ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১০৮

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১০৮
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১০৮
বৃহস্পতিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৯






















শব্দমিছিল : শোয়াইব শাহরিয়ার

শব্দমিছিল : শোয়াইব শাহরিয়ার


শব্দমিছিল
শোয়াইব শাহরিয়ার

পাখি

পাহাড় আমার খুব কাছেই। সাগরের সাথে সঙ্গমের অপেক্ষায় পাহাড়। মাঝখানে আমরা ক’জন প্রেমিকসেনা দুলতে থাকি, ঘুরতে থাকি। আমরা সাগরের সাথে প্রথম সঙ্গমে লিপ্ত হই, তারপর পাহাড়ের সাথে সঙ্গমের জন্য দৌড়ে যাই। আমরা দৌড়াচ্ছি, পাহাড় ততক্ষণে পাখি হয়ে গেল। পাখির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আর কোনো প্রেমই রক্ষিত নেই। বুঝলাম- মৌনতার পেছনের যৌবন ঢেলে লাভ নাই।

ভাগ্য

নদীকে ভালোবাসি। নদী আমায়। আমাদের মাঝে রাঘববোয়ালের অভাব নেই। আমরা একে-অপরকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরি। আমার মনে হলো- কোথায় যেন তলিয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরতেই দেখি সবাই কাঁদছে। এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করছে। মা বিলাপ করছে, ‘আল্লাহগো, এ কী করলা! শেষ পর্যন্ত নদীর পেটের ভিতর পোলাডারে... ‘মায়ের ডান দিকে কী একটা দেখা যাচ্ছে। সাদা কাপড়ে মোড়ানো। সন্তান হারার শোক। মা অনর্গল কাঁদছে। কিছুক্ষণ পর জানাজা হলো। আমার ভাগ্য আমাকে কাঁধে নিয়ে কবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সন্দেহ

ঘন মেঘের আড়াল হতে প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো বেরিয়ে এলে, প্রজাপতি মন আমার উড়ে যায় তোমার ভেতর। বৃষ্টিস্নাত পথে যখন বাড়াও পা, তখন তুমি ঢুকে যাও আমার ভেতর সম্পূর্ণ, একা। তোমার স্পর্শে আমার ভেতর জন্মেছে নদী। সেখানে সাঁতার কাটো তুমি। আমার চোখ দু’টো তোমার। যোগ করে, করেছ চারটি। আমার হৃদয়টি তোমার। যোগ করে, করেছ দু’টি। যোগ-যোগ খেলায় আমরা এখন সমুদ্র। পাশাপাশি খেলা করে সুখী ঢেউ। ঢেউগুলো নির্মল-বড়। সেই ঢেউয়ের আঘাতে, আমাদের পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে যায়।


শব্দমিছিল : কৃষক মাহমুদ

শব্দমিছিল : কৃষক মাহমুদ


শব্দমিছিল
কৃষক মাহমুদ

রাতের কথা

নগ্ন বৃক্ষের ডাল ধরে দেখছি নদীর নান্দনিক স্রোত-
নেমে দেখে নিতে চাই দুরত্বের জাদু বাকসো;
অকৃত্রিম নৈসর্গিক আপেল দ্বীপ আর আবাদি জমি দরজা অলিগলি-
দ্বীপে হাত বুলিয়ে চেটে যায় বৃক্ষের তল পেট।

তোমার হাত ধরে উঠে দাড়ায় কাল কিয়ামতের কাধে...
তোকে পুতে দিব বৃক্ষ বুকে, পরিচয় গিলে খাবে তোর শরীর আর মুহুত্রে হয়ে উঠব পিতা,
একজন শোষিতের গল্প-
যে আলো আধারে ও গোধুলী প্রভাতেও শোষিত - একটা তীক্ষণ ঠোঁট
আদর নামে খেয়ে নিচ্ছে জীবন মধু
কিচমিচ আদলে কুচকে যাচ্ছে জীবন...


আমি এক অদ্ভুদ পাপি

দৃষ্টি দরজায় খুলে দিলে বুকের কাপুড়
সভ্যতার আড়াল থেকে উঁকি দিল টলটলে খুসকিত দু’টি স্তন
অতঃপর দরজায় দোল দোল যৌবনের বাতাস...

আমি এক অদ্ভুদ পাপি...
চল্লিশ উর্ধনারীর প্রেমে পড়ে গেল মন-
ঢ্লঢলে নীল ব্লাউজ ফাকে দস্যুদৃষ্টি দেখে নিলো কালো কিসমিস স্তনবোটা...

আঠাশ বছর বয়সী যৌবন- ছায়াতলে মুখ লুকাতে উদ্বীগ্ন,
ওগো চল্লিশ উর্ধরমনী পাঁচটির জননী ডেকে নাও গোপন অভিসারে,
উন্মাদ করে তুলবো তোমার আঠারো কিম্বা আঠাশের কাম উদ্দীপনা আদলে,
আমার একেমন নেশা- সৌর্ন্দয দর্শনে আমি এক অদ্ভুদ পাপি...
শীতের এ শুকনো দুপুর কামদেবতা রং তুলেছে শিশ্ন মন্ডবে

ওগো নারী জননী হলেও তুমি রমনী
বাঁধা দিওনা- আমি যে সৌর্ন্দয পিপাসু পাপি..



প্রাচীন ধূলোর শরীরে


বন্ধ রাখা ঘর কোন থেকে তুলে আনি এক ডজন প্রাচীন ধূলো,
সরিয়ে দেখি চশমার ফ্রেমে বাঁধা আছে আজো মানুষ সেই হাটে-
যে প্রান্তরে প্রাণহীন লক্ষ দেহ হাহাকার তোলে, রকতো, বায়ু উড়ে যেত স্বর্গে
ঈশ্বরের পরে ঘৃণা করে অনেকে স্বেচ্ছায় চলে নরকের পথে
আর স্বরগ ও তার মালিকের পাড়ায় ঘৃণার ধিক্কারে ছুড়ে বলতো


শব্দমিছিল : লাবন্য শাহিদা

শব্দমিছিল : লাবন্য শাহিদা


শব্দমিছিল
লাবন্য শাহিদা

প্রেমিকা

দিব্যি নিলুম ছুঁয়ে শিরা ধমনিকা
পরের জন্মে হব মনের মত প্রেমিকা

আজকে যখন বিষাদ ছুঁয়ে বলিস,
তুই বরঞ্চ বাচ্চামো টা ছাড়িস!
তখন চোখ টা ভাসাই স্রোতে
জানতে পারিস কি তা কোনো মতে?
নতুন মানুষ বোঝে কি ভালো?
ছিলাম যখন তোর আবেশে কালো
বৃষ্টি ছিল মফস্বলের রেলে
ছুট লাগাতাম সেই হুল্লোড় বেগে
অভিযোগের সাতটি প্রহর শেষে
পাহাড় ভাঙ্গে গর্জন আর মেঘেতে
আচ্ছা বলি,
এখনো কি রেগে করিস তাণ্ডব?
ধৈর্য নিতুম চোখটি বেয়ে
এমন কেন তুই অর্ণব!
আজো যখন মাথা ব্যথা ঝাঁপালে
কেউ এসে কি হাতটা রাখে কপালে
অট্টহাসি দিতুম সকাল দুপুর সাঁঝে
তুই বলতিস, থাম প্লিজ,এসব কি সাজে!
জানিস, আজ অনেকদিন কেটে গেছে
হাসি যেন আমায় ছেড়ে গেছে!
এখন আর দেখা হইনা মোদের
পাংশু মেঘ আর একশ বৃষ্টি আকাশ
তুই ছিলিস মোর বেঁচে থাকার প্রকাশ
কেন যেন ছেড়ে গেলি চলে
চোখটা ভাসে রাতটা ভরে এলে
একটু এসে দেখ
বাচ্চামি টা ছেড়ে গেছে
নতুন নতুন রেশ
এখন কাঁদি এক সমুদ্র চোখে
নতুন ভোরের আলোর মিছিল দেখে

সত্যি বলছি দেখিস
দিব্যি নিলুম ছুঁয়ে শিরা ধমনিকা
পরের জন্মে হব মনের মত প্রেমিকা


কৃতজ্ঞতা

আমায় ছেড়ে যাওয়ার মাঝে
ধন্যি হলাম যাদের পা এর কাছে,
আজ ভাবাচ্ছে এমন অবেলাতে
খুব যেদিন কেঁদেছিলাম স্রোতে
বুঝলি?
বুকটা ধুমড়ে মোচড়ে ঘাতে
ভেঙ্গেছিল যেমন
বড় অবেলাতে প্রশ্ন জেগেছিল
আমার সাথে হচ্ছে কেন এমন?

