পদাবলি : ৩

পদাবলি : ৩



 ঈশ্বর, রাষ্ট্র ও নিম্নবিত্ত শিক্ষিত যুবক
রুদ্র সুশান্ত

উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছেলেটা একটা চাকরীর জন্য যখন
তার টিউশনির টাকায় কেনা চটিজুতা ক্ষয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে-
তখন তার চোখে-মুখের করুণ ঝলসানিতে মায়ারূপধারী সন্ন্যাসী
অহরহ শিক্ষা ব্যবস্থা আর মুখোশধারী রাষ্ট্রের নিকুচি করে।
তার দীর্ঘশ্বাস গিয়ে পড়ে ঈশ্বরের কাঁধে,
ঈশ্বর হাত জোড় করে ক্ষমা চায়।

জীবিকার্জনের তাগিদে যার চুলগুলো রুক্ষ হয়ে গেছে
সেই ছেলেটারও চাঁদতুল্য প্রেমিকা আছে।
প্রেমিকাকে নৃতাত্ত্বিক চুমো দিয়ে সে বলেছে- এই বসন্তে তোমায় বাসন্তী শাড়ি দিবো,
কাজল দিবো, ফুল দিবো।
প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়াবো- টিএসসি শাহবাগের শিরায় শিরায়।
বসন্ত তার আগমনধ্বনি বাজিয়ে দিয়েছে দিগি¦দিক।
রাষ্ট্রের নির্লজ্জ চশমা মধ্যরাতে দামামা বাজিয়ে চাকরীর কোটা পূর্ণ করে।

সার্টিফিকেটের বয়স বাড়ে, ঋতুর আবর্তনচক্রে নদীর জল শুকিয়ে যায়,
আমের মুকুল আসে, চিত্রা হরিণটা বাচ্চা দেয়,
গৃহস্থের লাঙ্গলের ফাল ক্ষয়ে যায়,
হরিদা দোকান ছেড়ে ডিলার হয়ে যায়,
পাশের কাকা মস্ত পাকাঘর করে ফেলে,
তেঁতুল পেকে গাছ থেকে ঝরে যায়,
প্রেমিকার অপেক্ষা থেকে অগ্নি ঝরে,
বাবার পুরাতন চশমাটাও নষ্ট হয়ে যায়,
গত দু’বছর ধরে বাবার চেয়ারটা ভাঙ্গা,
ছেলের চাকরী হলে একটা নতুন শাড়ি পাবে-
এ আশায় মায়ের কাপড়ে ঊনিশটা গিঁট্টো,
ছোট্ট বোনটি আশায় থাকে তার দাদা এত্তোগুলো চকলেট, নতুন জামা আনবে।

কিন্তু এ রাষ্ট্র নিষ্ঠুর চৌকিদার দিয়ে মুহূর্তে মুহূর্তে
ছিঁড়ে খাচ্ছে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সৌখিন যুবকটাকে।
একটা চাকরী, ঐ একটা চকরী ফেলে জীবনটা কতোই না রঙ্গিন হতো !
কিন্তু নির্লিপ্ত রাষ্ট্র ভালোবাসার নামে কারো মুখে হাসি আনতে পারেনি,
মাকড়শার জালের মতো মুখোশধারীরা ধুয়াশা অন্তর্বাস পড়ে আছে হৃদপিন্ডে, প্রতিটা শিরা-উপশিরায়,
এমনকি সেন্সরের নিউরন গুলোতেও।

যুবকের নাকের ডগার ঘাম গিয়ে পড়ে যমুনার কোলে,
তার ওষ্ঠ থেকে নির্গত শব্দাবলী বায়ুম-লীয় স্থরে মিশে গিয়ে ঈশ্বরের কর্ণে আঘাত হানে।
ঈশ্বর নিরুপায় হয়ে করুণা ভিক্ষা করে, তান্ত্রিক সমাজপতিদের কাছে।

এতো কিছুর পরে নির্মল যুবকটা একটা চাকরী পায়, যোগ্যতার চেয়ে যৎসামান্য।
ফিরে এসে দেখে প্রেমিকা গর্ভবতী।
তখন সে রাষ্ট্রের মুখে থুথু ঝেড়ে আবার দায়িত্বগামী হয়।



অসুন্দরের প্রতিচ্ছায়া
মোহাম্মদ অংকন

বিকশিত পৃথিবীটা ক্রমশ অসুন্দরে ভরে উঠছে;
সুভাসিত স্থানগুলোকে আকড়ে ধরছে ময়লা, জীর্ণতা।
বৈশাখেও বৃষ্টির জল তার রং হারিয়ে নামছে-
যে জল সবচেয়ে বিশুদ্ধ ছিল; তা এখন এসিডে আচ্ছন্ন।

বাজারের লকলকে সবজিগুলো ক্রেতাকে ঠিকই আকৃষ্ট করছে;
বিপরীতে ফরমালিন তার সুযোগটা বুঝে নিচ্ছে ঠিকই।
মানুষকে হত্যা করতে আর বিষ লাগছেনা-
অসুন্দরের গন্ধেই নাকেরশ^াস বন্ধ হয়ে আসছে।

নিরাপত্তা বোধটা ঠিক কি? মানুষ তা বুঝছে না আজ।
ঘুমোতে যেতে ভয়; যদি জাগতে না পাওে সকালে!
গাড়িতে একটু স্থির করে বসা হয়ে ওঠছে না;
যদি চালক গড়িয়ে দেয় পুকুর-ডোবা কিংবা কারও বুকে।

চোখের সামনে অনেককেই দেখছে রক্ত জল ঝরাতে;
তবুও দৌঁড়ে গিয়ে প্রতিবাদ করতে পারছেনা কেউ-
এই ভেবে,অসুন্দরের প্রতিচ্ছায়া যদি তাকেও  গ্রাস করে!
তাই তো সবাই অসুন্দরের আলিঙ্গনে রয়েছে একরকম।


এক মুঠো রোদ্দুর চাই
জমাদ্দার কাব্য

এক মুঠো রোদ্দুর চাই; পড়ে আছি আঁধারে।
অসৎ ভাবনা আমায় বেঁধে রেখেছে
নষ্টের মাঝারে।
দক্ষিণ থেকে উত্তর সাগর থেকে পাহাড়
সবাই শুধু ব্যস্ত থাকে ভেদাভেদ নেই আলো আঁধার।
অসম প্রতিযোগিতায় মানুষের আবাস
আলোর বিশালতা থেকে কালোর গহ্বরে
পুণ্য তাড়িয়ে দিনে দিনে যাচ্ছে পাপে ভরে
ফেরা হয় না পেয়েও পূর্বাভাস।
আকাশে সূর্য নেই, নেই চাঁদ
আছে শুধু পাতা কালো ফাঁদ।
দুর্নীতি, অন্যায় এটাই এখন ন্যায়
দিন দিন করে ভালোকে ক্ষয়।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতেই আঁধারে গেছে ঢেকে।
গলার মালা গলায় ফাঁস হয়ে রয়েছে গেঁথে।
নিজের লাভে, সীমাহীন লোভে যাচ্ছি চলে
ভয়ঙ্কর এক চোরাবালি তলে।
আঁধার থেকে মুক্ত হতে
এক মুঠো রোদ্দুর চাই;
যে রোদ্দুর পৃথিবীর সকল অশুভকে তাড়াতে হবে ধাই।



