ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৯৯

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৯৯

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর।। বর্ষ ৮ম।। সংখ্যা ১৯৯,

শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫























বিপ্লবী চেতনার রোমান্টিক কবি

বিপ্লবী চেতনার রোমান্টিক কবি

 

     বিট্রিশ কবি পার্সি বিসি শেলি, জন্ম : ০৪ আগস্ট ১৭৯২, মৃত্যু : ০৮ জুলাই ১৮২২


পার্সি বিসি শেলি

বিপ্লবী চেতনার রোমান্টিক কবি

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


পার্সি বিসি শেলি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি এবং ইংরেজি কাব্য সাহিত্যে অন্যতম প্রধান কবি। তিনি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে স্বল্পপ্রাণ এক ক্ষণজন্মা। মাত্র ২৯ বছরের জীবনেই রচনা করে গেছেন অমর কাব্য-সম্ভার। তার কাব্যের আবেদন আজও সমুজ্জ্বল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুগ্ধ হয়ে আছে শেলির কবিতায়। কাব্য প্রেমিদের পছন্দের তালিকায় এখনও শেলির নামটি শীর্ষে থাকে। রোমান্টিক ধারার এই কবি ইংরেজী কবিতার ছন্দের জাদুকর হিসেবেও স্বীকৃত। তিনি, জন কিটস এবং লর্ড বায়রন মিলে ইংরেজী সাহিত্যে রোমান্টিক ধারার সূচনা করেছিলেন। তারা তিনজনেই ইংরেজী কাব্য সাহিত্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে গেছেন। ১৭৯২ সালের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ডের সাসেক্সে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বাবা মিস্টার টিমথি শেলি ও মা এলিজাবেথ পিলফোর্ডের ঘর আলো করে তিনি জন্মে ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি তার প্রতিভা ও বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দিতে থাকলেন। তার লেখা, নিজস্ব আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা দিয়ে খুব কম বয়সেই তিনি খ্যাতিমান হয়েছেন। লিখে গেছেন এডোনাইস, ওড টু দা ওয়েস্ট ওয়াইন্ড, ওড টু এ স্কাইলার্কের মতো বিখ্যাত সব কবিতা। যার লেখায় রয়েছে বিপ্লব, বিদ্রোহ ও আদর্শের ছোঁয়া।


অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ঘটে যায় এক বিপ্লব। যেটি প্রজাদের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘোষণা করার বিপ্লব। বুর্জোয়াদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পোলেতারিয়াতদের জেগে ওঠা এবং ধনী-গরিবের মাঝে ভেদাভেদ দূর হওয়ার বিপ্লব। যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল মানবপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা। এ বিপ্লবে ধ্বংস হয়ে যায় রাজতন্ত্র। তৈরি হয় পার্লামেন্ট নির্ভর শাসনের প্রয়োজনীয়তা। সবার মাঝে ফিরে আসে সাম্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিপ্লব ফরাসী বিপ্লব নামে পরিচিত। যে বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। সমাজ এবং মানুষের জীবন-মান, চিন্তা-চেতনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেগেছিল এর ছোঁয়া। তেমনি সাহিত্যেও লাগে এর ছোঁয়া। ফরাসী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া রুশো ও ভলতেয়ারের কথাগুলো প্রভাবিত করে সাহিত্যিকদেরও। সাহিত্যিকরাও তখন চিন্তা করলেন শুধু উচ্চবিত্তদের নিয়ে সাহিত্য রচনা না করে সাধারণ ও নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের নিয়েও সাহিত্য রচনা করতে হবে। তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবিও ফুটিয়ে তুলতে হবে। সে জন্য সাহিত্যের ভাষাও হতে হবে সহজ ও সাবলীল এবং সবার জন্য প্রযোজ্য। তাই ১৭৯৮ সালে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ ‘প্রিফেইস টু দ্য লিরিক্যাল ব্যালাডস’ (চৎবভধপব ঃড় ঞযব খুৎরপধষ ইধষষধফং) নামক একটি বই লিখে সূচনা করেন সাহিত্যের নতুন একটি বিপ্লবী যুগের। যাকে রোমান্টিক যুগ নামে আখ্যায়িত করা হয়। যে যুগের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন শেলি নিজেও। তার লেখার মাঝেও ফুটে উঠেছে এই যুগের বৈশিষ্ট্য।


ছেলেবেলা থেকেই তার চারিত্রিক রূপে ফুটে উঠত সেগুলো। ১০ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ছিলেন সিয়ন হাউস একাডেমিতে। এরপর ১৮০৪ সালে ভর্তি হন ইটন কলেজে। এখানেই প্রথম তার বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ পায়। ইটনের পুরনো প্রথা অনুযায়ী সিনিয়ররা জুনিয়রদের দিয়ে তাদের কাজকর্ম করিয়ে নিত। এ ছাড়া বিভিন্ন ফরমায়েশ খাটাত। শেলির সঙ্গে এসব করতে এলে শেলি এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এমনকি এক ছেলের হাতে পেন্সিল কাটার বসিয়ে দেন। তারপর থেকে সবাই সাবধান হয়ে যায়। তার সাথে আর কেউ এমন আচরণ করার সাহস পায় না। সেখানে থাকা অবস্থায় তার লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৮০৯ সালে একটি লেখা ছাপিয়ে তিনি প্রকাশকের কাছ থেকে ৪০ পাউন্ড পুরস্কার লাভ করেন। ১৮১০ সালে ভর্তি হন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে। তার মাথায় তখন সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা ও ধর্মচিন্তা সম্পর্কে বিরূপ চিন্তাভাবনা কাজ করে। তখনই বন্ধুত্ব হয়ে উঠে টমাস জেফারসন হগের সঙ্গে। দু’জনের চিন্তাভাবনা প্রায় একই রকমের ছিল। তাই কিছু দিন পর দু’জন মিলে লিখে ফেলেন ‘দি নেসেসিটি অব এথেইজম’ বা ‘নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা’ নামে একটি গ্রন্থ। তখনকার সময়ে ধর্মবিরোধীদের প্রচুর শাস্তি দেয়া হতো। তাই এই গ্রন্থ প্রকাশ করার কারণে ১৮১১ সালে শেলি ও হগ দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেন। শেলির বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। পরিবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। ফলে জীবনের বাকি সময়গুলো খুব সংগ্রাম করে কাটাতে হয়। শেলির চিন্তাচেতনায় একাত্মতা পোষণ করার কারণে সবার বারণ সত্ত্বেও ১৮১১ সালের আগস্টে হ্যারিয়েট তাকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে চার্লস নামে এক পুত্রসন্তান জন্মলাভ করে। যদিও সে বিয়ে সুখের হয়নি। ১৮১৬ সালে অজ্ঞাত কারণে হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করেন। সে বছরই শেলির বিয়ে হয় গডউইনকন্যা মেরির সাথে। যিনি শেলির সহচার্যে ও অনুপ্রেরণায় একজন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক হয়ে উঠেন। যাকে আমরা মেরি শেলি নামেই চিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অটুট ছিল।