আজ বছর অনেক যেতেই
ভাবি এমন রোজই হয়
সব মানুষের সাথেই!
লিখতে বসে গড়িয়ে যাচ্ছে জলে
যে জিনিস টার মূল্য’ই নেই
আজন্ম কোনো কালে!

যাদের আশা নামক চোখে
স্বপ্ন একেঁছিলাম আবেগে
একদিন তারাই একলাটি
করে মোরে ছুড়ে দিল শেষে
জোকার সাজার রেসে!
এখন আমার বিস্তর জুড়ে
আকাশ খানা বাড়ি,
রাতটা বাজে
করুন সুরে ভায়োলিনের সারি!
এখন আমি একাই বাচঁতে পারি
আঁকতে পারি সুখ দুঃখ
আর ভুলে গেছি
আজন্মকাল ভালবাসার সাথী!

এড্রালিন

আজ যারা এত মিথ্যার দায়ভাগী
প্রত্তুত্তরে ঘৃণা সম কামানদাগী,
কবে আমাদের বাহুর প্রবলে
কোটি মানুষের দুর্বার চাপে
শৃঙ্খল গত হবে
কবে প্রাণ কোলাহলে
কোটি শ্লোগানের জোয়ারের জলে
ভেসে যাবে কারাগারে!


ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ১৩

(গত সংখ্যার পর)
দীপু ভাই অবুঝ কণ্ঠে বলে, ‘দেবী, জনম জনম কাঁদিব।’
সন্ধেবেলা জাকির সাহেব আসে বাবাকে নিয়ে। শুভপুর থেকে বাবা এসেছে পত্রিকায় বেবী আপাকে জড়িয়ে ধরা ছবি দেখে। পত্রিকায় যেভাবে লিখেছে তাতে উর্মির জীবন বিপন্ন। বসন্ত পাল অতি সাধারণ মানুষ। কন্যার সংবাদে ছুটে এসেছেন।
বাবাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে উর্মিলা। স্যালাইনের হাত দিয়ে বাবাকে ধরতে যায়।
জাকির সাহেব বলে, ‘অস্থির হইও না। উনি বয়স্ক মানুষ কষ্ট পাবেন।’
কে শোনে কার কথা। বাপ-বেটির ক্রন্দনে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
বাবা বলল, ‘উর্মি তুই ছাড়া আমার তো কেউ নেই।’ উর্মিলা কাঁদতে থাকে। এক সময় কান্না থামিয়ে বলে, ‘তুমি কেঁদো না বাবা। উর্মির মতো কত ছেলেমেয়ে তুমি জন্ম দিয়েছ। তারা তোমার কেউ না?’
‘না না আমি সে কথা বলি নাই।’
উর্মিলা জাকির সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার বাবা রাতে থাকবেন কোথায়?
‘কেন? তোমার বেডে। আমি কেয়ারটেকার, রুবীকে সেই ভাবে ব্যবস্থা করতে বলে দিয়েছি।’
‘ও। রুবী খুব ভালো মেয়ে বাবা।’
বাবা উর্মিলার  মাথায় হাত বোলাতে থাকে।

১৪.

