ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ৮৮

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ৮৮
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ৮৮
বৃহস্পতিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮















পদাবলি

পদাবলি


মাটি
শাহীন মাহমুদ

মাটির সারাংশে ঝুলে আছে প্যারানইয়া প্রেম
অযাচিত অবিশ্বাস তোমাকে শেখাল বিরোধবাস
আমি অধিবিদ্যা মেনে নিয়েছি অমীমাংসার বাসনায় ।
মাটির বৃক্ষের এই যে ভোগের বৈশ্বিক কাল
তুমি তো একদিন পাহাড় চূড়া থেকে নেমে
সাগরে মিশেছিলে তাই না ?
আহা সাগর ,একদিন হারালে তুমি আপন কক্ষপথ
এখন তোমার গর্ভাগারে ভাগাড় নিস্তব্ধতা । 


তোমার নোলক হয়ে
নুরুল ইসলাম বাবুল

আমারও আছে বেদনার দিন
অহরহ বুকের ভেতরে নামে রাতের আঁধার,
তবু হেঁটে আসা ঢেউয়ের কাছে শুনি সাগরের বৃত্তান্ত;
দেখি, ফেলে আসা শস্যবীজ
সোনা হয়ে ফিরে আসে কৃষকের হাতে।

ক্ষতগুলো আমাকেও টেনে নিয়ে যায়
বারবার হয়ে উঠি শুকনো নদী
তবু আমি দখিনা হাওয়ায় খুঁজি জলের কণা,
শরতের নীল নীল আকাশে তুলো মেঘ
উড়ে যেতে যেতে ফিরে আসে কিশোরীর পায়

অতঃপর আমিও পুড়ে যেতে যেতে
ফিরে আসি তোমার এক রত্তি নোলক হয়ে।


উপাখ্যান
শোয়াইব শাহরিয়ার

দেখি আশ্চর্য এক সাঁকো। টগবগে জল নিচে।
তবুও যাই সন্তর্পণে।  যেন পথহারা মাছের বাচ্চা!
যেন আগুনে ঝলসে যাওয়া...

শহরে পরিযায়ী পাখির মতো আসে
বনচারী হাওয়া; সবুজাভ হয়ে।
সুদীর্ঘ ছায়া নিয়ে। আটকে যায় আয়ু।

...হাতের দশ আঙুলে লিখে যাই কপালের কৌতুক।

এইতো জীবন
হোসনা মুরাদ

সকাল দুপুর রাত
নিয়মিত তিন বেলা খেলেই খাওয়া হয়না
পাকস্থলীর পূর্নতা মানে জীবনের সম্পূর্ণতা নয়
সুন্দর কাপড় পরে পরিপাটি হয়ে চললে
কিংবা...
মুখভর্তি হাসি দিয়ে কথা বললেই
সুখী বলা যায় না
ভণিতা করলেও সব যেন ভান হয়না
তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অতৃপ্তি’রা সদাই পুড়ে
ক্ষুদার অনলে 
ধূসর ভষ্ম হয়ে মিশে যায় মহাকালের গহ্বরে
ভাবের অন্তরালের অভাবটা এতটাই তীব্র
দ্রবীভুত হয়ে বের হয় নীরব লোনা জলে

এই খাওয়া পরা আর চলার মাঝেও
কতো মানুষ আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে
কতো মানুষ একটু বেঁচে পুরোটাই মরে 
কেউবা পুরোটাই বেঁচে থাকে ফসিল হয়ে
এইতো জীবন- ‘আহা রে জীবন’ 
জগতের তাতে কী’ই বা যায় আসে
কীইবা তার দায়ভার ?
স্মৃতির খাতায় সময়ের কবিতা লিখে 
এক কাঁদে বয়ে বেড়ানো কিছু শুদ্ধ নিয়তি
অন্য কাঁদে নির্ভুল জীবনের সব পান্ডুলিপি...

বাদলা দিনের গান
টিপু সুলতান

তোমার ঘরে আগুন দেব, উদাস দুপুর
রৌদ্র মাখা বটের পাতায় জলের নূপুর।
তোমার মুখে রঙ মাখাবে মেঘলা কালো চুল
কদম কেয়া নাচবে তখন দুলবে কাশফুল।
তোমার বুকে কাটবে সাঁতার,বাদলা দিনের গান
চুমুর টানে ভাগ হবে সব; শ্রাবণের প্রাণ।
তোমার চোখে চোখ খুঁজিবে হিজলবনের পাখি
ঘাসফুলেরা দাঁড়িয়ে যাবে,নিত্যনতুন মাখি!
তোমার ঠোঁটে ঠোঁট বসাবে সরব নীরবতি
ঘাসফড়িং আর মাটির গন্ধ,উড়ুক প্রজাপতি।
তোমার মনে শুদ্ধ হবো, শুদ্ধ হবে তুমি
আগুন দেব-উদাস দুপুর, হঠাৎ বৃষ্টি আমি।
তোমার ভেতর ডুবে যাবো, খানিক ভরসা
নদ নদী আর পদ্মদিঘি,পল্লীগ্রাম-শহুর বরষা।