গোধূলি মধুচন্দ্রিমা
হোসনা মুরাদ

কোনো এক বিকেলে ভ্রমণের উদ্যেশে আমি
বেরিয়ে পড়লাম অপার্থিব ইশারায় ।
দক্ষিণমুখী বাসের মাঝের সারির
ডানদিকের সিটে জানালা ঘেঁষে বসলাম ।

বাসটা যাচ্ছে সাই সাই করে বাতাস কাটিয়ে
মুগ্ধ আমি সাদানীল আকাশ দেখছিলাম ।
বিকালটা আকাশে হেলান দিতেই
লাল কমলা সোনালী রংগুলো এসে
জড়িয়ে ধরলো আকাশকে ।

রঙের আভা আমার গায়ে এসে পড়তে
আমিও চনমন উচ্ছসিত হয়ে উঠলাম ।
ভালোলাগা ভালোবাসার বেহায়াপনায়
হারিয়ে যেতে লাগলাম...
একবার উড়ছি, তলিয়ে যাচ্ছি আবার উড়ছি ।
বেপরোয়া ঘুরে বেড়াচ্ছি মহাকাশ থেকে মহাকাল ।
মোহ থেকে মোহগ্রস্ত হয়ে
নিজেকে সমর্পন করতে শুরু করলাম ।
ভোগ ও উপভোগের নেশায় মত্ত আমি
অপূর্ব এই গোধূলি মধুচন্দ্রিমায় !!!

একি !!!
আমি এখানে আস্তাকুড়ে পড়ে আছি কেন?
আমাকে খুঁজে পাচ্ছিনা কেন ?
সম্ভিত ফিরে পেয়ে দেখি
আমি আর আমি নেই
গতরহীন, চিত্তহীন, মস্তিষ্কহীন
কোমল শিরদাঁড়া নিয়ে
ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি
কিন্তু পারছিনা....

পার্থিব রঙের মাঝে আমাদের এই অপার্থিব
হারিয়ে যাওয়া,
অনতিক্রম্য পথ পার করেও প্রকৃত গন্তব্য
যেমন পাইনা
ফিরেও যেতে পারিনা ফেলে আসা উৎসমূলে ।
আমি-আমরা-তুই।

ঝলসানো পেখমের প্রাচুর্য
মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম

ভাঙা ঘুঙুরের কান্না নয়!
ক্ষত চেপে, নিয়ে এসেছি নৈশ ডাকঘরে-
                                     ফেলে রাখা সমুদ্রের সৎকার;

আনন্দগভীর খুঁড়ে, তরঙ্গের আগে, এনেছি
অজ্ঞাত কারও রিমিঝিমি, রাত্রি ছেঁকে মনোহর বিষ।

টুপটাপ ঝরে পড়বো যে কোনও সময়,
নিমিষে ভস্মীভূত যে কারও আঙুলের ভেতর?

সর্বনামের পাশে বসতে দাও বা না দাও,
একটু শুধু হাত বুলিয়ে দিয়ো যাবতীয় নুনে;

শুধু রক্তচক্ষু করে বাজতে এসেছি!
আঁকতে এসেছি উড়ন্ত বাদুড়ের ঝাঁক আর
              ঘন খুদকুঁড়োর পাশে কারও মায়াবী প্রস্থান।

পক্ষপাতসমূহ থাক, কাঠের কোকিল, পিতলের হাঁস
জেনে গেছে, কেন জেগে আছি কর্পূরের অনুকরণে;

ছায়া ভান করে ঘিরে আছি রক্তেমাখা বিদ্রুপ।
মোরগঝুঁটির ভেতরে ফেলে এসেছি ছুটির সংকেত?

ছেঁড়া তবলার খোলে জমিয়ে রেখো শিরীষের গোঙানি।
ঝলসানো পেখমের প্রাচুর্য ঢেলে দিয়ো জামবাটিতে;

শুধু স্বর-শোকে ডুবে থাকতে এসেছি,
আর কম্পাসে বিশ্বাস নেই তাই কংক্রিট ফুটো করে-
                         দেখতে এসেছি বিষাদের আড় চোখ।

আঁধারেই আমাদের সুখ
যাহিদ সুবহান

যেন এক দুঃসময়ের দিনযাপন
দারুণ অসময়ের দিনলিপি আমাদের
অচেনা আতঙ্কের জড়তায় আমরা কাপছি
অচেনা ডানায় ভর করে চলছে আমার স্বদেশ
এখানে আজ কত মুখ অথচ কোন কথা নেই
চারিদিকে বন তবু যেন কোন বৃক্ষ নেই
আমরা প্রতিদিন কাকের ডাক শুনতে শুনতে
কোকিলের সুরেলা গান ভুলতে বসেছি আজ
এখানে আমরা ভুতের গল্প শুনে ভয় পাই
অথচ হায়েনার সাথে বাস করি প্রতিনিয়ত
আমরা পায়রাকে খাঁচায় রেখেই শান্তি পাই
শকুন আমাদের এই আকাশের শোভা
অন্ধকার বড় অন্ধকারে হাঁটছি আমরা
আলো আমাদের থেকে দূরে দূরে হাঁটছে
আমরা যেন অন্ধকারেই ভালো আছি
যেন আঁধারেই আমাদের সব সুখ ...


সভ্য সে গাঁয়ে আয়
সাঈদ সাহেদুল ইসলাম

মানুষ নির্ভর শহরের বুকে ধূলি
মানুষ নির্ভর সড়কের বুকে চিৎকার
কাতর হয়েছে দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চুপে ল্যাম্পপোস্ট
বন্ধ হয়েছে ডিভাইডারের সবুজ নাসিকা ছিদ্র
গন্ধ লাগে না নাকে

গন্ধ বাতাস নষ্ট করেছে নাগরিক নাড়িভুড়ি
গাড়ির ধোঁয়াও পচন এনেছে বৃক্ষের ফুসফুসে

আমরা কেবল মানুষ দাবিতে বেঁচে আছি দিনমান
গরু-ছাগলের গোহালে যখন দেখছি না ধুলি গাঁয়
আমরা শহুরে ভূতের মতন চলেছি নির্দ্বিধায়
মাটির সোঁদা গন্ধ গাঁয়ের যায়নি হারিয়ে আজও
সভ্য সে গাঁয়ে আয়।


প্রশান্ত পাখি
বিটুল দেব

একাকিত্ব প্রশান্ত পাখিটি উড়তে উড়তে খোঁজে সবুজ সঙ্গিনী। সুখ দুঃখের করতে বয়ান। অবলীলায় মিলেছে যুগল মন মন্দির। হাল ছাড়া স্বপ্নের, আবার হাত ধরে গন্তব্য বিজয়ের আশায়। সফলতা বয়ে আনবে, যদি হামাগুড়ি দেয়া মাটির কথা মনে রাখে আর শীতার্ত রাতে মা পাখির ওম। সুনীল আকাশে জোড়া ডানা মেলে উড়ার কৌশল ভুলে গেলে, আজ না হয় কাল কাঁদবে গোপনে।

নদী বিষয়ক কবিতা
সবুজ আহমেদ কক্স

নদীর নাম শুনলেই সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করে
কিন্তু সাঁতার কাটা হয়নি এখনো
বাস্তবে কিংবা স্বপ্নে...

স্বপ্নে সাঁতার কাটতে চাইলেও একটিবার নদীর কাছাকাছি যাওয়া চাই।
                         যেতে হয়...
ডুব স্বপ্ন দেখতে চাইলে নামা চাই হাঁটুজল।
                                   নামতেই হয়..