পরদিন ড্রেসিংয়ের পর ডাক্তার বলল, ‘দু-একদিনের মধ্যেই বাসায় চলে যেতে পারবেন। ওষুধগুলো চলবে। ঘুমের প্রয়োজন।’
উর্মিলার বিচিত্র রকম ছবি নিয়ে পত্রিকাগুলো স্টোরি ছেপেছে। যেন সব গল্পের কেন্দ্রবিন্দু শুভপুর গ্রামের একজন অতি সাধারণ শিক্ষক কন্যা। যার রয়েছে অমিত তেজ আর সুদৃঢ় দেশপ্রেম। সারল্যে গড়া উর্মিলা পাল হয়ে উঠেছে জাতির এক অনন্য বিস্ময়। রাতারাতি গ্রাম, গঞ্জ-লোকালয় থেকে দেশান্তরে পৌঁছে গেছে উর্মিলা বলে একটি মেয়ের নাম। গার্ডিয়ান লিখেছে ‘সি ইজ ব্রিলিয়ান্ট লেডি এন্ড পেট্রিট।
ফ্রন্টলাইন লিখেছে, পেট্রিয়েট এন্ড গ্লামারার্স গার্ল।’
মিতালী সিকদার বারবার বলতে থাকে ‘উর্মি, আমি কিন্তু হিংসে করতে শুরু করেছি।
 শিমু দিদি বলেন, ‘জাকির সাহেব যেভাবে উর্মিলার বেডে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তাতে মনে হয় উর্মির বাধ্য প্রেমিক। শুধু হুকুমের অপেক্ষায়।’
নাজনীন আপা বলেন, ‘উর্মি, তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে।’ এ সময় হাসপাতাল জুড়ে কলবর। তাড়াহুড়ো। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আহতদের দেখতে আসছেন। প্রথমে শহীদ জননীসহ নেতানেত্রীদের দেখে তারপর উর্মিলার ওয়ার্ডে আসবেন। ওয়ার্ডবয় থেকে প্রশাসন পর্যন্ত  ক্যামন তটস্থ। নার্স-ডাক্তারদের ব্যস্ততার সীমা নেই। হঠাৎ করে সবকিছুতেই যেন ক্যামন সুনসান  নীরবতা।
ইতোমধ্যে শিমু দিদিরা চলে গেছেন। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ডুবে যেতে থাকে উর্মিলা। দীপু ভাইয়ের ডাকে ঘুম-মগ্নতা কেটে যায়। চোখ মেলে তাকাতে দেখে দীপু ভাই দাঁড়িয়ে। পাশে জননেত্রী শেখ হাসিনা। দীপু ভাইয়ের হাতে ফুলের তোড়া। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শেখ হাসিনা বললেন, ‘তুমিতো অসাধারণ মেয়ে হে।’
হতবিহ্বল উর্মিলা কী বলবে? আকস্মিক মনে হলো তার এই কথাটি, ‘বাবা আপনাকে হাসু বলে ডাকে।’
শেখ হাসিনা মৃদু হেসে সরল ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমার নামতো হাসুই। উনি তো তাই ডাকবেন।’
‘ও।’
‘তোমার বাবা কোথায়?’
‘শুভপুরে থাকেন। রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার।’
‘উনাকে আমার প্রণাম পৌঁছে দিও। বলো, উর্মিলার মতো হাসুও মাতৃভূমির জন্য কোনো আপস করে না।’
শেখ হাসিনা উর্মিলার মাথায় হাত বোলাতে থাকেন। আর ঠিক তখন ওর দু’চোখ ভরে জলের ধারা নামে।
প্রেসম্যানরা পটাপট ফটো তুলছে। আহতদের দেখে শেখ হাসিনা যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, উর্মিলা দেখে দীপু তেমনি ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে।
‘দেবী, তোড়া কোথায় রাখব? ভাবছেন শেখ হাসিনা দিয়েছেন। না না।  পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনেছি।  ভাবছিলাম, তোড়া দেবার ছবি পত্রিকায় উঠবে আর আমি অমর হয়ে থাকব।’ দীপু ভাই ফুলের তোড়া পাশের  ডেক্সে সাজিয়ে রাখলেন।
উর্মিলা স্মিত হেসে বলে, ‘কী যে বলেন দীপু ভাই! অসুস্থ মানুষকে কষ্ট দেয়া কি ঠিক?’
‘আমিও অসুস্থ। সুলতানা রাজিয়ার জন্য কাতর হৃদয় মুচড়ে গেছে। কেউ দেখেনি!’
‘দীপু ভাই, চুপ করবেন না আমি উচ্চস্বরে কাঁদব। তখন নার্স এসে আপনাকে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেবে!’
‘তখন রামের মতো বনবাসে যাব। অযোদ্ধা ছেড়ে পঞ্চবটি বনে। নিঃসঙ্গ, একাকী। শুধু দেবী সীতা থাকবে না।’
উর্মিলা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কথা বলে না।
‘এ দু’দিন ঘুমুতে পারিনি। চোখের তারায় দেবী ভেনাস হৃদয়বিদ্ধ কায়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই থেকে আমাকে কেউ উদ্ধার করেনি আহারে।’
‘দীপু ভাই, আপনি এভাবে কথা বলবেন না।’
‘অবশ্যই বলব। দেবীরা অদৃশ্য। পুরাণের নায়িকা। যুগ-যুগান্তরের উপকথা। আমি তাদের দেখিনি। কেউ দেখেনি। আমার দেবযানী রক্ত-মাংসে মানুষ। তার মানুষ জন্মের জন্য গর্বিত। আমি কষ্টে প্রেমে তাকে দেখতে পাই। তাকে নিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে। মিছিলের রাজপথে দিগন্ত কাঁপানো প্রতিবাদে ফেটে পড়তে  ইচ্ছে করে। আমি কি বেশি বলছি, দেবী?’
মাথার পাশে রাখা সংবাদপত্রে চোখ রাখতে যে সংবাদে দৃষ্টি আটকে যায় তার নাম মেরী মমতাজ। জেনারেল এরশাদের প্রেমিকা। লম্পটের  অংশীদার।
সংবাদটা এমনভাবে পরিবেশন করেছে যেন জগতের তাবৎ মানুষের ঘৃণার উদ্রেক হয়। উর্মিলার গা রি রি করতে থাকে।
‘দেবী, আপনাকে তো বলা হয়নি। মা আর আসমাকে ঢাকা নিয়ে আসব।’
উর্মিলা মৃদু স্বরে বলে, ‘অবশ্যই নিয়ে আসবেন! তাদের তো আপনি ছাড়া কেউ নেই।’
‘ওদেরকে আপনার কথা বলেছি। ওরা জানে না আপনি জগৎ জুড়ে থাকা এক নারী।’
‘আপনি বেশি বলেন।’
‘সত্য বলছি।’
‘শহীদ জননী, বেবী আপা কেমন আছে।’
‘শহীদ জননী চলে গেছেন। বেবী আপাকে আজ রিলিজ দিতে পারে। তিনি তো আপনাকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। না করতে পারতাম। না করিনি।’
উর্মিলা মৃদু হাসে। দীপু ভাইয়ের মুখের দিকে স্থির চোখ রেখে বলে, ‘দীপু ভাই, আপনি তো আমার লোকাল গার্জিয়ান। সমস্যা কোথায়?’
‘না না কোনো সমস্যা নেই। তবে দেবী বলে কথা। আপনার আহত ছবি নিয়ে পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো ঢাকা শহর। দেয়ালে দেয়ালে আপনি সেঁটিয়ে আছেন। আহ কী আনন্দ ঘরে ঘরে।’
উর্মিলার কোনো ভাবান্তর হয় না। শুধু শুভপুরের কথা মনে হয়। অনেক পরিচিত মুখ স্মৃতিতে ছায়াপাত করে যায়।
বাঁশিওয়ালা রফিক ভাই কি জানে উর্মিলা মেডিকেল বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। স্কুল গেটের নীরব প্রেমিক মনসুর। কী করুণ তার চোখ! উর্মিলা, লিলুয়া বাতাস অনুভব করে। মিহিন শব্দের ফ্রেমে আটকে থাকে করুণ রাখালিয়া অথবা বংশাইয়ের  জলের করুণ ক্রন্দন। ভাটি গাঙ বেয়ে কেউ কি চলে যায়। উর্মিলা অনুভব করে খোল-করতালের দ্রিমিকি-দ্রিমিকি উন্মাতাল কোলাহল।
‘দেবী, প্রেসের সঙ্গে কথা বলতে হবে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে। মনে রাখতে হবে আমরা ডিক্টেটরহীন সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। যার মধ্যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন আছে।’
‘আমি কি পারব, দীপু ভাই?’
‘পারবেন। অসাধারণেরা সব পারে।’
‘ফাজলামো করবেন না।’
‘আমি এর বাইরে কিছু জানি না। তবে দিব্যদৃষ্টি বলে, ‘যে পথরেখায় হাঁটতে চেয়েছি, তা আর এখন দুর্লঙ্ঘনীয় নয়। সামনের পথচারী পেয়েছি, দুঃখ-কষ্ট হলেও মেনে নেব।’
‘দীপু ভাই।’ উর্মিলা আত্মচিৎকার করে ওঠে।

পরদিন হাসপাতাল থেকে রিলিজ পায় উর্মিলা। জাকির সাহেবের ওপর দায়িত্ব হাসপাতাল থেকে উর্মিলাকে নাখালপাড়া নারীমুক্তি কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়া।
দশটার মধ্যে মাইক্রো নিয়ে জাকির সাহেব হাজির।
ট্রলি থেকে নেমে উর্মিলা গাড়িতে ওঠে। জাকির সাহেব বসে সামনের সিটে। এই ক’দিনের বেড রেস্টে উর্মিলাকে অসম্ভব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। শুধু মাথার ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ।
টিএসসির মোড়ে আসতেই জাকির সাহেব বললেন, ‘গতকাল ডিবি অফিস থেকে লোক এসেছিল। তোমার আদ্যোপান্ত জানতে চাইল।’ উর্মিলা কথা বলে না।
‘উর্মিলা কি ভয় পেলে?’
‘না! ভয় শুভপুরে রেখে এসেছি।’
জাকির সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে আবার বলেন, ‘গুড! আমি তোমার কাছ থেকে এরকম কথাই আশা করেছি।’
‘ধন্যবাদ।’
‘উর্মিলা, তোমার নিকট আমি কৃতজ্ঞ। কেন, কী কারণে! তা বলা হবে না।’
‘আমি জানি।’
‘জানো! হ্যাঁ-হ্যাঁ জানতেই পারো। কিছু কিছু মানুষ নাড়ি-নক্ষত্রের সংবাদ জানে।’
‘আমি তেমন নই। সাধারণ। শুভপুরের উর্মিলা নগরে এসেছি।’
‘আমি সাধারণের কাছে পরাজিত হয়েছি। এ পরাজয়ে গ্লানি নেই।’
জাকির সাহেবকে অতি আপনজন মনে হয়। মানবসন্তান হিসেবে এটা তার আজন্ম অধিকার।
(চলবে)