গল্প : ভবঘুরে কবি

গল্প : ভবঘুরে কবি





ভবঘুরে কবি
মোহাম্মদ অংকন

বিকাল গড়াতেই একদিন এক যুবককে চলনবিলের ধারে বসতে দেখা যায়। বিষয়টি অনেকেই খেয়াল করে। আবার অনেকে প্রয়োজন মনে করে না। তার ঝাকরা চুলের কারণে পেছন থেকে অবয়ব নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। উপর হয়ে বসে থেকে কি যেন লিখছে- এটা বেশ বোঝা যায়। কৌতুহলী হয়ে বিশ উর্ধ্বটপি সেই যুবকটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। উঁকি দিয়ে সে দেখে সবেমাত্র একটি কবিতার শিরোনাম লিখেছে- ‘তোমার টানে আগমন’। টপির অনুমান করতে দেরি হয় না যে তিনি একজন কবি। টপি কাশি দিতেই যুবক কবিটি পেছন ফিরে তাঁকিয়ে উঠে পড়ে। টপির মুখ থেকে বের হয়, ‘ভয় পাবেন না মহাশয়। আমি আপনার কাছেই এসেছি।’
‘জি¦, বলুন। কি উপকার করতে পারি?’
‘আমি তো উপকার পেতে আসি নাই। এসেছি কৌতুহল দূর করতে।’
‘জি¦, বলুন। কি জানতে চান?’
‘আমি  যদি ভুল না করি তাহলে নিশ্চিত যে আপনি কবিতা লিখেন। কিন্তু বিষয় হচ্ছে, আপনাকে এ অঞ্চলে আগে কখনও দেখি নাই। যদি..’
‘হ্যাঁ, আমি আমার পরিচয় বলব। আমি পথেপ্রান্তরে কবিতা লেখার অনুসঙ্গ খুঁজে ফিরি। বলা চলে আমি একজন ভবঘুরে কবি। যেখানে রাত সেখানেই কাত! চলনবিলের কথা আমি একটি বইয়ে পড়েছিলাম। আর তারপর থেকেই ভেবে নিয়েছিলাম, একদিন এখানে আসব। আমি এসেছি..’
‘বাহ! আপনি এতদূর থেকে চলনবিলে এসেছেন! আপনার দম আছে। তো একটু পড় রাত নামবে। কোথায় রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন?’
‘সে কথা বলতে নেই। ওই যে বললাম, যেখানে রাত সেখানে কাত।’
কবির এমন উত্তর শুনে বিরক্তির আভাস নিয়ে টপি সেখান থেকে চলে যায়। ‘আমার কৌতুহল মিটেছে। এবার আসি। যত্তসব কবি এসেছে দেশে!’

টপি চলে যায়। বিকালের সূর্য ডুবে গিয়ে সন্ধ্যা নামে। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কমতে থাকে। কিন্তু ভবঘুরে কবিটি সেখানে বসেই থাকে। তার কবিতা লেখা শেষও করে। ওদিকে টপির ঘর থেকে বিলের ধারের রাস্তাটি পরিষ্কার দেখা যায়। যদিও টপি সেই কবির কথাটি ভুলে যায়। রাতে জানালার কপাট আটকাতে গিয়ে যুবকটিকে চোখে পড়ে যায়। বিরক্তির আভাস নিয়ে উচ্চশব্দ করে বলে, ‘হায় রে কবি।’ জোড়ে শব্দ করে জানালার কপাট বন্ধ করে দেয়। কপাটের শব্দ কবির কানে গিয়ে লাগে।

টপির বাবা একজন বাউল শিল্পী। গ্রামে গ্রামে গান করেন। ফিরতে প্রায়ই রাত হয়। তবে সেদিন দশটার আগেই দলবল নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করেন। বাড়ির কাছে বিলের ধারে আসতেই সবাই রীতিমত চমকে ওঠে। রাতের মৃদু আলোতে দেখতে পায়, লাশের মত একটি দেহ পড়ে আছে। পাশে একটি ডায়েরি, একটি ব্যাগ ও রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার বই। একটু পড়েই তার নাকের আওয়াজ শোনা যায়। বাউল শিল্পী তার সাগরেদ ভল্টুকে বলে, ‘ডেকে তুলতো ছেলেটাকে।’
ভল্টু হাত থেকে ঢোলটি রেখে ঘুমন্ত কবিকে হালকা ধাক্কা দেয়। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে উঠে সে দাঁড়িয়ে পড়তেই বাউল প্রশ্ন ছোড়ে।
‘তুমি কে, বাবা। এখানে রাত্রি কাটাচ্ছ?’
কবি তার বৃতান্ত বলতেই বাউলের মনটা নরম হয়ে যায়। ‘কি, বলব তোমাকে, আমরাও একই পথের যাত্রী। পার্থক্য শুধু তুমি লেখ আর আমরা গাই। যদি কিছু মনে না একটি কথা বলি?’
‘জি¦, গুরু জ¦ী বলুন।’
‘তুমি এভাবে এখানে রাত্রিযাপন করলে এলাকার লোকজন ভালভাবে নিবে না। এছাড়া চোর ডাকাত ভেবে মারপিট করতে পারে। আমি বলি কি আমার সাথে চল। আজকের রাতটা না হয় ভল্টুদের সাথে কাটালে।’
এমন সুন্দর প্রস্তাবে কবি রাজি হয়ে যায়। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাউল দলের সাথে রওনা করে। তবে সে জানত না সে কোনো বাড়ি যাচ্ছে।

টপি ও তার মা রোজ অপেক্ষা করে। কখন তার বাবা গান করে ফিরবে।
‘মা টপি, তোমরা কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
ঘর থেকে দ্রুত বের হতে হতে টপি জানান দেয়, ‘না বাবা, ঘুমাই নাই।’
তার বাবার সাথে কবিকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে, ‘বাবা কবিকে তুমি কোথায় পেলে?’
‘কি রে মা, তুই কি তাকে চিনিস?’
‘না বাবা, চিনি না। বিকালে বিলের ধারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়েছিলাম। তখনই পরিচয়টা জেনেছি। তবে তিনি যে এখনও এখান থেকে চলে যান নাই সেটা আমার জানা ছিল না।’
‘ও আচ্ছা, রাত অনেক হয়েছে। সে আজ ভল্টুদের সাথে থাকবে। সকাল হলে কোথাও চলে যাবে। দে মা, আমাদেরকে এখন খেতে দে।’

সে সময় চলনবিলে বেশ চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। তাই লকলকে লাউ দিয়ে টপির মা চিংড়ি মাছ রান্না করে। কবিকে সঙ্গে করে বাউল খেতে বসে।
‘টপি মা, কবি আমাদের অতিথি। তাকে আগে খেতে দে।’
সে রাতে কবি এভাবেই সম্মান খাতির পেতে থাকে। ‘আপনারা আমাকে এভাবে আপ্পায়ন করবেন, আমার জানা ছিল না।’
কিন্তু টপি বরাবরই বিরক্তির আভাস প্রকাশ করে। মনে মনে বলে, ‘এ বয়সে কবি হয়েছে! তাও আবার ভবঘুরে কবি। ভাব দেখলে বাঁচি না।’
টপির বিরক্তির আভাস বুঝতে কবির আর দেরি হয় না। তখন সে ভাবে, ‘না, মেয়েটিকে সুবিধার মনে হচ্ছে না। এমন করে তাকাচ্ছে যেন সে আমার শত্রু।’
কবি টপির রুঢ় আচরণে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ‘না, আমার এখানে থাকাটা ভাল হবে না। আমি পথের মানুষ, পথেই চলে যাব।’

রাত তখন ১টা হবে। যে কথা, সেই কাজ। কবি তার ব্যাগপত্র নিয়ে ভল্টুদের কক্ষ থেকে বেরিয়ে পড়ে। ওরা ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন থাকায় বুঝতে পারে না।

