ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৫

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৫

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৫,

শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর ২০২০ 


















ম্যালেরিয়া বিজয়

ম্যালেরিয়া বিজয়

 



ম্যালেরিয়া বিজয়

মূল :  টমাস চার্লস ব্রিজস এবং হেজেল টিল্টম্যান 

অনুবাদ : আহাদ আদনান 


গ্রীষ্মম-লের দেশগুলোতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এসব দেশের হাসপাতালে রোগীদের এক তৃতীয়াংশ এই রোগ নিয়ে আসে। এমনকি উষ্ণ দেশগুলোর জনসংখ্যারও এক তৃতীয়াংশ বছরে ম্যালেরিয়ায় ভোগে। যদিও কয়েক হাজার রোগীদের মধ্যে একজন শুধু এই রোগে মারা যায়, এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের কথা চিন্তা করলে সামষ্টিক মৃত্যুর অঙ্কটা কিন্তু বিশাল হয়েই দাঁড়ায়। সরকারি হিসেব মতে ভারতে প্রতি বছর গড়ে তেরো লক্ষ প্রাণ ম্যালেরিয়ায় ঝরে যায়। এটি ইউরোপেও হানা দিয়েছে। দূর উত্তরে হল্যান্ড (নেদারল্যান্ড) এবং ইংল্যান্ডও এর শিকার। এই কিছুদিন আগেও গ্রীস এবং রোমের আশেপাশে এটি ছিল মূর্ত অভিশাপ। বিশ্বের একটি বিশাল অংশে ম্যালেরিয়া মানেই  প্লেগের মত মহামারি। অধিবাসীদের জন্য সাক্ষাৎ আতঙ্ক। 

বছরের পর বছর বিজ্ঞানি, চিকিৎসক এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। রাতের বাতাস এর জন্য দায়ী? নাকি দূষিত জল? এই দুটি ভাবনাই অবশ্য পরিত্যাক্ত হয়েছে। ম্যানসন এবং রস আজ এই উড়ন্ত ক্ষুদ্র জীবাণুটিকে পরাজিত করেছেন, যেটি বিংশ শতাব্দীর শুরু অব্দি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে চোখ রাঙিয়েছে। যার কাছে সেনা, নৌ-বহর এমনকি চিকিৎসকরাও ছিলেন অসহায়। তারা দেখিয়েছেন ম্যালেরিয়া কিভাবে ছড়ায় আর কিভাবে একে জয় করা যায়।

স্কটিশ চিকিৎসক স্যার প্যাট্রিক ম্যানসন ১৮৬৬ সালে ফরমোসা এলাকার চীনা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি ‘গোদরোগ’, অর্থাৎ যে রোগে হাত, পা হাতির মত ফুলে যায়, নিয়ে অধ্যায়ন করেন। সেখানেই তার পরিচয় ঘটে ম্যালেরিয়ার সাথে। দুটোই গ্রীষ্মম-লীয় এলাকার অসুখ। দুটোই কি জলাভূমির রাতের বাতাসের জন্য হয়? এমনই ছিল তখনকার ভাবনা।

ম্যানসন শুরু করলেন অনুসন্ধান। তিনি এই নতিজায় পৌঁছলেন যে, মানুষের রক্তে ‘ফাইলেরিয়া’ নামের একটি পরজীবী’র এই অসুখের (গোদরোগ) সাথে কোন না কোন সম্পর্ক আছে। সমস্যা তাতে বাড়ল বৈ কমলো না। ‘ফাইলেরিয়া’ রক্তে গেলো কিভাবে, এবার বলুন দেখি। এতো হাঁটেও না, উড়েও না। একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়। ধরুন; একজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় দিয়ে কোন পতঙ্গ তার রক্ত চুষে খেল, সে আবার আরেকজন সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ে তার রক্তে এই জীবাণু ছেড়ে দিল। এমন হতেই পারে, নাকি? 

সন্দেহ গিয়ে পড়ল মশা’র উপর। এর গতিবিধি’র সাথে জীবাণু ছড়ানোর সূত্র যে মিলে যাচ্ছে। হাতেকলমে পরীক্ষার জন্য ম্যানসন একটি ফন্দি আঁটলেন। তার অধীনস্থ দেশীয় কয়েকজনের রক্ত পরীক্ষা করে ভারি মাত্রায় জীবাণু আক্রান্ত একটি ছেলেকে বাছাই করলেন। মশা’য় ভরা একটি কামরায় তাকে রাত যাপন করতে দিলেন। উদ্দেশ্য, মশা যাতে তাকে প্রচ- কামড়ায়। পরেরদিন রক্ত খাওয়া মশাগুলোকে ধরে ব্যবচ্ছেদ করে দেখলেন। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পরকলা (লেন্স) দেখাচ্ছে রক্তে ‘ফাইলেরিয়া’ জীবাণু! আবিষ্কার হয়ে গেলো, গোদরোগের জীবাণুর বাহক আসলে মশা।

ম্যানসনের এই আবিষ্কার বিজ্ঞানিদের চিন্তার অনেকগুলো দ্বার’কে নাড়া দিল। এই মশা যেভাবে গোদরোগ করছে, একই ভাবে ম্যালেরিয়া করতে পারে না? ল্যাভেরান নামের একজন ফরাসি চিকিৎসক, যিনি কাজ করছিলেন আলজেরিয়াতে, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ম্যালেরিয়ায় জন্যও মশা দায়ি। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া তার দাবি পাত্তা দিবে কেন বিজ্ঞানি সমাজ? তাদের যেন কোন তাড়াও নেই। এর মধ্যে ম্যানসন চীন থেকে অবসর নিয়ে চলে আসেন ইংল্যান্ড। সবকিছু থমকে গেল কয়েক বছরের জন্য। 

লন্ডন, ১৮৯৪ সাল। ম্যানসনের কাছে একটি চিঠি এলো। লিখেছেন চিকিৎসক মেজর রোনাল্ড রস। অনেকদিন তিনি কাজ করেছেন ভারতীয় চিকিৎসা বিভাগে। ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন। ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য গ্রীষ্মম-লীয় ব্যাধি নিয়ে তার বিপুল আগ্রহ। একজন আরেকজনের সাথে দেখা করলেন। ভাবনার আদান প্রদান হলো। উপাত্তের বিনিময় হলো। জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রচ- আঘাতের এই ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ।      

যৌথ গবেষণার ইতিহাসে অন্যতম প্রসিদ্ধ অনুসন্ধান। মানবতার দুই পরম দরদি চিকিৎসক। একজন বিলেতে, আরেকজন আবার ভারতে। একজন আরেকজনকে সহায়তা, উৎসাহ আর পরামর্শ দেওয়া চালিয়ে গেলেন। রস তার পূর্বসূরি ম্যানসনের বাতলানো পথ ধরলেন। অর্থাৎ, ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর রক্ত খাবে মশা, আর তিনি তিনি সেই মশাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখবেন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে। আশ্চর্য, পরকলা যে কোন আশানুরূপ ফল দেখাচ্ছে না। কয়েকশ’ মশা বিচ্ছিন্ন হয়ে এলো যন্ত্রের নিচে। উঁহু, কিছুই হচ্ছে না। এখন কি হবে?

