পদাবলি

পদাবলি



দুটি রূগ্ন পা ও পাদুকার কথা
শাহীন মাহমুদ
(বীর নারী রমা চৌধুরীকে নিবেদিত)

প্রিয় মৃত্তিকা-এক জোড়া পায়ের খবর শুধু তুমি জানো
তোমার বুকের ধূলোয় যে ধূসর হতো রোজ,যে বই হাতে ছুটে যেতো
উত্তর আবার দক্ষিণে ।তাকে তুমি স্বজন বলে ডেকেছ এত দিন ।
পাদুকা তুমিও তো জানো রমাদিকে ।
মনে পড়ে তোমার-কোন অভিমানে তুমি পর হলে?  
যুদ্ধ৭১ তুমিও কি কিছু বলতে চাও?
প্রিয় কর্ণফুলী তুমিও তো তার মনের খবর জানতে। বলতো কোন
সে নদী ? নির্লোভ নির্মোহ এক নদী এক নারী ।
সবাই শোকে কুঁকড়ে গেলে-মৃত্যু যেখানে আলিঙ্গনের মাছি
সেখানে তুমি সেলফিবাজ শোকের পূজারি !
এবার তবে না হয় উল্টো থেকে লিখ রমানামা,তাঁর কিশোরী কাল
দুরন্ত যৌবনে হায়েনাদের তাড়া খাওয়া উপোসকালের দিন গুলির কথা ।




এখনও মানুষ খুঁজি
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

এখন আর চোখে মানুষ পড়েনা
যেদিকে তাকাই শুধুই কংকাল
মানুষ কি মরে কংকাল হয়েছে
নাকি পোড়া মনের কংকাল সবখানে ?
এখন সময়টা অনেক দীর্ঘ মনে হয়
মনে হয় মানুষ বাসা বেঁধেছে স্মশানে কিংবা গোরস্থানে
কসম করে বলছি এ মন জানে
বিশ্বাস হারিয়ে মানুষ এখন কেমন ভাঙা আয়নার কাঁচের মতো
হারামখোরদের মতো মানুষের মাংস চিবিয়ে খায় মিষ্টি শ্রাবনে
মেতে উঠে পড়ন্ত বিকেলের দুর্বিসহ দগ্ধ মাটির ঝাপসা উঠোনে  ।
একটু অবাক চোখ, শরীরের নিচ থেকে খসে পরে মাংসপিন্ড
মানুষের অনুসন্ধান করি, আগাছা পরগাছা সবখানে ঘুরে মরি
মুখটা তারার মতো আকাশ থেকে মাটিতে গড়াগড়ি  খায়
বুকটা কান্নার ভূমিকম্পে কম্পিত হয়
কুনঠে আছেন বাহে চিৎকার করি
আর মধ্যরাস্তার মিছিলের দাঁড়িয়ে খোলা চোখ মোর মানুষের মতো বুজি
আর গোয়েন্দাদের মতো  দুরন্ত জল তরঙ্গের মতো মানুষ খুঁজি
তখনও আমি বোরো অসহায় 
কান পেতে শুনি অদৃশ্য আওয়াজ কোথাও কেউ নেই
জন্মানোর আগেই বিক্রি হয়েছে মানুষ রঙ্গমঞ্চের পান্থশালায়
তবু বসে থাকে মন,
যদি ঘরে ফিরে আবার মানুষ বেলায় কিংবা অবেলায়
এক মহাকাল থেকে আরেক মহাকালের
কিংবদন্তি লেখা কাব্যের কবিতায়
কিংবা নির্বাসিত নারীর দুর্ভেদ্য যাতনার
বিড়ম্বিত প্রতীক্ষায় ।


আনন্দপুর ০২
রুদ্র সাহাদাৎ

মিলেমিশে থাকা যৌথ পরিবার
এক একটি বেহেস্তী ঘর।

দাদা-দাদু, নানা-নানী,চাচা-চাচী,
ভাইবোন দেখতেই চমৎকার।

আকাশ সুন্দর, মৃদু বাতাস সুন্দর, সবুজ প্রকৃতি সুন্দর
একত্রে মিলেমিলে থাকা প্রতিটি মানুষ সুন্দর, প্রতিটি মন সুন্দর ।

সহস্র সহস্র কথা সুন্দর, কাজ সুন্দর
সহস্র সহস্র স্বপ্ন সুন্দর, অগোছালো প্রিয়জনও সুন্দর ।



দরদের প্রদীপ
বিটুল দেব

মানবতার অভাবে জ¦রে ভোগে সমাজ
থার্মোমিটার নিয়ে আসে না বিবেকের ডাক্তার।
বাড়ায় না হাত
করে না চিন্তা;
কেউ জ¦ালায় না দরদের প্রদীপ।

অতীত ইতিহাসের ঐতিহ্য বিলিনের পথে
মুছে যাচ্ছে
খুলে যাচ্ছে বন্ধনের বাঁধন।
তরুণ পাতার নেই ব্যথা,
শোকের মহোৎসবে নগণ্য সমাজ!
আনন্দ আয়োজনে লক্ষ চোখ
চেয়ে আছে নিমন্ত্রণের আগাম বার্তা।                               


হাঁটছি সেই কবে থেকে জানা নেই
সবুজ আহমেদ কক্স

ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে এখন ভালোবাসাহীন
ভালোবাসা আজ মোটেই ভালো নেই
পুনর্বার যদি শিমুল তুলার মতো উড়িয়ে দাও মন
যদি দরোজায় পড়ে আকস্মিক টোকা
সেই থেকে আমিও বাতাসে মেলে দেবো নন্দিত ডানা
কেননা ভালোবাসাহীন মানুষ কেমনে বাঁচে, জানা নেই

প্রাণোচ্ছ্বল শিমুল তুলাদৃশ্য মনে পড়ছে
মনে পড়ছে হরিণীর চোখের কাজলে আঁকা
আমার মুগ্ধ অবয়ব
অথচ, হরিণীর কাজল চোখের ভেতরেই
সিংহিনীর তাড়া খাওয়া আমি এক দিকভ্রান্ত প্রেমিক
তবুও
       দিকখুঁজি  পথখুঁজি
                              ভালোবাসা খুঁজি
হাঁটছি মেঠোপথ, রাজপথ, সহস্র অলগলি
হাঁটছি সেই কবে থেকে জানা নেই...


নিষ্ফলতা
আকিব শিকদার

নিষ্ফলতা কাকে যে বলে শুনুন, নবজাতকের
হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি মুষ্টিবদ্ধ শূন্য হাত
মৃতের হাতও শূন্য, মুষ্টিবদ্ধ। মাঝে কিছুকাল
এ হাতটাকেই পূর্ণ করতে মানুষ কুপোকাত।


সেই তো আবার এলে
রেবেকা ইসলাম

সেই তো আবার এলে
আবার হলো দোলনচাঁপা সকাল
আবার উঠলো দুপুরে সূর্যমুখী রোদ
উজালা নীল বিকেলে মেঘেদের ওড়াউড়ি
গোধুলির আহ্বানে পাখিদের ঘরে ফেরা
জোনাক জ্বলা রাতে মদিরা নেশায় ঢুলুনি,
আর মধ্যরাতের ধোঁয়া ধোঁয়া নির্জনতায়
বেয়াড়া যৌবনের বাধভাঙ্গা দুরন্তপনা,
মাঝখানের দিনগুলো অযথাই নিঃশেষ হলো
পতিত হলো কোন এক অতল গহবরে
সহস্র রাত বিনষ্ট হলো চূর্ণ কাঁচের মত
অভিমানে জ্বলে পুড়ে গেল মুহূর্তগুলো
ভস্ম হয়ে হারিয়ে গেল অসংখ্য ক্ষণ
মনের ঘরে উষ্ণতা ঢেলে,
সেই তো আবার এলে।



