কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন

কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন


কাঙ্খিত মৃত্যুকে ঘিরে জগতের তাত্ত্বিক আয়োজন
সাদিক আল আমিন

এক.

আমি ঘুমিয়ে পড়লে আমার পারিপার্শ্বিক জগৎ জেগে ওঠে। নিত্যকার মতো অফিস যায়, জ্যামে পড়ে, শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরে। যখন আমি ঘুমিয়ে থাকি, অবচেতনে কর্মরত আমার পারিপার্শ্বিক জগৎকে স্বপ্নে দেখি। ওরা শুধু একজন বা কয়েকজন নয়, হাজার হাজার জন। হাজার হাজারটা স্বপ্নের আদলে গড়ে ওঠে তারা। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথম যখন আমি ঘুমোতে শিখি, জন্মের প্রথম দিনে মায়ের কোলে ঘুমিয়েছিলাম যেদিন, তখন থেকে আমার পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তু কিংবা ব্যক্তিসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তবে এ জগৎ আমি ব্যতীত অন্য সাধারণ মানুষজন নয়, অর্থাৎ সাধারণ পরিবেশে বসবাসরত ব্যক্তিসত্তার মধ্যে তারা নিরস্তিত্ব। কেবল আমার অবচেতন কিংবা অচেতন মনেই তারা বিদ্যমান; যার অনুভব কেবল আমিই টের পাই।
এখন আমার বয়স ৩০ চলছে। বেসরকারি একটা কোম্পানিতে কাজ করি। ৩০ বছর বয়স মানে ১০৯৫০ দিন। গণনানুসারে আমার দশ হাজার নয়শত পঞ্চাশটি পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তু বা পদার্থ কিংবা ব্যক্তি থাকা উচিত। কেননা, নিয়মানুযায়ী প্রতিদিন ঘুমোনোর ফলে এক এক করে বহিঃজগৎ সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু না, আমার ততোগুলো নেই। আমার সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেকের মতো হবে। অনেক রাত গেছে, আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। এরকম অনেক রাত হয়তো আমাকে জাগিয়ে রেখেছে, নয়তো আমি রাতকে জাগিয়ে রেখেছি; নিজের মতো করে উপভোগ করেছি। ডিটেকটিভ বই পড়ে, রঙ চা আর কফি উইথ ব্রাউনির সাথে ওয়েস্টার্ন মুভি দেখে সময় কাটিয়েছি। কারণ আমি আমার পারিপার্শ্বিক জগৎকে বাড়তে দিতে চাইনা। এর কারণ মূলত দুটো-

১.
আপনার পারিপার্শ্বিক জগৎ যখন আপনার মনোজাগতিক ক্ষমতার চাইতে বেশি মাত্রায় বেড়ে উঠবে, তখন আপনি ক্রমশ বুড়ো হতে থাকবেন। মৃত্যুর কাছাকাছি গড়াবে আপনার আয়ু।
২.
ঘুমোনোর মাধ্যমে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতার প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হওয়ার ফলে আপনার পরাবাস্তববাদের প্রতি তিক্ততা এসে যাবে। তখন আপনার কন্সাস মাইন্ড সাবকন্সাস মাইন্ড থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইবে। ফলত আপনার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে। দার্শনিক অর্থেই হোক কিংবা প্রকৃত অর্থেই হোক, স্বপ্নমৃত্যু ঘটা মানুষ বেশিদিন টিকতে পারেনা।


