বর্ষার পদাবলি

বর্ষার পদাবলি



 আমি আর...  
সোহেল বীর

চারিদিকে জমাট অন্ধকার, মুখোমুখি তুমি আর আমি
যে ছাতার নিচে আমরা বসে আছি
তা ক’দিন আগেই একটি বহুজাতিক কোম্পানি অনুদান দিয়েছে
ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য্য বর্ধনের মহান দায়িত্ব নিয়েছে তারা
‘সেট’ স্কুলের সামনের এই ছাতাটা এ ক’দিনেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে

 শ্রাবণ দিন- অযাচিত বৃষ্টিদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে
এত শীতলতার মাঝেও আমার শরীরে তীব্র উষ্ণতা
জ্বরাক্রান্ত এই শরীরে তোমার সঙ্গ আমাকে শীতলতা এনে দেয়
আমার কপালে হাত দিয়ে পরিমাপ করার চেষ্টা করো উষ্ণতার পরিমাণ
তোমার হাত এখন বরফশীতল
তোমার দেহের শীতলতা তিরতির করে আমার শরীরের শিরা উপশিরা ভেদ করে
পরম প্রশান্তি খুঁজে পাই তোমার স্পর্শে

রাত ক্রমাগত গভীর হতে থাকে, হলমুখি হই আমরা

এখনও বর্ষা আসে,
জমাট অন্ধকারে ছাতার নিচে বসে থাকি
মুখোমুখি আমি আর নিংসঙ্গতা! 

সুলক্ষণা 
রওশন রুবী

সুলক্ষণা কোথায়া থাকে বৃষ্টি বলো; কোথায় মেঘের বাড়ি
বৃষ্টি ধুয়ে দুঃখ নেবো; নেবোই দেখো মেঘের বাড়াবাড়ি,
আমি যে সেই জেনে ছিলাম দাঁড়াও তুমি কালোমেঘের পর
আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র মাসে জলের ছলে কাঁপাও থরোথর।

সুলক্ষণা নাওনি কেন গোলাপ বকুল চাইছো মেঘ আর বারি
বলছি শোন ছোট্ট থেকেই মেঘ চিনি না কোথায় পাবো বারি।
মেঘ কি তোমার চোখের মনি মেঘ কি খুবই কালো
পাহাড় বেয়ে নামে যেমন রোজ বিহানে কাজল পরা আলো?

সুলক্ষণা বললে নাকো; দেখলে নাকো; ভাঙছো পথের পথ
ক্লান্তি ধুয়ে নিতেই দেখো ছায়া হয়ে আছে তোমার পেছনে অশ^থ।




বর্ষার বয়স একুশ বছর 
নূরনবী সোহাগ 

লক্ষ অথবা কোটিতম বর্ষা নামলো; রাতের শরীরে
তবুও তার স্নিগ্ধ ধারায় এতটুকু বৃদ্ধের ছাপ নেই!
ঝিরঝিরে হিন্দোলে কি মাতাল সমীরণ
হাজার বছর ধরে; বর্ষার একই নিবেদন প্রিয়তমাদের কাছে!
‘আমায় একটু ছুঁয়ে দাও,
আমি যে তোমার জন্যেই ঝরছি অবিরাম; অজ¯্র হয়ে।’
বর্ষার চিরসবুজ ধারায়
যুগে যুগে কত নারী নিজেকে হারায়!
বর্ষার উন্মাদ ঘ্রাণ
কেড়েছে কত উদাসীর মধ্যরাতের প্রাণ
কত পুুরুষ! এ বর্ষায় করেছে কামিনীর লোভ।
চেয়েছে ভেজা শরীরের নির্লজ্জ আলিঙ্গন!
বর্ষায়, বিরহ ভিজেছে নতুন প্রেমে।
থোকা থোকা কদম হেসেছে শাঁখে
তবু বর্ষার বয়স হল না, একুশ থেকে বেড়ে!



বলিনি কখনো বর্ষাটাও ফুরিয়ে যাচ্ছে
ইকরামুল হাসান শাকিল

অতোটা দূরেও যেতে নেই যতটা দূরত্ব ফিরে আসা যায় না
সেইসব বর্ষার ঝিরিঝিরি আঁকিবুকির আঙিনায় থইথই ঝলমলে অভিমানে
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে
বুকের মধ্যে বেড়ে উঠা কদমগাছ শালিক হয়ে উড়তে শিখেছে
যেভাবে নিথর হয়ে দাঁড়ানো ঘুঘু তোমার সামনে আবোল তাবোল
তোমার ভেজা শরীরের চেয়ে আরো বড়ো কোনো ভাষা নেই আমার
কখনো বলিনি তোমায়-
বলিনি কখনো বর্ষাটাও ফুরিয়ে যাচ্ছে, আমিও ফুরিয়ে যাচ্ছি
যতটা দূরত্ব ফিরে আসা যায় না।





গোলাপ আমিও ফোটাতে জানি
আশিক বিন রহিম

পরী,
ওপাড়ার যুবাদের মতোন রক্ত গোলাপ আমিও ফোটাতে জানি
ঝিল থেকে পদ্ম এনে আমিও আঁকতে পাড়ি খোঁপা।

এই যে নোনাঘাম সিক্ত হাত দেখছো তুমি;
এই হাতে আমিও কলম ধরতে জানি, লিখতে পারি কবিতা
আর ভাঁজ করে দিতে পাড়ি চিঠি, হলুদ খামে।

আমার রোদ্রে পোড়া ধূষর ঠোঁট দেখে অযথা আঁকতে যেওনা
ভাবনার নক্শি কাঁথা; তুমিতো জানো- চুম্মন শিখতে
মক্তবে যায়নি কোনো পুরুষ!

তুমি ফুল চিনো, গোলাপ ক্যাকটাস গ্লাডিয়েস দেখেছো
শুনেছি নাইট কুইনের সাথে সখ্যতা আছে বেশ
অথচ কচুরী ফুলের রং জানা নেই তোমার।

পারফিউম চিনো তাই বড়ি স্প্রে আর এয়ার ফ্যাসনার খোঁজ
শুধু বোঝ না, কাঁদা মাটি সেদ্ধ ধানেও সুগন্ধি আছে
ঘন্ধ আছে পাটের আঁশ আর সবুজ ঘাসেও।

পরী,
ক্ষেতের আইল গুঁড়িয়ে দুটি আবাদি জমি এক হয়ে
ফসল ফলাতে আমিও দেখেছি, যেমন করে দেখেছি-
পাহাড়ের জলকে সাগর জড়িয়ে নেয় বুকে।

শুধু এটুকু দেখিনি
আকাশের চাঁদ কখনো মাটিতে দোলাতে পা।¬¬


বুনন
শ্যামলী বিনতে আমজাদ

কবিতার বীজ বুনেছি মননে
দগ্ধ অন্তঃকরণে হাসতে পারি তাই,
চর্চা করি শুদ্ধ স্বকীয় চিত্তের-
বিদীর্ণ হোক যত জাল আছে মিথ্যের।

কবিতার বীজ বুনেছি মগজে
শঙ্কা ভুলে স্বপ্নজাল বুনি তাই,
রঙ্গিন মোড়কে ভেজাল আছে যত-
নষ্ট সমাজে চাই শুদ্ধতা তত ।

অবাক বোতামের ভেতর থেকে 
দ্বীপ সরকার

চিনা বাদাম ছিলছি-
ক্রমশঃ ছিঁড়ে যাচ্ছে যেনো যৌক্তিক বাদামের শরীর,
শার্টটি লজ্জা টের পেলে হৈমন্তী দুপুর ঘামতে থাকে-
পরিচিত প্রজাপতিরা খুলে দিলো অবাক বোতাম...

