ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৩৫

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৩৫
তারুণ্যের শিল্প সরোবর : : ধানশালিক :  : সংখ্যা ১৩৫
শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারী ২০২০





































বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল

বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল






বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল      
শেখ একেএম জাকারিয়া

মার্চ মাস আমাদের জীবনে খুবই জরুরি ও তাৎপর্যবহ একটি  মাস। নুনাধিক সকলেই অবগত পরাধীন থাকাকালীন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যোজন হলো ১৯২০ সালের এ মাসেই ১৭ তারিখে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমায় টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফর রহমান ও তাঁর সহধর্মিণী সায়রা খাতুনের ঘর আলোকিত করে  অত্যন্ত উজ্জ্বল অর্থাৎ ফুটফুটে মুখাবয়বের একটি শিশুপুত্রের জন্ম হয়। শিশুটি অন্য শিশুদের  মতই পরিবারের সবমানুষের সুখের মধ্যবিন্দু হয়ে ওঠেন। পিতামাতা আদর করে শিশুপুত্রের নাম রাখেন খোকা। আর এই খোকাই হলেন আমাদের সবার প্রেমাস্পদ , প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি, জাতির  জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবার প্রীতিভাজন এ খোকার শৈশব ও কৈশোরকাল কীভাবে কেটেছে তা আজ অনেকের কাছেই অবিদিত। বইপত্রাদি পাঠে যে পর্যন্ত জানা যায়, খোকা বালকবয়সে দোয়েল ও বাবুই পাখি খুব ভালোবাসতেন,শালিক ও ময়না পাখি ভালোবেসে খাঁচায়  পুষতেন। এছাড়া তিনি বানর ও কুকুর পুষতেন খুব যতেœর সঙ্গে।  পশুপাখির প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় অনুরাগ। হাওর ও খালের পানিতে বক, মাছরাঙা কীভাবে ডুব মেরে মাছ ধরে, সেসব দৃশ্য তাঁর মনকে  নাড়া দিত খুব। ফুটবল ছিল খোকার পছন্দের একটি  খেলা। মোটকথা, বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে গাঁয়ের মেঠো পথের ধূলিমাটি মেখে আর বর্ষার কর্দমাক্ত জলে ভিজে। টুঙ্গিপাড়ার সবুজ ছায়াঘন গাঁয়ের আলো, বাতাস , মাটি ও মানুষ তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। তিনি ভালোবাসতেন গ্রামের সব মানুষকে। আর এ কারণেই তিনি ছিলেন সবার নয়নের পুত্তলি । শিশুকিশোর  জোয়ানবুড়ো সবাই খোকাকে একান্তভাবে বিশ্বাস করত ও ভালোবাসত। শৈশবে খোকা বালকদলের নেতা ও ভাই-বোনের আদরের মিয়া ভাই ছিলেন। মধুমতি নদীর কাদামাখা জলে গাঁয়ের ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটা, দৌড়ঝাঁপ, দলবেঁধে হাডুডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় খোকা ছিলেন খুবই পারদর্শী । টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গ্রামের লোকেদের কাছে শেখ বাড়ি নামেই পরিচিত ছিল। শেখ বাড়ির দক্ষিণপার্শ্বে ছিল বিচারালয় অর্থাৎ কাচারি ঘর। সেখানেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মৌলবি সাহেবদের কাছে খোকার বিদ্যাশিক্ষার হাতেখড়ি। তবে গৃহশিক্ষক মৌলবি সাখাওয়াৎ উল্লাহ সাহেবের কাছে প্রথম বর্ণপরিচয় শিখেন। তৎপর খোকা সাতবছর বয়সে ১৯২৭ সালে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হোন। পরবর্তীতে অর্থাৎ ১৯৩১ সালে তাঁর বাবা লুৎফর রহমান পরিবারবর্গ নিয়ে নিজ কর্মস্থল গোপালগঞ্জে আসেন এবং খোকাকে সেখানকার পাবলিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করান। সেখানে কিছুদিন যেতে না যেতেই বঙ্গবন্ধু বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হোন। এ রোগ থেকেই  চোখে জটিল সমস্যা বা অসুখ দেখা দেয়। যার নাম গ্লোফুমা। বাবা লুৎফর রহমান পুত্রের এই অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে ওঠেন এবং স্বজনদের  পরামর্শে খোকাকে চিকিৎসা করানোর  জন্য কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা.টি আহমেদ তাঁর চোখের অপারেশন করেন। অপারেশনের পর গ্লোফুমা থেকে সুস্থ হলেও চিকিৎসক তাঁকে চোখে চশমা ব্যবহারের উপদেশ দেন। পরিতাপের বিষয়, বঙ্গবন্ধু চোখে সমস্যার কারণে চারবছর বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। সুস্থ হবার পর তিনি বাবার কর্মস্থল মাদারীপুরেও কিছুদিন লেখাপড়া করেন।

