ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০৭

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০৭

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২০৭,

শুক্রবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪, ১৯ মাঘ ১৪৩০, ২০ রজব ১৪৪৫ ।

























একজন ইজাজ আহমেদ মিলন

একজন ইজাজ আহমেদ মিলন

 


একজন 

ইজাজ আহমেদ মিলন

জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


কেউ একজন আমাকে নিয়ে গল্প লিখবে আমার এটা কোনো সময়’ই মনে হয় না কিংবা আমি কারো জন্য গল্প লিখবো; এটাও কোনো সময় মনে হয়নি । কিন্তু চলতে গেলে প্রকৃতি অনেক কিছু দেখায়; অনেক কিছু দেখতে বাধ্য করে; কারণ সৃষ্টি আর সৃষ্টির কোনো এক সম্পর্ক গড়ে উঠলে প্রকৃতি খুশি হয়; ঐ মালিকও খুশি হয়। 

এভাবে ছোট খাটো সম্পর্কগুলো এক হয়ে বড় একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে । যে সম্পর্ক কেউ চাইলেও ছিন্ন করতে পারে না; ছিন্ন করা যায় না । যদিও তার সাথে দেখা না হোক কোনো কালে; যদিও তার সাথে কথা না হোক ! তবুও সম্পর্কের মায়া, মমতা আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকে নীরবতায় ।


একজন ইজাজ আহমেদ মিলন; একজন জীবনযোদ্ধা; কাঁদা মাটির সরল সম্ভারী মানুষ; যাকে চিনেছি নানান সৃষ্টিতে; নানান দৃষ্টিতে । 


এই মানুষটাকে যত দেখেছি; জেনেছি; বুঝেছি ততই তার প্রতি সম্মানবোধ, শ্রদ্ধাবোধ এবং ভক্তি দ্বিগুন বেড়ে গেছে । 

একটা মানুষ কতটা উদার হলে মানুষ তাকে আগলে নেয়; একটা মানুষ কতটা নীতিবোধ সম্পূর্ণ হলে মানুষ তাকে সহজেই বুঝতে পারে; একটা মানুষ কতটা নিজেকে ভেঙে চুড়ে নির্মান করলে হাজার মানুষের মাঝে নিজেকে পতাকার মত মেলে ধরতে পারে, সেটা কেবল একজন ইজাজ আহমেদ মিলনকে দেখলেই বুঝতে পারি । 


তার কাছ থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে শিখেছি; নতুন ভাবে চলতে শিখেছি; নতুন কিছু বলতে শিখেছি । একজন ইজাজ আহমেদ মিলন ঘরে ঘরে হলেই আমাদের সমাজ বদলে যাবে; আমাদের দেশ বদলে যাবে; আমাদের চিন্তা বলদে যাবে । হাজার হাজার মানুষ তাকে পরান উজার করে ভালোবাসে । মানুষের প্রতি তার যে চেতনাবোধ, ইতিহাসের প্রতি তার যে অগাদ টান; তা সত্যি অবাক করার মত । মানুষকে নিয়ে তার যে চিন্তা; সমাজ, ইতিহাস এবং দেশকে নিয়ে তার যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ; তা প্রতিটি মানুষকে অবাক করে ।


৩রা ফেব্রুয়ারী এই সংগ্রামী যোদ্ধার জন্মদিন । ধানশালিকের পক্ষ থেকে তার প্রতি সহ¯্র ভালোবাসা এবং দোয়া । মহান আল্লাহ্ তাকে দীর্ঘায়ূ করুন । তার সুন্দর জীবন এবং সুস্থতা কামনা করছি ।

দিপা

দিপা

 


দিপা

শফিক নহোর



দিপা আমার দুবছরের ছোট। সম্পর্ক ভিন্নতর হলেও সে আমার খেলার সাথী। স্কুলে আমরা দুজন একসঙ্গে যাওয়া আসা করতাম। স্কুল ছুটির দিনে মাটি দিয়ে বিভিন্ন খেলায় মগ্ন থাকতাম সর্বক্ষণ। পুতুলবউ, পলান-টুকটুক, বৌছি, গোল্লাছুট, সাঁতার, বিলের জলে শাপলাফুল তুলে দিপাকে বউ সাজিয়েছি অনেকদিন- তা অগণিত ।

চড়–ইভাতি খেলে সময় পার করতাম। পূজার ভেতর হিন্দু বাড়িতে নাড়–, আর খই, খেয়ে হারিয়ে যেতাম। এ পাড়া থেকে সে পাড়া। ঘুরে বেড়াতাম ইচ্ছামত। নারকেল পাতার চশমা, ঘড়ি হাতে পরে ঘুমিয়ে যেতাম কখন তা টের পেতাম না। সকালে ওঠে যখন দেখতাম আমার ঘড়ি, অথবা চশমা ভেঙ্গে গেছে। অভিমানে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তো নোনাজল। নিপুণ কারুকাজ করে ঠিক করে দিত আমার সাধের সেই নারকেল পাতার ঘড়ি, আর চশমা।


‘আজ বন্দি হয়ে গেছে থ্রি জি নেটওয়ার্কের মাকড়সার জালে মিথ্যা প্রেমের মোহমায়ায়। বৃষ্টিতে ভিজে কাঁক হয়ে ফিরে যেতাম বাড়িতে। পেছন ফিরে দিপা বার -বার আমাকে দেখতো। আমি পেছনে ফিরে তাকাতে গিয়ে পরে গিয়েছিলাম কাদার ভেতর ও তা দেখে মুচকি হেঁসে কুটিকুটি হত। পাগলিটা আমার এত খেয়াল রাখতো। মেয়েরা বুঝি একটু খেয়ালি হয় পুরুষ মানুষের তুলনায়। কলাগাছের ভেলা বানিয়ে বর্ষার দিনে হারিয়ে যেতাম। ভেসে যেতাম দূরে কোথাও। কত রকম মজা যে করতাম। লগি হারিয়ে ফেলেছি একদিন। সে কি -যে কান্না আমি বুক পানিতে নেমে কলাগাছের ভেলা ঠেলে নিয়ে যেতাম কিনারে। বুকে জড়িয়ে ধরে নামিয়ে দিতাম।

বাবার সঙ্গে হাটে যাবার সময় তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাইতে। আমি বাবার ভয়ে তোমাকে একদিন ও নিয়ে যেতে পারিনি। হাট থেকে আসার সময় বাবা, আট আনার তিলে খাজা আর নিমকি কিনে দিত। তা ঠিক-ই রেখে দিতাম তোমার জন্য অর্ধেক।

দিপাদের বাড়িতে ছোট খাটো কাজ করে দিতে হয় আমার তার বিনিময়ে রাতে মা আর ছোট- বোনের খাবার নিয়ে যেতে পারি। মা এবং আমার ছোটবোন তা ভাগ করে খেত। অবশিষ্ট ভাত পানি দিয়ে রেখে দিত পরের দিন সকালে খাবার জন্য। দিপার আবদার ছিল ভিন্নতর । আমি বুঝেও না বোঝার ভানধরে থাকতাম। একদিন রাতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি চিৎকার করে বলেছি, কে রে, কে রে, ভূত? 

