বৃষ্টি ভেজা পদ্য

বৃষ্টি ভেজা পদ্য




আমি বৃষ্টি ছুঁই
হাফিজ রহমান

তুমি বৃষ্টিকে ভালবাসতে,
যখনই বৃষ্টি আসুক, তুমি ছুটে গিয়ে বৃষ্টি ছুঁতে!
একদিন বৃষ্টি তাই বুঝে গেল,
তারপর তুমি যেখানেই যাও, বৃষ্টি পিছুপিছু যেতো!

এক ঘোর বৃষ্টিতে তুমি আমাকে ছুঁতে চেয়েছিলে,
তুমি জানতে তা সম্ভব না, তবু কি অনন্ত প্রয়াস!
তারপর যখন বুঝলে, এ জীবনে তুমি আমাকে ছুঁতে পারবেনা,
সেকি কান্না তোমার, বৃষ্টির মত অঝোর কান্নায় আমাকে ভেজালে।
আমি আজও তাই বৃষ্টি ছুঁতে যাই!
আমি তোমাকে ছুঁই!


তুমি এবং ওরা
সৈয়দ শরীফ

আজকে আকাশ খুব কেঁদেছে, জানো?
হয়তো শহর তুমিহীনা- তাই;
মেঘের ভাঁজে আবছা অভিমানও
ভাসছে- কোথায় তোমায় খুঁজে পাই !

তোমার খোঁজে বারান্দার ওপাশে
ফড়িং এসে অপেক্ষাতে রয়,
দৃশ্য তোমার অদৃশ্য আকাশে
প্রজাপতি ফড়িংকে তা কয়।

‘কোথায় তবে?’- প্রশ্ন করে পাখি
উত্তরে সব বললো ফুলের টব-
নেই তুমি আজ; জানি এ নয় ফাঁকি
নিলেন স্বয়ং ¯স্রষ্টা, মানে ‘রব’।

হুম জানি তা, নেই তো তোমার দোষ-ও
মানছে না মন; আসবো তোমার কাছে?
যাত্রাপথে একটু কোথাও বসো
আসবো দেখো তোমার মনের আঁচে।



বৃষ্টির দিনে
ইসরাফিল আকন্দ রুদ্র

মুষলধারায় বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ
পাড়ি দিয়ে এসেছিলাম পড়ার অজুহাতে!
কেউ জানতো না, এমন দুর্যোগে কেন আমার আগমন
তোমার কথা ভাবি আর বৃষ্টি বিলাস করি
বোরিং ইংরেজি দ্বিতীয় ক্লাসটাতেও।

টিফিন টাইমে বন্ধু নয় যেন ভাই সম্পর্কের মানুষের সাথে ভেজা
তোমার সাথে ভেজার ক্ষমতা তো আমার নেই!

ক্লাসে ফিরতি আগমন, আমার কাঁপুনি
সবাই বলাবলি করছিল আমার জ্বর বাঁধবে,
জ্বরের আক্রমণে ক্রমাগত ভেস্তে যাবো আমি
না আমাকে আক্রমণ করলো না।

তুমি হয়তো আমার সাথে জোড়া বাঁধতে চেয়েছিলে?
বাসায় ফিরে তোমারও এক দফা ভেজা-
ব্যস্- পরদিন শুনলাম জ্বরের আক্রমণ তোমার উপর!

যাচ্ছিলাম তোমার কাছে চার আত্মাকে নিয়ে
যেন সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হচ্ছি-
বল, কত অব্যক্ত প্রেম ছিল ঐ বৃষ্টির দিনগুলোতে!


বৃশ্চিকা বৃষ্টি
ইয়ার ইগনিয়াস

বৃষ্টিকে ডাকিনি সেইদিন।
গন্তব্যের ফিতে জুড়ে সাথী ছিলো মেঘা
মলিন মুখবিবর!
অনুতাপের অনু অনু তাপে চেয়েছে ছুঁতে আমারে
কান্নার কলায় চেয়েছে ভাসাতে প্রেমজ প্লাবনে।
পৃথক কাদায় না-জড়ায়ে
কৌশলে বাঁচায়ে নিয়েছি নিজেকে
চাহিদায় চাহিবামাত্র সমর্পিত নই আর ...

