ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ৯৯

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ৯৯
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।।  ধানশালিক ।। সংখ্যা ৯৯
বৃহস্পতিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৮




 















পদাবলি

পদাবলি



ভূত-ভবিষ্যৎ অতঃপর...
মাজেদুল হক

আত্মার অমিয় সুখ-
তপস্যার গৈরিকতায় এঁকে এঁকে খোলস বদলায়
বিনিদ্র চিন্তাধারা, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি লোভ-লালসায়
ভুলে যাই সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পঙ্কিলতা।

ভূত-ভবিষ্য জানবার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও
বিগত দিনের হিসাব-নিকাশ, স্বীকারোক্তির লাল টালিখাতায়
             লিপিবদ্ধ হয় মৃত্যুর ক্রমিক নম্বর।

অভিশপ্ত জনপথ থেকে বাঁচার অদম্য ইচ্ছায় দেঁৗঁড়াতে থাকি
সামনেই দেখি বিশাল আকৃতির কাঁটাতারের বেড়া
                 অস্পষ্ট ভাঙা ভাঙা বড় অক্ষরে লেখা
                          সতর্কীকরণ নির্দেশ...
অতঃপর...
তেড়ে আসে অসংখ্য হিংস্র শকুনের ক্ষুধার্ত চোখ।




মমির অভিশাপ
শাহীন মাহমুদ

মাটির সারাংশে দেখি পিতামহের মুখ
উজান হাওয়া কাটে দায়াদ আকুতি
তুতানখামেন  তুমি তো সত্য-ঘুরছো লাটিম ।
ফারাও গোত্রের ভূগোল
একি গোলক ধাঁধা  
তোমাকে দেখি নাসিরাবাদ,কমলাপুর
এখনো ঘুমঘোরে তোমার অণুতরঙ্গ  ।

হলুদ ক্যালারী পাখি লুকিয়ে আছে শ্বেতপাথরে
পিরামিডের অভিশাপে মৃত মমি তুতানখামেন  
কি করে আবাস পাল্টাও বার বার!


মুখোশায়না ও প্লাস্টিকভাবনা
মাহবুব মিত্র

প্রতিনিয়ত চাষ করি নৈঃশব্দের জমিন; নরোম পায়ে হেঁটে যায় শিকারী বিড়াল, রাজহাঁসের ডিম পড়ে থাকে শ্যাওলাঘন পুকুরঘাটে, কামনার জলে মৃদু ইশারায় মুরগী খুঁজে মোরগের ছায়া, ক্লান্ত বাতাস বসে থাকে বিছানার কোণে মিহি নিরালায়, বেদনাক্রান্ত নিঃসঙ্গ পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে জ্বলন্ত উনুনে, দুরন্ত শিশুটির চোখে স্টেইনলেস রোদের খেলা; কচি-কাঁচা শৈশব ফিরে-ফিরে আসে কবিতার আঙিনায়।

মায়াহরিণ ঘুরছে সোনার জলে... দূর্বাফুলের মতো ফুটে আছে কিশোরী স্তনের বোঁটা আধপোড়া রাতের মগ্নতায়, মানুষের মাথায়-মাথায় ঘুরছে রাবারের বল, ধর্মের বুকে গজাচ্ছে দিনে-দিনে প্লাস্টিকের মরিচফুল, ভিমরুলের আস্তানায় কচি-কচি চোখের নির্মিলিত প্রার্থনা। সিলভার রঙের চাঁদের আলো ছুঁয়েছে গাছের পাতা; যেখানে ঈশ্বরহীন সালোকসংশ্লেষণ।

নাকফুল আর কৃষাণী আমার ঘরের শোভা- আঙিনায় ছড়িয়ে থাকা চুলের সৌরভ, ফুলে-ফুলে মধুবন্তী প্রহরের মুখরিত হাসি, নাকের ভিতর গরম দুধের গন্ধ, নির্ঘুম সিথানে গড়াগড়ি করছে বিষের পেয়ালা, প্রতিটি দরোজা-জানালায় উপছে পড়ছে কুমির-হায়েনা-বিশ্বাসঘাতকের দল, মুখোশের আড়ালে নগ্নতার আয়না, ধর্মের বেঢপ চোখে হিংসার লড়াই, মানুষ গড়ো হে মানবতার দেবদূত; ক্লাশে-ক্লাশে লম্পট শিক্ষকের তীক্ষè দৃষ্টিতে ঢেলে দাও আগুনের নদী।

হে আমার মাটির পুতুল- জমিনের আলে-আলে তোমরা বেড়ে ওঠো, ঘুমিয়ে থাকো শস্যের শয্যায়, শস্যদানা তোমাকে চুমু খাবে, শস্যক্ষেত তোমাকে আলিঙ্গন করবে মাটির কোমল স্নিগ্ধতায়, ফসলের প্রেমে তুমি মুগ্ধ হবে, পান করবে শিশিরস্নাত ধান-দুধ, অতঃপর শস্যসম্ভার তোমাকে বিজয়ী করবে, পুলকিত হবে চোখ-মুখ-শরীর; কবিতার মতো ঘামে-ঘামে জন্ম নিবে কৃষকফুল।




একবার ভালবেসে দেখো
ওয়াহিদ জালাল

একবার ভালবেসে দেখো, এখানেও রাত নামে রাতের মতো । একবার ভালবেসে দেখো,
আজ জীবনে ফসল জন্মে ভালবাসার নামে। একবার ভালবেসে দেখো, প্রাণের আহারে স্পর্শ কেমন মাংসে গেঁথে থাকে আর দুরত্বের কাঁটা কেমন খোঁচা মাড়ে বুকের গভীরে !

একবার ভালবেসে দেখো,
মনে পড়বেই বাসি নিঃশ্বাসের গন্ধ আর বুকের উপর শুয়ে থাকা সেই অন্ধকারের কথা আজকের প্রহরে । একবার ভালবেসে দেখো,
আগুনে পুড়লেও শেষে সেই আগুন জন্মিয়ে যায় আগুনের ভিতর ।

একবার ভালবেসে দেখো,
কারো ভালবাসার স্মৃতিতে পুড়তে কতো আনন্দ জাগে মনে;
মনের টানে মন নামে আগুনে
আর চিতার আগুনকে আপন কতো লাগে ।

একবার ভালবেসে দেখো,
কতো কাঁদলেও শেষে আরো কাঁদতে ইচ্ছে করে খুব একাকিত্বে । একবার ভালবেসে দেখো
কতো ব্যথায় তার বিলাসী করে নিজের মনকে !

প্রয়োজন
জান্নাতুল ফেরদোস লিসা

আমাকে তোমার খুব প্রয়োজন।
ঘুম ভাঙ্গা চোখে এক কাপ চা হাতে তুমি আমায় রোজ দেখতে চাও,
চোখ খুলেই দেখতে চাও-
আমি দাড়িয়ে আছি এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে।
আমার হাতে তখন, রোজ রঙ বেরঙের চুড়ি থাকে।
কাঁচের চুড়ির শব্দ আমার খুব পছন্দ, তোমারো নিশ্চয়ই?
স্নানঘর থেকে স্নানের সময় একটা ডাক আসে-
কই আমার তোয়ালে কই?
আমি এক দৌড়ে তোয়ালে হাতে উপস্থিত।
আমার কপালে তখন নীল বেগুনী টিপ আভা ছড়ায়।
খাবার টেবিলে রোজ নতুন রেসিপি।
তোমার পাতে দেবার বেলায়, আলতো করে তুমি আমার হাত ছুঁয়ে দাও।
সেই ছোঁয়াটা নাকি তোমার খুব প্রয়োজন।
জ্যোস্না রাতে
তুমি আমি হয়ে যাই এক পৃথিবী।
তখন এই পৃথিবীর রাজনীতি, সাইক্লোন, বৃক্ষ নিধন, খড়া
কোন কিছুই তোমায় ছুঁতে পারেনা।
কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে ছোট্টো আওয়াজ তুলে বলো-
এই জীবনে তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন।

সত্যি, তোমার খুব প্রয়োজন আমায়।
সকাল বেলার চায়ে প্রয়োজন
স্নানঘরে তোয়ালে দেবার জন্য প্রয়োজন,
হাতের নরম ছোঁয়া আর
জ্যোস্না রাতে ভালোবাসার পৃথিবীতে ডুব দেয়ার জন্য প্রয়োজন আমায়।
কখনো বলোনি, বাহ্ কাঁচের চুড়ি!
কাঁচের চুড়ির শব্দ আমার খুব পছন্দ।
কারণ-
সে শব্দ যে কখনোই তোমার হৃদয় কুটিরে পৌঁছেনি।
বলোনি- এই টিপটা মানাচ্ছেনা
একটু অন্য রঙ্গের পড়ো না।
খাবার পাতে বলোনি রান্নাটা দারুণ হয়েছে।
সঙ্গমের জ্যোস্নায় ভাসার সময় বলোনি-
তোমায় ভালোবাসি।
তাই সারাটা জীবন আমি তোমার প্রয়োজন থেকে গেলাম,
ভালোবাসা হয়ে উঠতে পারলাম না।
আমার চুড়ির শব্দ তোমার কানে পৌঁছেনা
কপালের টিপ তোমার চোখ এড়িয়ে যায়,
আমায় হালকা ছুঁয়ে দাও
তোমার শরীরে শিহরণ জাগাবার জন্য।
আমায় এই প্রেমের জোয়ারে ভাসাও-
তোমার ক্ষুধার তাগিদে।
তাই আমি তোমার প্রয়োজন, খুব প্রয়োজন।
ভালোবাসা নই।


