পদাবলি

পদাবলি


সব মনে মন থাকে না
সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

এই যে পানি আমার চোখে খেলতে পারিস,
আমার বুকে লক্ষ ঢেউয়ে মেলতে পারিস
তার কী আসে যায়?
তাকেও বলিস ভিজবে না সে তোরই বরষায়?

এই যে আকাশ গোমড়ামুখে থাকতে পারিস,
বর্ষা মেঘের চাদরে মুখ ঢাকতে পারিস
তার কী আসে যায়?
তাকে বলিস মুখ যেন সে নেয় ঢেকে লজ্জায়!

শুনবি কারণ? তারও নাকি আকাশ সমান মন
আমাকে সে মনটা দিয়ে- ফেরৎ নিলো শোন!
তার যে এখন ভয়,
তাকে ভালোবেসে আমার সব হয়েছে ক্ষয়।

আলপিন
সারাজাত সৌম

একবার, তোমাকে দেখে—
আমার ভাই মনে হয়েছিলো
একবার, সেকি আমার বোন
কেন মনে হয়েছিলো—

তুমি কিন্তু তা না!

বারবার দেখার পর মনে হলো—
আমিই ছিলাম বারবার
এই ঋতুর—ঋতুহীন বনে
আমরা তো কেউ নই আর

শুধু এই ছোট্ট জামা!

তবে, কে ছিলো এমন—
কালো পাথরের ভেতর উজ্জ্বল
যেন কথা বলেই পালালো
হাওয়ায় বসে থাকা ত্রি-তল

দীর্ঘ হতে আর চায় না—

সে না আমার—না তোমার
মধ্যদিনের সুরে থাকে বিঁধে
একা একা তারার আলপিন
কখন যে মাথায় ছুটে আসে

মূলত মানুষ এমনই এক ধারণা!

গ্রীষ্ম
হাফিজ রহমান

কিছুটা বৃষ্টিঘ্রাণ শুঁকে নিয়ে এঁটেলের গায়,
কি করে গ্রীষ্ম নামে চেখে নেই কৃষকের নাকে।
প্রমত্ত গ্রীষ্ম শরীরে তার তীব্র দাহন,
ভেঙে নেয় গাছের শরীর!
মাছেদের নীড় গড়ে, ভাঙে পাখির।

তবুও প্রমত্ত হে, এতটাই প্রিয় তুমি,
তোমার কাছেই শিখি বাঁচার প্রেরণা!
শিখি, কিভাবে গাছেরা বুক পেতে তোমাকে করে প্রতিহত।
শিখি, জীবন আমাকে করবে আঘাত কত,
আমি প্রতিরোধ করব তত।

আমি বারবার ভেঙ্গে পড়ি, আর তোমার কাছে দীক্ষা নিয়ে
প্রতিবার ঘুরে দাঁড়াই। জীবনগুরু তুমি,
তাই  জীবনের শেষে এসে জীবন রাঙাই,
যেমন আঘাত শেষে তুমিও সাজাও
ডালে ডালে সুমষ্ট জীবন!


ঘরের মাঝে পরের মানুষ: বিবিধ বিম্বের সম্মিলন

ঘরের মাঝে পরের মানুষ: বিবিধ বিম্বের সম্মিলন



ঘরের মাঝে পরের মানুষ: বিবিধ বিম্বের সম্মিলন
ইলিয়াস বাবর

ঘরের মাঝে পরের মানুষ পড়তে পড়তে আমাদের মনে হওয়া স্বাভাবিক, সাম্প্রতিকতম বিষয়াশয়ও সাহিত্যে সংযুক্ত হয়। কবিতায় তার প্রকাশ বিণীত ও আবরণে; কথাসাহিত্যে বিস্তৃত ও বহুরৈখিক। সময়ের সাথে, প্রাযুক্তিক সংশ্লেষ বাড়ে আমাদের, সুযোগ হয় নিজেকে প্রকাশ ও প্রচারের। সেইহেতু মোল্লারা প-িত সাজে, প-িতকে পড়তে হয় তৈলমর্দনে ব্যস্ত বেপথুদের খপ্পরে। কিন্তু কথাসাহিত্যিক আরমানউজ্জামান এবারকার বইমেলায় প্রকাশিত তার উপন্যাসে নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাহাকার ও রোদনমুখরতা, যাপন ও উৎসবের বর্ণাঢ্য, জীবন ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব তুলে আনবার চেষ্টা চালান। এক্ষণে, এ সত্যও গিলতে হয়, আরমানউজ্জামান এর কথাসাহিত্যিক চারিত্র একটা সমান্তরালে হাঁটে, যা তারই নিজস্ব ভূগোলের বিজ্ঞাপন দেখায়, ভাষাশৈলীর পরিচিত বয়ানে পাঠককে এগিয়ে নেয়। আবুল হোসেনÑ তিন্নী ও মিহিরের জনক; অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবির জীবন নিয়ে তার ভাবনার যত বিস্তার। ছেলে মিহিরের সেদিকে খেয়াল নেই, স্ত্রীর কাছে পাত্তা পাওয়া যায় না তেমন, গালগল্প কি চা বানানোটা তিন্নির সাথেই হয়। কাজ না থাকলে যা হয়Ñ দুর্ভাবনা ভর করে আবুল হোসেনের মনে এবং এ ভাবনা-সংক্রান্ত বিস্তারে ক্রমান্বয়ে হাজিরা দেয় হুজুর, বিদায় স্টোরের মালিক মতিন মিয়াও। চলতে থাকে সাংসারিক ব্যস্ততা, ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার, প্রযুক্তি-আসক্তি ও স্ত্রীর প্যানপ্যানানির ভেতরেই তিনি হাঁটেন, হাঁটতে তাকে বাধ্য করে নি¤œমধ্যবিত্তের মানস ও প্রেস্টিজ।

