ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৩

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৩

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫৩

শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর ২০২০





















মানুষ, সভ্য-সমাজ ও কবিতা

মানুষ, সভ্য-সমাজ ও কবিতা

 



মানুষ, সভ্য-সমাজ ও কবিতা

অনন্ত পৃথ্বীরাজ 


পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। আর মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য অন্য সবকিছু সৃষ্টি। একজন ‘কবি সমাজের মানুষ, কিন্তু তবু তিনি সমাজের বাইরে।’১ কবিতা সমাজকে প্রভাবিত করে। সমাজের পরিপ্রেক্ষিতের মধ্য দিয়েই কবি ও তাঁর কবিতাকে বিচার করতে হয়। ‘মানুষের সমস্ত সৃজনপ্রেরণার উৎস তার সমাজ ও সময়। সমাজ ও সময়লালিত হবার ফলেই ব্যক্তির সংবেদনা, আবেগ, অনুভব ও জীবন-কল্পনা সমষ্টির মধ্যে আত্মমুক্তির সন্ধান করে।’২‘মানুষের বস্তুগত কর্মপ্রক্রিয়া ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষ প্রয়োজনবোধ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ধারণা, অনুভব ও চেতনা। কবিতা এই চেতনারই শব্দময় ও চিত্রকল্পময় অভিব্যক্তি।’৩ 

‘ব্যক্তির আবেগপুঞ্জের সাথে সংঘ-জীবনাবেগের সংযোগের ফলেই কবিতার সৃষ্টি। মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তিই হচ্ছে তার আত্মপ্রকাশ-প্রবণতাÑযে প্রবণতা ব্যক্তিকে সমষ্টিগত জীবনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। এই প্রকাশ আকাক্সক্ষার গভীরে নিহিত রয়েছে মানব মনেই সেই মৌল অভীপ্সা, যা সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষকে সামূহিক জীবনচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।’৪

“প্লেটো-অ্যারিস্টটলের শিল্প, দর্শন ও নন্দনতাত্ত্বিক অভিনিবেশের মধ্যেও কবিতার জীবন ও সমাজনিষ্ঠ স্বীকৃতি বিদ্যমান। প্লেটো কবিতাকে দৈবপ্রেরণাজাত সৃজনপ্রয়াস হিসেবে আখ্যায়িত করলেও, ‘শিল্প অনুকরণ’Ñএই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তিনি কবিতাকে অলৌলিকতার পর্যায় থেকে লৌকিক জীবনের পটভূমিতে স্থাপন করেছেন অলক্ষ্যে। অ্যারিস্টটলই প্রথম লোকায়ত জীবনের সহজ সম্বন্ধের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পকে। প্লেটো কথিত ‘আইডিয়াল রাষ্ট্রে’ কবিতার অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও তিনি শিল্প যে অভিজ্ঞতা বা জীবনের অনুকরণ এ সত্যে বিস্মৃত হন নি। আর অ্যারিস্টটলের চিরায়ত গ্রন্থ চড়বঃরপংÑ এর ভিত্তিমূলে রয়েছে এই অনুকরণবাদ। পোয়েটিক্স বা কাব্যতত্ত্বে ট্রাজেডির সংজ্ঞা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের মন্তব্য লক্ষণীয়, ট্রাজেডি ‘ঘটনার অনুকরণ এবং জীবনের অনুকরণ আর জীবনের রূপ কার্যেই প্রকাশিত।’ কোনো অলৌকিক দৈব-প্রতিভাস হিসেবে নয়, মানব স্বভাবের গভীরেই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন শিল্প-সৃষ্টির উৎস।”৫

সমাজজীবনের অন্তঃসারকে আত্মস্থ করেই যেহেতু কবিতার উদ্ভব, বিকাশ ও ক্রমযাত্রা, সে-কারণে বিশেষ ভৌগোলিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও মানচিত্রগত বৈচিত্র্যের ফলে কবিতার স্বরূপও বিভিন্ন হতে বাধ্য। এই বিভিন্নতার পরিচয় প্রতিটি যুগের কবিতায় অভিব্যক্ত। 

যে-কোনো সভ্যতার উদ্ভব-পর্যায়ের সৃষ্টি মহাকাব্য। ইলিয়াড-ওডেসি এবং মহাভারত-রামায়ণের গঠনমান সভ্যতার শৈল্পিক-প্রকাশই মুখ্য। প্রথম-পর্যায়ের কাব্যসমূহ তাই কোনো ব্যক্তি বিশেষের সৃষ্টি নয়, সভ্যতা-বিকাশ-পরম্পরায় ব্যক্তিচেতনা পুঞ্জের সমন্বিত সৃষ্টি।

সমাজ ও সভ্যতার বিবর্তন ও ক্রমযাত্রার পথপরিক্রমায় ক্রমাগত শ্রম-বিভাজনের ফলে শ্রেণিগত বিভেদ হয়ে ওঠে অনিবার্য। এই শ্রেণিগত বৈচিত্র্য একেকটা পর্যায় অতিক্রম করার সাথে সাথে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়াটাও হতে থাকে দ্রুততর। শ্রেণিসমূহের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টির ফলে বাস্তববিচ্ছিন্ন শোষকশ্রেণির উদ্ভব হয়, ব্যক্তিগত মালিকানা হয় সুসংহত, উপজাতিক যৌথজীবনের ধ্বংশাবশেষের ওপর জন্ম নেয় জমিদার, ভূমাধিকারী। শুরু হয় মানবিক বিপর্যয়। মানবীয় আত্মচ্যুতির মূলে বিদ্যমান নিজের সৃজিত সম্পত্তি থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। মহাকাব্য পরবর্তী কবিতার যুগ তাই মানবসমাজের অবক্ষয়ের যুগ, তার হীন মন্যতার যুগ। অবশ্য মহাকাব্যগুলোতেও আমরা একজন দেবতাধিপতিÑ যেমন ইলিয়াডের জিউস এবং মহাভারতের কৃষ্ণকে দেখতে পাই। ঈস্কাইলাসের ‘চৎড়সবঃযবঁং ইড়ঁহফ/ প্রমেথিউস বাউন্ড’-এ শোষিত-লাঞ্ছিত মানবাত্মার আর্তনাদই বাণীরূপ পেয়েছে। দেবতাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই প্রমেথিউস বাউন্ড এর মুখ্য বিষয়। সমাজজীবনের অবরুদ্ধার অনুষঙ্গেই ঈস্কাইলাসের কাব্যে প্রমেথিউস বন্দী। সফোক্লিসের ঙবফরঢ়ঁং ঃযব শরহম, ঙবফরঢ়ঁং ধঃ ঈড়ষড়হড়ং, অহঃরমড়হব Ñ প্রভৃতিতেও নিয়তিতাড়িত ও অসহায় মানবজীবনের যে হাহাকার ও করুণ পরিণতি বিধৃত, তার মূলেও বিদ্যমান সামাজিক মানুষের জৈবনিক ট্রাজেডি। ট্রাজেডিগুলোতে কোরাসের উপস্থিতি তার সামাজিক চরিত্রকে অধিকতর সুদৃঢ় করেছে। 

