মা নিবেদিত কবিতা

মা নিবেদিত কবিতা


আবার আসিবো ফিরে
এম এল আর বিপ্লব 

যুদ্ধ দেখিনি আমি, দেখেছি বিজয়
মা ডাক শুনে মা, হেসেছে যখন;
পল্লীবালার দীঘল কেশে;
উড়তে দেখেছি আমি, বিজয় কেতন
দূর প্রবাসের ঝলসিত রাজপথে;
হেটে হেটে বুঝেছি,
স্বাধীনতা কারে কয়?
ছকে বাঁধা জীবনের বৃত্তে দাঁড়িয়ে জেনেছি;
বৃষ্টি ভেজা সেই পিচ্ছিল মেঠোপথে’ই
আমার চিত্তের জয়।
সভ্যতার দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে;
ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, সিরিয়া, ইরাক,
মিয়ানমার, আফগান, জিনজিয়াং যখন দেখি;
তখন মনে হয়Ñ
কত দামে কেনা? কতটা দামী?
আমার স্বাধীনতা; আমার বিজয়।

মোরা এক সাগর রক্তে; করেছি ধারণ
লাল-সবুজের অনিন্দ্য নিকেতন।
মোদের পাখি ডাকা ভোর;
সোনালী রোদ্দুর;
আনমনে করে যায় স্বপ্নচারণ।
মোদের ধানসিঁড়িটির পরতে পরতে;
স্বপ্ন রাশি রাশি।
তাই; মন শুধু চায় চুপিসারে
একটু ছুঁঁয়ে আসি।
জানো কি তুমি? কেন সেথায়?
এমন স্বপ্ন গাঁথা!
হেথায়; বীর বাঙ্গালীর বুকের জমিন;
রাঙ্গায় স্বাধীনতা।

জীবনের প্রয়োজনে....
মা-মাটি-মমতার তৃষিত চাতকেরা;
দূর প্রবাসের ঝলসিত রাজপথে দাঁড়িয়ে,
সদা গুণছে প্রহর কবে আসবে ফিরে?
অবারিত সবুজের এ স্বাধীন তীরে।
প্রিয়হীনা পল্লীবালার; সিক্ত প্রেমের নীড়ে।
যেন উন্মুখ হয়ে হেরিতে পারে;
লাল-সবুজের স্নান।
যেন উজাড় করে বিলাতে পারে;
স্বাধীনতার ঘ্রাণ।
স্বাধীন চিত্ত ভরে
সাধ মিটাতে সাধের সাম্পান;
যেথায় এসে ভীড়ে।
সেথায় আবার আসবে ফিরে
আজ, কাল, পরশু কিংবা তারও পরে।

প্রিয় মা

প্রিয় মা


প্রিয় মা
সুমন আহমেদ

আজও মনে পরে সেই দিনগুলোর কথা। যেদিন মাথার উপর থেকে চলে গিয়েছিলেন বাবা নামের বটবৃক্ষের প্রশান্তির শীতল ছায়া। আমাদের টানাটানির সংসারে বাবা ছিলেন দু’বেলা দু’মুটো অন্য তুলে দেওয়ার একমাত্র উপার্জনকারী। সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রিকসা চালিয়ে আমাদের সংসার চালাতেন। আমার বয়স যখন ৭বছর তখন সড়ক দূর্ঘটনায় বাবা মারা যান। বাবা চলে যাবার সাথে সাথে অভাব এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে। মায়ের চোখে সেদিন শ্রাবণ দেখে ছিলাম; দেখেছিলাম কালবৈশাখীর তান্ডব ধ্বংসলীলা... ঝরে যাবার আর্তনাদ, বুকফাটা বোবা কান্নার ধ্বনি। সেদিন মা আমাকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন- বাবা রে.. আমি বেঁচে থাকতে তোকে কোনোদিন কষ্ট স্পর্শ করতে দেবো
না। মা তার কথা রেখেছিলেন। শত দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা আর অভাব অনটনের উপেক্ষা না করে- তার একমাত্র বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনের সুখের জন্য বেঁচে থাকার কঠিন জীবন যুদ্ধে নিজেকে সমর্পণ করেন। অল্প টাকার বেতনে মা একটি ইটের ভাটায় কাজ নিলেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, প্রতিটি মূহুর্তে মৃত্যুর যন্ত্রণা সয়ে এইভাবে কেটে যায় দীর্ঘ ১৫বছর। হঠাৎ একদিন ভাগ্য বিধাতার ডাকে সারা দিয়ে মা চলে যান অচেনা এক গন্তব্যে, না ফেরার দেশে। মা, আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন- আমি একদিন অনেক বড় হব সবার চেয়ে বড়।

