ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫২

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫২

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৫২

শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর ২০২০

















দুঃখবোধের গল্প

দুঃখবোধের গল্প

 


দুঃখবোধের গল্প
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ

তখন আমার বয়স ৭ কিংবা ৮। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সোজা ছুটে যেতাম যমুনার পাড়ে । বলা চলে; যমুনা আমাকে প্রেমিকার মত কাছে ডাকত; তার ডাকে বড্ড মায়া ছিল। ছুটে যেতাম সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে। সত্যি বলতে আমার ভীষণ ভালোও লাগতো। যাক সে কথা; পাড়ার বন্ধুরা মিলে যমুনায় কত জল কাটাকাটি খেলতাম।
আমার মামাতো ভাই আসাদুর; ও অনেক বেশি সাহসী ছিল । ওর সাহস আমাকে অবাক করত এবং ভয় জাগিয়ে দিত। অসম্ভব রকমের ভয়। এক কথায় বলে বোঝানো যাবেনা। গ্রীষ্মের সময়। যমুনার জল তখন যমুনার পেটে চলে যেত। কিনার থেকে জলের দূরুত্ব ছিল প্রায় ৪০ ফুট। আসাদুর সেই ৪০ ফুট ওপর থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ত। ওর এমন দুরন্তপনা আমার শরীর শিউরে দিত । ভাবতাম; আল্লাহ্, ওকে এত সাহস দিয়ে বানিয়েছে; ক্যামনে। শুধু আমি একা বললে ভুল হবে; আরো অনেকে’ই ছিল আমাদের সাথে। প্রায় ২ থেকে ৩ ঘন্টা জলে লাফালাফি শেষে যমুনার মরুভূমির মত বুকে হাত পা ছড়িয়ে রোদ মেখে নিতাম । কি এক অসম্ভব ভালো লাগা কাজ করত; বোঝাতে পারবনা ।
২.
একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির পাশে বন্যার পানি এসেছে। হালকা হালকা ¯্রােত বইছে। খেয়াল করলাম; কিছু মাছের আনাগোনা। দৌড়ে গিয়ে জাল নিয়ে এসে নেমে পড়লাম মাছ শিকারে। আহা; তাজা মাছের লোভ কে সামলাতে পারে। আমিও পারিনি। বেশ কিছু পুঁটিমাছ পেলাম; আরো ছিল টেংরামাছ। জাল দিয়ে না পেরে শেষমেশ মাকে গিয়ে বললাম; মা- টাকা দাও বর্শি কিনব । মা আমার; কথা শুনে প্রায় রাগে গর্জে উঠলো। অবশ্য; মায়ের এমন রাগ নিত্যদিনের। মায়ের রাগ উপেক্ষা করে দোকানে গিয়ে বর্শি আনলাম; তারপর বর্শি গুটিয়ে মাছ শিকারে নেমে পড়লাম। বাড়ি চারপাশ নতুন পানি। ঘোলা পানি। নানা রকম মাছের উৎপাত। শামুক কেটে কেটে বর্শিতে মাছের আহার বানিয়ে পানিতে ফেলে রাখলাম। সহযোগিতা করত আমার এক ছোটমামা; আর ছোট দুই বোন । ওরাও মাছ ধরায় ছিল ভীষণ পটু। প্রায় ২০টা বর্শির কঠিন দ্বায়িত্ব নিয়ে আছি আমরা চারজন। সবার চোখ কেবল বর্শির টোনের উপর । কখন যে মাছ এসে টিপ দিবে। বেশ কিছুক্ষণ পাড় হয়ে গেল । কিন্তু কোনো মাছের সাড়া-শব্দ নেই। আমার নিজের ভেতর কেমন যেন একটা রাগ তৈরি হলো। এত আগ্রহ নিয়ে বর্শি কিনে এনে যদি মাছ ধরতে না পারি; তাহলে আমাদের ইচ্ছের কোনো পূর্ণতাই পেল না। এক প্রকার জিদ তৈরি করলাম যে; আজ মাছ না ধরে এখান থেকে উঠব না। এমনটা ভাবতে ভাবতে ওদিকে আমার বোন জান্নাতী একটা বর্শি দ্রুত তুলে ফেলল। তারপর দেখি; সেই বর্শিতে বড় একটা বাইন মাছ ধরা পড়েছে। এতক্ষণে নিজেকে একটু স্বস্তি দিতে পারলাম। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল চলে এলো। বাড়ির যাবতীয় কাজ শেষ করে মা আমাদের মাছ ধরা দেখতে এসেছে। পাতিলে খুলে যা দেখল মা; তাতে মায়ের মনটা ভালো হয়ে গেল। ভাবতে শুরু করলাম; এই মাছ যদি আজ না ধরতে পারতাম; তাহলে মায়ের হাতের পিটুনি খাওয়া ছাড়া কপালে আর ভাত জুটতো না। আহ ! সেই সুন্দর শৈশব আজ কোথায় যে হারিয়ে গেছে; কে জানে !


৩.
আমার গ্রাম; আমার বাড়ি; আমার ঘর আর এই গ্রামের মাটি আমার সারা শরীরে মেখে আছে। কত মায়া; কত প্রেম; কত শান্তিতে লুকিয়ে আছে; কেউ জানেনা। ছোট থেকে বড় হয়েছি; সব বুঝতে শিখছি। এই গ্রামের মানুষ; এই গ্রামের ন্বিগ্ধতা; এই গ্রামের বাতাশ; এই গ্রামের গন্ধ আমার বুকে জুড়ে লেগে আছে।
আজ আমার গ্রামটা যমুনার জলে ভেসে গেল। আমার পড়শি; আমার কৈশোরের বন্ধুরা; আমার ছুটে চলার নিবিড় ঠিকানা হয়ত বা আর ফিরে পাবোনা । যমুনার এই ভাঙোনে কে কোথায় চলে গেছে; কে জানে । আর এখন মাটির কত দাম; ক’জনের’ই বা সেই সার্মথ্য আছে যে; তারা টাকা দিয়ে মাটি কিনে সেখানে ছোট করে একটা ঘর বানিয়ে কাটিয়ে দিবে বাকি জীবন। এসব ভেবে ভেবে আমার বুকের ভেতরটা আটকে আসে। নিঃশ্বাস নিতে পারিনা; চোখের উপর জল চলে আসে। জানিনা; সৃষ্টিকর্তা কেন এটা করল । হয়ত বা ভালো কিছুর জন্য। কারণ; সে যা করে; সব’ই তার বান্দার মঙ্গলের জন্য করে।
৪.
আমি ভাবতেও পারিনা; যমুনা আমার গ্রাম নিয়ে গেছে; বাড়ি নিয়ে গেছে; ঘর নিয়ে গেছে; পড়শি নিয়ে গেছে; শান্তি নিয়ে গেছে। যে যমুনার কাছে আমি বেশি’র ভাগ সময়’ই কাটিয়েছি খেলতে; দুলতে; ঘুমোতে। আহ! সেই যমুনা কিনা আমার কিংবা কিছুই রাখলো না। কতটা নির্মম; কতটা নিষ্ঠুর হয়েছে যমুনা; আমি চিন্তাও করতে পারিনা।
হে যমুনা; তবু ভালো থাকো; আমাদের দুঃখে; আমাদের অভাবে; আমাদের ঘরে; আমাদের উঠোনে। তুমি ভালো থাকো; যমুনা...
 