শেলি ব্যক্তি জীবনে খুব অগোছানো থাকলেও তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকায় সাহিত্য রচনায় মগ্ন ছিলেন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। তাঁর রচিত কাব্যগুলো হচ্ছেন ‘কুইন ম্যাব’ (১৮১৩), ‘অ্যালাস্টার’ (১৮১৫), ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ (১৮১৮-১৯), ‘দি চেনসি’ (১৮১৯),, ‘জুলিয়ান অ্যান্ড ম্যাড্ডালো’ (১৮১৮), ‘দি মাস্ক অব এনার্কি’ (১৮১৯), ‘দি উইচ অব এটলাস’ (১৮২০), ‘এপিসাইচিডিয়ন’ (১৮২১) এবং ‘এডোনাইস’ (১৮২১)। তাঁর রচিত সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ হচ্ছে ‘দি ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ (১৮২১)। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু গীতিকবিতা লিখেছেন। তাঁর লেখায় নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণাধারা, ফুল-লতাপাতা, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতি জীবন্ত রূপলাভ করেছে। ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট ওয়াইন্ড’ কবিতার মতো কখনো কখনো তাদেরকে আহ্বান করতেন ধরার সব অশুভ শক্তি জরাজীর্ণতা সব কিছু যাতে ধ্বংস হয়ে নতুন ও শুদ্ধ প্রাণে চারিদিক ছেয়ে যায়। সেখানে তিনি পশ্চিমা বায়ুকে বলেছেন, ঙ, রিহফ, ওভ ডরহঃবৎ পড়সবং, পধহ ঝঢ়ৎরহম নব ভধৎ নবযরহফ?’ এখানে শীত বলতে বুঝিয়েছেন পৃথিবীর জরাজীর্ণতাকে আর বসন্তকে নবজীবন এবং জরাজীর্ণতামুক্ত পৃথিবীর সূচনা হিসেবে। সত্যিই তো, শীতকাল এসে গেলে বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে? আবার ‘টু স্কাইলার্ক’ কবিতায় কবি স্কাইলার্কের গাওয়া গান শুনে বিস্মিত হন। স্কাইলার্ক চড়ুইয়ের মতো দেখতে এক ধরনের পাখি। কবি এর গানকে চাঁদের আলোর সঙ্গে তুলনা করেন। এর গান থেকে কবি নিজ আত্মার প্রেরণা নেন। মনে ইচ্ছা পোষণ করেন এই পাখিটির অর্ধেক আনন্দও যদি তিনি লাভ করতে পারতেন! কিন্তু পাখিটির মতো মানুষের মন এতটা প্রাঞ্জল নয়। শত দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও মানুষ হাসে। তবে তার পেছনে যেন মনের লুকানো বেদনাই প্রকাশ পায়। তাই তো কবি বলেছেন, ‘ঙঁৎ ংবিবঃবংঃ ংড়হমং ধৎব ঃযবংব ঃযধঃ ঃবষষ ড়ভ ংধফফবংঃ ঃযড়ঁমযঃ...


 

তার রচিত ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ গীতিনাট্যটিতে ঈশ্বর জিউসের সঙ্গে দেবতা প্রমিথিউসের বিদ্রোহ দেখা যায়। গ্রিক পুরাণের ঘটনা অনুযায়ী, আদিম যুগে আগুন শুধু স্বর্গের দেবতারাই ব্যবহার করতেন। পৃথিবীতে আগুন ছিল না। জিউসের বারণ সত্ত্বেও দেবতা প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন বয়ে এনেছিলেন পৃথিবীতে মানব কল্যাণের জন্য। তার শাস্তিস্বরূপ জিউস তাকে শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সেই বিদ্রোহের ঘটনা শেলি দারুণভাবে ছন্দের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন।


‘জুলিয়ান এ্যান্ড ম্যাড্ডালো’ তে যেন নিজের চরিত্রের রূপই বর্ণনা করেছেন। ‘দি চেনসি’ নাট্যের নায়িকার নাম হচ্ছে বিট্রাইস। মেয়েটি নিজের বাবার কুপ্রবৃত্তির কারণে সতীত্ব হারায়। পরে পিতাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা যেন শেলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘এপিসাইচিডিয়ন’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন একটি মেয়ের কাহিনী। শেলি তখন ইতালির এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন।


সে সময়ের অন্যতম রোমান্টিক কবি কিটসের মৃত্যু হলে তিনি ‘এডোনাইস’ নামে একটি বিশাল এলিজি বা শোকগাথা লিখেন। সেখানে তিনি কিটসের প্রশংসা করেছেন। প্রকৃতি যেন কিটসের মৃত্যুতে শোকাহত। সবাই শোকে কাতর হয়ে গিয়েছিল। দারুণ সব উপমার সাহায্যে এঁকেছেন শোকাবহ দৃশ্য। অন্যতম সেরা রোমান্টিক কবি বায়রনকেও হাজির করেছিলেন কিটসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।


শেলি সারা জীবন অন্যায়-অত্যাচার, ধর্মের নামে শাসন-শোষণ, ভ-ামি, নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গেছেন। নিজের আদর্শকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে ত্যাগ করেছেন পরিবার ও পরিজন। প্রতিনিয়ত লড়ে গেছেন অভাব-অনটনের সঙ্গে। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার জ্ঞানসমৃদ্ধ সাহিত্য ভা-ার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৮২২ সালের ৮ জুলাই ইতালির পিসায় কবি বায়রন ও হান্টের সঙ্গে দেখা করার পর নৌকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে এই মহান কবি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর অন্যায়, শোষণ ও অত্যাচারকে ঝড়ের মতো উড়িয়ে দিয়ে সেই ঝড়ের মাঝেই যেন মিশে যান চিরতরে। শেলি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অকাল প্রয়াত এই তরুণ কবি পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আছেন।


কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক, আমেরিকা।


ডাকনাম

ডাকনাম

 

    


ডাকনাম

রফিকুল নাজিম 


চায়ের কাপে ঠোঁট দিয়েই মুচকি একটা হাসি ঝুলে গেল আমার ঠোঁটের কোণে! কী অদ্ভুত ব্যাপার! মনের ভেতর মন না থাকা বড্ড বিড়ম্বনার ব্যাপার। কখন কী ঘটে যায়- বলা মুশকিল। রমিজেরও এখন মনের ভেতর মন নেই। হয়তো গত রাতে বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে। হতে পারেই। রমিজদের ঘরের ফাঁকফোকরে হা করে অপেক্ষা করে অভাব। সেই অভাবগুলো একটু সুযোগ পেলেই হামলা করে। অভাবেরা ঝগড়া বাধায়। মারামারি বাধায়। রমিজেরও হয়তো তাই হয়েছে- তা না হলে আজকে রমিজের হাতের চা এতো বিস্বাদ হবে কেন! চায়ে চিনি নেই। দুধের অনুপাতও ভয়ংকর রকমের কম। অথচ এই রমিজের চায়ের সুখ্যাতি চারিদিকে। আমাকে সপ্তাহে দুইদিন মাধবপুর আসতে হয়। সুরমা চা বাগানে বিশেষ শিক্ষা প্রোগ্রাম চলছে। পাঁচ বছরের প্রোগ্রাম। আসা যাওয়ার পথে রমিজের টং দোকানের চার কাপ চা গেলার জন্য মুখিয়ে থাকি। কী দুর্দান্ত কম্বিনেশনে চা বানায় রমিজ! 

