খাসিয়াদের জীবন ও সমাজচিত্র







খাসিয়াদের জীবন ও সমাজচিত্র
শেখ একেএম জাকারিয়া

খাসিয়া  জনসমাজ বাংলাদেশে ও ভারতে বসবাসরত একটি মাতৃতান্ত্রিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে, ভারতের আসামে ও মেঘালয় রাজ্যে এ জনগোষ্ঠী বাস করে। সিলেটের খাসিয়ারা সিনতেং (ঝুহঃবহম) গোত্রভুক্ত জাতি। এরা মূলত চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ভাত ও মাছ এদের প্রধান খাদ্য। এদের মধ্যে কাঁচা সুপারি ও পান খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান বাংলাদেশে খুবই লোকপ্রিয়। এরা মঙ্গো-লয়েড বংশজাত। প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি আগে খাসিয়ারা ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশে আসে। আর এরা আসামে এসেছিল সম্ভবত তিব্বত থেকে। খাসিয়াদের  বাংলাদেশে আগমনের সময় বা কাল জানা থাকলেও তিব্বত থেকে আসামে আগমনের  সময় আমাদের অজ্ঞেয়। এদের গায়ের রং পীতবর্ণবিশিষ্ট, নাক-মুখ থ্যাবড়া, মুখের ভিতরের যে অংশে দাঁতের পাটি সংলগ্ন থাকে সে অংশ অর্থাৎ থুতনি উঁচু, চোখ কৃষ্ণবর্ণ ও ছোটো টানা এবং ক্ষুদ্র দেহবিশিষ্ট। সুদূর অতীতে এ উপজাতি যাযাবর ছিল। এদের সে আত্মভাব বর্তমানকালেও পরিলক্ষিত হয়। খাসিয়াদের ভাষায় গ্রামকে পুঞ্জি বলা হয়। জীবিকার তাগিদে দলবলসহ স্থান ত্যাগ করে এরা নতুন পুঞ্জি গঠন করে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন সবসময়  নিরুপদ্রবে থাকতে ভালোবাসে অর্থাৎ এরা খুবই শান্তিপ্রিয়। বাংলাদেশে খাসিয়াদের আদি বসতি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব  সীমান্তে অবস্থিত সুনামগঞ্জ জেলায়, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে যা সমতল ভূমি বা হাওরাঞ্চল থেকে ৯/১০ মিটার উচুঁতে অবস্থিত।  অতীতে এ অঞ্চলের কয়েকটি পরগনা দখল করে কোনও এক খাসিয়া সর্দার একটি রাজ্যও স্থাপন করেন। অবশ্য পরবর্তীতে  তিনি এখান থেকে বিতাড়িত হোন। এ সময়ে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ২৫০টি খাসিয়া পরিবার বসবাস করছে। এরা সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সদর উপজেলার সীমান্দ এলাকায়  ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খাসিয়া অঞ্চলে সিন্টেং, গারো ও লালং উপজাতিরও বসতি আছে। তবে তারা সংখ্যালঘু, খাসিয়াদের চোখে হেয়, যদিও তারা (গারো ছাড়া) খাসিয়া বংশজাত। স্বয়ং খাসিয়াদের মাঝেও একের বেশি গোত্র আছে। যেমন খোংতা, পলং, সুরং ইত্যাদি। বর্তমানে হবিগঞ্জ ও
মৌলভীবাজার সীমান্তে ৫টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৬১টি এবং সিলেট জেলায় ৭টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে।