সারাটা পথে মেঘার চাপাকান্না
আমিও ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাই
টলোমলো মনোবলে
হাঁটি কাছিমের ভঙ্গিমায়।

পথের পাঁচিলে
কত শোকে জমাট হয়েছে আরক্তিম কংক্রীট 
তা-কি কোনো রিখটারে মাপা যায়?
কিংবা অন্যকোনো স্কেলে?
আমিও তেমন জমে যাই 
প্রত্যাখ্যানের মতো অবহেলায়
হৃদয়ের হিমাঙ্কে জমে যায় বোহেমীয় ভাষা

মেঘার মায়াশ্রু কিংবা
বৃষ্টির কদর্যহীন কদমবুচি
কোনকিছুতেই ফেরে না সম্বিৎ

শুধু সম্মানটুকু ভেজার ভয়ে 
রুদ্ধ করি আঙিনার প্রধান ফটক
তবু উঠান অবধি এসে
টানা চুরাশি মিনিট কান্নাধারা শেষে
বৃশ্চিকা বৃষ্টি
একরকম অভিমান করেই ফিরে গেল।


প্রচ্ছদ : রহস্যময় হাসি

প্রচ্ছদ :  রহস্যময় হাসি




রহস্যময় হাসি
নাদিয়া কানিজ

বাইরে ঝুম ঝুম বৃষ্টি পড়ছে আর বাসে বসে সেই বৃষ্টির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিহার। নিহারের মনে পড়ে এমনই এক বর্ষাস্নাত দিনে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সে বসে পড়েছিল নির্জন নদীর ধারে। নদীর ধারে বসে বৃষ্টি দেখতে নিহারের বরাবরই ভালো লাগে। সেদিনও তাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নদীতে বৃষ্টি পড়া দেখছিল।

হঠাৎ একজন বয়স্ক লোক ছাতা মাথায় করে নিহারের সামনে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নিহারের দিকে। লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল নিহারও। নীরবতা ভেঙে লোকটি ধমকের সুরে নিহারকে বললেন- ‘দেখতে তো ভদ্র ঘরের ছেলে বলে মনে হয়! বৃষ্টির মধ্যে নির্জন জায়গায় একা একা বসে আছ কেন?’

নিহার কিছু বলল না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। কোন উত্তর না পেয়ে লোকটি হেটে চললেন। নিহার চুপ করে বসে রইল।

কিছুক্ষণ পর কী মনে করে নিহার লোকটির পিছু পিছু হাটতে শুরু করল। লোকটি পিছন ফিরে আশ্চর্য হয়ে তাকালেন। নিহার কিছু না বলে শুধু হাসল। এবার দ্রুত হাটতে লাগলেন ভদ্রলোক। নিহারও তার গতি বাড়িয়ে দিল। লোকটি আবারও পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন নিহার আগের মত অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। এবার  দৌড়াতে শুরু করলেন। নিহারও লোকটার পিছু পিছু দৌড়াতে লাগল। লোকটি প্রচ- ভয় পেয়ে পিছন ফিরে দেখলেন নিহার এখনও সেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। ওরা প্রায় লোকালয়ের কাছাকাছি এসে পড়েছিল আর তখনই লোকটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

সম্বিত ফিরে পেয়ে নিহার শুনল বন্ধু ফাহাদ তাকে বলছে- ‘আমরা চলে আসছি এইবার বাস থেকে নামতে হবে।’
নিহার বাস থেকে নামল এবং ফাহাদকে বলল- ‘তুই আমার ব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে যা, আমি কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজব।’
ফাহাদ ব্যাগ নিয়ে বাসায় রওনা হল আর নিহার বৃষ্টির মধ্যে হেটে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেল “এই যে ভাইয়া!”
পেছন ফিরে দেখল একটা দশ- বারো বছরের ছেলে সম্ভবত টোকাই তার দিকে দুইটি কদম ফুল এগিয়ে দিয়েছে।

ফুলগুলো পেয়ে নিহারের মন আনন্দে ভরে উঠল। সে ফুলগুলো নিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকাল আর ভাবল তার সেই রহস্যময় হাসির কথা। কিন্তু এ কী! ছেলেটা গেল কোথায়? নিহার ভাল করে চারদিক তাকাল। কিন্তু সেই ছেলেটাকে কোথাও দেখা গেল না। নিহার খুব আশ্চর্য হল। আবার ভালও লাগল তার ফুলগুলো পেয়ে। তারপর আবার নিহারের সেই রহস্যময় হাসি।