যার যা পেশাÑ মতিন মিয়ার মানুষ মরলেই লাভÑ ব্যবসা ভালো হয়, পেট চলে। ওদিকে মোবাইল অপারেটর কোম্পানীগুলোর নানাবিধ চটকদার অফারে রাতজেগে ফেসবুকিং, চ্যাটিং আছেই; তিন্নি হাজার কথা বলে এসবের ধারাবাহিকতায়, তার প্রেমিক ওরফে বর রাশেদের সাথে। ঘটনা পরম্পরায় আরমানউজ্জামান যে গতি চালু রাখে তা কিন্তু ভাষার গতরে পূর্ণতা দিতে পারেনি বলেই সচেতন পাঠকের মনে হয়। যেখানে সৃষ্টির সেরা মানুষকে শরীরের আকার ঠিক রাখতে জিমে ঘাম ঝরাতে দেখা যায়, একজন কথাসাহিত্যিক কেন তার ভাষাকে মেদবহুল রাখবেন তবে? কিংবা যে মিহিরকে উপন্যাসের নায়ক হিসেবেই লেখক উপাস্থাপন করেন, সে কেন পীরের দরবারে ছুটতে যাবে? হোক না পারিবারিক প্রচেষ্টাÑ যেহেতু মিহির আউটসোর্সিং-এ ভালো রকমের ইনকাম করে বলে আমরা জানতে পারি। তার আয়েই প্রায় বেউপায় আবুল হোসেন পথ দেখেন মাঝদরিয়ায়। মেয়েকে বিয়ে দেয় আধুুনিক ও কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার অবস্থান থেকে। সে-ই কি তবে পরের মানুষ? পর-মানুষ হলেই বুঝি আরো স্বস্তি লাগতো! এ সীমাবদ্ধতার  ভেতরে, উপন্যাসে চাষ দিলে, সীমাহীন সম্ভাবনা আপ্লুত করে আমাদের। একজন কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার হাহাকার, সংসারে বাতিল হয়ে যাওয়া ছেলেটির সগৌরবে ফিরে আসা, রাশেদ ওরফে তিন্নির বরের বিয়ে সংক্রান্ত বাজেটে ব্যাংকের লোন নেয়া ইত্যাদিকে আরমানউজ্জামান দৃশ্যমান করেন সফলভাবেই। এমনকি ঔপন্যাসিকের নজর থেকে বাদ যায় না শরবত বিক্রেতার কা-, পুলিশবন্ধুর সন্দেহ, মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলার দিকটাও বাদ যায় না দেখার প্রয়াস থেকে। এখানে বলে রাখা ভালো, আলোচ্য কথাকার পেশায় একজন ব্যাংকার। ফলে, ব্যাংকিং জগতের ব্যবহারিক জ্ঞান ঘরের মাঝে পরের মানুষ’কে সমৃদ্ধ করেছে। উপরন্তু আরমানউজ্জামান এর কথাসাহিত্য বিশেষ উপভোগের দিক তার কথোপকথন দক্ষতা। রাশেদকে ভদ্রোচিতও হয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা যেভাবে আলাপের ছলে সতকর্তা দেয় তা প্রাগুক্ত উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়।

হতে পারে মানসিক রোগ, দুঃচিন্তা ও অবসাদÑ আবুল হোসেন প্রায় রাতেই অন্যরকম স্বপ্ন দেখেন, তিন্নি বাপেরবাড়ি আসায়, মেয়েকে পেয়ে বাপ খানিক স্বস্তি পান বটে তবুও স্বপ্নের ঘোরে তিনি থাকেন আক্রান্ত এবং একটা তাবিরে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে পিতাকে। মিহির ও তিন্নির দুই রকম ব্যাখ্যা, মতিন মিয়াকে খোঁজ করা; রমিজ পাগলার কাছে গিয়ে পরামর্শ নেয়া সবটাই যেন বাস্তবতার নিরিখে করতে চান আলোচ্য কথাকার। কাহিনির বিন্যাসে তা খুব যুৎসই-ই হয়। আরো মজার বিষয় এই, অস্থির ও ভুল বোঝাবুঝির এই দুঃসময়ে স্বামী-স্ত্রীতে অমিল হতে পারে, বিশেষত অর্থনৈতিক টানাপড়েনে। মিহিরের কথামালা আমাদের সহজ করে দেয় মিলমিশ থাকতে। একরোখা সিদ্ধান্তকে বেশ বদলে দিতে পারে মিহির। এক্ষেত্রে মিহিরের ভূমিকা আমাদের সমাজে খুব প্রয়োজন। সাহিত্য সমাজ বদলায় এমন কথা জোর দিয়ে না বললেও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানের আর্শীবাদকে সীমাহীন পৃথিবীর মানবিক কল্যাণে পরিপূর্ণভাবে লাগাতে পারলে মন্দ হয় না। একজন সচেতন কথাসাহিত্যিক, যেকোন শিল্পীই তার সমাজকে নিরীক্ষণ করে এগিয়ে যেতে চায়, তাকেও রাখতে হয় দৃষ্টির প্রখরতা। আমি বিজ্ঞানের দান নেব হাত পেতে আবার মাজারেও যেতে চাইবো, তা কেমনে হয়! প্রত্যেক ঘটনার নিশ্চয়ই দুদিকের ব্যাখ্যা থাকতে পারে তবুও এদেশ কিংবা উপমহাদেশের ধর্মীয় সাধক-পির-আউলিয়াদের অবদানে বিস্মৃত নই আমরা। লোকাচারের বিশ্বাসে শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই, চিন্তাকে একমুখি রাখতে হয়, অগ্রগামী চিন্তার সাথে কখনোই পশ্চাদপদতা যায় না; লেখার জগতে তো নয়ই।

আমাদের আবেগ সর্বস্ব ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন আরমানউজ্জামান। চলতি-পার্থিবতাকেও ছাড় দেন না বিনা বাক্যব্যয়ে। আমরা মনে করি, একজন কথাকারের ভূমিকা নিশ্চয়ই অনুসন্ধিস্যু হওয়া উচিত। তার মানে এই নয়, রমিজ পাগলার কিশোরীর সাথে মিহিরের ভালো লাগিয়ে দিতে হবে! নাটুকেপনা সিনেমার সাথে যায় ভালো, বাস্তবতার সাথে স্ক্রিপটের জীবন প্রায় সময়ই যায় না। জীবন তো আসলে সিনেমার সমান্তরালে চলে না, চলে না কথাকারের জীবন না-বোঝা কথার সংলাপে। তাছাড়া পড়ার শুরুতেই এবং প্রায়ই যদি বানান বিভ্রাট নজরে আসে পাঠকের বিরক্তি আসারই কথা।  র ও ড় এর ব্যবহার ঘরের মাঝে পরের মানুষ-এ একটা বিশ্রি কান্ড ঘটিয়ে দেয় কিন্তু। যৌথশব্দ ব্যবহারেও গ্রন্থকারকে আরো সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। কখনোসখনো যুক্তির প্রেক্ষিতে প্রতিযুক্তি চমকিত করে পাঠকদের। জীবনবাদী কথাসাহিত্যে আমাদের অভাব, তরুণেরাই পূরণ করবে; এ পথে আরমানউজ্জামান ভরসার এক নাম হবে বলেই বিশ্বাস রাখতে চাই।

ঘরের মাঝে পরের মানুষ
আরমানউজ্জামান
গ্রন্থকুটির প্রকাশনী
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১৫০
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০১৮