মাসের পর মাসের চলে যায়, পরীক্ষা আর সফল হয় না। রস কি ভুল পথে এগুচ্ছেন? এদিকে ম্যানসন বিশ্বাস করে বসে আছেন, আক্রান্ত মশা পানীয় জল দূষিত করছে, আর সেই জল পান করেই ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছে। রস কিন্তু এই মত মোটেও গ্রহণ করলেন না। কিন্তু আরেকজন বিজ্ঞানির মত এত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায়?

তিনি বেছে নিলেন চারটি মশা, একজন ম্যালেরিয়া রোগী আর দুই বোতল জল। কাজ খুব পরিষ্কার। মশা রোগীর রক্ত খেয়ে বসবে, ডিম দিবে সেই জলে। এক সপ্তাহ শীতল পরিবেশে রাখা হবে সেই জলাধার। তারপর দেখা গেল মশাগুলো মরে পড়ে আছে। ডিম ফেটে মশা’র লার্ভা বা কীট সাঁতরে বেড়াচ্ছে। রস শুধু মৃত মশাগুলো সরালেন। থেকে গেলো কিছু ডিম আর কীট। এবার সুস্থ ব্যক্তিকে এই জল পান করাতে হবে। কে পান করবে এই দূষিত জল? অধীন ভারতীয়রা আছে না (অনুমতি সাপেক্ষে অবশ্য) পরীক্ষার ফল এল অদ্ভুত!


দুইজন স্বেচ্ছাকর্মী দিব্যি সুস্থ হেঁটে বেড়াচ্ছে। একজনের এসেছে জ্বর। ম্যালেরিয়া নয়তো? লক্ষণতো সেরকমই? রক্ত পরীক্ষা বলল ম্যালেরিয়া নয়। আসলে এটা ছিল স্রেফ কাকতাল। এখন তাহলে ম্যানসনের তত্ত্ব বাতিল করতেই হয়। এই কথাগুলো লিখে রাখলেন রস তার ‘মেমোরিজ’ বইয়ের খসড়ায়। তিনি ফিরে এলেন তার মশা’র রক্তপানের এবং কামড়ের সূত্রে। 

একদিন সকালের কথা। তিনজন লোক রস’কে মশা ধরে দিত। তাদের একজন কিছু লার্ভা নিয়ে এসেছে। এই লার্ভাগুলোর থেকে যে মশা বেড়ে উঠলো তাদের পাখায় ছোপ ছোপ বর্ণালি। রসে’র আগের পরীক্ষায় মশাগুলোর পাখায় ছিল তিনটি করে কালো দাগ। রস বিস্মিত হলেন। এ যে নতুন, এ যে অপূর্ব! ঠিক আগের পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি হলো। সিকান্দারবাদ, ষোলই আগস্ট ১৮৯৭। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে রস তাকালেন পরকলা’য়। না, কিছুই পাওয়া গেলো না। হাল ছাড়লেন না তিনি। বর্ণালি ছোপের আরও কিছু মশা’র প্রজাতি জোগাড় করা হলো। 

চার দিন পরের কথা। অর্থাৎ, আগস্টের কুড়ি তারিখ। রসে’র ভাষায় ‘মশক দিবস’। প্রথম কয়েকটি মশা কেটে কিছুই পাওয়া গেলো না। শেষ কয়েকটি মশা আছে শুধু। এরা ষোল তারিখে ম্যালেরিয়া রোগীর রক্ত খেয়ে ফুলে আছে। একটি মশাকে ব্যবচ্ছেদ করা হলো। শরীরে কিছুই পাওয়া গেলো না। রসে’র চোখ ক্লান্তিতে ঢুলুঢুলু করছে। মশার পাকস্থলীতো এখনও দেখা হয়নি। পাক্কা আধ ঘণ্টা লাগবে। শরীর যে আর সায় দিচ্ছে না। এর আগেওতো কয়েক সহস্র পাকস্থলী দেখে বসে আছেন। এটা কি দেখতেই হবে? ‘বিনা রণে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’। এই মন্ত্রে দীক্ষিত রসে’র জবানিতেই আসুন দেখে নিই কী হয়েছিল সেদিন।     

‘কষ্ট হলেও আমি অনুসন্ধান অব্যহত রাখলাম।  হঠাৎ আমি স্পষ্ট গোলাকার একটি রেখা দেখতে পেলাম। প্রায় বারো মাইক্রন হবে ব্যাসার্ধে। আকারটি বেশ ক্ষুদ্র আর বাইরের আবরণ এত তীক্ষè। এটাতো শুধুই মশা’র পাকস্থলী’র কোষ নয়। আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক। এইতো, ঠিক একইরকম আরেকটি কোষ। আরও কয়েকটি। এদের একটিকে আমি আরও সূক্ষ্মভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। কিছু দানাদার বস্তু পেলাম যেগুলো অবিকল ম্যালেরিয়া’র পরজীবী’র সাথে মিলে যাচ্ছে। মোট বারোটি এমন গোলক পর্যবেক্ষণ করে ফেললাম। আমার শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। এত বড় আবিষ্কারের মাঝপথে বিশ্রামের জন্য বাসায় আসলাম। এক ঘণ্টা ঘুমিয়েছি কি ঘুমাইনি, আমি যে গেলাম। আমি কি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি? জেগে উঠে এটাই ছিল আমার প্রথম ভাবনা’।

চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসের অন্যতম বড় আবিষ্কার, যা কোটি কোটি জীবন বাঁচাতে কাজে লেগেছে, সেটা উপলব্ধি করতে ক্লান্ত, বিধ্বস্থ আর বারংবার ব্যর্থ রসে’র ঘুমটি জরুরি ছিল! পরের সকালে শেষ মশা’টি ব্যবচ্ছেদ করে সেই গোলাকার বস্তু পাওয়া গেল পাকস্থলীতে। তিনি বুঝে গেলেন কত বড় জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছে। তার ভাষাতেই আসুন দেখি তিনি কি ভাবছিলেন।