দিপা আমার মুখ চেপে ধরে নতজানু হয়ে বলেছিল, আমি দিপা। 

আমি আরও জোরেশোরে চিৎকার দিলাম। দিপা আড়াল হয়ে গেল। ওর মা এসে বলল,

কই কেউতো নেই ?

তোমার কি ভূত বা জিন টিন কিছু ধরে ?

আমি মাথা নেরে না সূচক জবাব দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করলাম।

ভোর হলে ছুটে যেতাম দিপাদের বাড়িতে। গোয়াল ঘর থেকে গরু, ছাগল বের করবার জন্য। ছোটখাটো কাজ করতে-করতে স্কুলে যাবার সময় হয়ে যেত। তার পর চিড়া-মুড়ি খেয়ে স্কুলে রওনা দিতাম। পুরো সংসারটা আমার মাথার উপর, ভেতরে নদী ভাঙনের ভয়। এত অল্প বয়সে কি কারো বাবা মারা যায় ? বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। বাবা আমায় ছাড়া একদিন ও একা বিছানায় ঘুমাতে পারতো না অথচ এতো ছোট একটা কবরের ভেতর বাবা কেমন করে আছে? আমাকে একা রেখে। টাকার অভাবে এসএসসি পরীক্ষা দিতে না পারার কষ্ট অন্য রকম। আমি পুরো দমে দিপাদের বাড়ির রাখাল। বেশ কয়েক বছর ধরে। 

দিপা এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন থেকে সে তার মামার বাসায় থাকবে।

আমার ঠা-া জ্বর, সারারাত কাশি, দম বন্ধ হয়ে আসে। দুই তিনটা কবিরাজ দেখানো হয়েছে। কোন কাজ হলো না। ছোট বোনটা লতার গাছের মত দিন-দিন বাড়ছে ছেলে দেখে বিয়ে দিতে হবে। মা আমার জন্য মনে-মনে মেয়ে দেখে রেখেছে। তার পছন্দ অনুযায়ী আমাকে বিয়ে করতে হবে। এদিকে পৃথিবীর বুক থেকে চলছে আমার বিদায় যাত্রা। আমার শরীর দিন-দিন অগ্রগতি হারাচ্ছে। অবশেষে শহরের ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তার বলেছে, আমার ফুসফুসে ক্যান্সার। চিকিৎসার খরচ বহন করবার মত সাধ্য আমার নেই, ছিলোও না কোনোদিন। আমি স্বেচ্ছায় পরাজয় মেনে-নিয়েছি। কিছুদিন পর ঘর বন্ধী হয়ে গেলাম।


পরিচিত লোকজন আমাকে দেখতে আসত। বিভিন্ন খাবার, ফল, বা আমার পছন্দের খাবার কী জানতে চাইত ? মরে যাবার আগে কি? শুধু মানুষ তার প্রিয় খাবার খেতে চায় ? প্রিয় মানুষটি কে দেখতে চায়না ? দিপাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি। দিপা আমার প্রিয় একজন। আপনের আপন। ইট পাথরের শহরে মানুষ- মানুষকে সহজে ভুলে যায় দিপা ও নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে গেছে।


পোস্টমর্টেম

পোস্টমর্টেম

 



পোস্টমর্টেম

আকিব শিকদার 


পোস্টমর্টেম কাকে বলে জানো? 

নীলাদ্রির যে বয়স, সেই বয়সে পোস্টমর্টেম কাকে বলে জানার কথা নয়। অনিমেষ চাচ্চুর প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে তার মাথা নিচু হয়ে গেল। লজ্জাবতি লতায়ের স্পর্শ লাগলে পাতাগুলো যেমন ক্রমান্বয়ে নিচু হয়ে যায়, অনেকটা সেই রকম কান্ড। 

অনিমেষ চাচ্চু বললেন- “মানুষের অপঘাত মৃত্যু ঘটলে সেই মৃত্যুর কারণ জানতে আইনি তদন্তে লাশকে যে কাটা ছেঁড়া করা হয়, সেটাই পোস্টমর্টেম। একবার পোস্টমর্টেম করতে গিয়ে কী ঘটনা ঘটেছিল, শুনতে চাও?” 

গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে! লোডশেডিং এর রাত থাকলে আর আকাশে চাঁদ থাকলে ছাদে বসে গল্প শোনার মজাই অন্যরকম। যাই হোক, অনিমেষ চাচ্চু যে বিষয়টা বলতে চাচ্ছেন, সেটা তো আর গল্প নয়; তারই জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। তবে বিষয়টা যে ভুতুড়ে হবে, নীলাদ্রি তা অনেকটা আন্দাজ করতে পারছে। কারণ ব্যাপারটা লাশ কাটাকাটি নিয়ে। সে বলল- “কি ঘটেছিল চাচ্চু?” 

আকাশের ঠিক মাঝখানটায় আশ্বিন মাসের চাঁদ, রূপার থালার মতো জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আবছা আলোয় হাতলওয়ালা চেয়ারটায় নড়ে চড়ে বসলেন অনিমেষ চাচ্চু। তারপর বলতে শুরু করলেন- “দিনটা ছিল মঙ্গলবার। অলক্ষণে দিন। নাম মঙ্গল, অথচ পৃথিবীর সব অমঙ্গল যেন এই দিনেই ঘটে। রাত নয়টার দিকে একটা ছাই রঙা পিকআপ এসে লাশ কাটা ঘরের সামনে থামল। লাফালাফি করে দুজন পুলিশ নামলেন গাড়ি থেকে। গাড়ির পেছনের অংশের দরজা খুলে পুলিশ দুজন ধরাধরি করে বের করে আনলেন একটা মৃতদেহ। লাশটা বাঁশের চাটাই দিয়ে শক্ত করে মুড়িয়ে রাখা। নলকূপের মোটা পাইপের মতো দেখতে। তবে লাশটার যে বেশ ওজন আছে, তা বুঝা গেল পুলিশ দুজনের হাঁটার ভঙ্গি দেখে। ভারী জিনিস বহন করলে পা দৃঢ়ভাবে ফেলতে হয়, মুখের চামড়া শক্ত হয়ে থাকে। মৃত দেহটা লাশ কাটা ঘরের বারান্দায় লম্বালম্বি ভাবে রাখা হলো। 