কবি মধ্যরাতে রাস্তা বেয়ে বেয়ে যেতে থাকে। পথে তার সাথে গ্রামের মদখোর কফিলের দেখা হয়। কফিল কি দেখতে কি দেখে কবিকে চোর বানিয়ে মারতে থাকে। গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে, ‘চোর ধরেছি, চোর।’ কয়েকটা কিলঘুষি দিতেই সে যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কফিলের চিৎকারের আওয়াজে আশেপাশের লোকজন ঘুম ত্যাগ করে হাজির হতে থাকে। টপি, তার বাবা-মা ও ভল্টুরাও ছুটে আসে। তাদের কবিকে চিনতে দেরী হয় না। বাউল বলে, ‘ওরে একে তোরা মারিস না। এ তো চোর না। যার কাছে রবীন্দ্রনাথের বই থাকতে পারে, সে কখনও চোর হতে পারে না। সে একজন কবি। কবিরা কখনও চোর হতে পারে না। তোরা এখান থেকে চলে যা।’
বাউলের কথা শুনে সবাই চলে যায়। কবিকে ধরাধরি করে টপিরা বাড়িতে নিয়ে আসে। কিলঘুষিতে কয়েকটা ক্ষত হয়। রক্ত ঝরে। টপি তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। কিন্তু ওর মনটা কেন যেন খাঁখাঁ করে। ভাবতে থাকে, ‘সে কেন আমাদের বাড়ি থেকে পালাতে গেল?’
‘আচ্ছা, একটা কথা বলবেন, আপনি কেন পালাতে গেলেন?’
‘কবি হাসতে হাসতে বলে উঠল,
কবিতার নিঃশ^াস যেখানে বন্দি হয়
সেখানে আমার একটি মুহুর্ত নয়।’
বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী টপি কবির এই সরল আহাজারী বুঝতে বাঁকি থাকে না। টপি বলতে থাকে, ‘আমাকে আপনি ক্ষমা করে দিবেন। আসলে আপনাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা আমার ঠিক হয় নাই। যারা সৃষ্টিশীল কর্ম নিয়ে কাজ করেন, হয়তো আমাদের মতো সাধারণদের কাছে অবজ্ঞার পাত্রই হয়।’

অনুতপ্ত টপিকে কবি শান্ত¡নার বাণি শুনিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়। তারপর সে রাত্রটি কেঁটে যায়। আরেকটি দিন চলে আসে। দিনের আলোয় সব অতীত মুছে যায়। কবি আবার ঘুরতে ঘুরতে কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। বিকালে টপি জানালা খুলে বিলের ধারে কবিকে খোঁজে। কিন্তু পায় না বলে তার মনে একটা বিষন্নতা বিরাজ করে। অতঃপর আস্তে করে জানালার কপাট আটকিয়ে বুকের নিচে বালিশ ফেলে কি কি যেন ভাবতে থাকে।

