পদাবলি

পদাবলি

 



কাঠগোলাপের ঘ্রাণ

বনশ্রী বড়ুয়া


জল হয়ে যায় পাথর

নুড়ি ভেঙে চুর 

এখানে পানকৌড়ি দেয় ডুব

কোথাও কেউ নেই আজ সবটাই চুপ।


জল নামে ধীরে

বৃষ্টি কাঁদছে দূরে 

ওরা জানে কান্নার নেই রঙ

আজ একলা থাকার শহর।


একা

পাঁজরের ভাঁজে চুল

খানিক অগোছালো

আমি আজ জলে দিয়েছি ডুব।


এখানে বর্ষা এসেছে ঘরে

কাঁপছে দূরে কেউ

তার কাঁপছে ঠোঁটের কোণ।




তুমি ভালো থেকো

রেজাউল করিম রোমেল


তোমাকে নিয়েই লিখছি, হ্যাঁ তোমাকে নিয়েই।

অনেক দিন হলো তুমি চলে গ্যাছ,

সেকথা ভাবতে ভাবতে এখন আর ভাবি না।

তোমাকে না পাওয়ার ব্যর্থতা এখন আমাকে আর কষ্ট দেয় না।

আমার মনের মণিকোঠায়, হৃদয়ের অতল 

গভীর থেকে গভীরতম স্থানে যে জায়গা জুড়ে তুমি আছ;

সাধ্য কার সেখান থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নেবে!

তুমি কি পারবে সেখান থেকে ছিনিয়ে নিতে তোমাকে?


কে বলে তুমি নেই! তুমি আছ-

আমার আকাশে বাতাসে, সাগর নদী মহাসাগর

আমার পৃথিবী মহাবিশ্বে, আমার প্রতিটি শিরায় শিরায়,

রক্তের প্রতিটি কণায় কণায়।


তোমাকে হারিয়ে আমি কষ্টে আছি আমি বেদনাহত,

একথা ভেবে যদি তুমি কষ্ট পাও!

তারপর-ও আমি বোলবো,-

তুমি ভালো থেকো প্রিয়তমাষু, তুমি ভালো থেকো।




নগর জীবন

গৌর চন্দ্র


নগরমুখী জীবনে রোঁদ এসে লুফে নেয় আমাদের নগর জীবন,

জনজীবনে গরম গরম বাতাস গায়ে গায়ে ছড়িয়ে পড়ে!

রাস্তায় হর্ণ বাজিয়ে তান্ডব চালায় লুকাল বাস

জীবিকার জন্য ছুটে চলে কতোনা মানুষ,

কেউ রিস্কা নিয়ে, কেউ অটো নিয়ে, কেউ আবার টিফিন বাটি হাতে নিয়ে চলে ফেক্টরীতে।

এই অসম জীবনে সকালের কড়া রোঁদ যেন এক অশান্তির আগুনের গোলা!

যার, যার, কর্মক্ষেত্রে এসে,

এখানে গ্রামীণ কৃষককে সবাই মিস করে

গ্রামের,

আলা-ভোলা জীবনে কতো না শান্তি, কতো না সুখ,

শহরের নিয়মে ঘেরা জীবন দেখে তাই তাদের  লজ্জা লাগে,

এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে, এভাবে নয়, ওভাবে নয়, কতো বাহানা শহরমুখি মানুষের  মনে!

এখানে গ্রামের মানুষগুলো শহরমুখী মানুষের জীবনের ধারণা নিয়ে একটু হলেও দুঃখ পায়, মনের ভিতর মোচর মেরে উঠে চাপানো কষ্টের কঠিন সময়ে,

গলার জল, শুকিয়ে আসে শহরের পঁচা ধূলো বালির গন্ধ শুকে-শুকে।


অবশ্য, মাঝে -মাঝে রাস্তায় পেন্ট পড়া, রমনীরা পায়চারি করে মনের ঘরেতে বিনোদন দিয়ে যায়,

ওসব সুময়ে ভালো লাগে-

কষ্ট হলে আবার গুলিয়ে যায়

আর এই শহরের খোলা মেলা সুন্দরীরা এখাকার ইট পাথরের বুকেতে ফুটানো তাজা তাজা ঘাস ফুল.....



ধ্রুপদী জীবন

আমিনুল ইসলাম 


জীবনের চপল মায়ায় ডুবে আছি।

দূর হতে ভেসে আসে মিথ্যা মায়ার 

আশ্বস্ত বেঁচে থাকার প্রাণ-বায়ু।


কিছু জীবন চৈত্রের খরার ন্যায় 

পাতাহীন বৃক্ষের মতো।

দ্রৌপদী মায়ায় জীবন হয় 

শুক্র তারার রঙিন প্রতিচ্ছবি। 


জীবন নামের বৃক্ষ টাও একদিন 

শুষ্ক রুগ্ন হয়ে পড়ে সদল স্বাদ 

পান করে চিবিয়ে অর্জুন বৃক্ষের মতো।

শেষ অব্দি পরে রয় নিথর বৃক্ষের দেহ খানা।



নগ্নবসন্ত

বনশ্রী বড়ুয়া


ঠোঁটের অনুচ্চারিত শব্দাবলী,

বিদীর্ণ করেছে হৃদয়

সেদিনের ছুঁড়ে দেয়া মাদল,

আজ ডুবেছে কুয়াশায়।


আঁখি জুড়ে নগ্নবসন্ত,

বেঁচে থাকা মৃত্যুসম যন্ত্রনা

মূহুর্তে ভাবনায় পাচ্ছি সুখ,

ফিরছো স্বপ্নিল কামনায়।



মোহনীয় মিহিন অসুখে 

 মমতাজ রোজ কলি 

          

ভস্ম হতে হতে আগুন হয়ে গেছি 

কয়লার বুকে শ্বাস রেখে.... 

ঘোর লাগা দহন-এ 

উত্তাপের চেয়ে উষ্ণতা বেশি। 

তাই জ্বলে ওঠার চেয়ে পুড়ে যাই আগে

মোহনীয় মিহিন অসুখে.... 

পুষ্প ফুটিয়ে তোলে ফাগুন 

আমি তা দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো 

জিইয়ে রাখি বুকে...





আহত পতাকার কান্না

আহত পতাকার কান্না

 




আহত পতাকার কান্না 

রানা মাসুদ


কান্নার শব্দে থেমে গেলাম। বোবা কান্নার মতো। শব্দ যেন ভিতর থেকে বের হতেই চাচ্ছে না। ঠিক যেন মোমবাতিতে আগুন জ্বালালে কোন ধোঁয়া আসে না। শুধু নিভু নিভু করে আগুন জ্বলতেই থাকে। মোম গলে যেমন মোমবাতি চুইয়ে চুইয়ে পরে ঠিক তেমনি চোখের অশ্রু নামক রক্তগুলো গাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পরছে। বারবার গামছা দিয়ে চোখের রক্তগুলো মুছলেও আবার এক নিমেষেই পূরণ হয়ে যাচ্ছে।

পুরনো একটি ব্যাগ। ধুলাবালি, মাটি আর এটাসেটা লেগে অন্যরকম একটা রুপ নিয়েছে ব্যাগটি। একটা বোতল। পানির বোতলই হবে। মনে হচ্ছিল অনেকদিন ধরে বোতলটি ব্যবহার করলেও কোনরকম ঘষামাজা বা ধোয়া হয়নি। আর্সেনিকের কারনে হয়তো বোতলটা হলুদে ভরে গেছে। তবুও যেন বোতলটিই নিত্য সঙ্গী।

সাদা একটি চাদর। আসলে চাদরকে চাদর বলে সম্বোধন করা ঠিক হবে না। কেননা, চাদরের গায়ে লাল রঙের অনেক লেখা, কালো রঙের অনেক শোকাহত স্মৃতিচারণ, সবুজ রঙে দেশের কথায় ভরে গেছে চাদরটি। তাছাড়া, চাদরটি এক নাগাড়ে শরীরে দেওয়ায় ময়লায় অন্য রকম একটি ছবিতে পরিপূর্ণ হয়েছে। তবে লেখাগুলো এখনো ফুটে আছে। লাল রঙের লেখাটি ঠিক রক্তের মতো লাগছে। মনে হচ্ছিল দুই একদিন আগে আঁকা হয়েছে। চাদরে নানান রকমের ইতিহাসের চিহ্ন। ধীরে ধীরে আমার মনে প্রচন্ড আগ্রহ হচ্ছিল প্রকৃত ঘটনাটি জানার। সেজন্য একটি ট্রেন মিস করেও বসেছিলাম।