গল্প : একজন শ্রমিকের গল্প

গল্প : একজন শ্রমিকের গল্প



একজন শ্রমিকের গল্প
কবির কাঞ্চন

পিনাকী দু'হাতে অনবরত মেশিন ঘুরাচ্ছে। গা থেকে অবিরম ঘাম ঝরছে। তবু গায়ের কষ্ট একদম মুখে বোঝা যাচ্ছে না। ওর মুখে জুড়ে সারাক্ষণ হাসি থাকে। সিনিয়রদের আদেশ যথাযথভাবে পালন করে। আবার বয়স ও উচ্চতায় সবার চেয়ে ছোট হওয়ায় ফ্যাক্টরীর সবাই ওকে খুব আদর করে।
ও যেদিন প্রথম এই ফ্যাক্টরীতে চাকরি নিতে আসে, সেদিন থেকে ওর প্রতি ম্যানেজমেন্টের লোকজনের স্নেহের দৃষ্টি আছে।
ওকে যেখানে শিশু বলে চাকরিতে নিচ্ছিলেন না, সেখানে এখন সবাই ওর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে।
ওর মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করে। ওর পড়াশুনা চালিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা জোগায়।

এক সময় পিনাকীর জীবনকাল বেশ ভালোই কাটছিল। তখন ওর বাবা, অপু চৌধুরী একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি করতো। বেসরকারি স্কুলে মাসে যে সামান্য বেতন পেতেন তা দিয়ে নিয়মের মধ্যে থেকে ভালোই এগুচ্ছিলেন। পিনাকীর মা ছিলেন পুরোপুরি ঘরমুখো মহিলা। কোনদিন ঘরের বাইরে তার পদচিহ্ন পড়েছে বলে মনে হয় না।
পিনাকীর বাবা ছেলেকে নিয়ে উচ্চস্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ছেলেকে দুরন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তৈরি করতে চাইলেন তিনি। পিনাকীও সেপথে এগুচ্ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ সহ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করে সে।
এরপর বুকভরা আশা নিয়ে তাকে নিজের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করালেন। ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ও প্রথম স্থান লাভ করে। স্কুলের সব শিক্ষক পিনাকীর প্রশংসা করেন। বাবা হিসেবে পিনাকীকে নিয়ে ওর অপু চৌধুরীরও গর্ব হয়।
সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে নিয়মিত ক্লাস করতে থাকে সে।
কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষার ঠিক দুইদিন আগে অপু চৌধুরী
বাসায় এসে ভাত খেয়ে শুতে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর " বুক ব্যথা! বুক ব্যথা! " বলে তিনি চিৎকার করতে লাগলেন। পিনাকী ও ওর মা দৌড়ে তার কাছে ছুটে আসে।
অপু চৌধুরী তখনও অনবরত ঘামছেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
- বাবা, পিনাকী আমার আরো কাছে এসো।
এরপর পিনাকীকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
- আমার হাতে মনে হয় আর বেশি সময় নেই। বাবা, বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে। সব সময় সৎপথে চলবে। আর একটা কথা, কখনও কারো সম্পদের দিকে লোভ করো না। নিজের যেটুকু রবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকো।
এবার অপু চৌধুরী স্ত্রীর দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মনিকা। আমি তোমাদের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। তোমরা আমায় ক্ষমা করো।
এরপর পিনাকীর হাতটা আলতো করে ওর মায়ের হাতে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন অপু চৌধুরী।
হঠাৎ তার চোখ দু'টো বন্ধ হয়ে গেল। নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। হাতদু'টো জড়বস্তুর ন্যায় পড়ে রইলো। কোন নড়াচড়া নেই। বাবাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে পিনাকী বাবার হাতদু'টো ধরে টানতে টানতে বলল,
- বাবা, এখন ঘুমিয়ে গেলে কেন? উঠো, আমাদের সাথে কথা বলো।
পিনাকীর মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা আর্তনাদ শুরু করেন।
মাকে কাঁদতে দেখে পিনাকীও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।

পিনাকীর বাবার সৎকার করার সাথে সাথে যেন ওদের সব সুখেরও সৎকার হয়ে যায়। স্বামীর জন্য চিন্তা করতে করতে দিনেদিনে অসুস্থ হয়ে পড়েন পিনাকীর মা।

পিনাকীর বাবা মারা যাবার পর প্রথম প্রথম অনেকেই এগিয়ে এসেছিল। সবাই সমবেদনা জানিয়েছে।
কেউ কেউ সাহায্যের হাতও বাড়িয়েছিল। কিন্তু সময় যতোই গড়াচ্ছিল ততোই কেটে পড়ছিল সবাই।

দিনেদিনে পিনাকীর বয়সও বাড়ছে। অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষার পর ফল বের হলো। পিনাকী এবারও জিপিএ-৫ পেয়েছে।
পিনাকীর মা স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পিনাকীর পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য সম্পদের ওপর ভর করে এতোদিন চলেছেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে বিছানার সঙ্গী হওয়ায় এখন আর সংসার খরচও চলে না।
তার ওপর নিজের জন্য ঔষধ কেনার টাকাও নেই। ইত্যাদি ভেবে ভেবে তিনি খুব দিশেহারা হয়ে পড়েন। একসময় পিনাকীদের জীবনে নেমে আসে চরম দারিদ্র। সব আশা নিরাশায় পরিণত হলে পিনাকী চাকরির জন্য এই ফ্যাক্টরীতে ছুটে আসে।

একদিন পিনাকীদের ফ্যাক্টরীর মালিক, রাতুল চৌধুরী কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে ফ্যাক্টরীর প্রোডাকশন সেকশনে চলে আসেন। তিনি ধীরপদে ঘুরে ঘুরে সবার কাজ দেখছেন। যারা মালিককে আগে থেকে চিনতো তারা বসা থেকে উঠে নিচুগলায় সালাম দিলে তিনি সবাইকে শব্দ না করে কাজ করার ইঙ্গিত করেন।

