ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৪ : স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৪ : স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা
তারুণ্যের শিল্প সরোবর : : ধানশালিক : : সংখ্যা ১৪৪
শুক্রবার, ২৭ মার্চ ২০২০

























ঝরাপাতার শোক

ঝরাপাতার শোক



ঝরাপাতার শোক
শফিক নহোর

সত্যিই আমরা পরম সৌভাগ্যবান না হলে লাশের মিছিলে সেøাগান দেবার মতো মানুষ পাওয়া এখন সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারিদিকে ভয়ানক অস্থির পরিবেশ।
হুমায়ূন সাহেব এই ফ্ল্যাটের মালিক করোনা ভাইরাস নিয়ে আলোচনার করার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
হুমায়ূন সাহেব ধনী মানুষ বয়স্ক এছাড়াও তাঁর আর্থিক দিক আমাদের চেয়ে সচ্ছল প্রাচূর্য ম-িত জীবন যাপন করে অভ্যাস।
তিনি সহ আমরা দশ বারোজন উপস্থিত হয়েছি ।
আমাদের মধ্যে কেউ আসতে অপারগতা প্রকাশ করেনি। করবেই বা কেন ? আমাদের এখন করোনা ভাইরাস নিয়ে বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া করোনা ভাইরাস আমাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের  হুমকি ।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে হুমায়ূন তার বক্তব্য শুরু করেছেন । ‘আপনারা জানেন নিশ্চয়ই....।’
বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পত্রিকায় প্রকাশিত করোনা ভাইরাসের খবর দেখেছেন; এ সংখ্যাবৃদ্ধি দিনদিন বাড়তে পারে বলে ব্যাখ্যা করেন ।
‘যে সব বিষয় নিয়ে কথা হল ।
‘আপনারা কি ফেসবুকে অথবা টেলিভিশনে বা পত্র-পত্রিকায় প্রচার দেখেছেন ?
রোগের ধরন খুব সাধারণ হলেও রোগ কিন্তু সাধারণ না। আমরা রীতিমতো ভয় পাচ্ছি কোন কোন হাসপাতালের ডাক্তার চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছেন। নার্স পালিয়ে বাড়ি চলে গেছে তা যদিও কোন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
‘এটা কি একটু বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না ?
‘না না, সত্য চিরকালই মানুষের কাছে চরম তিক্ত, একটুও বাড়িয়ে বলছি না।

হুমায়ূন সাহেব ঠা-া মাথায় মোলায়েম স্বরে গর্বের সঙ্গে বললেন। সরকার এটা মোকাবেলায় দেশের সেনাবাহিনী নামিয়েছে, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করছে, তবে মনের ভেতরে একটা ভয় তাদের আছে। সেটা মানুষের কাছে প্রকাশ করা সহজ হবে না।
আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বাড়াতে হবে মানুষের ভেতর সচেতনতা তাহলে মহামারি থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে হয়তো ।
তবে দেশে যখন মহামারি আসে তখন কে হিন্দু কে মুসলিম আর কে খ্রিষ্টান তার মুখ দেখে রোগ ধরে না। তাই সবাইকে ব্যক্তিগত ভাবে সচেতন হতে হবে। বিভিন্ন জায়গা লক-ডাউন হয়েছে; এটা জানানো সাধারণ মানুষের মনের ভিতরে যেমন ভয় ঢুকে গেছে, আবার নিজে থেকে সচেতন হবে এটাও ঠিক ।
‘তাহলে সতর্কতার সঙ্গে আমাদের সরকারের নির্দেশগুলো মেনে চলতে হবে। এই নির্দেশনাগুলো সরকারের পক্ষে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, টিভিতে প্রচার করতে হবে বেশি।
বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে, হাট-বাজারে ব্যানার তৈরি করে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। তা না হলে অল্প একটু অবহেলায় আমাদের দেশে বয়ে যেতে পারে লাশের জলপ্লাবন ।
‘এসব খরচ কি আমাদের দিতে হবে ?
আমাদের মধ্যে একজন সাধারণ মানুষ জিজ্ঞাসা করলো ।
হুমায়ূন ভাই পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,
সূরা নাসে পারলৌকিক বিপদ আপদ ও মুসীবত থেকে আশ্রয় প্রার্থনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
নিজেদের পাপ কর্মের জন্য লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইতে হবে সৃষ্টিকর্তার নিকট পৃথিবীর কোনো দেশ এখনো সঠিক চিকিৎসা আবিষ্কার করতে পারেনি ।
আসল কথা হচ্ছে যখন কোন ডাক্তার চিকিৎসা বিজ্ঞান ব্যর্থ তখন আমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট ফিরে যেতে হয়। তার আগে আমরা অবহেলায় ভুলে যাই। মানুষের উপর কখনো পুরোপুরি নির্ভর করবেন না। এতে আপনাদের মঙ্গল হবে ।
‘আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি থাকবো।
সাধারণ বিষয়ে নিজেদের প্রতি বিশ্বাস রাখবেন। আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের রক্ষা করবেন।
তবে মনে রাখবেন, দাওয়া ও দোআ খুব বেশি প্রয়োজন কেউ কেউ পানি পড়া খাচ্ছেন। সেই হজুর ফার্মেসি থেকে পেট খারাপের জন্য ওরস্যালাইন, ফ্লাজিল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্ধভক্ত হয়ে বসে থাকার দিন এখন নেই।
যদি সম্ভব হয় রুমের ভেতর থাকবেন। বিশেষ প্রয়োজন না হলে বাহিরে যাবার প্রয়োজন নেই। এমন নিয়ম কেউ কেউ সহজে মেনে নিবে না। নিজেদেরকে বড় ডাক্তার হিসাবে জাহির করবে। নিজেরা বেশি বুঝতে গিয়ে অবহেলায় মহামারি ডেকে আনবেন না ।
বিপুল উৎসাহ এবং আন্তরিক দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আমরা সেদিন হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাট থেকে বাড়ি চলে এলাম ।
শীঘ্রই করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের মাথার ভেতরে ঢুকে গেল বাদবাকি চিন্তা-ভাবনা।
আমাদের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বলতে শুরু করলো, করোনা ভাইরাসে এখন হাঁস মুরগী মরছে। মানুষ মরার কথা কেউ প্রকাশ করছে না। এমন খবর শুনে গ্রামের মানুষের চোখে পাথর বৃষ্টি শুরু হলো অবহেলা করে এড়িয়ে গেলেই হয়তো মহামারি তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না ।
বিদেশ থেকে ফিরে গ্রামেই পাঁচতলা বিল্ডিং তৈরি করে গ্রামকে শহরে পরিণত করে প্রথম দিকে হুমায়ূন ভাই ।
নিজেদের সতর্ক হতে হবে। হুমায়ূন ভাইয়ের কথায় আমরা তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছি; তখন বিষণ্ন দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে চোখ পড়তেই হাজারটা না বলা কথা বলা হয়ে যায় ।

আমারা কোথাও বন্দি থাকলে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ হতো কিন্তু কারাগারে কেউ শান্তিতে নাই ।
‘আমরা এখন একটা যুদ্ধে আছি। বলতে পারেন দেশে এখন জরুরি অবস্থা চলছে। আমরা শুধু মৃত্যুর ভয়ে ভীত নই,  একটা বিভীষিকাময় মহামারীর সম্মুখীন দেশের মানুষ। আল্লাহ্ আমাদের সহায় না হলে বুঝে নিতে হবে জীবনের শেষবেলায় শুধুই আমরা ভুল বকছি অপরের দোষ দিয়ে। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে হবে। এটাই চির সত্য।
বিভিন্ন অফিসে তাপমাত্রার মেকি মেশিন নিয়ে কেউ কেউ মানুষের মনের ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তি স্বার্থে দরিদ্র মানুষের জীবনের মান আরো নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে, বাড়ছে মানুষের প্রতি অবহেলা শুধু অবহেলা নয় চরম অবহেলা ।

সুসংবাদ আসে আলো বাতাসের মতো কেউ কেউ সুস্থ হয়ে আপন গৃহে ফিরে যাচ্ছে। অসাধু মানুষের মনের ভেতরে নীরবে বয়ে চলছে ঈদ আনন্দ। কসাই চামারের মতো অসহায় মানুষের কাছ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য চোখের   সামনে ভেসে উঠলে বাবার মুখে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার কথা। মনের খোয়াবনামায় বেদনার সুর তলে বেহুলার করুণ সে সুর ।
খুব অল্পতেই একশ্রেণীর মানুষের বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে । সঠিক ভাবে কারো প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছে না। নিজেদের বোকামির কারণে নিজেরাই তৈরি করছে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

মহামারি পৃথিবী সৃষ্টি লগ্ন থেকেই বিভিন্ন জাতি বংশ পরস্পর ছিল। কিছু বছর পর এর রূপ পরিবর্তন করে ভয়ানক ভাবে আমাদের সামনে আবার কেউ আসবে তখন কি ভাবে বেঁচে থাকবে পৃথিবীর মানুষ। নিজে একা কখনও ভাল থাকা যায় না। পরিবার, সমাজ, দেশ পাশের রাষ্ট্র সবাইকে একে অপরের প্রতি আন্তরিক না হলে মহামারি আসবেই। মৃত্যু আমাদের হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে যাবে অপ্রত্যাশিত ভাবে ক্ষণেক্ষণে, আমরা প্রিয় মানুষের লাশ নিয়ে পড়বো নতুন এক দুশ্চিন্তায় ঝঁরাপতার মতো শোক আমাদের কাছে ম্রিয়মাণ ।


একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মবিলাপ

একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মবিলাপ



একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মবিলাপ
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

প্রায় বছর দশেক আগে আমার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই। এক বিকালে ওদের গ্রাম্য বাজারের টং দোকানে বসে আমার বন্ধুর সাথে চা খাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম একজন পঞ্চাশোর্ধ অর্ধনগ্ন পঙ্গু লোক পাগলের মতো জোরে জোরে বলছে, ‘তোরা আমার সখিনারে ফিরাইয়া দে, আমার সখিনারে মারিছ না, তোদের আল্লার দোহাই, সখিনার ইজ্জত নষ্ট করিছ না।’ আমার জানতে ভীষণ আগ্রহ জাগলো, এই লোকটিকে আর কে সেই সখিনা, কারা তার ইজ্জত নষ্ট করবে? আমার বন্ধুর কাছে জানতে পারি, তিনি ওদের গ্রামের একজন সনদবিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম, তারপর সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে গিয়ে উনাকে আমার পাশে নিয়ে এসে বসালাম। তিনি আমার সাথে তখন খুব স্বাভাবিক আচরণ করলেন। উনাকে চা-বিস্কিট খেতে দিয়ে কিছু সময় গল্প করলাম। তারপর উনাকে তার জীবনের গল্প বলতে বললাম।

তিনি উনার গল্প বলা শুরু করলেন এভাবেই-
আমার নাম তোরাব আলী। আমার জন্মের কয়েক মাস পরে বাপ মইরা যায়। মায়ে আর বিয়া বয় নাই। আমার দাদা, দাদী, আমি আর আমার মায়েরে লইয়া আমাগো গৃরস্থ পরিবার। দাদাজানের জমিজমা আছিল বিস্তর। কোন অভাব আছিল না। আমি সারাদিন দোস্তগো লগে ঘুরাইতাম । মায়ে কতো বকাঝকা করতো, দাদাজানের জমিজমা দেখশন করতে কইতো। দাদাজান মায়েরে উল্টা কইতো, তুই ওরে বকিস না বেটি, আমি এখনও বাইচ্ছা আছি। তোরা আমার পুলার শেষ নিশানা, আমার কলিজা, আদরের নাতি, থাকুক হের মন মতন। আসলে আমার মনডা পইড়া থাকত অন্য জায়গায়। হা.. হা.. হা.. কি কমু শরমের কথা, সারাদিন পইড়া থাকতাম মোল্লা বাড়ির সামনের পুকুরের বাঁশঝাড়ের চিপায়। সখিনা ঘাটে আইলে আমি হাবলার মতো তাকাইয়া থাকতাম। সখিনাও কাজল টানা চোখ তুইল্যা দুই এক নজর আমারে দেখতো আর আঁচল দিয়া মুখ লুকাইয়া মিটমিটাইয়া হাসতো। আহারে, কি যে সুখ পাইতাম। মনের সুখে গান ধরতাম, আরো কতো যে পাগলামি করতাম। আসল কথা অইলো, সখিনারে আমি বহুত মহব্বত করতাম।

সখিনা দেখতে আছিল আসমানের পরীর লাহান। টানা টানা চোখ, দুধে আলতা চেহারা, মাথার চুল আছিল মাশাল্লাহ। একদিন সখিনারে পথে একলা পাইয়া, পথ আটকাইয়া দাঁড়াইলাম। সখিনা আমারে সালাম দিয়া কইলো, তোরাব ভাই পথ ছাড়েন। আমি সখিনারে কইলাম, তোমার সাথে আমার কথা আছে। সখিনা জওয়াব দিল, আমি মোল্লা বাড়ির মাইয়া, পথে ঘাটে কারো লগে কথা কই না, আফনে পথ ছাড়েন। আমি লগে লগে পথ ছাইড়া দিলাম আর সখিনা হনহনাইয়া হাইট্যা যাইতাছিল। আমি সাহস নিয়া পিছন থাইক্যা জোরে কইয়া উঠলাম, সখিনা আমি তোমারে অনেক মহব্বত করি। আমার কথা শুইন্না, সখিনা আঁচলে মুখ ঢাইকা একটা মুচকি হাসি দিয়া একবার পিছন ফিরা কইলো, ‘আফনে একটা বেশরম মানুষ, লজ্জা শরমের মাথা খাইছেন। আমার বুঝি শরম নাই, এইসব কথা কেউ এমনে কয়।’ কথাডা শেষ কইয়াই হের বাড়ির দিকে জোরে দৌড় দিছিল। তহনই পুরাপুরি বুঝতে পারছি, সখিনাও আমারে মহব্বত করে। হেই দিন এই দুনিয়ায় আমার মতো সুখী মানুষ আর কেউ আছিল না। হেই খুশিতে আমার হগল দোস্তদের ছাগল জব দিয়া খাওয়াইছি।

হঠাৎই একদিন মাইনষের মুখে শুনি, দেশে কি জানি ঝামেলা চলতাছে। আমি মাথা ঘামাইনাই, এই গুলা অইলো রাজাগো ব্যাপার। কিন্তু না, ঘটনা তো অইন্য রকম। শেখ সাবে নাকি কইছে, যার কাছে যা কিছু আছে, তাই লইয়া পাক সেনার উপর ঝাঁপাইয়া পর, দেশ পাক সেনার হাত থাইক্যা মুক্ত কর। তহন আমার টনক নড়লো। শাব্বাস শেখের ব্যাটা, জব্বর একখান কথা কইছে। কি করমু, কি করমু ভাবতাছি। এমুন সময় আবারও হঠাৎ একদিন শুনি, গভীর রাইতে পাক সেনারা নাকি ঢাকাতে হামলা করছে। গুলি কইরা পাখির মতো হাজার হাজার বাঙ্গাালী মারছে। তহনই দেশ স্বাধীনের ঘোষণা আইছে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু অইয়া গেছে, প্রত্যেক দিন হাজারে হাজারে বাঙ্গালী মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতাছে। আর চুপ কইরা থাকতে পারলাম না। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিমু, দেশ পাক সেনা মুক্ত করমু। দোস্তগো লগে যুক্তি করলাম, সবাই রাজি অইয়া গেলো যুদ্ধে যাইতে। শরীলডাতে তহন আগুন জ্বলতাছে, আর তর সইতাছেনা। তারপর যে যার মতো বাড়িত গেলাম।



রাইতে খাইতে পারি নাই, ঘুম আহে নাই। চিন্তায় পইড়া গেছি, দাদাজান আর মায়েরে কেমনে কথাডা কই। চিন্তা করতে করতে এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়ছি আর খোয়াবে দেখলাম আমি যুদ্ধের ময়দানে গুলি কইরা পাক সেনা মারতাছি। এমুন সময় একটা পাক সেনা পিছন থাইক্যা আইয়া আমার গাঢ়ে স্টেনগান দিয়া গুতা মারছে। আমি রাগে থাবা দিয়া হের স্টেন গানের নলে ধইরা টান দিয়া কইলাম, গুলি মারলে সামনে দাড়াইয়া আমার সিনাতে গুলি মার। তহনি ঘুম ভাইঙ্গা গেছে আর দেহি মায়ে আমার সামনে দাঁড়াইয়া আছে আর আমার হাতে একটা লাটি। হা..হা..হা.. মায়ে আমারে ঘুম থাইক্যা জাগাইবার লাইগ্যা লাটি দিয়া গুতা দিছিল। খোয়াবে লাটিডারে স্টেনগান মনে কইরা টান মারছিলাম। মায়ে আমারে জড়াইয়া ধইরা কইলো, বাজান তুই কি কুনু খারাপ খোয়াব দেখছত নাকি? কেডা তোরে পিছন থাইক্যা গুলি মারবো?

মায়েরে সাহস নিয়া কথাডা কইয়া ফালাইলাম, আমি মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিমু, পাকসেনার সাথে যুদ্ধ কইরা দেশ স্বাধীন করুম। মায়ে আমার কথা হুইন্না হাউমাউ কইরা কাইন্দা উঠছে। আমারে কিরা কসম দিয়া যুদ্ধে যাইতে নিষেধ দিতাছে। আমি অইলাম বংশের একমাত্র বাত্তি, আমি যদি যুদ্ধে মইরা যাই, তাইলে বংশের বাত্তি নিব্বা যাইবো। আরো কতো কথা কইতাছে, আমি ফতুয়াডা কান্দে লইয়া না খাইয়া বাজারে দিকে পথ দিলাম। মায়ে পিছন থাইক্যা ছিল্লাইতাছে, ওরে পুত কিছু মুখে দিয়া যা। আমি আর শুনলাম না, সিদা বাজারে আইয়া আকছির মিয়ার চায়ের দোকানে গিয়া বইলাম। তহন আকছির মিয়া আমারে ফিসফিসাইয়া কইলো, মাইনষের মুখে হুনলাম তোমরা নাকি যুদ্ধে যাইবা? আমি কইলাম, তুমি হুনলা কেমনে? আকছির মিয়া তহন চাপা স্বরে কইলো, যাইবার অইলে আইজকা রাইতের মইধ্যে যাও, নাইলে কাইলকাই হারামী শান্তিবাহিনী তোমরারে পাকসেনার হাতে ধরাই দিব, আমার কাছে খবর আছে।