অনিমেষ চাচ্চুর কথা শুনে নীলাদ্রির কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। মানুষের লাশ বলে কথা। বাঘ মরলে সমস্যা নেই, ভাল্লুক মরলে সমস্যা নেই, সিংহ মরলে সমস্যা নেই, কিন্তু মানুষ মরলেই বিপদ। মানুষের মৃত আত্মা নাকি ভূত হয়ে ঘোরাঘুরি করে। অনিমেষ চাচ্চু বলেই চলছেন- “পুলিশ দুজনের একজন চাটাই এর বাধন খুললেন। লাশটা মধ্যবয়সী মানুষের। চল্লিস-পয়তাল্লিশের মত বয়স হবে। দাড়ি সেভ করা, তবে গোঁফ আছে। কুচকুচে কালো মোটা গোঁফ। আম গাছের ডালে ফাঁসি নিয়ে মরে ছিল লাকটা। গলায় দড়ির দাগ লেগে আছে। চোখ দুটা অসম্ভব রকমের বড় বড়। কাঁকরার চোখের মতো কুঠুরির বাইরে বেরিয়ে এসেছে যেন। জিহ্বাটা প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা হয়ে ঠোঁটের উপর দিয়ে ঝুলে আছে, কুকুরের জিব্বা যেমন ঝুলে থাকে। রূপকথার রাক্ষসের মত লাগছে দেখতে। মানুষের জিহ্বা লাল, তবে এ লোকটার জিহ্বা কালো। ফাঁসি নিয়ে মরলে রক্ত জমাট বেঁধে জিব্বা কালো হয়ে যায়। আমি লাশটার দায়িত্ব বুঝে নিতেই পুলিশ দুজন পিকাপটায় চড়ে চলে গেল। তখন লাশ কাটা ঘরে মৃতদেহটার সামনে আমি একা। পোস্টমর্টেম তো আর সন্ধ্যা রাতে করা হয় না, পোস্টমর্টেম করতে হয় মধ্যরাতে। খুব সিগারেট ফুকতে ইচ্ছে করছিল। পকেটে হাত দিয়ে দেখি সিগারেট নেই। এদিকে কেউ আসেও না যে তার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নেওয়া যাবে। ভাবলাম দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনলে মন্দ হয় না। লাশ কাটা ঘর থেকে একটু দূরেই একটা মোদির দোকান আছে। মৃতদেহটাকে চাটাই দিয়ে আগের মত শক্ত করে মুড়িয়ে রেখে দোকানটার দিকে রওনা দিলাম। এক কাপ চা খেয়ে আর দোকানীর সাথে কয়েকটা টুকিটাকি কথা বলে ফিরে আসতে একটু দেরি হলো। সিগারেট ফুকতে ফুকতে লাশ কাটা ঘরের বারান্দায় এসে কী দেখলাম জানো?” 

নীলাদ্রিদের বাসার ছাদে ঝিরঝির বাতাস বইছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে নীলাদ্রির। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা ঢোক গিলে নিয়ে সে ছোট্ট করে জানতে চাইলো- “কী” 

অনিমেষ চাচ্চু বলতে থাকলেন- “বাঁশের চাটাইসহ লাশটা যেন নড়েচড়ে উঠছে। চাটাই এর ভেতর থেকে একটা গুমগুম শব্দ শোনা গেল। শব্দটা মানুষের কন্ঠের মত নয়। ভূত টূত নয় তো আবার! বারান্দায় সুডিয়াম লাইট জ্বলছে, ভূত আসবে কেমন করে! ভূত আলো ভয় পায়। ভূত হোক, আর যাই হোক, লাশটার কাছে ভিড়তে সাহস পেলাম না। লাশ কাটা ঘরের পাশেই সপ্তর্ষিদের বাড়ি। সপ্তর্ষি আমারই মতন লাশ কাটার চাকরি করে। সে প্রতিদিন আমাকে লাশ কাটার বেলায় সাহায্য করে। সেদিনও তার আসার কথা ছিলো। সেখান থেকে এক দৌড়ে ছুটে গেলাম তাদের বাড়িতে। সপ্তর্ষি আমার চেয়ে বয়সে কম, কিন্তু সাহস আছে অনেক। অনেক  দুঃসাহসী কাজ একাই করতে পারে সে। ভূতপ্রেতে ভয় পাওয়া তার সংবিধানে নেই। একটা লম্বা লাঠি হাতে সে লাশটার কাছে গেল। যাবার আগে লুঙ্গিটাকে শক্ত করে নেংটি বেঁধে নিয়েছে, যাতে কোনো সমস্যা না হয়। লাশটার নিরাপদ দূরত্বে ঝুঁকে ধারালো সে। ডান হাতে লাঠিটা নিয়ে বাম হাতে চাটাই এর বাঁধন খুললো মাত্র। অমনি এটট৬কটা খেকশিয়াল পরিমড়ি করে বেরিয়ে গেল চাটাই এর ভেতর থেকে। মরা মানুষের গন্ধ পেয়ে এসেছিল মাংস খাওয়ার জন্য। শিয়ালটার ভাগ্য ভালো, আরেকটু হলে প্রাণ দিতে হতো সপ্তর্ষির লাঠির আঘাতে। রাত বারোটার দিকে শুরু হল পোস্টমর্টেম। গলা পেট পিঠ কেটে পরিক্ষা নিরিক্ষা। পরীক্ষাটা খুব সূক্ষ¥ভাবে করতে হবে। ফলাফলের উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। লোকটা নাকি আত্মহত্যা করেনি। শত্রুপক্ষের কেউ একজন নাকি লোকটাকে গলা টিপে মেরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে। পোস্টমর্টেমের ফলাফলেই বলে দেবে এটা আত্মহত্যা নাকি শত্রুপক্ষের হত্যাকা-ের সাজানো নাটক। পরীক্ষার জন্য লাশটার পেট কেটে কলিজা ও ফুসফুস রেখে দেওয়া হলো। ভোর রাতের দিকে সেই পিকআপে চড়ে কয়েকজন পুলিশ এসে লাশটা নিয়ে গেল।  লাশটার কলিজা ও ফুসফুস রেখে দেওয়াতেই হলো সমস্যাটা। 

অনিমেষ চাচ্চুর বর্ণণা শুনে নীলাদ্রীর খুব ভয় লাগছে। ভয়ে তার চোখের কোনায় পানি এসে গেছে। এক পা দুই পা সরে এসে সে অনিমেষ চাচ্চুর হাতলওয়ালা চেয়ারটার সাথে মিশে দাঁড়িয়েছে। চাচ্চু চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেই চলছেন- “লাশটা চাটাই দিয়ে মুড়িয়ে শক্ত করে বেধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পথে সে বাধন খুলে গেল। পুলিশেরা গিয়েছিল লাশটা পুনরায় মুড়িয়ে দিতে। তারা শোনলো লাশটা কথা বলছে, ‘আমার কলিজা কই? আমার ফুসফুস কই? আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে। কলিজা ছাড়া, ফুসফুস ছাড়া আমি যাব না তোদের সাথে। আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে।’ কী ভুতুড়ে কান্ড! পুলিশেরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল কান্ড দেখে। কিছুতেই তারা লাশটাকে চাটাই দিয়ে মুড়াাতে পারছিল না। ফজরের আজান শোনার পর অবশ্য লাশটা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল।” 

নীলাদ্রির হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। কারেন্ট এসেছে। রাস্তায় সোডিয়াম লাইট জ্বলছে। অনিমেষ চাচ্চু তবু বলেই চলছেন- “তারপর বেশ কয়েক দিন কে যেন লাশ কাটা ঘরটার চারপাশে ঘুরে বেড়াতো। শুকনো পাতা ঝড়ার মতো পায়ের আওয়াজ শোনা যেত। আর শোনা যেত ফিসফিসানু শব্দ, ‘আমার কলিজা কই? আমার ফুসফুস কই? আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে।’  এখনো মাঝে মাঝে একা একা বসে থাকলে শুনি কানের কাছে মুখ এনে কে যেন বলছে, বেশ শব্দ করেই বলছে, আমার কলিজা কই? আমার ফুসফুস কই? আমার কলিজা দে, আমার ফুসফুস দে।” 