পিনাকী তখনও গভীর মনযোগ দিয়ে মেশিনে কাজ করছে। রাতুল চৌধুরী ওর সামনে এসে বেশ কিছু সময় ধরে নির্বাক  দাঁড়িয়ে থাকেন। হঠাৎ আগন্তুক ব্যক্তিকে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে মেশিনে হাত চালাতে চালাতে বলল,
- আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
- তোমার নাম কি?
- ‎পিনাকী।
- ‎কত বছর ধরে এখানে কাজ করছো?
- ‎এই দুই বছর হবে।
- ‎এত অল্প বয়সে চাকরি করছো কেন?
- ‎সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য।
- ‎ঠিক বুঝলাম না। খুলে বলবে?
পিনাকী কাজ বন্ধ করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- আমার দরকার ছিল বলে চাকরি নিয়েছি। আর আপনি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না, পি¬জ। আমার হাতে এখন অনেক কাজ।
- ‎তুমি চাইলে তো কাজে ফাঁকি দিতে পারো।
মুখে বিরক্তির ছাপ এনে পিনাকী বলল,
- আপনি কে? আমি তা জানি না। তবে একটা কথা জেনে রাখবেন, মাস শেষে আমার মালিক আমাকে আমার ন্যায্য বেতনভাতা দেন। আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে আমার মালিকের লাভ হবে না। আর মালিকের লাভ না হলে এক সময় ফ্যাক্টরী বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তখন আমরা চাকরি করবো কোথায়?
- ‎তবুও----।
এই কথা শোনে পিনাকী লোকটার ওপর রেগে গিয়ে বলল,
- আপনি এখন যান তো। আমার কাজের ডিস্টার্ব হচ্ছে।
পিনাকীর লাইনের সুপারভাইজার এগিয়ে এসে কিছু বলতে চাইলে মালিক তাকে চোখের ইশারায় নিষেধ করেন।
এরপর পিনাকীর মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বাইরে চলে যান।
লাইন সুপারভাইজার পিনাকীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- এই পিনাকী, তুমি উনাকে চিনতে না!
- ‎না, কে উনি? অনেকক্ষণ ধরে আমার কাজের ডিস্টার্ব করছিলেন।
- ‎তুমি উনার সাথে যেভাবে কথা বলেছো তা একদম ঠিক হয়নি। আগে তোমার বোঝা উচিত ছিল, মন চাইলেই বাইরের যে কেউ এখানে আসতে পারেন না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই আসতে হয়। তাছাড়া যারা আসেন তারা সবাই কর্তৃপক্ষেরই লোক।
আমার মনে হয় আজই তুমি চাকরিটা হারাবে।
- ‎কেন? উনি কে ছিলেন?
- ‎উনিই আমাদের ফ্যাক্টরীর মালিক। রাতুল চৌধুরী। খুব ভালো মানুষ। শ্রমিকদের মনে কোনরূপ অসন্তুষ্টি আছে কিনা তা জানতে স্যার প্রায়ই এভাবে স্বশরীরে ফ্যাক্টরী ভিজিটে আসেন।

পিনাকী চিন্তিত হয়ে ভাবতে লাগলো- আমি তো স্যারের সাথে অন্যায়মূলক কোনকিছু বলিনি। স্যার রাগ করে আমায় চাকরি থেকে বাদ দিবেন কেন? আল¬াহ কপালে যা রেখেছেন তা-ই হবে।
লাইন সুপারভাইজার বললেন,
- আবার কী ভাবছো?
- ‎না, কিছু না।
পিনাকী আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। আরও দুই ঘন্টা পর মধ্যাহ্নভোজের বিরতি হলো। পিনাকী  সবার সাথে একসাথে লাঞ্চ করছে।
এই ফাঁকে পিনাকীর লাইন সুপারভাইজারের কাছে অফিস থেকে একটা চিরকুট এলো।
দুপুর ২:০০ ঘটিকায় পিনাকীকে ফ্যাক্টরীর মালিকের কক্ষে ডাকা হয়েছে।
লাইন সুপারভাইজার সেই প্রথম থেকেই ওর কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন। পিনাকীর বয়স কম হলেও তার লাইনের সবচেয়ে একটিভ ছেলে পিনাকীই। যদি ওর চাকরি চলে যায়, তবে আমিই মালিকের হাতে-পায়ে ধরে হলেও ওকে আবার কাজে নিয়ে নেবো।

এরিমধ্যে আবার সবাই যার যার আসনে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
লাইন সুপারভাইজার পিনাকীর কাছে এসে বললেন,
- পিনাকী, তোমাকে মালিকের কক্ষে ডাকা হয়েছে। কোন চিন্তা করো না। মালিক যা বলবেন, বুঝে শুনে সুন্দরভাবে জবাব দিও।
- ‎জ্বি, তাহলে আমি আসছি।
এই কথা বলে পিনাকী মালিকের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।
ফ্যাক্টরীর ম্যানেজমেন্টের সাথে মিটিং-এ  বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নেন রাতুল সাহেব। এক পর্যায়ে
তিনি ম্যানেজারের ওপর রেগে গিয়ে বললেন,
- আমার ফ্যাক্টরীতে শিশুশ্রমিক কেন? আপনাদের কতো করে বলেছি, ফ্যাক্টরীতে কোন শিশুকে যেন চাকরি দেয়া না হয়। সরকার ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা শিশুশ্রম বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখছে।
পিনাকীর মতো আর কতজন আছে?
- ‎না, স্যার, পিনাকী ছাড়া আর কোন শিশুশ্রমিক নেই। ওকে চাকরিটা মানবিক দিক বিবেচনা করে দেয়া হয়েছে।
- ‎মানবিক বিবেচনায় মানে!
- ‎ছেলেটার বাবা মারা গিয়েছে। তার ওপর মাও অসুস্থ, মৃত্যু পথযাত্রী। ও খুব মেধাবী। পিএসসি ও জেএসসিতে এ+ পেয়েছে। শুধু অর্থের অভাবে মায়ের চিকিৎসা ও নিজের পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারছিল না। মূলতঃ এইসব বিবেচনা করেই ওকে চাকরিতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া ওর কাজের রিপোটেশনও ভাল।
- ‎ও কি এখন পড়াশুনা কন্টিনিউ করছে?
- ‎জ্বি স্যার, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ফ্যাক্টরী থেকে ফিরে গিয়ে বাকী সময়টা ও পড়াশুনাতেই কাটায়। আবার পরীক্ষার সময় এলে ছুটি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে।

দুপুর ২:০০ টা। পিনাকী সালাম দিয়ে অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। রাতুল চৌধুরী পিনাকীর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন,
- তুমি আমাকে আগে কখনও দেখোনি?
পিনাকী নম্রগলায় বলল,
- না, স্যার, আমি এর আগে আপনাকে কখনও দেখিনি। তাই চিনতে পারিনি। কাজের ব্যস্ততায় আমি আপনার সাথে সুন্দর করে কথা বলিনি। আপনার মনে কষ্ট দিয়েছি। আমায় ক্ষমা করুন, স্যার। দয়া করে আমাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করবেন না। এ চাকরিটা আছে বলে, মায়ের চিকিৎসা করাতে পারছি। আমার পড়াশুনাও চালিয়ে যেতে পারছি। চাকরি না থাকলে তো আমার সব শেষ হয়ে যাবে।
- ‎আজ থেকে এই ফ্যাক্টরীতে তোমাকে  চাকরি করতে হবে না।
পিনাকী কেঁদে কেঁদে বলল,
- দয়া করে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দিবেন না, স্যার।
পিনাকী উপস্থিত সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
রাতুল চৌধুরী আবার বললেন,
- তুমি মাস শেষে কত টাকা বেতন পাও?
- ‎স্যার, ৯৫০০টাকা।
- ‎তাতে কি হয়?
- ‎জ্বি, কোনমতে হয়।
- ‎চাকরি চলে গেছে বলে খুব ভয় পেয়ে গেলে?
- ‎স্যার, পি¬জ আমাকে মাফ করবেন।
এই কথা বলে ফ্যালফ্যাল করে কাঁদতে থাকে পিনাকী। ততক্ষণে রাতুল চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠে এসে পিনাকীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
- আমি তোমার আচরণে খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। সবাই তোমার মতো কাজ করলে আমাদের ফ্যাক্টরীর সমৃদ্ধি হতে বেশি সময় লাগবে না। আগামীকাল থেকে তুমি নিয়মিতভাবে স্কুলে যাবে। ফ্যাক্টরীতে আসবে প্রতি মাসের এক তারিখে। শুধু বেতন নেয়ার জন্য। আর হ্যাঁ, তোমার মায়ের চিকিৎসার খরচও আমি দেবো। কী,এখন খুশি তো?
পিনাকী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মালিকের মুখের দিকে পরম কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে রইলো।