রিনভি

রিনভি

 



রিনভি
হাসনাত আসিফ কুশল


প্রায় চারটি দশক হতে চললো রিনভির সাংবাদিক জীবনের। চার দশক ধরেই সে কাঁধে একটা ব্যাগ আর পকেটে একটা কলম নিয়ে রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর কাদা ছোড়াছুড়ির সাক্ষ্য দিচ্ছে সে। সাংবাদিকতা বিষয়ক বইও লিখেছে অবশ্য। কিন্তু বই লিখে কি আর বিবিÑবাচ্চার দাবি মেটানো সম্ভব ? এখন সে ভাবছে এ পেশা ছেড়ে দেবে। অনেকবারই ভেবেছে। কিন্তু অন্য পেশায় গেলে অভিজ্ঞতার ঝুলি চায়। আর ব্যবসায়ে নামলে পুঁজি হারানোর ভয়। কাজেই এ পেশাতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও থেকে যেতে হয়। এবারও ভাবনা আসছে নানাবিধ। আবার ওগুলো উবে যাবে। আবার পুরনো কাজের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। এখন আপাতত সে কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। সারা দিন দশ বারোটা ছোট ছোট অ্যাসাইনমেন্টের কাজ সহকর্মীদের ভেতর এন্তেজাম করে দিতে হয়। আবার গভীর রাতে বাসায় ফিরে বিবিÑবাচ্চার সঙ্গে কথাও হয় না। তারা তাদের ঘরে ঘুমিয়ে যায়। আর সে খেয়েদেয়ে তার ঘরে ল্যাপটপটা নিয়ে লেখালেখির কাজ করতে থাকে। কখনও পড়াশুনারও। রাত জেগে বসে থাকা তার পেশার অংশ হলেও সে এটাকে নেশার অংশ বানিয়ে নিয়েছে। এক সময় ভাবতো, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর আবর্তনের একটি অংশ যদি ঘুমেই কেটে যায় তাহলে জীবনকে সে কিভাবে উপভোগ করবে ? আগে কবিতা লিখতো। এখন লেখে না কাজের প্রেশারে। সাংবাদিকতা বিষয়ক কিছু বাংলা বই লেখে আর ইংরেজি বই বাংলায় অনুবাদ করে। বই বাজারে বের হয় প্রতি বছর। বইমেলায়ও যায় তার বই মাঝেমধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্যও তাকে যেতে হয়। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা সেগুলো ভালোই কেনে। উপকৃত হয় মনে হয়।

অফিস থেকে গভীর রাতে ফিরে ঘুমায় না রিনভি। রাত জেগে লেখালেখি করতে থাকে সে। ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলতে থাকে। কবিতায় শব্দেরা যেন দুশ্চিন্তার ভেতর থাকে। এখন মনে মনে ভাবছে, এ মাসের স্যালারি পেয়ে গেলে বাসার কিছু ফার্নিচার কেনা লাগবে। বিবি সেই কবে থেকে বলে আসছে, সোফাসেট কেনার জন্য। বাসায় পুরনো একসেট সোফা পড়ে আছে। নতুন একসেট কিনলেই ওগুলো সের দরে বিক্রি করে দেয়া হবে। ওগুলো ফেলে দিতে অবশ্য মায়া লাগছে রিনভির। সেই আশির দশকে যখন নীলক্ষেতের বাসায় ব্যাচেলর হিসেবে একা একা থাকতো, তখনকার কেনা সোফা ওগুলো। ওগুলোতেই কত আড্ডামুখর দিন পার হয়েছে। রিনভির মনে পড়ে, ওর খুব প্রিয় এক বন্ধু নীলাভের জন্মদিন ওর বাসায় হয়েছিলো। কেক কেটে কত মজা হলো। সুজন আবার স্টুডিও থেকে কোনো এক ফটোগ্রাফারকে জুটিয়ে নিয়ে এসেছিলো ছবি তুলবে বলে। এখনও সে ছবি অ্যালবামের পাতায় আছে। ওর কাছেই আছে। অবশ্য বিবির দখলে। আলমারিতে যতœ করে বিবি রেখে দিয়েছে। খেয়া, রাজন, বিউটি, দ্যুতি, সুজন, নীলাভÑসকলের কথা একযোগে মনে পড়ে গেল একরাতের ভেতর। ভাবছে চারটা দশক দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল। এখন ওদের অনেকেই স্টাফ রিপোর্টার থেকে অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের গ-ি পেরিয়ে সোজা এক্সিকিউটিভ এডিটর পর্যায়ে চলে গেছে। আর রিনভি এখনও সেই অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরেরই ঘানি টানছে। মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে পড়ে সে। মাঝেমধ্যে বিরক্তির উদ্রেক হয় ওর ভেতর। প্রতি মাসে অশান্তি আর ভালো লাগে না তার। এ অশান্তির অধিকাংশই অর্থ সংক্রান্ত। এ পেশায় বেতন বড় কম। এখানে তাই ফ্রয়েডÑফুকোর দর্শন চর্চা করা অসম্ভব হলেও ভাবনার ভেতর ওগুলোকে লালন করতে থাকে রিনভি। ওয়ার্কশপ করেও অল্প কিছু পায় রিনভি। কয়েকটা পড়াশুনার বই কিনেই তা শেষ হয়ে যায়। বাচ্চাদেরও স্কুলে ফাইনাল পরীক্ষা কড়া নাড়ছে। টাকা দেবে কোথা থেকেÑএই দুশ্চিন্তায় তার ঘুম আসে না। রিনভি ভাবছে। হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে টেবিলটা কেঁপে ওঠে। মনে হলো, জীবন ফিরে পেয়েছে সে। বড় অক্ষরে লেখা এডিটর। মেইল না গেলে ঠিক এই সময়টাকেই উনি বেছে নেন। রিনভির বড় বিরক্তি লাগে। ফোন ধরেই অবাক হয় ও। কারণ এডিটর আর আজকে মেইলের ব্যাপারে বলে নি। বরং শুরুতে অভিবাদন জানিয়ে ভূমিকা না করে তার প্রমোশনের খবর দিলেন। খবর শুনে খুশি হয় ও। কিন্তু কথার ভীড়ে স্যালারির বিষয়টা আর বলতে পারে না। রাতে অফিস থেকে আসার পথে ও দেখে এসেছে এডিটর, এক্সিকিউটিভ এডিটর এবং অফিসের কয়েকজন লোক মিলে সেমিনার রুমে আলোচনা করছে। চিফ রিপোর্টার জাহিদের সঙ্গে কিছুদিন আগে এডিটরের মনোমালিন্য হওয়ায় গতকাল সে ওই পদে ইস্তফা দিয়েছে। এখন ওই পদে তাকে রাখবে আর তার পদে আরেকজনকে নেয়া হবে। অবশ্যই অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বাজারে এই পদগুলোতে অভিজ্ঞতার মূল্য যেন চড়া। রিনভি ফোন রেখে দেয়। ওর এখন কি করা উচিৎ ? আনন্দ করবে, নাকি মাতম করবে ? ভাবে, নশ্বর এই পৃথিবীতে সে যেখানে অবিনশ্বর নয়, সেখানে এসব মেকি আনন্দ করার মানেটা কি ? 


