ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৬

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৬
তারুণ্যের  শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৬
শুক্রবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২০


























দুর্ভেদ্যযামিনী : নৈঃশব্দ্যের মিছিলে শব্দের অভিযাত্রা

দুর্ভেদ্যযামিনী : নৈঃশব্দ্যের মিছিলে শব্দের অভিযাত্রা


দুর্ভেদ্যযামিনী : নৈঃশব্দ্যের মিছিলে শব্দের অভিযাত্রা

আসআদ শাহীন

ঝঞ্ঝাট-কোলাহলমুক্ত প্রকৃতি। নিস্পন্দন-নিঝুম-পিনপতন-নৈঃশব্দ্যতা চারিদিকে। ফাগুনীয়-শৈত্যপ্রবাহের মৃদু হিমেলীয় দমকা হাওয়া বইছে। অন্তরীক্ষে উড়ো উড়ো শ্বেতাভ জীমূতমালারা লুকোচুরি খেলায় মত্ত। নিহারিকা ও ইন্দু দু’জনার গভীর সখ্য গড়ে উঠেছে। নেই কোনো রেষারেষি ও মনান্তর। সত্যিই এসব বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিকের কথা কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কাব্যরূপে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন-
‘চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা-কোথায় উজান এমন ধারা,
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ, এমন কালো মেঘে,
তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জেগে।’

তদ্রুপ বুদ্ধদেব বসু-ও এ প্রকৃতির রূপ, বৈচিত্রময়তা ও সৌন্দর্যতার উপমা কাব্যিক তুলিতে এঁকেছেন-
‘কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,
যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান
দিগন্ত থেকে দিগন্তে;
কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে;
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে।’

গিরি এক পথ ধরে হেঁটে চলেছি নির্লিপ্ত আনমনে আর অবলোকন করছি রাতের নৈসর্গিকতা। তবে, কায়াতে শীতলের প্রকটতা জেঁকে বসেছে। লোমকূপগুলো ক্রমশই জড়সড় ও কেঁপে কেঁপে উঠছে। বদনে ¯্রফে একটি শুভ্রবসন। সেই সন্ধ্যেয় পরিধান করে বেরিয়ে পড়েছি। অংসে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে। কেনো বেরিয়ে পড়েছি, কারণ কি-সবই অজান্তা। এখন একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে দণ্ডায়মান। কতকগুলো কুকুরের আনাগোনা। লাল-কালো-ধূসর-ডোরাকৃতি। নেই কোনো পত্র-পল্লবের দূষিত শব্দবহের অনুরণন। নেই কুকুরদের ও ‘ঘেউ-ঘেউ’ শব্দের প্রকটতা। এই ঠাঁইয়ের সঙ্গে আমি পূর্বপরিচিত। বেশ কয়েক দফা নিজ তাগিদে এখানে আগমন ঘটেছে। এতক্ষণ যাবৎ মোবাইলে পিডিএফ বইপাঠে মগ্ন ছিলুম। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।
‘এ বইটা মূলত ১৯৩৮/৩৯ -১৯৫৫ পর্যন্ত সময়কালের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে লেখা। (বিশেষ করে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাবলীর এক অনবদ্য দলিল)। এছাড়া শুরুতে বঙ্গবন্ধুর গ্রামের বাড়ি, জন্মবৃত্তান্ত, বংশ, ও তরুণ কালের কিছু ঘটনা পাঠকদের সুবিধার্থে  তুলে ধরেছেন। বইটা ঠিক ডায়েরী না। ১৯৬৭ সালে কারাগারে থাকাকালীন তিনি এই বই লেখা শুরু করেন। তাই এটিকে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ স্মৃতিচারণ মূলক আত্মজীবনীই বলা যায় আবার স্মৃতি ডায়েরীও বললেও ভুল হবে না হয়ত। বইটি শ্রুতিলিখন বা অনুলিখনের মাধ্যমে অন্য কারো হাতে লিপিবদ্ধ নয় বরং বঙ্গবন্ধু নিজেই জেলখানায় বসে নিজের স্মৃতি থেকে বইটি রচনা করেন। তাঁর দুহিতাদ্বয় (বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা শুধুমাত্র প্রকাশের আগে কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করেন। এছাড়া তথ্যগত কোন সম্পাদনা করা হয়নি বলেই উল্লেখিত রয়েছে।
একজন সাধারণ মানুষ থেকে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির দিশারী হয়ে উঠার গল্পে ভরা এর প্রতিটা পাতা। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ। সহজ সরল ভাষায় তিনি তার স্মৃতির রাজ্য খুলে দিয়ে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের যে ধারাবাহিক বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন, তাতে একজন পাঠক খুব সহজেই তাঁর- শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠার উপাদান সমূহ অনুধাবন করতে পারবেন ।’

এবার একটু উঠে দাঁড়ালাম আমি। কিঞ্চিদধিক অগ্র হয়ে চলতে আরম্ভ করলাম। কোথায় যাচ্ছি, কোনদিকে এগোচ্ছি- তা বিস্মৃত। এই ফাগুনের নিশীথ সময়েও চারিধার প্রকট ঘনান্ধকারে আঁধারের শামিয়ানায় ঢাকা। নিশিপুষ্প-শিউলি-হাসনাহেনা ও আম্রমুকুলের সঙ্গমের সৌরভময় ঘ্রাণে ঘ্রাণেন্দ্রিয় সুবাসিত হচ্ছে।

এই ঋতুরাজ বসন্ত তথা ফাগুনের আবির্ভাবপ্রণয়জনিত সঙ্গমে বৃক্ষাদি পুরনো পাতা-পল্লব ছাড়িয়া নব কচি কচি সবুজাভ পাতা-পল্লবে প্রসবিতা হয়। বসন্তের দৃষ্টিনন্দিত রূপবিভায় বাংলা অপরূপ এক রূপ ফিরে পায়। তাই তো জীবনানন্দ দাশ কবিতার ভাষায় কতই না চমৎকার ভাবে বাংলার রূপের কথা ব্যক্ত করেছেন-
‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতো বড় পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দোয়েলপাখি - চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ
জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোঁপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ।’

যদি এসবের উপমা কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায় বলি তবুও ভুল হবে না। কেননা, তিনি তো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন-
‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি,
গুঞ্জরিয়া আসে অলি, পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে,
তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সেযে আমার জন্মভূমি।’

চতুঃর্পাশ্ব বিক্ষিপ্ত শুকনো পাতা-পল্লবের মর্মরধ্বনি ঝঙ্কারিত হয়। গগনে গর্জ্জনবিরত শ্বেতকৃষ্ণাভ নীরদমালার মধ্যে হ্রস্বদীপ্তি সৌদামিনী মধ্যে মধ্যে চমকাচ্ছে। বোধ হচ্ছিল হয়ত বৃষ্টি নামবে। কিন্তু আমার বোধ শেষ না হইতেই হঠাৎ-ই ফাগুনাকাশ ছেদ করে ঝিরিঝিরি বারি নেমে আসল। তবে বোধহয় ভালোই হলো। ক্রমাগত চলতে থাকা ঘর্মাক্তবদন বর্ষণমুখর বারিবিন্দুতে কিছুটা শৈত্যের শীতলতম আবেশ-বিহ্বলতায় সিক্ত হলো।


তবে বারিবর্ষণ শব্দের মধ্যে বৃক্ষাগ্র হতে বৃক্ষপত্রের’ পর বর্ষাবশিষ্ট বারিবিন্দুর পতনশব্দ, বৃক্ষতলস্থ পত্রচ্যুত জলবিন্দুপতনশব্দ, পথিস্থ অনিঃসৃত জলে শৃগালের পদসঞ্চারণশব্দ, কদাচিৎ বৃক্ষারূঢ় পক্ষির আর্দ্র পক্ষের জল মোচনার্থ পক্ষবিধূননশব্দ। মধ্যে মধ্যে শমিতপ্রায় বায়ুর ক্ষণিক গর্জ্জন, তৎসঙ্গে বৃক্ষপত্রচ্যুত বারিবিন্দু সকলের এককালীন পতনশব্দ। এহেন পরিস্থিতিতে রবী ঠাকুরের কবিতাটি অনির্বার উচ্চারিত হচ্ছে মনের কুঠরিতে-
‘আজি গন্ধবিধুর সমীরণে
কার সন্ধানে ফিরি বনে বনে।
আজি ক্ষুব্ধ নিলাম্বর-মাঝে
এ কি চঞ্চল ক্রন্দন বাজে।
সুদূর দিগন্তের সকরুণ সংগীত
লাগে মোর চিন্তায় কাজে--
আমি খুঁজি কারে অন্তরে মনে
গন্ধবিধুর সমীরণে।

ওগো জানি না কী নন্দনরাগে
সুখে উৎসুক যৌবন জাগে।
আজি আম্রমুকুলসৌগন্ধে,
নব-পল্লব-মর্মর ছন্দে,
চন্দ্র-কিরণ-সুধা-সিঞ্চিত অম্বরে
অশ্রু-সরস মহানন্দে
আমি পুলকিত কার পরশনে
গন্ধবিধুর সমীরণে।’

কবিতাটি বিস্মৃতিপ্রবণতাযুক্ত করিয়া অগ্রসর হইলাম। ইহার একটা হেতুও রয়েছে। তবে থাকুক না হেতুটা পুশিদা!

হাতঘড়ির গ্লাসের ’পর আলতো ছোঁয়া লাগাতেই আলো জ্বলে উঠলো। জ্বলজ্বল করে জ্বলে থাকা গাণিতিক সংখ্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই আমি ভড়কে উঠলাম। দেখি- শূন্য এক, তেত্রিশ। মানে এখন মধ্যরাত। তবে রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা। এই পরিবেশে নিঃসঙ্গ-নিশাচর-একাকি হেঁটে বেড়াবার মজ্জাই ভিন্নতর। সেই ছোট বেলা থেকেই পথ হাঁটতে আমার ভালো লাগে। আলোজ্বলা পথ, ছায়ার ঘোমটা-ঢাকা পথ, সুনসান পথ, ধুলোওড়া পথ, ফেরিওয়ালার গলার আওয়াজে চমকে-ওঠা পথ; সবরকমের পথ বেয়ে হেঁটে যেতে ভালোবাসি আমি।
তথাপি এই নিশীথ সময়ে নিজেকে মনে হচ্ছে আমিই হিমু। কারণ, হিমুর শখ ছিল গভীর রজনীক্রান্তে একাকি হেঁটে বেড়ানোর। মন বলছে হিমুর শহর ‘নুহাশ পল্লীতে ঘুরে বেড়াবার। কিন্তু তা আদৌ সম্ভবপর নই। আকাশকুসুম কল্পনা। নানাবিধ কল্পনা-জল্পনা স্মৃতির দফতরে নাযরানা পেশ করছে। কিন্তু একটাও গ্রাহ্য হচ্ছে না। কোথায় এসেছি ভ্রুক্ষেপ করিনি। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর একটি বিলবোর্ড চোখে পড়ল। সেথায় লেখা আছে পদ্মা নদীর পাড়। এর মানে হল আমি এখন পদ্মা নদীর তীরে অবস্থান করছি।
(এই পদ্মা নদীকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। পদ্মা নদী (চধফসধ জরাবৎ)  মূলত গঙ্গার নিম্ন ¯্রােতধারার নাম, (হিমালয় পর্বতমালার গঙ্গোত্রী নামক হিমবাহ হতে গঙ্গা নামে উৎপত্তি) আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় গোয়ালন্দ ঘাটে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম স্থলের পরবর্তী মিলিত প্রবাহই পদ্মা নামে অভিহিত।  এই নামটি (পদ্মা) গঙ্গা নদীর ডান তীর থেকে বিভক্ত হয়ে আসা ভাগীরথী নামক শাখাটির উৎসস্থল পর্যন্ত ব্যবহূত হয় এবং হিন্দুমতে এই ধারাটিই গঙ্গার ধর্মীয় পবিত্রতা বহন করে।