বিশ্বকবি ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর : এক বিস্ময়ের নাম

বিশ্বকবি ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর : এক বিস্ময়ের নাম


বিশ্বকবি ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর : এক বিস্ময়ের নাম
    শরীফ সাথী

              বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর সুবিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও মাতা সারদা সুন্দরী দেবী। সরল ও ধর্মপ্রান ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতা। পিতার আদর্শ অনুসরণ করেই তাঁর সন্তানরা জীবনযাবন করত। পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল কৃতি সন্তান অমর হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্ব কবি নামে আজো সুপরিচিত বিশ্ববাসির কাছে। এমন অসাধারণ প্রতিভা সত্যিই বিরল বিশ্বের ইতিহাসে। বাল্যজীবন অতিবাহিত করেন অতি সাধারণভাবে যদিও তিনি ধনী ঠাকুর পরিবারে জন্ম নেন। লেখাপড়া আরম্ভ করেন বাড়ির গৃহশিক্ষকের কাছে। কলকাতার নর্মাল স্কুলে ভর্তি করেন মাত্র আট বছর বয়সেই। কলকাতায় বেশীদিন পড়াশুনা না করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখতে লাগলো গৃহ শিক্ষকের নিকট। সেই যুগে ঠাকুর বাড়ি ছিল সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, সংগীতের পীঠস্থান। শিশু রবীন্দ্রনাথের জীবন কেটেছিল ঝি-চাকরদের হেফাজতে নিতান্তই সরল সাদাসিদেভাবে। ঠাকুর বাড়িতে সর্ববিদ্যা পারদর্শী করার জন্য বিচিত্র শিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। ভোরে পালোয়ান কুস্তি শেখাতো, গৃহশিক্ষকের কাছে বাংলা, অঙ্ক, ছুটির পর ইংরেজি পড়া, ছবি আঁকা, রুটিন মাফিক জীবনে চলতে হাফিয়ে উঠতো।
রবীন্দ্রনাথ ১১ বছর বয়সে মুক্ত বাতাসে ঘুরতে শান্তিনিকেতনে গেলেন। নিতান্তই এক গ্রাম বোলপুর। বালক বয়সেই প্রকৃতির সাথে পরিচয় হয়ে কাব্য রচনায় সূত্রপাত হয়। চার মাস বোলপুর থেকে হিমালয় ঘুরে কলকাতায় ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথ। স্কুল ভালো লাগেনা। পড়াশুনা আর কবিতা লেখা। মাত্র তের বছর বয়সে স্বনামে প্রথম কবিতা ছাপা হয় “হিন্দুমেলার উৎসব” অমৃতবাজার পত্রিকায়। বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনায় প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত লিখে চলেন। ভানুসিংহের পদাবলী ষোল বছর বয়সেই লিখলেন। স্কুলের গন্ডি পেরুতে পারেনি অভিভাবকদের সমস্ত প্রচেষ্টায়ও। ব্যারিস্টার করার আশায় বিলেতে পাঠানো হয় ১৭ বছর বয়সে। ইংরেজি শিখতে পড়াশুনা করেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে। যে উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় তার কিছুই হলো না। বেশীর ভাগ সময় কাটে সাহিত্য চর্চা আর নাচ গানে। উনিশ বছর বয়সে ফিরে এসে নতুন কিছুর সৃষ্টির জন্য মন ব্যাকুল হয়। লিখলেন গীতিনাট্য “বাল্মীকি প্রতিভিা” যা তার সার্থক ও জনপ্রিয় প্রতিভা বিকাশ।  সাহিত্য চর্চা হতে বিরত হননি কখনো। সম্পূর্ণ সাহিত্য সাধনায় লিপ্ত হন বিলেত থেকে ফিরে এসেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা একটি বিরাট বনারতি। বিস্ময়কর সৃষ্টি রহস্য তাঁর। গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক, উপন্যাস সাহিত্যের সর্বশাখায় বিরাজমান। তাঁর সৃষ্টি সম্ভার যেদিকে তাকায় সেদিকেই । সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিমন্ডলকে রবীন্দ্রনাথ করেছেন ফুলে ফলে, ঐশ্বর্য, দীপ্তিতে পূর্ণ এক অসাধারণ ক্ষেত্র। তার গান ও কবিতা দিয়েছে আমাদের দূর্বার সাহস ও প্রেরণা। রবীন্দ্রনাথের হাতে ঝরনাধারার মত রঁচিত হতে থাকে। প্রতাপাদিত্যের জীবন অবলম্বনে রঁচিত ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’ তাঁর প্রথম উপন্যাস।  ১৮১৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর ঠাকুর বাড়ির এক কর্মচারির কন্যা বারো বছরের মৃণালিনীর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়। ঠাকুর বাড়ি ছিল বাংলা সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র। আর্থিক দিক থেকেও অন্যতম ধনী। পূর্ববঙ্গ উত্তরবঙ্গে ছিলো বি¯তৃত জমিদারি। এক সময় রবীন্দ্রনাথের কাছে দায়িত্বভার এলে নদী পথে তিনি ঘুরতে ঘুরতে বিশাল অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। জমিদারি কাজে নিয়মিত কবি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসতেন । ঘুরতেন গ্রামের মানুষের সাথে ছোট বড় সুখ-দুঃখের আলোয় জন্ম দিয়ে লিখলেন ছোট গল্প- দেনা-পাওনা, গিন্নি, পোষ্টমাষ্টার যা তিনি হিতবাদী প্রত্রিকায় প্রকাশ করেন সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায় থেকে। কয়েক মাস পরে তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রেরা সাধনা পত্রিকা বের করলে গল্প প্রকাশের জোয়ার বইতে শুর করে। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, কঙকাল, জয়পরাজয় প্রভৃতি প্রতিটি বিয়োগান্তক গল্প প্রকাশ পায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ-‘রাজা ও প্রজা, ইংরেজদের আতংক, সুবিচারের অধিকার, ইংরেজ ও ভারতবাসী।’ গান ও কবিতার পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন একের পর এক কাব্য নাটক। উল্লেখযোগ্য নাটক-লক্ষীর পরীক্ষা, সতী, বিদায়, অভিশাপ, মালিনী প্রভৃতি। কবি শিলাইদহে স্বপরিবারে বহুদিন ছিলেন। শান্তিনিকেতনে এসে প্রতিষ্ঠা করেন আবাসিক বিদ্যালয়। কবির স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ত্রিশ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে করকাতায় মৃত্য বরন করেন। তাঁদের দুই পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও মনীন্দ্র এবং তিন কন্যার মাধুরীলতা, রেনুকা, মীরা। কিছুদিন পর মাত্র তের বছর বয়সেই মেয়ে রেনুকা অসুস্থ হয়ে মারা গেলে কবি ভেঙে পড়েন।