‘আমাদের একই সাথে দুটি বিষয় বের করতে হয়েছিল। কোন ধরণের মশা জীবাণু বয়ে বেড়াচ্ছে এবং এর ভেতরে জীবাণুটির আকার, অবস্থান। আমি প্রচ- ভাগ্যবান, দুটো পাখিই আমি এক ঢিলে শিকার করে ফেলেছি। শুধুমাত্র “এনোফিলিস” মশা’ই ম্যালেরিয়া’র জীবাণু বহন করে বেড়ায়। এই জীবাণু বাসা বাঁধে মশা’র পাকস্থলী’র দেওয়ালে। এদের চেনা যায় এই বিশেষ বর্ণ দেখে। গত ত্রিশ বছর আমি এবং আমার মত আরও বিজ্ঞানি যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছি, এখন তা ছেলেখেলা মনে হচ্ছে। এই সুত্র ধরে এগুলে যে কেও এখন থেকে এটা পারবে’। 

নিন্দুকের দল বসে ছিল সেদিনও। তারা বলল, মশা আসলে বাসা বেঁধেছে রস’দের মাথাতেই। এগুলো গুজব। আবার অনেকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। নিন্দা বা প্রশংসা, রস গায়ে মাখেননি কোনটিই। পাখিদের শরীরে আক্রান্ত মশার কামড় দিয়ে জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি আবার তার আবিষ্কার প্রমাণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঠিক পথেই আছেন। এটাই যথেষ্ট। মৃত্যু আর অসুখের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের চেয়ে আর কি বড় হতে পারে? 

এই আবিষ্কার তাকে খ্যাতি এনে দিলেও অর্থযোগ ঘটাতে পারেনি। এ যেন অন্য হাজারও গবেষকদের গল্প। রস’কে দরিদ্র’ই বলতে হবে। পরবর্তীতে ১৯০২ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে তাকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। পাটনা’য় তার নামে প্রতিষ্ঠিত গ্রীষ্মম-লীয় অসুখের একটি ইন্সটিটিউটে তিনি ছিলেন প্রধান পরিচালক। আমৃত্যু, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাজ করে গেছেন। 

তরুণ রস ভারতে এসে দেখেছিলেন প্রতিষ্ঠিত, মেধাবি চিকিৎসকরা একটি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়া অসুখ মোকাবিলা করতে হিমসিম খাচ্ছেন। হ্যা, তারা কুইনিন দিয়ে রোগ সারাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রতিরোধের উপায় কোথায়? শত্রুর ডেরার খোঁজ কে দিবে? চার বছরের সাধনার পর রস শত্রুকে খুঁজে বের করে দেখালেন কিভাবে একে জয় করা যায়। কিভাবে ম্যালেরিয়া বিজয় সম্ভব। অনাগত প্রজন্ম এমনি করে জীবন এবং মৃত্যুর অসংখ্য রহস্য উন্মোচনের জন্য লড়াই করবে। কোন এক মুহূর্তে হতোদ্যম, হতাশ হয়ে পড়বে। তখন সেই পাথর সময়গুলোতে স্যার রোনাল্ড রসে’র গল্প হয়ত ওদের মনে পড়বে। অনুপ্রেরণা জোগাবে যুগে যুগে। 


আলতার রং লাল

আলতার রং লাল

 



আলতার রং লাল

মুনিম রাব্বী


অমাবশ্যার বুনো অন্ধকার । মাঝ রাতের এই গভীর আঁধারে যেন গ্রামটা অনন্তকাল ধরে ঘুমিয়ে আছে । আঁধার ডিঙ্গিয়ে কতকাল সূর্যও ওঠে না মনে হচ্ছে । এমন ঘুমন্ত রাতই আদর্শ আলতা চোরার জন্য । বছর দুয়েক আগে এই গাঁয়ে এসেছিল আলতা। সেবার ধরা খেয়ে বেদম পিটুনি খেতে হয়েছিল । ধরা অবশ্য খেতনা । সামান্য ভুলটুকু না করলে আলতাকে কেউ আর হাতের নাগালে পেতনা । এখনও সে রাতের কথা মনে পড়লে খুব আফসোস হয় । এই দুবছরে আলতার হাত আরও পেকেছে । স্বয়ং অধীশ্বরও যেন ওর হাতের গতিবিধী বুঝতে পারেন না । 

আলতা এখন অন্ধকারে আরও ভাল দেখতে পায় । আলতা গ্রামে ঢুকল । বৈশাখের ছিন্ন বাতাসও তার অস্তিত্ব টের পেলনা । গোলাম ভাই গতকালই বিদেশ থেকে এসেছে । অন্য চোরদের কাছে এই খবর পৌছানোর আগেই আলতাকে কাজ শেষ করতে হবে । গোলাম ভাই খুব ভাল মানুষ । বছর পাঁচেক আগে গোলাম ভাই যখন বিদেশ যাচ্ছিল তখন রাস্তায় আলতার সাথে দেখা হয়েছিল । আশেপাশের দশগ্রামে আলতার হাতটানের নাম-ডাক তখনও ছিল । তা জানা স্বত্বেও গোলাম ভাই আলতাকে ডেকে একশ টাকার নোট ধরিয়ে বলেছিল , আলতা আর এসব কাম কাইজ করিস নে । এই নে ধর টাকাটা । আমার জইন্যে দোয়া করিস । আলতা কচকচে একশ টাকার নোট হাতের মধ্যে গুজে গোলাম ভাইকে একটা ছালাম দিল । আর বলল , ভাই আমি ওসব কাম কবে বাদ দিয়ে দিছি । আপনি কি বিদ্যাশ যাচ্ছেন ? হরে ভাই । ওটাই ছিল গোলাম ভাইয়ের সাথে আলতার শেষ কথা ।  

গোলাম ভাইয়ের দরজার সামনে এসে আলতা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল । গ্রামের গরীব আর অভাবী মানুষের জন্য গোলাম ভাই কম করেন না । সামনের চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়াবে শোনা যাচ্ছে । তাঁর ঘরে চুরি করায় আলতার মন সায় দিচ্ছেনা পুরোপুড়ি । ঘরের দক্ষিণে আমগাছের গোড়ায় বসে একমনে ভাবছে আলতা । হাতে টাকা-পয়সার বড্ড অভাব । চুরি না করলে না খেয়ে মরতে হবে । আচ্ছা , গোলাম ভাইয়ের কাছে কিছু সাহায্যও তো চাইতে পারে সে । এমন কিছু ভাবতে ভাবতেই সব নিস্তব্ধতা যেন ভেঙে গেল । আলতা দৌড়ে পালাবে , এমন সময় অদ্ভুত গোঙানীর আওয়াজ শোনা গেল । শরীরের সব শক্তি দিয়ে কেউ একজন চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু সেই আওয়াজ তার গলার ভিতরেই আটকে আছে । আলতা দাঁড়াবে না পালাবে বুঝতে পারছে না । জানালার এক পাশের পাল¬া হালকা হা হয়ে আছে । আলতা সাবধানে উঁকি দিতে গেল । ঠিক তখনই কেউ একজন তার পিঠে খোঁচা দিল । আলতা হচকিত হয়ে পিছন ফিরে তাকাল । গামছা দিয়ে মুখ জড়ানো । তার উপরে তাজা রক্তে লাল হয়ে আছে  পুরো মুখ , শরীর । লোকটি একটি বড় ছোরা আলতাকে দিয়ে বলল, একদম খালের মইধ্যে ফেলবি, কেউ যেন টের না পায় । যাহ , তাড়াতাড়ি । আর সপ্তাহ খানেক আমার সাথে দেখা করনের কাম নাই । যাহ । 