বিশাল আকাশ। মা’র স্বপ্ন মিথ্যে হয়ে যাইনি, মা’র প্রতিটি আদর্শ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। আজ কেন জানি শুধু বারবার মা’র কথা মনে পরছে। কেন জানি বারবার জান্তে ইচ্ছে করছে- কেমন আছো মা? অচেনা-অজানা শহরের অন্ধকার মাটির ঘরে কতটা ভালো আছো? জানো মা, তুমি ছাড়া এই পৃথিবী আমার একটুও ভালো লাগেনা। তোমার মতো করে আমায় কেও একটুও ভালোবাসে না। একটা সময় ছিল আমার, ভোরের সূর্য উদয় হতো তোমার চাঁদ মুখখানা দেখে আর প্রশান্তির নিদ্রায় ঘুমিয়ে যেতাম তোমার ঘুম পাড়ানি গান শুনে। একটু চোখের আড়াল হলে ছুটতে পাগল বেশে; খোকা খোকা বলে সারা বাড়ি তুলতে মাথায়। একটুখানি অসুস্থ হলে সারারাত জেগে আমার পাশে বসে চোখে জলে বুক বাসাতে; বাবা চলে যাবার পর, শুধু আমার কথা ভেবে সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বেঁচে থাকার জীবন যুদ্ধে নিজেকে সমর্পণ করে দুবেলা দু’মুটো অন্য তুলে দিয়েছ আর একটু একটু করে আমার সমস্ত চাওয়াগুলো পূর্ণ করেছ। আমার এক জীবনের প্রতিটি অধ্যায় তোমার কাছে ঋণী। ইহকাল পরকাল আমার সমস্ত পৃথিবী তুমি... কোথায় গেলে গো মা? কোন সে দূর অজানায়, কোন সে পথের বাঁকে? ফিরে এসো মা- ফিরে এসো; একা থাকতে বড্ড কষ্ট হয়- একা থাকতে আর ভালো লাগে না। ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা; যেখানেই থাকো সবসময় যেন ভালো থাকো প্রিয় মা।
তারাবুলোছ, লেবানন।

