গল্প : স্বপ্নের ঘুণপোকা

গল্প : স্বপ্নের ঘুণপোকা


স্বপ্নের ঘুণপোকা
শর্মি ভৌমিক

বাইশ বছরের শিবু এখনও মায়ের আঁচল ধরে মামাবাড়ি বেড়াতে যায় হাসিমুখে। মামাবাড়ি বড় শান্তির স্থান শিবুর কাছে। কৈশোরে যে কয়দিন ওখানে থেকেছে, খুব স্বাধীন জীবনযাপন করেছে সে। খাওয়ার চিন্তা নেই, পেটপুরে খেয়েদেয়ে গল্পগুজবে বেশ দিন কেটে যেতো তার। শিবুর বাবার বড় সংসার। পাঁচ মেয়ে, শিবু ও স্বামী- স্ত্রী মিলে মোট আট সদস্যের সংসার সুধীর বাবুর। ছোটখাটো মাছের ব্যবসায় ঠিকঠাক সংসারও চলতো না তার। সকালে খেলে বিকেলে কি খাবে এমন অভাব অনটন যেন সংসারে নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। শিবুর একমাত্র স্কুলশিক্ষক মামা অবিনাশ বাবু শিবুকে পড়াতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন শিক্ষিত করে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে। কিন্তু, পড়ালেখার প্রতি শিবুর অনাগ্রহ অবিনাশ বাবুর ইচ্ছেকে সফল হতে দেয়নি। খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার কাজে বেশ মনোযোগ গড়ে ওঠে তার। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুমচোখে মাথায় মাছের খাঁচি তুলে বাবার সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতো শিবু। বাবার কষ্ট সইতে না পেরেই সেসময় সাহায্য  করতে নেমে পড়েছিলো কিশোর ছেলেটি।
জ্যৈষ্ঠের খরতাপে সুধীর বাবুর অনাহারী শুকনো মুখে যখন মুক্তোদানার মতো ফোঁটা ফোঁটা শুভ্র ঘাম জমে উঠে  তখন শিবু কোমরের ময়লা গামছা খুলে অতি যতেœ আলতে ছোঁয়ায় বাবার কপালের ঘাম মুছে দেয় গভীর ভালোবাসা মেখে। সুধীর বাবু অসহায় দৃষ্টিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেদিনের সেই ছোট্ট শিবুর দিকে। ভাবে, এতো মায়া, এতো মমতা, ও পেলো কোথা থেকে? শিবুর এতোসব গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও পড়ায় অমনোযোগী হওয়ার দোষে অন্তরে ভীষণ ব্যথা অনুভব করে সুধীর বাবু। তাই, একদিন মাছের আড়ত থকে মাছ নিয়ে ফেরার পথে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে একমাত্র বংশপ্রদীপ সন্তানটিকে বললো,
-আইচ্ছা বাপ, তুমি কি সত্যিই আর ইসকুলে যাইবা না? আমার সন্তান কি আমার মতো মূরুখ্য হইয়াই জীবন কাটাইবো?
সুধীর বাবুর বয়স কম হয়নি! আট ছেলেমেয়ের জনক  তিনি। দুটি সন্তান জন্মের পর মারা গিয়ে এখন ওরা  ছয়জন। শিবু তিন বোনের ছোট। ওর ছোট আরও দু’বোন রয়েছে, খুবই ছোট ওরা। জন্মের পর থেকেই বাবার ঘানী টানা দেখে এসেছে শিবু। ঘাড়ে করে মাছের খাঁচি টানতে টানতে বাবার কুঁজো হয়ে যাওয়া পিঠের দিকে তাকিয়ে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। রাত হলে ঘুমের মাঝে খক খক করে কেশে উঠে সুধীর বাবু। শ্বাসকষ্টে ভালো ঘুম হয় না তার। রাত পোহালেই ছোট ছোট সন্তানদের একাধিক বায়না সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় সুধীর বাবুকে। কণা, মীনা, সীমার পছন্দ  বাজারের তেলের পিঠা আর রসগোল্লা দিয়ে গরম গরম পরোটা ভাজা খাওয়া। ঘরের কোণেই বাজার। বাচ্চাদের এসব আবদার পূরণ করতে গিয়ে বাবাকে কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয় তা অনুভব করে শিবু, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর মামার বাড়ি থেকে পড়ালেখা করবে না। পড়ালেখা শিখে চাকরি বাকরি করতে করতে বাবাকে আর বাঁচানোই যাবে না! তারচেয়ে এই ভালো, বাড়িতে থেকে বাবার কাজেই সহযোগিতা করবে, মাছের ব্যবসাতেই নিজেকে জড়িয়ে নেবে । বাবাকে ভালোবেসে বাবার কাজটিকেই বেছে নিয়েছে মাতৃপিতৃভক্ত শিবু নামক সহজ সরল ছেলেটি।
আজ বাবার সেই একই কথা আবার! সেই পড়ালেখা! আজকের কথাগুলো যেন কথা নয়, এ যেন অতৃপ্ত হৃদয়ের সকরুণ হাহাকার! বেদনাক্লিষ্ট আর্তনাদে শিবুর বুকও খুব করে কেঁপে উঠে। কিন্তু, আজ আর কিছুই করার নেই তার। পড়ায় বিস্তর গ্যাপ পড়ে গেছে, এখন আর ওটা পূরণ করার উপায় নেই। তাই বললো,
-আইচ্ছা বাবা, সকলেরই কি বই পইড়া জ্ঞানবান হইয়া অফিস আদালতে চাকরি করতে হইবো? সকলের পক্ষেই কি তা সম্ভব, কওতো? আমরা যদি মাছের ব্যবসা না করি, তাইলে মানুষ মাছ খাইবো ক্যামনে? অহন যদি দেশের সকল কিষাণেরা অফিসে চাকরি করতে চায়, তাইলে মানুষ ভাত পাইবো কইত্তে?
-হুন বাপ, আমি সক্কলের কথা জানি না, আমি তুমারে শিক্ষিত কইরা তুলতে চাইছিলাম। তোমার মামা একজন নামকরা মাষ্টর, সেও চাইছিলো তুমি পড়ালেহাডা কর, কিন্তু তুমি এইডা কি করলা বাপ?! তুমি পড়ালেহাডা ছাইড়া দিলা! ক্যান এমন করলা?
কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার কামাল্লা গ্রামের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে ছিলো জমিদারদের বসবাস। এখনও সেই জমিদারী স্থাপত্য বিদ্যমান। বড় বড় শ্যাওলাযুক্ত পুরনো ভাঙ্গাচোরা দালানকোঠা আজো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে জমিদারীর সাক্ষ্যস্বরূপ। বিশাল বিশাল দিঘী আজ মৎস্যশূন্য নীরব, আবর্জনায় ভরপুর। শান বাঁধানো পাকা ঘাটলায় জমিদার রমণীদের পায়ের স্পর্শ পড়ে না আর! সব পড়ে আছে শূন্য, খাঁ খাঁ! দিঘীর পাড় ঘেঁষে হাঁটার সময় শিবুর বুকের বাঁপাশ ব্যথায় কিঞ্চিত চিনচিন করে ওঠে। কেন এভাবে সব শূন্য হয়ে যায়? কেন সব পড়ে রয় জনমানবহীন এমন অবহেলায়? অজস্র ভাঁটফুল ফুটে আছে দিঘীটির চতুর্পাশ্বে প্রকৃতির পূর্ণ মহিমা নিয়ে। কেউ কি খোঁজ রেখেছে তার? কোনদিনই হয়তো কারো পূজার ফুল হয়ে উঠেনি ওরা, কেউ দেখেও দেখেনা ওদের, অবিরাম মাড়িয়ে যায় পায়ে পিষ্ট করে। ওদেরও কি রক্ত করবী কিংবা পদ্ম হতে ইচ্ছে হয়? নাকি গোলাপ না হতে পারার যন্ত্রণায় প্রতিদিন বাবা- মায়ের বকুনি খায়? এমন হাজারো ভাবনায় শিবু ধাক্কা খায় হঠাৎ বাবার কথায়। বাবার অপূর্ণতা কি দিয়ে পূরণ করবে শিবু? বাবা যে ওকে শিক্ষিত দেখতে চেয়েছিলো!  সময় চলে যায়, সে কারো জন্য বসে নেই। দিশেহারা মনে শিবু তবুও বলে,
-বাবা, আমি তোমার সন্তান; সন্তান হইয়া যদি তোমার কোন সেবা করতে না পারি; মা বোনদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে না পারি, তাহলে কিসের সন্তান হইলাম আমি? তুমিই যদি না থাক, তবে কে দেখবে আমার সাফল্য? আমি তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই বাবা, আমি মায়ের চোখের জল সইতে পারি না আর! আমি চাই নাই তোমরা না খাইয়া মইরা যাও...
বলতে বলতে ঢুকরে কেঁদে ওঠে শিবু। হঠাৎ পথে থমকে  দাঁড়ায় সুধীর বাবু। শিবুকে বুকে চেপে ধরে মুছিয়ে দেয় চোখের জল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তার বুকের ভেতরটাও। ব্যর্থ বাবা হবার অপরাধে ফেনিল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তার দু’চোখের তীরে।
-বাপরে, পেটের দায়ে আমি এই কাম করি, এই কাম বড় কষ্টের কাম বাপ! আমি কোনদিন চাই নাই তুই এই কাম করস, তুইতো বুঝলি না আমি কি চাইছিলাম! আমিতো তোর সুখ দেখতে চাইছিলাম বাপধন!
চলতি পথে কামিনীর মৃদু গন্ধ মোহিত করে তোলে শিবুর হৃদয়ের অলিগলি। চোখ আটকে যায় ইট খসে পড়া পোড়াবাড়িটির দিকে। সবুজাভ শ্যাওলাপড়া ভাঙ্গা দেয়ালের গায় কি আশ্চর্যভাবে গজিয়ে আছে একটি বড়সড় বটগাছ! মাটি নেই, তবুও শেকড়গুলো হাত পা ছড়িয়ে শ্যাওলা থেকে শুষে নিচ্ছে বেড়ে উঠার যাবতীয়  নির্যাস! গাছটি বাতাসে ডালপালা নাড়িয়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে দুলছে বারবার। জমিদার বাড়ির ভেতরটা  এখন ছোটখাটো একটি সুন্দরবন বৈ কিছু নয়। কিছু গোখরো সাপের বসতবাড়িতে পরিণত হয়েছে বাড়িটির অন্দরমহল। এককালে বড় নিষ্ঠুর ছিলো এই জমিদারেরা। বর্ণবিভেদ করে ওরা মানুষকে ঠকিয়েছে নির্দয়ভাবে। মানুষকে নিম্ন বর্ণের করে রেখে তারা উচ্চবর্ণ হয়ে সিংহাসনে পা ঝুলিয়ে জমিদারিত্ব ফলিয়েছে বহুকাল ধরে। নিম্নবর্ণ বলতে কিছু যে নেই, সেসময় তা ছিলো  সাধারণ মানুষের বোধেরও বাইরে। ওরা নিজেদেরকে ছোট মনে করে জমিদারদেরকে সেবাপূজা করে গেছে তখনকার দিনে। জমিজমা চাষাবাদ করে শূন্যহাতে ঘরে ফিরতো নিম্নবর্ণের মানুষজনেরা। জমিদারদের নিকট তারা ছিলো এক অচ্ছুত বস্তু মাত্র! লঘু  অপরাধের জন্য তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতো গুরু সব শাস্তির আয়োজন। এরকম হাজারো উপায়ে সাধারণ লোকেরা নিপীড়িত হতো ক্ষমতাশালীদের নিকট।
শিবু এ গাঁয়ে জন্মেছে ঠিকই, তবে জমিদারদের দেখা পায়নি সে। নিম্নবর্ণের করুণ কাহিনীর কথা জেনে জেনে মাঝে মাঝে বড়বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠে শিবু। তাদের অনাচার মেনে নিতে পারে না কিছুতেই।
জমিদার বাড়ির জঙ্গল পেরিয়ে মেঠোপথে পা রাখতেই  এক স্বচ্ছ শীতল বায়ু বয়ে যায় শিবুর দেহের ধমনী ও শিরার সমান্তরাল পথ পরিক্রমণ করে। অজান্তেই একরাশ ঘৃণা বেরোয় যেন নিঃশ্বাসের হাতটি ধরে!