এখন অনিমেষ চাচ্চু সম্পর্কে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনিমেষ চাচ্চু জীবনটা কাটিয়েছেন কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালের পোস্টমার্টেম ইউনিটে কাজ করে। রাত বিরাতে লাশ কাটাকাটিই কাজ। গত তিন মাস ধরে তিনি আর কাজে যান না। এই লাশ কাটাকাটির কাজটা নাকি তার আর ভালো লাগে না। বয়স হয়েছে, শরীর আর কত কুলাবে! তার চেয়ে বড় কথা ইদানিং কী একটা রোগ দেখা দিয়েছে তার। একা একা বসে থেকে বিড়বিড় করে কী সব বলেন তিনি। সেসব কথার কোন অর্থ থাকে না। ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকার রামপুরায় নীলাদ্রিদের বাসায় এসেছেন অনিমেষ চাচ্চু। ডাক্তার বলেছেন রোগটা শারীরিক নয়, মানসিক। অনিমেষ চাচ্চুকে একজন ভালো মনোচিকিৎসক দেখাতে হবে।


পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১

 



কথাকুঞ্জ

ঋতিদীপ্ত শ্যামল


১.

ঘূর্ণায়মান চাকার কেন্দ্রে একটু আধটু তেলের প্রয়োজন হয়ে থাকে, না হয় চাকা ঘোরে না, গতিও বাড়ে না-  ড্রাইভারকে সেকথা জানতে হয়। মানুষের কর্মের গতি বাড়াতেও তেমনি তেল স্বরূপ প্রেরণা দিতে হয়, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এই বিদ্যা ভীষণ জরুরি। 


২.

খাঁচায় পোষা পরাধীন পাখিরাই শুধু শেখানো কথা বলে থাকে।  তোমার কথাও তারাই  বলছে- যারা তোমার কূটখাঁচায় এখন বন্দি। আর তোমার সেবাই এই বন্দিবিদ্যা। প্রভূত্বপ্রাপ্তিযোগ সেবা থেকেই আসে। তবে প্রভুত্বপ্রাপ্তিলিপ্সা একটি ভাঙা খাঁচা মাত্র।


৩. 

সূর্যকে কেন্দ্র করে যেসব গ্রহ ঘোরে, সবগুলো নিজ নিজ কক্ষপথেই ঘোরে। কেউই অন্য কারো কক্ষপথ কখনও অনুসরণ করে না করবেও না, কিন্তু তাদের সবার কেন্দ্র একই-  সূর্য। কারও কক্ষপথে কেউ ঢুকলে সৌরজগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত নিশ্চয়ই। তাই তোমাকেও মনে রাখতে হবে: কেউই তোমার মতন হবে না; প্রত্যেককে তারই গুণমতো গড়ে তুলতে পারলে সেই-তারাই তোমার প্রতি কেন্দ্রস্থ শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য হবে। নেতা হতে হলে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।


৪.

যে গাছের একটাই মাথা, সেসব গাছই সরল বা সোজা হয় দেখছি। তাই সহজ মানুষের সমাজেও একজনমাত্র নেতা থাকতে হবে। না হয় সামাজিক পরিস্থিতি জটিল হবে। পারিবারিক স্বস্তিও সেই পরিবারে রয়েছে, যে পরিবার যোগ্যজনের একক সিদ্ধান্তে চলেছে।



কবিতা) 

ভালোবাসা

রাফি ফরায়েজী 


লাল আধর চুষে, মধুর আস্বাদন করা। 

কোমল ছোঁয়াতে, শিহরণ তুলে ঝরে পড়া উদ্বেল যৌবন। এ নয় ভালোবাসা। 

গোলাপে চুমু এঁকে কেবল, মধু সঞ্চয়ের প্রতারণা। কামনা পূরণের খেয়াল সাধনা। 

ভালোবাসা তো ষোড়শী কুমারীর লিপস্টিকের মতন, হৃদয়ে লেপ্টে থাকা করো প্রেমের মায়াবী আল্পনা।



ইনভার্টেড কমার ভেতর

উদয়ন চক্রবর্তী 


আমি একটা জায়গা খুঁজছি 


যেটাকে মনে হবে আমার, একান্ত আমার 

তখনই মহাজাগতিক ঝড় ভাসিয়ে 

নিয়ে এলো নৈসর্গিক ধূলো আর তাপ


যা আমার রক্তের ভিতর শতাব্দীর জমাট 

অহংকার বারবার জমাট বাধে অ্যাসপিরিন দিয়ে

লঘু করি সে কালচে রক্ত

আর ঠিকানা হীন পথে হেঁটে হেঁটে পথ খুঁজে মরি পিঁপড়ে দের মতো


মোবাইল টাওয়ারের মাথায় ক্লান্ত চিল

পড়ন্ত বিকেলে নেশাতুর মানুষের 

না পাওয়ার কান্না শুনে

নিজেকে যথার্থই স্বাধীন ভেবে একবার 

আকাশের দিকে তাকায় 

সূর্যাস্ত দেখবে বলে

উঁচু মানুষেরা কারাগারের

ওপরে বসে আলো ঘড়ি দেখে আস্থানায়

ফেরার মানচিত্র আঁকে


কৌতূহল ওকে জানিয়ে দেয় মৃত্যু নিয়ে 

মানুষের এড়িয়ে যাওয়ার অনুভব 

সেখানে হাজার জিজ্ঞাসা চিহ্ন হাতে দাঁড়িয়ে 

আছে সময়ের অপেক্ষায়

আর আমরা মানুষ নামের পোকা ইনভার্টেড কমার ভেতরে সেঁধিয়ে আছি মুহূর্ত দের হাতে নিয়ে।


শিক্ষার মাথা ন্যাড়া 

মনোজ চৌধুরী 


বেকারত্বের আগুনে জ্বলছে চারিদিক

হাজার হাজার দিন ঘুরে মেরুদন্ড নাজেহাল 

আগামী কী নিথর কানা বোবা ? 

শিক্ষা করলো মাথা ন্যাড়া- ভবিষ্যৎ হল টালমাটাল

তারা’ই কি লোহিতদূর্নীতির বাবা? 

শিক্ষার পোশাক কেড়ে: তারা কি করেছে ঠিক? 


