বর্ষার একগুচ্ছ কবিতা

বর্ষার একগুচ্ছ কবিতা
  




বর্ষার একগুচ্ছ কবিতা
সাগর শর্মা

ছাতা

বর্ষার প্রথম বৃষ্টি হলো আজ। স্টেশন চত্বরে।
কতদিন পর দেখা হবে- বসে আছি কাউন্টারে।
তুমিও এলে ঠিক, বৃষ্টির পরে। দাঁড়কাক বসে
আছে দুইটা, এ্যান্টেনার তারে।

গাছের পাতায় বৃষ্টি ফোঁটা লেগে আছে এখনও।
তুমিও ঠিক আগের মতোই আছো।
শুধু পরনে শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদুর ওঠেছে।
ঠোঁটে লাল লিপস্টিক এখনো তো মাখো;
এখনো সেই মাতাল হাসি চোখে ধরে রাখো।
বৃষ্টি আবারও এলো বলে-
আমরা দিব্যি হেঁটে যায় এক ছাতার তলে!


জ্বরে ও ঝড়োরাতে

ঘুমোতে না পারার ক্ষত নিয়ে সারারাত শুয়ে থাকি
চন্দ্রমল্লিকা- মাঝরাতে তুমিও কি অলক্ষ্যে জেগে
ওঠো, বালিকা? এমন ঝড়োরাতে আচানক কোন
ব্যথা অনুভূত হয়েছিল কি বুকে? এরকমও কি হয়,
দু’জন বহুদূরে জেগে আছি একই বেদনায় বা সুখে!
ঝড়ো হাওয়ার এই রাতে, ভাবতেও আনন্দ লাগছে তা!
জ্বর ও হাওয়ার ভেতর জেগে থাকে দু’চোখের পাতা।


বস্ত্রবালিকা

জলের জালে আটকে পড়ে-
একদঙ্গল মৎস্যকন্যা উঠে এলে ডাঙায়

সুই-সুতোর সঙ্গম সয়ে
                          ক্লান্ত পা পথে পিছলায়

পেছন পেছন হাঙররা তড়পায়
                                   তড়পাতে থাকে-

এসময় বেহায়া বৃষ্টি নেমে পড়লে
                    ওড়না-শেমিজ লেপ্টে থাকে
                                     অঙ্গের আয়নায়

হাঙরের দল আয়নাতে ছিপ ফেলে
                               বেসামালে টাল খায়
                                 টাল খেতে থাকে-

তখনই বেখেয়ালে গাল পাড়ে বস্ত্রকন্যা-
বৃষ্টিকে, না হাঙরকে বোঝা যায় না!



বৃষ্টি হয়ে গেল

বৃষ্টি হয়ে গেল কিছু আগে
ওখানে গরম কি পড়ে গেল?
এড়িয়ে ঝুমবৃষ্টি একেবারে-
                       বিপুল বৈরাগে
এই বৃষ্টিই বর্ষাকে বুঝি নিয়ে এলো!

এখনও গরম পড়ে গেলে বিকেলে-
                      যাও লেকের ধারে
আজও নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে
স্বপ্নগুলো দারুণ উৎসাহে জাগে!

বৃষ্টি হয়ে গেল কিছু আগে-
ধুয়ে-মুছে, সাফ-সতুর করে দিয়ে গেছে
                     ময়লা যতসব একেবারে;
মনের গতরে বিবর্ণ ময়লা নিয়ে
                     কতকাল লেপ্টে থাকা-
                     কিসের অনুরাগে!

অথচ কচকচে পরিষ্কার এখানে চতুর্দিক;
          কেবল ঢোঁড়াসাপের মতো
            পথটি শুয়ে আছে একা
          
          কেবল দু-চারটে দাঁড়কাক
এখনও বসে আছে অ্যান্টেনার তারে।

কানের উল্টো পিঠের তিলটা আয়নায় এখনও
দক্ষিণের ঝড়ো হাওয়ায় নিয়ে আসে গন্ধ বুনো।



যদিও বর্ষা

মেঘলা বাদলদিনে নির্জন রাস্তায়-
দেখা হলে অকস্মাৎ বুকের পাড়ায়;
খানিক পুলক দোলা দিয়ে যাই
বসে ছিলাম দু’জন একা রেস্তোরাঁয়।

বৃষ্টি হলে ছাতায় দু’জন এঁটে যায়-
আড়ালে আড়ালে লোকে কী যে বলে;
গেছি হুডতোলা রিক্সায় সিনেমা হলে!
তবু বদনাম রটিয়ে দেয় পাড়ায়।

নদীর উপর সমুদ্রের ঢেউ খেলে
মেঘ জমে থাকে মেঘের আড়ালে;
অকস্মাৎ দেখা হলো কতদিন পর
পৃথিবীতে একা আমরা বহু বছর
কাটিয়ে দিলাম এক ভাঙা নায়;
ছলাৎছলাৎ ঢেউ বুক ভেঙে যায়
বাইরে যদিও বর্ষা। ভেতরে বিষাদ;
যখন মেঘলা দিনে দেখা হলো হঠাৎ।


ভেজা পাখি

 ভেজা পাখি


 ভেজা পাখি
কবির কাঞ্চন

সারারাত টিপটিপ বৃষ্টি ঝরে। ফজরের আযানও ঈশাতের কানে বাজেনি। রাতে বেশ ঘুম হয়েছে। সকাল আটটায় ওর ঘুম ভাঙে। শরীরে বেশ ফুরফুরে ভাব আসে । এক পা দুই পা করে  জানালার পাশে এসে ও বাইরে তাকালো।
এখনও আকাশ জুড়ে ঘন মেঘের সরব উপস্থিতি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দার টবের গাছগুলোও যেন নবরূপে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। হঠাৎ করে একটি ময়না পাখি উড়ে এসে ওদের ব্যালকুনীতে বসতেই সেদিকে চোখ যায় ঈশাতের। পাখিটি বৃষ্টিতে ভিজে  প্রায় কুপোকাত। দেখে মনে হচ্ছে উড়বার শক্তি হারিয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
এমন সব ভাবনা থেকে ব্যালকুনীর দিকে এগিয়ে আসে ঈশাত। খুব সাবধানে পাখিটিকে ধরতে হাত বাড়ায় সে। পাখিটি উড়বার চেষ্টা না করে তার কাছে খুব সহজে ধরা দেয়। ঠিক অসহায় মানুষের মতো।
এমনিতেই পাখির প্রতি তার অঢেল ভালোবাসা। দীর্ঘদিন ধরে একটি পাখি পোষার শখ মনের মধ্যে পুষে আছে। ভেবেছিল আসন্ন কুরবানির ঈদে বাবার কাছে ঈদ উপহার হিসেবে সে একটি পাখি চাইবে। তারপর সেই পাখিকে চোখে চোখে রাখবে। নিজের হাতে খাওয়াবে। বাবা-মা অফিসে চলে গেলে পাখির সাথে মনের কথা বলবে। আস্তে আস্তে পাখিকে কথা শিখাবে। পুরোপুরিভাবে পোষ মানলে স্কুলে নিয়ে গিয়ে রকিবকে দেখাবে।
রকিব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পড়াশুনায় ঈশাতের মতো ভালো। ক্লাসে কখনও ঈশাত ফার্স্ট হয়। আবার কখনও রকিব। ওদের সবকিছুতে মিল থাকলেও একটা জায়গায় মিল নেই। আর তা হলো- রকিব একটি টিয়াপাখি পোষে। প্রায় স্কুলে নিয়ে আসে। পাখিটি খুব সুন্দরভাবে রকিবের নাম ধরে ডাকে। কী সুন্দর লাগে! সেই থেকে তার মনে একটি পাখি পোষার আকাক্সক্ষা জাগে।
ময়না পাখিটি নিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে আসে। এরপর চুলো জ্বালিয়ে দিয়ে পাশে পাখিটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে পাখিটি স্বাভাবিক হয়ে নড়াচড়া শুরু করলো। পাখিটিকে উৎফুল্ল হতে দেখে ঈশাতের খুব ভালো লাগে। সে মায়ের কাছে এসে আনন্দে বলতে লাগলো ।
‘এই দেখো, মা, আমি একটি ময়না পাখি ধরেছি।
ঈশাতের মা অবাক হয়ে বললেন-
‘কীভাবে ধরেছিস, বাবা! ওরা তো সহজে কারোর কাছে ধরা দেয় না।
‘আল্লাহ ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ওকে আমি পুষবো। কথা শেখাবো। আমার মতো করে তোমাকে ‘মা’ বলতে শেখাবো।
‘আর!
‘আর কোনদিন আমি মারা গেলে আমার বদলে ও তোমাকে ‘মা! মা!’ বলে ডাকবে। তখন আমার কথা তোমার মনে পড়বে।
মুনমুন খাতুন ঈশাতকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন-
‘মন কথা কখনও মুখে আনবি না। তুই তো আমার প্রাণ। তুই না থাকলে আমি কেমন করে বাঁচবো।
‘মা! মাগো! আমি তোমার বুকে লুকিয়ে থাকতে চাই।
এই কথা বলে ঈশাত মায়ের শাড়ীর আঁচলে মুখ লুকায়।