স্কুলজীবনেই বঙ্গবন্ধু সংস্কারমুক্ত অর্থাৎ সমাজে প্রচলিত কোনো অযৌক্তিক ধ্যান ধারণার বশীভূত নয় এমন  রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। খোকা বাল্যকাল থেকেই কথা বলায় খুব পারদর্শী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে সময়ে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশনারি হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন, সে সময়ে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উক্ত স্কুল পরিদর্শনে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এ সময় কিশোর মুজিব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সামনে দাঁড়িয়ে স্কুলের ছাদ মেরামতের দাবি জানান। পরে তার সে দাবি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। তাছাড়া তিনি যে সময়ে নবম শ্রেণীর ছাত্র, সে সময়ে একবার ছাত্রদের উদ্দেশে মঞ্চে বক্তৃতা দানকালে তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সম্ভবত এটাই তাঁর জীবনের প্রথম গ্রেফতার। পরবর্তীতে ছাত্রদের চাপের কারণে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। শৈশবে সবার প্রিয় খোকা বড় হয়েও ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। তাঁর প্রিয় সংগঠন ছিল কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর। এমনকি বঙ্গবন্ধু তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও কচিকাঁচার আসরে ভর্তি করেছিলেন। তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্তু তিনি কাটিয়েছেন এই সংগঠনের  সঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শিশুদের কাছে দিনটি অনেক মজার ও আনন্দের। পরিশেষে বলতে চাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নেতা, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, যার সমকক্ষ আর কেউ নেই। তিনি যে সময়ে জন্ম গ্রহণ করেন, সে সময়ে দেশ ব্রিটিশ শাসনাধীন  ছিল। সেই ব্রিটিশদের শাসন থেকে, পাকিস্তানীদের কালো থাবা থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

একটি মেয়ের গল্প

একটি মেয়ের গল্প



একটি মেয়ের গল্প
আব্দুল্লাহ আল তানিম

এটা আমার ছোট্ট গল্প, একটা মেয়ে গল্প, আমার নিজের গল্প। আমার গল্পে কোনো ভিলেন নেই, নেই কোনো হিরো, তবু বড় মিস্টি গল্প।

আমার না, বাবা নেই জানেন; না না কোনো অসুখে মারা যায়েনি, আমাকে আর মা কে ইচ্ছা করে ছেড়েও যায়নি। বাবার ছিল ঘুরতে যাওয়ার নেশা, মা বাইরে বাবার এই নেশাটাকে নিজের সতিন বললেও, ঘুরতে যাওয়াকে ঘিরে বাবার যে আনন্দ সেটা দেখে মাও কম খুশি হত না। আমার তখন চার বছর বয়স, চার বছরেই আমি বেশ কিছু জায়গা ঘুরে নিয়েছি বাবা-মার সাথে।

যদিও আমার কিছু মনে নেই, যেটা শুনেছি, সেবার আমরা পুরি গেছিলাম। আমি ছোট, রোদ লেগে পুড়ে যাব, শরীর খারাপ করবে ভেবে মা আমাকে নিয়ে হোটেলেই ছিল, বাবা একা গেছিল সমুদ্রস্নান করতে, কিন্তু আর ফেরেনি। সবাই বলেছিল যে বাবা ভেসে গেছে, অনেক ডুবুরি, নুলিয়া, কোস্টগার্ড নাবিয়েও বাবাকে পাওয়া যায়নি। সবাই বলত যে বাবা মারা গেছে, মা এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিত না, প্রশ্ন করলে আদর করে এড়িয়ে যেত।