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্র্রাণ : পর্ব ০৪

ধারাবাহিক উপন্যাস : জোসনা রাতে জাগে আমার প্র্রাণ : পর্ব ০৪

জোসনা রাতে জাগে আমার প্রাণ
আবুল কালাম আজাদ

[গত সংখ্যার পর]
বাবা বোধহয় ব্যাপারটা ধরতে পরল। বলল, এখানে কিন্তু তোর জন্য একটা শিক্ষা আছে।
অন্তর তাকাল বাবার মুখে। বাবা বললেন, সৎ ও পরিশ্রমী হবার শিক্ষা।
অন্তর বলল, বাবা, তুমি আগে কখনো চন্দ্রা গিয়েছো?
হ্যাঁ গিয়েছি।
কাল যে বললে পাহাড়, সমুদ্র দেখেছো কিন্তু বন দেখোনি?
সে তো বহু আগের দেখা! সেই দেখা কি আর সেভাবে মনে আছে?
কত আগে.......?
তখন আমার বয়স প্রায় তোর মত। তুই যেন এখন কোন ক্লাশে পড়িস?
প্রশ্নটা শুনে পারভেজ হাসান ঝট করে পেছনে তাকাল। বাবা ছেলেকে জিজ্ঞেস করছেন-তুই যেন এখন কোন ক্লাশে পড়িস? যে কেউ বিস্মিত হবে এতে।
বাবা বলল, তুমি এভাবে পেছনে তাকালে গাড়ি তো খাদে চলে যাবে।
অন্তর বলল, বাবা, আমি এবার ক্লাশ এইটে উঠবো। এবং আজই ঘটবে সেই ঘটনাটা।
ও তাহলে আমি তখন আর একটু বড় ছিলাম। আমি তখন নাইনে পড়ি। তখন আমাদের স্কুল থেকে পিকনিকের আয়োজন করল। ঠিক করল, গাজিপুর চন্দ্রার বনে যাবে। চাঁদা পঞ্চাশ টাকা। পঞ্চাশ টাকা এখন কোনো পিকনিকের চাঁদা হয় না। বাড়ির ছাদে পিকনিক করলেও না। পঞ্চাশ টাকা চাঁদার কথা শুনে তোর দাদা বললেন-পঞ্চাশ টাকা খরচ করে জঙ্গলে যেতে হবে না। এ টাকা দিয়ে বাড়ির সবাই মোড়গ-পোলাও খেতে পারব। শেষ পর্যন্ত তোর দাদীর কারণে তোর দাদার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করতে পারলাম।
তখন কি বনটা খুব ঘন ছিল?
হু, গাছ ছিল অনেক। পাখি ছিল। প্রাণীও ছিল। চিতাবাঘও ছিল।
খুব মজা করেছিলে নিশ্চয়?
মজা সেভাবে হয়নি। আমাদের সহকারি প্রধান শিক্ষক খালেক স্যার পাকানো এক বেত নিয়ে শাসন করে চলছিলেন-এ্যাই ছেলেরা, লাইন হয়ে হাঁটো। ইচ্ছে মত এদিক-ওদিক যাবে না। হারিয়ে গেলে বিপদ হবে। বিপদ শুধু তোমাদের না, আমাদেরও। আমরা লাইন হয়ে হাঁটছিলাম। লাইন একটু বাঁকা হলেই পিঠের ওপর সপাং করে বেত পড়ে। কিছু দেখা বা আনন্দ করার দিকে মন নেই আমাদের। লাইন বাঁকা হল কিনা সেই চিন্তায় অস্থির। এরকম অবস্থায় লাইনের সামনে কি যেন এক ঝামেলা মেটাতে খালেক স্যার সামনে গেছেন। পেছন থেকে আমি আর আমার বন্ধু মঞ্জুর আহসান (যার গাড়িতে এখন আমরা বসে আছি) লাপাত্তা। ও, সাথে আমাদের আরেক বন্ধু অমল ঘোষও ছিল।
বাবা থামলেন। অন্তর তাকিয়ে রইল বাবার মুখে। মূল গল্প কিন্তু এখান থেকেই শুরু। অথচ বাবা এখানে এসে চুপ। অন্তর বলল, তারপর কী হল?
আমরা এলোমেলো কিছুক্ষণ ছুটে চলে গেলাম অনেকটা গভীর জঙ্গলে। আকাশ ছোঁয়া গাছ। নিচে কাঁটা-গুল্মের ঝোপঝার। সে সব আমাদের কাছে কোনো বাঁধা ছিল না। মুক্তির আনন্দই ছিল আসল।
বন্য প্রাণী দেখেছো?
অজস্র! কাঠবেড়ালী আমাদের খুব কাছ দিয়ে ছুটোছুটি করছিল। বন বেড়াল, বেজি, গুইসাপ, ভোঁদর, সজারু, শেয়াল, খাটাশ, বাগডাশ ছিল প্রচুর। একটা শেয়াল তো আমাদের সাথে খুব মজা করছিল।
শেয়াল মজা করছিল?
মজাই বলা যায়। আমাদের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে আগাছা ঢাকা মাঠ। তারপর আবার বন। দেখি বেত ঝোপের পাশে একটা শেয়াল। আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ও যেন কোনোদিন মানুষ দেখেনি। আমরা ওর দিকে একটু এগিয়ে গেলাম। ও সরে না। আর একটু এগোলাম। ও তাও সরে না। আরও এগোলাম। তখন একটু সরলো। ঠিক আমরা যতটুকু এগোই ও ততটুকু পিছোয়। পিছিয়ে আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আবার আমরা পেছালে ও এগোয়। আমাদের বন্ধু অমল বলল-ও হয়তো শেয়াল না-অন্য কিছু। আমাদের সাথে মায়ার খেলা খেলছে। এভাবে মায়ায় ফেলে আমাদের কোথাও নিয়ে যাবে। শেষে আমরা আর এগোলাম না।
আচ্ছা বাবা, তোমরা যে তিনজন দল থেকে উধাও হয়ে গেলে অন্যরা তা টের পেল কখন?
দুপুরে খাবার সময়। দুপুরে খাবার সময় খালেক স্যার বললেন তিনটাকে তো দেখছি না। আমরাও তখন টের পেলাম আমাদের পেটে প্রচন্ড ক্ষিধে। কন্ঠে তৃষ্ণা। আমরা পা বাড়ালাম আমাদের পিকনিক স্পটের উদ্দেশ্যে। কিন্তু হায়! আমরা যে পথ হারিয়ে ফেলেছি। এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে আমরা ভীত বিহ্বল হয়ে পড়লাম। মনে শঙ্কা জাগল, আমরা হয়তো আর পথ খুঁজে পাব না, খুঁজে পাব না আমাদের সঙ্গিদের-তারা পাবে না আমাদেরকে। তাই যদি হয় তবে উপায়? আমরা যে নির্ঘাত মারা পড়বো। তখন শুনলাম কতগুলো শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক। দিনের বেলা শেয়ালের ডাক! সেই শেয়াল কি তার সঙ্গিদের খবর দিয়েছে যে, বনের ভেতর তিনটি ছেলে পথ হারিয়ে ফেলেছে? ওরা কি আনন্দ করে আমাদেরকে খাবে? যখন আমাদের বসে মাথা চাপরে কান্নাকাটি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই, তখন আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে এক লোক। তার মাথায় একটা ঝাঁকা। আমাদের দেখে সে থমকে দাঁড়াল। বলল-তুমরা দেখছি ভদ্দ লোকের পোলাপান। সমস্যা কী? জঙ্গলের মধ্যি ক্যান?