মাথার মইধ্যে খুন চাইপ্পা গেল, মনে মনে নিয়ত করলাম আইজকা রাইতেই পথ দিমু। কিছু সময়ের মইধ্যেই আমার সব দোস্তরা বাজারে আইল। সবাইরে লইয়া মিটিংয়ে বইয়া আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাইয়া দিলাম। সাথে সাথেই রশিদ, করিম, ফিরোজ, জলিল, মুক্তার, হরিপদ আর অসীম আইজকা রাইতে আমার সাথে যাইতে রাজি অইয়া গেল, বাকিরা বাড়িত গিয়া সিদ্ধান্ত নিব। আমি সবাইরে কইলাম, যারা আমার সাথে যুদ্ধে যাইবা, আইজকা রাইতে দশটার সময় নদীর ঘাটে থাকবা। তারপরে হগলে বুক মিলাইয়া যার যার মতো বিদায় নিলাম। আমি তহন মোল্লা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম সখিনার লগে এক নজর দেহা করতে। পুকুর ঘাটের বাঁশঝাড়ের নিচে বহুত সময় বইসা আছিলাম কিন্তু সখিনা ওই দিন পুকুর ঘাটে আর আহে নাই। সখিনা গো বাড়ির একটা ছোট মাইয়ারে পথে পাইয়া কইলাম, সখিনারে কইছ আমি আইজকা রাইতে যুদ্ধে যাইমু আর হয়তো দেখা নাও হইতে পারে। তারপর বাড়ির দিকে রওনা দিলাম আর বুকের মইধ্যে তহন ধুকপুকানি শুরু হইছে।

বাড়ির উঠানে পা রাখতেই দাদাজানের গলার আওয়াজ শুইন্না কইলজাডা শুকাইয়া কাঠ অইয়া গেছে। দাদাজানে আমারে কইলো, তর মায়ের মুখে আমি কি শুনলাম? আমিও সাহস নিয়া জওয়াব দিলাম, যা শুনছো, ঠিকি শুনছো। মায়ে আর দাদীজানে মরা কান্দন শুরু করছে আর দাদাজানে কতো কিছু বুঝাইতাছে কিন্তু আমি অনড়। শেষমেশ দাদাজানে মায়ে আর দাদীরে কান্দন থামাইতে কইলো। আরো কইলো, ‘তোরাবের শরীলে আমাগো রক্ত, জবানে যখন কইয়া লাইছে, কথা আর নড়বো না, তোমরা হের যাওনের ব্যবস্থা কর।’ তহন মায়ে আর দাদীজান আমার পছন্দের তরকারি রানতে গেছে আর আমি কিছু কাপড়-ছাপর গুছগাছ কইরা বিছানায় শুইয়া একবার সখিনা আরেক বার যুদ্ধের কথা ভাবতাছি। এমুন সময়ে মায়ে আইয়া খাইতে ডাকলো কিন্তু আমার  ক্ষিধা নাই। তবুও গিয়া দাদাজানের লগে বইলাম। সবাই মিল্লা জোর কইরা অনেক কিছু খাওয়াই দিল। রাইত বাড়তাছে আর যাওনের সময় কাছাইয়া আইছে।

আমি সবাইরে কইলাম, আমি পথ দিমু অহন। মায়ে আর দাদীজান তহন আমারে জড়াইয়া ধইরা কান্দন শুরু করলো। আমি সান্তনা দিয়া কইলাম, সুযোগ মতো মাঝে মইধ্যে আইয়া দেহা করুম, চিন্তা কইরো না। দোয়া কইরো, আমরা যেন যুদ্ধে জিততে পারি। মায়ে তখন কইলো, তুই যেদিন দেশ স্বাধীন করতে পারবি, হেই দিন আমার কাছে ফিরা আবি। এহন এই দেশ তোর মা, দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত আমি তোর সব দাবি ছাইড়া দিয়া দেশের কাছে সইপ্পা দিলাম। মায়ের কথায় সিনা টানটান হইয়া গেছে, শরীলে রক্ত ফুটতাছে। মায়ে আমার হাতে চিড়া, মুড়ি, গুড় আর নাড়–র একটা পুটলি ধরাইয়া কইলো, ক্ষিধা লাগলে খাইছ বাজান আর দাদাজানে আমারে বেশ কিছু খরচের টাকা দিয়া কইলো আরো লাগলে খবর পাঠাইছ। আর দেরী না কইরা সবাইরে পায়ে ধইরা সালাম কইরা পথ দিলাম নদীর ঘাটের দিকে। সখিনা গো বাড়ির রাস্তা পার হমু, এমুন সময় কেডা জানি আমারে পিছন থাইক্যা জড়ায়া ধরছে। বুঝতে পারতাছি কুনু মাইয়া মানুষের শরীল। চাপা স্বরে কইলাম, কেডা তুমি...??? তখন চাপা কান্দন সুরে কইয়া উঠলো, আমি সখিনা। আমার তহন মনে হইছিল, আসমান থাইক্যা মাটিত পড়ছি। যে সখিনার হাত ধরতে পারি নাই, ঠিক মতো কথাই কইতে পারি নাই, হে আইয়া আমারে জড়ায়া ধরছে!!
সখিনা আমারে কইতাছে, ‘তুমি আমারে ফালাইয়া একলা যুদ্ধে যাইতে পারবা না তোরাব ভাই, আমিও তোমার লগে যামু।’ আমি পিছন ঘুইরা সখিনার মুখের দিকে চাহিয়া দেহি কাইন্দা চোখ ভাসাইয়া লাইছে। তখন আমার মনে হইতাছিলো, শরীলডা অবশ হইয়া গেছে, জবানে আওয়াজ দিতে পারতাছিলাম না। তবুও বুকের মইধ্যে পাষাণ বাইন্ধা কইলাম, ‘তুই মোল্লাবাড়ির মাইয়্যা, তুই এতো রাইতে বাইরে আয়োন উচিত হইছে না।’ সখিনা আমার কথাডা শুইন্যা রাইগা কইলো, ‘আমি আর বাড়ি ফিরা যামু না। হয় তোমার সাথে যুদ্ধে যামু আর নয়তো দুই চক্ষু যেদিক যায়।’ আমি তহন আমার মহব্বতের কসম দিয়া কইলাম, ‘তুই যদি আমারে হাছা মহব্বত করছ, বাড়ি ফিরা যা কেউ দেহনের আগে। আমি তোরাব আলী রাইতের আইন্ধারে তোরে সাথে নিয়া দুই পরিবারের ইজ্জত মারতে পারুম না। আমি যুদ্ধ শেষে ফিরা আইয়া তোরে বিয়া কইরা ঘরে তুলুম। যা এই বার তুই বাড়ি ফিরা যা।’

কথাটা শেষ কইরা আমি এক মূহুর্ত না দাড়াইয়া হাটা শুরু করলাম। আমার বুকটা তহন ফাইট্যা যাইতাছিল। এমুন সময়ে সখিনা পিছন থাইক্যা কইয়া উঠলো, ‘তোরাব ভাই কথা দিয়া যাও, তুমি ফিরা আইবা।’ আমি তহন পিছন ফিরা কইলাম, ‘আমি তোরাব আলী তোরে জবান দিলাম, আমি যুদ্ধ শেষে ফিরা আমু।, ইনশআল্লাহ’ । সখিনা তহনও পথে বইসা কানতাছে, আমি আবার কইলাম, যা সখিনা, বাড়ি ফিরা যা। সখিনা তহন দাঁড়ায়া কইলো, ‘আমিও জবান দিলাম, তুমি না ফিরা আসা পর্যন্ত সারাজীবন তোমার অপেক্ষায় থাকুম।’ তহন আমার চোখের পানি আটকাইতে পারলামনা। আর কথা না বাড়াইয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে নদীর ঘাটের দিকে পথ দিলাম। গিয়া দেখি সব দোস্তরা আমার আগেই আয়া পড়ছে। হগলে বুক মিলাইয়া তারপওে নৌকায় উইঠা যুদ্ধে যাওনের যাত্রা শুরু করলাম। নদী পার হইয়া রাইতের মইধ্যেই বর্ডার পার হইয়া ইন্ডিয়া ঢুইকা গেলাম মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে।

মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে আমরা সবাই ট্রেনিং লইলাম। ট্রেনিং শেষে পঁচিশ জন কইরা বেশ কয়ডা গেরিলা গ্রুপ বানাইয়া দিলো। একটা গেলিরা গ্রুপে আমরা নয়জন দোস্ত আছিলাম, বাকিরা সবাই আছিল কলেজের ছাত্র আর একজন কলেজের স্যার। কইতে গেলে আমরা আছিলাম একটা নওজোয়ান গ্রুপ, সবাইর শরীলের রক্ত টকবগ করতাছে যুদ্ধের ময়দানে নামতে। আমাগো গ্রুপের কমান্ডার আছিল ওই স্যার আবীর আহমদ আর আমি আছিলাম গ্রুপের সহ-কমান্ডার। আমরা সবাইর হাতে অস্ত্র তুইল্যা দিয়া ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন সবাইরে লইয়া শপথ বাইক্য পড়াইলো। শপথ পড়তে পড়তে রক্ত গরম হইয়া গেছে, শপথ বাইক্য শেষ কইরা সবাই এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ফায়ার করলাম দেশের নামে, এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ফায়ার করলাম মায়ের নামে, এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ফায়ার করলাম শহীদি ভাইয়েদের নামে, তারপর ক্যাম্প থাইক্যা বিদায় নিয়া গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হইয়া রওয়ানা দিলাম যুদ্ধের ময়দানে।