যদি প্রসঙ্গ স্বপ্ন হয়, ভার্চুয়ালনৈকট্যে ঠিকটাক মিলছে না আঙুলের ক্লিক।

হলো না, হলো না
তোমাকে শিরোনাম করে, হলো না একটিও নদীকবিতা।

অথচ আমার স্বপ্নের নদীতে ঢেউ বিকট আওয়াজ করে,
বারংবার সাতারু দল চেচামেচি করে উঠে

হঠাৎ মাঝরাতে ঘুমভাঙ্গে...


সাত্ত্বিক সুখ
শফিকুল ইসলাম শফিক

আজ ফকির-আমিরের অন্দরমহলে
সাদা-কালো রাতের মহাসমাবেশ।
সারেজাহানে একটাই চাঁদের হাট
মোলায়েম উল্লাস ঝরে পড়ে অহর্নিশ।
পাপিষ্ঠ এই তপ্ত মরুভূমির ধূলিকণায়
ঝড়ের মতো অপ্রত্যাশিত ছিল বৃষ্টির আনাগোনা।

আজ অহমিকা বরফ গলা নদী
ঝরনার মতো হাসি তার বুকে ঢেউ তোলে।
ক্রোধেরা রাতের শিশির বিন্দু
আলমকুলে স্নিগ্ধ প্রভাতের আলোয় হাস্যোজ্জ্বল।
হিংসুটে মন আর খেলে না খুনসুঁটি
লোভাতুর অন্তরালে খুঁজে পাই সাত্ত্বিক সুখ।

বিভেদের দিগন্ত জোড়া দেয়াল    
প্রেমের তোড়ে ভেঙ্গে পড়ে অনায়াসে।
আমির মুঠি মুঠি সাধ-আহ্লাদ
বিলিয়ে দেয় পরম তৃপ্তির আঙিনায়।
উত্তর-দক্ষিণের এক মেরুতে অবস্থান,
ফকির-আমিরের মিঠেকড়া প্রেম ছুটে চলে দিগি¦দিক।


শুধু তুমিই কিছু চাওনা
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন

ঈদ এলে সবারই কিছু কিছু বায়না থাকে
সাপ্তাহিক কালেকশন শেষে
বকশিস নিতে ঘোরে মহল্লার  হিজড়েগুলো।
বাজারের ঝাড়ুদার তোক্কেলও বলে
এবার যেন দুশো টাকা বাড়িয়ে দেই।
পাহারাদার সবদুলের মুখ কালো হয়ে যায় একশ দিলে।
লোকাল বাসের কন্ট্রাক্টর
আজকাল সিটিং সার্ভিস হয়ে যায়।
রিক্সায় চড়লে ধমকি দিয়ে
নিয়ে নেয় ঈদ সেলামি, যতবার চড়ি ততবার সেলামি গুনতে হয় আমার।
সেদিন লোকাল কাগজের
রিপোর্টার এসেছিল।
ঈদ এলে
মুদি দোকানির ভোল পাল্টে যায় প্রত্যেকটা  বছর।
মহল্লার যুবকগুলির কি যেন পিকনিক হয়, সেখানেও চাহিদা
পাঠায় দল বেঁধে।
মাদরাসার খাদেম আসে
তিনিতো ওই এগার মাসও এসে থাকেন।

পুরোনো জুতোটায় কালি দিতে বা
চুল-দাড়ীতে ক্ষৌরকর্মে বকশিশ লাগে।
শুধু তোমার লাগেনা কোন কিছু! কোন একটি ঈদেও।

তুমি কোনদিন বায়না করনা।
এক মাত্র বায়না তোমার আমিতিই ফিরব কবে।

আর আমি পাঁজরের দক্ষিণাঞ্চল খুঁড়ে খুঁড়ে দেখি
সেখানে শুধু অস্থিরতা।
সেখানে শুধু হাহাকার
তোমাকে কিছু দিতে না পারার বেদনা।


ঝুল-কালির শূন্য ঘর
ফখরুল হাসান

ধুলোপড়া শূন্য ঘরে ঝুল-কালি পরে আছে দীর্ঘদিন যাবৎ।
চাদর , বালিশের মোড়কগুলোতে শ্যাওলা জমে স্যাঁতসেঁতে।
অযন্তে অবহেলায় এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকে স্মৃতিকথা!
দিন তারিখ ভুলে এভাবেই বেঁচে থাকে ব্যর্থ পঞ্জিকা। 


বাবার ছবি
আশিক বিন রহিম

আমাদের ঘরে- দেয়ালে বাবার কোনো ছবি নেই। ওনার মৃত্যুদিনে আমাদের ছোট যে বোনটি মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে কেঁদেছিলো- এখন তার একুশ পূর্ণ হয়েছে। আজকাল সে ঘড়ির টাইম দেখে নামাজ দাঁড়ায়, না দেখে সুরা-কেরাত পড়ে; অথচ কি আশ্চর্য, কল্পনায় একটি বারও সে বাবার মুখটা আঁকতে পারে না। কারণ, বোনের চোখেও বাবার কোনো ছবি নেই।

আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম- প্রায়ই দাদির কাছে দাদার মুখাকৃতি জানতে চায়। মা তখন বেহায়া চাঁদের মতো চুপচাপ চেয়ে থাকেন; অথচ একটা সময় তিনি মুখের ভাষা আর হাতের ইশারায় অনায়াসেই বাবার মুখ- চোখ এঁকে দিতেন। ওনার অঙ্গ-ভঙ্গির মাঝে আমরাও খুঁজে পেতাম বাবার ছবি- গায়ের গড়ন। কখনো আবার কথার পিঠে চড়ে বলে উঠতাম ‘হ- মা, বাবার গায়ের রঙ বাদামের খোসা লাহন আছিলো, মুখভর্তি দাড়ি আর কোঁকড়া চুলে বাবারে মনে হইতো রাজা-বাদশাহ্। আম্মা তখন মাটিতে দৃষ্টি পেতে বলতেন ‘অনেক সুন্দর আছিলো মানুষটা, যেমন আচার তেমন তার ব্যবহার’

আজকাল আম্মার ছানি পড়া চোখে বাবার কোনো ছবি আছে কি-না তা আমারা জানি না; তবে আম্মা বেঁচে আছেন বলেই ঘরের দেয়াল কিবং অ্যালবামে আমরা আর বাবার ছবি খুঁজতে যাই না।