আলতার চোখ পাকা মরিচের মত লাল হয়ে গেছে । আলতা কিছুই জানে না এসবের , কিন্তু কিছু না জেনেও সব কিছু জানার ভান করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই । আলতা ছোরা নিয়ে বিলেতি ঘোড়ার মত গলা লম্বা করে দৌড় দিল । আলতা দৌড়াতে পারে । এক্ষেত্রে দশ গ্রামে তার সমকক্ষ কেউ নাই । এক দৌড়ে দুই তিন গ্রাম পেছনে ফেলতে পারে । কিন্তু আজ কি হলো আলতার ? আলতা হাঁপিয়ে যাচ্ছে । পালনোর জন্য মানুষ নির্জন অথবা গোপন জায়গা খোঁজে, আর ভয় পেলে খোঁজে আশ্রয় , লোকালয় । অন্যদিন হলে আলতা লোকালয় এড়িয়ে যেত । কিন্তু আজতো সে পালাতে চাইছে না । তার চাই আশ্রয় । লোকালয় । এবারও আলতা অজান্তেই আরও একটি ভুল করে বসল । ভয়ার্ত আলতা কখন যেন লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে । একদম আমজাদের চায়ের দোকানের সামনে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল আলতা । আমজাদের দোকান মাঝ রাত অব্দি খোলা থাকে । কোন কোন দিন সারারাতই খোলা থাকে । সেরাতেও ঝাঁপ বন্ধ করে তাসের আড্ডা জমেছিল আমজাদের দোকানে । আলতার পায়ের শব্দে সবাই বের হয়ে আসল । আলতা উন্মাদের মত পড়ে আছে । ওর বুকের ছাতি নদীর ঢেউ এর মত উঁচু হচ্ছে আবার নিচু হচ্ছে । সবাই এসে আলতাকে ধরল, কিন্তু একি ? আলতার হাতে তাজা রক্ত । পাশেই পড়ে আছে রক্তাত্ব একহাত ছোরা । কেউ একজন আলতার হাত পা শক্তকরে বেঁধে ফেলল । আলতা চোরা খুন কোরছে । ওরে শক্ত কইরা বাঁধ ! শুকনো মেহগনির ডাল হাতে কালো চেহারার একটা লোক, আলতার পশ্চাতে একটা কসিয়ে বারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কারে খুন করছস তুই ? আলতা লোকটির চোখের দিকে তাকাল ।

পিঠ ঠেকিয়ে গাছের সাথে বাঁধা আলতার পুরো শরীর । অপরাহ্নের সূর্যমূখী ফুলের মত মাথা নিচু হয়ে আছে । এমন মার খাওয়ার জন্যেই জন্ম হয়েছে তার । এখনও দুই কিস্তি কিল ঘুশি হজম করতে পারবে সে । কিন্তু কই, কেউ’ই আর আলতার গায়ে আর হাত তুলছেনা । লাল চোখা সেই ছিমছাম শরীরের লম্বা লোকটি, সেও হাঁপিয়ে গেছে বোধয় ।  

বেলা অর্ধেক গড়ানোর আগেই একটি জিপ গাড়ি নিয়ে পুলিশ আসল । প্রথমে জনা দশেক এবং এই মাত্র আরো দশ জন পুলিশ আসল । সাথে আরও দুই তিন গ্রামের মানুষ । পাই পাই করে খুজেও কোথাও কোন লাশ পাওয়া গেল না  । সকাল থেকে শুধু গোলাম ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না । গোলাম ভাইয়ের’ই যে কিছু হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নাই ।

পুলিশ এসে আলতাকে দুই এক ঘা দিতেই আলতা কেকিয়ে উঠল । ওর শরীর কাপছে এখন । এই লাশ কোথায় হাওয়া হয়ে গেল । লাশ না পওয়া পর্যন্ত যে তাকে বেদুম পিটুনি খেতে হবে এতে কোনো ভুল নেই । অনাগত দুই এক দিনের জন্য বড্ড ভয় হচ্ছে আলতার । আলতার বউ এল কাঁদতে কাঁদতে । একের পর এক যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছে ।  এই কাজ করতে গেলা ক্যান মুনতার বাপ ? মানুষ মারবার গেলা ক্যান ? আমি যদি আগে জানতাম তোমারে ঘরে আটকায়ে রাইখতাম । আলতা কোন ক্রমে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বউ এইসব কথা কইস নে ! আমি চোর , খুন করা আমার কাম না । আমি খুন করি নাই । 

আলতার চারপাশে এখন গ্রামের অর্ধেক মানুষ । সাধারনত চেয়ারম্যানের বড়সর জনসভাতেও এর চেয়ে কম মানুষ হয় । এর আগে অন্য সময় গুলোতে আলতা টানা মার খেয়েছে । এইবার সেই তুলনায় অনেক কম । উচ্চতর অপরাধে অভিযুক্ত আলতা বুঝেছে মাইরও ক্লাসভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় । তবে এ যাত্রায় গোলাম ভাইএর লাশ না পাওয়া গেলে রক্ষে নেই । এলাকার গন্যমান্য সবাই উপস্থিত । মেম্বার সকাল থেকেই এখানে হাজির । চ্যেয়ারম্যান সাহেবও চলে আসবে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ।   সবাই এসে  আলতাকে কড়া করে জিজ্ঞেস করল, এরে আলতা, ভালয় ভালয় কইয়া দে,  গোলামের লাশ কই রাখছিস ? 

আলতা শুকনো মুখে ভয়ে ভয়ে মাথা তোলে । আমি গোলাম ভাইরে মারি নাই । বলতেই কয়েকজন অতি উতসাহি, পোক্ত লাঠি দিয়ে আলতাকে মারতে তেড়ে গেল । পুলিশের কন্সটেবল কোন রকমে তাদেরকে সামলে নিয়ে আলতার দিকে এগিয়ে গেলেন । আলতাকে কান ধরে টেনে উপড়ের দিকে তুলে ফেললেন । আলতা যন্ত্রণায় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল । স্যার স্যার, মাফ করেন, আমি যা জানি তাই কবো । স্যার !