সমাজ ও সভ্যতার দ্বন্দ্বময় বিকাশের নিয়মই হচ্ছে ক্রমবিবর্তন। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব যখন চরম রূপ ধারণ করে, তখনই সংঘর্ষ হয়ে ওঠে অনিবার্য। ধর্মের আশ্রয়েই যেহেতু রাষ্ট্রের শক্তি ও স্থিতি, সে কারণে রাষ্ট্রশক্তির জয় পরাজয়ও অনেকাংশে ধর্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। যেমন রোমান সভ্যতা পতনের পর ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের আক্রমণে পতন ঘটে হেলেনীয় সভ্যতার। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার গণতন্ত্রের গৌরবসূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বকবিতার পটভূমিতে সূচিত হয় একটা শূন্যতাময় তমসাপ্রবাহ। বিশেষ সমাজে এক ধর্মের আধিপত্যের পরিবর্তে ধর্মও একটা জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজ ও ধর্মের এই সংঘাতময়, দ্বন্দ্ববহুল ও বিচিত্র রূপবৈশিষ্ট্যের অঙ্গীকারই প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতায় বিধৃত।

ইংরেজি সাহিত্যের আদিকাল-পর্ব অ্যাংলো-স্যাক্সন পর্ব। এই কালসীমা সপ্তম থেকে দশম খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই পর্বে ইংল্যান্ডে ঐহিক জীবনচেতনাপরি¯্রুত যে কাব্যধারার উদ্ভব ঘটে, তা মূলত সমসাময়িক কালের জার্মানিক বা টিউটোনিক সাহিত্যের প্রভাবজাত। গ্রীক ও রোমান সাহিত্যের পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ভুত এই সাহিত্য ধারা ভূমধ্যসাগরের উত্তরে অর্থাৎ ইউরোপের প্রধান ভূখন্ডে বিস্তার লাভ করে। জার্মানিক সাহিত্যের সাথে অ্যাংলো-স্যাক্সন কবিতার যোগসূত্র একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্মিলনের প্রতিফলন।

ইংরেজি কবিতায় রেনেসাঁসলব্ধ জীবন চেতনার প্রকাশ ঘটে ষোল শতকের মধ্য পর্যায়ে। স্যার টমাস ওয়াট (১৫০৩-১৫৪২) এবং আর্ল অব সারের (১৫১৮-১৫৪৭) এর কবিতা নবচৈতন্যময় জীবনান্বেষার শিল্পরূপ। রেনেসাঁস-যুগের ইতালির ভাবপুরুষ পেত্রার্ক এই যুগচৈতন্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। 

এলিজাবেথীয় যুগে রেনেসাঁস-প্রভাবিত জীবনবোধ এবং নবজাগ্রত জাতীয় চেতনার অঙ্গীকারে এডমন্ড স্পেন্সার এবং শেকস্পিয়র মানবীয় সমাজ ও তার সমগ্রতাকে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন। স্পেন্সারের কাব্যে জীবনের বিচিত্র সম্মিলন ঘটেছে। শেকস্পিয়রের কবিচৈতন্যের সার্থক প্রকাশ তার সনেটে এবং নাট্যকার শেকস্পিয়রের সাফল্য ও সিদ্ধির উৎস তাঁর কবিত্ব শক্তি। জন মিল্টন (১৬০৮-১৬৭৮) রেনেসাঁসলব্ধ ইংল্যান্ডীয় জীবনচৈতন্যের পরিণত কবিপুরুষ। ইংরেজি কবিতার পটভূমিতে তাঁকে রেনেসাঁসের শেষ প্রবক্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রেনেসাঁসের মূল্যবোধ ও জীবন চেতনা মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ (১৬৬৭) কাব্যকে চিরায়ত শিল্পমহিমায় উন্নীত করেছে। ঈশ্বরের সৃষ্টি প্রথম নর-নারী আদম-ঈভ কর্তৃক ঐশী বিধি লংঘন, তাদের স্বর্গচ্যুতি, ঈশ্বরের ন্যায় বিচার প্রভৃতি প্রসঙ্গÑএই কাব্যের প্রধান বিষয়বস্তু। রেনেসাঁসের প্রভাবে সমাজচৈতন্যে এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল হলো যে, মানুষের জন্য একটা নতুন উন্নতর জীবনের দ্বার এখন উন্মুক্ত। সুতরাং মানুষ হিসেবে ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে হলো স্বতঃস্ফূর্ত। যে সৌন্দর্যচেতনা ব্যক্তির জীবনবোধ ও সৃষ্টিশীলতার স্বাধীনতাকে করে প্রাণময়, এ সময়কালের ফরাসি কবিতায় সেই ধর্মবন্ধনমুক্ত সৌন্দর্যচেতনার নবদিগন্ত হলো উন্মোচিত। রেনেসাঁসের প্রভাবেই ফ্রান্সে ধ্রুপদ সাহিত্যের পথ হলো অবারিত। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি সমাজপ্রবাহ, তার সংগঠন ও সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত লা ফতেঁর (১৬২১-১৬৯৫) কবিতায় বিদ্যমান।  

ইংরেজি সাহিত্যে এলিজাবেথীয় যুগের কল্পনাময় ও ভাবাবেগ রেস্টোরেশন যুগে (১৬৬০-১৭০০) যুক্তিবাদিতা, বস্তুতান্ত্রিকতা এবং ক্ল্যাসিক মতবাদে ক্রমবিকশিত ও সুসংহত হয়। ১৬৮৮ সালের ‘গৌরবদীপ্ত বিপ্লব’ এবং ১৬৮৯ সালের উইলিয়াম ও দ্বিতীয় চার্লস কন্যা মেরি কর্তৃক ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রের পট পরিবর্তন পরিবর্তন হয়। এ সময়ে কবিতার ক্ষেত্রে জন্ ডাইড্রেন ও স্যামুয়েল বাটলার যুগপ্রতিনিধিত্বশীল কবি প্রতিভা। অগাস্টান যুগে (১৭০০-১৭৫০) ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় ধর্মীয় দ্বন্দ্বের অবসান, রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে সহযোগী মনোভাব সমাজজীবনের স্থিতিশীলতার দ্যোতক। পার্লামেন্টের প্রাধান্য বিস্তারের ফলে স¤্রাট ও অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের গতি হয় অবরুদ্ধ। সাহিত্যের ক্ষেত্রে রাজদরবারের পরিবর্তে ‘কফি হাউসের’ প্রাধান্য বিসতৃত হয়। আলেকজান্ডার পোপ এ যুগের শ্রেষ্ঠতম কবি। 

মানবীয় সক্রিয়তার এক বিস্ময়কর বিকাশ পর্যায় শিল্পবিপ্লব বা ওহফঁংঃৎরধষ জবাড়ষঁঃরড়হ। এই বিকাশ-পর্বে ইংল্যান্ড বিশ্বব্যাপী তার বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তারের চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। তবে, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্তর্গত ক্ষয়শীলতারই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আর্থনীতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের এই বিশ্বব্যপ্ত পটভূমিতে সংগঠিত হলো ‘ফরাসি বিপ্লব’ (১৭৮৯)। ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক প্রতিক্রিয়া ইউরোপীয় চৈতন্যে হলো দূরসঞ্চারী। যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার জীবনবেদ ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে নিহিত ছিল, ইংল্যান্ডের সমাজচৈতন্যে তার অভিঘাত অপরিমেয় জীবনচাঞ্চল্যে হলো গতিময়। টমাস পেইনের ‘রাইটস্ অফ ম্যান’(১৭৯১) গ্রন্থটি রুশো-ভলতেয়ার প্রভাবিত বিপ্লবী জীবনচেতনার উত্তরাধিকার সমৃদ্ধ। জৈবনিক মুক্তির মধ্যেই মানুষের কল্পনার সর্বময় মুক্তি নিহিত। আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তাই ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব এতো গভীর ও তাৎপর্যময়। রোমান্টিসিজমের জীবনচৈতন্য ও সাহিত্যাদর্শ ফরাসি বিপ্লবের কাছে অনেকাংশে ঋণী। 