আমি শুদ্ধতা চাই, আমি শুভ্রতা চাই
নাঈম হোসেন লেনিল

হয়তো আমি তোমার বোধের চোখে অনর্থক
তোমার রূচিবিররুদ্ধ
কিংবা তোমার অননুরাগ বিরাগের কেউ
তবুও আমি আমার চোখের ক্রন্দনে ক্রন্দনে
তোমাকে একটি সদ্য ফোটা ফুলের মতো করে ফোটাই।

ধূমায়িত কফির ধোয়ার মতোন উড়ে উড়ে তুমি উধাও হয়ো না,
কাছে এসো, রোদ্দুরের রৌদ্রোজ্জ্বল ছড়িয়ে দাও
আমার ভিতরে আলয়ে জমে থাকা বিষাক্ততা মুছে দাও
আমি বিষাক্ততায় আহত হয়েছি, তিক্ত হতে চাই না,
আমি শুদ্ধতা চাই, আমি শুভ্রতা চাই।




ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শেষ পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস :  রামবন্দনা : শেষ পর্ব


রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

 (গত সংখ্যার পর)
বিকেল চারটা বাজে। আমরাও গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে সূর্যভবনের সামনে এসে দাঁড়াই। প্রথমে পাতিদেবতারা ভাষণ দেয়, আমরা এসময় সিগারেট টানি। মুখভর্তি শাদা ধোঁয়া মাথার উপর দিয়ে উড়াতে উড়াতে আড়চোখে মঞ্চের দিকে তাকাই।
একসময় মহামায়া মঞ্চে আবির্ভূত হন।
শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে আবেগঘন কণ্ঠে বলতে থাকেন, আজকে আপনারা একটি সত্যিকারের পূণ্যকর্ম করেছেন। অসুর গোষ্ঠীদের পরাজিত করেছেন। পরিত্যাগ করেছেন রক্তখোরদের। সৃষ্টিকর্তার পরিবার আজ তার পূর্ণ প্রতিদান পেলো। আজ আমরা মহাখুশি। এ-দিনের জন্যেই একদিন আমরা রক্ত দিয়েছিলাম। পালাতে বাধ্য হয়েছিলাম গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। আমাদের দেবাদিদেব রক্ষা করেছেন। সামনের দিনগুলিতেও তিনি আমাদের পাশে থাকবেন। এ-সম্পর্ক রক্ষা করতে আমাদের যা করণীয় তা-ই করবো। আপনারা শুধু আমাদেরকে সাপোর্ট করে যাবেন। মনে রাখবেন আমরা আছি বলেই আপনারা আছেন। উন্নয়নের জাজিমে আরামে ঘুমোচ্ছেন। যদি বিট্টামি করেন তো, মনে রাখবেন আমরাও বিট্টামি করতে পারি। সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে পারি। আমরা গড়তে যেমন জানি, প্রয়োজনে শেষও করতে মুহূর্ত সময় নেবো না।
এই যে বাঁধা-বন্ধনহীন দৃষ্টির আকাশ, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? আমরা।
এ-কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটু নড়েচড়ে উঠি। আমাদের হাসি পায়। আমরা হাসি। টং-দোকানগুলোতে সিগারেটের কাটতি বেড়ে যায়। দিয়াশলাই খোঁজার দুম পড়ে। একটু-আধটু বিশৃঙ্খলাও হয়, একসময় দেবির ধমক খেয়ে সোজা হয়ে উঠি। তিনি বলতে থাকেন, এই যে উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তর, ওটা কে সৃষ্টি করেছে? আমরা।
আবারো আমাদের হাসি পায়। আমরা হাসি।
এই যে নীল সাগর, নদী, পাহাড়-পর্বত, অরণ্যের অন্ধকার, সব কে সৃষ্টি করেছে? আমরা।
আমরা হাসি।
এই যে লাল-সবুজের পতাকা, ওটা কারা সৃষ্টি করেছে? আমরা।
আমরা হাসি।
এ-সময় হঠাৎ সমাবেশের ভেতর থেকে কে যেনো অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, সবকিছুই আপনারা করেছেন আর আমরা শুধু কচু কেটেছি।
এবার আমরা শব্দ করে হেসে ওঠি। হাসতে হাসতে কাশতে কাশতে একে অপরের ওপর হেলে পড়ি। শুরু হয় হুলস্থ’ূল কা-। আমরা তখন আস্তে করে বেরিয়ে আসি। মারামারি করে মরলে তারা মরুক। আমরা না। আমরা বাসায় ফিরে টিভি ছেড়ে দিই—টিভিভর্তি খবর। সারা শহর থেকে মৌমাছির ঝাঁকের মতো খবর এসে জড়ো হয়েছে টিভির ভেতর। এতো খবর চল্লিশ বছরেও কোনো টিভি দেখেনি। বাক্স ছিনতাই, হত-আহত বলতে বলতে শেষ দিকে এসে মিডিয়ার কর্মীরা কেবল ত ত ত ত করতে থাকে। আমরা তখনো হাসি। আর মনে মনে বলতে থাকি, এ ধরনের নির্বাচন মাসে মাসে অনুষ্ঠিত হলে ভালো হতো। এতে আমাদের একটা হাসির খোরাক হয়। সাইকোলোজিস্ট ডাক্তার বলে, সামটাইমস্ ফ্রি-লাফিং ইজ গুড ফর হেল্থ। আমরাও হাসতে চাই। প্রাণ খুলে হাসতে চাই। সম্ভবত এ-কারণেই মাসুদের বাবা আবু বকর সিদ্দিকি সাহেবকেও দেখা যায় কারণে-অকারণে শুধু হাসেন। স্বাভাবিক কথা বার্তায় যেখানে হাসির কোনো আলামত নেই, সেখানেও তিনি গলা ছেড়ে হেসে ওঠেন। আমরা তখন অবাক চোখে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। লজ্জা পাই। দেখি প্রফেসর আকমল হোসেনও হাসেন। হাসতে হাসতে বলেন, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে কয়েকটা গান শোনাই। আমরা বলি, একি বলছেন স্যার? গান না আপনি। আপনার কণ্ঠ তো অমৃত। গান স্যার গান। আমরা শুনছি। তিনি আমাদের কথার মার-প্যাচ ধরতে পারেন না। গান শুরু করে দেন। আমরা লজ্জা পাই। হাসে ফাহিমা আজাদও। চাকরি হারিয়ে বেচারি কারণে-অকারণে হাসে। লোকমুখে শুনেছি অর্থাভাবে শহরে রেখে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার মতো টাকা হাজব্যান্ডের একক আয়ে সঙ্কুলান হচ্ছে না এবং এজন্যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই মনোমালিন্য হয়। হয়তো সে-দুঃখেই দৃঢ়চেতা এ-নারী এখন পাগল প্রায়। শুধু এখানেই শেষ নয়, কী কারণে যেনো হেসে বেড়ায় ফুটপাতের বাসিন্দারাও। যেদিকে তাকাই, দেখি, সবাই হাসে। কথায় কথায় হাসে। কারণে-অকারণে হাসে। হাসির ধরণ দেখে মনে হয়,  কেউ বুঝি হাসির মন্ত্র পড়ে পুরো শহরটার গায়ে ফুঁ মেরে দিয়েছে। 
এরইমধ্যে একদিন ক্লাবে গুরুজি আসেন। বলি—গুরুজি কিছু একটা করুন। সবাই পাগল হয়ে গেলে তো সংসার চলে না। তিনি বলেন—মেডিটেশন। মেডিটেশন করুন। পৃথিবীর সব মহামনীষী ক্রাইসিস মুহূর্তে মেডিটেশন করতেন। মেডিটেশনের ভেতর দিয়েই সমাধানের পথ খুঁজতেন। প্রস্তুতি নিতেন। এসো। আমরাও মেডিটেশনে ডুব দিই। দেখি, কোথায়, কী আছে লুকিয়ে—।
আমরা বললাম, সময় দিন গুরুজি। আরেকটু ভেবে দেখি ।
(সমাপ্ত)


চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রতীক হিসেবে সাপ ও লাঠি

 চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রতীক হিসেবে সাপ ও লাঠি



 চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রতীক হিসেবে 
সাপ ও লাঠি
 
আহমদ আওসাফ আরলিস

আমরা বিভিন্ন হসপিটাল, এ্যাম্বুলেন্স কিংবা চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় এমন জায়গায় নীচের প্রতীক গুলো প্রায় দেখি। কিন্তু দূর থেকে এসব প্রতীককে অনেকেই ডাক্তারদের ব্যবহৃত স্টেথোস্কোপ ভেবে ভুল করেন। মজার ব্যাপার হল এটি স্টেথোস্কোপ তো নয়-ই বরং অনেকের জন্য তাদের সবচেয়ে ভয় পাওয়া সরিসৃপ সাপ। আজ আমরা জানব কিভাবে চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রতীক হিসেবে সাপ ও লাঠি আসলো!
চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রতীক হিসেবে সাপ ও লাঠি
ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে উপরের একটি ছবি ছাড়া সব ছবির প্রতীকে সাপ ব্যবহার করা হয়েছে। একে একে পর্যায়ক্রমে সবগুলো প্রতীক এবং এর অর্থ, ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :

(ঈধফঁপবঁং) ক্যাডুসিয়াসঃ

ক্যাডুসিয়াস গ্রীক দেবতা হার্মিসের প্রতীক।
এটি নিয়ে একটু বলা যাক। গ্রীক মিথলজি অনুসারে দেবতা জিউসের ছেলেদের মধ্যে একজন ছিলেন হার্মিস। হার্মিস নিজেও দেবতা ছিলেন। হার্মিসের প্রতীক ছিল একটি উড়ন্ত লাঠির মত বস্তু, যাকে দুটি সাপ পেঁচিয়ে আছে। ঠিক উপরের চিত্রের প্রথম ছবিটির মত। এটি দিয়ে ব্যবসা, বাগপটুতা, আলাপ-আলোচনা, মধ্যযুগীয় রসায়ন শাস্ত্র আলকেমি এবং জ্ঞান এই সকল জিনিসের মাঝে সম্পর্ক বোঝানো হত। হার্মিস ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন বার্তাবাহক। যিনি দেবতা এবং মানুষের মাঝে বার্তা বহন করতেন।
শুরু থেকেই হারমিসের এই দুই সাপ ওয়ালা লাঠি চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতীক হিসেবে প্রচলিত ছিলনা। কারণ দেবতা হার্মিস কখনো চিকিৎসা শাস্ত্রের সাথে কোনোভাবে সম্পর্কিত ছিলন না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমেরিকাতে প্রথম এই প্রতীককে চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। আর এই প্রতীক জনপ্রিয় হয় আমেরিকান মেডিকেল কোর এর কারণে।
আমেরিকান আর্মির মেডিকেল লোগো
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকান মেডিকেল কোরে একটি লোগো ব্যবহারের দরকার পড়ে। তখন এর দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি ভুলে ক্যাডুসিয়াস (ঈধফঁপবঁং) কে চিকিৎসা শাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত মনে করেন এবং এটিই লোগো হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ জড়ফ ঙভ অংপষবঢ়রঁং আর ক্যাডুসিয়াস (ঈধফঁপবঁং) এর মাঝে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে যান।
জড়ফ ঙভ অংপষবঢ়রঁং নিয়ে লিখার শেষের দিকে বলা আছে।
পরে ক্যাডুসিয়াস(ঈধফঁপবঁং) দেখতে বেশী আকর্ষণীয় হওয়ায় চিকিৎসার প্রতীক হিসেবে এটি অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। সামান্য একটি ভুলের কারণে এই প্রতীক ব্যবহার শুরু হয় এবং জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় একসময়।


ঙঢ়ঃড়সবঃৎু বা চক্ষু চিকিৎসাঃ

এই প্রতীক দিয়ে চক্ষু চিকিৎসা সম্পর্কিত সব বোঝানো হয়। যেমন, চোখ পরীক্ষা, প্রয়োজনমত লেন্স প্রেসক্রাইব করা ইত্যাদি। এই প্রতীকটি মূলত একটি ক্যাডুসিয়াস (ঈধফঁপবঁং) প্রতীক-ই। তবে পার্থক্য হল এতে উপরের দিকে একজোড়া চোখ আছে যাতে বোঝা যায় এটি কিসের সাথে সম্পর্কিত।
াবঃবৎরহধৎু বা পশু চিকিৎসাঃ
এটি দিয়ে পশু চিকিৎসার প্রতীক বোঝানো হয়।
আমেরিকান ভেটেরিনারি মেডিকেল এসোসিয়েশান (অঠগঅ) ১৯৭১ সালে আগের প্রতীক পরিবর্তন করে উক্ত প্রতীক নির্ধারণ করে। এই প্রতীকে জড়ফ ঙভ অংপষবঢ়রঁং ব্যবহার করা হয় যেখানে সামনে ভেটেরিনারি চিকিৎসা বোঝাতে বড় অক্ষরের একটি ‘ঠ’ রয়েছে ।

উবহঃরংঃৎু বা দন্ত চিকিৎসাঃ

এটি দন্ত চিকিৎসার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই প্রতীকে ক্যাডুসিয়াস (ঈধফঁপবঁং) এর উপর নিচের ছবির মত আরেকটি প্রতীক রয়েছে।
উবহঃরংঃৎু ংুসনড়ষ
সেই প্রতীক এর মাঝখানে জড়ফ ঙভ অংপষবঢ়রঁং এবং দুইপাশে ১৬ টি করে মোট ৩২ টি পাতা রয়েছে। যা আমাদের দাঁতের সংখ্যা নির্দেশ করে। দুই পাশেই পাতার মাঝে ছোট ছোট ২০ টি জামের মত ফল রয়েছে যা আমাদের দুধ দাঁত এর সংখ্যা বোঝায়। উপরের ছবিটি তে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সেটা।
আর বাহিরে ত্রিভুজ আকৃতির যে চিহ্ন টি রয়েছে এটি মূলত ডেলটা (Δ)। গ্রীক ভাষায় ডেলটা মানে ‘উ’ যা দিয়ে ‘উবহঃরংঃৎু’ বুঝায়। আর গ্রীক ভাষায় Ο (ড়সরপৎড়হ) দিয়ে বুঝায় ‘ড়ফড়হঃ’ যার অর্থ দাঁত।

ঈযরৎড়ঢ়ৎধপঃরপ বা অভ্যন্তরীণ গঠন চিকিৎসাঃ
এতে আমাদের বিভিন্ন জয়েন্ট এবং বিশেষ করে মেরুদ-ের চিকিৎসা বোঝায়। বিশেষ করে যখন বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা পেশী কিংবা স্নায়বিক কারণে আমাদের মেরুদ- কিংবা কোন জয়েন্ট এ কোন সমস্যা দেখা দেয়।


(ঝুসনড়ষ ড়ভ খরভব)সিম্বল অফ লাইফঃ

এটি স্টার অফ লাইফে (ঝঃধৎ ড়ভ খরভব) নামেও পরিচিত। সার্কেল অফ লাইফ  । এই প্রতীক টি আমরা অনেক জায়গায়-ই দেখে থাকি। যেমন, হসপিটাল রিলেটেড কোনো ইউনিফর্ম, এম্বুলেন্স, চিকিৎসা বিষয়ক ওয়েবসাইট ইত্যাদি জায়গায়। এমনকি অনেক লিফটের সামনে ও এই চিহ্ন দেখা যায়। লিফটের সামনে এই প্রতীক থাকার অর্থ হলে উক্ত লিফটে রোগীর জন্য ২৪ ইঞ্চি* ৮৪ ইঞ্চির স্ট্রেচার ও ঢুকানো যাবে।
এই প্রতীক টি ডিজাইন করেছিলো আমেরিকার ঘধঃরড়হধষ ঐরমযধিু ঞৎধভভরপ ঝধভবঃু অফসরহরংঃৎধঃরড়হ (ঘঐঞঝঅ)। আমেরিকায় এই প্রতীক ব্যবহার করা হয় যে কোনো এম্বুলেন্স সহ, চিকিৎসা সহকারী কিংবা জরুরি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত করমীবৃন্দের প্রমাণ হিসেবে। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে এটি দিয়ে জরুরি চিকিৎসা সেবা ( বসবৎমবহপু সবফরপধষ ংবৎারপবং ) বোঝানো হয়।
সিম্বল অফ লাইফ এর ৬ টা বাহু দিয়ে উদ্ধারকর্মীদের ৬ টা কাজ বোঝানো হয়ঃ