গল্প : অনুতপ্ত

গল্প : অনুতপ্ত




অনুতপ্ত
এমএ ওহাব মণ্ডল

কারণে অকারণে লতিফ সাহেব খালেদা বেগমের গায়ে হাত তোলেন। অশ্লীল ভাষায় বকাবকি করেন। যা মাত্রাতিরিক্ত। খালেদা বেগম স্বামীর এমন অনাকাক্সিক্ষত আর অপ্রত্যাশিত অত্যাচারে অতিষ্ট। তবু কিছু বলেন  না বা করেন না।  কেননা, এটি অধিকাংশ বাঙালি নারীদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। স্বামী সংসারের প্রতি দায়িত্ব বা মমতা অনেক বেশি। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই স্বামীর সব অবিচার হজম করে চলেছেন বেচারি খালেদা বেগম।
প্রায় দশ বছরের দাম্পত্য খালেদা বেগমের। দশ বছরের সংসারে একটি কন্যা সন্তান দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা।। নাম লাবিবা। খালেদা বেগমের বিয়ের পাঁচ বছরের শেষান্তে শ্বশুর ইন্তেকাল করেন। খালেদা বেগমকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে মোখলেছ সাহেব ভীষণ খুশি এবং গর্বিত। এমন ধৈর্যশীলা মেয়ে সমাজে খুব নগন্য। মোখলেছ সাহেব  খালেদা বেগমের শ্বশুর। পুত্রবধূর ওপর ছেলের অমানবিক আচরণের কারণে তিনি খালেদা বেগমকে মাঝেমধ্যে পরিতাপ করে বলতেন- ‘মা তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও।’ পুত্রবধূর দাম্পত্যের কষ্টে তিনি কাঁদতেন।  নিজের বাবা-মাকে হারিয়ে শ্বশুরালয়ে খালেদা বেগম বাবা-মা না থাকার সেই শূন্যতা কোনো দিনও অনুভব করেননি। খালেদা বেগমের বাবা-মা অনেক আগেই পরলোকে চলে গেছেন। তাঁরা মৃত্যুকালে লতিফ সাহেবকে বার বার হাতজোর করে মিনতি করে বলে গেছেন-
‘বাবা, আমার মেয়েকে তুমি দেখে রেখো। বড্ড আদরের মেয়ে। ওকে মারধর যেন করো না। ছোট বেলা থেকে খুব যতœ আর ভালবাসার ভেতর থেকে ও বড় হয়েছে।’ মৃত্যুর পূর্বে এই কথা গুলোই বারবার লতিফ সাহেবকে খালেদা বেগমের বাবা-মা বলে গেছেন। কিন্তু  তাতে কোনো ফলাফল আসে না। ইচ্ছে করলে উনারা তালাকের ব্যবস্থা করে খালেদা বেগমকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা সেই কাজটি করেননি। তাঁরা ভেবেছেন-দ্বিতীয় জায়গায় সুখী হবে সেটারও তো নিশ্চয়তা নেই। এই ভেবে মেয়েকে বারবার সান্তনা দিয়েছেন। আর বলেছেন-কপালে সুখ থাকলে তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। ভাগ্যের প্রতিও বিশ্বাস থাকতে হয়।
‘বাবা আর মেরো না, ছেড়ে দাও মাকে। তোমার পা ধরে বলছি-মা মরে যাবে বাবা।’  কথা গুলো লাবিবা ওর বাবা লতিফ সাহেবকে কাঁদতে কাঁদতে বলছে। কিন্তু সন্তানের এমন আহাজারিতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই নির্মম লতিফ সাহেবের। মার খেতে খেতে একসময় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে খালেদা বেগম। লাবিবা নিথর মাকে জড়িয়ে গগনবিদারী কাঁন্নায় ডুকরাতে থাকে।  খালেদা বেগমের অবস্থা বেগতিক হওয়ায় দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা আর ডাক্তারের নিবির পর্যবেক্ষণে সুস্থ্য হয়ে ওঠেন খালেদা বেগম।
প্রায় পনেরো দিন পরের কথা। একমাত্র বোনের ওপর পাশবিক নির্যাতনের কথা শুনে নূও হোসেন খালেদা বেগমের বাড়িতে আসেন। খালেদা বেগমের একমাত্র বড় ভাই নূর হোসেন। নূর হোসেন লতিফ সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন-
‘তুমি খালেদার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানোর কারণ কী? বিয়ের পর থেকে তুমি খালেদার ওপর অবিচার করে আসছো।  শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদেরও তুমি পছন্দ করো না। তোমার বাড়িতে কেউ এলে বাড়তি অশান্তি করো। যে কারণে তোমার বাড়িতে শ্বশুর বাড়ির  কেউ আসেও না। আজ আর স্থির থাকতে পারলাম না। আমাকে আসতে বাধ্য হতে হলো। কি পেয়েছো  তুমি?