রোমান্টিক যুগের প্রথম পর্বের প্রধান কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্ড এই নব্য জীবন চেতনার সার্থক কবি প্রতিনিধি। এ সময়ের আরেকজন প্রধানতম কবি হলেন কোলরিজ। উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্ড ও কোলরিজ দু’জনের সম্মিলিত প্রয়াসে খুৎরপধষ ইধষষধফং (১৭৯৮) এর উদ্ভব আধুনিক জীবন চৈতন্যের অঙ্গীকারে গৌরবমন্ডিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের রোমান্টিক কবিদের মধ্যে শেলী, কীট্স, বায়রন  বিদ্রোহ ও জীবনচেতনায় একই আদর্শের প্রতিনিধি। উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্ড ও কোলরিজের বিদ্রোহ ছিল অন্তর্গত, কিন্তু শেলী কীট্স বা বায়রনের বিদ্রোহ জীবনাচরণ ও কবিতায় যুগপৎভাবে প্রতিফলিত। শেলীর চৎড়সবঃযবঁং টহনড়ঁহফ সমকালীন সামাজিক ও  রাজনৈতিক মুক্তির প্রতীকী কাব্যরূপ। 

ইংরেজি সাহিত্য-শিল্পের ভিক্টোরিয়ান যুগ (১৮৩৭-১৯০১)। এই সময়কে বলা হয় পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়ের যুগ। এই অবক্ষয় শিল্পবিপ্লবের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবজাত। সৌন্দর্য এবং বাস্তবজীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যে সমন্বয়বিধানের প্রয়াস সত্ত্বেও পরিণামে বস্তুজগতের দৈনন্দিনতার অভিঘাতদীর্ণ জীবন মুখ্য হয়ে ওঠে টেনিসনের কবিতায়। ভিক্টর হুগো ফরাসি রোমান্টিসিজমের সার্থক প্রবক্তা। 

পুঁজিবাদী সমাজের গতি ও উদ্যমের উৎস পুঁজি। ব্যক্তির অবস্থান সেখানে মূল্যহীন। তার ক্রিয়াশীলতা পুঁজির মানদন্ডেই বিবেচিত। শিল্পসৃষ্টি সেখানে এক অনুৎপাদনশীল শ্রমমাত্র। 

‘পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং বহির্দ্বন্দ্বের চরম প্রকাশ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)। সা¤্রাজ্য-বিস্তার ও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী সমাজ যে বিশ্বব্যাপ্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিলো, প্রথম মহাসমরের মধ্য দিয়ে সূচিত হলো তার অবক্ষয় পর্ব। কালের এই অস্থিরতা, অবক্ষয় ও অনিশ্চয়তার পটভূমিতে টি. এস এলিয়টের উপলব্ধি তাই গভীর যন্ত্রণা এবং রক্তক্ষরণে পর্যবসিত। আইরিশ কবি ইয়েট্স-এর বিশ্বাস ও অনুভবের বাস্তব-উৎস বিপন্ন হবার ফলে, তাঁর ইতিবাচক প্রত্যাশার ভিত্তিভূমি হয় পর্যুদস্ত। যুদ্ধোত্তর জীবনের অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়ায় ইয়েট্স-এর চেতনার রূপান্তর হলো অবশ্যম্ভাবী। তাঁর প্রকৃতিসংলগ্ন চেতনার কেন্দ্রমূলে সূচিত হলো যুদ্ধজনিত রক্তক্ষরণ, অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ববোধ। তবুও ইয়েট্স এর মধ্যে জীবন জিজ্ঞাসার ইতিবাচক সূত্রসমূহের উপলব্ধি নি:শেষিত নয়। যুদ্ধোত্তর জীবনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সার্থক দৃষ্টান্ত টি. এস এলিয়টÑএর কবিতা। জীবনের অনিশ্চয়তা, অবক্ষয় ও অবিশ্বাসবোধ থেকে এক সীমাহীন অমীমাংসার অন্ধকারে নিমজ্জিত তাঁর কবিচৈতন্য। সেখানে উজ্জীবনের কোনো সম্ভাবনা নেইÑ সকলেই ধ্বংসপ্রবণ পরিণতির দিকে ধাবমান। সংযোগ এবং বিচ্ছিন্নতা, দ্বন্দ্ব এবং অবক্ষয় তার কবিতার সমান্তরাল অভিব্যক্তি লাভ করে।’৬

টি. এস এলিয়টের বিশ্বাসের পরিণতি ক্যাথলিক ধর্মবোধে আর এজরা পাউন্ড যুগধর্মের অন্বিষ্ট হিসেবে সনাক্ত করেন চিত্রকল্প। এজরা পাউন্ডের মতে, কবির কাম্য সংগ্রাম বা সংঘশক্তি নয়, কবির দরকার একটি ভালো চিত্রকল্প। পুঁজিবাদী সমাজে আশ্রিত কবি এক পর্যায়ে উপলব্ধি করেন নিজের অস্তিত্ত্বে নৈঃসঙ্গ্য ও বিচ্ছিন্নতা। কবি শ্রমের শোষক বা পুঁজিপতি নন, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শোষিত। সুররিয়ালিস্টিক কবি এই সমাজের স্বভাবধর্মকে অতিক্রম করতে পারেন না বলেই তিনি যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হন।   

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু এবং ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার প্রথাগত ধারায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচক। এ পরিবর্তনের অন্যতম কারিগর ছিরেন কবি পুশকিন। ইতালির দান্তে বা পেত্রার্কের মতো পুশকিনকে বলা হয় ‘রাশিয়ার বসন্ত’। 

‘আধুনিক সভ্যতা মানবচৈতন্যের উজ্জীবনকে যেমন  সর্বময় করেছে, তার বিস্তারকে যেমন গভীরতা ও ব্যাপ্তি দান করেছে, তেমনি তার জন্য স্থিতিশীল জীবন পটভূমি নির্মাণ করতে হয়েছে ব্যর্থ। দ্বন্দ্বময়, জটিল ও স্তরবহুল সমাজ সংবেদনশীল চৈতন্যকে নিক্ষেপ করেছে সীমাহীন জিজ্ঞাসা ও কৌতুহলের মধ্যে। একেকটি আদর্শের উদ্ভব যেমন প্রত্যাশাদীপ্ত স্বপ্নকল্পনার কার্যকারণ হয়ে ওঠে, তেমনি সমাজ ও জীবনের অনিশ্চিত-গতি পদবিক্ষেপে সেই প্রত্যাশার দিগন্তও আলোকিত সম্ভাবনার পরিবর্তে উপনীত হয় এক শূন্যময় তমসাপ্রবাহের সীমাহীনতায়। কতিার প্রকরণ এ কারণেই তার প্রথাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যায়Ñ কবির অর্জিত বিশ্বাস প্রতিনিয়তই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। দুঃস্বপ্নের চোরাবালিতে পথ হারিয়ে ফেলে চৈতন্য। এভাবেই কবির অন্বিষ্ট সমষ্টির পরিবর্তে হয়ে ওঠে আত্মগত। বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাঁর কাম্য। প্রত্যাশিত আদর্শের প্রতিষ্ঠা-সম্ভাবনা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখনি আদর্শগত সংগ্রাম থেকে সামূহিক বোধ থেকে কবি হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন। র্যাঁবোর পরিণতি যেন সে-সত্যেরই ইঙ্গিত।’৭

তথ্যসূত্র :

১ .  মনজুরে মওলা : প্রসঙ্গ-কথা, কবিতা ও সমাজ, রফিকউল্লাহ খান, (ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা ১৯৮৯), বাংলা একাডেমী, ঢাকা। 