-আইচ্ছা বাবা, পড়ালেখা না শিখলে মানুষ বুঝি ভালা  মানুষ হইতে পারে না? যদি তাই হইবো, তাইলে জমিদার বাড়ির অতো শিক্ষিত লোকগুলি এমন অত্যাচারী হইছিলো ক্যামনে? আমি পড়ালেখার বিপক্ষে না, কিন্তু পড়ালেখা শিইক্ষা অমানুষ হওয়ার বিপক্ষে, বুঝলা বাবা?
-হেইডা আলাদা কতা, বুঝলি? জমিদারেরা ছিলো ক্ষমতালোভী, ক্ষমতার জইন্য হেরা সব করতে পারতো। নিজের পিতারেও সিংহাসনচ্যুত করতে দ্বিধা করতো না তারা। পিতাও সন্তানের গর্দান নিতো অবলীলায়। তাদের কথা বইল্যা লাভ নাই বাপ। তয়, সব জমিদারতো আর খারাপ আছিলো না, কিছু ভালা  নেতারও জন্ম হয় জগতে, তারাই টিকাইয়া রাহে এই বিশ্বডারে।’
শিবু মন দিয়ে বাবার কথা শোনে। খুব ইচ্ছে জাগে ভালো নেতা হবার। সকলের নয়নের মনি হতে কার না ভালো লাগে! তবুও কেন আজকালকের নেতাগুলো তা হতে পারছে না? কেন মানুষের ঘৃণা নিয়ে অবৈধ অর্থের পেছনে দৌড়ুচ্ছে তারা? এদেশেতো বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবরের মতো এক মহান নেতার জন্ম হয়েছিলো, তবে কেন আজকের নেতৃবৃন্দরা সেকথা হৃদয়ে ধারণ করছে না? কেন ব্যক্তিস্বার্থই বৃহৎ হয়ে উঠছে তাদের কাছে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজেদের কুঁড়েঘরের সামনে ছোট্ট উঠোনে এসে পৌঁছায় ওরা বাপবেটা দু’জনে। দুপুর গড়িয়েছে বেশ আগেই। তবুও জ্যৈষ্ঠের সূর্যের তেজ কমেনি। তীব্র দাবদাহে সুধীরবাবুর কুচকুচে কালো মুখ আরো কালো রূপ ধারণ করেছে। তাকে দেখে যেকারো মনে হবে এ যেন একরত্তি ঘুটঘুটে অন্ধকার! কোটরাগত চোখ যেন আঁধারে জ্বলে উঠা ছোট্ট ছোট্ট জোনাকি পোকা!
বাবার ভাঙ্গা গলায় কাশির শব্দ শুনে ঘর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো শীলা, মিলা, মিনারা। টিওবয়েল চেপে একজগ ঠান্ডা জল নিয়ে এলো তড়িৎ গতিতে। কলের গোড়ায় কাঁদা খুঁড়ে খাদ্য খোঁজা হাসদুটোও প্যাঁক প্যাঁক স্বরে সরব হয়ে উঠলো তাদের আগমনে। কলাবতী ফুলের পাঁপড়িগুলো বাতাসে মাথা দুলিয়ে যেন সাদর সম্ভাষণে মেতে উঠলো নির্জন দুপুরের শেষ প্রহরে!
অজান্তেই মায়াময় এই ভালোবাসার সংসারের ভার এসে পড়লো শিবুর কাঁধের উপর। সুধীর বাবু ভিন্ন স্বপ্ন দেখলেও শিবুর কাছে তা দেখা দিয়েছিলো বিলাসী স্বপ্ন রূপে। তারচেয়ে বরং এইতো ভালো, সবাই মিলে পেটপুরে দুটো ডালভাত খেয়ে শান্তিতে জীবন কাটাতে পারছি, ভাবে শিবু। ভেবে স্বন্তির নিঃশ্বাস ফেলে নীরবে।
আজ বহুদিন পর মায়ের সাথে মামাবাড়ি এসেছে শিবনাথ (শিবু)। প্রতিদিনকার কর্মক্লান্তি থেকে এইতো কিছু অবকাশ! সুধীরবাবুর সংসারে আগের মতো তেমন অভাব নেই আজ আর। মাছের ব্যবসাও ছেড়ে দিয়েছে শিবু। শহরে রাজমিস্ত্রির কাজ করে এখন বেশ ভালোই রোজগার হয় তার। বাবাকেও অবসর দিয়েছে কষ্টের কাজ থেকে। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে, ওরাও ভালোই আছে স্বামী সংসার নিয়ে। মায়ের গায়েও উঠেছে নতুন ছাপার শাড়ী, সোনার নাকফুল, হাতে বাঁধাই করা সোনার শাঁখা। ছেঁড়া আঁচলে মাথায় ঘোমটা টানার দিন ঘুচেছে গীতা রানীর। সুগন্ধি জর্দায় পান খেয়ে দু’ঠোঁট লাল করে মধুর হাসিতে আজকাল ঘর ভরিয়ে তোলে গীতা দেবী। শিবুর চোখ আনন্দে ভিজে উঠে। লেখাপড়া করতে না পারার দুঃখ নিমিষেই উবে যায় হৃদয় হতে।
মামাতো বোন চৈতালীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুব বড় ঘর বর পক্ষের! আষাঢ় মাসেই বিয়ে। চৈতালী বয়সে শিবুর বড়। দিদির বিয়ের কথা শুনে মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো তার। নিজের বোনেদের বিয়ে দিয়েছে প্রচন্ড যুদ্ধ-সংগ্রাম করে। সেখানে দায়িত্ব ছিলো কিন্তু কোন আনন্দ ছিলো না। বোনেদের বিয়ে দিয়ে বাবার মাথার বোঝা সরানোই ছিলো তার একমাত্র কাজ। এবার আর সেই ঝামেলা নেই, দিদির বিয়েতে অনেক মজা করবে বলে স্থির করে মনে মনে। অনেকদিন পর মামীর হাতের পায়েস খেয়ে অমৃত মনে হলো শিবুর কাছে। অবিনাশ বাবুর দখিনমুখী বাড়ীটিতে সারাক্ষণ বয়ে যায় শান্তির বাতাস। মামাবাড়ীর সবই যেন স্বর্গীয় মনে হয় শিবুর কাছে।
-অ্যাই শিবু, এদিকে আয় ; দেখ দেখ, গাছে কাঁঠাল পেকে ফেটে আছে;  উঠে পড়, পেড়ে নিয়ে আয় ওটা, গাছতলায় বসেই খাবো, হি হি...
চৈতালী এমনই হাসিখুসি একটি মেয়ে। দিদির কথায় শিবুও তরতর করে উঠে পড়ে গাছে। গাছপাকা কাঁঠালটি পেড়ে তুলে দেয় প্রিয় দিদির হাতে। চৈতালী কাঁঠাল ভেঙ্গে খাইয়ে দেয় ছোট ভাইটিকে। তারপর বলে,
-এবার পুরোটা খা, হি হি!
-আমি একলা এত্তোবড় কাডাল খাইতে পারুম না দিদি, তুমিও খাও।  এই নেও হা করো, দারুণ মজার কাডাল! "
চৈতালী প্রিয় ভাইটির কথা ফেলতে পারে না। খেয়ে নিলো একটি কুশ ভালোবেসে। তারপর বললো,
-গাছে আমও পেকে আছে, পেড়ে খা যতো ইচ্ছে।
শিবু চৈতালীর দিকে তাকায়। কি মায়াবী সরল একটি মুখ! সে চলে যাবে এ বাড়ি থেকে, ভাবতেই বুকের ভেতরটা হু হু করে কেঁদে ওঠে তার!
-দিদি, আমার একটা কথা রাখবা?
-কি, বল?
-আমিতো গরীব, তোমার বিয়েতে ক্ষুদ্র একটা উপহার দিতে চাই, নিবা তুমি?
শিবুর কথায় কেঁদে ওঠে চৈতালীর কোমল হৃদয়। চৈতালী জানে শিবু গরীব নয়, ওর হৃদয়টা খুব বৃহৎ,  অর্থ দিয়ে এ হৃদয়ের পরিমাপ করা সম্ভব নয়। শিবুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহভরা কন্ঠে বললো,
-কেন নেবো না ভাই? তুই দিদিকে ভালোবেসে একটি উপহার দিবি আর আমি নেবো না! তাই কখনও হয় নাকি? ঠিক নেবো আমি।
শিবুদের সংসারের কথা সবই জানা চৈতালীর। মামা হিসেবে চৈতালীর বাবা অবিনাশ বাবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন বোনের পরিবারের জন্য। গীতা রানী অবিনাশ বাবুর সবচেয়ে আদরের ছোট বোন। সংসারের টানাপোড়নের সময় গীতা রানী তার বাচ্চাদের নিয়ে মাসের পর মাস ভাইয়ের সংসারে এসে পড়ে থেকেছে, অবিনাশ বাবু কখনোই অনাদর করেননি বোনটিকে। আজ ভাগ্নেটি বড় হয়েছে, ভালো টাকা রোজগার করছে, এতে অবিনাশ বাবু খুবই সুখী। বোনটি ভালো আছে জেনে নিশ্চিন্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।
শিবু ছোটবেলায় প্রায়ই আসতো মামার বাড়ি। এবার এসেছে তিন বছর পর। শহরে দালানকোঠার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে, তাই আর বেড়ানো হয়ে উঠে না তেমনভাবে। অনেকদিন পর ভাগ্নেকে দেখে মামা অবিনাশ বাবুও ভীষণ খুশি। বেশি লেখাপড়া না জানলেও শিষ্টাচারের কোন ঘাটতি নেই শিবুর মাঝে, তাই শিবুকে ছোটবড় সকলেই ভালোবাসে। রাতে মামাভাগ্নে একসাথে খেতে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ জুড়ে বসলো। আলাপের এক ফাঁকে শিবু বললো,
-মামা, একটা কথা আছিলো আমার।
-কি কথা, বল?
-মামা, চৈতালীদির বিয়ের বেনারসিডা আমি বিয়েতে উপহার দিতে চাই দিদিরে, দয়া কইরা আপনে না করবেন না। এইডা আমার মনের ইচ্ছা মামা।
অবিনাশ বাবু ভাবতেও পারেননি শিবু এমন একটি অনুরোধ করবে! তার একমাত্র মেয়ে চৈতালী, তার বিয়ের বেনারসি কিনবে শিবু!
-ভাগ্নে শোন, বেনারসিটা আমিই কিনবো, তুই মন খারাপ করিস না। আসলে, আমি চাই না তুই এতো টাকা খরচ করিস। বেনারসির অনেক দাম, তুই বরং অন্য কোন উপহার দে তোর দিদিকে।
মামার কথায় সত্যিই খুব মন খারাপ হয় শিবুর। মুখ কালো করে বলে,
-মামা, এ নিয়া আপনের ভাবতে হইবো না, আমি বেনারসিই উপহার দিমু দিদিরে। কথা কিন্তু ফাইনাল, মামা।
সরল শিবুর মুখের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ বাবু আর দ্বিমত করতে পারলেন না।
শিবুরা দুদিন বেড়িয়ে বাড়ি  চলে এলো। বাড়ির ঘরটাকে ঠিকঠাক না  করলে আর চলছে না। এ দফায় সম্ভব হচ্ছে না, শহর থেকে কাজ শেষ করে দিদির বিয়ের আগেই ঠিক করে ফেলতে হবে ঘরটাকে, ভাবে শিবু। দিদির বিয়ের পর জামাইবাবু ও দিদিকে একবার আনতে হবে তো! কতো পরিকল্পনা তার! শহরে গিয়ে কাজে খুব মন দিলো শিবু। এ কয়দিন কোন অবকাশ নয়, কাজ আর কাজ নিয়েই থাকার কথা ভাবে সে। চৈতালীদি কতো স্নেহ করে তাকে, তার বিয়েতে যেমনতেমনভাবে গেলে হয়! দিদির বিয়েতে রাজপুত্র সেজে জামাইবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, বুঝিয়ে দেবে কতোটা স্নেহের ছোটভাই সে।