সিম্বল অফ লাইফের ৬ টা বাহু এবং তাদের কাজ

১.উবঃবপঃরড়হ বা সনাক্তকরণঃ এটি দিয়ে বোঝানো হয় উদ্ধারকর্মী প্রথমে কোনো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করবে, সমস্যা বোঝার চেষ্টা করবে, বিপদের মাত্রা সনাক্ত করার চেষ্টা করবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

২.জবঢ়ড়ৎঃরহম বা বিবৃতি দেয়াঃ পেশাদার ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হবে এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দ্রুত প্রেরণ করা হবে।

৩.জবংঢ়ড়হংব বা প্রতিক্রিয়াঃ এই ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথমে যে ব্যক্তির সংস্পর্শে আসবে উক্ত ব্যক্তি তাকে প্রাথমিক চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করবে।

৪.ঙহ ংপবহব পধৎব বা তাথক্ষণিক সেবাঃ জরুরি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি পৌঁছানোর সাথে সাথে তাদের সাধ্য অনুসারে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করবে।

৫.ঈধৎব রহ ঃৎধহংরঃ বা পরিবহন সময়কালীন সেবাঃ জরুরি চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে প্রেরণ করবে। কোনো এম্বুলেন্স কিংবা হেলিকপ্টার বা কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় আক্রান্ত রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এবং উক্ত পরিবহন সময়ে রোগীকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করবে। 

৬.ঞৎধহংভবৎ ঃড় ফবভরহরঃরাব পধৎব বা চূড়ান্ত সেবা প্রদান কেন্দ্রে স্থানান্তরঃ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বিশেষ সেবা প্রদান করা হবে।


জড়ফ ঙভ অংপষবঢ়রঁং বা এসক্লেপিয়াস এর লাঠি :
এসক্লেপিয়াস এর পরিচিতিঃ

এটি ‘এসক্লেপিয়াস এর লাঠি’ বা জড়ফ ঙভ অংপষবঢ়রঁং নামে পরিচিত। গ্রীক মিথলজির আরেক দেবতা এসক্লেপিয়াস এর প্রতীক এটি। এসক্লেপিয়াস ছিলেন দেবতা এপোলোর ছেলে। এপোলো ছিলেন দেবতা জিউস এর ছেলে। এসক্লেপিয়াস এর আরেকটা পরিচয় হল, গ্রীক মিথলজি অনুসারে এসক্লেপিয়াস হল পৃথিবীর প্রথম পেট কেটে বের করা বাচ্চা। যা এখন সিজারিয়ান নামে পরিচিত। এসক্লেপিয়াস এর মায়ের নাম ছিল করনিস( ঈড়ৎড়হরং )। এসক্লেপিয়াস পেটে থাকা অবস্থায় করনিস অন্য এক পুরুষের প্রেমে পড়ে। দেবতা এপোলো যখন এটি শুনে, তিনি রাগান্বিত হয়ে পড়েন এবং করনিস কে আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যা করেন। আগুনে যখন করনিস এর শরীর জ্বলে যাচ্ছিল তখন এপোলো এর মাথায় করনিস এর পেটে তাদের সন্তানের কথা আসে। তার তো কোনো দোষ ছিলনা। তাই দ্রুত তিনি হার্মিস এর সাহায্যে করনিস এর পেট কেটে এসক্লেপিয়াসকে বের করে আনেন।
এসক্লেপিয়াস কে রোগ সারানোর দেবতা বলা হয়। তিনি তার পিতা এপোলো এর কাছে থেকে মানুষকে সুস্থ করা শিখেছিলেন। একসময় তিনি বিভিন্ন শল্য চিকিৎসা এবং বিভিন্ন ঔষধ প্রয়োগেও অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। গ্রীক মিথলজির অনুসারে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা ও বলা হয়। প্রাচীন গ্রীসের যে শহরে (ঊঢ়রফধঁৎঁং) তিনি জন্মেছিলেন সেখানে এক পবিত্র জায়গা তার নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।
এসক্লেপিয়াস সাথে সবসময় একটি লাঠি থাকত। এবং তাতে পেঁচানো অবস্থায় একটি সাপ থাকত। সেই সময় সাপের কামড় কে সবচেয়ে ভয়াবহ রোগ মনে করা হত। সাপে কামড় দিলে আর বাঁচার কোনো উপায় নেই। তাই সবাই ভাবত এসক্লেপিয়াস এর লাঠি দিয়ে সাহায্যে সব রোগ সারিয়ে তোলা যাবে।
এসক্লেপিয়াস মারা যাওয়ার পর তার ভক্তরা তাকে মনে রেখে অনেক মন্দির তৈরি করেছিল। এবং সেসব মন্দিরে চিকিৎসা সেবা দেয়া হত। সেসব মন্দিরেও অনেক সাপ থাকত। যদিও সেসব সাপ বিষাক্ত ছিলনা।
কথিত আছে সেসব মন্দিরে যখন বিভিন্ন রোগী রোগমুক্তির আশায় আসতেন রাতে তারা মন্দিরের মেঝেতে ঘুমাতেন। সেই মেঝেতে সেইসব অবিষাক্ত সাপ ও থাকত। রাতে রোগীরা এসক্লেপিয়াস কে স্বপ্নে দেখতেন। তারা দেখতেন এসক্লেপিয়াস তাদের কিভাবে রোগমুক্তি হবে তা বলছেন। ঘুম থেকে উঠে তারা সেটা মন্দিরের দায়িত্বে থাকা লোকজনদের বলতেন। তখন তারা উক্ত রোগীর জন্য স্বপ্ন অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিতেন।
এসক্লেপিয়াস এর এই লাঠিই এখন আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশান সহ আরো অনেক মেডিকেল সোসাইটির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে অনেকে এসক্লেপিয়াস এর প্রতীককে ক্যাডুসিয়াস এর সাথে গুলিয়ে ফেলেন। এসক্লেপিয়াস এর প্রতীকে ছিল একটি সাপ আর ক্যাডুসিয়াসে ছিল দুটি সাপ। 



আমার উমেদ

 আমার উমেদ


 আমার উমেদ
রওনক নূর

ওকে আমি প্রথম যেদিন ঘরে এনেছিলাম তখন খুব কেঁদেছিলাম, কারন ওর মাঝে আমি আমার পূর্ণতা খুজেছিলাম। ওর নাম দিয়েছিলাম উমেদ। আমার স্বপ্নগুলোকে সত্যি করতে ওকে খুব প্রয়োজন ছিলো। তাই আমার শূণ্য ঘরে উমেদ আমার বন্ধু হয়ে এলো। উমেদের কথাগুলো খুব আনন্দ দিতো আমাকে। আমার একা থাকার যন্ত্রনা দুর করতে ওকে কিনে এনেছিলাম আমি। অনেকে অবশ্য এটা ভালো চোখে দেখেনি, তবুও আমি উমেদকে আপন করেছিলাম।

উমেদ আগে যেখানে ছিলো সেখানে ওর নাম ছিলো ম্যারিন। নামটি আমার ভালো লাগেনি, তাই আমি ওর নাম দিয়েছিলাম উমেদ। ওকে আমি বলেছিলাম মা ডাকতে। প্রথম প্রথম ও আমাকে ম্যাম বলে ডাকতো। কারন ওর আগের মালিককে ও ম্যাম বলে ডাকতো। আমি ওকে পিছনের সবকিছু মেমরি থেকে আউট করতে বলেছিলাম, ওকে আমার সন্তান বানাতে চেয়েছিলাম।