২ . রফিকউল্লাহ খান : কবিতা ও সমাজ (ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা ১৯৮৯), বাংলা একাডেমী, ঢাকা। পৃষ্ঠা : ০৯। 

৩ . প্রাগুক্ত। পৃ : ১১

৪ . প্রাগুক্ত। পৃ : ১৪

৫ . প্রাগুক্ত। পৃ : ১৯ 

৬ . প্রাগুক্ত। পৃ : ৭৯

৭ . প্রাগুক্ত। পৃ : ৭৮

কবি, কথাকার ও এম. ফিল গবেষক।


এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়

এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়

 



এখানে স্বপ্ন বিক্রি হয়

মনিরা মিতা


ডাস্টবিনের ময়লা আর্বজনা খেতে আসা কাকগুলোর কর্কশ কন্ঠের কা কা শুনতে শুনতে হেঁটে চলছে আব্দুল বাতেন আর তার স্ত্রী আজিরন। ঢাকা শহরের ল্যাম্প পোস্টগুলোর বাতি এখানো নেভে নাই। ব্যস্ত শহর একটু পরেই আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠবে, শুরু হবে কোলাহল। ফজরের নামাজ আদায় করেই আব্দুল বাতেন আর এক মুহূর্ত দেরি করে নাই, স্ত্রীর হাত ধরে বেড়িয়ে পরেছে পথে। গতরাতের ঘটনার পর এই শহরে থাকার ইচ্ছেটা তার একেবারেই মরে গেছে।

অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আব্দুল বাতেন স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায়; গোলগাল ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে গেছে। এই শহর মাত্র দুটি বছরে মমতাময়ী এই মহিলাটির বয়স যেন বিশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে।

রক্তের টান যেমন বড় টান, তেমনি রক্তের অপমানও বড় অপমান। হ্যাঁ, গত দুই বছর ধরে বড্ড অপমানিত হয়েছেন এই বৃদ্ধ মানুষ দুটো। অনেক নির্ঘুম রাত পার করেছেন নিজ সন্তানের বাসায়। এই বয়সে এতো অপমানিত হতে হবে এটা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তারা।

রাফিদ তাদের বড় কষ্টের ধন। বিয়ের ৬ বছর পরও যখন তাদের সন্তান হচ্ছিল না তখন অজিরন বেগম অস্থির হয়ে যায়। স্বামীর হাত ধরে বহু ডাক্তার, কবিরাজ এমন কি মাজারে পর্যন্ত গিয়েছে। যে যা বলেছে তাই করেছে। নামাজের পাটির উপর রাতের পর রাত কাটিয়ে দিয়েছে, রোজা থেকেছে, মানত করেছে। অবশেষে আল্লাহ তার ডাক শুনেছেন। বহু সাধনায় তার কোল আলো করে এসেছে রাফিদ। 

ছেলেকে মানুষ করতে শহরে পাঠিয়েছে তারা, ভালো কলেজ- ভার্সিটিতে লেখাপড়া করিয়েছে। আর সেজন্য একে একে বিক্রি করতে হয়েছে ফসলের ক্ষেত। শেষ সম্বল ভিটে বাড়িটাও বিক্রি করে ছেলের হাতে টাকা দিয়েছিল নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। ছেলের চাকরি হয়েছে, সংসার হয়েছে। ছেলের ইচ্ছে অনুযায়ী বৃদ্ধ বাবা-মা এসে উঠেছে ছেলের সংসারে।

ঢাকা শহরে আসার এরপর থেকে শুরু হয় তাদের নতুন জীবন। এ জীবনের প্রতি পদে পদে অপমান আর অপদস্ত। সকাল হতে না হতেই বৌমার চিৎকার শুরু হয়। কেনই বা হবে না! সকালে তাদের অফিসে যাবার তাড়া তার উপর আবার বাড়তি এই মানুষ দুটোর ঝামেলা, যদিও কাজের মানুষ আছে তবুও বাড়তি বৃদ্ধ মানুষ দু’টোর চেহারা সহ্য করাও কি কম কষ্টের! 

বৌমার উঁচু গলার আওয়াজ আব্দুর বাতেন আর আজিরন বেগমের কানের গহব্বরে প্রতি নিয়ত গরম সিসার মতো ঢুকে পরে। অফিস থেকে ফিরেই আবার শুরু হয় অশস্তি। এই বৃদ্ধ দুটি মানুষ সারাক্ষণ তার ঝগড়ার কারন হয়ে দাঁড়ায়। আজিরন বেগম মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠে, বলে ‘চলেন আমার গ্রামে ফিরা যাই।’

‘গেরামে কই যামু রাফিদের মা? গেরামের সব কিছুই বেইচা দিছি, ওইহানে গিয়া কই থাকুম?’

‘আইচ্ছা ঐ যে সরকার গুচ্ছ গেরাম বানাইছে ওইহানে একটু ঠাঁই হইবো না আমাগো!

আর নয়ত চলেন বৃদ্ধাশ্রামে চইলা যাই। ওইখানে শুনছি আমাগো মত অসহায় মাইনষের থাকনোর জায়গা দেয়, খাওন দেয়।’

স্ত্রীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আব্দুল বাতেন বলে- ‘বউের উপর রাগ কইরা পোলার শাস্তি  দিবা রাফিদের মা? আমরা এমনে চইলা গেলে মাইনষে আমাগো পোলারে মন্দ কইবো। পরের মাইয়া যাই করুক আমাগো পোলায় তো কিছু করে নাই হেই তো আমাগো ভালা পায়।’

‘হ, ভালা পায়। বিবির সামনে ভেড়া হইয়া যায় আপনের পোলায়। একবার ও বাপ-মার খোঁজ নেয় না। বিবির কথার প্রতিবাদ করে না।’

‘অশাস্তির ভয়ে কয় না কিছু, আমরা আর কয়দিন আছি কও, সহ্য করো রাফিদের মা আল্লাহ’য় একদিন মুখ তুলে চাইবো।’

‘হ, আল্লায় য্যান তাড়াতাড়ি চায়। দুনিয়ার থেইক্কা যাইতে পারলেই সব অশাস্তি ফুরাইবো।’

ঢাকা শহরে খাঁচায় বন্ধি পাখির মত ছটফট করতে থাকে অসহায় মানুষ দু’টি। গ্রামের মেঠোপথ, ক্ষেতের আইল, কঁচি ঘাস, সজনে গাছ, পুঁয়ের লকলকে ডোগা, গোবর লেপা উঠান, পাটের আঁশের গন্ধ, মজা পুকুর এসব কিছুর জন্য তাদের মনটা অনচান করে। ছুটে গ্রামে চলে যেতে মন চায় কিন্তু পারে না। তাদের শরীর থাকে এই বন্ধি খাঁচায় আর মন পরে থাকে গ্রামের চিরচেনা বাড়ির আঙ্গিনায়। 

রাত প্রায় একটা বাজে। আব্দুল বাতেন শ্বাস নিতে পারছে না, তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বুকটা পাথরের মত ভারি হয়ে আসছে। স্বামীর অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে ডাকতে যায় আজিরন বেগম। ছেলেকে ডাকতেই খেকিয়ে ওঠে ছেলের বৌ।

‘এতো রাতে কি চাই! আপনাদের জন্য কি একটু ঘুমাতেও পাবো না?’