লতিফ সাহেব কোনো কথা বলেন না। মাথা নিচু করে আছেন। নূর হোসেন আবার বললেন-
‘কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন? কোনো মানুষ যদি নিজের ইচ্ছেয় ভালো না হয় তাহলে সারা জীবন তাকে মেরেও ভালো করা যায় না। যদি মানুষকে মেরে ভালো করা যেতো তাহলে তোমাকে অনেক দিন আগেই পিটে গায়ের চামড়া তুলে দিতাম। তোমার লজ্জা করে না সন্তানের সামনে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে? স্ত্রীকে মেরে কী খুব মহৎ পুরুষ হওয়া যায়? তোমারও তো একটা কন্যা সন্তান আছে। লাবিবাকে যদি ওর বর ভবিষ্যতে এমন নির্যাতন করে মেনে নিতে পারবে?  যদি তোমার বোনকে কেউ এমন পাশবিক নির্যাতন করতো তাহলে কী তুমি তা মেনে নিতে পারতে? তোমার সংসারে আমার বোনকে না রাখলে কী হবে? আসলে তোমাকে ভালবাসাটা বেশি হয়ে গেছে। এই বয়সে তোমার এমন আচরণ দেখে আমি নিজেই রীতিমতো লজ্জ্বা পাচ্ছি। মানুষ এক সময় মন্দ থাকে। সন্তান হলে বা বয়স বাড়লে আচরণের পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু তোমার ভেতর কোনো পরিবর্তন নেই। তোমার গায়ে কখনো হাত তুলিনি। তুলতেও চাই না। তুমি খালেদাকে ডিভোর্স দেও। আজই। এক্ষুণি।
খালেদা বেগম ভাইয়ের এমন কথা শুনে ভাইকে বলেন-
‘ভাইজান, তুমি ডিভোর্সের কথা বলো না। লাবিবার কী হবে। ও তো পরিচর্যাহীন হয়ে পড়বে। আমার নিজ হাতে সাজানো সংসার। বড্ড মায়া জমে আছে এই সংসারের প্রতি। আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারি না।
খালেদার মুখের কথা শুনে নূর হোসেন লতিফ সাহেবকে বলেন-
‘শুনলে, শুনলে তো খালেদার মুখের কথা। সংসার, সন্তানের প্রতি একজন মায়ের দায়িত্ব কত বড় দেখলে। এই দায়িত্ব কেবলই খালেদার নয় তোমারও থাকা উচিত। অথচ, তোমার সে বিষয়ে কোনো জ্ঞানই নেই। যে নারী তোমার পাশবিক নির্যাতনে আহত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও তোমার সংসারকেই জীবনের নিরাপদ আশ্রয় মনে করছে। কী করে তুমি সেই নারীকে আঘাত করো? বিয়ের পর যে নারী তাঁর স্বামীর ঘরে নিরাপদ নয় সে নারী পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো জায়গায় নিরাপদ হতে পারেন না। খালেদা ঠিকই একজন আদর্শময়ী স্ত্রী এবং মমতাময়ী মা হতে পেরেছে। কিন্তু তুমি আজো আদর্শবান বাবা কিংবা যোগ্য স্বামী হয়ে ওঠতে পারোনি। এ তোমার জীবনের চরম ব্যর্থতা। মাথা নিচু করে কথা গুলো শুনে যান  লতিফ সাহেব। কোনো  প্রতিউত্তরের সাহস হয়নি আজ।