- কী মিয়া, মনটা আজ কই রাইখ্যা আইছো? আজ চা তো চা হয় নাই।

- কন কী, স্যার।

- হ। চায়ে দুধ চিনির কোনো কিছুই ঠিক হয় নাই। চায়ের পাতিও পানির তুলনায় কম মনে হইলো! আগের ফ্লেভার নাই।

- আইচ্ছা, স্যার। বহেন আপনে। আমি আরেক কাপ চা বানাইয়া দিতাছি।


কথাগুলো অন্যমনস্ক হয়েই বলছিল রমিজ। স্টেশনের চারদিকে তার চোখ ঘুরছে। স্টেশন ভর্তি লোকজন। খুব শোরগোল। কুলিদের চিৎকার চেঁচামেচি। হকারদের হাঁক-ডাক। চারদিকে কেবল শব্দ বোমা ফাটছে। আমি রমিজকে বোঝার চেষ্টা করছি। রমিজের চোখ স্টেশনে কী খুঁজছে? প্রিয় কোনো মুখ? নাকি পরিচিত কোনো চায়ের কাস্টমার? অথচ আমাকেও এই ট্রেন ধরেই ঢাকা যেতে হবে। কালনি এক্সপ্রেস ক্রসিংয়ে পড়েছে। সময় লাগবে। তাই আমার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। মনে হচ্ছে রমিজের হাতের চা না খেয়ে আমি যেতেই পারবো না। চায়ের প্রতি আমার নেশাটা বরাবরই বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত। আমি রমিজের চোখের রেটিনা ধরে দেখার চেষ্টা করছি- সে কী দেখছে?

- ঐ মিয়া, তুমি কী যেন খুঁজতাছো? কও আমারে। আমিও তোমারে সহযোগিতা করি।

- না, স্যার। তেমন কিছু না। তয় কিছু একটা ঘটতেও পারে। 

- কই- কী ঘটতে যাইতাছে। আমারেও দেখাও। আমিও মজা লই।

- না, মজা না। মনে হইতাছে বিপদ।

- কও কী, মিয়া!


রমিজ আমারে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় দেখালো। একটি যুবক। খুব উসকোখুসকো। লম্বা চওড়া যুবকের কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলানো। মাথার ক্যাপ দেখতে দারুন। ভ্যাগিক্যাপ। বিদেশীদের পড়তে দেখেছি। ফ্যাড জিন্স পরা যুবকটার গায়ে চে গুয়েভারার ছবি সংবলিত টি-শার্ট। বাম হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেটের অপমৃত্যু হচ্ছে। অথচ যুবকটা সিগারেটে টান দিচ্ছে না। পুড়ে পুড়ে সিগারেটটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে নীরবে। অথচ এই যুবক একমনে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটার হাতে আইফোন। বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি মোবাইলের ওপর প্রান্তের মানুষটার ওপর বিরক্ত। মাথাটা নিচু করে সেই যুবক মেয়েটার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তার হাঁটা চলাফেরা রহস্যজনক। রহস্যজনক না বলে সন্দেহজনক বললে ভুল হবে না। আচ্ছা- মেয়েটা কি যুবক এই ছেলের সন্দেহজনক গতিবিধি খেয়াল করেছে? হয়তো। এমনও হতে পারে- খেয়াল করলেও পাত্তা দিচ্ছে না। মেয়েরা এমনটা ঠিকঠাক ভাবে পারে। মনে যা মুখে তার ছাপ না রেখেই অভিনয় করতে পারে। কয়েকবার ছেলেটা প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে যাচ্ছে। অথচ একমনে মেয়েটা মোবাইলে কথা বলেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রমিজের কথাই সত্য। আপাততঃ যুবকের গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে- মেয়ের হাতের মোবাইলই তার টার্গেট। তাই আমি একটুকুন এগিয়ে গেলাম। সিনেমায় এমন দৃশ্যে নায়কের আগমন ঘটে। হিরোয়িক একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকে। তাই মেয়েটার সামনে হিরো হবার এমন সস্তা চান্স আমি হাত ছাড়া করার মত বোকা নই। তাই আমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- কী ঘটতে যাচ্ছে। ছেলেটা এবার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছে। ছেলেটার তাকানোর ভেতর এক সাগর তৃষ্ণা দেখেছি। কলি কালের চোরও কত রোমান্টিক হয়! শালার আমিই কেবল বেখাপ্পা রসকষহীন মানুষ। বউয়ের কাছে একটা কাঠখোট্টা যন্ত্র বিশেষ মাত্র। 


মেয়েটা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে রাখতেই একজন সুদর্শন পুরুষ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষটার কোলে চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। একদম পরীর মত। পুরুষটার কোলে বসে পুচকিটা বাবা বাবা বলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কটমট করে কিছু বলছে সাথের পুরুষকে। মনে হচ্ছে পুরুষটা অসহায়ভাবে মেয়েটার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি বেশ উপভোগ করছি ঘটনাটি। বেশ থ্রিলার টাইপ মনে হচ্ছে। এই যাত্রাপথে কত ঘটনার রাজ স্বাক্ষী আমি। দেখে মনে হচ্ছে তারাই পৃথিবীর সুখী পরিবার।


মেয়েটা মোবাইলটি তার পার্সে রেখেছে। পরীকে কোলে তুলে নিয়েছে। সেই সুদর্শন পুরুষ ব্যাগ দুটো নিয়ে ট্রেনের এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ‘ট’ বগির দিকে যাচ্ছে। আমার চোখ ছেলেটার ওপর। হঠাৎ খেয়াল করলাম ছেলেটা মেয়ের পিছু নিয়েছে। তাই আমিও ছেলেটার পেছন পেছন যাচ্ছি। ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠে গেল মেয়েটার পার্টনার। মেয়েটা বগিতে ওঠতে যেতেই ছেলেটা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল। মাথার ক্যাপটা আরেকটু টেনে বলল, ‘মিথি, ভালো থেকো।'’- কথাটা বলেই ছেলেটা ঘুরে দ্রুত পায়ে স্টেশনে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল। ছেলেটাকে আমি স্টেশনের কোথাও দেখছি না। শান্ত সৌম্য সেই মেয়ের বুকে তখন মেঘেদের গুড়–ম গুড়–ম নিনাদ। চৈত্রের খরা মুছতে বৃষ্টির অপেক্ষায় এলোপাতাড়ি ওড়ছে মেঘ। 


মনে হচ্ছে- মেয়েটা হঠাৎ ডাকে ভড়কে গেছে। মনে হলো হঠাৎ হারিয়ে ফেলা মূল্যবান কিছু একটা পথে খুঁজছে। মেয়েটা ট্রেনের বগিতে না ওঠে অস্থির চোখে সেই কণ্ঠটা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। হঠাৎ এমন ডাকে তার চোখে বান ে ডেকেছে। অথৈ জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে পাড় ভাঙছে। এইদিকে ট্রেনের হুইশেল বাজছে। সাথে সুদর্শন পুরুষের আচমকা ডাকে মেয়েটার সম্বিৎ ফিরে এসেছে। মেয়েটা বগিতে ওঠেছে। আমিও পেছন পেছন ওঠলাম। কী দৈব এক ঘটনা! আমার সিট পড়েছে মেয়েটার একদম সামনে। মুখোমুখি আসন। জানালার পাশে বসা মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে স্টেশন চত্বরে কিছু একটা খুঁজছে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। 


আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এমন লাস্যময়ী মেয়েকে আড়চোখে দেখতে দেখতে গন্তব্যে যাওয়া যাবে। সুযোগ পেলে মেয়েটার সাথে ছেলেটার সম্পর্কের রূপরেখাও আবিষ্কার করা যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই সুযোগটা এসে গেল। সুদর্শন পুরুষটা পরীর জন্য চিপস আনতে গেল। মেয়েটা তখনও ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে কোথায় যেন ডুবে আছে। পাশের ছোট্ট পরীর দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। বড্ড এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে।

- হ্যালো- আপনি কি মিথি? 