পরদিন মাহফুজ চৌধুরী ছেলের জন্য পাখির হাট থেকে একটি সুন্দর খাঁচা নিয়ে আসেন। বাবার কাছ থেকে খাঁচাটি পেয়ে তার সে কী আনন্দ! খাঁচাটি নিয়ে একদৌড়ে ময়নার কাছে আসে। পরম যতেœ  দরজা খুলে পাখিটিকে খাঁচার ভিতরে ছেড়ে দিয়ে বাইরে থেকে তাকিয়ে রইলো। খাঁচার মধ্যে
পাখিটি বড় বড় চোখ করে এদিকওদিক উঁকিঝুকি মারতে থাকে। ঈশাত বুঝতে পারে- পাখিটি কোন বন্ধী মানুষের মতো অস্বস্তি অনুভব করছে। পাখিটির জন্য ওর খুব মায়া হয়।
দৌড়ে মায়ের কাছ থেকে পাখির খাবার নিয়ে আবার ফিরে আসে। পাখিকে খুব আদর করে নিজ হাতে খাবার খাইয়ে খাঁচাসুদ্ধ বারান্দায় চলে আসে সে। বারান্দার এককোণে নিচে কাঠ বসিয়ে তার ওপর খাঁচাটি রাখলো। এরপর খাঁচার আরো কাছাকাছি এসে পাখিটির দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল,
‘এখন থাকো। আমি স্কুলে যাচ্ছি। স্কুল থেকে ফিরে এসে তোমাকে আবার সময় দেবো। টা-টা, বন্ধু।
কিন্তু পাখিটি কোন শব্দ না করে ঈশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ঈশাতের মনে হলো- ওকে তো এখনও কথা শেখানো হয়নি। তাই উত্তর দেয়নি। কেবল দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।

স্কুল থেকে ফিরে এসে কোনমতে ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রেখে ময়নার কাছে ছুটে আসে সে। পাখির খাঁচার ভিতরে লক্ষ্য করে দেখে। ছোট প্লেটটিতে কোন খাবার নেই। পাখিটি বড় বড় চোখে ঈশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশাত প্লেটটা নিয়ে মায়ের কাছে আসে। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে আবার পাখির কাছে চলে আসে। নিজ হাতে পাখিকে খাবার খাইয়ে পাখির সাথে কথা বলে। অনেক কথা। কথা যেন ফুরায় না।
কিন্তু পাখিটি নিশ্চুপ থেকে সব বুঝতে চেষ্টা করছে।
এভাবে দিন যায়। আবার রাত আসে। ময়নার সাথে ঈশাতের গভীর মিতালী গড়ে ওঠে। একসময় ময়না কথা বলা শুরু করে। ঈশাতকে দেখলে ‘ঈ-শা-ত’ বলে ডাকতে পারে। ময়নার কন্ঠে নিজের নাম শুনলে তার খুব ভালো লাগে।

একদিন ঈশাত স্কুলের বন্ধুদের দেখাতে ময়না পাখিটি নিয়ে আসে। পাখির কন্ঠে ঈশাতের নাম শুনে সবাই খুশি হয়। ঈশাতের বন্ধু বিজয়ও মুগ্ধ হয়। সে ময়নার দিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ঈশাত তা লক্ষ করে বলল,
‘কিরে বিজয়, আমার ময়নার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছিস। মনে হচ্ছে ময়নার ঠিক প্রেমে পড়ে গেছিস!
বিজয় গম্ভীর গলায় বলল,
‘না, বন্ধু তোর পাখিটি খুব সুন্দর! রকিবের টিয়াপাখির চেয়ে আলাদা। কতো মোলায়েম কন্ঠে তোর নাম ধরে ডাকলো! দেখতেও মাশাল্লাহ।
‘ধন্যবাদ, বিজয় সময় হলে আমাদের বাসায় আছিস। আমরা দুজন ওর সাথে খেলবো।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।
স্কুল ছুটি হলে ময়নাকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে ঈশাত। বাসা থেকে বাইরে কোথাও গেলে সবসময় ময়নাকে বারান্দা থেকে ঘরে নিয়ে যায়।

কয়েকদিন পর ঈশাত তার বাবা-মায়ের সাথে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়। কিন্তু ভুল বশতঃ ময়নাকে বাসায় নেয়া হয়নি। পথিমধ্যে তার মনে পড়ে। সে খুব চিন্তাগ্রস্থ হয়ে মনে মনে ভাবে, যদি হঠাৎ বৃষ্টি আসে, ময়না তো খাঁচার মধ্যে ভিজে অসুস্থ হয়ে যাবে। আবার অন্য কেউ যদি চুরি করে নিয়ে যায়! ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বাবার কাছে বাসায় ফিরে যাবার বায়না ধরে। বাবা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাজারের দিকে নিয়ে আসেন। একসময় মন থেকে ময়নার টেনশন দূর হয়। ইচ্ছেমতো কেনাকাটা শেষ করে ওরা বাসায় ফিরে আসে। ঈশাত এক দৌড়ে ময়নার খাঁচার কাছে আসে। খাঁচাটি পড়ে আছে। কিন্তু খাঁচার মধ্যে ময়না নেই। খাঁচার দরজাটি খোলা। ময়নার কয়েকটি পালক নিচে পড়ে আছে। পালকগুলো হাতে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো সে। তার কান্নার আওয়াজে বাবা-মা বারান্দার দিকে ছুটে আসেন।
মাহফুজ চৌধুরী ঈশাতের দিকে আগ্রহ ভরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি হয়েছে, বাবা? এতো কান্না করছো কেন?
ঈশাত কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
‘বাবা, বাজারে যাবার সময় ময়নার খাঁচাটা বাসায় রেখে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন এসে দেখছি, আমার পাখিশূন্য খাঁচা পড়ে আছে।
এই কথা বলে আবার ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে উঠলো।
বাবা- মা দুজনে তাকে সান্তনা দিলেন। কিন্তু ঈশাতের মন তা বোঝতে চায় না। সে তার প্রিয় ময়নাকে পেতে পাগলপারা। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসা হলো।
এরিমধ্যে বাইরে জোরেশোরে বৃষ্টি নামলো। বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে ঈশাত আবার ব্যালকুনীর খাঁচার কাছে ফিরে এলো। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে। না জানি কেউ আশপাশে তার প্রিয় ময়নাকে লুকিয়ে মজা করছে। কিন্তু কৈ? ময়নাকে তো দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া ও আমাকে দেখলে তো কিচিরমিচির শুরু করতো। তবে কি... ! ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে একসময় বাসার ছাদে এসে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে।
ওদিকে ছেলেকে বাসায় না পেয়ে বাবা-মা দুজনে খোঁজতে বের হলেন। অবশেষে তাকে বাসার ছাদে আবিস্কার করলেন। ততক্ষণে ঈশাত ঠান্ডায় কাঁপছে। তাকে পাঁজাকোলা করে বাসায় নিয়ে আসা হলো। গায়ে প্রচন্ড জ্বর।
মাহফুজ চৌধুরী তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তার ভালোভাবে দেখে ঔষধ দিয়ে চলে গেলেন। সাতদিন তাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। তারপর একটু ভালো বোধ করলে স্কুলের পড়া সংগ্রহের জন্য বিজয়দের বাসার দিকে এলো। বিজয় দূর থেকে তাকে আসতে দেখে দৌড়ে এগিয়ে আসে। তারপর সোজা তার পড়ার রুমের দিকে নিয়ে যায়। ঈশাত কুশল বিনিময় শেষে স্কুলের পড়া সব বুঝে নিচ্ছে। এমন সময় জানালা হয়ে তার চোখ যায় বারান্দার দিকে। বারান্দায় একটি খাঁচা ঝুলে আছে। খাঁচার মধ্যে একটি ছোট পাখি মনমরা অবস্থায় ঘাঁড় নিচু করে বসে আছে। পাখিটির গায়ের রঙ ধবধবে সাদা। ঈশাত ভাবতে লাগলো, ঠিক আমার পাখিটার মতো দেখতে। শুধু রঙটাই পার্থক্য। এরিমধ্যে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিজয় ঈশাতের দিকে লক্ষ করে জানালাটা লাগিয়ে দিতে এগিয়ে এলে ঈশাত তা বারন করে বলল,
‘জানালাটা খোলা থাক না। ভালোই তো লাগছে। বাইরে থেকে হালকা বাতাস আসছে। তাছাড়া তোর পাখিটিও খুব সুন্দর।
বিজয় একটা ঢোক গিলে বলল,
‘হ্যাঁ, পাখিটি আমার খুব পছন্দের। তোর ময়নার কী খবর? এখন আর কি কি বলতে পারে?
ঈশাত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘নারে দোস্ত, আমার ময়না চুরি হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে বাইরে থেকে খাঁচার পাখিটি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। বৃষ্টির মাত্রা খুব বেড়ে যাওয়ায় পাখিটি ভিজে একেবারে জবুথুবু হয়ে যায়।
পাখিটির দিকে চোখ পড়তেই ‘ময়না! ময়না!’ বলতে বলতে বারান্দার দিকে ছুটে আসে ঈশাত। বিজয় খুব ভয় পেয়ে ঈশাতের পিছুপিছু আসে। এরিমধ্যে বিজয়ের মাও রান্নাঘর থেকে বারান্দায় ছুটে আসেন।
বৃষ্টির জলে পাখির গায়ে সদ্য লেপে দেয়া রঙ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। পাখিটিকে দেখিয়ে ঈশাত বিজয়ের মাকে কাঁদো গলায় বলতে লাগল,
‘খালাম্মা, এটা আমার পাখি। গত এক সপ্তাহ আগে আমাদের বাসার বারান্দা থেকে চুরি হয়েছে।
বিজয়ের মা বিজয়ের দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললেন,
‘এই বিজয়, তুই না বললি, এটি বনে পেয়েছিস?
‘হ্যাঁ, মা আমি পাখিটি বনেই পেয়েছি। ও মিথ্যে বলছে।
ঈশাত দুহাতে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,
‘এই দেখুন, খালাম্মা, ও আমার পাখির গায়ে রঙ মেখেছে।
বিজয় প্রতিবাদের সুরে বলল,
‘আমি রঙ মেখেছি, সত্য। যাতে করে আমার পাখিকে অন্যের পাখিদের মধ্য থেকে সহজে আলাদা করে চিনতে পারি।
ঈশাত একটু ভেবে নিয়ে খালাম্মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘খালাম্মা, এটি যদি আমার পাখি হয়, তবে ওকে ময়না বলে ডাকলে ও আমার নাম ধরে ডাকবে।
‘তাহলে তুমি ওকে ময়না বলে ডাকো।
ঈশাত পাখিটির দিকে জলজল চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ময়না, আমার ময়না।’
সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার পাখিটি ডানা ঝাপটিয়ে বলল, ‘ঈ-শা-ত ’
এতক্ষণে বিজয় ও বিজয়ের মা লজ্জায় মাথা নিচু করে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো।