হাতে কিছু পাথর ছিলো। একটু দূরে বসে থাকার কারণে বুঝতে পারছিলাম না। একটি সিগারেট জ্বালিয়ে পাশে গিয়ে দাড়ালাম। কখনও লাল রঙের পাথরের টুকরো দিয়ে লিখেই আবার পরক্ষণেই মুছে ফেলছে। আবার কখনও কালো রঙের পাথরের টুকরো দিয়ে লিখেই আবার পরক্ষণেই মুছে ফেলছে। আমার কাছে সবকিছুই গন্ডগোল লাগছিলো। তবে, মুছে ফেলা লেখাগুলো আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে। বাম হাতে থাকা কাপড়ের টুকরোটি মুছে মুছে অনেক ক্ষয় করে ফেলেছে। মনে হচ্ছিল কাজটি অনেকক্ষণ ধরেই একনাগাড়ে করছিলো।


হাতে মুকুট বিড়ি। ব্যাগের ভেতর কি যেন খুঁজছিল? ব্যাগের মধ্যে যা কিছু ছিলো তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছিলো না। পকেটের ভিতর হাত দিয়েও যখন পেলেন না তখন আর কি করা? বিড়িটা আবার রেখে দিলেন।। কিন্তু ততক্ষণে বেশ নেশা হয়ে গেছে। কেমন যেন একটা অসস্তি অনুভব করছিল। প্রথমে নেশাগ্রস্ত মনে হচ্ছিল। কিন্তু না। সেরকম কিছু না। একটু পরেই আবার আগের মতো...।

সিগারেটের আগুন দেখেই মুচকি হেসে উঠলো। যেন জীবন জীবদ্দশায় কিছুটা দম ফিরে পেয়েছে নিশ্বাস

নেওয়ার মতো। ততক্ষণে পকেটে রাখা বিড়িটা বের করেছে। বুঝে উঠতে দেরি হলনা আমার তখন.....। তবে এরকম মলিন হাসি অনেকদিন দেখিনি। হয়তো আবার দেখতে পাবো কিনা সেটাও জানিনা। মনে হয় পৃথিবীতে যারা অল্প কিছু নিয়ে সুখে থাকার চেষ্টা করে শুধুমাত্র তাদের মধ্যে এই হাসিটা পাওয়া যায়। 

বাম হাতে বিড়ি, ডান হাত দিয়ে সিগারেটের আগুনটা নিয়ে ধরাবে এমন সময় কেউ একজন এসে সিগারেটের উপর পা দিয়ে সামনের দিকে হাটতে থাকে। রেলস্টেশনতো অনেক মানুষের ভিড়।

আকাশে মেঘ জমালে যেমন পৃথিবীটা স্তব্ধ ও অন্ধকার হয়ে যায় ঠিক তেমনি এমন মুচকি হাসি মুখ নিমেষেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। দুয়েক মিনিট শুধু আগুনের দিকে চেয়ে রইলেন। আর জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলেন।

গ্যাস লাইট। চোখের সামনে ধরতেই আবার পুনরায় সেই হাসি। খুবই ভালো লাগছিলো এরকম হাসি দেখে। সময়টা যদি ফ্রেমে বন্দী করা যেতো তাহলে আরও বেশি আনন্দমুখর হতো। আমার হাত থেকে গ্যাস লাইট নিয়েই বিড়ি ধরালো।

বিড়ি টানা শেষ। এতো তারাতাড়ি বিড়ি টেনে শেষ করতে এই প্রথম দেখলাম। ক্ষুদার্ত হাতির সামনে যেমন হালকা কিছু খাবার খেতে দেওয়া। কয়েকটি ছবি তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু মোবাইল নষ্ট হওয়ার কারণে সব কিছু ডিলিট হয়ে গেছে।

এবার একটু উঠে দাঁড়ালো। খুব সহজেই যে উঠতে পারলো তেমন কিন্তু নয়। লোহার খুঁটি ধরে ধরে উঠতেই যেন মিনিট দুয়েক লেগে গেল। মনে হচ্ছিল অনেকসময় ধরে বসে থাকার কারণে হাত-পা গুলো জ্যামে পরে গেছে।

কাকা ধরবো?

কথাটা শুনে কেমন যেন একটু ইতস্তা বোধ করলো। ডান হাত নাড়িয়ে ইশারায় বললো না না। উঠতে গিয়ে হঠাৎ টোলে পরে যাওয়ার মতো হওয়ায় আমি গিয়ে ধরে ফেলি। তখন অবশ্য কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালেন। আমি আর কিছু বলিনি।

বেশকিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরে আবার বসে পরলেন। এইবার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা কৌতুহল এসে বারবার ডেকে যাচ্ছে। 

কোনরকম সংকোচ না করেই বললাম, কাকা কিছু খাবেন?

কোন উত্তর পেলাম না। ভাবলাম হয়তো শুনতে পায়নি। 

পূনরায় বললাম, কাকা কিছু খাবেন?

এবারও কোন সাড়াশব্দ নেই। মনের মধ্যে একটু রাগ হলো। 

তারপরও শেষবারের মতো বললাম, কাকা কিছু খাবেন?

এইবার বলার আগেই মাথা নাড়িয়ে দিলো। 

আমি আর দেরি না করে হুট করে পাশের দোকান থেকে রুটি, কলা আর কেক পানি নিয়ে হাজির।

কাকা খাচ্ছে। আর আমি বসে শুধু দেখছি। 

কাকার খাওয়ার তালে তালে জিগ্যেস করলাম,‘কাকা কোথায় যাবেন?’

কিন্তু কাকা কিছুই না বলার কারণে বুঝতে পারলাম এমনিতেই কথা বলে না তারপর আবার খাচ্ছে।

হঠাৎ চোখ দুটো কেমন যেন বড় বড় করে তাকালেন। আমিও বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কি যেন বলতে চাচ্ছে? কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। তবে, মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। মাটিতে লুটে পরতেই বুঝতে আর দেরি হলো না কি হয়েছে? পাশে রাখা পানির বোতল তারাতাড়ি খুলে মুখে দেওয়ায় স্বস্তি ফিরলে একগাল হেঁসে বলল,‘বাবা তুমি আমার জীবনটা পূনরায় বাচিয়ে দিলে।’

তালা দেওয়া মুখের কুলুপ যেন এবার খুলে গেল। লটারির পুরুষ্কারের মতো। সুযোগটা হাত ছাড়া করিনি। আস্তে আস্তে ভাব জমাতে শুরুকরলাম। শিকলে বাঁধা মনের গোপন কথাগুলো বের হতে থাকলো।

বাড়ি নিতাইগঞ্জ। বাবার নাম কেষ্ট ঠাকুর। তিনিও নাকি যুদ্ধের আগেই গত হয়েছে। মা ছিলো তবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে ভুগে তিনিও ওপাড়ে চলে গেছেন।

বয়স ৫২ ছুঁই ছুঁই। শরীরটা যে খুব ভালো যাচ্ছে সেটাও নয়। তবে এখনো কারোরই দারস্থ হয়নি। এক ছেলে আর মেয়ে নিয়ে সংসার। গৃহকর্ত্রী বছর দুয়েক হলো নিশ্বাস ছেড়ে দিয়েছে।

ইতিমধ্যে চোখের কোনায় অশ্রুজলের ছড়াছড়ি। টপটপ করে কয়েক ফোটা অশ্রুজল পরে গেলো। ভাবলাম কথাগুলো মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ডান হাত দিয়ে চোখদুটো মুছে ফেললেন। আবেগ আপ্লুত কন্ঠে কি যেন গড়গড় করে বলতে চেয়েও থেমে গেলেন।

-কাকা, কাঁদছেন কেন? প্রিয়জনের কথা মনে পরেছে?