গল্প : নাফু

গল্প : নাফু






নাফু
নূরে জান্নাত

বর্ষার শেষ,শরতের শুরু। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়ায়। নদীর কুলের কাঁশবনে ফুল গুলো বিকেলের বাতাসে নেচে নেচে ওঠে। নদীতে পালতোলা নৌকা গুলো পূর্ণতা দিয়ে যায় নদীকে। নৌকোতে সবচেয়ে চুপচাপ শান্ত দুটি চোখ মেঘেদের ভেসে যাওয়া, নদীর ঢেউ, পাড়ের কাঁশফুল দেখে চলছে। মাঝে মাঝে চেষ্টা করছে নদীর ¯্রােতস্বীনী চকচকে জলে হাত ভেজাতে; কিন্তু পারছে না। এই মুহূর্তে নৌকো থেকে নীরব ও শান্ত চোখের দশ বছরের যে শিশুটিকে নামানো হলো ওর নাম নাফু। আর সঙ্গে টিপু ও অন্য দুজন নাফুর ভাই ও বোন। কোলে বাচ্চা নিয়ে মুখে আঁচল চেপে যে মহিলা হাঁটছে উনি নাফুর মা। কাঁধে ভার ভর্তি সবজি নিয়ে উশকোখুশখো চুল, ময়লা পাঞ্জাবি, ছেড়ার উপক্রমিত চোটি পায়ে যিনি হাঁটছেন তিনি নাফুর বাবা। নাফুর বাবা একজন সবজি বিক্রেতা। নাফুরা আজ নানীর বাড়ি থেকে ফিরছে। ওই এলাকায় সবজির দাম কম হওয়ায় ভার বোঝায় করে সবজি কিনে এনেছে নাফুর বাবা। শহরে ভালো দাম পাওয়া যাবে! নাফুর বাবা সারাদিন অলিতে গলিতে সবজি বিক্রি করে যে টাকা পায় তা দিয়ে সংসারের জন্য চাল, ডাল, তেল,নূন নিয়ে আসে। তাদের নূন পান্তায় দিন কাঁটে কোন রকমে। কয়েক সপ্তাহ হলো টিপু ফার্ণিচারের দোকানে কাজ করে যে পয়সা পায় তা দিয়ে মাঝে মাঝে মাছ,ডিম নিয়ে আসে। নাফু ডিম খুব পছন্দ করে। হয়তো সে কারণে আজ ওর প্লেটে অবশিষ্ট কোন খাবার নেই! দুপুর বেলা সবজির ভাড় কাঁধে চৌরাস্তার মোড় থেকে সোনালী ব্যাংক পার করে নাফুর বাবা এগিয়ে চলছে। হঠাৎ একটা স্কুলের সামনে গিয়ে থেমে যান! সেখানে তার নাফুর মত কত মেয়ে হাসছে,খেলছে,পড়ছে! তার নাফুকে যদি এরকম স্কুলে ভর্তি করাতে পারতো!! নাফু ওর তিন ভাই বোন থেকে আলাদা। সবাই যে ভাবে বাবা মায়ের কাছে আবদার করে নাফু তার কানি কোনাও আবদার করে না। নাফু চুলার পাড়ের কামরাঙ্গা গাছটা খুব পছন্দ করে। ওর সময় গুলো কামরাঙ্গা তলায় বেশির ভাগ কাঁটে। নাফুর প্রতি ওর পরিবার খুব একটা যতœশীল না হলেও কিছুদিন হলো নাফুর বাবা নাফুকে নিয়ে ভাবছেন। আকাশে আজ চকচকে চাঁদ উঠেছে। আঁখের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো নাফুর মুখে এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে চাঁদের আলো নাফুর মুখে এসে পড়েছে। আস্তে আস্তে চাঁদের আলো থেকে নেমে আসা আলোর পাখা যুক্ত পরি নাফুকে ধবধবে সাদা ফ্রক পড়িয়ে দেয়। রুপলি রঙের আলোক উজ্জ্বল ফুলের মধ্যে বসিয়ে পরি গুলো নাফুকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। নাফু পরি গুলোর আড়াল থেকে ওর বাবার সাথে লুকোচুরি খেলে। এক সময় আকাশ মেঘে ভরে যায়, নাফুকে দেখতে পায়না ওর বাবা কিন্তু “বাবা” বলে নাফুর ডাক ঠিকি শুনতে পান। ঘুম ভেঙ্গে নাফুর বাবার বুক ধরফরিয়ে ওঠে। মেঝের অন্য প্রান্তে তাঁকিয়ে দেখেন সত্যিই আখের পাতার ফাঁক দিয়ে নাফুর মুখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। প্রতিদিনের মত নাফুর বাবা সকালে সকাল সবজির ভাড় নিয়ে বেড়িয়ে যায়। নাফুর মা চুলার ছাঁই ফেলে উঠোন ঝাঁড়– দিচ্ছেন। হঠাৎ ছোট্ট উঠোনের ডগায় একজন ভদ্র মহিলা আর দুজন ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান। নাফুর মা উঠোনের এক কোণে মাদুর পেঁতে দেন তাদের বসার জন্য। নাফুর ভালো থাকার কথা চিন্তা করেই নাফুর মা তাদের কাছে নাফুকে দিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সেদিনের পর থেকে নাফু অনেক ভালো খাবার পাওয়া সত্বেও ঠিকমত খায় না। বার বার জানালার গ্রীল ধরে বাইরে আকাশ দেখবার চেষ্টা করে। নাফুকে খাবার জন্য জোর করা হলে নীরবে দুচোখ উপচে ওঠে। চোখের সামনে তার বাবা মা, ভাই বোনদের মুখ ভেঁসে ওঠে! ভেঁসে ওঠে নদী পাড়ের কাঁশফুল, খোলা আকাশ আর কামরাাঙ্গা গাছটি। নাফুকে অনেক গুলো নতুন জামা এনে দেওয়া সত্বেও কোন জামা ও ছুঁয়ে দেখে না। কেবল তার বাবার কিনে দেওয়া সবুজ রঙের ফ্রকটি ছাড়া। এক দুপুরে জোর করে নাফুর গাঁ থেকে খুলে নেওয়া হয় নোংরা সবুজ ফ্রকটি। নাফুকে বার বার বোঝানো হয় ফ্রকটি ধুয়ে আবার ওকে দেওয়া হবে; কিন্তু নাফু বোঝে না! শহর থেকে যারা নাফুকে নিতে গিয়েছিলেন তারা নাফুদের পরিবারকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। যা দিয়ে নাফুুদের বাড়িতে টিনের প্রশ্বস্ত ঘর তুলেছে। সবজির বাজার চড়া হওয়ায় পয়সাও বেশ আসছে। সবাই ভালো থাকা সত্বেও নাফুর মাকে মুখে আঁচল চেপে মাঝরাতে আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদতে দেখা যায়। তার উচ্চারিত অন্য শব্দগুলো না বোঝাও গেলেও “ও নাফুরে”... কিছুটা স্পষ্ট হয়। প্রতিদিন সবজি বিক্রি শেষে নাফুর বাবা বাড়ি ফিরে চুলার পাড়ের কামরাঙ্গা গাছটির দিকে তাঁকিয়ে শূন্যস্থান দেখে হার জিরজিরে পাজর কেঁপে ওঠে। যাদের কাছে নাফুকে দিয়েছিল তাদের ঠিকানাটা নতুন ঘর তোলার সময় কোথায় রেখেছে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় চলে যায়। ঈদ চলে আসে। এবার সত্যি সত্যি নাফুর কাছ থেকে কেঁড়ে নেওয়া হয় তার বাবার কিনে দেওয়া ছিড়ে যাওয়া সবুজ ফ্রকটি। নাফুকে পড়িয়ে দেওয়া হয় নতুন একটি ফ্রক। নাফু নীরবে সড়িয়ে ফেলা সবুজ ফ্রকের দিকে তাঁকিয়ে চোখের জলে বুক ভাঁসায়। ঈদের আগের দিন নাফুর বাবা শহর থেকে অনেক রাতে বাড়ি ফেরেন। সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চিনি সেমাই রেখে নতুন জামা তুলে দেয় সবার হাতে।