আমি মানুষ দেখতে চাই
নূরে জান্নাত

সত্যিই কি ওটি মানুষ নাকি মানুষের ছায়া!
আজকাল স্বপ্ন গুলোও ঘুমের মধ্যে নরে চরে বসে! জ্যমিতির কাটায়
টিকটিকির ছবি আঁকি ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ; সেও বৃত্তের বাইরে!
ইরেজারে মুছবোনা বলে কলম হাতে নিয়েছি পেন্সিলের জায়গায়!
স্পর্শ কলমে লাগবার আগেই আমার আঙ্গুলগুলো
হাসির প্রকম্পনে নেঁচে ওঠে!
অংক কষা বড্ড পক্ক মস্তিষ্কের খেলা! আমি তো ঘোলে নেয়ে তুলেছি শুষ্ক মস্তিষ্ক!
ঘি’এর অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া! আমার ঝুলিই ঘিলু ছাড়া খুলিই পাওয়া যায়;
শ্বসান থেকে কুড়িয়েছি কোন এক অন্ধকার আমাবৎশার রাতে দগদগে চিতার পাশে থেকে!!
যখন আমি হাঁটি..
কারা যেন পাশ দিয়ে
বির বির করে মন্ত্র পড়ে!! আমি মানুষ দেখি
আলোর মাঝে আমার সাঁজে।
ও পাড়ের নৌকায় কিছু মাঝি দেখি ওরা মানুষ মাঝি নয়- ছায়া!!
 অসম্পন্ন মধ্যরাতে আমার বুকের ঠিক মাঝখানে পুরে যাবার গন্ধ ছোটে!
অর্ধ মানুষ হওয়া চন্দ্রপূজারীকে করো জরে বলি..
‘আমি মানুষ দেখতে চাই
আমাকে বাদে।’
পূজারী পায়ে শুরশুরি নিয়ে হেঁটে চলে মানুষ রুপে মানুষের ছাঁয়ায়!!
আমি কষ্ট পেতে চাই খুব করে। হে বিধাতা-আমি মানুষ দেখতে চাই! কাঁদতে পারিনা আর!
আমার চোখে কোঠরে মরে যাওয়া স্বপ্ন পিচুটি রূপে গলে যায়
তবুও আমি মানুষ দেখতে চাই।




হেমন্ত কথন
জাহিদ হোসেন

সেবার আউলা বাতাসে দ্বাদশীর চাঁদ ইশারা বোঝেনি,
কুয়াশার অতীত ইতিহাস খুঁজে কোণের টেবিলে বসে
কেটেছে প্রাচুর্যের রাত। কাঁটাঘেরা একটি হেমন্ত
কষ্টের ভাগ নিতে বিনীত অনুরোধ জানায় অঘ্রাণ পাঁজরে।
দ্বাদশীর চাঁদ এক যমুনা প্রেম ঢেলে ঢেলে
ছায়ার ভোর হাতে নিয়ে যায় পাশের বাড়ির ছাদে,
বুকের তলায় পড়ে থাকে নিঝুম দুপুরের রোদ।


মানুষের ভিড়ে মানুষ নেই
মিশির হাবিব

নিকেলমাখা শহরে মানুষের অভাব নেই,
পিপড়ের মতো সারি সারি চলে মানুষ-
ট্যাক্সি, রিকশা আর বাসে চড়ে
মাছির মতো মধুর ওপর
চাদের মতো নীলের ওপর
মানুষের কাধে ঘুমিয়ে পড়ে মানুষ।
আমার একটা মানুষ নেই,
আমার একটা আপন মানুষ নেই,
আমার একটা ভালোবাসার আপন মানুষ নেই।
মানুষ থাকলে দুঃখ হতো না,
প্রেমের নেশায় মনের মধ্যে ছোবল দিতো না;
বাদল দিনে চুপটি করে চোখে চোখে কথা কইতাম,
চুমুর ছলে পেটের মধ্যে শিশুদের ছবি আকতাম;
মানুষ থাকলে ভালোবাসতো
বুকের ভেতর পাখির মতো পুষে রাখতো।
চোখ ফেটে জল এলে ঠোট দিয়ে শুষে নিতো।
আমার কোনো মানুষ নেই,
ভালোবাসার, ভালোলাগার মানুষ নেই।
মানুষ থাকলে সারাটা দিন একা লাগতো না,
তারার মতো চোখ দুটোর রাত জাগা হতো না
শিশুদের  পুতুল আছে
পাখিদের ফুল আছে
তারাদের নীল আছে
আমার কোনো মানুষ নেই
দুঃখগুলো ধার দেবার মানুষ নেই
কষ্টগুলো বোঝাবার মানুষ নেই
আমার কোনো মানুষ নেই
ভালোলাগার, ভালোবাসার মানুষ নেই।




জীবনের আপন মন

জীবনের আপন মন



জীবনের আপন মন
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

বাইরে খুব কোলাহল।
গাড়ির হর্ন, হকারদের চিৎকার, কুকুরদের অসহায় গোঙানি, আকাশের মেঘের কঠিন গর্জন, এলোমেলো বাতাস আর গাছদের থর থর করে কাঁপুনি।
এর মধ্যেও জীবন রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলেছে। খুব অস্থির আর উদ্বিগ্ন মন।
রাস্তায় পথচারীদের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া। একটা বাস যখন এসে রাস্তার ধারে এসে থামছে। তখন মনে হচ্ছে বাসটা যেন  লোভনীয় একটা খাবার। হুড়মুড় করে মানুষ একে অন্যকে ঠেলে বাদুড় ঝোলা হয়ে বাসের বাইরের হ্যান্ডেলটা আঁকড়ে রেখে কোনো মতে নিজেকে ধরে রেখেছে। সময় যেন জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে গেছে।  হয়তো এটাই বাস্তবতা। সময় মানুষকে ফেলে যায় নাকি মানুষ সময়কে ফেলে যায় কে জানে।
হয়তো কেউ জানে, কেউবা জানেনা।
জীবনের কথা বলছিলাম। দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই। জীবনকে বাজি রেখে জীবন দৌড়ে চলেছে। জীবন কি জীবনের পিছনে দৌড়াচ্ছে নাকি জীবন জীবনের পিছে দৌড়াচ্ছে। কে জানে কেইবা বলতে পারে। মানুষের বাইরেরটা দেখা সহজ কিন্তু ভিতরেরটা তো দেখা যায়না।
আশেপাশের মানুষজন। চেনা কিংবা অচেনা। সফবাই অবাক হয়ে জীবনকে দেখছে। চেনা মানুষদের কেউ কেউ চিৎকার করে ডাকছে ‘এই জীবন শুনতো, এতো দৌড়াচ্ছিস কেন? এতো দৌড়াইসনা। থাম্তো এবার। কি হয়েছে ‘তোর। ‘নিরুত্তর জীবন, কোনোদিকে তাকানোর সময় যেন নেই তার।
সামনে চলন্ত ট্রেন। পু ঝিক ঝিক পু ঝিক ঝিক করে ডাক দিচ্ছে।
লোকজন চিৎকার করছে আরে ছেলেটা পাগল নাকি চলন্ত ট্রেনকেও মানছেনা। পাগল থাম থাম, নইলে কিন্তু ট্রেনে পিষে মরবি।
কি অদ্ভুত। লোকজন হট্টগোল করছে জীবনের পাগলামো দেখে।
আর জীবন সুপারসনিক বিমানের মতো ট্রেনলাইন এমনভাবে পার হলো যে আর একটু হলেই ট্রেনটা তার দেহকে থেতলে দিতো।
কে জানে জীবন ট্রেনলাইনটা পার হতে পেরেছে কিনা। মনে হচ্ছে আবার মনে হচ্ছেনা ।
লোকজন তো ভয়ে চোখ বন্ধ করেছে আর খোলার নাম নেই। ভাবছে চোখটা খুললেই মাংস খুবলে পড়া একটা  রক্তাত্ত নিথর দেহ দেখতে পাবে। তারপরও সময়ের সীমা অতিক্রম করে আলতো পাতার চোখ খুলতেই যা দেখলো  তাতে ভয়ে আঁতকে উঠার মতো অবস্থা। আরে এটাও কি সম্ভব! ট্রেন অনেকটা দূর চলে গেছে আর জীবনও ট্রেন লাইন পার হয়ে নদীর বাঁশের সাঁকোটা ঘেষে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই।

সময়ের পিছে পিছে একদল মানুষ একটা লাশ বহন করে চলেছে। কোথায় কে জানে। কার লাশ কেইবা বলতে পারে। হয়তো... চেনা অচেনা একজন মানুষের লাশ। সবাই বলছে গতকাল রাস্তার ধারে দুর্ঘটনায় পরে লোকটা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। আহা মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে একটা বাচ্চা রাস্তার ওধারে দৌড়ানোর সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটা বাসের মুখোমুখি পড়েছিল। লোকটা নিজের জীবন বিপন্ন করে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ে একসময় জীবনের কাছে হেরে যায়।
জীবন জাহাজে সারেং এর কাজ করে। ছয় মাস নীল সুমুদ্রে তার বসতি আর ছয় মাস ছুটি। জীবনের ছয় মাস ছুটির সময়টা চলে এসেছে। এখনো দুদিন আগে জন্মানো সন্তানের মুখটা দেখতে পায়নি জীবন। তাই হয়তো সময়কে আর জীবনকে পিছে ফেলে নিজের অস্তিত্বের টানে নতুন জীবন দেখবে বলে জীবন  ছুটে চলেছে। ছুটছে তো ছুটছেই। বাতাসের বেগকে ছাড়িয়ে এ জন্য অন্যরকম আনন্দের দুঃসহ ছুটে চলা।