- এই নাম আপনি কি করে জানলেন?

- না মানে আপনাকে উদ্দেশ্য করে একটা যুবক এই নামে ডাকতে শুনলাম! সুন্দর একটা নাম।

- তার মানে আমি ভুল শুনিনি! সেটা তমালই ছিল? কত বছর পর এই নামে সে ডাকলো!


অস্পষ্ট স্বরে মিথি এই কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আমি শোনার চেষ্টা করছি। বাকি কথাগুলো ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মিথির চোখে বৃষ্টি নেমেছে। আমি সেই বৃষ্টি দেখছি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমাল নামটি কি মিথির দেয়া কিনা? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত অবস্থায় সে নেই। জানালায় মুখ রেখে মিথি কাঁদছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমালও কি মিথির মত এখন কাঁদছে? ট্রেনের ভেতরে তুমুলভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ প্রকৃতিতে হবু শীতে মিষ্টি রোদের চাষবাস চলছে।


রফিকুল নাজিম 


চায়ের কাপে ঠোঁট দিয়েই মুচকি একটা হাসি ঝুলে গেল আমার ঠোঁটের কোণে! কী অদ্ভুত ব্যাপার! মনের ভেতর মন না থাকা বড্ড বিড়ম্বনার ব্যাপার। কখন কী ঘটে যায়- বলা মুশকিল। রমিজেরও এখন মনের ভেতর মন নেই। হয়তো গত রাতে বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে। হতে পারেই। রমিজদের ঘরের ফাঁকফোকরে হা করে অপেক্ষা করে অভাব। সেই অভাবগুলো একটু সুযোগ পেলেই হামলা করে। অভাবেরা ঝগড়া বাধায়। মারামারি বাধায়। রমিজেরও হয়তো তাই হয়েছে- তা না হলে আজকে রমিজের হাতের চা এতো বিস্বাদ হবে কেন! চায়ে চিনি নেই। দুধের অনুপাতও ভয়ংকর রকমের কম। অথচ এই রমিজের চায়ের সুখ্যাতি চারিদিকে। আমাকে সপ্তাহে দুইদিন মাধবপুর আসতে হয়। সুরমা চা বাগানে বিশেষ শিক্ষা প্রোগ্রাম চলছে। পাঁচ বছরের প্রোগ্রাম। আসা যাওয়ার পথে রমিজের টং দোকানের চার কাপ চা গেলার জন্য মুখিয়ে থাকি। কী দুর্দান্ত কম্বিনেশনে চা বানায় রমিজ! 

- কী মিয়া, মনটা আজ কই রাইখ্যা আইছো? আজ চা তো চা হয় নাই।

- কন কী, স্যার।

- হ। চায়ে দুধ চিনির কোনো কিছুই ঠিক হয় নাই। চায়ের পাতিও পানির তুলনায় কম মনে হইলো! আগের ফ্লেভার নাই।

- আইচ্ছা, স্যার। বহেন আপনে। আমি আরেক কাপ চা বানাইয়া দিতাছি।


কথাগুলো অন্যমনস্ক হয়েই বলছিল রমিজ। স্টেশনের চারদিকে তার চোখ ঘুরছে। স্টেশন ভর্তি লোকজন। খুব শোরগোল। কুলিদের চিৎকার চেঁচামেচি। হকারদের হাঁক-ডাক। চারদিকে কেবল শব্দ বোমা ফাটছে। আমি রমিজকে বোঝার চেষ্টা করছি। রমিজের চোখ স্টেশনে কী খুঁজছে? প্রিয় কোনো মুখ? নাকি পরিচিত কোনো চায়ের কাস্টমার? অথচ আমাকেও এই ট্রেন ধরেই ঢাকা যেতে হবে। কালনি এক্সপ্রেস ক্রসিংয়ে পড়েছে। সময় লাগবে। তাই আমার মধ্যে কোনো তাড়া নেই। মনে হচ্ছে রমিজের হাতের চা না খেয়ে আমি যেতেই পারবো না। চায়ের প্রতি আমার নেশাটা বরাবরই বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত। আমি রমিজের চোখের রেটিনা ধরে দেখার চেষ্টা করছি- সে কী দেখছে?

- ঐ মিয়া, তুমি কী যেন খুঁজতাছো? কও আমারে। আমিও তোমারে সহযোগিতা করি।

- না, স্যার। তেমন কিছু না। তয় কিছু একটা ঘটতেও পারে। 

- কই- কী ঘটতে যাইতাছে। আমারেও দেখাও। আমিও মজা লই।

- না, মজা না। মনে হইতাছে বিপদ।

- কও কী, মিয়া!


রমিজ আমারে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় দেখালো। একটি যুবক। খুব উসকোখুসকো। লম্বা চওড়া যুবকের কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলানো। মাথার ক্যাপ দেখতে দারুন। ভ্যাগিক্যাপ। বিদেশীদের পড়তে দেখেছি। ফ্যাড জিন্স পরা যুবকটার গায়ে চে গুয়েভারার ছবি সংবলিত টি-শার্ট। বাম হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটা সিগারেটের অপমৃত্যু হচ্ছে। অথচ যুবকটা সিগারেটে টান দিচ্ছে না। পুড়ে পুড়ে সিগারেটটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে নীরবে। অথচ এই যুবক একমনে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটার হাতে আইফোন। বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি মোবাইলের ওপর প্রান্তের মানুষটার ওপর বিরক্ত। মাথাটা নিচু করে সেই যুবক মেয়েটার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তার হাঁটা চলাফেরা রহস্যজনক। রহস্যজনক না বলে সন্দেহজনক বললে ভুল হবে না। আচ্ছা- মেয়েটা কি যুবক এই ছেলের সন্দেহজনক গতিবিধি খেয়াল করেছে? হয়তো। এমনও হতে পারে- খেয়াল করলেও পাত্তা দিচ্ছে না। মেয়েরা এমনটা ঠিকঠাক ভাবে পারে। মনে যা মুখে তার ছাপ না রেখেই অভিনয় করতে পারে। কয়েকবার ছেলেটা প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে যাচ্ছে। অথচ একমনে মেয়েটা মোবাইলে কথা বলেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রমিজের কথাই সত্য। আপাততঃ যুবকের গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে- মেয়ের হাতের মোবাইলই তার টার্গেট। তাই আমি একটুকুন এগিয়ে গেলাম। সিনেমায় এমন দৃশ্যে নায়কের আগমন ঘটে। হিরোয়িক একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকে। তাই মেয়েটার সামনে হিরো হবার এমন সস্তা চান্স আমি হাত ছাড়া করার মত বোকা নই। তাই আমি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছি- কী ঘটতে যাচ্ছে। ছেলেটা এবার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছে। ছেলেটার তাকানোর ভেতর এক সাগর তৃষ্ণা দেখেছি। কলি কালের চোরও কত রোমান্টিক হয়! শালার আমিই কেবল বেখাপ্পা রসকষহীন মানুষ। বউয়ের কাছে একটা কাঠখোট্টা যন্ত্র বিশেষ মাত্র। 