নাফুর মা ঘুমের ভানে চোখের জলে বালিশ ভেঁজায়। নাফুর বাবার চোখে ঘুম নেই। কামরাঙ্গা গাছটির নিচে নাফু যেখানে বসে থাকতো সেখানকার মাটি নিয়ে হার জিরজিরে বুকের সাথে মালিশ করে আর ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। আজ রাতে মনে হয় আকাশেরও মন খারাপ। তাইতো মেঘ করেছে আকাশের গাঁয়ে। বিদ্যুৎ চমকানোর  সাথে ঝড়ো হাওয়া। কাঁথাটা ভালো করে টেনে ঘুমোনোর চেষ্টা করে নাফুর বাবা। হঠাৎ দরজায় প্রচন্ড শব্দ হতে থাকে। বাতাসে হয়তো! কিন্তু না, বজ্রপরার শব্দের সাথে দরজার শব্দটা স্পষ্ট হতে থাকে। তবে কি গ্রামের রসু গুন্ডা শুনতে পেয়েছে গতকাল পাঁচ হাজার টাকার সবজি বিক্রির কথা!! নাফুর বাবা একটা লাঠি হাতে নিয়ে দরজা খুলে আঘাত করার জন্য লাঠি ঝুকলেই কে যেন তাঁর পায়ের উপর পড়ে পা জড়িয়ে ধরে। টর্চ জ্বালিয়ে পা জড়িয়ে ধরা মুখটা দেখে খুশিতে কাঁপতে থাকেন। একটানে নাফুকে বুকে তুলে নেন। নাফুর চোখে মুখে কত চুমু আঁকেন! নাফুর বাবার চিৎকার চেচামিচিতে সবাই জেগে যায়। নাফুর মা “ ও নাফুরে......” বলে বুকে জড়িয়ে নেন নাফুকে। নাফু নির্বাক শুধু চোখের জল ফেলে যায়। মা আর বাবার মাঝখানে শুয়ে আছে নাফু। নাফুর বাবা খুশিতে ঘুমোতে পারছেন না। এনজিও এর  লোকজন নাফুর ভালোর জন্যই নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু যে ভালো অনেক গুলো হৃদয় পোড়ায় সে ভালো না হওয়ায় ভালো ভাবতে থাকেন নাফুর বাবা। তার মেয়ে পালিয়ে এসে ঠিক কাজ করেছে। এবার নিতে এলে প্রথমে না করবে, না মানলে হাতে বটি তুলবে। নাফুর মাথায় হাত বুলতে বুলতে আরো ভাবেন ঈদ পর প্রতিবন্ধি যে স্কুলটা দেখেছিল শহরে ওখানে নাফুকে ভর্তি করে দেবে। কাল ঈদের নামাজ পড়েই নাফুর জন্য সবুজ রঙের নতুন জামা কিনে আনবে। এক সাথে সেমাই খাবে, ভালো ডাক্তার দেখাবে যাতে নাফু কানে শুনতে পায়, কথা বলতে পারে এবং স্বাভাবিক অনুভূতি ফিরে পায়। “আচ্ছালাতু খায়রুম মিনান নাউম”... ফজরের আযানের ধ্বনিতে সকাল হয়। পূব আকাশে লাল সূর্যটা উঁকি দেয়। পাশের বাড়ির ছেলে মেয়ে গুলো নাফুকে ঈদ মোবারক জানায়। টিপু চুলার পার থেকে মায়ের রান্না করা সেমাই নাফুকে খাইয়ে দেয়, নাফুর মুখ দিয়ে গড়িয়ে পরা লালাও অনেক বার মুছে দেয়। ঈদের নামাজ শেষে নাফুর বাবা সবুজ রঙের ফ্রক কিনে হাসি মুখে বাড়ি ফিরছিলেন। বাড়ি ভর্তি লোকজন দেখে হকচকিয়ে যান!!! উঠোনে কাপড়ে ঢেকে রাখা ছোট্ট শরীর দেখে স্থিমিত নাফুর বাবা! নদীতে সবার সাথে গোসল করতে গিয়ে শেষ গোসল দেবে নাফু কে জানতো! নাফু তার বাবার কিনে আনা নতুন জামা না পড়লেও নাফু ঠিকই পড়েছে ধবধবে নতুন জামা। নতুন জামায় মোড়ানো নাফুকে নিয়ে খাঁটিয়া কাঁধে এগিয়ে চলে নাফুর বাবা!!!




গল্প : দ্বি-খন্ডিত

গল্প :  দ্বি-খন্ডিত



 দ্বি-খন্ডিত
  তন্ময় আলমগীর

জাহানারা নিজের পার্সেল থেকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে আরিশা এবং তাশফিয়াকে দিতে দিতে বললেন- আংকেলের টাকা আংকেলকে ফেরত দাও। মাহমুদ সাহেব এতে কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলেন। লজ্জাও পেলেন খানিকটা। কোথাও কোন ধাক্কা লাগল? তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে গুতোটা যে গাঢ়, চোকা টের পাচ্ছেন। বললেন- কষ্ট পেলাম কিন্তু। জাহানারা বললেন- আর সব শিক্ষার সাথে সন্তানদেরকে আত্মসম্মানবোধটাও শেখাতে চাই। কিছু মনে করো না।
  আরিশা এবং তাশফিয়া নাচের তালিম নিতে চলে গেলে বাসাতে জাহানারা ও মাহমুদ ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ঠ থাকল না। বাইরের দুপুর ক্রমে এগুচ্ছে বিকেলের দিকে। খুব ধীর লয়ে। বর্ষার তেজহীন রোদে কোন প্রাণ নেই। এরচে পাতা ঝরার শব্দ বেশ কোমল। স্পর্শের মত খেলে যায় হৃদয়ের অতলে। দোলা দেয় ঢেউয়ের মত। রোদ পড়ে যাওয়াতে ছায়াছন্ন পরিবেশে এক ধরনের নৈঃশব্দ এসে জড়ো হয়েছে। রেলিংয়ে চুপিচুপ খুনসুটি করছে কয়েকটি চড়–ই। জানালার শার্সিতে ফোটা হাসনাহেনা ফুলের রাতের মাতাল গন্ধের ঝাঁঝ এখনো বাতাসে দৃশ্যমান। পর্দার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে ফ্লাইওভারের বুকে গাড়ির নিরব তোলপার। চোখে চিকচিক করছে শুভ্র আকাশের হাস্যরস।
  জাহানারা জানে, শুধু তার না, মেয়ে দুটো আশফাকেরও। দেখতে তার মত হলেও ওদের শরীরে বইছে আশফাকের রক্ত। তবে অতটুকুই। আর কোন প্রভাব, চিহ্নের ছিটেফোটাও নেই। থাকতে পারত। থাকার সুযোগ দেয়নি জাহানারা। জমজ সন্তান দুটো যখন কোলে, সেই তখন থেকে আশফাককে টাকার নেশায় পেয়ে বসে। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা, ব্যবসা দিয়ে প্রতিষ্ঠান। তারপর আজকের এই প্রতিষ্ঠিত আশফাক।
  টাকা দিয়ে এমন কোন হীন কাজ নেই যা সে করেনি। মদের নেশা, নারীর নেশা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ক্ষমতার নেশা। যে হাত দুটো ধরলে আবেগে বিগলিত হত জাহানারা, টাকা সে হাত দুটোকে পাপাস্ত্র বানিয়ে দিয়েছে। আরিশা, তাশফিয়ার কথা ভাবতে গেলে তবুও যেন কিসের এক পরাজয় অনুভ’ত হয় আশফাকের কাছে। রাগ-অনুরাগের দরোজা ভেঙ্গে হুরমুর করে ঢুকে পড়ে দক্ষিণা বাতাস। লকলকে লতাগুল্মের গায়ে খেলে যায় শীতল পরশ। তখন কী মনে হয় জাহানারার? মাহমুদ সাহেব জানতে চান। জানতে গিয়ে অবাক না হয়ে পারেন না। তিনি ভেবেছিলেন নিশ্চয় কষ্ট-টষ্ট হয়।
-ঠিক তা নয়। আনন্দ আনন্দ লাগে।
-আনন্দ! খানিকটা মিইয়ে পড়ে মাহমুদ সাহেবের গলা।
-হুম, আনন্দ। কিছুটা বেমানান লাগছে তাই না?
-কিছুটা না, পুরোটাই। দৈতসত্ত্বার শক্তিটা আসে কোথায় থেকে আমি জানি না।
-আমি জানি। আমাদের মত মানষদের মনে শুধু প্রেম বা শুধু ঘৃণা থাকে না। প্রেম আর ঘৃণা মিলে প্রেম অথবা প্রেম আর ঘৃণা মিলে ঘৃণা। যাকে বলে মাল্টি-ইমোশন। ফালুদা খেয়েছো তো? প্রতি চামচে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। সব স্বাদের কথা মনে থাকে না। তবে সব স্বাদের শেষে যেটা জিভে লেগে থাকে সেটাই আসল।


