নাফের নিঃশ্বাস

নাফের নিঃশ্বাস



নাফের নিঃশ্বাস
মুনিম রাব্বি

আজও ফজর একটুও রাগল না। ওর বাম গালে হাসানমাঝির ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের দাগ লকলক করছে। তুই আমার নৌকারতন লাফ দিয়া মর । কোন কামডা পারো তুমি হ্যা ? তিন বেলা মাগনা খায়োন ছুডাইতাছি দ্বারা। অভিসপ্ত গলায় খ্যাচ খ্যাচ করে বলে গেল হাসানমাঝি । মধ্য বর্ষার অবিরাম বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া নাফ নদীর মতন ফজরের দুই চোখও তলিয়ে যায় । ফজরের চোখে রাগ জন্মেনি এখোনোও । সাধারন চেহাড়ার ফজরের খানিক ছোট ছোট চোখ দুটো লাল হয়, লজ্জায়, অপমানে আর অনাদরে ।সুযোগ পেলেই হাত পা ফুস ফাস করে হাসানমাঝির । সুযোগ না পেলেও অকারন চরথাপ্পর না দিলে মাঝি বুঝি শান্তি পাননা । ফজর বছর পনেরোর এক রাখাইন কিশোর । সাম্পানে চড়ে রাত বিরাতে এভাবে ভাসেনি কখোনোও । কিন্তু জীবন সাগরের যে উন্মাতাল দহে সে ভাসছে তা এই যৌবনা নাফ নদীর চেয়ে দৈর্ঘে প্রস্থে গভীরতায় অনেক গুন ।
ফজরের শক্তিতে কুলায় না ।এত ভারি জাল টেনে টেনে উঠানো তাঁর সামর্থের বাইরে । যেন নদীর দেহ থেকে সমস্ত নদীর অন্তশ্বার টেনে তোলা । তবুও করতে হচ্ছে । শীরদ্বাড়া যেন ডেউরে ওঠে । অল্প বয়সী নবীন মাংসপেশী গুলো যেন প্যাঁচানো দড়ির মত ভেসে ওঠে । আনন্দে চোখ ভেজে , দুঃখ পেলেতো ভেজেই । কিন্তু ফজর জানত না শরীরের উপর বেশী জোর করলে তখনও চোখ ভিজে উঠতে পারে । 
ওস্তাদ, ও ওস্তাদ । একটু ধরেন না । পারতাছি না । ম্যালা ভার । এতো ভার জাল এহলা উডান যায় ? 
হাসানমাঝি পানের পিচকানি ফেলে । উঠে দাঁড়ায় । এই পাইনসা জালডাও টানবার ক্ষেমতা নাই ? হাসানমাঝির হাতে কোচ ফেলার বাঁশ । সেই কোচ ধরে ফজরের পেটে খোঁচা দেয় কয়েকবার । জালের ভার ধরে আছে ফজর । পেটের মাংশপেশীর বিভক্ত রেখা গুলো ফুটে উঠেছিল । চোঁকতা বাশের খোচায় তাঁর পেটে রক্তের দাগ পড়ে গেল ।    
সকাল থেকেই আকাশ ঢেকে আছে পড়ত পড়ত মেঘে । হালাকা বাতাস থেকে থেকেই ভাড়ি হচ্ছে । ফজর খবর পেয়েছে । আজ আকাশ ভাল না , সাগর ও বেজায় চটে আছে । বিক্ষুব্ধ সাগরে আজ কেউ নাও ভাসাবে না । তবুও সে ঘাটমালিকের ঘাটে যায় । দূর থেকেই হাসান মাঝির চোখ দেখা যাচ্ছে । সাগরের চেয়েও ক্ষেপে আছে যেন । ফজর দর দর গলায় আগেই বলে ওঠে ,
চাচা আইজতো আকাশ ভালা না , তাই ভাবছি নাও ভাইসবো না ।
হাসান মাঝি দাঁত কামড়ায় । বাঁশের কোচে ভর দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ,
চান্দু , তোমারে ছুটি দিছে কোন বাপে ?
ফজর মাফ চায় । ওর চোখে মুখে ক্ষমা চাওয়ার তীব্র আকুতি । শ্যমল মুখের ছোট্ট রেখায় ভয়ের তীব্র সংকোচন । অবনত ধরে চোখ থেকে পল পল জল নিংড়ে অন্তত একবার প্রথমবার হাসানমাঝির কাছে মাফ চায় । কিন্তু না , ততক্ষণে নাফনদীর পানি শুকনো ধুলোর উষ্ণদুকূল ভিজিয়ে দিলেও হাসানমাঝির মন ভেজে না । লুঙ্গি খিচিয়ে ধেয়ে আসে । কাঁচা কঞ্চির ডাল দিয়ে ফজরের ধূসর পীঠের ছোট্ট অঞ্চলে একবার দুইবার কয়েকবার সজোড়ে আঘাত করে । ফজরের কান্না থেমে যায় । চোখ মুছতে মুছতে কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায় সাম্পানের দিকে ।
আজও যেন ভোর ভোরেই আটকে আছে । পাহাড়ের খুব কাছে এসে মেঘগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে । দমকা বাতাসে ক্যম্প জুড়ে ফত ফত আওয়াজ শোনা যায় । চোখের সামনে অগনিত প্লাস্টিকের ত্রিপলের ছাউনি পাহারের গায়ে ক্ষতের মত দেখা যায় । লেদা ক্যাম্পের সি ব্লকের ছোট্ট কুড়েঘরে থাকে ফজর । কাদামাটিতে লেপ্টে থাকা এই ঘরের দেয়ালের কোন জানালা নাই । ত্রিপলের ছাউনিতে মৃদু বৃষ্টির ছন্দ উঠেছে । সেই ছাউনীর একফাঁক দিয়ে বিস্তীর্ন আকাশ দেখা যায় । এই আকাশ দেখা , ছাউনীতে বৃষ্টির অনিন্দ ছন্দ শোনা  শুধু বেঁচে থাকার আক্ষেপ বাড়ায় । এই আকাশ দেখার চোখ নেই ফজরের। চোখ মেললেও সেই চোখের যে কোন জানালা নাই । 
পৌষের মাঝামাঝি । অনেক দিন ধরেই মাছের তেমন বাজার নেই । তবে এতে হাসানমাঝির খুব একটা যায় আসে না । হাসানমাঝির আরো ব্যবসা আছে । অনেকদিন পর বড় এক কারবারির সন্ধান পাওয়া গেছে । অনেক টাকার ব্যাপার । নাফের ওপার থেকে এপার আনতে পারলেই সিন্দুক ভরে ফুলে উঠবে হাসানমাঝির । দশ হাজার পিস ইয়াবা । শুধু নাফ নদী পার করে হাত বদল করতে পারলেই পিস প্রতি বিশ টাকা পাওয়া যাবে । কিছুদিন আগেও পিস প্রতি পাঁচটাকা পাওয়া যেত । ইদানিং পুলিশের আনাগোনা বেড়ে গেছে এই অঞ্চলে । আইন খুব কড়াকড়ি হওয়ায় এসব কারবারি করার রিস্ক সবাই নিচ্ছেনা । কিন্তু হাসানমাঝি এসব রিস্কের ধার ধারে না । সে এই সব কাজ ফজর কে দিয়েই করায় । উপায় হীন দাসের মত ফজরকে এসব করতে হয় বাধ্য হয়ে । এর আগে অল্প সল্প চোরাচালান সফল ভাবে করলেও এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন । 
 কুয়াশায় দিগন্ত ঢেকে গেছে । ফ্যাকাশে আবছায়ার অতলে কাঁদা মাখা নাফ নদীর কুল ধরে হেটে এগিয়ে যাচ্ছে ফজর । তখনো আলো ফোটেনি । আঁধার আর কুয়াসায় পাঁচ কদম দূরের মূর্তিও দেখা যায় না । গুনে গুনে দশ হাজার পিস ইয়াবা ফজরের সমস্ত দেহের খাঁজে খাঁজে আটকানো । জোয়ার আর ভাটার  বাদান্যতায় ফজরের দিক ভ্রম হয়েছিল । ঠিকঠাক সময় মত ফজর এসে পৌছতে পারেনি । সকালের আলো ফুটে গেছে । ভটভট করে দুখানা ট্রলার এগিয় আসছে ভাটির বীপরিতে । ট্রলার ভরা পাঁচ থেকে ছয় জন অ¯্র সজ্জিত পুলিশ । ফজর জানেনা যে সে অপরাধি । জঘন্য অপরাধের অকুন্ঠ প্রামান তাঁর গায়ে জড়িয়ে আছে । ফজর এসবের কিছুই জানে না।   
ফজর তাদের কে চেনেনা । সে শুধু জানে কিছু দিন আগে এই অস্ত্র সজ্জিত মানুষেরাই তাঁর বাবা এবং আত্বিয়দের হত্যা করেছিল । ঘড়বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল । ধাড়ালো ছোড়ার মাথা দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে অত্যাচার করেছিল । ফজর আবার পুরোনো আতঙ্কে ভীত হয়ে উঠল । তবে কি সে পথ ভুল করে রাখাইনেই ফিরে এসেছে ? আসে পাশে লুকানোর জায়গা নেই । দৌড় দিলে ধরা পরে  যাবে । তাঁর গায়ের কাপরের রং ঝলসে  গেছে । ঝলসানো কাপরের রং মাটির রঙের কাছাকাছি পৌছে গেছে । ফজর তৎখনাত মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পরল । এমন ভাবে শুয়ে পড়ল যেন তাকে দূর থেকে ভেসে আসা কলাগাছ কিংবা গাছের গুড়ির মত দেখায় । তাই হয়ত দেখাল । দুটো ট্রলার ভর্তি এত গুলো মানুষের এত গুলো চোখ ফজর কে আবিষ্কার করতে পারল না ।   