জীবনের বউটা জীবনের জন্য বিয়ের বেনারসি লাল শাড়ি পরে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। নাকে নথ, গলায় লাল গোলাপের মালা, খোঁপায় গাদা ফুল, হাতে লাল টুকটুকে মেহেদী আর হাতে রেশমি চুড়ি । কিন্তু প্রতীক্ষা যেন ফুরায় না। হয়তো অপেক্ষাটা দীর্ঘ যুগের মতো। মন প্রেমে অস্থির হয়, আবেগের ব্যাকুলতা বাড়ে। কে যে কমে না কে জানে।
জীবনের বউ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখে। ঘুমকে হারা মানাবার কত চেষ্টা। হার মানে ঘুম কিন্তু মন তো মানে না।
বউ বউ চিৎকার শুনে জীবনের বউ। জীবন এসেছে জীবন। কিন্তু আবছা ছায়ার মতো। বউটা ধরতে যায় কিন্তু ধরতে পারেনা। কোলের সন্তানকে জীবনের বুকে তুলে দিয়ে মহামিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ দেখতে চায় জীবনের বউ মন। জীবনের মন পাখি, নামটাও মন। কিন্তু জীবনের আদরের হাত দুটো তার সন্তানকে কেন যেন ধরতে গিয়েও ধরতে পারছেনা। একটা দুঃসহ আনন্দ চোখের জলের যন্ত্রণার মতো যেন ছটপট করছে। সন্তানের নামও রেখেছে জীবন  খুব সুন্দর একটা নাম আপন। খুব মেলানো একটা শব্দের মতো। জীবনের আপন মন।
কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা জীবনের বউ। জীবন দূর থেকে ছায়া হয়ে দেখছে তার আরেক নতুন জীবন।
বাইরে হট্টগোল। আহা বেচারা মারা গেলো ।
আতংকে আঁতকে উঠে মন। কে মারা গেলো।
তারপর নিঃশব্দ। চিৎকার করে আহাজারি। লাল গোলাপ লাল রক্তের উপর আছড়ে পরে। গাদা ফুলগুলোর গন্ধ হারিয়ে যায়। বেনারসি শাড়ি বিবর্ণ হয়। রেশমি চুড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো কাচের বৃষ্টি হয়। আনন্দ, অপেক্ষা আলো থেকে আধার হয়।
জীবন এসেছে কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। জীবন এখন মরণ হয়ে গেছে।
জীবনের লাশটা বয়ে নিয়ে আসছিলো কিছু মানুষ।
কিন্তু জীবনের অতৃপ্ত আত্মাটা সন্তানকে দেখবে বলে দেহ থেকে বের হয়ে বাতাসের মতো শুধুই দৌড়েছে। দৌড়েছে আর দৌড়েছে।
জীবনের বেঁচে থাকা দেহহীন আত্মাটা আগে এসেছিলো মনের কাছে। আপনার কাছে।
তারপর আত্মাটা পাখি হয়ে উড়ে গেছে নির্বাসিত জীবনে।
এখন এসেছে মৃত দেহটা।
জীবন মরেছে। কিন্তু দুটো জীবনের জন্ম দিয়েছে।
একটি রাস্তায় পার হতে চাওয়া আরেক মায়ের সন্তান। আরেকটি তার সন্তান।
জীবনরা এভবেই জীবন দিয়ে মরে যায়। মন্দের কপাল পুড়ে। জোড়া লাগেনা কোনোদিন।
সময় গোড়ায়।
আপন এখন বড় হয়েছে। ঘরে তার বৌ এসেছে। নিজের সন্তান হয়েছে।
জীবনের কথা কেউ মনে রাখেনি। মনও না। আপনও না।
মন বিয়ে করে আরেক মনে জায়গা করে নিয়েছে।
সব কিছু যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু একটা জীবন ছিল তা সবাই ভুলে গেছে। হয়তো এটাই জীবনের মরণ।
আজ আবার রাস্তায় দেখতে পেলাম জীবনকে। তবে কি জীবন বেঁচে আছে। যদি বেঁচে থাকে তবে হয়তো মরণের ভান করে জীবন পরখ করেছে কেমন করে একদিন আপন মন পর হয়ে যায়।
এটাই হয়তো সময়। জীবন চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে দূর আকাশের তারাদের সাথে।
পৃথিবীতে কেউ আপন নয়। না নিজের মন, না জীবন। তারপরও অসমাপ্ত জীবনের গল্প লেখা থাকে সময়ের অদৃশ্য খাতায়।




পয়সা

পয়সা







পয়সা
হালিমা মুক্তা

পদ্মা নদীর পাড়। দক্ষিনে ও পূর্বে পশ্চিমে অবারিত পানি। উত্তরের চরে জব্বার মিয়ার বসবাস। মোট ২৮-২৯ টি বাড়ি। বাড়িতো নয় খুপড়ি যাকে বলে। আগে জব্বার মিয়ার বাড়ি ছিল। জায়গা জমিন সব ছিল। পদ্মার পূর্ব পাড়ে। কিন্তু পদ্মা নদীর পাড় ভেঙ্গে তারা হলো ভিটে মাটি হারা। আজ ১০ বছর হলো এই উত্তরের চরে আছে তারা। প্রথম এই চরে ঘরখানা উঠিয়েছিলো জব্বার মিয়ার বাবা লতিফ সরদার। লতিফ সরদার বলেই সবাই জব্বার মিয়ার বাবাকে ডাকতো। লতিফ সরদার ছিলো সৎ এবং ন্যায় পরায়ণ। চর এলাকায় তার বেশ শুনাম ছিলো। বিচার বিয়ে শাদিতে সবাই তাকে ডাকতো, মান্য করতো। জব্বার মিয়ার এখন আর আগের মতো সংসার ভালো চলে না। চরে মসজিদে ইমামতি করে আর কয়টাকা যোগানো যায়! পূর্বে ভিটে থাকতে লতিফ সরদার সবার থেকে ঈলিশ মাছ কিনে বড় পাইকারি হাটে বিক্রি করতো। জব্বার মিয়ার বাবার সাথে ঈলিশ মাছ ধরতে যেত মাঝে মাঝে । সে সব অতীত এখন আর ঈলিশ আগের মতো ধরা পড়ে না। জব্বার মিয়া মসজিদে ইমামতির কাজটা নিয়েছে তাছাড়া ঈলিশ ধরা এখন আর ভালো লাগে না। শরীরটা আর চলে না। সারাদিন কাশতে কাশতে জীবন ত্যাক্ত। জব্বার মিয়ার রাতে রাতে জ্বর আসে। হাঁপানী টাও বেড়ে গেছে। রাতে কাশির চোটে ঘুম আসে না। জব্বার মিয়া এপাশ ওপাশ করতে থাকে। রহিমা পাশ ফিরে ঝাঝালো স্বরে বলে উঠে আপনের জ্বালায় আজ বোধ হয় ঘুম হবে না। আজ দুই রাত এরকম শুরু করছেন। দিন ভরতো আমাকে গাধার খাটুনী খাটতে হয়। তাছাড়া একটা ট্যা ট্যা তো আছেই। রহিমার চোখ একটু ধরে আসে। পাশ থেকে রহিমার এক বছরের মেয়ের কান্না শুরু করে। মেয়েটারে দুধ দে, জব্বার মিয়া ডাক দেয়। পারবো না একটু ঘুম আইছিলো । রহিমা বাচ্চার মুখে দুধ গুজে দেয়। তার পরেও কান্না থামে না মেয়েটার, শুকনা দুধ এক ফোটা দুধ নেই বুকে। কি করেই বা থাকবে। চার জনের সংসার রহিমার ৭ বছরের এক ছেলে আর এক মেয়ে জমজ। তার উপর জব্বার মিয়ার ওষুধ পত্র। এখনতো মসজিদে তেমন যেতে পারে না জব্বার মিয়া। কমিটি লোক দেখতেছে হয়ত ইমামতি টাও থাকবে না। রহিমা একবেলা সেলাই মেশিন এর কাজ করে আরেক বেলা চরের ছোট ছোট বাচ্চাদের আরবী শেখায়। তার পরে এখানে আবার হিন্দুদের ঘরও আছে। যে পাঁচ দশ জন পড়ে তারা  আবার টাকা দিতে চাইনা। কেও ৫০ কেও ১০০ টাকা এতে কি আর হয়। এ যুগে চলে! নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

এই হাফসা তোর দাগে পাও পড়ছে। এবার আমার দান। হাসান বলে। হাফসা বলে  পড়েনাই তুই মিথ্যা কইতাছোস। দুই ভাই বোনে হাতা হাতি শুরু করে দেয়। রহিমা বাড়ির ভিতর থেকে দৌড়ে এসে মেয়ে হাফসা কে একটা চড় মেরে বলে সারাদিন খ্যালোন। বুড়ি হয়ে গেছে তাও খ্যালোন মারাই। যাহ পাতিল গুলো ধুয়ে দে। জব্বার মিয়া মসজিদ থেকে এসে মেয়েকে কাঁদতে দেখে। হাসানের মা হাফসার গায়ে হাত তুলছোস ক্যা। মেয়েটা এখন সিয়ানা হচ্ছে। রহিমা উঠান ঝাড়– বাদ দিয়ে মুখ ভেঙ্গচে বলে মেয়ে বড় হচ্ছে, না দিন দিন ছোট খুকি হচ্ছে। স্কুলে লেখাপড়ার মনোযোগ নেই। সারাদিন খ্যালোন । আর আমি একা খেটে মরি। এই হাসান এদিকে আয়তো মার সাথে একটু কাজে হাত দে। ছোট বোন টাকে ধরলেও তো পারোস। বলে উঠে জব্বার মিয়া।  রহিমা বলে উঠে ও পোলা ব্যাটা ছেলে ওর কি কাম। মেয়ে টাকে কিছু কইতে পারেন না। ছাওলটাকে ধমকান।