আজ শিক্ষার মাথা ন্যাড়া 

ডুকরে ডুকরে কাঁদছে এক নারী-সমাজ-আগামী 

রঙিন চোখের স্বপ্ন চুরমার করেছে যাঁরা 

অন্ধকারের রক্তে দূষিত এই ভূমি

বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছি তুমি-আমি 


আজ শিক্ষা যেন যন্ত্রণায় কাঁদছে 

তার সঙ্গে কাঁদছে হাজার হাজার মুখ 

ডিগ্রি নম্বর মার্কশিট চুলোয় যাচ্ছে 

শুধু অন্ধকারের রাস্তা উন্মুখ। 


আজ শিক্ষার মাথা ন্যাড়া 

ডুকরে ডুকরে কাঁদছে এক স্বপ্ন 

ডুকরে ডুকরে কাঁদছে সমাজ 

যন্ত্রণায় কাতর এক নারী 

আর অন্ধকার আগামী। 


আজ শিক্ষার মাথা ন্যাড়া

শিক্ষা ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।



নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি

রাতিক হাসান রাজীব


একটা নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে 

ছেয়ে যাবে মাঠঘাট, 

ওাস্তার মোড়, রেলস্টেশন

শহরের অলিগলি, সর্বত্র। 

লিখা থাকবে- 

কবির কবিতা হারিয়ে গেছে। 

হারিয়ে গেলে তুমি

হারিয়ে যাবে তোমার সেই চোখজোড়া;

যেখানে পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার ঘনীভূত 

আমি তাকালেই ডুবে যাই অতল সমুদ্রে। 

হারিয়ে যাবে তোমার ঠোঁট;

যার হাসিতে আমার পৃথিবীর সমস্ত সুখ লুকায়িত।


আনাড়ি

রুদ্র সুশান্ত


যে আগুন জ্বলছে জ্বলুক

বৃথা চেষ্টার কি ছিল দরকার? 

এই আগুন জ্বলে জ্বলে নিভে যাবে

না হবে অন্যায় না হবে প্রতিবাদ আর। 


যে মাটি জ্বলছে বিনা দোষে

বিনা কারণে যে হল ছারখার-

পদ্যরা ঘুমিয়ে পড়ে শিরিষতলে

এইখানে আমিই প্রেমিক আমিই সরকার। 


এখানে পানির উপরে পদ্ম ফুটে না

সবুজে সবুজে ভালোবাসার কথা কয়না আর, 

ছেলেটা করেনা প্রেমের বায়না

নিঃসংকোচে জীবন চলছে যার।


প্রথম চুমুর রাত

আশরাফ চঞ্চল


কেউ একদিন ডেকেছিল কাছে-

ছায়াঘূর্ণি রাতে

ঠোঁট মদিরায় চুমুক দিয়ে

হয়েছিলাম রাজা! 

আমার সামনে যারা ছিল সবাই যেন প্রজা!


পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২

 



সমর্পিতা

শঙ্খশুভ্র পাত্র


সমর্পিতা আমি বুঝি। শুভ প্রাতে তোমার সান্নিধ্য

ধানে ঘ্রাণ আনে নবান্নের প্রীতি। ইতিহাস সাক্ষী

রেখে অগ্রসর হতে চাই। সাহিত্য আমাকে ঋদ্ধ

বরাবরই করে শ্রীরামকৃষ্ণের মতো বিশালাক্ষী


দেবীকেই মান্য করি। আমি খুবই সহজ-সরল।

তোমার বিদগ্ধ জ্ঞানে নত হই বিশ্বাসে অধীন

সরস্বতী মনে-প্রাণে লক্ষ্মীকৃপা, অতীব চঞ্চল

অভাবের দ্বারে এসে দেখা দেবে প্রার্থিত সুদিন।


এই মতো ভাবি, আর অর্পিতার রাঙা-করতলে

একটি গোলাপ রেখে মনে-মনে থেকেছি উদাস...

গুপ্রভাত সম্ভাষণে, সারাদিন তারা হয়ে জ্বলে।

আমার স্বপ্নের কাছে তুমি এক মহার্ঘ আকাশ।


সমর্পিতা, আমি তো জানি না কিছু কে আমাকে টানে

নতুন বরষে এসে, ভালোবেসে, খুঁজি তার মানে...


একদিন সে আসবে

মুহাম্মদ নূর ইসলাম 


লাল শাড়ি পরে একদিন সে আসবে

ঘোমটা মাথায় দিয়ে আমার পাশে বসবে,

একদিন সে আসবে।


কোমল হৃদয় সিক্ত করে আমায় ভালোবাসবে

আঁচল টেনে মুখ লুকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে,

একদিন সে আসবে।


সুযোগ পেলে হাতছানিতে আমায় কাছে ডাকবে

বুক পাঁজরে যতœ করে আমার ছবি আঁকবে,

সবার চেয়ে অনেক বেশি আমায় ভালোবাসবে

একদিন সে আসবে।


মেহেদিতে রাঙা দুহাত আমার হাতে রাখবে

চোখের ভাষা, মনের কথা, সবটা বুঝে থাকবে,

তার মনের আকাশ জুড়ে আমার ছবি ভাসবে

একদিন সে আসবে।


খালি পায়ে আলতা পরে উঠোন জুড়ে হাঁটবে

আমার কথা ভেবেই তার সারাটা দিন কাটবে,

শূন্য হৃদয় পূর্ণ করে আমায় ভালোবাসবে

একদিন সে আসবে।




সুলেখার প্রতি

এবি ছিদ্দিক


যদি কখনও আসতে চাও

তবে সবুজ রঙ মেখে এসো...

মালা দিও...কাঁটা দিওনা, প্রিয়।

আমি অনেক রুগ্ন ও পা-র হয়ে যাচ্ছি ! 

দেহে ব্যধি বাসা বেঁধেছে...

বাক যন্ত্রও বুঝি বিকল হয়ে যায় !


ভোরের সূর্য ক্রমশ অস্তমিত হতে যাচ্ছে...

আমিও আমার ঋতু চক্রের শেষ প্রান্তে !

তোমার উষ্ণ হাতখানা.. 

আমার বুকের উপর রেখো

যেন চার চোখের শেষ কথাগুলো শেষ হয়।



পথে চলে যেতে যেতে

নাসরিন জাহান মাধুরী 


তুমি সামনে এলেই 

থেমে যাই, থেমে যায় অবিরাম কলকল কথার নদী

থেমে যায় মনের গহনে বয়ে চলা ঝর্ণার সরোবর

ফুলের হাসি পাখির গান সব থেমে যায়

নীরব বিশ্ব চরাচরে একা দাঁড়িয়ে থাকি

অনাবিল আনন্দে থরো থরো কাঁপি


তুমি হাসলে

আলোকিত ভোরে দেখি আকাশ হাসে

ফুলেরা দোলে সুশীতল সমীরণে

ভোরের পাখিরা ডানা মেলে গানে গানে

নীরবে খুন হই হাসিতে 

শব্দের মালা গাঁথি নিঃশব্দে 


তুমি দূরে গেলে

হৃদয় চিরে বয়ে যায় বরফ গলা নদী

চোখ জুড়ে মেঘলা বিষন্ন আকাশ

শীতল ¯্রােত বয়ে যায় অস্তিত্ব জুড়ে 

কুঁকড়ে যাই, কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে রই অসাড়

ভীষণ ঘুম পায় তখন, মরণ ঘুম


তবুও 

আমি দাঁড়িয়ে থাকি স্বর্গের উদ্যানে যেন

পথে চলে যেতে যেতে



বরফ শীতল বাতাস

গাজী তৌহিদ


স্মৃতিগুলো যুগ পেরুলেই হয়ে যায় বেদনাবিধুর কাব্য, 

শীতকাল, হাড় কাঁপানো শীত! ভোরের আবছা অন্ধকার, 

হিসাব-নিকাশের জট খুলতে বহুপথ হাঁটছি তো হাঁটছি! 