একজোড়া আঙ্গুলের বাঁধন

একজোড়া আঙ্গুলের বাঁধন

একজোড়া আঙ্গুলের বাঁধন
ইয়াকুব শাহরিয়ার

বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ভার্সিটি গেইটে গিয়ে দাঁড়াই। বাসস্ট্যান্ড থেকে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় খুব কাছে। পূজোর বন্ধ শেষ হয়েছে। কাল থেকে ভার্সিটি খোলা। সকল শিক্ষার্থীরা হলে ফিরতে শুরু করেছে। তাই গেইটের সামনে প্রচ- ভিড়। ভিড় বলতে হল পর্যন্ত যেতে যে টমটম বা রিকশা পাওয়ার কথা সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছে। বেশি দূর হবে না। এক কিলোমিটার হবে। নরমালি পায়ে হাঁটলে পনেরো ষোলো মিনিট বড়জোর বিশ মিনিট লাগে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। কুসুম আসলে পরে একসাথে যাবো, ভিরতে। এরই মাঝে একজন স্ট্রিটহকার এসে আমাকে ‘বরিশালের আমড়া’ অফার করলো। পাঁচ টাকা দাম। গোলাপের মতো করে কাটা আমড়াগুলো রোদে শুষ্কভাব ধরে আছে। এমন আমড়া প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন সি থাকে। খুব উপকারি। রং ফর্সা রাখে। বিশেষ করে স্কার্ভি রোগ এড়াতে এগুলো খাওয়া দরকার। ছোট বেলায় আমি একজন নিয়মিত স্কার্ভি রোগী ছিলাম। আমড়াগুলোর চেহারা পছন্দ হয়নি বলে পকেটের পাঁচ টাকা থেকে গেলো। দূপুরের রোদের পরে বিকেলের আগের রোদটা কড়া থাকে। তাই একটু গরম গরম লাগছিলো।
হঠাৎ করে আম্বরখানা থেকে আসা একটি সিএনজি থেকে কুসুম নেমেই আমাকে ডাক দিলো। আমু...। ভাঙতি পনেরো টাকা আছে? আমার কাছে ছিলো কিন্তু কেনো যেনো মুখ দিয়ে না চলে এলো। পরে সিএনজি ড্রাইভারই যাত্রীদের কাছ থেকে ম্যানেজ করে দিয়েছে। কুসুম নামতেই ওর চেহারার দিকে নজর পরে আমার। শুকনা পাতলা একটা মেয়ে। খুব ভাল লাগছে দেখতে। বোরখা পড়ে না কখনো। তাকে দেখে কখনো মনে হয় নি আলাদা করে বোরখা পড়া দরকার। কারণ এমনিতেই তার পোশাকে সব সময় শ্লীল সে। তার প্রতি ভালবাসা, বিশ্বাস, সম্মান ও স্নেহ কাজ করে। আমি মনে করি এ চার উপাদান না থাকলে ভালবাসা যায় না। সময় কাটানো যায়। আমার কাছে এসে কিছু না বলে আমার মতো করে দাঁড়িয়ে রইলো। জিজ্ঞেস করলাম- কি? ছোট্ট করে সরি বলে- বললো, চলো যাই। আমি বুঝতে পেরেছি কেনো সরি বলেছে। তার কারণে যদি কালো চেহারায় কিছুটা ঘেমে যাই, সোজাসাপ্টা সরি বলতে কোনোদিন দ্বিধা করে নি। ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়ে ঘড়ির দিকে থাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

জানি রিকশার অপেক্ষা করা বোকামী। তাছাড়া কুসুম আর আমি যতদিন গেলাম- এলাম ভিতরের এ রাস্তাটা হেঁটেই পাড় হয়েছি। খুব ভাল লাগে এ রাস্তায় হাঁটতে। এ ভার্সিটিতে আমরা কেউ পড়ি না। আমি আর কুসুম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমার দুই ইয়ার জুনিয়র সে। দু’জন দুই শহরে। দেখা করতে আমিই ছুটে চলি তার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে শহিদ মিনারের পেছনের দিকটায় গিয়ে বসি। আমাদের সামনে আরো দু’চার জোড়া বসে লুটোপুটি খেলছে। ভাল লাগছে। কুসুম আমার কাছে কিচ্ছু আশা করে না। সান চিপস্ তার খুব পছন্দের। সেদিন দেই নি। হঠাৎ করে করুণ স্বরে বললো- আমু? তার দিকে তাকাতেই দেখি জল গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কাঁদতে লাগলো। কিছু না বলে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলাম। দু’চার মিনিট পরে ‘কি হয়েছে’ জানতে চাইলে বলে উঠলো- ‘আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি খুব একা। আমার পাশে থাকার মতো তুমিই একজন। প্লিজ, সব সময় থেকো।’ মনে হচ্ছিলো, একাকিত্ব খুব তাড়া করে বেরায় তাকে। শহিদ মিনারের সিসি ক্যামেরাগুলো আমাদের দিকে বড় বড় চোখ করে দেখছিলো। বাকীদের মতো আমরাও লজ্জা পাই নি।
তাকে বাহুডোরে বেঁধে পাশে থাকার আশ্বাস দিলাম। তারপর মুখের দিকে অনেক্ষণ থাকিয়ে বললো- দেশে সেলুন নাই? বন মানুষের মতো দাঁড়ি লম্বা করে রাখছো কেনো? পাগলের বেশে থাকতে খারাপ লাগে না? আর চুল গুলার স্টাইল আদিম যুগের মতো করে রাখছো কেনো? এটা বদলানো যায় না। আমার সান চিপস্ কই? টিশার্টের রং ভাল কিন্তু একটু মোটা।’ আমি কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেইনি। কিছুক্ষণ পর উঠলাম দু’জন। অডিটোরিয়ামের দিকে এগুতেই ছোট ভাই একটা পেলো। আজকেই হলে এসেছে। কুসুমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সে চলে গেলো বাংলা ভবনের দিকে। আমরা অডিটোরিয়ামের ডানদিকের রাস্তায় গিয়ে গার্ডওয়ালে বসলাম। একটা বনোশিয়াল আমাদের দেখে উঁকি দিলো। পরে এদিকে রোদ থাকায় ছায়ার দিকে বসে কথায় কথায় সময় পাড় করি। বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল জড়িয়ে কুসুম বললো- আমু, যদি এই আঙ্গুল গুলোকে সারাজীবন এভাবে একসাথে রাখার কোনো সুপ্রিম ক্ষমতা আমার থাকতো তাহলে আর কোনো ভয় থাকতো না।
-কিসের ভয়?
-যদি কখনো তোমার থেকে দূরে যেতে হয়?
আমি উঠে দাঁড়াই, কনিষ্ঠা আঙ্গুল আর হাত ছাড়া হয় নি। একজোড়া আঙ্গুলের ঘষাঘষি এসে থামে পুচকার দোকানে। আমি চটপটি খেলাম আর কুসুম পুচকা। আমার কাছে পুচকাটা মেয়েদের খাবার মনে হয়। আর চটপটি পুরুষের। ষাট টাকা বিল চুকিয়ে আবার একজোড়া আঙ্গুলের জড়াজড়ি। আবার হেঁটে চলা এক কিলোমিটার কিংবা পনেরো ষোলো মিনিট বড়জোর বিশ মিনিট। তখন গোধূলি সন্ধ্যার বুকে মাথা রাখলো বলে।