আমি বাদাম ছিলছি আর হাঁটছি
রোদবালিকা আছড়ে পড়তে লাগলো ক্রিয়াশীল অন্তরে 
নিশ্চুপ খোসাসমূহ খসে খসে পড়ছে রোদবালিকার গায়ে,
শহুর হাওয়ায় উড়ে দিচ্ছি গহীনতীর,
ধূসর রঙা কাক এসে ঠুকরে খাচ্ছে অবাক বোতামের ভেতর থেকে দুঃখরুটি !

আত্মীয় ও পরিচয় 
টিপু সুলতান

পিচ্ছিল পথে হেঁটে যাওয়া
পায়ের আঙ্গুলগুলো বলে যায় এবার আসি-
নিখিলেস দাঁড়িয়ে
ঘাসের পাহাড়ে ভাটফুলের গন্ধ শুঁকে নিঃশ্বাস চোয়ায়
ভালো থেকো ভেঁজা পথ।

লিখে রেখ দিন তারিখ
শতাব্দী, যুগে যুগে আর যদি ফিরে না আসি-
বাঁকফেরা চৈচৈ আনন্দের পুরাতন পাড়াগাঁয়।
চিনে নিও শামুকের অলসগতিতে
আকাশে বৃষ্টির ফেরিওয়ালা,
শালিক ভেঁজা দুপুরে
ধানক্ষেত, ভুট্টা, গম
বাতাসের পাল দোলানো দিগবিজয়ী ওড়া কুয়াশায়।
ঢের বক্রতল সারিসারি গাছের ডেরায়
ক্লান্ত চাষী ও ক্লান্ত মুসাফীরের রেখে যাওয়া
নবাঙ্কুর পাতার হাঁড় পাঁজরে

বহু রূপ গরিমে-সুরতহল দৈনন্দিন
আত্মীয় ও পরিচয়।




বেনেবউ
মাহবুবা নাছরিন শিশির

গোলাপের সাথে সই পেতে কবে বেনেবউ গেছে চলি
কত দূরে গেছে? আসবে কী ফিরে? কিছুই যায়নি বলি
অসহায় একা গোলাপের ব্যথা শুনে কাঁদে বনভূমি
কান্নার সুর শোনেনা পাখিরা, শোনে আধ ফোটা কলি।

একটা গোলাপ অকালে ঝরলে হয়না কারোর ক্ষতি
রোজ রোজ কত ফুটবে গোলাপ নজর তাদের প্রতি
অগোচরে কোন বেনেবউ কবে বলেছিল ভালোবাসি
মুখে না বলেও মনেতে গোলাপ দেখেছিল তার গতি।

অভিমান ছিল, মায়া ছিল আর ছিল আস্থার ছবি
অবিশ্বাসের ধাঁধাঁয়  গোলাপ হয়েছে দুদিনে কবি,
বেনেবউ তাকে শুনিয়েছে গান, শিখেয়েছে সুর, লয়
প্রিয়কে হারালে প্রিয়ারাও বোঝে আঁধার জীবন রবি!

কত বেনেবউ, বউ কথা কও, কাতর ব্যাথার গানে
গোলাপের সেই বেনেবউ সখা চেয়ে আছে কার পানে
থাকুক সে সুখে কাছে কিবা দূরে, তবু তার ছায়া ভাসে
মাতাল বাতাস ভরে ওঠে কেন চেনা মহুয়ার ঘ্রাণে!

ভুল প্রেমিকের মুগ্ধ কথায় দগ্ধ চিত্ত-মতি
দেহ না দিয়েও মনের সূচি হারিয়েছে কত সতী
গোলাপ ভীষণ আবেগপ্রবণ সহজে দেয় না মন
বিশ্বপ্রেমিক প্রেম নিবেদনে তাকে করে শুধু নতি!

গানের পাখি বেনেবউ তবু নন্দিত সারা বনে
বকা খেতে হয় চুপ থাকা জনে, মন খারাপের ক্ষণে
গোলাপ বিরহী নয় মোটে নয় ভুল প্রেমিকের প্রতি
বনের গোলাপ একদিন হবে সাচ্চা প্রেমির কনে।

অকালের দেশ : উজাড় হচ্ছে প্রকৃতি ও বনভূমি
তাপ বেড়ে গেছে পৃথিবীর আর অগ্নি গিয়েছে চুমি
বোমারু-ঘাতক, শোষক-খাতক অরাজকতার দেশে
গোলাপের পরকাল; ইহকালে সুখে থেকো তুমি!



ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব ০১।। শাদমান শাহিদ (রামবন্দনা)

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পর্ব ০১।। শাদমান শাহিদ (রামবন্দনা)



 রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

আচ্ছা ধরো, কেউ একজন বললো, কিছু একটা হারিয়ে গেছে আমাদের অথবা কেউ কিছু বললো না, আমরা ধারণা করলাম। তারপর থেকে?... ওটার পেছনে আমরা জীবনানন্দীয় স্টাইলে হাজার বছর ধরে ছুটে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। আর এদিকে সুযোগ পেয়ে আমাদের পথ দেখাতে অদৃশ্য থেকে নেমে এলো প্রেরিতপুরুষদের মতো একশ্রেণির বুদ্ধিপ্রাপ্ত প্রাণি। যারা পথ বাতলে দিতে খুবই পারঙ্গম। যদিও তাদের দেখানো পথের মাথায় কোনো ঠিকানার খোঁজ আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি। তারপরও তাদের কথায় আস্থা রাখতে হয়। তাদের মোটা মোটা পা-ুলিপি পড়তে হয়। আমরা তাদের পা-ুলিপি পড়ি আর অক্ষরের অলিগলি ঘুরতে ঘুরতে আরো গহীনে হারিয়ে যাই। তখন আমাদের মাথার মগজে জন্ম নেয় অসংখ্য কল্পপথ। পথগুলো ধরে আমরা যার যার মতো যুগ যুগ ধরে...
 লোকটি কথা শেষ করে না। থুথু ফেলতে গিয়ে রাস্তায় লোক চলাচলের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তা দিয়ে মানুষ যায়, মুক-বদির-অন্ধ যায় আর কুকুর যায়। ফের তারা আগের কথায় ফিরে আসে। সোহাস বলছিলো, এখন নাকি অভিনয়ের সময়। এখন নাকি সবাই অভিনয় করছে। সে রেণুকে আহ্বান করে। ‘এসো আমরা কাজ-কাম রেখে কেবল অভিনয় দেখি। নাহয় নিজেরা ক্যামেরার সামনে যেয়ে অভিনয় করি। তাও যদি না পারি, তখন কোথাও নির্জনে যেয়ে গোল হয়ে বসে মেডিটেশন করবো। ধ্যানের খেলা খেলতে খেলতে একটা ব্রিজের কল্পনা করবো।’ সে তখন আবারো অশোক স্যারের প্রসঙ্গ তোলে। তিনি নাকি অনেকদিন আগে ক্লাসে বলেছিলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরাও নাকি সেই প্রগৈতিহাসিককাল থেকে একটা ব্রিজের কল্পনা করে গেছে এবং সেটা বাস্তবরূপ দেয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় রসদও আমাদের চোখের তার রোপণ রেখে গেছে। এখন কেবল দৃশ্যায়নের পালা।
‘সব ভাওতাবাজি। তরুণদেরকে ঘুম পারিয়ে রাখার এটা আরেক ষড়যন্ত্র। পূর্বপুরুষগণ গরিব-চাষা-ভূষা ছিলো। তারা দিনে কাজ আর রাতে নাক ডেকে ঘুমোনোকেই পছন্দ করতো। তারা কারো আগেও ছিলো না, পাছেও ছিলো না। তারপরও তাদের পিঠেই দৃশ্যায়ন হতো তাবৎ অবিচারের উপমা।’
তারা তখন লোকটির কথায় আর মনোযোগ দেয় না। তারপরও কথা বলতে বলতে লোকটা রেলিং ছেড়ে তাদের কাছে আসে। হাতলহীন প্লাস্টিকের চেয়ারটাকে জুতসই করে বসে পড়ে। সোহাস আর রেণু তারা দুজনেই তার দিকে তাকায়। লোকটি তখন তাদেরকে একটা সাপ-ব্যাঙের গল্প শোনায়— বলে, এক ব্যাঙ আদার খুঁজতে কুচুরি ফানার আড়াল থেকে বেরিয়ে খালের পাড় ধরে হাঁটতে থাকে। ঠিক এ-সময় এক সাপ এসে তাকে গপ করে ধরে মুখে আটকে নেয়। ব্যাঙ তখন জান বাঁচাতে ঘ্যাঁৎঘুঁৎ করতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই সাপের কামড় থেকে ছুটতে পারে না। আবার তার প্রাণও যায় না। প্রাণটা গেলেই বেঁচে যেতো। দুনিয়ার সব যন্ত্রণা অবসান হতো। কিন্তু তার প্রাণ যায় না। সাপও তাকে গিলে না। এমন এক বিষম যন্ত্রণায় পড়ে ছটফট করতে থাকে ব্যাঙ। এক সময় ব্যাঙ দেখে একটা বেজি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ব্যাঙের তখন খুশি আর ধরে না। কারণ শত্রুর শত্রু বন্ধু। এই সূত্রটা ব্যাঙের জানা আছে। তাই সে বেজিকে ডেকে আকুতি-মিনতি করে বলে, ভাই আমাকে বাঁচাও। এ মরণ থেকে আমাকে বাঁচালে, তুমি যা চাবে, আমি তাই দেবো। বেজি তখন বলে, এটা তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে আমার কিছুই করার নেই। কারণ আমার আর সাপের মাঝে উনিশ দফা চুক্তি এখনো বলবৎ রয়েছে। চুক্তির বাইরে যেয়ে আমি কিছু করতে পারবো না। আশাহত ব্যাঙ তখন হাল ছেড়ে দেয়।
গল্প শেষ হলে রেণু বলে, আঙ্কেল, গল্পটাকে কি অন্যভাবে ঘুরিয়ে দেয়া যায় না?
কীভাবে!
এই ধরুন, হাল ছেড়ে না দিয়ে ব্যাঙটাই এক সময় সাপ-বেজি দুটোকেই খেয়ে ফেললো।
লোকটা তখন প্রায় মিনিটখানেক সময় চুপ থেকে কী যেনো ভাবে। তারপর মাথা দোলাতে দোলাতে বলে—হুম।
রেণু বলে, তাহলে একথাই থাক। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এক সময় সাপ-বেজি দুটোকেই খেয়ে ফেলবো। ফোর জি-যুগে আর কারো জাদুমন্ত্র কিংবা লোক দেখানো মায়াকান্না কাজ করবে বলে মনে হয় না। কে, কোথা থেকে কলকাঠি নাড়ছে, মোটামুটি এখন সবাই বুঝতে পারে।
 তখন লোকটা পাল্টা উত্তরে আরো কিছু কথা বলে। ঠিক এসময় বৃষ্টি নেমে আসায় আমি শুনতে পারি না। আমি জানলার পর্দা সরিয়ে বৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকি। দেখি সোহাস-রেণুও বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটিকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত বার্থরুমে যেয়ে থাকবে। কোথায় যেনো পড়েছি, বৃষ্টির সময় নাকি কারো কারো বার্থরুমের চাপ বেড়ে যায়। লোকটাকে হয়তো সে রোগেই পেয়েছে। বৃষ্টি যাকে বার্থরুমের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমি তখন বৃষ্টি দেখি। জানালার সামনে শাদা পর্দার মতো অনবরত নিচের দিকে নামতে থাকে। সে পর্দায় রূপোর নূপুর পরা একটি কিশোরী ভিজে আর নাচে। মুদ্রার তালে তালে তার চুল নাচে, বুক নাচে, মন নাচে। মহল্লার উঁচু উঁচু দালান এবং সেসব দালানের খোলা দরজা-জানালা নৃত্যদৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে উপভোগ করে। মেয়েটা কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। তার মন ভরা আনন্দ, দেহ ভরা নাচ আর চোখ ভরা বিস্ময়। কেবলই বিস্ময়। বাবা তার দেশ উদ্ধারে বন্ধুদের সাথে গোপন থেকে গোপনে রাইফেল কাঁধে ঘুরে বেড়ায়। মা ডাকে, আর ভিজিস না, অসুখ করলে দেখার কেউ নাই কিন্তু—।  মেয়েটার অসুখ হয় না, অসুখ হয় তার মায়ের। কলেরা। 