আমরা বললাম আমাদের বিপদের কথা। সে বলল-পিকনিকের দল কুন জায়গায় গাড়ি থামায় তা আমি জানি। আসো আমার সাথে।
আমরা হাঁটতে লাগলাম তার পেছনে। মঞ্জুর আমাকে কুনুইয়ের গুঁতো দিল। গুঁতো দিয়ে বোঝাল, সে ভাল লোক না খারাপ লোক তা কে জানে। শেষে আরেক বিপদে না পড়ি। তবে তখনও মানুষের ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস করা যেত। বিপদের সুযোগে মানুষ মানুষের ক্ষতি খুব কমই করতো। বেশ একটু সময় হাঁটার পর আমরা শুনতে পেলাম, বিমল স্যার মাইকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলছেন-আলম-মঞ্জুর-অমল, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন অতিসত্বর আমাদের গাড়ির কাছে চলে এসো। আমরা তোমাদের জন্য খুবই চিন্তিত হয়ে আছি। সেই লোকটা বলল-মাইকে কি তুমাগো নাম কইতেছে? আমি বললাম-জি।
তুমরা না কইয়া বার অইছো?
জি।
খুব খারাপ কাম করছো। নিজেরা তো বিপদে পড়তাই, তাগোও বিপদে ফালাইতা। এই রকম কাম করা তোমাগো মোটেও উচিত হয় নাই। তোমাগো তো শেয়ালেই খাইয়া ফালাইতে পারতো।
বিমল স্যার ঘোষণা দিয়েই চলেছেন। কোনো থামাথামি নাই। তাঁর গলা অনেকটা বসে গেছে যেন। কন্ঠটা কেমন কাঁদো কাঁদো।
আমাদের কাছে পেয়ে সবাই যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেল। খালেক স্যার বললেন-আগে খা, তারপর তোদের পিঠে গজারি গাঠের ডাল ভাঙবো।
আমরা গোগ্রাসে পোলাও আর মুরগির রোস্ট গিলতে লাগলাম। সেই লোককেও স্যাররা না খেয়ে আসতে দিলেন না। দেখি আমাদের সাথে সব স্যার খেতে বসেছেন। তার মানে আমাদের চিন্তায় তাঁরা সবাই না খেয়ে ছিলেন। কি ভালোবাসা!
পরে কি তোমাদের পিঠে গজারির ডাল ভেঙেছিলেন?
না, ব্যাপারটা বোধহয় খালেক স্যার ভুলে গিয়েছিলেন।
বাবার শৈশবের বন ভ্রমনের অভিজ্ঞতা অন্তরের খুব ভালো লাগল। বাবা এখন অনেকটা ভীতু মানুষ। কিন্তু শৈশবে নিশ্চয় এমনটা ছিলেন না। সাহসী না হলে দল ছেড়ে এভাবে বনের মধ্যে লাপাত্তা হতে পারতেন না। অন্তর বলল, বাবা, এখনও কি তেমন বন্য প্রাণী দেখতে পাব?
এর উত্তরে মুখ খুলল পারভেজ হাসান। বলল, যতদূর সম্ভব দু’/একটা কাঠেেবড়ালী ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না। আমাদের দেশে যেমন আশঙ্কাজনক হারে মানুষ বেড়ে যাচ্ছে, তেমন আশঙ্কাজনকভাবে বন ও বন্য প্রাণী কমে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে আমি সুন্দরবন গিয়েছিলাম। আশা ছিল বাঘ মামার সাক্ষ্যাত পাব, হরিণের ঝাঁক দেখবো। দেখবো তারা কাজল টানা মায়াময় চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কিন্তু না, সে সবের কিছুই দেখলাম না। দেখার মধ্যে দেখলাম দু’/একটা বাচ্চা কুমির খালের পাড়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। হ্যাঁ, হরিণ দেখলাম-তবে জীবিত না। চোরাকারবারিরা মেরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের বুকে গুলির ক্ষত। সুন্দর হরিণগুলোর দিকে তাকিয়ে বুক ভেঙে যাবার উপক্রম। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে হরিণ দেখা যায় না, অথচ আমেরিকায়......।
পারভেজ হাসান থেমে গেল। তারও বোধহয় বাবার মত অভ্যাস আছে কথার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেমে যাওয়া।
অন্তর বলল, আমেরিকায় কী আঙ্কেল?
আমার স্যার কিছুদিন আগে আমেরিকা বেড়িয়ে এলেন। তিনি বললেন, সেখানে নাকি হাইওয়েতে হরিণ চাপা পড়ে। এত বন্যপ্রাণী সেখানে যে তারা লোকালয়ে চলে আসে।
কিন্তু চাপা পড়ে কেন?
সেখানকার হাইওয়ে তো আমাদের হাইওয়ে না। এই যে দেখ আমি হাইওয়েতে চলছি। একটু পরপরই আমাকে বাঁক নিতে হচ্ছে। থামতে হচ্ছে সিগনালে। অ-সিগনালেও থামতে হচ্ছে বারবার। আর সেখানে একশ’ মাইল চলে যাওয়া যায় সূতা টানা সরল রেখায়। গাড়ির সাধারণ গতি ঘন্টায় ৭০/৮০ কি.মি। হঠাৎ করে রাস্তার পাশ থেকে কোনো বন্য প্রাণী গাড়ি সামনে চলে এলে থামানোর উপায় থাকে না।
পারভেজ হাসানকে অন্তরের ভাল লাগল। সুন্দর করে কথা বলে। বলবে না কেন। সে তো আর সব ড্রাইভারের মত না। সে বাংলা সাহিত্যে এম.এ।       