নদীজ ভূমিরূপ বিদ্যাগতভাবে যমুনার সাথে সঙ্গমস্থলের পূর্ব পর্যন্ত প্রবাহটিকে গঙ্গা নামে এবং সঙ্গমস্থল পরবর্তী নিম্ন¯্রােতধারাকে পদ্মা নামে অভিহিত করা অধিকতর সঠিক। পদ্মা কখনও কখনও ভুলবশত গঙ্গা নামে উল্লিখিত হয়।

ব্রহ্মপুত্রের স্থানান্তরিত প্রবাহের ফলে এই নদীখাতের সৃষ্টির কারণে শুধুমাত্র নয় বরং বৎসরের অধিকাংশ সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা গঙ্গার তুলনায় পদ্মার প্রবাহে অধিকতর ভূমিকা রাখে।
রাজা রাজবল্লভের কীর্তি পদ্মার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ধ্বংস হয় বলে পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা।)
এই পদ্মা নদী নিয়ে বিভিন্ন কবি অনেক কবিতা রচনা করে গেছেন। রচিত হয়েছে অনেক গান।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কবিতায় পদ্মার প্রতি বলেছেন-

‘হে পদ্মা! প্রলয়ংকরী! হে ভীষণা! ভৈরবী সুন্দরী!
হে প্রগলভা! হে প্রবলা! সমুদ্রের যোগ্য সহচরী
তুমি শুধু, নিবিড় আগ্রহ আর পার গো সহিতে
একা তুমি সাগরের প্রিয়তমা, অয়ি দুবিনীতে!
দিগন্ত বিস্তৃত তোমার হাস্যের কল্লোলতারি মত
চলিয়াছে তরঙ্গিয়া, চির দৃপ্ত, চির অব্যাহত।
দুর্নমিত, অসংযত, গূঢ়চারী, গহন গম্ভীর;
সীমাহীন অবজ্ঞায় ভাঙিয়া চলেছ উভতীর।’

কাজী নজরুল ইসলাম-ও পদ্মা নদীকে তাঁর কাব্যতে এভাবে তুলে ধরেছেন-
‘পদ্মার ঢেউ রে
মোর শূণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যারে
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙ্গা পা
আমি হারায়েছি তারে।।
মোর পরান বধু নাই,
পদ্মে তাই মধু নাই নাই রে
বাতাস কাঁদে বাইরে
সে সুগন্ধ নাই রে
মোর রূপের সরসীতে আনন্দ-
মৌমাছি নাহি ঝঙ্কারে।’

অনুরূপ জসিম উদ্দিন-ও তাঁর কবিতাতে পদ্মানদীর কথা উল্লেখ করেছেন-
‘জেলে গাঙে মাছ ধরিতে যায়,
পদ্মা নদীর উজান বাঁকে ছোট্ট ডিঙি নায়।
পদ্মা নদী কাটাল ভারী, চাক্কুতে যায় কাটা,
তারির পরে জেলের তরী করে উজান ভাঁটা।
জলের উপর শ্যাওলা ভাসে, ¯্রােতের ফুলও ভাসে,
তারির পরে জেলের তরী ফুলেল পালে হাসে;
তারি সাথে ভাসায় জেলে ভাটীর সুরে গান,
জেলেনী তার হয়ত তাহার সাথেই ভেসে যান।’
যেখানে দিনের বেলায় রিকশা আর রঙ বেরঙের বিভিন্ন আকৃতির মানুষে ভরা থাকতো, এখন সেখানে শুধুই আবর্জনার স্তূপ ছড়িয়ে আছে। ফুটপাত-শপিংমলের টাইলস মোড়ানো চকচকে সিঁড়িগুলো বেওয়ারিশ কুকুর আর হাড্ডিসার অর্ধ-নগ্ন মানুষের বিছানায় পরিণত হয়েছে। পথ ছিল গাড়ি-ঘোড়া শূন্য, ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতই পৌঁছে গেলাম ব্রিজের গোঁড়ায়।

ল্যাম্পপোস্টের ঝলমলে আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত, তীব্র আলোর কিছু রশ্মি ছায়া ফেলছে ¯্রােতস্বিনীর জলে, তাতে লোচনে পড়ছে অনুদ্ধত তটিনীর আলতো লহরী। মৃদু বীচিপুঞ্জের উপর ভাসছে কিছু গলুইবিহীন ছোট নৌকা। দূরে নোঙ্গর করা বিরাট সাইজের লাইটার অর্ণবপোতগুলো ভাসছে নিশ্চল। নদের দু’পাড়ের উঁচু উঁচু দালানগুলোর শরীর থেকে আলোকচ্ছটা ঠিকরে বেরুচ্ছে এই মাঝ রাতেও। ছাদের উপর বসানো রঙিন বিলবোর্ডের লাল-নীল-হলুদ আলো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে রাতের অন্ধকার আকাশ।
এই পরিবেশে পদ্মা নদীকে দেখে স্মৃতির বাতায়ন খুলে যায় দখিনা হাওয়ায় এক নিমিষেই। তখন ভিড় করে সারি সারি, গুচ্ছ গুচ্ছ সাজানো ছোটবেলার কত শত স্মৃতিকথা। আশৈশবের দুরন্তপনা। ফেলে আসা দিনগুজরানোর রূপ-রস-গন্ধ-ছোঁয়া-স্পর্শের অনুভূতিতে ধূসর-মলিনবিধুর চিত্রায়ন ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। আমার ছোট চোখ দু’টো হয় যদি অতীতের স্বপ্ন ধরে রাখার আরশি-তবে আমার ছোটবেলার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন সেই অতীতের স্বপ্ন ধরে রাখা সারি সারি সাজানো একেকটা মহামূল্যবান হিরে-পান্না। আমার বুকের অন্তরায় শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রটা যদি হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ মুস্তার্দা-তাই তো সেথায় সারি বেঁধে সাজানো বেসাতের বোরার মত রয়েছে আমার শৈশব-কৈশোরের সেই সুমধুর সময়-আনন্দঘন মুহূর্ত-দিনগুলো।
আমি আশৈশব-যখন থেকে বই পড়তে শিখেছি তখন থেকেই বইয়ের প্রতি ভালোবাসা-ভালোলাগা ছিল তীব্রতর। একটি কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেও ভুল হবে না- আমি গ্রন্থকীট। সব রকমের বই পড়তে ভালোবাসতাম। সেসময় কোনো বাচবিচার ছিল না। যখন যেটা হাতের নাগালে পেতাম গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম। আমাদের গ্রামে একটা পাঠাগার ছিল। সেখানকার প্রায় বই-ই আমার পড়া হয়েছে। ইশ! মন বলে আবার যদি সেই সোনা ঝরা রৌদ্রময় শৈশব ফিরে পেতাম! আজও যদি সেরকমই গ্রন্থকীট হতাম! সময়ের বিবর্তনে সব কিছু যেন ওলোটপালোট হয়ে গেছে। আজ এই পদ্মানদীর পাড়ে বসে মনে পড়ছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের কথা। এই উপন্যাসটি শুরু হয়েছে পদ্মার রূপ বর্ণনার মধ্য দিয়ে।
‘বরষার মাঝামাঝি ইলিশ ধরার মওসুমে রাত্রিকালীন পদ্মার রূপ চিত্রনে লেখক সংকেতময় উপমা মত ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন। লেখকের দৃষ্টিতে নদীর বুকে শত শত কৈবর্ত নৌকা আলো জোনাকীর মত ঘুরে বেড়ায়। অন্ধকারের মধ্যে আলো দুর্বোধ্য। রাতে সারা পৃথিবী যখন নিদ্রামগ্ন তখন আলোগুলো থাকে অনির্বাপিত। এই আলোতে ইলিশের নিষ্পলক চোখগুলো হয়ে ওঠে স্বচ্ছ নীলাভ মনি সদৃশ্য। রাত্রিকালের কৈবর্ত নৌকার এই বর্ণনা ছাড়া লেখক উপন্যাসের একাধিক স্থানে পদ্মার রূপ অংকন করেছেন।

পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসটি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের আধুনিক বাংলা উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট সংযোজন। জীবন জীবিকার তাগিদে পদ্মানদীর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত মানুষের জীবন কাহিনী।

জীবন কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে উপন্যাসিক কৈবর্তদের যে অনবদ্য চিত্র অংকন করেছেন তা যেমন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তেমনি এই ঔপন্যাসে মানুষের হৃদয় বৃত্তির যে বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে তাও পাঠকের মনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। বাংলাদেশের সমাজ জীবনে নিম্ন শ্রেণির গ্রামীণ মানুষের বাস্তব চিত্র এখানে নিখুঁত ভাবে রূপায়িত হয়েছে।
পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটি বাংলাদেশের পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবন চিত্র। কৈবর্ত ও নাবিকদের দুঃসাহসিক জীবনযাত্রা এই উপন্যাসের উপজীব্য। পদ্মার সংগ্রামী জীবনের সাথে কৈবর্তদের যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তাতে তাদের আনন্দ নেই, নেই স্বপ্ন, নেই চাওয়া পাওয়া। আছে সীমাহীন বেদনা ভার। প্রাণন্তর পরিশ্রম করেও সেই পরিশ্রমের ফসল তারা ভোগ করতে পারেনা। ভোগ করে মহাজন। উপোষ কাপসে তাদের দিন কাটে। পদ্মানদীর মাঝি কৈবর্তদের জীবন দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। জেলে পাড়ার ঘরে ঘরে শিশুদের ক্রন্দন কোনদিন থামে না।’
উপন্যাসটির কথা চিত্রায়ন করতে গিয়ে কখন যে চোখের কোণায় জল এসে খেলা করছে তা বুঝতেই পারি নি। আমি এতোক্ষণে ব্রীজ থেকে নেমে নদীর উপর বেঁধে রাখা একটা ডিঙি নৌকায় উঠে বসলাম। এখান থেকে রাতের আকাশটা মনে হচ্ছে আমার খুব কাছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব। তবে যেহেতু আজ সন্ধ্যেয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে সেজন্য আকাশটা একটু মেঘলা। বৃষ্টিস্নাত আকাশ হলেও শশীর কৌমুদিনী ঠিকই নদীর অনুদ্ধত জলের সাথে লুকোচুরি খেলছে। আমি আমার পা দু’টো সেই শান্ত জলে ডুবিয়ে দিয়ে বিস্তৃত রাত্রিকালীন নদীর দৃশ্য অবলোকন করছি।
দূর হতে দেখা যায়-এই মধ্য রাতেও কিছু কৈবর্তরা নৌকায় চড়ে জাল ফেলে মৎস শিকার করছে। নাবিকেরা বৈঠা বইছে। রাতের আকাশে আনোখা কিছু পাখির উড়াউড়ি। কিনারে থাকা ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে নিশি-পাপিয়াদের সুরের মূর্ছনা। মধ্যে মধ্যে কল্লোলিনীর তরঙ্গ আছড়ে পড়ছে তরঙ্গিণীর বক্ষঃস্থলে। ঊর্মিমালার প্রকট গর্জ্জনের হ্রস্বধ্বনি। সহসা কেনো যেন মন বলে উঠল-এমন মুহূর্তকে নিয়ে কিছু লিখতে। তাই উদাসী মনে লিখে ফেললাম-জানি না এটাকে কবিতা বলে কি না!