‘রাফিদ তাড়াতাড়ি এদিকে আয়, তোর আব্বা য্যান কেমন করতাছে।’

‘আহা! ঘরে যান তো, সে এখন যেতে পারবে না।’

আজিরন বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলে তার বোবা সেজে আছে। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না।

রাফিদের মা আর কিছু না বলে দ্রুত স্বামীর কাছে ফিরে আসে। তেল গরম করে স্বামীর বুকে মালিশ করে। গরম তেল আর গরম চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর রাফিদ আসে। হয়ত সন্তান হিসেবে বিবেক তাকে ধাক্কা দিয়ে এখানে আনে। যদিও ওর মায়ের সন্দেহ হয় ওর ভিতর বিবেক বলে কিছু আছে কি না! নাকি পুরোটাই স্ত্রীর কষাঘাতে নিঃশেষ হয়ে গেছে। 

বাবার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় রাফিদ। হঠাৎ বাবা মারা গেলে সবাই তাদের সন্দেহ করতে পারে কেননা আশেপাশের সবাই তার বাবা- মায়ের সাথে বউয়ের খারাপ ব্যবহারের কথা জানে। এমন কি মাঝে মধ্যে দু’একজন প্রতিবাদও করছে কিন্তু তার বউ এসব গায়ে মাখে নাই বরং উল্টো তাদের উপর চড়াও হয়েছে।

বাবার বুকের ব্যথা আরও বেড়েছে দেখে বাবাকে হাসপাতালে নেয় রাফিদ। ডাক্তার ইমারজেন্সি রোগী দেখে অপেক্ষা না করে আইসিইউতে নিয়ে যায়। প্রথম প্রথম রাফিদ ভাবে এসব ডাক্তারদের বাড়াবাড়ি, টাকা কামানোর ফন্দি।

কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। চিকচিকে ঘাম উঁকি দেয় সে ভাঁজে।

ওদিকে আজিরন বেগম হাসপাতালের বারান্দায় জায়নামাজে বসে পরেন। 

রাফিদ থেকে থেকে পায়চারি করছে, কিছুক্ষণ পর পর তার ফোনটা বেজে উঠছে আর রাফিদ কেটে দিচ্ছে। সে জানে এজন্য তার কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে তবুও কল ধরে ঝাঁঝালো গলা শোনার ইচ্ছে তার এই মুহূর্তে হচ্ছে না। 

পরদিন বেলা ৮টার দিকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো।

‘ডাক্তারসাব কি হইছে তেনার? উনি ভালা হয়ে যাইবেন তো?’

‘আপনার সাথে আর কে আছে? 

‘জি, আমি ওনার ছেলে।’

‘আমার সাথে চেম্বারে আসুন।’

ডাক্তারের রুম থেকে ফিরেই রাফিদের চেহারা ফ্যাকাসে দেখায়।

‘কিরে বাজান কি কইলো ডাক্তার? তোর আব্বা ভালা হইয়ে যাইবো তো?’

‘হ্যাঁ, তুমি চিন্তা করে না।

কয়েকদিন পর আব্দুল বাতেন একটু সুস্থ হয়। ডাক্তার তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। এখন তার সঠিক যতœ দরকার,  পরিবারের সবার ভালোবাসা দরকার। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও হার্টের অপারেশন জলদি করাতে হবে নইলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।   

রাফিদ তার বাবাকে বাড়ি নিয়ে আসে। কিন্তু এটা বাড়ি কোথায়? আব্দুল বাতেনের কাছে এটা দোযখ মনে হয় যেখানে প্রতিমুহূর্তে জ্বলছে তার স্ত্রী, ছেলে আর সে।

আগে তাও বৌমার উচ্চ আওয়াজের বিপরীতে ছেলের নিচু গলার আওয়াজ শোনা যেত যা তাদের অসহায় মনকে একটু শান্ত¡না দিত কিন্তু ইদানিং সেটাও বন্ধ। প্রথম প্রথম ছেলের উপর অভিমান হলেও এখন ওর প্রতি মায়া হয়। বেঁচে থেকেও প্রতিদিন যে পুরুষের  আত্মা পুড়ে যায় তার মত দুর্ভাগা আর কে আছে? আব্দুল বাতেন শিক্ষিত মানুষ না তবুও বিভিন্ন সময় নারী নির্যাতন নিয়ে বহু আলোচনা হতে শুনেছেন কিন্তু কখনও পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে শোনেননি। তাহলে তার ছেলের এই অবস্থাকে তিনি কি বলবেন? শরীরে হাত তুললে সেটা নির্যাতন আর মানুষিকভাবে প্রতিমুহুর্তে কুচিকুচি করে কাটলে সেটার কি নাম দেওয়া যায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না আব্দুল বাতেন।

রাত তখন প্রায় একটা, আব্দুল বাতনের চোখে ঘুম নেই, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর ঘরের ভেতর বইছে ঝড়। সে ঝড়ের গর্জন নিজ রুমে শুয়েও শুনতে পায় আব্দুল বাতেন আর আজিনর বেগম। প্রচন্ড ডাক পরার আওয়াজে ছোট বাচ্চা যেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে আজিরন বেগমও তেমনি কেঁপে কেঁপে উঠছে। ওঘর থেকে ভাঙ্গচুরের শব্দ আসছে সাথে বৌমার চিৎকার।

‘আস্তে কথা বলো সাথী। বাবা-মা শুনবে।’

‘শুনতে পেলে কি হ্যাঁ! শুনুক তারা। তাদের শোনার জন্যই বলছি।’

‘সাথী চুপ করো বলছি, বাবা অসুস্থ।’

‘বুড়ো বয়সে অসুস্থ হবেন এটাই স্বাভাবিক আর কত দিনই বা বাঁচবেন? এমনিতেই তো মরার বয়স হয়েছে তাহলে এতো টাকা নষ্ট করে হার্টের অপরেশন করানোর কি দরকার?’

‘উনি আমার বাবা। সে আমাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি  করেছেন। তাছাড়া তোমার বাবার উচ্চাকাঙ্খা মেটাতে গিয়ে আমার বিয়ের জন্য ভিটেমাটি পর্যন্ত বেঁচে দিয়েছেন। এখন আমি না দেখলে কে দেখবে? কোথায় যাবেন তারা বৃদ্ধ বয়সে?’

‘উনি যা করেছেন তা সব বাবারাই করে এটা তার দায়িত্ব ছিলো। আর যাওয়ার জায়গা নেই কে বলেছে, ওনাদের মতো বোঝা নিরাপদে রাখার জন্যই বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়েছে। ওনাদের নিয়ে তোমার এতো ইমোশনাল হবার কি আছে আমি বুঝি না। 

‘তুমি এটা বুঝবেও না সাথী কারন তোমার সে মনই নাই। আর আমি কখনো তাদের বলতে পারবো না তোমরা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাও। তারা এখানেই থাকবে আর আমি বাবার অপারেশন করাব।’

‘বাজে কথা বলবে না রাফিদ। আমি ফ্ল্যাটের বুকিং দেব। ঢাকা শহরে আর কতদিন এভাবে ভাড়া গুনবো? বহু কষ্টের টাকা এভাবে নষ্ট করতে দেব না। আর কান খুলে শুনে রাখ, আমিও চাকরি করি সুতরাং টাকা তোমার একার না আমারও সমান অংশ তাই এই অপারেশন আমি হতে দেব না।’

‘ফ্ল্যাট পরেও কেনা যাবে কিন্তু বাবা ...’