থমকে যায় হঠাৎ! বাইসাইকেল প্যাডেলের খটখট শব্দ-

বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সাথে মিশে যায়;

পাতলা হাফ হাতা গেঞ্জি, মাফলার বা টুপি ছাড়া কান! 

হাত-পা ঠা-ায় কেমন বরফ হয়ে যায়! 

টিউশনি হারানো মন খারাপ করা বিকেল- 

ব্যস্ত শহরে মেসের ছাদে পা ঝুলিয়ে একলা বসে থাকা;

নিঃশব্দে কখন অট্টালিকায় ছেয়ে গেছে- 

কুয়াশায় হারিয়া যাওয়া মাঠ, ফসলী ক্ষেত, 

রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত খাল-বিল, ভাঙা চায়ের দোকান। 

মাঝরাতে খেঁজুরের ঠান্ডা অমৃতের স্বাদ- 

পানসে হয়ে গেছে হয়তো এতো দিনে! 

পাতা ঝরা মেহগনি বাগানের ক্রিকেট খেলা, 

সন্ধ্যা নামার আগেই এখন বন্ধ হয় কিনা কে জানে! 

বহুদিন বহুপথে বহু লেনদেনের অনিশ্চিত হিসাব

ধেয়ে আসে বরফ শীতল বাতাসে...


স্মৃতির দর্পণ

মুবাশশির খন্দকার!


জীবন কখনো থেমে থাকে না! অবিরাম চলে যায়। বহমানের নদীর ¯্রােতের ন্যায় তরতরিয়ে কেটে যায় অষ্টপ্রহর। ফেলে আসা দিনগুলো বিমূর্ত অতীত হয়ে যায়। সেই অতীতজুড়ে থাকে কিছু মায়া-প্রীতি-টান ও জ্বালামিশ্রিত অনুভব। যা আজীবণ জিইয়ে থাকে স্মৃতিপটে! মানসপটে আষ্টে- পৃষ্টে সেঁটে থাকে, কিছু রমরমা স্মৃতি ও ঝলসে যাওয়া অতীত!

কিছু বিষাদ ও দহন মেখে একাকার থাকে স্মৃতির দর্পণ! যে স্মৃতি রোমন্থনে ভীষণভাবে বিষিয়ে ওঠে মন! অনেকক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক জাগড়ণেও ব্যাঘাত ঘটে। কিন্তু সেই যাপিত দিনগুলো সম্যকদর্শনে সযতনে খুঁটিয়ে দেখলে, মিলে যায় কিছু আনন্দঘন মুহুর্ত, রঙিন ও “অত্যুজ্জ্বল অতীত”! যার জাদুবলে আমাদের এগিয়ে যাবার প্রয়াসটুকু ক্রমান্বয়ে

বৃদ্ধি পায়। কখনোই থিতু হতে পারে না, হতোদ্যমের নিকষ

জংলায় জর্জরিত বেড়াজাল!

ঠিকই কোথাও প্রচ্ছন্নভাবে আগলে থাকে, এগিয়ে যাবার

টিমটিকে বাতিটুকু; প্রত্যাশার চিরঅম্লান দ্যুতি!

যা যতনে দিবালোকে পরিণত হয়!


পদাবলি : ০৩

পদাবলি : ০৩


 


আমাদের মনে আগুন লাগুক

হাসান মাহাদি 


আগুন জ্বলে 

বাসে, ট্রামে, ট্রেনে

আগুন জ্বলে

হায়নার লোভাতুর চোখে 

জীবন্ত মানুষের রক্তের লোভ, 

জলন্ত হাড়গোড়-গোস্তের লোভ,

ক্ষমতার লোভ।

আগুন জ্বলে নিরাপদ নীড়ে

আগুন জ্বলে বেকসুর দেহে

আগুনে ছারখার স্বপ্ন, সংসার।


আগুন শুধু জ্বলে না নিভে যাওয়া হৃদয়ে

প্রতিবাদে, প্রতিশোধে

আর আমাদের বিক্রি হয়ে যাওয়া বিকৃত চেতনায়

আগুন শুধু জ্বলে না জালেমের কালো হাত ভেঙে দেওয়ার তাড়নায় 

আগুন জ্বলে না আমাদের আত্মকেন্দ্রিক কামনায়-বাসনায়

গোপীবাগে ট্রেনের আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া 

সেই শিশুটির হাড়গুলো নিয়ে কেউ মিছিলে যাবে না

পিশাচের আগুনে যখন মানুষ জ্বলে 

তখন ঝলসানো মুরগীর লেইগ পিস আর লাল ওয়াইনে ব্যস্ত বেহায়া পুঁজিবাদ

নির্লজ্জরা স্লোগান দিবে

কথিত ডেমোক্রেসির পলিটিকাল গেইমের বিজয়ে

বেহায়া বুদ্ধিজীবীর শব্দদূষণে 

হলুদ মিডিয়া ঢেকে দিবে পুড়ে যাওয়া মানুষের ছাইগুলো।


আগুন জ্বলছে 

জ্বলুক!

একাত্তরের মতো গ্রামের পর গ্রাম আর শহরের পর শহর জ্বলুক

তবেই যদি হুঁশ আসে নিভে যাওয়া বারুদের

আগুন নেভাতে আগুনের প্রয়োজন 

আমাদের মতো আত্মকেন্দ্রিক আর স্বার্থপর মানুষগুলোর মনে আগুন লাগুক।



করুণ চারু বিষাদনামা

রফিকুল নাজিম


তোমা প্রেমিক হতে গিয়ে আমি কবি হয়ে গেলাম।

বিচ্ছেদের এই বিরানভূমিতে 

বিষাদ আমার কালি

জীবন আমার কলম।

আমি প্রেমপত্র লেখার বদলে লিখে যাচ্ছি 

করুণ চারু এক বিষাদনামা,

বিচ্ছেদের গোপন অনলে পুড়ে পুড়ে 

আমি লিখে যাচ্ছি বিরহের অনিন্দ্য এক কবিতা- ‘তুমি কেন আমার হলে না?’



দ্বিতীয় ওজুদ

হুসাইন আহমদ 


কমলা রঙের রোদে তোমাকে লিখছি

তোমাকে লিখছি জীবনের খেরোখাতায় 

কবিতা আমার

যে কোনো মূহুর্তের কাছে তুমি চিরবিস্ময় 

এবং চির উচ্ছ্বাসের নাম


জীবনের নিটোল অধ্যায়গুলো খরচ করে

তোমার পেছনে ছুটছি হরদম

তোমার জন্য তকমা জুটেছেউদাসী

পাগল, মাতাল, বদ্ধ উন্মাদ 

আফোসোস নেই

কবিতা আমার 

আমি জানি, আমার অস্তিত্বের আরেক নাম তুমি


রমণীর কেশভাগ ছুঁতে গিয়ে 

যখনই মনে পড়েছে তোমার কথা

নির্জনতা তরক করেছি

দুই হাতে টুটি চেপে 

ভুলে গেছি প্রবাল পৌরুষের কথা

কবিতা আমার 

আমার মুহুর্মুহু বেদনার দিনে তুমি অব্যর্থ ওষুধ

আমার করোটির ডাকনাম তুমি

আর তুমিই দ্বিতীয় ওজুদ


মিলনের অসুখ 

মিজান মনির 


স্বপ্ন-প্রেম

আশা-ভালোবাসা

দু’জনা অমৃত অসুখে!