মেয়েটা কান থেকে মোবাইলটা নামিয়ে রাখতেই একজন সুদর্শন পুরুষ তার পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষটার কোলে চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। একদম পরীর মত। পুরুষটার কোলে বসে পুচকিটা বাবা বাবা বলে কথা বলছে। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কটমট করে কিছু বলছে সাথের পুরুষকে। মনে হচ্ছে পুরুষটা অসহায়ভাবে মেয়েটার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আমি বেশ উপভোগ করছি ঘটনাটি। বেশ থ্রিলার টাইপ মনে হচ্ছে। এই যাত্রাপথে কত ঘটনার রাজ স্বাক্ষী আমি। দেখে মনে হচ্ছে তারাই পৃথিবীর সুখী পরিবার।


মেয়েটা মোবাইলটি তার পার্সে রেখেছে। পরীকে কোলে তুলে নিয়েছে। সেই সুদর্শন পুরুষ ব্যাগ দুটো নিয়ে ট্রেনের এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ‘ট’ বগির দিকে যাচ্ছে। আমার চোখ ছেলেটার ওপর। হঠাৎ খেয়াল করলাম ছেলেটা মেয়ের পিছু নিয়েছে। তাই আমিও ছেলেটার পেছন পেছন যাচ্ছি। ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠে গেল মেয়েটার পার্টনার। মেয়েটা বগিতে ওঠতে যেতেই ছেলেটা দৌড়ে মেয়ের কাছে গেল। মাথার ক্যাপটা আরেকটু টেনে বলল, ‘মিথি, ভালো থেকো।'’- কথাটা বলেই ছেলেটা ঘুরে দ্রুত পায়ে স্টেশনে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল। ছেলেটাকে আমি স্টেশনের কোথাও দেখছি না। শান্ত সৌম্য সেই মেয়ের বুকে তখন মেঘেদের গুড়–ম গুড়–ম নিনাদ। চৈত্রের খরা মুছতে বৃষ্টির অপেক্ষায় এলোপাতাড়ি ওড়ছে মেঘ। 


মনে হচ্ছে- মেয়েটা হঠাৎ ডাকে ভড়কে গেছে। মনে হলো হঠাৎ হারিয়ে ফেলা মূল্যবান কিছু একটা পথে খুঁজছে। মেয়েটা ট্রেনের বগিতে না ওঠে অস্থির চোখে সেই কণ্ঠটা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। হঠাৎ এমন ডাকে তার চোখে বান ে ডেকেছে। অথৈ জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে পাড় ভাঙছে। এইদিকে ট্রেনের হুইশেল বাজছে। সাথে সুদর্শন পুরুষের আচমকা ডাকে মেয়েটার সম্বিৎ ফিরে এসেছে। মেয়েটা বগিতে ওঠেছে। আমিও পেছন পেছন ওঠলাম। কী দৈব এক ঘটনা! আমার সিট পড়েছে মেয়েটার একদম সামনে। মুখোমুখি আসন। জানালার পাশে বসা মেয়েটি মুখ বাড়িয়ে স্টেশন চত্বরে কিছু একটা খুঁজছে। ট্রেন ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে। 


আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। এমন লাস্যময়ী মেয়েকে আড়চোখে দেখতে দেখতে গন্তব্যে যাওয়া যাবে। সুযোগ পেলে মেয়েটার সাথে ছেলেটার সম্পর্কের রূপরেখাও আবিষ্কার করা যেতে পারে। ভাবতে ভাবতেই সুযোগটা এসে গেল। সুদর্শন পুরুষটা পরীর জন্য চিপস আনতে গেল। মেয়েটা তখনও ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে কোথায় যেন ডুবে আছে। পাশের ছোট্ট পরীর দিকে তার কোনো মনোযোগ নেই। বড্ড এলোমেলো লাগছে মেয়েটাকে।

- হ্যালো- আপনি কি মিথি? 

- এই নাম আপনি কি করে জানলেন?

- না মানে আপনাকে উদ্দেশ্য করে একটা যুবক এই নামে ডাকতে শুনলাম! সুন্দর একটা নাম।

- তার মানে আমি ভুল শুনিনি! সেটা তমালই ছিল? কত বছর পর এই নামে সে ডাকলো!


অস্পষ্ট স্বরে মিথি এই কথাগুলো বলে যাচ্ছে। আমি শোনার চেষ্টা করছি। বাকি কথাগুলো ট্রেনের কু ঝিকঝিক শব্দের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। মিথির চোখে বৃষ্টি নেমেছে। আমি সেই বৃষ্টি দেখছি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমাল নামটি কি মিথির দেয়া কিনা? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত অবস্থায় সে নেই। জানালায় মুখ রেখে মিথি কাঁদছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে- তমালও কি মিথির মত এখন কাঁদছে? ট্রেনের ভেতরে তুমুলভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ প্রকৃতিতে হবু শীতে মিষ্টি রোদের চাষবাস চলছে।


পদাবলি

পদাবলি

 



বিপর্যয়

হাফিজুর রহমান


ভালোর থেকে বেশি এখন মন্দের কদর

মানুষকে নয়, টাকাকে করতে আদর!

বাড়াতে সম্মান, যার যতোটা বেশি জোর

এ দায়িত্বে রয়েছে কিছু হারামখোর।


এতোটাই বেড়েছে বেশি মানুষের লোভ

শুধুমাত্র স্বার্থে কারণেই বর্ষে ক্ষোভ!

মিথ্যার আশ্রয়ে- হলেও গেলাতে টোপ

ন্যায়ে নয়, অন্যায়েরই গুরুত্বারোপ।


দয়া-মায়া ওসব এখন খেলনার মতোন

বিশ্বাসের নয় প্রীতিকর কথপোকথন;

দ্রুততম সময়ে স্বভাব-চরিত্রের পরিবর্তন

দিচ্ছে এনে, মনুষ্যত্ববোধে অধঃপতন।




রঙহীন মানুষ 

রুদ্র সাহাদাৎ 


রঙহীন মানুষ তবুও সারাটাদিন রঙে থাকি, শূণ্যতায় ঘেরা জীবন হাওয়ায় ভাসি 

নীল ঢেউ ভাজ ভাঙে জলে ও মনে, শাদা গাঙচিলের মতো উড়ে উড়ে ঘুরছি 

অতীত মনে নেই কিছু,জানা নেই ভবিষ্যৎ, ফ্যাকাসে বর্তমান, বেঁচে আছি এটাই শুকরিয়া। 

ফিলিস্তিন কাঁদে কালো ধোঁয়া উড়ে বাতাসে, বিধ্বস্ত নগরী

আমদমুখ সমুহ নিঃস্তব্ধতায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, হারিয়ে প্রিয় স্বজন কাঁদে আবালবৃদ্ধবনিতা। 

’’ লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ¦ালিমিন’’।

ঠিকানাহীন উদ্বাস্তু পথে পথে জীবন্মৃত শিশুর চিৎকার, ছয় ওয়াক্ত সালাত আদায় পাড়া মহল্লা অলিগলি..


রঙমশাল

স্বপন গায়েন


রংচটা শরীর

রংচটা হৃদয় উপকূল

তবুও আতসবাজি জ্বালাতে ইচ্ছে করে।


সব্বার ঘর আলোময়

শুধু আমাদের ঘর বড্ড আঁধার

মোমবাতি রঙমশাল কতো রকম বাজি ...