-তার মানে আশফাককে তুমি পুরোপুরি ভালও বাস না আবার ঘৃণাও করো না।
-কিছুটা এমনই। তবে তোমার ব্যাপারটা আলাদা।
  দুজনই শোয়ার ঘরে ঢুকল। হাতে দুঘন্টার মত সময় আছে। সন্ধায় আরিশা, তাশফিয়া ফিরলে ওদেরকে নিয়ে বাইরে বেরুতে হবে। বেনারশি পল্লিতে বসেছে তাঁতের মেলা। কিছু তাঁতের জামাকাপড় কেনা দরকার। জাহানারা চান, তার মেয়েরা মনেপ্রাণে এমনকি শরীরেও বাঙালি হোক। অন্তত তার মত যেন না হয়। এ উত্তাপ বড় ভয়ঙ্কর।
  জাহানারা কড়া করে দুটো কফি বানিয়ে এনে বারান্দার চেয়ারে এসে বসলেন, মুখোমুখি। খানিকটা হালকা লাগছে জাহানারার। কফিটা খেলে আরো ঝরঝরে হয়ে যাবেন। মাহমুদ সাহেব এসেছে বলে নয়, এই মুহুর্তে নিজেকে ভুলে থাকা ভীষণ প্রয়োজন তার। আশফাক যখন গভীর রাতে ঘনিষ্ট হত, তখন একপেশে জীবনটাকে এক নিমিষেই উড়িয়ে নিত পল্লবিত গাছটার লকলকে মগডালে। চারপাশের দিগন্তবিস্তৃত শুভ্র আলো পেলব ছোঁয়ার মত ঘিরে থাকত দেহপ্রাণ। কিন্তু এমন আশফাকের দেখা মিলত কদাচিত, সাগর সেঁচে মুক্তো আনার মত। সেই অতৃপ্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে সহজেই জায়গা করে নিল মাহমুদ সাহেব। অবিবাহিত। কাঁচা আবেগ আর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে পরাভ’ত হল জাহানারা। প্রথমে পার্ক, শপিংমল, চুমু। ক্রমান্নতির ধারাবাহিকতায় এখন তা বিছানা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
  জাহানারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে আরো খানিকটা সময় নিলেন। শরীর ক্লান্ত হলেও সরিষার দানার মত যতটুকু মন জুড়ে আছে আশফাক তা এখনো সচল। বিবেকটাও যাবতীয় কুসংস্কার নিয়ে পাহাদারের মত হাঁক ডাকছে। ডেবডেবে চোখে এখনো জেগে আছে পোড় খাওয়া অন্তঃপ্রাণ। জ্বও জ্বর লাগছে জাহানারার? নিজেই দেখল কপাল ছুঁইয়ে। এ সময় শরীর গরম হওয়া দারুন সুখের। কামজ্বরে আক্রান্ত না হলে প্রেমের খেলা জমে না।
  অতটা উচ্চমার্গীয় অভিরুচির বা বিলাসি ছিলেন না জাহানারা। আশফাক শিখিয়েছে। সোসাইটিতে তাল মেলাতে হলে আত্মঅহং (অন্য অর্থে অন্যের কাছে সস্তা হওয়া) বেশ শক্ত হাতিয়ার। এটাকে বহিঃখোলসও বলা যায়। ভেতর পুড়ে খাঁ খাঁ করলেও বাইরের জগতটাকে শোনাতে হয় সমুদ্রগর্জন। জাহানারা সে পথে পা বাড়ায়। কিন্তু টিকেনি। পিছলে পড়া পায়ের চিকিৎসা দাবি করলে আশফাক পথ্য দেয় আরো ভাঙতে ভাঙতে তারপর শক্ত হওয়ার। ততদিনে দুজনের শপথি হাতদুটো অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। পরিচর্য়ার অভাবে ভালবাসার খুঁটিতে ধরেছে ঘুণপোকা। অন্যের গরম ভারা ভাত রেখে আশফাক যেমন ফিরতে চাইত না ঘরে, তেমনি ধীরে ধীরে নিজেকে শানিত করল জাহানারা। মাঝখানে মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আসলেও আশফাকের দেখানো পথে সেও যোগ্যসঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেল মাহমুদ সাহেবকে। মনের দলিল থেকে এমনকি শরীরের মালিকানা থেকেও ছিটকে যেতে লাগলেন আশফাক সাহেব।
  শেষ ধাপে অবস্থান করছেন জাহানারা। আশফাকের পতনের পর বিবেকের কুটুরিতে এখন কেবল টোকর মারছে মেয়েদুটো। বড় হওয়া, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যতের সিঁড়িগুলো উতরে যাবার প্রকৌশল তাদের জানা আছে কিনা সে চিন্তা। কেননা, জাহানারা নিজেই অন্ধ, বধির হয়ে সময়ের ¯্রােতে ঘুরপাক খাচ্ছে। পথভ্রষ্ট হয়ে কোথা থেকে কোথায়া পা ফেলছে জানে না। অন্যের জন্য মসৃন পথের সন্ধান দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। তবে, দু মেয়ে বা আশফাকের জন্য নয়, ফুরফুরে গতরে সুন্দর পৃথিবীর অপরপিঠের রুঢ়, কর্কশরুপ ছাড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিজেকে কিছুটা আড়াল করতে পারছেন, সেটাইবা কম কীসে?