এসব হাজারো ভাবনায় কর্মোদ্যম বেড়ে যায় শিবুর। দেখতে দেখতে দিদির বিয়ের দিনটিও এগিয়ে এলো। তার চোখেমুখে স্বপ্নেরা ঝিকিমিকি খেলা করে চলছে  সারাবেলা। ট্র্যাঙ্কে খুব যতœ করে তুলে রেখে দিয়েছে দিদির বেনারসি কেনার টাকাটা। আজ বিকেলে মার্কেটে যাবে ঠিক করে ফেললো শিবু। সুন্দর দেখে সব থেকে ভালো লাল বেনারসিটা সে কিনবে দিদির জন্য। প্রথমেই শাড়ীর দোকানে বেনারসি পল্লীতে ঢুকলো শিবু। অসংখ্য বেনারসির ভীড়ে কোনটা কিনবে ভেবে কূল পায় না সে। অবশেষে দশ হাজার টাকা দিয়ে সুন্দর লাল টুকটুকে একটি বেনারসি কিনে ফেললো তার দিদির জন্য। দিদির জন্য শাড়ীটি কিনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শিবু। তারপর, বাবা- মা ও ছোট বোনদের জন্যও কিনলো নতুন নতুন পোশাকআশাক। নিজের জন্য তবে কি কিছুই কিনবে না শিবু?! তার বহুদিনের শখ একটি হাতঘড়ি কেনার। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে নিজের কোন সখ পূরণ হয়নি তার। এবার আর কোন ভাবনা নয়, সাধের ঘড়িটি কিনেই ফেললো শিবু। হাতে ঘড়ি পরে বাবুদের মতো হাত ঝুলিয়ে হাঁটবে সকলের সামনে দিয়ে, কতোইনা সুন্দর দেখাবে তাকে! ভাবতে ভাবতে মলিন মুখে সুখের হাসি ফুটে ওঠে শিবু বাবুর। সোনালী চেইনের স্বপ্নের সেই ঘড়িটি এখন তার ঘরে, ভাবতেই আহ্লাদিত হয় শিবুর হৃদয়।
আর এক সপ্তাহ পরই চৈতালীর বিয়ে । শিবু আজই বাড়ি এসেছে। ঘরটা ঠিক করতে হবে বলেই একটু আগেভাগেই চলে এসেছে বাড়িতে। টিনের চালে মরচে পড়েছে খুব। বহুদিনের পুরনো টিন, স্থানে স্থানে ফুটো হয়ে গেছে। আষাঢ় মাস। রোজকার বৃষ্টিতে ঘরের চালে জল পড়ার আগেই ঘরের ভেতরে যেন জল গড়ায় পাল্লা দিয়ে! দিদির বিয়ে উপলক্ষে ঘরটিও সারাই করা হবে শিবুদের।
দু’জন মিস্ত্রীসহ শিবু নিজেই আজ লেগে পড়েছে ঘরের কাজে। আর মাত্র চারদিন বাকী দিদির বিয়ের। গীতারানীও ভাইজি বিয়ের উত্তেজনায় ভীষণ আবেগাপ্লুত। সুধীর বাবুর মনেও আনন্দের বান ডেকেছে যেন! শিবুর ছোট বোনগুলোও উচ্ছ্বসিত। ওরাও গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেদের মতো। আজ চালে নতুন টিন বসাচ্ছে শিবু। নিজ হাতে আনন্দের সাথে ঘরের কাজ করছে সে। কতো সুখের স্বপ্ন মাথায় খেলা করছে তা শিবু ছাড়া আর কে জানে! গুনগুন গান বেজে চলেছে তার অন্তরে। হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘেরা ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলো! বৃষ্টিটা নামবে নামবে করছে। শিবু মিস্ত্রীদের একজনকে ডাকলো,
-ওহ মানিক ভাই, হাতুরিডা দেওতো জলদি, টিনডা খুইল্যা যাইতাছে, তাড়াতাড়ি দেও।
কথাগুলো বলতে না বলতেই একঝাঁক দমকা হাওয়া এসে উল্টিয়ে দিয়ে গেলো ঘরের উপরে বিছানো টিনগুলো। শিবু বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে আটকাতে চাইলো উড়ে যাওয়া টিনগুলিকে। কিন্তু পারলো না! টিনের সাথে নিজেই উড়ে গিয়ে পড়লো মাটিতে। ধারালো টিনের আঘাতে প্রচন্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলো শিবু। থেঁতলে গেলো তার গোপনাঙ্গটি। দমকা বাতাসের সাথে ভেসে এলো একটি আর্ত চিৎকার...
-মাগো, ওমা, আমি আর বাঁচবো নাগো মা !
সুধীর বাবু, গীতারানী, দৌড়ে এলো সবাই। সন্তানের এই অবস্থায় বিলাপ শুরু হলো শিবুদের উঠোনে। কান্নার রোলে দৌড়ে এলো পাড়ার সব লোক। এ কি হলো! এ কি হয়ে গেলো, মুখে মুখে এ কথাই যেন সবার! হাসপাতালে নেয়া হলো শিবুকে। নাহ্, কাঁটাছেঁড়া হয়নি কোথাও। ডাক্তার ভালো করে দেখলেন, কয়েকটি ব্যথার ওষুধ দিলেন শিবুকে। প্রথম দিন ব্যথা ক্ষাণিকটা কমলেও দ্বিতীয় দিন ব্যথাটি বেড়ে গেলো কয়েকগুণ!  শিবু ব্যথা ব্যথা বলে চিৎকার করলেও কাউকে বলছে না কোথায় হচ্ছে তার ব্যথা! ডাক্তারও জানতে পারলো না শিবুর গোপন সেই যন্ত্রণার কথা।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মাথার কাছে বসে থাকা মাকে কি যেন বলতে চাইলো শিবু। গীতা রানীর চোখের জল অনবরত ঝরে পড়ছে পুত্রের মাথায়। মাথাটি আগলে মুখের কাছে মুখ এগিয়ে মা জলভরা চোখে জিজ্ঞেস করলো,
-শিবু, বাপ আমার, কিছু কইবা তুমি? কি কইবা বাপ, কও না, কওনা বাপ...?
শক্ত করে মায়ের হাতটি চেপে ধরে শিবু। কোঁকাতে কোঁকাতে কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা  করছে সে ।
-মা, আ- আ- মি বুঝি আর দিদির বিয়েতে যাইতে পারুম না, মা! সখের হাতঘড়িডা পরা অইলো না আমার!
শিবুর আর্তিতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে গীতা রানী। বিলাপ করতে করতে পুত্রকে প্রবোধ দিতে চাইলো,
-পারবা, পারবা বাপ, তোমার কিচ্ছু অয় নাই, তুমি ভালা অইয়া যাইবা বাপ। ডাক্তার কইছে, তুমি সুস্থ অইয়া যাইবা। এমন কতা কইয়ো না বাপ, আমার কইলজায় যে মানে না! ওহ্, ঈশ্বর, তুমি আমার বাপধনেরে ক্যান এত কষ্ট দিলা? তুমি আমার মানিকরে ভালা কইরা দেও ঈশ্বর ...!
পুত্রকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে গীতা দেবী।
-ওমা, মাগো, তুমি আমার একটা কথা রাখবা মা?  দিদির বিয়ে যেন আমার কেনা বেনারসি শাড়ী পইড়াই অয়, তুমি শাড়ীডা পৌঁছাইয়া দিবা, মা? তুমি আমারে কতা দেও মা, কতা দেও, কতা দেও...
বলতে বলতে কেমন যেন কঁকিয়ে ওঠে শিবু! তার এমনসব কথায় গীতা রানীর মন আশঙ্কায় কুঁকড়ে যায়। অন্তরে কিসের যেন অশনিসংকেত বেজে ওঠে! বুকের বীনায় বেজে ওঠে বিধ্বংসী এক সুর! কোন এক কুডাকে বারবার কেঁপে কেঁপে ওঠে মায়ের অন্তর।
-শিবু, বাপ আমার, এইসব ভাবে না বাবা, তোমার কিছু অয় নাই, তুমি তাড়াতাড়ি ভালা অইয়া যাইবা, আমরা তোমারে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ডাক্তার দেহামু, তোমার কিচ্ছু অইবো না বাপ...
আর কেউ না জানুক, শিবুতো জানে তার কি হয়েছে! সে প্রতি সেকেন্ডে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে যাচ্ছে  হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থেকে। ক্ষণে ক্ষণে নিঃশ্বাস থেমে যাচ্ছে তার।
-মা, ওমা, আমার আরেকটা কথা আছে মা।
অসহায় দৃষ্টিতে পুত্রের স্বপ্নভরা চোখে তাকায় গীতা রানী। পুত্রের প্রতিটি কথা যে তার বুকে তীরের মতো বিঁধে চলেছে তা কি করে বোঝাবে সে! মায়ের মন মানে কেমন করে?! শুধু কাঁদে আর চেয়ে থাকে পুত্রের বেদনার্ত মুখের দিকে।
-নতুন জামাইরে মুখ দেইখা তুমি নিজের হাতে ঘড়িডা পড়াইয়া দিবা, আমি দূর আকাশ থাইক্যা চাইয়া চাইয়া দেখমু আর আনন্দ করমু, মা। আমার দম বন্ধ হইয়া আসছে মা! বাবার কষ্টটা আমি দূর করতে পারলাম না, আমারে ক্ষমা কইরো তোমরা...
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ শিবুর জিভ আটকে যায়। শিবুর মা ছোট্ট চামচে ওর মুখে তুলে দেয় এক ফোঁটা জল। আবারো জোরে কঁকিয়ে ওঠে শিবু। তার বড় বড় নিশ্বাসে কেঁপে ওঠে হাসপাতাল কক্ষ। গীতা রানীর আর কিছু বুঝতে বাকী থাকে না, শিবু চলে যাচ্ছে, সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেখানে, যেখানে গেলে কেউ আর ফেরে না কোনদিন!
-শিবু, শিবুরে, ও আমার বাপ, কতা কহ, কতা কহ বাপ, চুপ কইরা থাহিছ নারে বাপ, ও ভগবান, এ তুমি কি করলা? ক্যান করলা? আমি কি অন্যাই করছিলাম ওরে আমার ভগবান.....!
সুধীর বাবু ওষুধ আনতে ফার্মেসীতে গিয়েছিলো। এসে পুত্রকে নীরব হয়ে যেতে দেখে এক চিৎকারে ফিট খেয়ে গেলো। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন অট্টহাসিতে হাসপাতাল কক্ষ ফাটিয়ে দেবার উপক্রম করতে লাগলো মানুষটি!
-শিবু, শিবু, ও আমার শিবু, আমারে ছাইড়া তুমি কোনহানে যাইও না, আমি তোমারে ছাড়া বাঁচতে পারুম না..... হা হা হা হা হা! শিবু, ঘুমাইছে, আমার শিবু ঘুমাইছে, ওরে কেউ ডিস্টাব কইরো না..... খবরদার, আমার বাপধনেরে জাগাইও না, কতদিন ঘুমায় না আমার পুলায়, হা হা হা হা হা.....!
শিবুর বাবা- মায়ের সকরুণ আহাজারিতে ভারী হলো প্রকৃতির আকাশ, বাতাস চারিপাশের সবকিছু। গীতা রানী বুক চাপড়ে এলোচুলে বার বার মুর্ছা যাচ্ছে। সুধীর বাবু দেয়ালে মাথা খুঁটছে। শিবু নিথর দেহে সব ব্যথা বিসর্জন দিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে স্থির।
লজ্জায় মরণকে বেছে নিলেও কারো নিকট গোপনাঙ্গের চরম আঘাতের কথাটি কাউকেই বলতে পারলো না হাজারো স্বপ্ন দেখা সেই উঠতি যুববকটি! নীরবে এভাবে বুঝি চলে যায় কেউ কেউ!
চৈতালীর বিয়ের সাতপাক ঘোরা আর দেখা হলোনা শিবনাথের! গোপন ব্যথা বুকে লুকিয়ে হয়তো শ্মশানে গুমরে কাঁদছে নিষ্পাপ ছেলেটি! লাল বেনারসি, হাতঘড়ি সব পড়ে আছে শূন্য টিনের ঘরে, শুধু স্বপ্ন দেখা শিবু আর রইলো না এই পৃথিবীর পরে!
ছেলের শোকে শিবুর বাবা আজ মতিভ্রষ্ট, পাগল। গীতা রানীও চলে গেছে ছেলের টানে ছেলেরই কাছে! ছেলের শোকে পাথর হওয়া গীতারানী সি, এন, জির ধাক্কা খেয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে! সুধীর বাবু সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, অভাবে দিন কাটিয়েছে, কিন্তু অসুখী জীবন ছিলো না তার। স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসতো এই মানুষটি। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার ছিলো তার।
আজ কিছু নেই, নিঃস্ব, সর্বশান্ত সুধীর বাবু। শুধু আছে  মুখভর্তি দাড়িগোঁফ! কারো সাথে কোন কথা বলে না আজকাল;  খাওয়া নেই, দাওয়া নেই; শুধু শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ানোই তার একমাত্র কাজ; একা একা হাসে, কাঁদে আর কি যেন বিড়বিড় করে বলে যায় সারাবেলা, কেউ তা বোঝে না.....


কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ

কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ


কালজয়ী কথাসাহিত্যিক 
হুমায়ূন আহমেদ
 
মীম মিজান

অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের পর বাংলা কথাসাহিত্যে যিনি অদ্বিতীয় আসনে আসীন তিনি হলেন নন্দিত ও কালজয়ী লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা গদ্য সাহিত্যে স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হলেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বরে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া গ্রামের কুতুবপুর উপজেলায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তার পারিবারিক ডাক নাম ছিল কাজল। ছোটবেলায় হুমায়ূন আহমেদ খুব ভাল ছাত্র ছিলেন না। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হুমায়ূন আহমেদের পড়াশোনার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হতে থাকে। তারই ফলস্বরূপ এসএসসি পরিক্ষার রেজাল্টের পর দেখা গেলো তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২য় স্থান অধিকার করেছেন। এইচ এস সিতেও তিনি মেধা তালিকায় খুব সহজেই স্থান করে নেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। কর্মজীবনের প্রারম্ভে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের রসায়ন বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এমনকি আমেরিকার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার সায়েন্সেও পি এইচ ডি অর্জন করেন এই কালজয়ী লেখক। পরবর্তিতে এই কলম জাদুকর তার লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় অধ্যাপনা পেশা থেকে অব্যাহতি নেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক হুমায়ূন আহমেদ দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর বাংলার পাঠক সমাজকে নিজের কলমের জাদুতে এক রকম মোহবিষ্ট করে রেখেছিলেন। জাদুকর যেমন তার হাতে থাকা কালো ছড়ি বা, লাঠি ঘুরিয়ে দর্শকদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়, হুমায়ূন আহমেদও তেমনি নিজের হাতে থাকা কালো কলমটি সাদা কাগজের উপর ঘুরিয়ে আমাদের বারবার অন্য জগতে নিয়ে গেছেন। তিনি একাধারে রচনা করেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কবিতা এবং গান। প্রথম উপন্যাসেই বাজিমাত করা লেখকের দেখা পাওয়া গোটা পৃথিবীতেই অনেক দুষ্কর। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তাদেরই একজন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হলে সেটিই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি তার জীবনকালে ২০০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বলা হয়, বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। মজার বিষয় তার সব বই’ই বাংলাদেশের বেস্ট সেলার বা, সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের স্বীকৃতি প্রাপ্ত।
হুমায়ূন আহমেদ তার জীবনে দুবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে তার প্রথম বিবাহ হয়। তার প্রথম স্ত্রীর নাম গুলকেতিন আহমেদ। পরবর্তিতে ২০০৫ সালে তিনি তার ১ম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। দুই সংসার মিলে হুমায়ূন আহমেদ তিন কন্যা ও তিন পুত্রের জনক।
তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার জনপ্রিয়তায় অনেকেই পরশ্রী কাতর হয়ে তাকে বাজারি লেখক বলে অযথা আক্রমণ করেছিলেন। আসলেই কি তিনি বাজারি লেখক ছিলেন? একজনের লিখনির ভাষা সহজ ও সাবলীল বলে তাকে আমরা বাজারি লেখক বলতে পারি না। হুমায়ূন আহমেদ বাজারি লেখক না জনপ্রিয় ও কালজয়ী লেখক তা পাঠক মহলের কাছে স্পষ্ট। এই বাজারি লেখক বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর কাঠপেন্সিল থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি- তিনি লিখেছেন, ‘বাজারি লেখক- বিষয়টা আরও পরিস্কার করা দরকার। তেল-সাবান- পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমনের নমুনা, ‘অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না। কালজয়ী এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশিরভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট না। এমন একজনের সাথে কথোপকথনের নমুনা-
কালজয়ী: কেমন আছেন?
আমি: জি ভালো।
কালজয়ী: ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমি: একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি।’
তিনি কালজয়ী উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখার পাশাপাশি নাট্যকার হিশেবে বাঙ্গালি দর্শকদের মনে চিরজাগরুক। এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়সহ সাড়া ফেলানো অনেক নাটক তিনি নির্মান করেছেন। তার নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’তে প্রধান চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হলে সেই ফাঁসি বন্ধে সারা দেশের মানুষ মিছিল নিয়ে নেমে পড়েছিল। ঢাকার গলিতে গলিতে পোস্টার লাগানো হয়েছিল। তাহলে অনুমিত যে তিনি কতোটাই জনপ্রিয় নাট্যকার। তার যুগান্তকারী কিছু গল্প অবলম্বনে তিনি ৮টি চলচিত্রও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি একজন গুণী পরিচালকও। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘আগুনের পরশমনি’। তার নির্মিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রটি বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর মাঝে একটি। তার ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি ২০০৬ সালে সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দিতা করেছিল। তার পরিচালনায় সর্বশেষ সিনেমা ছিল ‘ঘেটুপুত্র কমলা’।
এছাড়াও গান লিখেছিলেন অনেক। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানটি এক সময় সবার মুখে মুখে লেগেই থাকত যেটি হুমায়ূন আহমেদের গান।
তিনি সবকিছুকে ছাড়িয়ে একজন সন্দেহাতীত কালজয়ী কথা সাহিত্যিক। আমরা একজন কালজয়ী লেখক ও সাহিত্যিক হিশেবে হুমায়ূন আহমেদকে মূল্যায়ন করতে তার গল্পের কিছু বৈশিষ্ট্য জেনে নেই। তার রচনার প্রথমত ও প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ভাষার সারল্যে। এছাড়াও স্বল্পায়বে তিনি লিখে ফেলতেন চমৎকার সব গল্প। দীর্ঘ রচনা হুমায়ূন আহমেদের ধাতে ছিল না। তার অধিকাংশ গ্রন্থই স্বল্পাবয়ব। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো স্বল্প পরিসরে চরিত্রচিত্রণের ক্ষমতা। ইনিয়ে-বিনিয়ে বর্ণনা তার রচনায় পাওয়া যায় না। ঝটিতে মাত্র কয়েকটি বাক্যে একটি মানুষের ছবি তিনি পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। পাঁচ-সাতটি মোক্ষম সংলাপে ফুটে ওঠে এক-একজন মানুষের চারিত্রিক প্রবণতা। পৃথিবীতে আর কোনো লেখক এত স্বল্প পরিসরে একটি মানব চরিত্র সুনির্দিষ্টভাবে নির্মাণ করতে পারেন, এই রূপ উদাহরণ সহসা পরিদৃষ্ট হয় না।
চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রেও হুমায়ূন আহমেদ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। সমাজের সর্বপ্রকার চালচিত্র হুমায়ূন আহমেদের গল্পে স্থান লাভ করেছে। সর্বপ্রকার মানবচরিত্র ভূমিকা রেখেছে তার গল্পের মানচিত্রে। ব্যাপক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও কল্পনাশক্তি যুক্ত হওয়ার ফলে তাঁর চরিত্রগুলো সর্বদাই কৌতূহলোদ্দীপক।
চরিত্র চিত্রণের পাশাপাশি শক্তিমান ও জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের ইমাজিনেশন বা কল্পনাশক্তি ছিল প্রখর। তার গল্পগুলো পাঠে এ বৈশিষ্ট্যটি দারুণ উপভোগ্য। বাস্তবতার সঙ্গে অসম্ভবের সন্ধি হুমায়ূন আহমদের প্রিয় কৌশল। যাকে আমরা জাদু বাস্তবতা বলতে অভ্যস্ত হুমায়ূন আহমেদ তার দক্ষ কারিগর। তাঁর বিভিন্ন গল্পে আমরা লক্ষ্য করি অসম্ভবের বহুবর্ণ উপস্থিতি। অতুলনীয় বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বয়ান করেন মানুষের অভিজ্ঞতা, কল্পনা, বিশ্বাস ও চিন্তার ভারসরাম্যম-িত সংশ্লেষ।
হুমায়ূন আহমেদ কেন এতটা জনপ্রিয় ও বেস্ট সেলার গ্রন্থসমূহের অধিকারী? যুবক শ্রেণী পাঠক ও ভক্তের কাছে হুমায়ূন গল্পগুলির ব্যাপক আবেদন ও সাড়া ফেলানো। তার সৃষ্ট কতিপয় অমর চরিত্র যুবক শ্রেণীর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এরকম কিছু অমর চরিত্র হলো:
হিমু:
খালি পায়ে পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় হিমু। উদ্ভট সব কাজই তার মূল কর্মকা-। যুক্তির ধারধারেন না। এমন সব কা- করেন যে তার আশে পাশের মানুষ বরাবরই অবাক হয়ে যায়। মানুষকে চমকে দেওয়াই তার কাজ।
মিসির আলী:
মিসির আলীমোটা ফ্রেমের ভারী চশমা পরিহিত লোকটি কিছুতেই বিশ্বাস করেন না অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা। যতো রহস্যময় ঘটনাই ঘটুক যুক্তি দিয়ে তার সমাধান খুজে নেন। এই যুক্তিবাদী মানুষটির নাম ‘মিসির আলী’। হিমু’র ঠিক বিপরীত। হিমু যেমন যুক্তি মানে না, মিসির আলী আবার যুক্তির বাইরে হাঁটেন না।
শুভ্র:
সব সময় মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে বইয়ের মাঝে ডুবে থাকেন। বাবার বিপুল সম্পত্তি শুভ্রকে কখনো টানে না। শুভ্র সুন্দরের শুদ্ধতা নিয়েই বেঁচে থাকতে চান।
বাকের ভাই:
বাকের ভাই কোনো গল্প, উপন্যাস কিংবা নাটকের চরিত্র যে বাস্তবজীবনে এভাবে দৃশ্যমান হয় তা বোধ হয় আগে কেউ দেখেনি। হুমায়ূন আহমেদই সেই বিস্ময়কর ইতিহাস সৃষ্টি করেন ‘বাকের ভাই’ চরিত্রের মাধ্যেমে।
রুপা:
‘রুপা’হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সৃষ্টি ‘রুপা’। হিমু’র মতো এক বাউন্ডুলেকে ভালোবাসে এই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটি। সবসময় অপেক্ষা করে হিমুর পথের দিকে তাকিয়ে। হিমু ফোন দিয়ে বলে ‘রূপা আমি আসছি’। হিমুর পছন্দের আকাশি রংয়ের শাড়ি , চোখে কাজল দিয়ে ছাদে কিংবা বারান্দায় দাড়িয়ে থাকে রূপা। কিন্তু হিমু আসে না। রুপাও জানে হিমু আসবে না। কিন্তু তারপরও অসম্ভব মায়া আর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে। উপর্যুক্ত চরিত্রগুলি নাটক, গল্প, আড্ডার মঞ্চে সরসভাবে আলোচিত হতো।
ব্যক্তি হুমায়ূন আহমদের মূল্যায়নে প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ শুধু একজন উজ্জ্বল জনপ্রিয় লেখকই নন, তিনি একজন ভালো মানুষও বটে।’
হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত মধ্যাহ্ন উপন্যাসটি। তবে হুমায়ুন আহমেদ সাধারণত সমসাময়িক ঘটনাবলি নিয়ে লিখে থাকেন।
তার মূল্যায়নে রকমারি ডটকম লিখেছে, ‘হুমায়ূন আহমেদ এ দেশের একজন জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক। তার লেখনী অসম্ভব রসঘন, সংবেদনশীল ও মানবিক। জীবনের সামান্য একটি ঘটনা, একটা বিশেষ মুহূর্তও তার অসামান্য লেখনীতে অসাধারণ হয়ে উঠতো। তার সৃষ্ট চরিত্রসমূহ সব সময় তৃষ্ণাকাতর। যে তৃষ্ণা জীবনকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা।’
‘সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ’ গ্রন্থে সালাম সালেহ উদদীন স্তুতি করেছেন এভাবে, ‘তিনি সাহিত্যের জনপ্রিয় ধারার পথিকৃৎ। বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের পরে জনপ্রিয়তায় হুমায়ূন আহমেদের নাম উচ্চারিত হবে দীর্ঘদিন।’
একজন সফল লেখক হিসেবে সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাকে এনে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা। বহুমাত্রিকতা তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তিনি তার জীবনে বহু সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই  এই নন্দিত লেখক ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে অন্য ভূবনে চলে যান।
আজ আমাদের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে নেই। কিন্তু তার কথা, তার চিন্তা, তার গল্প, তার জাদু এখনো আমাদের সাথে আছে। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক মুকুটহীন সম্রাট। বাংলা সাহিত্যের এক নতুন সূর্য ছিলেন হুমায়ূন। সবচেয়ে তেজী সূর্যদেরও একজন বললেও খুব বেশি বলা হবে না।
আজ সেই কালজয়ী, শক্তিমান, প্রতিভাবান ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিক। তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।

পদাবলি

পদাবলি


দুঃসময়
চন্দনকৃষ্ণ পাল

মাটির প্রদীপ ছিলো খুব কাছে, আজ তার শরীরে ধুলো
প্রদীপের স্থানে আজ মোমবাতি
দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে এই বুঝি প্রজ্জ্বলন হলো
এই বুঝি আলোতে মাখামাখি হয়ে গেলো সব তৈজস!

জ্বলে কই? জ্বালানোর দায় নিয়ে যে আজ এসেছিলো গৃহে
সে দেখো বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া চাখে
শহুরে তালের টেকে গ্রামীণ শব্দ খুঁজে ফিরে
কচুরীপানার ঝোঁপে ডাহুকের চলা ফেরা দেখে
আর দেখে বহুতল ভবনের আকাশ ছোঁয়ার নেশা...