বিবর্ণ কবিতার পাতায় রক্তপাত হয়

চারিদিকে মাইকে বাজছে শ্যামা মায়ের গান

অদ্ভুত আঁধারকে গিলে খাচ্ছে বিপন্ন জীবনের কাব্য।


সব পুজো শেষ

আতসবাজির সব রঙ ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে যায়

জীবনটা রঙমশাল হল না কখনও ...



যদি জন্মান্ধ হতাম 

এস আই শিমুল


যদি জন্মান্ধ হতাম, 

আজ থাকতোনা কোন অভিযোগ- 

আলোর এই পৃথিবীতে পরিচয় হতো না কখনোই। 


তুমি নামক সোনালী রোদের সাথে;

কখনোই খোঁজতে হতো না আলো-আঁধারের সুখ

এই পৃথিবীর পথে। 

তোমাকে দেখার তীব্র ব্যাকুলতায়

চোখের ক্ষুধায় চিত্ত চাঞ্চল্য হতে হতো না আমায়।

উদাস প্রদোষ, বিষাদের রাত্রি 

পৃথিবীর অবসাদ কুড়ে কুড়ে খেতো না রোজ।



ছায়া হয়ে যায় ছুঁয়ে

সাইফুল ইসলাম


দুপুর কিংবা গোধূলি 

খুঁজে ফিরি 

পাইনি আমার প্রিয় শব্দগুলোর ঠিকানা

ঘাপটি মেরে কোথায় যেন চুপিসারে বাজায় 

শুধুই বেহালাখানা।


খুঁজে গেলাম রাত নিশি অবধি

নীরব পথের পথিক হয়ে

জোছনায় ভিজে শরীর 

মনের ভিটোয় ছায়া হয়ে যায় ছুঁয়ে

এক ছবি, করে বড়’ই অস্থির লাল হয় চোখ আমার।


একটা কবিতা নির্মাণ করবো বলে

দিবারাত খুঁজে ফিরি

আমার প্রিয় শব্দাবলী 

অলিগলি পাহাড় পথ গিরি।


আমার মনের জানালা রক্তাক্ত হয়

প্রতিনিয়ত, ভুগি শুধুই জানা অজানা

কঠিন কাঁটার আঘাত বিষময়

বেড়ে যায় মনের কোণে দীর্ঘশ্বাসের আলপনা।




অনধিকার

হোসেইন দিলওয়ার


বখেড়া বলয়ে পলি- জমেছে প্রাণরসে

অবৈধ খেলায় দখল হয়েছে সা¤্রাজ্য,

উত্তাপ দেখি জলজ মাটির কলসে!

তৈলাক্ত দহনে আজ সুখ পরিত্যাজ্য।

মুক্তির ত্রিশূল যেন অসুরের হাতে-

সপ্রতিভ মহিমায় আশ্চর্য সফেন,

সব খায় ছিঁড়ে খুঁড়ে ধারালো ইস্পাতে-

চুপসে যায় জীবনের বিশুদ্ধ লেনদেন!


সমস্ত শান্তির দূত ঘুমায় কবরে-

অনধিকার প্রবেশে চলে বলাৎকার,

নেতৃত্বের হাহাকার অবনি চত্বরে-

পথে প্রান্তরে লক্ষিত- বেসুরো চিৎকার।


সমস্বরে দানবেরা গেয়ে যায় গান-

বাঁচার তাগিদে কাঁদে মানবিক প্রাণ।



বদলায়নি ভালোবাসা

এ এম তোফায়েল 


তার বাড়ির দিকে এখনো ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আমি! দেখি ফুলের বিয়ে হচ্ছে- হলুদ ফুলের বিয়ে! জানি সে নেই! এক চিলে ডানায় করে নিয়ে গেছে তাঁরে! তবুও কেনো যেনো তাকায় আমি এক অজানা পুরনো প্রণয়ের টানে! 

বাওড়ের ঢেউ এখন আর আগের মতো কয় না কথা! কপোতাক্ষের বুকে হয় না আগের মতো জোয়ার ভাটা! শুল্কপক্ষের পঞ্চদশী চাঁদ এখন আর হাসে না! সময বদলেছে- বদলেছে মানুষ! অথচ আমি নিজেকে বদলাতে পারলাম না! বদলায়নি ভালোবাসা!


প্রমিত সাহস

মুস্তফা হাবীব


অকারণ সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়ার দুরন্ত সাহসে

 না আছে নিজের কল্যাণ না আছে দেশের। 

অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দঁড়ানো সাহসের কাজ

তবে তা যেনো হয় প্রমিত সাহসের মাইলফলক। 


প্রগাড় অভিমানে মৃত্যুমৃণাল পান করা 

কোনো সাহসের কাজ নয়, চরম আত্মঘাত

এমন কাজটি করে যারা স্বজনকে কাঁদায়

পাতাঝরা বৃক্ষের মতো শুধু নিজেকে হারায় । 


আমি এমন সাহসের কথা কথা বলছি

যে সাহস প্রস্তুত করে সত্য- সৌন্দর্যের রূপকল্প 

শিল্পবোধে মানুষকে কাছে টানে অনির্বাণ 

মানুষের কল্যাণে নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটায়।



জন্মান্তর যাত্রা 

রবীন বসু 


আসল মৃত্যুর মতো ঘণ্টা বাজে দূরে

কালভার্ট পেরিয়ে, খালপাড়ের উঁচু ঢিবি পেরিয়ে

রেললাইন পেরিয়ে ওই যে পরিত্যক্ত কারখানা

ওখানে অপেক্ষা করে আছে মৃত্যু, ঘন অন্ধকার;

সংক্রান্তির রাত শেষ হলেই বেজে উঠবে খোল

সংকীর্তন শুরু হবে অষ্টপ্রহর

নিরবচ্ছিন্ন সেই মৃত্যু হাহাকার অনির্দেশ পথ 

অতিক্রম করবে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে!

হাওয়াকল আর চালমিলের পাশ দিয়ে 

যে সরু রাস্তা নির্মোহ পড়ে আছে

গত জন্মের ফেলে আসা স্মৃতির গুঁড়ো

নাকে নোলক পরে এবার জন্মান্তর যাত্রায় যাবে



হতাশার মিছিল

এম সোলায়মান জয় 


জরাজীর্ণ পৃথিবীতে আমি এক বৃদ্ধ ক্যাকটাস

মিথ্যার সাম্রাজ্যে অস্থায়ী মরণ যাপন করছি

প্রাচীন দুর্ভিক্ষে শেষবারের মতো সেই যে সত্যকে দেখেছিলাম।

সেদিনের মুখের সেই করুণ চাহনি

পৃথিবী আর দেখেনি কোনদিন।

হতাশার মিছিলে হারিয়ে গেছে সুবিচার

নিষ্ঠার কাটা গর্দান হাতে নিয়ে মিছিল করেছে দুর্বৃত্তরা।

অন্যায়ের পা চেটে বেঁচে আছে পৃথিবীর যত প্রাণ

যাদের ভেতরে কোন জীবন নেই

আছে মহাদুর্ভিক্ষের ক্ষুধা।


কথাশিল্পের চারুপিতা, বিদায়....

কথাশিল্পের চারুপিতা, বিদায়....

 

     কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, জন্ম : ০২ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৯, মৃত্যু : ১৫ নভেম্বর ২০২১, ছবি : নূর এ আলম



কথাশিল্পের চারুপিতা, বিদায়....