হঠাৎ করে টেবিলের দিকে হুঁশ ফিরে আসে তার। ল্যাপটপটা কি কারণে যেন হ্যাং করেছে। প্রতিদিন এমন হচ্ছে। ভাবছে দোকানে নিয়ে যাবে। কিন্তু সময় নেই। সারা দিন খাটাখাটনি, নিশীথে স্বেচ্ছা নিঃসঙ্গ জীবন আর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সমন্বয়হীনতা তাকে বাড়তি কাজের দিকে যেতেই দেয় না। বইমেলা আসতে অনেক দেরি। বইয়ের পা-ুলিপি তৈরি করতে হবে। এবার বইটা বের করতেই হবে। কাজের খুব প্রেশার। অফিসের কাজ সেরে আবার প্রকাশনীর কাজ। সামনে ঈদ সংখ্যায়ও তার একটি গল্প যাবে। অফিসের এডিটরই তাকে বারবার বলেছে। আবার নতুন পদ মানে নতুন দায়িত্ব। স্যালারি অবশ্য বাড়তে পারে। কিন্তু কতই বা বাড়বে ? এভাবে কি দিন চালানো যায় ?
এমন প্রবঞ্চনাপূর্ণ জীবন যেন ঘোর শত্রুও বেছে না নেয়। বারবার মনে হয় তার।
পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আযান ভেসে আসলো হঠাৎ। মন্দিরেও ঘণ্টার সশব্দ বারতা। ভোরের আলো স্পর্শ করেছে দরজার ওপাশটা। বিবি বোধ হয় উঠেছে। বাচ্চাগুলোকে এবার ডাকবে। প্রতিদিনের রুটিন তার। রিনভির মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব মার্কসবাদী স্বপ্নে বিভোর দিনের কথা। তখন জীবন এত কঠিন হয় নি। মানুষ সামান্য যা কিছু পেত, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো। এখনÑমানুষগুলো এমন হলো কেন ?


স্তালিনের জীবন নিয়ে একটা বই হাতে রিনভি বারান্দায় বসে আছে। বিবি বাচ্চাদেরকে ভ্যানে উঠিয়ে দিলো। ভ্যান চালক স্কুলে নিয়ে যাবে ওদের।
স্তালিনের স্বৈরাচারী সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গ উঠলেই রিনভি বরং স্তালিনের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকে। বন্ধুবান্ধবের সামনে হোক আর অফিসে হোক। সে স্তালিনের একজন অন্ধ ভক্ত। লেনিন, মার্কস এরা যেন তার পছন্দের লোক।
বাচ্চাদের ভ্যানে উঠিয়ে ফিরে আসে বিবি। তারপর সে বাসায় তুলসি গাছে পানি দেয়। তুলসি গাছটার বয়স সাত আট বছর। আর তাদের সংসারের বয়স বোধ হয় সতেরো। কিন্তু বাচ্চারা এখন কেবল ক্লাস টুÑথ্রিয়ের গ-ি পেরোতে পারে নি। এখন রিনভির সঙ্গে ওর বিবির কথা প্রায় হয়ই না। অফিসে যাওয়ার সময় বিবি শুধু ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। অবশ্য রিনভির ভাবতে লজ্জা লাগে এমন একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে যার সঙ্গে তার কোনো মিল নাই। রিনভির বিবি বাইরে সচরাচর বের হতে চায় না। বাজার করে নিয়ে আসে ও পাড়ার এক লোক। প্রতিমাসে ওর হাতখরচ বাবদ কিছু দিতে হয়। মাঝেমধ্যে ডাক্তারের কাছে বের হলে কালো বোরখা পরে বের হয় ওর বিবি। আর বোরখা পরায় প্রবল আপত্তি রিনভির। যে সারা জীবন ধরে স্তালিন, লেনিন ও মার্কসের আদর্শের রজ্জু ধরে এসেছে, তার বিবি কেন ওসব ‘মুখ ঢাকা সংস্কৃতির’ দিকে যাবে ?
বিবি কিন্তু ছেড়ে দেয় না। দু’য়েকটা কটু কথা বলে ফেললেও বিবির তীব্র প্রতিবাদের মুখে সে পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।


এই সময়টায় রিনভি সাধারণত বিবিকে ফোন করে না। বিবিও ফোন করতে চায় না। ভাবে হয়তো ব্যস্ত আছে। কিন্তু আজ কি মনে করে রিনভিই বিবিকে ফোন করেছে। প্রমোশনের খবরটা ওকে দেয়া হয়নি। বিবি শুনে প্রথমেই স্যালারির কথা জিজ্ঞাসা করলো। সে বললো, স্যালারি আগের চেয়ে দ্বিগুণ দেবে বলেছে এডিটর। তবে এসব লোকের কথা ও কাজের মিল খুব কমই থাকে। তাই নগদ হাতে না আসা পর্যন্ত রিনভি কিছু বলতে পারছে না।

সহকর্মীদের ফুলেল শুভেচ্ছা, বন্ধুদের অভিবাদন, মালিক পক্ষের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়াÑসব মিলিয়ে নতুন দায়িত্ব মানে কাজের প্রেশার বাড়া। এত কিছুর মধ্যেও রিনভি সুস্থ থাকবে এমন সংকল্প গ্রহণ করেছে। আর সুস্থ না থেকে উপায় কি আছে, অনেক দিন পর ওর একজন প্রিয় বান্ধবী শায়লা ফোন করেছে। বলেছেÑঅভিবাদন। অ্যাই, ইনবক্সে আয়। কথা বলি। কাজ ছিলো না বলে পাশের ট্যাবে ইনবক্সে গিয়েই দেখলো, শায়লা বলছেÑআজ নাকি ওরও প্রমোশন হয়েছে। ওর বোন নায়লাও আইন পরীক্ষায় পাস করেছে। শায়লা বড় একটি টেলিভিশনের মার্কেটিং অফিসার হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছিলো। এখন এক ধাপ উপরে প্রমোশন হয়েছে।