খাসিয়ারা  বর্ণজ্ঞানহীন। তাদের  ভাষা অলিখিত। কিংবদন্তি আছে এক সময়ে তাদের লিখিত ধর্মশাস্ত্র ছিল, ঝড়বৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাপূর্ণ সময়ে তা নষ্ট হয়ে যায়। এরা দ্বিভাষী, খাসিয়া ভাষা ও সামান্য বিকৃত উচ্চারণে বাংলায় অনর্গল কথা বলতে করতে পারে। এক সময়ে খাসিয়া ভাষা বাংলা অক্ষরে লেখা হতো। বাইবেলের কিছু অংশ প্রথম খাসিয়া ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা অক্ষরে লেখা হয়েছিল। শিক্ষিত খাসিয়ারা  আজও বাংলা অক্ষরে খাসিয়া ভাষায চিঠিসহ অন্যান্য ধর্মীয় প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কাগজে লিখে রাখে। বর্তমানে সীমান্তের ওপারে ভারতে খাসিয়া ভাষা রোমান হরফে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে খাসিয়া ভাষার কোনও সর্বজনীন রূপ নেই। দু’দেশে খাসিয়াদের  অধিকাংশই সীমান্ত অঞ্চলে বাস করে। সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর এবং জোয়াই ও জৈন্তাপুরের মাঝখানে অনেক খাসিয়া পুঞ্জি বা বসতি রয়েছে। কুলাউড়ার চা বাগানে বহু খাসিয়া চাকুরি করে। বাংলাদেশে খাসিয়া জনসংখ্যার ঠিক হিসাব এখনও জানা  যায়নি । ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ১২হাজার ৩০০জন খাসিয়া আছে। কিন্তু ‘বাংলাদেশ খাসিয়া সমিতি’ তাদের সংখ্যা ৩০ হাজার বলে দাবি করে।  উইকিপিডিয়ার হিসাব অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশে খাসিয়াদের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ১৩,৬১,১০০ জন। উল্লেখ করার মতো জনসংখ্যার অঞ্চলসমূহের মধ্যে  ভারতের মেঘালয়ে ১২,৫০,০০০ জন, আসামে ২৯,০০০ জন। তাছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মিজোরাম, মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা, তামিলনাড়, অরুণাচল প্রদেশ, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ৩,১০০ জন। অপরদিকে  বাংলাদেশে আছে ২৯,০০০ জন। খাসিয়াদের জন্মহার অনেক বেশি। খাসিয়া পুঞ্জিতে রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-কানুন। এদের পুঞ্জি প্রধানকে সিয়েম বলা হয়। মেঘালয়ে কিছু পুঞ্জি প্রধানের বিচার-ক্ষমতা আছে। বাংলাদেশেও পুঞ্জি প্রধানগণই নিজেদের আচারবিচার করেন। এদের মন্ত্রী বলা হয়। খাসিয়া সমাজ ব্যবস্থায় কোনও পুরুষ সম্পত্তির মালিক হয় না। এরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত। বর্তমানে নূনাধিক সকলেই অবগত খাসিয়া সমাজে নারীতন্ত্র বিদ্যমান অর্থাৎ নারীরাই খাসিয়া সমাজে প্রধান ভূমিকা পালন করে। খাসিয়াদের বিশ্বাস, নারীর হাত ধরেই মানব সভ্যতার সূচনা। আর সেজন্যেই খাসিয়ারা নিজ সমাজে জন্মলগ্ন থেকে  অদ্যাপি মাতৃতন্ত্র ধরে রেখেছে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ বিয়ের পিড়িতে বসা খাসিয়া সমাজে মহাপূণ্যের কাজ। তাদের ধারণা এটি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ এবং বিয়ে না করা মহাপাপ, অন্যথায় অভিশপ্ত হতে হয়। খাসিয়াদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বেশ সমৃদ্ধিশালী। খাসিয়া ভাষায় রচিত গানগুলো মানব হৃদয়কে আলোড়িত করে। বিয়েসহ এদের অন্যান্য অনুষ্ঠান বেশ সরগরম ও উপভোগ্য। বিয়ে ছাড়াও নানারকম সাংবাৎসরিক উৎসবে ওরা দলবদ্ধভাবে নৃত্যগীত করে। জন্ম-মৃত্যুর অনুষ্ঠানাদিও এভাবেই পালন করে। তাদের নাচ-গান অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। খাসিয়া সমাজে নারীরা পছন্দমতো অন্য গোত্রের পুরুষ বিয়ে করতে পারে, সামাজিক রীতি অনুযায়ী