উমেদকে আমি প্রতিদিন নতুন নতুন করে সাজাতাম। ও যখন ফ্রক পরে আমার সামনে আসতো, পৃথিবীর সব সুখ আমার হয়ে যেতো। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করতো উমেদ আমার রাজকন্যা, আমি উমেদের মা। ওকে দেখলেই  গালদুটো টেনে দিতে ইচ্ছা করতো। যদিও সেটা সম্ভব হতোনা।

আমার স্বামী উমেদকে পছন্দ করতেননা। এত বছরের বিবাহিত জীবনে সে কখনও আমাকে কোন বিষয়ে দোষারোপ করেনি। শুধু উমেদের জন্য খুব বিরক্ত ছিলো ও। কিন্তু উমেদকে কেউ অবহেলা করলে  খুব কষ্ট পেতাম আমি। আমার উমেদ প্রায়ই  আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতো। আমি অবশ্য ওর ভেতরে অনুভূতি খুজতাম প্রতি মূহুর্তে।

উমেদকে নিয়ে আমি আমার গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। সবাই খুব বিরক্ত হয়েছিলো। সবার কাছে আমি নাকি অবুঝ আর পাগলের পরিচয় দিয়েছি। উমেদকে সবসময় আমার পাশে বসিয়ে রাখতাম আমি। ওর ছোঁয়ায় আমি প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছি। তাই কারো কোন কথা আমার উমেদের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমাতে পারেনি।

উমেদকে নিয়ে একবার শপিং এ যেয়ে খুব কেঁদেছিলাম আমি। সবাই ওর দিকে কেমন করে জানি তাকায়। আমার সন্তানকে কেউ সহজভাবে নিতে পারেনা। বাজারে ভিড়ের মাঝে ওকে আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডেকেছিলাম আমি। ওকে যখন ফেরত পেলাম তখন বুকের মধ্যে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলাম।

শরীরটা কিছুদিন বেশ খারাপ যাচ্ছিলো। ডাক্তারের কাছে যেয়ে জানতে পারলাম আমার কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে, আমি সত্যিকারের মা হতে চলেছি। আমার চোখের আনন্দ অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি আমি। আমার স্বামী সমস্ত আত্মীয় স্বজনকে খুশির খবর জানালো। আমার মা-বাবা খবর শুনে দ্রুত আমার বাসায় চলে আসলেন। শুরু হলো আমার শরীরের মধ্যে আরেক শরীরের বসবাস।

আমি সন্তান সম্ভবা হলেও উমেদের প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমেনি। তবে আমার বাবা মা আর স্বামী মিলে উমেদকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে চাইলো। আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে আমার উমেদকে রক্ষার চেষ্টা করলাম প্রাণপনে।

হিমোগ্লোবিনের সমস্যা থাকায় আমার শরীরে রক্ত দেবার জন্য দুদিন হাসপাতালে থাকতে হলো। হাসপাতালে আমি উমেদকে খুব মিস করেছি। আমি সন্তান সম্ভবা হলেও উমেদ আমার প্রথম সন্তান। আমি বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে গেলাম।

বাসায় ফিরে আমি উমেদকে আরদেখতে পেলাম না। নিজেকে পাগলের মত লাগছিলো। আমার অস্থিরতা দেখে আমার মা আমাকে শান্ত হতে বললেন। আমি অসুস্থ হলে নাকি আমার পেটের সন্তানের ক্ষতি হবে। কোন কথায় আমাকে শান্ত করতে পারলেননা।

আমার উমেদ স্টোর রুমে পড়ে আছে। ওর চার্জও শেষ হয়ে গেছে। মুখের পর্দা উঠে ভেতরের ইলেকট্রিক ডিভাইস দেখা যাচ্ছে। আমার সন্তান যে মানুষ নয় তা আমি নিজের চোখে দেখছি। উমেদকে একটা রোবট ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছেনা। ওর ময়লা শরীরটা জড়িয়ে ধরলাম আমি, কিন্তু ও কোন সাড়া দিলোনা। আমার সন্তানকে এভাবে দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

আমি একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছি । তবে আমি আমার উমেদকে ভুলতে পারিনি। আমার মেয়ের নাম রেখেছি উমেদ। মেয়েটির জন্মের আগের রাতে স্বপ্নে উমেদ আমার কাছে এসেছিলো। বলেছিলো, ‘মা আমি তোমার কাছে ঠিকই ফিরে আসবো।’