কি ভাবছেন? আহারে বাপ-মরা মেয়ে, কিভাবে সংসার চলত, কি করেই বা পড়াশুনা করত, তাই না? আমার মা না, একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করত, আমার জন্মের আগে থেকেই, আর আমার খেয়াল রাখত বিমলের মা।

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে কিছুটা স্নেহবশে ও মাও তার যোগ্য প্রাপ্য দিত, সে আমাদের বাড়িতেই সকাল থেকে রাত, মা বাড়ি না আসা অবধি থাকত। পড়াশুনা জানত না, কিন্তু বসে থেকে আমার হোমওয়ার্ক করিয়ে নিত। মা যখন আমার জন্য টিউটর রাখল, বিমলের মা ঠায় দরজার কাছে বসে থাকত যতক্ষণ স্যার পড়াতেন, একমুহুর্তের জন্যও অন্য কোথাও যেত না। তার পেটে কোনো কথা থাকত না ঠিকই, কিন্তু মায়ের ব্যপারে কেউ কিছু বললেই ঝেড়ে ভুত ভাগিয়ে দিত।


বড্ড একঘেয়ে গল্প না? কোনো পুরুষ চরিত্র নেই; দাঁড়ান, গল্প এখনও বাকি। আমার হিরো ছিল দিবাকর আঙ্কেল, মায়ের ছোটবেলার বন্ধু, বাবারও বন্ধু। প্রতি রবিবার ছিল দিবাকর আঙ্কেল এর সাথে বিকালে বেড়াতে যাওয়ার দিন। খুব আনন্দ হত যখন দিবাকর আঙ্কেলের সাথে মিলে বাকি বন্ধু আর তাদের বাবাদের ভিডিও গেম এ হারিয়ে দিতাম।

একদিন হঠাৎ করে সৈকত আমায় প্রশ্ন করল, ‘দিবাকর আঙ্কল কি তোর নতুন বাবা? মা বলছিল তোর মা ওনাকে বিয়ে করবে’। শুনে তো আমি আল্লাদে আটখানা, তাহলে তো বেশ হয়, আঙ্কেল শুধু রবিবার না, রোজ খেলা করবে আমার সাথে। কেন জানি না, সৈকত বলল এটা নিয়ে আমার খুশি না, লজ্জা পাওয়া উচিৎ। হিংসুটে একটা, দিবাকর আঙ্কেল আগের রবিবারই আমার সাথে মিলে সৈকত আর সৈকতের বাবাকে বাজে ভাবে হারিয়ে দিয়েছিল।

মাকে প্রশ্ন করতে, মা আবার আদর করে এড়িয়ে গেল। তার কিছুদিন পরে, এক রবিবার, বেড়াতে যাব বলে আঙ্কেলকে বারবার ফোন করলাম, কিন্তু আঙ্কেল এল না, ফোনও ধরল না, মাকে প্রথমবার আমি কাঁদতে দেখি। বিমলের মা বলল, ‘দিবাকর দাদাবাবু তোমায় হস্টেলে পাঠায়ে দিতে চায় গো, দিয়ে তোমার মা রে বে করবে। আমি বলে দিলুম বাপু, এমন অনাছিট্টি হতে দিমু নি। মার থিকে মেয়েকে আলাদা করে দেবে, এ কেমন মানুষ গো”। এরপর অনেকদিন পরে দিবাকর আঙ্কেল কে রাস্তায় দেখি আমার প্রিয় আইসক্রীমের দোকানের সামনে, এক আন্টির সাথে, আমি কথা বলতে গেলে কেন জানি না আমায় চিনতে অস্বীকার করল।

কি বলেন, এই মেয়ে প্রেমে পড়তে পারে? খুব সহজেই প্রেমে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক, তাই না? একদম ঠিক। আমি প্রেমে পড়ি আমার থেকে দুই বছরের বড় অভিদার। নেহাত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি, না তো বলতাম, ‘আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ী’; হ্যাঁ, আমি সেদিন শাড়ী পরেছিলাম,। তারপর আমি আর অভিদা বেড়াতে বেরুইছিলাম। বাড়িতে ফেরার সময় ফাঁকা রাস্তাটায় অভিদা হঠাৎ করে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘শোন,আমার তোকে খুব ভাললাগে,আমার জিএফ হবি?’ আমারও অভিদাকে বেশ ভালই লাগত, কিছু না বলে মুচকি হেসে মুখ টা নাবিয়ে নিলাম, একটা আলাদা অনুভুতি।