এদিকে চরের অবস্থা ভালো না আবার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। চরের সমস্থ মানুষের মুখে চিন্তার ছাপ। বেশি দিন বোধ হয় এ চরে থাকা যাবেনা। এদিকে চরের মসজিদটার একেবারে কাছে পানি চলে এসেছে। কোন সময় নদীর ভাঙ্গনে মসজিদটা পানির গর্ভে বিলিন হয়ে যায়।  চিন্তার শেষ নেই। রহিমা বিবির চারিদিকে অন্ধাকার দেখতে পাই। যত চিন্তাতো তার । সে তো সারাদিন ঘরেই শুয়ে বসে কাটাই। সবি কপাল। রহিমার ঘরে সৎ মা। মা মরছে সেই ছোট কালে। বাপ আর একটা বিয়ে করেছে। সে মা দুই চোখ পেড়ে রহিমা কে দেখতে পারে না। রহিমা ছিল পাড়ার সুন্দরি মেয়ে। সৎ মায়ের অত্যাচারে স্কুল করে পরের  বাসায় কাজ করতো। লতিফ বাবা সরদার রহিমাকে ছেলে জব্বার মিয়ার সাথে বিয়ে দেয়। রহিমা ও জব্বার মিয়াদের বাড়ি ছিল এ পাড়া ও পাড়া। বিয়ের পরেও কপালে সুখ হলো না। রহিমা কাঁদতে থাকে। পাশের বাড়ির রুবিনা এমন সময় রহিমাদের বাড়ি একটা জামা সিলাই করতে আসে। কি রে রহিমা তুই কান্দস ক্যা। রহিমা শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছে বলে কপালে কান্দন থাকলে কি করমু। রুবিনা নানা রকম বুঝ দেয় রহিমা কে।

সত্যিই কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে দেখতে চরের বেশির ভাগ বাড়ি নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। অনেকে চর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় অনেকে আবার যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। জব্বার মিয়া চোখে অন্ধকার দেখে। কোথায় যাবে! তার শরীরের যে অবস্থা কি করে খাবে সে। হাতে একটা পয়সা কড়ি নেই। হাসানের মা শুনছো, আর তো থাকা যাবে না এখানে, তো কই যাবা। রহিমা জানতে চাই। সামনের সপ্তায় রমজানরা ঢাকা যাবে। চলো  ওদের সাথে আমরাও ঢাকা চলে যায়। কিছু না পারি কামলা তো খাটতে পারবো। নাহলে রিক্সা জমা নিয়ে চালামু। রহিমা ছল ছল চোখে জব্বার মিয়ার দিকে তাকাই তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো। ঢাকা যে যাবে পয়সা কড়ি কিছু লাগবে না। রহিমা জানতে চাই, জব্বার মিয়া বলে একটা ব্যবস্থা হবেনে। রহিমা বলে আমার কাছে কিছু আছে এতে কি হবে। এমন সময় হাফসা তার মাটির ব্যাংক মাচার উপর থেকে পেড়ে আনে। মায়ের হাতে দেয়। বলে মা ধরো এতে পয়সা আছে। এ পয়সা দিয়ে আমরা ঢাকা যেতে পারবো। রহিমা বিবি মেয়ের কথা শুনে চোখ মুছে বলে, তোমার পয়সা লাগবে না মা। তুমি রেখে দাও। বরং ঢাকা গেলে লাগবে। মেয়ে হাফসার মাথায় চুমু খায় রহিমা বেবি। জব্বার মিয়া বলে দেখছোস মেয়ে আমার কি লক্ষী। তুই তো মেয়েটাকে দেখতে পারোস না। রহিমা বলে উঠে ছেলে বা কার মেয়ে বা কার। আপনি এমন কথা কন ক্যা হাফসার বাপ।
এডা ঢাকা শহর কাম একটা ঠিকই পাওয়া যাইবো তুমি চিন্তা করো না, রহিমা বিবি জব্বার মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে। মিরপুর বস্তিতে একটা খুপরিতে উঠেছে জব্বার মিয়া। প্রতিবেশি রমজান ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জব্বার মিয়া ঢাকা আসার পর অসুখটা আরো বেশি বেড়ে গিয়েছে। রহিমা বিবি একটা বাসায় বান্দা কাজ  ধরেছে। সকালে যায় আর বিকালে ফেরে। পাশের খুপরির রানুর মা ভালো মানুষ। রহিমা বিবির কষ্ট দেখে কাজটা নিয়ে দেছে । বলেছে এটা ঢাকা শহর একজন কাজ করলে পেট চলতো না তুমি কিছু করো। রহিমা বলে উঠে কি কাম করুম। সেলাই কাজ জানি। কিন্তু সেলাই কাজতো এখানে হবে না। রানুর মা বলে আমার হাতে ভালো একটা বাসা আছে তুমি চাইলে করতে পারো। রহিমা আতকে উঠে! বাসায় কাজ করুম। রানুর মা বলে উঠে তা কি করবা। এছাড়া উপায় কি। ভালো বেতন দিবে। ভেবে দেখো। রহিমা বিবি ভেবে চিন্তে একদিন পরেই রাজি হয়ে যায়। এভাবে বসে থাকলে আর চলবে! জব্বার মিয়া নিষেধ করে বলে আমি একটা কাজ পেলেই আর সমস্যা হবে না। কিন্তু রহিমা বিবি বলে তোমার যে শরীলের অবস্থা কাজ পেলেই কি করতে পারবে! রহিমা বাসা বাড়িতে কাজে যায়। হাফসা আর হাসান ছোট বোন টাকে দেখে রাখে। কিছুদিন যেতে না যেতেই রহিমার ছোট মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছু খাই না। বাচ্চাটা আগের থেকেই বাড়তি খাবার খেতে চাইতো না। সারাদিন খুব কান্নকাটি করে। দিন কে দিন বাচ্চাটি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। রহিমা বাসা থেকে দুই দিনের ছুটি নেয়ে মেয়েকে হসপিটালে ভর্তি করায়। কিন্তু চার পাঁচ দিন চিকিৎসায় ও বাচ্চাটির কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এদিকে একমাস হয়নি রহিমা বিবি কাজ ধরেছে। তাই বেতন ও পাইনি, নতুন বাসা। হাফসার খুব শখের ব্যাংক ভেঙ্গে খুচরো পয়সা টাকা মিলেয়ে চারশোর মতো টাকা হয়েছে। তাই দিয়ে আর  রানুর মার কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছে। কোন রকম চলছে, রহিমা বিবি মনে মনে ভাবছে আজ যাবে সাহেবদের বাসায় অর্ধেক বেতন  ও যদি দেয় তবুও কিছু দিন যাবে। এদিকে জব্বার মিয়ার শরীর ও বেশি ভালো না। শ্বাস কষ্ট খুব বাড়ছে, তাকেও আর ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না। হসপিটালে ভর্তি করানো দরকার। রানুর মা বলেছে কোন একটা সরকারি হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেবে, ছোট বাচ্চাটা একটু সুস্থ হলেই। কিন্তু তার একদিনের মাথায় বাচ্চাটি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।

জব্বার মিয়াকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। রহিমা বিবি বাসা বাড়ির কাজটাও আর করতে পারে না। স্বামীর সেবা করার জন্য স¦ামীর পাশেই থাকে সর্বক্ষন। এভাবে ১৫ দিন কেটে যায়। জব্বার মিয়ার কোন উন্নতি নেই। সরকারি হসপিটাল নামে মাত্র চিকিৎসা। কি করবে রহিমা! একমাসের বেতন পেয়ে তাও তো ফুরিয়ে গেল প্রায়। ভালো অন্য কোন হসপিটালে নিবে। কিন্তু কিভাবে! চোখে সরষে ফুল দেখে রহিমা বিবি। ছোট মেয়েটা মারা যাওয়াতে রহিমা অনেকটা কাহিল হয়ে পড়েছে। কিন্তু হাত শূন্য। চিন্তায় রহিমার রাতে ঘুম হয়না। কত গুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়েছে। সে গুলো বাহির থেকে করনো লাগবে। তাহলে কি পয়সার অভাবে স্বামীকে চিকিৎসা করাতে পারবেনা। রহিমা আর ভাবতে পারে না। দুই দিনের মধ্যে পরীক্ষা রিপোর্ট ডাক্তার কে দেখাতে বলা হয়েছে। কি করবে সে এখন। রানুর মার কাছ থেকেও টাকা ধার নিয়ে আছে। সে গুলো ও দেওয়া হয়নি। তার পরে ঢাকা শহর নতুন পরিচিত তেমন কেও নেই। স্বামীকে রেখে দুই দন্ড সরার কায়দা নেই। যে সাহেবের বাসায় কাজ করেছে তারা খুব ভালো মানুষ। রাতটা পুহালেই সাহেবের বাসায় যাবে ভাবে রহিমা।

পরের দিন সকাল ১০ টা। হাফসা আর হাসান কে জব্বার মিয়ার কাছে রেখে রহিমা বিবি সাহেবের বাসায় উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু কপাল মন্দ গেটের দারোয়ান বলে সাহেবেরা ৬ মাসের জন্য দেশের বাহিরে গেছে। রহিমা বিবির মাথায় যেন বাজ পড়ে। কি হবে এখন! রহিমা বিবি আর ভাবতে পারে না। ভাঙ্গা হৃদয়ে হসপিটালে ফিরে এসে দেখে স্বামী তার আর এই দুনিয়াই  নেয়।



ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৫

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০৫


০৫.

