ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১১৩

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১১৩
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১১৩
বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯































কিছু কিছু ইতিহাস ভাসতে থাকে জলে

কিছু কিছু ইতিহাস ভাসতে থাকে জলে






কিছু কিছু ইতিহাস ভাসতে থাকে জলে
মিনহাজ শোভন

বারান্দায় বসে শীতের সকালের স্নিগ্ধ রোদ পোহাতে মন্দ লাগেনা। খুব ভালোই লাগে। এতো ভালো লাগে অনেকে আবার প্রেমে পড়ে যায় সকালের। আফরা হয়তো প্রেমেই পড়ে গেছে। নয়তো প্রতিদিন সকালে এক কাপ গরম চা হাতে বারান্দায় রাখা চেয়ারটাতে স্বামীর মতো গা এলিয়ে বসে থাকার মতো মেয়ে সে নয়।
আরাফাত প্রতিদিন সকালে এক কাপ গরম চা হাতে বারান্দায় এই চেয়ারটাতে গা এলিয়ে রোদ পোহাতো। গাড়ি দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যাওয়ার কয়েকমাস পরে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করেছে আরাফাত। তার মৃত্যুর পর অনেকদিন বারান্দায় আসতে পারত না আফরা। মনের ভেতর একটা অজানা ব্যাথা জাগ্রত হয় যখন বারান্দায় রাখা এই চেয়ারটার ওপর চোখ পড়ে। আরাফাতের মৃত্যুটা কেন জানি স্বাভাবিক মনে হয় না তার। হয়তো খুব কাছের, খুব আপনজন বলেই এমনটা হয়। অন্য কারো বেলায় তো এমনটা হয়নি। সেই কৈশরের দুরন্ত দিনে তাকে চুপিচুপি দেখতে থাকা ছেলেটার অস্বাভাবিক মৃত্যুটাও তার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ছেলেটার পেটে না কোথায় যেন সমস্যা ছিল। তখন সে বেশ ছোট তাই মানুষের কথাগুলো সে বুঝতে পারেনি। আজ এতোটা বছর পরে আর সেই ছেলেটার মৃত্যুর কারণ তার মনে পড়ে না। মনে পড়ে না ছেলেটার মুখচ্ছবি। ছেলেটার ছিপছিপে গড়ন আবছা আবছা মনে পড়ে। কিন্তু কি আশ্চর্যজনকভাবে আরাফাতের চেহারাটা এখনো ভুলে যেতে পারছে না সে। প্রায় বছর পাঁচেক হতে চলল আরাফাত এখানে, এই বাড়িতে নেই। চলে গেছে এই বাড়ির; এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনেক দূরে। আরাফাতের স্মৃতি তার বুকে কাঁটার মতো বিধত। সেই স্মৃতির কাঁটা থেকে নিজেকে বাঁচাতেই আরাফাতের স্মৃতিযুক্ত সমস্ত কিছুকে সরিয়ে ফেলে তার সামনে থেকে। সবকিছু সরিয়ে ফেললেও কেন যেন রয়ে গেছে স্মৃতিযুক্ত এই চেয়ারটা। যাতে বসে প্রতিদিন চায়ের কাপ হাতে সকালের রোদ গায়ে মাখে আফরা। স্মৃতিযুক্ত সবকিছু সরিয়ে ফেলা যায় ঠিকই কিন্তু মনের মাঝে লেগে থাকা, মস্তিস্কে আটকে থাকা ঘটনাগুলো কি কখনো সরিয়ে ফেলা যায়? যায় না। কেন যে যায় না সে উত্তর আফরার কাছে নেই। মনের মাঝে লেগে থাকা কিংবা মস্তিস্কে আটকে থাকা স্মৃতিগুলো যদি সরানো যেত তাহলে হয়তো খুব ভালো হতো। অন্তত শান্তিতে থাকতে পারত কিছুটা দিন। কিন্তু সেই স্মৃতি যদি হারিয়ে যেত তাহলে আফরা কি বাঁচতে পারত? এর উত্তরটা সহজ মনে হলেও আসলে সেটা আমাদের ধারণার বাইরে।



