর স্মৃতি যতœ করে তুলে রেখেছে তার হৃদয়ের নীল খামে। এই স্মৃতিটুকু একন্তই অর্কের নিজের, যা দেখার অধিকার সে কাউকে দেয়নি। 

আজ পয়লা আষাঢ়। হুম..

এমন এক বর্ষাঘন দিনে দেখা হয়েছিলো মিতুর সাথে। দোয়েল চত্তরের উল্টো পাশে মাটির শো পিস গুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলো সে। এমন সময় আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। সে কি বৃষ্টি! অর্ক বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য জায়গা করে নিলো মিতু পাশেই। বেশ সাদামাটা পোশাক, নেই কোনো বাড়তি মেকআপের ছোঁয়া, একটু কাজল আর ছোট্ট একটা টিপে একটা মেয়েকে এতো সুন্দর দেখতে হতে পারে জানা ছিলো না অকের্র। এইচ এস সি তে ভালো রেজাল্ট করে এখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে অর্থনীতি তে ভর্তি হয়েছে সে। মফস্বলের এক ছোট্ট শহর থেকে এসেছে অর্ক। বাবা একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে অর্কই বড়। 

রিকশার বেল বাজতেই হুঁস ফিরে এলো অর্কের। কি জানি কতক্ষণ সে মিতুর দিকে তাকিয়ে অন্য মনস্ক হয়ে পড়েছিলো জানে না। কিন্তু মিতু কোথায়! এদিক ওদিক তাকিয়ে মেয়েটিকে আর দেখতে পেলো না অর্ক। এতো বৃষ্টি ঝরছে যে, এদিক ওদিক যাওয়ারও জো নেই। বৃষ্টিটা হালকা হতেই সে মেসের দিকে রওনা হলো। কিছু টিউশনি জোগাড় করে দিয়েছে রুমমেট আসিফ। বড় ভালো ছেলে সে। পরউপকারীও বটে। মেসে ফিরে খেয়ে আবার টিউনশি পড়াতে যেতে হবে অর্ককে। 

কিছুতেই যেনো মিতুর মুখটা ভুলতে পারছে না সে।

পরদিন ক্যম্পাসে গিয়ে ক্লাসগুলো শেষ করে লাইব্রেরীতে গেলো অর্ক। প্রয়োজনীয় নোট লিখে ফিরে আসার সময় আচমকাই মেয়েটার দিকে চোখ পড়লো তার। হ্যাঁ গতকাল দেখা সেই মেয়েটাই তো। এক মনে পড়ছে আর লিখে যাচ্ছে। চারদিক কি হচ্ছে সেদিকে মনোযোগ নেই তার। দেখেই বোঝা যায় বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়ে মিতু। কাছে গিয়ে অর্ক জানতে চায় নাম। 

আমার নাম মিতু - উত্তর দেয় মিতু। 

- কোন ডিপার্টমেন্ট? 

- সোস্যাল ওয়েলফেয়ার। 

অর্কও তার পরিচয় দেয় মিতুকে। 

আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন উত্তরের মাঝে না জড়িয়ে মিতু তার গন্তব্যে পা বাড়ায়। 

এভাবেই মিতুর সাথে অর্কের দেখা হয় কথা হয়। 

বন্ধুত্ব গড়ে উঠে একে অপরের সাথে। 

অর্কের মতো মিতুও মফস্বল শহর থেকে পড়তে এসেছে ঢাকায়। হোস্টেলে সিট না থাকায় দূর সম্পর্কের এক মামার বাসায় থাকে সে। মামার দুই ছেলে মেয়েকে পড়ায়। ফাঁকে ফাঁকে ঘরের কাজে মামীকেও সাহায্য করে। মামা- মামী দুজনই খুব ভালো মানুষ। মিতুর বাবার মারা গেছেন তিন বছর হলো। গ্রামের বাড়িতে ছোট ভাইটাকে নিয়ে থাকে মা। দর্জির দোকানে কাজ করে কোনো রকমে সংসার চলে তাদের। 

এভাবেই তাদের দিন গুলো কেটে যায়। 

অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয় অর্ক ও মিতু। 

মিতু এখন হোস্টেলেই থাকে। একটা প্রাইভেট কম্পানিতে পার্ট টাইম জব করে মিতু। পড়াশুনার খরচ, হাত খরচা রেখে বাকি টাকা সে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় প্রতি মাসে। অর্কও বেশ কয়েকটা টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাড় করে নেয়। বৃদ্ধ বাবাকে সে আর আর্থিক চাপে রাখতে চায় না। 

বেশ কেটেই যাচ্ছিলো অর্ক ও মিতুর জীবন। 

একদিন হঠাৎ একটা ফোন এলো অর্কের কাছে বাড়ী থেকে। অর্কের বাবা খুব অসুস্হ্য। খবর পেয়েই সে চলে গেলো বাড়ীতে। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো কিন্তু অর্ক আর ফিরলো না। এদিকে ওকে মিতু ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু সুইট অফ পাচ্ছে। এর আগেও অর্ক বাড়ীতে গেছে তবে এক দু দিন এর বেশি থাকেনি সে। আজ গোটা একটা সপ্তাহ পার হয়ে গেলো কিন্তু সে ফিরছে না। বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে কেঁদে উঠছে মিতুর। তার কেনো এমন লাগছে?  চারপাশে কত মানুষ তবুও কেনো বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে অর্কের জন্য। কেমন একটা শূণ্যতা বিরাজ করছে তার ভেতর। কি যেনো নেই, কি যেনো নেই। তবে কি মিতুও অজান্তে অর্ককে ভালোবেসে ফেলেছে?  তাই ই হবে। নয়তো কেনো বারবার অর্কের জন্য তার মনটা পুড়ছে। এভাবেই চলতে থাকে কয়েকটা দিন। রাত গিয়ে দিন আসে, দিনের শেষে রাত। ক্লান্ত মনটা খুঁজে ফেরে এদিক ওদিক যদি অর্কের দেখা পাওয়া যায়। 

  আজ সেকেন্ড আওয়ারে কোনো ক্লাস না থাকায় মিতু চলে যায় লাইব্রেরীতে। একটা নোট লিখবে বলে বইয়ের পাতা উল্টে যায়। কিছুই যেনো ভালো লাগছে না তার। ভাবছে ক্যম্পাসের মাঠের এক কোণে বসে থাকবে। এই জায়গাটিতে রোজ অর্ক আর সে কত গল্প করেছে। অর্কের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে কখন যে জল গড়িয়ে পড়ছে তাও টের পায়নি মিতু। হঠাৎ তার কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে সে। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো অর্ক। জানিনা কি ভেবে মিতু জড়িয়ে ধরলো অর্ককে শক্ত করে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। যেনো সকল ব্যথার পাহাড় আজ গলে গলে লুটিয়ে পড়ছে অর্কের বুকে। লাল চোখে তাকিয়ে মিতু জানতে চাইলো - সেই বাড়ী গেলে এরপর আর কোনো খোঁজ নেই তোমার। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছো, আমি কতবার ট্রাই করেছি একবারও পাইনি তোমায়। আচ্ছা তুমি কি বলতো? আমার তো চিন্তা হয় তোমার জন্য। এতোদিনে একবারও কি মনে পড়েনি আমার কথা তোমার? এতো কঠিন হলে কি করে তুমি? 

অর্ক তার মিতুর ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল-পাগলী একটা, এতো প্রশ্ন এক সাথে!! 

বসো, বলছি তোমায়। একটু শান্ত হও এবার। 

মিতু চোখের জল মুছতে মুছতে জানতে চাইলো -

বলো কি হয়েছিলো তোমার? 

তোমার মুখটাও বেশ শুকনো লাগছে। সব ঠিক আছে তো?  বাবা কেমন আছে? 

অর্ক মিতুর হাতে হাত রেখে বললো - বাবা আর বেঁচে নেই মিতু। আমি পৌঁছবার আগেই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। মা ভেঙে পড়েছে খুব। পুরো সংসারের ভার এখন আমার উপর। ছোট ভাই বোনগুলোর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। কি করবো? কি হবে? কিছুই মাথায় আসছেনা জানো...। 

আচ্ছা তোমার কি হয়েছে বলতো মিতু?