‘আহ্ ...... আর কোন কথা শুনতে চাই না। আমি এই অপারেশন করাতে চাই না। এনিয়ে আর কোনো তর্ক আমি শুনতে চাই না। এরপরও যদি তুমি বাড়াবাড়ি করো তাহলে আমি আগুন লাগিয়ে দেব তোমার সংসারে তারপর চিরতরে চলে যাব বাবার বাড়ি আর তুমি সারাজীবন পরে থাকবে ওই বুড়ো দুটোকে নিয়ে।’

এবার রাফিদের গলা আর শোনা গেল না। হয়ত এবার আর প্রতিবাদের ভাষা নেই তার কাছে।

ছেলে-বৌয়ের ঝগড়া শুনে মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছে আজিরন বেগম।

‘কাইন্দো না রাফিদের মা। আমাগো সাথে আল্লাহ্ আছেন তিনি সব ঠিক কইরা দেবেন। আমার হার্টের অপারেশ লাগবো না, দেইখো আমি এমনই ভালা হইয়া যামুনে। তয় আমার যদি টাকা থাকতো ডাক্তাররে কাইতাম বৌমার বুক অপরেশন কইরা দেখতে ওইখানে কি সত্যিই হৃদয় বইলা কিছু আছে আছে নাকি পুরাটাই পাথর?’

‘রাফিদের আব্বা আমি আর এইহানে থাকমু না। আপনি আমারে অন্য কোনহানে নিয়া চলেন। এইহানে আমার দম বন্ধ হইয়া যাইতাছে।’

‘যাইবা রাফিদের মা! গাছতলায় থাকবার পারবা? এহন তো আমি পথের ফকির, তোমারে দুইবেলা খাওয়াইতেও পারমু না।’

‘হ, পারমু। এই দালানে থাকার চাইতে গাছতলায়ও শান্তি পামু। এতো অপমানের গোশতো ভাতের চাইতে নিঝগড়ার উপসোও ভালা।’

চারিদিকে এখন আলো ফুটছে, ফুরফুরে বাতাস বইছে। আব্দুল বাতেন স্ত্রীর হাত ধরে পার্কের একটা বেঞ্চে এসে বসলো। কৃষ্ণচূড়া গাছে লাল ফুল ধরেছে, গাছে গাছে পাখি ডাকছে। প্রকৃতি আজ বড্ড সুন্দর আয়োজন করেছে যেমনটা করেছিলো বহু বছর আগে তাদের বিয়ের সময়। 

অজিরন বেগম স্বামীর কাধে মাথা রেখে বসে আছেন, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে, বাতাসে তার ঠোঁট কাঁপছে। আব্দুল বাতেন পরম মমতায় স্ত্রীর মাথায় হাত রাখেন। আজিরন বেগম চোখ তুলে স্বামীর দিকে তাকায়, চার দেওয়ালের বন্ধিশালা থেকে মুক্তির আনন্দে দুজনের চোখেই তৃপ্তির হাসি উছলে পড়ে।


অফিসে যাবার আগে রাফিদ বাবা- মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে তারা ঘরে নেই। বুকটা কেমন ধক্ করে ওঠে ওর, মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন তাদের পাওয়া যায় না তখন রাফিদের বুঝতে বাকি থাকে না আসল ঘটনা। বাবা-মা তাদেরকে মুক্তি দিয়ে চলে গেছে, দূরে বহুদূরে। 

রাফিদের মুখটা কালো হয়ে যায়, শুক্নো বুকটা হাহাকার করে ওঠে। বাবা-মা তাদেরকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে এটা মানতে কেন জানি কষ্ট হয় তার।

ওদিকে সাথী খুব খুশি আজ, নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হয় আর কোন বাড়তি ঝামেলা নেই তার সংসারে, এখন কেবল সুখ আর সুখ। এই সুখবরটা মাকে জানাতে কেবল মোবাইলটা হাতে নেয় সে ঠিক এমন সময় বোনের ফোন আসে। রিসিভ করেই সাথী হাসিমুখে বলে ‘জানিস আজ আমার সব দুশ্চিন্তা শেষ হয়েছে। আমার শ্বশুড়- শ্বাশুড়ি আজ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।’

ঠিক তখনি ওপাশ থেকে বোনের কান্না শুনতে পায় সাথী।

‘আপা, মা খুব অসুস্থ। হসপিটালে নিতে হবে তুমি জলদি চলে আসো।’

কথাটা শোনা মাত্রই সাথীর পুরো দুনিয়াটা কেঁপে উঠলো, আকাশ ভেঙে পড়লো তার মাথায়। মা তাদের দুই বোনের একমাত্র সম্বল।

বছর খানিক আগে হঠাৎ করে বাবাকে হারিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরেছে দুই বোন। ছোট বোন এখনো লেখাপড়া করছে। মায়ের আর বোনের সমস্ত দায়িত্ব সাথীর উপর। মা থাকবে না একথা সে চিন্তাও করতে পারে না। 

সাথী দ্রুত মায়ের কাছে ছুটে যায়। দুইদিন পর শুকনো মুখে ফিরে আসে হসপিটাল থেকে।  হার্ট অ্যাটাক করেছে তার মা, এখনই অপরেশন করাতে হবে। অনেক টাকা দরকার।

ফ্ল্যাট কেনার টাকাগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাথী। ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া ছিলো তার স্বপ্ন অথচ আজ তার সে স্বপ্নের ইতি ঘটবে। তবুও সাথী তৃপ্তির হাসি হাসে কেননা সন্তান হিসাবে সে তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে।

তার স্বপ্ন থেকে তার মা অনেক বড়। সুতরাং  সে তার স্বপ্ন দিকে তাকায় না; তাকায় তার মায়ের দিকে। 


সাথীর মুখে আজ অনেকদিন পর হাসি ফুটেছে। আজ তার মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। ওর বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর সরে গিয়েছে, মা হারানোর যন্ত্রণা তাকে পেতে হয়নি এটাই আল্লাহ্ কাছে অনেক শুকরিয়া।

হঠাৎ করে ফ্ল্যাটের মালিক ফোন করে। অপমানিত হবার লজ্জায় সাথীর দু’চোখে পানি চলে আসে, ভয়ে ভয়ে বলে ‘ভাই আমার মায়ের অসুস্থতার কারণে ফ্ল্যাট কেনার টাকা খরচ করতে হয়েছে। আমরা ফ্ল্যাট নিতে পারছি না, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন।’

ঠিক তখনই ওপাশ থেকে হাসির রোল পড়ে যায় ‘কি বলছেন ম্যাডাম, আপনারা তো প্ল্যাটের পুরো টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন। আপনারা চাইলে যে কোন সময় ফ্ল্যাটে উঠতে পারেন। সময় করে এসে কাগজপত্র নিয়ে যাবেন।’

কথাটা শুনে রাফিদ আর সাথী দুজনেই খুব অবাক হয়ে গেল। এ কি করে সম্ভব? নিশ্চয়ই কোন ভুল হয়েছে, হয়ত ভুল করে তাদেরকে ফোন করেছে। ওনার ভুল ভাঙ্গানো দায়িত্ব নিয়ে দুজনে দ্রুত চোখের নিমিষে ছুটে যায় ফ্ল্যাটে।

ফ্ল্যাটের মালিক রাফিদ আর সাথীকে দেখে মুখে একটা চওড়া হাসি এনে দৌড়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র নিয়ে আসে। কাগজে চোখ বুলিয়ে দুজনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

হ্যাঁ, তাইতো ফ্ল্যাটের মালিকানায় রাফিদের নাম লেখা  কিন্তু এ কী করে সম্ভব! একটি টাকাও দেয়নি তারা তাহলে কি করে হলো এসব? নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে দুজনের মনে। এমন সময় রাফিদ একটি চিঠি দেখতে পায়, সে এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা শেষ করে।

চিঠিটা পড়ে রাফিদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়, পা দুটো টলতে থাকে। যে মানুষ দুটোকে তারা এত অবহেলা করেছে, এতো কষ্ট দিয়েছে তারাই কি না বাবার অপারেশন না করিয়ে ফ্ল্যাটের টাকা বুকিং দিতে চেয়েছে আর সেই বাবা তার জন্য এই ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে কিন্তু এ কি করে সম্ভব? যে বাবাকে নিঃস্ব অসহায় ভেবে সাথী দিনের-পর-দিন কটাক্ষ করেছে কটুক্তি করেছে সেই বাবা তার তিল তিল করে গচ্ছিত টাকা দিয়ে রাফিদের স্বপ্ন পূরণ করেছে। 

রাফিদের দু’চোখে বান ডাকে। মা-বাবার প্রতি করা অন্যায়ের অনুতপ্তে তার বুকের ভেতরটা ফেটে যায়। যে মানুষ দুটোকে এত অবহেলা করেছে একটা মুহূর্ত যাদেরকে শান্তি দেয়নি সেই মানুষ দুটোই তাদের শান্তির জন্য গোপনে এতো কিছু করেছে!