মো. আরিফুল হাসান


মধ্যহেমন্তের একটি করুণ নি¤œচাপবৃষ্টির রাত। রাতটা চাঁদের সাথে ভেসে গেলে কিংবা অন্ধকারের অপর পৃষ্ঠায় মুখ লুকালে তখন রাজশাহীতে ঘড়িতে নয়টা বেজে কিছু মিনিট। হিমকণার মতো কিছু ছায়াছায়া জলবিন্দু শোকাকুল হয়ে ঝরে পড়তে দেখে দুর্যোগপ্রবণ বাতাস কি মনে করেছিলো কে জানে? তবে পাতাদের ঘুম ছিলো না। ঘুম ছিলো না বিহাসের বাড়ি উজানে। কোনো এক নক্ষত্রের পতন হবে, এ জন্যেই বোধয় সাগরে সাগরে শীতার্থ হাওয়া হুহু করে কেঁদে গেলো। তখন একটি দিকহারা বিষণœ বাতাস ঘুরতে ঘুরতে, ঘুরতে ঘুরতে এলোচুলে এসে আছড়ে পড়লো বর্ধমানের যবগ্রামে। হায় জন্মভিটে, তোমার আরতি আজি, প্রণাম লহ হে মাতাবীজ।

৩০ কার্তিক ১৪২৮, ইংরেজি নভেম্বরের পনেরো তারিখ সন্ধ্যায় যে বিষণœতা দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো রুগ্নশয্যায়, হাসান আজিজুল হক কি তখন শুনতে পেয়েছিলেন কোনো এক বিভ্রান্ত কবির নিমগ্নপংক্তির অন্তর্যাস? “যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;/ যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে....।” জানি না, জানি না তিনি শুনতে পেয়েছিলেন কিনা। তবে ম্লান চোখ আরও বেশি ঝাপসা হয়ে এলে শোকাকূল ধরণী বললো, হায় ২০২১, তুমি আর কতো বলো নিঃস্ব করবে এই বাংলার রতœভা-ার?


তখন একটি নিশাচর পাখি সদ্য তার খোঁড়লের আঁধার কেটে জ্যোৎ¯œা ভেবে মেঘছায়া শিশিরের ভেতর পালক থেকে খুলে ফেলে শ্রান্তি। কিন্তু ডানায় তার নতুনের রেখাপথ তৈরি না হলে সে ভাবলো, এ আঁধারটাকে হয়তো সে গচ্ছিত রেখে দেবে কোনো এক নিমগ্নরেখার অন্তরপথের অভ্যন্তরে কিংবা তার মনের বেদনার সাথে ভাগাভাগি করে নেবে এ আঁধারটাকে। আচ্ছন্নতা তাকে পেয়ে বসলো। ডানার বিরামচিহ্নভুলে সে উড়ে গেলো পশ্চিমবাংলার দিগন্ত-বিস্তৃত বিলে হাহাকার হয়ে। একটি শৈশব ও কৈশোরের স্বপ্নঘেরা সে নিশুতি বিল পরম পরশে তার পালকের ভেতর থেকে খুলতে লাগলো হিমকণার মতো বিরহ। আহ, হাসান আজিজুল হক! যৌবনে দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত নিত্যসহচর, নিত্যকর্মে তার সঙ্গে হয়েছে চেনা-জানা।

পাখিটির পালক থেকে হিমকণাগুলি ঝরে পড়তে পড়তে একটি একটি বরফ পাহাড়ের আকৃতি নিলো। ¯্রােতের গতির চেয়েও অধিক একটি ঘন নীল আঁধার তখন পালকের বিলাপ নিয়ে হাজির হলো খুলনার ফুলতলায়; তার দ্বিতীয় আবাসে। যে ঝড়টি উঠেছিলো রাজশাহীতে, সেই নীরব, নিস্তব্ধ ঝড়টি অশ্রুধারার ফোয়ারা বয়ে নিতে নিতে বিএল কলেজের ছাত্ররাজনীতিতে কী উত্তাপ, কী হীম-শীতলতা ছড়াতে থাকে? তখন মর্মররেখারা ফিরে আসে রাজশাহীতে আবারও, সরকারী কলেজে। দর্শনের বারান্দায় রোনাজারিতে পাষাণের চোখে কান্না। 


পাহাড়ের চূড়ো থেকে একখন্ড পাথর গড়াতে গড়াতে বড় একটি ধ্বস নামিয়ে দিলে ছুটন্ত হরিণির পায়ের ক্ষুরায় আটকে গেলো মহাকাল। দিগন্তছুঁয়ে এক বিস্তৃত কথাপরিধি তখন সামনে এসে দাঁড়ালো খোদাই করা ভাস্কর্যের মুখাবয়বে। তখন সেখানে তারাফুল ঝলমল করে উঠলো যে আঁধার কেটে গিয়েছিলো তা যে অত্যাসন্ন আবার সে কথা কি কেউ তখন বলেছিলো? সন্ধ্যায় শকুনটা নেমে এসেছিলো ধূসর প্রান্তরে, বালকদের খেলার গুটির উপমারূপে। আসলে শকুনটা ছিলো ভেতরে, ভেতরের গোপন নরকে।

উৎসাহী বালকেরা একেকটা পালক খুলে ফেললে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলো পুঁজিমানসের বিভৎসতা, বেরিয়ে আসতে থাকলো সমাজের নিষ্পেষিতের দ্রোহ ও খুনের টকটকে লাল। আর তখন একজন হাসান আজিজুল হক বিশীর্ণতার ভেতর থেকে তুলে ধরলেন তৃতীয়বিশ্বের অপরিণত শিশু। আর দেখালেন কাদু শ্যাখের রাঁঢ় বোনটিকে, “দিনের চড়া আলোয় অদ্ভুত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মরা শকুনটার মতোই।” তাই জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের সময়টা মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, বেঁচে থাকার জন্য যে প্রয়োজন, তা মেটাতে চায় জীবনের দামে। একটু একটু করে কুপির সলতের মতো তাই নিঃশেষ হতে থাকে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিক বাশেদ। তৃষ্ণা, ও তৃষ্ণা তোমার জলচাবি! দাও মুখে দাও অমৃত মম, দাও অন্তরে জ্বালা-বিষ।

অচরিতার্থ যৌনবাসনা আর উদরের উদগ্র জ্বালা মিলে মিশে এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি, তখন রাতের অন্ধকারে বেকারার চলতে চলতে “একটা তীক্ষè তীব্র মৃত্যুর মৃত্যুর মতো অমোঘ প্রবৃত্তি গড়াতে গড়াতে চলল ঢালু বেয়ে, তার মৃতুর দিকে।”


আগুনপাখি একটি নদীর নাম। দুই পাড়ে প্রবাহিত জীবন, ও জীবনের প্রকোষ্ঠে জমে থাকা বিষস্মৃতি। দেশভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আখ্যানে দেখা যায় একটি প্রান্তিক রমনী তার যাপনের পরাকাষ্ঠা খুলে ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে রাখছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধকালীন আর্থ-রাজনৈতিক দেউলেপনা, কলেরা মহামারী আর ফসলহানির জীবনচিত্র। ভাঁজে ভাঁজে প্রজ্জ্বলিত শিখা এক সময় আপন আলোকে উস্কে দিতে দিতে বিশ্বচিত্রের প্রতিভূ হয়ে সামনে আসে। তখন ভ্রাতৃত্ববোধের দায়, প্রতিবেশিকতার আন্তরিকতা, কিংবা সহচল বন্ধুর হাত সহচলের জন্য হয়ে উঠে যমকুঠার। নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে একটি সাজানো বাগান ভেঙেচুড়ে তছনছ হয়ে গেলে শেকড়গেড়ে বসেন রাঁঢ় রমনী। নিজের ভেতর দ্রোহের আগুন ফুল হয়ে ফুটতে থাকলে জন্ম নেয় নবতর ফিনিক্স। ফলে চিরব্রতা প্রান্তরমনীও হয়ে উঠেন প্রাজ্ঞ আগুনের কোলাজ।