পুলিশবাহী ট্রলার চলে যাবার পর ফজর মুখ তুলে তাকাল । তাঁর সমস্ত শরীরে লেপ্টে থাকা বস্তুর কোন ক্ষতি হয়নি । ফজর চারদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখল । এবার ভাটির টান ধরে হাটতে লাগল । খানিক এগোতেই একটু দূরে একটি ঘাট দেখতে পেল । বাঁশের খুঁটিতে নৌকা বাঁধা । আর তাঁর উপর পা ঠেকিয়ে পেঁচার মত চোখ সাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাঝি । শুকনো বড়ই এর মত মুখ শুকিয়ে গেছে তাঁর । ফজর ক্লান্ত তবুও তাঁর হাটার গতি বাড়িয়ে দিল । আজকের মত এমন বীরত্ব আর বুদ্ধিদীপ্ত কাজ এর আগে সে করেনি । ক্যম্পের আর কোন ছোকড়া কিংবা হারপাকা সাহসী ছেলে পেলেও এমন কাজ করেনী । আজ হাসান মাঝি তাকে নিশ্চই বুকে জড়াবে ।  
কিন্তু তা হল না । ঘাটের কাছে যেতেই ফজর এর দিকে তেড়ে এগিয়ে আসল হাসান মাঝি । 
জানোয়ারে বাচ্চা , খানকির পুত , আমার মাল কোই ? মাল দে ? নইলে তোরে আজ গাঙ্গে ভাসায়া দিমু !! 
এতক্ষন ফজরের ছোট বুকে ভালবাসা পাবার যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আশার কনিকা দানা বেঁধেছিল , সমস্ত ক্লান্তি ভেদ করে চোখেমুখে যে বীরত্ব আর বুদ্ধিমত্বার উচ্ছাসা প্রস্ফুটিত হচ্ছিল তাতে আঁকষ্মাৎ অকাল ভাটা পড়ল । ফজরের গায়ের পোষাকটি খুলে গেল । কাঁদামাখা শ্যমল উলঙ্গদেহখানি অসহায় অদৃষ্টের পানে চেয়ে আছে যেন । শরীরের বাঁকে বাঁকে জড়ানো ইয়্বাার বিশেষ প্যাকেট । তার ঘষায়ঘষায় কোথাও কোথাও কেটে ছিলে রক্ত বেড় হয়ে গেছে । সেই রক্ত কাদার সাথে শুকিয়েও গেছে । বিশেষ পদ্ধতিতে এই প্যাকেট গুলো শরীর থেকে ছাড়াতে হয় । শক্ত আঠাদিয়ে লাগানো প্যাকেট গুলো টান দিতেই ফজর যন্ত্রনায় ক্যাঁত করে উঠল ।  হাসান মাঝির তাতে কিচ্ছু আসে যায় না । প্যাকেট গুলো ছাড়ানোর পর ফজরের দেহের দিকে তাকানো যায় না । জোকের গায়ে লবন ছিটালে যেমন হয় ,ফজরের অবস্থা তেমন ।         
তাঁর পর বেশকিছুদিন ফজর কে ভুগতে হয়েছে । পুলিশের ভয়ে বেশ কিছু দিন ক্যাম্পে যেতে পারেনি সে । পেটের নিচের অংশের এখনও জ্বালাপোড়া করে । ব্যাথার বিশে রাতে রাতে জ্বর আসে ফজরের ।ওষুধ নেই ,পেটে খাবার নেই । আবার ক্যাম্পে ফিরতে হয় । ধরা পড়লে পড়বে ।
কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা । গত কয়েকদিনে ফজরের শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে । তাই হয়ত ওর দিকে পুলিশ তাকায়নি । কিন্তু এভাবেওতো নাখেয়ে বেঁচে থাকা যায় না । ফজর খুব ভাল মাছ ধরতে জানে । ভাল জাল বাঁধা , জাল ছড়ানো ,জালে আটকে পড়া তাজা তাজা মাছ নিপুন হাতে ছাড়াতে পারে । খুব ভাল কোঁচ ও মারতে পারে সে । ওর গ্রামে কোচ দিয়ে সে অনেক মাছ ধরেছে । ওকে একটা কাজ খুজতে হবে । হাসানমাঝির কাছে সে আর যাবেনা । ওখানে গেলে ওকে নিশ্চিত মরতে হবে । হাসানমাঝিই ওকে মেরে ফেলবে , নয়ত পুলিশ গুলি করে মারবে ।  সে মাছ ধরার অন্য জেলেদের দল খুঁজতে থাকে । মাতব্বরের আড়তে যায়, টিপুদের ঘাটে যায় । কিন্তু কেউ তাকে কাজ দেয় না । ফজরের শরীর এতটাই খারাপ যে ওকে দিয়ে হালকা কাজও করানো কঠিন । ফিরে আসতে পথে দেখা হয় হাসানমাঝির সাথে । হাসানমাঝি ফজর কে ডাক দেয় । ফজর হাসানমাঝির দিকে এগিয়ে যায় ।       
কিরে ফজড়া শরীর ভালা হোইছে নি ? ভালা ভালাইত লাগে । তো , কামে আবি না ?
ফজর মাথা নিচু করে জবাব দেয় । আইচ্ছা চাচা । কাইলকারতন আমুনে ।  
হাসান মাঝির জন্যে ফজরের ভাল স্বাস্থ্য কিংবা অন্যকিছুর দরকার নেই । সেবার প্রতি পিস ইয়াবা বাবদ বিশটাকা পাওয়ার কথা থাকলেও সে লাভ পেয়েছিল চল্লিশ টাকা করে । শুধুমাত্র ফজরই মাল ঠিকঠাক আনতে পেরেছিল । অন্যরা ধরা পরেছিল পুলিশের হাতে , কেউ আবার পালিয়ে গিয়েছিল । মুন্তাকে তো গুলি করে মেরেই ফেলল পুলিশ । তাই ফজরের এই কৃতিত্ব মুখফুটে না দিলেও হাসানমাঝি জানে ফজরের গুরুত্ব কতখানি । অন্তত একারনেই তাকে দু এক পয়সা দিলে হাসান মাঝির ক্ষতি কি ?        
তাঁরপর বেশ কিছুদিন কেটেগেল । আজ সকাল থেকেই শামলাপুর ঘাটে বেকার বসে আছে ফজর । সাগরের বেতাল অবস্থায় মুখ ভার করে বসে আছে হাসানমাঝি । আজ মাঝির সাহস হবেনা । আজকের সাগরের সাথে পাগল ও পাল্লা দেবে না। কিন্তু সন্ধ্যার পর মাঝি ব্যাকুল হয়ে গেল । সারাদিন মাচালে বসে বসে ঢক ঢক করে কি যেন অশ্বাদ গিলেছে সে । আর তাতেই মাথার চারিধারে যেন গ্রহনক্ষত্র ঘুরছে আবিরাম।   
ওই ফজরা টানা জাল আর কোঁচগুলান নে ? আর নুরারে নাও ভাসাইতে ক?
চাচা আকাশত ভাল ঠেহে না । আর নুরাওত ভাগছে । নুরা তো নাই ।
যেইডা কইসি হেইডা কর । নুরা ফুরা লাগব না । মোহনায় যামু । ভাটির টানে মাছ বেশি পাওন যায় । এই সোযোগ পাওয়া যায় না ।
কি আর করার । বাঁচবার তীব্র ইচ্ছা বা মরে যাবার অজানা ভয় কোনটাই ফজরের নাই । ঘাট থেকে নাও ছাড়ে মাঝি । শামলাপুর ঘাটমালিক জহুর আলম একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে । ঘাটমালিক চেঁচিয়ে বলে ওঠে , আরে ওই হাসান , আইজ আর যাওনের কাম নাই । কাইল যাইস । এই আন্ধার কুন্দারে যাইস না । মাঝি নির্বিকার । এই অসময়ে আলাপ করার কোন ইচ্ছা নাই তাঁর । মাঝির উত্তর দেয় ফজর , দাদা ভয় পায়ো না । যামু আর আমু ।  
কালো আঁধারের কলঙ্ক সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা । এখানে নাফের হালকা ঢেউয়ে নৌকা হাতির পীঠের মত দুলছে । এমন ফুলে ফেঁপে ওঠা নাফের বুক কোন দিন দেখেনি ফজর । নদীর ওপারে ঘুমধুম সীমান্ত । তার ওপারে পাহাড়ের কালো ছায়া পড়ে আছে । চরম নিশ্তব্ধতা জমে আছে চারিধারে । স্বদর্পে জেগে আছে শুধু নাফনদী , কালো মেঘের দূরন্ত আকাশ আর দূর থেকে ভেসে আসা হুঁশিয়ারের ধ্বনি ।  