স্বামীকে পুরো জীবন স্ত্রীর বাড়িতে কাটাতে হয়। বিয়ের ব্যাপারে নারীরাই  মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নিজের পছন্দের পুরুষকে তারা বাড়িতে নেমন্তন্ন করে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে   একসঙ্গেও কিছুদিন কাটায়। পরবর্তীতে নিজেদের অভিভাবকের মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করে। বিয়ের দিনে বরযাত্রীরা বরকে সাদা ধুতি, চাদর, পাগড়ি পরিয়ে কনের বাড়িতে যাত্রা করে। যাওয়ার সময় মাতৃসমা নারীরা বরকে আশীর্বাদ করে। কনেপক্ষ বরযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। খাসিয়া ধর্মগুরুর মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে বিবাহকর্ম সম্পন্ন হয় এবং নবদম্পতিকে ‘ধনে-জনে অদৈন্য’ প্রার্থনা করে, তারপর উত্তম স্বাদবিশিষ্ট ভোজনপর্ব শুরু হয় এবং বরকে বিয়ে বাড়িতে রেখে রাতের মধ্যভাগে বরযাত্রী বিদায় নেয়। বিবাহকর্ম সম্পন্ন হওয়ার পর কন্যার মাতৃগৃহের পাশেই সদ্যবিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর জন্য ঘাসপাতা ইত্যাদিতে ছাওয়া ছোট কাঁচা ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। যদি তা সম্ভব না হয় মাতৃগৃহেই তাদের বাস করতে হয়। কোনও কোনও পুঞ্জিতে গৃহ বানিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে কনিষ্ঠা কন্যার জন্য আলাদা কোনও ঘর নির্মাণ করা হয় না। কারণ সে মাতৃগৃহ ও সমুদয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। সংসারের খরচাপাতিসহ টাকা পয়সার লেনদেন হয় স্ত্রীর হাত দিয়ে।














খাসিয়া সমাজে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে চাষাবাদ ও ঘরকন্নার সকল কাজ চলে। এদের মধ্যে বিরুদ্ধমত কমই দেখা যায়। পুরুষরা নারীদের সাথে বিশেষত স্বামীরা স্ত্রীদের সাথে সবসময়ই সম্মান বা শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করে থাকে। স্ত্রীর অকাল মৃত্যু হলে তার সন্তানগণ মাতৃনামেই পরিচিত হয়। স্ত্রী মারা যাবার পর স্বামীরা অর্থাৎ সন্তানগণের  পিতা অন্যত্র বিয়ে করে চলে যেতে পারে। এসময় তাদের সন্তানগণ মায়ের একেবারে ছোট বোনের দ্বারা লালিতপালিত হয়। এর কারণ পারিবারিকভাবে সমুদয় সম্পত্তির মালিক থাকে পরিবারের অনুজা কন্যা। অন্য মেয়েরাও ভাগ পায়, পরিমাণে কম। কিন্তু কনিষ্ঠা কন্যা ছাড়া তাদের সম্পত্তি বিক্রয় করার অধিকার নেই। পারিবারিক পুজো বা উপাসনা ও অনুষ্ঠানাদির কর্তব্য-ভার ছোট কন্যার ওপর অর্পিত। একবারই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া খাসিয়া সমাজের রীতি। তবে স্বামীর যৌন অক্ষমতা, স্বামী পছন্দ না হওয়া কিংবা শুধুমাত্র যৌন মিলনের জন্যও স্ত্রীরা একাধিক বিবাহ করতে পারে। পুরুষদের বহু বিবাহ খাসিয়া সমাজে নেই বললেই চলে । তবে স্ত্রীর সন্তান না হলে, স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে। বিভিন্ন পুঞ্জিতে তাদের বিবাহ রীতি ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কিছু বিভিন্নতা আছে। উল্লেখ্য, খাসিয়াদের  বিয়ে ভিন্ন গোত্রে হওয়া বাধ্যতামূলক। নিজ গোত্রে বিয়ে খাসিয়া