মর্ত্যলোকে বাসা


মেহেদী, বিয়ে

দু’জনার সন্ধি

আগামী নিয়ে


ঘুম ঘুম রাতে

নরোম পাহাড়ের নিচে

মিশে যাবো

     খতিয়ান দাগে! 


গড়বো পূর্ণ উত্তাপ-চাষে

স্বপ্নের শেকড়Ñ 

আঁকা ইতিহাসের পাতায় 

প্রজন্ম স্মরণ।



শীত আমার বোধের অনুক্ষণ

লুৎফা শাহিন


কুটুম্বশীত মোড়ানো কুয়াশা ঢাকা সন্ধ্যারাতÑ

সকালের রোমান্টিক সোনালি রোদ্দুর আমাদের লৌকিক ঐতিহ্য-অনুভূতি

আর বাঙালির পিঠা-পার্বনের বারতা প্রেমের আয়োজন কেমন মাতিয়ে রাখা

অলসতার দিনানিপাত মিষ্টি বিকেলের ভাঁজে ভাঁেজ স্পৃশ্যতার সংবেদ

কবির হৃদয়ে লুকোনো ছায়াসুন্দর রসিক উষ্ণতার সময় পার হয়!

আহা! কী সুন্দর তীব্র আবেগ শীতকে চেতনার মেজাজে আলাদা করছি আজ


আমাদের বেড়ে ওঠা দূর্বাঘাসে নারীঘুম মাতালবোধ নিয়ে ফিরে আসো তুমিÑ

আর চলে যাও অজানা শহরের ঠিকানায়Ñ 

কুয়াশা-সূর্যের লুকোচুরি পরির্বতনের খেলায় আমার বোধের ভেতর

শীত এখন নতুন বিস্ময়ের এক অনুক্ষণ! 



শীতের ঘটনা দৌড়ে যায় না!

মাসুদ মুস্তাফিজ


গতগ্রীষ্মে একটা ফ্লাটবাসা বন্ধুধ্বনির কাছে ধার নিয়েছিÑ

তারপর আমাদের আমাদের ইচ্ছেগুলো  জেগে থাকে কুয়াশায় নদীর  ঢেউয়ে

তারপর আমাদের মৃত্যু রচিত হয় আগুনজলে। এবং আমাদের অমার্দীঘ

সংসারের বিড়ালকলহ কিংবা বাক্যহীন অশেষ বিবেক সমস্ত শীত অব্যয়ে

স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাচ্ছে  জমাটবাঁধারোদেÑ

শীত নিয়ে আমার গোধূলি আর ভোরের কুশল নেই আপাতত

শীত আমার ভালোবাসা যৌথ মমতায় স্মৃতিসঙ্গ ডানপিটে প্রেমিকা!

ভাবছি সুখিরোদে বাসাটি ছেড়ে দেবো এবারÑ


ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০১ : মুর্শিদাবাদ- পথে প্রান্তরে ইতিহাস

ভ্রমণকাহিনী : পর্ব : ০১ : মুর্শিদাবাদ-  পথে  প্রান্তরে  ইতিহাস



মুর্শিদাবাদ 

পথে  প্রান্তরে  ইতিহাস

মাজরুল ইসলাম


মুর্শিদাবাদ নামকরণ ঘিরে নানা মত প্রচলিত আছে। জেলা হিসেবে মুর্শিদাবাদ-এর জন্ম ১৭৮৬ সাল। কিন্তু তার আগে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী ছিল। মুর্শিদকুলী খাঁর আগে এই জেলার নাম ছিল মুখসুদাবাদ। তারও আগে ছিল মাসুমাবাজার। এই জেলার নামকরণের  ৩১৭ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বর্তমান মুর্শিদাবাদ দেশ, উপমহাদেশ ও বিশ্বের পর্যটকদের হাতছানি দেয়। মুর্শিদাবাদ এক সময় প্রধান তিনটি শাসন ব্যবস্থার রাজধানী ছিল। বাংলার স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ, মহীপালের রাজধানী মহীপালে এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী  মুর্শিদাবাদ ঐতিহাসিক নগরীতে ছিল। ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে যেমন ঢাকার গৌরব ক্ষীণ হতে থাকে তেমনি মুর্শিদাবাদের লালবাগ শহরের চরম শিখরে পৌঁছায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর রণাভিনয়ের পরে বঙ্গের সৌভাগ্যলক্ষীর বিপর্যয় ঘটে। ১৭৬৫ সালে ক্লাইভ নবাবদিগকে শাসন কার্য থেকে অপসৃত করেন। এবং পেনশন প্রদান করেন। এই সময়ে নবাবদের ‘নবাব’ উপাধি মাত্র থাকে। এই উপাধিও ১৮৪৫ সালের পর উত্তরাধিকারী অভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নবাবরা কেউ স্বাধীনভাবে কেউ আবার পুতুল নবাব সেজে প্রায় ৫০/৬০ বছর বাংলা বিহার উড়িষ্যা শাসন করেছেন। সেই সময় থেকে মুর্শিদাবাদ তথা লালবাগ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে ঐতিহাসিক বাড়ি, অসংখ্য মসজিদ, মন্দির,মঠ, গির্জা, আখড়া ও প্রাসাদে পরিপূর্ণ ছিল। গুপ্ত-হত্যা, হাসি- কান্না, রাজা-প্রজা, এবং স্থাপত্য মুর্শিদাবাদের ভূমি। মুর্শিদাবাদ জেলার বুক জুড়ে রয়েছে মন-হরন পর্যটন কেন্দ্র। নবাবী আমল থেকে এখানকার ভূমিথথ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। পদে পদে ঐতিহাসিক স্থান, নিদর্শন ও চিহ্ন ছিল। তবে পরিতাপের বিষয় হল কিছু কিছু স্থাপত্য টিকে থাকলেও পূর্বের অনেক স্থাপত্য বর্তমানে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে।

ইতিহাস এমন একটি বিষয় যা জাতীয় জীবন চেনার বা সংশোধনের একমাত্র উপায়। ইতিহাস প্রাণ কিছু ব্যক্তি জেলার ইতিহাস লিখে জেলার কল্যান সাধন করেছেন। কিন্তু আজও বোধহয় মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি। এই জেলার প্রতিটি ধুলিকণার সঙ্গে অসংখ্য হিন্দু-সাধক, মসুলমান-পিরের করুন ইতিহাসের স্মৃতি বিজড়িত হয়ে আছে।              