ভাসতে ভাসতে মোহনায় চলে আসে ওরা । নৌকা থেকে নিখুঁত নিশানায় খুঁটি গারে ফজর । এই কাজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার । আর সেই খুটিতে কোন মতে জাল পাতে হাসানমাঝি । আর কিছু পড়েই শুরু হবে ভাটার টান । সে সময় জাল তুলে ধরলেই ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আটকে যাবে জালে । আর সেই মাছের ভাল দাম পাবে কাল । অনেক দাম !
ভাটার টান শূরু হয়ে গেছে । নাফের উঁচু বুক যেন শ্বাস ছেড়ে দিচ্ছে । দুকূল খালি করে দিয়ে সব পানি যেন গিলে খাচ্চে ক্ষুদার্ত সাগর । এবার জাল টেনে ধরবার পালা ।জালে টান দিতেই চোখ জূড়িয়ে গেল হাসানমাঝির । ঝাঁক ঝাঁক চিংড়ি , ওলিয়া আর কোয়া মাছ । মাছে টৈটুম্বুর অবস্থা নৌকার । মাছ সামলাতে গিয়ে যে কত গুলো বিপদদ্ধনি বেখেয়ালে হাড়িয়ে গেছে তা কেউ জানে না । 
চাচা আর আটত না নৌকায় । চলেন যাই । অবস্থা ভাল লাগতেছে না । ফজরের কথায় মাঝি আজ আর রাগলো না । ঢুলু ঢুলু চোখে শুধু সম্মতি জানাল । আজ মনে মনে ভিন্ন হিসাব কষেছে মাঝি । এই বিপদ সঙ্কুল দুর্যোগ দুর্মর পথে ফজরই তাঁর পাশে ছিল । চরম বাধ্য থেকেও কেউ এমন মৃত্যু ঝুঁকি নেয় না । চল , আইজ যাইগা ...। 
উন্মাতাল নাফ নদীর দহে ঢেউ এর কোন ব্যাকরন নেই । বেশামাল তড়ঙ্গে নৌকার দিক সামলানো কঠিন । আবারও হুঁশিয়ারি বেজে উঠল । এই বিপদধ্বনী সব সময় বাজে না । এর আগে হাসান মাঝি এই শব্দ একবার শুনেছিল । কয়েক বছর আগে । তুফানের কি যেন একটা নাম ? হ্যা সিডর ! তাঁর বেশ মনে আছে । খুব ভাল ভবেই মনে আছে । ফজরের চেয়ে বছর চারেক বড় হবে । হাসানমাঝির জোর করে মাছধরতে  পাঠিয়েছিল সেদিন ।  সাবরাং ঘাটে ওই যে হাড়িয়ে গেল , তাঁর আজও কোন হদিস পাওয়া যায় নাই । মাঝি ঘামে । ভয়ে তাঁর হৃদপিন্ডের ব্যস্ততা বেড়ে যায় ।    
মাঝি দ্রুত নৌকা চালায় । তার সমস্ত শক্তি নৌকাকে দাপিয়ে দিতে পারে অন্য যেকোন সময় । কিন্তু আজ কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না । মাঝির মুখে কালো আঁধারের ছাপ পড়েছে ।  হঠাৎ ভট ভট আওয়াজ তুলে নৌকার কল থেমে গেল । মাঝি আবার স্টার্ট দেয় । কিন্তু না , স্ব শব্দে আবারও থেমে যায় । 
নৌকা এতিমের মত ভাসছে । চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার । অবারিত বৃক্ষরাজিরা দুর্মর তুফানে চরমর করে ভেঙে যাচ্ছে । একটা পাখিরও মৃত্যু আর্তনাদ শোনা যায় না । মেঘেদের চঞ্চলতার প্রতিচ্ছবিতে ভেঙে যাচ্ছে নাফের ফেনীল জলরাশি । মাঝি আবারও মেশিন স্টার্ট দেয় । বিকট শব্দে বার বার যেন চিৎকার করে ওঠে । নিষ্ঠুর সমুদ্রের ভয়াল অশুর যেন সেই শব্দ শুনতে  পায় । ধেয়ে আসে আরো বিদ্ধংসী হিংসায় । নাফের ঢেঊ আছড়ে পড়ছে নৌকার উপর । নৌকার পাটাতন ধরে কোন রকমে টিকে আছে দুই জন । হাসান মাঝির নিখুঁত দৃষ্টি ফজর পর্যন্ত পৌছায় না । ফজর শুধু থেমে থেমে চিৎকার করে । নৌকা যে ঘুরছে , পাক খেয়ে ঘুড়ছে । চাচা ডড় লাগতাছে চাচা । আইজ মনেকয় বাচুম না ।  
মাঝির কোন আওয়াজ নাই । নৌকায় দ্বিতীয় কোন মানুষের ছায়াও নেই । নৌকা থেকে খানিক দূরেই একটা বিকট চিৎকার শোনা গেল । হাসান মাঝি ভাসবার বাঁচবার চেষ্টায় হাত পা নাড়ছে । ফজর দেখতে পায় । তাঁর নৌকা হালকা হয়ে গেছে । সেই ঘূর্নি থেমে গেছে যেন । ফজর হাত বাড়ালে মাঝিকে পাবে না , বাঁশের কোঁচ এগিয়ে দিলে মাঝির নাগাল পাবে । ফজর দাঁড়িয়ে গেল । তাঁর মাথা ঘুড়ছে । প্রতিশোধের দূরন্ত নেশা তাঁর চোখ জুড়ে ভেসে উঠেছে । হ্যা , ফজরের ও রাগ আছে । মন আছে ,ব্যথা আছে । যে নিষ্ঠুর মানুষের ভয়ার্ত রাক্ষুসে মুখ সে এত দিন দেখে এসেছে তাঁর কাছে আজকের এই স্বার্থপড়তা কিছুই না ।  হাসান মাঝির মত ভয়ানক স্বার্থপর দালাল দের মরে যাওয়াই উচিৎ । বাঁশের কোঁচটি চোখ বুজে ফেলে দিল ফজর । অনেক দূরে , তাঁর পাকা হাতের নিখুঁত নিশানায় । এই কাজে তাঁর জুড়িমেলা ভার ।      


পদাবলি

পদাবলি



আহ্লাদের প্রেমের
মিনহাজ উদ্দীন শরীফ

প্রেমের জ্বালায়
আহ্লাদে আটখানা; এখনও নদীর পাড়ে;
আবার বৃক্ষের গোড়ায়
বসে শুধুই কাব্য লিখছে আর লিখছে।

কিছু বলতে গেলে
চেঁচামেচি করে ; গলা ফাটিয়ে দেয়।
ধারেকাছে ঘেষতে দেয়া না; কাউকে!

সারাক্ষণ শুধু একা একা
বকবক করে যায়; লোকের মুখে পাগল ;
নামে খ্যাতি অর্জন করেছে।

ক’দিন ধরে  নিজেকে কবি
ভাবতে শুরু করেছে ; তাই খুব শান্তশিষ্ট
পরিবেশে লুকোচুরি খেলে নীলিমার মতো।

কখনো আবার একান্তেই
চাঁদের সাথে নিজের; ভাব বিনিময় করে প্রতিনিয়ত
সংসার ভুলে গিয়ে মগ্ন থাকে।



কোলাজ
সবর্না চট্টোপাধ্যায়

১. ভোর

স্নিগ্ধ মৃদু ছটা
ছুঁয়েছে মাটি
কোলাহল ঘুমন্ত শিশু। শুধু ঘুম নেই
মা হারা চারটে কুকুর ছানার

২. মা

চারটে মেরি বিস্কুট খেতে দিয়েছিলাম।
তুলতুলে ঠান্ডা জিভ চেটে নিল
হাতের তালু
গোলাপি লালার টোকায় নড়ে উঠল ফাঁপা কলসি!
তারপর সূর্য ওঠা আবার।
পাশের দোলনায় ঝাঁপাল একফালি রোদ।
সাদা বিছানাটা হঠাৎ আরও সাদা

ছেড়ে গেছে দু’দিন হল!