আমায় অমন জড়িয়ে ধরে কাঁদলে কেনো? 

এই বন্ধুটির উপর বুঝি খুব অভিমান হয়েছে তোমার? 

নাও, আমি তো এখন তোমার সামনে, যা শাস্তি দিতে হয় দাও আমায়। 

মিতু মাথা নিচু করে শুধু একটা কথাই বলল অর্ককে -

আজ থেকে সারা জীবনের জন্য আমাকে তোমার পাশে রাখবে, সুখে দুঃখে সব সময়, সারাক্ষণ..... এটাই তোমার শাস্তি। 

অর্ক বলল- বোকা মেয়ে, তোমার মতো বন্ধুকে আমি দূরে রাখবো এমন সাধ্য কি আর আমার আছে বলো। 

মিতু অর্কের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল - আমি তোমাকে ভালোবাসি অর্ক। পারবে না, এই আমিটাকে তোমার হৃদয়ে ঠাঁই দিতে। 

অর্ক মিতুর কথা শুনে অপলক চেয়ে থাকলো ওর দিকে। যে মেয়েটিকে সে একদিন দেখেছিলো আষাঢ়ী কাব্য হয়ে দোয়েল চত্তরে, যাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিলো, যাকে হারাবার ভয়ে কোনো দিন মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা সে বলতে পারেনি কোনো দিন, আজ এক পশলা বৃষ্টির মতো সে বুকে আঁছড়ে পড়ছে ভালোবাসার ঢল হয়ে। একি সত্যি! নাকি তাঁর কল্পনা...। 

মিতুর হাতটি শক্ত করে ধরে বলল- মিতু আমিও যে তোমায় অনেক ভালোবাসি। মিতুর কপালে আলতো চুমু দিয়ে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো। 

আর বলল- এই পাগলীটাকে আমি আমার কাছে রেখে দিবো সব সময়। ভালোবাসায়, মমতায়, আদরে রাঙিয়ে দেবো তোমায় মিতু। শুধু আমায় একটু সময় দাও। নিজের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করে নেই। এরপর আমরা নিজেদের সংসার শুরু করবো সবার দোয়া ভালোবাসার মাধ্যমে। 

মিতুও চোখের জল মুছতে মুছতে বলল- ঠিক আছে। তাই হবে। 

এখন চলো তো ক্যন্টিনে যাই, তোমার মুখটা দেখে তো বোঝা যাচ্ছে কিছুই পেটে পড়েনি। 

হুমমমমম চলো যাওয়া যাক, অর্ক বলল।

দেখতে দেখতে ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে দুজনেই ভালো একটি চাকরীর খোঁজ করতে থাকে। তবে দেশের পরিস্থিতি এমন হয়েছে হাজার হাজার বেকার সেন্ডেলের তলা ক্ষয় করছে একটি চাকরী পাবার আশায়। মুখ থুবড়ে পড়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। প্রতি নিয়ত চাকরী নামক সোনার হরিণ খুঁজে খুঁজতে অভাব গ্রাস করে প্রতিনিয়তই। ভালো রেজাল্ট করা সত্বেও অর্ক ও মিতু তেমন ভালো চাকরী পেলো না। অর্কের চাকরী হলো একটি প্রাইভেট কম্পানিতে আর মিতু একটি বেসরকারী স্কুলে। নিজেদের চলবার মতো খরচ যুগিয়ে বাকি টাকা দুজনেই যার যার মায়ের কাছে পাঠায়। মাস শেষে যখন টাকা গুলো হাতে পায় পরিবার তখন একটু হলেও তো ওদের অভাবটা পূরণ হয়। এর থেকে বেশি তো আর কি করাই বা যেতে পারে? ইচ্ছা যেখানে প্রবল স্বাধ সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। 

বছর দুয়েক পর ওরা সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করবে। দু পরিবার থেকেও কোনো অমত হয়নি। সবার সম্মতিতে বিয়ে হয় ওদের। দুজন যা আয় করে তাতে বেশ খানিক টাকা চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে দিতে। তবুও তো জীবনে থেমে থাকতে দেয়া যায় না। একটু একটু করে দুজনের দু কামরার ঘর সাজায়। বছর তিনেক বাদে অর্কের ঘর আলো করে আসে মেয়ে শ্রাবণী। শ্রাবন মাসে জন্ম বলেই মেয়ের নাম শ্রাবনী রাখা হয়েছে। অর্কের আনন্দের মূহুর্তগুলো কেমন করে যেনো আষাঢ়েই এসে আটকে যায়। এটাই অর্কের কাছে খুব অবাক করা বিষয়। অর্ক মিতু একে অপরকে যেমন সম্মান করে তেমনি ভালোওবাসে। একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থাও রয়েছে সব চেয়ে বেশি। শত অভাব অনটন গায়ে না লাগিয়ে একমাত্র মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবে বলেই কত চেষ্টা। ভালোবা তো এমনই হয়। ওদের ঘরে টাকার অভাব ছিলো ঠিকই তবে একটা মানুষিক প্রশান্তি ছিলো। এটাই তো ওদের সুখের, ওদের ভালোবাসার মূল মন্ত্র।

দেখতে দেখতে ওদের মেয়ের পাঁচ বছর হয়ে গেলো। 

এক রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে মিতু বারান্দার রেলিং ধরে আকাশ দেখছিলো। অর্ক দু’ কাপ চা এনে দাঁড়ালো মিতুর সামনে। মেঘের ভেলায় ভেসে চলেছে পূর্ণিমার চাঁদ। কি অদ্ভুত তার রূপ। চারদিক যেনো ঝলসে যাচ্ছে পূর্ণিমার আলোয়। 

মিতু ঐ গান টা ধরো না?  বলল অর্ক। 

- কোন গানটা? 

- চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে.....। 

মিতু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে গাইতে লাগলো এক মনে, 

চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো.......। 

মিতু যখন গান গাইছিলো, অর্ক আপন মনে মিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো।  এখনও সেই প্রথম দেখা মিতুকেই দেখতে পাচ্ছে অর্ক। খুব মিষ্টি একটা মায়া ভরা মুখ। সংসারের এই টানাপোড়েনে মিতু কে সে খুব একটা স্বচ্ছলভাবে রাখতে পারেনি ঠিকই তবে ভালোবাসার কমতি ঘটেনি কখনও। 

-কি হলো? কি দেখছো অমন করে?  

- তোমাকে। 

- যাহ্ আমাকে আবার দেখার কি আছে শুনি। 

- আজ তোমায় একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। 

- ধুর! কি যে বলোনা তুমি। 

- হুমমম, যা বলছি তা ঠিকই বলছি।

হয়েছে এই রাত দুপুরে আর প্রেম জাগাতে হবে না তোমায়। এখন শুতে চলো। সকালে তো আবার বাসটা ধরতে হবে আমায়। অনেক দূরের পথ।

ওওও, এই যাহ্, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি ময়মনসিংহ যাবে স্কুলের কাজে, বলল অর্ক।  

  সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনটায় কেমন কু ডাকছিলো অর্কের। মিতুর হাত টা ধরে বলল- আজ না গেলেই কি নয়?  মনটা কেমন অস্থির লাগছে আমার। 

মিতু অর্ককে জড়িড়ে ধরে বলল- ও, তোমার মনের ভুল। বিয়ের পর তো কখনও ছেড়ে থাকোনি আমায়। তাই অমন লাগছে তোমার। আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো। দু’ দিনেরই তো ব্যপার। তুমি চিন্তা করো না। 

অর্ক মিতুর কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে বলল- সাবধানে যেও, পৌছে ফোন দিও। তোমার ব্যাগে বিস্কুট আর ফল রেখেছি, পানিও আছে রাস্তায় খেয়ে নিও কেমন। 

আচ্ছা ঠিক আছে জনাব, খেয়ে নিবো। তুমিও সময় মতো খেয়ে নিও। নিজের খেয়াল রেখো। আর শ্রাবণীকে দেখে রেখো কেমন, এবার তবে আসি, নয়তো বাস মিস হয়ে যাবে -বলল মিতু।

একটা রিকশায় উঠলো মিতু, বাসস্টান্ডের দিকে রওনা হতেই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। 