-জি, বাবা। সবসময়ই মনে পরে। তবে যারা জীবিত আছে তাদের কথায় মনে পরে বেশি। আর মনে পরলে বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। হৃৎপিন্ডটা পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। যেটুকু বাকী থাকে সেটুকুও ধীরে ধীরে পচেগলে গন্ধ ছড়াতে থাকে।

-কাকা এতো কষ্ট কিসের? কিসের জন্য বুকে এতো হাহাকার?

-আর বলিস নারে বাপ! এতো কষ্ট করে রোজগার করে যাদের মানুষ করালাম তারাই আজ ফাঁকি দিতে শুরু করেছে। পিতৃত্বের পরিচয় বোধ হয় তাদের আর দরকার নেই। বাবা অক্ষরের দুটি শব্দের মানুষটি যে আজও বেঁচে আছে হয়তো তারও কোন খোঁজখবর নেই তাদের কাছে। জমিজমা যেটুকু ছিলো সবইতো নিয়েছে। দেহটাও পারলে বোধহয় এতোদিনে নিয়ে নিতো। ভাসিয়ে দিয়ে আসতো কলাগাছের ভেলায়। বাবারে! মেয়ের কথা বাদই দিলাম। অভাবী সংসারে ছেলে সন্তান নিয়ে কেমন করে আমার সেবাযতœ করবে। তবে যেটুকু সামর্থ্য আছে তার সেবাযতœ করে।

-আর ছেলে?

-ন্ডমম, আর ছেলে! ছেলের কথা বলিস নারে বাপ। বুকের হাড়গুলো ধস্তাধস্তি জবরধস্তি করে ভেঙে যেতে চায় তার কথা শুনে। কুলাঙ্গারটা আমার জমিজমাটুকু লিখে নিয়ে শশুর-শাশুড়ী আর বউ নিয়ে আমোদ প্রোমোদে ব্যস্ত। আমাকে খাওয়াতে নাকি তার অনেক খরচ পরে। বলতে বলতে আবার ধুকধুক করে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতে আবার বলতে শুরু করলেন...।

চোখের কোনায় অশ্রু নামক শব্দটি এসে ভিড় করছে। চোখের পাতা নড়তেই দুই ফোটা অশ্রুজল পরে গেল। নিজেকে হয়তো সংযত রাখতে পারিনি। রাখার কোন কৌশল আছে বলেও আমার জানা নেই। অসহায়ত্বের গল্প বুঝি এরকমই। পুঁজি বলে শুধু হাউমাউ করে কাঁদতে পারা আর দুঃখগুলো বুকের ভিতর চাষ করাটাই মুখ্য বিষয়।

চোখমুখে পানি দিয়ে আবার একটি সিগারেট জ্বালিয়ে পাশে বসে টানছি। দুঃখগুলোকে বিদায় জানানোর জন্য একটি অহেতুক চেষ্টা। ভুলে থাকার বাহানা শুধু। অভিনয় সে-তো অনেক আগেই হৃদয় পুড়ে পুড়ে রপ্ত করেছি।

-বাবা! আমাকে একটা দেওয়া যায়না?

কোন রকম চিন্তা না করেই সিগারেটের প্যাকেট বের করে হাতে দিলাম। একটি পকেটে রাখলেন আর একটি...।

সত্যি কথা বলতে কি এরকম বন্ধুত্ব হয়তো আগে কখনও হয়নি। একজন ৫০ উর্ধ্ব আর একজন যুবক। অভাবনীয় ব্যাপার।

-কাকা, ঢাকায় এসেছেন কেন? কার কাছে এসেছিলেন?

কোন কথায় বলছিলেন না। মনে হচ্ছিল ধোঁয়ার মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছে। আশেপাশে তাকানোর কোন সুযোগ নেই। একনাগাড়ে টেনে সিগারেট শেষ করে ফেললেন। 

তারপর বললেন,

-বাবা, কি যেন বলতে ছিলে?

-বলছিলাম ঢাকায় কেন এসেছিলেন?

কাকা গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন। 

বললেন,

- বাবা, আমি মুক্তিযোদ্ধা। হয়তো কাগজ কলমে কোন প্রমাণ নেই। তবে সত্যি বলছি স্বাধীনতা যুদ্ধে দলবেঁধে যুদ্ধ করেছি।

প্রিয় কয়েকজন বন্ধু, সহযোদ্ধাকেও হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে। ছোট ভাইকেও তো হারিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা যারা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা নামক শব্দটি ছিনিয়ে এনেছি তাদের কপালে কি জুটেছে? কিছুই নয়। হাহুতাশ করা ছাড়া কিছুই করার নেই। অনেক দিন চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে গিয়েও কোন কিছু পায়নি। উপজেলা অফিসে গিয়ে কোন সুরাহা হয়নি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়ে যায়। কিন্তু...।

অবশেষে, কেঁদে কেঁদে চোখের জল ফেলতে শুরু করলেন।

বাবা! তারপর থেকে আর কারোরই দারস্থ হয়নি। যেখানে সেখানে দিনরাত পার করি। কখনও খেয়ে আবার কখনও না খেয়ে। কখনও রেলস্টেশনে আবার কখনও গ্রামগঞ্জের চায়ের দোকানেই কাটে সবসময়। তবে বাবা, আমি প্রতিমাসে ঢাকায় আসিনা। বিশেষ কিছু দিন ছাড়া ঢাকায় আসা হয়না আমার। দিনগুলোর কথা মনে পরলে বুকের ভেতর ফাঁকা মাঠের মতো হয়ে যায়। যেখানে শুধু মরিচীকারা বাস করে। শুকনো পাতাগুলো মরমর করে ভাঙতে থাকে।

আমি একটু থমকে গিয়ে বলতে শুরু করলাম,‘কাকা বিশেষ দিন? মানে বুঝলাম না।’

ভাবলাম এরকম একজন নিরিহ মানুষেরও কি বিশেষ দিন থাকে? যার কারণে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা এই ব্যস্ত নগরী ঢাকায়। তাহলে কি সেই বিশেষ দিন? মনের মধ্যে ধীরে ধীরে আরও বেশি আগ্রহ জমতে থাকলো। পিপাসিত কাকের মতো হন্যে হয়ে গেলাম।

-বিশেষ দিন বলতে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর। এই তিনদিই আমার ঢাকা আসা হয়। যত ঝর বৃষ্টি, বাঁধা বিপত্তি আসুক না কেন আমাকে তুমি পাবেই। 

খুবই শক্ত গলায় কথাগুলো বলতে ছিলেন তিনি। কথার মধ্যে কেমন যেন একটা গন্ধ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বর এই তিনটি দিনই যে আমার সত্তাকে নাড়িয়ে যায়। বাংলা ভাষাভাষী সকল মাতৃপ্রানকে উজ্জীবিত করে।

-কেন কাকা? শুধুমাত্র এইদিগুলোতেই ঢাকায় আসেন কেন?

আবার সজোরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি কয়েকবার চেষ্টা করেও কোন সুরাহা করতে পারিনি। আসলে মনের মধ্যে গুপ্ত কষ্টগুলো এভাবেই মানুষকে আঘাত করে সুখ পায়। আর ভিতরের হৃদয় নামক কলকব্জাগুলো ধ্বংস করতে থাকে।

কান্না জড়িত কন্ঠেই বলতে শুরু করলেন,

-বাবারে! এই তিনটিদিনে আসলে বুকের পাঁজরগুলো ভেঙে তছনছ হওয়ার উপক্রম হয়। নিশ্বাস নিতে চাইলে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে পরি। থতমত হয়ে যায় কণ্ঠনালী। ফুসফাস শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।

-বাবা রে!! আমি সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম কোন দিন জানিস? জানিস না। সেদিনের অশ্রুজলে আমি নিজেই ডুবে যেতাম। 