 তারপর কত ঘাট পেরোতে হয়। কখনো মনে হয়েছে, সামনে বিশাল দরিয়া। পাহাড় পাহাড় ঢেউ। ঢেউয়ের মাথায় ডাকাত কেহেরমান। নারীর রক্ত-মাংসের গন্ধ পেয়ে উন্মাদ হি হি করে হাসে আর মাথার চুল ছিঁড়ে ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দেয়। মনে হয়েছে—এই বুঝি শেষ। ভয়ে চোখ বুজে রেখেছি। একসময় চোখ মেলে দেখি কীভাবে যেনো পাড়ে ওঠে গেছি। এভাবেই স্কুল থেকে কলেজ। মেয়েটা তখন কলেজে যায়। রাস্তার পাশের সারিবদ্ধ সহজিয়া গাছপালা-ফুল-পাখি আর কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টির ইথারে কুমারিত্বের সুরভি ছড়াতে ছড়াতে নিয়ম করে সাইকেল চালিয়ে কলেজে যায়। আরেকটা ছেলে ঠিক একই টাইমে কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে স্বপ্নসমান চোখে দৃষ্টি মেলে মেলে কলেজে ঢুকতো। স্টুডেন্টেদের সাথে কথা বলতো আর কীসব কাগজপত্র বিলি করতো। সবকিছুতে ছিলো খুব সর্তকতার ছাপ। ওর সাবধানতা আর ক্রিয়াশীলতা দেখে কখনো কখনো মনে হতো একটা শিকারী ঘুঘু বুঝি কলেজে ঢুকেছে। যদিও পারিবারিকসূত্রে শৈশবেই অল্প-বিস্তর উপলব্ধি করে নিয়েছিলাম, তবুও একদিন কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম, বুঝতে চাইলাম। তারপর অনেক কথা... ধীরে ধীরে অন্যজগতে, অন্য এক সময়ে আমি চলে গিয়েছিলাম। একদিন টিএসসিতে কথা প্রসঙ্গে বললো, আমরা সবাই একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি...। বাড়িটা হবে ভালোবাসার আর পারস্পরিক সহযোগিতার, সহমর্মিতার। তুমি-আমিসহ ষোল কোটি মানুষ বাড়িটাতে থাকবো। একসাথে খাবো, একসাথে রাত জাগবো, একসাথে ঘুমোবো। একদিন পার্টির কাজে বরিশাল যাওয়ার পথে অপূর্ব গ্রেফতার হয়। তারপর...আর তাকে কোথাও পাওয়া যায় না। না জেলে, না বাইরে। তবে আমি এখনো বাতাসে কান পাতলে স্পষ্ট একটা স্বপ্নবাণী শুনতে পাই; একসাথে খাবো...একসাথে ঘুমোবো।
তখন থেকে ধীরে ধীরে সে-অন্যজগতের বড়ো বড়ো পথ থেকে শুরু করে চিকনগলি পর্যন্ত মুখস্থ করতে থাকি। তখন একটা বাড়ির অস্তিত্ব আমার ভেতরও উঁকি দিতে শুরু করে। আর ভাবি, সত্যিই কি হবে কোনোদিন! উন্নয়নের দেবতারা যেভাবে ট্রাক বোঝাই করে হাজার বছর ধরে পূর্বপুরুষদের জমানো ইট-পাথর-বালি লুট করে নিচ্ছে, তাতে কি আর সম্ভব হবে একটা বাড়ির অস্তিত্ব দাঁড় করানো? তাছাড়া একটা বাড়ি নির্মাণ করতে যেসব বিকট শব্দের প্রয়োজন, সেগুলোই বা কোথায়? অথচ একদিন কিন্তু শব্দগুলো আমাদের পাশে ছিলো। রাজপথ-বিক্ষোভ-মিছিল, ফেটে পড়া প্রতিটি মুহূর্তে, চেতনার অগ্নিগোলা হয়ে গলার সবকটা রগ ফুলিয়ে বাকপ্রতঙ্গ ছিঁড়ে তারা বেরিয়ে পড়তো। ঝরে পড়া প্রতিটি রক্তকণার হিসেব কীভাবে কষতে হয়, পাশে থেকে প্রেক্টিকেলি তারা সুহৃদবন্ধুর মতো শিখিয়ে দিতো। আজ তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না দৃষ্টির ত্রিসীমানায়? নিশ্চয়ই পুষ্টির অভাবে ঝরে গেছে মাঘের শুকনোর পাতা। কিংবা আমাদেরই অযতœ আর অবহেলায় অভিমানী বালকের মতো ঘাড় কাত করে মাথা ঝুলাতে ঝুলাতে চলে গেছে দূর দিগন্তে। যেখান থেকে খুঁজে বের করার শক্তি-সাহস আমরা হারিয়ে বসে আছি।
বৃষ্টি থেমে গেলে ওদের কথা আবার শুরু হয়। লোকটিকে দেখা যাচ্ছে না। দক্ষিণ দিক দিয়ে সোহাসদের আর আমার বাসা পাশাপাশি। জানালাগুলো পরস্পরের মুখোমুখি। রেলিং ঘেষে হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যায়। সোহাসকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কোথায়। বললো, তিনি কমরেড শামসুল। রেণুর দূর-সম্পর্কের মামা। চিরকুমার। তিনি অনেকটা অন্যরকম টাইপের মানুষ। বৃষ্টিতে ভিজেই চলে গেছেন।
তিনি কী ধরনের লোক তা আমি বুঝতে পেরেছি। হতাশার চোরাবালিতে পড়ে এভাবে অনেকেই স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। যে-কারণে আমাদের সংসারটাও পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির অন্যতম নেতা হয়েও সামান্য মত-পার্থক্যের কারণে বাবাকে খুন হতে হয়। ভাঙন দেখা দেয় পার্টিতে। দলে-উপদলে বিভক্ত হয় কর্মীরা। হয় একে-অপরের শত্রু। এ শত্রুতা শ্রেণিশত্রু চেয়েও ভয়ঙ্কর। আস্থার ঘরে ঢুকে যায় সন্দেহের বিষাক্ত সরীসৃপ। আর একবার ঢুকে গেলে সব শেষ হয়ে যায়। ছোবলে ছোবলে পার্টি তো মরেই, সাথে পায়ের তলার মাটিরও মৃত্যু ঘটে।
 কমরেড শামসুল বেঁচে আছে ঠিক কিন্তু এটাকে বাঁচা বলা যায় না। আমি মানুষের এ অবস্থাকে মৃতই মনে করি। আমার কথাই বলি, আমি কি বেঁচে আছি। বাবার পার্টি মরে যাওয়ার পর থেকে মার্ক্সবাদ-সংশোধনবাদের দোলনায় দুলছি তো দুলছিই। এর শেষ কোথায় আপাতত তো চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তবে ‘আবার আসিবো ফিরে’র মতো যদি কেউ সত্যি সত্যিই ফিরে আসে, তাহলে ভিন্ন কথা। অঙ্কুরোদগম করতে হলে তো কাউকে না কাউতে মরতেই হয়। ফল পচে যায়, রেখে যায় বিচি। সে বিচিতে আবার প্রাণে সঞ্চার। তারপর বৃক্ষ। কত ডালপালা। কত বিস্তৃত ছায়া। হয়তো এজন্যেই নিজেকে বলতে পারছি—বেঁচে আছি। হয়তো এজন্যেই মানুষকে ভালো লাগে। তারা কে কী ভাবছে তা শুনতে ভালো লাগে। একটা সময় ছিলো প্রচুর কবিতা পড়তাম। বিশেষ করে লিটলম্যাগের। নতুন লিখিয়েদের কবিতায় ভিন্ন এবং একদম নতুন চিন্তা কাজ করে। সেগুলোতে অন্যরকম এক ভালোলাগাও লেগে থাকে, যা আমাকে খুব টানতো। কোনো কারণে শাহবাগ-আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে গেলেই লিটল ম্যাগের দোকানগুলোয় ঢু মারতাম। এখন কোথাও যেতে ভাল লাগে না। মন চায় না। কেবলই মনে হয়, যেনো কোথাও থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পরিচিত সব আলো-বাতাস থেকে। চোরাস্্েরাতের মতো। স্বরহীন। গতিক্ষীণ। মনে হয়, কেউ যেনো কানের ভেতর ওহি নাযিলের মতো বলছে, সরে যাও। যাতে কেউ না দেখে ফেলে। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ো। কিন্তু কোথায় কেটে পড়বো। কেনো পড়বো। উত্তর নেই। তবে কি অশরীরী কোনো শয়তানী আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে!
কথা বলতে বলতে দেখি আকাশ আবার কালো হয়ে আসে। সোহাস-রেণুকেও দেখি কেমন করতে শুরু করেছে। আমার সাথে কথা বলছে ঠিক, কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া। মনে হলো ওদেরকে সময় দেয়া দরকার। আমি তখন পর্দার আড়ালে চলে আসি। জানালা বন্ধ করে দিই। ওরা হয়তো তখন একে-অপরকে ভাঙতে থাকে। ভাঙতে ভাঙতে অনু-পরমাণু। তারপর কেবলিই বর্ষণ।
একদিন রেণু এসে বলে, আপা, আপনি সাজ্জাদ ভাইকে বিয়ে করে ফেলুন। ভাইয়া নাটক-ফাটক নিয়া থাকলেও আপনাকে খুব ভালোবাসে। আপনি একটু সিরিয়াস হলেই হয়।
ইচ্ছে তো আমারও হয়। বিয়ে করে সমাজের আর দশজনের মতোই সংসার করি। অ্যাকুরিয়ামের রঙিন মাছের মতো ঘরে বন্দি থাকা, ফেসবুকে ডুবে থাকা, বই পড়া কতো ভালো লাগে! তার চে’ বিয়ে করে নিলে সময়টা হয়তো অন্যভাবেই কাটতো। নগ্ন-নির্জন বাড়ি। সাজ্জাদ যখন ইচ্ছে আমাকে ভাঙতে পারতো। আমিও যখন তখন গুড়ো হবার আনন্দে বিভোর থাকতাম। কিন্তু সাজ্জাদকে আমি যদ্দূর জানি, এ ধরনের লোকদের কেবল ভালোই বাসা যায়, সংসার করা যায় না।
এজন্যেই মাঝে মধ্যে নিজেকে বলি, থাক, কিছুই করার দরকার নেই। একাই থাকো। টিভি দেখো। ফেসবুকে ফ্যাক আইডি খুলো। দূরের কারো সাথে গোপন চ্যাটিং করো। গুগলে সার্চ করে লাইভে সেক্স দেখো। তা না হলে আরো বই কিনে আনো। পুরোনো বইগুলো অযতেœ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঝেড়ে-মুছে সাফ করো। ঘ্রাণ শুঁকো।