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ০৮

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : শাদমান শাহিদ : পর্ব ০৮


রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

(গত সংখ্যার পর)
সিদ্দিকি সাহেব কার্পণ্য করেননি। টাকা নিয়ে তিনি গোপনে ওসি সাহেবের সাথে দেখা করতে যান। ওসি সাহেবও টাকা রিসিভ করে বলেন, বাড়ি যান, দেখি কী করা যায়। সিদ্দিকি সাহেব বাড়ি চলে আসেন এবং পরদিনই শোনেন ওসি সাহেবকে প্রমোশন দিয়ে অন্য জায়গায় বদলি করা হয়েছে। তাঁর জায়গায় আরেকজনকে নিয়োগ করা হয়েছে এবং সে-লোক উপরের ইশারার বাইরে একচুলও নড়ে না। তারপরও তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে গেলে তিনি বলেন, আপনারা তো সোহেল হত্যার বিচার চান, নাকি চান না?
আমরা বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই চাই।
তাহলে অপেক্ষা করুন। আমরা তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি এবং আদালতে দশ দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন। আশা করছি ঠিক মতো প্যাদানি লাগালে খলখলিয়ে সব ক্লু বেরিয়ে আসবে।
আমরা বললাম, স্যার, আপনি কার কথা বলছেন?
কেনো? মাসুদ আহমেদ? আমরা নিহত সোহেলের মোবাইল থেকে রিসিভকল চেক করে দেখেছি, ঘটনার রাতে মাসুদ আহমেদ তাকে ফোন করেছিলো।
মাসুদ আহমেদ তাকে ফোন করতে যাবে কেনো?
মাসুদ আহমেদ ফোন করতে যাবে এজন্যে যে, তার ছোট বোন সাদিয়া আক্তার ঝিনুকের সাথে সোহেলের খারাপ সম্পর্ক ছিলো। তার সাথে রাত নিশিথে ফোনে কথা বলতো। সম্ভবত এ-কারণেই তিনি খুনটা করে থাকবেন।
পুলিশের মুখে এসব কথা শুনে আমাদের মাথা গুলিয়ে যায়। এর প্রতিউত্তরে কী বলতে হয় কিছুই মাথায় আসে না। তখন সাহস করে আমাকেই দুটো কথা বলতে হয়। বললাম, ওসি সাহেব, আপনারা কি মাসুদ আহমেদের ফোন কলটাও চেক করেছেন? অথবা উভয়ের ফোন কলে কী কথা হয়েছে, আমরা কি জানতে পারি? এমন তো হতে পারে, মাসুদ আহমেদ তাঁর বোনের বিষয়টা মেনে নিয়ে থাকবেন। হতে পারে তাদের সম্পর্কটাকে পারিবরিকভাবে জায়েজ করার জন্যে সোহেলকে ফোন দিয়ে থাকবেন।
ওসি সাহেবের মুখের ভেতর তখন চুন-জর্দ্দা-সুপারি মেশানো পানের রস বেড়ে যায়, তিনি ভোঁস ভোঁস করে বলতে লাগলেন—হতে পারে, আবার নাও তো হতে পারে। এমনও তো হতে পারে, তিনি নেতা হওয়ায় তাঁর কোনো সহযোগি ক্যাডারকে দিয়ে ঝিনুকের জীবন থেকে সোহেলকে সরাতে চেয়েছেন।
হ্যাঁ। আপনার এমন ধারণাকে আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না। এজন্যই তো বলছি, তাদের উভয়ের ফোন কলে কী কথা হয়েছিলো, সেটা আমাদেরকে জানান।
ওসি বলেন—না, তদন্তের স্বার্থে কোনো কিছুই এখন প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আমাদেরকে তখন পুলিশের কথায় আস্থা রাখতে হয়। এবং পরদিন পত্রিকায়ও তাই ছাপা হয়। মানুষ পত্রিকায় সে রিপোর্ট পড়ে কিনা জানা যায় না। তবে সবখানে দীঘির তলার মতো নীরবতা নেমে আসে। দেশের কোথাও থেকে কোনো প্রকার প্রতিবাদ আসে না। আমাদের তখন মনে হয়, পুলিশ হয়তো সঠিক পথেই এগুচ্ছে। শত হলেও তারা আইনের লোক। আইনের লোক হয়ে গাইনের কাজ করতে পারে না।
এ বিশ্বাসের ফলে আমাদের স্মৃতিতে তখন সিনেমায় দেখা নীতিবান কজন পুলিশ অফিসারের চোখ-মুখ-শরীর-স্বাস্থ্য এবং তাদের প্রশংসনীয় কর্মযজ্ঞ নড়েচড়ে উঠলো। তখন রহিম মিয়ার চাখানায় চা-কাপে ঠোঁট বসাতে বসাতে একজন বললো, না, মনে অয় এই পুলিশটা ভালা। আমরা তার উপরে আস্থা রাখতে পারি। আরেকজন বললো, ঠিকই কইছো মফিজ ভাই, সবাইরে এক পাল্লায় মাপা ঠিক না। তাদের কথা-বার্তায় আমরাও আশ্বস্ত হয়ে একটা ভালো সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। তখনই টিভিতে দেখি তালিকাভুক্ত শহরের শীর্ষ সন্ত্রাসী মাসুদ আহমেদ (৪২) বন্দুকযুদ্ধে নিহত। আমরা তখন ঐ-চ্যানেলের কথা বিশ্বাস করি না। রিমোট হাতে চ্যানেল থেকে চ্যানেলে দৌড়াতে থাকি। সব চ্যানেলে একই খবর। তারপরও আমাদের বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয় এ-মাসুদ আমাদের মহল্লার মাসুদ নয়। আমাদের মাসুদ তো পুলিশের হাতে। রিমান্ডে আছে। টর্চাররুমে পুলিশের প্যাদানি খাচ্ছে। তাঁর মুখ থেকে কথা বের করার জন্য যা করার দরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ তাই করবে। ইচ্ছে হলে তার পাছা দিয়ে গরম দেড়ইঞ্চি রড ঢুকিয়ে দেবে। আঙুলের নখ দিয়ে দশ ইঞ্চি লম্বা সুই ঢুকিয়ে দেবে। লোহার ডা-া দিয়ে পিটিয়ে তার সবকটা হাড় ভেঙে গুঁড়ো করে দেবে। তারপরও যদি কথা না বের হয় তখন পুলিশ নিজেই সুবিধা মতো একটা বক্তব্য ডিজিটাল রেকর্ডারে রেকর্ড করে তার নামে চালিয়ে দেবে। শুরু হবে সে-কথার জের ধরে পাইকারি গ্রেফতার। আমরা তখন বাসা-বাড়ি ফেলে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের সীমানাটা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত দৌড়াতে থাকবো।
এসব ভাবতে ভাবতে যখন আমাদের মনে এক ধরনের বায়োসাইকোসোশ্যাল প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছিলো, তখন মনে হলো আকাশের সূর্যটা দপ করে নিভে গেছে। মাথার মগজ খালি করে পালিয়ে গেছে আমাদের বাস্তবতাবোধ। মহল্লার জারুল গাছে যে-পাখিগুলো সারাক্ষণ কিচিরমিচির করে আমাদের অস্থির করে তুলতো, হঠাৎ দেখি একটা পাখিও নেই সেখানে। বাসা ভেঙে কোথায় যেনো চলে গেছে। তার বদলে বেড়ে যায় কুকুরের চিৎকার। ছাল-ওঠা ঘনঘনে ঘাঁ-যুক্ত যে-কুকুরগুলো মহল্লার ডাস্টবিনের পাশে চুপচাপ শুয়ে-বসে থাকতো, হঠাৎ দেখি এদের উৎপাত বেড়ে গেছে। আমাদেরকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে লেজ নাচাতে নাচাতে কী যেনো জানতে চায়। আমরা তখন কুকুরের ঘেউ ঘেউ থেকে বাঁচতে রহিম মিয়ার চা-স্টল থেকে বনরুটি কিনে কুকুরের দিকে ছুরে মারি। আশ্চর্যের বিষয় কুকুরগুলো সেসব ছুঁয়েও দেখে না। বরং আরো বেশি করে তেড়ে আসে। কেউ কেউ তখন তরকারি মেশানো ভাত বেড়ে দেয়, আঁ-উ-আঁ-উ, খাও-খাও। আদর করার চেষ্টা চালায়। তাতেও কুকুরগুলোর মন ভরে না, মহল্লার লোক দেখলেই তেড়ে আসে। অবস্থা বেগতিক দেখে যখন সবার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি, তখনই এগিয়ে আসে মতিপাগলা (যাকে কেউ কেউ ছদ্মবেশি চরমপন্থী বলে সন্দেহ করে থাকে)। উদ্ধার করে আমাদের। ‘আঁ-ও-আঁ-ও’ করে ডাক দিলে কুকুরগুলো তার পায়ের কাছে গিয়ে লেজ নাচাতে থাকে। সে তখন কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের অমর ছড়াটা ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেনো ভালো হয়ে চলি’—আবৃত্তি করতে করতে বনরুটি কুড়িয়ে কুকুরগুলোকে খাওয়ায়। এ-সময় কী কারণে যেনো রহিম মিয়াও আমাদের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বিটলামি করার সুযোগ পায়। বলে, পাগলা ভাই, পইদ্যটা এইভা না বইলা এট্টু ঘুরায়া কও না। কও না—