হাউমাউ করে কাঁদতে ছিলেন তিনি। বলতে ছিলেন,

-গত কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে ‘লাখো কন্ঠে সোনার বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। অসংখ্য মানুষের আনাগোনায় ভরে গিয়েছিল পুরাতন বিমানবন্দর। দলবেঁধে, যে যার মতো, বিভিন্ন গার্মেন্টস, পোশাক শিল্প, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীর পদচারণে মুখরিত হয়েছিল সমস্ত মাঠ। একসঙ্গে লাখো মানুষের জাতীয় সংগীত গাওয়া ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। সেদিন বাংলাদেশ সরকার লাখো কন্ঠে সোনার বাংলাদেশ এর সার্টিফিকেট, পানি, ঔষধ এবং খাদ্যদ্রব্যও বিলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সেদিনই ছিলো বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিশপ্ত দিন। নাহলে কি এইদিন দেখতে হতো? কতো মায়ের বুক খালি করে, কতো বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, কতো পিতার অশ্রু দিয়ে, কতো নিরীহ মানুষের জীবন বলিদান দিয়ে, কতো ভাইয়ের রক্তের দাগে, কতো নববধূর সিঁথির সিধুর মুছে স্বাধীনতা নামক শব্দটি ছিনিয়ে এনেছি, লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে নিয়ে এসেছি। সবই আজ বিফল মনে হচ্ছে। এই দুঃখগুলো আমাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। সেদিন দেখলাম হাজার হাজার পতাকা মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কেউ কেউ ছিড়ে ফেলছে, কেউ কেউ ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে, আবার কেউ কেউ...ব্যবহার করছে।

-লাখ লাখ মানুষ সেদিন জাতীয় পতাকার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। অগুনিত পতাকা গুলো এভাবেই আর্তনাদে কেঁদে উঠছিলো বারবার বারবার। অনেকেই আবার পতাকার উপর... করছিলো। এই যদি দেশের মানুষের চিন্তাভাবনা হয়, এই যদি দেশের সরকারের উৎসব অনুষ্ঠান হয় তাহলে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে লাল সবুজের পতাকা অর্জনের দরকার ছিলো না। দরকার ছিলো না ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মিছিল মিটিং, প্রচার প্রচারণা করার। যেখানে বাঙালীরা একটি মাত্র পতাকার সন্মান দিতে পারে না।

-বাবা রে! আমরাতো যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। বিনিময়ে কিছুই পাওয়ার আশা করিনি। যদি পাওয়ার নেশায় বিভোর থাকতাম তাহলে সেদিন নিজের জীবন বিপন্ন রেখে দেশ রক্ষায় নিজেকে বিলিয়ে দিতাম না।

-বাবা রে! ঢাকায় আসি এই একটাই কারণে। নিজ উদ্যোগে যতটুকু পারি রাস্তাঘাটে, বাসস্ট্যান্ডে, রেলস্টেশনে এমনকি শহীদ মিনারে ছিটিয়ে থাকা পতাকা গুলো কুড়িয়ে এনে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিই। যাতে করে পতাকা গুলো কারো পদতলে না পরে। পদতলে পরলে ব্যথা অনুভূত হয় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরে। আহত পতাকার কান্না জড়িত আওয়াজ সবসময়ই কানে বাজে। চিৎকার করে বলতে থাকে এ কেমন স্বাধীনতা!

নিশ্চুপ বসে আছি। দুই হাত দিয়ে মুখটাকে ঢেকে রেখেছি। চোখ খুলে তাকানোর সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছি। এইতো গতকাল ১৬ ডিসেম্বর ছিলো। ভাবতেই অবাক লাগছে আমি নিজেও পতাকার অপব্যবহার করেছি। শাস্তি আমারও হওয়া উচিত। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার, দাঁড়িয়ে নিশ্বাস নেওয়ার শক্তিটুকু ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছি। কোন রকম শব্দ ছাড়াই কেঁদে উঠলাম।

পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। 

-কাকা, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে মাফ করে দিন।

-আরে বাবা! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? তোর উপলব্ধি নিজে থেকেই তোকে মাফ করে দিয়েছে। তোর মতো উপলব্ধি যদি সবার হতো তাহলে...।

ইতিমধ্যে বাড়ি যাওয়ার শেষ ট্রেন এসে গেছে। লজ্জায়, অপমানে তাঁর দিকে না তাকিয়েই ট্রেনে উঠে পরি। শেষবারের মতো এক পলক দেখার জন্য ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু মানুষের ভিড়ের কারণে দেখতে পারিনি।

আজ ২২শে ফেব্রুয়ারি। অনেক আশা নিয়েই রেলস্টেশনে বসেছিলাম সারাদিন। কিন্তু যাঁর খোঁজে সারাদিন বসে বসে কাটালাম তাঁর দেখা পেলাম না। ভেবেছিলাম গতকাল ২১শে ফেব্রুয়ারি ছিলো অবশ্যই তাকে এখানে পাওয়া যাবে। কিন্তু না, তাঁকে খুঁজে পায়নি।

ফেরার পথে একটু থমকে দাঁড়ালাম। রেলস্টেশনের একটি দেয়ালে ছবি লাগানো। 

সেই মানুষটির ছবি। যাকে আমি খুঁজছিলাম।

হারানোর বিজ্ঞপ্তি, ‘মানসিক ভারসাম্যহীন শ্রী নারায়ণ চন্দ্র দাশের কোন খোঁজখবর পেলে নিচের নাম্বারে যোগাযোগ করুন। তাকে বিশেষ পুরুষ্কার দেওয়া হবে।’

বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠলো। উল্লেখিত নাম্বারে যোগাযোগ করলাম। 

বলল, আমরা ওনাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তিনি...।

-কিন্তু তিনি কি ভাই?

অপরপ্রান্ত থেকে কান্নাজরিত কন্ঠে বলল, ‘তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।’

ততক্ষণে দুচোখ অশ্রুজল ভিজিয়ে দিয়েছে। আর কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করে শুধু বললাম,‘আপনার ঠিকানাটা পাওয়া যাবে?’

-ঠিক আছে লিখে নিন...।


ছায়া

ছায়া

 


ছায়া

হাসান মাহাদি 


অন্দরমহলে মা যেমন তার আঁচলে আগলে রেখেছেন তেমনি বাবা বাইরে থেকে একটা বটবৃক্ষের মতো পুরো সংসারটাকে ঝড়, বৃষ্টি, রৌদ্র থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ছোটবেলায় অনেক বায়না ধরতাম। কখনও পূরণ হতো...

‘বাবা, ওড়াটা ওপর দিয়ে খালি রাখছ কেন?' 

গামছাটা মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বললাম। সংসারের কাজকর্ম তেমন একটা করি না। বাবার সামান্য আয় আর মায়ের জোড়াতালিতে যে সংসার চলে, তা বুঝতাম। তবে আমার বাবা-মা কখনোই তা বুঝতে দিতেন না। নিম্নবিত্ত পরিবারের হলেও স্বাভাবিক অভাবটা কোনো দিনও অনুভব করিনি। আট-দশটা সাধারণ ছেলে থেকে একটু আলাদাভাবেই বড় হয়েছি। তবে সেটার কৃতিত্ব আমার মায়ের। বাবাও কোনো অংশে কম নন। 

অন্দরমহলে মা যেমন তার আঁচলে আগলে রেখেছেন তেমনি বাবা বাইরে থেকে একটা বটবৃক্ষের মতো পুরো সংসারটাকে ঝড়, বৃষ্টি, রৌদ্র থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

ছোটবেলায় অনেক বায়না ধরতাম। কখনও পূরণ হতো, কখনও হতো না। যখন বায়নাগুলো পূরণ হতো না তখন খুব রাগ হতো। এখন বুঝি, যে বায়নাগুলো পূরণ হতো সেগুলোর জন্য কতটা ঘাম ঝরত।

আজ বর্ষায় পলি পড়া মাঠে দাঁড়িয়ে কল্পনার মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে সেই কথাগুলোই ভাবছি।

একবার আমার খুব জ্বর হয়েছিল। আমি যখন ওষুধ খেয়ে মরার মতো বিছানায় শুয়ে থাকতাম, একটা হাত তখন আমার মাথায় নড়াচড়া করত। আমি অ্যাণ্টিবায়োটিকের ঘোরে থাকলেও শক্ত মেছ পড়া খসখসে হাতের অসম্ভব স্নেহ আর ভালোবাসার পরম ছোঁয়াটা কার ঠিকই বুঝতাম। খুব ভোরে যখন শরীরটা একটু হালকা লাগত, তখন পাশের ঘর থেকে শোনা যেত,

‘হে আল্লাহ, তুমি আমার ছেলেটাকে সুস্থ করে দাও। এই আমার একমাত্র সম্বল ...।'

সেই সঙ্গে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ।

মনে আছে, এই তো সেদিন যখন খবর হলো, আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি, সেকি আনন্দ তার!