সমাজে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কোনো যুবক-যুবতি নিজ গোত্রে বিয়ে করে তাদেরকে মারাত্মক শাস্তি দেওয়া হয়। যুবক যুবতি দুজনকেই গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়, সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, মৃত্যুর পর তাদের ধর্মরীতি অনুসারে সৎকার পর্যন্ত করা হয় না। ধর্মের দিক থেকে খাসিয়াদের ধর্ম অতি অনাধুনিক, কিন্তু কালে কালে তা বিবর্তিত। প্রচলিত আচার ও কুসংস্কারদ্বারা আচ্ছন্ন বিশ্বাসই এদের ধর্ম। খাসিয়াদের মধ্যে এ সময়ে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টধর্মের প্রভাব লক্ষণীয়। বর্তমানে এরা প্রেসবিটারিয়ান, ইউনিটারিয়ান, রোমান ক্যাথলিক, শাইভিশম অথবা সর্বপ্রাণবাদী আদিবাসী। খাসিয়া সম্প্রদায়ের পরিবর্তনটা মূলত তাদের ধর্মেই বেশি ঘটেছে। আনুমানিক ২০০বছরের কাছাকাছি সময়ে খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকরা খাসিয়াদের মধ্যে ধর্মপ্রচার শুরু করেছিল। বর্তমানে ৮০থেকে ৯০শতাংশ খাসিয়াই খ্রিষ্টান। প্রায় প্রতিটি পুঞ্জিতেই গির্জা রয়েছে। প্রতি রোববারে খাসিয়ারা গির্জায় প্রার্থনা এবং পুঞ্জির নানাবিধ  বিষয় নিয়ে কিছু সময় আলোচনা করে। খ্রিষ্টান যাজকগণ অনেক সময় পুঞ্জির আচারবিচারেরও দায়িত্ব পালন করেন। খাসিয়ারা শুরু থেকেই একেশ্বরবাদী। তাদের বিশ্বাস, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টির পর পৃথিবীতে একজোড়া অর্থাৎ একজন নর ও একজন নারী সৃষ্টি করেন। তারপর, মহাজগতের বিভিন্ন দিক নিয়ন্ত্রণের জন্য দেব-দেবী সৃষ্টি করেন। অধুনা, কিছু খাসিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ফলে খাসিয়াদের সমাজ ও অর্থনীতি বিষয়ক কাঠামোই বদলে গেছে। খ্রিষ্টান খাসিয়ারা প্রোটেস্টান্ট। এরা মৃতদেহ দাহ করে কিন্তু অস্থিগুলো কবর দেয়। মৃতদেহ সৎকারের সময় খাসিয়া ধর্মগুরু প্রার্থনামন্ত্র পাঠ করে, যার বাংলা ভাষান্তর, ‘বিদায়, বিদায়, বিধাতার রাজ্যে গিয়ে তুমি পান খাবে’। বর্তমানে এদের ধর্মীয় সুখদুঃখবোধ জীর্ণসংস্কার, পোশাকপরিচ্ছদ ও আচরণবিধিতে আধুনিক ছাপ পরিলক্ষিত হয়। ধর্মীয়দিক ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে খাসিয়াদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এদের অনেকেই প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক। বর্গাদার এদের জমিতে বাগ-বাগিচা তৈরি ও চাষাবাদের কাজ করে। বর্গাদার ঠিকমতো চাষাবাদ করছে কী-না, তা তদারকির জন্য বেতনভুক কর্মচারী আছে। ধর্মীয় ও সামাজিক আনন্দনুষ্ঠানাদি পুঞ্জির প্রধান অর্থাৎ মন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে উদযাপিত হয়। স্বজাতি প্রেম এদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত। খাসিয়ারা এককালে পার্বত্য জাতি ছিল।  জমিওয়ালা স্বল্পসংখ্যক লোকই  জুমচাষ ও বাগবাগিচা করে। এদের অনেকেরই  জমিজমা নেই। খাসিয়ারা