আলতার কোন কথাতেই কারো মন ভরে না । সময় গড়িয়ে যাচ্ছে । আলতা যেন পুরো গ্রাম আর এক কুড়ি পুলিশদের নিয়ে খেলছে । সারাদিন কয়েক কিস্তি মার খেয়ে আলতা সত্যি সত্যি বেশ ঝিমিয়ে পরয়েছে । তার মধ্যে সারাদিনই এক প্রকার না খাওয়া । কয়েকগ-াস পানি আর একটা বনরুটি ছাড়া কিছুই পরেনি পেটে । আলতা ও মনে মনে চাইছে গোলাম ভাইয়ের লাশটা যেন পাওয়া যায় । ওটা পাওয়া গেলে পুলিশ তাঁকে এখান থেকে নিয়ে যাবে । কিন্তু না, এতক্ষণেও গোলাম এর কোন হদিস পাওয়া গেলনা । 

শেষ বিকেলে একটা ঘটনা ঘটল । গ্রাম জুড়ে সবাই হা হবার জোগাড় । নিস্তব্ধ গ্রাম থেকে যেন হঠাৎ হৈহৈ রৈরৈ আওয়াজ শোনা গেল । ক্লান্ত, শ্রান্ত পাখি গুলো বিছলিত হয়ে উড়তে লাগল । গোলাম ভাই ফিরা আইচে । গোলাম ভাই মরে নাই । আগে আগে চার পাঁচ জন অল্প বয়সী এই বলে বলে ছুটে আসতে লাগল । পিছনে ছোট খাটো একটা বহর নিয়ে ধাই ধাই করে এগিয়ে আসছেন গোলাম ভাই । 

সত্যি, গোলাম ভাইএর স্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে । হালকা লাল রঙের পাঞ্জাবী পরা । তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ । ও চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই । গ্রামের সবাই অবাক । গোলামের পরিবারের কেউ কেউ তো গোলামকে দেখে জ্ঞানই হারিয়ে ফেলেছে । আলতা বউ এর দিকে তাকায় । শত যন্ত্রণা পাশকাটিয়ে আলতার মুখে হাসির মৃদু একটা রেখা ফুটে উঠল । বউ, আমি তরে কইছিনা, আমি গোলাম ভাইরে মারি নাই । আলতার বউ আচল গোজা মুখে আলতার কাছে এগিয়ে এলো । নাক মুখের রক্ত আলতো করে মুছতে মুছতে বলল, এ কতা জোর গলায় আগে থেকেই কতি পাইরলেনা ?

কইতি তো চাইরে বউ, যত জোরে কইতি যাই মাইনশে তত জোড়ে পিডায় । তুই বাড়ি যা । মাইয়াডা তরে খুঁজব । এহন আর ভয় নাই । গোলাম ভাই ফিরা আইচে । শুকনো চোখে টনটনে জলে আলতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । তবুও গোলাম ভাইয়ের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পায় সে। যুদ্ধ ফেরত বিজেতার ভঙ্গীতে বীর দর্পে এগিয়ে আসছে গোলাম ভাই । একটা লোক গোলাম ভাই এর  পিছনে পিছনে তাল মিলিয়ে একবার হাটছে আবার ছোট ছোট পায়ে দৌড়াচ্ছে কিন্তু গোলাম ভাইকে অতিক্রম করছে না । নিশ্চিত ভাবেই গোলাম ভাইয়ের এই নতুন সাগরেতকে গ্রামের কেউ আগে কখনও দেখেনি । আলতার কিন্তু তেমন মনে হচ্ছে না । চোখটা বড্ড চেনা চেনা । ওই টক টকে পাষ- চোখ দেখেই যে প্রাণভয়ে গত রাতেই পালিয়েছিল আলতা ।



আলতার মুখ লাল হয়ে আসে । চোখ মুছতে মুছতে ফিরে যেতে থাকে আলতার বউ । যেতে যেতে অজানা আশঙ্কায় বারবার পিছন ফিরে তাকায় আলতার বউ  । ভাবে কেউ যদি গাঁয়ে হাত দেয় তো দৌড়ে গিয়ে পিঠ পেতে দেবে । আপাতত আর তেমন লক্ষণ পায় না আলতার বউ । ধীরে ধীরে আলতার বউ আলতার চোখের আড়ালে চলে যায় । লম্বা লাল চোখা লোকটির চোখে চোখ পড়ে আলতার । আলতার চোরা মশ্তিষ্ক কি ঘটছে বা কি ঘটবে কিছুই বুঝতে পারে না । এখন ধরে আলতার গায়ে কেউই হাত তুলছে না । কেউ কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু জিজ্ঞেসও করছেনা । 

গোলাম দ্রুত পায়ে পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় । পুলিশ কনসট্যাবল গোলাম ভাইকে দেখে হা হয়ে গেছেন । গোলাম ভাইয়ের দিকে করমর্দনের হাত বাড়িয়ে দিলেন । গোলাম ভাই তা উপেক্ষা করে পুলিশকে জড়িয়ে ধরলেন । পুলিশের নাম ধরে বলতে লাগলেন , বড় বাচা বাইচে গেছি ভাই ! আমি লাশ হয়ে যেতাম ভাই ! আল¬ায় আমারে বাঁচাইছে ।

পুলিশ গোলাম ভাইকে স্বান্তনা দিয়ে বসতে বলল । পুলিশ সব কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গোলাম ভাই আলতার দিকে আঙ্গুল তুলে তাকিয়ে থাকে । গোলামের সাগরেতও আলতার দিকে তাকিয়ে থেকে মেকি কম্পনে কাপতে থাকে। আলতার বুক আতকে উঠল । কি হচ্ছে কোন কিছুই বুঝে উঠতে পাড়ল না সে । খুন কি কেউ হয়ই নি ? তাহলে রক্ত মাখা ছোড়া, গোঙানির আওয়াজ , লাল চোখা লোকটা  সবই কি মিথ্যে । এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আলতার চারপাশে  ছায়া আরও ঘন হয়ে বৃত্তাকার আঁধার সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল । 

ক চোরের পো চোর, তুই কারে খুন করছস ? লাশ কোই ? তোরে এইবার শেষ কোইরে ফেলাবো । 

নানান জনের নানান কথা আর মাইরের শব্দে অনেক ক্ষণ আলতার চিৎকার শোনা গেল । আর মাইরেন না । এদের মধ্যে আলতা দুই একজনকে চেনে । তাদের নাম ধরে আলতা বলতে লাগল । মাজেদ ভাই, ও মকবুল ভাই, আপনেরা আমারে পুলিশে দেন । আমারে আর মাইরেন না । 