বারান্দায় রাখা চেয়ারটাতে বসে থাকতে কেন যেন খুব ভালো লাগে। অনেকটা শান্তি লাগে। সমস্ত দুঃখ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কিন্তু সমস্ত স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মনে হয় এইতো, এই শূন্য বাড়িটা আবার ভরে উঠেছে আনন্দে। হাসছে, খেলছে বাড়ির সকলে। যেমনটা ছিল আবিরের আগমনের পর। আবিরের রঙে রাঙিয়ে রাখত সকলকে। সবসময় একটা অন্যরকম অনুভূতি হত সকলের। সবাই খুব যতœ নিত আফরার। খুব ভালো লাগত তার। আবিরের পৃথিবীতে আসার আগে আরাফাত প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস সাথে নিয়ে আসতো অফিস থেকে ফেরার পথে। কোনদিন পুতুল, কোনদিন ছোট প্লাস্টিকের গাড়ি বা অন্য কোনদিন ছোট দোলনা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের খেলনা নিয়ে হাজির হতো বাড়িতে। বাড়ি ফিরে সুন্দরকরে খেলনাগুলো গুছিয়ে আফরার কাছে এসে তার খুব কাছে বসে তাকে বলতো-
‘বুঝলে আফরা, আমাদের না একটা সুন্দর মেয়ে হবে। পরীদের মতো সুন্দও নয়। কালো। কিন্তু খুব মিষ্টি। সারাদিন ঘর মাতিয়ে খেলবে। চিল্লাচিল্লি করবে। জোরে জোরে কান্না করবে। এই শূন্য স্তব্ধ ঘরটা একেবারে মাতিয়ে রাখবে সারাদিন।’
আরাফাতের কথা আফরার খুব ভালো লাগত। কিন্তু তবুও সে চায়তো তাদের একটা ফুটফুটে ছেলে হোক। সুন্দর। খুব সুন্দর। একেবারে রূপকথার রাজপুত্রের মতো। কিন্তু আরাফাত মোটেও সেকথা মানতে চায়তো না। তাই সবসময় এ নিয়ে দু’জনের মাঝে চলত মিষ্টি খুনসুটি।
আজ এতোগুলো বছর পর সেই স্মৃতিগুলো আফরার চোখে জল নামায়। সকালের মিষ্টি রোদে বসে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আফরার ভেতর থেকে বের হয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের গরম হাওয়া মিশে যায় বাইরের বাতাসে। আফরা জলভরা চোখে আকাশের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকে। আকাশে সকালের রোদ ঝলমল করছে। নীলের মাঝে কয়েকগুচ্ছ সাদা মেঘ খেলা করে চলেছে অবিরাম। আকাশ দিয়ে উড়ে চলেছে একঝাঁক অতিথি পাখি। আফরা ভাবতে থাকে, এই অতিথি পাখিরা সেই কোন দেশ থেকে এদেশে উড়ে এসেছে এখানে। যেমনটা আবির চলে গেছে অনেক দূরে। সেই কোন দূরে। মাঝে মাঝে সেই হিসেব করতে গিয়ে হাফিয়ে ওঠে আফরা। ছেলের কথা ভাবতেই বুকের একপাশে কেমন একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। স্বামী চলে যাবার পর ছেলে পাশে না থাকায় কষ্টটা আরো বেশি আকড়ে ধরেছে তাকে।


স্বামীর স্মৃতি মনকে কাঁদালেও স্বামীর স্মৃতিযুক্ত বাড়িটা ছেড়ে দূরে চলে যেতে মন সায় দেয়না তার। আরাফাতের মৃত্যুর পর ছেলেটা অনেক বলেছে ওখানে ওর কাছে থাকতে। কিন্তু থাকতে ইচ্ছে হয় না সেখানে। এবাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে মন টেকে না। এবাড়ির প্রতিটি কোণে তার ছোঁয়া। এ বাড়ির বাতাসে তার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে রয়েছে। তার শরীরের গন্ধ এখনো এ বাড়িতে পাওয়া যায়। তাই আফরা কখনোই এবাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যাবার কথা চিন্তা