৩. জীবন

কেঁপে উঠি। বিদ্যুৎ পড়ে মাঝরাতে
ভূমিকম্পে তছনছ হই রোজ!
তবু তো সাজানো আবার
সপ্তাহে দু’টো সিটিং!
লড়াই শেখাচ্ছেন দু’জন মনোবিদ


রাঙা
ছাদির হুসাইন ছাদি

রাঙা দিনে রাঙা তোতা।
রাঙা জনে-জন।
রাঙা মুখে রাঙা কথা
রাঙা মনে-মন।

রাঙা প্রেমে রাঙা ফুল।
রাঙা ফুলের গন্ধ।
রাঙা কথায় রাঙা সুর
রাঙা সুরের দ্বন্দ্ব।

রাঙা ঠোঁটে রাঙা বঁধু।
রাঙা বঁধুর হাসি।
রাঙা চোখে রাঙা মামা।
রাঙা মামার বাঁশি।

রাঙা জলে রাঙা নৌকা।
রাঙা নৌকার পাল।
রাঙা ঘরে রাঙা টিন
রাঙা টিনের চাল।

রাঙা খেলা রাঙা মেলা।
রাঙা রঙিন দেশ।
রাঙা আমি রাঙা তুমি
রাঙা জাতি বেশ।


শিকড় ছেঁড়ার ইচ্ছা
মাহফুজা মতি জেরিন

হলদে রঙের ঘাসের তলে আছি
তোমার সবুজ আমায় ছুঁতে মানা,
বনের যত হাওয়া রীতির জোরে
তোমার আমার ফুরালো আলপনা।

জারুল গাছে দুইটি টিয়ের খুশি
আমার স্মৃতির কারণ হলো খুব,
কথা ছিল জোড়াপাখির মত
জোছনা নিশির বুকে দিব ডুব।
প্রথম যেদিন আমার ঘওে এলে
বৃষ্টি মেখে ভিজে হলে চুপ,
মুগ্ধ আমি পলক ছাড়া চেয়ে
চোখের নিচে জল ফেলেছি টুপ।

পায়ে আমার বনের শিকড় বাঁধা
তবু এ মন উথাল জোয়ার তুলে,
ইচ্ছে কওে শিকড় ছিঁড়ে ফেলি
তোমায় নিয়ে থাকি জারুল তলে।




ভ্রমের উপাখ্যান
নুশরাত রুমু

মৌন সময়ে পূর্ণিমার পটভূমি থেকে
ভেসে বেড়ায় অহমের ছায়াগুচ্ছ,
কর্ষিত চিন্তাতরঙ্গে রচিত হয় ভ্রমের উপাখ্যান।
সারি সারি অমানুষের বুনো ঘ্রাণে সংক্রমিত সততার চিন্তাশক্তি,
দুর্মতির লোকালয়ে অক্লেশে বয়ে চলে খেদের বাতাস।
মানবিক ব্যঞ্জনার জালে ঘুমন্ত বিবেক ছলকে ওঠে কখনো সখনো।
লিপ্সার গুল্মে প্যাঁচিয়ে সত্যের চামচে নুনও চাখে কেউ কেউ...

শরীরী ভারতবর্ষ
অতনু নন্দী

এখানে ভীষণ আঁধার, সাদা বককেও ঘন লাগে
শরীরের মাঝ বরাবর দু’টি পাহাড়ী টিলা সযতেœ ঢেকে রেখেছি বহুবার,
অনুকৃতি চাঁদ খাবে বলে আগুন নিয়ে
ছুটে এলো অক্টোপাস,
মহা উল্লাসে চটকে খেয়ে গেলো, হারালাম মেয়েবেলা!

হে ঈশ্বর প্রতিধ্বনি দাও, আমি ছিঁড়ে ফেলি দিক চক্রবাল।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে আজ জপের মালা,
আমিতো আমার কুসুম হারিয়ে
দেখতে চাইনি শরীরী ভারতবর্ষ!


মানুষ রোগ
নাজমুল হুদা

মানুষ নাই, অথচ মানুষ
সারি সারি ধানের মতো লেপ্টালেপ্টি করে
গ্রীষ্মের সাপ সঙ্গমের মতো গড়াগড়ি খেলে।

মানুষ নাই, অথচ মানুষ
রমনীর কলসভর্তি জলের মতো উপচে পড়ে
সজ্জিত পুতুলের ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে।

মানুষ নাই, মানুষ আছে -
স্বল্পমেয়াদি মূল্যে এন্টিসেপ্টিকের ঘ্রাণ নেয়
পাঁতি হাসের দাম্পত্যে সুখে জলাধারে ভাসে
লাল পিঁপড়ার বিষাক্ত বিষে বিষিয়ে তোলে।

অতঃপর, আমার কোনো মানুষ থাকে না ;
মানুষের মতো একাধারে কল্পনায় বুঝে উঠি
উদয়-অস্তের আলো ডিঙে নীল আমরা ভোগছি
মানুষরোগে- ব্যথায়, শূন্যতায় এদিক ওদিক কাতরাচ্ছি।


আমার এখন ভাল্লাগে না
ইস্রাফিল আকন্দ রুদ্র

আমার এখন ভাল্লাগে না তোমার ছায়া
আমার এখন ভাল্লাগে না তোমার মিছে কন্ঠ আর মায়া।
তুমি আমার হতে অযুত মাইল দূরে থাকো
তুমি স্বৈরাচার, তোমার মিছে প্রেম দূরে রাখো!

আমার এখন ভাল্লাগে না সাদা শার্ট পরা
আমার এখন ভাল্লাগে না পড়তে প্রেমের ছড়া।
তুমি আমার স্বপ্ন ছায়াতলা হতে বহুদূর
তুমি করো মিথ্যাচার; তাই আমার মন সেতারে অন্য কামিনীর সুর!

আমার এখন ভাল্লাগে না শুনতে তোমার হাঁসির শব্দ
আমার এখন ভাল্লাগে না আর তোমার অশ্লীল সব গদ্য।
তুমি আমার নীল কলমের চির অরাতি
তুমি থাকো খুব কষ্টে আর নষ্টে; আমি আনন্দে মাতি।

আমার এখন ভাল্লাগে না আটটা-পাঁচটা অফিস
আমার এখন ভাল্লাগে না তোমার কথা, তাতে যতই থাকুক আমিষ।
তুমি আমার পায়ের ধুলো আর ‘কালসাপ!’
তুমি ঠোঁটকাটা, তোমায় ভাবলে পাপ হবে পাপ।

আমার এখন ভাল্লাগে না, ভাল্লাগে না আর তোমার প্রেমের ছাঁপ!

বেদনার জল
আশিক আহমেদ

শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মিশে থাকে আমার বেদনা স্মৃতি;
ক্যানভাসে ভেসে উঠে তোমাদের গোলাকার মুখ।

বাবা-মায়ের শূণ্যতায়-
ঘেরা থাকে আমার চারিপাশ।

দাদার নিজ হাতে রোপন করা জামতলায় রেখে গেছে-
সমাধির শেষ ঠিকানা

যেখানে সমাধি হয়ে আছে
আমার বংশের পরম্পরারা আমাদের ও একদিন হতে হবে।

বাবা-মা
তোমাদের সমাধির পাড়ে দাড়ালে-
নিজের অজান্তে দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে আমার বেদনার জল।

দিব্য সাক্ষী হতে হাসনাহেনা গাছটিও ভুল করে না

আরো ও সাক্ষী হয়ে থাকে
ওই নীল আকাশ।

পরিবর্তন
সতী

এখন আর প্রভাত বেলায়
কপাল জুড়ে আমার চুমু লাগেনা
ঘুম জড়ানো দুচোখ খুলেই আমার অভাব জাঁগেনা!
এখন আর সাঁঝের বেলায়
আঁধার খেলায় সরল এ মুখ আঁকেনা
আমার কথা ভেবে কারো
জল দুচোখে থাকে না!
বৃষ্টি সুরে বজ্র ধ্বনিই ভয় কাটাতে জাপটে ধরার
সে আশ আজ আর হাসেনা
পদ্ম ঝিলে পবন দুলে
স্বপ্ন ডিঙ্গা ভাসেনা!
এখন আর সতী বলে মিষ্টি কন্ঠে
আমায় কেউ আর ডাকেনা
ভালোবেসে এখন সে আর
বুক পাজরে পোষে না!



ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৭

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৭



জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]

বাবা বলল, তোমার কি ভালো লাগছে হাসান?
হাসান কিছু বলল না। হাসানের ছোট ভাই নিলয় বলল, আমার খুব ভাল লাগছে স্যার। এই জীবনে এতটা ভাল কখনো লাগেনি।
তোমার জীবন তো খুব ছোট। এখনই ‘এই জীবনে’ এভাবে কথা বলার সময় হয়নি। সামনে তোমার অনেক কিছুই দেখার সুযোগ রয়ে গেছে।
জি স্যার।
তুমি আমাকে ‘স্যার’ বলছো কেন? আমি কি তোমাদের স্কুলের মাস্টার? তুমি আমাকে দাদা বলবে, আর হাসান বলবে ভাই। আবার যদি ‘স্যার’ ডাকো তো থাপ্পর দিয়ে তোমার তিনটা দাঁত ফেলে দেব। তুমি কি তিনটা দাঁত হারাতে চাও?
জি না স্যার।
তাহলে আর ‘স্যার’ ডাকবে না।
ঠিক আছে দাদা।
আমার বুকের কাছে আসো, তোমাকে আদোর করি।
নিলয়কে বুকে জড়িয়ে বাবা বললেন, দ্যাখো ঐ চাঁদটা! ঐ হিজল ডালের ফাঁক দিয়ে। কোথায় যেন পড়েছিলাম-হিজলের ডাল কেমন হিজিবিজি রেখা এঁকে দিয়েছে চাঁদটার মুখে।
অন্তর বলল, বাবা, আমরা কিন্তু চাঁদ দেখতে আসিনি, এসেছি চাঁদের জ্যোৎস্না অবগাহন করতে।
তা ঠিক, তাই বলে চঁদের প্রশংসা করব না? যে চাঁদ এমন নিঃস্বার্থ আলো ঢেলে দিচ্ছে......। তাই তো নজরুল বলেছেন-চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে/ গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধুলি মাঝে।
হাসান বলল, স্যার, এটা কিন্তু তর্কের সময় না। তর্ক করে একটা মুহূর্ত অতিবাহিত করা ভুল হবে। প্রতি মুহূর্তে চাঁদটা একটু সরে যাচ্ছে। রাত এগিয়ে যাচ্ছে ভোরের দিকে। প্রতি মুহূর্তে বনের ইফেক্ট চেঞ্জ হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তের চেঞ্জ অবশ্য আমরা ধরতে পারব না। তবে প্রতি ঘন্টার চেঞ্জ ধরার চেষ্টা করতে হবে।
তুমি ঠিক বলেছো। তবে আবৃত্তি বা গান তো হতে পারে।
তা হতে পারে। সব সুন্দরের অনুসঙ্গই হল গান আর কবিতা।
তোমার আবৃত্তি শুনেছি, এবার না হয় গান শুনি।
আপনাকে তো সেবারই বলেছি, আমার বাথরুমেও গান গাওয়া হয় না অনেক দিন।
তাহলে আমিই গান গাইবো।
বাবা এ কথা বলতেই অন্তর চট করে বাবার মুখে তাকাল। অস্ফূট স্বরে বলল, বাবা!
বাবা অন্তরের মুখে তাকিয়ে দেখল, ওর মুখের ওপর এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে। শিশুদের মুখে চাঁদের আলো পড়লে এত সুন্দর লাগে! বাবা বলল, কোনো সমস্যা?
তুমি না একবার কলেজ জীবনে গান গাইতে গিয়েছিলে। এক লাইন গাইতেই দর্শক-শ্রোতা চিৎকার শুরু করে দেয়-গান থামাও-গান থামাও। শেষে তুমি মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হও।
ঘটনা সত্য। তখন হয়তো কোনো সমস্যা ছিল। নার্ভাসনেস বা শারীরিক অসুস্থতা। তবে আমি গান জানি এবং আমার প্রিয় গানগুলো আমি ভালই গাই। এটাই আমার বিশ্বাস।
তাহলে গাও।
গানটা চাঁদ দিয়ে শুরু।
তাতো হতেই হবে। এখন চাঁদ, চাঁদের আলো এসব ছাড়া অন্য কোনো গান কি মানাবে?
আমার ওস্তার ফিরোজ খান বলতেন, এই গানটা আমার কন্ঠে খুব মানায়। তিনি প্রায়ই আমাকে অনুরোধ করে এই গানটা শুনতেন।
তাহলে মানতেই হবে, তুমি গানটা ভাল গাও।
আমি এক টানা বারো বছর ওস্তাদ ফিরোজ খানের কাছে গান শিখেছি। তাঁর সুরের ওপর যেমন দক্ষতা ছিল তেমন ছিল গান শেখানোতে। প্রচার বিমূখ মানুষ হওয়ায় তিনি খ্যাতি পাননি। সংগীতে তাঁর ধারে-কাছে নেই এমন অনেকে তখন স্টার ছিল, এখনও আছে। এখন তো যা হয়....। কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে হাজার বিশেক টাকার এসএমএস খরচ করলেই সার্টিফিকেট। সংগীতে সার্টিপিকেট হয়? কি যে সময়ে আমরা.......।
বাবা! গাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।
ও হ্যাঁ, ওস্তাদের মৃতুর পর আমি আর কারও কাছে গান শিখিনি, গাইওনি কোথাও।
তাঁকে তুমি খুব ভালোবাসতে নিশ্চয়?
হ্যাঁ, তাঁকে আমি তেমন ভালোবাসি যেমন ভালোবাসি আমার বাবাকে। এমন নিখাদ ও পবিত্র মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। তাঁর মুখটা মনে এলেই আমার চোখে জল জমে ওঠে।
বাবা বাম হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলেন। নিলয় যেন একটু ঘাবড়ে গেল। এরকমটি তার কাছে অনাকাঙ্খিত।
বাবা বললেন, ওস্তাদ তখন খুবই অসুস্থ। সন্ধ্যায় আমি তাঁকে দেখতে গেলাম। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে এমন মায়া হল! আমি বসে রইলাম তাঁর মাথার কাছে। রাত নেমে এল। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগল। আমি বসেই আছি ওস্তাদের মুখে চেয়ে। ওস্তাদ ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, তুমি বাড়ি যাও, রাত হচ্ছে সবাই চিন্তা করবে। আমার তখন ওস্তাদকে ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হল না। আমি বসে রইলাম ঠায়। সে রাতও ছিল এমনই ভরা পূর্ণিমার রাত। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে লুটিয়ে পড়ছিল ওস্তাদের মুখে। রাত তখন প্রায় বারোটা। ওস্তাদ বললেন-সেই গানটা গাও তো বাবা। আমি গাইলাম। ওস্তাদ অপলকে তাকিয়ে থেকে শুনলেন গানটা। আমার গান শেষ হল। ওস্তাদের চোখে আর পলক পড়ে না। আমার গান শুনতে শুনতে ওস্তাদ চলে গেলেন জীবনের অন্য প্রান্তে। আমি আলতো হাতে ওস্তাদের চোখ বন্ধ করে দিলাম।  
সবাই নিশ্চুপ। বাবা আচানক পরিবেশটা কেমন করুন করে দিল। কিন্তু দুঃখটাকে ধরে থাকা ঠিক হবে না। কারণ, এটা দুঃখের সময় না। হাসান বলল, স্যার, গানটা শোনাবেন না?
বাবা গাইল-
চাঁদের এত আলো তবু সে আমারে ডাকে
উতলা মাধবী রাতে মাঙ্গিছে হে মোর আঁখি।।
ফুলের সুরভী আছে, তাহারে ছাড়িয়া যাচে
মনের সুরভী মম শুনি রেনু তাতে থাকে।।
বনের লতার কোলে কত না বিহগ জানি
গানের লহর তোলে কহে গো কতনা বাণী।।
মোর কথা মোর গানে শুনিয়া অবাক পানে
আমার কন্ঠ যাচে মহুয়া বনের পাখি।।
গানটা শেষ হলে কেউ কিছু বলল না। বিস্ময় ও মুগ্ধতা সবার    চোখে-মুখে। অতিরিক্ত মুগ্ধতা, অতিরিক্ত বিস্বয়ে কথা আসে না মুখে।
ওরা যেখানে বসেছে সেখানে জ্যোৎস্না ততটা উজ্জ্বল নয়। সম্মুখটা আবছা অন্ধকারে ঢাকা। কারণ নিবীড় গাছের ছায়া। দূরে বন যেখানে শেষ সেখানের জ্যোৎস্না উজ্জ্বল। আবছা অন্ধকারের মাঝে বসে ওরা উজ্জ্বল জ্যোৎস্নার দিকে চেয়ে রইল। হয়তো ওরা সারা রাতই এভাবে বসে থাকতো। হঠাৎ অন্তর ডাকল, বাবা!
কন্ঠটা কেমন কাঁপা। একটু ভয় জড়ানো। সবার ধ্যান ভাঙল। বাবা বলল, কী হল?
ঐ দ্যাখো!
কী?
তিনজন লোক আসছে।
আসুক।
এত রাতে তারা বনের ধারে কেন?
আমরা কেন?
তুমি কি মনে করো, তারাও জ্যোৎস্নায় প্রকৃতি উপভোগ দেখতে এসেছে?
হয়তো আশেপাশেই তাদের বাড়ি। কাজ থেকে বাড়ি ফিরছে।
নিলয় বলল, গ্রামে বেশ রাত করেও অনেকে বাড়ি ফেরে। গ্রামের মানুষ রাতের বেলা বন-জঙ্গলে হাঁটতে ভয় পায় না।
বাবা নিলয়ের পিঠ চাপড়ে বলল, বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছেলে।
তিনজন লোক আসতে আসতে ওদের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। তিনজনই বয়সে যুবক। পোশাক-আশাক গ্রাম্য নয়। পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট, পায়ে বুট জুতা, চোখে সানগ্লাস। রাতের বেলা চোখে সান গ্লাস কেন? নাকি সেটা মুন গ্লাস? মুন গ্লাস বলে কি কোনো গ্লাস আছে? নাইট ভিসন গ্লাস আছে বলে অন্তর জানে। সেনাবাহিনীর লোকরা সে গ্লাস ব্যবহার করে। সে গ্লাস পরে নাকি অন্ধকারেও দেখতে পাওয়া যায়। তাহলে কি তাদের চোখে নাইট ভিসন গ্লাস?
দুইজন লোক দাঁড়াল ওদের দুই পাশে। আর একজন সামনে। পাশের দুইজন দু’টি পিস্তল বের করল। সামনের লোক বলল, যা আছে বার কর-ঝটপট, একটু এদিক-ওদিক হইলেই ফুটা....।
সামনের লোকটা বোধহয় দলের নেতা। ওরা কেউ কোনো কথা বলছিল না। কেমন স্তব্দ হয়ে ফ্যাকাশে চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। সামনের লোকটা বলল, পিস্তল দেইখা ডরের কিছু নাই। আমাগো কথা শুনলে আমরা ওগুলা ব্যবহার করি না। যা আছে ভদ্রভাবে বাইর কইরা দে’।
বাবা বলল, আমাদের কাছে দুইটা সেলফোন, কিছু টাকা, আর কিছু খাবার আছে। খাবার গুলোও কি দিতে হবে?
মোবাইল আর টাকা দিলেই হইবো।
হাসান তার সেলফোন আর মানিব্যাগ বের করে বাবার হাতে দিল। বাবা নিজের সেলফোন আর মানিব্যাগ বের করে লোকটার হাতে দিল। লোকটা বলল, এই পিচকিরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না? এই দুই পিচকি, তোগো মোবাইল ফোন নাই?
লোকটা আঙুল তুলে অন্তর আর নিলয়কে নির্দেশ করল। অন্তর কিছু বলতে পারল না। সে শুধু ভাবতে লাগল, শেষ পর্যন্ত মায়ের আশঙ্কাই সত্যি হল। মায়ের কথা অমান্য করে এভাবে রতের বেলা আসা ঠিক হয়নি।
নিলয় বলল, শিশুদের সাথে সুন্দর করে কথা বলতে হয়।
আব্বারা, তোমাগো মোবাইল নাই?
জ্বি না, আমি গ্রামের দরিদ্র ঘরের ছেলে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারি না। ও শহরের ছেলে হলেও সেরকম বড়লোকের ছেলে না। ওর বাবা ওকে মোবাইল ফোন দেননি।
আজকাল তো দুধের শিশুরাও মোবাইল ব্যবহার করে।
করে, তবে সবাই না। আমাদের কোনো মোবাইল ফোন নেই।
লোকটার ইশারায় দুই পাশের দুইজন পিস্তল পকেটে ঢোকাল। লোকটা মানিব্যাগ থেকে টাকাগুলো নিয়ে একটা মানিব্যগ হাসানের দিকে, আরেকটা বাবার দিকে ছুড়ে দিল। তারপর বলল, সিম খুলে দিলে কি ভাল হয়?
বাবা বলল, সিম তত জরুরি না। দুই/তিনশ’ টাকা ফেরত দিলে ভাল হয়। ঢাকায় ফিরে যাব, পকেটে একেবারে খালি থাকলে.....বলা তো যায় না কখন কী দরকার পরে।
ঢাকায় ফিরে যাব মানে কী?
আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।
ঢাকা থেকে আইসা রাইতের বেলা এই জঙ্গলের মধ্যি বইসা আছোস যে?
হাসান ভাঙা কন্ঠে বলল, দয়া করে তাকে তুই তুই বলবেন না। তিনি একজন সম্মানিত লোক। সরকারি অফিসের সেকেন্ড ক্লাশ অফিসার।
লোকটা হাসানের দিকে কঠিন চোখে তাকাল। বলল, তুই মনে হয় জানোস না যে, গুন্ডা-পান্ডার সাথে ফাও কথা বলতে হয় না। কত ফার্স্ট ক্লাশের গালে থাপরাইলাম তার হিসাব নাই, তুই আইছোস সেকেন্ড ক্লাশ নিয়া। আর একটা ফাও কথা কইবি তো দিমু ভুড়ি ফুটা কইরা। [ক্রমশ...]