‘সহালে উডিয়া আমরা মনে মনে বলি   
রাজনীতি ছাইড়া যেনো বোবা হইয়া চলি’
দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কে কী বুঝেছে, বোঝা যায় না। যার যার অবস্থান নিয়ে ব্যস্ত সবাই। সংসারে ছেলে-মেয়েরা বড়ো হচ্ছে। ওদের আয়ের পথ সৃষ্টি করতে হবে। বিয়ে-শাদির জন্যে পাত্র-পাত্রী দেখতে হবে। আবার অনেকের শরীর-স্বাস্থ্যও তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না। তখন শর্দি-কাশি তো, পরক্ষণেই ডায়রিয়া। জ্বর একবার শুরু হলে সারতে চায় না। সে-সাথে ডায়াবিটিসের দৌড়ানি তো আছেই। সকাল-সন্ধ্যা নিয়ম করে দৌড়াতে দৌড়াতে একেকজনের নাভিঃশ্বাস অবস্থা। বলা যায় জীবন চলছে সমুদ্র-গহীনের ইঞ্জিনবিকল জাহাজের মতো। শুধু দারের উপর ভরসা। তখন একবারও মনে পড়ে না—একদিন আমরা মানুষ ছিলাম। আমাদের চোখের তারায় ছবি হয়ে থাকবে বলেই মহান পিতৃগণ জীবন বাজি রেখেছিলো একদিন। অসাম্যের পিরামিড ব্রাশ-ফায়ারে গুড়িয়ে সমতায় মেশাবে বলেই অস্ত্র হাতে চষে বেড়িয়েছিল টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। একবারও মনে পড়ে না— মানবিক পাখিগুলো সেই কখন বাসা ছেড়ে গেছে, এখনো ফিরে আসেনি সন্ধ্যার বাতাসে। মনে পড়ে না—এমন আত্মহারা হয়ে যাবো বলেই কি একদিন স্বপ্ন দেখে ‘বাংলাডেইশ বাংলাডেইশ’ বলে চিৎকার করে পৃথিবী কাঁপিয়েছিলো জর্জ হ্যারিসন? যে চিৎকার ধ্বনি শুনে আবাবিল পাখির মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ে এসেছিলো বৈদেশিকমুদ্রা!
একদিন রেণু এসে বলে, আপা, চোখের মনি তো শুকিয়ে চাঁদলাশ। শুধু চেয়েই থাকি, দেখি না কিছুই। শুধু হাতড়ে বেড়াই সভ্যতার সেই দেয়াল, যেখানে আমাদের স্থান হবে সেই আশ্চর্য জাতি হিসেবে, যারা প্রাণ থাকা সত্ত্বেও লাশের অভিনয় করতে পারি অনন্তকাল। আমার মনে তখন মহল্লার চা-স্টলগুলো, খদ্দেরদের অভিব্যক্তি, গরম চায়ে চমুকে চমুকে উত্তেজনা, তাদের তর্ক-বিতর্ক। কেউ বলে—মাসুদ সন্ত্রাসীই আছিলো। সন্ত্রাসী না হইলে সে বন্দুকযুদ্ধে নামতে যাইবো ক্যান? বিনা কারণে কি পুলিশ তারে শহরের বাইরে নিয়া গেছিলো? নিশ্চয়ই এর মইধ্যে একটা ক্লু আছিলো, সেটা বাইর করবার লাগিই পুলিশ তারে শহরের বাইরে নিয়া যায়। যেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গী-সাথীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। তারপরই না পুলিশ জান বাঁচাতে পাল্টা আক্রমণ করে। আরেকজন বলে—মালেক ভাই, যা বুঝো না তা বলতে যেয়ো না। মাসুদ তো এ-মহল্লারই ছেলে এবং আমাদের চোখের সামনেই বড়ো হয়েছে, নাকি? কোনোদিন কি দেখেছো সে কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার তো দূরের কথা, কাউকে তুই বলে ডেকেছে? তখন উপস্থিত অনেকেই মাথা নাচিয়ে বলে—না, এমন কথা তার শত্রুও বলতে পারবে না। তার মতো ভদ্রছেলে আমাদের শহরে হাতে গোনা দশজন পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। আবদুল মালেক দেখে—মালেক তখন ঘাবড়ে যায়। তার মানে কেউই খুনটাকে মেনে নিতে পারছে না। তখন সে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে, ‘অতো ভদ্র মারাইও না। ভদ্র হইলে কি আর পুলিশের খাতায় নাম ওডে? সে যদি খুনটা না-ই কইরা থাকবে, তা হইলে মহল্লায় অতো লোক থাকতে পুলিশ শুধু তারেই টার্গেট করলো ক্যান? আর হাকিমও কোন বুঝে তারে দশ দিনের রিমান্ড দিলো? অপেক্ষা করো, তলের বিলাই ঠিকই বাইর অইবো। মহল্লায় কারা কারা রাজাকারগিরি করে বেড়ায়, সবই জানি। এইসব রাজাকারদের কারণেই মহল্লায় উন্নয়ন আয়ে না।’ ‘আন্দাজি কতা কইও না মালেক। রাজাকার থাকলে তোমার বংশে আছে। দুদিন আগেও তো তোমার চাচা মোতালেব ব্যাপারি জাতির পিতা-দেশরতœ-বঙ্গকন্যা ইসব শব্দ লইয়া ঠাট্টা-মশকারা কইরা বেড়াইতো। এখন মুক্তিযুদ্ধের সনদখান পাইয়া রাতারাতি দেশ প্রেমিক হইয়া গেছো গা, না? তুমরাও তো কয়েকদিন আগে বিএনপি করতা। এখন দল পাল্টায়া বড়ো বড়ো কথা কও। পাইকারি সবাইরে রাজাকার কইয়া বেড়াও।’
ফুল মিয়া সরদারের মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর মালেকের অবস্থা তাপহীন ভাতফেনার মতো। এদিক-ওদিক বার কয়েকবার তাকায়। না, কোথাও তাপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে কি তখন পাল্টা উত্তর দেবে? নাকি চুপ থাকবে, বুঝতে পারে না। আবার কথা বলতে গেলেও বিপদ। ফুল মিয়া সরদারের ছেলেরা শুনলে আস্ত রাখবে না। শুধু লাঠির জোরেই টিকে আছে লোকটা, না হলে অনেক আগেই সিস্টেমে ফেলে সাইজ করা যেতো। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে আস্তে করে কেটে পড়ে। সে চলে যাওয়ার পর অনেকেরই ধড় সোজা হয়ে যায়। জনতা ব্যাংকের ক্যাশ ম্যানেজার আবু তাহের বলে—‘মাসুদ যদি সন্ত্রাসী হয়েও থাকে, তাহলেও তো তার বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সে সমাজ বা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করে থাকলে, তার জন্যে আইন আছে। আদালত আছে। সেখানে আইনের ভিত্তিতে তার বিচার হবে। কিন্তু পুলিশ যা করেছে এটা কোনো মতেই আইনসিদ্ধ নয়। আইনের বাইরে কোনো কাজই পুলিশ করতে পারে না।’
ক্ষিতিশপুর ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক ওমর ফারুক বলে—ঠিক পয়েন্ট ধরছো তাহের ভাই, ‘পুলিশের কথায় এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। এ-পর্যন্ত পত্র-পত্রিকায় মহান বন্দুকযুদ্ধের যতোগুলো খবর বেরিয়েছে, সবকটাতেই দেখা গেছে; একতরফা রেজাল্ট। সবকটাতেই কেবল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারকৃত বন্দি নিহত হয়েছে। এর বাইরে পক্ষ-বিপক্ষের কেউ নিহত হওয়া তো দূরের কথা কারো গায়ে সামান্য আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি। এমনকি কোনো যুদ্ধে রণভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের কাউকে আমাদের সুদক্ষ পুলিশ বাহিনি গ্রেপ্তার করেছে বা তাদের কোনো একজনের কোনো প্রকার আলামত হস্তগত করতে পেরেছে, এমন খবরও কোথাও ছাপা হয়নি। তবে কি আমরা ধরে নিবো যে, আদতেই তারা কোনো মনুষ্যসন্তান ছিলো না, তারা ছিলো ভিনগ্রহ থেকে উড়ে আসা এলিয়েন অথবা শ্মশানবাসী ক্ষুধার্ত কোনো ভূত-প্রেতের দল।’
‘অপেক্ষা করেন, দিন একবা যায় না, আমাদেরও সময় আসবে।’ চা-কাপে লিকার ঢালতে ঢালতে বলে রহিম মিয়া।
(চলবে)