বাবার হার্টের অপারেশন করা জরুরি  অথচ তার পরিবর্তে বাবা; না, আর ভাবতে পারে না রাফিদ। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়, সাথীও তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। রাফিদ আর সাথী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায়, পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে বাবা-মাকে। শহরে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়ায় কিন্তু কোথায় তার বাবা- মা? 

রাফিদ মনে মনে বলে বাবা-মা তোমরা একটি বার ফিরে আসো তোমাদের মাথায় তুলে রাখবো। তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। মা তুমি কোথায়? বাবা তুমি কোথায়? কিন্তু এই অচেনা শহরের প্রতিটি দেওয়ালে সেই কথা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে শুধু ফিরে আসে না বাবা-মা।

হারিয়ে যাওয়া মানুষকে হয়ত খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু আতœ গোপনে থাকা মানুষকে কি কখনো খুঁজে পাওয়া যায়?

শিরোমনি, খুলনা।


পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 



গাছবৃষ্টি

মিসির হাছনাইন 


এই যে আকাশের নীল রঙ দেখলে

এসব শরতে আমার যেন কি হয়!

খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই সবকিছু।

মনে হয় গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি,

আর নদীর ভেতরে বেড়ে ওঠে আমার ছায়া;

নিজকে মনে হয় কত বছরের পুরনো।

তোমাকে আকাশের পথে হাঁটতে দেখি

মনে মনে ভাবতে থাকি আহা!

যদি পাখি হতাম তোমার আকাশের নীল

রঙে উড়তে উড়তে তোমাকে ছুঁয়ে দিতাম।

তারপর খুব গোপনে আমরা ঢুকে যেতাম

মেঘের ভেতরে; তোমার মুখ পানে চেয়ে

গভীর প্রেমের কতগুলো সূত্র মনে পড়ে।

এরপর দেখি আকাশ কাঁদে-আমিও কাঁদি...

হয়তো এর নাম শরতের হঠাৎ বৃষ্টি

আমরা দেখি- খুব ধীরে উবে যাচ্ছে একটা মানুষ;

ওরা দেখে-মানুষের গায়ে ঝরে পড়ছে গাছবৃষ্টি।


ফুলের ইশকুলে শেখা

অসীম মালিক


তৈরী হয়েছে এক মানচিত্র,

টানা হয়েছে অনেক রেখা।

মেঘ, রোদ, বৃষ্টির ইশকুলে

বন্ধু, কিছুই হয়নি শেখা।


রোদের ইশকুলে কাঁটাতার !

এ বৃষ্টির ব্যাকরণে লেখা।

মেঘের কোনও সীমান্ত নেই

আকাশের চোখে দেখা।


আমরাই শুধু সীমান্ত খুঁজি,

দু’হাতে টানি অদৃশ্য রেখা।

বদলায়না, মাটির গন্ধ

সব, ফুলের ইশকুলে শেখা।


পরিত্যাজ্য নাম

সুজন আরিফ


সেই পরিত্যাজ্য নামটি

আর মুখে নেই নি।


অধিকাংশ জল’ই ঘোলা হয়ে গেছে

ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে

দুই পাড়’ই যে চূর্ণ-বিচূর্ণ;

আমার চারপাশেই এখন

রাক্ষসী নদীর পাহারা

তবুও একলা চলার নীতি নিয়ে

শূন্যতাকেই ধরে আছি।


আমি জানি

শেষ পর্যন্ত দূরে থাকাই ভালো

নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রের মতন

কেবল সতন্ত্র সত্তার জোরালো জানান

অথচ আলোর এতটুকু কমতি নেই

মানুষ, সেতো ক্লান্তিহীন এক প্রজাপতি

কাক্সিক্ষত সুখে অবিরাম ওড়াউড়ি ।


শুধু অর্ধযুগ কেন

শত যুগেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা

আমি এক সুবোধ পাহাড়

অভিমানী মেঘকে ছুঁয়ে ছুঁয়েই শুধরে নেবো

এই জীবনের যাবতীয় ভুল

অন্ধ প্রেমিক ফিরে পাবে

অকালে হারিয়ে ফেলা অতিপ্রিয় প্রণয়ের কূল।


সেই পরিত্যাজ্য নামটি

আর মুখে নেই নি।


পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২

 