পরদিন সকাল সকাল রুবীর সঙ্গে অফিসে এল উর্মিলা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। তাতে মেয়েলি প্রয়োজনীয় জিনিস। চূড়ো করে চুল বেঁধেছে। হালকা গোলাপি সালোয়ার কামিজের সঙ্গে হলুদ উড়না। পায়ে অতি সাধারণ সেন্ডেল। সব  মিলিয়ে বেশ রূপবতী লাগছে।
উর্মিলা রুবী সিটের পাশে চেয়ারে বসতেই পিয়ন রুবীকে দীপু ভাইয়ের রুমে ডেকে যায়। উর্মিলা একটু অস্থির লাগতে থাকে। হুড় হুড় করে আরও দুটি মেয়ে অফিসে ঢোকে। সবাই বেশ র্স্মাট। কলকল করে কথা বলতে বলতে দীপু ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। অল্পক্ষণ পর রুবী ফিরে আসে কতকগুলো কাগজ নিয়ে।
উর্মিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো দেখো। মনে রাখতে হবে প্রশ্নের উত্তরের পাশে হাঁ-না টিক চিহ্ন আছে। যেটা সত্য তার পাশে টিক চিহ্ন দেবে। ছয়জনের মিশন। জাকির সাহেব মুখ্য ভূমিকায় থাকবেন। জাকির সাহেব ছাড়া আরও দু’জন। তুমিসহ তিনজন মেয়ে। মনে রাখতে হবে তোমরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা মিশনে যাচ্ছ। যাতে লিপিবদ্ধ হবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়ের দলিল। উর্মিলা বেশ অবাক হলো। রুবী এমন ভাবে বলছে যেন এ বিষয়ে ওর কত অভিজ্ঞতা। কাগজগুলো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে উর্মিলা বলল, ‘আমার ভয় করছে রুবী। খুব অল্পদিনে তোমার অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি তোমার  মতো অতটা বুদ্ধিমান না। আমার হাত-পা কাঁপছে।’
রুবী ধমকের সুরে বলল, ‘ঘাবড়িও নাতো। জটিল কিছু না আমি পারলে তুমিও পারবে। তুমি আমার মতো না। অপেক্ষা করো। জাকির সাহেব এলেই তোমরা কেরানীগঞ্জ রওনা হবে। নিচে  মাইক্রো অপেক্ষা করছে।’
‘ফিরব কখন?’
‘সন্ধ্যার মধ্যেই। অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে এসো।’
উর্মিলার কৌতূহল হলো। এ নিয়ে ও চারদিন অফিসে এসেছে। জাকির সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়নি। অফিসের কৌণিক রুমে বসে। প্রয়োজন ছাড়া চেয়ার ছেড়ে উঠে না। অফিসের মধ্যে জাকির সাহেব আলাদা ভাব-ভঙ্গি আছে। যা তাকে বেবী আপার কাছাকাছি মর্যাদায় বসিয়ে রেখেছে। কিন্তু উর্মিলার কাছে!
রুবীর ভাষ্যনুযায়ী ভীতিকর। গ্রাম থেকে উঠে আসা উর্মিলার জন্য স্বস্তিকর নয়।
উর্মিলা আরেক কাপ চা খায়। এখন দেয়াল ঘড়িতে নয়টা পঁয়তাল্লিশ।
দীপু ভাই তার রুম থেকে ওই দু’মেয়েসহ বের হয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সরস্বতী, এই দুই নারীকে নিয়ে নিচে যেতে হবে। অদ্য জাকির বস উপরে উঠবেন না। মাইক্রোতে বসে আছে। আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
উর্মিলা উঠে দাঁড়ায়। আলতো লজ্জায় ব্যাগে কাগজগুলো ভরতে থাকে।
দীপু ভাই বলে, ‘সুমি, নাজনীন, দেবী  নতুন এসেছে। আপার প্রিয়। তাকে কষ্ট দেয়া যাবে না।’
সুমি কলকলিয়ে উঠে, ‘কী যে বলেন দীপু ভাই! দেবীকে কি কষ্ট দেয়া যায়। রুষ্ট হলে বংশ নির্বংশ হবে।’ হাসতে থাকে।
উর্মিলা কিছু বুঝতে পারল না। হঠাৎ কিছু রক্ত চোখ মুখে ছলকে ওঠে। দীপু ভাইয়ের দিকে তাকাতে পারে না। রুবীসহ দীপু ভাই লিফট পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দেয়।
সুমি ও নাজনীনকে অনুসরণ করে মাইক্রোতে উঠে যায় উর্মিলা। পেছনের সিটে ওরা তিনজন বসে। সামনের সিটে জাকির সাহেব গম্ভীর বসে আছে। তার পেছনে সিটে অন্য দু’জন। মাইক্রো ছেড়ে দিতেই নাজনীন বলল, ‘বস ডেমড়া কিলিং-এর রিপোর্ট কি বেবী আপাকে দিয়েছেন?’
জাকির সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মাইক্রোবাস পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে ভরপুর। নেশার মতো। ‘তালেব আলীর বর্ণনায় আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।’ সুমি বলে।
সামনের আয়নায় তেসরাভাবে জাকির সাহেবের মুখ দেখা যাচ্ছে। শান্ত, স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ববান মুখ। পুরু গোঁফের আড়ালে কোনো পাপ লুকিয়ে থাকতে পারে বলে এ মুহূর্তে উর্মিলার মনে হলো না। তারপরও অসহায়ত্ব ওর বুকে বাসা বেঁধেছে।
সুমি বলল, ‘উর্মিলা তোমার কি বসতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘না না।’ খুব শান্ত উত্তর দিয়ে উর্মিলা মিররে তাকায়।
জাকির সাহেব নির্বিকার বসে আছে। ড্যাবড্যাবা চোখ দুটো সামনের দিকে নিবদ্ধ। ভাবলেশ। নয়াবাজার পেরিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর ওপর দিয়ে মাইক্রো ছুটে চলছে।
নাজনীন বলল, ‘বুড়িগঙ্গার জল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নীল পালিয়ে গেছে। কেমিক্যাল গলিজের পানি খেয়ে একদিন পটল তুলব।’
সবাই হেসে উঠে। আর তখন উর্মিলা কানের কাছে মুখ নিয়ে সুমি বলে, ‘দীপু ভাই তোমাকে নায়িকা ভাবছে।’
আকস্মিক উর্মিলা সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে যেতে থাকে। উর্মিলা কিছু বলে না। খুব কাতর নয়নে সুমির দিকে তাকায়।
‘না না তোমাকে খারাপ বলেনি।’ সুমি মৃদু সুরে হাসে।
ইতোমধ্যে কেরানীগঞ্জ পেরিয়ে সাথিয়া পালপাড়ায় এসে মাইক্রো থেমে যায়। আস্তে আস্তে সবাই নেমে যায়। জাকির সাহেবকে সবাই অনুসরণ করে। পেটফোলা, হাড়জিরজিরে কিছু ছেলেপেলে ছুটে আসে। ওদের শরীরে পুষ্টিহীনতার চিহ্ন। বসন্ত পালের বাড়ির সামনের বাংলো ঘরটায় বসার আয়োজন করেছে। আশপাশের বাড়ির উঠোনে হাঁড়ি, পাতিল, পুতুল রোদে শুকোতে দিছে। নাজনীন খুব অবাক হয়।
উর্মিলাকে বলে, ‘সুন্দর না।’
উর্মিলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
এ প্রোগ্রামে সব বিষয় বসন্তবাবুকে জানানো হয়েছিল।
টিমের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে।
এ সময় সুমি জাকির সাহেবের উদ্দেশে বলে, ‘বস, উর্মিলাকে দেখেনি?’
‘বেবী আপা ওর কথা বলেছে। খুব সম্ভাবনাময়ী বলে বাঁকা চোখে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্মিলা দু’হাত তুলে নমস্কার জানায়। ব্যস ওইটুকু। তারপর ওরা ব্যস্ত হয়ে যায়। টিমের অদ্যকার জরিপ কো-অর্ডিনেট করবে মঞ্জু রহমান। যিনি জাকির বসের সহকারী। যার যার মতো চেয়ারে বসে ফরমে উল্লিখিত বিষয়ে মার্কিং করবে। প্রস্তুতি গ্রহণ করার আগে মঞ্জু সাহেবকে সুমি বলে, ‘মঞ্জু ভাই, বসের তবিয়ত গোলমাল।’
‘তোমার তো অজানার কথা না! দেখো গা, রাতে বউয়ের সঙ্গে মারামারি করেছে।’
উর্মিলা কৌতূহল অনুভব করে। কান উৎকীর্ণ রেখে দু’জনের কথোপকথন শুনতে চায়।
নাজনীন বলে, ‘বদলোকের ভাগ্য সংসারে সুখ কম।’
‘তুমি এমন নিষ্ঠুরভাবে বলো নাজনীন, অভিশাপের মতো শোনায়।’ মঞ্জু রহমান হাসতে হাসতে বলে।
‘আমি সংসারের কঠিনতম সত্য বলেছি মঞ্জু ভাই।’ হঠাৎ করে উর্মিলার অসম্ভব ভালো লাগতে থাকে। নগরে আসার পর নানাবিধ উৎকণ্ঠার পীড়নে একধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করছিল। সুমি, নাজনীনের স্পষ্টবাদিতা ওকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সাহসী করে তুলেছে।
জাকির সাহেব একটু দূরে মঞ্জু রহমানের সহকারী তবারক হোসেনকে সঙ্গে চেয়ার টেবিল বসে কী সব কাগজ দেখাতে থাকে।
বসন্ত পালের বাংলোঘরের বারান্দায় তিনটে চেয়ারে ফরম আর কলম নিয়ে সুমি, নাজনীন, উর্মিলা, মঞ্জু রহমানের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। মঞ্জু রহমান উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘আমাদের এ মিশনের কাজ কি তা সুমি-নাজনীন জানে। সম্ভব তো নতুন ম্যামের জানা হয়নি। এত তাড়াতাড়ি বেবী আপা  আপনাকে কাজে ইনভলবড্ করবে এটাও ভাগ্যের। আমাদের কাজে কী? মনে রাখতে হবে, আমাদের একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। যা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ নামক এ ভূখ-ে কত নিরীহ নারী মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কতজন নিহত? কতজন ধর্ষণের শিকার? কত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তার একটি চিত্র পাওয়া যাবে। যা পরবর্তীকালে দেশ ও জাতির  ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হবে।  আমরা এ গ্রামটিতে তারই জরিপ করব। মনে রাখতে হবে এ গ্রামের একাশি জন নিরীহ কুমোর সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি আর্মি এবং তাদের দোসররা গুলি করে হত্যা করেছিল। ধর্ষণ করা হয়েছিল বত্রিশ জন নারীকে। এ তল্লাটের প্রতিটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। আমরা শহীদ পরিবার এবং ধর্ষিতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করব।’
মঞ্জু রহমানের মমতাবান, স্পর্শকাতর ব্রিফিং শুনে উর্মিলা বিস্মিত হয়। এভাবে কেউ বলেনি। হঠাৎ ওর বেবী আপার কথা মনে পড়ে। বেবী আপা মানুষের পক্ষে।
একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে একজন একজন করে সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। সারা পালপাড়ার আবাল-বৃদ্ধা-বণিতা ভিড় করেছে। যাদের পূর্ব পুরুষ হত্যা অথবা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল। স্বাধীনতার এত বছর পরও তাদের খোঁজ কেউ রাখেনি।
উর্মিলা শুধু নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দিদি আমার কান্না পাচ্ছে।’
নাজনীন বলল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে উর্মিলা।
উর্মিলা একবার ভাবল, সুমি, নাজনীনও ওর মতোন সাধারণ। যা ভেবেছিল ওরা তা না। দুরুদুরু বুকে উর্মিলা ফরমশিট নিয়ে যে অশীতিপর বৃদ্ধার সম্মুখীন হয় তার সঙ্গে ঠাকুরমার  চেহারার মিল আছে। হিন্দু বিধবা। একাত্তর সালে এই গ্রামে হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের শিকার মণিবালা পাল। আটমাসের বিবাহিত জীবনে স্বামীহীন ধর্ষিতা এক নারী চরিত্র নিয়ে এত বছর যাপন করছে।
বর্ণনার পাশে টিক চিহ্ন দিতে হাত কাঁপছিল। বারবার নাজনীন এবং মণিমালার দিকে তাকাতে থাকে। নাজনীন বলে, ‘প্লিজ উর্মিলা, ইজি হও। এর চেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অপেক্ষায় আছে।’
‘দিদি, আমার কষ্ট হচ্ছে।’
‘তুমি কি  আমার মতো দুঃখী?’
উর্মিলা অসহায় নাজনীনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
উর্মিলা এখন আর মণিমালা দেবীর কথা শুনতে পাচ্ছে না। টিক চিহ্ন দেওয়ার কথা ভুলে গেছে। ফরমশিট এ পৃষ্ঠা থেকে অপর পৃষ্ঠায় চলে গেছে। একটাও ডট দেবার কথা মনে নেই।
এ পাশ থেকে সুমি বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না। তোমার এ সিটটা পরে আমি ঠিক করে দেব। অন্যটার জন্য প্রস্তুতি নাও। বেদনায় কর্তব্য ভুলে গেলে চলবে কেন?’
মনে মনে সুমিকে ধন্যবাদ জানায়। আত্মার ভিতরে অন্যরকম একটি শক্তি বইতে থাকে।
এরপর আর উর্মিলাকে পেছন তাকাতে হয়নি। এক টানা তিনটে পর্যন্ত কাজ করে। একত্রিশ জন ধর্ষিতা নারীর লোমহর্ষক যন্ত্রণার কাহিনি শুনতে শুনতে ভাবালুতা লোপ পেয়েছিল প্রায় সবার মধ্যে। শুধু নাজনীন বলল, ‘পৃথিবীতে এত বেদনা জমে আছে?’
তবে বুকের ভেতর  রোরুদ্যমান ক্রন্দন সবাইকে একাকী করে দিয়েছে।
মঞ্জু রহমান বলল, ‘তোমরা গাড়ির নিকট যাও। প্যাকেট লাঞ্চ পানি আছে খেয়ে নাও। শরীর খারাপ লাগছে। কিছু খাব না।’
জাকির সাহেব এবং অন্য জনের কাজ শেষ হয়নি। তারা ওপাশের আমগাছের তলায় জটলা করে কাজ করছে। বসন্ত পালের কুয়ো জলে হাত মুখ ধুয়ে দুপুরের লাঞ্চ করতেই বিকেল চারটা বেজে গেল। জাকির সাহেব তার জরিপের কাজ তখনও শেষ করতে পারেনি।
সুমি বলল, ‘কী নির্জন গ্রাম। প্রকৃতি এখানে ক্যামন নিস্তরঙ্গ। আর প্রকৃতির সন্তানরা। আহ।’
নাজনীন বলল, ‘আমার গ্রামের মতো!’
উর্মিলা বলে, ‘দিদি, আমি তো এ জীবন দেখিনি।’
আর এ সময় মঞ্জু রহমান দৌড়ে এলেন।
‘বস সবাইকে গাড়িতে উঠতে বলেছে।’