অভিদা আস্তে করে আমার থুতনি ধরে মুখ টা তুলে ধরে ঠোঁটে আমার জীবনের প্রথম চুম্বন এঁকে দিল। কাঁপা কাঁপা পায়ে বাড়ি ফিরলাম। দরজা বন্ধ করে সন্ধে অবধি পড়ে থাকলাম নিজের ঘরে, হাজার ডাকাডাকি তেও ভোগ খেতে গেলাম না। বিমলের মা থাকলে হয়ত জোর করে নিয়ে যেত, কিন্তু সেও কাজ ছেড়ে গুজরাট চলে গেছে ছেলের কাছে। এরপর মাসকয়েক কেটে গেছে, আমাদের প্রেম ও পড়াশুনা সমান তালে চলছে।

একদিন মা রাতে বাড়ি ফিরে সবে কফির কাপ নিয়ে বসেছে, অভিদার মা ও পাড়ার আর কিছু মহিলা এলেন। তাঁদের অভিযোগ আমি নাকি আমার মায়ের মত নষ্টামি শুরু করেছি, পাড়ার ছেলেদের থেকে যেন দূরে থাকি, ওরা সবাই ভদ্রবাড়ীর ছেলে। আমি বুঝিনি আমি ও মা কি অভদ্রতা ও নষ্টামি করেছি, কিন্তু মা জীবনে প্রথমবার আমার গায়ে হাত তোলে। সেই রাতে মাও কিছু খায়েনি, আমরা নিজের নিজের ঘরে খুব কেঁদেছিলাম। বুঝতে শিখি, যেহেতু বাবা নেই, তাই অনেকের কাছে আমাদের বেঁচে থাকাটাও দোষের।

খুব নারীবাদি লাগছে না? যে পুরুষদের ঘৃনা করে? হ্যাঁ তা একটু ইতস্তত হত বটে, কিন্তু ঘৃনা ঠিক না। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন কম প্রস্তাব পাইনি, তবু ইচ্ছা হত না কোন সম্পর্কে জড়াতে। প্রেম এল আরো এক বসন্তে, আমার বান্ধবীর হবু বরের বন্ধু, পেশায় ব্যবসায়ী।

আমি তখন হাসপাতালে রোগী আর ছুটির দিনে প্রেমী সামলাতে সামলাতে মা কে প্রায় ভুলেই গেছি। হুঁস ফিরল, একদিন একটা ফোন আসায় থানা থেকে, আমার মা নাকি রাস্তায় বেরিয়ে ফেরার পথ মনে করতে পারছে না, এক সহৃদয় ব্যক্তি মাকে থানায় দিয়ে গেছে, মায়ের ফোন থেকে আমার নম্বর পেয়ে যোগাযোগ করে। মায়ের অ্যলঝাইমার ধরা পড়ে। মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়, কিন্তু জানি এ রোগ সারবার নয়। বিমলের মা ততদিনে ছেলের সংসার থেকে বিতাড়িতা হয়ে ফিরে এসেছে; আমার দেখাশুনা করত, এখন মায়ের। এর মধ্যে আমার প্রেমী এল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, সঙ্গে একটি শর্ত; আমার সঙ্গে সংসার পাতবে ঠিকই, কিন্তু সেখানে জায়গা হবে না আমার মা আর বিমলের মায়ের।

অনেকদিন পর দিবাকর আঙ্কেলের মুখটা মনে পড়ল আমার, ভাগ্যের পরিহাসে এরও নাম দিবাকর; নাম যখন এক, প্রস্তাবও যখন এক, পরিণাম টাও একই ছিল।

অনেকদিন পর ফেসবুক খুললাম, অনেক মেসেজ জমে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নাকি বলেছে, সন্তানধারনের জন্য ছাড়া তার কোনো পুরুষের দরকার নেই, এই নিয়ে তুমুল ঝামেলা। পাগলী একটা, একটু ভুল বলেছে; বলা উচিৎ, “যে পুরুষ আমার প্রাপ্য সম্মান দেয় না, সেই পুরুষের কোনো দরকার নেই।