ও পাহাড়, তুমি মানুষের গান গাও...

ও পাহাড়, তুমি মানুষের গান গাও...


ও পাহাড়, তুমি মানুষের গান গাও...
মিসির হাছনাইন

‘ও মেঘের দেশের পাহাড় তোমার কাছে,
আসছি তবে মেঘের ভিতর আদিবাসী হইয়ে’

রাতের মরা ঘুমে স্বপ্ন দেখছিলাম....

     সাত আগষ্ট সকাল। জানালায় কাক ডাকে। দূরের নির্মলা আকাশ তাকিয়ে আছে ছাই বর্ণের মেঘ নিয়ে। মেঘের কাছে বলে দিলাম, ও মেঘ আমরা আসছি তবে ছুঁয়ে দেখবো তোমার শরীর! সারাটা দিন কেটে গেল মেঘদের সংসার আর পাহাড়ের গল্প ভাবতে ভাবতে। পাহাড় নিয়ে কত আগ থেকে তো ভাবছি-
‘ভাবছি, পাহাড়ে চলে যাবো, ঐ দূর পাহাড়ের চূড়ায়; যেখানে কালো মেঘ জড়ো হয়ে ঝর্ণা নামে শরীর ভিজে, নাগরিক নিয়ন আলোয় তোমাকে ভুলে গিয়ে পাহাড়ের পাতায় পাতায় চনের মাচাং ঘর বানাবো সকাল বিকাল সন্ধ্যা রাতে... মহুয়া ফুলের গন্ধ শুকে শহরের মানুষের ভীড় ঠ্যালে নষ্টে যাওয়া জীবন দেখবো আদিবাসী জনপদে । নিজকে চিনবো পাহাড়ী গাছের ভিতর সুবজের গায়ে এলোমেলো জীবনের লেনদেন  পুড়ে যাবে অতীত, পুরানো সব ছেঁড়া খাতা। বুনোফুল ফুটে আছে এদিক ওদিক ।  ভুলে যাবো শহরের রাস্তা অলিগলি। এক পৃথিবী রঙ নিয়ে শুরু করবো- মানুষের মিছিলে নতুন মানুষ আঁকা জীবনের আঁকাবাঁকা রাস্তায় সারস পাখির ডানায় খুব ধীরে ধীরে মানুষ হারিয়ে যায়, নাগরিক জীবনের সোডিয়াম আলোয়। পাহাড়ের চূড়ায় ভাঙা মাচায় বসে রাতের জ্যোৎস্না দেখতে দেখতে... দেখবো আকাশের তারায় তারায় কত জীবন ঝুলছে আহা! শহরের মানুষ ভালোবাসা বুঝে না। বুঝে না জীবনের সুন্দর, বুঝে না মানুষ। যে মানুষ ভালোবাসতে জানে না, সে আকাশের নক্ষত্র দেখতে জানে না, সে জানে না জীবন এক সুন্দর নক্ষত্র রাতের যে নক্ষত্র নামে তাঁর ঘরে শহরের শক্ত ব্যালকনিতে বসে খোলাচুলে চায়ের কাপে ফুঁ দিয়ে তুমি দেখেছো মেঘ উড়ে যায়... ঐ পাহাড়ের চূড়ায় এবং উড়ে যায় পুবে- সাদা বকের সার, একলা আকাশের শহুরে কোলাহল
অতীতের হাজার হাজার ক্ষত নিয়ে তোমার ভেতর বেড়ে উঠছে এক পাহাড়; সে পাহাড়ে ঝর্ণা নামে...গা ভিজিয়ে আকাশে তাকিয়ে যে ছবি আঁকি ভুল করে নারীর শরীর। শুকনো শরীরে হেঁটে চলে ক্লান্ত পা ধীরে ধীরে... নরকের অতল গহ্বরে কালো অন্ধকারে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে ফুটে আছে ফুল এদিক ওদিক; পাহাড়ী জনপদ; জীবন এক বুনোফুল মাচাং ঘরে ঝুলছে । প্রাচীন অলিম্পাসের দেবতা জিউস । মানুষের উপকারী দেবতা প্রমিথিউস । পাহাড়ের গল্পে গেঁথে আছে গ্রীক মিথ। পাহাড়ের পাতায় পাতায় আগুন জ্বলে; জ্বলছে মিটিমিটি আঁধারের জোনাক, কেরোসিনে পোড়া কুপি বাতির আলোয় সুন্দর এক জীবনের উদ্দেশ্যে... ভাবছি, সবকিছু ছেড়ে পাহাড়ে চলে যাবো।