স্বপ্নের সাইনবোর্ড জ্বলে নেভে এরে ওরে আহবান করে
সেও সেই আলোকেই ভালোবেসে সন্ধ্যে কাটায়
মোমবাতি অন্ধকারে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখে
মানুষের জ্ঞানহীন কা-কারখানা
তার চোখে জল নেই, থাকলে দুঁ’ফোটা দিতো ভূমিকেই,
স্বাক্ষী হতো সাথে তার দুঃসময়ের।

একশত বিলিয়ন নিউরনের কসম
শাহীন মাহমুদ

কার্বন যৌগ বলেই খালাস
কাঠ-কয়লা বোঝাতে চাইলে নিশ্চয় ?
কোটি কোটি নিউরনে তুমি ভেসে গেলে
এই অযাচিত বিস্মরণে তুমি প্রজাপতিকে সাপ
আর সাপকে  নির্মোহ প্রাণ বলে দিব্যি চালিয়ে দিতে চাইলে
আসলে তুমি ও কি সেই জাতের পাগল?
নিউরনের গহীনে আঁক মায়া নামক এক নর্দমার তৈলচিত্র
হীরার উলটো পিঠে ভুলের মাশুলে কাঠকয়লায় পোড়াও
একশত বিলিয়ন নিউরনের কসম ।
তুমি বেঁচে থাকো আজকালকার সম্মেলক স্মৃতিঘরে
লোভ, মোহ আর মায়ায় থোড়াই নিকুচি করি ।
তবে তাই হোক; রয়ে যাক তোমার সেই নৈতিক অসুখ
এসো তবে অযৌন প্রক্রিয়ায় বংশ বিস্তার করি
তোমার মতো আমিও মানুষ হতে চাই
তোমার মতো আমিও মুক্তজীবি প্রাণী হতে চাই ।

ভালোই তো আছি
রেবেকা ইসলাম

বেশতো ভালোই আছি,
বখাটে মেঘের সাথে সন্ধি করে
আঁচলটা মেলে দেই নির্দ্বিধায়,
কুঁকড়ে যায় কুন্দনের দস্যি কাজগুলো,
যৌবনের ভাঁজে ভাঁজে তখন ভেজা বিকেল....
আজকাল কষ্টের নিশিন্দা তিতা
আমায় করে না অস্থির,
স্বপ্নভূক কীটের আক্রমণে হইনা ধুন্ধুমার
দীর্ঘশ্বাসের ট্রেন চলে যায়,যাক না
আমার এক হাতে হেমলকের পেয়ালা
অন্য হাতে শত পঙ্ক্তির বেণী
তারপর শ্লথের গতিতে নেমে আসে রাত
নাগেশ^রের থোকায় থোকায়
ঝুলন্ত বারান্দার পাঁজরে,
ভালোই তো আছি কবিতাপুরে।


দিন শেষে...
শাহমুব জুয়েল

১. কোন এক প্রাণবন্ত ক্ষনে জ্ঞানের দড়ি ধরে পারাপার, ভেজা ঘাসের উপর অপুষ্ট তরুণ ছিলাম;
তাই নজর লাগেনি কারো দু’ একজন এলেও বাদামের খোসার মত রয়ে গেছে দূর্বাঘাসে; আড়ালে
অভাবী কিন্তু ইনোসেন্ট ওতে কী আর জীবন বাঁচে; সেদিন বড্ড কষ্ট হতো, নেহাত অসহায় ভেবে...

২. দু’নম্বরী বন্ধুর পাল্লায় পড়ে পার করেছি যুগলের ব্যাগ কখনো নদী, কখনো রেল কখনোবা ফুসকা
স্টফেজ সব সালারই গার্লফ্রেন্ড আছে, আমার ভয়েস আছে গেলাশে গেলাশে কষ্ট ঢালি,
ললিত প্রান্তে বন্ধু নাকি শিয়াল- কুকুর হজম করি অজান্তে...

৩. গুরু ছিলো বৃক্ষ সমান, আদর করতো নিজ সন্তান শিখাতো নীতির কাঠি, জ্বলতো শুধু পরান
কবিতাই আমায় খেলো, কে যেন এগিয়ে এলো অভাবের কবিতার সম্মুখে প্রেমের কবিতা গেলো
শরীরে এলো বিরহের চুম্বন, এবার বুঝি হৃদয় দহন চারটি সিঁড়ি হলো মেঘনাসম, লাগে ঝড় পবন...

৪. দুপরের খানা খেয়ে যুগেছে হিশেব, আমি টিউটর সাব- মস্ত দিন শেষে জিবিকার সন্ধানে অঙ্গন ত্যাগ
ওহ কী দু:সহ সময় কেটেছে যেন ঘন মেঘ, চায়ের বাগান হাওড় বাওড়, স্বপ্নময়নদী পড়ন্ত বিকেল শেষে
বিরহ কাটেনি তখনো, প্রথমপাঠের গ্রাসে অজানা ডট থেকে একটা স্বর এসে, দুটো পাঠক মিলে গেলো-
গ্রন্থাগারের পাশে...


আশা নিরাশার ঢেউ
সাইয়্যিদ মঞ্জু

মহাজনের সিন্দুকে নিবসন
বাড়ি ভিটার পুরানো তকসিমনামা
জননীর বালাহীন দু’হাত, দুলহীন কর্ণদ্বয়
নাকের ছেদিত ছিদ্রে নিঃসঙ্গ নাকফুল
তবুও হয় না কিছু
অস্থির পিতার প্রবোধদায়ী হস্ত স্বজনের দিকে।

পসরা সাজিয়ে বসে আছে সওদাগর
সোনার হরিণের অদৃশ্য হাটে,
কড়ির ঝুলি নিয়ে হাজির বিদ্যাওয়ালা ক্রেতা
লেনাদেনা শেষে,আশা নিরাশার ঢেউ
অতঃপর ঘর অভিমুখে ক্লান্ত যুবক।

আগেরমত ঘুরে না যেন সময়ের কাঁটা
পরিমিতকাল অপেক্ষা আর অপেক্ষা
বুঝি না এই আমি
সত্যি কি কিছু হয়!


শর্তহীন শর্ত
সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

যতদিন
তুমি রবে না শর্তহীন
ততদিন
আমার সবকিছু অর্থহীন।

যদি না এই শর্ত মানো,
আমার বাঁচা কঠিন হবে
কী ভবিষ্যৎ বর্তমানও।

যতবার
দাবি করেছি অধিকার
ততবার
ভেবেছি তুমি নদী কার?

তুমি আমার যদি হবে,
তোমার শর্তে কেঁদে কেন
আমার দুচোখ নদী হবে?

পাগলের কোনো ধর্ম নেই
যাহিদ সুবহান

মানসিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে মানুষ
আমরা সবাই যাকে পাগল বলে সজ্ঞায়িত করি
পাগল অন্যের ঘরে আগুন দিতে জানে না
পাগল ধর্মের জন্য করে না কারো শিরচ্ছেদ
পাগল তার চোখ দিয়ে শুধু মানুষ দেখে
পাগল জানে ধরণীর সব মানুষই মানুষ
পাগল জানে না সব ধার্মিকই মানুষ নয়
পাগল জানে না মানুষ আর ধার্মিক ভিন্ন
পাগল জানেনা ধার্মিকও অমানুষ হতে পারে
পাগল তো পাগলই আমাদের চোখে
পাগল ঈশ্বরকেও মানুষ ভাবতে পারে
পাগলের কোনো ধর্ম নেই পৃথিবীতে
পাগলের কোনো ধর্ম থাকতে নেই ...   

নিথীথের গল্প
সাজ্জাক হোসেন শিহাব

আমি জেগে থাকি একা কীর্তনখোলাতে
উালাফালা চোখে দেখি নদীর আকুতি!
নিথীথের গল্প শুনি শো শো আওয়াজ !
বিষণœ রজনী একা একা কাঁদে হায়
বুক চিরে বের করে বেদনা গল্প ।
আতœাহীন নগরীতে কিসের কৈতর
আসে অবেলায় ! ফরফর করে
এনদ্বীপে ! একা বার্তা আসে জীবনের-
যে বার্তা কেউ ডিকোড করেনা কখনো ।

জুতার তলা খোয়ানো মানুষ
মোহাম্মদ অংকন

পথ-ঘাট চেনা; তবুও মাঝে মাঝে হোঁচট খাই, পড়ে যাই, ঘুরে দাঁড়াই। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে চোখ মেলতেই যা দেখতে পাই; সে কথা ভাবতেই আমার একটা দীর্ঘকাল কেঁটে যায়।

প্রতিদিন তাঁজা গোলাপ ছিড়ে এনে ফিওে নিয়ে ডায়েরীর ভাজে লুকিয়ে রাখা কতটা বিষাদের; তা শুধু জুতার তলা খোয়ানো মানুষগুলোই অনুধাবন করতে পারে।

পথ-ঘাট চেনা; শুধু চিনতে দেরি হয় জানালার পাশে বসে থাকার মনীর মনটাকে; সে একবারও চেয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনা- কোন সে পথিকতার জন্য জুতার তলা ক্ষয় করছে!


কষ্ট-ব্যর্থতা-বেদনা সীমাহীন
সিরাজ অনির্বাণ

অবিরাম নির্বাক কান্না হৃদয় করে ক্ষত বিক্ষত
অতীত-এ্যালবামে স্বপ্ন-কণা রেখে অজানায় চলে যায়
বিশ্বাসী হস্ত-পদ-নাসিকা-বদন আর মায়াবী কণ্ঠস্বর।

প্রাথমিক পুষ্পানুভূতিগুলো ধরে রাখার প্রত্যাশায়
জোড়া-মন চোখে স্বপন মেখে ডুব দেয় সময়-হাওড়ে
পানকৌড়ির মতো টুকে টুকে খুঁজে নিতে আবেগের কণা।

বিসর্জনের পরে যখন ফিরে আসে শ্রান্ত হয়ে মলিন মুখে
ফিরে আসে ব্যর্থ জীবন একমুঠো নীলিমা বুকে করে
বাস্তবতার রাজপথে তখন বেজে ওঠে বিরহীবংশী
একমুঠো বিষাক্ত-বাতাস এসে নিভিয়ে দেয় সংগ্রামী প্রদীপ
অন্ধকারে ভেতরে বসে কাঁদে রক্তাক্ত বেদনার দল।

সোনালি দিনের শেষে মৌনতা ঘিরে ধরে মুখরিত চারদিক
পূর্বাকাশের সূর্যটা বলে দেয়-
সত্যিকার ভালোবাসায় কষ্ট-ব্যর্থতা-বেদনা সীমাহীন।


ব্যয়বহুল কথার মলাটবন্ধি
শহিদুল আলীম

হে মাননীয় সাংসদবৃন্দ,
হে মাননীয় মন্ত্রীপরিষদ,
আপনারা সুরক্ষিত সংসদে দাড়িয়ে যখন কথা বলেন
মিনিটের লক্ষ-লক্ষ টাকার ব্যয়ভার আমরাই বহন করি
এ-ভাবে হাজার কোটি টাকার কথা জমা হতে হতে-
দামি অফসেট পেপারের মোটা যে বইটির
আপনারাই নাম রেখেছেন, পবিত্র সংবিধান
আমরা আমজনতা,
তার ভিতরের জমানো কথার ক’টা কথা আমরা জানি!
এতো সাধনার এতো ব্যয়বহুল কথাগুলোর ক’টা কথা আপনারা মানেন?
তার একটা হিসেব হোক।
আজ অরক্ষিত রাজপথে তপ্ত রোদে দাড়িয়েÑ
বৃষ্টিতে ভিজে হিসেব চাইতে এসেছি বিনা খরচে!
আপনাদের খরুচে-কথার, অপব্যয়ের হিসেব নাইবা দিলেন!
দয়া করে বিনামূল্যের কথার উপর জলকামান ছুড়বেন না...