নীড় ও নিসুখের গল্প

নীড় ও নিসুখের গল্প






নীড় ও নিসুখের গল্প
শফিক নহোর

ক.
সামেদ আলী ব্যাপারীর শরীরে টরে শার্ট বুক পকেটে পাঁচশত টাকার নোট অনেক দূর থেকেই তা দেখা যায়। শাদা জামার বুক পকেটে টাকা রাখা তার অভ্যাস। এলাকার মাতব্বর শাদা পোশাক, মাথায় ছাতা পিছনে দুই চারজন মানুষজন হাঁটবে , গা ঘেঁষে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাজারের বড় ইলিশ-মাছ , সেরা সবজি, পানের দোকান থেকে শতশত পান সুপারি , জর্দা, এগুলো না নিলে সন্ধ্যায় মর্জিনার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হবে, কাচারি ঘরের জন্য এসব লাগে। মাতব্বর মানুষ বলে কথা, তার বাড়িতে গেলে কেউ খালি মুখে ফিরে আসবে অন্ততপক্ষে পান মুখে দিয়ে যাবে। আশে পাশের লোকজন কেউ কেউ তাকে খারাপ বলে, কিপটে বলে চরিত্র নিয়েও টানাটানি করেছে ; এলাকার মানুষ ।
প্রচলিত নিয়মেই সমাজে চলতে হয়। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, স্কুল, কলেজ বাজার, চরের মিটিং-মিছিল সব জায়গায় তার আধিপত্য আছে। সুঠাম দেহের অধিকারি দারাজ কণ্ঠ, ভাসা-ভাসা চোখ, দেখে মনে হতো লোকটা প্রেমিক কখনো দেখে মনে হতো ভিলেন কোয়ালিটির মানুষ। ‘মানুষকে বিচার করতে বসলেই সব মানুষেরই দোষ বের হয়ে আসে।'
ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যে যার মতো দূরে চলে গেছে। সেই খেলার মাঠ, বাড়ির বিশাল উঠোন, দক্ষিণে বড় পুকুরপাড় ছেলে মেয়েদের স্মৃতি চোখের কোণায় ভেসে ওঠে তার। বছরের পর বছর, পার হয়ে গেছে কেউ বাড়িতে আসতে চায় না। গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকেনা, রাস্তায় কাদা, মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। কত রকম তাল বাহানা করে তাঁর বাবার সঙ্গে। এবারের ঈদে ছেলে-মেয়ে কেউ আসবে না। ফোন করে আগেই তাকে জানিয়ে দিয়েছে ; এ নিয়ে ব্যাপারীর ভীষণ মন খারাপ, সকালে মুখে কিছু না দিয়েই বাসিমুখেই বের হয়েছে ; চরের সালিশ করতে ।
এই মানুষটাকে দেখেছিলাম , তার ছেলেমেয়েদের জন্য পরম মায়া মমতায় দিনের-পর-দিন খেয়ে না খেয়ে মাঠে-ঘাটে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সন্ধ্যা অবধি বাজার থেকে মাছ কিনে নিয়ে এসেছে, এবং-নিজে তা রান্না করে বাচ্চাদের খাইয়ে মানুষ করেছে। লেখাপড়া শিখিয়েছে , প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছেলে-মেয়েদের। ‘তবে একটাও মানুষ হয়নি। ‘ব্যাপারী এবার খুব আহ্লাদ করে ছেলে মেয়েদের সঙ্গেই ঈদ করতে চেয়েছিল!
মেয়ের ঘরে নাতি আসছে ; তাকে নিয়ে খেলবে,বাজারে যাবে। ছেলেমেয়েদের অনেক অর্থকরী হয়ে গেছে এখন। গ্রামের- প্রতি এক ধরনের ঘৃণা তৈরি হয়েছে মনে। গ্রামে গরিব মানুষ থাকে, টাকার জন্য কেউ আসবে। অথবা বড় ধরনের সাহায্য চাওয়ার জন্য সাত সকালে এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিবে। এ ঝামেলা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে বুদ্ধি মানের কাজ করছে , ছেলেমেয়েরা হয়তো এভাবেই ভাবছে ; তা না হলে নিজের জন্ম ভিটাকে কেউ এমন ঘৃণা করে, বাবাকে অবহেলা করে। অমানুষ, অমানুষ, অমানুষ ব্যাপারী নিজেই বিরবির করতে করতে কাচারি ঘরে বসে বাড়ির সামনের ধানের জমির দিকে মায়াবী চোখে কি যেন অপলক দৃষ্টিতে দেখছে।