কোনো এক অজানা কারণে নতুন নিয়োগ পাওয়া অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর দীর্ঘ দিন ধরে অফিসে অনুপস্থিত। এডিটরের মাথা গরম হয়ে আছে। যাকে তাকে বকাঝকা করছে। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের অনুপস্থিতির কারণে রিনভিকেই অঘোষিতভাবে দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ বার্তাকক্ষে শোরগোল শুনতে পেল রিনভি। কি হলো ? টিভির দিকে তাকিয়ে দেখেÑপল্টনে নাকি পুলিশের সাথে মোল্লাÑমুন্সিদের ধাওয়াÑপাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ নিহত হয়েছে নাকি তা কোনো টিভি চ্যানেল দেখাচ্ছে না। শুধু বায়তুল মোকাররমের সামনে একটা ওভারব্রিজ থেকে মোল্লাÑমুন্সিদের দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে রিনভি দূরদর্শী একটা কাজ করেছে। অফিসের পারভীনকে আগেভাগেই মতিঝিলে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাতে সে সবকিছু সময়মতো জানাতে পারে। পারভীনকে ফোন করে রিনভি। ফোন নট রিচেবল। এই জরুরি মুহূর্তে ফোন বন্ধ কেন ? ইনফরমেশন না থাকলে নিউজ হবে কি করে ? আর নিউজ না হলে পত্রিকা চলবে কি করে ? আধা ঘণ্টা পর আবার ফোন করে। তখন পারভীন কল ব্যাক করে। এটা রিনভির ক্ষেত্রে সব সময়ই ও করে থাকে। কল ব্যাক করার পর সে জানায়, তাকে কয়েক জন মোল্লাÑমুন্সি ধাওয়া করেছিলো কিছুক্ষণ আগে। সে কোনো মতে প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মক আহত হয়। তার আরেক বন্ধু সাংবাদিক সোহাগ তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। রিনভি জিজ্ঞাসা করে, কয়টার দিকে হামলা করে তারা ? পারভীন জানায়, ঘণ্টাদুয়েক আগে। রিনভি ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়িতে বাজে বিকেল চারটা। তারপর সমবেদনা জানিয়ে নি¤œতন সহকর্মীদের দুঃখের সঙ্গে বললো, পারভীনের ওপর হামলা হয়েছে। সবাই বিস্মিত! কেমন করে। এও মানুষ করতে পারে। পারভীনের নাকি একটাই দোষÑসে মাথায় কাপড় দেয়নি।


পত্রিকায় আট কলামের হেডলাইন গেলÑসংবাদকর্মীর পেছনে ধাওয়া। এটা অবশ্য রিনভিরই দেয়া। তবে এতে অবশ্য ওর ক্রেডিটের কিছু নেই। রিপোর্টটা যেহেতু মালেক নামে এক সহকর্মী করেছে, তাই তারই ক্রেডিট। আর তা ছাড়া মালেক এডিটরের খুব কাছের লোক। তাই ওর এমন সাহসী রিপোর্ট দেখে এডিটর ওর বেতন দ্বিগুণ করে দিলো। অথচ রিনভি ওর উপরের পদে কাজ করে। হেডলাইনও তার দেয়া। কিন্তু ক্রেডিট মালেকের।
রিনভি পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে পারে না। সে মনে মনে চায়, রাশিয়ার লেনিন, স্তালিনের যুগ আবার ফিরে আসুক। আফগানের সাউর বিপ্লব এদেশেও হোক। তবু পুঁজি তোষণ আর তোষামদী প্রক্রিয়া থেকে প্রলেতারিয়েতরা মুক্তি পাক। বন্ধ হোক শ্রেণিশোষণ।
 

পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 


সন্ন্যাস
অলক চন্দ্র দাশ

বুকের পাহাড়ের শ্যাওলা ভরা গাঢ়ো জলের নদী
চোখের মধ্যে তুলবো না প্রতিজ্ঞা ভাঙা অবদি।
চেষ্টার কলস ডুবিয়ে যাও ত্রিকালের দোহাই দিতে দিতে
বিষন্নতা উবু হবে না তবু হাতের আঙুল এক করে।

আমি ক্ষ্যাপা, রাত্রির অস্ফালনে সেদ্ধ হওয়া শূন্যতা
তুমি তোমরা পূর্ণতা ; আমি মুদ্রাস্ফীতি
নোটের শরীরে হনুমানের মতো বুক খোলে রেখেছি
দেখো! ছোঁয়!  গুণো হাঁড়ের সংখ্যা! ক্যালসিয়াম! জীবাণুবাহী নালী-
গণ সার্কাসে ঠাঙিয়ে দিতে পারো!
প্রজন্মরা মধুসূদনের  চতুর্দশপদী কবিতার মতো
দু’ভাগ করে নেবে অথবা মন যত চায় তত ভাগে!
তারপরও আমি ভেক্সিন নেবো না, প্রোটেকশনে ঢাকবো না দৈর্ঘ্য প্রস্থ
চাল খাবো না, ডাল খাবো না, তৈল ছোঁবো না
লবণে মুখ দেবো না, দেবো না, দেবো না না না।

রাষ্ট্রীয় সঞ্চয় বাবু!  স্যার! ওস্তাদ! কর্তা! হুজুর
আজগুবি না। দৈব না। মন্ত্র যজ্ঞের ফল না।

হাত বাড়ানোটা এই মূহুর্তে অধিকার!
খতিয়ানের ঘরে সংখ্যাগুলোর সঙ্গে থাকা বিয়াদবি না সাব
আপনি হিসেব রক্ষক মাত্র, দানবীর না।
গণসংখ্যা স্বতন্ত্র; নাকি গ্রীণ রুমে সাজিয়ে রাখা আর্টিস্ট ওরা ?
যে আগে দেখলে রহস্য থাকবে না!
স্ক্রিপ্ট রাইটার, ডিরেক্টর, কোরিওগ্রাফার আপনারা ?  
রাজার বুকে সমাধিস্থ মঙ্গলা তীরকে উবু করে দাও
যোদ্ধার বুক রক্ত জবার সম্পদ।


নিয়তি
শেখ একেএম জাকরিয়া

ঘটকের ঝুলি থেকে
হেঁটে আসা প্রস্তাবটি বিষিয়ে তুলল জীবন
আঁতুড়ঘর ডিঙোতেই হবে ঋতুমতি যুবতীর
আকাশ-বাতাস-নদী সবারই একই ইচ্ছে
নীতি সরোবরের পঙ্ক্তিগুলো তুমি নামক কলসে ডুবিয়ে রাখতে হবে

অকাব্যের পিচহীন রাস্তায় অনিচ্ছাকৃত বাজাতে হবে গীতিকাব্যের মাউথ অরগান
অসমাপ্ত কাব্যে দাঁড়ি কমার ম্যাকবেথ
অহেতুক উড়িয়ে দিতে হবে প্রবাসী হাওয়ায়
সাথে আয়ুর আর্কেস্ট্রা
শব্দতলার প্রেমময় শব্দ

অন্য কোনও সমাধান নেই
শুধু টান পড়বে দুরন্ত হৃদয়ে।



কবরনীতি
কাজী রুপাই 


কবরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। ভালো লাগে কবরের শীতল ঘ্রাণ। প্রায়শ’ই দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মধ্যে অজস্র রাজহাঁস হাঁটতে থাকে। আমি তাদের অনুসরণ করি। যেমন আমার পূর্বপুরুষরা হেঁটেছিলো বংশ-পরম্পরায়।

একশো বছর বয়সী এক রেইনট্রির নিচে দাঁড়িয়ে আছি। তার ছায়া আমাকে শূণ্য থেকে অলীক শূন্যতায় ভাসায়। আমি অপরাজিত শক্তির মতো অনুভব করি নিস্তব্ধতা। আমার বুকের বাম পাশে একটুকরো  মাটি চেপে তাকিয়ে থাকি আরশে।

আমি ভীষণ চিৎকারে আব্বাকে ডাকি। ‘আর কতো ঘুমাবেন! এবার জাগোন! আম্মাকেও জাগিয়ে তুলুন । দুনিয়ারী আর ভালো লাগে না। নিজেকে কবরের মতো অসহায়  লাগে। মনে হয় প্রতিটি কবর যেনো আমার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি?