‘প্রগাঢ় কৃষ্ণে নিশিকৃষ্ণ
ধরত্রীর ওই অন্তরীক্ষ
কুঞ্জকাননে কুররপক্ষী
উড়ন্ত তাহারী বক্ষ।
ডলক ডহাতে ধুনিজল
ফিরে যৌবনে থৈ থৈ
প্রত্যেহ নিশিতে চন্দ্র
ধুনির লগে পাতে সই।
নাবিকেরা তরী তীরে
প্রাবৃটপ্রাতে করে নঙর
কৈবর্ত মৎস দরিয়াপ্তে
সঙ্গেতে নেয় স্বকোঙর।’

পুনশ্চ: ভাবনার সাগরে ডুব দিতে দিতে মনের দহলিজে কিসের যেন ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল-কর্ণকুহর সজাগ হয়ে অনুসন্ধিৎসু হলো। এক অচিনকূল হতে অনুরণিত হচ্ছে রবী ঠাকুরের এই পঙক্তিমালা-
“নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।”

শিক্ষার্থী: ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।                  

ছেলেটি ভালো ছিল !

ছেলেটি ভালো ছিল !


ছেলেটি ভালো ছিল
মুনিম রাব্বী

‘আমারে মার, বাচায়ে রাখছস ক্যান ? হাতের বটি খান দিয়ে একটা কোপ মারলেই তো হয়। নয় টাকা দিবি আর নয় কোপ ফেলবি ঘাড়ের উপরে।
সকাল থেকেই সারা বাড়ি মাথায় তুলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে সুজন। ওর মুখের উপর বিকট শব্দে দরজা আটকে দিল ওর মা। এতক্ষণ রাগে ফোঁস ফোঁস করছিলেন। কিছুই বলেন নি । কিন্তু এবার তাঁর চিৎকার চ্যাঁচামেচি বাইরে থেকেও শোনা গেল ।
হারামির বাচ্চা, তোরে পেটে ধরছিলাম আমি ! ভাবতেও ঘেন্না লাগে। মরবি, রাস্তা ঘাটে যায়া মর। তরে এই বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখপার চাই না। তারপর কিছুক্ষণ বাঁধন হারা উন্মাদ কান্নার রোনাজারি ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।
সুজনের শরীর কাঁপছে। দরজার উপর উরুম-ধুরুম কয়েকটা লাথি ঘুষি দিয়ে ওখানেই বসে পড়ল। চারপাশ চুপ হয়ে গেছে। ঘরের ভিতর থেকেও আর আওয়াজ আসছে না। সুজন অনেকক্ষণ দরজায় বসে থেকে ফিরে গেল । সে আজ বাসায় ফিরবে না। আজ কেন, সে আর কোন দিনও বাসায় ফিরবে না । সুজনের ভয় হয় আজকাল। এখানে ওর মা আর ছোট বোন ছাড়া আর কেউ নেই ।
চার রাস্তার মুখে ফাঁকা জায়গা। বড় একটা ব্যানারে হাউজ সেলের বিজ্ঞাপন লেখা । এখানে এক সময় টিনের ছাপরা ঘর ছিল । তখন সুজন খুব ছোট। অনেক বছর এখানে থেকেছে । নতুন বিল্ডিং হবে এই জায়গায়। এখানেই বসে আছে মুখ গম্ভীর সুজন। সে আজ বন্ধদের কাছে যাবে না। ফাঁকা পকেটে রোজ রোজ এসব আড্ডায় যাওয়া যায় না। মায়ের উপর রাগারাগিটা বেশী হয়ে যাচ্ছে ইদানীং। সত্যিই তো, মা এতো টাকা কোথায় পাবে ? নাহ, মায়ের সাথে এমন করা উচিৎ না। আর এমন না করেই কি উপায় আছে? ভালো, সুবোধ, ভদ্র ছেলে হয়ে বড় হওয়াটা যে তাঁর হয়নি । এখন কি চাইলেই বদলে যাওয়া যাবে ?
মায়ের সাথে প্রতিদিনই কথা কাটাকাটি হয়। মাকেও যে এত আজে বাজে ভাষায় গালাগাল করা যায় তা সুজনের মুখের কথা না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। ওর মায়েরও পোড়া কপাল। স্বামী তাঁকে ছেড়ে গেছে অনেক বছর। কত রক্ত পানি করে ছেলে মেয়েকে নিয়ে এই সংসার গড়ে তুলেছে সে। কত কষ্ট যে নিত্যদিন লুকিয়ে রেখেন শাড়ীর আচলে তা কেউ টের পায় না। সেই সংসারে আজ কোন শুভ লক্ষণ নেই। যেই ছেলেটার সম্বল হয়ে ওঠার কথা ছিল এত দিনে, সে বড় হচ্ছে ভুল পথে, ভুলের সঙ্গে। গত দুদিন সুজনের কোন খোঁজ নেই। সুজনের মায়ের দুশ্চিন্তা হচ্ছে কিছুটা। ছেলের জন্য মায়ের মন সব সময় একরকম থাকে না। তাছাড়া সঙ্গদোষে কোথায় কি করছে তা কে জানে ?
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। বাজার থেকে দুই আটি শাক, গুড়ো মাছ আর কেজি পাঁচেক চাল হাতে নিয়ে ফিরছে সুজন। তাঁর চোখে মুখে কেমন যেন পবিত্র আত্মশুদ্ধির ছাপ। ময়লা মাখা মানুষ যখন ঘষে মেজে গোসল করে তখন তাদের শরীরটা স্বাভাবিকের চেয়েও উজ্জ্বল দেখায়। সুজনের চেহারাতেও তাই।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সুজন। আলতো করে দরজায় আঘাত করল। কি অদ্ভুত, এর আগে কোন দিন এত ভদ্র ভাবে দরজায় টোকা দেয়নি সে। দরজার ওপারের মানুষটাও যেন দরজার দিকেই তাকিয়েই ছিল, নয়ত কান পেতে ছিল এতক্ষণ। প্রথম বার শব্দ করে দ্বিতীয় কড়া নাড়বার আগেই দরজা খুলে গেল। মায়ের চোখের জল, তার ভিতরে বিস্ময় জাগানিয়া দুটি কৃষ কালো অক্ষিগোলক স্থির হয়ে আছে। যেন অনেক আঁধার ছাড়িয়ে অনেক দিনে পরে অপ্রত্যাশিত সূর্যটা উদিত হল।
কিছুই বলছে না সুজনের মা। সুজন সম্পর্কে তার এ যাবৎ কালের ধারণা বদলে গেল।
বাপধন, এগুলা কি আইনছো তুমি ?
এর পরেও অনেক প্রশ্ন করাযায় । কিন্তু আপাতত এই উত্তর জানা প্রশ্নেই খুশিতে বুক ফুসে উঠছে। মা, মাফ কোইরে দাও! ভাল হয়ে যাবো আমি। আর টাকা পয়সা লাগবে না আমার। মাঝে মাঝে আমিই তোমারে কিছু টাকা দিবার পারব এহন। ওমা, শান্তার কি খাতা ফুড়ায়ে গেছে ?
মায়ের শূণ্যবুকে, মরুভূমির বিস্তীর্ণ বালুকার স্তূপে, এত দিন জল জমত না। চোখ নিংড়ে যাই ঝরত সেই রাশিরাশি বালুর সমুদ্রে তা বিলীন হয়ে যেত। আজ যেন সেই মরু অঞ্চল ঢেকে গেল সবুজ পত্র পল্লবীতে। মমতার সুঘ্রাণ ফুলের অন্ত হতে যেন ছড়িয়ে পড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে যেন পুনরায় সজীব হল হারানো সংসার।
বাজান, তোরে কত বইকছি! তুই কিছু মনে রাখিস নে। এভাবে রাগ কোইরে মা-বোনটারে ফেলে কোথাও যাইস নে। তোরে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন !
সুজন মায়ের ওষ্ঠে আঙ্গুল ঠেকিয়ে থামিয়ে দিল। মা, এই স্বপ্নের কথা আর কইবা না। স্বাদ আর স্বপ্নের মইধ্যে ব্যবধান বেশী হোইলে মানুষ পথ হারায়া ফেলে। আগে মানুষ হোই মা। মানুষ না হয়ে মাইনশের স্বপ্ন দেখপার চাইনে।
সুজন বাসের কন্টাক্টরি করে। ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত শহরের এ মাথা ও মাথা ঘুরতে হয়। ইনকাম খারাপ না। যাত্রীদের সাথে টুকটাক ঝাঁই ঝামেলা হয় এই আরকি। ওসব ঝাঁই ঝামেলা মনে থাকে না। কত কত গালাগাল হজম করতে হয় ইদানীং। হজম হয়ে যায়। এক টিপে ঝাইঝামেলা অন্য টিপেই মনে থাকে না। কয়েক দিন হল দেশের অবস্থা ভালো না। কি এক কারণে সব বাস বন্ধ। বাস মালিক সমিতি গোসসা করে বাস বন্ধ করে রেখেছে। তাই আজ তেমন কাজ নেই সুজনের। সারাদিন বাসের সিটে ঘুমিয়ে সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় বাড়ির পথ ধরে সুজন ।
বাড়ির আগে বৌবাজার । সেখান থেকে সাদা দেড় কেজির একটা বয়লার মুরগী কিনে নিয়ে যায় সুজন। বাড়ির আগে রিকশার গ্যারেজ, ভাঙ্গারী মালের দোকান, তারপরে স্টিলের ঝালাই দোকান। তাঁর সামনে একটা আধ মড়া নারকেল গাছ। সেখান থেকে বামে গেলে সুজনদের টিনের ছাপরা ঘর। নারকেল গাছের বাম দিকে যেতেই সুজনের চোখ পড়ল বরাবর রাস্তায়। মা আর শান্তা ধাঁই ধাঁই করে আসছে ওই দিক থেকে। মনে হচ্ছে ওদেরকে পিছন থেকে কেউ ধাওয়া দিয়েছে। সুজনের মা শান্তার হাত শক্ত করে ধরে আছে। শান্তাও যেন তা সামর্থ্যের বাইরে মায়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটছে, হাটছেনা ঠিক, দৌড়চ্ছে।
সুজন এগিয়ে গেল । মা কি হোইছে ? কিছুনা।
মা ধাঁই ধাঁই করে ঘড়ে ঢুকে গেল। সুজন ঘরে ঢুকে আবার জিজ্ঞেস করল, এমন ভাবে আসলা, কি, কিছু হোইছে ? আরে নাহ ! তুই এত আগেই ফিরলি যে ?
কোন উত্তর না দিয়েই সুজন আবার জিজ্ঞেস করল, মা কি হোইছে । কও না কেন? আরে কিছু না, ভাঙা বিল্ডিঙের ওই হানে কুত্তা বেশি হয়ে গেছে । চেনা মানুষজন ও ধরে ইদানীং।
সুজন জানে, ওই জায়গায় কয়েকটা কুকুর ঘোর পাকিয়ে থাকে। অচেনা মানুষ দেখলেই হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু মা তো অচেনা না। এই পথেই কয়েক বছর ধরে গার্মেন্টসে কাজে যায় মা। কিন্তু এমন তো কোন দিন হয়নি। সুজন ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। মা, মুরগী ডা রান্না কইরো, আমি একটু বাইরে
গেলাম।