(৩)
যখন বনের ধারে গাড়ি থামল তখন সকাল নয়টা। বাবা বলল,    নাস্তাটা সেরে নেই।
গাড়ির পাশে সবুজ ঘাসের ওপর চাদর বিছানো হল। নাস্তার প্যাকেট খোলা হল। তখন দেখা গেল, মা ভেবেছে শুধু ক্ষুধার কথা। তৃষ্ণার কথা ভাবেনি। খাবার দিয়ে বিশাল বিশাল ব্যাগ ভরে দিয়েছে। কিন্তু এক ফোটা পানিও দেয়নি। অন্তর বলল, বাবা, এখন উপায়?
বাবা বললেন, উপায় তো একটা বের করতেই হবে। খাবার ছাড়া দুই দিন থাকতে পারব, পানি ছাড়া বোধহয় আর এক ঘন্টাও থাকতে পারব না।
বাবা পারভেজ হাসানকে বললে, হাসান, তোমার গাড়িতে কি বোতল-টতল নেই?
সাধারত থাকে, কিন্তু আজ নেই।
অভাগা যেদিকে যায় মহাসাগরও শুকায়ে যায়।
স্যার, আপনি একবার আমাকে পারভেজ ডাকছেন, আবার হাসান ডাকছেন।
তোমার নাম পারভেজ হাসান। পুরো নাম ধরে ডাকা যাবে না। ডাকতে হবে হয় প্রথমটা, নয় দ্বিতীয়টা। আমি বুঝতে চেষ্টা করছি, কোনটা ডাকলে ভাল লাগে।
স্যার, আপনি বরং হাসান নামে ডাকেন।
অন্তর হাসানকে সাপোর্ট দিয়ে বলল, জি বাবা, তুমি হাসান নামে ডাকবে। আমি ডাকবো, হাসান আঙ্কেল।
বাবা বলল, না, আমি ডাকবো পারভেজ নামে। পারভেজ হল এজন স্টেটম্যানের নামের প্রথম অংশ। পাকিস্তানের সাবেক স্টেটম্যান। স্বৈরাচারী স্টেটম্যান। পাকিস্তানের আর্মি থেকে সব জাদরেল স্টেটম্যান উঠে আসে। সেই ’৪৭ থেকেই আসছে। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়াউল হক, পারভেজ। কখন যেন কিয়ানি-ফিয়ানি নামের কেউ উঠে আসে। এসেই মাশাল্লা-ফাসাল্লা দিয়ে.......। ওদের দেখেই তো আমাদের জেনারেলরা শিখেছিল। আর্মি চালায় দেশ...যতসব......!
বাবা চলে গেছে রাজনীতিতে। দেশ হোক, বিশ্ব হোক রাজনীতির কথা বলতে বলতে বাবার মাথা গরম হতে থাকে। তারপর শুরু করে নেতাদের গালাগাল। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর বাবার কি যে ক্ষোভ!
বাবা বলল, পারভেজ নামে ডাকবে, কিন্তু অন্তর ঠিকই জানে, বাবা তাকে হাসান নামে ডাকবে। তার অপছন্দের মানুষের নাম সে বারবার মুখে আনবে না।
অন্তর বলল, বাবা, জেনারেলদের চিন্তা রেখে এখন পানির কথা ভাবা উচিত।
ও হ্যাঁ, পানির কথা-পানির কথা তো ভাবতেই হবে। ওয়াটার মিনস লাইফ। এটা ছাড়া তো চলবেই না।  
হাসান বলল, স্যার, আপনারা একটু বসুন। আমি পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে দেখি পানি আনা যায় কিনা।
তোমাকে বেশ কষ্ট করতে হবে।
কষ্ট কোনো বিষয় না স্যার। আমারও তো পানি খেতে হবে। জান বাঁচানো ফরজ।
তাহলে যাও, একটু বেশি করে আনবে যাতে সারাদিন খাওয়া যায়।
অন্তর বলল, বাবা, আমিও হাসান আঙ্কেলের সাথে যাব। বনের ধারে গ্রামগুলো আমার দেখা হবে। বাড়তি অভিজ্ঞতা।
বাহ! বুদ্ধমান ছেলে। স্বল্পবুদ্ধির বাবার ঘরে বেশি বুদ্ধির ছেলে। বেশি বুদ্ধির লোকরা সব সময় এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। রথ দেখতে চায়, কলাও বেচতে চায়। যাও, তুমি কলা বেচে এসো।
হাসান আর অন্তর পানি যোগার করতে গেল। বাবা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল, ওদের পানি নিয়ে আসতে কতক্ষণ লাগতে পারে? দশ/পনেরো মিনিটের মধ্যে আসতে পারবে না নিশ্চয়। ঘন্টা লেগে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।
এই একাকি সময়টা বাবা কিভাবে কাটাবে? চা খাওয়া যেতে পারে। পেট একবারে খালি। খালি পেটে চা খেলে অনেকের পেটে মোচর দেয়, বাবার সেরকম কিছু হয় না। দুই কাপ চা খেতে পনেরো মিনিট লেগে যাবে। বাকি থাকবে আরও পয়তাল্লিশ মিনিট। এই সময়টা গাড়িতে বসে গান শুনে কাটানো যেতে পারে। হাসান কী ধরনের গান শোনে সেটাই কথা। বর্তমানের হুক্কা-হুয়া ধরনের গান হলে শোনা যাবে না। তবে হাসানের সে জাতিয় গান শোনার কথা নয়। বাংলায় মাস্টার্স একটা ছেলে হুক্কা-হুয়া জাতিয় গান শুনবে না। বরীন্দ্র সংগীতই তার প্রথম পছন্দে থাকার কথা। [ক্রমশ...]