অক্ষরমালা : সাদিক আল আমিন

অক্ষরমালা : সাদিক আল আমিন



অক্ষরমালা
সাদিক আল আমিন


নিঃসঙ্গতার সঙ্গে কিছুক্ষণ

কিছুটা ভ্রান্ত হলেও হতে পারে উৎকণ্ঠা
নিমিষেই হাওয়া হয়ে যেতে পারেন বলে
গোচরের বাইরেও হাতরালাম
একদিন কিভাবে করে বুঝতে পেরে যেন
তিনি খোঁপা খুলে পিঠ ঢাকলেন
ইচ্ছের তখনো বহু বাকি হাত-পা গজানোয়
বোনদের সাথে কথা বলে দেখলাম,
নিতান্ত ভদ্রমহিলাও নন; তবে
সন্ধ্যের দিকে একা বসে আছি ভেবে
ঐদিন তিনিও কেমন ভুল-ভাল হাঁটছিলেন; আর
এদিকে দমকা হাওয়ায় আমার আধ-খোলা শার্ট
লোমশ বুক উন্মুক্ত করে দিলো অগত্যাই

প্রহেলিকা তুমি অন্য কারো

প্রত্যাশার বিকৃতি হয়না কখনো, একথা জানে নিখিল
শিমুল হাতে দৈনন্দিন বাসস্টপ, অপেক্ষা অবসর
কবিতা লিখতে পারলে চমৎকার হতো, কাব্যিক পরিবেশ
আবৃত্তি ওর পছন্দের কিনা! জানা যেতো
শাপলাচত্তরে উদ্দেশ্যহীন চক্কর খায় বেসুরো ঝড়
শ্রেফ ইমপ্রেস করার জন্য; মঞ্চনাটকেই মূল দাখিল
মেয়েটা হয়তো বুঝবেনা, বুঝলে কি আসে যায়!
সিরাজপর্ব যবনিকায়, এখন কি আর প্রণয় মানায়!

জীবনবোধের পদাবলি

অতঃপর যে বৃদ্ধ ভবিষ্যৎবাণী করেছিল ঝড়ের
এবং ‘সমূলে সবকিছু ধ্বংস হবে এ ধরায়’
মনোভাব নিয়ে যে সাফাই গেয়েছিলো চিরমুক্তির
তার কুঁচকানো গলা দিয়ে নামেনা বাস্তবতা
সর্বস্ব হজম করতে পারলেই তবে মুক্তি
তাই প্রভুর মতো অভিনয় করে; যদি আবার
ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে অন্যকিছুর, যেমন-
‘পরবর্তী প্রজন্ম হবে অতিব সুজলা’
আর ‘এবারের মতো এ বৃদ্ধ পরিত্রাণ পাবে’
ধরণের কথকতা; তবে হয়তো ক্ষমাপ্রার্থনা
সময় নিয়ে সফল হতে পারে
বৃদ্ধ তার হাড়গিলে গলা নামিয়ে পেতে পারে
অমর-মুক্তি; দ্বিতীয় বাণী অনুসারে...
তবে যদি ঝড় ওঠে প্রকৃতির ধারা মেনে
হা-হুতাশ অনেকেই মাথা চাপড়িয়ে বলবে,
‘ইতিহাস যেনো বারবার ফিরে আসে!’
আরো বলবে, ‘বাণীপ্রার্থনার দরকার কি ছিলো!
খামোখা শুধু বুড়োটা মরলো
আমাদের তবে পথ দেখাবে কে!’
তখন ঝড় নিয়ে আসে অমর-বার্তা
তিলে তিলে শিখোয় কষ্টসাধ্য বেড়ে ওঠা
লোকেরা কাজ করে খায় সিন্ধুর দ্বীপে
অহেতুক কখনো মাথা চাপড়িয়ে বলে,
‘ও বুড়ো, তুমি শুধু তুমিই ছিলে’