আগুন এরপরে ফুটতে থাকে গল্পে গল্পে তিলোত্তমার পদাকীর্ণ করে। শঙ্খে বাজে নিনাদ, আর মনোসমীক্ষণের ভুমিকার বিপরীতে বেজে উঠে বাস্তবতার রেখায়ন। তবু “মন তার শঙ্খিনী।” নানা ভাবে প্রেমের ব্যাকরণে পরাপাঠের গারদে আবদ্ধ রাখে প্রেমিক হৃদয়। হামিদার বরপালা দেহ, আর মনপালা অভিসার শাদুর শাদাসিদে জীয়নজয়ন্তীর এজলাসে উঠে, “হয় স্বামীর ঘরে যা, নইলে তাকে তালাক দিয়ে আমাকে বিয়ে কর।” ভাতের যে মুরোদ নেই, তার আবার ঘর! ও ঘরে পাখির কান্না হয়ে নিরন্ন হাওয়া খেয়ে দোল খাবে কি হামিদা? আবার দোলাও লাগে মনে, ডাকেÑ “আজ রেতে আসিস আমাদের বাড়িতে, মনের জ্বালা জুড়োব তোর কাছে।” তখন হয়তো বায়ুবনে নানারৈখিক তরঙ্গের উৎপত্তি ও বিকাশ সমান্তরালে বয়ে চলে তাই দেহপতির বাড়িতে গেলেও দেহের ভেতর বাস করে প্রেমিকের বীজ।


প্রেমের বীজ থেকে সিরিয়ার আদুনিস আগুনের গাছ উত্থিত হতে দেখলেও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক জ্বালান “জীবন ঘষে আগুন।” দেশলাইয়ের কাঁঠিটি টুপ করে জলে পড়ে গেলেও বুকের চিতায় জ্বালিয়ে নেয়া যায় দিব্যি মশাল। ও হাত যদি হয় মিছিলের, ওই হাত যদি হয় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারের। বাগদীদের রক্তের ভেতর তখন একযোগে জ্বলে উঠে ভিসুবিয়াসের সবগুলো শিখা। এমনি ভাবে শোষিতের পক্ষের ঋণ, আপামর জনতার প্রাণের আকুতি, জীবনকামী মানুষের স্বপ্নের শক্তি প্রতিভাত হয়ে উঠে দক্ষশিল্পীর যাদু-কারিশমায়। তখন, কথাবৃক্ষে ফুল ফোটে, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’। প্রান্তের বাইরে ও শেকড়ের অভ্যন্তরে ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, উদ্দেশ্য একটাই, ‘রোদে যাবো।’

তবু রোদের পথে যে যায়, অমাবস্যার দমবন্ধবৈরিতায় তাকে সয়ে যেতে হয় অন্ধকারের ঘাত। আর রাত আরো বেশি দীর্ঘতর হতে থাকে, আরও বেশি বিপন্ন হতে থাকে জাগরুকের অস্তিত্ব। তখন কুয়াশার একটি নীল চাদর ঢেকে দেয় রাজশাহীর উজান ভিটেতে শির উঁচু করে থাকা একটি মহিরুহকে। আর তাবৎ পাংশুতার ভেতর পড়ে থাকে ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘মা মেয়ের সংসার’; কিংবা ঢেকে যায় কার্তিকের মেঘে ‘অপ্রকাশের ভার।’ তবু এ চলে যাবার, ছেড়ে যাবার আদি পর্বে প্রশ্ন জাগে, ‘কে বাঁচে কে বাঁচায়?’ বিদায় হে কথাশিল্পের চারুপিতা, চির বিদায়....


কুমিল্লা, বাংলাদেশ



শব্দমালা : হাসান মাহমুদ

শব্দমালা : হাসান মাহমুদ

 



চন্দ্রিমা


কুয়াশায় মুড়ানো চাঁদ শিশির ফেলো নক্ষত্রের ওপর-


দূর্বাঘাসের গালিচায় জলজ কুয়াশায় ফেলো নিভু নিভু নরম আলো; 

জোছনারঙের দুইফালি কুমারী চন্দ্রিমা 


আজ 

শিশিরের গড়িয়ে পড়া দৃশ্যে হোক প্রেমের জলসা। 


ঝিম ধরা এই রাত্রি শেষে ভোরে ফুটুক 

শিশির ভেজা কুসুম; 

কুসুমের জল পতন বড়ো সুন্দর-


ও দুধরঙের চাঁদ! তুমি তোমার রূপে সুন্দর।




জলজোছনার গান


তোমার গহিনে ফকফকা আলো শরতের উঠোনে যেন চিরায়ত শাদা কাশফুল-


সমুদ্রের উত্তুঙ্গ ঊর্মির ফেনায়িত জলোচ্ছ্বাস 

খেলে যাচ্ছে জলজোছনায়-


একটা মার্জারী হামাগুড়ি দিচ্ছে দুধের বাটিতে; 


দুধেল চাঁদ যেন আরও হেসে উঠছে এমন ঘনীভূত আলোর গানে।


চাঁদের মহিমায় নিজস্ব আলো নেই: 

চাঁদের আছে জলজোছনার গান-

তোমার সলাজ চাঁদের বদনে যেন আনে কোলাজ-


কী অপূর্ব তুমি- তুমি ও চাঁদ যেন পাতানো সই!



অলিভের ছায়া


তুমি এমন

যেন

চাঁদ সূর্যের দূরত্ব রেখা-


সন্ধ্যা ঘনালো সূর্যের কিরণ লুপ্ত করে-

গরম সূর্যটি রেখেছে চাঁদের দূরত্ব;

তুমিও তাই!


ডুমুরের ছোট ছোট ছায়ায় যে গোল দৃশ্য 

সে ছায়াদৃশ্য তোমার বুকজুড়ে-


মসজিদে 

মন্দিরে 

প্যাগোডায়

গির্জায় 

হলো ধর্ম আর কর্মের উৎসব-

তখন তুমি জপছ আমার নামে ইশক;


যেন দ্বিপাক্ষিক কোনো

চুক্তিতে তুমি আমায় প্রেমের ঘরে

দাঁড় করিয়ে দিলে-


বলো, 

প্রেম কেন মানে ধর্মের মিথ?


মসজিদে আজান হলো-

মন্দিরে হরি জপ-

প্যাগোডায় বুদ্ধের নাম-

গির্জায় যীশুর নাম-


সব নামের পর; প্রার্থনায় প্রেমই আগে আসে!

বলো তুমি কোন্ প্রেমে বেছে নেবে আমায়?


প্রেমের মাহফিলে আমি বাংলার চিরায়ত 

সবুজ মেখেছি প্রেমের অবগাহনে-

আমায় আপন করে রেখো তুমি: 

অলিভের ছায়ায়।