হয়তো এক শান্ত ভোরে ফজরের নামাজের পর করা কোনো প্রার্থনার ফল তিনি পেয়েছেন! সবার অগোচরে সেদিন বাবা তার সজল নয়ন তৃপ্তি দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে ¯্রষ্টার শুকরিয়া যে আদায় করেছিলেন তা আমি দেখেছিলাম। তারপর যখন দেখলেন আমি তাকিয়ে আছি, তিনি তার ডান হাতটা তুলে মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নেড়ে কিছু একটা বোঝালেন। আমি বুঝেছি সে কথা।

‘এগিয়ে যাহ, বাছা। আরও বড় হতে হবে।’ আমিও মাথা নেড়ে তাকে কথা দিয়েছি।

এসব যখন ভাবছি এর মধ্যে মা যে কখন পানি নিয়ে এসে গেছেন খেয়াল করিনি।

হঠাৎ ডাক শুনলাম, ‘এমনে দাঁড়াইয়া আছস কেন?’

আমার ঘোর ভেঙে গেল। আমি বললাম, ‘কই? এমনি।’

আমার সামনে তখন বিচিত্র রঙের কিছু প্রজাপতি শুকনো ও আধা কাঁচা হেলেঞ্চা লতায় খেলছিল।

মায়ের ডাকটা শুনে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম। 

বাইরের যত কঠিন বাস্তবতা আমাকে বিপদে ফেলতে চায় তখন সেই মেছ পড়া রুক্ষ হাত এসে আমাকে সামলে রাখে। আর যখন মন খারাপ থাকে, একটা কোমল আঁচল এসে আমাকে ভরসা দেয়। 

আজ নিজের ইচ্ছাতেই মাঠে এসেছি। কেন যেন ক্লান্তহীন বিরক্তিহীন ত্যাগী মানুষদের একটু বুঝতে ইচ্ছা করছে। কখনও পারব কি-না জানি না। হয়তো পারব, যখন তাদের জায়গাটা আমার হবে!

বাবাকে বোঝা ভরতে দেখে মা বললেন, ‘পোলাডায় পারব? ঘাড়ে ব্যথা পাইব না?’ বাবা হাত থেকে পচা কচুরিপানা ওড়ার মধ্যে রেখে আমার মাথায় উঠিয়ে দিলেন। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘পোলায় বড় হইছে কি-না একটু পরখ করতে অইব না?’ আমি ততক্ষণে দু’কদম এগিয়ে গেছি। বাবার কথাটা স্পস্টই শুনলাম। নিজের অজান্তেই বুকভরে শ্বাস নিয়ে ভেতরের সব অপ্রাপ্তির ধূলিগুলো প্রশ্বাসে বাইরে ফেলে দিলাম। ভাবলাম, বাবা-মায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার, শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি নেই।

বর্ষার দুপুরটা যেন অসম্ভব সুন্দর হয়ে ধরা দিয়েছে। কাঁচা মাটির ছোঁয়ায় অমূল্য প্রাপ্তির আনন্দটা আরও আন্দোলিত হচ্ছে। মাথার বোঝাটাকে মনে হচ্ছে হালকা। কেউ যেন বুঝতে দিচ্ছে না বোঝাটা ভারী। 

একটা কণ্ঠ পরম আদরে আমাকে বলছে, ‘ভয় কিসের বোকা? এগিয়ে যা, আমি তো আছি।’

আমাকে অবশ্যই ভারী বোঝাটা শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। কেননা বাবাকে দেখাতে হবে আমি বড় হয়েছি। আর আমার বড় হওয়াটা তার শত পরিশ্রমের একমাত্র প্রাপ্তি হয়ে থাকুক।


হাসান মাহাদি 

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা।


গঙ্গাজলে পূণ্য স্নান

গঙ্গাজলে পূণ্য স্নান

 


গঙ্গাজলে পূণ্য স্নান

এম ইব্রাহীম মিজি


পীর সাহেব তার সাগরেদ রমজানকে ডেকে বলে- আমার জায়নামাজ এবং বিছানা-পত্র গুছিয়ে নাও। কাপড় গোছ করতে করতে রমজান পীর সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, পীর সাহেব কোথাও যাবেন না-কি? তখন তাকে একটা ধমক দিয়ে বলে। চুপ কর বেয়াকুফ। আমার সাথে এতো বছর হলো রয়েছিস এখনো আমার মতিগতি ধরতে পারিসনি। আমি হলাম ইসলামের ধারক-বাহক, দ্বীনের খেদমতে আমাকে পৃথিবীর কত প্রান্তে যেতে হয়। তারপর এই বলে পীর সাহেব কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকেন। মনে মনে হাতের কড় গুনলেন। তারপর বলেন, গুনে গুনে আঠারোটা ডিলে কুলুপ নাও। ঐখানে তিন দিন অবস্থান করবেন। তাই প্রতিদিন তিনবার করে এক নম্বর (এক নম্বর বলতে প্রস্রাব করা) করবে। আর প্রতিদিন একবার করে দুই নম্বর (অথাৎ টয়লেট) করতে লাগবে তিনটি ডিলে কুলুপ। তাহলে তিনদিনে তিনটি করে মোট নয়টা ডিলে কুলুপ লাগবে দুই নম্বর করতে আর প্রতিদিন তিনবার করে এক নম্বর করতে তিনদিনে লাগবে মোট নয়টা ডিলে কুলুপ। এক নম্বর এবং দুই নম্বর হলো সাংকেতিক ভাষা। 

পীর সাহেব একটা চেয়ারের উপর বসে আছেন। বসে বসে তার কাজগুলো হলফ করছেন। রমজান বিছানা-পত্র গুছিয়ে নিয়ে চটকরে ঘরের বাহির হয়ে যায়। ঘরের অদূরে ছিল একখন্ড জমি। কয়েক দিন হলো জমিতে হাল চাষ দিয়েছে। এখন শীতকাল তাই শুকনো মাটির কোন অভাব নেই। সেখান থেকে কয়েকটি বড় বড় মাটির টুকরো নিয়ে আসে। তারপর মাটির টুকরোগুলোকে একটা দা নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে নেয়। যখনি একটা নেকড়ার মধ্যে বেঁধে দিবে। ঠিক তখনি পীর সাহেব রমজানকে নির্দেশ করলেন। ডিলে কুলুপগুলো এদিকে নিয়ে এসো আর একটা একটা করে আমার হাতে দাও। রমজান একটা একটা করে পীর সাহেব হাতে দেয় আর পীর সাহেব প্রতিটি ডিলে কুলুপের গায়ে তিনটি টোকা মারে তারপর চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে কি সব দোয়া কালাম পড়ে ফুঁ দেয়। এভাবে আঠারোটায় ফুঁ দেওয়ার পরে রমজান যখন আরেকটা ডিলে কুলুপ দেয় তখন পীর সাহেব বলে আঠারোটা হইছে ত। আরেকটা কেন? তখন রমজান বলে আমার জন্য। 

পীর সাহেব মুখটাকে একটু বিকৃত করলো। তারপর বলল,

পীর আমি, না তুমি?

আর কখনো পীর সাহেব হতে চেষ্টা করো না। কারণ এটার অনেক ওজন। সইতে পারবে না। রমজান একেবারে কোনঠাসা হয়ে যায়। কি বলবে সে কোন কথা খুঁজে পায় না। রমজান ছিলো পথ শিশু। একটু সহজ-সরল ধরণের। গ্রামের মধ্যে হকারের ব্যবসা করতো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাছে বিভিন্ন খাবার বিক্রি করতো। তার বিনিময়ে ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত বোতল বিভিন্ন ভাঙ্গাচোরা জিনিস নিতো। একদিন পীর সাহেবের সাথে তার দেখা হয়। তাকে দেখে পীর সাহেব হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। হাত উঁচু করে পীর সাহেব তাকে ডাকলেন। 

এই...ছেলে। এদিকে আসো।

ছেলেটি তার কাছে এলো। কাঁধে ঝুলানো হকারি জিনিসগুলো নামিয়ে রেখে তার সামনে খুব বিনয়ী হয়ে দাঁড়াল- তারপর হুজুর জিজ্ঞাস করলো। 

তোমার নাম কী?