যুদ্ধের ময়দানে আমরা মাইলের পর মাইল হাঁটছি, খাইছি কি না খাইছি। আমরা গাও গেরামের পুলাপাইন আছিলাম, তেমুন অসুবিধা অয় নাই কিন্তু ছাত্র পুলাপান এই কষ্ট সইতে পারে না, তবুও হার মানে নাই। ক্ষিধার জ্বালায় লতাপাতা খাইছি, আমার মায়ে আর দাদাজানে যদি দেখতো, কাইন্দা মইরা যাইতো। পাক বাহিনী আর রাজাকারদের লাইগ্যা জঙ্গলে জঙ্গলে রাইত কাটাইছি। আমরা এর মইধ্যে বেশ কিছু গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিছি, এর মইধ্যে চাইরটাতেই জিতছি কিন্তু আমাগো দোস্ত পরিমল, ছাত্র পুলা সোহেলরে হারাইছি। দুই জনেই একই দিনে শহীদ অয়। পরিমল আর সোহেলের লাশ কারো বাড়ি পাঠাই নাই, জঙ্গলেই নিজেরা বিনা কাফনে দাফন করছি। তহন ইংরাজি অক্টোবর মাসের শুরু, এমুন সময় হেড কোয়ার্টার থাইক্যা খবর আইলো, বড়ো একটা যুদ্ধের মিশন আছে, সবাই সাব-ক্যাম্পে যাওয়ার নির্দেশ পাওয়া মাত্র ক্যাম্পে ফিরা গেলাম।

এইবার আমাগো মিশন আছিলো, আর্মির বড়ো একটা ক্যাম্প দখল করা। হেইখানে বন্দি বাঙালি মা-বইনদের আর আটক বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাগো ক্যাম্প থাইক্যা উদ্ধার করা। সব মিলাইয়া আমরা সবাই পঁচাত্তর জনের একটা বড় গ্রুপ হইলাম। এই গ্রুপ পনেরো জনের পাঁচটা ছোটো ছোটো গ্রুপে ভাগ অইলাম। এইবার আমারে একটা ছোটো গ্রুপের কমান্ডার বানাইয়া দিলো। তারপর প্ল্যান মোতাবেক একদিন রাইতে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হইয়া বিভিন্ন দিক থাইক্যা সরাসরি পাক বাহিনীর ক্যাম্পে ঝাপইয়্যা পড়লাম, তবে খুব সাবধানে। যাতে কইরা শুয়রের বাচ্চারা বুঝতে না পারে। তহন হায়েনার বাচ্চারা বাঙালি মা বোনের ইজ্জত লইয়া ফুর্তি করতাছে আর রাজাকারের বাচ্চা গুলা ক্যাম্প পাহারা দিতাছে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাগো উপর অমানবিক জুলুমবাজি চালাইতাছে।

প্রথমে আমরা দুই গ্রুপ সামনে আর পিছন দিকে পাহারা দেওয়া রাজাকারের বাচ্চা গুলার উপর হামলা করি আর দুই গ্রুপ এই ফাঁকে ক্যাম্পের দুই পাশ দিয়া ভিতরে ঢুইকা পড়ে। আরেকটা গ্রুপ ক্যাম্পের চাইর দিক ঘেরাও দিয়া রাখে। ক্যাম্পের ভিতরের আর্মিরা প্রস্তুতি নিতে নিতে আমরা হগলে পুরা ক্যাম্প ঘেরাও কইরা ফেলি আর যেদিকে আর্মি দেখি, ফায়ার করতাছি। এইভাবে একের পর এক আর্মি মারতাছি, আর বন্দি মা বইনদের চিল্লাইয়া কইছি আশেপাশে নিরাপদ দূরে সবাই একসাথে লুকাইয়া যাইতে। সবাই মিল্যা তাই করলো কিন্তু এর মধ্যেই পাক আর্মি পুরা প্রস্তুতি নিয়া আমাগো উপর পাল্টা হামলা শুরু করলো। ক্যাম্পে আমরা আগুন ধরাই দিলাম, তবুও কাম হইলো না। আসলে আমরার ধারণার থাইক্যা দ্বিগুণের বেশি পাক আর্মি আছিলো, প্রায় একশোর বেশি অইবো। তুমুল যুদ্ধ চলতাছে, বৃষ্টির মতো গোলাগুলি।

আর্মি যেমন মরতাছে, তেমন কইরা আমাগো পুলাপাইন গুলি খাইতাছে। এইটাই আছিলো আমাগো সবাইর প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। হঠাৎ কইরা একটা গুলি লাগে আমার পায়ে তারপরে মাথায়, আর কিছুই কইতে পারি না। শুধু মনে আছে ওই দিন আমি একলাই পাঁচটা পাক আর্মিরে কতল করি। যহন আমার হুশ আইলো, তহন আমি ইন্ডিয়ার কোনু একটা হাসপাতালের বিছনাতে শুইয়া আছি। তহনও কিচ্ছু কইতে পারি না, আরো কিছু দিন গেছে এমুন কইরা। আস্তে আস্তে হগল কিছু মনে পড়ছে। আমি নার্স দিদির কাছে দেশের খবর জানলাম, আমরা নাকি যুদ্ধে জিতছি, পাক বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করছে। সাথে সাথে জয় বাংলা, জয় বাংলা কইয়া ছিল্লাইয়া উঠলাম। দেশে ফিরা আইতে অস্থির অইয়া গেলে, ডাক্তর সাব আমারে ছাইড়া দিলো। দেশে ফিরা সোজা বাড়ি ফিরা দেহি, বাড়ি আর বাড়ি নাই, একটা ধ্বংস লীলা অইয়া আছে।

আমার গেরামে ফিরা আইবার খবর পাইয়া আশেপাশের দুই চাইর জন আইয়া কইলো, মুক্তি বাহিনীর বাড়ি বইল্যা আমার দাদাজান, দাদী আর মায়েরে গুলি কইরা মাইরা এই বাড়ির ভিতরে আগুন লাগাইয়া সবাইরে পুড়াইয়া দিছে পাক আর্মি আর হারামী রাজাকারের বাচ্চারা। আমি রাগে কষ্টে চিল্লাইয়া উঠলাম, তারপর দৌড়াইয়া সখিনা গো বাড়ির দিকে গেলাম। সখিনা গো বাড়ির উঠানে দাঁড়াইয়া সখিনারে ডাকা ডাকি করতাছি। এমুন সময়ে সুরোজ চাচা কাছে আইয়া কইলো, সখিনারে পাক সেনারা ক্যাম্পে তুইল্যা নিয়া গেছে, তারপর আর ফিরা আহে নাই। তহন আমি আবার চিল্লাইয়া আকাশ পাতাল এক কইরা ফালাই। এরপর থাইক্যা মাইনষে আমারে পাগল কয়। অই পুলা, আমি কি পাগল, তোর কি তাই মনে অয়..??

আমি তখন দুচোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম, আপনি পাগল নন, আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। তখন তিনি আমাকে আবার বলে উঠে, ‘তাইলে তুই আমার দাদাজান, দাদী আর মায়েরে ফিরাইয়া দে... আমার সখিনারে ফিরাইয়া দে... সখিনা কইছিলো আমার লাইগ্যা সারাজীবন অপেক্ষা করবো। তোরা কেউ আমার দাদাজান, দাদী, মায়ে আর সখিনারে রক্ষা করতে পারলি না, তয় কি এই তোদের লাইগ্যা আমি দেশ স্বাধীনে গেছিলাম...’ এসব কথা বলতে বলতে আমাকে তিনি মারধর শুরু করলেন। সবাই মিলে উনাকে আমার কাছে থেকে সরিয়ে নিয়ে পাগল বলে মারতে শুরু করলে আমি সবাইকে বাঁধা দেই। তখন একজন বলে উঠলেন, ‘এই পাগলারে মুক্তিযুদ্ধের কথা জিগাইলেই হের পাগলামি শুরু অয়। আপনি নতুন মানুষ, জানেন না, তাই অযথাই হয়রানি হইলেন।’ আমি উনার পুরো গল্প শুনে এবং উনার পাগলামি দেখে বাক রুদ্ধ হয়ে গিয়ে ছিলাম। তিনি আমার সামনে দিয়ে সখিনা সখিনা বলে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি উনাকে ডাকতেও পারছিলাম না। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে উনার চলে যাওয়া পথের পানে তাকিয়ে ছিলাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা।