এমনি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। রেইনট্রির পদতলে। আমার ভিতরে গজিয়ে উঠে একটি  দৃপ্তময় জাহাজ। তার মাস্তুল জুড়ে প্রত্যাবর্তনের স্ফীতি । এক করব থেকে আরেক কবরে ঝাপায় আমার আত্মা; যেনো ঘাসফড়িংয়ের দৃপ্ত  ছায়া।

পূর্ব পুরুষদের করবনীতি মেনেই এতোদুর আসা আমি জানি মৃত্যুর কোন আলাদা সংজ্ঞা নেই।
প্রতিটি কবর তার নিজস্ব ঘ্রাণে হিরন্ময়। এইসব ঘ্রাণ একদিন মিশে যাবে- আগুনের ভিতর; মাটি ভিতর ;নদী যাবে সমুদ্রে ;বাতাস মিশবে  বায়ুতে।

অতঃপর পুনরুত্থানে হবো একাকার। ঘ্রাণে ঘ্রাণে ঘ্রাণময় হবে আমার কবিতার উত্তরসূরীদের পথ।



ভালোবাসা যতটা শব্দে হয়
মোস্তফা কামাল

আমাকে খুঁজো তুমি প্রমত্ত হাহাকারে
আমাকে খুজো তুমি গোধূলির রৌদ্দুরে।
আমি মিশে থাকি শিশির ভেজা দূর্বাদলে
আমি মিশে থাকি স্রোতস্বীনী নদীর জলে।
আমি মিশে থাকি উদাসী বাউলের অবিন্যস্ত চুলের ভাঁজে
আমি থাকি যুবতী চাঁদের আলোয় মনোলোভা জোসনা সাজে।
উদ্ভ্রান্ত সময় আমাকে খোঁজে অবিরত
আমি থাকি সময়ের যোগ্য শিরোনামের মত
প্রীতির পরাগ ছড়ায় যত অনুরাগ
আমি এক প্রান্তিক পূজারীর বিরাগ।
আমি সদা উপকথার চরিত্র পরি গায়
পানশালাতে কে যেন আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়।
ক্ষুধার্ত বিকেলের সঙ্গম থেকে যেমন
বসন্ত বেরোয় আমি থাকি বিরহী বাতাসের অসম প্রেম পূর্ণতায়
যদি কখনো হারিয়ে যাই-
এলোকেশ মেঘডম্বর স্মৃতির ভারে
খুঁজে নিও বন্ধু আমায়;
যতটা শব্দে ভালোবাসা হয় ততটা শব্দের বাহুডোর।
 

পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২

 



ভালবাসা দুরত্ব মানে না
রাসেদুল হাসান রাসেল

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে-
তোর কপালে কালো টিপ হয়ে তোর সাথে মিশে থাকি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে-
তোর খোঁপার ঐ কালো কেশে রক্ত জবা হয়ে ফুটি।
তোকে সাজাই আমি আমার মতো করে।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে-
তোর বারান্দায় দক্ষিণ পাশে রাখা পিঞ্জরের সবুজ টিয়ে হয়ে
তোর সাথে সারাক্ষণ কথা বলি।
তোকে গান শুনাই।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে-
তোর আলতা রাঙা পায়ে নুপুর হয়ে রিনিঝিনি শব্দে তোকে ব্যাকুল করে রাখি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে-
তোর খোলা জানালার পর্দা হয়ে তোকে আড়াল করে রাখি।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে-
তোর বসত ঘরটা আমার বাড়ির আঙ্গিনায় নিয়ে আসি,
কারণ-
ভালবাসা দুরত্ব মানে না।



পাথর এবং ক্ষত বিক্ষত হওয়ার গান
দ্বীপ সরকার

পাথরের ধ্বনি বলে কোন ধ্বনি নেই ,সব কিছু মানুষের সাথে মানুষের ধ্বনি
ধূসর ডিগবাজির নাম-

পাথরের ঘর্ষণে রসুন পিঁয়াজের কি যে দহন ! লৌকিকতা ছাড়িয়ে বহুদূর,
বহু নিবির ও প্রকাশ্যে বিস্তারিত সুর
সমর্পিত হলে কান্নার রোম- পাঁজরের সাথে ছুপ ছুপ রক্তগুলো কথা বলে ইদানিং

ডাকসাইটে রাতÑ ঘুঙুর সরানো ভুল, জোসনার মতো শরৎ ভাঙা আকাশের ডানা
আচমকায় ঘুম ভেঙে দেয় আমার। বালিশের চেকপোস্টে লেগে আছে দাউ দাউÑ
সেই যে দুঃখকালের পরন্ত জোসনা রাত ,পাথরের ধ্বনি কানে বাজে আমারÑ সিলপাটার ঘর্ষণে  যে সুর তুলেছিলো নববঁধু নিখুঁত করে

ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় পাহাড়ের ঘুমে- জ্বলে ওঠা হরিণীর শিং
পাগলের মতো তাড়িয়ে বেড়ায় কে বা কারা দৌড়োয়;
ছাতিম বৃক্ষ পর্যন্ত তার মোহন পায়ের আওয়াজ-
সে এক ক্ষত বিক্ষত হওয়ার গান !


পৃথিবীর বিবর্তনবাদ
দিপংকর ইমন

থেমে গেছে জন কোলাহল
পৃথিবী এখন শুধু পাখিদের দখলে।
কিছু মেঘ ডাকে,
ভৈরবী রাগ কিনা, অপ্রাসঙ্গিক সময় এখন।
বৃষ্টির ঝুমুর তালে আন্দোলিত হয় না কবিতা
তবুও লাল কাঁকড়ার শিল্প চর্চা
আশা জাগায় গৃহবাসীর।
পৃথিবী থামেনি
পাখিদের রাজত্ব কেবল।
বিবর্তনবাদ আজ গলা ছেড়ে গান গায়
উচ্চাঙ্গ সংগীতের রাজকীয় ঢংয়ে।
 

প্রেম ও মায়াবতী

প্রেম ও মায়াবতী

 