এক ফোটা জল

 এক ফোটা জল


 এক ফোটা জল
মাহবুব এ রহমান

বাহির থেকে এসেছি মাত্র। প্যান্ট না খুলেই বসে পড়েছি বই নিয়ে। খানিকক্ষণ যেতে না যেতেই পাশের রুম থেকে রুমানের ডাক। ওর রুমে মোবাইল চার্জে লাগিয়েছিলাম। ফোন আসছে। দৌঁড়ে গেলাম। একি, সাজিদ ভাইয়ের ফোন! রিসিভ করে সালাম দিলাম।
‘কই?
‘বাসায়।
‘খামটা কোথায়?
‘ব্যাগে।
‘রাতের ট্রেনে আস। আবার ওইটায় চলে যাবে।
‘জ্বী, ঠিকাছে।
লাইন কেটে দিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এখন ক্যাম্পাস যাব! ধুর, দিনে যাইনি ক্লাসে। তাই বলে এরকম শাস্তি! না গিয়ে উপায়ও নেই। খুব নাছোড়বান্দা। এক কথার লোক। কিছু বললে ফিরানোও যায়না। মোবাইল চাপলাম। আটটা বাজতে আর তিন পাঁচ মিনিট। ট্রেন তো সাড়ে আটটায়। শার্টটা জড়িয়ে নিলাম গায়ে। হ্যাডফোন তো নষ্ট। রুমানেরটা ডুকিয়ে নিলাম পকেটে। হ্যাডফোন ছাড়া শাটলট্রেন জার্নি কল্পনা করা যায়! বেরিয়ে পড়লাম। ভাল্লাগছেনা। একা একা হাঁটছি। সেদিনের মত যদি স্টেশনে মাসুম ভাইকে পাওয়া যেত, মন্দ হতনা। কিন্তু কেমনে সম্ভব! উনি তো ক্যাম্পাসে। মনে মনে ওসব ভাবছি আর পা ফেলছি সামনে।

দাঁড়িয়ে আছি স্টেশনে। এইতো ট্রেন আসবে। মিনিট চারেক বাকি।
‘কিতারে কিতা খবর?
পেছন চেয়ে দেখি চয়ন দা। ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টে পড়েন। এবার থার্ড ইয়ারে। টিউশন থেকে ফিরছেন।
‘অত্ত বালা আছি, আফনে?
‘বালা, বাড়িত কোনদিন যাইতে?
‘এখনও টিক নায়, বন্ধ অইলে যাইমুগি।
কথা বলছি। উনার সাথে উনার এক ফ্রেন্ড। উনার বাড়িও সিলেট। যদিও আগ থেকে পরিচয় ছিলনা। হঠাৎ দেখি মাসুম ভাই ও নাঈম ভাই আসছেন।  অবাকই লাগলো!  একটু আগে যা ভাবছিলাম, আর তা কিনা সত্যিই হয়ে গেল। একটা আলাদা ভাল লাগা কাজ করল। ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করিতেই ট্রেন চলে এলো।
সবাই ছোটাছুটি শুরু করছে সিট ধরতে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি।
‘ধাক্কাধাক্কির দরখার নাই। আমরা মালবগিত উটিযাই’ বলে সামনে বাড়লেন মাসুম ভাই। একসাথে মালবগিতে উঠে গেলাম সবাই।

বসার সিট না থাকায়  মালবগিতে সবাই ওঠেনা। তা ছাড়া এটাতো মালামালের জন্যই। সব সময় তো আর মালামাল থাকেনা! তাই সংগত কারণেই অন্যান্য বগির চেয়ে ফাকা থাকে।
নিজ নিজ সুবিধা মতো দাঁড়িয়েছে সবাই। আরও কয়েকজন ছিল আগ থেকে। চারজন পা লটকিয়ে বসেছে দরজায়। আরও দু’জন জুতো নিচে দিয়ে বসেছে। আমাদের সবাই মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে কথা চালাচালি করছে। সবাই আমার সিনিয়র। আবার দু’একজন ছাড়া সবার সাথে সম্পর্কটাও ওরকম না! সুতরাং দর্শক আর শ্রোতার ভূমিকায় আমি। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই খেয়াল করলাম গাঁজার গন্ধ! অন্ধকারে তেমন কিছু দেখাও যাচ্ছেনা স্পষ্ট। নিচের দিকে তাকালাম। চলন্ত ট্রেনে রাস্তার নিয়ন  আলো ঝলক দিচ্ছে বজ্রপাতের আলোর মত। সাথে মোবাইল স্ক্রিনের সহযোগিতা নিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।
একজন সিগারেট টানছে একমনে। পাশের কয়েকজন হাতে কি যেন ঘষছে। বুঝতে আর বাকি থাকল না। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগলে দেখে যে, একজন একটান দিয়ে দিচ্ছে পাশের জনকে। ও আবার দিচ্ছে ওর পাশের জনকে। এরকমভাবে চক্রাকারে টানাটানা চলছে চারজনের মধ্যে। একটা শেষ করে আরেকটা শুরু।  আমার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
একবার মাসুম ভাইকে বললাম-
‘ভাই ইতা কিতা?
‘কুস্তা মাতিছনা, যেতা দেখরে ওতা।
সহ্য করতে না পেরে সরে বিপরীত দরজায় দাঁড়ালাম। চুপচাপ শুধু দেখেই যাচ্ছি।