নিকষ

নিকষ



নিকষ
আহাদ আদনান

বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের বারান্দাজুড়ে ছিল ফুলের গাছ। মা নিজের হাতে লাগিয়ে ছিলেন গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া আর হাসনাহেনা চারা। বসন্তের সেই সন্ধ্যাগুলোতে আমরা বারান্দায় বসতাম বাবার রেডিওটা নিয়ে। বাবা বলতেন, ‘দেখো, এইবার আমরা স্বাধীন হবোই। শেখ মুজিব কি বলছে শুনো নাই, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মা হয়ত তখন অনুকে দুধ খাওয়াচ্ছেন বসে। আর আমি খেলছি বিড়ালটার সাথে।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। বিকেলে বাবার কিছু ছাত্র আসে দেখা করতে। ‘স্যার, কিছু আঁচ করতে পারছেন দেশের অবস্থা? আমরা কোন পথে যাচ্ছি এখন’? বাবা তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে মুছে নিচ্ছেন। আমি এখনও মনে করতে পারি বাবার মুখ। জ্বলজ্বলে চোখ, হালকা হাসি আর প্রচ- রাশভারি লোকটা অভয় দেন ছাত্রদের, ‘তোমরা প্রস্তুত থাকবে। রক্ত আরও দিতে হতে পারে। দেশ হচ্ছে মায়ের মতন। মা’কে বাঁচাতে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সংগ্রাম করতে হয়। মুক্তির সংগ্রাম’। আশ্চর্য, বাবাকে কেন যেন হুবুহু মনে হচ্ছে পত্রিকায় দেখা আর রেডিওতে শোনা সেই মহাপুরুষের মত।
আমি তখন পড়ি ষষ্ঠ শ্রেণীতে। স্কুলে আবার কবে যাব, জানি না। দেড় বছরের অনু, আমার এই ছোট বোনটার সাথে খেলা করতে করতে কেটে যায় আমার প্রতিটাদিন। সন্ধ্যারাতেই মা রাতের খাবার সাজিয়ে দেন। আমরা সবাই টেবিলে। খাবার নামছে না কারও গলা দিয়ে। কিসের যেন উৎকণ্ঠা, ভয়। ‘এই অনু’র কিন্তু আজ বুকটা ধড়ফড় করছে খুব। কাল একবার নিয়ে যাবে ডাক্তারের কাছে’? আমার এই বোনটা জন্ম থেকেই হৃৎপি-ে ছিদ্র নিয়ে বড় হচ্ছে। অল্পতেই ঘেমে যায়, বুক ধড়ফড় করে, শ্বাসকষ্ট হয়। নিয়মিত একজন ডাক্তার দেখেন ওকে। ২৫ তারিখের সেই সন্ধ্যারাতে কেন জানি আমরা কেওই ভাত খেতে পারিনি।
রাত তখন কয়টা জানি না। রাস্তায় বড় বড় গাড়ির বিকট হর্নের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার। ঘরের বাতি নেভানো। বসার ঘরে বাবা একলা পায়চারি করছেন। হাতে সিগারেট। মা অনুকে নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। অনেক দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, বুকের খাঁচা ভেঙে যাচ্ছে, আর এতটা নীল ঠোঁট আমি আজও দেখিনি কোন মানুষের।
‘শুনছ, অনু’র প্রচ- শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কি করি বলোতো’?
এত অসহায় দৃষ্টিতে বাবাকে তাকাতে দেখিনি কখনো। মোমবাতির আবছা আলোয় দেখি, বাবা কপালের ঘাম মুছছেন, ‘একটু কষ্ট কর। বাইরে কারফিউ। সকাল হলেই...’।
চারদিক হঠাৎ বিক্ষিপ্ত শব্দে আন্দোলিত হয়ে পড়ে। মিলিটারির বুটের শব্দ, দরজায় লাথির শব্দ, উর্দু গালিগালাজ, গুলি’র শব্দে জাহান্নাম নেমে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের কোয়ার্টারে। মা কী আঁচ করেছিলেন জানি না। আমাকে শুধু একবার বললেন, ‘বাবারে, তোর বোনটাকে কোলে নে। এই আলনাটার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকবি। কেও আসলে, তোর বাবাকে ডাকলে, নিয়ে গেলেও চুপ করে থাকবি। একটা টুঁ শব্দ করবি না। পারবি না, বাবা’?
একটার পর একটা বুটের লাথির শব্দ আমাদের দরজায় আঘাত করে। বাবা গর্জে উঠেন, ‘কে? হু ইজ দেয়ার’? দরজা খুলে দিতেই কয়েকটা পশু ঢুকে পড়ে ঘরে। একজন বাবার গলা চেপে ধরে। মা চিৎকার করে ছুটে আসেন। প্রথম গুলিটাও লাগে মায়ের কপালে। লুটিয়ে পড়েন নতুন কেনা কার্পেটটার উপর মা। আমাদের শো-কেইস, টিভি, আসবাব ভেঙে তছনছ হয়ে পড়ে। কে একজন চিৎকার করে বলে, ‘এ প্রফেসরকো মার ডালো’।
অনু’র শ্বাস আরও বেড়ে গেছে। আমি ওর মুখ চেপে আছি। মায়ের আদেশ একটা শব্দও জেনো না হয়। আমার হাত ঘেমে যাচ্ছে, অনু’র ঘামে। বুকের ঘড়ঘড়টা আমি যেন এখনও শুনতে পাই। আলনার পিছনে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সামনে রক্তাক্ত পড়ে আছে বাবা আর মায়ের নিথর দেহ। আমি চিৎকার করতে ভুলে গেছি। নড়াচড়ার শক্তিটুকু হারিয়ে যায় আমার ।
যখন সম্বিৎ ফিরে আসে হাতের দিকে চেয়ে দেখি অনু খুব শান্তিতে আছে। কোন শ্বাসকষ্ট নেই, বুকে ঘড়ঘড় নেই, বুক ভাঙা নেই। বোনটা আমার কখন যেন চুপ করে চলে গেছে মায়ের সাথে, না ফেরার দেশে।

মাতুয়াইল, ঢাকা। 



শব্দমালা : সাকিব জামাল

শব্দমালা : সাকিব জামাল



শব্দমালা
সাকিব জামাল


চড়ুইপাখিমন

সারাক্ষণ, খুঁজি আমি- ‘বাবুই’ প্রিয়জন,
অথচ, বাসা বাঁধতে বায়না ধরে ‘চড়ুইপাখিমন'!
মনকে বলি বাবুই হও,
কষ্ট করে ‘মুক্ত’ রও!
চড়ুইসুখবিলাস এক মিথ্যে আয়োজন।


বসন্ত বিরহ!

কী অস্বস্তিকর! বসন্তে আমার একেলা প্রহর!
বহমান বিরহে অবিরত কুয়াশামাখা ভোর,
দেবী, শিশির ভেজা পায়
একটু নুপুর পরে আয়।
ভালোবেসে একবার কেবল হাতটি ধরি তোর!


ফুলের অগ্নিবাণ

ভেবে চিন্তে গাও গান ভ্রমর- ফুলের কানে,
প্রেমে সুখ স্বর্গরূপ, দুঃখ নিশ্চিত কামাগুনে,
এক ফুলে প্রেম, দুই ফুলে পাপ!
বহু ফুলে জীবন- দোযখের বাপ!
ভানে প্রেম উড়ন্ত ভ্রমর: মরে ফুলের অগ্নিবাণে।


দৃষ্টিভঙ্গি

শীত এলে, সবগাছের জীবনচক্রে- শুধুই পাতা যায়না ঝরে!
কিছু গাছে নতুন ফুলও ফোটে- নানা বাহারে, নানা বহরে!
কিভাবে দেখো তোমার সময়?
সেভাবেই ফলাফল নির্মিত হয়!
ঢেউয়ে ঢেউয়ে আসে জয়- ধনাত্মক ভাবনার সাগরে!


তুমি বিনে শীত দ্বিগুণ!

তুমি বিনে শীতের তীর- বোধকরি দ্বিগুণ!
প্রথমত, দেহ খুন! দ্বিতীয়ত, মনও খুন!
একলা জীবন, বিরহ যাপনকাল-
বাড়ন্ত শীতের অনন্ত সমকাল।
অথচ, তুমি থাকলে- সুফলা প্রেম, সর্বদা ফাগুন!



পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১





স্মৃতিময় তুমি
রেহমান আনিস

বদ্ধদ্বারে মাথা ঠুকে ঠুকে পৃথিবীর অনলে জ্বলছি
আর কতোকাল অপেক্ষা করতে হবে আমাকে?

জানালার ওপারে আলো, ধরণী আমাকে ডাকে
আমি ধরতে চাই, আলিঙ্গন করতে চাই তাকে।
আহারে অরুচি, অনিদ্রায় অস্থির হয়ে যাই আমি
দু’টি মায়াবী চোখ আর এক ঝলক হাসির নেশায়।

উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে থাকি অজানা কোন পথে
রক্ত চক্ষু, গুজব, সমালোচনা পিছে ফেলে।
শুধু জানি আমাকে বহুদূর যেতে হবে
বহুপথ পেরিয়ে, বহু বাঁধা অতিক্রম করে।

কাকচক্ষু মেলো, কাজলজলে ভাসতে ভাসতে চলে যাবো
মোহনার সীমা পেরিয়ে গভীর সমুদ্রের নীল জলে ।
ডুবে যাবো সাগরের বুকে হাতে হাত রেখে
তলদেশে সাঁতরে সাঁতরে খুজে বেড়াবো মণি মুক্তা।

আবারো জেগে উঠবো কোন এক পূর্ণিমা রাতে...
তীরে বসে দু’জনে দেখবো নক্ষত্রের যৌবন।
গ্যালাক্সির দীর্ঘ পথ চলতে চলতে হারিয়ে যাবো..
কালোকেশ  ধীরে ধীরে ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যাবে
ভাজপড়া দু’টি চোখ বিলবিল করে আমাকে তাকাবে।
আমি ভাজ গুনে, রেখা ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব শতবর্ষ পূর্বে
যেদিন চোখে চোখ রেখে প্রথম দেখেছিলাম তোমাকে।