পাপ

পাপ


পাপ
রুহুল আমিন রাকিব

পৃথিবীটা গোলাকার জীবন চলার পথে হঠাৎ আপনার সাথে দেখা হতে পারে শৈশবের প্রিয় বন্ধু। তরুণ বয়সের সেই প্রিয়জন! জীবনের বাঁকে বাঁকে, জড়িয়ে আছে কত স্মৃতি! কত হাসি গান, কাঁন্না বেদনা! রাজু সুঠাম দেহর অধিকারি প্রাণবন্তময় এক হাস্যজ্জল তরুণ।
কত হবে বয়স তেইশ, চব্বিশ, দেখতে শুনতে খুবই স্মাট। সব সময় নতুন নতুন শার্ট, প্যান্ট পরে। চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে ডিজিটাল মডেলের হাত ঘড়ি পায়ে দামি চামড়ার জুতা। সব সময় পরিপাটি ভাবে চলতে পছন্দ করে বাবা মায়ের এক মাত্র ছেলে রাজু!
এক মাত্র ছেলে হলে যা হয় আর কী! রাজুর বেলায়ও তাই হয়েছে ছোট থেকে যা আবদার করে বসতো বাবা মা তাই কিনে দিতো। রাজু ঠিক মতো পড়া লেখা করে নাই সেই ছোট বেলা থেকে। টেনে টুনে কোন রকমে এস, এস, সি পরীক্ষায় পাশ করে, এখন সব সময় বন্ধুদের সাথে  আড্ডা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাজুর স্বভাব চরিত্র ছোট থেকেই ভালো নয় দেখতে শুনতে সুন্দর হলেও ব্যবহারও কথা বার্তায় কখনই মাধুর্য ছিলো না। এলাকার লোক কখনই ভালো চোখে দেখত না। এমন কি ভালো পরিবারের কোন ছেলেকে রাজুর সাথে কখনই মিশতে বা চলতে দিতো না। রাজুর বাবা ওদের এলাকায় খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি।
অনেক বছর আগে এলায় মেম্বার ছিলো। সেই সুত্র ধরে এলাকায় এখনো লোক মুখে উচ্চরণ হয় তার নাম। আর বাবার নাম ভাঙিয়ে সব জাগায় অন্যায় করেও পার পেয়ে যায় রাজু।
তবে ওর বাবা ও মা খুবই ভালো মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। রাজুর বাবা মাঝে মাঝে খুবই আক্ষেপ করে বলেন। জীবন চলার পথে কী পাপ যে করছি আমি কে জানে! হয়তো’বা সেই পাপের ফসল এই রাজু। গ্রামের এমন কোন খারাপ কাজ নেই যেখানে তার নাম নেই।
এইতো সেদিন ও পাশের গ্রামের এক মেয়েকে স্কুল যাওয়া আসার পথে আজে বাজে কথা বলার দায়ে জুতার মালা গলায় পরিয়ে, দুুই গ্রামের লোকের সামনে বিচার করা হলো। সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছে রাজুর বাবা। লজ্জায় চোখের পানি ছেড়ে চুপি চুপি কেঁদেছে।
ছেলের এমন ব্যবহারের কোন মানে খুঁজে পায়না বাবা মা। ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিলো বাবা মায়ের। ছেলেকে একদিন কোরআনের হাফেজ বানাবে। একদিন অনেক বড় আলেম হবে রাজু। হাজার হাজার লোকের সামনে কোরআনের তাফসির পেশ করবে! গর্বে বুক ভরে যাবে বাবা মায়ের। অথচ আজ রাজুর নামে একটার পর একটা বিচার আসে। গ্রামের কারো কাছে মুখ দেখাতে পারে না রাজুর বাবা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে লজ্জা অপমান আর ঘৃণায় মরে যেতে। কত জাগায় যে চুরি করতে গিয়ে মাইর খেয়েছে রাজু তার যেন কোন শেষ নেই। ছেলেকে অনেক বুঝিয়ে বলার পরেও কিছুতেই ভালোর পথে আনতে পারে না বাবা মা। কী ছিলো না রাজুর বাবার! হালের গরু, কয়েক বিঘা আবাদি জমি, বড় বড় তিনটা পুকুর, বাঁশের বাগান বাড়ি ভিটা। তবে আজ আর কিছুই নেই। সব গুলোই এই রাজুর পিছনে শেষ করছে। তবুও ছেলেকে ভালোর পথে আনতে পারলো না। একটার পর একটা মামলায় জড়িয়ে যেতো রাজু। আর বাবা জমি-জমা সব কিছু বিক্রি করে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতো। রাজুর বাবা ভাবতো হয়তো তার ছেলে এবার তার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হয়তো এবার সে ভালোর পথে ফিরে আসবে। তবে নাহ্ শত চেষ্টা করেও ভালোর পথে ফিরানো গেলো না। রাজুর বাবা এক সময় তার নিজের ভুল বুঝতে পারে।
ছোট থেকে ছেলেকে সব সময় টাকা পয়সা দেওয়া ও তার বিষয়ে সঠিক ভাবে খোঁজ খবর না রাখার কারণে আজ এই পরিণতি রাজুর জীবন জুড়ে। তবে ততোদিনে অনেক ডেরি হয়ে গেছে। অন্ধকারের কালো মেঘ গ্রাস করে েেফলছে রাজুর আকাশ। চাঁদনীর আলো হয়তো আর কখনই উঠবে না ওই আকাশে। মসজিদে ফজরের নামায পড়ে বাড়ি মুখে ফিরছে গ্রামের মানুষ। হঠাৎ সবুর মিয়ার পুকুর জলে ভাসতে দেখা যায় অপরিচিত এক তরুণীর লাশ। মহুর্তের মাঝেই কয়েক গ্রামে ছড়িয়ে গেল সেই খবর। থানা থেকে পুলিশ এলো লাশ তোলা হলো ডাঙায়। লাশ দেখে কারো বুঝতে বাকি রইলো না রাতের কোন এক সময় ধর্ষণের পর ধারালো ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয় এই মেয়েকে। বাঁশের চাটিয়া দিয়ে লাশ মুড়িয়ে মর্গে নেওয়া হয়। পরের দিন পুলিশ এসে বাডড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় রাজুকে। থানায় পুলিশের জেরার মুখে অনেক কিছুই উল্টা পাল্টা বলে রাজু। সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। একে একে বেরিয়ে আসে তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা করার  ভয়ংকর কাহিনী। অনেক আগে থেকেই রাজুর পরিচিত এই তরুণী। ও যখন ক্লাস নাইনে পড়তো তখন এই মেয়ে পড়তো ক্লাস সেভেনে। তখন থেকেই প্রেমের অফার করে আসতো রাজু।
তবে বার বার তার প্রেমকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণে, অন্য ছেলেকে দিয়ে ফোনে প্রেমের ফাঁদে ফেলে। আজ রাতে কোন এক নির্জন জাগায় নিয়ে ধর্ষণের পরে খুন করে লাশ ফেলে দেওয়া হয় সবুর মিয়ার পুকুরে। এই হত্যাকা-ে আরো তিন জন অংশ নেয় রাজুর সাথে।
এই মামলার প্রধান আসামি করা হয় রাজুকে। মামলার রায়ে রাজুকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু দ-র আদেশ দেয় আদালত। আর বাকি তিন জনকে অমৃত্যু কারাদ-ে দ-িতো করা হয়। আর ছেলের এমন করুণ পরিণতির জন্য আজও উত্তর খুঁজে ফিরে রাজুর বাবা।
আসলে কে দায়ি ছিলো রাজুর এমন ভয়ংকর পথে পা দেওয়ার জন্য? পরিবার, সমাজা, না কী রাজুর বন্ধুরা?