ওরাও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরছে।
আহারে মা-বাবা কতই না স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছেন। আর ওরা কিনা......!
ওসব ভাবতে ভাবতেই মনেপড়ে গেল সেদিনের ক্লাসের কথা। শাখাওয়াত স্যার ক্লাসে বলেছিলেন এক ছাত্রের কথা- সবার মত ভর্তি হয়েছিল সেও। ১ম বর্ষে ক্লাস নিয়মিত করলেও ২য় বর্ষ থেকে দেখা মেলেনি তেমন। কিন্তু ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি কিংবা রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে প্রায়ই চোখে পড়ে। ইতোমধ্যে ক্লাসসহ নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ায় বাতিল হয়েছে ছাত্রত্ব। একদিন ওর বাবার ফোন আসে।
কুশলবিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করেন ছেলের ব্যাপারে।
‘স্যার আজ অনেকদিন হয় আমার ছেলের কোনো খবর পাচ্ছিনা। ফোন দিলে ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ওরে প্রতি মাসে ৩০০০ করে টাকা পাঠাতাম তাও দিতে পারছিনা। স্যার আমি দিনমজুর। আর পারছিনা। কখন আমার ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে কিছু একটা করবে সে অপেক্ষায় আছি। অনেক কষ্টে আপনার নাম্বার জোগাড় করেছি। সেদিন সবার মত আমার চোখের কোণেও জমেছিল একফোঁটা জল।
‘কিতারে নামতে নানি?
মাসুম ভাইয়ের ডাক। বুঝলাম চলে এসেছি। নেমে হাঁটা ধরলাম। খেয়াল করলাম ডান দিক থেকে স্ট্রবেরির ঘ্রাণ আসছে। তাকালাম ডানে। এক আপুর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়া উড়ছে মুখ থেকে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গিয়ে থামলাম জিরো পয়েন্টে। সাজিদ ভাইয়ের নাম্বার ডায়াল করতেই দেখি উনি সামনে দাঁড়িয়ে। খামটা হাতে দিয়ে আবার উঠলাম ট্রেনে।

মধ্যখানের বগি। জানালার পাশ দেখে একটা বগিতে বসেছি। ছেড়ে দিয়েছে ট্রেন। ক্যাম্পাস থেকে শহরমুখি হওয়ায় ভিড় নেই ততটা। কানে বাজছে শাটলেরর জানাশোনা সেই মিষ্টি গানের কলি। অনেকদিন থেকে একটা ছড়ার থিম মাথায় ঘুরঘুর করছে। ভাবলাম নামানোর এটাই মোক্ষম সুযোগ। পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। কয়েকলাইন লিখে অন্ত্যমিল  নিয়ে ভাবতে ভাবতে জানলা দিয়ে তাকালাম। বাহিরে অন্ধকার। আকাশটাও বেশ কালো। মেঘলা আকাশে একটা তারাও নেই। ঝাপসায় লুকোচুরি খেলছে মেঘেদের দল। যেন ঝকঝক ট্রেনের সাথে তাল মিলিয়ে দৌঁড়াচ্ছে ওরাও। অনেক খোঁজার পরও রূপোর থালাটার দেখাই পেলাম না। একটা ঝাঁকুনিতে ভাবনায় ছেদ পড়ে। বুঝলাম ব্রেক কষছে ট্রেন। বায়ে থাকাতেই চোখে পড়লো ষোলশহর স্টেশনের ফ্লাইওভার। হুঁ, তাইলে চলেই এসেছি। মোবাইলটা এখনও হাতে। স্ক্রিনে তাকালাম। ও, আমিতো ছড়া লিখছিলাম। দাঁড় করিয়েছিলাম এই ক’লাইন-
মন ভাল নেই লিয়ার;
মজনু এখন আগের মতো আর করেনা পিয়ার!
হয়না এখন আগের মতো রাত্তিরেতে চ্যাটিং
অনেক জোরের পরও লিয়া, চায়নি যেতে ডেটিং।
মনে ভীষণ ভয়-
কী থেকে কী হয়
দেখলে তাকে মজনু; পরে করতে পারে ব্রেক আপ
যে পিকগুলা হয় শেয়ারিং তা তো পুরো মেকাপ।

মোবাইলটা পকেটে ঠেলে দিয়ে হাঁটা ধরলাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, একটা ফোনকল উপহার দিয়েছে একটি ছড়ার। জন্ম দিয়েছে একটি গল্পের উপকরণ। অভিজ্ঞতার ঝুলির ওজন বাড়িয়েছে খানিকটা। সব মিলিয়ে এক চমৎকার রাত। কম কিসে !


ভেজা বিকেল

 ভেজা বিকেল


 ভেজা বিকেল
রহিমা আক্তার মৌ

দুপুর থেকেই আকাশটা মেঘলা। সূর্য এই হাসে এই আবার লুকিয়ে যায় লজ্জাবতি নতুন রাঙ্গা বউয়ের মতো। একটি বৃষ্টির জন্যে গত পাঁচ দিন আগেও অনেকের প্রত্যাশার শেষ ছিল না। সেই প্রত্যাশার বৃষ্টি হয়ে গেছে তাও আবার কোন অগ্রিম সংকেত না দিয়ে।
অথচ সকাল থেকে সংকেত থাকা সত্বেও দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির কোন খবর নেই। আকাশকে গম্বির হতে দেখলেই মৌমিতা দৌড়ে রুমে যায় জানালাগুলো হালকা ভাবে টেনে দেয়, এরপর যায় বারান্দায়, ভালোবাসার আবেশ জড়ানো সাদা পোশাকগুলো তুলে নিয়ে আসে। আবার রোদের জলকানি দেখে কাপড়গুলো নেড়ে দেয়।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে এই মুহুর্তে যদি বিপুল কল করতো ওকে ওর পছন্দের গানটা শুনিয়ে দিতো। এমন মেঘে ঢাকা আলো আধারের লুকোচুরি খেলার সময়ে বিপুল গানটি বারবার শুনে। গত সাত বছরে দুজন দুজনকে অনেক কাছ থেকে দেখেছে, বুঝেছে। বিপুল কখন কোন গানের আবদার করবে তা মৌমিতা বুঝেই যায়। প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে চলে বিপুলের মন। আর সে কারনে বুঝতে দেরী হয় না ওকে।

খামার বাড়ির এক প্রোগ্রামে মঞ্চ কাঁপিয়ে গান করছে মৌমিতা। ভক্ত শুভাকাক্সক্ষীরা একের পর এক গানের অনুরোধ করে। সেই দিনের সময়টাও  ছিল এমন ভেজা বিকেলের। কথাছিল পাঁচটি গান করবে মৌমিতা। সেখানে আটটি গান করার পর ও ভক্তদের আরো অনুরোধ আসতে থাকে, বাধ্য হয়ে সঞ্চালক ঘোষণা করেন- ‘এখন আপাতত মৌমিতা স্টেইজ থেকে নেমে যাবেন, তবে ঘন্টা খানেক পর তিনি আবার আপনাদের গান শুনাবেন, শুনাবেন আপনার পছন্দের তালিকা থেকে।

সবার সাথে সেদিন সেখানে ছিল রিপুল ও। এতো অনুরোধের মাঝে ওর অনুরোধ হয়তো পাত্তাই পাবেনা। তাই অন্য পথ বেছে নিলো।
ছোট একটা কাগজে নিজের মোবাইল নাম্বার লিখে সাথে একটা গানের লাইন লিখে দেয়, গানটি হল-
‘সাগরের পাড়ে দাড়িয়ে কারো হাত বাড়িয়ে’
লোক মারফতে চিরকুটটি চলে আসে মৌমিতার হাতে। মৌমিতা চিরকুটটি দেখেই রেখে দেয় নিজের কাছে। স্টেইজে উঠে ২য় গানটি করে চিরকুটের গান, গান শেষ হবার পর হাততালি পড়ে। মঞ্চ থেকে আবছা আলোয় মৌমিতা দেখছে হালকা আড়ালে কেউ একজন হাত তালি দিয়েই যাচ্ছে। তবে তাকে চেনার কোন উপায় নেই।
প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে রাত সাড়ে এগারটা। স্টেইজ থেকে নামার পর অমনি চার পাশ থেকে সবাই ঘিরে ধরে মৌমিতাকে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত বারটা। কলের পর কল আসে ম্যাসেজ এর পর ম্যাসেজ। নিজের রুমে ঢুকেই দেখে ওর জন্য অপেক্ষ করছে পছন্দের কেকটা। আজ মৌমিতার জন্মদিন। জীবন থেকে দুই যুগ বয়স চলে গেছে। এক সময় বলা হতো কুড়িতে বুড়ি, এখন শহরে সেসব কে বলবে?