প্রেম ও মায়াবতী
ইরফান তানভীর

দ্যা প্যারাডাইস অন আর্থ, কাশ্মীরের প্রতি আমার এক অদ্ভুত মায়া আছে। বলা যায় একধরনের প্রেম। বই টই পড়ে পড়ে অদেখা কাশ্মীরের প্রতি যে পুলক আমার তৈরি হয়েছে তা দেখে আম্মা প্রায়ই বলতেন, কোন এক দেশ কাশ্মীর ,যার জিকির তুই উঠতে বসতে করে যাচ্ছিস! পাগল হওয়ার আর কদ্দুর বাকি? বললাম, এখন একটা বিয়ে শাদি কর! না তা না, উনার কেবল একটাই কাজ, বাবার পয়সা খরচ করে ওনি ঘুরবেন আর ঘুরবেন। আবার কোন এক পাগলামি উঠল মাথায় ‘ কাশ্মীর কাশ্মীর ’॥                                                                             
আমার মনে হলো - যে কাশ্মীরে শালিমার বাগ, গুলমার্গ, চেশমা শাহী, ডাল ও নাগীন লেকের মতো স্বর্গীয় অনুরণণ মিশে আছে, সে কাশ্মীরের প্রতি আমার পাগলামো নেহাৎ সামান্য। পাঁচ ছ বছর আগে, তখন ভার্সিটিতে বন্ধুরা মিলে প্লান করেছিলাম দেশ ভ্রমনের। পর্যটক হবার শখ জেগে ছিল কিনা। দেখা গেল সেমিষ্টার শেষ, পনের ষোল জনের বন্ধু গ্রুপটা ছুট দিতাম বান্দারবানের নাফাখুম অথবা মাধবকুন্ডের জলপ্রপাতে। কি যে এডবেঞ্চার, আহা। যে সময়ে অন্য বন্ধুরা তাদের জীবন নিয়ে ছিল বিরক্ত, বন্ধের সময় গৃহপালিত প্রাণীর মতো আবার ঢুকে পড়ত তাদের দশ পনের তলা আলিশান খোঁয়াড়ে, সে সময়ে আমরা হাতেগনা কজন ছুটতাম নতুন অদেখাকে দেখতে। নতুনকে বরণ করে নিতে। আমাদের ইচ্ছে ছিল ভার্সিটি শেষ হতে হতেই আমরা মুঘল ¯থাপত্যের তাজমহল, আগ্রা-ফোর্ট কিংবা লাল কেল্লা দেখে ফেলব। অথচ, কেবল তাজমহলই দেখার স্বাধ হলো। তাও কম বেগ পোহাতে হয়নি, টাকার জন্য আমাদের রিতিমত রাতের ঘুম হয়েছে হারাম। হবিগঞ্জ অথবা কিশোরগঞ্জ যাবার জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা পাওয়া গেলেও মূঘল ¯া’পত্য দেখতে বাবারা টাকা দিতে অপারগতা দেখাতে থাকেন প্রথম থেকেই। সে যাই হোক, ভার্সিটি থেকে বের হলাম কদিন হলো? বছর হতে পারে। তবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা ভ্রমণালাপ এখনো আগের মতো। সেদিন আজমাল ফোন দিয়ে ভ্রমনের পোকাটা উসকে দিল। শুন ইকবাল, এবার কিন্তু দূরে কোথাও যাচ্ছি। সিকিম, ভুটান অথবা দার্জেলিং। সবাইকে নিয়ে সামনের শুক্রবার রমনায় বসছি। বিকেলে। ঠিকাছে? আচ্ছা।        

সবাই যদি সিকিম ভুটানই যেতে চায় তাহলে আমার কাশ্মীর যাবার কি হবে? নাহ্, যেতে হলে কাশ্মীরই যাব, আর না হলে কোথাও না! শুক্রবার বিকেলে রমনায় গিয়ে যখন মনমরা হয়ে বসি, তখন আজমাল সহ সবারই সিদ্বান্ত কাশ্মীর যাবে। পেহেলগাঁমে নাবিলের কোন এক বন্ধু যেন থাকে। সেই আমন্ত্রন জানিয়েছে নাকি। আহা, মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। নাগরিক কোলাহল ভুলে কাশ্মীরের স্বর্গীয় শান্ত সমাহিত নীল জল আর ঝিকমিক করা রঙবেরঙের ফুল ফল মূহুর্তে আমার চোখে আনন্দের সঙ্গীত জাগিয়ে দিল। ১৪ এপ্রিল রাতে বাসা থেকে যখন বের হই আম্মা হৈ হৈ শুরু করে দিয়েছে। কই যাচ্ছিস? যুদ্ধের দেশ, এখন কি আর কাশ্মীর কাশ্মীর আছে?
আহা কাশ্মীর, পৃথীবির স্বর্গ! এখন ধংসের পদপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। ভাবতে গিয়ে এক অনিরুদ্ধ আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল। বেনাপল বর্ডারের  বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন সেন্টারে সকাল ন’টায় এসে চোখ কপালে উঠার যোগার। এই সকালেই ইমিগ্রেশনের সামনে ইন্ডিয়াগামি যাত্রীদের বিশাল লাইন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এগার জনের এই টিমটার  পেটে তখন গুরু গুরু অবস্থা। ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে বিশাল লাইনটাতে  দাঁড়াতেই   দালালদের দেখা মিলল। আমরা তো প্রায় দাললদের মুরিদ হয়েই যাচ্ছিলাম, মনোয়ার একাই আমাদের সামলাল, তারপর ইমিগ্রেশনের যাবতীয় ঝামেলা শেষ করে আমরা যখন কলকাতা এসে পৌঁছাই তখন ঘড়িতে বিকাল পাঁচটা প্রায়। পরদিন দুপুর তিনটায় দিল্লির ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে যাবে।   কলকাতা নিউমার্কেটের ঠিক পাশেই আমাদের হোটেল বুকিং দেয়া ছিল। সারারাত এবং পরদিন দুপুর পর্যন্ত রেস্ট করে শিয়ালদাহ রেল স্টেশনে এসে পৌঁছাই তিনটা বাজার এক ঘন্টা আগে। শিয়ালদহের কমলা আর ক্রিম কালারের সুন্দর বিল্ডিংটার প্রবেশমুখ দিয়ে ডুকছিলাম সবে, গজকয়েক দূর থেকে একটি ছোঁড়া বাক্য শুনতে পেলাম। ইকবাল!                                                          

পেছনে তাকাতেই কলকাতার সূর্যের আলো ঝাপটা মেরে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ইকবাল, মেরি আন্দাজ, ইকবাল? সূর্যের আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে এবার তাকালাম সে উজ্জল দেবী মুখটির দিকে, যার দিকে তাকিয়ে আমার চোখজোড়ায় আরো দ্বিগুন আলো খেলে গেল। কিছু মূহুর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রবল চিৎকারে বলে উঠলাম, ফারজানা! হাউ সারপ্রাইজ! কতোদিন পর?
ভাঙা ভাঙা বাংলায় ফারজানাও কথা বলা শুরু করল। কোথায় যাচ্ছো? কাশ্মীর? বুঝলে কিভাবে? অনুমান। তোমার তো অনুমান শক্তি প্রবল দেখছি। কতোদিন পর ফারজানার সাথে দেখা? বছর চারেক তো হবে। কাশ্মীরের মেয়ে ফারজানাকে প্রথম দেখি ঢাকা মেডিকেলের সামনে। নতুন ভর্তি হয়েছে তখন। একবছর তক ছিল। তারপর কাশ্মীরের মেয়ে কাশ্মীরেই ফিরে যায়। আর যোগাযোগ হয়নি। মাঝেমধ্যে মনে হয়েিেছল। ফারজানা,  আহা ফারজানা। তার বাঁকা ভ্রুজোড়াকে আমার কাশ্মীরের সচ্ছ নীল ঢেউ মনে হতো।
তারপর আর কি খবর বলো? কলকাতায় কি করছ? বান্ধবির কাছে এলাম বেড়াতে। বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে হয় না? অফকোর্স হয়। সেদিন আম্মা তোমার কথা বলছিল। কি বলল আন্টি? সে অনেক কথা। আচ্ছা আমার কথা মনে হয় তোমার?
নাহ্! তারপর ফারজানা খলখল করে হাসতে লাগল, সে হাসি কাশ্মীরের নয়নাভিরাম নিসর্গকেও হার মানাবে। আজমাল এসে তাড়া দিয়ে বলল, এই ইকবাল, ট্রেনের সময় হয়ে এল। সে সময়ে ফারজানার পাশে ভদ্রগোছের এক যুবক এসে দাঁড়াল। কাঁদে ছোট্ট ব্যাগ। চলে যাব, ঠিক সেসময় ফারজানা যুবকটির হাত ধরে পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাজবেন্ড। কলেজের লেকচারার। একসাথেই আমরা তোমার বাংলাদেশে যাব। ভদ্রলোক হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়াল। আই এ্যাম হাসান ইসফার। শিয়ালদহ রেলওয়ের ফ্ল্যাটফর্ম বি থেকে তখন দিল্লিগামি রাজধানি এক্সপ্রেস হুঁইশেল দিচ্ছিল।  
 