দাগ

দাগ


দাগ
জেলী আক্তার

পড়শু বিয়েটা সাইড়া ফালাইতেই  হইবো, নয়তো পোলাডা হাতছাড়া হইবো-
খুব জোড়ে সোড়ে বললো- কেরামত ঘটক।
সব কোণার ঘরটায় শুয়ে শুয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেলছে করিম মিয়া। শিমুল তুলোর তৈরী করা তুলতুলে বালিশটা চোখের জলে ভিজতে ভিজতে কডকডে মাথায় দিয়ে আজ কাল স্বস্তি নেই।
করিম মিয়া ভাবছেÑ ‘মাইয়াডা বড় হইতেছে ভাল একটা সম্বোন্ধো পাইলাম হাতে টেহা পয়সা কিচ্ছু নাই কেমনে কি করবো। আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তেই কেরামত ঘটক ডাকলো-
-ও করিম ভাই বাইরে আহেন কতা আছে।
-চোখ মুছতে মুছতে বাইরে বেড়িয়ে এলো করিম মিয়া।
-কন কেরামত ভাই কি কইবেন ?
-আরে কইলাম না সেদিন ।
একটা ভালো পোলা আছে মেট্রিক এ দুই সাবজেক্ট ফেল, বাপের সাড়ে সাত বিঘা সম্পতি আছে, ছেলেডা এহন ব্যবসা করে কাঁচামালের ব্যবসা কামাই আছে খুব।
-কেরামত ভাই পাওনা দাওনা কি?
-তেমন কিচ্ছু চায় নাই একলাখ টাহা, আর তোমার মাইয়াডা কে সাজে দিবেন তাতেই হইবে।
-কেরামত ভাই টাহা পয়সা হাতে নাই, ঘরে যা ধান আছে তা দিয়া এই মাসটাই চলবো না। আর এত টাহা কই পাবো।
-দেহো করিম মিয়া মাইয়ার সুখ এ থাকলেই তো আপনেও সুখী থাকবেন। হাতে সময় নাই পড়শু’ই শুভ কাজটা সাড়তে হইবো। ভাইবা চিন্তা কন কি করবেন।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন আমি আইতাছি।
এই বলে ঘরে গেল করিম মিয়া অনেক ভাইবা করিম মিয়া ঘরে গিয়ে ট্রাং থাইকা বাড়ী ভিটার দলিলডা বাইর করলো। ওই একটাই জমি সেইডাও গত বছর বউটার অসুখের পিছনে বন্ধক রাখছে। এই বার বিক্রি করা ছাড়া উপায় নাই।
ঘাড়ের গামছা টা দিয়া দলিল ডা ঢাইকা বাইরে আইসা কইলো-
-কেরামত ভাই  ডিমেনডা (যৌতুক)একটু কম করার চেষ্টা করেন। আর বিয়া পড়শুই হইবো।
-করিম মিয়া চিন্তা কইরো না, খুব চেষ্টা করুম। এই বলে চলে গেল ঘটক।

-করিম মিয়া বউ কে ডাকছে।
-কই গো ফুলির মা এইদিকে আহো।
-কি কইবেন?
-জমিটা বিক্রি দিয়া টাহা নিয়া আইলাম মাইয়াডা যদি ভাল থাকে আমরা না হয় গাছের তলায় থাহুম তাতে সুখ আইবো।
-কি আর কমু আপনে যা ভাল বোঝেন সেই ডাই করেন।
-হ পড়শু বিয়া। ফুলী কই গ্যাছে অনেক ক্ষণ দেহি না মাইয়াডারে।
-ওই গ্যাছে হয়তো খেলতে।
-এহন মাইয়াডারে বাইরে বাইরতে দিয়ো না।
-কেমনে বাইন্ধা রাখুম মাইয়াডার এহন ও খেলার বয়স’ই পার হয় নাই। সংসার যে কেমনে করবো?
-ফুলীর মা অত চিন্তা কইরো না তো। সব ঠিক হইয়া যাইবো।
-চিন্তা হয় ফুলীর বাপ, চিন্তা হয়।
বিয়ের দিন এসে গেল সব আয়োজন করা হলো ফুলী এহন ও  বিয়ে সংসার এসব কিছুই বোঝে না। তবুও বিয়েটা দিয়েই দিলো ফুলীর বাপ।
কিন্তু অবুঝ ফুলী স্বামীর বাড়ীতে গিয়ে খেলতে যায়, রান্না পারে না, এবাড়ী ওবাড়ী টই টই করে ঘুড়ে বেড়ায় এই নিয়ে কত কথা, কিছুদিন পর  ফুলীকে প্রচ-ভাবে মারধর করে ফুলীর স্বামী বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দেয় ফুলীকে। ফুলীর মা ফুলীর পিঠে অসংখ্য মারের দাগে তৈরী হওয়া ফুল দেখে চিৎকার করে বলে-
-ফুলীর বাপ ফুলীর পিঠে এত্ত মাইরের ফুল গো, এইডাই কি আমার মাইয়ার সুখের দাগ।
ফুলীর বাপ কোন কথা বলছে না অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের পিঠে আঘাত গুলোর দিকে।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ

এবং প্রথমা

এবং প্রথমা


এবং প্রথমা
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

          হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এসেছিল ওরা। প্রথমা আর বিতান। দু’জনের চেনাজানা এমন একটা স্তরে পোঁছায় নি যার ওপর ভর করে অচেনায় পা বাড়ানো যায়। তবুও কেন জানি না প্রথমার মনে হয়েছিল মানুষটাকে পথ চিনে নিতে ডাকা যায়। অনুমান ভুল ছিল না। অনেকটাই পথ হেঁটেছিল দুজনে।
          অনেকটা পথ চিনে নিয়েও কোনো লাভ হয় নি প্রথমার। বাড়ির আয়োজনে আবার তাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল। গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার বারিধারায় যেমন কারও হাত থাকে না, প্রথমারও মনে হয়েছিল জীবনের সংখ্যা পর্বের সূচনায় আবার তাকে দাঁড়াতেই হবে। অক্ষমতার কারণে বাধ্য ছাত্রীর মতো আবার তাকে অঙ্ক নিয়ে বসতে হয়েছিল।
          কিন্তু যার কাছে অঙ্ক শিখতে আসা তারই কোনো আগ্রহ ছিল না। শিক্ষকের অনীহা কী করে মানিয়ে নেওয়া যায়? হাজার চেষ্টা করেও প্রথমা তাকে বসাতেই পারত না। শিক্ষকের একমাত্র ছাত্রীটিকে প্রথমা একদিন আড়াল থেকে দেখেছিল।
          স্কুলের থেকে নাম কাটিয়ে নিজের বাড়িতেই উঠেছিল প্রথমা। প্রতিজ্ঞা করেছিল আর কোনোদিনও স্কুলে যাবে না। না, শিক্ষকের ওপর তার রাগ হয় নি। বরং শিক্ষা পেয়েছিল এভাবেই বোধ হয় বেঁকে বসতে হয়। একটাই শুধু প্রশ্ন, ভর্তি হওয়ার আগে কি জানিয়ে দেওয়া যেত না?
          সবকিছু জেনেও বিতান আবার অঙ্ক কষাতে রাজি হয়েছিল। অরাজি সে কোনোকালেই ছিল না। শুধু একটু চোখে চোখ রেখে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জোরের সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া। সেটুকুও প্রথমা সেদিন করে নি। নিজেকে চূড়ান্ত স্বার্থপরের মতো মনে হলেও প্রথমা আবার বিতানের কাছে অঙ্ক খাতা না খুলে পারে নি।
          একদিন সন্ধ্যে থেকে একটা অঙ্ক নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ল দুজনে। অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মিলছে না। বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গেল প্রথমা। তখন কত রাতকে জানে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। পাতার পর পাতা অগণন সংখ্যার হাত ধরে অঙ্ক মিললো। শুধু মাথা নয়, সারা শরীর দিয়ে প্রথমা অনুভব করলো যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
          দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলো প্রথমা। অনেকটাই আলো ফুটে গেছে। পেয়ারা গাছের ডালে একটা টুনটুনি ওড়াওড়ি করছে। নিজেকে হালকা লাগছে প্রথমার। এখন সে উড়তেও পারবে।
হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ।