সে হিসাবে ওর বয়স তো হয়েছেই, পরিবার থেকে বিয়ের কথা বললেও কানে নেয়নি, শুধু বলেছে সময় হলে ঠিক বিয়ে করবে। এই পুরোদিন কেটে যায় মৌমিতার একেবারেই অন্য ভাবে। দুদিন পর মনে পড়ে সেই চিরকুটের কথা। নাম্বার বের করে একটা খুদেবার্তা পাঠায়-
‘আমি মৌমিতা, সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে....’
সাথে সাথে রিপ্লাই আসে-
‘গানের লাইন না লিখেলেও হতো, আপনি ফ্রি থাকলে কল দিতে পারি।
‘অবশ্যই দিতে পারেন।
কথা হয় দু’জনার। দুমাস আগের প্রোগ্রাম অনুযায়ী তিন দিনের মাথায় মৌমিতা তাদের দলের সাথে চলে যায় বাহিরে। কাজ সেরে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকে কিছু দিন। এই ভাবে পুরো দুই মাস পর ফিরে দেশে। এর মাঝে বিপুলের সাথে কোন যোগাযোগ নেই, দেশে ফিরে আবার কথা। বিপুল অনেক অভিমান করে আছে, মৌমিতা কথার ধরন শুনে বুঝলেও কারন খুঁজে পায়না। তবুও ভক্তের মান ভাঙ্গাতে একটা গান শুনাবে বলে-
‘আচ্ছা বিপুল আপনার কোনো পছন্দের গান আছে, থাকলে বলেন, আমি শুনাবো।
‘সত্যি শুনাবেন।
‘হ্যাঁ সত্যিই শুনাবো।
‘তাহলে ইনবক্সে লিখে দিচ্ছি।
‘চাইনা কিছুই তো জীবনে আর .......... তোমার মুখটা যদি দেখি একবার............’

মৌমিতা কল করে, বিপুল নিজে কল কেটে দিয়ে কল করে। মৌমিতা কল ধরেই গানটা করে। খুব খুশি বিপুল।
এই ভাবেই ওদের মাঝে ভালো লাগার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে দেখা করার ব্যাপারে কেউ কারো কাছে মুখ খোলেনা। দু’জন আলাদা ভাবে নিজেদের জগৎ তৈরী করে নেয়।
মৌমিতারা কয়েক বন্ধু মিলে প্রায় আড্ডা দেয় বেইলী রোডের একটা ফাস্টফুডের দোকানে। খুব মনোরম পরিবেশ। ওদের দুই তিনটি গ্রুপ আছে। একেকদিন একেক গ্রুপের সাথে আড্ডা হয়। এই কফি হাউজে অনেক প্রেমিক প্রেমিকারা হাত ধরে আসে। ওদের জন্য আলাদা জায়গা আছে। সেখানে শুধু জোড়ায় জোড়ায় চেয়ার আর ছোট্ট টেবিল।

গ্রুপের সাথে বসলেও মৌমিতার মন ছুটেযায় সেই জোড়া চেয়ার গুলোতে। ইচ্ছে করে পছন্দের মানুষের হাত ধরে এখানে আসতে, চুপি চুপি চোখে চোখ রেখে হাতে হাত রেখে স্বপ্ন বুনতে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুরুষকে সে খুঁজে পায়না। পেলেও যেনো আপন করে নিতে পারে না। রিপুল মৌমিতাকে এত পছন্দ করে কিন্তু দেখা করার কথা কখনো বলে না কেনো। মৌমিতা নিজে যদি ওকে এখানে নিয়ে আসে তাহলেও কি খুশি হবে নাকি অন কিছু ভাববে।
দু’জন দু’জনের অনেক বিষয় শেয়ার করে, কে কবে কোথায় যাবে। কারো কাজে কখনো কেউ বাধা দিতে চায় না। মৌমিতা একদিন কথা বলার সময় কফি হাউজের কথা বলে-
‘জানো বিপুল আমার পরিচিত একটা কফি হাউজ আছে। আমরা অনেক সময় সেখানে বসি, আড্ডা দিই। তবে একটা চেয়ারে কখনো আমার বসা হয়নি, ভাবছি নতুন কাউকে নিয়ে ওখানে বসবো।
‘ভালোতো, সময় করে নতুন কাউকে নিয়ে বসে যাও।
‘কথাটা সরাসরি বলি, জবাব দিবে।
‘অবশ্যই দিব, তুমি বলেই দেখো।
‘আমি যদি ওই চেয়ারে তোমাকে নিয়ে বসতে চাই তুমি আসবে।
‘তুমি না বললে নতুন কাউকে নিয়ে বসতে মন চায়। আমি কি নতুন কেউ? আমি তো পুরানো হয়ে গেছি।
‘তাই, কবে পুরানো হলে। আমিতো তোমায় এখনো দেখিইনি।
‘মৌমিতা আমি কিন্তু তোমায় প্রতিদিন দেখি।
‘কোথায় দেখো ?
‘কেনো, ক্যান্টেনমেন্টের সেনাকুঞ্জে, বইমেলায়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, পার্লারে, আরো বলবো।
‘মানে ?
‘ধুর মজা করলাম, কিচ্ছু না, ঠিক আছে আমি সময় করে ঠিক আসবো। তুমি কবে আসতে চাও আমায় জানিও। রাত ১২টার পর মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমায় মৌমিতা। সকালে উঠতে আজ একটু দেরীই হয়েছে। ওইদিকে সারা রাতের ঘুম হারাম হয়ে আছে বিপুলের। সারারাত বসে একের পর এক ম্যাসেজ পাঠায় মৌমিতাকে। কিন্তু কোন জবাব পায়না, কোন কলও আসেনা। আরামের ঘুম দিয়ে উঠে সকাল দশটায়। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে পনেরটা ম্যাসেজ। একটার পর একটা পড়ছে আর অবাক হচ্ছে। এই কায়েক মাসে মৌমিতা কোথায় কোথায় গেছে কেমন পোশাক পরেছে কেনো গেছে সব লেখা। অবাক হওয়ার চেয়ে সে দিন মৌমিতা খুশি হয়েছে অনেক। খুব লজ্জাও লাগছে, বিপুল ওকে এতটা ভালোবাসে বুঝতে পারেনি। তবে এও ঠিক মৌমিতাও অনেক ভালোবাসে বিপুলকে। কল করে রাঙ্গা গলায় কথা বলে-
‘বিপুল আর দেরি নয় সামনের সোমবার আমরা দেখা করব কফি হাউজে।
‘ওকে, আজতো মাত্র বৃহস্পতিবার, আমি ঠিক চলে আসবো।
শনিবার সবার সাথে কফি হাউজে যায় মৌমিতা। খুব মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরে। গত কাল কপি হাউজটা ভেঙ্গে দিয়েছে। এখানে বিশাল শপিং মল গড়ে উঠবে। এতটাই খারাপ হলো বিপুলকে জানাতেই পারলো না। রবিবার সন্ধায় বিপুল নিজেই কল করে মৌমিতা কিছু বলতে চায়। কিন্তু বিপুল কিছুই বলতে দেয়নি। কফি হাউজ বন্ধের কথাও জানাতে পারেনি। সোমবার ঠিক সময়ে দুজন একই জায়গায় আসে, মৌমিতার মন খারাপ। বিপুল খুব স্বাভাবিক করে নেয়, বলে চলো আমরা রিকসায় ঘুরি। পুরো বিকেল সন্ধ্যার জন্য একটা রিকসা নেয় ওরা। বেইলী রোড থেকে টিএসসি, নীলক্ষেত হয়ে ধানমন্ডি, শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। বাতাসে মৌমিতার উড়া চুল বিপুলের কাঁধে এসে আলতো ভাবে ছুয়ে যায়। হাতে হাত রেখে স্বপ্ন বুনে। কখন যে রিকসা কোন পথে যায় বুঝতেই পারে না। এক ফাঁকে মৌমিতা বাসায় জানিয়ে দেয় বাসায় ফিরতে রাত এগারটা হবে। ও বাইরে খেয়ে আসবে।
এই ভাবে এই স্বপ্নের শহর কখনো দেখেনি মৌমিতা। ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে চেনা পথে অচেনা স্বপ্ন বুনতে বুনতে খুব কাছের হয়ে যায়। এই প্রথম মৌমিতার পাশে বসা কেউ ওর রিকসার পেছনে হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। ভালোবাসার ছোঁয়া এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠে।
ছোট বেলা থেকেই ডানপিঠের স্বাভাবের ছিল। কেউ কাছে আসতে চাইলেও সাহস পায়নি। দু’জনে মিলে রাতের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরে। মৌমিতা যেন আজ অন্য কেউ। ওর মাঝে জমে থাকা সব ভালোবাসা যেনো আজ ওকে জানান দিচ্ছে ও একজন পরিপুর্ন নারী। সারারাত মোবাইল কথা বলে দুজন।
পনেরো দিনের মাঝে চার দিন এই ভাবে ওরা ঘুরতে বের হয়। এতদিনের স্বপ্ন গুলোকে পরিপূর্ণ করার জন্য তৈরী হয় দুজন। মৌমিতা পরিবারকে জানায় বিপুলের কথা। সব শুনে সবাই রাজি থাকে।
দুজনেই বিয়ের শপিং করবে একসাথে। দিন তারিখ ঠিক হয়। তবে খুব আয়োজন করে কিছু করবেনা। গুরুত্বপূর্ণ কিছু আগের দিন কিনে নিয়ে আসে। আজ বাকী জিনিষ গুলো কিনবে বলেই বের হয়। বিপুলের খুব পছন্দ মেহেদী রাঙ্গা হাত। তাই বিয়েতে যাই হোক মেহেদী ঠিক পরতে হবে। বিপুল নিজেই কিনে দেয় মেহেদী। আজ সকাল থেকেই আকাশ অনেক ভালো। বিকেলের আগেই অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ। এমনটা হওয়াটা স্বাভাবিক। বৈশাখ চলে এসেছে। ক্ষণে ক্ষণেই বৃষ্টি নামে। রাফা প্লাজার সামনে মৌমিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে বিপুল পাশেই কোথায় যায় কিছু কেনার জন্যে। বৃষ্টি না পড়লেও আকাশে বর্জপাত হচ্ছে। ফেরার পথেই বিপুলের মোটরবাইক এ বর্জপাত পড়ে। মুহূর্তেই বিপুল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। দূর থেকে মৌমিতা সব দেখছে। দৌড়ে আসে বিপুলের পাশে, আকাশ ভেঙ্গে যেনো বৃষ্টি পড়ছে। মৌমিতার চোখে জল নেই। আকাশের জলে ওকে কাঁদতে দেয়না। ও বিপুলকে সামনে করে বসে আছে। চারপাশে অনেক লোকজন, কারো কথা ওর মাথায় যায়না।
পুরো দুদিন পর মৌমিতার স্মৃতিশক্তি ফিরে এলেও স্বাভাবিক নয় সে। কারো সাথে কথা বলে না। গান গায়না, আড্ডা দেয় না। বৃষ্টি এলেই বারান্দায় যায়, আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে আর বিপুলের পছন্দের গান টা গায়। আর কোন গান ওর মুখে আসে না। গলায় সুর উঠেনা। একাকিত্বের জীবনের সাথী শুধুই বৃষ্টি ভেজার গানটা।


ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব ০২।। শাদমান শাহিদ (রামবন্দনা)

 ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব ০২।। শাদমান শাহিদ (রামবন্দনা)


শাদমান শাহিদ 
রামবন্দনা


পুরান বইয়ের ঘ্রাণে যে আলাদা এক ধরনের মাদকতা আছে। সেটা সবাই বুঝতে না পারলেও তুমি পারো। প্রতিটি বইয়ের দেহে লেখকের ঘাম জড়ানো। কারো কারো নাকে সে-ঘামগন্ধ ডলসি আ্যান্ড গাব্বানা কিংবা মিস দিওর চেয়েও প্রিয়। ইচ্ছে হলে ঐ ছেলেটার কথা ভাবতে পারো। পার্টির অফিসে তোমার পিনোন্নত বুক আর মেদহীন ঝুরঝুরে ফিগারের দিকে তীরের ফলার মতো যে বারবার তাকাচ্ছিলো। বয়সটা তোমার চেয়ে বছর পাঁচেক কম হলেও কামদ উত্তেজনায় ভরপুর। পার্টিতে নতুন ঢুকেছে। সংশোধনবাদিদের খপ্পরে এখনো পড়েনি। ভাবতে পারো উত্তরবঙ্গের ঐ যুবকদের নিয়েও। যাদের কথা পত্রিকায় এসেছে। আহা রে! ছেলেগুলো শুধু অভাবের নিষেধাজ্ঞায় সংসার পাততে না পেরে ঢাকায় যেয়ে অ-কোষের রগ কেটে খোজা হয়ে গেলো। অথবা রাজনীতি নিয়েও কিছু সময় খরচ করতে পারো। দেবতা-ছায়াদেবতা-রিমোট কন্ট্রোলাররা এখন অনেকটা বেকায়দায়। শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ-নেপাল-ভুটান-মায়ানমার এখন পুরোপুরি চীনের বগলে। বাকি আছে কেবল বাংলাদেশ। এটা হাতছাড়া হয়ে গেলে তেত্রিশকোটি তেত্রিশকোটিই, হাজারকোটি মিলেও দাদাদের পতন ঠেকাতে পারবে না। চতুর্দিক থেকে ইলাস্টিকে টান পড়বে আর অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো একটি একটি করে খসে পড়বে।
এমন সরল সমীকরণের পরও বাঙালি দেবতারা বুঝতে চাচ্ছে না। আনাড়ি লোকের মতো অভিনয় করেই যাচ্ছে। হাবভাব এমন—যেনো মান্যবর ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কথাবার্তা আর বাচন-ভঙ্গি দেখলে মনে হয়, হাজারটা ক্ষমতার ঈশ্বর তাদের নিঃশ্বাসের গরম বাতাসে উড়ে যাবে। সে-মোহেই কিনা... যখন যা ইচ্ছে, করে যাচ্ছে। রাতকে দিন, দিনকে রাত করতে মুহূর্ত সময় নিচ্ছে না। ইচ্ছে হলো তো সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মুহূর্তে সৃষ্টি করে দিচ্ছে খা-ব-দাহের শত উপমা। যখন যাকে ইচ্ছে গুম-খুন-ধর্ষণ করে চালিয়ে দিচ্ছে ধর্মের নতুন অধ্যায় হিসেবে। কারো কিচ্ছুটি করার নেই, বলার নেই। মুখটা খুললেই বিপদ। চেতনার (সুবিধাবাদ-জিন্দাবাদ) এসিড ছুড়ে ঝলসে দেবে আমূল। তা সম্ভব না হলে, হুকুমের গোলাম পোশাকধারী ছায়াদেবতারা রয়েছেই, তাদেরকে ব্যবহার করবে। যারা জনগণকে কেবলি ২০ নম্বর গ্রেডের কর্মচারি মনে করে। পান থেকে চুনটা খসলেই বানচুতের বাচ্চা বানচুত, মাঙির পু, খানকির পু, শালির বেটি শালি বকতে বকতে বুকে-পিঠে-পাছায় লাথি মারতে মারতে থেতলে দেয়। জনগণ চতুর্থশ্রেণি-পঞ্চমশ্রেণির কর্মচারির মতোই সব পাইকারি হজম করে। মার খায়। কোনো দিন তারিখ নাই, আফ্রিকার ক্রীতদাসের মতো খোদার তিনশো পঁয়ষট্টি দিন তারা মার খায়। মার খেতে খেতে ভুলে যায় একদিন তারাও মানুষ ছিলো। পৌরষ ছিলো।
এসব ভাবতে গিয়ে যখন মাথাটা ধরে আসে, তখন ঘুমোতে ইচ্ছে করে। অবোধ শিশুর মতো ঘুমোতে ইচ্ছে করে। ঘুমের সুড়ঙ্গ দিয়ে বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। যদি যেতে পারতাম, বাবাকে আবৃত্তি করে একটি কবিতা শুনিয়ে আসতাম—
‘তুমি নেই বলে ঢাকাও দু:খ পাচ্ছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে ইটের গাঁথুনি
গাঁথুনির জমা চুন, পাথরে-লোহায় জড়াজড়ি সুরকি-কাঁকর
সিমেন্টের মায়ামমতার ভেতরে জীবন, জীবনের ভেতরে মৃত্যুর কীট,
ভেন্টিলেটরের ফাঁক- ফোকর, অন্ধকার
আর প্রাণ, কষ্টের দুহাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে
শহরের পুরোনো দালানকোঠা, মতিঝিল হাফপ্যান্ট পরা এক
মফস্বল কিশোরের মতো কেবলি আকাশ তার নীল করে দিতে থাকে
আমি দেখি... দেখতে দেখতে যাই...বহুদিন পর আমি এইভাবে
কিছুই দেখি না।
কিন্তু ঘুমোতে পারি না। কেবল শুয়ে থাকি। পারতোপক্ষে কোথাও যেতেও ইচ্ছে করে না। নাসিমাকে দিয়ে বাজার করাই, ইউটিউবে সার্চ দিয়ে পছন্দ মতো রিসিপি দেখে রান্না করি। খাই-দাই-টিভি দেখি। বোরিং লাগলে নাসিমার সাথে গল্প করি। মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী। অজপাড়া গাঁয় জন্ম হলেও খুব অল্পতেই শহুরে চরিত্র রপ্ত করে ফেলেছে। যখন যা প্রয়োজন ইশারা দিলেই চুকে যায়। এমনকি সেক্স বিষয়ক আলোচনা করলেও কম যায় না। টিভিতে হারবালের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে সব আয়ত্ত্ব করে ফেলেছে। সে-সাথে সে গ্রামীণ মেয়ে, গ্রাম্য বদ্দি-কবরেজদের টোটকা সম্পর্কেও বেশ দখল। কার্তিক মাসে কেনো কুকুর পাগল হয়ে যায়, চড়–ই পাখির মর্দানা শক্তি বেশি কেনো, অর্গাজম অবস্থায় ইঁদুরের অবস্থা কেমন হয়, কোন জাতের পুরুষ স্বয়ং কামদেব। চড়–ই মাংসের কিমা কীভাবে তৈরি করতে হয়, কুমারিলতার ডগা কতটুকু কাজে লাগে, সবই অকপটে শেয়ার করতে পারে। যদি বলি, হে রে তোর নেশাখোর মরদটা তোকে সময়-টময় দেয় তো? তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। কোথায় যে হারায় হয়তো সেও জানে না। হারিয়ে যাওয়ার জন্যেই বুঝি পৃথিবীতে নারীকুলের আবির্ভাব। যুগে যুগে সবকালে সবসমাজে পুরুষরা ভোগ করে বেড়াবে। আর নারী, সে কেবল হারাবে। অষ্টপ্রহর হারাবে। অধিকার থেকে হারাবে, বিছানা থেকে হারাবে, ইচ্ছে-চিন্তা-সিদ্ধান্ত থেকে হারাবে।