পথের ধারে সেই আধমরা নারকেল গাছটার গোরায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ। কালো মুখের চোখে চরম অস্থিরতা। মধ্যবয়সী চিনচিনে মানুষটার চেহারায় নরকের বীভৎস ছাপ পড়েছে যেন। এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেনি সুজন। সুজন দূরে কোথাও গেল না। যতদূর থেকে লোকটাকে দেখা যায় তত দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।
লোকটি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। যে পথে এসেছিল সে পথেই ফিরে গেল। জমসেদ দের দোকান থেকে চা খেয়ে বাসায় ফিরে আসল সুজন । অনেক দিন পর মুরগী রান্নার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রান্না হলে একসাথে তিন জন খেয়ে নেয়। অনেক কাল পরে ওরা তিন জন একসাথে ভাত খেলো। কাজ না করেও আজ সুজন খুব ক্লান্ত। ভালই হল। কাল ও বাস চলবে না। সুজনেরও এখন লম্বা একটা ঘুম দরকার।
পকেটে টাকা জমে আছে। কয়েকদিন হল সময়ও কাটছে না। তাছাড়াও লোকাল বাসের কন্টাক্টরিতে মনও বসছে না। অচেনা অজানা মানুষের অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে হয়। সুযোগ পেলে কেউ কেউ কলার্ট ও ধরে । প্রত্যেকটা দিন ঐ শালা মতিন ড্রাইভারও কম কথা শুনায় না। গায়ে খেটে এতো বাজে কথা পেটে হজম হয়না । 
সকাল সকাল বের হল সুজন । অনেক দিন পর দেখা হল পুরনো বন্ধুদের সাথে । ওরা ভাঙা বিল্ডিঙের ওইদিকেই যাচ্ছিল। কিরে সুজন, দেখাই যায়না, কেমন আছিস? এইত ভালোই আছি, তোরা কেমন আছিস ? আমরা কি খারাপ থাকি রে !
চল যাই, ভাঙা বিল্ডিঙে সবাই আছে।
নারে, তোরা যা। আমি টার্মিনালে যাব।
টার্মিনালে সারাদিন বসে থেকেও কোন নিশ্চিত তথ্য পেলনা সে। সাত দফা দাবিতে অনড় বাস-মালিক সমিতি। যদিও সুজন এসবের তেমন কিছুই বোঝে না। তবুও থেকে থেকে সুজনের রক্ত আন্দোলিত হয়। রাস্তায় তো মানুষ মরবারই পারে। কেউ কি কাউরে হাউস কইরে মারে ? হা হইয়া আসমানের দিকে চায়া কেউ যদি চাক্কার তলে গর্দান দেয় তার খেশরত কি আমাগো দেয়া লাগবো ? এসব যৌক্তিকতা বেশ ভালই বুঝতে পেরেছে সুজন। এভাবেই ঘুরে ফিরে বেশ সময় গড়িয়ে গেল। টার্মিনালেরে পিছন গেটের টঙ দোকান থেকে পাঁচ টাকার সিগারেট ধরিয়ে বাড়ির পথ ধরে সুজন।
 চ্যাঙরা ছেলেপুলে দুই এক পয়সা রোজগার করলে যা হয়। ইদানীং বেশ একা একা লাগে সুজনের। বিয়ের ভুত মাথায় চেপেছে। কথা বলার একজন মানুষ চাই এখন। মা কেমন যেন চুপচাপ থাকে। যেন বড্ড ক্লান্ত থাকেন তিনি। কিছু জিজ্ঞেস না করলে কোন কথা বলেন না। মাকে বলা উচিত। মা নিশ্চয় না করতে পারবে না। সুজন মাকে জানাবে। যদিও তার পাকাপাকি ওই ভাবে পছন্দেরে কেউ নেই। তবে জমির চাচার মেয়েটা ভালই। গোল গাল সাদা সিদে চেহারা। কিন্তু জমির চাচা কি রাজি হবে ? মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়নি এখনও। রাজি অবশ্য হতেও পারে। জমির চাচার টানা টানির সংসার, তাছাড়া সুজন ও ছেলে হিসেবে একেবারে খারাপ না।
কিছুক্ষণ হল মা ফিরেছেন। মায়ের চোখে মুখে ক্লান্তির চেয়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রোগ নেই, শোক নেই, অভাব ও কমেছে আগের চেয়ে, তবুও মায়ের এত চিন্তা কেন তা জানা নেই সুজনের। মা, তর সাথে কথা আছে। বল শুনতেছি।
জমির চাচার মাইয়ারে তর কেমন লাগে? মা কাজ থামিয়ে সুজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তুই কি কইতেচাস? সোজাসুজি বল।
মা, আমি বিয়ে করবার চাই।
সুজনের মা কিছু একটা বলতে গেল কিন্তু পরক্ষনেই কি যেন ভেবে আর বলল না । মা জানে, সুজনের বয়স বিয়ে করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাছাড়া যে দুই চার টাকা ইনকাম করে তারও কোন ভবিষ্যৎ নেই। চোখ বন্ধ করে সুজনের এই সিদ্ধান্তে না বলে দেয়া যায়। কিন্তু, সুজনের মা না বললেন না ।
হুম , জমির ভাইয়ের মাইয়াডা খারাপ না ! কিন্তু বাজান, বিয়ে যে করবা, আগে পরে ভাইবে নিছো তো ?
হ, মা । তুমি জমির চাচার সাথে কথা কও ।
পরের দিন শুক্রবার বিকালে সুজনের মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জমির আলির চায়ের দোকানে গেল। চা খাওয়ার ফাকে ফাকে সুজনের মা পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল জমির আলীকে। এই প্রস্তাবে জমির আলী রাজি না নারাজি বোঝা গেলনা তৎক্ষণাৎ। চায়ের কাপ গরম পানি দিয়ে ধুতে ধুতে জমির আলি বলল, মাইয়াডার কি বিয়ার বয়স হোইছে সুজনের মা ? তোমার পোলাডারই বা কি বয়েস ?
তা তো আমিও জানি জমির ভাই । তুমি ভাইবে চিন্তে দেখো কি কোরবা। তোমার মেয়ে তো আর তোমারে ছেড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে না।
জমির আলী গম্ভীর হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। আচ্ছা সুজনের মা। দেখি, বাড়ি যায়ে তোমার ভাবির সাথে আলাপ আলোচনা করে।
খবর আসতে খুব দেড়ি লাগল না। পরের দিন সকালেই কেজি খানেক মিষ্টি নিয়ে সুজনদের বাড়িতে আসল জমির আলী। কি ভেবে যে তার মর্জি হল তা ভেবে পায় না সুজনের মা। তবুও, তার চোখে মুখে অপ্রত্যাশিত আনন্দের ছাপ। বিয়ে ঠিক হল পরের শুক্রবার।
এই কয়েকদিনে সুজনের চেহারা বেমালুম বদলে গেছে। তার চেহারায় হঠাৎ করে পরিণত পরিণত একটা ভাব এসেছে। সে জানে জীবন মানেই দায়িত্বকে গ্রহণ করা। দায়িত্বকে এড়িয়ে যা কিছু হয় তাকে সেই অর্থে জীবন বলা চলে না। তার কাছে নিশ্চিন্ত জীবনের চেয়ে অনিশ্চয়তাই মধুর।
গরিবের জীর্ণ সংসারে আজ বিয়ের আমেজ। ছোট্ট টিন শেডের ঘড় সাজানো গোছানো এখন। সবই ঠিকঠাক কিন্তু সুজনের মায়ের যেন এ নিয়ে কোন চিন্তা নেই। সে অন্য কোন কিছু নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় আছে।
মায়ের এমন থমকে যাওয়ায় সুজনের ও মন খারাপ। আজ বাদেও কাল বিয়ে অথচ মা মুখ ফুলিয়ে বসে থাকেন। সুজন এই ভাবতে ভাবতে ভাঙা বিল্ডিঙের দিকে হাটতে লাগল। আশে পাশে কোন ল্যাম্পপোস্ট নেই। দূরের কোথাকার কোন আলো এসে পড়েছে । ছোট খাটো অপরাধ গোপন করার মত যথেষ্ট অন্ধকার আছে এখানে । তবুও মায়ের শরীরের চিরচেনা অবয়ব চিনতে পারল সুজন । ওই হলদে ফুলের ছাপার শাড়িটাও সুজন কিনেছিল গত মাসেই । সেকি, ওই সেই কালো দুর্ধ্বষ লোকটা, যে দাঁড়িয়ে ছিল আধ মরা নারকেল গাছটার গোঁড়ায় । সেই লোকটা রক্ত লাল চোখে মাকে শাসিয়ে যাচ্ছে । মায়ের মুখে কোন কথা নাই। মাঝে মাঝে হাত জোড় করছে, মাঝে মাঝে চোখ মুছছে। কিন্তু লোকটার অকথ্য কথা বার্তা মাকে শুনতে হচ্ছে । এমন যেন তাকে শুনতেই হবে।
সুজনের আর আগানো উচিত না। মা বাড়ি ফিরলে  না হয় শোনা যাবে। কিন্তু কি হচ্ছে এসব ? রাত পোহালেই বিয়ে অথচ সুজনের মা কি সব ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছে আল্লাহই জানে । কত টাকা ধার দেনা করতেছে আল্লাহই জানে। নাহ, থামাতে হবে । বাড়িতে আসলে বুঝাতে হবে ।
সুজন বাড়িতে ফিরে আসে । ছোট ছোট রঙিন আলোয় কালো আকাশের নিচে রঙিন হয়ে উঠেছে জায়গাটা । সবার ভিতরেই অন্যরকম আনন্দের উচ্ছ্বাস । সাউন্ড বক্সের উন্মাতাল গানের ছন্দে বার বার নেচে নেচে ক্লান্ত হচ্ছে সুজনের ছোট্ট বোন শান্তা। আশে পাশের কয়েকজন বন্ধুরাও এসেছে। সুজনের জীবনে এমন আনন্দের উপলক্ষ এর আগে কোন দিন আসে নি । কিন্তু সেকি, এই আনন্দ কোলাহলে সুজনের মা এখনও নেই। সুজনের রাগ হচ্ছে এবার। এদিকে সুজনের বোনটাও মা মা করে চেঁচিয়ে যাচ্ছে ।  সুজন সেই প্রিয় মহুর্তটাকে ফেলে রেখে ছুটে গেল ভাঙা বিল্ডিঙের কাছে । সেখানে তেমনি অন্ধকার । আলোছায়ার অনন্তকালের খেলা । কিন্তু সেই দুটো মানুষের ছায়াও নেই । মা নেই ওখানে । হলুদ ফুলের ছাপার শারীর সেই আঁচলটাও নেই ওখানে। সে নাও থাকতে পারে। মা বাজারের দিকে গিয়েছে হয়ত। কাল বিয়ে। মা  কিছু  কিনতে হয়ত বাজারে ছুটেছে। তাই ভেবে সুজন ও বাজারের দিকে গেল
 সমস্ত বাজার খুঁজল, নাহ মা নেই। বড় রাস্তার বড় শাড়ির দোকানটা, ওখানেও নেই।  আশে পাশে কোথাও মা নেই । সুজন বাড়ি ফিরে আসে। ততক্ষণে রাত অনেক। শান্তাও ঘুমিয়ে পড়েছে। সাউন্ড বক্সের উন্মাতাল গান ও থেমে গেছে। বাজারের দোকান পাট ও বন্ধ। সুজন ছড়া অন্যরাও ওর মাকে খুঁজছে। ওই কালো লোকটা, বিচ্ছিরি রকম লোকটা , ওই লোকটার নাম জানে না সুজন। নাম জানবে কোত্থেকে, দেখেছে একবার। ওই লোকটা হয়ত জানে মা কোথায়।
রাত আরও গভীর হল। আশে পাশের সব কিছু জনশূণ্য হয়ে গেছে। এখন আর দুশ্চিন্তা না করে উপায় নেই। সুজনের চোখে পানি জমে। আশে পাশের কেউ কিচ্ছু জানে না। আর কোথাও খোজার বাকি নেই।  আচমকা কি হয়ে গেল এসব। দুশ্চিন্তার কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে সুজনের ছোট্ট মুখ। খানিক বাদে পাশের বাড়ী থেকে মধ্য বয়সী এক মহিলা ছুটে আসল। সুজনের মায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে । ওই কালো, লম্বা ছিপ ছিপে লোকটাকে সুজনের মা নাকি নিকাহ করছে।

পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১



উপমার উপমা
লুৎফর রহমান রবি

তীব্র দাবদাহনের মাঝে গলে পরা হাজারো বৃষ্টি ফোঁটার মধ্যে থাকা প্রথম বৃষ্টি ফোটা তুমি।
রংধনুর সাঁত রং এঁর মাঝে সবচেয়ে গাঢ় আকাশী রং টা তুমি,
যাকে আকাশ ধরে রাখলেও সে তার নিজের আলোয় আলোকিত।

তুমি কোকি এঁর কুহু কুহু গান।
যে গান কোন বীণার তাঁর ছাড়াই হৃদয়ে বাজতে থাকে অহর্ণিশ।
তুমি রাখালের বাঁশির সুর, যা আমাকে সুদূরে ডেকে নিতে চায়।
তুমি বকুল ফুলের মিষ্টি সুভাষ,- যা আমায় মুগ্ধ করে প্রতিবার।

তোমাকে সব সুন্দরের উপমায় খুব সহসায় মানিয়ে যায়,
আর আমি তোমাকে জানি সকল উপমার উর্ধ্বে।
তোমাকে রাখতে চাই উপমারও উপমা হিসেবে।


ভয়ংকর সুন্দর এক নদী 
জাহিদ হাসান তুহিন 

এইবার শান্ত হয়ে
চোখের দিকে তাকাও
ডুব দাও গভীরে
ভয়ংকর সুন্দর এক নদী।
চারপাশে কাশফুল আর ধুতরা ফুটে আছে।
তুমি নদী পাড়ের মেয়ে
রোদে পোড়া শরীরের মাঝি তোমার প্রেমিক।
শরীর জুরে মাটি আর আটশে মাছের গন্ধ
ভিজে লুঙ্গিতে লেগে আছে প্রেমের চিহ্ন।
তারপর আস্তে আস্তে
বুকের বামপাশে দৃষ্টি দাও
আমি আবারও বলছি
শরীরের উপরে জেগে ওঠা বক্ষ নয়
তারও গভীরে
রক্তাক্ত হৃদয়ে
সেখানে কবর দাও তোমার অনুভূতি।
মুক্তি দাও সদ্য জেগে ওঠা যৌবন
তোমার প্রেমিক ডুবে গেছে পদ্মার বুকে।
সাদা কাশফুল কানে গুজে
চুমুক দাও ধুতরার মুখে।
আস্তে আস্তে ডুবে যাও পড়ন্ত সূর্যের মত
শান্ত চরের মাটির গভীরে।



ঘড়ি
সালমা বিনতে শামছ

শান্ত- সব হয়ে আছে শান্ত,
তীব্রতা- ভুলে গেছে উদভ্রান্ত।
ছাই আর পুড়ে না ; অস্তিত্ব হারিয়ে,
মন ছুঁতে চায় মন, সীমানা ছাড়িয়ে।
পথ হেঁটে যায়, দীর্ঘ হয়, পা এ পা বাড়িয়ে।

সময় হেঁটে চলে তার আপন গতিতে,
ভাষা- বলে যায় যার যার অনুভূতিতে
হাসির দায়বদ্ধতা; প্রকাশিত নিজস্ব মতিতে।

ব্যাটারির মৃত্যুতে থেমে আছে ঘড়ির কাটা,
কেউ আর তাকায়না বলে আর দেখেনা বাজে ক’টা।
থেমে নেই জীবন চাকা,
চলুক না তা আঁকা বাঁকা।
কেউ ফুরিয়ে যায়, কেউবা জন্মায় সদ্য,
ভাবে না, পাবে কি না ; চিন্তার কৌটা আবদ্ধ।

কে কবে?
এ সবে
লিখে যাবে রীতি,
কি হবে?
না ভেবে
রেখে যাবে প্রীতি।

মননে রোজ বাজে কত শত বাজনা,
ধরে রাখি, ছুটে যায়, বলে শুধু আজ না।
কি আর লিখবো,
তুলে ধরবো,
সবি গত হয়েছে,
কে কি গাইবে,
সুর তুলবে
কবি কোথা রয়েছে।

তারচেয়ে বরং গল্প বলি,
সময় ভুলে অল্প চলি।
মৃত ঘড়ির শোক ভুলি।


আজীবন নেশার মতো
জারিফ এ আলম

গোর খোদকের মতো খুঁড়ে যাচ্ছি নিজেকে
যে মদিরায় চুর হয়ে আছি, পানপাত্র ঠোঁটে নিয়ে
ধ্যানস্থ হয়ে আজ। চোখের কোণ জুড়ে তাই
পৃথিবীর বিস্ময় বড় একঘেয়েমি লাগে এখন।
যার বাহুতে মাথা রাখতে সংকোচ নেই দ্বিধা নেই
সে আজ প্রাচীরের ওপার থেকে বাড়ায় হাত!

সময়ের এই যে শিরোনাম, উপমা জীবনের প্রয়োজনে
অন্ধের মতো গলি খুঁজে খুঁজে হোঁচট খাওয়া বারবার
মানুষের পৃথিবীতে সম্মিলিত সুরে হিংসার অবতারণা
গ্রাম থেকে নগরে পৌষ আর সর্বনাশের চিত্রে
ধারণ করি আমিও এক বিশ্বনাগরিক।

আসলে সময় শোষণ করে নেয় আবেগ অনুরাগ
বেঁচে থাকার জন্য সামান্য এই প্রীতির পরাগ
অবশিষ্ট নেই কোনো কিছুর। রাত নামলে এখন
কৃষ্ণপক্ষের প্রহর এসে দরোজায় টোকা দেয়।
পৌরাণিক চরিত্রে নিয়ে গল্প ফাঁদা হয় না আর
রূপকথা আর উপকথার চরিত্র গড়াগড়ি খায়
নির্জন কোনো কক্ষের ভেতরে।

প্রান্তিক কোনো হিশেব মেলাতে না পেরে এখন,
মহারাজ আসন পেতে বসেন, মুক্তির মিছিলে
সবাই ভুলে যাই, আমি কে? তুমিই বা কি ছিলে!


ঘুঙুর নাচের শব্দ 
হাসান মাসুদ 

পিঁপড়ের আশ্রম ভেঙে গাঢ় হয় রাত
আমি ঘুঙুরের নাচের শব্দে
বাড়িয়ে তুলি পায়ের শক্তি;
যেমন একাত্তরে তুলেছিল মুক্তিকামী
ভিটেহীন মানুষগুলো।

ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে
হঠাৎ মরার স্বাদ ঢেরবেশি,
জীবন পথে খুব বেশি না হেঁটে
চলো; পায়ের ছাপ রেখে যাই।

চলো সেই বনপথে
মানুষের জন্য রেখে যাই বিশ্বাস
মিছিলের অগ্রভাগের দু একটা মানুষ
ফুল চাষের জমি কিংবা মাছেদের সাথে
কথা বলার ভাষা।


ছুঁয়ে দাও আমায়
মুহাম্মদ ইমদাদ হোসেন

তুমি ছুঁয়ে দিলেই
আমি বদলে যাব
থমকে আছে জীবন
তোমার ছোঁয়ার প্রতীক্ষায়।

তোমার আদর সোহাগে
প্রেমের স্নিগ্ধ পরশে
আমি ফিরতে চাই
আনন্দ শান্তির ঠিকানায়।

তুমি ছুঁয়ে দিলেই
আমি বদলে যাব
কেটে যাবে আধাঁর
রাঙাবে জীবন উজ্জ্বলতায়।

হে প্রাণের প্রিয়জন
ছুঁয়ে দাও আমায়
আমি বদলাতে চাই
তোমার ভালোবাসার ছোঁয়ায়।

পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২


আড়াল
দিপংকর ইমন 

তোমায় খুব ভালোবাসি প্রিয়তমা। সংসারে খুব টানাপোড়েন ছিলো। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে গিয়েছে কতবার। তবুও ভালোবাসার কমতি ছিলো না কোন কালেই। আজ তুমি শরীরে ক্যান্সার পোষছো। আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছো। তবুও তোমায় খুব ভালোবাসি। বাসবো আজীবন।
তোমাকে ভালোবাসার জন্য সংসারে তোমার উপস্থিতিটা কি  খুব প্রয়োজন? লোকে ভুল বলে। চোখের আড়াল হলেই পৃথিবীর সবকিছুই মনের আড়াল হয়ে যায় না।


নিঃশ্বাসে ঘ্রাণ পাই 
মজনু মিয়া 

জানালার পাশে বসে আছি, মিষ্টি রোদ
এ ঘর থেকে ও ঘর যায়
ভেসে আসে ঘ্রাণ, প্রতিনিয়ত যে ঘ্রাণ পাই।
বাম পাশের বালিশে হাত পড়তেই
আলতো ছোঁয়ায় জড়ায় বুকে, সেই ঘ্রাণ
উষ্ণ ভালোবাসায় লেপটে থাকে অঙ্গে।
শ্বাস প্রশ্বাসে আমার ভেতরে যায় যে ঘ্রাণ;
আসলে তুমি, নিঃশ্বাসের সাথে মিশে আছ।


জলরঙে জীবনের আঁক
ফজলুর রহমান

এই দোআঁশ মাটি, পল্লবিত আকাশমনির ডাল;
আর বালুবেলার চাপাখিরা জানে না কোন চাঁদকে দেখে দেখে আমার চন্দ্রমুখী রাত কাটে।
টানা বারান্দায় যে রোদ দুপুরকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে ডেকে আানে;
সুগন্ধি মরিচ গাছের ওপর সে দুপুর আড়াআড়িভাবে বিছায় তার শরীর।
ঘুমভাঙা বিকেল আড়ষ্টতা মুছে কবিতার উপযোগী হয়ে ওঠে,
দুধের সরের মতোন ঘন কুয়াশা আর কোনো কোনো বেগানা শীতকাতুরে রাত;
জেনে থাকতে পারে আমার একলা জীবনে মালতী ফুলের গল্প।
জীবনের নিত্য হালচালে এসেছে কী মেঘবাড়ির চিঠি?
ভাঙা খাট গলে যে রূপকথা একদা নেমে এসেছিল;
হৈচৈ এর দুনিয়ায় তাকে আর হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে জাদুঘরে রাখা হয়নি।
এই হেঁশেলি মন, খুচরো পয়সা আর শাদা-কালো কাপড়ের দিন জানে না,
কতটা লালা ক্ষরে ক্ষরে ভেজে তেতো জীবনের পার।


আমি কেউ নই
জাহিদ হাসান 

আমি কেউ নই
কারো গল্পের বই,
বৃষ্টিস্নাত এক সন্ধ্যায়
আনমনে বসে বারান্দায়
দিগন্তের পানে চেয়ে
উদাস মনে রই।

আমি কেউ নই
কারো ছবির বই,
কোনো স্বপ্ন বালিকার
মনের তুলিতে আঁকা
সহ¯্র  ছবির মাঝে
কোনো ছবি নই।

আমি কেউ নই
কারো কবিতার বই,
কোনো ষোড়শী লেখিকার
শত তরুণ নিয়ে লেখা
শত কবিতার বইয়ে
শুধু আমি দূরে রই।


কামায়ন
বিশ্বজিৎ মণ্ডল

প্রতিদিন এভাবেই তোমার উন্মাদ কাঁচুলিতে মেনেছি স্বর্গ
আজ্ঞাবহ প্রতিপালকের বার্তা...