আট আগষ্ট ভোর ছয়টা। গাড়ি চলছে পাহাড়ের পাশ দিয়ে। ভোরের ঐ দূরের পাহাড়ে দেখা যায় উড়ছে পাখি, পাহাড়ী জুমে। মনে হচ্ছিল- ‘পাহাড়গুলোও চলছে আমাদের পথে’। আকাশটা মিশে গ্যাছে যে পাহাড়ে, সেই পাহাড়ের ঘরে আমাদের অভিনব যাত্রা। চলতে চলতে কখন যে চলে আসলাম পাহাড়ের ঘরে একটু টেরও পেলাম না! আমরা গাড়ি থেকে নামলাম।
সূর্য অনেকটা ওঠে গেছে। আট তারিখ সকাল। ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তায় আমাদের পাহাড়ের দেশের মাটিতে যাত্রা শুরু পায়ে হেঁটে। হাঁটতে হাঁটতে  আমরা দেখে নিলাম ছিমছাম শান্ত পাহাড়ের শহর। কড়া রোদে আমরা এসে পৌঁছলাম ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ইনস্টিটিউটে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম আদিবাসী অডিটোরিয়ামের সুন্দর করে সাজানো মাচাং মঞ্চখানা এবং আদিবাসী জাদুঘরে ঢুকে একে একে দেখতে লাগলাম বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন সব নিদর্শন। আদিবাসী নারী-পুরুষ তাদের ব্যবহৃত সোনার ঘামে গড়া তৈজসপত্রের সাথে বাঙালিদের পরিচয় করিয়ে দেয়, বাঙালিদের ঘামে হারিয়ে যাওয়া বহু কালের পুরানো সব লোকজ শিল্প-সংস্কৃতি । পাহাড়ের চূড়ায় বান্দরবান শহর, শহরের জাদুঘরে দেখলাম পাহাড়ের প্রাণগুলো এখনও তাকিয়ে আছে জলজল চোখে। পাহাড়ী তরুণী’রা স্নান করে সুমেশ্বীর জলে। কাঠের নৌকায় আঁকাবাঁকা নদীতে কোন পুরুষ পথ হারায়।


আদিবাসী দেবতা পান করে পাহাড়ী চু। খোলা গায়ে তামুক খায় জুম চাষী কৃষক উঠানের পিঁড়িতে। শাড়ি বুনে গুন গুন গানের সুরে কোন জিপসি রমণী। দেবতা পূজায় আমরাও মাতাল হই স্বর্গের অমৃত শরাবে, গাই পাহাড়ী গান।
পাহাড়ের উৎসবে বাঙালি কৃষক হাল চাষ করে দুপুরের রোদে। ভাঙা কুলায় ধান উড়ায় কৃষাণী, দক্ষিণের মহুয়া বাতাসে। জাদুঘরে বাস করে আদিম বাঙালি।
বাঙালির রক্ত মিশে আছে, পাহাড়ী জনপদে।

দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা উঠলাম চান্দের গাড়িতে। চান্দের গাড়ি চলছে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। হঠাৎ উঁচুতে আর নিচুতে নেমে আমরা চলে আসছি পাহাড়ের মন্দিরের সোনায় গড়া ঈশ্বরের দরজায়। স্বর্ণমন্দিরের দেবতাদের চরণে ফুল রেখে আমরা শুরু করলাম পাহাড়ের পথে যাত্রা। আদিবাসী মানুষ দুই হাতে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আমাদের। আমরা বুঝে নিলাম, ওনারা বলছেন- ‘পাহাড়ের দেশে আপনাদের স্বাগতম’।
মেঘলা পৌঁছলাম বিকাল সাড়ে তিনটায়। মেঘলার ঝুলন্ত ব্রিজ, লেক, পাহাড়, মিনি চিড়িয়াখানা, ক্যাবল কার, পাহাড়ী চু, পাহাড়ী ফুলের ঘ্রাণ আর ছোট্ট সেই ঘূর্ণিটা আমাদের নিয়ে গিয়েছিল অন্য এক জগতে। পুরো ভালো লাগাটুকু  ব্যাগ ভরতি করে স্বর্গের মতন মেঘলা ছেড়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম, গাড়ি চলছে নীলাচলের পথে...
‘নীলাচলে আমরা মেঘ হয়ে গিয়েছিলাম, আপনাদের কাছে। আমরা গেয়েছিলাম পৃথিবীর গান, বৃষ্টিতে ভিজে গেলেন আপনারা, ভিজে গেলো পাহাড়ী ফুল, চাকমা তরুণীর ভেজে গা, পাহাড়ের বুকের পাথর। আপনারা অবাক হবেন, পাহাড়ের চোখ দিয়ে আমরা ভিজে গেছি, অথচ, আপনারা দেখেছেন আকাশে উড়ে যাওয়া এক খন্ড মেঘমালা।
আমরা হাসি কারণ, আদিবাসী নারীর ওড়না থাকে নাহ। আপনারা তাকিয়ে আছেন এবং মনে মনে বলেন আহা! কি সুন্দর ফুল!

বাবা কয়েছিলেন- মাঝে মাঝে পৃথিবীতে কিছু অদ্ভূত জিনিস ঘটে! তবে, হ্যা এ কথা সত্য যে, সবাই সেই অদ্ভুত কাজটা খুঁজতে খুঁজতে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস ঘটিয়ে পৃথিবী থেকে চলে যান পাহাড়ের জীবন কত সহজভাবে উড়ে মেঘদের মাঝে!
আমরা যখন আপনাদের কথা ভাবতে যাই, কেমন যেন নেশা লাগে ঘুরতে থাকে মাথা, দেখি- কত অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে আপনাদের চোখ। সবুজের দোষ দিয়ে আপনারা দেখেন ভোরের উঠানে ফুটছে যেসব লাল লাল জবা।
পাহাড়ের জীবন আপনাদের খুব প্রয়োজন!
পাহাড় যে মানুষের কথা বলে, পাহাড় যে মানুষের গান গায়।
মানুষের জীবন সেতো পৃথিবীর খোলা মাঠ থেকে উড়ে যাওয়া শেষ বিকেলের চিল।
নয় আগষ্ট সকাল। রোয়াংছড়ি পাহাড়ের উপর দিয়ে চলছে আমাদের চান্দের গাড়ি। রোয়াংছড়ির কচ্ছপতলা বাজারের মধ্য দিয়ে আমরা পাহাড়ের পথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছলাম শিলবাঁধা ঝরনায়। পাহাড়ী ঝরনায় ভিজে গেলাম আমরা সবাই। পাহাড় সে তো ভিজিয়ে দিতে জানে, জানে মানুষের ভিতরের দুঃখকে ধুয়ে নদী করে দিতে। নদীর দু-পাশের পাহাড়ে আদিবাসী মানুষের ঘর।