করতে পারেনা। কিন্তু এই কিছুদিন আগে আফরা অসুস্থ শরীর নিয়ে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিল তখন আবির তাকে বলেছিল কিছুদিন পরেই সে তাকে নিয়ে যাবে তার কাছে। আফরা এখন বেশ খানিকটা সুস্থ। সুস্থ হলেও আগের মতো সবল নয়। বয়সের ভারে দূর্বল শরীর নুইয়ে পড়েছে অনেকটা। অনেক্ষণ ধরে হাঁটতে পারে না। হাফিয়ে ওঠে; পায়ের ভেতর কেমন যেন একটা অস্বস্তি হয়। দাড়িয়ে থাকতে পারে না স্থির হয়ে।
 গতকাল রাতের খাবারের পর যখন আফরা শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয় ঠিক তখন প্রতিদিনের মত গতকালও আবির ফোন করেছিল। সব কথা শেষে বলেছিল, ‘মা কালই আমি দেশে আসছি। তোমাকে নিতে। গুছিয়ে রেখ সবকিছু।’
ছেলের আকস্মিক  এই সিদ্ধান্ত শোনার পর থেকে অস্থিরতা কমছে না আফরার। যদিও এই সিদ্ধান্ত একেবার নতুন নয়। এর আগে অনেকবার তাকে নিতে এসেছে আবির। কিন্তু সে নিজেই কখনো ছেলের সাথে যেতে রাজি হয়নি এই বাড়ি ছেড়ে। কিন্তু এবার অসুস্থ শরীরে হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় আবির খুব কড়াভাবে তার মাকে বলে গেছে, এবার সুস্থ হলেই তোমাকে নিয়ে যাব এখান থেকে। এবার আর কোন অজুহাত চলবে না তোমার। এরপর ছেলের এই সিন্ধান্তকে আকস্মিক বলা যায় না মনে হয়। কিন্তু তবুও আকস্মিক মনে হয় আফরার।
২.
হাতে থাকা চায়ের কাপ খালি হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। সকালের রোদের প্রখরতা বাড়ছে ধীরে ধীরে। খুব মিষ্টি লাগে এই সকাল। রাতের আনন্দ কিংবা ক্লান্তিকে মুছে ফেলে যে আলো ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে সে আলো পবিত্র; সে আলোতে পূণ্য। এই পবিত্র কিংবা পূন্য আলোতে বসে থেকে পবিত্র করে নিতে ইচ্ছে হয় আফরার। শরীরের অসারতা কিংবা মনের দূর্বলতা তাকে চেয়ার ছেড়ে চলে যেতে দেয়না। একটা অজানা শান্তি, না বোঝা আকর্ষণ টেনে বসিয়ে রাখে এখানে। প্রথম যৌবনে প্রেমে পড়ার আকর্ষণের মতোই আটকে রাখে তাকে। প্রথম যৌবনের প্রেম! হায়! সেতো তার জীবনেও এসেছিল। তাকেও গ্রাস করেছিল একেবার। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা; সে এক অন্যরকম টান। মানতে চায়না কোন বাঁধা। এগিয়ে চলে দূর্বার গতীতে।

আজ বার্ধক্য শরীরে এই সকালের নির্মল রোদে বসে হঠাৎ সেসব দিনের কথা মনে পড়ে আফরার। মনে পড়ে, তখন সে দশম শ্রেনীতে পড়ে। স্কুল ড্রেসের পরিবর্তে বোরকা পড়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল। প্রথম দিককার সবকিছুতেই একটু বেশি আগ্রহ থাকে মানুষের। পরে সে আগ্রহ আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়। তেমনি প্রথমদিকে আফরা বোরকা পরাতে খুব আগ্রহী এবং সচেতন ছিল। সুন্দর করে হিজাব পরত; মুখ বেঁধে থাকত সবসময়। যদিও সময়ের পরিক্রমায় তার সে অভ্যাস খুব বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। ঠিক সে সময়ে স্কুলে যাবার পথে একদিন খেয়াল করে একটা ছিপছিপে গড়নের ছেলে রাস্তায় প্রতিদিন দাড়িয়ে থাকে তার