ক্লান্ত, বিষণœ, তিক্ত মন নিয়ে উর্মিলা যখন নাখালপাড়ার বাসায় ফিরে এল তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে।
রুবীর প্রশ্ন করার আগেই  উর্মিলা বলল, ‘রুবী, জীবন এতো গ্লানিকর, জানা ছিল না।’
(চলবে)


মালয়েশিয়া কমনওয়েলথ ইয়ুথ সামিটে : ইমরান মাহফুজ

মালয়েশিয়া কমনওয়েলথ ইয়ুথ সামিটে : ইমরান মাহফুজ


মালয়েশিয়া কমনওয়েলথ ইয়ুথ সামিটে 
ইমরান মাহফুজ

মালয়েশিয়ার সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠেয় ‘ফিউচার ইয়ুথ সামিট-২০১৮’র আয়োজনে বাংলাদেশ থেকে যোগ দিচ্ছেন কবি, গবেষক ও কালের ধ্বনি সম্পাদক ইমরান মাহফুজ। এইছাড়া কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী। পাশাপাশি ডেলিগেট হিসেবে আরও কয়েকজন যোগ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে ইয়ুথ সামিট যেন হয়ে উঠছে দেশী ও প্রবাসী বাংলাদেশীদের মিলনমেলা।
কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট, কমনওয়েলথ ইয়ুথ কাউন্সিল ও কমনওয়েলথ ইয়ুথ ইনোভেশন সেন্টারের যৌথ আয়োজনে আগামী ১৬-১৮ নভেম্বর অনেুষ্ঠেয় এ সামিটের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তা পাভেল সারওয়ার। মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন নির্বাহী তরুণ চলচিত্র নির্মাতা জাফর ফিরোজ, তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগে সরোজ মেহেদী, স্পিকার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে প্রকৃতি ওয়াজেদ শিকদার ও তাহিয়া ইসলাম,  হিউমান রিসোর্স বিভাগ রিফাত রিয়াজ বিকু, স্পন্সর ও পার্টনারশিপ বিভাগে সবুজ সরদার সামিটের এক্সিকিউটিভ মেম্বার হিসেবে আছেন ।
ইমরান মাহফুজ ইতোমধ্যইে তাঁর কাজরে স্বীকৃতি স্বরূপ ‘আবুল মনসুর আহমদ গবষেণা পুরস্কার ২০১৫’, ‘শহীদ সাংবাদকি সলেনিা পারভীন স্মৃতি পুরষ্কার ২০১৩, সন্টোর ফর ন্যাশনোল কালচার থকেে ‘আবুল মনসুর আহমদ পুরষ্কার ২০১৮সহ পয়েছেনে অনকে পুরষ্কার ও সম্মাননা। শুধু পুরষ্কার বা সম্মাননা নয় পাঠকদরে ভালোবাসার পাশাপাশি মলিছেে অনকে প্রাপ্তওি। যমেন তাঁর আবুল মনসুর আহমদ স্মারকগ্রন্থ ইতমিধ্যইে বশ্বিবদ্যিালয়য়রে অর্নাস ও মার্স্টাস র্পযায়রে পাঠ্যসহায়ক গ্রন্থ হসিাবে বশে কয়কেটি বশ্বিবদ্যিালয়রে পাঠ্যসূচীতে স্থান পয়েছে।ে সম্প্রতি দশেরে গন্ডি পরেয়িে কলকাতার নতোজী সুভাষ মুক্ত বশ্বিবদ্যিালয়ে দশে ভাগ ও সমকালীন বাংলা ইতহিাস ও সাহত্যি পাঠ্য তালকিায় ইমরান মাহফুজ সম্পাদতি ‘আবুল মনসুর আহমদ স্মারকগ্রন্থ যুক্ত হয়ছে।ে  আর মা মাটি মানুষকে জানতে বাংলাদেশের ৬০টি জেলা ভ্রমনসহ ভারত, নেপাল ও ভুটানে রয়েছে তার চমৎকার পদচারণা। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাত, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস চর্চার সংগঠনের আয়োজনে একক বক্তা হিসেবে অংশ নেন ।


‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮’ পাচ্ছেন যাঁরা

 ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮’ পাচ্ছেন যাঁরা


 ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮’ পাচ্ছেন যাঁরা

তৃতীয়বারের মতো জাতীয় জাগরণের স্বীকৃতি স্বরুপ। ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮’ ঘোষণা করা হয়েছে। কথাসাহিত্যে  আনিসুল হক, কবিতায় আমিনুল ইসলাম,  শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনীতে ‘ বেদনা আমার জন্ম সহোদর’ গ্রন্থের জন্য ইজাজ আহ্মেদ মিলন, প্রবন্ধে- ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জমান চৌধুরী, মানবতার কল্যাণে বিশেষ অবদানের জন্য (সমাজ সেবা) কামরুল হাসান কাজল, ছোটগল্পে নূর কামরুন নাহার এবং তরুণ কবিতায় তুষার কবির এ বছর দাগ সাহিত্য পুরস্কার-২০১৮ পেতে যাচ্ছেন। উল্লেখ, বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও কর্মের এক যুগের মূল্যায়ন করে কথাসাহিত্য, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, তরুণ কবি বিভাগে ‘দাগ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। সেই সাথে সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষের কল্যাণে কাজ করার অবদানের জন্য একজনকে পুরস্কৃত করা হয়। আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর এ পুরস্কার প্রদান করে আসছে সংগঠনটি। 

ব্লকলিস্টের রাণীরা

 ব্লকলিস্টের রাণীরা


 ব্লকলিস্টের রাণীরা
হাসনাত আসিফ কুশল

প্রতিদিন কতজনই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। ক’জনের আর খোঁজ রাখা যায়। তবে এমনই একটি মেয়েকে দেখে ভালো লেগেছিলো অনিকের। বাস্তবে নয়, ফেসবুকে। অনিক একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ছে। যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে অনিক, সেই মেয়েটাও একই বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে।
একদিন প্রেমের প্রস্তাবও দেয়। লাভ হয়না। এই যন্ত্রণা কেউ বোঝে না। সাথে সাথে মেসেঞ্জারকল। হ্যালো।
হ্যালো।
তুমি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো।
হ্যা। সত্যিই ভালোবাসি।
কিন্তু আমারপক্ষে তোমাকে অ্যাকসেপ্ট করা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু কেন ?
আমি জানি তুমি খুব ভালো ছেলে। সৎএবং ভদ্রও বটে। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত নই।
আচ্ছা। ঠিক আছে।
সাথে সাথেই ফোন রেখে দেয় অনিক। ভালো লাগছিলো না কিছুই তার। প্রচ- রকম অস্থিও লাগছিলো তার মনের মধ্যে। বারবার ভেঙে পড়ছিলো সে।

অন্য একদিনের কথা।
মেয়েটির প্রত্যাখানের কথা সে ভুলতে পারছিলো না। তাই একদিন ক্রাশ এন্ড কনফেশনের পেজে গিয়ে নিজেই ইংরেজিতে একটি পোস্ট দেয়- আমি তোমাকে ভালোবাসি শিরোনামে। সাথে ওই মেয়েটার ছবিও ছিলো। কিন্তু মেয়েটা ফেসবুকে সেই ছবি দেখেই রেগে যায়। তখন সে নক দেয় অনিককে। বলে- তুমি একটা ফাউল ছেলে। তোমাকে বিশ^াস করে আমি ভুল করেছি। আমি তোমাদেও বিভাগীয় প্রধানের কাছে অভিযোগ করবো। বলেই ‘ঠাস’ করে ব্লক করে দেয়।

অনিক এখন কি করবে ?

ভালো লাগছেনা কিছুই তার। মনে হচ্ছে সবকিছু এলোমেলো হয়ে আসছে তার। সারা পৃথিবী একদিকে, আর নিজেকে আরেক দিকে ভাবতে শুরু করেছে। ভালো লাগছেনা কিছুই। সিগারেট খাওয়া শুরু করে। ড্রাগস নেয়া শুরু করে। কিন্তু সুখ পায় না।

সুখ যে কোথায় তা খোঁজার জন্য পৃথিবীর এমন কোনো স্থান নেই যে সে যায়নি। সুখের সন্ধানে সব জায়গায় বেড়িয়েছে সে। তবুও সুখ পায়নি। সুখ আসলে আপেক্ষিক বিষয়। একেক জনের কাছে সুখের সংজ্ঞা একেক রকম। কেউ ডিম ভাজি দিয়ে রুটি খেতে ভালোবাসে, কেউ কবিতা লিখতে ভালোবাসে, কেউ ডকুমেন্টারিফিল্ম বানায়।

কিন্তু অনিক সুখ পায়না।

ভেঙে পড়েছে খুব। তবুও জীবন থেমে থাকার নয়। এভাবে কয়েকটা দিন চলে গেলে ওই মেয়েকে আপনা আপনিই ভুলে গেল অনিক। অথচ একদিন এই মেয়েটিই তার কাছে প্রিয় ছিলো।

একদিন অনিক আরেকটি মেয়েকে ইনবক্সে নক দিয়েছিলো। বলেছিলো- ভালোবাসি।
সাথে সাথেই উত্তর- ডু ইউ ইভেন নোমি ? লল।
সে বললো, চিনিনা তো কি হয়েছে ? নতুন করে চিনবো। প্রেম করবো তো সাহস নিয়েই করবো।

এরপর আর কোনো কথা বলেনি সেই মেয়েটা।


অনেক  দিন পর সেই মেয়ে আবার তাকে মন্তব্য করলে, সে ‘দিদি’বলে সম্বোধন করে তাকে। এতে ওই মেয়ে অবাক হলেও কিছু বলেনি। পরে ইনবক্সে গিয়ে ‘দিদি’ বললে ‘ঠাস’করে ব্লক করে দেয় সে। এরপর আবার মন খারাপ হয়ে যায় তার। এভাবে কিছুদিন গেলে পরে অনিক আপনা আপনিই ভুলে যায় তাকে।

অনিক তার বন্ধুদের এড়িয়ে চলা শুরু করে। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। এভাবে কয়েক দিন যেতে যেতেই তাদের মিডিয়াল্যাবের সিনিয়র ইন্সট্রাক্টরের নজরে আসে অনিক। ইন্সট্রাক্টর এই বিশ^বিদ্যালয়েই চাকরি করছে। এক সময় এখানেই পড়াশুনা শেষ করেছে।
তিনি একদিন চা খেতে অনিককে ডাকলেন। তারপর বললেন- কি হয়েছে ?
তখন সে বলতে চাইছিলোনা। ইন্সট্রাক্টরের ধমকে সে বলে ওঠে, তাকে কেউ পছন্দ করেনা। কোনো মেয়েই পাত্তা দেয় না।
ইন্সট্রাক্টও তখন বললেন, আমাকেও তো কেউ পাত্তা দেয় নি যখন এখানে পড়তাম।
তখন অনিক কিছু বলছেনা।
বল।
কিবলবো ?
এই যে তোরসিদ্ধান্তকি ?
কিসেরসিদ্ধান্ত ?
লাইফের।
এখনো নেইনি।
নেসনাই কেন ?
ভালোলাগেনা।
তখন ওর আরও বন্ধু যোগ হয়েছে। তারাও একই ভাবে সান্ত¡না দিতে থাকলো। কি হয়েছে জানতে চাইলো।
এক বন্ধু বললো, কিছু হয়ে থাকলে আমাদেরকে বল।
তখন অনিক বললো, আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না। ভালো লাগেনা। আমাকে কেউ পছন্দ করে না।
সেই বন্ধু বললো, দেখ একেকজন একেক ভাবে এই পৃথিবীতে জন্মেছে। তাই বলে এভাবে নিরাসক্তভাবে থাকতে হবে ?

অনিককে অনেকে অনেক মোটিভেট করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মোটিভেশন মিলছেনা তার মনে। অনেক কথাই সে দাবিয়ে রেখেছে। কেন ?