এই কারণ দু’টোর কথা স্মরণে আমি আমার বহিঃজগৎকে আয়ত্বে রেখেছি। কারণ আমি জানি বাহ্যিকজগৎ অন্তঃজগতের চাইতে বেড়ে উঠলেই খসে পড়ে আত্মা। আপনাদের হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারে যে, যেহেতু ঘুমোনোর ফলে অবচেতনে দেখা যে জগৎটা বেড়ে ওঠে তাকে অন্তঃজগৎ বা মনোজগৎ বললাম না কেন? কেন-ই বা বহিঃজগৎ বললাম যেখানে বহিঃজগৎ বলতে আমরা শুধুমাত্র বাস ট্রাকে ভরা যান্ত্রিকীয় জগৎকে বুঝে থাকি! এর উত্তরটাও অনেক সহজ। ধরুন আপনার বাবা-মা কিংবা অতিপ্রিয় েেকউ আজ মারা গেলো। সেই মৃত্যু ঠেকানোর সাধ্য কিন্তু আপনার নেই। এটা কিন্তু বহিঃজগতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। পক্ষান্তরে যদি মনোজগৎকে বাহ্যিক জগতের স্থান দিতেন, তবে যা ঘটতো সবকিছু হতো অবচেতনে। বান্তবে এর কোনো বিরুপ প্রভাব ফেলতো না...।
সুতরাং তত্ত্বানুসারে অন্তঃজাগতিক বাস্তবতার চাইতে বহিঃজাগতিক কল্পনার মাত্রা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে মৃত্যুসময় ঘনাতে থাকে।যেমন পুষ্টতার চাইতে রুক্ষতা বেশি হলে ঝড়ে পড়ে পাতা। ঠিক তেমনি একদিন, পক্ষান্তরে বহুদিনের রুক্ষ এক পাতার মতো ঝড়ে পড়েছিলো মেয়েটা। এক কুয়াশাভোরে হঠাৎ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করে সে। আমি তখনো ঘুমিয়ে ছিলাম মেঝেতে। শীতের রাত ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমিয়ে কাটাতে আমার পছন্দ ছিলো। আট বছর আগের ঘটনা। তখন আমার বয়স বাইশ। আমার ঘুম ভাঙালো একটা বুনো মেষের উৎকণ্ঠা। দরজায় এসে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারছে আর যেন চিৎকার করে বলছে, ‘হে মানব ওঠো, তোমার প্রতিবেশী মানবী কিছুক্ষণ হলো মারা গেছে। তাকে এখন নিয়ে যাওয়া হবে নো ম্যানস ল্যান্ডে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে চাইলে ওঠো।’ আমি যেন মেষটির কথা শুনতে পেলাম! ঘুম ভেঙে গেল। দরোজা খুলে দেখলাম ঠিকই একটা মেষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে নির্বাক চেয়ে। বাইরে বেশ তুষারপাত হচ্ছে। হালকা একটু কুয়াশা। সেই কুয়াশার মধ্যে দেখলাম, ওবাড়ির লোকজন সবাই গ্রেভ ইয়ার্ডে যাবার আয়োজন করছে। কালো কফিনের বাক্সে ভরে রেখেছে মেয়েটাকে। সেই মেয়েটা, কাল রাত্রে যে আমাকে এক বোয়াম কফিবিন দিয়ে গেলো। বলে গেলো, ‘সকালে একমগ হাতে নিয়ে বেরোবেন। ঝিরঝিরে তুষারপাতে দারুণ খেতে লাগবে...।