কবিতা আর লিখব না
আবু আফজাল সালেহ

কবিতা আর লিখব না!
কবিতা লিখতে বোলো না আমার।
মানচিত্র ছিঁড়ে খেতে চায় শকুনেরা!
দেশপ্রেম নেই আজ; শুধুই কাগজে-কলমে।
নিজ স্বার্থের কাছে বিকিয়েছি তা!

কবিতার শব্দগুলো আসে না এখন
বিমুখ কবিতাগুলো দলছুট হরিণের ন্যায়।
আমরা সবাই রঙিন চশমা পরে-
তাই কবিতার শব্দগুলো আসে না ঠিকমতো।
কবিতাগুলো চিল্লিয়ে বলে- ওহে কবি
রঙিন চশমা খুলে রাখুন-
নাহলে আমি পালালাম




মগ্ন চৈতন্যে
সুমি সৈয়দা

এসো এসো নহলী
           মগ্ন চৈতন্যে লুট করি রোদ্দুর

আত্মার নিভৃতে পুড়ুক
রোহিনী বিনিন্দিত প্রেম

হে নীলাম্বু যৌবন
                পান করি প্লাবনের মালকোষ

অচেনা অনুভূতি হারাক
লুন্ঠিত মজনুন ভালোবাসায়।

দেয়াল প্রেমিক
বিটুল দেব

দেয়ালের শব্দফুলে দারুণ সুবাস। কালোফুলের বিন্যাসে মুগ্ধ চিত্ত পাঠে, ডুবে যাই রূপরেখার মায়ায়। মনে ধরে, দেখতে প্রতিভাবানের আলো। হায়... কবি! প্রথম আঁকিবুকির দেয়াল। হয়ে যায়... শব্দের দেয়াল প্রেমিক। মাঝে মাঝে হতভম্ব, এমন বিচিত্র আনন্দ আয়োজনে।
নরোম করতল স্পর্শের চেয়ে হাজারগুণ আমোদের আকর্ষণ। সুরার পেয়ালা নিয়ে মনোহরণীর আপ্যায়িত চোখ আর মনচুরি হাসির স্বর। লিওনার্দো হার মানতো যদি দেখতো দেয়ালের কারুকাজ।
 