দু দিন পরের কথা। রাত এগারোটা বাজে। লাবিবা ওর ঘরে ঘুমাচ্ছে। বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। লতিফ সাহেব খালেদা বেগমকে পাশে ডেকে বলে-
‘খালেদা, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। নূরু ভাই এর কথা গুলো আমি হজম করতে পারছি না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
খালেদা বেগম স্বামীর মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে শিহরিত কন্ঠে বলে ওঠেন-
‘এ তুমি কী বলছো লতিফ। ক্ষমা চাইতে হবে না। তুমি যদি তোমার ভুল গুলো শুধরে নিতে পারো তাহলেই আমি ধন্য হবো।
: আমি খুব গভীর ভাবে নূরু ভাইয়ের কথা গুলো চিন্তা করলাম। সত্যিই তো, কোনো নারী যদি স্বামীর ঘরে নিরাপদ না হয় তাহলে দ্বিতীয় কোথায় নিরাপদ হবার কথা নয়। দু টো ভাত আর কাপড় দিতে পারলেই স্বামী হওয়া যায় না। অকারণে তোমাকে অনেক নির্যাতন করেছি। কিন্তু তুমি কখনোই আমাকে, আমার সন্তানকে মোট কথা আমার সংসার ছেড়ে যেতে চাওনি। এই গুনাবলী কোনো সাধারণ মেয়ের হতে পারে না। তুমি সত্যিই একজন মহিয়সী নারী। প্রতিবেশী আর দশজন নারীর মতো তোমার জীবনাচার নয় সেটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করলাম। আমি আর কখনো তোমার প্রতি নির্যাতন করবো না খালেদা। আমাকে অন্তত এবার একজন যোগ্য স্বামী হয়ে ওঠতে হবে। অতঃপর আদর্শবান বাবা।
স্বামীর  মুখে এমন অপ্রত্যাশিত কথা গুলো  শুনে খালেদা বেগমের চোখ জলে অশ্রুসিক্ত হয়। লতিফ সাহেবের ভেতর জাগ্রত হয় অনুশোচনা। খালেদা বেগম ফিরে পান তাঁর জীবনের কাক্সিক্ষত দাম্পত্য। হঠাৎ বজ্রধ্বনিতে  আকাশ গর্জন দিয়ে ওঠে। খালেদা বেগম চমকে ওঠে লতিফ সাহেবের বুকে মাথা লুকায়।  পরম মমতায় লতিফ সাহেব খালেদা বেগমকে জড়িয়ে ধরেন। দীর্ঘ  দশ বছর পর এমন গভীর সান্নিধ্য খুঁজে পেয়ে ধন্য হোন খালেদা বেগম।