দুই.
আমি তৈরি হয়ে নিলাম মেয়েটার গ্রেভে যাওয়ার জন্য। শোকাভাব প্রকাশ করার জন্য পরলাম ব্ল্যাক স্যুট। যাবার পথে রাস্তারদোকান থেকে একতোড়া অর্কিড কিনলাম। যেতে যেতে ভাবলাম, ওর বহিঃজগৎ কি অন্তঃজগতের চাইতে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছিলো? অথবা কি তার স্বপ্ন দেখা নির্দিষ্টতার সীমা ছাড়িয়েছিল! যার কারণে নিঃস্বপ্ন হয়ে হঠাৎ মেয়েটাকে দুটো জগৎ ছেড়েই চলেযেতে হয়েছে...!
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হলে তার টম্বের উপর ফুলগুলো রেখে দিলাম। আর বুঝতে চেষ্টা করছিলাম তার মৃত্যুর কারণ; কি হয়েছিলো তার! নিউমোনিয়া বা এজাতীয় কিছু রোগ কি ছিল! নাকি সব পারস্পরিক জগতের কারবার! ভুক্তভোগী ছিল নাকি সুবিধাভোগী! শিকারি ছিলো নাকি ছিলো শিকার! ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে চলে আসছি, এমন সময় মনে হলো সেই মেয়েটা যেন কথা বলছে পেছন থেকে, ‘কফি কিন্তু প্রতিদিন খাবেন। বিশেষত খাবেন রাতে। জেগে থাকবেন। আমাকে ভুলবেন না’।  পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সব নিস্তব্ধ, নিশ্চল। মেয়েটা সেদিন কেন মরেছিল সে রহস্য বের করতে আমি দুটো বছর নষ্ট করি। সে দু’বছর আমি একদম ঘুমোইনি। তার মৃত্যুর কোনো কারণও আমি দেখিনা। কারণ মেয়েটা কখনো ঘুমোতো বলে মনে হয়না। তার ঘরের রাতজাগা ল্যাম্পের আলো আমার জানালায় এসে পড়তো। এছাড়াও যেদিন রাতে সে কফি দিতে এলো, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কালসিটে ছায়ায় ঢেকে ছিল চোখ; ব্যাপক ডার্ক সার্কেল। এর অর্থ দাঁড়ায় মেয়েটা অনেকদিন ঘুমোয়নি। অথচ পারিপার্শ্বিক জগৎকে অপ্রাধান্য দেওয়া সত্ত্বেও ওর আত্মা খসে পড়লো কেন? পরিবারের সংশ্লিষ্ট লোকদের থেকে অবগত হলাম তার কোনো অসুখও ছিলোনা। আর তাকে মনে রাখারও বা কি আছে! তার সাথে তো আমার কোনো প্রণয় ছিলোনা কোনোদিন!

তারপরের চারবছর আমার ঘুম ছিল খুব সামান্য। চব্বিশ ঘন্টায় মাত্র এক কি দু’ঘণ্টা ঘুমোতাম। মনে হতো যেন এক অদ্ভুত বাহ্যিক জগতের আশ্রয়ে বেঁচে আছি। পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে সেসব অনুভবের চেষ্টা করতাম। কখনো মনে হতো সবকিছু বস্তুসদৃশ নির্জীব; আবার কখনো মনে হতো যেন অলৌকিক কিছু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছি! কিন্তু কোনোভাবেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না যে আমার আবিষ্কৃত দুটো তত্ত্ব মেয়েটির ক্ষেত্রে মিললো না কেন! সুতরাং সিদ্ধান্তক্রমে এটা কি বলা যেতে পারে যে, বহিঃজগত অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে মনঃজগত আবার নতুন করে সৃষ্টি হয়! পূর্বরুপ ডালপালা ছড়িয়ে আবার পারিপার্শ্বিক জগতের চেয়ে বড় হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে! এটাকে যদি তৃতীয় তত্ত্ব ধরি, তবে সবগুলো তত্ত্বের একটিই পরিণতি; সব তত্ত্ব সমান ক্রমধারা মেনে অবশেষে এক অনন্য পরিণতিতে পরিণত হয়; এবং তা হলো মৃত্যু। মৃত্যু উপলব্ধি করার পর থেকে আমি একদিন জেগে থাকি, একদিন ঘুমোই। কেননা এর অন্তিম পরিণতিও হয়তো মৃত্যুই হবে। যদি হয়, তবে এটা আমার আবিষ্কৃত চতুর্থ তত্ত্ব হবে। যদি না হয়, তবে অমরণশীলতার এক সফল তত্ত্ব হিসেবে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সফল হবার কারণ হতে পারে আয়ুবৃদ্ধির সাম্যাবস্থা। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক জগৎ ও অন্তঃজগৎ সর্বদাই ধ্রুব থাকছে।
চতুর্থ তত্ত্ব আবিষ্কারের পর থেকে মেয়েটার দেয়া বোয়ামের কফিবিন দু’চামচ করে গরম পানিতে মিশিয়ে এক দিন অন্তর অন্তর রাতের বেলা খাই। মেয়েটা মারা যাবার আট বছর হলো। আশ্চর্যজনকভাবে তার দেয়া সেই একবোয়াম কফি এখনো ফুরোয়নি।