সুঠাম রাস্তা বেয়ে গড়িয়ে যেতে যেতে সেজে উঠি
                                                        প্রলুব্ধ ময়াল   
তোমাকে লিখে ফেলি আরো এক কামসূত্র...
কখনও লক্ষ্মী চোখে তোমার দিকে তাকিয়ে খুঁজিনি
                                           প্রান্তিক সেই স্টেশন
সদ্য ছেড়ে যাওয়া রিক্সাওয়ালার গালিগালাজ

ভুলে থাকতেই শিখেছি যাবতীয় উপদ্রব
মেঘ মল্লারের দিন আর শিউলি তলায় দাঁড়িয়ে
তোমাকে উচ্চারণ আঁকা প্রথম পাপ

আজ দ্যাখো, নেহাত ভদ্রলোক সেজে উঠেছি
শূন্য দশকের রমণীয় উপবনে...
জানতেই পারোনি, বুক পকেটে চুরির রাখা-
সেই সিফিলিস গল্পটা....

পদাবলি : ০৩

পদাবলি : ০৩


প্রেমিকার প্রতি
মিসির হাছনাইন 

ক্ষুধার্ত বিকেলের পেট থেকে
যে কিশোরী বসন্ত বেরোয়-
একটা গাছ খুব নীরবে কেঁদে উঠে
আকাশে জবাফুল নাচে
ঈশ্বরকে আপন মনে হয়
চোখের ভিতরে একশ তেইশটা নদী নিয়ে,
গান গাই উড়ে আসা বৃষ্টির
নিজকে খুঁজতে থাকি তোমার ভেতর;
তুমি সন্ধ্যাতারার মতো ঘুমিয়ে যাও
ঘাসের ভেতর;
মাঝরাতে রাখালের বাঁশি হয়ে
শিশির, তোমার সাথে সঙ্গম করি
নিজকে গাছের ফুল মনে হয়
মনে রেখো, বেঁচে আছি তোমার ভেতর।



অবিশ্বাসের কয়েদখানা
এনাম রাজু

বিশ্বাস হারিয়ে মানুষ পরিণত লাশে...

ক্রমেই অবিশ্বাসীর দখলদার হচ্ছি
গতোকাল প্রেমিকার ঠোঁট দেখে কেঁপেছে হৃদয়
দূরত্বে আছি যতোটুকু থাকা যায়।

পাশের রুমে শুইয়ে কাঁশি দিচ্ছে মা
তার পাশে শুইয়ে পোষা বিড়াল
আমি নেই আমার যাওয়া নিষেধ!

আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না,
হাতকে বিশ্বাস করতে পারি না
বন্ধ দরজার হাতলটাকে অবিশ্বাস করে
দু কদম এগিয়ে বাইরের আলো দেখি না
নিরুপায় হয়ে পড়ে থাকি বিছানায়,
বিছানাকে সরিয়ে দেই অবিশ্বাসের দোলনায়।

আমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারি না
তাই ছুঁইয়ে দেখি না আমার হৃদয়
যেনো অবিশ্বাসে ধোঁকায় বন্দী হয়ে
লাথি মেরেছি ঈশ্বরের কলিজায়!

হায় এতো মহাপাপ! আমি বিশ্বাস করি না আজ
 যাবতীয় বস্তুর প্রাচূর্য বৈভব, করুণা, প্রণয়।



তোকে আমি ভুলবোনা কোনোদিন
শম্পা মনিমা

আপ্রাণ উষ্ণতা মুড়ে হাসিতে তুই ফিরে আসছিস
সফেন বালি থেকে, বেলোয়ারি দিন

ঘাম মোছা শহরের শহীদ মিনারে ঠোঁটের কোণে ছুঁয়ে যাচ্ছে ঠুনকো হয়ে ওঠা হাইফেনের মিঠে সময় তর্জনীতে জলন্ত স্পর্শ কাছাকাছি আসতে চায়, সর্বহারার স্বাদটা ধুলোবালির দাম দিয়ে কিনলাম। ধুসর আত্মীয়তা জড়ানো মাফলারে রয়েছে শেষবেলার শীত। ফিকে হচ্ছে উঠোন, জেটিঘাট, একলা পথ, মাঠের কান্না, বরফের কুচির মতো বিষাদ থরে থরে সাজানো অস্তিত্ব সন্ধ্যের মরশুমী প্রনয়। বসন্তের আজান উদাসী লগ্নে কানে আসে, জলের ছায়া আরো গভীর হয় অভিমান করে,  আমি খুঁজি বিচ্ছেদের আড়াল অমিতাক্ষর ছন্দে, মায়াছোঁয়া ধূপের গন্ধে, পাতা ঝরার ভালোবাসার ঋতুতে।
মুহূর্তের সোমলতাহীন চাঁদে বিরোধিতা খুলে বিজনে মেলে হাত, নেই সেখানে কান্না চোখ মোছার নক্ষত্রের হাত।

এই বেলায় থেমে থাক, এতটুকু থেমে থাক যাযাবরের মধুমাস।



নদীজাত
সাদিক তাজিন

আমার আঁকা নদীগুলো শুধু বাঁকা’ই হয়না বরং জিলাপির প্যাঁচে ভাঙে ভুমি ও নদীর জ্যামিতি। দুর্যোগ ছাড়াই কিছুদূর ঘুরেফিরে পাল্টায় গতিপথ। তবুও কোন ভাঙন নয়, খরস্রোত নয় যেন সে ম্যাগনেটাইট মোড়কে সুরক্ষিত পাকস্থলী। বৈরাগীর ভারত থেকে বুকের বাংলাদেশে ঢুকে ঠিকই কিন্তু চিরন্তন সমুদ্রে আর পৌছায় না। অথবা কে জানে এই নদীগুলোর মৌলিক ভাব; সমুদ্রস্বভাব বলে কিছু নাই।


অবসর যাপিত জীবন
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ

উঠোন আর ঘর
শুয়ে বসে কাটে সারাদিন।

কত দিন হলো...
ফুলের টবগুলোর মাটি
চৈত্রের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে অপলক চেয়ে আছে। একটু জলের আশায়।

চোখ পড়ে অবসরে...
মৃদ পায়ে হাটি জল হাতে। গোলাপ কামিনী গন্ধরাজ বাগান বিলাসী গোড়ায়।

মাহমুদ নোমানের উপন্যাস ‘জোছনাপোড়া ছায়া’

মাহমুদ নোমানের উপন্যাস ‘জোছনাপোড়া ছায়া’


মাহমুদ নোমানের উপন্যাস 
‘জোছনাপোড়া ছায়া’

নীলিমা নূর

বইটি যখন শেষ করলাম, রাত এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন। বারোটা বেজে এখন ছয়। এই সময়ে আমি কারো বইয়ের রিভিউ লিখতে বসি না সাধারণত। কিন্তু বইটা এতো বেশি নাড়া দিল ( বিশেষত শেষ পৃষ্ঠায়) কিছুক্ষণ হয়ে বসে থাকলাম। তারপর লিখতে বসলাম। না লিখলেই নয় যে!

প্রথমত: ‘জনরা’ রোমান্টিক/সামাজিক উপন্যাস.... কিন্তু আমি বলবো এটা buildungsroman, Bildungsroman ,  হচ্ছে সেই উপন্যাস যাতে প্রধান চরিত্রের বিকাশ ঘটে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। শৈশব/কৈশোর থেকে শুরু হয়। যেকোনো পর্যায়ে গিয়েই থামতে পারে। তো, আমার দৃষ্টিতে, ‘জোছনাপোড়া ছায়া’ মোটামুটি গোছের একটি bildungsroman
James Joyce Guy A Portrait of the Artist as a Young Man যেরকম , যৎসামান্য ঐ ধাঁচের। তবে পার্থক্য এই যে, এই উপন্যাসে শেষ পৃষ্ঠায় একটা সারপ্রাইজ আছে। সেটি জানতে পড়তে হবে বইটি।

প্রেম এবং প্রেমজীবন- এটিই উপজীব্য বিষয়। কিন্তু আর দশটা প্রেমের উপন্যাস থেকে এটি আলাদা। আলাদা একারণেই যে, এটি কোনো একক প্রেমের গল্প নয়। এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত একটু মতামত দিই। আমার মতে, আপনার প্রেমজীবন মূলত একটি ধারণা। শৈশব এবং কৈশোরে চারপাশের সিনিয়র, মিডিয়া, কালচার- এসব মিলিয়ে একটা স্টেরিওটাইপ ইমেজের ছবি আঁকেন আপনার অবচেতনে। এরপর যে মানুষটার সাথে কিছুটা মিলে যায় কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যে, আপনি তার প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু সমস্ত জীবন ধরে, আপনার সব প্রেমের মাঝেই ঐ একজনকে খুঁজে বেড়ান অবচেতনে। বেশির ভাগ সময়েই প্রথম প্রেমটা জায়গা করে নেয়, কখনো অন্য প্রেম। কিন্তু কোনো একটা বেশি ইনফ্লুয়েনশিয়াল থাকেই, এটা আপনাকে মানতে হবেই।


‘জোছনাপোড়া ছায়া’র বিশেষ দিকটিই এর রিয়্যালিজম। কোনো লাইনেই মনে হবে না, লেখক ভণ্ডামি করেছেন। জীবন ঠিক যেমন, তেমনটাই পেয়েছি প্রতি লাইনে। চিঠির যুগ, ফেসবুকের যুগ কোনো যুগকেই অস্বীকার করেননি তিনি। নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন- এ যেন রেকর্ডেড জীবনালেখ্য। গুরুগম্ভীর দর্শনে বোঝাই নয়, কিন্তু সাবলীল হরহামেশা ঘটে যাওয়া জীবনের প্রতিচ্ছবি যেন। আপনার জীবন যে একটি গতিময় জীবন এবং উপন্যাসের কাজই হচ্ছে সম্পূর্ণ সত্যকে তুলে ধরা, বিশেষ অধ্যায়ে আটকে থাকা নয়- এই উপন্যাসটি অন্তত, আপনাকে এই উপলব্ধি দেবে।
চরিত্রের বিশ্লেষণ করছি না । তাতে সাসপেন্সগুলোই কেটে যাবে। কিনুন, পড়–ন, উপলব্ধি করুন।
আমি লেখকের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। আশা করি তিনি ভবিষ্যতে স্টাইল নিয়ে  আরো গবেষণা করে নতুন কিছু দিবেন । তেমন সীমাবদ্ধতা চোখে পড়েনি। আর বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো চমৎকার। ঘ্রাণটা নাকে লেগেছিলো সর্বক্ষণ। প্রকাশক পরিবার পাবলিকেশন্স এর জন্যও শুভকামনা....