আমার নাম রাকেশ মিয়া।

তুমি কি হিন্দুর বাচ্চা? রাগতঃস্বরে পীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। 

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি প্রতিবাদ করলো। না, না, আমি মুসলমান। আমার বাবার নাম সুমন বেপারি আর মায়ের নাম জোলেখা বেগম । 

তাহলে তোমার নাম কেন রাকেশ মিয়া রাখলেন। রাকেশ হল হিন্দুধর্মের ছেলেদের নাম। এটা কোন মুসলমানদের নাম হতে পারে না। 

তাহলে হুজুর  কি নাম রাখবো। 

কেন, কত নামই ত আছে। রমজান, আশ্রাফ, শরিফ আরো কত কি।

তখন ছেলেটা বলে, তাহলে হুজুর আপনি আমার একটা নাম রেখে দেন। 

আজ থেকে তোমার নাম রমজান রাখলাম। বারো চান্দের মধ্যে সবচে ফজিলতের মাস রমজান, তাই আজ থেকে তোমার নাম রমজান বলে সবাই ডাকবে। বাড়িতে গিয়ে তোমার বাবা-মাকে বলবে। তারা যেন আজ থেকে তোমাকে রমজান নামে ডাকে। 

তখন ছেলেটা বলে হুজুর আমার কেউ নেই এ জগতে। এ জগতে আমার বলতে শুধু আমি। মাকে হারিয়েছি সেই জন্মলগ্নে। ছিল বাবা, সে-ও চলে গেছে আমাকে রেখে। আজ পর্যন্ত তার আর কোন খোঁজ -খবর পাইনি। আমিও কখনো খোঁজার চেষ্টা করি নাই। 

ত, তোমাকে লালন-পালন করেছে কে? 

আমার নানি। নানির কাছে বড় হয়েছি। নানি অনেক কষ্টে অনেকের কথাঘাত সহ্য করে আমাকে বার বছর পর্যন্ত লালন-পালন করেন। তারপর একদিন নানিও মারা যায়। আর কি থাকা যায়। ব্যস নেমে পড়লাম এ ব্যবসায়। 

তাহলে ত ভালোই হল। মনে মনে পীর সাহেব বলে আমার ষোলকলা পূর্ণ হল। আমি ত এমন একটি ছেলে খোঁজ করছিলাম এতদিন। 

হঠাৎ পীর সাহেব উঁচু গলায় বলে উঠলো। 

আলহামদুলিল্লাহ...তোমাকে তো আমি খোয়াবে দেখেছিলাম গত রাতে! তোমার সাথে দেখা হবে। কথা হবে। তুমি আমার কাছে বায়াত গ্রহণ করছ। আমার মুরিদ হয়েছ। ছেলেটা হা করে শুধু পীর সাহেবের দিকে চেয়ে রয়। সে কিছুই বুঝতে পারে না। কি বায়াত, কি মুরিদ। 

পরে ছেলেটা বলে, হুজুর আপনি এগুলো কি বলেন। আমি কিছুই বুঝি না।

তোমার কিছুই বুঝতে হবে না। তুমি শুধু আমার সাথে চলো। ছেলেটা রাজি হয় না। পরে তাকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখায়। আমার অনেক জ্বিন মুরিদ আছে তারা তোমার ক্ষতি করবে। এরপূর্বে অনেকের, অনেক ক্ষতি হয়েছিল। যারাই আমার কথা অমান্য করেছিল। আমার সাথে বেয়াদবি করাকে তারা মেনে নিতে পারে না। তখন ছেলেটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এখন যা জিজ্ঞেস করে সে হ্যাঁ বলে না, আবার না-ও বলে না। একটু একটু নিম রাজি জ্বিনের ভয়ে। সেই থেকে রমজান পীর সাহেবের সাথে আছে। 

পথে আসতে আসতে তাকে সব শিখে দেয়া হয়। আমাকে শুধু হুজুর ডাকবে না। পীর সাব হুজুর বলে ডাকবে। আর আমার গুণকীর্তন করবে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করে, 

রমজান, ও রমজান। তার কোন সাড়া নাই। 

তখন পীর সাহেব ফিরে দাঁড়ায়। এ..ছেলে তোমাকে ডাকতেছি না?

তখন সে বলে, কইন, পীর সাহেব হুজুর।

কেন। আজ থেকে না তোমার নাম রাখা হলো রমজান । 

ও..হ্যাঁ। আমি ভুলে গেছিলাম, তো ক্যান ডাকছেন? ছেলেটা জিজ্ঞেস করে। 

তুমি কি আরবি পড়তে পার?

না।

নাউজুবিল্লাহ! পীর সাহেব বলে উঠে। তার পরের দিন হতে তাকে আরবি পড়াতে থাকে ।

বল “আলিফ”

বা’...(এক আলিফ টানিয়া পড়িবে) 

পির সাহেব, এইভাবে রমজানকে শরিয়তের ছবক নিয়মিত দিতে লাগল...


গ্রামে পৌঁছার আগেই সূূর্যটা নেমে যায় নদীর ঐ পাড়ে। যেন কূূল ছুঁই ছুঁই। সারা দিনের ক্লান্ত সূূর্যটা কেমন  লালচে হয়ে গেছে। এখুনি আঁঁধার নামবে গ্রামের বুকে। চারিদিকে  আজান পড়ছে। পিছন হইতে রমজান হাঁক ছাড়ে- পীর সাহেব নামাজের উক্ত চলে যাচ্ছে। নদীর পাড়ে নামাজ পড়ে নিই। তখন পীর সাহেব জিজ্ঞেস করে এ নদীর নাম কি?

পিছন হইতে রমজান বলে এ নদীর নাম হল ‘গঙ্গা’। এ নদীর জলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পাক-পবিত্র হওয়ার জন্য গঙ্গা স্নান করে। তাৎক্ষণিক পীর সাহেব হাঁটু সমান পানি থেকে এক লাফে কূলে উঠতে উঠতে বলে তওবা! তওবা!। যেমন শীতকালে ঠান্ডা পানি ছুঁইলে শরীর আঁতকে উঠে। ঠিক তেমনি। তাহলে ত এখানে অজু করা যাবে না। এটা নাপাক পানি। যেখানে বিধর্মীরা স্নান করে। তখন রমজান বলে তাহলে কি নামাজ পরে পড়বেন। 

হু...। গ্রামে পৌঁছে তারপর নামাজ পড়ব।

তাহলে ত কাযা হয়ে যাবে? রমজান বলে। 

হোক। এক-দুই ওয়াক্ত নামাজ কাযা হলে কিছু হবে না। পীর সাহেব বললেন। 


গ্রামে পৌঁছে সে তার কামরাতে অবস্থান করে। সেখানে সে তিন দিন, তিন রাত থাকবে। কিন্তু পরে এখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। এটা ছিলো এক সময় একজন হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি। হিন্দু ব্যক্তিটি ছিলো এ অঞ্চলের প্রধান। এ বাড়িতে হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা -অর্চনা অনুষ্ঠিত হতো। একদিন বাড়ির পীর সাহেবের চোখে পড়ে। তার খুব পছন্দ হয়। বাড়িটি প্রায় নয়/দশ একর জমির উপর অবস্থিত। এছাড়াও বাড়ির আশেপাশে আরো কয়েক একর জমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। একদিন যখন আসর বসে। আসর শেষ করে তারপর পীর সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বলে। আজকে আপনাদেরকে বহু বছরের একটা পুরনো কথা বলবো। আজ হইতে বহু বছর আগে আমার দাদাজান পীর সাহেব হুজুর যখন এখানে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসছিলো তখন এ বাড়ির হিন্দু প্রধান উনাকে বেদমভাবে মেরে তাড়িয়ে দেয়। তখন এ অঞ্চলে নওমুসলিমদের সংখ্যাধিক্য ছিল। এখান থেকে যাওয়ার পরে উনি আর বেশি দিন টিকে নাই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কথাটা বলতে গিয়ে পীর সাহেব হাউমাউ করে কান্না জুড়িয়ে দেয়, উপস্থিত মুরিদগণ তার কান্না সহ্য করতে পারে না। সবার মাঝখান হতে একজন হঠাৎ স্লোগান দিয়ে উঠে। ‘না’রে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’ দাদা হুজুরের অপমান সইবো না, সইবো না। স্লোগান দিয়ে সবাই লাঠিসোটা নিয়ে হিন্দু প্রধানের বাড়িতে হামলা করে। 