কাগুজে যোদ্ধা

কাগুজে যোদ্ধা

 

কাগুজে যোদ্ধা

যাহিদ সুবহান


মহরম আলী। বয়স পঁচাত্তর। গাঁয়ের মোড়ে মোতালেব হোসেন মতুর চায়ের দোকান; সেখানে প্রতিদিন দুবার তিনি নিয়ম করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পাঁতানো বাঁশের মাঁচায় এসে বসে থাকেন। প্রতিদিন একই সময় বাড়ি ফেরেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মহরম আলীর একমাত্র ভরসা বাঁশের লাঠিটা। লাঠিটা খুব শৈল্পিক; মাথাটা দেখতে অবিকল মানুষের মাথার মতো। রাজার মাথার মুকুটের মতোও বলা যায়। এই লাঠিটাই মহরম আলীকে সোজা হয়ে হাঁটতে সাহায্য করে। শরীরটা একটু ঝুঁকে থাকলেও অন্তত মাথাটা উঁচু হয়ে থাকে। মহরম আলী অর্থবিত্তে গরীব হলেও সারাটা জীবন মাথা উঁচু করেই চলেছে। এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। এলাকার মানুষ বিষয়টি খুব ভালোভাবেই জানে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মোটামুটি ভাল থাকলেও বয়সের কারণে মহরম আলীর কানে একটু সমস্যা হয়েছে। কানের একটা মেশিন কেনা জরুরী। কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। সাত হাজার টাকা লাগবে। এই টাকা জোগানোর সামর্থ্য তার নেই। শ্রবণশক্তি কমে গেছে; কানে শোনেন না বললেই চলে। সে কারণেই তিনি সকলের সাথে একটু জোরেই কথা বলেন। কথা বলার সময় মনে হয় অন্যরা হয়তো তাঁর কথা শুনছে না। অনেকটা কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শোনারত কোন ব্যক্তির মতো। সে মনে করে তার কথা হয়তো কেউ শুনছে না। মহরম আলীরও ঠিক একই অবস্থা। কেউ কিছু বললেও একবারে শোনেন না। উল্টো তাকেই উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,‘এ্যা, কী কচ্ছাও!

মোড়টাতে মতুর দোকান ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি মুদির দোকান আর একটি ধানের কল। গাঁয়ের মানুষের ধান ভানার কাজ চলে কলটায়। গাঁয়ের মানুষের বিনোদনের জায়গা মতুর চায়ের দোকান। দোকানের ভিতরে রয়েছে ভিসিডি প্লেয়ার। গাঁয়ের নানা বয়সের শ্রমজীবী মানুষ চা খায় আর হা করে রঙিন টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখে। বাংলাদেশী সিনেমা এবং ভারতীয় সিনেমা। তবে অবশ্যই বাংলা ভাষার। রঞ্জিত মল্লিক-মিঠুন চক্রবর্তী-দেব-জিৎ-কোয়েল মল্লিক আর বাংলাদেশের মান্না-আমিন খান-সাকিব খানের সিনেমা। নানা রকম সিনেমা; নরম-গরম! মোড়ের কয়েকটা মুদি দোকানের একটা মহরম আলীর ছোট ছেলে আলালের। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিল আলাল। সেই পুঁজির জোরেই কোনমতে দোকানটা চালায়। বুড়ো বাপটাকে সেই দেখে। মহরম আলীর আরেকটা ছেলে আছে। দুলাল। সে বড় ছেলে। নিজের কোন জমি-জিরাত না থাকায় পরের জমিতে কৃষাণ দেয়। সারাদিন হাড়খাটুনি খেটে বউ-ছেলেপুলে নিয়ে কোনমতে সংসার চালায়। মহরম আলীর একটা মেয়েও আছে। পাশের গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন।

মহরম আলী মতুর দোকানের বাঁশের মাঁচায় বসে থাকে। যাকেই পায় তার সাথেই গল্প জুড়ে দেয়। অনেকেই মহরম আলীর গল্প শোনে; অনেকেই বিরক্তও হয়। সবচেয়ে বেশী বিরক্ত হয় চায়ের দোকান্দার মোতালেব হোসেন মতু। এই বিরক্তির কারণও আছে। মহরম আলীর গল্পের বিষয় একটিই। প্রতিদিন একই গল্প শুনতে কারই বা ভাল লাগে। মানুষ বিরক্ত হলেও মহরম আলীর গল্পের সিংহভাগ জুড়ে থাকে একই বিষয়। মহরম আলীর এই পৌঢ় জীবনের অভিজ্ঞতা সেসব গল্পকে জীবন্ত করে তোলে। মহরম আলীর গল্পের মূল শব্দ দুটি। গন্ডগোলের বছর আর শেখ সাহেব। এ দুটি শব্দ যেন মহরম আলীর কাছে স্লোগান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন মুক্তিযোদ্ধা আর গণমানুষের স্লোগান ছিল জয় বাংলা। এই স্লোগান পুরো জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছিল। মহরম আলীও তেমনটিই মনে করে। তাঁর গল্পের গোন্ডগোলের বছর মানে উশিশ’শ একাত্তর সাল আর শেখ সাহেব হচ্ছেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। মহরম আলীর মতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই বংশীবাদক যাঁর মোহন বাঁশির সুরে বাঙালি জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য; স্বাধীনতার জন্য। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মহরম আলীর গল্প শুনলে মনে হয় একাত্তর মানে এই তো সেদিনের কথা। বঙ্গবন্ধু যেন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন,‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যে ভাষণ অনেকের সাথে মহরম আলীও শুনেছিলেন রেডিওতে।