গল্প- পথের বাগড়া

গল্প- পথের বাগড়া


পথের বাগড়া
শাদমান শাহিদ


     কারওয়ান বাজারের সবকটা বস্তিকে একে একে পেছনে ফেলে ট্রেনের গতি তখন প্রায় পূর্ণমাত্রা। যাত্রীদের বিরস কোলাহল আর গিজগিজে ভিড়ের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি চোখটাকে বাইরে সারিবদ্ধ বস্তিদর্শন থেকে সরিয়ে তারই পাশে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা বিচিত্র কাঠামোয় নির্মিত দৃষ্টিনন্দন দালানগুলোর দিকে ফিরিয়ে নেন। সেখানে বিভিন্ন কন্সট্রাকশন কোম্পানির রুচিবোধ শৈল্পিক দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, নগরায়নে এমন নান্দনিক সুখ-সমৃদ্ধির চিন্তা দশ-বারো বছর আগেও ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের মাথায় আসে নাই। অথচ এখন...
     ঢাকা শহরের দ্রুত উন্নয়নের বিষয়টা নিয়ে এভাবে ভাবতেই বুক ফুলিয়ে একটা তৃপ্তিকর শ্বাস বেরিয়ে যায়। ‘যাক, শেষ পর্যন্ত এই শহরে আমারও একটা ঠিকানা হলো। ধন্যবাদ সরকারকে। সরকার যদি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ফ্ল্যাট-বাসা বরাদ্দ না দিতো, অজপাড়া গাঁর একজন স্কুলশিক্ষকের পক্ষে এই শহরে ফ্ল্যাট-বাসা, কল্পনা করা যায়!’ ভাবতে গিয়ে টের পান আরও একটা তৃপ্তিকর ঢেউ বুকের ভেতর ইতি-উতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন দৃষ্টিটাকে বাইর থেকে ধরে এনে ফাইলবদ্ধ কাগজগুলোয় ছেড়ে দেন। শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের সনদ। ওটাতে তাকালেই সব সময় মোটা কালিতে লেখা নিজের নামটা আগে নজরে আসে। গর্বিত নাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল হাসান। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা নামও মনের ভেতর উঁকি মেরে যায়। গ্রুপ কমান্ডার জসিম উদ্দিন। তিনিই তাকে যুদ্ধে নিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনি যখন মহকুমা সদর দখলে নিয়ে আশ-পাশের গ্রামগুলোয় আগুন জ্বালাতে শুরু করে দিলো, তখনই এক অন্ধকার রাতে ঘরে এসে বলেছিলেন, আবুল, লও নাম লেখাইয়া ইন্ডিয়া যাই। ট্রেনিং ছাড়া বন্দুক ধরন যাইবো না।
    তারপর কত ঘটনা। কত স্মৃতি। সবই আজ বিস্মৃতির অতলে...
    বছর তিনেক হয় জসিম ভাই মারা গেলেন, মতের ভিন্নতার কারণে রাষ্ট্রীয় সম্মান তো দূরের কথা রাষ্ট্রের কোনো কাক-পক্ষীও তাঁর জানাযায় এলো না। দল-মতের বিরুদ্ধে যাওয়া যেনো এমনই জঘন্য অপরাধ। পাপ। সহযোদ্ধা আবদুল আজিজ তো এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতিটাই আদায় করতে পারছে না। কতো করে বলা হয়, পার্টিতে যোগ দাও। স্বীকৃতিও পাবা, সাথে সাথে আরো নানান সুযোগ-সুবিধার রাস্তাও খুলবো। শুনে না। বলে, যেইডা আমার অধিকার, হেইডা অতো সিস্টেম কইরা পাইতে অইবো ক্যান? দেশ কি কারো বাপের জমিদারি? যা কইবে তা-ই হুনতে অইবে?
     মুর্খলোক। দেশের কোনো কিছুই যে স্বাভাবিক চলছে না, এটা তাকে কে যাবে বোঝাতে? মনে মনে কথাগুলো উচ্চারণ করে আবার ফাইলটা খুলেন। এতো দৌড়াদৌড়ির ভেতর কোথাও কোনো কাগজ মিসিং হয়নি তো? ঈষৎ উদ্বিগ্নের সাথে কাগজগুলোয়  চোখ বোলাতে থাকেন।  
     ঠিক এ-সময় ট্রেনের গতি অনেকটা নরম হয়ে আসে। বাইরে তাকিয়ে দেখেন ট্রেন বিমান বন্দর স্টেশনের প্লাটফর্মে উঠে গেছে। তারপরই চিরাচরিত দৃশ্য। ট্রেনটা থামতে না থামতে যুদ্ধাক্রান্ত দেশের শরণার্থীদের মতো আপাদমস্তক গিলে নেয়। কি বাইরে  কি ভেতরে। পা ফেলারও জো থাকে না। বিরক্তিটা চরমে পৌঁছার আগেই দেখেন একঝাঁক তরুণ-তরুণী ফাইল-পত্র বগলদাবা করে অসম্ভব ভিড় ঠেলে তাঁর সিট বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে। সম্ভবত সরকারি কোনো অফিসে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছে। তাদের সবার কণ্ঠেই বিষাদের বুদ্ বুদ্। ‘কবে যে কৌটা প্রথা শেষ হবে আর আমাদের মতো সাধারণ ঘরের সন্তানরা চান্স পাবো! আল্লাই জানে। কেউ একজন বললো, কামাল ভাই চার-চারবার ভাইবাতে যেয়ে ফিরে এলো; অথচ মনির ভাই তার চেয়ে অনেক দুর্বল স্টুডেন্ট হয়েও শুধু কৌটার কারণে প্রথম চান্সেই চাকরি পেয়ে গেলেন। আহ! আফসোস। তারা যদি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেন, তখন কোন যোগ্যতায় কার্যালয় চালাবেন?’
      তাই তো! কোন যোগ্যতায় ওসব ল্যাঙ-মারা লোক পদের প্রতি সুবিচার করে কর্মপরিচালনা করবে? ওদের মুখ থেকে প্রশ্নটা এক প্রকার কেড়ে নিয়ে আপন মনে ভাবতে লাগলেন। তখনই মনে পড়ে ছোট বোন জাহানারার ছেলে মারুফের কথা। এসএসসি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত সবকটা পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এসেছে ছেলেটা। অথচ তার মতো মেধাবী ছেলের চাকরি হলো না। তিন তিনবার বিসিএস-ভাইবায় পর্যন্ত ফেইস করলো। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে, কাউকে ধরতে হবে না। ওর নিজের যোগ্যতায় পেয়ে যাবে।  