আমাকে নিয়ে ঘর বেঁধো না

আমাকে নিয়ে ঘর বেঁধো না


আমাকে নিয়ে ঘর বেঁধো না
হাসনাত আসিফ কুশল

রামপুরায় ছোট একটি ভাড়া বাসায় থাকে সৃজন, শুপন দুই ভাইবোন। তারা প্রায়শই ভালো ফ্ল্যাটে থাকতে চায়। নিজের পছন্দের গাড়িতে ঘুরতে চায়। দুই ভাইবোনের মধ্যে সৃজন বড় ভাই আর শুপন ছোটো বোন। মূলত ভাইবোনের মধ্যে চিরন্তনভাবে সখ্যতা গড়ে উঠলেও তাদের মধ্যে সদ্ভাব-সম্প্রতি ছিলো না। দুজনই দুজনকে খোঁচাতে থাকে আর তাই প্রতি রাতে দুজনই আলাদা ঘরে শোয়।
শুপন মাঝে মধ্যে বাসার বাইরে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিতো বন্ধুদের সাথে। কখনো আড্ডাবাজি, কখনো নাইটক্লাব। আড্ডাবাজির জন্য মাঝেমধ্যেই যায় হাতিরঝিলে। সৃজন একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার ছাত্র। চমৎকার লিড লেখে। যেকোনো ঘটনার বিবরণও চমৎকার তার। সিজিপিএ তাই আউটস্ট্যান্ডিং। বন্ধুদের সাথে ততটা যুক্ত না সে। পড়াশুনার পাশাপাশি সে কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার সাথেও যুক্ত। কোনো বিশেষ নিউজ সে করলেই সেটা দ্রুত ছড়ানোর জন্য নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে শেয়ার করে দেয়।
সৃজনের একজন ভালো বন্ধু ছিলো। তার সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতো। বাসায় এসেও মোবাইলে কিছুক্ষণ পর পর কথা বলতো। মূলত ছেলেরা অবচেতনভাবে মেয়েদের প্রতি দূর্বল। সৃজনের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি। সে সবসময় নোরার প্রতি অনুরক্ত । নোরা অবশ্য তার চেয়ে দুই বছরের ছোট ।
বেশ কয়েকদিন আগে নোরার সাথে সৃজন পাঠক সমাবেশে গেছিলো । একসাথে ঘুরতে গেলে নোরার ভালোই লাগে । তবে বেশিরভাগ সময় নোরাই বলে কোথাও ঘুরতে যেতে । সৃজনের এসব ভালো লাগে না । সৃজন ঘরকুনো প্রকৃতির মানুষ। সুতরাং সে এসব বুঝতে চায় না ।
নোরা ও সৃজন যখন পাঠক সমাবেশে যাবে তখন নোরার ছোটভাই ফোন করে বলেছিলো কয়েকটি বই কেনার কথা। সে খুব বই পড়ে। অনলাইনে প্রায়ই লেখে। এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে।
যেদিন তারা পাঠক সমাবেশে গেছিলো, সেদিন সৃজনের ঘুম ভাঙতেই চাইছিলো না। তখন ফোন করল নোরা। সৃজন অবশ্য বিরক্ত হয়। নোরাও ছেলেমানুষ। সে কোনোকিছু চাইলে তা দিতেই হবে। তাই সে বায়না করেই চলেছিলো। এক পর্যায়ে সৃজন যেতে রাজি হয়েছিলো।
নোরা: হ্যালো।
সৃজন: (কোনো কথা নেই)
নোরা: এই যে। এখনো ঘুমায় মানুষ ?
সৃজন: হুম।
নোরা: বহুদিন একসাথে কোথাও যাই নি। আজ একসাথে যাই ?
সৃজন: কোথায় যাবে ?
নোরা: শাহবাগে। টিএসসির মোড়ে। চলো না প্লিজ।
সৃজন: নাহ। আজ আর যেতে ইচ্ছা করছে না। আরেকটু ঘুমাই ?
নোরা: তোমার ঘুমের কিছু করি। তাড়াতাড়ি ওঠো। আমি যা বলছি তাই করতে হবে।
সৃজন: আজ ইচ্ছা করছে না।
নোরা: বুঝেছি। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। এই বেয়াদব ছেলে, ওঠো। আজ আমরা ঘুরতে যাবো।
সৃজন: আজ না। আরেকদিন।
নোরা: তোমার কোনো কথাই শুনবো না। আজকে মানে আজকেই....
...এই হচ্ছে নোরা। সবকিছু তার সাথে সাথেই চাই। সুতরাং সেদিন সৃজনকে ঘুম থেকে উঠে আধা ঘণ্টার মধ্যে তার মটর বাইকে করে টিএসসির মোড়ে যেতে হয়েছিলো। মানিব্যাগে নিয়েছিলো দেড় হাজার টাকা। সারা দিন ঘোরাঘুরিতে সব শেষ।
তাদের দেখা হয়েছিলো সেদিন বুয়েট কলেজের সামনে। টিএসসির মোড়ে খুজে খুঁজে কোথাও পেল না নোরাকে। কোথায় গেল। ও তো এখানেই দাঁড়াবে বলেছিলো। আধা ঘণ্টা খোঁজাখুজি করলো সৃজন । ফোন করলে জানা গেল সে বুয়েট কলেজের সামনে আছে।
তখন কিছু তো বলা যায় না । মটর বাইকে দ্রুতবেগে গেল বুয়েট কলেজের দিকে । ততক্ষণে নোরা বুয়েটের কাছে । ওর এক বন্ধু এসেছে বিদেশ থেকে । বন্ধুর নাম চঞ্চল ।
এদিকে বুয়েট কলেজের সামনে গিয়ে সৃজন ফোন করলো নোরাকে । নোরা ফোন ধরলো না ।
চঞ্চলের সাথে অনেক গল্প হলো আজ ।
চঞ্চল: আচ্ছা তোমার আইইএলটিএস এর কি হলো ? বাবা তো বলছিলো সামনে মাসে বিয়ে করার জন্য ।
নোরা: উম, এখনই বিয়ে ? নাহ দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে । আমি আগে গ্রাজুয়েশন শেষ করে নেই ।
চঞ্চল: আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয় ? এখন বিয়ে করে নাও । বিয়ের পর পড়াশুনা করা যাবে না হয় ।
নোরা: আমি তাতে সম্মত নই ।
হঠাৎ খেয়াল ব্যাগের ফোন বাজছে অনেকক্ষণ ধরে । নোরা চঞ্চলকে থামিয়ে বললো, এক মিনিট ।
‘কতক্ষণ ধরে ফোন করছি । ফোন ধরো না কেন ?’
‘ওহ সরি, সরি। এ্যই শোনো, একটু বুয়েটের সামনে আসো ।’
‘আচ্ছা’
বিরক্ত হয়ে আবার মটর বাইকে স্টার্ট দেয় সে । বুয়েটে সামনে এসে নোরাকে পেল সে ।
নোরা: ওহ । সৃজন, (সৃজনের দিকে তাকিয়ে) ও হচ্ছে চঞ্চল । আমার বাবার বন্ধুর ছেলে । (চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে) চঞ্চল, ও