..............


শেষাধ্যায়

শেষাধ্যায়


শেষাধ্যায়
বিবিকা দেব

চোখ দুটো স্থির। জীবনে চলার পথে যত হিসেব নিকেশ এক নিমেষেই শেষ হবে। আশে পাশে সবাই এসে চামচ দিয়ে পানি খাওয়াচ্ছে। কেউ বা পাশে বসে নাম কীর্ত্তন করে। সহজ সরল ছোট মেয়েটার কথা ভেবেই চোখের কোটর বেয়ে দু’ধারা জল গড়িয়ে পড়ে। কেউ বা বলে একটু সরে দাঁড়াও বাতাস আসা যাওয়া করুক। মানুষের কোলাহলের ভীড়ে পাখির কলরবে ও বাতাসের সাথে প্রাণ বায়ু মিশে গেছে।
মুক্ত এখন অবনী পাল। ততক্ষণে বাড়ীময় কান্নার ধুম পড়ে গেছে বড় ছেলেকে ফোনের মাধ্যমে মায়ের মৃত্যু সংবাদ পাঠানো হল। বড় ছেলে দুলাল বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে অবস্থানরত। পন্য বহনকারী জাহাজে চাকুরী করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আসা যাওয়া করে। বড় ছেলের বউ ননী পাল বিলাপ করে শাশুড়ির জন্য। মেঝ ছেলে জীবিত নেই! লিভার জন্ডিসে সুবল মারা যায়। তিন মাসের ছোট দিপুকে নিয়ে মেঝ বউ বাবার বাড়ীতে ফিরে যায়। অবনী পাল মৃত্যুর দুই দিন আগেও নাতীকে চোখের দেখা দেখতে চায়। খবর পৌঁছানো হয়েছে। কিন্তু মেঝ বউ আসতে পারে নাই।
লক্ষী পাল হচ্ছে অবনী পালের ছোট মেয়ে। সেই ও মায়ের জন্য খুব কান্না করে। আত্মীয় স্বজন যারা আছে সবাইকে অবনী পালের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানো হয়। সকাল থেকে দিনের বেলা বাড়ার সাথে সাথে মানুষ বাড়তে থাকে। গ্রামের গুরুজন যারা আছে। ওনারা আবার তাড়া দেয় এই ও বলে মৃত মানুষের জন্য এত পোড়াতে শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে। এদিকে ছোট ছেলে সুলাল কাজের খোঁজে শহরে গেছে।
এদিকে লক্ষীর কোন গতি হবে। মা ছিল শেষ আশ্রয়। মমতাময়ী মা’টাও মরে গেল টুক করে। সহজ সরল মেয়ে বলে বিয়ের পর শশুড় বাড়ীতে ঠাঁই হল না। পর পর দুইটা ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যে একটাও বেঁচে নেই। ছেলে দুইটা জন্মানোর কয়েক ঘন্টা পর মারা গেছে। তার কয়েক মাস পরে স্বামী বিমল পাল লক্ষীকে বাবার বাড়ীতে রেখে চলে যায়। প্রথম কয়েক মাস খোঁজ খবর নেয়। পরে বিমল পাল আর লক্ষীর খোঁজ নেয় না! পরের বছর বিমল পাল আবার নতুন বউ ঘরে তোলে। দিব্যি সুখে সংসার করে। এদিকে দিন মাস যায় লক্ষীর চোখের জল আর থামতে চায় না!
বাবা বেঁচে নেই। ভাইদের সংসারে খেটে খুটে থাকতে হয়। সারা দিন ঘরের বাহিরে কাজ করার পর দু’একটু কাটা কপালে জুটে। তাও আবার ভাইয়ের বউদের মুখ ঝামটা শুনতে হয়। লক্ষী যাবেই বা কোথায় ? কোথাও যাবার জায়গা নেই। গ্রামের পাড়া পড়শিরা আড়ালে লক্ষীর নামে নিন্দ করে। আবার দু’ একটা কটু কথা শুনিয়ে দেয়। আরও বলে লক্ষী অপয়া, অলক্ষী মেয়ে। স্বামীর ভিটেতে থাকতে পারল না। ছেলে দুইটাকেও মেয়ে ফেলেছে।
মায়ের মৃত্যুর পর কেউ লক্ষীর দায়িত্ব নিতে চায় না। এদিকে বাঁশ দিয়ে মড়া বহন করার খাটিয়া প্রস্তুত। বড় ছেলে দুলাল এখনো বাড়ীতে আসতে পারেনি। অবনী পালকে ঘর থেকে বের করে খাটিয়ার উপর আস্তে আস্তে শুইয়ে দেয়। বাড়ীর চারপাশে শুধু কান্নার শব্দ।
অবানী পালের ছোট ছেলে সুলাল সহ, চার জন শক্ত সামর্থ মানুষ খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয়। শ্মশান যাত্রীদের মুখে হরি বোল, হরি বোল বলে শ্মশানে উদ্দেশ্য নিয়ে যায়। অবনী পাল শেষ বারের মত স্বামীর ভিটে থেকে চির বিদায নেয়। শ্মশানে নিয়ে আম কাষ্ঠের উপর চিৎ করে শুইয়ে দেয়। বড় ভাই দুলাল আজো আসতে পারেনি। তাই ছোট ছেলে সুলাল মায়ের মুখাগ্নি করে। হাতে আগুনের মশাল নিয়ে সাত পাক ঘুরে কাষ্ঠের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাউ দাউ করে সেই আগুন জ্বলতে থাকে। সাথে ধূপ ছিঠানো হয়। পোড়া গন্ধ যেন ধূপ সুগন্ধি হয়।
ঘন্টা তিনেক পর চিতার আগুন নিমেষেই শেষ। এদিকে লক্ষীর কান্নার শব্দে গাছের পাতারা যেন নৈঃশব্দ্যে নির্বাক হয়ে গেছে। পাখীরা যেন আপন স্বর ভুলে গেছে। দিন শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। লক্ষীর সারা ঘরময় মাকে খুঁজতে থাকে। মা...মা বলে ডেকে যায়। কিন্তু মা সাড়া দেয় না। অন্ধকার ঘরে লক্ষী একা একা বসে থাকে। যে যার মত চলে যায়। কেউ আর সহজ সরল লক্ষীর খোঁজ করে না। লক্ষী শুধু মায়ের কথা ভাবতে থাকে। মা কোথাও যায় নিই। আবার ফিরে আসবে। লক্ষীর কাছে এসে মা পাশে বসবে। ¯েœহের হাত মাথায় রাখবে। লক্ষীর যখন সংবিৎ জ্ঞান ফিরে আসে, দেখে ছোট ভাই সুলালের হাতে সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষী দৌঁড়ে গিয়ে ছোট ভাইয়ের বাহু জড়িয়ে কান্না করে। কান্না আর থামতে চায় না! চোখে ভাসে এখনো চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে। মাথার উপর থেকে বট বৃক্ষের ছায়া নিমেষেই হারিয়ে গেল। মা যেখানে যাও ভালো থেকো!