আমিও তখন আর এগুই না। ওকে ছেড়ে দিয়ে খোলা জানলার গ্রিল ধরে যতক্ষণ ইচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকি। আকাশ দেখি। ধুলিময় শূন্যে উড়ে বেড়ানো পাখি...ফেরিওলাদের লোক ঠকানোর দৃশ্য...রহিম মিয়ার চা-খানায় খদ্দেরদের আসা-যাওয়া এবং চা খেতে খেতে আষাঢ়ে গপ্প মারা...ক্লাবের তালাবন্ধ দরজাটা...খুচরো বাঁচানোর জন্যে অটোরিক্সাঅলার সাথে যাত্রীদের ঝগড়া আমাকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। বিরক্তি লাগে মোড়ে কদমগাছ আর ইলেক্ট্রিসিটির খুঁটিতে খুব শক্তভাবে বাঁধা ঢাউশ ঢাউশ ফোর কালারের ব্যানার-ফ্যাস্টুন-সাইনবোর্ডগুলো। কোথায়, কী উল্টাইছে, সেসব প্রচারের বড় বড় অক্ষরগুলো ‘লাগবা বাজি’র কন্ডমবিজ্ঞাপনের মতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী কারণে জানি না, তখন তলপেটে চাপ বেড়ে যায়। পালাতে ইচ্ছে করে। পালাতে ইচ্ছে করে ইতিহাসের প্রতিটি অক্ষর থেকে। অর্জনের প্রতিটি বাঁক থেকে। সারি সারি লাশের উপর দিয়ে। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিশোধ সব গা থেকে ধুয়ে-মুছে মানুষ-দেবতা-শয়তানমুক্ত অজানা-অচেনা কোনো এক অচিন দ্বীপে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে সকালের সিএনজিটা দুপুর গড়াতে না গড়াতে ল্যাম্বোরগিনি ভেনেনো অথবা লাইকান হাইপার স্পোর্ট’এর মতো দামি গাড়ি হয়ে চোখের সামনে বিদ্যুৎবেগে উড়ে বেড়াবে না। যেখানে চরিত্রহীনের বিষদৃষ্টি পাঁচ-সাত বছরের অবুঝ শিশুর নাক-মুখ-চোখ-বুক হয়ে দেহের আর আর পথ বেয়ে গড়াবে না। সিডাক্সিন ট্যাবলেট মিডিয়া থাকবে না। ধারা-উপধারায় প্যাচ লাগানো কৌটিল্যের জাল থাকবে না।
ইদানিং একটা রোগে ধরেছে। অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ি। সাচ্চু ভাইয়ের সাথে দেখা হলেই বলে, এতো ব্যস্ত হইও না। আবেগ আর তাড়াহুড়ো দিয়ে আর যাই হোক বিপ্লব হয় না। আর দৈবাৎ হলেও ক্ষণকালের জন্যে। একপলকের বিপ্লবের জন্যেই কি এভাবে সর্বস্ব নিঃশেষ করে যাচ্ছি! মেহনতি-বঞ্চিত মানুষকে কিছু দেবার জন্যেই যেহেতু পথে নেমেছি, তখন আরো সময় লাগবে। তোমরা তৈরি হয়েছো, এখন অন্যান্য শাখাতেও আমাদের কিছু লোক প্রয়োজন। ওগুলো হয়ে ওঠলেই মালকোচা দিয়ে নেমে পড়বো।
আমি তো বুঝেছি এবং বুঝেছি বলেই বইয়ের শেষ পাতাটির মতো লেগেও রয়েছি। কিন্তু আবেগ নির্ভর অপেক্ষাকৃত তরুণদেরকে তো বোঝানো যাচ্ছে না। ওরা সারাক্ষণই অঙ্ক কষে। বড়োদের এক্টিভিটিস দেখে যখন হিসেব মিলাতে পারে না, তখনই বুকের নিচে মাটি পাওয়া পিঁপড়ের দলার মতো সব ছড়িয়ে যায়। এজন্যেই বলি, আগে সিদ্ধান্ত স্থির করুন। কোথায় যাচ্ছি এবং কতদিন পর। তখনই কাজে গতি আসবে। কর্মীরাও সক্রিয় থাকবে। কয়েকদিন আগে স্টারপ্লাস বারে কবি অদ্বৈত বাড়ৈর সাথে দেখা। প্যাগ গিলতে গিলতে অনেক কথাই হলো, দেখলাম তারও কাঁসুন্দির শেষ নেই। সবকটা কর্মী বাষ্পের মতো যে যে-দিক পারে ছিটকে গেছে। বিজ্ঞাপনের অভাবে সুবলের লিটলম্যাগটা বন্ধ... কোটা বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে মার খেয়ে বুলবুল এখন পঙ্গুহাসপাতালে...নাবিলা বৈদেশিক কর্মস্থান মন্ত্রণালয়ের হাত ধরে সৌদি গিয়েছিলো, সেখানে বাড়িঅলা বাপ-ছেলের পালাক্রম ধর্ষণধকল সইতে না পেরে লুকিয়ে ফিরে এসেছে। এখন যেমন তেমন একটা কাজ চায়...পিপলু কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছে, কী হবে কবিতা লিখে, কবিতা তো মানুষ পড়তে চায় না, এই তার অভিমান। এই ব্যাধি নাকি জহিরকেও সংক্রামণ করেছে, সদ্যপ্রয়াত শওকত আলী শোকসভায় লোক সমাগম না হওয়ায় অতিথিদের অধিকাংশই ভাষা হারিয়ে নিরীহ শামুকের মতো নিজ নিজ খোলসে আশ্রয় নিয়েছে। আতিক বাংলালিংকের পার্টটাইম চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে মঞ্চে আবার সক্রিয়। সক্রেটিসের চরিত্রটা নাকি কারোই হচ্ছে না। আশা জাগানিয়া সংবাদ মাত্র একটা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নমিতা দি’রা নাকি মত পাল্টাইছে, দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। অদ্বৈতর অবস্থাও তেমন ভালো নয়। দ্বিতীয় সারির এক দৈনিকে কাজ করে। পারিশ্রমিক হিসেবে যা ধার্য, তাকে কোনোমতেই বেতন বলা যায় না। তাও আবার অনিয়মিত। কখনো কখনো নাকি তিন-চার মাসও পেরিয়ে যায়। হাতে মান্নান সৈয়দের কাব্যসমগ্র ছিলো। ওখান থেকে চারটা লাইন শোনালো। লাইনগুলো যেনো জীবিত আত্মার সমষ্টি। ডায়রিতে টুকে এনে বেশ কয়েকবার পড়েছি। এখন মুখস্থ।
...তারপর যতোবার কল্যাণে গিয়েছি, কে হেঁকেছে:
‘এ দেশ তোমার নয়!’ ভালোবাসা-প্রবেশের কালে
বেজে ওঠে তুঙ্গ নাদ: ‘বেরোও এখান থেকে তুমি!’
ঘৃণা রেলোয়ে বেয়ে ছেড়ে যাই ভালোবাসা-লোক।
মাঝে-মধ্যে হতাশ হয়ে গেলে লাইনকটা কুমিল্লা-শ্রীপুরের ট্যাবলেটের মতো কাজ দেয়। আর অন্যরা তো আমাদেরকে নিয়ে কেবল খেলেছে। ‘দুঃশাসনের রক্ত চাই’ বলে দাবি তুলেছে। বলেছে, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ আমরা এসব দাবির পক্ষে সাড়া দিয়ে বারবার নিজেদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেশকে দুঃশাসনমুক্ত করেছি। পরক্ষণেই দেখা গেছে দেশ আমাদের হাতে নেই। দেশ চলে গেছে দেবতা-ছায়াদেবতা-ভ্যাম্পায়ারদের দখলে; যাদের চোখে আমরা কেবলই ঘৃণীত জীব। যারা আমাদেরকে সাইজ করার জন্যে দিন-রাত ফরমা বানায়। সেসব তৈরি ফরমায় পড়ে আমাদের নিজস্ব অস্তিত্ব আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ কে না জানে এই জনপদে আমাদের অবদানের কথা। কে সৃষ্টি করেছে এসব? জানি, কেউ স্বীকার করবে না। কিন্তু আমরা তো জানি, আমাদের হাত-পায়ের ছোঁয়া না পেলে এসবের কিছুই হতো না। ঢাবি, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শাহবাগ; কিছুই হতো না সববঞ্চিতের হাত-পায়ের ছোঁয়া না পেলে। এবং সিনেমার এক্সাইটিং দৃশ্যের মতো এগুলো একদিনেও হয়নি। কখনো রক্ত দিয়ে কখনো বুকের পাজর গুড়ো করে তিল তিল করে গড়ে তুলেছি সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। এসব করতে গিয়ে সময়ের বাঁকে বাঁকে কতোকিছু যে ঘটেছে, কতোকিছুর যে মুখোমুখি হয়েছি; তা কেবল আমরা জানি। আর জানে পরদেশি বাতাস। তারা কতোবার যে স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে, আর কতোবার যে বুনেছি চোখের তারায়। এসব বকবক করা কোনো তক্ষকের জানার বিষয় নয়। দিনের সূর্য আর রাতের চাঁদ-তারা সাক্ষী; কতোবার যে ভেবেছি—এটা হবে ওটা হবে। এভাবে করবো ওভাবে করবো। আর ভুল হবে না। কিন্তু কীভাবে যেনো ভুল হয়ে যায়। ভুলের মাশুলও গুনেছি অসংখ্যবার। মাশুল দিতে দিতে বুঝে ফেলেছি—আমরা স্্েরাতের সাইডে পড়ে গেছি। যেখানে কেবলই ভাঙনের শব্দ। কেবলই ভেঙে যায়। চুরমার হয়ে যায়। সবকিছু।