জোছনাপোড়া ছায়া
মাহমুদ নোমান
প্রচ্ছদ : রাজদীপ পুরী
পরিবার পাবলিকেশন্স
মূল্য : ২০০ টাকা



গহীনে আর্তনাদ

গহীনে আর্তনাদ


গহীনে আর্তনাদ
মিশির হাবিব 

গেটের সামনে একটা বাইশ বছুরে ছেলে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো অতিথি এলে প্রথমত জিজ্ঞেস করে- কে আপনি?
তরু সোজাসাপটা উত্তর দেয়- দারোয়ান। তারপরও অনেকে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে- দারোয়ানের কি নাম নেই!
তরু বলে- তরু। উত্তর শুনে অতিথি রেগে গিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিলেও প্রাপ্য ভেবে সে চুপ করে থাকে। পেশায় দারোয়ান হলেও পেশাদার দারোয়ানের মতো খাকি রঙের কোনো পোশাক নেই। বাসার মালিকের নির্দেশ, প্রচলিত দারোয়ানদের মতো কোনো পোশাক পরা চলবে না। ওর সাহেব দেশের নাম করা ব্যবসায়ী। তার নাম যে শুনেনি, তার ব্যবসা সম্পর্কে ধারণা কুয়ার ব্যাঙের আকাশ দেখার সাথে তুলনাসই। অসম্ভব বড়লোক মানুষ। দশ বছর ধরে বাড়ি পাহারায় নিয়োজিত থেকেও তার ব্যবসা সম্পর্কে আঁচ করতে পারিনি তরু। জানার কথা নয়। প্রয়োজনও বোধ করেনি কখনো।
তবে মাঝেমধ্যে শহরের বড় বড় গুন্ডারা তার বাসায় আসে। অথিতিকক্ষে বসে খোশ গল্প করে। টাকা চাইলে দুই তিন বান্ডেল অনায়াসে দিয়ে দেন। দানবীর। দানের বেলায় কার্পণ্য নেই । অন্যদিন এসপি সাহেবও আসেন। তখন গুন্ডারা থাকে না। ভিন্ন উপায়ে খোশগল্প হয়। নিষেধ মতো তরু দারোয়ানের পোশাক পরে না। তার সাহেবের সম্মানে আঘাত লাগে। দেশের সবচে’ বড় ব্যবসায়ীর কয়েক কোটি টাকার বাড়ি। সেই বাড়ির দারোয়ান। অন্য সব দারোয়ানের সাথে তুলনা চলে না।

সাহেব একদিন দুপুরে হম্বিতম্বি করে ছুটতে ছুটতে গেটের দিকে আসলেন। দূর থেকে তরুকে দেখেই বললেন- ‘তরু! এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।’

তরু দ্রুত পা চালিয়ে গেল বিশ্রামকক্ষের টেবিলে দিকে । কাঁচের গ্লাস ভালো করে সাতবার ধুয়ে পানি ভর্তি করে নিয়ে আসে। সাহেবের হাতে দিলো। তার চোখ টকটকে লাল। কপালের ভাঁজে ভাঁজে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেশ চিন্তিত। মানুষ হিসেবে উনি রগচটা। গ্লাস বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে তরুকে থাপ্পড় দিলেন। তরুর কলিজাটি এক মোচড় দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে উনাকে পানি এনে দিয়ে পৃথিবীর মহত্তম কাজটি সে করেছে। তার উপহার সক্ষোভ থাপ্পড়। তরু অনুমান করেছে, উনি বেসামাল রাগান্বিত। এই থাপ্পড় অন্য কারো বাজেট ছিল। প্রকৃত প্রাপককে দিতে না পেরে ওর ঘাড়ে চাপালেন। হয়তো অন্যজন তার নাগালের বাইরে ছিল। তরু নাগালের খুব অনুগত । তাই দুর্বলের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে স্বস্তি অনুভব করেছেন। যার যা পাওনা তাকে বুঝিয়ে না দিয়ে অন্য জনের কাছে ঋণী হওয়া আপাত স্বস্তিকর হলেও শান্তিময় হয় না। তরু নির্বাক চোখে থাপ্পড়ের যন্ত্রণা অনুভব করল। মাত্র একটা থাপ্পড়, সসীম। বেদনার গভীরতা অসীম। ওর সমস্ত ভাবনাকে একীভূত করে দিল। মনের ভেতর যেখানে যত আনন্দ, খুঁজে খুঁজে সবটুকুতে শিকড় ছড়িয়ে বেদনা ঘিরে নিল। তাদের  দুজনের বর্তমান অবস্থান হয়তো উল্টো হতে পারতো। একজন মানুষ ওকে আঘাত করে স্বস্তি পেয়েছেন। সামান্য দারোয়ান, তবু সে মানুষের স্বস্তির কারণ- এই ভেবে নিজেকে শান্ত করে নিল । সাহেব এক নি:শ্বাসে পানি শেষ করবেন ভাবল তরু। তা না করে সাহেব বললেন-
‘পানি আনতে দেরি হলো কেন?’
তরু ভাঙাগলায় বলল- ‘ছার, গেলাসটা ভালা কইরা ধুইচি।’
-গ্লাস ধুতে এতো সময় লাগে?
-সাতবার ধুইচি, ছার। আগেরদিন পানি দেওনের সময় গেলাসে ময়লা আছিল। আফনে কইছিলেন, হেরপর থাইকা সাতবার ধুইতে।
-সাতবার না হলে চৌদ্দবার ধুইবি তবু যেন ময়লা না থাকে।
-জি, ছার।

সাহেব পানি খাবেন ভেবে মুখের কাছে নিয়েও গ্লাস ফিরিয়ে আনলেন।
কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন-
‘পানিতে কি বিষ আছে? তোদের দিয়ে তো বিশ্বাস নেই, কখন কী করে ফেলিস। তুই হা করে একটু খেয়ে দেখা।’

তরু তার হুকুম মেনে হা করে। উনি প্রায় আধগ্লাস পানি ওর মুখে ঢেলে দিলেন। ঠোঁটে গ্লাসের দেয়াল স্পর্শ করেনি। সে গিলে খেয়ে তার দিকে লজ্জার চোখে তাকিয়ে থাকে। যুব দুটি চোখ হয়তো লজ্জা পেতে গিয়ে লজ্জা দিয়ে ফেলে। তরু মরেনি নিশ্চিত হয়ে সাহেব নিশ্চিন্তে পানি খেয়ে তৃষ্ণা মিটানোর চেষ্টা করলেন। আধগ্লাস পানিতে তো দীর্ঘমেয়াদী তৃষ্ণা মেটে না। তরু মনে মনে হাসছিল। সামান্য এক গ্লাস স্বচ্ছ পানির ব্যাপারে যাকে বিশ্বাসের পরীক্ষা দিতে হয়, অথচ তারই কাছে কয়েক শো কোটি টাকার বাড়ি দেখাশুনার দায়িত্ব। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, মালিকের বুদ্ধি কতটুকু কার্যকর?
সাহেব টাই খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করেন-
‘পানি যে খাওয়ালি, কোথা থেকে এনেছিস?’
আরেকটি থাপ্পড় বরাদ্দ হচ্ছে ভেবে ভয়ে ভয়ে তরু বলে-
‘আমার রুম থাইকা।’
-কী! তোর রুম থেকে কেন?
সাহেব হয়তো ভাবেন না, পানি এবং গ্লাসে লেখা থাকে না যে কখন কে কতটুকু খাবে।পানির প্রকৃত মালিকই শুধু তা জানে।
ভাবনা চেপে রেখে তরু বলল-
‘ছার, কাছেপিছে তো পানি পাওন যাইব না। উপরে থাইকা আনতে মেলা সময় লাগব। আফনের তো মেলা তিরাশ। তাই নিয়া আইছি। হেরপর থাইকা উপ্রে থাইকা নিয়া আইব।’