একদিন বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে নুয়ে পড়েছে ধানের বোঝা নিয়ে ব্যাপারী, সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তায় কাদা, ভেজা লুঙ্গি গামছা মাথায় করে ছুটছে। কেউ এসে সহযোগিতা করবে হাত বাড়িয়ে দেবে, এমন মানুষ বাড়িতে নেই। বউ মারা যাওয়ার পর থেকেই সামেদ আলী ব্যাপারী নিঃস্ব, অপারগ। ছেলে-মেয়ে গুলো চাঁড়াল। গ্রামের সোঁদা মাটির গন্ধে মানুষ হয়েছে ; গ্রামের আম, তরমুজ, বেদানা, আতা, পেয়ারা, তরমুজ, পুকুরের মাছ, বিলের মাছ , পদ্মার ইলিশ। এসব রেখে শহরের চার দেয়ালের কয়েদী জীবন মেনে নিতে পারবে না ব্যাপারী। সবুজের সঙ্গে বেয়ে ওঠা, যার সময় কাটে প্রকৃতির সঙ্গে- মাটির সঙ্গে, নিবিড় মমতায় ভালবাসায় সেই মানুষ ইট পাথরের ভেতর থাকতে পারবে না কখনো। যদিও বউ মরে যাবার প্রথম দিকে ব্যাপারীর আদর-যতœ ছিল বেশ ভালই ছেলেমেয়ের কাছে। কিছু জমিজমা ছেলেমেয়ের নামে দিয়েছে , তার পর থেকেই পল্টি বাপের সঙ্গে।
তবুও তো নিজের ছেলেমেয়ে বাবার খবর নিতে পারে, কখনো নেয়নি। বউ মরে যাবার পরে যেই মুখ ফুটে ব্যাপারী বলেছিল, বিয়ে করবে, সেই জাত গেল জাত গেল বলে, মেয়ে-ছেলে শহর মুখী হয়েছে ; সেই থেকে কেউ আর কোন খবর নেয়নি। নিজের দেখভাল করবার জন্য হলেও একজন মানুষ প্রয়োজন। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদার জন্যই নয়, একে অপরের সাহায্য সহযোগিতায় পাশে থাকার জন্য হলেও একজন মানুষ প্রয়োজন। ছেলে-মেয়ে এত শিক্ষিত , তার বাবাকে বুঝতে শিখেনি, চেনেনি। নিজেদের স্বার্থ নিয়ে পড়ে আছে ; নিমকহারামি। বুড়া মানুষের প্রসাব-পায়খানা পরিষ্কার করবে কে? রান্না করবে কে ? গ্রামের মাতব্বর এখনো এলাকার মানুষ তার কাছে আসে। ভালমন্দ দুটি কথা শোনার জন্য। পরামর্শ নেবার জন্য। গ্রামের সালিশ দরবার এখনো নিজেই করে। গ্রামের মানুষ সম্মান দেয়। শুধু নিজের ছেলে-মেয়েদের কাছে নিজের ইজ্জত পায়নি কখনো ব্যাপারী ।