চোর

চোর


চোর
কিশলয় গুপ্ত

খবরটা দাবানলের মতো সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার বিনয়বাবু মিড'ডে মিলের চাল পাচার করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। স্কুল কমিটির সেক্রেটারী নিজে ধরেছে। গোটা গ্রাম ছি ছি করছে । বাচ্চাদের মুখের খাবার যে কেড়ে নেয় সে আবার মানুষ নাকি? আপাতত চোরের ঠিকানা হাজতে....
পঁচিশ বছর বিনয়বাবু কে চিনি। যে মানুষটার মাস মাহিনার এক চতুর্থাংশ বেরিয়ে যায় অন্যের কাজে সে বাচ্চাদের মিড’ডে মিলের চাল পাচার করবে- একথা আর যে’ই মানুক আমি মানতে পারছি না । গোটা গ্রাম কেন, সারা পৃথিবীর মানুষও যদি বলে আমার কাঁধের ছাগলটা আসলে ছাগল নয়-কুকুর..তবু আমি জানি ওটা ছাগল ।
থানার ছোটবাবুর সাথে কিঞ্চিৎ আলাপের সুবাদে হাজতে বিনয়বাবুর সাথে সাক্ষাৎ এর অনুমতি পাওয়া গেল। দেখে ভালো লাগলো মানুষটা এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মৃদু হেসে আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে যা বললেন, মোটামুটি এই রকম-স্কুল কমিটির সেক্রেটারী অনেকদিন থেকেই প্রলোভন দেখাচ্ছিল মিড’ডে মিলের চাল পাচার করার জন্য। আধাআধি বখরা। কিন্তু বিনয়বাবু সে কথা তো শুনলেনই না তদুপরি সরকারী বুলেট চাল বিক্রী করে নিজের দায়িত্বে মিনিকেট চাল কিনে বাচ্চাদের খাওয়াতেন।
সেক্রেটারীর চক্ষুশূল যে হবেন এতো জানা কথা । যেটা জানতেন না তা হল যে ভ্যানে করে সরকারী চাল পাঠিয়ে ভালো চাল আনতেন- সেই ভ্যান চালক, যে দোকান থেকে চাল কিনতেন- সেই দোকানী, মিড’ডে মিল যারা রান্না করতেন-সেইসব মহিলা... সকলেই সেক্রেটারীর কথায় সায় দিয়ে বিনয়বাবুকে চোর প্রমান করে দিলো। অর্থাৎ পায়ের তালু থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সকলেই দুর্নীতির কাছে বিকিয়ে গেছে।
বলা শেষ করে বিনয়বাবু আমার দিকে তাকালেন। বললেন- ‘আমি কিন্তু বিশ্বাস রাখি সত্যের জয় হবেই’। কিছুই বলতে পারলাম না, নীরবে থানার বাইরে বেরিয়ে এলাম। কাকে চোর বলবো- বিনয়বাবুকে? ভ্যান চালককে? রাঁধুনী মহিলাদের? দোকানীকে? স্কুল কমিটির সেক্রেটারীকে? নাকি...নাকি এই প্রশাসনকে... এই সরকারকে...
শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকালাম। অনেক মেঘ জমে আছে আকাশে। বৃষ্টি হবে কি?
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ ।
                

রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা

রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা


রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা
আনোয়ার রশীদ সাগর

সূর্যটা পূর্বদিকে ডুবেই যাবে, বিকেল ছাড়িয়ে গোধুলী ছুঁই ছুঁই করছে। এখন তো আর মাঠের মাঝ বেয়ে দূরে কোথাও  রাস্তাও দেখা যায় না, একদল গরু  ধূলা উড়াতে উড়াতে বাড়িও  ফিরে না।
শুধুই যেন স্মৃতিকথা।
গ্রামের উত্তর মোড়ে সপ্তায় দু’দিন হাট বসে। সে হাটকে ঘিরে ছোট ছোট টোঙ দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছে অনেকেই। প্রায় গ্রামেই এখন হাট বসে, তাই এক গ্রামের লোক অন্যগ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। জাহিদ হাসান ওরফে জাহিদ চারযুগ ধরে পাশের গ্রাম থেকে এই বন্ডবিল গ্রামে চা খেতে আসে। তখন এই এলাকায় একটায় চা’র দোকান ছিল।
মেয়েটি  সবুজ শাড়ী আর লাল ব্লাউজ পোরে চা’র দোকানে, একটা কাসার গ্লাসে করে, চা নিতে এসেছিল। সেই যে একবার দেখেছিল মেয়েটিকে, সে দেখার সাধ আর মেটেনি জাহিদের। চল্লিশটা বছর চা খেতে আসে এই দোকানে অথচ মেয়েটি আর একবারও চা নিতে এল না। কোনদিন এই রাস্তা দিয়েও হেটে গেল না। জাহিদ সেই একই সময় চা খেতে আসে, ঠিক  সন্ধ্যার  একটু আগ দিয়ে।
তখন চা এর দোকানের পাশের বাড়ি থেকে ধুপের গন্ধ আসত। আর এখন টিভি চলার শব্দ শুনা যায়। জাহিদ কোনদিন কাউকে কিছু বলেনি, শুধু মনে মনে ভাবে মেয়েটি আর একদিনও এলো না? -সে কি আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে এসেছিল, নাকি মরে গেছে?
এতটি বছর ঐ বাড়ির ভাঙা টিনের, পুরানো দরজার দিকে, বিকেল হলেই চা খাওয়ার ভান  করে, এসে বসে থাকে। এতদিনে টিনের ভাঙা গেটটা গ্রিলের পাতির তৈরি গেট হয়ে গেছে, বাড়ির প্রাচীরটাও রঙিন হয়ে গেছে।  আশ-পাশের অনেক কিছুই বদলিয়েছে। শুধু বদলায়নি জাহিদের মনটা, দিন দিন লোহায় জং ধরার মত মরিচা বেড়েই চলেছে মনে।
জাহিদ অনেক মোটা মানুষ। খুব সোজা-সাপ্টা কথা বলে। কিন্তু এই মেয়েটির কথা কোনদিন কাউকে বলতে পারল না। এখন বয়স ষাট বছর ধর্ ধর্ করছে, অপেক্ষার পালা শেষ হয় না।
 হঠাৎ  যেন প্রাণের ভিতর ছ্যাৎ করে উঠল। কড়ার তপ্ত তেলে, মাছ ঢেলে দেওয়ার মত শব্দ হলো। ধৈর্যের শেষ বেলায় এসে যেন সাধ পূর্ণ হল। ঠিক সেই মেয়েটিই নীল সালোয়ার কামিজের সাথে লাল ওড়না গলায় জড়িয়ে জাহিদের পাশ ঘেষে দাঁড়াল। অবাক করা কান্ড, মেয়েটির বয়স একটুও বাড়েনি? জাহিদ মনে মনে ভাবে তোমাকে আর একবার দেখার জন্য, অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বৃদ্ধ হয়ে গেলাম অথচ তুমি সে রকমই রয়ে গেছো? এও কি সম্ভব?
এবার মেয়েটির দিকে ঘাড়টা উঁচু করে বেশ খানিক সময় ধরে জাহিদ চেয়ে থাকল। তখন পাশ থেকে এক যুবক তার এক বন্ধুকে  উদ্দেশ্য করে বলল, দ্যাখ্, ‘লালি’ একদম রুপী খালার  ফটোকপি। রুপী খালা, এই ‘লালি’ ছুড়ি  হওয়ার সময় মইরি গিছ্।
মেয়েটি প্রতিবাদ করল, এই তুই আমাক্ ছুড়ি বুলবিনি?
ক্যান্ বুড়ি বুইলবো? -ছেলেটি  প্রশ্নটা করে,  মেয়েটির দিকে বেশ কিশোর-মিশ্রিত কামুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। মেয়েটি বেশ বড় করে, জিহ্বা বের করে ছেলেটিকে দেখাল।
এবার যুবকটি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই লালি আমি তোকে বিয়ে কইরবো। লালি পা দাপাতে দাপাতে ও মুখ ভেঙচাতে ভেঙচাতে বলল, আমি নানিক বুইলি দিবোন্।
বলেই ওড়নাটা গলায় জড়াতে জড়াতে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। ছেলেটি তার বন্ধুর গলা জড়িয়ে ধরে লালির দিকে তাকিয়ে থাকল। লালি বাড়ির গেটের ভিতরে ঢুকার আগ দিয়ে  আবার জিহ্বা বের করে  ‘উঃউঃ’ শব্দ করে রোমান্টিক মাথা দুলিয়ে, হারিয়ে গেল উঠানের দিকে।
আলমডাঙ্গা,চুয়াডাঙ্গা।