অপেক্ষায়। প্রতিদিন দাড়িয়ে থাকতে দেখে আস্তে আস্তে মনের মাঝে গেথে নেয় তাকে। একটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে যায় ছেলেটা। একদিন না দেখলে ছটফট করতে থাকে ভেতরে ভেতরে। এভাবে দূরে দাড়িয়ে দেখতে দেখতে একসাথে হাঁটতে শুরু করে একজোড়া মন আর দুইজোড়া পা। এভাবে পথে হাঁটতে হাঁটতে শুভ্রর সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে আফরা। শুরু হয় তার অন্য একটা জীবন। প্রথম যৌবনের প্রেমের জীবন; ভালোবাসার জীবন। এই জীবনের শুরুতে তার মনে হতো সে কোনভাবেই বাঁচতে পারবে না শুভ্রকে ছাড়া। সে ছাড়া আফরার জীবনটা যেন গন্ধ আর সৌন্দর্যহীন ফুল, যে ফুলের কোন মানেই হয়না।
প্রত্যেক সুখের কিংবা আনন্দের জীবনে ট্রাজেডি আসে। আফরার এই প্রেমের জীবনেও এসেছিল। একদিন রাতে। আকাশে তখন ঝলমলে চাঁদ আর আকাশভর্তি তারাদের মেলা। বাড়ির উৎসবমুখর পরিবেশ রাতের নিস্তব্ধতাকে একেবারে কাঁটতে না পারলেও অনেকটাই কাঁটতে পেরেছিল। এই উৎসবমুখর নিস্তব্ধ রাতে লাল রঙের এক বেনারসি শাড়ি আর গহনা পরে আফরা সজ্জিত হয়েছিল। না। তার সেই পরিচিত পুরুষের জন্য নয়। এক অজানা অচেনা অন্যরকম পুরুষের জন্য। ছেলেটা সরকারি কলেজের শিক্ষক। খুব বেশিদিন না। অল্পকিছুদিন আগেই পেয়েছে চাকরিটা। বাবা বলেছিল খুব ভালো ছেলে অনেক সুখে থাকবি তুই। বাবার এই কথার ওপর আর কোন কথা সেদিন আফরা বলতে পারেনি। সে বলতে পারেনি তার ভালোবাসার কথা। সে বলতে পারেনি তার পছন্দ-অপছন্দের কথা। সে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিয়েছে সবকিছু। সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল আফরার। খুব কষ্ট হয়েছিল। কষ্ট হয়েছিল তার নিজের জন্যে, কষ্ট হয়েছিল তার প্রেমিকের জন্যে। কিন্তু এই কষ্টের কারণ কি?এই প্রশ্নের জবাব এখন আর সে পায় না। এখন তার ভালো লাগে।


 নিজেকে বুদ্ধিমান মনে হয়। তার মনে হয় শুভ্রর ভালোবাসা ছিল আবেগের যা নষ্ট হয়ে যেত নিমিষেই যেমন বিয়ের কয়েকদিনের মাঝেই তার ভালোবাসা, তার সেই প্রেম একেবার নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। শীতের সকাল ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশির যেমন সকালের হলুদ সূর্যের আলোয় একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় তেমনি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল তার সমস্ত প্রেম, সমস্ত ভালোবাসা। তখন তার জীবনের সমস্ত আশা, সমস্ত ভরসা ছিল শুধু মাত্র তার স্বামী আর কেউ নয়। যদিও এখনো তার মনের এককোনে সেই প্রথম যৌবনের ভালোবাসার মানুষটার জন্যে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভূত হয়। সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে এখনো চোখের কোনায় জল নামে। কিন্তু কিছুই করার নেই তার। তার মনের দোলাচলচিত্তে সে এখন অসহায়। আর পিছনে ফিরে যাওয়ার কোন পথ নেই তার। শুভ আগামী পড়ে রয়ছে তার জন্যে। আগামী তাকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে।
৩.