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : পর্ব ০৩

ধারাবাহিক উপন্যাস : রামবন্দনা : পর্ব ০৩


রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ

(গত সংখ্যার পর)
তারপর দাগ ধরে ধরে ডেকোরেশন থেকে শুরু করে প্লট-সংলাপ-চরিত্রসমূহকে কীভাবে বীণার তারের মতো সেট করতে হয়। এসব শিখতে শিখতে একদিন টের পাই ও ক্রমশ আমার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি? না, পারি নি। সে যে অভিনেতা। অভিনয়ই যার সারাজিন্দেগির পাথেয়— ইহকাল-পরকাল। সেখানে আমার স্থান কোথায়? আমিও যে নারী, হারিয়ে যাবার দলেরই একজন। সকালে সিরাজ-উদ্-দৌলা’র চরিত্রে নেমে বিকেলেই মীর জাফরের পোশাকে দাঁড়িয়ে যায়, একটা দিন পেরোতে না পেরোতেই হিজড়া হয়ে হাতে টেপ্পা মারতে মারতে সারা মঞ্চ নাচিয়ে তোলে। এতো ছলাকলা কি আমি বুঝতে পারি? আমি তো চেয়েছিলাম, বঞ্চিত মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর হতে। যেখানে ছলাকলার কোনো স্থান নেই। যেখানে কেবল বেঁচে থাকা তাগিদেই খাদ্যগ্রহণ কিংবা অন্যকিছু। কখনো কখনো এমন ভাবও করতো, ভাবতাম এবার নিশ্চয়ই সিরিয়াস কিছু বলবে। ভেবে ভেবে সারাপথ বারবার শরীর চিড়িক দিয়ে ওঠেছে। জিভের ডগায় পানি বারবার পাতলা হয়ে এসেছে। পরে দেখি রিক্সা থেমে গেছে এক বিশাল হলরুমের সামনে। আমাকে ভিআইপি লাইঞ্জে বসিয়ে দিয়ে ও চলে গেছে সাজঘরে। যে সাজঘরে ইচ্ছে করলে আমিও যেতে পারতাম। ভাবলাম, সাজঘরের পাশাপাশি রাজঘরটাও তো দরকার। আর সেটা কোনোভাবেই উত্তরাধিকারসূত্রের উচ্ছিষ্ট হিসেবে নয়, নিজের হাত-পায়ের কামাই হিসেবে, মেধা-মগজের আউটপুট হিসেবে, রাজপথ ধাবিয়ে পেতে চাই। তবেই যদি আমাদের কিছু হয়। *****
এখন তো সবই পরিষ্কার। অভিনয়ই সব। কৃষ্ণ অভিনয় করেছে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, জিউস অভিনয় করেছে হীরার আড়ালে অজ্ঞাত কোনো পাহাড়ের গুহায় নিয়ে... মহাদেব তো আরো সাত পা এগিয়ে। আর কেউ নয়; সব তিনি একা ভোগ করবেন। যে-জন্যে নারী-পুরুষের প্রেম-প্রীতি তো দূরের কথা দৃষ্টির ত্রিসীমায়ও কেউ কারোর দেখা-সাক্ষাত হয়েছে, জানতে পারলে সাথে সাথে চিতায় নিক্ষেপের আদেশ। মা-ভগিনি-কন্যা সব কেবল তার জন্যে। কখনো একজনকে, কখনো অনেকজনকে। একসাথে। এভাবেই চলছে অদ্যাবধি। একেই বলে, জোর যার...। সব নিজের ভোগে রেখে দিয়ে গলায় লাল-সবুজের উত্তরীয় ঝুলিয়ে দিনের পর দিন অভিনয় করে যাচ্ছে। দেশপ্রেমের চমৎকার সব বাণী উড়িয়ে হাত তালি বাজিয়ে নিচ্ছে। কে হাত তালি দিলো আর কে দিলো না, কে মিটি মিটি হেসেছিলো, হাসিটা কি আবেগের ছিলো? নাকি অন্যকিছু। সবই রেকর্ড হচ্ছে অদৃশ্য ক্যামেরায়। স্বয়ং মহাদেব নাকি সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন।
কথাগুলো যে ভিত্তিহীন নয়, তা বুঝতে দেরি হয় না কারোই। মিটিং-এ না যাওয়ার অপরাধে সিদ্ধিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে, ফেসবুকে দু’কথার এক মন্তব্যের কারণে আহমেদ ফকিরের ছেলে তুষার কবিরকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়, ইউটিউবে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়, সে দোষ গিয়ে পড়ে ডা. সুমিতের ঘাড়ে। তারপর থেকে সে নাকে কর্পুরের গন্ধ পায়। ঘুমের ভেতর কীসব দেখে বিছানায় লাফিয়ে ওঠে। কেউ একজন বললো, শুধু আমাদের ঘুম কাড়ে নাই, ঘুম কেড়ে নেওয়া হয়েছে মৃত্যুদেরও। হয়তো তাই। এজন্যেই বোধ হয় রাত নেই দিন নেই, কালো বাহিনি, সাদা বাহিনিসহ আরো নানা বাহিনির পোশাকের আড়ালে মৃত্যুরা মৌজার খতিয়ানসহ একেবারে দোর-গোড়ায় এসে হাজির হয়। এসব আতঙ্কে আমার চোখেও ঘুম আসে না। আবার যে জেগে থাকি, তাও নয়। চিৎকার আর আর্তস্বরের স্্েরাতের ভাসানে হারিয়ে যেতে যেতে আমি হয়ে যাই প্যারালাইসিস রোগী। ঘুম-সজাগের মাঝামাঝি এক ধরনের অবশ হয়ে থাকি। তখন অনেক কিছুই ভাসে চোখে। অনেক কিছুই দেখি কিন্তু কোনো কিছুই স্পষ্ট করতে পারি না। ধোঁয়া দেখি। আগুন দেখি। আকাশ ফেটে-পড়া শব্দ দেখি। দেখি মৃত্যুদেরও।
ইদানিং মৃত্যুদেরকে শহরের গলি-ঘুঁজিতে বেশি দেখা যায়। তাদেরও নাকি দাবি-দাওয়া আছে। যখন-তখন মৃত্যুদেবের ডাকে সাড়া দিতে দিতে ক্লান্ত...। বিশ্রামের প্রয়োজন। চাকরির নীতিমালা প্রয়োজন। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গলির মোড়ে মোড়ে। আমি দেখি, মহল্লার সবাই পোস্টার পড়ছে। পড়তে পড়তে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া মানেই চোখে অন্ধকার দেখা। বাবা একদিন তার সহকর্মীদের নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো। ভেবেছিলো, গহীন অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো পথ পেয়ে যাবে। কিন্তু পেলো কই। আসলে ওটা ছিলো তাদের চোখের ভেলকি। নয়মাস অভুক্ত আর ঘুমহীন থেকে হঠাৎ চোখ মেলেছিলো তো, তাই বুঝতে পারোনি। চরিত্রহীন দেবতারা তোমাদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে এক অরন্য থেকে বের আরেক অরণ্যে ছেড়ে দিয়েছিলো। যে অরণ্যের শেষ কোথায় আমাদের কারোই জানা নেই। যাক ওসব। মহল্লাবাসীদের কথায় ফিরে আসি। তারা কেবল অন্ধকার দেখতে থাকে। চোখে পড়ে একটা কায়া কালো আল-খেল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন কেউ একজন আল-খেল্লার আস্তিন ধরে টান দেয়। একটি একটি করে খসে পড়ে সবকটা বোতাম। তখন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়। তারা কি তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে ওঠবে? কিংবা বেদনায় নীল হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়বে? না, কোনোটিই করে না। কারণ তখনই টের পায়, কেউ তাদের নড়া-চড়ার স্বাধীনতাটাকে আমূল কেটে দিয়েছে। তখন আমার কেনো যেনো মনে হয় সবাই নিরীহ কচ্ছপের অভিনয় করছে। পরিবেশ অনুকূল দেখলে ভেতর থেকে গলা বের করে আর প্রতিকূল দেখলে সাপে ধরা ব্যাঙের মতো মরার ভান ধরে। এজন্যে শহরে পর্যটকদের মধ্যে অনেকেই বিটলামি করে বেড়ায়। বলে, মহল্লার পুরুষরা নাকি রক্তশূন্য বর্ণহীন রোগী। কেউ বলে, তাদের নাকি প্রাণ নেই। তাদের প্রাণ নাকি সময়ের উল্টোস্্েরাতে ভাসতে ভাসতে প্রাগৈতিহাসিক কোনো এক আদিম পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। কোনোক্রমে সেখান থেকে ছাড়াতে না পারলে একবিংশ শতাব্দি তথা উত্তরাধুনিক ডিজিটালাইজ্ড যুগে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ততোদিন পর্যন্ত তাদেরকে প্রাণহীন লাশের মতোই চলতে হবে। কেউ বলে, তারা অপ্রকৃতিস্থ। তাদের আচার-আচরণ নাকি বেশ দুবোর্ধ্য। ফাগুনের পাগলা বাতাসের মতো। কখন কী করে, কোথায় যায়, কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই।