হাওর সুন্দরীর টানে ভ্রমণবিলাসী মন

গোলাপ আমিন


হাওরবিলাসে মিটে যায় আমাদের সমুদ্র দর্শনের অপূর্ণ সাধ,

কোনো এক ছলে যেন আমাদের উঠতি তরুণের মনের কোণে,

পিরিতের আগুন ঢেলে দিয়ে উস্কে দেয় দারুণ উচ্ছ্বাস।

মনের অজান্তে ভাটিয়ালি মাঝির মতো সুরে সুরে গেয়ে ওঠে গান,

তাপিত হৃদয় শীতল হয়ে ওঠে হাওরবিলাসী নান্দনিক দর্শনে।

তার বুকে ভালোবাসার টইটম্বুর রাশি রাশি জল-যন্ত্রণা,

উছলে পড়া রূপ-যৌবনের আকর্ষণে ছুটে যায় মানব-মন,

বাড়বাড়ন্ত জলে বড়’ই সৌন্দর্য উপভোগ করে প্রাণ ভরে সকলে,

কোনো বাসনার মায়াবী হাতছানিতে ডেকে নিয়ে যায় গোপন অভিসারে,

সাগরিকার নির্ভেজাল নিপুণ ও নিখুঁত সহোদরা হাওরসুন্দরী।

ছলাৎ ছলাৎ ছলকায় ছিটকে পড়া শান দেওয়া জলের ঝিলিক,

পানির তোড়ে ভেসে আসা ছোট ছোট ঢেউ যেন নাবালিকার বক্ষোজ,

মাঝে মাঝে আমরাও কম্পিত হাতে ছুঁয়ে দেখি তার ভাঁজে ভাঁজে,

বেনোজলে বেহুলার ভেসে চলা, লখিন্দর যেন এক স¦ার্থক প্রেমিক।

অষ্টাদশী যুবতীর মতো এলোকেশ খুলে স্নানরত হাওরসুন্দরী,

বাউরি বাতাসে তার কখন যেন উড়ে গেছে শাড়ির আঁচল,

চিত হয়ে শুয়ে থাকা নগ্ন নারীর মতো সুবিশাল এক জল-ভাস্কর্য,

ভ্রমণবিলাসী মনে আনন্দ আনয়নে হাওরসুন্দরী যেন চতুর ছিনাল।



রোদ ছুঁয়ে যায় 

শাহীন রায়হান


রোদ ছুঁয়ে যায়

দামাল বাতাস কিচিরমিচির পাখি

আলতো করে ফুল পরী গাঁও খুকুর দু’টি আঁখি।


শান্ত দিঘির ফড়িং ছানা

শরৎ মেঘের নরম ডানা

শিশির মাখা ঘাসের ডগা

কনকচাঁপা ফুল।

বিলে ঝিলে বউ টুবানি

কলমিলতার গুনগুনানি

রঙিন ঘুড়ির কাটাকুটি

দুষ্ট খোকার চুল।


আকুল করা চোখের দু’কোণ

মন ছোঁয়া গান লাল টেলিফোন

ফড়িং ছানার সুখ।

রিনিকঝিনিক পাতার নূপুর

উদাস করা গাঁয়ের দুপুর

বাংলা মায়ের মুখ।




চম্পাবতী বেদে যায় 

মফিদুল ইসলাম


চম্পাবতী বেদে যায় মাঠের পথে দূরের গাঁয়,

ঝুম ঝুম ঝুম ঝুমকা নূপুর বাজছে যে তার রঙিন পায়।

হলুদধোঁয়া হাত দু’খানি কলমি ফুলের গয়না পরে,

গাঁয়ের পথে চলছে হেঁটে সাপের ঝাঁপি মাথায় ধরে।

নূপুর পায়ে ঝুমুর তালে মাঠ কাঁপিয়ে, বন কাঁপিয়ে, 

ক্ষনেক থেমে, ক্ষনেক হেসে, পিছন ফিরে ঘাড় বাঁকিয়ে ।


মেঘ কুচ কুচ কেশের বাহার, ঠিক যে গাঢ় বনের ছায়া, 

কালো মেঘের আড়াল দিয়ে, মুখখানি তার মিষ্টি মায়া।

ভ্রমর-কালো চোখ দু’টিতে ভাসছে যেন মেঘের মেলা,

তারি মাঝে থেকে থেকে বিজলি মেয়ে করছে খেলা।

মায়ার পরশ দেয় বুলিয়ে সেই না চোখের আড়াল দিয়ে, 

পথের মাঝে তারই রেখা আঁকছে ছবি ছন্দ নিয়ে ।


দীঘল বাঁকা পথটি ধরে চম্পাবতী যায় যে হেঁটে, 

মাথার উপর শঙ্খচূড় আর দিগরাজেরা পড়ছে ফেটে।

ছন্দ তালে তাল মিলিয়ে ঝাঁপির মাঝে তুলছে ফণা, 

ছন্দে তালে উড়ছে সাথে ধূসর পথের বালুকণা।

চম্পাবতী বেদেনী গো মাথায় নিয়ে সাপের ঝাঁপি, 

বাড়ি বাড়ি ফিরছো ঘুরে গাঁয়ের বাঁকা পথটি মাপি ।


বেদের মেয়ের শাড়ির আঁচল বাউরি বায়ে নাচছে উড়ি,

নদীর বুকে পাল তোলা নাও ঠিক যেন এক আকাশ-ঘুড়ি ।

তাঁর সে চলার পথটি চেয়ে রাখাল ছেলের থামছে বাঁশি, 

দূর থেকে সে দেখছে তাঁরে আপন মনে উঠছে হাসি।

বেদের মেয়ে তুমি ওগো আসো যদি আমার বাড়ি, 

মেপে দেব পাঁচ ঘটি চাল, মাটির ঘড়া, রঙিন হাড়ি।

এই ভাবেতে চলতে গিয়ে পড়লে খসে উত্তরীয়, 

সাপের ঝাঁপি নামিয়ে রেখে ক্ষনেক তুমি জিড়িয়ে নিও।


যে শোধ জীবনের 

সাদ্দাম মোহাম্মদ


গড়তে গেলে ভেঙে যায়

লড়তে গেলে যাই হেরে,

একটা মানুষ একজীবনে

কতটা উঠতে পারি পেরে!


সবার থাকে অনেক চাওয়া

আমার খুবই কম ছিলো,

কম থাকাতেই হয়তো জীবন 

এমন করে শোধ নিলো...


মনের মুকুরে

মনের মুকুরে

 


মনের মুকুরে

শহিদুল ইসলাম লিটন


চৌধুরী সাহেবের একমাত্র আদরের নাতি তার নাম হৃদয়। বয়স ষোল, দশম শ্রেণিতে পড়ে। হৃদয় সবসময় নতুন কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে তার দিন কাটে। আজ সে দাদাকে খুব বেশি চেপে ধরেছে যে, দাদা তাকে এমন একজন কীর্তিমান মানুষের গল্প শোনাতে যার জীবন কাহিনী শুনে সে খুব অনুপ্রাণিত হয়। দাদা নাতীকে প্রশ্ন করেন কি দাদা ভাই দেশের না বিদেশের লোকের গল্প শুনতে চাও? নাতী দাদাকে বললো আগে আমার দেশের মানুষের গল্প শুনি। দাদা বললেন, তুমি যদি ধৈর্য্য সহকারে মনযোগ দিয়ে আমার গল্প শোনো তাহলে আমি তোমাকে এমন একজন মহান দেশপ্রেমিক নেতার গল্প শোনাবো, যিনি আমাদের দেশের লোক হয়েও দেশে বিদেশে ছিল তাঁর প্রচুর সুনাম। তাঁর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মধুমতি নদীর জলস্নাত অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের এক সবুজ শ্যামল গ্রাম যার নাম টুঙ্গিপাড়া। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল খোকা। ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নানা তাঁর নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। একজন নীতিনিষ্ট দেশ প্রেমিক নেতা হিসাবে ক্রমান্বয়ে তিনি সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে তিনি আমাদের দেশে জাতির জনক উপাধিতে ভূষিত হোন। তিনি যখন ব্রজ্রকণ্ঠে ভাষণ দিতেন সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর ভাষণ শুনতো। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি যে ভাষণ দেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো, তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর এই কালজয়ী ভাষণ শুনে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের কাংখিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনেক জেল-জুলুম আর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে। সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত হয়ে একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিক নেতা হিসেবে সকলের কাছে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। তিনি আরও বলেছিলেন সাত কোটি বাঙ্গালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারবো, কিন্তু বাংলার মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারবো না। তাঁকে উদ্দেশ্য করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজি এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবেনা। যিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি, ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলার রাখাল রাজা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, তাঁর জন্ম না হলে আমরা পেতাম না স্বাধীন দেশ এবং ঘন সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত সম্বলিত সবুজ পতাকা। এই মহান নেতাকে ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট ধানমন্ডির তাঁর বাসায় স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তাঁর মতো একজন মহান নেতার আদর্শ আমাদের মনের মুকুরে যদি চিরকাল ধরে রাখতে পারি তবেই স্বাধীন জাতি হিসাবে আমরা যথাযথভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা উপহার দিতে পারবো। দাদার মুখ থেকে একজন মহান নেতার জীবন কাহিনী শুনে নাতি মনে মনে চিন্তা করে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন যেদিন দেশে কায়েম হবে আমরা যেদিন ভুখা নাঙ্গা মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে পারবো, দুর্নীতি যেদিন দেশ থেকে চিরতরে দূর হবে, স্বাধীন পতাকার মান বজায় রেখে আমরা যখন বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষুধা ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিতে পারবো তবেই সেদিন বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে। দাদার নিকট থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনের জানা-অজানা অনেক মূল্যবান কথা শুনে নাতী দাদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রশান্ত চিত্তে বিদায় নেয়। এই গল্প সারা জীবন তার মনের মুকুরে চির অ¤¬ান হয়ে থাকবে।