তুমি যার জন্যে কাঁদছ, সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না...

 তুমি যার জন্যে কাঁদছ,  সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না...


 তুমি যার জন্যে কাঁদছ,
সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না...
মীম মিজান

বাংলাদেশ এক বৈচিত্র্যের অধিকারীনি। আর তার বৈচিত্রের প্রধানতম কারণটি হলো বার মাসে বিচিত্র ছয়টি ঋতু। এদেশের আলো-বাতাশে বেড়ে ওঠা কবিগণের মনও তাই তাদের দেশ মাতৃকার বৈচিত্র্যের স্মৃতিতে ছিল সর্বদাই সরব। বসন্ত ও বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের লেখকরা যত রূপে লিখেছেন তা আর কোনো ঋতু নিয়ে ততটা লেখেননি। তার মধ্যে বর্ষা-ঋতু বাংলার কবিদের মন ও মননকে আন্দোলিত করেছে অনন্য এক আলোড়নে। সব যুগে সব সময়ে বর্ষা তার অপরূপ রূপের ছুরি নিয়ে হানা দিয়েছে প্রেমিক কবির মনে। কবিরাও অপরূপ রূপের রাণী বর্ষার ছুরিতে খুন হতে চেয়েছেন বারবার।
এ কথা অত্যুক্তি নয় যে, বাংলা কবিতায় বর্ষা ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুগামী বৈচিত্র্যতা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র। আমাদের বাংলা কাব্য সাহিত্যে মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় বর্ষার বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে কবি কালিদাস, জয়দেবের কবিতায় বর্ষার সন্ধান মেলে। তা ছাড়া কবি বড়– চন্ডীদাসের শ্রী কৃষ্ণকীর্তনে, কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, রায়শেখর, মনোহরদাস, বাসুদেব ঘোষ এদের প্রত্যেকের বৈষ্ণব পদাবলিতেও বর্ষার বর্ণনা রয়েছে। যেখানে দেখা যায় যে, তারা প্রত্যেকেই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের যে অনুরাগ সেই অনুরাগের গভীরতাকে প্রকাশ করেছেন বর্ষার বিভন্ন রূপ বৈচিত্র্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এ ছাড়াও মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, খনার বচন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, অক্ষয় কুমার বড়াল, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় বর্ষার সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের হাত ধরেই বাংলা কবিতায় বর্ষার বিচিত্ররূপ বা সৌন্দর্য উঠে এসেছিল। এ প্রসঙ্গে কবি কালিদাস বর্ষাকে কিভাবে অনুভব করেছেন তা দেখা যেতে পারে। কালিদাস বর্ষাকে অনুভব করেছেন অনুরাগের গভীরতায়। কালিদাসের দৃষ্টিতে বর্ষার সৌন্দর্য-সখা যে মেঘ, সেই মেঘকে কবি লোভনীয় সম্ভোগের আভাস দিয়ে যক্ষের সহচররূপে যক্ষ প্রেমিকার কাছে পাঠান। সেখানে মেঘ সঙ্গত কারণেই প্রেমের বার্তাবহ দূতরূপে চিহ্নিত হয়। মেঘের সঙ্গে প্রেম আর বিরহের একটা অনড় সম্বন্ধ পাতিয়ে কালিদাস তার কবিতায় এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। কালিদাসের কবিতার অনুবাদের কিছু অংশবিশেষ পড়লে আমরা তার বর্ষা নিয়ে মননের অভিব্যক্তি বুঝতে পারব:


‘কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে/যদি- না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?/যক্ষ অতএব কুড়চিফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য/স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।’
মধ্যযুগের আরেক কবিপ্রতিভা কবিকঙ্কন উপাধিখ্যাত মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন:
‘আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুড়ে
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি’


বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান মহাপুরুষ বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তার হাত ধরেই কবিতার মাধ্যমে বর্ষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। তার কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বাদ দিলেও বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তার ‘আষাঢ়’, সোনার তরী’, ‘বাঁশি’সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
‘আষাঢ়’ কবিতায় তিনি মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। তবে আষাঢ় মাসের একটি নিটল বর্ণনা তার কবিতার দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে। আউশের খেত, কালিমাখা মেঘ, ধেনু ও ধবলীর বর্ণনায় সত্যিই গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে। যা পাঠকমনে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।
‘সোনার তরী’ কবিতার দৃশ্যকল্প এ রকম আকাশে মেঘ গর্জন করছে। চারিদিকে বরষার পানি থৈ থৈ করছে। সঙ্গে খর¯্রােত বয়ে চলছে। জমির ধান কেটে একটি ছোট খেতে কৃষক একা বসে আছেন, পার হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ধান কাটতে কাটতে নদীর জল বেড়ে গেছে। খেতের চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলা করছে।
‘বাঁশি’ কবিতায় দেখা যায়, বর্ষা এলেই ট্রামের খরচা বাড়ে। ছাতার অবস্থা জরিমানা দেয়া মাইনের মতো- বহু ছিদ্র তার। চারিদিকে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। তখন গলিটাকে ঘোর মিছে অন্ধকার মাতালের প্রলাপের মতো মনে হয়।
এছাড়া কবিগুরুর অন্যতম ছড়া কবিতা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ আমাদের দুরন্ত শৈশবকে হাতছানী দিয়ে ডাকে। তারও অনেক পরে বর্ষার স্মৃতিতাড়িত হয়ে কবিই আবার বলেছেন:
‘কবে বৃষ্টি পড়েছিল, বান এলো যে কোথা
শিব ঠাকুরের বিয়ে হলো কবেকার সে কথা।
সে দিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘনঘটা
থেকে থেকে বাজ বিজুলি দিছিল কি হানা।’
প্রেমের কবি কাজী নজরুলের কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রেমের জারক হিসাবে। প্রিয়া বিরহ আরো দ্বিগুণ করেছে বাদল দিনের মেঘ। বাদল ধারা প্রিয়ার আগমনী সুরকে বিদায়ী সুরে পরিণত করেছে। বাদল রাতের বর্ষণ সিক্ত রাতের পাখি হয়ে ওঠে কবির বেদনা বিজয়ী চিত্তলোকের চিত্রল প্রতীক। বিরহ কাতর পাখিকে কবি তাই বলছেন, তুমি যার জন্যে কাঁদছো সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না। যেমনটি ‘চক্রবাক’ গ্রন্থের ‘বাদল রাতের পাখী’ কবিতায় কবির উপদেশ:
‘বাদল রাতের পাখী।


উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।’
কবি বর্ষার এই রাতে পাখিকে বন্ধু ভেবেছেন। পাখির বিরহের সাথে নিজের বিরহ একাকার করেছেন। আসলে সকল কোলাহল ছেড়ে কবি বর্ষার নির্জনতায় প্রেমের প্রকৃত মূর্তি গড়েন। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম বর্ষার বিদায় মুহূর্তে ব্যথিত হয়েছেন। কবি বর্ষাকে বলেছেন, তোমার বিদায়ের কথা শুনে কেয়া রেণু পান্ডুর হয়েছে, প্রণয় অশ্রুসম শিশিরভেজা শেফালি ঝরছে আজ। ঝরে কদমের কেশর। ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষা-বিদায়’ কবিতায় কবি তাই বলেছেন:
‘সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নুপূর খুলি’
চলিতে চলিতে চমকি’ উঠ না কবরী উঠে না দুলি’!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!’