কবির সবচেয়ে বেশী ভাবনা বিকশিত হয়ে ওঠে শিলাইদহে আর শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনে বসে কবি লিখেছেন ডাকঘর। পুত্রবধূ প্রতিমার সাথে বিলেতে গিয়ে পরিচয় হয় ইংরেজ কবি ইয়েটস্ এর সাথে। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদ করে পড়ে ইয়েটস্ খুবই মুগ্ধ হয়ে ভূমিকা লেখেন। গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হলে ইংলান্ডের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সাড়া পড়ে উচ্ছাসিত প্রশংসার জোয়ার বইতে শুরু করল। কবি আমেরিকা হয়ে ফিরে আসলে ১৫ই নভেম্বর ১৯১৩ সনের সন্ধাবেলা সংবাদ এল কবি সাহিত্যে নোবেল পুরুস্কার পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার পর দেশে-বিদেশে ফুলের সৌরভের মত তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর একের পর কবি সৃষ্টি করেছেন অফুরন্তু লেখার ভান্ডার। বিখ্যাত ছোট গল্প হৈমন্তী, বোষ্টমী সহ অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে কবি লেখেননি। বৃদ্ধ বয়সেও কবি গান, ছবি আঁকা, লিখলেন শ্যামলী, আকাশ প্রদীপ, ছড়ার উৎসব, নৃত্যনাট্য শ্যামা। বেসরকারী ব্যক্তি হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিরচায়িত ইংরেজ প্রথা ভেঙ্গে কবি বাংলায় বক্তব্য দিলেন। ইংরেজরা দেরীতে হলেও কবিকে ১৯০৪ সালের ৭ই আগষ্ট ডক্টর উপাধী দিলেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জাতীয় সংগীত রঁচয়িতা। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” কালত্তীর্ণ এ বানীতে আমরা আজো উদ্দীপ্ত। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভালোবাসার, আমাদের কাছের মানুষ। তাঁর অসাধারণ বাণী “ পঁচিশে বৈশাখ চলেছে, জন্মদিনের ধারাকে বহন করে মৃত্যুদিনের দিকে---।”  উজ্বল্যের প্রভা নিয়ে নতুন প্রেরণা ও উদ্দীপনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আলোয় ভাসাতে ২৫শে বৈশাখ আসে।  বহু গ্রন্থের জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শেষের কবিতা, গীতাঞ্জলি, সঞ্চয়িতা তাঁর অসাধারণ রঁচনা সৃষ্টি। তাঁর মহত জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্ত্তি বীরভূম জেলার বোলপুরে শান্তিনিকেতনে ‘বিশ্বভারতী’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালীর নয় সমগ্র বিশ্বের গৌরব। বিশ্ব মানবতা ও সাম্যের কবি। তাঁর আহ্বান সমগ্র তরুণ সমাজকে নব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে। বাঙালীর কবি আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের মানকে আন্তর্জাতিকমানে রুপান্তরিত করেছেন। অবিনশ্বর হয়ে আছে আজো সকলের হৃদয়ে। ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন এলেই এপার-ওপার বাংলাসহ বিশ্বে সমগ্র সাহিত্য সাধনায় নতুন আলোয় উদভাসিত করে সমগ্র সাহিত্য জগৎ। এবার বিশ্বকবির জন্মদিনের মূল অনুষ্ঠান বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের শাহাজাদ পুরে, ঢাকাসহ কবি গুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওঁগার পতিসর ও খুলনার দক্ষিণ দিহিতে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যাবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যদায় কবিগুরুর ১৫৪-তম জন্মদিন পালিত হচ্ছে।  বিভিন্ন তথ্যের আলোকে সাজানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জানা-অজানা কিছু জীবণী যা পাঠক হৃদয়ে দাগ কাটবে। 