যাহ্, এমন সময় বৃষ্টিকে আসতে হলো, বিরক্তি গলায় বলল অর্ক। ঘরের ভেতর থেকে দৌড়ে ছাতাটা এনে মিতুর হাতে দিয়ে বলল- সাবধানে যেও। 

রিকশা চলতে থাকলো। মিতু রিকশার হুড নামিয়ে পিছন ফিরে অর্ক কে দেখতে লাগলো। অর্কও রিকশাটাকে দেখতে লাগলো যতক্ষন অবধি গলিটা পার না হয়। এরপর একসময় দুজনের দৃষ্টিও মিলিয়ে গেলো পথের সীমায় এসে। 

    বাসটা সময় মতোই ছাড়লো। মিতুর সাথে রয়েছে ওরই দুজন কলিগ। বৃষ্টির যেনো থামার ইচ্ছাই নেই আজ। ঝরছে তো ঝরছেই। আকাশের আজ বড্ড মন খারাপ হয়েছে বোধ হয়, তাই অমন কাঁদছে আজ। 

ঠিক সময়ে মিতুরাও পৌছে গেলো ময়মনসিংহ। দু’ দিন পর কাজ শেষ করে আবার রওনা হলো ঢাকার দিকে। পথে বাসটি তিনবার থামলো, ড্রাইভার হেলপার মিলে ঠিকও করলো বাসটা। বলল ব্রেক একটু নড়বড় করছে তবে ভয়ের কিছু নেই। বাস আবার তার আপন মনে চলতে শুরু করলো। বেশ কয়েক মাইল যাওয়ার পর বাসটির ব্রেক আর কাজ করছিলোনা। ড্রাইভার তবুও যাত্রিদের কিছু বলেনি, তারা ভয় পেয়ে যাবে বলে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো বাসটিকে একটু সাইডে থামানোর। তা আর হয়ে উঠেনি, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সাথে সংঘর্ষ হয়। বাসে থাকা ২৫ জন যাত্রির মধ্যে সাত জন নিহত হয় ১১ জন গুরুতর আহত এবং বাকিরা কম আহত হয়। 

নিহতদের মধ্যে মিতু ও তার একজন কলিগও রয়েছে। আরেকজন কলিগ বেশ আহত হয়েছে। তবু সে এই দূর্ঘটনার সংবাদ সবার বাড়ি ফোন করে বলে দেন এবং স্কুলেও জানান। 

   অর্ক ঘটনাটি শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। তার পুরো শরীর যেনো অবশ হয়ে আসতে লাগলো। মিতু নেই এটা যেনো কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারলো না অর্ক। 

সে ছুটে গেলো মিতুর কাছে। হাসপাতালের মর্গ থেকে যখন মিতুর লাশটাও আনা হলো অর্কের সামনে তখন সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিলো মিতুর নিথর দেহটা। কাপড়টা রক্তে ভিজে গেছে। মুখ থেকে কাপড় সরাতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অর্ক। বুকের মধ্যে শক্ত করে মিতুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো অর্ক। 

দাফনের জন্য যখন মিতুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো গোরস্থানে তখন পাঁচ বয়সী শ্রাবণী বাবার পাঞ্জাবীর কোনা ধরে বলতে লাগলো - ওওও বাবা, বাবা, মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? মা কথা বলছে না কেনো? মায়ের কি শরীর খারাপ হয়েছে? মা ঘুমিয়ে আছে কেনো বাবা?

অবুঝ মেয়ের এ প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না। চোখের পানি মুছতে মুছতে মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলল- মামনি, তোমার মা ঐ দূর আকাশের একটা তারা হয়ে গেছে। রোজ রাতে তুমি আকাশের দিকে তাকিও, ওখানে দেখতে পাবে মাকে........। 

আজ আট বছর হয়ে গেলো মিতু নেই। শ্রাবনীর বয়স ষোলোতে এসে পড়েছে। 

বারান্দায় মিতুর প্রিয় শাড়িটি হাতে নিয়ে বসে আছে অর্ক। এই শাড়িটা খুব প্রিয় ছিলো মিতুর। এই শাড়িটায় এখন মিতুর শরীরের গন্ধ লেগে আছে, যা কেবল অর্কই টের পায়। 

আজ মিতুর মৃত্যু দিবস, আট বছর পার করে গেলো মিতুর শূণ্যতা। তবুও কত যতœ করে আজও অর্ক তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার স্মৃতি যতœ করে তুলে রেখেছে নিজের কাছে। 

মানুষ তো চলেই যায়। সত্যিই কি চলে যায়? 

চলে গিয়েও যে তারা ফিরে আসে আমাদের মনে অবিরত বর্ষার ধারা হয়ে। 

মিতুও তেমনি দূর আকাশে থেকে আজও অর্কের মনে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে.......।


রামপুরা, ঢাকা।



একজোড়া আঙুলের বাঁধন

একজোড়া আঙুলের বাঁধন

 


একজোড়া আঙুলের বাঁধন

ইয়াকুব শাহরিয়ার


বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ভার্সিটি গেইটে গিয়ে দাঁড়াই। বাসস্ট্যান্ড থেকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় খুব কাছে। পূজোর বন্ধ শেষ হয়েছে। কাল থেকে ভার্সিটি খোলা। সকল শিক্ষার্থীরা হলে ফিরতে শুরু করেছে। তাই গেইটের সামনে প্রচ- ভিড়। ভিড় বলতে হল পর্যন্ত যেতে যে টমটম বা রিকশা পাওয়ার কথা সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে। বেশি দূর হবে না। এক কিলোমিটার হবে। নরমালি পায়ে হাঁটলে পনেরো ষোলো মিনিট বড়জোর বিশ মিনিট লাগে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। কুসুম আসলে পরে একসাথে যাবো, ভিরতে। এরই মাঝে একজন স্ট্রিটহকার এসে আমাকে ‘বরিশালের আমড়া’ অফার করলো। পাঁচ টাকা দাম। গোলাপের মতো করে কাটা আমড়াগুলো রোদে শুষ্কভাব ধরে আছে। এমন আমড়া প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন সি থাকে। খুব উপকারি। রং ফর্সা রাখে। বিশেষ করে স্কার্ভি রোগ এড়াতে এগুলো খাওয়া দরকার। ছোট বেলায় আমি একজন নিয়মিত স্কার্ভি রোগী ছিলাম। আমড়াগুলোর চেহারা পছন্দ হয়নি বলে পকেটের পাঁচ টাকা থেকে গেলো। দূপুরের রোদের পরে বিকেলের আগের রোদটা কড়া থাকে। তাই একটু গরম গরম লাগছিলো।


হঠাৎ করে আম্বরখানা থেকে আসা একটি সিএনজি থেকে কুসুম নেমেই আমাকে ডাক দিলো। আমু...। ভাঙতি পনেরো টাকা আছে? আমার কাছে ছিলো কিন্তু কেনো যেনো মুখ দিয়ে না চলে এলো। পরে সিএনজি ড্রাইভারই যাত্রীদের কাছ থেকে ম্যানেজ করে দিয়েছে। কুসুম নামতেই ওর চেহারার দিকে নজর পরে আমার। শুকনা পাতলা একটা মেয়ে। খুভ ভাল লাগছে দেখতে। বোরখা পড়ে না কখনো। তাকে দেখে কখনো মনে হয় নি আলাদা করে বোরখা পড়া দরকার। কারণ এমনিতেই তার পোশাকে সব সময় শ্লীল সে। তার প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস, সম্মান ও স্নেহ কাজ করে। আমি মনে করি এ চার উপাদান না থাকলে ভালবাসা যায় না। সময় কাটানো যায়। আমার কাছে এসে কিছু না বলে আমার মতো করে দাঁড়িয়ে রইলো। জিজ্ঞেস করলাম- কি? ছোট্ট করে সরি বলে- বললো, চলো যাই। আমি বুঝতে পেরেছি কেনো সরি বলেছে। তার কারণে যদি কালো চেহারায় কিছুটা ঘেমে যাই, সোজাসাপ্টা সরি বলতে কোনোদিন দ্বিধা করে নি। ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।