আবাসন

তাই ঐচ্ছিকতাকেও খুব ঘরোয়া হতে দেখি
এমনকি দেখছি এখনও... যদিও
দৃশ্যপট থেকে খসে পড়েছে দর্শন-ইচ্ছা
আর প্রেরিত প্রেমিকার লোভনীয় আঙুল ধরে
হেঁটে চলেছে এক সুদর্শন অথচ বোকা পুরুষ
আবছায়া ঘটনায়, অনিশ্চিত গন্তব্যে
গৃহাগত হতে দেখি বনবাসীদের...
বনবাসিনী, কি নাম ছিলো তার!
একথান ময়লা কাপড় পুরো শরীরে জড়াতো
নাম হয়তো ‘ডুমুর’, স্বাদহীন সেও ছিল ফলের মতো
ঘরে ফিরেছে একদিন...
দুরন্ত দিন, গোছানো রাত, বিপন্ন সময়
ঘরোয়া হয়... ফিরে আসে নাভিমূলে
আমি মহাজাগতিক, ফিরতে পারিনা মনের ভুলে

জন্মবেদনা

জন্মের বেদনা কেমন লাগে জানতে চাই
ইদানীং সবাইকে খুব মৃত্যুচেতা হতে দেখি
কালীন সময়ের থরে থরে তাদের যাতনাবৃন্দ সাজানো
সেই নিয়ে চলছে সন্ধ্যাপরবর্তী আলোচনাসভা
কার মৃত্যু কেমন হতে পারে...
কার দুঃখ রথ পেরিয়ে যেতে পারবে স্বর্গে! এইসব
আমি এসবের মোটেই তোয়াক্কা করছি না
শুধু জানতে চাইছি জন্ম নিলে কেমন লাগে
জন্ম দিতে নয়, জন্ম নিতে কেমন লাগে!

আকুলতা

এক প্রহর বিরহ...
অথচ মনে হয় যেন শত প্রহর তোমাকে
বলা হয়না মনের গোপন অভিসার
যেন বহুযুগ ধরে জাহাজের খালাশি সেজে
ছুটে গেছি, ছিটকে পড়েছি অজানায়
তীর্থবাসী হয়েছি, ফিরে গেছি উল্টোপথে
ব্যথাতুর গতভূষণা আমার
গহীন বনে অসহায় তড়পায়
এক প্রহরে কত কিছুই না দেখেছি!
দেখিনি শুধু তোমাকে

লেখা আর হল না

লেখা আর হল না


লেখা আর হল না
বিনায়ক ব্যানার্জী

বসেছি একটা কলম আর কাগজ নিয়ে। অনেকদিন কিছু লেখা হয়নি লিখব বলে। গ্রীষ্মের দুপুর, নাওয়া খাওয়া সেরে জানলার দিকে চেয়ে সুখটান দিচ্ছি। ভাবের কোন অভাব নেই, অভাব শুধু ভাবের। বাইরে চাঁদি ফাটা রোদ। গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ওদের মাথাতেও ছাতা ধরতে হবে। মাটির রাস্তা, জনপ্রাণীও  নেই। যতদূর দেখা যাচ্ছে সব ঘরগুলোর জানলা দরজা বন্ধ। আমি একাই বোধ হয় জানলা খুলে বসে আছি। তবুও কেউ উঁকি মারছে না।

ভিতরে ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ওকে আসলে বার্ধক্যে ধরেছে। কদিন হল একটা নতুন টিকটিকির আমদানি হয়েছে। বুঝেছিলাম ওর চেহারা দেখে। একটু বেশী’ই বড়। অবশ্য এসেই একটার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। ছেলে না মেয়ে জানি না কিন্তু। দু’জনে মিলে এখন বইয়ের তাকের অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নাহ্- অনেকক্ষণ হয়ে গেল তবুও একলাইনও লেখা হল না। বসে থাকাই সার। স্মৃতিগুলো মনে হচ্ছে ধূলো পড়ে গেছে। কেউ আর ধরাই দিতে চায় না। ধুর; কি যে করি! এতো সময় কাটানোই দুরহ ব্যপার। আজকের পেপারটাই আবার উলটাতে লাগলাম। সেই এক খবর পলিটিসিয়ান গুলোর বড় বড় ভাষণ, আন্দোলন, হ্যান করব ত্যান করব। বিপদ সাধারন লোককটার। কোন দল ঠিক আর কে ভুল এটা বিচার করতে করতেই জীবন উদ্ধার। ফুটবলের খবরও কিছু নেই। বদলে ইয়া বড় একটা জাপানী তেলের বিঞ্জাপন। লেখা আর আমার হচ্ছে  না।

জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি ঈশাণ কোনে কালো মেঘ জমাট বাঁধছে। কালবৈশাখী। গাছগুলোকে যেন আরও সবুজ দেখাচ্ছে। কি দ্রুততার সঙ্গে মেঘগুলো জম হচ্ছে। ওরাও কি আন্দোলন করতে আসছে নাকি! মুহূর্তের মধ্যে গোটা আকাশ কালো করে ফেলল। একটা ঠান্ডা হাওয়ায় মনপ্রাণ শীতল হয়ে গেল। গাছগুলো মাথা দোলাতে লাগল। তার মানে  ওরাও আন্দোলনে শামিল। শুরু হল ধূলোর ঝড়। হঠাৎ প্রচন্ড বেগে মেঘ ডাকল। সত্যি বলছি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

হঠাৎ মনে পড়ল একটা মুহূর্ত। অনেক বছর আগেকার, আমি তখন স্কুলে পড়ি।  সেদিনও ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময় কালবৈশাখী শুরু হয়েছিল। ভয় পেয়ে দাড়িয়ে ছিলাম একটা খড়ের চালার মধ্যে। সেখানে একটা মেয়েও ছিল, অপরিচিত, মনে হয় আমার বয়সী। সেদিনও মেঘ ডেকেছিল। মেয়েটা ভয় পেয়ে এগিয়ে এসেছিলো আমার কাছে। না জড়িয়ে ধরেনি। কিন্তু আমি তার গরম নিশ্বাস অনুভব করেছিলাম।




সাম্যবাদী, প্রেম ও দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

সাম্যবাদী, প্রেম ও দ্রোহের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ




সাম্যবাদী, প্রেম ও দ্রোহের কবি 
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা আদ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে’
-রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিমান কবি ও প্রতিবাদী কন্ঠস্বর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা কবি ১৯৯১ সালের ২১ জুন রাজ্যের অভিমান নিয়ে পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে চিরতরে ওপারে চলে যান। মার্কিন বর্ণবাদ বিরোধী অবিসংবাদিত নেতা মার্টিন লুথার কিং কে বলা হত মুকুল বিহীন সম্রাট। আর বাংলা কাব্য সাহিত্যে আরেক মুকুট বিহীন সম্রাট ছিলেন বিপ্লবী কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। কবি আল মাহমুদের পর তিনিই দুই বাংলায় সমানভাবে জনপ্রিয় এবং শক্তিমান কবি হিসেবে খ্যতি অর্জন করে ছিলেন। তবে তাঁর নামের পাশে বড় কোন তকমা মানে পদক নেই। এতে করে কবিকে কোন ভাবেই খাঁটো করা যায়নি বরং যেসব প্রতিষ্ঠান কবিকে সম্মান জানাতে পারে নাই, তারাই বিতর্কিত ও বঞ্চিত হয়েছে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সমকালীন অনেক কবির নামের পাশে অনেক বড় বড় তকমা যুক্ত থাকলেও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জনপ্রিয়তার কাছে তাঁরা অনেকেই ম্লান হয়ে যাবেন। কবির সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে দুই বাংলার কোটি কোটি ভক্তের ভালোবাসা। জীবিত অবস্থায় কবি যতটা না জনপ্রিয় ছিল, মৃত্যুর পর তিনি আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ঘুণে ধরা জরাজীর্ণ  সমাজকে বদলে দিতেই এই স্বল্প প্রাণ কবির জন্ম হয়েছিল। ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশে এমন কোনো আন্দোলন নেই, যেখানে কবির অংশগ্রহণ ছিলো না। অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন। মুক্ত মঞ্চে সেই প্রতিবাদী কবিতা গুলো আবৃত্তি করে সাধারণ মানুষের ভেতরে প্রতিবাদী সত্তা জাগ্রত করার নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর মননে ছিল কবিতা, আবৃত্তিতে অনলবার্তা আর রক্তে প্রবাহিত বিদ্রোহের লাভা। মৃত্যুর মাঝেই তাঁর সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে। তবে তাঁর প্রতিবাদী কবিতা গুলো আজও পাঠক হৃদয় আন্দোলিত করে। কবিতা, গল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ, গান- যেখানেই শিল্প সাহিত্য সেখানেই রুদ্র। তিনি ভক্তদের হৃদয় সিংহাসনে কবিতার রাজপুত্র হয়ে বসে আছেন। উনাকে আখ্যায়িত করা হয় বাংলা কাব্য সাহিত্যের ‘প্রতিবাদী রোমান্টিক কবি’।