ভালবাসার এক মূহুর্ত

ভালবাসার এক মূহুর্ত


ভালবাসার এক মূহুর্ত
খোরশেদ আলম খোকন

সে দিনই প্রথম কথা হয়েছিল মিনার সঙ্গে... আমাকে খুব ভালবাসে। আমাকে না পেলে নাকি ও বাঁচবেনা! কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই... ঘুম এসে গেল চোখে। আমার পাশে ঘুমিয়েছিল দিলুও।
হঠাৎ করে দিলু বলে উঠলো-
এই তাজ! মিনা তোকে সত্যি খুব ভালবাসে।
-তুই পাগল একটা, শুধু’ই কি তাই! মিনা আমাকে কী বলেছে জানিস?
-আবার কি বললে শুনি?
কয়দিন পরই নাকি বাসর সাজাবে ওহ্...
এখন শুধুই সে দিনটির অপেক্ষা!

চিৎকার করে ডেকে উঠল দিলু।
-এ্যা তাজ উঠ! সকাল হয়েছে।
অমানিশার কালো আধারে সেই দিন; সেই রাত, সেই সময়; সেই মূহুর্ত! জীবন থেকেই হারিয়ে গেল! আর কবুল বলা হলোনা!
খবর পেলাম, বাবার পছন্দ করা বরটির সঙ্গে রাতে মিনার বাসর হয়েছে!


অভাব

অভাব


অভাব
মোহাম্মদ জসিম

গাঢ় সুন্দর গায়ের রঙ, আটাশটা চকচকে দাঁত (তিনটা কালচে, একটা নাই), প্রমাণ সাইজ দৈর্ঘ্যে সবল ও স্বাস্থ্যবান- এই হইলাম আমি।
আমারে কিনুন।
বিজ্ঞাপন টানাইয়া দিলাম, শহরের আনাচ কানাচ, দেয়ালে, গাছে, এইহানে ওইহানে। নিয়ম কইরা সকাল সন্ধ্যা বটতলায় দাঁড়াইয়া থাহি, ওইডাই দোকান। নিজেরে বেইচা দিমু।
বিজ্ঞাপনের আছড় ভালমতোই পড়তাছে। লোকজন আইতাছে, দরদাম করতাছে। কিন্তু, সমস্যা হইতাছে গিয়া কেউ পুরা শরীরডারে কিনতে চাইতাছে না। কেউ হাত কিনবো, কেউ পা। কেউ কেউ নিলোম বুকটায় হাত রাইখা ছুঁইয়া টুইয়া দেখতাছে, কেউ কয় বুকে লোম থাকলে ভালা হইতো।
এক বয়রা আইছে, একখান কান কিনবো। অন্য কানডারে কি ধুইন্যাক্ষেতে হালাইয়া রাখুম নাকি!  মর জ্বালা, কান বেচলাম না।
একজন বুইড়া আইছে চোক্ষু নিবো, তাও একখান।
কাইল্যা কুচকুইচ্যা এক মাইয়া আইলো, হ্যায় কিনবো লিঙ্গডা। বেলাজ, বেশরম  যা-ই কন, তারে আমার সাহসী মনে হইলো, ভাল্লাগলো। কিন্তু কথা হইতেছে, পুরুষ মাইনষের লিঙ্গ না থাকলে বাকি শরীরডার দাম ঠিকঠাক পাওন যাইবো না।
অহন ভাবতাছি, দুনিয়ার মাইনষের অভাবের শ্যাষ নাই। কিছু না কিছু একটার কমতি হগ্গলেরই আছে। অথচ মনে হইতাছে দিনে দিনে খয়রাতি হইতাছে মানুষগুলান। আস্তা একটা বডি কিনবার ক্ষ্যামতা কারো নাই।
বরিশাল


কে বড়?

কে বড়?


কে বড়?
অনিকেত রায়

দৃশ্য ১:
বিস্তৃত ন্যাড়া মাঠ, মাঝ বরাবর দু’টি আলাদা আলাদা মঞ্চ। একটিতেগেরুয়াধারী, মু-িতমস্তক গুটি কতক ব্রাক্ষ্মণ, অন্যটিতে চাপদাড়ি, মাথায়টুপিওয়ালা সম সংখ্যক মৌলবী। দু’দলই নিজ নিজ ভাবে স্ব স্ব আরাধ্যের বাস্তবিক প্রতিষ্ঠায় তর্জন গর্জন করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুই মঞ্চের সম্মুখেই সমপরিমাণভিড়, দু’দিকেরভিড়েই কোন অন্য ধর্মের মাছির অনুপ্রবেশ ঘটে নি।
শেষ এক ঘণ্টা উভয় ধ্বজাধারীরাই শ্রোতাদের সামনে নিজেদের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সপক্ষে একাধিক প্রমাণ দর্শেছেন।

হঠাৎই ভিড়ের সামনের সারি থেকে এক তরুণ নিরাপত্তা বলয় ভেঙ্গে উভয় মঞ্চের তফাৎ খানেক দূরত্বে এসে বলল- ‘অত শত বুঝি না। আল্লাহ ও ঈশ্বরের মধ্যে কে বড়?  তাই বলুন।’  বাঁ দিকের মঞ্চধারীরা সোৎসাহে বললেন, ‘আল্লাহ বড়’ তো ডানদিকেররা বললেন, ‘না, না, ঈশ্বর সবচেয়ে বড়’। শুরু হলো দারুণ চেঁচামেচি। কোলাহল আরো বাড়ল, হাতাহাতি, মারপিটও হলো বিস্তর। সৃষ্টিকর্তার মহত্ত্ব সংক্রান্ত এই বিতর্ক চলল বহুক্ষণ।

দৃশ্য ২:
হঠাৎ নির্মেঘ আকাশে বজ্রপাত হল বারকয়েক। তারপর এক অদৃশ্য স্বর বলে উঠল- ‘অমৃত তোদের ঠাকুর্দাদের এক পাড়াতুতো ভাই ছিল, নাম করিম। রফিক, তোদেরও নানাদের এক মুখে বলা ভাই ছিল, দুলাল। যে বছর খরা হতো, দু’জনেই আকাশে তাকিয়ে সূর্যের তেজ নয় শুধু মেঘ খুঁজে বেড়াত।’