পল্লী কবি জসিম উদদীন বর্ষায় দেখেছেন গাঁয়ের কৃষক-মুঠেরা কি করে তাদের এ আলস্য সময়ে। দাওয়ায় বসে গল্প, গান কিংবা গৃহস্থালী কিছু উপকরণ তৈরির দৃশ্য। যেমনটি পল্লী-বর্ষা কবিতায় গাঁয়ের চিত্র বর্ণনায় লিখেছেন:
‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পের গানেকি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।’
আদিকাল থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বর্ষাঋতু নিয়ে রয়েছে উচ্ছ্বসিত বন্দনা, অনুরাগ ও স্মৃতি। রহস্যময়ী এ বর্ষার রূপ, বৈচিত্র্য, চমক, বর্ণচ্ছটা এবং আকাশ- প্রকৃতির গভীর মিতালী শিল্প-সাহিত্যের সরস উপকরণ হিসেবে আবহমানকাল থেকেই অনুপ্রাণিত ও স্পন্দিত করছে শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকদের।
তার-ই ধারাবাহিকতায় কবি আহসান হাবীব বৃষ্টিকে ঘিরে আমাদের দারিদ্র্য, হতাশা আর স্বপ্নকে বুনেছেন নিজস্ব স্বপ্নময়তাকে অবলম্বন করে। তিনি যেন প্রবল কোনো ঘোরের মধ্যে থেকে পার করছেন অপেক্ষার নিরন্তর প্রহর। তার ‘রেনকোট’ কবিতায় লিখেছেন:
‘পঁচিশটি বর্ষা ত পেরিয়ে এলাম
দেখে এলাম
কত অন্ধকার অরণ্যশীর্ষ
কালো মেঘের অন্ধকারে ছাওয়া,
দেখলাম
কত ঝরঝর বর্ষা
আর কত নিঃসঙ্গ জানালার
ইতিহাস পড়লাম
আমার নির্বিকার জানালায়।’
আমরা যদি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তাহলে দেখতে পাই তিনি বর্ষাকে কল্পনা করেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসাবে। তার কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যার সাথে একাত্ব ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। মধুসূদন দত্তের ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা হয়েছে এভাবেই:


‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমনীর মন লয়ে/সুখে কেলি করে/দানবাদি দেবযক্ষ সুখিত অন্দরে।’
‘বিপ্লবী’ ও ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ ফররুখ আহমদ অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণায় ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতায়ও বর্ষার দোল লেগেছে। বৃষ্টির ছন্দ তাকে নাচিয়েছে। মনে আনন্দের ঢেউ খেলিয়েছে। তিনি আনন্দে তবলার ছন্দের মতো শিশুতোষ কাব্য ‘বৃষ্টির গান’-এ গেঁথেছেন :
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।’
বাংলা সাহিত্যের মহিলা প্রতিনিধিত্বকারী কবি সুফিয়া কামালের কবি মনন ও মানষে বর্ষার আগমন ও স্মৃতি এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। পোয়েট অ্যান্ড পেইন্টার খ্যাত ইংলিশ কবি উইলিয়াম ব্লেক যেমন ‘ ল্যাম্ব’ ও ‘টাইগার’ দুটি কবিতা দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির দুটি বিপরীত কিন্তু অনিবার্য মহিমা তুলে ধরেন সুফিয়া কামালও তাই। বৈশাখের তপ্ত খরতাপের পরে আসে বর্ষা। বর্ষার নতুন জল ধারায় প্রাণে জাগে স্পন্দন। সজীবতায় প্রাণ ফিরে পায় বিশ্ব-ব্রহ্মা। ঝড়ের রুদ্রমূর্তির পরে সরস বর্ষার যে রূপের সন্ধান মেলে, তা কবির ‘ঝড়ের শেষে’ কবিতায় উঠে এসেছে :
‘মধুর মমতা ধারা বিথারিয়া আর্দ্র সমীরণে
ভুলিয়া বেদনা জ্বালা শুচিস্মিতা প্রশান্ত আননে
চাহিয়াছে ঊর্ধ্বমুখী সুকল্যাণী ঝঞ্ঝা বিশেষে
যত ক্ষতি যত ব্যথা ভুলাইয়া ভুলিয়া নিঃশেষে।’
ইয়সমিন সুলতানা ‘বর্ষার প্রতীক্ষা’ কবিতার ব্যাপারে বলেন, ‘কবি এই কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ষার জলধারাকে কবি প্রিয়ার অভিমানিত অশ্রুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রিয়া এলায়িত ঘনকেশে দিগন্তের দিকে চেয়ে চেয়ে প্রিয়ের জন্য অপেক্ষা ও অশ্রু বিসর্জন করে।
 গ্রীষ্মের তপ্তরোদে বর্ষা তার ঘন মেঘ নিয়ে বর্ষণের জন্য অপেক্ষা করে। তারপর এক সময় তা ধরণীর বুকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে।’


বর্ষাকাল মানেই আকাশ কালো করা ঘন মেঘের আনাগোনা, যখন তখন ঝমঝমিয়ে পড়ে বৃষ্টি। পথে ঘাটে কাদাপানি। ঘরে স্যাঁতসেঁতে ভাব। তাই তো কবি শামসুর রাহমান বর্ষার বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন:
‘হঠাৎ আকাশ সাদা মুখটি কালো করে,
কালো মেঘে বুকটি ফুঁড়ে পানি পড়ে।
ঝর ঝর ঝর একটানা বৃষ্টি ঝরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ঝরে।’
এছাড়া কেতকীর মনমাতানো সুগন্ধ, কদমফুলের চোখ জুড়ানো শোভা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছ্বল নৃত্যের আবাহন থাকে এই আষাঢ়েই। তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ আষাঢ়কে বলেছেন- ‘ধ্যানমগ্ন বাউল- সুখের বাঁশি’।
বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তার কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার এক কথা বলে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ তিনি ব্যক্ত করেছেন :
‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল
আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’
উপর্যুক্ত কবিগণ ছাড়াও প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের অনেক কবি বর্ষার বন্দনায় কাব্য স্তুতি করেছেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হক, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, নির্মেলন্দু গুণ, হুমায়ূন আহমেদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, কায়কোবাদ, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী, শেখ ফজলল করীম প্রমুখের কাব্য মানসেও বর্ষার অপার সৌন্দর্য নিয়ে রয়েছে সরস বর্ণনা। বর্ষা আসে কবিগণের মানসকে উদ্বেলিত করে নস্টালজিয়ায়। অনেকেই কাছে পেতে চেয়েছেন তার আপনজনকে। কারো কাছে দাওয়ায় বসে গল্প করা। কিন্তু খেটে খাওয়া মজুর-মুঠেদের দূর্দশার বর্ননাও এসেছে অনেক মানবতাবাদী কবির কাব্যে। সবাই নিজেদের নস্টালজিয়ায় ভেসে বেড়ানো, প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা ও একত্রে সবাই বসে গল্পে মশগুলের পাশাপাশি যেন দূর্দশাগ্রস্থদের পাশে দাঁড়াই। বর্ষা হোক সবার জন্য আনন্দের!