‘পাহাড় নিয়ে গল্প লিখছি, গল্পের ভিতর জন্ম নিয়েছে এক কুমারী পাহাড়। সে পাহাড় থেকে ঝরনা নামে...
বাপে কয়- পাহাড়ে গেলে দুঃখ মোছা যায়, সেই দুঃখ বয়, এক নদী হয়ে সে তাকিয়ে আছে। আমরা ভিজে যাই তাঁর চোখ দিয়ে, শরীরভর্তি দুঃখ নিয়া যখন ডুব দেই পাহাড়ী ঝরনায়, দেখা দেয়- এক মারমা তরুণী, তাঁর সাথে আমার কথা হয়। ‘এই যে পাহাড়, এখানে রেখে যান আপনার যৌবন!
আকাশের মেঘের ভেলায় আমরা যখন উড়ছি আপনাদের শহরের আকাশে। পাহাড় তখন তাকিয়ে থাকে মারমা তরুণীর চোখে, সে জন্ম দেয় এক বাঙালি শিশু।
যৌবনের সাদামেঘে উড়ছে মারমা শিশু  কুমারী পাহাড়ে আদিবাসী বাঙালির ঘর নদীতে ভাসছে পাহাড়ী সাদা বেলিফুল... মেঘের ভিতরে ঘর, ডাকছে মারমা নারী।
ভিজে গ্যাছে শরীর। কুমারী পাহাড়ের চোখের ভিতর হেঁটে যায় শত শত মারমা তরুণী’।
দশ আগষ্ট সকাল। আমরা চলছি থানচির পথে চান্দের গাড়ির ছাদে বসে বসে ভাবছি-
‘পাহাড়ের কোলে একটা ঘর বানাইছি, ঘরটায় থাইক্যা দেখা যায় ঐ দূর শহরে তোমার ঘর। আয়নায় দাঁড়িয়ে তুমি দীঘল কালো চুলে সুগন্ধী মাখো, জানালা দিয়ে ঢুকে যায় কালো মেঘ। পাহাড়ী মহুয়ার গন্ধ, ঘর মৌ মৌ করে। আর, আমি ভাসি তোমার শহরের আকাশে। বাপে কইত- ছোড এই জীবনটা কতকিছুই তো চায়, মনভক্তি দিয়া চাইলে সবকিছুই পাওন যায়। মন থাইক্যা চা, তুইও তারে পাবি!


তারপর থাইক্যা সকাল-বিকাল তাঁরে আমি পূজা করি, সে এখন বাস করে আমার ঘরে।
পাহাড় যে নদীখান জন্ম দিছে, তাঁর ভিতর কাঠের নৌকা ভাসাই, পাহাড়ের মাঝখান দিয়া বইয়া যায় খালের মতন আঁকাবাঁকা নদী। হঠাৎ করে দেখি- উড়ে যায় একটা সন্ধ্যা পাখি, কোন শহরের জানালায়! জীবন সেতো উড়ে পাখিদের ডানায়...
দুপুরের রোদে যৌবন ঝরে। বাপ শুনায় তাঁর যৌবনের কিচ্ছা। পাহাড়ী ফুল ফুটে, খোলা গায়ে অংকন করি পাহাড়ী জুম। মেঘের ভিতর দেখা যায় আমার আর তোমার সাদাকালো সংসার।
শহরের আকাশে মেঘ জমে, নাগরিক মানুষ একদিন শহর ছেড়ে পাহাড়ে বানাবে ঘর।
আমার জানালায় উড়ে আসে একটা শহরের পাখি। 


আমরা চলে আসলাম উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ের দেশ থানচিতে। থানচির আলিকদম সড়কে উঠছে আমাদের চান্দের গাড়ি, মনে হচ্ছিল- খাঁড়া দেয়াল বেঁয়ে বেঁয়ে উঠছে পিঁপড়ের দল’। পাহাড়ের বিশাল চূড়ায় আমরা খুলে খুলে দেখছি আমাদের জীবন এবং যৌবন। পাহাড়, সেতো জীবনের গান গায়।
ডিম পাহাড় থেকে যখন আকাশ দেখি, মনে হয়- ইশ! একটু দূরের ঐ পাহাড়ে উঠলেই আকাশ ছোঁয়া যেত। চারদিকের পাহাড়ে সবুজ খেলা করলে আমরা গাই পৃথিবীর গান, ‘সোনা বন্ধে আমারে পাগল বানাইল...
পাহাড় থেকে আমরা যখন পিঁপড়ার মতো নামছি, আপনারা দেখছেন- বিকেলের আকাশে মেঘের ছুটাছুটি।
ডিম পাহাড়ে রেখে এসেছি আমার যৌবন। পাহাড় তুমি তারে যতন করে রাখো তোমার বুকের ভিতর, সেখান থেকে জন্ম নিক এক ষোড়শী পাহাড়।

সন্ধ্যায় আমরা ঢুকে গেলাম মেঘের ভিতর, মেঘের ভেলায় ভাসছে চান্দের গাড়ি। সেই মেঘে আমরা হই পৃথিবীর আকাশের কোন এক যুবক-যুবতীর চোখের মেঘ; হয়তো হয়েছি কৃষকের চোখের কালো মেঘ; আবার হয়তো হয়েছি পশ্চিমাকাশের অনন্ত যৌবনার মেঘ। হিম শীতল চারপাশটায় মনে হয় ঢেকে গেছে শীতের কুয়াশায়, দেখা যাচ্ছে না পাহাড়ী পথ, বহুদূরের পাহাড় যেখানে আকাশ ছোঁয়া যায়। চিম্বুক পাহাড়ের উপর দিয়ে নীলগিরিতে কিছু সময় আড্ডায় আর পাহাড়ীদের জীবন নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে চিৎকার করে গাই-
‘ও পাহাড় তুমি তো মানুষের গান গাও’
ঘুম ভাঙে। এগারো আগষ্ট মধ্যরাতে। একটা ছোট্ট স্বপ্নের ভিতর দিয়ে ঘুরে এলাম স্বর্গের মতন বান্দরবান।