পৃথিবীর প্রতিটি মায়ের প্রতি অফুরান ভালোবাসা

পৃথিবীর প্রতিটি মায়ের প্রতি অফুরান ভালোবাসা


পৃথিবীর প্রতিটি মায়ের প্রতি অফুরান ভালোবাসা
মাহমুদুল হক জালীস

মা। একটি মধুর ডাক। এক অক্ষরের শব্দ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শব্দ। শ্রুতিমধুরও বটে। মা ডাকটি কানে এলেই নির্লিপ্ত চোখে ভেসে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। মায়াবী একখানা মুখ। যে মুখে লেগে আছে ভালোবাসার হাজারও স্মৃতি। হাসি কান্নার ভাষা।
পৃথিবীর শত দুঃখ-কষ্টের মাঝে যে মানুষটির একটু সান্তনা আর স্নেহ-ভালোবাসা সন্তানের সমস্ত বেদনা দূর করে দেয় তিনিই হলেন মা। দশমাস দশদিন গর্ভে ধরে বহু ত্যাগ তিতিক্ষার পথ মাড়িয়ে স্বযতেœ লালন-পালন করে যিনি মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেন তিনিই হলেন মমতাময়ী মা। জগৎ সংসারের বিভিন্ন সংকটে যে মানুষটি স্নেহের পরশ বিছিয়ে দেয় তিনি হলেন মা। প্রত্যেকটি প্রাণীর পৃথিবীতে আসা এবং বেড়ে ওঠার প্রধান ভূমিকা মায়ের। তাই তো পৃথিবীর বেশিভাগ মানুষের কাছেই মা ডাকটি অতি প্রিয়।

২০০৫ সালে একশরও বেশি দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল এক সমীক্ষা চালায়। তাতে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের মতামত নেওয়া হয়। এর ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে পছন্দের ৭০টি শব্দের তালিকা করা হয়। তৈরি করা হয় ‘টপটেন’। এ টপটেনের ‘টপ’ শব্দটিই হলো ‘মা’। মা শব্দটির ভিতরে রয়েছে ভালোবাসার উষ্ণতার আদরমাখা পরশ। মা তার প্রতিটি সন্তানকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে বসবাস করে। স্নেহ-মমতা দিয়ে আগলে রাখে সবসময়। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই মাকে সীমাহীন ভালোবাসে। এজন্যই প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় বিশ্ব মা দিবস।
আজ বিশ্ব মা দিব
ইতিহাসের পাতায় নজর করলে দেখা যায়, বসন্তকালে দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে যে উৎসব করা হতো, সেটি মা দিবস হিসাবে গণ্য ছিল। প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যে এ উৎসব ‘ক্রানাম’-এর স্ত্রী এবং দেবতাদের মা রিয়ার সম্মানে পালন করা হতো। রোমে মা ইসাবেলাকে উৎসর্গ করে জাঁজমকভাবে পালিত হতো এ উৎসব। খ্রিস্টের জন্মের ২১৫০বছর আগে এ উৎসব পালিত হতো যা ‘হিলারিয়া’ নামে পরিচিত ছিল।

১৬০০সালে ‘মাদারিংসানডে’ নামে একটি দিন পালিত হতো ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডবাসী মা দিবসকে মায়ের জন্য রোববার হিসাবে পালন করে। দিনটি পালিত হতো যিশুর উপবাস স্মরণের উদ্দেশ্যে ইস্টারের আগে। খ্রিস্টান ধর্মাবল্বীদের ৪০দিন বর্ষিক উপবাসের চতুর্থ দিবস রোববার। ইংল্যান্ডে সে সময় অসংখ্য দরিদ্র মানুষ ভৃত্য হিসাবে কাজ করত। বাড়ি থেকে অনেক দূরে কাজ করতে হতো বলে প্রায়ই তারা মনিবের বাড়িতে থেকে যেত। মাদারিংসানডে মনিবরা ভৃত্যদের ছুটি দিত এবং তাদের বাড়ি ফিরে দিনটি তাদের মায়ের সঙ্গে কাটাতে উৎসাহিত করত। পরে এ দিনটি পরিবর্তিত হয়ে মাদার চার্চে পরিণত হয়। জনসাধারণ গির্জায় গিয়ে তাদের মাকেও শ্রদ্ধা জানাতে থাকে এ দিনে। তখন উত্তর ইংল্যান্ডে ও স্কটল্যান্ডে মা দিবসে কেক বানানোর রীতি প্রচলিত ছিল। বর্তমানে যে মা দিবস পালিত হয় এর পেছনে অ্যানা মেরি জারভিসের অবদান উল্লেখযোগ্য।
১৮৬৪ সালের ১ মে জন্মগ্রহণকারী আমেরিকার এই ভদ্রমহিলা ছোটবেলাতেই জানতেন, তার মায়ের খুব ইচ্ছে জীবিত ও মৃত সব মায়ের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা। অ্যানার মা নিজেই ‘মাদারস ফ্রেন্ডশিপ ডে’ প্রচলনের ব্যাপারে উদ্যোগী ছিলেন। তিনি ‘মাদারস ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ নামে একটি ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেন।
মিস অ্যানা জারভিস প্রথমবার মা দিবস উদযাপনের সময় সাদা, গোলাপি বা লাল ফুল মায়ের ভালোবসার প্রতীক হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। এরপর থেকে লাল ফুলকে বেঁচে থাকা মায়ের শ্রদ্ধার প্রতীক হিসাবে গণ্য করা হয় ।