ভাঙনের থুরে ভাসতে ভাসতে অনেকেই অনেককিছু ভাবতে থাকে। সাবটাইটেল স্মার্ট গ্রুপের আরিফ, বিপ্লব, রঞ্জু, প্রবিররা ভাবে সাবটাইটেলের পাশাপাশি একটা নাট্যদলও করবে। অভিনয়ের মাধ্যমে লোকদেরকে যতো সহজে কনভেন্স করা যায়, তা নাকি কোনো মাধ্যমে সেকি পরিমাণও সম্ভব নয়। হয়তো তাই। ঋত্থিক ঘটকও এমনটাই বুঝেছিলেন। যেজন্যে লেখালেখি ছেড়ে ফিল্ম জগতের অবতার হয়েছিলেন । কতোটুকু সফল হলেন তা নির্ণয় করতে হয়তো আরো সময় অপেক্ষা করতে হবে। সোহাস ভাবে চাকরির পেছনে না দৌড়ে, বাবার টাকা আছে, তা দিয়ে একটা প্রাইভেট ক্লিনিক খুলবে। ব্যবসার পাশাপাশি গরিব-গোরবাদের জন্যেও গেইট খোলা থাকবে। তাদেরকে ফ্রি-ভিজিটের সাথে টুকটাক ওষধপত্রও প্রদান করা হবে। রেণু ভাবে ক্ষণকালীন সঙ্গিনী হবে। এই যেমন  কোনো নিঃসঙ্গ মানুষ, যার টাকা-পয়সা আছে কিন্তু কথা বলার মতো তার পাশে কেউ নেই। রেণু সেখানে যাবে। চুক্তি মোতাবেক তার সাথে সঙ্গ দেবে। এভাবে সে কারো মা, কারো বোন, কারো আবার প্রেমিকা-ট্রেমিকা ইত্যাদি হবে। মন ফুরফুরে থাকলে আমিও অনেককিছু ভাবি। ভাবি, একটা গাড়ি ডেকে কয়েকদিনের জন্যে শহরের বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসবো। বিশেষ করে সালুয়া, মাছিমপুর, ডুমরাকান্দা, ভিটিগাঁও থেকে। সবকিছু মরে গেলেও কীভাবে যেনো এখনো গ্রামগুলো বেঁচে রয়েছে। আকাশের মতো বিস্তৃত ফসলি জমি। লোকেরা চাষবাস করে। কোনো খেতে আলু, কোনো খেতে মরিচ, কোনোটাতে আবার পাহাড়ি জুমচাষের মতো টমেটো-ভরবটি-করলা একসাথে। এসব ছাড়িয়ে গেলেই দৃষ্টিকাড়া বিস্তীর্ণ ধানী জমি। এসময় বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে পোয়াতি ধানখেতগুলো এক চাপে সব থুর খালাস করে দেয়। কা--পাতা ছাড়িয়ে শুধু শীষগুলো উপরে ওঠে ঘাড় কাত করে বাতাসের অপেক্ষায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাস এলেই ছায়ানটের সারিবদ্ধ একঝাঁক তরুণ-তরুণীর মতো ডানে-বামে মৃদু দোলে ওঠে, তখন এক অপরূপ সুরের মূর্ছনায় পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। হয়তো নিজেকেও খুঁজে পাবো।
কখনো ভাবি, আরিফদের দলে আমিও থাকি না কেনো? ছেলেগুলো বেশ চৌকষ। হলিউড, ইরানি, কোরিয়ার বেশ কিছু জনপ্রিয় ছবির সাবটাইটেল করে ইতোমধ্যেই পারঙ্গমতার পরিচয় দেখিয়েছে। তাছাড়া অভিনয় জগতের টুকটাক কিছুতো আমারও জানা-শোনা আছে। পার্টির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক থাকাকালীন সময় দেশের সংস্কৃতিকর্মীদের সাথে বেশ একটা ভালোলাগার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। মহানগর নাট্যমঞ্চ, মহিলা সমিতি, উদীচী, মুক্তধারা, ছায়ানট ইত্যাদিতে ঘনঘন যেতাম। ওখানেই পরিচয় সাজ্জাদের সাথে। সাজ্জাদই শিখিয়েছিলো কীভাবে একটা সফলমঞ্চের ছক আঁকতে হয়....