ভ্রমনকাহিনী : শেকড়ের টানে

 ভ্রমনকাহিনী : শেকড়ের টানে



শেকড়ের টানে
মীম মিজান

রাজশাহী। এই একটি শহর, যার কথা মনে পড়লে আবেগে আপ্লুত হই। এই শহরের মানুষগুলো অমায়িক। সবার চাওয়া-পাওয়া খুবই অল্প ও সাধারণ। নরম সুরে কথা বলে। আতিথীয়তায় এক দৃষ্টান্ত। আম ও সিল্কের জন্য বিখ্যাত এই শহরটি অনেক পর্যটকের কাছে আকর্ষণের জায়গা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সবুজ ও দেশের ২য় বৃহত্তম উচ্চ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, পদ্মা নদী, শাহ্ মাখদুম রুপোসের (র.) মাজার, চিড়িয়াখানাসহ অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে।
গবেষণার কাজ ও সাহিত্যের টানে ছুটে গেছিলাম সেই প্রিয় শহর ও ক্যাম্পাসে। ঢাকাথেকে ছেড়ে আসা 'ধুমকেতু' ট্রেনে সিরাজগঞ্জ কড্ডার মোড়ে 'মনসুর আলী রেলস্টেশন' এ এক ছোটখাটো যুদ্ধ শেষে 'চ' নম্বর বগিতে উঠে নিজ আসনে বসি। 'জামতৈল', 'উল্লাপাড়া', 'বরালব্রীজ', 'চাটমোহর', 'ঈশ্বরদী বাইপাস' ও 'আব্দুলপুর জংশন' পার হয়ে রাজশাহী রেলস্টেশন পৌঁছতে দুপুর দু'টো বেজে দশমিনিট। পথিমধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ বিল 'চলন বিল'র বুক চিরে আমাদের বয়ে নিয়ে চলা সাদা ও সবুজ রংয়ের 'ধুমকেতু' ট্রেনটি তার জানালা দিয়ে কত সবুজ ক্ষেত ও ইরিক্ষেতে পানিসেচের ইঞ্জিন ও ডিপকল দেখার প্রয়াস দিল। কত ধরনের রসুন ও ভূট্টার ক্ষেত। তালগাছ, খেঁজুরগাছ, গমক্ষেত, জটলাপাকানো কলাগাছ, দূরে দূরে দু'য়েকটা গরু-ছাগল ঘাস খাচ্ছে। পুকুরগুলো শুকিয়ে গিয়ে কচুরিপানাগুলো রোদে পুড়ে বিবর্ণতা পেয়েছে। আইলের মাথায় বসে কিশোর ছেলের নিয়ে আসা দুপুরের খাবার খাচ্ছে কিছু কৃষক। মাঝে মাঝে উঁচু জায়গায় গাছপালা বেষ্টিত বাড়ি দেখেছিলাম।
প্রাণের ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেন প্রবেশ করলে স্মৃতিগুলো চলচ্চিত্রের দৃশ্যের ন্যায় মানসপটে ভাসতে থাকল। পূর্বপাড়ার ও পূর্বদিকে বিস্তৃত আখক্ষেত। মাঝখান দিয়ে একটি রাস্তা। রাস্তার দু'ধারে কড়ই গাছ। উত্তরপাশে হরিজন সম্প্রদায়ের বস্তি। উত্তর-দক্ষিণ রাস্তা সংলগ্ন সেই বদ্ধভূমিটি একপায়ে দাঁড়িয়ে। প্রথমবর্ষে দলবেধে ঠিক এই বদ্ধভূমিতে রেহেনা, আব্দুল্লাহ, সালমাসহ কতবার আসতাম। রেল লাইনের লোহার উপর হাঁটার চেষ্টা করতাম। চারুকলা ও ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের সামনের জলাতে লাল পদ্ম তুলে দিতাম তাকে। ভদ্রা মোড়থেকে খানিকটা পূর্বদিকে সেই রেললাইনের জায়গাটা আমাকে সুখস্বপ্নে বিভোর করে দিল। হ্যাঁ! এই সেই জায়গা। যেখানে প্রথম তাকে বলেছিলাম 'ভালোবাসি অনেক তোমায়।' তারিখটিও স্মৃতিপট জানিয়ে দিল ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল।
ট্রেনস্টেশনের সেই প্লাটফর্মগুলো আমায় বলছে, 'মীম মিজান, এই সেই জায়গাগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে কতদিন তুমি অপেক্ষা করেছিলে ঢাকা ফেরত ট্রেনগুলির জন্য। আজও কী অপেক্ষা করবে কোনো ট্রেনের জন্য?'
আমি উত্তর করলাম, 'না। ঢাকা ফেরত ট্রেনের সেই কবিলা আজ আমার জন্য রাজশাহী থেকে কখন ফিরব একমাত্র তনয়সহ অপেক্ষারত।'
ব্যটারিচালিত রিক্সা করে সোনাদিঘি মোড়ে পৌঁছে লৌহের আঁধার কচুশাক ও মুরগী গোস্ত দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ শেষকরে চিরাচরিত অভ্যেস বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে কথাসাহিত্যের ছয়টি বই কিনলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়েও বই সংগ্রহের একটি নেশা ছিল। সেই নেশাটি এখনো ছাড়তে পারিনি। বই সংগ্রহ শেষে পদ্মানদীর তীরে গেলাম। হায় পদ্মার তীর! কী অপরিচ্ছন্ন এখন তুমি! কী উচ্ছিষ্ট! কী দুর্গন্ধ! তবে শাহেব বাজার কাঁচাবাজারের দক্ষিণদিক হতে পূর্বদিকের তীরটা বেশ সাজানো হয়েছে। অবসর কাঁটানোর জন্য রঙ্গিন চেয়ার, টেবিল ও ফুচকার দোকান সারি সারি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর 'পদ্মানদীর মাঝি' উপন্যাসের সেই পদ্মা আর আজকের বন্ধুত্বের হাতে গলাটিপে ধরার পদ্মা কী পার্থক্য! বালুময় পদ্মায় অপরাহ্নের যুগলবন্দী সময় যাপনের উদ্দেশ্যে ঝলমল পরিচ্ছদে উচ্ছ্বাস নিয়ে চারটি পা পাশাপাশি চালিত করে অসংখ্য জুটি হাঁটছে।


তুমি কেন আজ আসলেনা আমার সাথে? আমিও যেতে চাই উত্তপ্ত বালুকারাশীকে মাড়িয়ে হাতটি ধরে একটু দূরে। সবপাখিগুলো যখন নীড়ে ফিরবে, তখন আমরাও ফিরব। আমি অশ্রুসিক্ত। আমার হৃদ-আতœা হু হু করে লু হাওয়ায়।
পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বললাম বর্তমান বাংলা কথাসাহিত্যের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক স্যারের সাথে। স্যার সীমাহীন ব্যস্ততা সত্তেও আমাকে সন্ধ্যায় তার বিহাসের বাসায় যেতে বললেন। হানুফার মোড়ের এক ছোটভায়ের মেসে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দ্রুতই ইজি বাইকে ছুটে চললাম বাংলাভাষী পাঠকদের অন্যতম আকর্ষণ হাসান আজিজুল হক স্যারের বাসায়। স্যারের বাসাটা বিহাসের গেট পেরিয়েই হাতের বায়ে। পূর্বদিককার দেয়ালটি ঘেষেই স্যারের দোতলা বাসা। স্যারের বাসাটা দক্ষীণমুখী। প্রথমেই একটি হাফওয়ালের গেইট। সেই হাফওয়াল দিয়েই বাড়ির সীমানা নির্ধারিত। উপর তলায় স্যারের বড়মেয়ে থাকেন যিনি একটি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। আর ছোট্টমেয়ে টোটন আপু কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি নিচতলায় থাকেন। তার সাথে তেমন কেউ একটা কথা বলেন না। আমি একটু কুশল বিনিময়ে তার ভিতরে খুশির ঢল অনুভব করলাম।স্যার বাসার নিচতলার দক্ষীণদিকের পাশাপাশি দুটো কক্ষের পশ্চিমের কক্ষটাতে ঘুমান। পূর্বের কক্ষটি তার পড়াশুনা ও লেখার ঘর। অনেক বড় বড় জানালা ও গ্রিল এই কক্ষটিতে। পর্দাগুলোও উজ্জ্বল রংয়ের। চারদিকে গাদা গাদা বই। দক্ষীণদিকের স্যারের সেই কক্ষদুটোর থেকে উত্তরদিকে টোটন আপুর কক্ষ পর্যন্ত বিশাল এক বৈঠকখানা। জাতীয় অনেকগুলো দৈনিক বৈঠকখানার টেবিলে ছড়িয়ে আছে। চতুর্দিকে সাজানো সোফাগুলো দেখতে দারুন। বৈঠকখানার দেয়ালে অধিকাংশ জায়গাজুড়ে স্যারের বিভিন্ন বয়সের স্কেচ করা চিত্র। টোটন আপুর ঘরের দক্ষীণ দেয়াল ঘেষে একটি শোকেস আছে। শোকেসটি পূর্ণ ও ঠাসাঠাসি বিভিন্ন প্রকার পদক ও ক্রেস্টের দ্বারা। পশ্চিমদিকে বেশ কিছু জায়গাজুড়ে কিচেন। দেয়ালের এক জায়গায় দেখলাম স্যারের সহধর্মীনির স্কেচচিত্র। শাবিপ্রবি'র অধ্যাপক জাফর ইকবাল অতর্কিতে হামলায় পতিত হওয়ার পর মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী বিশেষ করে হাসান আজিজুল হক স্যারদের মতো ব্যক্তিগণ তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে খুবই সজাগ হয়েছেন।
তদুপরি স্যারের বাসায় সার্বক্ষণিক সাহিত্যপ্রেমীদের আড্ডা চলে। আমি প্রবেশ করতেই স্যার হেসে হেসে বললেন, 'মীম মিজান, তুমি তো সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছ। কিন্তু আমার সিনিয়র বন্ধুদের সাথে আমি এখন আড্ডা দিচ্ছি। তুমি যদি কালকে আসো বেশ খুশি হবো।' স্যার আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই মিনিট তিনেক ব্যক্তিগত কিছু বিষয় জানতে চাইলেন সোৎসাহে। আমার উত্তরগুলো শুনে স্যার অত্যন্ত প্রীত হলেন। দেখলাম অনেক বয়ঃবৃদ্ধ ব্যক্তিদের সাথে তিনি একান্ত আড্ডায় মশগুল। আমি দোয়া চেয়ে বিদায় নিলাম।
সন্ধ্যার অব্যহতি পরে বিনোদপুরে নির্মাণাধীন সাততলা ভবনের উপরতলায় সিঁড়িভেঙ্গে উঠে তারুণ্যে উচ্ছ্বল কবি, গবেষক, সম্পাদক ও শিক্ষক প্রিয়মানুষ মাহফুজ আখন্দ স্যারের সাথে আলাপচারিতা, সাহিত্য আড্ডা, মতবিনিময় ও বই উপহারের একটা দারুন পর্ব শেষ হয়।