দূর থেকে দুই একজন মানুষ ছুটে আসছে । বড় বড় দম নিতে নিতে তারা এসে বলল, লাশ পাইছি । উত্তরের খালে একখান লাশ ভাইসা উঠছে । পেটে বুকে ছড়ির দেড় ইঞ্চির ও বেশী ক্ষত।  দাড়িতে সারা মুখ ঢেকে আছে। তবুও কারই তাকে চিনতে কষ্ট হয় নাই । চেয়ারম্যান চাচারেই মারছে শালা । বুড়া মানুষটারে পাষাণের মত কোপাইছে । 

এই কথা শোনার পর সমস্ত মানুষ তীব্র ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল আবারও। এবার আর আলতার কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না । মাফ চাইবার, করুনা পাওয়ার মত আর কোন অবস্থা নেই তার । পুলিশ বাসি ফুকতে ফুকতে এগিয়ে আসল । আর মাইরেন না । হইছে , ছাড়েন । ওর শাস্তি ও পাইব । কয়েক জন পুলিশ কোন মতে জায়গাটা ফাঁকা করে । পুলিশ আলতার হাতে হাতকরা পড়িয়ে টানতে লাগল । আলতার শরিরে বল নেই । চোখের মৃদু  দ্যুতিতে দূর গ্রহ নক্ষত্রের ঘোলাটে আলো পুঞ্জীভূত হতে লাগল । আলতা সেই লাল চোখা লোকটিকে দেখতে পেল । লোকটি আলতাকে মারতে মারতে হাঁপিয়ে গেছে। গা থেকে ঘাম ঝড়ছে । লোকটি গোলামের কানে কানে কি যেন বলছে । মাথা ঝুঁকে পরে আছে আলতা। ছোপ ছোপ রক্তে পথের ধুলো পিঙ্গল বর্ণের হয়ে গেছে । আলতা আবার একটু চোখ তুলে তাকাল । গোলাম ভাই আলতার দিকে চেয়ে আছে । তার মুখে, চোখে অদৃশ্য বিভৎস্যতার ভয়ার্ত হাসি  ।   


পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 



একজন পাণ্ডুলিপিবলছি

নুসরাত জুবেরী


আমি একজন পাণ্ডুলিপি বলছি-

কোনো এক গ্রীষ্মের তাপদাহে, অবেলায়; কবির

কলমের বুননে জন্ম হয়েছিল আমার

সেই সময় গুলোতে আমি নিতান্তই শিশু,

আমাকে নিয়ে কবি দেখতো না কোনো ভবিষ্যৎ 

নিছকই বেখেয়ালে আমি রচিত হয়ে যেতাম

একের পর এক,

স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে আমাকে রচনা করে উন্মাদ কবি

প্রশংসা কুড়াইতেন খুব।


সেই থেকে- 

কখনো কখনো আমি ধারণ করেছি,

শুভ্রতার সাদা রঙ

কখনো ধূসর মলিন; কখনো

প্রকৃতির সবুজ হয়ে মিশে গেছি কবির মনে।

ভালবাসায় একাত্ম হয়ে কখনো লাল; আবার

কখনো ব্যর্থতার নীল রঙে আঁকড়ে ধরেছে আমাকে।


কখনো কবির ঘোর উন্মাদনায় আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে গেছি আমি,

ভীষণ মাতালী হাওয়ায় হয়েছি নগ্ন পোস্টার।

আবার কখনো-

কালো শহরের সহিংসতার বৃত্তান্ত শুনে জেগে উঠেছি

জড় পা-ুলিপি হয়েও কেঁপে উঠেছি কবির মনে,

বার বার।


নিঃসঙ্গ টেবিলে মহাশূণ্যের দিকে চেয়ে কখনো,

কবি জোৎস্নার আলো জমিয়ে আনকোরা  হাতে সাজাতেন পোর্ট্রেইট

তার আলোকে আবার গড়তেন আমাকেও

কখনো জড়িয়ে ধরেছে আমাকে অকৃত্তিম নিষ্পাপ ভালবাসা,

আবার কখনো- 

কবির নিষ্ঠুরতায় সিলিংয়ে ঝুলানো শ্বাসরুদ্ধকর এক বৃত্তের ভেতরে আটকে গেছি আমি। 


আমি একজন তরুণ পাণ্ডুলিপি বলছি-

কবিতার গভীরে আমি আজ কবির এক টুকরা অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ,

তার নিজস্ব সৃষ্টি।

আমাকে আলোকিত করতে,

কবি ঘুরিয়েছেন বহু প্রকাশকের দ্বারেদ্বারে

সদ্য ফোঁটা ক্যামেলিয়ার মত আমার সুভাষে মন হারিয়েছেন অনেকেই

কিন্তু আপন করেনি তবুও।

আবার কারো অলস নিদ্রায় নিজেকে মেলে দিয়ে অসভ্য হয়েছি আমি,

আমাকে-

নির্মমভাবে মুখে হত্যা করে ছুড়ে ফেলেছেন ডাস্টবিনে।

আমি কবির ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছি বারবার,

স্বপ্ন ভেঙেছি অসংখ্যবার। 


আমি একজন পাণ্ডুলিপি বলছি,

গুম হয়েছি আজ কবির ব্যথাতুর হৃদয়ে

হারিয়ে গেছি কোনো এক কথিত মহাকালের গর্ভে।

তাই-

আমি আজও এক অবহেলিত পাণ্ডুলিপি’ই রয়ে গেছি

সোনালী মলাটের বই হতে চেয়ে বঞ্চিত হয়ে আছি।


 


ফিসফাস ক্ষুরের শব্দ

টিপু সুলতান


সব পথ থেমে গেলে-দাঁড়াইয়া দেখি


আমার ধানমাঠ বৃষ্টিতে কাঁথামুড়ি দিচ্ছে

চিড়েভেঁজার মতো; দুগ্ধবতী আলপথ-

শর্করা মাখানো শরীর-বাহু টেনে-হাঁটে

তরুণরোদের উঠোন-থির হাওয়াদের

বাড়ি বাড়ি জ্যান্ত হরিণ চোখ, এত ভাবি-


বাদ যায় না আগত অনাগত মুখ

বয়ে নিচ্ছে পৃথিবীর সুস্থ কলোনি-

মিলিয়ে যায় আগামী সব, বিসর্জন-


এই সব খবর পৌছয় ঘাসের কাছে

জেগে আছে পালের বৃক্ষ, ছায়াসম;