রক্তে কেনা নীলপদ্ম 
কাব্য কবির 

খোকা হৃদয়ে স্বপ্নের বীজ বুনে
অচিনদেশে গিয়ে নীলপদ্ম  নিয়ে ফিরে আসবে।
সাত সিন্ধু তেরো স্রোতস্বিনী পাড়ি
দিয়ে যেতে হয় সেখানে। মা-জননীর
কাছে বলে খোকা-
আমি নীলপদ্ম চাই,
আমি অচীনদেশে যাবো
আমি নীলপদ্ম নিয়ে আসবো সেখান থেকে।
মায়ের বক্ষে নেমে এলো তখন
শ্রাবণের কালো মেঘ, দুটি আঁখি ভিজে
গেলো কান্নার বৃষ্টিতে।

খোকা বলে, মা তুমি কান্না কর না।
আমি নীলপদ্ম নিয়ে ফিরে
আসবো তোমার বুকে।
খোকা সাত সিন্ধু, তেরো ¯্রােতস্বিনী পাড়ি
দিয়ে গেলো সেই অচীনদেশে,
সেখানে গিয়ে দেখে,
নীলপদ্মের দীঘির পাড়ে বাস করে
কাল নাগিনী। আশেপাশে দুষ্টু ছেলের দল।
খোকা ওদের সাথে যুদ্ধ করলো দীর্ঘ
নয় মাস। শত্রুর অত্যাচারে খোকার
দেহ থেকে বের হলো রক্ত,
রক্তগঙ্গার মতো হয়ে গেলো নীলপদ্মের দীঘি।

অবশেষে, শত্রুকে পরাজিত করে খোকা
নিয়ে এলো নীলপদ্ম। নীল পদ্ম দেখে
মায়ের মুখে ফুটলো
টুকটুকে লাল গোলাপ রাঙা হাসি....



সব নদী গাছ
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

সবুজ দুপুরের পাশ দিয়ে যত নদী বয়ে গেছে
কোনো পান্থশালা থেকে তাদের ডাক আসেনি
বাসস্ট্যান্ড থেকে চেনা পথের বন্ধু
হাতনাড়া দিয়ে ঝড়ের পথে কথা বলেনি
যত উপনদী শাখানদী সব এক একটা গাছ
বাড়ির পাশ দিয়ে এলেও এখন হাতের নাগালের বাইরে
শাসকের ভোঁতা বইয়ে নদীর সংজ্ঞায়
আগামীর সারা মন আর্দ্র হয়ে উঠতে দেখে
পাঠ থেকে নদীনাম উঠে গেছে সব
ভুলে গেল প্রতি পথে জল দিয়ে মুখ দেখেছিল সে

জলের ভুল নামতায় মাটি তো মরুভূমি
নদীপথে ছাড়া বৃষ্টির গান কোথায় ?

এখনও কেউ কেউ জলে জলে কথা বলে
নদীপথে উড়ে যায় সব পাখি
মাটি তার হারিয়েছে ডানা
সব ছেড়ে মাঝরাতে মুখোমুখি হয়েছে যখন
সব নদী হয়ে গেছে গাছ ।



চির সবুজের বাংলাদেশ
মহিউদ্দিন বিন্ জুবায়েদ

রেসকার্স ময়দান...
লাখো জনতার ভিড়, একটি প্রত্যাশায়
যে স্বপ্ন দীর্ঘ লালিত হৃদয়ে দানা বাঁধা।

বাস্তবে রূপায়িত হবে..
একটি প্লাটফর্ম থেকে একটি কন্ঠ থেকে
অধির আগ্রহে জনতার ভিড়

কখন ? কখন ঘোষণা?
সেই মহানায়কের কণ্ঠ হতে...
যার যা আছে তা নিয়েই বেড়িয়ে পড়ো

অবশেষে...
মহান নেতার কণ্ঠে বেড়িয়ে এলো
একটি বিপ্লবী বাণী, যাকে লালন করে
আমরা পেলাম একটি স্বাধীন সার্বোভৌম
রাষ্ট্র। চির সবুজের বাংলাদেশ।


মসি হোক জয়ের হাতিয়ার
জেসমিন সুলতানা চৌধুরী

জগতে আছেন যতো জ্ঞানীগুণী জন
লেখাপড়া শিখে তাঁরা দেশসেরা ধন।
সময়ে করেন তাঁরা সময়ের কাজ
দেশের ধ্বজা ধরেন নেই রব সাজ।

শিশুগণ দাও মন নিজ নিজ পাঠে
অমূল্য সময় যেন লিখে পড়ে কাটে।
পড়ার সময় যেন করো নাতো হেলা
পাঠশালার পঠন জীবনের ভেলা।

পাঠ শেষে খেলো মাঠে কে করিবে মানা?
খেলাধুলা প্রয়োজন সকলের জানা।
অসি নয় মসিতেই আনো জয় ভূমে
জনতার হৃদ মাঝে থাকো যেন চুমে।

জীবনে চলার পথ কতো না বন্ধুর !
থেমে থাকা চলবে না হোক না সিন্ধুর।
মনে হও বলিয়ান ভয় করো জয়
কলুষতা দূরে রাখো হয় শুধু ক্ষয়।

মানবতা সেরা গুণ সব থেকে বড়ো
দেশটাকে ভালোবেসে অতি যত্মে গড়ো।
গুরুজনে করো নতি অহমিকা ছেড়ে
সততার দীপ জ্বেলে তবে উঠো বেড়ে।

অবহেলা নয় যেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা
ভালোবাসা থাকে যেন হৃদয়েতে পাতা।
উপকার করো তবে কারো ক্ষতি নয়
তোমরা পার আনতে নব নব জয়।


গাঢ় রঙ
শম্পা মনিমা

ট্রেনটা থামে, শিরশিরে হাওয়া শরীর জুড়ে ছুঁয়ে হাত ধরে নামায় স্টেশনে, বুনো রোদ এলো কোমর জড়িয়ে বিলাসী আগুন ছুঁয়ে হাঁটছে পাশাপাশি, যতগৃহ হেঁটে পার হাওয়া যায় না, তুমি তো সংসারী নও, তাইতো তোমার দেওয়া চৌকাঠে আল্পনা দেওয়া হয় না, কুশল খবর নিয়ে যায় না, হেঁটে চলি তুমি আমি, পুরোটাই সুতোয় বাঁধা মাঠঘাঠ তাকিয়ে আছে, দেখছে আমাদের নিলাজ প্রেম, দূরে ছুটির ঘন্টা সুর ভেসে আসছে, চুল বেয়ে নামছে তোমার আদর, নাভিতে ফুটছে গাঢ় পলাশ, মাঙ্গলিক চিহ্ন জন্মগোপনে থাক, ফিরতি পথে পাখিরা বসবে উড়াউড়ি আমাদের ঠোঁটে, খাপছাড়া সংলাপে, বুঝবে আশ্চর্য সব স্টেশন পার করেছিল জীবনে গাঢ় রঙ, রাতে এসে অশ্বমেধের ঘোড়া বলবে, পালানো যুদ্ধে, হারানো শতাব্দীর লুকানো আমাদের সংসার, পরের স্টেশনে করছে অপেক্ষা নিয়ে আজও গাঢ় রঙ।



তিনটি কবিতা
অনিন্দিতা মিত্র


অসমাপ্ত শব্দমালা
দুঃখরাত নিঃসঙ্গ জোছনায় ভর করে আসে ভোর, চৈতি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বাঘবন্দী খেলার হিসেব। আশ্রয় খোঁজে ক্লান্ত  নীড়হারা পাখি, বিবর্ণ স্মৃতিকে আগলে রাখে বিষাদ।


পদ্মপাতার জলতরঙ্গ 
স্বপ্নধোয়া জলে টুপটাপ ঝরে যায় ফিকে সম্পর্ক, উপচে পড়া চোখের জল গতি হারায়, অশ্বনদীর জলে ভেসে যায় জঠরে লুক্কায়িত চিরকালীন অভিমান ।


সমুদ্র-মুখর 
এঁকে চলি সমুদ্র-মুখর দিনরাতের ছবি। গত জন্মের অভিশপ্ত রাত ঠেলে আসে প্রেম, হতে চাই নির্ভীক জাতিস্মর।



পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২




অনন্ত মধ্যরাত
মিশির হাবিব 

আমি এপাড়ে বেদনার নীল বিষে মৃতবৎ,
তুমি ওপাড়ে নিঃসুখে জ্বলে জ্বলে বিবর্ণ গোলাপ-
আমাদের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে জীবননদী।
যেন অযুত কোটি মাইল দূরে তুমি-আমি!
কেউ কাউকে শত বছর বোঝার চেষ্টা করি না,
অথচ মধ্যরাত পেরোলেই আমার বুকে তোমার শরীরের জাফরানি গন্ধ পাই-
যেন সূচনা থেকেই মানুষের দুটি চোখের মতো অনন্ত
মধ্যরাত আমরা পাশেই থাকি
তবু কেউ কারো কান্না দেখি না!