জানি রিকশার অপেক্ষা করা বোকামী। তাছাড়া কুসুম আর আমি যতদিন গেলাম-এলাম ভিতরের এ রাস্তাটা হেঁটেই পাড় হয়েছি। খুব ভাল লাগে এ রাস্তায় হাঁটতে। এ ভার্সিটিতে আমরা কেউ পড়ি না। আমি আর কুসুম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার দুই ইয়ার জুনিয়র সে। দুজন দুই শহরে। দেখা করতে আমিই ছুটে চলি তার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে শহিদ মিনারের পেচনের দিকটায় গিয়ে বসি। আমাদের সামনে আরো দু’চার জোড়া বসে লুটোপুটি খেলছে। ভাল লাগছে। কুসুম আমার কাছে কিচ্ছু আশা করে না। সান চিপস্ তার খুব পছন্দের। সেদিন দেই নি। হঠাৎ করে করুণ স্বরে বললো- আমু? তার দিকে তাকাতেই দেখি জল গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো। কিছু না বলে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলাম। দু’চার মিনিট পরে কি হয়েছে জানতে চাইলে বলে উঠলো- আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি খুব একা। আমার পাশে থাকার মতো তুমিই একজন। প্লিজ, সব সময় থেকো। মনে হচ্ছিলো, একাকিত্ব খুব তাড়া করে বেরায় তাকে। শহিদ মিনারের সিসি ক্যামেরাগুলো আমাদের দিকে বড় বড় চোখ করে দেখছিলো। বাকীদের মতো আমরাও লজ্জা পাই নি।


তাকে বাহুডোরে বেঁধে পাশে থাকার আশ্বাস দিলাম। তারপর মুখের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে বললো- দেশে সেলুন নাই? বন মানুষের মতো দাঁড়ি লম্বা করে রাখছো কেনো? পাগলের বেশে থাকতে খারাপ লাগে না? আর চুল গুলার স্টাইল আদিম যুগের মতো করে রাখছো কেনো? এটা বদলানো যায় না। আমার সান চিপস্ কই? টিশার্টের রং ভাল কিন্তু একটু মোটা। আমি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেই নি। কিছুক্ষণ পর উঠলাম দু’জন। অডিটোরিয়ামের দিকে এগুতেই ছোট ভাই একটা পেলো। আজকেই হলে এসেছে। কুসুমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সে চলে গেলো বাংলা ভবনের দিকে। আমরা অডিটোরিয়ামের ডানদিকের রাস্তায় গিয়ে গার্ডওয়ালে বসলাম। একটা বনোশিয়াল আমাদের দেখে উঁকি দিলো। পরে এদিকে রোদ থাকায় ছায়ার দিকে বসে কথায় কথায় সময় পাড় করি। বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল জড়িয়ে কুসুম বললো- আমু, যদি এই আঙ্গুল গুলোকে সারাজীবন এভাবে একসাথে রাখার কোনো সুপ্রিম ক্ষমতা আমার থাকতো তাহলে আর কোনো ভয় থাকতো না।

- কিসের ভয়?

- যদি কখনো তোমার থেকে দূরে যেতে হয়?

আমি উঠে দাঁড়াই, কনিষ্ঠা আঙ্গুল আর হাত ছাড়া হয় নি। একজোড়া আঙ্গুলের ঘষাঘষি এসে থামে পুচকার দোকানে। আমি চটপটি খেলাম আর কুসুম পুচকা। আমার কাছে পুচকাটা মেয়েদের খাবার মনে হয়। আর চটপটি পুরুষের। ষাট টাকা বিল চুকিয়ে আবার একজোড়া আঙ্গুলের জড়াজড়ি। আবার হেঁটে চলা এক কিলোমিটার কিংবা পনেরো ষোলো মিনিট বড়জোর বিশ মিনিট। তখন গোধূলি সন্ধ্যার বুকে মাথা রাখলো বলে।



পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 



মালিবাগ যাবে

তূয়া নূর


আমার লাইসেন্সিং পরীক্ষাটা আলসেমি করে দেয়া হয়নি। 

ক্যাব চালায়ে ভালোই চলে 

সকাল হবার আগে গাড়ি জমা দিয়ে এফ ট্রেন নিয়ে চার্চ ম্যাগডোনাল্ড এভিনিউতে নামি। 

হেঁটে এসে এপার্টমেন্টে উঠি

রুমমেটরা ঘুমে

আমি বুড়ো আঙুল ঠোঁটে ভেজায়ে খস খস শব্দ করে ডলার গুনি। 


জ্যাকসন হাইটে যাত্রী নিয়ে খুব বেশী আসা হয় না

আমার তেমন একটা পছন্দের জায়গা এটা নয়,

মানুষের বড্ড ভিড় এখানে।  


রুজভেল্ট এভিনিউ দিয়ে বের হবো সেদিন একজনকে সব্জিমণ্ডির সামনে নামিয়ে দিয়ে। 

খুব আস্তে চালাচ্ছি গাড়ি চারদিক মানুষ জন দেখে শুনে। 

তার ভেতরেও একজন বাবার বয়সী মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে বনেটে 

থাবা দিয়ে গাড়ি থামালো,

জানালা খুললাম জানতে চাইলাম ঘটনাটা কী!


লোকটা বললো, মালিবাগ যাবে?

মৌচাক মার্কেটের পিছনে, 

সমস্যা নেই আমি চিনিয়ে নিয়ে যাবো না চিনলে

ভাড়া নিয়ে চিন্তা করো না 

মিটারে গেলে বাড়াযয়ে দেবো

দাম ঠিক করে যদি যেতে চাও তাও হবে। 


আমি বললাম, মালিবাগ?


চিলের মতো হাতটা ছো মেরে ধরে হাঁটার পথের উপর টেনে তুললো তাকে,

আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকায়ে গলার স্বর তুঙ্গে তুলে বললো, 

সকালের ওষুধ দিতে ভুলে গেছি বাবাকে। 

কিছু মনে করবেন না,

ওষুধ ঠিকমত দেয়া না হলে বাবা আবোল-তাবোল বকে এমন।

    


অশ্রু বিন্দুর মতো

নাসরিন জাহান মাধুরী 


নবনীতা

আমি হেঁটে এসেছি অনেকটা পথ

আজ যখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল

তোমার কথাই ভাবছিলাম..


ভেজা পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম

এই পথ দিয়ে তুমি হেঁটে গেছো কতো বার 

মেঘের আড়ালে চাঁদের উঁকিঝুঁকি 

এমনটা কতোবার তুমিও হয়তো 

মুগ্ধ চোখে দেখেছো

এই বাতাস তোমায় ছুঁয়ে গেছে কতোবার


এখন আর নিজেকে আগন্তুক মনে হয় না এ শহরে

তবুও যে শহরটাতে তুমি নেই

সে শহরের দেয়ালে ফিসফাস অভিমান

যে বাতাসে তোমার স্পর্শ নেই

সে বাতাসে নীরবতার শীতল কাঁচ বেয়ে

নেমে যায় কিছু ভোরের শিশির 

অশ্রু বিন্দুর মতো..

সে শহরের আমি কেউ নই..


ফাগুন চোখ

বশির আহমেদ 


রোদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে 

ঢেঁড়স ফুল, 

প্রকৃতি আমাকে ভীষণ ভাবায় সকাল সন্ধ্যা দুপুর। 

কড়া রোদে ছায়া পড়ে কঙ্কাল শরীর!

একটা নতুন কবর,

মৃত্যুর খবর শুনে বেদনার জল চোখে ছুটে আসে দূরের স্বজন।

বর্ষার জল শুকিয়ে গেছে,

বেঁচে নেই একটাও শালুক ফুল।

পথের ধারে কুসুমের কলি মরে যায় ধূলিঝড়ে।

ভাবনার ফাগুন চোখে রক্ত কবরী ফুটে 

পিয়ারির ঠোঁটে।


বিকৃত মাল ফেরত নেওয়া হয় না

দেলোয়ার হোসাইন 


আমি ‘আস্তিক’ বলে গায়ে পড়ে

‘নাস্তিক’ হলে মোক্ষম হাতিয়ার

আমি ‘চামচা’ হলে বেশ হতো

‘সত্যটা’ মুখে নিলে অন্ধকার...