গল্প : ঈদ

গল্প : ঈদ



 ঈদ
আহমদ মেহেদী

 
১. ঈদ এলেই কাপড় পট্টিতে উপচে পড়া ভিড় থাকে। জৈষ্ঠের গরম আর রোযা মিলে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। আমার বন্ধু সোহেলের বাড়িতে কামরাঙ্গা গাছটার নিচে বসে আছি। উদ্দেশ্য দুজনে দাবা খেলব, গাছের নিচে বেশ ছায়া। আর বিকেল হলে বাজারে যাব। পকেটে নানার দেওয়া পাঁচশ টাকার মলিন নোটটা নিয়ে ভাবছি। ঈদ নিয়ে ভাবছি, ঈদ নামক স্বপ্নের  মাঝে কেটেছে আমার গতকাল রাত্রটা। আজকের বাজারে পাঁচশ টাকা দিয়ে কিইবা কেনা যাবে? সোহেল বলল-কিরে এবার ঈদে কিছু কিনবিনা? আমি বললাম-কিনব। আসলে পাঁচশ টাকা দিয়ে আমার ও সোহেল এর জন্য দুটি টি শার্ট কিনব ভেবেছিলাম। সোহেল বলল-আমার দরকার নাই,তুই একটা ভাল চাইয়া কিইন্নালা। সোহেল ওআমার পারিবারিক অবস্থার ততটা পার্থক্য নেই। তার বড় সংসার আর আমি ধনী নানার বাড়িতে থাকি বলে এই টাকাটা জুটেছে। প্রতিটি ঈদ এলেই সোহেল খুব গম্ভীর হয়ে থাকে আর আমায় বলে-কিরে এবার ও কি ঈদে কিছু কিনতে পারবনা? আমি বললাম-দেখ আমার কাছে পাঁচশ টাকা আছে;বিকেলে তুই আর আমি মিলে বাজারে যাব। দেখি দুটা কম দামি টি শার্ট আনতে পারি কীনা। এই বলেই দুজনে দাবা খেলায় মন ভাসালাম।

দাবা খেলছি আর ভাবছি। গত কয়েকটি ঈদে আমরা একে অন্যের সঙ্গী হয়ে ঈদের অজুহাতে আধুুনিক মহড়ায় সামিল হতে পারিনা। খেলায় মন থাকলেও কয়েকটি পাঁচশ টাকার চকচকে নোট চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। বাবাকে ও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আমার প্রাইভেট পড়ার টাকা যোগাতে চাউল বিক্রি করতে হয়েছিল তার উপর মা’র অসুখ। কিছুই ভাবতে পারছি না। মানুষ গরিব হয়ে জন্মায়,এতিম হয়ে জন্মায়। কিন্তু আমার সব আছে। (বাবা-মা, দাদা-দাদী,নানা-নানী)। তাই বলে ঈদের জন্য নিজের পছন্দ মত কাপড়-চোপড় কিনতে পারবনা? এ যে কি কষ্টের তা বলে শেষ করতে পারবনা। এমনিতে মা বাবার সাথে আমার লেখাপড়ার খরচ নিয়ে সবসময় ঝগড়া করে আসছে। মা বলত-তোমার এই ছেলের জন্য চাউল বেঁচার সবকটি টাকা খরচ করলে? আর আমরা না খেয়ে আছি। পরিবাবের এমন হীন অবস্থা দেখলে সত্যি মনে বড় কষ্ট পেতাম,অকপটে দুচোখে জল এসে যেত। তাই ঈদ এলে আমার কাছে কখনও ভাল লাগেনি। আজও লাগে না। দু-বেলা খাবারের জন্য যে সংসারের কর্তার সবসময় যুদ্ধ করতে হচ্ছে সে সংসারের একটি ছেলের স্বপ্নের  কোন দাম নেই,তার চাওয়া-পাওয়া নিতান্তই  অবহেলিত। আমার ‘আমি’-কে বরাবরই এমন দৃশ্যের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করতাম। যখন বন্ধুরা প্রশ্ন করতো ঈদগাঁহে যাইনি কেন তখন তাদের সত্য উত্তরটি কখনোই দেইনি। বরং বলেছি-এবার আমাদের গ্রামের ঈদগাঁহে গেছি। কাকা এমন ভাবে বলল না গিয়ে থাকতে পারিনি। বড়ই লজ্জার সেদিনের সেই মুহূর্তুগুলো। আজও সবটুকু স্পষ্ট মনে আছে। সোহেল ৮ম শ্রেণীর পর আর এগোতে পারেনি। আমি এস.এস.সি কোনরকম শেষ করেছি। সে সংসারকে টিকানোর জন্য সামান্য রোজগারের আশায় দিনরাত পরিশ্রম করে। নানার বাড়ীতে থাকতাম বলে পরিবারের বোঝা যে কী তা তখন বুঝতাম না। কাজ সেরে বিকালে দুজনে কলেজের মাঠে চলে যেতাম। সুখ-দু:খের জলসাতারে হাবুডুবু খেতাম। মাধাইয়া মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি কলেজ মাঠ। যেই কলেজে আমাকে ও সহপাঠীদের জোড় করে ভর্তি করানো হয়েছে। আমার নানা এই কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য বিধায় আমাকে বলল-‘‘তুই এই কলেজে ভর্তি হয়ে যা,বেতন-টেতন লাগবেনা।’’

মা-তো শুনে খুব খুশি। কেননা বেতন ছাড়া কলেজে তার ছেলে ভর্তি হয়ে পড়তে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা ভাল কলেজে ভর্তির আশাকে মাটি চাপা দিতে পারল। আমার না থাকুক অন্য অনেকেরই সামর্থ্য আছে ভাল কলেজে পড়াশুনা করার। স্থানীয় এম.পি ও এম.পি’র-খাস দালাল এই কলেজের  অধ্যক্ষ আমাদের কচি- স্বপ্নের  শরীরে দু:স্বপ্নের -চাপাতি বসিয়ে দিয়েছিল। সোহেল বলল-‘‘তুই কি এই কলেজে পড়বি না? আমি বললাম-না। দরকার হলে পড়াশুনা করব না। এমনিতেই তো পড়াশুনা আর করা যাবে বলে মনে হয় না।


সোহেল বলল- কি আর করবি। ভর্তি হয়ে যা। ভালমত পড়লে এই কলেজ থেকেই ভাল রেজাল্ট করতে পারবি। আমি নিশ্চুপ ছিলাম সেদিন। সে তার জায়গা থেকে আমাকে বুঝানোর চেষ্টায় ক্রুটি করেনি। আমার নাড়ি- নক্ষত্র  জানে বলেই শান্তনার সুরে কথাগুলো বলেছিল বিষন্ন আকাশ পানে চেয়ে।

সোহেল প্রায়ই বলত- আল্লাহ  আমাদের তওফিক দিলনা দোস্ত । আমরার সমাইন্না বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেছে আমরা আমরা কই? এটাই নিয়তি আর নিয়তির নিষ্টুর ঝড়ে বলি হয় কিছু স্বপ্নের,  স্বপ্ন-বিভোর কিছু পাগলেরা; একটু শুধু ভাল থাকতে চাওয়া জীবনের। যে জীবনে ঈদ এলেই মনে দু:খ ধানা বেঁধে উঠবে না। ছলছল চোখে সিগারেট টা ধরিয়ে বলত- কি আর করবি গরীব হয়ে জন্মেছি আমরা!