একাত্তরে মোহন বাঁশির সুরে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য যে দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহরম আলী তাঁদের একজন। যুদ্ধদিনের স্মৃতিগুলো মহরম আলীর মুখে শোনায় মধুর মতো। মহরম আলী চার ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তামাটে বর্ণের সুঠামদেহের অধিকারী ছিলেন তিনি। আইয়ুব খানের আমলে আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। শৈশবের গুলতি মারা হাতে তীক্ষè নিশানা ছিল মহরম আলীর। প্রশিক্ষণের সময় তার নিশানা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলো প্রশিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বুরামারা বিলের পাশে খয়ের বাগানে এলাকার পয়ত্রিশ জন যুবককে নিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছিল। বেণু কমান্ডারের নেতৃত্বে এই ক্যাম্পের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল মহরম আলীর হাতে। বেণু কমান্ডারের নির্দেশে তিনিই সকলকে ট্রেনিং দিতেন। র‌্যাখি করা, এমবুশ করা, রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। মহরম আলীকে বেণু কমান্ডার খুব ভালোবাসতেন। তাই তাঁর উপরই এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। মহরম আলীর খুব মনে পড়ে সেই সোনালি দিনগুলোর কথা; সেই যুদ্ধদিনের কথা। এই পৌঢ় বয়সেও সেই পয়ত্রিশ জন যুবক মুক্তিযোদ্ধার প্রায় সবার নামই বলতে পারেন মহরম আলী। মকুল মাস্টার, সাজু, রেজু, সিদ্দিক, রবু ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ এই ভর বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে সাথে আরো কয়েকজন মুরুব্বী গোছের বয়স্ক মানুষ নিয়ে মোড়ে মতুর দোকানে এসেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি এ গাঁয়ের সবচেয়ে সম্মানী মানুষ। একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। একজন সফল মানুষ তিনি। তাঁর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। সবাই বড় পদে সরকারি চাকরি করে। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদে তারা চাকরি পেয়েছে। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ভাবলে গর্বে বুক ভরে যায় তাদের। হাবিবুর রহমান দোকানে আসার সাথে সাথে মতু হাতাওয়ালা প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো বের করে দেয়। এই চেয়ারগুলো মূলত দোকানে গুরুত্বপূর্ণ আর সম্মানী ব্যক্তিরা আসলেই দেওয়া হয়। আম পাবলিকের জন্য এগুলো নয়। ইতিমধ্যে দোকানের টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাবিবুর রহমান চাচার সামনে এসব বেয়াদবীর পর্যায়ে পড়ে। এলাকার মানুষ তা জানে এবং মেনে নেয়। হাবিবুর রহমান হাঁক ডাকেনÑ
- মতু, এ্যা মতু। জলদি চিনি ছাড়া এক কাপ লাল চা দে তো বাপ!
- ক্যা কাহা, আইজক্যি এতো তাড়াহুড়া ক্যা?
- হ রে বাপ। সামনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন। মুক্তিযোদ্ধাগেরে সাথে যোগাযোগ করা লাগতিছে; ভোট চাওয়া লাগতিছে। খুব চাপে আছি।
- নির্বাচনের কী অবস্থা কাহা?
- ইনশাল্লাহ্!
- আচ্ছালামু আলাইকুম মহরম ভাই। ক্যামা আইছেন?
গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাঁর চোখে পড়ে বাঁশের মাঁচায় বসে থাকা মহরম আলীকে। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে মহরম আলীকে সালাম ঠোকেন। সেই সাথে মতুকে ডেকে মহরম আলীকে চা-বিস্কুট দেওয়ার কথা বলেন তিনি। হাবিবুর রহমান সালাম মহরম আলীর কানে পৌছায় না। সে এদিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ্যা, কী কচ্ছাও!

মতু এবার মহরম আলীর প্রসঙ্গে কথা তোলে। তার দুর্দশার কথা; মুক্তিযোদ্ধা সনদ না পাওয়ার কথা ইত্যাদি।
- ক্যা কাহা, শুনি মহরম চাচা আপনেগোরে সাতে যুদ্ধে গেছিলো। তার নাম নাকি লিস্টে ওটে নাই। আপনে রা কি তার জন্যি কিচু করতি পারেন না?
- আর কইস নি বাপ, চেষ্টা তো কম কইরলেম না। বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। তাঁর এই দীর্ঘশ্বাস অশিক্ষিত, চা বিক্রেতা মতুর মনে এই ধারণার জন্ম দেয় যে, মহরম আলীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের আন্তরিকতা কিংবা চেষ্টার কোন ঘাটতি নেই।

সরকার তালিকায় নাম না ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করার না কি উদ্যোগ নিয়েছে। একবার কয়েকজন সাংবাদিক এসেছিলেন গ্রামে। তারা মহরম আলীকে নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন জাতীয় পত্রিকায়। পত্রিকায় এই রিপোর্ট ছাপা হলে ইউএনও সাহেব ডেকেছিলেন মহরম আলীকে। ছোট ছেলে আলালকে সাথে করে তিনিও গিয়েছিলেন ইউএনও অফিসে। মহরম আলীকে নিয়ে শুনানীও হয়েছিলো। সেই শুনানীতে ছিলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও। কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধা মহরম আলীর বিষয়ে তথ্য না দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আর কিছুই হয় নি।

মহরম আলীর নাম মুক্তিযোদ্ধা লিস্টে না ওঠা নিয়ে অনেকবার ভেবেছে মোতালেব হোসেন মতু। কিন্তু ক’লিয়ে উঠতে পারে নি। বিষয়টি খুব জটিল। আর জটিলতার শেষ পর্যন্ত পৌছানো মতুর মতো একজন অশিক্ষিত চা বিক্রেতার সম্ভব নয়। মতু সেটা জানে। তবু মনে অনেক প্রশ্নের উঁকি দেয়। তবে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মহরম আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। যদিও মতুর বিশ্বাসে কারো যায় আসে না। শুধুমাত্র লিস্টে নাম না থাকলেই কি তিনি বীর হিসেবে বিবেচিত হবেন না? মতু এও জানে দেশের অনেকের অবস্থাই মহরম আলীর মতো। মতুর এসব ভাবনায় দিন দিন জং ধরছে। মহরম আলীর জন্য মতুর খুব কষ্ট হয়। গর্বও হয় বেশ! এদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের হাতে বানানো চা খাওয়াতে পারাকে নিজের ভাগ্য বলে মনে করে সে। এদেশের অনেককে দেখে মতু আশ্চর্যও হয়। মহরম আলীর মুখে উচ্চারিত সেই যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তো বেঁচে আছেন। তারা কি মহরম আলীর জন্য কিছু করতে পারেন না? যদিও হাবিবুর রহমান চাচার নাম কোনদিনও মহরম আলীর মুখে সে শোনে নি কোনদিন। মহরম আলী তার দোকানের দিকে মন দিতে চায়। বাঁশের মাঁচায় বসে থাকা মহরম আলীকে উদ্দেশ্য করে বলে-
- কাহা, এক কাপ রঙ চা খাবেন?
মতুর কথা মহরম আলীর কানে পৌছায় না। সে এদিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ্যা, কী কচ্ছাও!

যাহিদ সুবহান, আটঘরিয়া, পাবনা।