আমি রাত হলে ‘সিন্ডিকেট’ ভালো

দিন হলে ‘কুটুম বাড়ি’ চার আনা

আমি ‘নরম’ হলে দু’চোখ টলমল

‘ছোবল’ দিলে বিষ আর নামে না...


আমি চাষার ছেলে ‘আগুন’ ফলাই

‘বিকৃত মাল’ ফেরত নেওয়া হয় না.


হাসে মুখোশ তালাবদ্ধ মুখ 

রুদ্র সাহাদাৎ 


নৈঃশব্দ্যে স্বদেশ কাঁদে - চৌদিক শুনি বোবাচিৎকার  

তবুও আমাগো কর্ণ পর্যন্ত পৌছায় না কেনো আওয়াজ

বাজারে জান গো বাপজান -বুঝবেন ঠেলা -গরম ঠান্ডা 

বাজারে গিয়া দ্যাইখা আসেন - কত ধান কত চাল 

ক্ষণে ক্ষণে হাসে মুখোশ- তালাবদ্ধ মুখ অন্ধ চোখ

নিত্যপণ্যের ডান্স দেখে অজ্ঞান পাশেরবাড়ি পলাশের মা

রনি, রুপন,আলম, ইব্রাহীম, অরুণেরও অবস্থা করুণ,খালি হাতে ফিরছে বাড়ি 

মলিন চেহারা সবুজ শাকপাতা ব্যাগ ভর্তি...


জীবন ভাবনা

 আবুল বাশার শেখ


 রক্তের দাগ বহতা ¯্রােতে হারিয়ে যায়

 অন্ধকারের উন্মদনায় ওলট পালট জীবন হিসেব

 পলকেই চেনা মুখগুলো অচেনার ভান করে।

 দৈন্যতা ঘিরে ধরে উপরের সিঁড়ি নিন্মমুখী করে

 ছলাকলার শতভাগ প্রয়োগে একটা কণ্ঠ রোধ হয়।

 চেনামুখগুলো ছলনার অভিনয়ে এগিয়ে যায় সামনে,

 বোধশক্তি হারিয়ে অমানুষ অগ্নি মানুষ হতে চায়;

 দেয়ালে ঠেকিয়ে পিঠ ঠোঁট কামড়ে পথ চলে।

 বহুরূপী জীবনের নান্দনিক পাঠচক্র এগিয়ে যায়

 খোলসের আবরণে দানব ফায়দা লুটে,

 যোগ বিয়োগের হিসেব খাতা নতুন করে কষে

 আবারো এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয়।

 পেছনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ফ্লাসব্যাক

 ভাবিয়ে তুলে বার বার, ঘৃণার আবরণ ঢেকে দেয়

 আহা জীবন ভাবনা তবুও হয়না কেন শেষ!



দীর্ঘশ্বাস 

ইমরান খান রাজ 


আজকাল আর তোর ঠোঁটে হাত বুলানো হয় না 

অপলক তাকিয়ে দেখা হয় না, তোর হাতের মেহেদী 

কথা হয় না রোজ, দেখাও হয় না কোথাও। 

প্রকৃতি কখন, কাকে, কোথায় সরাতে হবে 

সেটা ভালো করেই জানে, খুব ভালো করে



পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২

 


স্মৃতি 

সুশান্ত হালদার 


তোমাকে ভালোবাসার পর 

ভূমিকম্পে নড়েচড়ে বসেছে পৃথিবী সাড়ে সাত বার 

এমনই কপাল আমার 

সূর্য সংঘর্ষে হারিয়ে ফেলেছি নিজেরই প্রজ্জ্বলিত অধিকার  


তোমাকে ভালোবাসার পর 

তুষার ঝড়ে দুমড়েমুচড়ে গেছে ইউক্যালিপটাস

এমনই কপাল আমার

চাঁদ পোড়া আগুনেই হারিয়ে ফেলেছি বসন্ত আবার 


তোমাকে ভালোবাসার পর 

নদীর জলে সাধু সন্ততি ডুবে মরেছে শত শত বার 

এমনই কপাল আমার 

কান পাতলেই বুদ্ধ ধ্যানে চিৎকার শুনি মরুময় সাহারার


তোমাকে ভালোবাসার পর 

ড্রোন হামলায় শুধু আমারই ভেঙেছে দক্ষিণ দুয়ারি ঘর

এমনই কপাল আমার 

কুরুক্ষেত্রের স্মৃতি নিয়ে হেঁটে চলছি এখন অযোধ্যা থেকে লাদাখ বরাবর!  


তুমি আছো বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর 

মুস্তফা হাবীব


জরির ওড়নায় সুষম সাজে যখন তোমাকে দেখি

আনত নয়নে লাজন¤্র ঠোঁটে গোলাপ ফোটাও

আমার স্বপ্নের দিগন্ত হেসে ওঠে সবুজ- শ্যামলে।


ঘুমঘোরে তুমি যখন নীলাম্বরী সাজে এসে

বসন্ত সরোবরে শরীর ভেজাও

আমি আপ্লুত দেখে তোমার নিসর্গ সৌরভ

অলখে ভুলে যাই জীবনানন্দের বিম্বিসার ধুসর জগত।


তোমার বিকল্প কোনো কনকলতা আমাকে টানেনা

জাগতিক ঝর্ণার উচ্ছ্বল রূপ দেখে যতোদূরে যাই

দিনের শেষে আমি তোমাতেই বিলীন।


অনিন্দিতা, তোমাকে ভালোবাসি বলেই 

আকাশের তারাগুলো ভেসে ওঠে জলপদ্ম চোখে 

তুমি আছো বলেই বাঁচতে সাধ হয় জনম জনম, 

অনিন্দিতা, তুমি আছো বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর!


বিষাদ দুঃখ 

সাব্বির আহমাদ 

[প্রয়াত জান্নাতুল ফেরদৌসকে]


বন্ধ কবাটের ওপাশে নিস্তব্ধতায় 

ছেয়ে গ্যাছে বুক। 

একটা নতুন কবরের উপর ফুটে আছে ফুল  

ডনশ্চুপ, নির্ঘুম।  


খয়েরি আকাশ বেয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখি। 

মৃদু ছন্দে দুলছে পাহাড়ি ফুল। 

কারো চোখ বেয়ে নদী হচ্ছে হৃদয় ভাঙ্গা বুক। 


সময় হলে খুলে দিয়ো কবাট 

বন্দ কবরের মুখ। 

কথা দিলাম সন্ধ্যা সংগীতে আমি;

মুছে দিবো তোমার সমূহ বিষাদ দুঃখ।


অবকাশ

জয়িতা চট্টোপাধ্যায়


গতবার চলে গেছ বড় তাড়াতাড়ি

ভেঙেছিল বুকের ভেতর বালিতে গড়া বাড়ি

চলে গেছে কতো জোয়ার, শরীর অনন্ত ভাঁটায়

তুমি আসবে বলে আজ ও চাঁদ প্রহর কাটায়

তোমাকে ফিরিয়ে নেব অবশেষে জোয়ারে

আমি পাহাড় হয়ে উঠবো, যদি বলো পাহাড়ে কাটাবে

শরীর উষ্ণ হয়ে ওঠে, যতটা উত্তাপ তুমি চাও

ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিজেকে রেখেছি, একবার তাকাও

কতদূর যেতে চাও? এনেছো কতটা অবকাশ?

চিন্তা চিন্তা করো না তোমার শরীরে ছোঁয়াবো না আকাশ।



স্পর্শহীন বালিকা

এবি ছিদ্দিক 


মন ভালো নেই - ডাক্তার সাব

স্পর্শহীন বালিকা লেখাপড়ার খরচা বাবদ

হাজারখানেক টাকা নিয়ে গেছে


আপনি এতো কথা বলেন কেন ?

আমি সরল বিশ্বসী কবি

কণ্ঠনালি বেয়ে গড় গড় করে শব্দ বেড়িয়ে আসে!


আমি আপনার মতো খস খস করে ওষুধ লিখি

আচ্ছা - দাঁড়ান আমি তৈরি হয়ে আসি 


ভোর হয় সূর্য উঠে ডাক্তার আসে

রোগী আসে - পরিচিত অপরিচিত রোগী

একজন জিজ্ঞেস করেন - কেমন আছেন ?