২.সাত দিন ধরে কলেজ বন্ধ। সারাদিন বাড়ীতে একা। সোহেল সোনাপুর কাজে গেছে। তার ফিরতে সন্ধ্যা হবে। তাঁর বোনের বাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিল। ছোট বোন-জামাইকে ঈদের দাওয়াত না দিলে নাকি বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হনুফাদের বাড়ি ‘তাবিজ বাবা’,র বাড়ীর নিকট। ‘তাবিজ বাবা,এই অজপাড়া গায়ের একটি আতঙ্কের নাম। রিক্সাচালক থেকে শুর“ করে সব শ্রেণীর মানুষের তার অদ্ভুত দরবারে যাতায়াত। একটু কল্যাণের আশায়-দু:খ-কষ্ট লাগবের আশায়। এমনও লোক দেখেছি যারা মা-বাবাকে ভাত দিতে নারাজ কিন্তু তাবিজ বাবাদের জন্য মরতে ও রাজি। এ সমাজ আস্তে আস্তে  তথাকথিত বাবাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তাইতো সোহেল একদিন বলল-চল তাবিজ বাবার কাছে যাই। গিয়ে দেখি কিছু পাইকীনা।আমি যেতে চাইনি কিন্তু সোহেল বলাতে না গিয়ে থাকতে পারিনি ঐদিন। তার বোনের বাড়ীর কাজ শেষ করে রাতের অন্ধাকারে সোজা তাবিজ বাবার আস্তানায়  হাজির হলাম। রাত্র তখন ১২.৩০ ধস হবে। বিস্ময়ের ঘোরে কেমন জানি লাগছে নতুন এই পরিবেশটাকে। তাবিজ বাবা একটি মাচার উপর একটি লুঙ্গী গায়ে বসা। খদ্দেরদের জন্যে ও একই ব্যাবস্থা। হনুফাদের বাড়ি থেকে ১-১.৫ কিলোমিটার দূরে হবে হয়ত। রাতের আধারে বুঝতে পারিনি। যারা নতুন যাবে তারা প্রথমেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবেন। বিড়ি ও গোলাপ জল ছিটানো গন্ধে চারদিক থমথম,ধ্যান-মগ্ন নিবিড় তপস্যা তাবিজ বাবার আস্তানা  জুড়ে। আমি আর সোহেল মাচার উপর বসে পড়লাম। চামচা ধরনের একজন আমাদের দুজনকে দুটি বিড়ি এগিয়ে দিল। কিছুদিন হল সিগারেট ধরেছি। বিড়িতে অভ্যস্ত  না। তারপর ও বাবার আস্ততানার বিড়িটা নিলাম। বিড়িটা টানছি আর ভাবছি এ কোথায় এলাম? মানব কূলের সকল রোগের ঔষধ নাকী এই সুখ্যাত বিড়ি। চামচা ধরনের লোকটি পরে অবশ্য নাম জানতে পেরেছিলাম ‘‘জালাল বখশী’’ মাচায় বসা সকল মক্কেলদের উদ্দেশ্যে-বলছে- ‘‘যার যা নিয়ত করে বিড়ি টানেন। আর যাওয়ার সময় ঐ দোকান থেকে(আঙ্গুল। দিয়ে ইশারা দিয়ে)  দু’প্যাকেট বিড়ি নিয়ে যাবেন। যার যা সমস্যা ভাল হয়ে যাবে। বাড়ীতে নিয়ে মা-বাবাকে,প্রতিবেশীকে যার যেই রোগ,আরোগ্য লাভের জন্য এই বিড়িটা খাওয়াবেন। জালাল বখশীর কথা আমার কানে ঢুকছে না। পাশেই বসা মা’র মত বয়সী মহিলাদেরকে দেখছি। মনের সুখে বিড়ি টেনেই চলেছে। যেন কোন অদৃশ্য শক্তি সকলকে বিড়ি টানাতে বাধ্য করছে! তাবিজ বাবার একদল ভক্ত তার পায়ের কাছে তবলা আর ঢোল বাজিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করছে। একটা সুর মনে পড়ছে‘‘থাকতে যদি না পাই তোরে,চাই না মরিলে’’। মনের সুরে ঝং ধরা ভক্তরা সুর তেমন তুলতে পারেনি। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হল তাবিজ বাবা নাকী ল্যাংটাই থাকেন। তবে লুঙ্গিটা যত সামান্য পেচিয়ে রাখেন। মাচার মধ্যেই তাঁর মল-মূত্র ত্যাগের অভিনব ব্যবস্থা। বিড়ি টানাই তো চলছে তার ফাকে কিছুক্ষণ পর পর কয়েকজন লোক সম্ভবত বাবার খাস লোক কটবেল ফাটিয়ে নিয়ে আসতেন। বাবা শুধু হা করেন দু’তিন জন মিলে বাবাকে কটবেল খাইয়ে দেন। দুইজন অবিরত বিড়ি সাজানোতে ব্যস্ত । একটি শেষ হলে আরেকটি। তাবিজ বাবা কয়েক মিনিট পরপর(গুপ্তবায়ু) সজোরে ছাড়েন। সবাই নির্বিকার। আমার বিস্ময়ের সীমা অতিক্রমের পালা। কোন সে বনে খেলাম ধরা। ইচ্ছা করলেই যায়না ছুটা। সোহেল তাবিজ বাবার স্পেশাল বিড়ির অপেক্ষায় আছে। আমি কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম।
৩.পরদিন সকালে বাড়ীতে এলাম। নিজেকে কেমন জানি অপরিচিত লাগছে কিছুটা(সন্ন্যাসী সন্ন্যাসীভাব)। রাত জাগা আর তাবিজ বাবার কেরামতির অংশ বিশেষের ঘূর্ণিপাক স্মৃতিকে উলট পালট করে দিচ্ছে মনে হয়। কাল ঈদ গোসল সেরে তাবিজ বাবার টানের মত লম্বা একটা ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠেই বাজারে চলে গেলাম। সোহেল আর আমি কাপড় পট্টির একপাশে দাড়িয়ে আছি। কত ভিড়। চেনা-জানা অনেক মানুষ। কারো হাতে ব্যাগ-ভর্তি কাপড়,কারো হাতে দামী মোবাইল। বাচ্চাগুুলোর বায়না ধরার যেন শেষ নেই। দেখতে ভালই লাগছে। আমাদেরই শুধু দেখার পালা। এ পালা শেষ না হলে ও কোন ক্ষতি নেই। মনের  অজান্তে  চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। এবারের ঈদেও আমরা নতুন কাপড় পড়তে পারব না! (তাবিজ বাবার বিড়িতে মনে হয় কাজ হয় নি।) তাবিজ বাবার কারণে হোক বা না হোক, সোহেল মালয়েশিয়ায় গেছে সাত বছর হল। গত পরশু  আমার জন্য দশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে ঈদের কেনাকাটার জন্য। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট ‘‘নাগরাজ এবারের ঈদে তোর যা ইচ্ছা কিনবি। তাহলে সেদিনের দু:খকে ভুলে যাব। আর মার্কেটে গেলে দেখবি মার্কেটের আশে পাশে অসহায় দৃষ্টিতে আমাদের মত কেউ উকি দিচ্ছে কিনা !

পকেটে দশটা এক হাজার টাকার চকচকে নোট। অথচ কিছুই কিনতে ইচ্ছা করছে না। আজ পকেটে টাকা আছে। কিন্তু একা যে কিছু কিনব তা পারছিনা আমি। বন্ধু টাকাটা জমা করে রাখলাম। তুই যখন দেশে আসবি তখনই না হয় কিনব দুজনে মিলে। আবার যাব যে জায়গায় দাড়িয়েছিলাম আমরা একদিন। অতীত অনেক কথাই মনে করিয়ে দেয়। সেদিনের কষ্টটাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তা কী ভুলা যাবে। যাবে না। আনন্দময় কাটুক সকলের ঈদ, বিষন্নতা দূরে থাকুক।