বহুকাল পূর্ব থেকেই থেকে কলা, আনারস, কমলা, তেজপাতা, গোলমরিচ, পান ইত্যাদি উৎপাদনে অভ্যস্ত। অতীতে এরা খুবই আক্রমণাত্মক ছিল। মুঘল শাসন আমলের পূর্ব থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত পার্বত্য খাসিয়ারা নিম্নাঞ্চল আক্রমণ করে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ড চালাত। প্রাচীন গ্রন্থাদি পাঠে জানা যায়, খাসিয়ারা  ১৭৪৪খ্রিস্টাব্দে কোনও এক সামন্ত রাজার রাজধানী সুনামগঞ্জের লাউড় পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে মুঘলরা খাসিয়াদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সীমান্ত পরগনাগুলোতে সৈন্য মোতায়েন করে। ইংরেজদেরকেও তাই করতে হয়। সীমান্তে অবস্থিত পাহাড়গুলো চুনাপাথরের ধনভান্ডার। চুনাপাথরের ব্যবসা নিয়ে ১৭৭৪থেকে ১৭৯৫খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বিবাদ সৃষ্টি হয়েছে। সে সময় ওইসব পাহাড় ছিল খাসিয়া সর্দারদের অধীনে। ১৭৮৭সালে খাসিয়ারা সুনামগঞ্জর পাঁচটি পরগনা আক্রমণ করে প্রায় ৩০০ লোক হত্যা করে। বিষাক্ত তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি তাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র। খাসিয়াদের দমন করতে ইংরেজদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। স্থানীয় জমিদারের সঙ্গেও প্রায় সময়ই খাসিয়াদের সংঘর্ষ বাঁধত। কৃষিকাজ কিংবা চা বাগানের কাজ ছাড়াও বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকার এপার-ওপারে এরা অবাধে পান, কমলা, মাছ, চাল ইত্যাদির ব্যবসা করে। খাসিয়াদের সীমান্ত ব্যবসা সুদূর অতীত থেকে শুরু এবং আজও তা অব্যাহত। এপার-ওপার সীমান্ত ব্যবসা বা বেচাকেনার জন্য খাসিয়াদের নির্দিষ্ট বাজার রয়েছে। খাসিয়া নারীরা সেসব বাজারে মালামাল আনা নেয়া ও বেচাকেনা করে। নারীরা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের জন্য পাহাড় থেকে লোকাল হাটে বা বাজারে নেমে আসে। খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হচ্ছে শিরে চূড়াবাঁধা পাগড়ি পরিধান করা। আধুনিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে এখনও স্বকীয় ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। ভূমির উৎপাদনশক্তি বৃদ্ধির জন্য তারা বিভিন্ন নামে সারাবছরই ব্রত পালন করে। তাছাড়া ফসল বপনের সময় খিয়াখাং ব্রত পালন করে। অন্যান্য ব্রত হচ্ছে খিয়া পিস্থল, পিরদোং স্ট্রোং, খিয়া ক্লাম ইত্যাদি। প্রাচীন গ্রন্থাদি পাঠে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্যরা এ দেশে কর্তৃত্ব স্থাপন করলে তারা আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে এ আদিবাসীরাই আর্য নয় এমন জাতি বা অনার্য বলে পরিচিতি লাভ করে। আর্য-অনার্য যুদ্ধে অনার্যরা পরাজিত হয়ে বনজঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং পরে সে সব ঝোপঝাড়পূর্ণ স্থান বা গহীন বনজঙ্গলেই বসবাস শুরু করে। ফলে তারা শিক্ষাদীক্ষা ও আধুনিক জীবনব্যবস্থা থেকে দূরে থাকে। বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার প্রভাবে খাসিয়া সমাজে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এসেছে। সে সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাও পর্যায়কর্মে শিথিল হয়ে এসেছে।


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট