চিঠি

চিঠি



চিঠি
আনোয়ার রশীদ সাগর

নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ ও এলোমেলো বিষন্নতা নিয়ে বসে আছি পড়ার টেবিলে। হুড়পাড় শব্দ করে পদ্মার পাড় ভাঙে, ফিসফিস করে দু’এক ফোটা বৃষ্টি নেমেই থেমে যায়। মেঘগুলো কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মেঘের ফাকে চাঁদের জ্যোৎস্না হেসে উঠছে,আমার অবাধ্য মনও মেঘের সাথে বার বার চলে যাচ্ছে-ফিরে আসছে। অজানা অচেনা পথে হাঁটার মত, চোখ বুজলে দেখতে পায় আমাকে...
ইস তুই না বড় হ্যাবলা?
লালিমা কথা বলেই আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি ওর হাসি-খুশি মুখবয়টা বার বার দেখতে পায়।
আবার লালিমা আমার ওড়না ধরে টেনে বলে, দেখলি না স্বপ্ন তোর জন্য চিঠি রেখে গেল।
আমি মুখ ফসকিয়ে বলে ফেলি, কোথায়?
লালিমার সজনে ডাটার মত হাতটা উত্তর দিকে উঁচু কওে দেখানোর চেষ্টা করে বলে, ঐ যে সাইন্স বিল্ডিংএর জানালার উপর ইটের নিচে।
আমি পা বাড়াতেই ইংরেজির শিক্ষক ছড়ি হাতে নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করল। ওরে বাবা, আজ ডিসিপ্লিন রচনা মুখস্ত করে আসতে বলেছিল। আমার বুকের মধ্যে  ভুমিকম্পন শুরু হয়ে যায়, পড়া তো হয়নি। স্যার দাঁড় করিয়ে হাতে সপাং সপাং মারে, অপমান করে।
আমার পড়া হবে কি করে?- গতরাতে বরপক্ষ ছেলেসহ আমাকে দেখতে এসেছিল। হাতে সোনার আংটি পরিয়ে রেখে গেছে। ছেলে ইউরোপের কোন এক দেশে থাকে। বুকের মধ্যে সম্পানের নাও বয়ে যায় সারারাত।
আমাকেও নিয়ে যাবে বিদেশে। সবেমাত্র দশম শ্রেণিতে পড়ি।
চেয়ারম্যান সাহেব বাবার বন্ধু, তাই বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন করে দিবে। বিয়ে হয়ে যাবেই।
স্যার ক্লাসে এসেই বলে, কার কার পড়া হয়নি? -দাঁড়াও।
যথারীতি দাঁড়িয়ে পায়ের দিকে মুখ করে, মাথা নিচু করে থাকলাম। যারা যারা আমার মত দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতের উপর চলছে লাঠির আঘাত। স্যার আমার কাছে আসতেই, আমি ডান হাতটা সোজা করে স্যারের সামনে মেলিয়ে দিলাম। স্যারের চোখ আমার রাঙা হাতের সোনার আংটির দিকে। আমার মুখের দিকেও  দু’ একবার তাকালো; তারপর বলল, তোমার বিয়ে নাকি?
আমি মাথা নিচু করে, নিরবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
হঠাৎ দড়বড় শব্দে বৃষ্টি নেমে এলো। বাইরে জানালার কাছে কলাগাছের পাতার উপর বৃষ্টির ফোটা জোরে জোরে আঘাত করায় যেন স্মৃতির পাতা থেকে ফিরে এলাম।
শামীমের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার, এক বছর হতে চলল। বিয়ে করে বাসর ঘর করে, সোনার গহনা-পোষাক-টাকা-পয়সায় ভরিয়ে দিয়ে চলে গেছে বিদেশে। যাওয়ার সময় বলে গেছে, মন দিয়ে পড়বা, বেশি বেশি ইংরেজি শিখবা। কিন্তু আমার চারিদিকে হাহাকার, মানুষের আহাজারি। পদ্মার ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। দুই তিন কিলোমিটার ভাঙতে ভাঙতে  আমাদের বাড়ির পাশে চলে এসেছে।
 একাকিত্ব আমার চারপাশ আটকিয়ে ধরেছে। মেঘের মত ভেসে যাচ্ছি উদ্দেশ্যহীন। ইটের নিচের চিঠিটা খুঁজি সারাক্ষণ। কি লিখেছিল স্বপ্ন? স্বপ্ন আমার সাথেই পড়তো। স্বপ্নকে  ও স্বপ্ন’র চিঠিকে  জানার আগ্রহ মাঝে মাঝে আমাকে পাগল করে তোলে, উতলা হয়ে ওঠে মন। কাশফুলের ঝরা পাপড়ির মত কল্পিত চিঠির উপর মনটা আছড়িয়ে পড়ে। পদ্মার ভাঙনের মত স্মৃতির ধারগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ে। দূরে আধো-আলো ছায়ায় দেখা যাচ্ছে, বাড়ন্ত কদম গাছটি পদ্মার ভাঙনের সাথে হেলে পড়ছে।
দু বছর পরের ঘটনা।
আমার স্বামী আসবে করে করেও বাড়ি আসে না। টাকা পাঠায়।  মোবাইলে কোনদিন কথা বললে, ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। মোবাইলে কথা বলতে হলেও, কোন মোবাইল ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে। মোবাইল ব্যবসায়ী ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম। তবে আমার চেয়ে এক বছরের ছোট সে। আপা বলে ডাকতো। দু’সপ্তাহ বা তিন সপ্তাহ্ পর পর সংবাদ দিত, আপা দুলা ভাই অমোকদিন বিকালে ফোন করবে আপনাকে আমার দোকানে থাকতে বলেছে। যেতাম, অপেক্ষা করতাম। ফোন করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো বা কোন কোনদিন রাতও হয়ে যেতো। আমি ওই দোকানে গেলে বেশ কয়েকজন ছেলে এসে আড্ডা দিত। বুঝতে পারতাম আমাকে নিয়ে ওদের আলোচনা চলতো। এও বুঝতাম আলোচনার বিষয় থাকতো বেশ রোমান্টিক। মাঝে মাঝে মনে হতো, মিশে যায় ওদের সাথে। একদিন ওদের সাথে সিনেমা হলেও ঢুকেছিলাম, সিনেমা দেখেছিলাম। যেদিন সিনেমা হলে সিনেমা  দেখছিলাম, সেদিনই লিলিমা আর তার স্বামীও সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। কাকতালীয় ভাবে আমি আর লিলিমা এক জায়গায় পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম। লিলিমার স্বামী ওর ডান দিকে আর আমি ওর বামদিকের সিটে বসেছিলাম। উহ্ যাদের সাথে সিনেমা দেখতে এসেছিলাম, ে দেখেছিলাম, তাদের আফসোস। আমি যেন ওদের হাত ছাড়া হয়ে গেছি। চাঁদ হয়ে আলো ছড়িয়েছি ওদের মনে অথচ মেঘ এসে বরষা ঝরিয়েছে ওদের মুখে।
এর মধ্যে আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাটা হয়ে গেল। বাড়ির কাছে যে স্কুলে পড়তাম, ওই স্কুলে একাদশ শ্রেণি খোলায়, ওখানেই লেখাপড়া করতাম। বেশ রিলাক্সে সময় কাটছিল। স্বপ্ন জেলা শহরের কলেজে পড়তো। পরীক্ষা দিয়ে ও বাড়ি এসেছে। আমাদের গ্রামের ছেলে হলেও,  তেমন কথা হয়নি ওর সাথে। শুধু চিঠি দিতো, আমি পাগলের মত ওর আবেগপূর্ণ চিঠিগুলো পড়তাম। হয়তো আমি চিঠি পড়ে মুগ্ধ হয়ে জোছনাময় অথবা আলোময় দুপুর খুঁজছি, ছুটে চলেছে আমার মন টুনটুনি পাখির মত বসন্ত দুয়ারে, ফুলে ফুলে, ঘুরে ঘুরে, ফুটন্ত পাপড়িগুলো ঝরাতে চায়। নতুন চৈত্রদিনের প্রত্যাশায় সারাক্ষণ মৃদু ওম বাতাস  ও তপ্ত ছায়ার সন্ধানে চলি।
        একদিন বেরিয়ে পড়লাম, অজানা-অচেনা পথে। স্বপ্ন এর দু’জন বন্ধু স্বাধীন আর উদয় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। কলকল শব্দে মাঠ থেকে, ক্যানেল দিয়ে, নদীতে পানি নামছে। বেশ খানিক আগে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। ভীষণ অন্ধকার ছিল আকাশটা। কালো মেঘে রাতটাকে আরো কালো করে তুলেছিল।
এখন বেশ পরিস্কার ঝকঝকে লাগছে পরিবেশ। আকাশের মাঝখানে চাঁদটা ঝলমল করে হাসছে, যেন দুপুরের সূর্যমূখী ফুল ফুটেছে-মেলে দিয়েছে পাপড়িগুলো। আমি স্বাধীন আর উদয়ের মাঝে হাটছি।নদীর ধার দিয়ে হেটে চলেছি। স্বাধীনের ডাকে সাড়া দিয়েছি।
‘স্বপ্ন’ এর সাথে  মুখোমুখি কথা না  হলেও, শুধু ওর আবেগে ভরা চিঠিগুলো পড়েই ঘর ছেড়েছি। আমার শরীর ভর্তি গহনা রয়েছে। বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা যা ছিল, সব সঙ্গে নিয়েছি। কোথায় যাচ্ছি জানিনা, শুধু জানি ছায়ার মত, বন্ধু-সহপাঠী স্বপ্ন আছে আমার সাথে। যাকে নিয়ে আমার কল্পনা, আমার উড়–উড়– বাসনা, সারাক্ষণ পাখা মেলে থাকে, তার কাছে যাচ্ছি।
দূরে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। ঝড়-জঙ্গল ছেড়ে ক্যানেলের ধারে এক পায়ে দাঁড়ানো একটি তাল গাছের নিচে পৌছালাম। জ্যোৎস্নালোয় দেখা যাচ্ছে, একটা টিনের বেশ বড় বাড়ি। ওই বাড়ি থেকে স্বপ্ন এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কয়েকবার চুমু খেলো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটনাটা ঘটছে এবং আমিও ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ওর পাতলা বুকটা আমার নরম বুকে লেপটে আছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছি দু'জনেই। কয়েক মিনিট পর আমার ডানহাতটা চেপে ধরে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। ওই বাড়ির ভিতর গিয়ে দেখতে পেলাম, একজন কাজী আর দু’জন লোক বসে আছে। কাজী সাহেব খুব তাড়াতাড়ি আমাদেরকে ওজু করে তার সামনে গিয়ে বসতে বলল। স্বপ্ন খুব দ্রুত ওজু করল। আমার বেশ খানিক দেরি হল। আমার মাথায় যেন কোন কাজ করছে না, হ্যাঙ হয়ে গেছে। তারপর যখন তালাকনামায় স্বাক্ষর করলাম তখন বুকটায় যেন বড় কোন পাথর এসে চেপে বসল। চোখে পানি টলটল করছে। আমি কিছুই বলতে পারছি না। না কবুল অথবা না তালাক। শুধু একের পর এক হুজুর কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে আর আমি স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। আমি কি শাড়ি বদল করছি, না ঘর বদল করছি, বুঝতে পারছি না। আমার এতদিনের সমস্ত আবেগ ও অনুভূতি বিকল হয়ে গেছে। বার বার বাবা-মা আর স্বামীর কথা মনে হচ্ছে। যেন আমার স্বামী শামীম, আমাকে ফোন করে বলছে, ভাল করে লেখাপড়া করবা, মা-বাবাকে দেখবা। যা লাগবে, শুধু বলবা। ওর কণ্ঠ আমাকে ব্যস্ত করে তুলেছে। মৌ, মৌ আমার মৌ, ভাল থেকো, সোনা-মধু ফোন করো...। এ যেন বাস্তব এক চিঠি, আমাকে বার বার উতলা করে তুলছে, মৌ কিছু বলো, আমিই শুধু বলছি, তুমি কিছু বলো। আমি খিলখিল করে হেসে পড়েছি। অমনি আমার সামনে বসা হুজুর চুমকিয়ে উঠেছে। যেন ভয় পেয়ে গেছে।
স্বপ্ন, স্বাধীন ও উদয় হুজুরের সাথে মোনাজাত করছে। তখন আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। আকাশটা আবার মেঘে ঢেকে গেছে। ঝরঝর করে বৃষ্টি নেমে গেল। আমার শামীমের দেওয়া গহনাগুলো, আমার শরীরকে ধিক্কার দিতে লাগল। আমি উড়ছি খোলা আকাশে, বৃষ্টির মধ্যে। ভারী ভারী গহনা ছুঁড়ে ফেলে পাতলা হচ্ছি। স্বপ্ন এর আবেগপূর্ণ চিঠিগুলো ভিজে ভিজে যাচ্ছে, বৃষ্টির ফোটায়। কালো কালো কাগজে ছড়ানো কালি, কাগজের পাতা থেকে ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে। সাদা খন্ডখন্ড কাগজ ভেসে যাচ্ছে নর্দমায়।



ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৫

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ : পর্ব ০৫


জোসনারাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
বাবা ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খেতে লাগল। তখনই কাছে একটা টিট শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে টিট। তারপর টিট-টিট। তারপর টিট-টিট-টিট। বাবা চারিপাশে তাকাল। দেখে, তার ডান পাশে ঝাকড়া এক গাছে পাতার আড়ালে বসে আছে খুব ছোট একটা পাখি। বসে আছে ঠিক নয়, একটু একটু লাফাচ্ছে, আর টিট-টিট-টিট ডাকছে। পাখিটা খুবই সুন্দর। উজ্জ্বল এবং চকচকে নীল রঙের পালক। লম্বা বাঁকানো আর সুঁচালো ঠোঁট। ঠোঁটের রঙ কুচকুচে কালো।
নাম কী পাখিটার? টুনটুনি না মৌটুসি? এত ছোট আকারের পাখি। পাখি বিশারদরা বলতে পারবে। বাবা মনে মনে বলল, নাম দিয়ে কাজ কী? পাখিটা সুন্দর। তাকে দেখ। তার গান মিষ্টি। তা শোনো। মানুষের গান শুনলে তার নাম জানার দরকার হয়। কারণ, তার সিডি বা ক্যাসেট বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। পাখির কোনো সিডি-ক্যাসেট নেই। তাই তার নাম জানারও দরকার নেই। রবীন্দ্রনাথের গান না শুনে আজ পাখিন্দ্রনাথের গানই শোনা যাক। বাবা বলল, গা বাবা, মনের সুখে গলা ছেড়ে গা।
বাবা পাখিন্দ্রনাথকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করল। সে তো মা-ও হতে পারে। না তা পারে না। বাবা জানে যে, সাধারণত ছেলে পাখিরাই গান করে, মেয়ে পাখিরা গান করে না। আবার দেখতেও ছেলে পাখিরাই বেশি সুন্দর। অথচ মানুষের মধ্যে পুরুষের রূপের কোনো কদর নেই বললেই চলে। সব কবি-লেখকই সারা জীবনভর শুধু মেয়েদের রূপের গুণ-গান লিখে যায়।
পাখির স্বর উঠে গেছে সপ্তমে, এবং একটানা হয়ে গেছে। বাবা গান শুনতে শুনতে দুই কাপ চা খেয়ে ফেলেছেন। হঠাৎ আরেকটি পাখি এল। এই পাখিটার গায়ের রঙ উজ্জ্বল বাদামী আর হালকা সবুজের মিশেল। পাখিটা এসে সংগীতরত পাখিটার পাশে বসল। বসা মাত্র শিল্পী তার গান থামিয়ে দিল। তারপর দু’টি পাখি ফুড়–ৎ করে উড়াল দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।  
এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। মাত্র দুই কাপ চা খেতে এক ঘন্টা চলে গেল? পরে বাবা বুঝল, সে দুই কাপ চা খায়নি। খেয়েছে কম করে হলেও আট কাপ। কারণ, সে তো কাপে করে চা খায়নি। চা খেয়েছে ফ্লাস্কের ঢাকনায়। ফ্লাস্কের সাইজ সর্বোচ্চ মাপের। তার ঢাকনাটাও তাই। সেটায় কম করে হলেও স্বাভাবিক কাপের চার কাপ চা ধরবে। খালি পেটে আট কাপ চা খেয়েছে, এ কথা ভাবতেই বাবার পেটের মধ্যে মোচর দিয়ে উঠল। সে হয়তো বমি করে ফেলবে।
তখন দেখল, হাসান আর অন্তর আসছে। হাসানের দিকে তাকিয়ে বাবার বমি পেটের ভেতর চলে গেল, অথবা বাবা বমির কথা ভুলে গেল। তার হাসি পেল খুব। গ্রামের মেয়েরা কলসি কাখে পানি আনে। তাদের কলসি থেকে সলাৎ সলাৎ করে পানি পড়ে যায়। হাসান পানি আনছে কাঁধে করে। তার কলসি থেকেও সলাৎ সলাৎ করে পানি পড়ে তার শরীরের বাম পাশটা ভিজে গেছে। অন্তরের কাঁধেও একটা ব্যাগ। সে ব্যাগে কী আছে বাবা তা বুঝতে পারল না।
হাসান বলল, স্যার, পানি আনার জন্য তো কিছু নেইনি। শেষে এক বাড়ি থেকে এই কলসটা দিল।
কলসটা কি আবার ফেরত দিতে হবে?
না, এটার দাম বারো টাকা। আমি তাদের পনেরো টাকা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা নিল না, এমনিই দিল।
সাহিত্যে এমনিই গ্রামের মানুষদের উদার বলে না?
স্যার, এবার নাস্তা শুরু করা যাক। খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
সিওর সিওর। তুমি তো তোমার জামা-প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছো। বদলাবার মত তো কিছু নেই। ভেজা কাপড়ে......।
তাতে কোনো সমস্যা নেই স্যার। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। ওহো......!
এই বলে হাসান পকেটে হাত দিয়ে কিছু টাকা আর দু’টো কাগজ বের করল। সেগুলো গাড়ির সামনে সার বেঁধে শুকাতে দিল। বাতাসে যাতে উড়ে না যায় এ জন্য সবগুলোর উপরে একটা করে ইটের টুকরো বসিয়ে দিল।
নাস্তা খেতে খেতে বাবা বলল, হাসান, কাগজগুলো কি খুব দরকারি?
না স্যার, আমার ছোট ভাইয়ের চিঠি।
তোমার ছোট ভাই কত বড়?
বলেছিতো, অন্তরের সাথেই পড়ে। ওদের রেজাল্ট গত সপ্তাহে হয়ে গেছে। সেই রেজাল্টের কথাই লিখেছে।
ওদের রেজাল্ট আগেই হয়ে গেছে?
জি।
আরেকটা কাগজ কিসের?
সেটায় আমি চিঠির উত্তর লিখেছিলাম।
এই সেলফোনের যুগে চিঠি চালাচালি?
আমার ভাইটা চিঠি লিখতে পছন্দ করে। ও মনে করে, যে কথা মুখে বলা যায় না, সে কথা অনায়াসে চিঠিতে লেখা যায়।
বাবা পুডিং-এর বাক্সটা খুলল। বাবা কিছুটা পুডিং নিজের প্লেটে নিয়ে বাক্সটা বাড়িয়ে দিল হাসানের দিকে। বলল, তোমার ভাইয়ের রেজাল্ট কেমন হয়েছে?
অংক আর বিজ্ঞানে ফেল করেছে। আর সব বিষয়ে হাইয়েস্ট মার্কস পেয়েছে।
বাবা ঝট করে তাকাল হাসানের মুখে, অন্তরও। এমন অদ্ভূত কথা তারা কখনো শোনেনি। কিন্তু হাসানের মুখে তাকিয়ে বোঝা গেল না যে, সে অদ্ভূত কিছু বলেছে। সে খুব স্বাভাবিক। বাবা বলল, তুমি উত্তরে কী লিখেছো?
লিখেছি-তুই যে এত ভাল করবি আমি তা ভাবতে পারিনি। তোর ওপর আমি খুব খুশি হয়েছি। আগামি মাসের বেতন পেয়ে আমি তোর জন্য একটা উপহার পাঠিয়ে দেব। তবে তোকে তো এবার প্রমোশন দেবে না। তুই অংক আর বিজ্ঞানের দিকে একটু মন দে’। যদিও আমি বাংলা পড়েছি, অংক-বিজ্ঞান ভাল বুঝি না, তবু আমার মনে হয়, এ দু’টো খুব সহজ বিষয়। আইনিস্টাইনের মত একজন অটিস্টিক মানুষ........।
তোমার কি মনে হয়, সত্যি আইনস্টাইন অটিস্টিক ছিলেন?
সব বড় মানুষই সাধারণের কাছে অটিস্টিক। মানুষ যত বড় তার আচরণ তত অটিস্টিক।
তাহলে তুমি এ কথা লিখলে কেন?
একটু সাহস দিতে। অংক-বিজ্ঞানের ব্যাপারে আমার ভাইয়ের মনে একটু সাহস দরকার।
নাস্তা শেষে বাবা পানি খেতে গেল। তখন অন্তর বলল, বাবা, পানির উৎস জানো?
কূপ না নলকূপ?
এর একটাও না।
তাহলে?
কচুরিপানা ঢাকা পুকুরের পানি।
বলিস কী! পুকুরের পানি আনলি কেন?
কূপ বা নলকূপ পাওয়া গেল না। এখানকার মানুষগুলো খুবই গরিব। মাটির ঘর, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, মাটির থালা-বাসন। ঘরে বিশেষ কোনো আসবাব নেই। তারা নলকূপের কথা ভাবতেই পারে না। একটা এলাকার সবাই এমন গরিব আমি তা আগে ভাবতে পারিনি।
বাড়তি অভিজ্ঞতা। তোর গল্পের মোড় ঘুরে যেতে পারে। কী ধরনের গল্প লিখতে বসেছিলি?
সায়েন্স ফিকশান।
সায়েন্স ফিকশান এবার শুধুই ফিকশান হয়ে যেতে পারে। আচ্ছা, পানিটা কি খুব নোংড়া? শ্যাওলা-ট্যাওলা ভাসছিল?
না বাবা, যে অংশটা তারা ঘাট হিসেবে ব্যবহার করে সে অংশের পানি খুবই পরিস্কাার-একেবারে স্বচ্ছ-টলটলে।
স্বচ্ছ পানিকে কিসের সঙ্গে তুলনা করা হয় যেন?
জানি না বাবা।
হাসান, তুমি জানো?
হাসান তখন ঢকঢক করে পানি গিলছে। এক নিঃশ্বাসে এক বাটি পানি গিলে বলল, কাকের চোখের সঙ্গে তুলনা করা হয়। বলা হয় কাক-চক্ষু জল।
দেখেছিস অন্তর, সাথে বাংলায় মাস্টার্স থাকলে কত কিছু জানা যায়। এই পানি পান করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কবিতাটা মনে আছে-
আসমানিদের বাড়ির পাশে পদ্ম পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা-শ্যাওলা পানা কিলবিল বিল করে
মশক সেথা ম্যালেরিয়ার বিষ গুলিয়ে জলে
সেই জলেতে আসমানিদের নাওয়া-খাওয়া চলে।
সেই পানি খেয়ে আসমানি বেঁচে ছিল নব্বই বছর। আর আমরা ফুটিয়ে, ফিল্টার করে পানি খেয়েও পঞ্চাশ বছর বাঁচলে.....।
নাস্তা শেষে হাসান আর অন্তর বাটিতে ঢেলে চা খেল। বাবা আগে আট কাপ খেয়েছে বলে আর খেলেন না। বাবা বলল, অন্তর, তোর কাছেও তো একটা ব্যাগ দেখলাম?
যে বাড়ি থেকে পানি এনেছি তারা বড়ই দিয়ে দিল।
বড়ই তো এখন পাকার কথা না।
আধা পাকা।
আধা পাকা বড়ই লবন দিয়ে খেতে খুব মজা। দেখিস, তোর মা হলুদ-লবন-মরিচ মিশিয়ে তেলের মধ্যে ভিজিয়ে আচার বানিয়ে ফেলবে।
মা’র কথা আসতেই বাবার মোবাইলে ম্যাসেজ এল।বাবা বলল, তোর মা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
কী লিখেছে?
পড়ে শোনাচ্ছি-তোমার ছেলে এবারও ফার্স্ট হয়েছে। ছেলের নাম ডেকে ডেকে হেডমাস্টর অস্থির। আমি যখন প্রগেস রিপোর্ট আনতে গেলাম হেডমাস্টর বললেন-ফার্স্ট বয় কোথায়? আমি বললাম, বাপের সঙ্গে জঙ্গলে বেড়াতে গেছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন-রেজাল্টের দিন জঙ্গলে? কি আশ্চার্য! এখন বিজয় স্তম্ভে কে উঠবে? দুই পাশে দুই জন উঠবে, আর মাঝের স্তম্ভটা খালি থাকবে? তাহলে ছেলের হয়ে আপনি উঠুন। শেষে সেকেন্ড বয় আবীর আর থার্ড বয় চঞ্চলের কাঁধে ভর দিয়ে আমি উঠলাম।
মেসেজ পড়া শেষ হলে বাবা বলল, খুব খুশি হয়েছিস?
না বাবা।
ফার্স্ট হয়েছিস অথচ খুশি হোসনি?
আমি  চেয়েছিলাম সেকেন্ড হতে। চেয়েছিলাম আবীর ফার্স্ট হোক। ও খুব গরিবের ছেলে। খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করে।
ওকে তোর পথ করে দিতে হবে না। ও সংগ্রামী ছেলে, নিজের পথ নিজেই তৈরী করে নেবে। তুই বৈঠা ঠিক মত চালাস। এতটুকু গাফলতি হলে ও কিন্তু তোকে ফেলে চলে যাবে। তখন ওকে ধরতে তোর জিহ্বা বের হয়ে যাবে তিন হাত।
তারপর বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত এখানে কিছু হয়নি। তারপরও বাবা বলে কথা। অন্তর বাবার মুখে তাকাল দীর্ঘশ্বাসের কারণ জানতে। বাবা বলল, রবীন্দ্রনাথ শালবনে ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে নবেল প্রাইজ প্রাপ্তির খবর পেয়েছিলেন। আর তুই বাপকে নিয়ে গজারি বনে বেড়াতে এসে পেলি ফার্স্ট হওয়ার খবর। আমার আর রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথীন্দ্রনাথের ভাগ্য চিরকালই ঘোলা জলের ডোবা। বড় রকমের ইতিহাস ধরে না সেখানে। এই খবরের পর তোর মুখে একটু মিষ্টি দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এখন মিষ্টি কোথায় পাব?
হাসান বলল, স্যার, আমার কাছে এক ধরনের চুইংগাম আছে, নাম সেন্টার শক। সেটা মুখে দেবার পর ভীষণ টক। একটু পর ভীষণ মিষ্টি।
তাহলে একটা চুইংগাম ঢুকিয়ে দাও ওর মুখে।
অন্তর চুইংগাম মুখে দিয়ে মুখটা বিকট করে চোখ বন্ধ করে রইল।

(৪)
বনের ভেতর ঘুরতে অন্তরের ভাল লাগছিল। ছায়া ঢাকা পথ। পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ। মাঝে মাঝে লতাগুল্মের ঝোপঝাড়। তবে পাখি বা প্রাণীর দেখা মিললে আরও ভাল লাগতো। বন অথচ সেখানে পাখি বা প্রাণী থাকবে না তা কেমন করে হয়? হাঁটতে হাঁটতে বাবা বলল, অন্তর, তোর মা যদি জিজ্ঞেস করে কী দেখলি তাহলে কী বলবি?
বলবো গাছ দেখেছি। লম্বা লম্বা গজারি গাছ শক্ত লাল রঙের মাটির মধ্যে পা দাবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লতাগুল্মের ঝোপঝাড় দেখেছি।
বনে তো গাছ আর ঝোপঝাড়ই দেখবি। এসব না থাকলে বন হবে কেন? শেয়াল, খাটাশ, বাগডাস, গুইসাপ এসব বলার মত জিনিস। সুন্দর কিছু পাখি-টাখি দেখা গেলেও বলা যেত।
প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিব। সবুজ বন, বনের কোল ঘেষে কৃষকের ফসলী জমি, তারপর গ্রাম। আমি যে গ্রামে ঢুকেছিলাম তাও বলবো। তাদের ঘরবাড়ি, জীবন-যাপন বলবো।
বাহ! তাহলে তোর মধ্যে প্রকৃতি ধরার ক্ষমতা আছে। লেখক না! এ বিষয়ে আমি একটা কৌতুক জানি, বলবো?
বলো বাবা।
হাসান কী বলো, বলবো?
হাসান বলল, বলুন স্যার। বনে হাঁটতে হাঁটতে বন বিষয়ক কৌতুক ভাল লাগবে।
আমি কিন্তু রস মাখিয়ে বলতে পরবো না। আমার মুখে রস কম।
আমরা রস মাখিয়ে শুনে নেব। কী বলো অন্তর, তুমি রস মাখিয়ে কৌতুক শুনতে জানো না?
অন্তর তা জানে না। সে জানে কৌতুক যদি রসের হয়, বলার ঢঙটা যদি সুন্দর হয় তাহলে শুনে হাসি পাবে। কৌতুক রসের না হলে শোনার সময় রস মাখানো সম্ভব না। সে বলল, না, আমি রস মাখিয়ে কৌতুক শুনতে জানি না।
বলো কী? ব্যাপারটা খুব সহজ। কৌতুক শোনার সময় ঠোঁটের কোণে অল্প একটু হাসির রেখা টেনে যে কৌতুক বলবে তার মুখে তাকিয়ে থাকবে। তাহলে সে নার্ভাস হবে না, বলতে উৎসাহ পাবে, তার মুখে রস আসবে।
অন্তর বলল, বাবা, তুমি কৌতুক বলতে শুরু করো। আমি মুখে হাসির রেখা টেনে তোমার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বাবা শুরু করল, এক লোক অনেকের সাথে গিয়েছিল বনের ভেতর পিকনিকে। সে ফিরে এলে.......ফিরে এলে......ফিরে এলে......তোরা এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিস যে, আমার খুব নার্ভাসবোধ হচ্ছে। তোরা অন্য দিকে তাকা।
অন্তর অবাক হয়ে বলল, হাসান আঙ্কেল, আপনার থিওরী যে উল্টো ফল দিল?
কোনো কোনো থিওরী কারও কারও ক্ষেত্রে উল্টো হতে পারে। আচ্ছা, স্যার আমরা অন্যদিকে তাকালাম, আপনি বলুন।
তো সে পিকনিক থেকে ফিরলে তার বন্ধুরা বলল-কিরে, প্রাকৃতিক দৃশ্য কেমন দেখলি? সে বলল-আর বলিস না, গাছপালার জন্য কোনো দৃশ্যই দেখতে পারলাম না। [ক্রমশ...]

পদাবলি

পদাবলি


রেশমী চুল
সিত্তুল মুনা সিদ্দিকা 

কার্নিশে বেয়ে ওঠা মাধবী লতার লাল গোলাপী ফুলের
মাতাল করা গন্ধ ছড়ালো চারিদিক।
পুড়ছে কানন আজ মধ্য গগনের অগ্নিঝরা রোদে।
 খুব চেনা ঐ শুকনো মাটির গন্ধে লাগে নাকে
চোখ জ্বালা করে রবির দহনে
তবুও চুপকরে জানালায় বসে চেয়ে দেখতে দেখতে ব্যথাতুর
এই মন হায়ায় অলক্ষ্যে আপন সীমানা এড়িয়ে বহুদূর
দূরের গাঁয়ের শ্যামল টানে,
যেখানে হেলে দুলে গ্রাম্য বালিকা চলছে বাড়ির পথে,
ওর পটলচেরা চোখের চাহনিতে আছে অজানা এক বিস্ময়,
হেঁটে যেতে যেতে পুকুর পাড়ে পা ডুবিয়ে
শাপলার পাতা সরিয়ে ফুল তোলে আপন মনে,
পথের ক্লান্তি এড়াতে বট বৃক্ষের ছায়া খোঁজে।
মধ্য দিবসের তাপদাহ বেড়েই চলছে তখনো,
হঠাৎ বেহিসেবি উত্তরী বাতাস এসে এলোমেলো করে
তার দীঘল কালো রেশমী চুল!


আমি ধার্মিক হইনি
রাফাতুল ইসলাম আরাফাত

এই পথে জীবন ফুরিয়েছে
পথের দু’পাশে অশোকের সারি
ঠিক জীবনের মতো-
জীবন নয়।

এক হাতে রাইফেল,
আরেক হাতে বাইবেল।
ভালোবাসা এক মহান ধর্ম-
আমি প্রেমিক হতে গিয়ে ধার্মিক হইনি।


মনের অলি
দিপংকর দাশ

ঝরণা হয়ে পাহাড় বেয়ে শীতল করো বক্ষ,
রুক্ষ হৃদয় খুব মরুময় খোলা মনের কক্ষ।

তপ্ত দুপুর বাজে নূপুর বিষ মনে হয় বাঁশি,
চুপিসারে ডুব সাঁতাওে উঁকি দাও গো আসি।

দেখলে চাঁদমুখ ভুলে সব দুখ হাসবো পরাণ খুলে,
নীল পাহাড়ে রং বাহারে পুষ্প যেমন ঝুলে।

গুনগুনিয়ে মধু নিয়ে সাজো মনের অলি,
তোমার পাখায় ভালোবাসায় মনের কথা বলি।

আঁধার কালোয় মৃদু আলোয় জোনাক আলো তুমি,
ধন্য হবো সুখে রবো তোমার ললাট চুমি।



অন্তিম চাওয়া
রুহুল আমিন রাকিব

ঝলসে যাওয়া মাংস বলে কথা;
আহ্লাদী মন নিয়ে তুমি চিবিয়ে খাও।
নাহ আমি বাঁধা দিব না, যতো খুশি
ইচ্ছে মতো হামলে পড়ো আমার ঝলসে যাওয়া দেহের উপর।
একটু একটু করে চুশে খাও আমার শরীরের সমস্ত রক্ত!
প্রয়োজন শেষে, দাফন করিও তোমার বুকের শহর জুড়ে
ভালোবাসার আগুনে ঝলসে যাওয়া দেহের এইতো অন্তিম চাওয়া।





এক পশলা বৃষ্টির জন্য
ফারুক মোহাম্মদ ওমর

সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে আছি
বাঁধভাঙ্গা ইতিহাসকে আলিঙ্গন করে,
নিদ্রাহীন এক পশলা বৃষ্টির জন্য

বজ্রসঙ্কেত সারা আকাশ জুড়ে
আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি তোমার আঙ্গিনায়।