চুড়ি

চুড়ি




চুড়ি
আতিক এ রহিম

সতী আমার হাতে একটি চুড়ি দিয়ে বলল, আপাতত আপনাকে দেয়ার মত কিছুই নেই। জানেন তো এখানে এসেছি ২/৩ দিনের জন্য। বই বহন করার মত ব্যাগ ছিলনা। তা ছাড়া কি নেব না নেব সেরকম পরিকল্পনা করার সময় ছিলনা। কবির ভাই রাতে ফোন দিয়ে কনফার্ম করল যে আমাদের পরশু ঢাকা যেতে হবে। তাছাড়া এখানে এসে আপনার সাথে দেখা হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি।
সতী আবার বলল, আপনার সাথে ফেইসবুকে পরিচয় তা তো বেশিদিন হলো না। আমরা যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম তখন আপনার একটা ম্যাসেজ দেখে আপনার কথা মনে পড়ল। তাই আপনাকে লিখলাম যদি পারেন আপনার বইটি আমার কাছে পৌঁছানো ব্যবস্থা করবেন।
সতী একজন শ্যুটার। সে প্রতিযোগিতা করতে ঢাকায় এসেছে। সতী বিকালে আমাকে ম্যাসেজ লেখেন ‘আমি ঢাকায় এসেছি... হাতির ঝিলে আছি’। আগামী তিনদিন থাকব। আমিতার মোবাইল নাম্বার নিলাম কথা বলে কনফার্ম করলাম আগামিকাল দেখা করব। ভাবতে পারছিলামনা সত্যি কিতার সাথে দেখা হবে? মাত্র কয় দিনের পরিচয় কারো সাথে ভাল পরিচয় নেই। তারপরও আমার ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারছিলাম না। আমি অনেক দ্বিধা-দ্বন্ধে ছিলাম মেয়েটির অন্যকোন অভিসন্ধি আছে কিনা। আজকাল তো বিপদেও কোন হাত পা নেই বলা যায়না। সমাজে নানা ধরনের অপরাধ ঢুকে পড়েছে এ মোবাইল আর ফেসবুকের কারণে। প্রতিদিনের ঘটনা শুনলে বা দেখলে চিন্তা হয়। কিন্তু সতীর কথায় সে ধরনের কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তার কথা কাটকাট বাস্তববাদী । যারা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত তাদের কথাই আসল হাতিয়ার। তারা কথার মাধ্যমে অন্যকে আকৃষ্ট করে রা ফাদেঁ ফেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সতীর কথার মধ্যে সে রকম কোন ইঙ্গিত ছিলনা।
আমার যে সময় সতীর কাছে পৌছানোর কথা আমি সময় মত পৌঁছতে  দেরি হয়ে গেল জ্যামের কারণে। গুলশান বাসষ্ট্যানে নেমে রিক্সা নিতে চাইলাম রিক্সাওয়ালা  এ রোডে রিক্সা যেতে দেয় না। কি  আর করব অজানা উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম। একটু সামনে এগিয়ে জিজ্ঞাস করলাম শ্যুটার স্পোর্টস ফেডারেশন বিল্ডিংটা কোনদিকে? আমি হাঁটা ধরলাম। ৫/৬ মিনিট হাঁটার পর পেয়ে যাই ফেডারেশন বিল্ডিংটি। এ বিল্ডিংটি দেখে আমার মনটা একটু আস্বস্ত হলো এই ভেবে যে তাহলে সতীর মধ্যে কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। ফেডারেশনের গেটে দাড়িয়ে দেখি ভেতওে অনেক লোকজন চলাফেরা করছে গেটের একপাশে দুজন সিকুউরিটি বসে আছে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে সতীকে ফোন দেই রিং হচ্ছে কেউ রিসিভ করছেনা। পর পর দুইবার কল দেই কেউ ধরেছে না। আমি একটু হতাশ হয়ে যাই কারণ কাকে জিজ্ঞাস করব সতীকে কেউ চিনে কী না! আবার জিজ্ঞাস করব রাজশাহী থেকে মেয়েরা এসেছে আমি তাদের সাথে দেখা করতে চাই। আমার এ ধরনের কারো কাছে গ্রহণ যোগ্য তা হবেনা তাই দাঁড়িয়ে থাকি গেট থেকে একটু দুরে। আবার ট্রাই করে দেখি কল দিলাম। এ মূহুর্তে নিজেকে কেন যেন অদ্ভুদ লাগছে। একজন অপরিচিত মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এবার রিসিভ করল সতী বলল, দাড়ান আমি আসছি। একটু পরে দেখি একটি মেয়ে কালো জিন্সের প্যান্ট এবং কালো রঙের শার্ট পড়া পায়ে কেডস গলায় একটি নেমকার্ড ঝুলানো এগিয়ে আমার দিকে। আমাকে দেখে দুর থেকে হায় বলে একটা হাসি দিয়ে বলল, সরি রুমে ছিলাম না তাই সময় মত কল রিসিভ করতে পারিনি। আমিও একটু হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলাম তার সাথে। সতী সিকুউরিটিকে বলল, বন্ধু কোন ইনফরমেশন লেখতে হবে?
সিকুউরিটি বলল, নোম্যাডাম।
আমি সতী!
ও হেসে বলল, আমি আসলে সতী নয় । এটা আমার ছদ্ম নাম। আমার সামনে দাঁড়িয়ে ওর নেম কার্ডটি উচুঁ করে ধরে বলল আর গোপন রাখতে চাইনা। এই যে আমার আসল নাম।  পার্সপোর্টের সাইজের ছবির নিচে ওর নাম সুন্দর করে লেখা আমি পড়লাম দুজনেই হেসে ঊঠলাম।
ওয়েটিংরুমে বসলাম দুজন পাশাপাশি। আমি বললাম আমি আপনাকে সতী বলে ডাকব। সতীর যে কয়জন বন্ধুরা এসেছে সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয় সে। ওর কোচ, ম্যানাজার সবার সাথে আমার পরিচয় হলো।
সবাই বলল, তোমরা কথা বল তবে বাইরে বের হওয়া নিষেধ। পাশাপাশি দুজন বসে কথা বলছি মাঝে মধ্যে  দুজনই হেসে ওঠছি এ ভেবে যে হচ্ছিল না যে আমরা দুজন ফেসবুকে সামান্য পরিচয় তারপর দুজনের সাক্ষাত নিজেদেও কাছে মনে হয়েছিল অবাস্তব বা কোন নাটক সিনেমার গল্প ।
সতী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী । এবার ফাইনাল দিবে। কথা বলতে বলতে ওর সম্পর্কে সব জানতে পারি।
সতী খুবই প্রাণচঞ্চল ধরনের মেয়ে। তবে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে তার প্রতিভার কথা। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার নেত্বত্ব দেয় তার বিভাগে। ওর আকেটা গুণ হলো সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করতে পারে। সতী মুখে একটি কবিতা শুনলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমরা ভেতরের  গেলাম। ভেতওে বিশাল মাঠ যেখানে শ্যুটার প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রথম দেখলাম এ মাঠ। ভেতওে অনেক প্রতিযোগিরা প্র্যাকটিস করছে ছেলে মেয়েরা।  তাদের বয়স ১৮/১৯ বছর হবে।
সতী আমাকে দেখাতে লাগল কিভাবে একজন শ্যুটার প্রতিযোগিতায় বসে, শুয়ে এবং দাঁড়িয়ে শ্যুটার লক্ষ্য বস্তুতে শুট করতে পারে। আমি শ্যুটার প্রতিযোগিতা সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিলাম। আমার ভীষণ ভালো লাগল তার বিভিন্ন দিক বুঝানোর জন্য।
আমরা আবার চলে আসি ওয়েটিংরুমে  । আমরা দুজন দুজনার বিভিন্ন দিক কথা বলতে লাগলাম। তবে আমি শুনছি আবার মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছি সতীকে।
সতী আমাকে আগেই বলে রেখেছিলেন আমাকে ২০/২৫ মিনিট সময় দিতে পারবেন। তারপরও প্রায় ঘন্টাখানেক চলে যাচ্ছে। আমরা কথা বলে যাচ্ছি। আমাদেও পাশে অনেকে আসছে যাচ্ছে আবার কেউ শেয়ার করছে আমাদের সাথে। আমরা বসে আইসক্রিম খেলাম যদিও আমার দাতের সমস্যা ছিল , সতী তাতে পাত্তা দিলনা। নিজে ওঠে গিয়ে দুহাতে দুটি চকবার নিয়ে এলো।
সতী বার বার আমাকে বলতে লাগল আমার কাছে এমন কোন কিছু নেই আপনাকে দেওয়া যায়। আমি বললাম আপনি এখানে এসেছেন প্রতিযোগিতায় তেমন কিছু থাকার কথা না।
আইসক্রিম খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম। এক সময় আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয় সতী আমাকে বলে, আপনাকে আর সময় দেওয়া যাবেনা। আমিও দেখি অনেক সময় ২০/২৫ মিনিটের জায়গায় অনেক সময় পার করে ফেলেছি। আমার ফিরতে হবে।
আমি উঠছি চলে আসব সতী তার বা’হাত থেকে একটি চুড়ি খুলে বলল, রেখে দেন। আমি গিফট দিলাম। আমি হাত পেতে নিলাম। একজন তার হাতের চুড়ি আরেক জনকে উপহার দেয় এঁটা সত্যি পরম পাওয়া। আমি সযতেœ আমার প্যান্টের পকেটে রাখি। দুজন কয়েক সেকেন্ডের জন্য দাঁিড়য়ে থাকি মুখোমুখি। হাঁটতে হাঁটতে সতী চলে আসে গেট পর্যন্ত। আমাকে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের আড়াল হওয়ার আগ মূহুর্তে আমাকে বা’হাতের নেড়ে বিদায় জানান। আমি নিঃশব্দে হাটঁতে থাকি সামনে। আমার পাশ দিয়ে শোঁ শোঁ করে চলে যাচ্ছে শত শত গাড়ি আমার সেদিকে খেয়াল নেই, শুধু কিছুক্ষণ আগের আর এখনকার সময়ের পার্থক্য অনুভবকরি।