মরিচিকার খোঁজে
আবু ইউসুফ সুমন

আমি যেখানে থাকি সেখানে আমার সাথে সুখ আর দুঃখ নামে আরো দু’জন থাকে।
সুখটা কেন জানি আমার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায়। মাঝে মধ্যে একটু এসে একটা হাসি দিয়ে আবার চলে যায়।
অথচ দুঃখ আমার সাথে ছায়ার মত লেগে থাকে। এক মুহুর্তও আমাকে চোখের আড়াল করতে চায়না।
অথচ আমি কতটা স্বার্থপর তবুও দুঃখকে ভালোবাসতে পারিনি।
সুখের একটুখানি হাসি দেখার প্রতিক্ষা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত!
মানুষের স্বভাবই কি মরিচিকার খোঁজে জীবন পার করা?




করোনা 
হাসান মাসুদ 

তোমার করোনা
তুমি কাঁপছ জ্বরে
আমার করোনা
আমিও নড়বড়ে

আমাদের করোনা যদি প্রেমে বদলে যেত...

তোমার করোনা
আমার করোনা
মধ্যে বাঁশের সাঁকো।

আমরা ঝুলছি,
কাঁপছি
যেমনটা রুদ্রাক্ষ রুদ্রাক্ষের ভিতর।


কষ্টের ভাইরাস
শাহীন খান

চাখারী আর আহমেদের মধ্যে তেমন একটা তফাৎ আমি দেখি না।
দু’জনই আমার বন্ধু।
কদাচিৎ ব্যস্ততার ভীড়ে ফোনে খবরাখবর নেয়া হয়।
দু’জন দু’দিকে।
চাখারী চাখারে, আহমেদ বানারীপাড়ায়।
পলখালেখি ওরাও করে।
বন্ধুদের মধ্যে ওরাই সাহিত্য পক্ষত্রে স্বতন্ত্র।
দু’জনারই হস্তাক্ষর দারুণ, চটপটে, বাকপটু, সুখী।
আমি ওদের থেকে যোজন যোজন দূরে...
খানাখন্দরে পড়ে পড়ে বিরহ-ব্যথায় ধুঁকছি।
নামহীন, ঠিকাহীন, মস্তক কাটা একটি লাশ!
পচে পচে গলে গলে ক্ষয়ে ক্ষয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছি, হচ্ছে পরিবেশ কলুষিত।
আমি ভাইরাসে আক্রান্ত, কষ্টের ভাইরাস!
কতো কষ্টের কথা বলবো?
আমার কষ্ট শেয়ার করবো না কাউকেই,
চাখারী কিংবা আহমেদকেও না।




একটা যুদ্ধ
সব্যসাচী নজরুল

পদ্মার ধূ ধূ বালুচরে ঘর্মাক্ত দিনের শেষে কীর্তিনাশায় গা ভিজাই,
ক্লান্ত দেহখান কখন জানি ঝিমিয়ে পরে বটের ছায়ায়।
সুদূর বিস্তৃত ভূমি মাঝে নিরবতা ভেঙে জেগে ওঠা তোমার একাকী জীবনের বিরহগাথা, কষ্টরা, অমানিশায়-
ব্যথার গীত রাগে-অনুরাগে করুণ সুরে বেজে যায়।

শুনলেও যা শিহরণ জাগাতে পারে না পাথর-চাপা এ কঠিন প্রাণে!
আলিঙ্গনে আলিঙ্গনে কোমল পরশে জড়িয়ে রাখা,
 আমায় ঘিরে থাকা তোমার অস্তিত্ব টের পেয়েও আমি নিরুপায়?
ব্যথা, কি যে ব্যথা, নিদারুণ কষ্টে চোখে জল ঝরে যায়।
অনুভূতি, স্পর্শগুলো পাঁজর ভেঙে কলিজা ছিঁড়ে গলিত বিগলিত হয়ে গড়িয়ে পড়লেও, আহারে-
ওরে হায়, হায় হায় আমি নিরুপায়!

ক্রমাগত ধাবমান একটা যুদ্ধ,
এ জীবনময় চলমান একটা যুদ্ধ।
অস্ত্রহীন কম্পিত হৃদে ধীর পায়ে হেঁটে যাই,
তবুও লড়ে যেতে চাই।
একটা বিজয় চাই, একটা মুক্তি চাই
প্রিয় চিরচেনা জগতে আমৃত্যু তোমায় নিয়েই বাঁচতে চাই।

চারিদিকে ভয়-আতঙ্ক, মৃত্যু উপত্যকা খুলেছে দ্বার,
দলছুট এক নেকড়ে আধিপত্য বিস্তার করছে বারংবার।
পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ভীষণ ক্ষুধার্ত শৃগালের দলে
তোমাকে আমাকে খেতে চায়
পলায়ন করে ঝাপ দেবো অথৈজলে
না, না, আমিতো এমন মানুষ নই?
পশ্চাৎপদে রবো, অগ্রগামী এ আমিতো এমন নই!
দেহের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত-
ওষ্ঠাগত শেষ দমটুকু পর্যন্ত প্রাণপণে লড়ে যেতে চাই,
স্বভূমে নিরোগ নিরাপদ আশ্রয়ে তোমায় নিয়ে বাঁচতে চাই।
বাঁচতে চাই, বাঁচতে চাই......


পারিপার্শ্বিক গল্পের বই ‘শহরের অসম প্রেম’

পারিপার্শ্বিক গল্পের বই ‘শহরের অসম প্রেম’



পারিপার্শ্বিক গল্পের বই 
‘শহরের অসম প্রেম’

অনিক মাযহার

‘শহরের অসম প্রেম’ সতেরোটি ছোটগল্পের একটি সংকলন। প্রতিটি গল্পই পাঠকের কাছে ধরা পড়বে খুব পরিচিত হয়ে। কারণ এগুলো প্রায়ই ঘটছে বা ঘটেছে আমাদের জীবনে। বিশেষ করে আমরা যারা শহরে থাকি, তাদের মনে ছড়াতে পারে আরো গভীর রোমাঞ্চ।

চাকরির উদ্দ্যেশে বাবা তার মেয়েসহ পরিবারকে গ্রাম থেকে নিয়ে যায় শহরে। আর এখানেই বিচ্ছেদ ঘটে ভালোবাসার সর্ম্পকের। যা আমরা দেখতে পাই, ‘বসন্ত এলে মনে পড়ে’ গল্পে। উঁচু-উঁচু দালানের ভীড় ঠেলে শহুরে জীবনে সকালের স্নিগ্ধ রোদ দেখা বেশ কষ্টসাধ্য একটা বিষয়। কিন্তু অনেকেরই ইচ্ছা থাকে সকালের সাফল্য গাঁথা রৌদ্র ছুঁয়ে দিনটা শুরু করার। পরিশেষে যখন রোদের দেখা পাওয়া যায়, তখন তা হয়ে ওঠে সাবালোক। যা সকলেই এড়িয়ে চলতে চায়। এমনই স্নিগ্ধ রোদের পরশ না পাওয়ার আপসোস আমরা টের পাই ‘সকালের রোদ’ গল্পে।

আলোমতি, ষোলো বছর বয়সের এক মেয়ে। বাবা বিছানায়, মা অনেক দিন হল বিদায় নিয়েছে। তাই সংসারের ভার সামলাতে তাকে চালাতে হয় একটি টঙ (দোকান)। সেখানেও শান্তি নেই তার। মানুষরূপি কিছু শকুনের দৃষ্টি হরহামেশা থাকে তার ওপর। আর তখনই রক্ষাকবচ হয়ে ছুটে আসে গফুর। যে অনেক দিন হল হারিয়েছে বাকশক্তিসহ মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা। যতদূর জানা যায়, নিজের চোখের সামনে মিলিটারিদের হাতে বড় বোনকে ধর্ষণ ও হত্যা হতে দেখে। ফলে তার আজ এমন দশা। এমনই সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে ‘রক্ষাকর্তা’ গল্পে।

কিছু সফলতা অনুপ্রেরণা যোগায় অনেকের পথ চলায়। তেমনই একটা সফলতার গল্প ‘ভাগ্য বদল’। যেখানে মনির স্নাতক পাশ করে বেকার সময় কাটাচ্ছিল গ্রামে। কিন্তু এ জীবন কখনোই পছন্দ না তার। ঘুরে দাঁড়াতে চায় সে; কিন্তু সরকারি চাকরির পিছনে ছুটবে না। কেননা, তেমন টাকা-পয়সা বা চেনা-জানা মানুষ কোনোটিই নেই তার। তবুও আশাহত হয়নি কখনো। নিজ পায়ে দাঁড়ানোর লক্ষে একদিন পাড়ি জমায় শহরে। ঠাঁই মেলে চাচার বাসায়। ভর্তি হন স্নাতকোত্তর করার জন্য। পাশাপাশি খুঁজতে থাকে চাকরি। এভাবেই অনেক খোঁজাখুঁজির পর ডাক আসে একটি বেসরকারি কোম্পানি থেকে। বেশি কিছু না ভেবে ঢুকে যায় সেখানে। দিনরাত চরম পরিশ্রম করতে থাকে। ওদিকে তার থাকা নিয়ে চাচার সাথে চাচির প্রায়ই বাঁধতো বাকবিত-া। এক পর্যায়ে মেসে উঠতে হয় তাকে। যাতে খরচ চালাতে গিয়ে আরো হিমশিম খেতে হয়। এভাবেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার হয় দুটি বছর। বের হয় স্নাতকোত্তরের ফলাফল। সফলতার সাথেই পাশ করে সে। তারপরই খুলতে থাকে ভাগ্যে দুয়ার।