সূর্য অনুরাগ

সূর্য অনুরাগ


সূর্য অনুরাগ
কৃপাণ মৈত্র

মা ঝাঁজালো স্বরে বললেন, কী দরকার ছিল এমন ঝুঁকি নিয়ে অন্যকে বাঁচাতে যাওয়ার । কেন ও কি তোর রক্তের সম্পর্ক? তাও যদি এক জাতের হত তো কথা ছিল।
    করিশ্মা কথা বলে না । বলে না এই কারণে যে সে তার মাকে বোঝাতে পারবে না মানুষের কোন জাত হয় না। কিছু স্বার্থপর মানুষ জাত নামক এক সংক্রামক রোগ তৈরি করেছে এবং মানুষের মধ্যে এমন ভাবে ইঞ্জেক্ট করে দিয়েছে যে তার প্রভাব চলছে যুগ যুগ ধরে।
ক্ষতস্থানে ডেটল দিতে দিতে মা বললেন , নাম কী?
 -জানিনা।
 -থাকে কোথায়?
 -বলতে পারব না।
 -কিছুই যদি না জানিস তো এত দরদ উথলে উঠল কেন!
করিশ্মার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে যন্ত্রণা সহ্য করছে । চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়েছে। মুখ যন্ত্রনার প্রকাশ স্পষ্ট।
এ দৃশ্য মায়ের চোখ এড়িয়ে যাবার নয়।
-কীরে হাড় ভাঙেনি তো।
তার মা ছুটে বেরিয়ে গেলেন। করিশ্মা ভাবে তার কী বা করার ছিল ।ও জায়গা না দিলে যে বাচ্চা মেয়েটা রাস্তার ধারে গড়িয়ে পড়তো। ভাঙ্গা রাস্তার সংকীর্ণ পথ যে দুজনের দখলদারিতে বিপদ ডেকে আনবে সে তো তখন কেউ বুঝতে পারেনি। সে মেয়েটিকে আগেও দেখেছে। সম্ভবত সবে সাইকেল চড়া শিখেছে। আরেকটু রপ্ত হয়ে বেরোনো উচিত ছিল। আজ না হয় সে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য কেউ যে রাস্তা ছেড়ে উদারতা দেখাবে তা তো নাও হতে পারে। ব্রাম্ভণ পাড়ার দিকে ওকে যেতে দেখেছে সে।  কিন্তু ওর সঙ্গে আলাপ হয়নি কখনো।
    রফিউল গ্রামের কোয়াক ডাক্তার। গরিব পাড়ার একমাত্র ডাক্তার। গরিবদের এফ আর সি এস। ওকে ওরা বিশ্বাস করে। ওষুধের থেকে মনের জোরে বেশি কাজ দেয়।
     ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন , সম্ভবত সামান্য একটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। একটা ছবি করাতে পারলে ভালো হতো।
     মায়ের মুখে বিরক্তি এবং উদ্বেগ। মনে হল একটা পাহাড় যেন ভেঙে পড়েছে তার মাথায় ।        
-কত খরচ হবে?
 -দুশটাকা তো বটেই । তার সঙ্গে ওষুধ ব্যান্ডেজ  আছে।
    করিশ্মা চুপ করে সব শুনছে। চুরির দায়ে তার বাবা জেল খাটছে। এই কদিন আগে ছোট ভাইটার কলেরা হয়েছিল। মায়ের শেষ সম্বল কাঁসার থালা চারটি বিক্রি করে ডাক্তার ওষুধ কেনা হয়েছিল। আর তো অবশিষ্ট কিছুই নেই । ভাতের চাল বাড়ন্ত। চাচার বাড়ি থেকে এক বাটি চাল ধার করতে গিয়েছিল করিশ্মা। চাচী অনেক কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল, তোর মা কোন খাস তালুকের বেগম রে । আমাদের সঙ্গে কয়লা কুড়াতে তোর মার  শরম হয়। তবু যদি তোর বাপ না চুরির দায়ে জেল খাটত।
তোর বাবার কোনো দোষ নেই। মালিকের অনেক নষ্ট কাজের সাক্ষী তোর বাবা। মোল্লা উপযাচক হয়ে তোর বাবাকে কিছু টালি দিয়েছিল। তাতেই সন্দেহ দানা বাঁধলো। ভয় হলো মোল্লাকে বুঝি তোর বাবা সব কথা বলে দিয়েছ ।তোর বাবার কারখানার  কাজ গেল ।তারপর একদিন পুলিশ কারখানায় রেড করল। মজিদের ধারণা হলো এসব তোর বাবার কান্ড। ভেতরে ভেতরে টাকা দিয়ে মজিদ সব মিটিয়ে ফেলল। চুরির দায়ে তোর বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। করিশ্মার মা হামিদা করিশ্মার চুলে চিরুনি দিতে দিতে করিশ্মার কাছে মনের ভার হালকা করেছিলেন। করিশ্মা উপলব্ধি করেছিল তার পিঠে তার মায়ের গরম শ্বাস ভেতরের পুড়ে খাক হওয়া অন্তরের ভাব আত্মজাকে তাপিত করেছিল। করিশ্মা ভাবে এই সংসারে  স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। অথচ ঈশ্বর তো মিলে মিশে থাকতে বলেছেন। সকলের মধ্যে তো সমান উপাদান দিয়ে তিনি মানুষ তৈরি করেছেন।
     ডাক্তার চলে গেলে হামিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী হবে বল দিকিনি। আমার কাছে যে ফুটো পয়সাও নেই।
-তুমি ভেবনা তো। ওসব কিছুই হয়নি। তুমি বরং একটু নুন তাবা দাও তো।
-তুই আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন। তুই কিছু হয়নি বললে আমি বিশ্বাস করবো। যখন মা হবি তখন বুঝতে পারবি।
হামিদা উঠে গেলেন।
করিশ্মাদের বাড়ি রাস্তা থেকে অন্দরমহল পর্যন্ত দেখা যায়। অভাবের সাক্ষী ঘরের ভাঙা কাঠামো। ভাঙা দেওয়াল। ভোটের পর ফেলে দেওয়া ফেস্টুন খাটিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সম্মিলিত অস্থায়ী পার্টি অফিস। একটা সংকীর্ণ পথ ধরে তাদের বাড়ি যেতে হয়। বর্ষায় দরিয়া হয়ে যায়।
কে যেন সাইকেল নিয়ে আসছে। পিছনের ক্যারিয়ারে সেই মেয়েটি।
করিশ্মাকে দেখে উল্লসিত হয়ে মেয়েটি বলল, বাবা ঐতো সেই দিদিটা।
বিস্কুট আর ফলের ব্যাগটা করিশ্মার পাশে রেখে রেখার বাবা বললেন, তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। রেখার ক্ষত তুমি যে চেয়ে তোমার শরীরে নিয়েছো।  ঈশ্বরের কত বড় দান হলে তবেই না এমনটা হয়।
হামিদা মাথায় একটা বড় ঘোমটা টেনে  পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।  বললেন,  গররিবের ঘরে উদারতা যে বড় দায়।
রেখার বাবা বললেন, কেন কেন  খুব ইনজিওরড হয়েছে বুঝি। ডাক্তার কি বললেন?
-ফ্র্যাকচার হয়েছে।  ছবি করা  ঔষধ কেনা  -সে অনেক টাকার ব্যাপার। আমরা গরিব। পাব কোথায় ?
সে তো নিশ্চয়। অনেক টাকা তো লাগবেই। 
রেখার বাবা পকট থেকেএকটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে বললেন, এতে হবে না ? আমি কালকে একবার আসবো।
      হামিদা কোন মতেই টাকা নিতে চান না। রেখার বাবা করিশ্মার হাতে জোর করে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বললেন, মিস্ত্রি বউ  টাকাটাই সব হল। তোমার মেয়ে যা করেছে ক’জনই বা পারে। আমরা ক’জনই বা  মানুষ নামের মর্যাদা রাখতে পারি । তাই বয়স হলে  বলিরেখা পড়ে। বলিরেখা তো কিছু না মনুষ্যত্ব অব্যবহারের শ্যাওলা। সেইজন্য মানুষ আয়নায়  নিজের মুখ দেখতে ভয় পায়। নিজের কাছে তো নিজের ফাঁকি চলে না।
-পেট চালানো ভাতের জন্য হলে কিছুতেই নিতাম না।  কিন্তু অর্থের আশায় বসে থাকলে যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। সেই ভয়ে ঋণ হিসেবে নিচ্ছি । মিস্ত্রি ফিরে এলে সব শোধ করে দেব।
রেখার বাবা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হামিদ ঠিক করেনি । ভালো ছেলেটাকে  ফাঁসিয়ে দিলে। মুশকিল কি জানো মিস্ত্রি বউ , ওদেরও এক ঈশ্বর আছেন।  আহুর মাজদা। এদের মধ্যে অবিরত লড়াই চলছে। আপাত অন্যায়ের জয় হয়। পরিণামে সত্যের জয় হয়। তাই যদি না হবে তোমার ঘরে এমন মনের  মেয়ে জন্ম নেয় কি করে !
হামিদার মুখ  লজ্জায় লাল হয়ে গেল । না জেনে  জাত তুলে তিনি কত  কথাই না বলেছেন। এখন তো আর মেয়ের জন্য রাগ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে  এই বিশ্ব সংসারে তাঁর থেকে ধনী কেউ নেই।
-বাবা  ঘরে ডাব আছে। খাবেন?
-না থাক।
 হামিদা চুপ করে গেলেন।
রেখার বাবা হামিদার  মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, না বলছিলাম,  তোমাদের অভাবের সংসারে...
-না না অনেকগুলো আছে। নতুন গাছের ডাব। বামুনের সেবায় লাগলে খুশি হব।
      করিশ্মা সব কথা শুনছিল । তার চোখে  বাঁধভাঙ্গা জল। রেখা জামার খুঁট দিয়ে করিশ্মার চোখের জল মুছিয়ে দিলো।
      পশ্চিমের  সূর্যের লাল অনুরাগের আলো তখন তাদের নিষ্পাপ মুখে পড়েছে। তারা সে অনুরাগ ভাগ করে নিল।