হচ্ছে সৃজন । আমরা খুব ভালো বন্ধু ।
চঞ্চল: (সৃজনের দিকে তাকিয়ে) নাইস টু মিট ইউ ।
চঞ্চল ও সৃজন দুই জন হ্যান্ডশেক করলো । এরপর তিন জন মিলে ঘুরতে বের হলো । হাঁটতে হাঁটতেই গেল । সৃজন তার মটর
বাইক পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছে রেখে গেল ।
নোরা: সৃজন কিন্তু খুব অলস । ওকে আজ সকালে ফোন করেছি এখানে আসার জন্য । ও আসবেই না । আমি জোর করে এখানে
নিয়ে এসেছি ।
সৃজন: সেই সাথে অনেক ঘুরেছি । তোমার দঁড়ানোর কথা ছিলো টিএসসির মোড়ে । তুমি একবার বুয়েট কলেজের সামনে যাও,
একবার বুয়েট ক্যাম্পাসে চলে আসো ।
নোরা একটু হাসলো । চঞ্চলও হাসছে । হাঁটতে হাঁটতে পাঠক সমাবেশ পর্যন্ত এসে নোরা বলল, আচ্ছা আমার কয়েকটা বই কেনা লাগবে । চঞ্চল একটু না করছিলো তবে সৃজন উৎসাহ দিলো । বললো, চলো তাহলে।
চঞ্চলকেও তাই যেতে হলো । বই নেওয়ার ট্রেতে করে কয়েকটি বই নিয়ে আসলো নোরা। তারপর যখন পে করার কথা বললো সেলসম্যান তখন নোরা পার্সব্যাগে দেখলো পাঁচশো টাকার নোটটি নেই । তাড়াহুড়া করে বাসায় ফেলে এসেছে ।
নোরা তাই সৃজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কাছে পাঁচশো টাকা আছে ? আমি ভুল করে বাসায় পাঁচশো টাকার নোট ফেলে এসেছি । আমি পরে তোমাকে ফেরত দিয়ে দেবো ।
সৃজন বললো, ওহ শিউর । (মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিয়ে দিলো)
নোরা বললো, থ্যাংকস ।
আরেক দিনের কথা নোরা আর সৃজন সেদিন একসাথে বেরিয়েছে । নোরা বললো, জানো, আমি তোমার মধ্যে আমার ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি । আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি ।
সৃজন বললো, রিয়েলি ?
নোরা বললো, হানড্রেড পারসেন্ট সত্যি । আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি ।
সৃজন পাত্তা দিলো না । বললো, চলো সামনের দোকানে যাই ।
দোকানে যাওয়ার পর দুজন অনেক কথা বললো ।
সৃজন: তোমার ছোটভাই পড়াশুনায় কেমন ?
নোরা: একদম ভালো না । সারা দিন অনলাইনে হাবিজাবি লেখে ।
সৃজন: (হেসে) লেখালেখিও তো পড়াশুনা । পড়াশুনা না করলে কি লেখালেখি করা যায় ?
এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্ক হয়ে গেল । একজন বলে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার কথা, আর একজন বলে অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার
কথা। খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠলো ।
তিন দিন তাদের কোনো কথা হলো না । দুজনই দুজনের উপর রেগে আছে । ফেসবুকে যোগাযোগের কোনো সম্ভাবনা নেই । কেউ কারও পোস্টে লাইক পর্যন্ত দেয় না । সৃজন ফেসবুকে পোস্ট দিলো, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন এদেশে অনুভূত হয় না । মানুষ শুধু পাঠ্যবইকেই প্রাধান্য দেয় । হ্যা পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজন আছে কারণ তা আমাদের জীবিকার খোরাক যোগাবে। তবে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও প্রয়োজন আছে । কেননা অপ্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থাগার একটি প্রতিষ্ঠান । জীবিকার তাগিদে বিদ্যালয়ের প্রয়োজন থাকলে অবচেতন মনের উনড়বতির জন্য গ্রন্থাগারের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ।
সেখানে একজন মন্তব্য করলো, বেশ খাসা বলেছেন ভাই । তবে এরকম চিন্তা আর কেউ করে না ।
আরেক জন লিখেছে, একমত ।
আরেক জন লিখেছে, না ভাই । একমত হতে পারলাম না ।....
অনেকেই লিখেছে । সৃজনের ধৈর্য নাই এত মন্তব্যের উত্তর দেওয়ার । এমনিতেই মেজাজ খারাপ । আবার একেকজন একেক রকম পা-িত্য দেখাচ্ছে ।
নোরা লাইক না দিলেও পোস্টটি হয়ত দেখেছে । সেকারণে সেও আবার একটি পোস্ট দিয়েছে । ......অনেকেই আছেন যারা গ্রন্থাগার
প্রতিষ্ঠার কথা বলেন তারা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায় কতটুকু এগিয়ে এসেছেন জানতে ইচ্ছা হয় ।
এই পোস্টটি সৃজনের চোখ এড়িয়ে গেছে । সৃজনের আর ভালো লাগে না ।
নোরা চঞ্চলের প্রতি দূর্বল হয়ে উঠছে। বাবার বন্ধুর ছেলে বলে কথা। নিউইয়র্কে নামকরা একটি বিউটি পাল্লারে কাজ চঞ্চল। চঞ্চলের বাবা কোনো একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক। সেই খুশী নোরার মা-বাবা কোথায় রাখবেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না ।
বারবার মেয়েকে ভাগ্যবতী বলে সম্বোধন করছেন । তবে মনে মনে সে সৃজনকে ভালোবাসে । কিন্তু বলতে পারে না। কি করবে ?
একটু যদি সৃজনকে পাওয়া যেত! তবে এই কথাটি বলা যেত ।
এদিকে সৃজন নোরার সাথে কথা হচ্ছে না দেখে হতাশ, তখন তার এক বন্ধু তাকে বিভিনড়ব ওয়াজে নিয়ে যেতে থাকে । টিভিতে জাকির নায়েকের লেকচার হয় । প্রতিদিন শুনতে পরামর্শ দেয় সৃজনকে । ফেসবুকে তারা অ্যাড হয় । ইউটিউবের অনেক লিংক এবং বিভিনড়ব
ইসলামী ব্লগের লিংক তাকে দিতে থাকে । নিয়মিত নামাজ ধরা দেখে অবশ্য তার পরিবারের কেউ না করে নি । কারণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে শুরু করলে কে না খুশী হয় । কিন্তু আড়ালে আড়ালে যে নষ্টের উপাখ্যান রচনার প্রচেষ্টা চলছে তা তো আর কেউ জানে না ।
তো যাই হোক, নোরাও জানে না সৃজনের এই অধঃপতনের সংবাদ । যদি কখনো জানতে পারে তখন কি হবে এটা নিয়ে এখন ভাববো না । নোরার মধ্যে টানাপোড়েন । কাকে বেছে নেবে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে । সৃজন নাকি চঞ্চল ?
সৃজন পরামর্শ পেয়েছে মেয়েরা বেদআতের ঝরণা। তাই মেয়েদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। কোনো ধরণের নারী সং¯্রবে না আল্লাহ-রাসূলের জিহাদি রাস্তায় চলে আসছে যা ভুল পথ। সৃজন এতকিছু জানে না। সৃজন শুধু সরল মনে ওর বন্ধুর কথা বিশ^াস করেছে। মাঝেমধ্যে দুই বন্ধু একসঙ্গে সাইদুল মাস্টারের বাসায় যায়। সাইদুল মাস্টার ভালো হাদিস জানেন। বোমাও বানাতে জানেন। সে-ই এখন তাদেরকে বোমা বানানো শেখাচ্ছে। অনেক মানুষকে টার্গেট করে রেখেছে তারা।
সৃজন আর ওবায়দুর খুব ভালোভাবে এগুলো শিখে নিচ্ছে । তারা বিশ^াস করে এই পথ তাদেরকে পূণ্যের পথে নিয়ে যাবে । সুতরাং তারা সবকিছু শিখছে । সাইদুর মাস্টার আগে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন । পরে সেখানে শিক্ষকতাও করেছেন । কিন্তু মাদ্রাসার নীতিবিরোধী কাজে যুক্ত থাকার জন্য বহিষ্কৃত হয়েছেন । এখন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন ইসলামী পরামর্শ দিচ্ছেন ঘরে বসেই । তার আত্মীয়রাও তার নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত । ছেলেমেয়েরা অবশ্য বলে থাকে তিনি কারগিল যুদ্ধের মুজাহিদ ছিলেন । তবে অনেকে আবার বলে থাকেন উনি তালেবানের সাথে যুক্ত ছিলেন । অনেকে বলে থাকেন তিনি আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু । এরকম নানা বিশেষণ তার সম্পর্কে শোনা যায় ।
সৃজনের এসব শেখা হয়ে গেছে সাইদুল মাস্টারের কাছে। বাসায় এখন পিস টিভি ছাড়া কোনো চ্যানেলই চলে না। চালাতে দেয় না।