সাহেব কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলেন।

মধ্যরাতে কী যেন একটা গণ্ডগোলের আওয়াজ পেয়ে তরুর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কচলিয়ে বালিশের কাছে সুইচ টিপে লাইট চালু করে সে। বাড়িতে লুটেরা ঢুকেছে ভেবে তড়িঘড়ি করে তিন পায়ে দৌড়াতে থাকে। হাতের মধ্যে একটি বন্দুক। লাইসেন্স করা। সাহেব সপ্তম তলায় থাকেন। তেরো তলা বাড়ির সপ্তম তলায় থাকলে উপর-নিচ দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধে হয়। সপ্তম তলার দরজা খোলাই ছিল। তরু সাহেবের শয়নকক্ষে ঢুকে দেখল, অনেক বড় ভীড়। সাহেব তার প্রিয় দামি সোফায় বসে নাকে-মুখে চিৎকার করছেন। কিছু সময় খেয়াল করে তরু ইতোমধ্যে কারণ খুঁজে পায়।
নিচ তলার ভাড়াটিয়া ব্যরিস্টারের সাথে সাহেবের দীর্ঘশত্রুতা। কর ফাঁকির মামলা নিয়ে বহুদিন ধরে তাকে হেনস্থা করে আসছে। আইনের লোক। কম কথা বলে বেশি টাকা নিবে। উনি কেন এত সাধুতা দেখাতে যান! সাহেব অনেক সাত-সত্তর  বুঝিয়েছেন। ব্যরিস্টার যদি বুদ্ধিমান হতেন, তাকে তো অন্যের বাসায় ভাড়াটিয়া বনতে হয় না। নিজেরই ওমন কয়েকটি বাড়ি থাকতো। কোটি কোটি বুঝিয়েও সাহেব ব্যরিস্টারকে টাকায় নাক ডুবিয়ে কাবু করতে পারলেন না। সবশেষে ব্যরিস্টারের ক্লাস থ্রী পড়–য়া মেয়েকে হত্যার হুমকি দিলেন। সেটাও বৃথা গেল। তাই সাহেব তার পালিত বন্দুকবাজদের নির্দেশ দিলেন যে ব্যরিস্টারের মেয়েটিকে ধর্ষন করে শেষ করে দেয়া হোক। তাদের পারিশ্রমিক তের লক্ষ বাংলাদেশি মুদ্রা। মেয়েটি তখন স্কুলে ছিল। টিফিন বিরতিতে মায়ের জন্য ছাউনিতে বসেছিল। খুব খুশি খুশি মন। আজ মা  মেয়ের জন্য পছন্দের ফিরনি রান্না করে নিয়ে আসবে। মা পেশায় উকিল । সপ্তাহে প্রতিদিন মেয়ের আবদার পূরণের সুযোগ হয় না। তাই সে এই দিনটিই বেছে নিলো। কপাল যে মেয়েটির ইদুরের মা কি তা জানতো? জানলে তো বুকের ধন বুকেই আগলে রাখতো। মা স্কুলে পৌঁছার আগেই সন্ত্রাসীরা মেয়েটিকে মুখ বেধে তুলে নিয়ে গেল। পরিত্যক্ত বাড়ির ছাদে। সবাই বড্ড মাতাল। লাল লাল চোখ। শকুনের মতো তীক্ষ্ন দৃষ্টি। মেয়েটিকে যেন ওরা শিকার পেয়েছে। এইটুকু মেয়ে। হতভাগী হয়তো জানেই না কেন ওকে ধরে আনা হয়েছে। সে ভেবেছে এরা হয়তো ওর আংকেল হবে। অনেকগুলো চকলেট দিবে। বাবার মতই মতিন মামার দোকান থেকে একটি রাজা পুতুল আর রানি পুতুল কিনে এনে দিবে। রাতের বেলা বাবা-মা ঘুমোলে সে রাজা রানির বিয়ে দিবে। দিনে স্কুল থাকে। আম্মু বকে। কিন্তু তা হয়নি। অবুঝ প্রাণিটি কল্পনাও করতে পারছে না, কী ঘটবে তার সাথে। মাতালদের একজন পরনের প্যান্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলল। মেয়েটি ‘মা মা’ বলে চিৎকার শুরু করল। মুখ বাঁধা। ‘মা মা’ ধ্বনি শুধু ‘আ আ’ হয়ে বাতাসে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাতালটি মেয়েটিকে ধাক্বা মেরে কংক্রিটের ছাদের ওপর ধপাশ শব্দে চিৎ করে ফেলে দিলো। যে মেয়েকে জন্মদাত্রী মাও কোনোদিন এইটুকু চড় মারেনি, কতটা অসহ্য এই পাথর-আঘাত, শুধু সেই জানে। মেয়েটির চোখ থেকে একনাগারে স্বচ্ছ অশ্রু বের হয়ে আসে।
চারজন মাতাল ওর চার হাত-পা ছাদের সাথে শক্ত করে আটকে ধরে। মেয়েটির শরীর শক্ত করে জড়িয়ে নেয় দলনেতা। শুরু হয় ক্রমাগত পাশবিক নির্যাতন। এরপর পালাক্রমে বাকী চারজন। অথচ এই অবুঝ মেয়েটি বুঝতেই পারছে না, তার সাথে কী হচ্ছে এসব! সে হয়তো জানে না, এর নাম ধর্ষন। কী নাম আছে বিশেষ অঙ্গের। এই পাশবিক নির্যাতনের জন্য ওর কী অপরাধ, কোনোদিন হয়তো জানা হবে না ওর। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সে চিৎকার করতে চাইছে। মুখে বন্ধন। পারছে না। যন্ত্রণা চেপে রাখার যন্ত্রণা কত যে বিষাদময় তা শুধু এই শিশুটিই বুঝতে পারছে। তার গহীনে আবদ্ধ উৎশৃঙ্খল আর্তনাদ। মেয়েটির মধ্যে যে প্রাণপাখি ছিল, সেটি গলাকাটা বাচ্চা মুরগীর মতো তড়পাতে তড়পাতে পৃথিবী ত্যাগ করল। ছাদের ওপর অশ্রু আর নতুন রক্ত শুষে নিতে ছাদেরও কষ্ট হচ্ছিল বুঝি।
মেয়েটির লাশ ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে খুনিরা কাজ সমাপ্তির প্রমাণ তুলে ধরবে। তাই মেয়েটির থেতলানো ছবি তুলে সাহেবকে দেখাবে। পাওনা বুঝে ভাগাভাগি শেষ করে ঐ মেয়েটির মতই মেয়ের জন্য শখের জিনিস কিনে নিয়ে যাবে। আহা এও সম্ভব!
ঘটনাটি ঘটল তখন, যখন সাহেব ছবি দেখে চিনতে পারলেন, এটা তার ছোট মেয়ে। রেগে মেছো সাপ হয়ে খুনিদের দলনেতাকে টানা পাঁচ মিনিট চড়ালেন। এটাই তার চিৎকারের কারণ ছিল। চিৎকার করে বলতে লাগলেন- ‘বাস্টার্ড! তোরা আমার মেয়েকে চিনতে পারলি না!’
তরুর কিছু বলার ইচ্ছা হয়। বলে না। সাহেব হয়তো জানেন না, ধর্ষিত মেয়ের গায়ে বাবার নাম লেখা থাকে না। একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে তার বাবার নাম যে কারো নাম হতে পারে। ব্যরিস্টার খবর শুনে পুলিশে জানালেন। খুনি পাঁচজন গ্রেফতার হলো। সাহেব অস্থির অস্থির করছেন।
তরুকে পানি আনতে বললেন। তরু দ্রুততম সময়ে চকচকে একটি গ্লাসে পানি নিয়ে এলো।
এসেই বলল- ‘ছার আমি কি অধ্যেক পানি খাইয়া দ্যাহাব?’
সাহেব ধপ করে এক চড় বসালেন। তরু এবার মন খারাপ করল না। চোখ তুলে জানতে চাইল- ‘ছার, বেক খুনি কি ধরা পড়চে?’
সাহেব চোখ আকাশে তুলে আবার থাপ্পড় ছুঁড়লেন। পর পর তিনটি। তরু আর কথা বলে না। চোখ বড় বড় করে সাহেবের চোখে তাকায় । তরুর চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি বের হয়। যেন পুড়িয়ে মারতে পারে হাজার বছরের পুরোনো এই সাহেবদের।

হোম কোয়ারেন্টাইন

হোম কোয়ারেন্টাইন


হোম কোয়ারেন্টাইন
কাজী তানভীর 

সবার স্নেহভাজন আরাফ। অল্প বয়সী হলেও লিখে দারুণ। লেখনিতে সবার হৃদয়স্পর্শ করার মতো যোগ্যতা আরাফের আছে। প্রায় মানুষ ওকে পিচ্চি কবি বলে ডাকে। মনে হচ্ছে ওর এই ডাক-নামটা চিরকাল বেঁচে থাকবে। বয়োজ্যেষ্ঠ হোক কিংবা মারা যাক, এই নাম বেঁচে থাকবে। ‘পিচ্চি কবি’ নামটি লোকদের মুখে এতো সমাদৃত যে, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের সামনেও সবাই ওকে পিচ্চি কবি বলে ডাকবে হয়ত! আর এতে ও খুব আনন্দ পায়। এমনকি পোষা টিয়েটাকেও ওই নামে ডাকতে শিখিয়েছে আরাফ।

ইদানিং আরাফ সকাল-বিকেল পোষা টিয়েটা নিয়েই পড়ে থাকে। বেলকনিতে টেবিলের একপাশে টিয়ের খাঁচাটা রেখে অন্যপাশে খাতা কলমে বসে বসে গল্প, কবিতা লিখে। টিয়ের সাথে খেলেধুলা করে দিন কাটিয়ে দেয়। টিয়ের মনে হাজারো প্রশ্ন। আরাফের কাছে যে তার উত্তর জানবে তাও সুযোগ নেই। আরাফ যে সাধারণ কবি নয় মহাকবি!  সারাদিন ব্যস্ত। কাগজের সাথে কলমের যুদ্ধ তো চলছেই অবিরত।
একদিন দু’দিন নয়, অনেকদিন হলো সে ঘর থেকে বের হয় না। এমনকি নামাজের জন্যে মসজিদেও যায় না। সেটাও ঘরে আদায় করে। সেও বন্দি জীবন কাটাচ্ছে, আমাকে বন্দি করে রেখেছে খাঁচায়। সূর্যের আলো বিছিয়ে পড়া থেকে নিয়ে আলো নিভিয়ে যাওয়া পর্যন্ত একটাই কাজ, ও লিখবে আর আমি দেখব। কীসব যে লিখে!
বুঝিও না। যেমন তেমন প্রশ্ন করলে রেগে মেগে একাকার হয়ে যাবে। অনুমতি নিয়ে বাহিরের হাল চাল দেখে আসি। তারপর না হয় প্রশ্নোত্তর করব। আগামিকাল সকালে বাহিরে বেরুবার অনুমতি নেবো। পরদিন সকাল হলো, যে মাত্র আরাফ বেলকনিতে এল অমনি টিয়ে অনুমতি চেয়ে বসল ঘুরতে বেরুবার।
 -ও পিচ্চি কবি, বাহিরের আলো বাতাস পাইনি বহুদিন, আজ একটু অনুমতি তো দাও। অন্যান্য পাখিরা কত্ত উড়াউড়ি করছে। ঘুরছে ফিরছে।
অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তো বেরুতে দাও।
-আরে টিয়ে বন্ধু, অত আক্ষেপ করে কেন বলছ। যাও। প্রত্যেক প্রাণীই নিজ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এটা তার অধিকার। যাও টিয়ে বন্ধু যাও। ঘুরে এসো।
-আচ্ছা যাচ্ছি। শীঘ্রই ফিরব।

এবার টিয়ে পেখম মেলে ঘুরঘুর করে চারোপাশ উড়ছে। এই গাছ থেকে ওই গাছে বসছে। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রামে যাচ্ছে। টিয়ে ভাবছে, আর মনে মনে বলছে,
-কী এক অবস্থা। একজন মানুষও বাহিরে নেই যে! শুধু কিছু পোষাকধারী লাঠিয়াল মানুষ দেখতে পাচ্ছি। মানুষদের সরব ব্যস্ততা কেমন যেন নিরব হয়ে আছে। নেই কোনো জনসমাগম। নেই বাজার হাট। নেই কোলাহল। নেই অস্তিরতা। সব যেন কেমন স্থির নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাটিতে মানুষদের পদাচারণা নেই। আকাশজুড়ে শুধু পাখিদের সরব আনাগোনা ও মাটিতে মানুষ নয় এমন কিছু প্রাণীদের নড়াচড়া।

বিষণœ মনে টিয়ে বাসায় ফিরে এল।
-কিরে টিয়ে বন্ধু এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?
-আচ্ছা কবি বন্ধু, বল তো দেশের এমন বেহাল পরিস্থিতি কেন? দেশের মানুষরা সবাই কি মারা গিয়েছে? না অন্য কোনো ব্যপার আছে!
-না রে বন্ধু। তেমন কিছু না। ব্যপারটা অন্যরকম একটু। একটা মহামারী। যার নাম নোভেল করোনা। উৎপত্তিস্থল হচ্ছে চীন। ক্রমে এসে পড়েছে আমাদের দেশেও। এটা একটি শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সংক্রমণ ব্যধি। জনসমাগম থাকলে হয়ত সংক্রমণে একজনের কাছ থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে যেতে পারে।
তাই সচেতনতামূলক সব মানুষই নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করছে। এই হলো মূল কাহিনী।
আর আমার একাএকা ভাল্লাগে না তাই তোমাকে আমার কাছ থেকে সরতে দেই নাই। রাগ করো না টিয়ে বন্ধু।
-আরে কবি বন্ধু কী সব বল!  তুমি তো আমার একমাত্র বন্ধু। আমার নিঃসঙ্গের সাথী তুমি, তেমনি তোমার নিঃসঙ্গের সাথী আমিও। আমি তোমার সাথে সবসময় আছি, থাকব।
-অন্তত এমন পরিস্থতিতে আমাকে সঙ্গ দাও। হয়ত তোমার কষ্ট হবে। আমার যে একা একা ভাল লাগে না তার জন্যে বলছি টিয়ে বন্ধু।
-চিন্তা করো না কবি বন্ধু এখন তোমার সর্বোত্তম সঙ্গী হচ্ছে তোমার গল্প, কবিতা আর আমি। দুআ করি সৃষ্টিকর্তা মানুষের উপর থেকে এই মহা মুসিবত ওঠিয়ে নিক।
-টিয়ে বন্ধু তোমরা তো নিষ্পাপ তোমাদের দুআ কবুল হবে বেশি। দুআ করো যাতে করে আমরা এমন মুসিবত থেকে পরিত্রাণ পাই।

এভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন কাটাচ্ছে আরাফের মতো কবিরা গল্প কবিতার সাথে। সঙ্গ পাচ্ছে হাজারো মানুষ তাদের পোষা প্রাণীর। মোটামোটি মন ভালো কাটছে অন্তত এভাবে। প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা যাতে আমাদের প্রতি সদয় হয়। আমাদের প্রার্থনা নিষ্ফল হবে না যদি তাতে থাকে বিশ্বাসের দৃঢ়তা। শুভ কামনা বিশ্ববাসীর জন্যে!