আবুল মনসুর আহমদ’র সাহিত্য কর্ম

আবুল মনসুর আহমদ’র সাহিত্য কর্ম


আবুল মনসুর আহমদ’র সাহিত্য কর্ম
হালিমা মুক্তা

“ব্যঙ্গ সৃষ্টিতে অসাধারন প্রতিভার প্রয়োজন এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা সুরও বেরু বে, তার ও ছিঁড়বে না”। হ্যাঁ এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম। কোন এক ব্যঙ্গ শিল্পিকে নিয়ে। এখন আমরা জানবো কাকে উদ্দেশ্য করে এ উক্তিটি করেছিলেন আমাদের প্রিয় কবি। হয়ত আমরা কিছুটা অনুধাবন করতে পারছি। সে আর কেউ নন আমাদের প্রিয় “ব্যঙ্গ” গল্পকার আবুল মনসুর আহমেদ। সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য  অসাধারন পন্ডিতের অধিকারী আবুল মনসুর।  তিনি লেখালিখির জগতে আবুল মনসুর নামেই খ্যাত। আবুল মনসুর আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যের অন্যান্য শেষ্ট ব্যঙ্গ গল্পকার শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যের ও একজন শেষ্ট ব্যঙ্গ গল্পকার। সাহিত্য শিল্পির যা প্রধান ঐশর্য ভাষা-সম্পদ, তা আবুল মনসুর আহমেদের ছিল। আবুল মনসুর আহমদ শিল্পের জন্য শিল্প নয়- জীবনের জন্য শিল্প নীতিতে বিশ্বাস ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি লেখালিখি করে আসছেন। মাসিক আল ইসলাম পত্রিকায় স্পেনের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তি ওপর একটি অনূদিত রচনা প্রকাশিত হয়। এটিই আবুল মনসুর আহমদের প্রথম প্রকাশিত রচনা।  আবুল কালাম শাসসুদ্দীন সম্পাদিত সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ-এ নিয়মিত লেখা শুরু করেন।
আবুল মনসুর হাইস্কুল থেকেই  তার লেখার হাতেখড়ি শুরু। তার সাহিত্য জীবন শুরু হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকেই সওগাত পত্রিকায় নিমক-হারাম নামে প্রথম তার গল্প প্রকাশ। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন ভাবে দ্বায়িত্ব পালন করেছেন। শেরেবাংলা ফজলুল হকের মালিকানাধীন দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় সম্পাদকের দ্বায়িত্ব গ্রহন। পেশাগত জটিলতার কারণে তিনি বেনামীতে এই দ্বায়িত্ব পালন করতেন। জানুয়ারিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় সম্পাদনায় দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন। একই বছর ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তিনি সাহসিও বটে। তার বিভিন্ন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, শিরোনাম পড়লে আমরা বুঝতে পারি। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় ‘গোলামী সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তিনি তারপর থেকেই সাপ্তাহিক মুসলিম জগৎ এ নিয়মিত লেখা শুরু করেন। ‘ছবি বড় তৈয়ুব নামা’ নামে পুঁথি-প্যারোড এবং সভ্য তার দ্বৈত্য শ্বাসন’ নামে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। আবুল মনসুর আহমদ প্রধানত গদ্য-লেখক আবুল মনসুরের দীর্ঘ একাশি বছরের জীবনের মধ্যে রচিত হয়েছে তার বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। সব ধরনের লেখা মিলিয়ে আবুল মনসুর আহমদের শুধু পুস্তক আকারে ছাপা বইয়ের পৃষ্টাই সাত হাজারের কাছাকাছি। তার বিখ্যাত ব্যাঙ্গ গল্প গন্থের সংখ্যা চার টি। (১) আয়না, (২) ফুড কনফারেন্স, (৩) আসমানী পর্দা, (৪) গালিভরের সফর নামা। মূলত এই চারটি ব্যাঙ্গ গল্প গ্রন্থের উপরেই কিছুটা আলোক পাত করবো। আয়না সম্পর্কে অন্নদাশংকর রায় বলেন “আয়না” লিখা আবুল মনসুর আহমেদ প্রাপ্তঃস্বরনীয় হইয়াছিলেন। ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন। গল্প গুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যাঙ্গবিদ্রুপ ও পরিহাস প্রিয়তা। তবে নিছক পরিহাসই লেখকের উদ্দেশ্য নয় পক্ষান্তরে আবুল মনসুর আহমদের গল্পের পেছনে তীক্ষè সমাজ ও সমাজ কল্যান উদ্দেশ্য কাজ করেছে। তার দুঃখকে তিনি পরিহাস দিয়ে ব্যক্ত করেছেন। সমাজের অসংগতি লেখকে পিড়া দিত। তাই তার প্রত্যেকটি কর্মে তার পরিস্কার ছাপ পরস্ফুটিত হয়। লেখক সম্পর্কে সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক আবু জাফর শামশুদ্দিন বলেন “তার জীবন বৈচিত্রময়, আমি তাকে ক্ষুরধার প্রতিভাশালী লেখকরুপে আজীবন শুদ্ধ করে এসেছি। “আয়না” তার অবিস্বরনীয় কীর্তি”।
ফুজ কনফারেন্স গল্পে লেখক ব্যঙ্গ  করে বলেছে এইসব রাস্তায় আগে গাউন শাড়ি পরা পরীর ভিড় হতো আর আজি কিনা সেখানে অসুন্দর, অসভ্য, কুৎসিত, অর্ধোলঙ্গ স্ত্রী লোকেরা ভিড় করছে। কি অন্যায়!
“কোথাও মোটর বা ট্রেন থামলে চারদিকে হতভাগা ও হতভাগীনিরা যেভাবে গার উপর পড়ে ভিক্ষে দাও বলে জ্বালাতন করে তাতে একেবারে ঘেন্না ধরে যায়। কি উৎপাত” আমরা দেখি লেখক এ গল্পে ব্যঙ্গ করে  সমাজের বড় শ্রেনীর পুজিবাদি মন কিভাবে শোষন করবে নিজেদের হাতে ক্ষমতা রাখবে কিভাবে নিজের
ভাল থাকবে এর চিত্র তুলে ধরেছেন। নিচু শ্রেনীর লোকেরা না থাকলেই যেন উচ্চ শ্রেনীর লোকেরা বেঁচে যায়। এখানে নি¤œ শ্রেনী ও উচ্চ শ্রেনীর বৈষম্যের দিক গুলো লেখক সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে ধরেছেন। লেখক গল্পের ভাবধারা ব্যঙ্গ উপমার মধ্য দিয়ে শেষ করিয়াছেন। যেমন ছাগলে- বাঙলাটা দাড়ি নেড়ে বললেন! তা হল বটে কিন্তু শেরে বাঙলা হাতীয়ে বাঙলা প্রভৃতি শুধু জানোয়ারে বাঙলাতেই আমরা বেঁেচে রইলাম । মানুষে বাঙলারা যে, সবাই মরে গেল। সকলে জয়ধ্বনি করলেন জানোয়ার-বাঙলা জিন্দাবাদ। মানুষে-বাঙলা মুর্দাবাদ।। তেমনি ভাবে আমরা দেখতে পাই গালিভরের সফর নামা গল্পটিতে লেখেক ব্যঙ্গ করে সুন্দর ভাবে বুদ্ধিমান ও নিরবুদ্ধিতার উত্তাপন করে গেছেন। লেখক গালিভরের সফর নামাই বিরাট সত্য উদঘাটন করেছেন। সাহসের সাথে তিসি লেখার মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে তিনি আমাদের সমাজের অসংগতি দেখিয়ে গেছেন। লেখক যদি আর কোন সাহিত্য কর্ম সৃর্ষ্টি নাও করতেন তবুও তিনি এই চারটি ব্যঙ্গ গল্প গন্থের জন্য বাংলা সাহিত্য অমর হয়ে থাকতেন। গ্রন্থ গুলোতে ভাব ছাড়াও অন্যান্য রস-রচনাও রয়েছে। “ফুড কনফারেন্স মোট নয়টি ব্যঙ্গ গল্পের সমাহার ঘটেছে। গালিভরের সফর নামাই নাট্য চিত্র দুটো, ব্যাঙ্গ গল্প সাতটি। আসমানী পর্দা’র মোট দশটি রস-রচনার মধ্য তিনটি প্যারোডি-কবিতা, দুটো নাট্য চিত্র এবং পাঁচটি ব্যঙ্গ গল্প রয়েছে।  আয়নার সাতটিই ব্যঙ্গ-গল্প”।
১.    আবুল মনসুর আহমেদের ব্যাঙ্গ গল্পের পটভূমি মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়। (১) ধর্মীয়, (২) রাজনৈতিক, (৩) আর্থ-সামাজিক।
(১)    ধর্মীয়ঃ তিনি এই ধরনের গল্প গুলোতে ধর্মান্ধত, ধর্মীয়  কুসংস্কার, ধর্মের নামে ভন্ডামি এবং ধর্ম-ব্যবসায়ের মুখোস উম্মোচন করেছেন। 
(২)    দ্বিতীয় ভাগের গল্প গুলোতে তিনি সমকালীন রাজনীতি ও রাজনীতিক নেতাদের অন্ধাকার দিক ব্যাঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যেমন গালিভরের সফর নামা।
(৩)    আর্থ-সামাজিকঃ পর্যায়ের ব্যঙ্গ গুলোতে তিনি প্রধানত বাঙালি সমাজও বাঙালি চরিত্রের অসংগতি বা দোষত্রুটি সমূহ বার বার প্রয়াস করেছেন। আবুল মনসুর আহমেদ কে আমরা একজন প্রখর দৃষ্টি সম্পন্ন শক্তিমান ব্যঙ্গকার হিসাবে দেখতে পাই। আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ গল্পে দুটো মুখ্য বিষয়। (ক) রস-রচনা হিসাবে এর সার্থকতা বা রস বিচার এবং (খ) এই ব্যঙ্গের পিছনে লেখকের সমাজ-দৃষ্টি। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভাবে লিখেছেন। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের আঘাতে সমাজ ও দেশের চৈতন্য জাগরোন তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। হাসতে হাসতে কাঁদতে যাওয়ার মতো ব্যাপার ও তার রস-রচনার ক্ষেত্রে পরিদৃষ্ট হয়। ‘তার আদু ভাই একটি জমৎকার হিইমার চরিত্র।
২.     তার উপন্যাস জীবন ক্ষুধা, আবে হায়াত প্রকাশ হয়।  ১৯৭৫ : আল কোরআনের নসিহৎ নামে কোরআন শরিফের বিষয়ভিত্তিক সংকলন প্রকাশ। ১৯৭৮ : আত্মকথা প্রকাশিত হয়। (১) ১৯৩৫ : গল্প গ্রন্থ আয়না প্রকাশ।  ২। ১৯৪৪ : গল্প গ্রন্থ ফুড কনফারেন্স প্রকাশ। ৩। ১৯৫৭ : গল্প গ্রন্থ আসমানী পর্দা প্রকাশ। ৪। ১৯৫৯ : গল্প গ্রন্থ গালি ভরের সফর নামা প্রকাশ।  আবুল মনসুর সাহিত্যর মাধ্যমে সমাজ সংস্কার করতে চেয়েছেন। অকুতভয় এক যোদ্ধার নাম ছিলো আবুল মনসুর আহমদ। ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময়ে তার সাহসী উচ্চারনে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। নন্দিত  এই ব্যাক্তি আয়নার মতো গল্প গ্রন্থ লিখে যে, সৎ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যি বিস্ময় কর ব্যাপার। হুজুর কেবলা নায়েবে নবী বা মুজাহেদীনের মতো গল্প লিখতে  এবং তা প্রকাশ করতে কতটা সৎ সাহসের প্রয়োজন আজকের দিনে তা কল্পনা করা অসম্ভব।  এমনি গুনি মানুষের লেখা ও জীবন চিন্তা আধুনিক সমাজে আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাকে নিয়ে ব্যাপক গবেষনার প্রয়োজন বোধ করি। তিনি ছোট গল্পের জন্য বাংলা একাডেমীতে পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর সমকালীন সমাজের অন্ধকার দিকের উন্মোচনে লেখকের বড় সাফল্য। ছাত্র বয়সেই তিনি কবিতা ও প্রবন্ধের জন্য পুরস্কৃত হন।