ছোটবোন শুপন স্টার প্লাস দেখতে গেলে সৃজন বলে, তুই জানিস না ওরা আমাদেরকে শোষণ করছে । তারপরেও এসব দেখবি ?
এখন সৃজন ছোটবোনের সাথে আর তর্ক করে না । বরং বোরকা পরতে বলে । বাইরে বের হতে দেয় না । বাইরে যেতে চাইলেই বোরকার প্রসংগ তোলে । শুপন পাত্তা দেয় না এসব । ভাবে পাগলামি । শুপন না বলে কোথাও বেরিয়ে গেলে সে তখন অনেক রাগ করতে থাকে । বোরকা ছাড়া বের হলে তো রক্ষা নেই ।
শুপন প্রাইভেট থেকে ফিরলে সৃজনের সাথে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল । শুপন ক্লান্ত হয়ে কেবল বসেছে । এর মধ্যে সৃজন বললো, ‘বাইরে যেতে হলে অনুমতি লাগে না ?’
শুপন বললো, ‘কিসের অনুমতি ? আমাকে কি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখে বাইরে যেতে হবে ?’
সৃজন তখন ভয়ংকর রেগে আছে । বোনের গায়ে হাত উঠাতে গিয়ে থেমে গেল ।
শুপন বললো, ‘তুমি তো আগে এরকম ছিলে না । এখন এমন করছ কেন ?
সৃজন বললো, ‘তোমার দোষে’
সোফায় বসে পড়লো সে । আর কথা বললো না সে । শুপন এখন অনেক ভয় পায় সৃজনকে । ছোটভাই হওয়া সত্ত্বেও । এখন প্রতিদিন বোরকা পরে কলেজে যায় । কোচিংয়ে যায় । এখন আর তাই সৃজন কিছু বলে না । একদিন হঠাৎ করে নোরা সৃজনের বাসায় চলে আসে । সৃজন তখন বাসায় ছিলো না । শুপনের কাছ থেকে সব জানতে পারে নোরা ।
নোরা: তুমি শুপন, না ?
শুপন: জ¦ী, আমিই শুপন । কাকে চাচ্ছেন ?
নোরা: আমি সৃজনের বন্ধু । আপনার কথা আমি ওর কাছে প্রায় শুনি ।
শুপন: ওহ ভিতরে আসুন । আসুন ।
নোরা ভিতরে চলে আসে । পুরো ঘরটিতে একবার তাকিয়ে দেখে ।
শুপন: সৃজন এখন বাইরে গেছে । কোথায় যায় না যায় ঠিক নাই । এখন তো পুরো পাল্টে গেছে ও ।
নোরা: পাল্টে গেছে মানে ?
শুপন: এখন তো ওর জন্য আমি বাইরেই যেতে পারি না । বাইরে গেলেই বলে ওঠে বোরকা পরো বোরকা পরো।
নোরা: বুঝছি । ওর সাথে তো আমাদের অনেক বছরের বন্ধুত্ব ছিলো । মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হলো । গ্যাপ সৃষ্টি হলো । আচ্ছা ভালো কথা, তুমি ওর নম্বর দাও তো । ওর সাথে কথা বলবো ।
শুপন মোবাইল বের করে সৃজনের মোবাইল নম্বরটি দেয় এবং বললো, ওকে ফোন করলে তো বিপদ । ওর আবার মেয়েদের সাথে আড়াল থেকে কথা বলছে ইদানিং । আমার তো সন্দেহ হয় ও ভুল পথে চলে গেল না তো ।
নোরা বললো, এই ব্যাপার তাহলে । আচ্ছা আমি আজ তোমাদের বাসায় থাকবো । তুমি ওকে বলবে না । আমি লুকিয়ে শুনবো ও আমার সম্পর্কে কি বলে ? তুমি খুব কৌশলে ওকে আমার কথা জিজ্ঞেস করবে ।
শুপন বললো, আচ্ছা তাই হবে ।
শুপন এখন নোরার কাছ থেকে অন্য জায়গায় চলে গেল । মাগরিবের আযানের পর সৃজন আসবে । নোরা ততক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকলো ।
যথারীতি মাগরিবের আযানের সময় সৃজন এসে ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়েছে । নোরা মনে মনে খুব খুশী হলো যে তার বন্ধুর এতদিনে
বোধোদয় হয়েছে । মাগরিবের নামাজ শেষ হলে কিছুক্ষণ বসলে শুপন কিছুক্ষণ পর আসলে সৃজন ইঙ্গিত দেয় । তাতে শুপন বুঝে যায় যে সরে যেতে হবে । একটু হেসে সরে গেল । তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে বললো, নোরা নামের একটি মেয়ে এসেছিলো । তোমার বন্ধু বলছিলো ।
সৃজন ক্ষেপে গিয়ে বললো, মেয়েদের নাম আমাকে বলবে না । তাদের নাম শুনলে গুনাহ হবে । আর নোরা, এই মেয়েটা না জানি কার কার সাথে শুয়ে এসেছে । এখন এসে হম্বিতম্বি করছে ।
শুপন বললো, কেন গুনাহ হবে ? দুপুরে কথা হলো ওর সাথে । ভালোই তো ।
সৃজন বললো, এইসব মেয়ে ছলাকলা জানে । কিছু বাগাতে এসেছে । আমি নিশ্চিত লিখে দিতে পারি ।
শুপন বললো, তুমি লিখে দিলেই হবে ?
সৃজন বললো, হানড্রেড পারসেন্ট ।
নোরা পর্দার আড়াল থেকে সবকিছু শুনছিলো । এই কথা শুনে তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল । কানড়বায় ভিজে উঠলো দুই চোখ । আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না । পর্দার কোণ থেকে আত্মপ্রকাশ করলে শুপন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠে ।
নোরা: (কাঁদতে কাঁদতে) তুমি আমাকে এইভাবে চেনো ? আমরা তিন বছর ধরে যে প্রেম করলাম তা কি শুধুই অভিনয় ।
সৃজন: (অবাক ও রাগান্বিত হয়ে) আশ্চর্য তোমাকে আমি ভালো বন্ধু বলে গ্রহণ করি নি কখনো ।
নোরা: (একটু থেমে) তাহলে কি আমাদের সম্পর্ক কি মিথ্যা ?
সৃজন: হ্যা । মিথ্যা । কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি নি কখনো ।
শুপন: আচ্ছা সৃজন থাম । অনেক হয়েছে ।
নোরা কাঁদছে । শুপন নোরাকে ধরে রেখেছে । নোরা তখন শুপনকে বলছে, আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না । আমার দমবন্ধ লাগছে ।
হঠাৎ করে নোরা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো । সে সৃজনকে বিয়ে করবেই । যতই ঝড়তুফান আসুক । এই কথা শোনার পর সৃজন নোরাকে টেনে ধরে দরজার বাইরে বের করে দিলো । - আর কোনোদিন যদি আসিস এখানে ।
দরজা বন্ধ করার পর শুপন বললো, এ কি করলি । যে মেয়ে তোমাকে বিনা সংকোচে ভালোবেসে গেছে সেই মেয়েকে তুমি এভাবে প্রত্যাখান করতে পারলে ?
সৃজন বললো, ‘আমি যা জানি তা নিশ্চয় তুমি জানো না ।’
এই বলে নিজের ঘরে চলে যায় । নিজের ঘরে গিয়ে কোরআন পড়া শুরু করলো। শুপন কিছুই বললো না। ভাবলো শুভবুদ্ধির উদয় হচ্ছে।

পরদিন সকালবেলা। সৃজন অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। ভোর চারটা পর্যন্ত কোরআন শরীফ পড়েছে সে। ফজরের নামায পড়ে ঘুমিয়েছে। শুপন অবশ্য এসবের মধ্যে নেই। বোরকা পরে সৃজনের ভয়ে। স্বেচ্ছায় চলতে চাইলেও চলতে পারে না। সৃজন সকালে উঠেই গোসল করে নিয়েছে। এখন কাকরাইল মসজিদে যাবে। উবায়দুল্লাহর সাথে তাবলীগ করবে।

কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ করার সিদ্ধান্তটি ইতঃপূর্বেই বাতিল করে দিয়েছে উবায়দুল্লাহ। সৃজন সেটা জানে না। সৃজন উবায়দুল্লাহর কাছে গিয়ে বললো, ‘চলো, যাই।’
উবায়দুল্লাহ বললো, ‘ওখানে না। চলো আমরা ওয়াজ শুনে আসি।’
সৃজন: কার ওয়াজ ? 
উবায়দুল্লাহ: নারায়ণগঞ্জে মাওলানা হেকমত আলীর ওয়াজ হবে। চলো সেটা শুনে আসি। তাবলীগ করে কাজ নেই।
সৃজন: আচ্ছা। চলো।

যেতে পথে অনেক গল্প হয় দুজনের। গল্প করতে করতে কখন যে পৌঁছে যায় নিজেরাই জানে না। নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার একটা অটো নিয়ে তারা এগোতে থাকে।
উবায়দুল্লাহ: বুঝছ, যারা মেয়েদের বিরক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদে নামতে হবে।
সৃজন কিছু বলে না। সায় দেয় খালি।
উবায়দুল্লাহ: যারা নাস্তিক, তাদের হত্যা করা ওয়াজীব। এই সমস্ত কুলাঙ্গারদের জন্যই আমাদের দেশের অবস্থা ভালো হয় না।
সৃজন: মনে হয় পৌঁছে গেছি।
চারপাশে তাকায় উবায়দুল্লাহ। তারপর অটো থামিয়ে টাকা দেয় সে। দুজনই অটো থেকে নেমে যায়।

ওয়াজ শোনা শেষ হলে পথে সৃজন আর উবায়দুল্লাহর মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। সাথে সাথেই সৃজন উবায়দুল্লাহর সাথে সম্পর্ক শেষ করে দেয়। বাসায় গিয়ে বোনকে সব খুলে বলে। সব শুনে শুপন বলে ওঠে, ‘কি মারাত্মক কাজ করেছিস তুই ! তাই বলি তুই এত ধর্মপ্রাণ হলি কিভাবে।’ 
গভীর রাতে বাসায় ফিরে সৃজন শুপনকে বলে ওঠে, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
শুপন এখন আর বাইরে যেতে হলে সৃজনের কাছে অনুমতি নেয় না। স্বেচ্ছায় সবকিছু করে। বোরকাও পরে না। মাথায় কাপড়ও দেয় না। তাকে অনেক সুন্দর দেখায় আগের চেয়ে।
ঘরে ঢুকে সৃজন জানতে পারে নোরার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। নোরা নিজেই এসে বিয়ে ঠিক করে গেছে।
সৃজন শুধু একটাই কথা বললো, ‘কাজটা ভালো করলে না।’