গায়ে চিমটি কেটে উত্তর দিই - হ্যাঁ, বেঁচে আছি


নৈসর্গিক আকাঙ্ক্ষা

এম সোলায়মান জয়


এই ভরা মাঘের শীতে

কম্বলের মতো অবয়বে জড়িয়ে নিই তোমার প্রেম

তোমার রূপের উষ্ণতার গোপন প্রত্যাশায়

নিমগ্ন থাকে আমার মহাবেগী হৃদয়।

কুয়াশা ভেদ করে তোমার বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেল খেত

কেন্দ্রের গভীর গহ্বরের অস্বাভাবিক নেশা

হৃদয়ের শিরা উপশিরায় পৌঁছে দেয়

চারকোলের উত্তপ্ত দাহ।


শুভ্র কুয়াশাচ্ছন্ন অলিক্ষে আকাঙ্ক্ষার বিশাল দেয়াল

ভেদ করে সূর্যরশ্মির মতো কিরণ ফেলে

শিশিরভেজা ডালিমকুমারী চঞ্চু।

মিলনের বৈচিত্র্য প্রাচীনপন্থায়

অনুভূতির স্পর্শে শীতল অন্তরে 

মিলনের দামামা বাজিয়ে 

গুপ্ত হামলা চালিয়ে পরিপূর্ণ নির্জাস নেয়

তোমার রূপের নৈসর্গিক আকাঙ্ক্ষা।




দুঃখের প্যাটার্ন লক

আজমল হুসাইন


এই আমি যা শুভ্র বলি, কও সেটাকে- কালো

আমার কাছে মন্দ যেটা তোমার কাছে ভালো।


যে পথটাতে ভীষণ কাঁটা, কও সেটাকে ফুল-

এসব নিয়েই তোমার সাথে আমার হুলুস্থুল।


ছয় যেটাকে বললাম আমি, বললে সেটা নয়

সবটুকু বুঝ শেষ হয়ে যায় তোমার বিদ্যালয়।


পৃথিবী নয় সূর্য ঘুরে, বললে না না স্থির;

উল্টো ¯্রােতে ভাসছো ভাসো, নেই জানা তাফসির।


বললাম আমি মিষ্টি এটা, বললে না না টক-

বাক্সবন্দী আনন্দরা দুঃখের- প্যাটার্ন- লক।



মনে রাখবে তো আমায়?

এম. তাওহিদ হোসেন 


পরের জন্মে অতলান্ত আশ্চর্যের সমাহার নিয়ে তোমার দরজায় কড়া নাড়বো, বর্তমানের সব অনুভূতি ভালোবাসার পরতে পরতে ভাঁজ করে রাখবো,

তুমি মনে রাখবে তো আমায়? 


হৃদয়ের গহীনে মস্তো বড় ছাদ গড়বো

শীতলপাটি বিছিয়ে দেব

সন্ধে হলে বসবো দু’জনে অব্যক্ত কথাগুলো নিয়ে।

তুমি বসবে তো আমার সঙ্গে? 


হঠাৎ, একটি দুটো তারা খসবে;

তোমার চোখের পাতায় তারার আলো প্রতিবিম্ব হবে

তখন আমি চুপটি ক’রে দুচোখ ভরে চেয়ে থাকবো

তুমি কী ততোদিন মনে রাখবে আমায়?


এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব

এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মের জন্য রক্ষিত করো, পাওনাদার হয়ে আমি সে চাওয়াগুলো দাবি করবো

সে পর্যন্ত মনে রাখবে তো আমায়?


আমি হবো উড়নচন্ডি, উস্কোখুস্কো,

এই জন্মের অপারিপাটি আমিকে সবার আগে, পরিপাটি করে পরজন্মে হাজির হবো! 

তোমার জড়ো করা চোখের অশ্রুকে 

চিরতরের জন্য মুছে দিবো,

সেই সুযোগ দিবে তো আমায়?


মনে রাখবে তো আমায়?

আমি পর জন্মে কবি হবো

তোমায় নিয়ে সহ¯্র কবিতা, গান লিখবো

তোমার অমন মোলায়েম ওষ্ঠ নিয়ে

মায়া ভরা কাজল কালো চোখ নিয়ে

মাথা ভরা কৃষ্ণ কালো মসৃণ কেশ নিয়ে

¯্রােতস্বিনী নদীর মতো বয়ে যাওয়া তোমার ঐ চিকন গড়ন দেহ নিয়ে আমি গান বানাবো

মনে রাখবে তো আমায়?


কবিতার জন্মদিন

কবিতার জন্মদিন

 


কবিতার জন্মদিন

নবী হোসেন নবীন



কদম আলী আমার এক সময়ের সহপাঠী। ছারাবস্থায় সে টুকটাক কবিতা লিখত। মাঝে মাঝে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে তার স্বরচিত কবিতা পড়ে শুনাত। প্রথম প্রথম সহপাঠীরা তাকে ফুল কবি, পাতা কবি বলে ডাকত। কিন্তু সে তা গায়ে নিত না। এক সময় জীবিকার তাগিদে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এর পর দীর্ঘ দিন কদম আলীর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। একদিন হঠাৎ আমার লেখার টেবিলের সামনে কদম আলী এসে হাজির। তাকে দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম। তার মাথার চুল লম্বা হয়ে ঘাড়ের নিচে নেমে গেছে। দাড়ি-ঘুপে মুখ আচ্ছন্ন। দেখে মনে হলো যেন কোনো সন্যাসী এই মাত্র আস্তানা থেকে উঠে এসেছে। তার হাতে একটা ফাইল। ফাইলে বেশ কিছু এলোমেলো কাগজ পত্র। তাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে বসতে বললাম। সে বসে ফাইল হতে একটা চিঠি বের করে আমার সামনে রাখল। জিজ্ঞেস করলাম কিসের চিঠি? সে বলল, আমার কবিতার জন্মোৎসবের দাওয়াত পত্র। কদম আলীকে আমি কখনও নিজের জন্মদিন পালন করতে দেখিনি। এবারই প্রথম হঠাৎ ঘটা করে কবিতার জন্মদিন পালন করেছে আনুষ্ঠানিক ভাবে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী সহকর্মী সবাই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণ অতীতের স্মৃতি চারণের পর যাওয়ার সময় বলে গেল অনেক কষ্টে ঠিকানা সংগ্রহ করে এসেছি যাবে কিন্তু। বললাম, ঠিক আছে। 


        আমি ভেবেছিলাম কবিতা কবির কোনো মেয়ের নাম হবে হয়ত। না গেলে মেজবানের কাছে নিজেকে ছোট করা হবে। তাই সাধ্যমত কিছু উপহার সামগ্রী নিয়ে আমিও হাজির হলাম কবির বাড়িতে। গিয়ে দেখি কবিতা কোনো মেয়ের নাম নয়, কবির লেখা কবিতা। সুন্দর করে ঘর সাজানো হয়েছে। রং বেরঙের কাগজ কেটে দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে কবির স্বরচিত কবিতাও শোভা পাচ্ছে দেয়ালে। ঘরের দৈর্ঘ্য বরাবর একটি দেয়ালে বড় হরফে লেখা আছে একটি কবিতা। যার শিরুনাম “গোলাপ যদি প্রেম হতো”। কবিতাটি এখন পুরোটা মনে পড়ছে না তবে প্রথম দিকের কয়কটি চরণ ছিল এমন


“গোলাপ যদি প্রেম হতো 

প্রেম হতো সুবাসিত।

প্রেমিক হতো অলি

অকালে ঝরে পড়ত না আর কোনো কলি”।


এ কবিতাটিরই জন্মদিন আজ। কবিতার জন্মদিন বাংলাদেশে এই প্রথম নাকি সারা বিশ্বেই প্রথম তা নিয়ে আমি কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলাম। মানুষের যে কত বিচিত্র রকমের ভাবনা ও শখ থাকতে পারে তা ভেবে কিছুটা অবাকও হলাম।


        অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে তিন পর্বে। প্রথম পর্বে কবির কবিতা সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় পর্বে কবির লেখা কবিতা আবৃত্তি। তৃতীয় পর্বে প্রীতি ভোজ। আলোচনা শুরু হয়েছে। এক জন আলোচক তার আলোচনায় বললেন, আমাদের মত এমন দরিদ্র ক্লিষ্ট দেশে কবিতার জন্মদিন পালন করা খুব সহজ কথা নয়। এর জন্য যতেষ্ট আত্মবিশ্বাশ ও সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন যা কবি কদম আলীর আছে। আর এক জন বললেন, যে দেশে এখনও অসংখ্য মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে জীবন যাপন করে সে দেশে কবিতার জন্মোৎসব পালন করা সত্যিই গর্বের বিষয়। কবি কদম আলী এ কর্মের সূচনা করে ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এক জন বললেন, যে দেশের অর্ধেক মানুষ এখনও দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে সে দেশে কনিতার জন্মোৎসব প্রামাণ করে আমারা শিল্প-সংস্কৃতিতে কতটা এগিয়েগেছি। আমাদের আর পিছেনে ফেরার সময় নেই। সামনে এগিয়ে যেতে হবে তাই আমি আশা করছি কবি কদম আলী প্রতি বছরই তাঁর এক একটি কবিতার জন্মদিন পালন করবেন। আমি বসে বসে বক্তৃতা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম যে এখানে আসাটা সত্যিই ভুল হয়েছে। এখন যদি আমাকে কিছু বলতে বলা হয় তাহলে আমি কী বলব এ নিয়ে যখন চিন্তিত হয়ে পড়লাম তখনই মাইক থেকে আমাকে অনুরোধ করা হলো কিছু বলার জন্য। অগত্যা কী আর করা ধীর পদে এগিয়ে গেলাম মাইকের কাছে। বললাম সুধিবৃন্দ, যে দেশে কবির জন্মদিন পালিত হয় না সে দেশে কবিতার জন্মদিন পালন করা হাস্যকর। ভেবেছিলাম অনুষ্ঠানে পিন পতন নীরবতা নেমে আসবে কিন্তু ঘটল উল্টো ঘটনা। টেবিল চাপড়িয়ে সবাই আমাকে উৎসাহ দিতে লাগল। সবাইকে শান্ত করে আবার শুরু করলাম, যদি আমারা আমাদের নিজ নিজ এলাকার গুণীজনদের প্রাপ্য সম্মান দিতাম তাহলে আমাদেরকে আজকের মত কবির উপস্থিতিতে কবিতার জন্মদিন পালন করতে হতো না। আমরা কখনও কখনও নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য কিংবা সুনাম সুখ্যাতির জন্য অথবা শখের বসবর্তী হয়ে এমন সব ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি যার ব্যয় দ্বারা কয়েক জন ভাগ্যাহত মানুষের ভাগ্য বদলে দেয়া যায়। এবার অনুষ্ঠানে আমার কাঙ্খিত নীরবতা নেমে এলো। সবাই মাথা নিচু করে আমার কথা শুনছিল। আমি বললাম, বন্ধুগণ আসুন আমরা কবিতার জন্মোৎসব পালন না করে কবিকে সম্মানিত করি। এই বলে আমি আমার আনিত একটি নোট খাতা ও কলম কবির হাতে তুলে দিয়ে আমি মঞ্চ থেকে নেমে এলাম। উপস্থিত সবার উপহার সামগ্রীগুলো আজকের অনুষ্ঠানের সাথে অনেকটাই বেমানান হয়ে গেল। কারণ সবাই আমার মত ধরেই নিয়েছিল যে কবিতা কবির কোনো মেয়ের নাম হবে।


  অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে কয়েক জন অতিথি কবির লেখা কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। পরিশেষে কবি কদম আলী তাঁর স্বরচিত গোলাপ যদি প্রেম হতো কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। আবৃত্তি তো নয় যেন কুড়াল দ্বারা বয়স্ক গাছ কাটার শব্দ। তার পর শুরু হলো তৃতীয় পর্ব প্রীতিভোজ। বিশাল আয়োজন যেন বিয়ে বাড়ি। দেশি মুরগীর রোস্ট, খাসির কোর্মা, গরুর কালো ভোনা ও সুগন্ধী চালের পোলাও পাক করা হয়েছে। সবাই তৃপ্তি সহকারে খাইল বটে তবে খাবারের মান অনুযায়ী রসাত্বক আলোচনা আর তেমন জমলো না। আমিও খাবার সম্পর্কে আর কিছুই বলিনি। সবাই দাওয়া দাওয়া শেষ করে নীরবেই চলে গেল। আমিও বিদায় নিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম এ ধরণে একটি অপ্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানে না আসলে হয়ত জানতেই পারতাম না যে কবিতারও জন্মোৎসব হতে পারে। অনুষ্ঠানটি যত হাস্যকরই হউক না কেনো তার বার্তাটি কিন্তু মোটেও হাস্যকর মনে হলো না।


গ্রাম-বাঁশিল ডাকঘর-কাঠালী

উপজেলা-ভালুকা, ময়মনসিংহ


ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০৩ : মুর্শিদাবাদ- পথে প্রান্তরে ইতিহাস...

ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০৩ : মুর্শিদাবাদ- পথে প্রান্তরে ইতিহাস...

 


মুর্শিদাবাদ :
পথে প্রান্তরে ইতিহাস...

মাজরুল ইসলাম


[গত সংখ্যার পর...] 

                        মরীচা: মুঘল শাসন আমলে নদী কেন্দ্রিক প্রাচীন নগর। সভ্যতার ও নাগরিক  চেতনার বিকাশ গড়ে উঠেছিল। শিয়ালমারি, জলঙ্গি ও ভৈরব নদী কেন্দ্রিক বিকাশের অনেক প্রমান পাওয়া যায়। ভৈরব নদী নির্ভর যাতায়াত ছিল গৌড় থেকে সাতগাঁও পর্যন্ত। ভৈরব শিয়ালমারি ও জলঙ্গি নদীথথ এই নদীগুলোর উৎস মুখ পদ্মা এখনও। সুলতানি বা মুঘল শাসন আমলে সাতগাঁও শাসনের জন্য সুতি, লালগোলা, ভগবানগোলা, চুনাখালি স্থলপথে অথবা ভাগীরথী- ভৈরব জলপথে যোগাযোগ করত। সম্রাট আকবর পর্যন্ত সাতগাঁও যেতেন ভৈরব নদীর বুক বেয়ে। এছাড়া সুলতানী আমলেও এই নদীগুলোই যাতায়াতের একমাত্র প্রধান উপায় ছিল। প্রতি প্রতিক্ষার স্বার্থে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা ছাউনি গড়ে তুলেছিলেন। মরীচা সেনা ছাউনি তার মধ্যে অন্যন্য। শিয়ালমারি নদী ও পদ্মা নদীর কাছাকাছি ছিল মরীচা। প্রশাসনিক দপ্তর গড়ে ওঠার কারণেই মরীচা, মৃদাদপুর ও আমিরাবাদ বিভক্ত হয় এবং পৃথক জনপদ গড়ে ওঠে। সেনা প্রশাসকদের বসবাসে আমিরাবাদ এবং প্রাত্যহিক সেনা মহড়ার জন্য মৃদাদপুর গ্রাম দুটোর নাম স্মরণ করিয়ে দেয়। মরীচা ও মৃদাদপুরের পূর্বে শিয়ালমারি নদী। উত্তরে আলাইপুর মরীচা জলঙ্গি প্রাচীন সড়কপথ। পরিখার ধারে মসজিদ সমর বিভাগে নিযুক্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের নামাজ পড়ার প্রমাণ। এই মসজিদটির নাম ছিল ‘চৌকী’ মসজিদ। মরীচা সামরিক ছাউনির কারণে ও সামরিক লোকজনের প্রয়োজনে সংলগ্ন এলাকায় হাট বাজার এবং সুপরিগোলায় একটি বানিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল। জনরব, মরীচায় কড়িয়ালদের বসবাস ছিল। প্রসঙ্গত, প্রাচীন মরীচা জনপদেই ভাষা বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আবদুল হাই জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন মরীচা পদ্মায় ভেঙে গেলে নতুন করে মোল্লাডাঙ্গা সেখপাড়া পাকা সড়কের দক্ষিণে মরীচা গ্রাম এখনও বিদ্যমান। প্রাচীন কালে নদী কেন্দ্রিক যাতায়াতের সুবিধার্থে মরীচা সেনা ছাউনি, সুপরিগোলায় শস্য ভান্ডার এবং টাঁকশাল গড়ে উঠেছিল।