ওগো বাদলের পরী যাবে কোন্ দূরে ঘাটে, বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী...

ওগো বাদলের পরী  যাবে কোন্ দূরে ঘাটে,   বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী...


ওগো বাদলের পরী
যাবে কোন্ দূরে ঘাটে 
বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী
মোস্তফা কামাল গাজী

গ্রীষ্মের প্রচ- রোদ্দুর আর তাপদাহের পর ঘন গৌরবে নব যৌবনে আসে বর্ষা। জরাজীর্ণ প্রকৃতি সিক্ত হয় আল্লাহর বর্ষিত বৃষ্টিজল দিয়ে। বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল। এ দুমাস বর্ষাকাল হলেও এর ব্যাপ্তি আরো বেশি। ষড়ঋতুর লীলার মাঝে বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যে বর্ষাকাল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বসন্তকে ঋতুরাজ বললেও রূপের গৌরব ও প্রকৃতির সৌন্দর্যে বর্ষাই প্রকৃতির রাণী। বর্ষার আগমনে খাল-বিল জলমগ্ন হয়ে যায়। জনজীবনে নেমে আসে আনন্দঘন পরিবেশ। মেঘেরা ডেকে যায় ‘গুড়–ম গুড়–ম’ শব্দে। কালো মেঘের ভেলা ভেসে যায় পশ্চিম দিগন্তে। আকস্মিক বিদ্যুৎ রেখা চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আকাশ ছাপিয়ে নামে বৃষ্টি। আল্লাহর নেয়ামত সে বৃষ্টি প্রবাহিত হয় ফসলের মাঠ, নদীনালা, খালবিল সবখানে। একটানা রিমঝিম শব্দের দ্যোতনায় উদাসী বনে যায় মন। টাপুরটুপুর বৃষ্টিফোঁটা পত্রপল্লবে দিয়ে যায় সজীবতার ছোঁয়া। ধুয়ে দেয় তরু-মহীরুহের সকল পঙ্কিলতা। ঝুম বৃষ্টি পুকুরজলে পড়ে ঝুমুরঝুমুর শব্দ তোলে। মনে হয় যেনো নূপুর পায়ে কিশোরী পুকুরজলে নৃত্য করছে।
বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায় খাল-বিল, নদী-নালা। চারদিকে থৈ থৈ করে নতুন পানি। গ্রামগুলোকে তখন মনে হয়, বিশাল সমুদ্রে ভাসছে ছোট ছোট কয়েটা দ্বীপ। নতুন পানি পেয়ে আনন্দে ভেসে বেড়ায় নানান প্রজাতির মাছ। গাঁয়ের বিলকে অনিন্দ্য আর বাহারি রূপে সাজায় সাদা শাপলা। ছোট ছেলেমেয়েরা কলাগাছের ভেলায় চড়ে তুলে আনে শাপলা, শালুক। পরিষ্কার জলে ডুব সাঁতার দিয়ে হার মানায় পানকৌড়িকেও। জেলেরা জাল ফেলে ধরেন ছোট-বড় অনেক মাছ। বর্ষায় জেলেদের আয়ের অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে এই মাছ শিকার। চাষিরা ফলান আউসের ধান। উদাস হয়ে পল্লীবধূ ঘোমটা পরে রাঙামুখ টেনে ছই নৌকোয় বাপের বাড়ি নাইয়র যায়। চারদিকে বয়ে চলে রংবেরঙের পালতোলা নৌকো। মাঝি আনন্দসুখে গলা ছেড়ে গান ধরেন। ঘরের দাওয়ায় বা জানালর পাশে বসে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে বেশ ভালই লাগে। এ সময় দাদা-দাদিরা ছোটদের সামনে গল্পের ঝুলি খুলে বসেন। বিকেলে আয়োজন হয় চালভাজা ও মুড়ি-মুড়কির। বাড়ির বউ-ঝিরা তখন নিজেদের মনের কল্পনাগুলো ছড়িয়ে দেন নকশীকাঁথায়। পুকুরপাড়ের কদমগাছে ফোটে হাজারো কদম ফুল। মনে হয় যেনো কয়েকশ ঝাড়বাতি কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে গাছে।


গ্রামের মতো শহরে বর্ষার সৌন্দর্য খুব একটা ফুটে ওঠে না। তবুও ইট-পাথরে ঘেরা শহুরে লোকজনও বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঝুম বৃষ্টিতে কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় বর্ষার পরশ পেতে। কেউ ছাদে উঠে বৃষ্টির ছোঁয়া নিয়ে জুড়িয়ে নেয় দেহ-মন। কেউ ফিরে আসেন গ্রামে।
বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত বৃষ্টির রিমঝিম মিষ্টি সুরে রচিত হয়েছে শত শত ছড়া, কবিতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।/কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।/রাশি রাশি ভারা ভারা/ধান কাটা হল সারা,/ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।/কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।’
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ওগো বাদলের পরী!/যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!/ওগো ও ক্ষণিকায়, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব?/পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব?’
কেবল রবীন্দ্রনাথ বা নজরুন নন, যুগে যুগে অনেক কবি-সাহিত্যিক মানুষের হৃদয়ানুভূতিকে মেঘে সঞ্চারিত করেছেন, বৃষ্টির জলধারায় করেছেন সিঞ্চিত। শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতে বর্ষা পেয়েছে এক চিরায়ত মর্যাদা।


বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এই মেঘ-বর্ষার একটি পৃথক রূপ আছে। এই বৃষ্টি আর মেঘ মানুষের মনকে করে তোলে উদাস ও ব্যাকুল। মন হয়ে ওঠে চঞ্চল, স্মৃতিভাবাতুর। মনে হয় যেন বহুযুগের ওপার হতে নেমে আসছে এই বৃষ্টি। ভাবুক মন হারিয়ে যায় কেবল কোন দূর অজানায়।
বর্ষার সৌন্দর্য অতুলনীয় হলেও কোনো কোনো সময় বর্ষাকাল হয়ে ওঠে মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগের। বৈরি আবহাওয়া আর অতিবৃষ্টিতে বন্যার সৃষ্টি হয়। ফসলাদি তলিয়ে যায়। কৃষক আর হতদরিদ্র মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না তখন।
মানুষ তবুও বর্ষাকে আপন করে নেয়। কারণ, বর্ষাকালের সঙ্গে কৃষির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। বর্ষার প্রকৃতিতে ¯্রষ্টার পরিচয় সহজেই ধরা দেয় মানুষের কাছে। বর্ষা প্রকৃতিকে যেমন সতেজ ও গতিময় করে তোলে, তেমনি মানুষের মনকেও করে তোলে সহজ, সরল ও ছন্দময়। সৃষ্টিশীল চেতনাকে করে সুচারু ও তীক্ষ্ম। একজন ভাবুকের জন্য স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবার উপযুক্ত সময় এটা। বর্ষার নির্মেদ প্রকৃতি ফুরফুরে অনুভূতি সৃষ্টি করে প্রতিটি অন্তরে। উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগে তাড়িত করে সকলকে। বর্ষার প্রকৃতি জাগ্রত করে উদার, প্রেম ও ভালোবাসার সরল অনুভূতি।