লোকের কথা শুনে আমার হাসি পাই। রেণু ফেসবুকে পোস্ট দেয়। ‘প্রাণ না থাকলে আমাদের পুরুষরা চলাফেরা করে কীভাবে? খায় কীভাবে? বিয়ে করে কীভাবে? সন্তান উৎপাদন প্রতিযোগিতায় বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন হয় কীভাবে? জ্যৈষ্ঠের শেষ দিকে যখন কারওয়ান বাজারের ফল ব্যাপারিরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রকার আম কিনে তাদের সামনে এনে নামায়, তখন তো তারা ঠিকই কোনটা ল্যাংড়া, কোনটা আশ্বিনা কিংবা কোনটা বোম্বাই-বৃন্দাবনি-লখনা, কোনটা খেতে চুক্কা, কোনটা মিঠা, কোনটার ঘ্রাণ কেমন, সবই ঠিকঠাক মতো বাছাই করতে পারে। তখন পারে কীভাবে? কিংবা আঠারো প্রকার একজিমা থেকেও শুধু চুলকানির ধরন দেখেই কার শরীরে কোন প্রকার একজিমা এবং এর জন্যে কোন বড়ি খেতে হবে, ডাক্তার-বৈদ্য ছাড়াই তারা ঠিকঠাক মতো ওষুধ কিনে সেবন করতে পারে। তখন পারে কীভাবে?’ পোস্টটা পাবলিক স্পেসে ছাড়তে না ছাড়তে লাইক-কমেন্টস্ এ ভরে যায়। শাকিলা নামে এক মেয়ে লিখেছে, আপনার সাথে একমত, সাথে আরেকটু যোগ করি, রমণক্রিয়ায়ও বাঙালি পুরুষরা যথেষ্ট দীর্ঘমেয়াদি। নাবিলা নামে আরেক মেয়ে লিখেছে, তাদের বাসার সাথের ইটভাটায় এক লোক মাথায় বত্রিশটা ইট তুলতে পারে। কেউ লিখেছে মুসা ইব্রাহিমের নাম। আরেকজন লিখেছে আমাদের এখানে একজন আধ্যাত্মিক সাধক যার সেক্স পাওয়ার কুকুরকেও হার মানায়। উদাহরণ হিসেবে সে কয়েকটা ঘটনাও উল্লেখ করেছে। আরো অনেকেই অনেক কথা লিখেছে। তবে বেশির ভাগ মন্তব্যই ছিলো, যৌন বিষয়ক। বিশেষ করে মেয়েদের মন্তব্যগুলোতে। তাছাড়া এটা যে আমাদের কাছে কতটা কৌত’হলের, তা আমরা কজন একসাথে বসলেই টের পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে মিথিলা অদ্বিতীয়া। একবার ওর মুখ ছুটে গেলে নিজেদের গোপন কথা থেকে শুরু করে ওদের বিল্ডিংয়ে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে কার মরদ কতক্ষণ থাকে সবই শেয়ার করে দেয়। তখন হাসতে হাসতে আমাদের অনেকেরই পেটে ব্যথা ধরে এলেও ওর মুখ থামে না। আর যদি কোনো কারণে থামেও সঙ্গে সঙ্গে অন্যজন শুরু করে দেয়। বানু খালাও কম যায় না, এ বুড়ো বয়সেও নাকি কোনো রাত মিস নেই।
এতোকিছু পরও যখন বলে, আমাদের পুরুষরা প্রাণহীন। তখন আমি ওটাকে উসকানি বা বিটলামিই মনে করি। তবে কেনো যেনো মনে হচ্ছে শহরের লোকেরা কোনো কারণে নাটক করছে। হয়তো তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে যে, এখন থেকে ঠাডায় মরা লাশের মতো কেবল চেয়ে থাকবে। কোথাও কোনো অন্যায়-অপরাধ করবে না। দেবতাদের কোনো কাজে বাঁধাও দেবে না। এমনকি তারা ইতিহাসের সবকটা পাতা নিলামে কিনে নিলেও কেউ কিছু বলবে না। তাদের পাপের দায় গ্রহণ করতে গিয়ে পৃথিবীর সব শ্বেতপাথর কালো হয়ে গেলেও কিচ্ছু বলবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনোকালেই ভালো কিছু বয়ে আনেনি। এবারো ব্যর্থ হলো। পণ করে যখন সবাই কিছুদিন চুপচাপ বসে থাকলো, তখনই শোনা যায় দেবতারা আমাদের উপর চটা।
কারণ কী?
তখন বিরোধী দলীয় এক দেবতা জানায়, চটবেই তো। তোমরা এভাবে পাপহীন বসে থাকলে তো দেবতাদের আয়ের সব উৎস লাটে ওঠে যে।
 ট্রেনে ফেরি করে যে ছেলেটা, সে তখন বিস্ময়ের দৃষ্টি মেলে বলে, এইডা কী কন সাব! আমরা তো কারো আগেও নাই, পাছেও নাই। ট্রেনত যায়া হারাদিন ঝালমুড়ি বেচি আর সন্ধ্যায় আইসা জাহাঙ্গীরের বস্তিত যায়। ওখানে পা-কাটা বাদইল্যার দোকানে দুই দান লুডু খেলি, পাতাবিড়ি টানি। তারপর কাশতে কাশতে নিজের ডেরায় আইসা হুইয়া থাহি। আমরা আবার কি দোষ করলাম!
উত্তরে তিনি তখন যা বলেন, শুনে আমরা ত্রিশঙ্কু দশায় পড়ে শূন্যে ঝুলতে থাকি। শাস্ত্রে নাকি লেখা আছে, পাপ না করাটাও একটা পাপ। এতে নাকি মনের ভেতর অহঙ্কারের জন্ম হয়। ব্যক্তির মনে অহঙ্কার থাকলে দেবতাদের আসন কেঁপে ওঠে। সুতরাং ব্যক্তিকে পাপ করতে হবে। ব্যক্তি পাপ করলেই বরং দেবতারা খুশি। তাহলেই সার্থক হয় দেবতাদের সৃষ্টিকর্ম। বেকার হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ দেবদূতও কাজ করার সুযোগ পায়। তাদের আয়ের যাবতীয় কার্যালয় সচল হয়। সেসব কার্যালয় সচল রাখতেই আমাদেরকে পাপ করতে হবে। আমরা না চাইলেও অগণিত অদৃশ্য দেবদূত নানাভাবে নানারূপে আমাদের রিপুগুলোকে হাত করে নেয় এবং তাদের মাধ্যমে একটা না একটা পাপ করিয়েই ছাড়ে। এতেও যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তখন নিজেরাই ছদ্মবেশে একটা আকাম করে চালিয়ে দেবে আমাদের নামে। বিশেষ করে আমাদের পুরুষদের নামে।
তারপর সে-পাপের ছুতা ধরে পাঠাবে নরকে। আমাদের পুরুষেরা নরকের আগুনে জ্বলবে। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে আকাশ-পাতাল কাঁপাবে। তাদের পরিবার-পরিজন তখন বস্তাভর্তি পুণ্য নিয়ে দেবতাদের ধারে ধারে পাগলের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাদের পাথর পায়ে মাথা ঠুকতে থাকবে। মনে চাইলে দেবতারা মুদ্রার তালে তালে নৃত্য করতে বলবে। নৃত্য করতে করতে বাংলাদেশি বেহুলারা দেবতাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারলে, তবেই পুরুষরা প্রাণ ফিরে পাবে। প্রাণ ফিরে পেয়ে খুশির দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে সর্বোচ্চ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গড় ভক্তিতে লুটিয়ে পড়বে দেবতাদের পায়ে। দেবতারা তখন তাদের প্লান মোতাবেক কাজ হাসিল হয়েছে দেখে দেবতাসুলভ একটা হাসি দিয়ে বলবে—তথাস্থ তথাস্থ।
এভাবেই দেবতারা মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে থাকে।
সে-প্লানেই কিনা কে জানে। একদিন শুনি মহল্লায় মাইকিং হচ্ছে, পারুল নামে আট-নয় বছরের একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে। মেয়েটির গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। পরনে লাল-সবুজের ডোরাকাটা ফ্রক। যদি কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি পেয়ে থাকেন তাহলে ০১৭৯৬৬৫৪৫৬৫ নাম্বারে ফোন করার জন্য অনুরোধ করছি। শত অনুরোধের পরও কেউ মেয়েটির খোঁজ দিতে পারলো না। মহল্লার সচেতন-অবচেতন নাগরিক, পুলিশ, কেউ মেয়েটির খোঁজ দিতে পারেনি।
এভাবে একদিন যখন সব খোঁজাখুঁজি থেমে যায়, তখন শুরু হয় আমাদের কল্পনার খোঁজ। কল্পনায় দেখি কসাই মিজানের সহকারি আবদুল করিমের ক্লাস থ্রি-তে পড়া আট-নয় বছরের মেয়েটা সন্ধ্যায় পড়তে বসে। পড়ার মাঝখানে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেলে মেয়েটা কিছুই দেখতে পায় না। তখন ঘরের ভেতর সে মোমবাতি খুঁজতে থাকে। মা আনোয়ারা খাতুন জানায়, ঘরে কোনো মোমবাতি নাই। তোর বাপের কাছে যা। গিয়া পাঁচ টেহার দামের দুইড্ডা মোমবাতি আর আড়াইশো গেরাম মুশুরি ডাইল নিয়া জলদি আয়। মেয়েটা তখন মহল্লার মোড়েই মাংসের দোকানে গিয়ে তার বাবা আবদুল করিমকে পায়। এবং পাঁচ টাকা দামের দুটো মোমবাতি আর আড়াইশো গ্রাম মুশুরি ডাল নিয়ে রেখে যাওয়া পড়াটা স্মৃতিতে ভাসাতে ভাসাতে মুন্সি বাড়ির চিপা গলি দিয়ে আসতে থাকে। সে-সময় মুন্সি বাড়ির কালো কুকুরটা কী কারণে যেনো ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে।
(চলবে)