                    মুর্শিদকুলী খাঁ: নবাব জাফর আলী খাঁর পূর্ব নাম ছিল করতলব খাঁ। ইতিহাস খ্যাত নাম মুর্শিদকুলী খাঁ। তিনি ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকা) থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মুর্শিদাবাদে। তাঁর অনেক কীর্তির মধ্যে কাটরা মসজিদ। শুধু তাই নয় তিনি ঢাকা (জাহাঙ্গীর নগর) নগরীতে আরও একটি মসজিদ ও বাজার নির্মাণ করে ছিলেন। উক্ত মসজিদটি ‘জাফরী’ মসজিদ নামে খ্যাত। ইহা ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর উত্তরসূরি গুজনফার হুসেন খাঁর কন্যা হাজি বেগমের তত্ত্বাবধানে দেন। মসজিদটি আকারে বিশাল। এই মসজিদ নির্মাণ কৌশল অতি চমৎকার। মসজিদটি বেগম- বাজারের মসজিদ নামে পরিচিত।


                 মুর্শিদকুলী খাঁ ১৭০৪ সালে কাসিম বাজারে টাঁকশাল স্থাপন করেন। কাসিম বাজারে কোন স্থানে এই টাঁকশাল ছিল তা আজ চিহ্নিত করা যায় না। এক বছর পর কাসিম বাজার থেকে সরিয়ে মহিমাপুরে রাজকীয় টাঁকশাল স্থাপন করলেন। এবং এই টাঁকশালের পুরো দায়িত্বে রাখলেন মানিক চাঁদ তথা শেঠেদের উপর। এদেরই চক্রান্তে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়।


                    সম্রাট ওরঙজেব প্রধান কানুনগোর ক্ষমতা হ্রাস করে এবং সুবাদার বা নাজিম থেকে দেওয়ানকে আলাদা করে বেশি রাজস্ব আদায়ের জন্য হায়দ্রাবাদের দেওয়ানী দপ্তরের দক্ষ হিসাবরক্ষক মহম্মদ হাদীকে করতলব খাঁ উপাধি দিয়ে মুখসুদাবাদ প্রদেশের ফৌজদার ও সুবা বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যাকে সুবা বাংলা বলা হত। তিনি প্রথমে আসেন তৎকালে সুবার রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে। আজিম উসসানের বিদ্বেষ বাড়তে থাকলে  মহম্মদ হাদী মুখসুসাবাদের ভাগীরথী তীরে কুলোরিয়াতে বসবাস এবং দেওয়ানখানা গড়ে তুলেন। ভারত সম্রাট আরঙজেবের অনুমতিক্রমে তাঁর নামে রাজধানীর নাম করলেন মুর্শিদাবাদ। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর মুর্শিদকুলী খাঁ হন বাংলা সুবার সুবেদার এবং তাঁর সুতামন-উল-মুলুক আলা উদ্ দৌলা, জাফর খাঁন বাহাদুর নাসির, নাসির। মহম্মদ হাদীর সঙ্গে এসেছিলেন মহিমা পুরে মানিক চাঁদ, দর্পনারায়ন ডাহাপাড়ায় এবং ভট্টবাটিত জয় নারায়ন তখন থেকে মুর্শিদাবাদ জাঁকজমক রূপ পেল। এই কুলোরিয়াতে নিজ প্রাসাদ, দরবার হল সবই ছিল। চেহেল সেতুন নাম দিয়েছিলেন। ১৭০৪-১৭২৭ পর্যন্ত চেহেল সেতুন ছিল সুবা বাংলার নবাবদের বাসস্থান।

                    চেহেল সেতুন: ভাগীরথী তীরে কুলোরিয়া নামক স্থানে চল্লিশটা স্তম্ভের উপর নির্মিত দরবারখানা। ১৭০১সালে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার প্রধান দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি রাজস্ব আদায়ে দক্ষ ছিলেন বলে রাজস্ব আশাতীত বেড়ে যায়। তাঁর নির্মিত চেহেল সেতুন আজ আর চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন ইতিহাসের পাতায়। এটি একটি নবাবদের বাসোপযোগী সুদৃশ্য প্রসাদ। ১৭০৪-১৭২৭ প্রায় ২৫ বছর চেহেল সেতুন ছিল সুবা বাংলার নবাবদের বাসস্থান। বাংলার রাজধানী ছিল জাহাঙ্গীরনগর। ১৭০৪ সালে সেখান থেকে মুকসুসাবাদে রাজধানী তুলে এনেছিলেন। তাঁর নামানুসারে হয় মুর্শিদাবাদ। অবশ্য মুর্শিদাবাদ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতের প্রচলিত আছে। মুর্শিদকুলী খাঁ  এখানে আসার পর যে বিশাল বিশাল প্রাসাদ, ইমারত, কেল্লা, দরবার গৃহ প্রভৃতি নির্মাণ করলে মুখসুসাবাদ বা মুর্শিদাবাদ অজগাঁ থেকে শহর বা রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। নবাবও নেই আর সেই জৌলুসও নেই। চেহেল সেতুনের পাশেই মুর্শিদকুলী খাঁর মহিষী নৌসেরীবানু বেগমের একটি মসজিদ ও তার মধ্যে নৌসেরীবানু বেগমের সমাধি আছে। মসজিদটি নির্মাণ করেন ১৭১৮ সালে নৌসেরীবানু বেগম। মসজিদটির নাম কেউ বলে নৌসেরী বানুর মসজিদ আবার কেউ বলে বেগম মসজিদ। মসজিদটি বিলুপ্তের পথে।


                    কাটরা মসজিদ: মুর্শিদাবাদ শহরের অন্যতম আকর্ষণ কাটরা মসজিদ। নগরীর মধ্যে একটি প্রাচীন অন্যতম মসজিদ। মুর্শিদকুলী খাঁর আরও একটি অমর কীর্তি কাটরা মসজিদ। ১৭২৩ সালে মক্কার সুপ্রসিদ্ধ মসজিদের আদলে নির্মিত কাটরা মসজিদ। মোরাদ ফরাস নামে তাঁর একজন স্থপতিকে ওই মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করে ছিলেন। স্থপতি মোরাদ ফরাস মাত্র ১৭২৩-১৭২৫ সালের মধ্যে কাটরা মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ মৃত্যু বরণ করলে তাঁর পূর্ব ইচ্ছে অনুযায়ী মসজিদের সিঁড়ির নিচে কবরস্থ করা হয়। ১৭৮০ সালে হোজেস নামের পরিব্রাজকের মতে এখানে ৭০০ জন কারী এক সঙ্গে বসে কোরআন পাঠ করতেন। এবং তার ব্যয় ভার ছিল কাটরা বাজারের আয় থেকে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কাটরা মসজিদের গম্বুজ ও অন্য অংশের ক্ষতি হয়। এখানে একটি সুবিশাল শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। এবং যা দেখে সবাই অবাক হতেন।

                   মহিমা পুর ও টাঁকশাল: ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খাঁ ঢাকার জাহাঙ্গীর নগর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সেই সময় জগৎ শেঠ বংশের পূর্ব পুরুষ মানিক চাঁদও মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। তিনি ছিলেন হীরা নন্দের পুত্র। হীরা নন্দের সাত ছেলে নানা স্থানে ব্যবসা করতেন। মানিক চাঁদের ব্যবসা ছিল বাংলায়। তাঁর ব্যবসা মূলত মহাজনী ও হুন্ডির। মহিমা পুর টাঁকশালের পরিচালনার দায়িত্ব পান মানিক চাঁদ। ১৭১৫ সালে দিল্লির বাদশা ফারুকশিয়ার তাঁকে শেঠ উপাধি প্রদান করেন। সুবা বাংলার উত্থান ও পতনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে এই খল নায়ক জগৎ শেঠের নাম। 

[চলবে...]