রাত নয়টা নাগাদ মিলিত হই আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন প্রধান স্যারের সাথে। এই হেয়ালী ও বাউণ্ডুলে জীবনে অনেকটাই দেরী করে বেলেছি গবেষণার অগ্রগতিতে। একটি সম্মানজনক পেশা ও লেখার পিছনে ব্যায় করে ফেলেছি পাঁচটি বছর। তাই খেসারত দিতে হবে আমাকে পুনঃভর্তির মাধ্যমে। সদ্যা হাস্যজ্জ্বল ও ইতিবাচক মানসিকতার পরম উদাহরণ স্যার আপ্যায়ন করালেন চারদেশের চারপ্রকার খাদ্য উপাদান দিয়ে। ইরানের বিখ্যাত কাজুবাদাম। আরব্য খেঁজুর। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মিয়ানমারের কাঠবাদাম ও ম্যাডামের হাতে তৈরি বিশেষ ধরনের গোস্তের সিংগারা দিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক মহোদয়ের কাছথেকে বের হয়ে কথাসাহিত্যিক ও কোমল হৃদয়ের মানুষ মাতিউর রহমান ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য মণ্ডলের মোড়ে অপেক্ষায় থাকলাম। মাতিউর রহমান ভাই কোলকাতার একদল কবি-সাহিত্যিকদের সাথে রাজশাহী কলেজসহ কিছু জায়গা ঘুরে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাই একটু দেরীই হলো একসাথে হতে।
কথাসাহিত্যিক মাতিউর রহমান ভাই আসলেন। ভাইয়ের মুখে এ্যালার্জির সমস্যা ও কোমর ব্যাথার কথা বলতেই তিনি প্রায় আশ্চর্য হলেন। 'তুমি তো মেধাবী ও স্মৃতিধর মানুষ ভাই! একবারের দেখায় সবকথাই মনে রেখেছ!' বলে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। মণ্ডলের মোড়ে বসে গল্পে গল্পে একচাপ খেলাম। এরপর হাঁটতে হাঁটতে তার বাড়ির দিকে গেলাম। তার বাড়িটিও নির্মাণাধীন। ভাবী গরম গরম গমের রুটি, ডিম ভাজি ও সব্জি দিলেন। খেতে খেতে অনেক গল্প ও হাসাহাসি করলাম। খাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত সাহিত্যের নানা বিষয়, ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ই আলোচিত হলো দুজনের মধ্যে। বাসাথেকে বেরুবার সময় তার সম্পাদিত 'সিড়ি' নামক পত্রিকার একটি সংখ্যা সৌজন্য উপহার দিলেন। প্রায় অর্ধেক রাস্তা এগিয়ে দিলেন।
রাতে হানুফার মোড়ে একটি মেসে রাত্রি যাপন করে সকালে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষে সাইকেল চালিয়ে ক্যাম্পাসে গেলাম। ক্যাম্পাসের মূল প্রশাসনিক ভবনের সামনের জোহা সমাধীস্থলটির পরিবর্তন দেখলাম। একটু এগিয়ে লিচুতলার সেই ফাঁকা জায়গাটা দেখলাম। সেখানে একটি স্মৃতি স্থাপনা তৈরী হয়েছে। লাইব্রেরি চত্বরে দেখি প্রাইভেটের অনেক কুণ্ডুলী। টুকিটাকি চত্বরটি প্রাণবন্ত। কেউ কউ বিতর্ক নিয়ে ব্যস্ত। অনেকেই সেগ্রেট ফুকছে। দেখলাম মতানীরাও আছে। আমি ডাকলাম। নানীরা আমাকে দেখেত কী খুশি! খুশিতে চোখগুলো চিকচিক করছিল। আমাকে দুই নানীর মাঝখানে বসিয়ে সেই কী গান গাইল দু'জন! কত স্বাদের একপ্লেট খিচুরি ও ডিমভাজি খেলাম।
টুকিটাকি চত্বরথেকে রিক্সাকরে রা.বির সাবেক ভিসি ও আমার শ্বশুর এলাকার মানুষ বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের গবেষক প্রফেসর ড. আব্দুল খালেক স্যারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তার 'নর্থবেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি'তে গেলাম। উল্লেখ্য যে তিনি উক্ত ইউনিভার্সিটির ভিসি। অনেক খোঁজখবর নিলেন স্যার। আক্ষেপ প্রকাশ করলেন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত 'রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়' নিয়ে। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সকল কাজ করলেন অথচ তিনিই আজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের কোন পদেই নেই। স্যারের সাথে দেখা শেষে ইজি বাইকে চলে আসি আবারো বিহাস। বিহাসে হাসান আজিজুল হক স্যারের সাথে দেখা করলাম।
আমার দু'দিনের প্রিয় শহর রাজশাহী ও প্রাণের ক্যাম্পাস রা.বির সফরের বিদায় ঘন্টা বেজে উঠল। বিনোদপুরে বাসে উঠে রওয়ানা হলাম সিরাজগঞ্জের দিকে। ফাতেমা পরিবহনের বাসটি সবুজের সমারোহে দুইসারি গাছের মাঝখানে কালোপিচের রাস্তার উপর গতিতে পূর্বমুখে ছুটতে থাকল।