হামলায় আহত হয়ে হিন্দু প্রধান তার পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে চলে যায়। এদিকে পীর সাহেব তার মুরিদদেরকে নিয়ে বাড়িটির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে যায়। সে আজ আনন্দে বিমোহিত। সকল আকাক্সক্ষা যেন আপনা হইতে ধরা দিয়েছে। সে যখন কাজ করতে যায় তখন তার মুরিদরা তা করতে দেয় না।


পরে পীর সাহেব এখানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে। তার আপনজনেরা জিজ্ঞেস করলে বলত- এখানকার মুরিদদের অনুরোধে থাকতে হয়েছে। তারা এত করে অনুরোধ করলো। তাদের কোন মুরুব্বি নেই। 

তারা আমাকেই মুরুব্বি হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাছাড়া এ অঞ্চল ছিলো ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। আল্লাহ-রসুল সম্পর্কে তাদের লেশমাত্র জ্ঞান ছিল না। পুরুষ-নারীতে কোন বেদ-বিচার ছিল না। পরে বেপর্দাকে এনেছি পর্দায়। বে-জাতকে করেছি জাত। এভাবে আস্তে আস্তে এ অঞ্চলটি আলোকিত হয়ে ওঠে।

একদিন পীর সাহেব মাগরিবের নামাজ শেষ করে তার খাস কামরায় মোরাকাবায় বসে আছেন। এমন সময় একজন আসে পানি পড়া নিতে। তার স্ত্রীর পেটের পীড়া। দরজা খুলবে খুলবে এমন সময় তার মুরীদ রমজান পিছন থেকে লোকটিকে টেনে ধরে।

অ্যা...অ্যা তুমি কি করছ।

ভাই আমার গিন্নির পেটে ভীষণ ব্যথা উঠেছে। এখন একটু পানি পড়া লাগবে। লোকটির চোখে-মুখে খুবই কাতরতা। না, এখন হবে না। পীর সাহেব এখন ধ্যান মগ্নে আছেন। খোদার সাথে কথালাপ করছেন। পীর সাহেব ভেতর থেকে সব শুনে হঠাৎ করে বোল পাল্টিয়ে প্রলাপ করতে থাকেন। দাদাজান আপনাকে যারা একদিন এ অঞ্চল থেকে অপমাণ করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। খোদাতায়ালা আজ তাদেরকে দেশ ছাড়া করেছে।  

কিছুক্ষণ পর পীর সাহেব তার খাস কামরা ছেড়ে বের হয়ে আসেন। বাহির হয়ে শাগরেদ রমজানকে ডাক দেন। তাকে ডেকে কালীগঞ্জে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তার আরেক জন মুরিদ আছে। তাকে গিয়ে বলবে তার মৃত বাবা গত রাতে স্বপ্নযোগে আমার কাছে কিছু খেতে চেয়েছে। এখন সে যেন একটা কাঙালি ভোজের আয়োজন করে। আরো বলবে, আয়োজনে যেন কোন কার্পণ্য না করে। উল্লেখ্য এসব আয়োজনে পীর সাহেবই প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পেয়ে থাকেন!

আর এখন এক পেয়ালা পানি নিয়ে এসো। রমজান দ্রুত পানি নিয়ে আসে। পীর সাহেব পানি পেয়ালাটা হাতে নিয়ে ফিসফিস করে কি কি পড়ে কয়েকবার পানিতে ফুঁ দেয়। তারপর লোকটার হাতে দিয়ে বলে, আপনার স্ত্রীর না পেটের পীড়া? পানিপড়া নিয়ে তাকে খাইয়ে দিবেন। ইনশাল্লাহ আরোগ্য লাভ করবে।

আগন্তুক লোকটা ত অবাক হয়ে যায়! মনে মনে কথোপকথন করে আমি কিছুই বললাম না, তবু পীর সাহেব কিভাবে বুঝলেন। কত বড় পরহেজগার লোক হলে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। 

লোকটা ভয়ে ভয়ে বলে- পীরসাব, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? 

হ্যাঁ। পীর সাহেব বলেন। 

তখন সে বলে। আমি ত আপনাকে কিছুই বলিনি। তবু কিভাবে বুঝলেন? 

পীর সাহেব একটু মুচকি হাসলেন। তারপরে বলতে থাকেন, আমাদের ‘রুহানি’ শক্তির বলে আমরা তা বুঝতে পারি। জগতের সব অদৃশ্য বস্তু দেখতে পাই। কার কি সমস্যা সব কিছুই উপরওয়ালা আমাকে বলে দেন। লোকটার মুখে কোন কথা নেই, লা জবাব!


শীতের সকাল, কুয়াশার জাল ছিঁড়ে আস্তে-আস্তে সূর্যের কিরণ এসে আছড়ে পড়ে পুকুরের নরম ঘাসের উপর। স্নেহের পরশে সূর্যটা উঁকি দিল পূর্বাকাশে।

পীর সাহেব খদ্দরের চাদরটি গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ায়। হাতে একটা হাদিসের বই। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রমজান দৌড়ে গিয়ে একটা চেয়ার দিয়ে আসে। পীর সাহেব চেয়ারে বসে বসে রোদ পোহায় আর বই পড়ে। কিছুক্ষণ একাগ্রচিত্তে বইটি পড়ার পর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পীর সাহেব মাথা তুললেন। মাথা তুলতে দেখলেন রমজান বাড়ির সামনে পরিত্যক্ত জমিতে কোদাল দিয়ে কোপাচ্ছে। সেখানে সে এবার রবি শস্যের চাষ করবে। এখনো গায়ের গরম কাপড়-চোপড়গুলো খুলেনি। সে যখন কোন কাজ শুরু করে তখন তার আর কোন পূর্ব-পশ্চিম ঠিক থাকে না। সেখান থেকে পীর সাহেব তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, রমজান ফরজের দিকে খেয়াল রেখো। ফরজ তরককারি কোন লোকের হাতে আমি কিছু খাই না। তুমি জানো। রমজান সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করে না। না শোনার কারণে পীর সাহেব তাকে আবার ডেকে বলে- 

রমজান, ও... রমজান। 

কয়েকবার ডাকার পর রমজান মাথা তুলে তাকায়। তখন সে বলে, হাঁটুর কাপড় ঠিক করো। রমজান জীভে কামড় দিয়ে তড়িঘড়ি করে হাঁটু ঢেকে দেয়। কখন যে হাঁটুর কাপড় খসে পড়ল সেদিকে তার খেয়ালই ছিল না।

তারপর তার দিকে পীর সাহেব কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই কিশোর ছেলেটি আজ কত বড় হয়ে গেছে। আজ সে এক পরিপক্ক যুবক। পীর সাহেব ঐ অবস্থায় মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন এবার তাকে বিয়ে করিয়ে দিবেন। 

পীর সাহেবের ধ্যানমগ্ন অবস্থায় একটা লোক আসে তার কাছে। একটা স্বপ্নের বর্ণনা নিয়ে। বলো, কি স্বপ্ন তোমার? পীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। তখন লোকটা বলে, হুজুর আমি গতরাতে ঘুমের মধ্যে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। পীর সাহেব লোকটার কাছে স্বপ্নের ধরণ জানতে চান? তখন লোকটা বলে- 

হুজুর আমি দেখলাম, তিন বর্ণের তিনটা কুকুর। কালো, লাল আর সাদা। আমাকে খুব দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। এটা দেখার পরে হুজুর আমি আর সারারাত ঘুমাতে পারিনি। এখন হুজুর আমি এটার ব্যাখ্যা জানতে চাই। 

তখন পীর সাহেব বলে, তাহলে শোনো। তোমার পিছনে অনেক শত্রু। তারা একেকজন একেক ক্ষতি করতে চায় তোমার। তুমি একটু সাবধানে থেকো। এটাই হল স্বপ্নের মর্মকথা। 