মহিষের ঘাড়ে পাখির হাঁটাফাটা দাগ

ফিসফাস ভেসে যাচ্ছে ক্ষুরের শব্দ




চাবুকে ঝাঝড়া চুমু

রহমতুল্লাহ লিখন 


নিরঙ্কুশ প্রশ্বাস নিয়ে আমরা বাঁচলেই,

তাদের নিঃশ্বাস যে আটাকে যায় বারবার।

তাই প্রতিবার শ্বাসহীন যন্ত্রণা দিয়েই তারা লাভবান।


তাদের বেঁচে থাকার জিয়ন কাঠির ছোয়া তো,

আমাদের হাড়ভাংগা চিৎকারে, মরণে।


প্রাণভরে উল্লাসিত আমরা হলেই, 

তাদের বেদনার কালবৈশাখিতে উথাল পাথাল চারিদিক। 

তাই প্রতিক্ষণে কান্নার নোনা জল গড়িয়ে তারা সবল।


তাদের পরাক্রমের উপাস্য কেদারার আরাম তো,

আমাদের রক্তাক্ত কোষের ছিন্নভিন্ন হওয়াতে, ক্ষরণে।


প্রশান্তির ছাপ গায়ে মুখে আমরা মাখলেই 

তাদের চিটেচিটে চর্বির পিত্তথলিতে গুড়গুড় ডাক।

তাই প্রতিদিন বিনা প্রাপ্তিতে, হাহাকার শুনে তারা উজ্জ্বল।


তাদের পশ্চিমা দালানের উঁচু পিলারের নকশা তো

আমাদের একটু শান্তির কেড়ে নেয়া লোকমাতে, ক্রন্দনে।


আমাদের তাদের এই মাখামাখি, এই দেয়া নেয়া,

চাবুকে ঝাঝড়া চুমুতে থাকে পিচঢালা মখমলে শোয়া।


পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২

 




সমস্ত যুগের সম্মাননা

এমরান হাসান


সত্য বলতে চাই আজ

নির্জলা সত্য।


যারা আমায় সত্য বলা শিখিয়েছেন

সময়ের নিয়মে তাদের আবিষ্কার করেছি

বোবা ও বধির তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যর্থ দাবাড়– রূপে


সামন্তবাদী সৈন্যের দোলাচালে শেষ সায়াহ্নে

ঘোড়া-চালের আড়াই ঘর তারা দিব্যি ভুল মেরে বসে আছেন


রোদের তেজ বাড়তে থাকলে এসব

আবিষ্কৃত হতে থাকে।

চোখের সামনে নাচতে থাকে

পিথাগোরাস, নগ্ন আর্কিমিডিস কিংবা

সময়ের প্রয়োজনে বীতশ্রদ্ধ ভ্যানগগ।


সত্যি সত্য কিছু নেই।

যা আছে নদীজল আর স্বচ্ছ হাওয়ার

বিটকেলে বেতাল নৃত্যে উধাও হওয়া

সেই সমস্ত আশ্চর্যকথা।


লিখে আর লাভ কি?

উল্টোরথের বয়ানে সমগ্র অসত্য জেনেছে

পাথর প্লাবণ!


সত্যি সত্য বলতে নেই আজ

এসব মুছে দিয়ে নামতা শিখি সাম্প্রদায়ীকতার

নিজেকে মুদ্রিত করি পরম পামররূপে


পাড়া গায়ের মুর্খ মাতাল জানে

পুস্তকে ধরেছে জলজ্যান্ত অধিবিদ্যের পোকা!!




দীর্ঘশ্বাস 

নাসিমা হক মুক্তা 


কতদিন দেখি না 

তোমার জলভরা বিস্ময় 

জ্যোৎস্নারাত্রির অবকাশে নিবিড় মায়ায়

কতদিন হাসে না 

তোমার চারুশিল্পময় চোখ ! 


এই দুরুত্বের কাব্যটি 

কার বুকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে? 


আমি নির্জন নদীর স্রোতে ভেসে 

খুঁজেছি কাকে জানি না

শত শত পা-ুলিপি, লেখা হচ্ছে তার বিষন্নতায়।



সময়

সাদিয়া রাকা 


সময়

বড়’ই বেয়াড়া প্রবাহ,

                    সময়

                   এক নিষ্ঠুর দাবদাহ।

সময়

এক তুষার ঢাকা পাহাড়,

                     সময়

                  এক অনাহারীর আহার।

সময়

এক অদৃশ্য যাতাকল,

                     সময়

                 এক অত্যাচারিতের বল।

সময়

এক রঙিন ঘুড়ি,

                 সময়

                 এক কংকালসার বুড়ি।

সময়

এক কংক্রিটের দেয়ালে কাটা আঁচড়,

                     সময়

                এক অত্যাচারীর গালে মারা চড়।

সময়

একটি সাদা কাপড়ে লাগা কালি,

                 সময়

               সেতো ভয়ংকর চোরা বালি!


কালোচিত্র

কালোচিত্র

 


কালোচিত্র

সৌর শাইন


বৃদ্ধার উদাসীন দৃষ্টিতে মৃতাত্মাদের আনাগোনা, কতশত শেষ দাফনের স্মৃতি। নিশ্বাসে আগুনের হলকা এসে পুড়িয়ে দেয় সব গুন গুন সঙ্গীতকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। রেললাইনের বস্তির অন্যসব ঘরের মতো এখানেও নিস্তব্ধতা ছোবল দিয়েছে, হাহাকারের যাঁতাকলে গলা টিপে ধরে সময়ের অভিশাপ। সুঁচের পেট ফুঁড়ে লাল সুঁতো বেরিয়েছে, এক একটা ফোঁড়ে ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগটা যতটা সম্ভব মেরামত চলে সেলাই চিন্তায়। ভিক্ষের চালগুলো এখানেই জমাতে অভ্যস্থ বৃদ্ধা।


মৃত ক্ষুধারা পেটের ভেতর হঠাৎ হঠাৎ চিৎকারে নাচে। শহরের মেইন রোডে উঠা যায় না, মুখোশ পরা পুলিশ বাঘের মতো তেড়ে আসে। বৃদ্ধার মগজ এখনো বুঝতে পারে না করোনা শব্দের পেছনে কী এমন দৈত্য দানব লুকিয়ে আছে। রাতে ছোট্ট নাতনিটি বৃদ্ধাকে বিদেশি রোগের ব্যাখ্যা শুনায়।

বৃদ্ধা শুনতে শুনতে নিশ্বাস ফেলে। আট বছরের নাতনির উরুসন্ধিতে হাত ছুঁয়ে বলে, তুই এহনো বাড়ছ না ক্যান?