সেলিনা হোসেন : বাংলাসাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র

সেলিনা হোসেন : বাংলাসাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র




সেলিনা হোসেন
বাংলাসাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র
রাহাত রাব্বানী

বাংলাসাহিত্যে যাঁরা অভিভাবকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন সেলিনা হোসেন তাঁদের একজন। সমৃদ্ধ লেখনী দিয়ে ঋণী করে রেখেছেন বাংলাসাহিত্যকে। বলা যায়, তাঁর সাহিত্যকর্ম এদেশের, সমাজের আয়না। তিনি তাঁর সময়কে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর সৃষ্টিতে। ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষী হয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। যার কারণে ইতিহাস থেকে তিনি সরে দাঁড়াননি। বরং এই ইতিহাস তাঁর লেখক সত্তাকে নিপুণভাবে আলোড়িত করে সবসময়।

কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ ঘটলেও মধ্য ষাটের দশকে গল্প চর্চা শুরু করেন সেলিনা হোসেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ এবং ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’।১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সাহিত্যসমাজে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়।

ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার, সাহসের, শক্তির সবচেয়ে বড় অংশ। আর সেলিনা হোসেনের লেখনী এই বিষয়গুলোরই প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ বাংলার ইতিহাস আর সেলিনা হোসেনের সাহিত্যকর্ম একই মঞ্চে। ‘৪৭-এ দেশভাগের পর পাকিস্তানি হায়েনা শিবির আমাদের ভাষার ওপর থাবা বসায়। কিন্তু প্রতিবাদী বাঙালি তা মেনে নেয়নি। মাতৃভাষার সম্ভ্রম রক্ষার্থে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। এই আন্দোলনই আমাদের স্বাধীনতার সূচনাপর্ব। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সেই বিষয়টিই রূপকের আড়ালে তুলে ধরেছেন ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে। ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন তিনি স্বৈরশাসনের বিপক্ষের একজন।

একাত্তরে একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অভিযান, অন্যদিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বন্দী নারীদের অকথ্য দৈহিক নির্যাতন ভোগের পাশাপাশি তাদের ফুঁসে ওঠা। বর্বর পাকিস্তানিদের মেরে তাদের অকুতোভয় আত্মদানের মর্মচেরা কাহিনী সেলিনা হোসেনের ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ উপন্যাসকে দিয়েছে ধ্রুপদী সাহিত্যকর্মের মর্যাদা।

সেলিনা হোসেনের লেখনীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ উঠে এসেছে,উঠে এসেছে মানবিকতা। দেশে ও বিদেশের বেশ কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রচনা পাঠ্য।

মা-মেয়ের গভীর সম্পর্কের সফল উদাহরণ তাঁর ‘লারা’ উপন্যাস। উল্লেখ্য যে, ‘লারা’ উপন্যাসটি তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতির দিয়ে সাজানো। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার অদূরে পোস্তগোলায় প্রশিক্ষণ বিমান দূর্ঘটনায় নিহত দুইজনের মধ্যে একজন ছিলো তাঁর প্রিয় কন্যা ২৬ বছর বয়সি বৈমানিক ফারিয়া লারা।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্ম নিয়েও সেলিনা হোসেনের সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে অনুধাবন করা যায়, তাঁর অনুপ্রেরণার এক বড় অংশজুড়ে রবি ঠাকুরের বিচরণ।

গ্রন্থসংখ্যা হিসাবে তিনি শতাধিক গ্রন্থের সার্থক রচয়িতা। সাহিত্য সম্মাননা ও পুরস্কারের সংখ্যাও অনেক। ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০০৯ সালে একুশে পদক এবং  স্বাধীনতা পুরস্কার ২০১৮’র মাধ্যমে দেশসেরা তিনটি পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া পেয়েছেন ড. এনামুল হক স্বর্ণপদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার। শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে লাভ করেন আনন সাহিত্য পুরস্কার। ২০১০ সালে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেন। শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে দু’বার অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়াও দেশে ও বিদেশে বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন তিনি।

১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক নিযুক্ত হয়ে ২০০৪ সালে চাকরি জীবন থেকে অবসর নেন। কর্মময় এসময় তিনি বাংলা একাডেমি অভিধান, বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ‘ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন’র প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে জন্মগ্রহণ করেন । বাংলাসাহিত্য আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র সেলিনা হোসেন। নবীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যের সাথে যাঁর নিবিড় অংশগ্রহণ এবং নবীনদের প্রেরণার অংশ। সদা হাসিখুশি প্রিয় এই কথাসাহিত্যিকের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলার আকাশে সেলিনা হোসেনের মতোন অভিভাবক আরো অনেক অনেক বছর খুব বেশি প্রয়োজন।

প্রিয় কথাশিল্পী, আপনি দীর্ঘজীবি হোন। আপনার আলোয় আলোকিত থাকুক আমাদের সোনার বাংলা।


ফররুখ আহমদ : স্বদেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী কবি

ফররুখ আহমদ : স্বদেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী কবি




ফররুখ আহমদ
স্বদেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী কবি
মীম মিজান

ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যের এক শক্তিমান ও অনন্য দিকপাল কবি ব্যক্তিত্ব। মহাকবি, শিশু সাহিত্যিক, মুসলিম জাগরণের কবি, মানবতাবাদী কবি প্রমূখ পদবী দ্বারা সাহিত্যরস বোদ্ধা ও সমালোচকগণ কর্তৃক তিনি সমাদিত। মা, মাতৃভাষা ও দেশমাতৃকার প্রতি এই বিপ্লবী কবির ছিল অগাধ প্রেম ও প্রচ্ছন্ন আকর্ষণ। যুগসষ্টা এ কবি যশোর জেলার মাগুরা থানার মাঝআইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর সৈয়দ হাতেম আলী। তাঁর মার নাম রওশন আখতার। বাবা মার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি । তাঁরা তিন ভাই, দুই বোন।
মাঝআইল গ্রামের পাঠশালায় ফররুখ কিছুদিন পড়েছিলেন। ফারসি-জানা এক মহিলা বাড়িতে এসে তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তারপর কলকাতায় গিয়ে মডেল এম.ই.স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর কিছুদিন পড়েন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। এর পর ফররুখ ভর্তি হন খুলনা জেলা স্কুলে। এই স্কুলে তাঁর শিক্ষক ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল ও কবি আবুল হাশেম। এই স্কুলের ম্যাগাজিনে ফরররুখ আহমদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। কলকাতায় এসে রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে রিপন কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আই.এ. পাশ করার পর ঐ বছরই কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স নিয়ে বি.এ. তে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। তাঁর অধ্যাপকমন্ডলীর মধ্যে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ। স্কুল-কলেজে তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিকার সত্যজিৎ রায়, অভিনেতা ফতেহ লোহানী, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তবে যেকোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত বি.এ. পরীক্ষা দেননি তিনি।
কলকাতায় থাকাকালীন ফররুখ আহমদ অনেকগুলি চাকরি করেছেন। কিন্তু সবগুলিই ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে, ১৯৪৫ সালে মাসিক ‘মোহাম্মদী’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি।
ঢাকা বেতারেই ফররুখ আহমদ দীর্ঘদিন চাকরি করেন। ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বেতারে প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট বা নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করতে থাকেন এবং আমৃত্যু ঢাকা বেতারে ষ্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি)-এর সঙ্গে ফররুখের বিবাহ হয়। তৈয়বা খাতুনের বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ নূরুল হুদা। বিবাহের উদ্যোক্তা ছিলেন ফররুখ ও তৈয়বা খাতুনের নানা মোহাম্মদ হুরমাতুল্লাহ। তাঁর নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়। ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে ১১ জন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), হাতেমতায়ী (১৯৬৬), হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১) ইত্যাদি। পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ইত্যাদি তাঁর শিশুতোষ রচনা।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানে জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬১), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮০) লাভ করেন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভাধর কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলা ঢাকায় ইস্কাটন গার্ডেনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
২৩শে জুন ১৭৫৭ সালের পলাশীর আর্মকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ঘষেটি বেগম ও মীর জাফরদের ষড়যন্ত্রের ফলে অস্তমিত হওয়ার ফলে বিপ্লবী কবি ফররুখ দেখেছেন ইংরেজ বেনিয়াদের শাসন ও শোষণের অবস্থা। এ দেশবাসীর জন্য স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। আরো উপলব্ধি করেছেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য সুযোগ্য নেতা প্রয়োজন। যে নেতা কোটি কোটি মজলুম মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবেন তিনিই হলেন কবির কল্পনায় সৃষ্ট আদর্শ মহানায়ক পাঞ্জেরী। এক রূপক কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করলেন :
‘জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি
জাগো অগনন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরী, কত দেরী’
(পাঞ্জেরী: সাত সাগরের মাঝি।)
যদিও তিনি কবি তবে সত্যেন্দ্র নাথ রায়ের মতো তাঁর কাব্যে ছান্দসিক ব্যঞ্জনা না থাকলেও তাঁর কাব্যের পরতে পরতে বৈপ্লবিক আহ্বান লক্ষিত। তাই তো ছন্দে তিনি যাদুকর ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী।
১৩৫০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর চাপানো একটি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। এ নিয়ে অনেক কবি কবিতা লিখেছেন। বিপ্লবী কবি ফররুখ আহমদের লেখা ‘লাশ’ এ ফুটে উঠেছে তার বাস্তব অবস্থা। কবি লিখেছেন :
‘মানুষের হাড় দিয়ে তারা আজ গড়ে খেলাঘর
সাক্ষী তার পড়ে আছে মুখ গুঁজে ধরনীর পর।’
[লাশ: সাত সাগরের মাঝি]
অধ্যাপক ড: মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছেন : ‘লাশ’ তেরশ পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা একটি অসাধারণ কবিতা।
সূতরাং ফররুখ আহমদ একজন প্রকৃতই বিপ্লবী কবি।
ব্রিটিশ-বেনিয়ারা এদেশ থেকে তাদের লোলুপতা ও অপশাসন তুলে লেজ গুটিয়ে চলে যাওয়ার পর ভারত বিভক্তি হলে পাক শাসকেরা রাষ্ট্রীয় ভাষা নিয়ে জোচ্চুরি করতে আরম্ভ করে। মায়ের কাছ থেকে শেখা অ, আ, ক, খ’র ভালোবাসার ১৯৫২’র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ফররুখ আহমদকে যথার্থই উদ্দীপ্ত করেছিল। ভাষা বিষয়ে তাঁর সচেতনতা অনেক আগেই দেখা গিয়েছিল। ‘উর্দু বনাম বাংলা’ নামক ব্যঙ্গকবিতায় (মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৫২) ১৯৪৫ সালেই তিনি তীব্র বিদ্রুপ হেনে লিখেছিলেন,
‘দুই শো পঁচিশ মুদ্রা যে অবধি হয়েছে বেতন/বাংলাকে তালাক দিয়া উর্দুকেই করিয়াছি নিকা'।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশিত তাঁর ‘পকিস্তান’ : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্যে (‘সওগাত’, আশ্বিন ১৩৫৪) তিনি দ্বিধাহীন জানিয়েছিলেন :
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছে। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তাই হয়, তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।’
তিনি ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। এভাবে যখন চলে আসে উত্তাল কাল ১৯৭১ সাল। তখন মাতৃভূমি বাংলাদেশে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। হাতে বন্দুক নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ না করলেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর সম-সাময়িক অনেক লেখক ও বুদ্ধিজীবীকে দেখা গেছে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে ও দেশ স্বাধীনের পরে নিজেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে প্রচার করতে। অথচ দেশপ্রেমিক এ বিপ্লবী কবির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সর্বাতœক সমর্থন থাকার পরেও এখন তাঁকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।
মহান কবি ফররুখ আহমদ অমর হয়ে থাকবেন যতদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে। আমরা কবি ফররুখ আহমদকে একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে সম্মান জানাতে পার। মানবতাবাদী কবির অসংখ্য লেখা এখনো যা অপ্রকাশিত রয়েছে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হোক এ কামনা করি।
কবি ফররুখ আহমদ সেইসব ভাগ্যবান কবিদের মধ্যে অন্যতম, যারা কালের মধ্যে বিচরণ করেও হয়েছিলেন কালোত্তীর্ণ। তিনি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং অকুণ্ঠ মূল্যায়ন পেয়েছেন, সংবর্ধিত হয়েছেন, ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং উন্মোচিত হয়েছেন তাঁর অগ্রজ, সমসাময়িক, সময়-উত্তর-এমনকি আজকের শতাব্দীর এই প্রজন্মের লেখক, কবি, সমালোচক ও বিপুল-বিশাল পাঠকদের দ্বারা। ফররুখ আহমদ একটি কাল, এমনকি একটি শতাব্দীতেও যে নিঃশেষ হবার মত কবি নন-তাঁর এই দুর্বার চলমানতাই সেই স্বাক্ষর বহন করে। বিপ্লবী এ কবির মাতৃভাষা প্রেম এবং দেশ মাতৃকার প্রতি একনিষ্ঠ অনুরাগ তাঁর পাঠকমহল সহ সকলকেই আলোরিত করেছিল, করছে এবং করবে। তাঁর কাব্যপাঠে ঈপ্সা হয় ‘পাঞ্জেরী’র মতো একজন বিপ্লবী হতে। এ মহান কবির আজ শততম জন্মজয়ন্তী। এ দিনে তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। আসুন তাঁর শততম জন্মজয়ন্তীতে আমরা প্রত্যয় গ্রহণ করি একজন বিপ্লবী হওয়ার। একজন একনিষ্ঠ মাতৃভাষা প্রেমিক হওয়ার ও একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক হওয়ার।