তারপর একদিন, মহা ধুমধামে রমজানের বিয়ে হয়। পীর সাহেবের এক ভক্ত-অনুসারী মেয়ের সঙ্গে। তারা স্বামী-স্ত্রী দুইজনই থাকেন পীর সাহেবের বাড়িতে। কারণ পীর সাহেব ছাড়া এ দুনিয়াতে রমজানের আর কেহ নাই। দেখতে দেখতে রমজানের বিয়ের ছয় মাস পার হয়েছে। কিন্তু পীর সাহেব এখনো তার বৌকে দেখে নাই। যদিও মাঝে মধ্যে কিছু নিয়ে আসতো, তখন একেবারে হাতে পায়ে মোজা পরে পর্দা করে আসতো। একদিন পীর সাহেব তাকে বলে তুমি রমজানের বৌ। আর রমজান হলো আমার পালিত ছেলে। সেই হিসাবে তুমি আমার ছেলের বৌ’য়ের মতো। আমার সামনে আসতে এতো পর্দা কেন করো? আর পর্দা করা লাগবে না।

তারপর থেকে সে আর পীর সাহেবের সামনে আসতে পর্দা করতো না। এবার প্রথম পর্দা ছাড়া পীর সাহেবের সামনে আসে। তাকে দেখে ত পীর সাহেব থমকে যায়। এত সুন্দরী একটি মেয়ে রমজানের স্ত্রী! আবার সে আমার বাড়িতেই থাকে। তারপর থেকে পীর সাহেব আর তার মনকে এক মুহূর্তের জন্য স্থির করতে পারে না। আল্লাহ -রাসূলের নাম ভুলে গিয়ে সে রমজানের স্ত্রী’কে নিয়েই ভাবে। সর্বক্ষণ পীর সাহেব বিভিন্ন কূটকৌশলী ভাবনার জাল বুনে চলে। কিভাবে রমজানের স্ত্রীকে নিজের করে কাছে পাবে? দিবানিশি এই ভাবনা।

হুজুরের প্রথম কৌশল হলো, তাদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি করবে। তাই একদিন রমজানকে ডেকে বলে, তোমার বৌ কেন পর্দা করে না? আমার সামনে খোলামেলা আসে। আমার আমল নষ্ট হয়। তাছাড়া চলা-ফেরায় অনেক ত্রুটি পরিলক্ষিত হইতেছে। জোরে আওয়াজ করে কথা বলে। খিল খিল করে বেটা ছেলের মত হাসে, রমজান এমন বউকে নিয়ে তুমি ঘর সংসার করতে পারবে না। যত দ্রুত পারো তাকে তাড়ানোর একটা পদক্ষেপ নাও।

পীর সাহেব কি বুঝাতে চেয়েছিলেন রমজান না বুঝার কোন অবকাশ রইলো না। বড় শক্ত কথা। কথাগুলো শোনার পরে সে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার শরীর যেন উত্তাপে ফেটে যাবে। সারা শরীর জুড়ে ঘামের ঢল নামে। গলায় মোড়ানো রুমাল দিয়ে হাত ও মুখের ঘাম মুছে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, পীর সাহেবকে সালাম দিয়ে হন্ হন্ করে বেরিয়ে যায়।


রমজান সারাদিন অন্যরকম অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে পার করে। কোন কিছুতে মিল খুঁজে পায় না। পীর সাহেব তার বৌ’য়ের ব্যাপারে যা বলল, বাস্তবে তার কোন মিল খুঁজে পায় না। রমজান ভাবে, পীর সাহেব কি কখন মিথ্যে বলতে পারে! নিজের সাথে নিজের কথপোকথন। এদিকে ততদিনে রমজান আর তার স্ত্রীর মাঝে স্বগসর্ম প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। 

অনেক দিন হয়ে গেছে পীর সাহেব তাদের দুই জনের মধ্যে দূরত্ব হওয়ার কোন আলামত দেখতে পায় না। তাই মনে মনে  নতুন আরেকটা ফন্দি আঁটে। কীভাবে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যায়। দিনরাত শুধু ভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে একদিন মনের মাঝে একটা কুটচালের উদয় হয়।

একদিন পীর সাহেব খুব বিমর্ষচিত্তে ঘরের দরজা বসে আছেন। এত ধ্যানমগ্ন যেন কাউকে দেখতে পায় না। তার সামনে দিয়ে রমজান কয়েকবার হেঁটে যায়। প্রতিদিন দেখলে ত একবার না একবার রমজানকে ডাকতো। কিন্তু আজ একবারও ডাকল না। রমজান ভাবলো, আজ পীর সাহেবের কি হলো। সে ভয়ে ভয়ে পীর সাহেবকে ডাক দিল।

হঠাৎ ডাক শুনে পীর সাহেব চমকিত হয়ে উঠে। রমজান বলে, পীর সাহেব কি কোন কিছু নিয়ে ভাবছেন? 

-হ্যাঁ, আমি ত তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত। তুমি যেভাবে ঘর-ঘরণি নিয়ে মত্ত আছো। জাহান্নাম খুব আজাবের স্থান। রমজান শুনছে, কিন্তু কিছু বলার সাহস নেই তার। 

সে যখন পীর সাহেবের কাছে এলো। তখন পীর সাহেব চেয়ার থেকে উঠে তার কাঁধের উপর হাত রেখে বলে। আজ যে আমি মর্যাদার শিখরে এলাম, তা এমনিতে হাঁচিল হয়নি। অনেক সাধনা করতে হয়েছে। রাত-দিন খোদার কদমে পড়ে ছিলাম। তারপর উনার দিদার পেয়েছি। এটা বলতে বলতে পীর সাহেব আবার চেয়ারে বসল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে- দুনিয়াটা হল ইমানদার এর জন্য পরীক্ষাখানা। এখানে আমরা উপভোগ করতে আসি নাই, এসেছি যুদ্ধ করতে। কারণ আমরা হলাম ধর্ম প্রচারক বলতে পারো খেদমতগার। দ্বীন প্রচারের জন্য আমাদেরকে দূর হইতে দূরে চলে যেতে হয়। গৃহের প্রতি টান থাকতে নাই। পরে জগতে আরো সুন্দর সুন্দর হুর (নারী) পাবে। আর এখন তোমার যৌবন কাল। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপযুক্ত সময়। 

তাছাড়া তুমি আমার কাছে থাকো। তোমাকে যদি আমি দ্বীনের কাজে ব্যবহার না করি। তার জন্য আমাকে পরে কালে জবাবদিহি করতে হবে। এ কঠিন পরীক্ষা হইতে আমাকে উদ্ধার করো। পীর সাহেব অত্যন্ত কাতরস্বরে বলে। তারপর কৌশলে রমজানকে এক বছরের জন্য দ্বীনের কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কয়েক দিন পর পীর সাহেব রমজানের স্ত্রীকে ডেকে পাঠায়। আসার পরে তাকে আরবি লেখা একটা কাগজ দেখায়, এটা হল তোমার তালাকনামা। রমজান যাওয়ার আগে আমার হাতে দিয়ে গেছে। সে আধ্যাত্মিক জগতের বাসিন্দা হতে চায়। তুমি হয়তো জানো না, সে বিয়ের আগেও এমন ছিল। বছরে পর বছর নিরুদ্দেশে চলে যেতো। এবার বোধ হয় আর ফিরবে না। কথাটা শোনার পর মেয়েটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বারবার মূর্চ্ছা যায়। বেশ কিছুদিন পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়, রমজান আর ফিরে আসেনা।

তারপর সুযোগ বুঝে পীর সাহেব একদিন তার জন্য তার বাপের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। পীর সাহেবের প্রস্তাব, না করার সাহস গ্রামের কারো নেই। কারণ, না করলে পীর সাহেবের বদদোয়া লাগতে পারে। 

একবার কলিমউদ্দিনের স্ত্রী গর্ভাবস্থা তার পড়া তাবিজ হাতে দে নাই বলে তার গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ হয়েছিল। গ্রামের মধ্যে এনিয়ে হই চই পড়ে যায়। কথাটা পীর সাহেবের কানে গেলে তখন সে তার পীরত্ব জাহেল করার জন্য বলে আমি তো ক্ষমা করে দিয়েছি। আল্লাহ বোধ হয় তাকে ক্ষমা করতে পারে নাই। তার এ অধম বান্দাকে অপমাণ করা আল্লাহ পছন্দ করেনি...