হাতের আঙুল গভীরে যেতেই নাতনিটা আঁৎকে উঠে।

আঃ ব্যথা পাই নানি।

বৃদ্ধা ধমকে বলে, একটু আধটু ব্যথা লাগবোই। বেডারা তো মাঙনা টেকা দিবো না। কষ্ট দুক্ষু সহন লাগবো। আমি তো তোর মতন থেইক্যা শুরু করছি।

দাঁতে দাঁত ঘষে সহ্য করে নাতনি। চোখ বেয়ে নোনা জল নামে। নাতনির কষ্ট কমানোর জন্য বৃদ্ধা পুরোনো গল্পের পসরা ঢেলে দেয়। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, তুই যহন ছোট আছিলি তোরে আঁচলে বাইন্ধা ভিক্ষা করছি। রেলের ধারে কেঠায় যে তোরে রাইখ্যা গেল আল্লাহ কবার পারবো। সবিই উছিলা, তোরে টুকায়া পাইলাম এই শেষ বয়সে। আমার কপালও তোর মতোন আছিল। এক বেটি পথে পাইয়া বড় করছে, তারপরে তো জীবনে কত কিছু ঘইট্যা গেল। নাতনিটা কিছুই বলে না। অন্ধকারে ব্যথা ও পৃথিবী সমান্তরাল ছুটে। ক্ষুধার কাছে পরাজিত বোধ এসে স্বপ্ন আঁকে আর কিছুদিন পরেই শরীর বাড়বে পথিকদের ক্ষুধা মেটানোর ¯্রােত বইবে। তারপর পয়সা আসবে, দুঃখ বলে কিছু থাকবে না, দু’বেলা পেট পুরে আহার জুটবে।


ত্রাণ পাবার লাইনে দাঁড়ায় বৃদ্ধা, হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা খেয়ে কপালে ফাটিয়ে রোডের একপাশে নিশ্চুপ বসে থাকে। প্যাকেট ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়া চাল ডাল কুড়িয়ে আঁচল ভরে বৃদ্ধা আর নাতনিটা লাইনে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়, এক প্যাকেট হাতে পেয়ে যুদ্ধ জয়ের স্বাদ নিয়ে বস্তিঘরে ফেরে।


দু’সপ্তাহ যায়। ক্ষুধা ও পরিস্থিতি ভুগায় নিরন্তর। তুরাগ পাড়ের বয়স্ক দোকানদার একশো পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে একবেলা নাতনিটিকে কিনে নেয়। নদীর কালচে পানিতে রক্তাক্ত বিছানার চাদর ধুয়ে দেয় বৃদ্ধা। উরুর ফাঁকে টনটনে ব্যথা থাকলেও নাতনিটির মুখে হাসি। ডিমের ঝুলে ভাত মাখে ওরা।


লকডাউনে চারপাশে বন্দিদশা, ভিক্ষে পাবার জো নেই। বৃদ্ধা রেললাইন ও তুরাগের পাড়ে এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়ায়। ইফতারের সময়ে উপরতলা থেকে কেউ কেউ পলিথিন ভরে ছোলা-মুড়ি ছুঁড়ে ফেলে। সে আহার নিয়েও লড়াই চলে। ফেরার পথে অন্য ভিক্ষুকরা হাত থেকে প্যাকেট আচমকা কেড়ে নেয়। যারা মেস, বাসা-বাড়িতে কাজ করত ওরাও আজ এই দলে।


ক্ষুধার আক্রমণে যখন শরীর মৃত্যুমুখী তখন নাতনি বলে, নানি, কই আজকাইল কেহ শরীল কিনতেও আহে না।

বৃদ্ধা বলে, মসিবতের যুগ আইছে। না খাইয়া মরার যুগ।

নাতনি বলে, সরকারি চাইল নেতারা মাইরা খাইতেছে নানি, এর লাগিই আমাগোরে মরতে হইবো।

বৃদ্ধা কাঁদে।

নাতনি বলে, তোমার ব্যাগডা দেও, আমি ভিক্ষার মাগতে যাইমু। শইল খাইতে কইমু, তবুও ব্যাগ ভইরা চাইল লইয়া আইমু।

নাতনিটা লকডাউনের ফাঁকফোকর এড়িয়ে বিভিন্ন দোকানপাট, শ্রমিকদের ঘুপচি মেসে ঘুরে বেড়ায়। চাল চায়, খাবার চায় কারোর দয়া পায় না।



বৃদ্ধা সেই সন্ধ্যার পর থেকে নাতনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। চারদিকের সন্ধান ব্যর্থ। কেউ বলে হারিয়ে গেছে, কেউ বলে কারোর বাসায় নিশ্চয়ই আটকে রেখেছে। কেউ বলে নারী কেনাবেচার ফাঁদে নিশ্চয়ই পা দিয়েছে। বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে দোষারোপ করে। মাস খানেক যায়। মাঝখানে গেল ইদের দিন, যেন বিষের আনন্দ!


রোডে হাঁটতে হাঁটতে বৃদ্ধা অন্ধকার দেখে। ক্ষুধার কবলে শরীরে শক্তিহীনতা আঁকড়ে ধরে, পথ চলতে পৃথিবী কাঁপে। বৃদ্ধা বিড় বিড় শব্দে বলে, করোনার চাইল পাই নাই। কেঠায় দিবো চাইল? ভিক্ষা দিবার মানুষ নাই, রাস্তায় গেলে পুলিশে খেদায় কোনঠে যাবাম?

সন্ধ্যায় ধীরে হেঁটে বৃদ্ধা বস্তিতে প্রবেশ করে। এই ঘরে ওই ঘরে উঁকি দেয়, কোনো মানুষ নেই। বৃদ্ধা বলে, সব্বাই শহর ছাড়তে আছে, আকাল পড়ছে দেশে।

নির্জন বস্তির ঘরে ঘরে খুঁজতে থাকে কোনো খাবার দাবার পায় কিনা। একটা ঘরের দরোজা খোলা, মেঝেতে হাতড়ে বুঝতে পারে ব্যাগ ভর্তি চাল। বৃদ্ধা আশপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে চালের ব্যাগটা আঁচলের নিচে লুকায়। বস্তি থেকে বেরিয়ে পথ ধরে হাঁটতে থাকে আর বলে, গাড়ি, বাস কিচ্ছু চলবে না, কেমন কইরে গাঁয়ে যাবাম?

বৃদ্ধার মনে তবুও আশা শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে গেলে খাবার মিলবে, বাঁচার উপায় পাওয়া যাবে। বিড়বিড়িয়ে বলতে, কেহ চুরি করে স্বভাবে, কেহ চুরি করে অভাবে, খোদা তুমি সাক্ষী।

হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত বৃদ্ধা একটা ল্যাম্পপোস্টের পাশে লুটিয়ে পড়ে। নিশ্বাসের ছাড়তে ছাড়তে মহান স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করে থুথু ফেলে মাটিতে। হঠাৎ বৃদ্ধা দেখতে পায় যে চালের ব্যাগটি চুরি করে এনেছে ওটা তারই ব্যাগ, লাল সুঁতোয় সেলাই করা বহুছিন্ন সেই ব্যাগ।

বৃদ্ধা আবারো শহরের পথে পা বাড়ায়। চোখের আয়নায় আঁকতে থাকে নাতনিটির মুখ!