১৯১৪ সালের ৮ মে কংগ্রেসের এক যৌথ অনুমোদনের পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা দেন, প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস হিসেবে পালিত হবে । পরিশেষে পৃথিবীর প্রতিটি মায়ের প্রতি অফুরান ভালোবাসা।

মায়ের জন্য লেখা পঙ্ক্তিমালা

মায়ের জন্য লেখা পঙ্ক্তিমালা


মায়ের জন্য লেখা 
পঙ্ক্তিমালা
বাসার তাসাউফ

আজকাল প্রকৃতি বড় বেয়াড়া। শুকনো, ঠন্ঠনে। চারপাশটা মরুভূমির মতো লাগছে। কী সকাল, কী দুপুর কিংবা মধ্যারাতের নির্জনতাÑ সারাক্ষণই গরমে বুকের ভেতরের থাকা কলজেটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়ে থাকে। তার ওপর আছে নিসঙ্গতা নামক এক অনিরাময়ী ব্যাধির যন্ত্রণা। কিছুতে মন বসে না। খালি সব কিছু শূন্য শূন্য লাগে। জানি না অন্যদের কেমন লাগছে আজকালের শুষ্ক, গুমোট প্রকৃতি। আমার মতো বেকার ও অকর্মণ্য যারা তাদের কাছেই বোধহয় এমন অনুভূতি হচ্ছে। সকাল থেকে কোথাও বের হই নি। শুধু ফযরের সময় মসজিদ থেকে নামায আদায় শেষে বাসায় ফেরার পথে বাবার কবর জিয়ারত করার সময়টা ছাড়া। বাগানে যাইনি, ফুলগাছে পানি ঢালিনি। বিরস লেগেছে জেলি ও পাউরুটি। কফির মগে চুমুক দিয়ে তেতোয় জিভ বেঁকে গিয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে রিমোটের বাটন টিপে টিপে চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টে গেছি, কোনো চ্যানেলই দেখতে ইচ্ছে হল না। অগত্যা বসা থেকে উঠে স্টাডি রুমে এসে বুকসেলফ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ নামিয়ে আনলাম। দুই লাইন পড়ার পর আর পড়তে ইচ্ছে হল না। বইটি আগের জায়গা রেখে নিচের তাক থেকে আমার লেখার ডায়েরিটা বের করলাম। কয়েকটি পাতা উল্টাতেই ‘আমার মা’ শিরোনামের বহুদিন আগে লেখা আমার একটি কবিতাচোখে পড়ল।
শৈশবে আমি না-কি খুব বেশি অস্থির রেখেছি
আমার মাকে,
কারণে অকারণে অর্থহীন চিৎকারে
তাঁকে ডেকে উঠেছি কান্নার ভাষায়।
মা আমাকে কোলে তোলে নিয়ে
আদর করে বুকে জড়িয়ে রাখত
আমি সুখ পেতাম।
এ সুখ তখন বুঝিনি।
হোক না মাঘ-নিশিতেই
তবু কেমন মায়া আমার মায়ের!
শুভ্র মখমলের ওম বিছানায়
শুয়ে আছি মায়ের পাশে
মা আমার দু’চোখে এঁকে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ, স্বপ্নিল আল্পনা
অনাগত আগামীর মানচিত্র।
হঠাৎ কখন ভিজিয়ে দিয়েছি মখমলের সেই বিছানা
উষ্ণতার ওমে, শিশির বিন্দু
মা ভেজা বিছানায় গা এলিয়ে
উষ্ণতায় রাখে আমায় সযতনে
কী মমত্ব মায়ের!
কৈশোরের কথা বলি: একদা রাত্রি বেলায়
আমার শোবার ঘরে
আলনা কিংবা শো’কেসের আড়ালে
কী যেন এক প্রাণীর অদ্ভুত ডাক শুনতে পাই
মা দৌড়ে ছুটে এসে বলে, ‘খোকা! ওদিকে যাসনে,
দেখছি আমি কোন সে প্রাণী লুকিয়ে ওখানে
সাপ কিংবা বিষাক্ত কিছু হয় যদি!’
সাপ-কি মায়েদের ছোবল দেয় না?
কী মায়া মায়ের!
মাকে নিয়ে লেখা আমার প্রথম কবিতা এটি। লিখেছি আজ থেকে ঠিক দশ বছল আগে। ৯ মে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের কোনো এক দুপুরবেলা। ভাতঘুম না দিয়ে আমি কবিতাটি লেখার চেষ্টা করেছিলাম। জানি না, এটি কোনো কবিতা হয়েছে কি না। কবিতা হোক আর না হোক মাকে নিয়ে সেই আমার প্রথম অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর অনুভূতিরা দলে দলে মগজে, মননে, অন্তরে ভিড় করলেও আমি আর একটি চরণও লেখতে পারিনি মাকে নিয়ে। অথচ মাকে নিয়ে আমার একটা গল্প অথবা কবিতা লেখার কথা ছিল। কিন্তু লিখতে পারি নি। লিখতে বসলেই মনে হয়, আমি আমার মাকে নিয়ে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র চেয়ে বড় একটা কাব্য লিখতে পারি। কিন্তু কখনও লেখা হয় নি। মা আমার পৃথিবীর সবচেয়ে আপন ও প্রাণের চেয়ে প্রিয়। আমি না লিখলে কী হবে? মাকে নিয়ে অনেকে কবি-সাহিত্যিক লিখে গেছেন তাঁদের নিজেদের মতো করে। কাজী নজরুল ইসলাম ‘মা’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,/মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো/ আর/কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!/হেরিলে মায়ের মুখ/দূরে যায় সব দুখ,/মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,/মায়ের শীতল কোলে/সকল যাতনা ভোলে/কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেনÑ ‘আমি যদি দুষ্টুমি করে/চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,/ভোরের বেলা, মা গো,/ডালের ’পরে/কচি পাতায় করি লুটোপুটি-/তবে তুমি আমার কাছে হারো-/তখন কি, মা, চিনতে আমায় পারো?/তুমি ডাকো ‘খোকা কোথায় ওরে’/আমি শুধু হাসি চুপটি করে।’
‘বীরপুরুষ’ কবিতায় লিখেছেনÑ‘মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে/মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।/তুমি যাচ্ছ পালকিতে, মা, চ’ড়ে/দরজা দু’টো একটুকু ফাঁক ক’রে,/আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে/টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।’