গ্রামের ছেলে সুবোধ। শহরের একটি ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। স্বপ্ন দেখতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু বাস্তবে স্বপ্নগুলো তার থেকে অনেক অসম, তাই তাদের থেকে পাশ কাঁটিয়ে চলে। পড়াশোনায় সুবোধ খুব ভালো। নিয়মিত ক্লাস করা, পড়া রেডি করা, এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করা, ক্লাসটেস্ট সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা ইত্যাদিতে কোনো গাফিলতি নেই তার। হয়তো এসব কারণে ভার্সিটিতে ম্যাডাম থেকে শুরু করে অনেক সহপাঠিই খুব পছন্দ করে তাকে। অনেকেই গড়তে চাই প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু এসব থেকে সুবোধ যতটা পারে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। কারণ এসব অসম সম্পর্কগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলার অর্থ-কড়ি, সময়, যোগ্যতা কোনেটি নেই তার। কিন্তু শিক্ষিকা তাকে প্রেমের সর্ম্পকে জড়াতে বাধ্য করে। ছাত্র হয়ে শিক্ষিকার সাথে অসম প্রেম সুবোধ মেনে নিতে পারে না। এভাবেই সুবোধের শেষ হয় প্রতিটি দিন। আবারো জেগে ওঠে অসম সম্পর্কগুলো। যতটা পারা যায় দূরে রেখে বড় হওয়ার সংগ্রামে। এমনই নানা অসম সম্পর্কের উপাখ্যান ভেসে ওঠে ‘শহরের অসম প্রেম’ গল্পে। এ গল্পকে কেন্দ্র করে গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে।

শুধু এ কটা নয়, তরুণ লেখক মোহাম্মদ অংকন সবগুলো গল্পে এমন সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন  আমাদের ব্যস্ততম জীবনের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে। প্রতিটা গল্প খুবই জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবমুখি। আশা করি, গল্পগুলো মন কাড়বে সকল পাঠকের।


গল্পগ্রন্থ : শহরের অসম প্রেম
লেখক : মোহাম্মদ অংকন
প্রচ্ছদ : আল নোমান
প্রকাশক : চর্যা প্রকাশ
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০
মূল্য : ২৩০ টাকা।


অনিক মাযহার, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ,
৩৯, জেল রোড, ঘোপ যশোর।



সেই মহামারী !

সেই মহামারী !



সেই মহামারী
আনোয়ার রশীদ সাগর

গাঁ এর মানুষ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। মেয়েরা একজন অপরজনকে ঠেলা দিচ্ছে, কানাঘুষা করছে। সামনে দু’টি গাধার পিঠে চড়ে দু’জন বেদে সরদার আসছে। দু’সরদারের পাশে বসে দু’জন সুন্দরী যুবতী, যুবতী মেয়ে দু’টির ঠোঁট পান চিবানো রসের লালপিকে ভরা, মুখে খিলখিলানি হাসি।
হেলে দুলে কুঁতে পেদে গাধা হাঁটছে। পিছনে পিছনে একদল বেদে হেঁটে আসছে। তাদের মাথায় সাপের ঝুড়ি, লতা-পাতার ঝুড়ি রয়েছে। হয়তো চিকিৎসা বা অপচিকিৎসার সরঞ্জাম রয়েছে। গাঁয়ের  যুবকেরাও বেশ মজা পাচ্ছে ওদের দেখে। রাস্তার ধারে সারি সারি বাড়িঘর। পূর্বদিকে বড় একটা ফাকা মাঠ। সেখানে গরুছাগল চরে। বিকেল হতে হতে মাঠটা বেদেরা দখল করে ফেলে, তাবু টাঙিয়ে থাকার ব্যবস্থাও করে। সন্ধ্যা হতে হতে গাঁয়ের যুবকেরা দল বেধে দেখতে যায় ওদের। ঠিক ওদের সকলকে নয়, যুবতীরাই ওদের বড় আকর্ষণ ।
মোদী দোকানী ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা বেদেদের আগমণে খুবই খুশি, খুশি ম-লরাও। গোপনে নিজেকে আড়াল করে মাতুব্বরী ভাব নিয়ে, বাড়ি ছেড়ে তারাও সেখানে ঘুরঘুর শুরু করেছে। বেদের মেয়েরাও কম বোঝে না। তারাও সমানতালে, মাজায় শাড়ি পেচিয়ে নলা-কলা শুরু করে, ও ভাইরে ভাই আইসো আমার ডেরায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে ম-ল মশায় গিয়ে সুন্দরী বেদেনির তাবুতে বসে গল্প ফাদে, আমার এলাকায় আমার কথামত সবাই চলে, সবাইর অনেক টাকা-পয়সা রয়েছে। আমারি চল্লিশটা গরু বিশটা ভেড়া এ মাঠে চরে। এ কথা শুনে বেদেনি তার শাড়ির আঁচল খুলে বাধে এবং পেটের পেটি নগ্ন করে রাখে। তাবুর ভিতর থেকে কিশোরী একটা মেয়ে পান সেজে এনে ম-লের হাতে দেয়। আর ওদিকে দূর থেকে ম-লের ছেলে হাত ইশারায় কিশোরীকে আহ্বান করে। কচিমুখে হেসে কিশোরী মেয়েটি ছোট নিতম্ব দোলাতে-দোলাতে বের হয়ে যায়।
সকাল হতে হতে একটু বয়সী মেয়েরা ঝুড়ি মাথায় বেরিয়ে পড়ে, যাবে আশে-পাশের গ্রামে বা পাড়ায় পাড়ায়। নতুন উৎসবে আনন্দের জোয়ার চারদিকে। কাজ ফেলে ছেলেমেয়ে-বুড়োবুড়ি ছোটে ওদের দেখার জন্য। ওরাও মাজায় শাড়ির আঁচল বেধে, মাথায় ঝুড়ি নিয়ে, নিতম্ব দোলাতে দোলাতে ঘোরে এগাঁয়ে-ওগাঁয়ে।

দুদিন-দুরাত পার হয়ে গেছে। পুবদিক থেকে বাতাস বয়ে যেতে থাকে পশ্চিমে। সন্ধ্যা হতেই হতেই মল-মূত্রের গন্ধে ভরে যায় গাঁয়ের বাড়িঘর। মুতের তীব্র গন্ধে অনেকেই বমি করে ফেলে। যতরাত হতে থাকে ততই বেদেমাঠের গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। দু পাড়ার দু’ম-ল বেদেপাড়ায়ই রাত কাটিয়ে দেয়। সেই সাথে তরুণ ছেলেরাও।
মাঠের  আঁশটে গন্ধে ও মল-মূত্রের জীবানু ছড়িয়ে পড়ে সারা গাঁয়। কেউ স্থির থাকতে পারে না। এর মধ্যে আকাশে হড়াম-হড়াম শব্দ করে মেঘ ডাকা শুরু হয়। অনেকেই ভেবে নেয়, বৃষ্টি হলেই সব ধুয়ে যাবে। মেঘের গর্জনের পর বৃষ্টিও হয়ে যায়, বৃষ্টির পানিতে মাঠের গুঁ-মুতের আংশিক ধুয়ে ভেসে গিয়ে ডুবা-নদী-নালার পানির সাথে মিশে যায়।
সকালে হালকা ঠা-া ঠা-া অনুভব হয়। শুরু হয় কলেরা। মহামারী আকার ধারণ করে, শিশু বৃদ্ধ মারা যেতে থাকে, লাশের লাশ পড়ে থাকে। কে কাকে দেখবে? সকলেই বদনা হাতে দৌড়ায় নদীর ধারে। মেয়েরা তাদের লজ্জা ভুলে, সবাইর সামনেই পাছার কাপড় তুলে কলকল শব্দ করে মল ত্যাগ করে। একই অবস্থা হয় বেদে মাঠে। বেদে সরদারসহ কেউ কেউ মাঠ ছেড়ে পালায়। বাকি প্রায় সব বেদেই মারা যায়। মারা যায় গাঁয়ের অসংখ্য মানুষ। রেহাই পায় না গরু, ছাগল, ভেড়া ও পাখি। কেউ কেউ পালিয়ে, ভিনগাঁয়ে গিয়ে বাঁচে।



করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ১০টি টিপস...

করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে ১০টি টিপস...


বর্তমানে করোনা ভাইরাস ভয়ানক এক রোগের নাম।
এই রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকতে আপনাকে যা কিছু মেনে চলা অতীব প্রয়োজন । জেনে নিন...

ধানশালিক প্রতিবেদক :

১. খাওয়ার আগে এবং পরে অবশ্যই ক্ষার জাতীয় সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধৌত করুন।
২. বাহিরে বের হলে অবশ্যই মুখে মাস্ক পরিধান করুন।
৩. সব রকম সবজি গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে ধৌত রান্না করুন।
৪. বেশি বেশি পানি পান করুন [ঘন্টায় ১ থেকে ১.৫ লিটার]।
৫. কাছে কিংবা দূরের মানুষের সাথে সাময়িক সময়ের জন্য হাত মেলানো থেকে বিরত থাকুন।
৬. একটি পোশাক একবার পরিধান করেই ধুয়ে পুনরায় পরিধান করুন।
৭. নিজেকে সব সময় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখুন [সর্বোনিম্ম : ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস]।
৮. সব সময় নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন।
৯. অজু গোসল করে নিজেকে পবিত্র রাখুন।
১০. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।