১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ ওয়ালীউল্লাহ, মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। তাঁদের স্থায়ী নিবাস ছিল বাগেরহাট জেলার মংলা থানার সাহেবের মেঠ গ্রামে। রুদ্রর নিজ বাড়ি সাহেবের মেঠ থেকে তার নানা বাড়ি মিঠেখালি খুব বেশি দূরে ছিল না। রুদ্রর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আর লেখালিখিতে আগ্রহ দুটোই তৈরি হয় এই নানাবাড়িতে। সে সময় ঢাকার বিখ্যাত ‘বেগম’ আর কলকাতার ‘শিশুভারতী’ পত্রিকা আসতো তাঁর নানাবাড়িতে। সেই সাথে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পাশাপাশি বিভিন্ন বিখ্যাত লেখকদের বইপত্র তো ছিলই। রুদ্র এসব বইয়ের রাজ্যে মজে যান। নানাবাড়ির পাঠশালায় ৩য় শ্রেণী অবধি পড়েন রুদ্র। এরপর ১৯৬৬ সালে ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন মংলা থানা সদরের সেইন্ট পলস স্কুলে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাঁর আর ৯ম শ্রেণিতে পড়া হয়নি। যুদ্ধ শেষে ৯ম শ্রেণী টপকিয়ে কবি ১০ম শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে। এখান থেকেই ১৯৭৩ সালে ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসহ বিজ্ঞান শাখায় ১ম বিভাগে রুদ্র এসএসসি পাস করেন। এরপরে তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পিতামাতার ইচ্ছা ছিল, রুদ্র ডাক্তার হোক কিন্তু রুদ্র বিজ্ঞানের পথে আর না গিয়ে তাঁর পছন্দের মানবিক শাখায় চলে এলেন। ঢাকা কলেজে এসে রুদ্র পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। সহপাঠী হিসেবে পেলেন কামাল চৌধুরী, আলী রিয়াজ, জাফর ওয়াজেদ, ইসহাক খানসহ একঝাঁক তরুণ সাহিত্যকর্মীকে। ১৯৭৫ সালে রুদ্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ২য় বিভাগে। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি হন বাংলা বিভাগে। ১৯৭৮ সালে রুদ্র ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে সাহিত্য সম্পাদক পদে। রুদ্র সরাসরি কখনো রাজনীতিতে না এলেও ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রকাশ করেন তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস টিকে ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ১৯৭৯ সালে রুদ্রর অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিতির হার কম থাকায় বাংলা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর আহমদ শরীফ তাকে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেননি। পরের বছর, ১৯৮০ সালে তিনি অনার্স পাস করেন। এরপর নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় আবারও পিছিয়ে পড়েন রুদ্র। পরিশেষে ১৯৮৩ সালে রুদ্র এমএ ডিগ্রি নেন।

রুদ্রর পিতৃ প্রদত্ত নাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছোটবেলায় এই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। লেখালেখির জগতে এসে নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন। কবির ভীষণ এক খামখেয়ালীর জীবন ছিলো। মুক্ত স্বাধীন পাখির মতোই ডানা মেলে এখানে ওখানে ঘুরতেন। তিনি ছিলেন নিখাদ বাউন্ডুলে ও ভবঘুরে। পারিবারিক স্বচ্ছলতা ছিলো কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে বাঁধেননি। কয়েকটা রিক্সা ছিলো, তা থেকে যা আয় হতো তাতেই চলতেন। তিনি ঠিকাদারী করেছেন, চিংড়ির খামার করেছেন কিন্তু শৃঙ্খলহীন জীবনের কারণে সফলতা পাননি। পাঞ্জাবী আর জিন্স প্যান্টের যুগলবন্দী তখন বোধহয় তিনি একাই ছিলেন। তাঁর ছিল অতি মাত্রায় মদ্যপ্রীতি। প্রতিসন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা দিতেই হতো। হুইস্কির বাংলাকরণ করেছিলেন ‘সোনালী শিশির’। এই নামে একটা গল্পও লিখেছিলেন। জীবন নিয়ে রুদ্র যতো হেলাফেলাই করেছেন, কবিতা নিয়ে কখনো করেননি। কবিতায় তিনি সুস্থ ছিলেন, নিষ্ঠ ছিলেন, স্বপ্নময় ছিলেন। ১৯৭৯ সালে বের হয় রুদ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূলে’। প্রথম কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। প্রথম বইটির প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। তারপর একে একে ‘মানুষের মানচিত্র’ (১৯৮৪), ‘ছোবল’ (১৯৮৬), ‘গল্প’ (১৯৮৭), ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ (১৯৮৮), ‘মৌলিক মুখোশ’ (১৯৯০)। কবির জীবদ্দশায় মোট ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় আর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’। রুদ্র যেমন খ্যাতিমান কবি ছিলেন, তেমনিভাবে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। তিনি প্রায় অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। কবির কালজয়ী কবিতা, পরবর্তীতে সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা গান ‘আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ কবিকে অমরত্ব এনে দেয়। বাংলায় এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে, যিনি এই গানটি শুনেন নাই। দুই বাংলায় এই গানটি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বেশ আলোচিত। তিনি ‘অন্তর বাজাও’ নামে একটি গানের দল গড়েছিলেন। এই গানের দল নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। শেষ জীবনে ফিল্ম বানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু অকাল মৃত্যু পথ আটকে দিলো। রুদ্র ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-যুগ্ম সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহবায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব।

১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারি, সামাজিক প্রথা ভেঙে, অভিভাবকের অমতে তসলিমা নাসরিনকে বিয়ে করেছিলেন। তসলিমা মূলত ছিলেন একজন চিকিৎসক। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। রুদ্র ও তসলিমার পরিচয় লেখালেখির সূত্র ধরে আর পরিচয় ক্রমে রূপ নেয় প্রণয়ে। রুদ্র-তসলিমার দাম্পত্য জীবন ভালোই কাটছিল। রুদ্রের উৎসাহ ও প্রেরণায় তসলিমাও পুরোপুরি জড়িয়ে যান লেখার জগতের সাথে। তসলিমা চেয়েছিল রুদ্রের মতোন বন্য পাখিকে সংসারের খাঁচায় বন্দি করে রাখতে। রুদ্রের শৃঙ্খলহীন জীবনে সংসারের খাঁচায় বন্দি হওয়াটা ছিল অসম্ভব। ছয় বছর দাম্পত্য জীবন শেষে তারা আলাদা হয়ে যান। ১৯৮৬ সালে উভয়ের সম্মতিতে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর রুদ্র ভীষণ একাকিত্ব অনুভব করেন। তিনি আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেন। শরীরের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করেছেন। তুখোড় ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম সব মিলিয়ে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। শারীরিক অসুস্থতাকে তিনি গুরুত্ব দিতেন না। অসুস্থতা নিয়েও তিনি ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে যেতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’ প্রকাশনীতে। কবির অগণিত বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও এই সময়টায় তিনি অনেক বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। একদিন গুরুতর অসুস্থ হলে কবির স্থান হয় হলি ফ্যামিলির ২৩১ নম্বর কেবিনে। হাসপাতালে সপ্তাহখানেক থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২০ জুন রুদ্র বাসায় ফেরেন। পরের দিন ২১ জুন ভোরে দাঁত ব্রাশ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। অকালপ্রয়াত এই কবি তাঁর কাব্যযাত্রায় যুগপৎ ধারণ করেছেন দ্রোহ ও প্রেম, স্বপ্ন ও সংগ্রামের শিল্পভাষ্য। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’ এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি ততধিক স্পর্ধায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। সাহিত্য সমালোচকদের মতে, তিনি ছিলেন সত্তর দশকের অন্যতম কবি। তবে পাঠকের বিবেচনায় তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম কবি। ওপারে কবি ভালো থাকুক, তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
চৌধুরী পাড়া, মালিবাগ, ঢাকা।