খ.
গোয়ারিয়া বাজারে পাচুর, চায়ের দোকানে বসলে, লোকজন নানা রকম কথা বলে, বয়স্ক মানুষ সবাই ছেলে-মেয়ে নাতি, নাতনী মেয়ের বাড়ির গল্প করে। বউকে ডাক্তার দেখানো, প্রেসার, ডায়াবেটিস, হাঁপানি বেড়েছে, আগের ডাক্তার ভাল ছিলো না কত কথা ব্যাপারীর কানে আসে। কেউ একজন পিছন থেকে বলে উঠলো, আমাদের দুলাল মাস্টারের ছাওয়াল কানু পোদ্দার কিন্তু খুব ভাল ডাক্তার। আমি দুলাল মাস্টারের বাড়ির উপরে গেলাম। কানুর বাড়ি আসার কথা শুনে, কি ভদ্র মানুষ গো বাবা, আমার প্রেসার মেপে দেখল, কিছু ওষুধ লিখে দিলো, বললো কাকা ঢাকা আসবেন, কিছু টেস্ট করানো দরকার
আমার মুখ ফসকে বের হয়ে গেল,
- ডাক্তারা শুধু টেস্ট দেয় এখন।
- কাকা আমার উপর ভরসা রাখবেন, আমি টাকার লোভে আপনাকে বেশি টেস্ট দিবো না। ভয় পাবার কোন কারণ নেই, তাছাড়া শুনেছি, ছেলে-মেয়েরা আপনাকে দেখতে পারে না। গান বাজনা করেন বলে এই বয়সে। তাহলে সংসার চলে কি ভাবে ? কত কথা হলো, আমাকে পান খাবার কথা বলে পকেটে পাঁচশত টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো। আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখের জল সবসময় বেদনার হয়না, আনন্দের ও হয়। আমার গর্ব হয়। আমাদের গ্রামে এমন একজন মানুষ আছে।
গ.
সামাদ আলী ব্যাপারীর মন খারাপ হয়ে গেল। তার ছেলে গুলো হয়েছে হারামি। এ বয়সে- ছেলে মেয়েদের কেউ প্রশংসা করলে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে, বাবা মায়ের। কিন্তু সেখানে যদি উল্টো দুর্নাম শুনতে হয়, তখন বুকের জমিনে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়। আহা এ জীবন বড়ই বৃথা। মর্জিনা দাদা মনে করেই সামাদ আলী ব্যাপারীর রাতে ভাত রান্না করে দিতো, সেই প্রথম থেকেই কত মানুষের বাজে কথা শুনতে হয়েছে ; ত্রি-ভুবনে মর্জিনার কেউ নেই, বিয়ে হয়েছিল অনেক বছর হলো। স্বামী নেশা করতো, রাত করে বাড়ি আসত, ঘরে অভাব, সংসারে আলো জ্বলে-নিভুনিভু করে, সন্তান হয়না বলে স্বামী তাড়িয়ে দিয়েছে। এ বাড়ির ভিটাটুকু ছাড়া কিছু নেই। আকার ইঙ্গিত দিয়ে ব্যাপারী বিয়ের কথা বলেছিল, মর্জিনা তোর আপত্তি না থাকলে, আমাদের বাড়িতে থাকতে পারিস, আমার বয়স একটু বেশি। আমার ছেলে-মেয়ে তোকে কখনো মা বলে মেনে নিবে না। আমার ও যে একজন মানুষ দরকার রে, মর্জিনা। শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করে। কতদিন হলো তোর দাদী মরছে। সে মরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার সবকিছু মরে গেছে। আমি আর এখন কোন পুরুষ মানুষ নাইরে। শুধু একজন মানুষ হয়ে বেঁচে আছি। আমার এক পা কবরে এক পা ডাঙ্গায়।
-দাদা আপনাকে আপন করে নিতে আমার কোন আপত্তি নাই, আমিও মন থেকে আপনাকে সেবা করতে চাই, সমাজের কুচোখ বন্ধ করতে আমাদের সমাজের আইনে ঘর করতে হবে। রাতবেরাতে আপনাকে রান্না করে দেওয়া, সেবা করা, আমার কোন সমস্যা নেই। তবে মানুষ তা ভাল চোখে দেখে না। ‘এ সমাজে কেউ চায় না কারো দিয়ে কারো উপকার হোক।'
মর্জিনা তোকে লাল শাড়িতে এত সুন্দর লাগে কখনো কল্পনা করিনি। আমি কথা দিচ্ছি তোকে ঠকাবো না। তোর নামে দুবিঘা সম্পত্তি লিখে দিবো। যাতে আমি মরে যাবার পরে, তোকে কেউ এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে না পারে। আমার ছেলে মেয়ে শিক্ষিত, ভদ্র, কিন্তু অমানুষ। শেষ বয়সে মানুষের একজন সঙ্গী লাগে, সত্যিই একজন সঙ্গী লাগে। আমার ছেলে-মেয়েরা কখনো তা বোঝেনি। আমার ঘরে নতুন মানুষ আসলেও সেলিমের মাকে কোনদিন, কোন সময়ের জন্য ভুলে থাকা সম্ভব হয়নি। সেলিমের মা বড় ভাল মানুষ ছিল। আমার ছেলে-মেয়েরা মনে করছে বাপ বিয়ে করে, ভুলে যাবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেউ কখনো ভুলে যায় না। তবুও ছেলে-মেয়েদের জন্য আমার দোআ ওরা যেন ভাল থাকে সর্বক্ষণ।