জসীম উদ্দীন তার পল্লী-জননী কবিতায় লিখেছেনÑ‘রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার, /নিশ্বাস ফেলি, তাও/শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার। /রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা, /করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা। /শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে, /তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে। /ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান, /এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?/ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু, /শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।’
কবি কামিনী রায় লিখেছেনÑ ‘জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-/‘মা, তোমারে কত ভালোবাসি!’/কত ভালবাস ধন?’ জননী শুধায়।/‘এ-ত।’ বলি দুই হাত প্রসারি দেখায়।/‘তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?’/মা বলেন ‘মাপ তার আমি নাহি জানি।/‘তবু কতখানি, বল।’/‘যতখানি ধরে/তোমার মায়ের বুকে।’
কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি পড়ে আমরা আবেগাপ্লুত হয়েছি। ‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি/সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’
‘আমাদের মা’ কবিতাটি পড়লে হুমায়ুন আজাদের মা যেন হয়ে উঠে আমাদের মাÑ ‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।/আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,/কথা বলতে গিয়ে কখনোই/কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতো না।/আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে/মাকে আপনি/বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।/আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।’
কবি কালিদাস তাঁর বিখ্যাত ‘মাক্তৃভক্তি’ কবিতায় লিখেছেনÑ ‘বায়েজিদ বোস্তামী- /শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী। /দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন, /বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন দু’নয়ন। /দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি, /বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।
কবি সুভাষ মখোপাধ্যায় লিখেছেনÑ ‘আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মাকে/কখনও মুখ ফুটে বলি নি।/টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে/কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু/শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত/আমার ভালাবাসার কথা/মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।’
কবি আল মাহমুদ লিখেছেনÑ ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে /হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।’
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেনÑ ‘মাগো, ওরা বলে,/সবার কথা কেড়ে নেবে/‘তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো মা, তাই কি হয়?’
মাকে নিয়ে লেখা আরও লিখেছেন, আম্মা- আবদুল মান্নান সৈয়দ, মায়ের চোখে- দাউদ হায়দার, ¯মৃতি- আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আমার হারানো মাকে-পুর্ণেন্দু পত্রী, একটি গ্রাম্য দৃশ্য- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আমার মায়ের চোখ- রফিক আজাদ, তোমার মা- হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মা- দিলওয়ার, স্বপ্ন- সঞ্জয় ভট্টাচার্য
মা থাকো- দেবারতি মিত্র, তাদের মাতা, জগৎমাতা- জাহিদ হায়দার, মা-র কাছে ফেরা- রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, একটি সবুজ তারা- শিহাব সরকার, উনুন- ত্রিদিব দস্তিদার, জীবন দেবতা- স্বপন বন্দোপাধ্যায়, মা- জাহাঙ্গীর ফিরোজ, মাকে নিয়ে- আশিস স্যানাল, জন্মবৃত্তান্ত- দিব্যেন্দু পালিত, মাও যেন কবিতা লেখেন- জয় গোস্বাম, একটি সজল ছায়ামূর্তি- ইকবাল আজিজ, মা- সুজিত সরকার, আলোর ভাসান- সুনীলকুমার নন্দ, মা আমাকে ফিরিয়ে নাও- মাহমুদ শফিক, সোনালী চুলের স্মৃতি- ভাস্কর চক্রবর্তী, মা- পঙ্কজ সাহ, আমার মা-মাকিদ হায়দার, মাকে- আবদুল গনি হাজারী, বাঁচবো কি- আবুল হোসেন, মা- অসীম সাহা, আমার মা- শ্যামলকান্তি দা, মা- সুমিত্রা দত্তচৌধুরী, ঠিক কোনখানে- প্রমোদ বসু, মা আমার- বৃন্দাবন দাস, গল্প লেখার মাকে- নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, এক পৌরাণিক দেবীর গল্প- দেবাঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, মা, তোমাকে- বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য, মা- মল্লিকা সেনগুপ্ত।