যে স্থান সুদীর্ঘ কাল ধরে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী পরিগণিত ছিল, তার বিস্মৃত বিবরণ জানার কার না ইচ্ছে হয় ? বিশেষতঃ মুর্শিদাবাদের তিনশো বছরের অধিক ইতিহাস নিয়ে চর্চার যথেষ্ট অবকাশ থেকে গেছে। পুরাকীর্তি, পুরানো পুঁথি, প্রাচীন মুদ্রা, দেবদেবীর মূর্তি, শিলালিপি থেকে আমরা আমাদের প্রাচীন জাতীয় জীবনের সন্ধান পেতে পারি।

২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বলা যেতে পারে মুর্শিদাবাদ জেলার আয়তন ৫৩২৪ বর্গ কি.মি.। আনুমানিক জনসংখ্যা ৫৮৬৬৫৬৬৯ জন।


বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের একটি জনবহুল পর্যটন শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সমমৃদ্ধ এই শহরের জনপ্রিয়তা কেবল তার প্রাচীন প্রকৃতির জন্য নয়। বরং বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগের সাক্ষীর প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প নিদর্শন বিস্ময়কর উদাহরণ হয়ে এই শহরের ইমারতগুলি আজও মরে বেঁচে আছে। এই জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত। ভৌগোলিক দিক দিয়ে এজেলার অবস্থান বিচিত্রময়। পুর্বে অধুনা বাংলাদেশ, দক্ষিণে নদীয়া, উত্তরে মালদা এবং পশ্চিমে বীরভূম। ভাগীরথী নদী জেলাকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। উভয়েরই সদর শহর বহরমপুর। বহরমপুর, লালবাগ, কান্দি, জঙ্গিপুর ও ডোমকল। একেবারেই কৃষি প্রধান জেলা। আরও একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ হল ভারতের যে ক’টি জেলা মাত্র সংখ্যা লঘু অধ্যুষিত তারমধ্যে মুর্শিদাবাদ একটি। জেলার কৃষকরা বেশির ভাগই সংখ্যালঘু মুসলমান। এই জেলার অসাম্প্রদায়িক জেলা বারে বারে সম্প্রীতি অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করেছে। যেমন, ১৯৮৫ সালে কাটরা মসজিদের ঘটনা কেন্দ্র করে একই সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ শহিদ হলেও জেলা জুড়ে শান্তির বার্তা দিয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনার পর মুর্শিদাবাদ ছিল ঘটনাবিহীন। ১৭৫৭ সালের আগে ভাস্কর্য পন্ডিতের নেতৃত্বে এই জেলা কয়েক বার লুণ্ঠিত হবার কথা সর্বজনবিদিত। ১৭৫৭ সলের পর প্রকৃত অর্থে চেহেলসেতুনের খাজাঞ্চিখানা লুণ্ঠন করে গেছে ইউরোপীয় দেশের বণিকের ছদ্মবেশে আসা দস্যু ও ইংরেজরা। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধজয় থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ থেকে কয়েকশো বজরা ভর্তি সোনা, স্বর্ণমুদ্রা রুপোরমুদ্রা, অন্যান্য দামি সামগ্রী স্বদেশে পাচার করে। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬০ সালে এই তিন বছর কোম্পানি পুতুল নবাব মীরজাফরের নিকট থেকে উপোঢৌকন বাবদ আদায় করে ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা মীরজাফর এছাড়াও কোম্পানির কর্মচারীদের দিতে বাধ্য হয়েছিল নগদ ভাতা ও পুরস্কার দানের নাম করে ৫৯ লক্ষ টাকা। পরের পাঁচ বছরে আরও ১ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা। এছাড়াও কোম্পানির বাড়তে লাভ ৮ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা, ভূমিরাজস্ব বাবদ ৫৬ লক্ষ টাকা।

জনশ্রুতি আছে, মুর্শিদাবাদ শহরে ছোট বড় মিলে ৫৭০ টি মসজিদ ছিল। এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ছিল ২৯৬ টি। লালবাগ শহরে পাঁচটি বাউলির খবর পাওয়া গেলেও চারটি স্থান নির্নয় করা যায়, একটির স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। যেগুলোর স্থান নির্নয় করা যায়। যথা বিডিও মোড়, বনমালীপুর, চকমসজিদ ও কাঠগোলা। এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলায় সাতটি গোলার খবর পাওয়া যায়, যথা- ভগবানগোলা, লালগোলা, সুপরিগোলা, আজিমগঞ্জগোলা (ডোমকল), চরবলণগোলা, গোলাবাড়ি ও কারাগোলা। ইংরেজরা এই শহরকে লন্ডনের চেয়ে সুন্দর, জনবহুল এবং সমৃদ্ধ বলেছে। ১৭১৭ খ্রীষ্টাব্দে শাহেন শাহ ফারুকশিয়রের নিকট থেকে রাজস্ব আদায়ের সনদ পেলে তারা কাশিমবাজার, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে কুঠি গড়ে এবং তখন থেকে একটু একটু করে লালবাগের গৌরব হারাতে বসে। তার পরও যেটুকু ছিল ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে ৮/১০ ঘণ্টার পুতুল খেলা হয় এবং সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর আরও শেষ হল।

সপ্তম শতাব্দীর শুরুতেই গৌড় রাজ্যকে এক প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম পরাক্রান্ত রাজ্য গৌড়ের অধিপতি মহারাজ শশাঙ্ক বাংলার ইতিহাসে প্রথম সার্বভৌম নরপতি ছিলেন। তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তাঁর সময়েই গৌরবের চরম সীমায় পৌঁছে ছিল।


কর্ণসুবর্ণ: ৬০০-৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বলাবাহুল্য বাংলার প্রথম স্বাধীন মহারাজা শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ন। প্রাচীন রাজ্যের মধ্যে কর্ণসুবর্ন সুবিশাল বলে মনে করা হয়। প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙামাটি বা কর্ণসুবর্ন বিশেষ স্মরণীয় স্থান। এমন কি ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়াদের বেশ বড়সড় রেশমের কুঠি ছিল। এই স্থানকে স্বাস্থ্যনিবাস মনে করা হত। কোম্পানির আমলের সাহেবরা এখানকার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হতেন। ১৯৬০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ থেকে খনন করে প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া  গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পোড়া মাটির সীলমোহর। যার গায়ে উৎকীর্ণ ধর্মচক্র- প্রতীকের নিচে দু’লাইন লিপিতে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের উল্লেখ আছে।  রাঙামাটির বেশির ভাগ ভাগীরথী গ্রাস করছে। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ এসেছিলেন। তিনি দু’হাজার বৌদ্ধ শ্রমিকের বসবাস ছিল বলে বর্ণনা করেছেন। কর্ণসুবর্নে গুপ্ত বংশীয় রাজারা বহুদিন রাজত্ব করেছিলেন। এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সুপ্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের স্তুপ থেকে বহু প্রাচীন মুদ্রা পাওয়া গেছে। খননকার্য চালালে এখনও হয়তো বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যেতে পারে। [ক্রমশ]



ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০৬

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২০৬

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২০৬,

শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৪, ১২ মাঘ ১৪৩০, ১৩ রজব ১৪৪৫ ।