সূর্যের তেজ বাড়ছে ধীরে ধীরে। ঝলমল করছে আকাশ। পাখিরা আকাশে উড়াউড়ি করছে এখনো। আফরা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে পড়ে আছে। বাতাসের শুনশান শব্দ তার কানে যাচ্ছে। দূরে বড়  রাস্তার গাড়ি চলার শব্দ বাতাসে ভেসে এসে তার কানে ভেতর প্রবেশ করছে। ঘরের ভেতরে কাজের মেয়েটা খুটখাট করে কি যেন একটা করছে। আফরা চোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পর কাজের মেয়েটা পাশে এসে দাড়িয়ে বলে-
‘খালাম্মা। ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আসেন নাস্তা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নেন।
আফরা তার কথা শুনে চোখ না খুলেই জবাব দেয়-
‘নাস্তা আর ঔষধ এখানে নিয়ে আয়। আমি এখানে বসেই খাব।
কাজের মেয়েটা কিছু না বলেই চলে যায়। আফরা চোখ বুজে তার কথা ভাবতে থাকে। অনেকদিন ধরে এই মেয়েটা আছে এই বাড়িতে তার সাথে। বাবার মৃত্যুর পর আবির এই মেয়েটাকে নিয়ে এসে রেখেছিল এই বাড়িতে। তখন থেকেই মেয়েটা তার সাথেই আছে। আফরার দেখাশোনা করে। মেয়েটার নাম ইয়াসমিন। মেয়েটা শিক্ষিত। মাস্টার্স পাশ করেছিল। ভালো রেজাল্টও নাকি আছে। কিন্তু কেন যে তার সাথে এই বাড়িতে পড়ে আছে সেটা বুঝতে পারে না আফরা। কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়নি কথাটা।
কিছুক্ষণ পরে নাস্তা আর ঔষধ হাতে বারান্দায় আসে ইয়াসমিন। খুব যতœ করে সব গুছিয়ে পরিবেশন করে আফরার সামনে। সে চেয়ার থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে খাওয়া শুরু করে। খেতে খেতে ইয়াসমিনের দিকে তাকায় সে। সুন্দর গড়ন মেয়েটার। সমস্ত শরীরে অন্যরকম একটা সৌন্দর্য আছে। সবথেকে সুন্দর তার চোখজোড়া। তার চোখ জুড়ায় যেন অন্যরকম একটা মায়া আছে, অন্যরকম একটা নেশা আছে। যে মায়ায় কিংবা নেশায় আটকে যায় সমস্ত পৃথিবী। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কেন তার কাছে পড়ে থেকে এভাবে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে সেটা খুব ভাবাচ্ছে তাকে। তাই নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আফরা বলেই বসে-
‘আচ্ছা ইয়াসমিন। তুমি এতো শিক্ষিত সুন্দর একটা মেয়ে। তবু আমার কাছে এভাবে পড়ে থেকে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছ কেন?
মালকিনের প্রশ্ন শুনে তার মুখের দিকে তাকায় ইয়াসমিন। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। লজ্জায় নামিয়ে নেয় নিজের মুখ। কোন কথা বলতে পারে না। মুখ নামিয়ে রাখে।


ইয়াসমিনের এই অবস্থা দেখে আফরা আর কিছু বলে না। কিন্তু তার মনের মাঝে একটা সন্দেহ তৈরি হয়। সে চুপচাপ খাওয়া শেষ করে ঔষধ খেয়ে নেয়। ইয়াসমিন সবকিছু গুছিয়ে ভেতরে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার পরে আফরা আবার চেয়ার হেলান দিয়ে ভাবতে শুরু করে ইয়াসমিনের কথা। সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায় তার। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আবির আর ইয়াসমিনের কোন সম্পর্ক নেই তো? তাহলে কি এর জন্যে বিয়ে করছে না সে? আর চিন্তা করতে পারে না সে। কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো মনে হয়। আর এসব নিয়ে আর ভাবতে মন চায় না। একটা অন্যরকম ক্লান্তি পেয়ে বসে। আবার শরীরটাকে এলিয়ে দেয় চেয়ারে।
৪.
সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে অবিরাম। সাথে সময়ও বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে দুপুর ঘনিয়ে আসে। আফরা স্থীর হয়ে চেয়ারে বসে রয়েছে। চারিদিক থেকে বিভিন্নরকম শব্দ কানে আসে। ঘরের মাঝের টেবিলের উপর থেকে মোবাইলের রিংটোন কানে আসে। চেয়ার ছেড়ে আফরার উঠে যেতে মন চায় না। সে মোবাইলের রিংটোন উপেক্ষা করে বসে থাকে চেয়ারে। ঘরের মাঝে মোবাইলের রিংটোন বন্ধ হয়ে যায়। তখনই ইয়াসমিনের কন্ঠ শোনা যায়। ওপার থেকে ছুড়ে দেওয়া কোন একটা কথার জবাব দেয়। তারপর মোবাইল রেখে বারান্দায় এসে আফরার মাথার কাছে এসে দাড়িয়ে বলে-
‘খালেম্মা। আপনার ছেলে প্রায় চলে এসেছে। আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে বলেছে।
ইয়াসমিনের কথা শুনে আফরা চোখ খুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে-
‘তুই যা।
ইয়াসমিন চলে যায় সেখান থেকে। আফরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে একদল সাদা মেঘেরা খেলা করে বেড়াচ্ছে। এই খেলা করতে থাকা মেঘগুলোর মাঝে কিসের যেন ছায়া দেখতে পায় আফরা। ভালো করে খেয়াল করলে সে বুঝতে পারে মেঘের মাঝে অনেক মানুষ। এই অনেক মানুষের সামনে হাত বেধে দাড়িয়ে আছে আর স্বামী, তার বাবা, তার মা। তাদের পেছনে অনেক মানুষের চেহারা দেখতে পায়। অনেক মানুষের ভীড়ের মাঝে দুরন্ত কৈশরে তাকে চুপি চুপি করে দেখতে থাকা সেই ছেলেটাকে দেখতে পায়। আরো পরিচিত অনেককে দেখা যায় সেখানে। আফরার চোখ বেয়ে জল নামে তাদের দেখে। মনে পড়ে সব স্মৃতি। ওদিকে আকাশে পরিচিত সবাই হাত নেড়ে নেড়ে তাকে ডাকতে থাকে। আফরার দৃষ্টিভ্রম হয়। সে থেকেই হারিয়ে ফেলে। আকাশে বাতাসে অনেক পাখির শব্দ শুনতে পাই। তার মনে হতে থাকে এই বিশাল পৃথিবী এখন পাখিদের দখলে। মানুষ নামের এই প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে পৃথিবী। তার খুব ভালো লাগে। মনে হয় পৃথিবী আবার পূর্ণ হবে পাখিতে বিভিন্নরকম পাখি ডেকে বেড়াবে গাছে গাছে। আবার পূর্ণতা পাবে এই ধরা। আবার সুখ নেবে আসবে ধরার বুকজুড়ে।
আর কিছু বুঝতে পারে না আফরা। শরীর ভেঙে আসে। সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে। পানি থেকে তুলে রেখে দেওয়া শাপলা ফুলের মতো একেবারে নেতিয়ে পড়ে তার শরীর। সমস্ত পাখিদের গুঞ্জন, সমস্ত শব্দ থেমে যায়, সমস্ত আলো নিভে যায় বরাবরের জন্য।
আবির বাড়িতে পৌছালো মাত্র। এসেই মা কে ডাকতে থাকে। কিন্তু মায়ের কোন সাড়াশব্দ নেই। ইয়াসমিন বলে মা বারান্দায় চেয়ারে বসে ছিলো। আবির সেখানে এসে দেখে মায়ের অসাড় দেহ নেতিয়ে রয়েছে চেয়ারের সাথে। তার সমস্ত আলো নিভে গেছে চিরদিনের জন্য। আবির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়ের নিস্তেজ দেহটার দিকে। তার চোখের জলে ভাসতে থাকে মায়ের সব কথা, সব স্মৃতি।