শেষে দেখা গেলো আশায় গুড়েবালি। পরে তিনিও কয়েক জায়গায় ওর হয়ে কথা বলেছিলেন, কাজ হয়নি। এখন সে পাগল প্রায়। কোথায় যায়, কী করে, কোনো কিছুরই ঠিক-ঠিকানা নেই। অথচ নিজের মেয়ে শাকিলার জন্যে কোথাও ধরনা দিতে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা কৌটায় প্রথম  চান্সেই চাকরি পেয়ে গেলো। এ নিয়ে আরো কী যেন ভাবতে যাবেন,
এমন সময় আরেকজন তরুণ বলে উঠলো, আফসোস, বিদেশে না যেয়ে কেনো যে লেখাপড়া করতে গেলাম! ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করে। নরসিংদীর আগে আর কোথাও  থামবে না। সেজন্যে গতিটা নিশ্চয়ই আগের মতো পূর্ণমাত্রায় গিয়ে উঠবে। তখন জানলার বাতাসে ফইলের কাগজ-পত্রগুলো এলোমেলো হয়ে যাবার জোর সম্ভাবনা। সে আশঙ্কায় তাড়াহুড়ো ফাইলটা গুটিয়ে নিতে নিতে টের পান কার যেনো এক দলা গরম নিঃশ্বাস ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়লো।
সাথে সাথে মাথা তোলে দেখেন কাঁধ ঘেষে দাঁড়ানো ছেলেটা জানলা দিয়ে লক্ষ্যহীন বাইরে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে কী যেনো বলছে, কোলাহলের কারণে বোঝা যাচ্ছে না। তবে পাশের ছেলেটা নিশ্চয়ই কিছু একটা বুঝেছে।
তাই তো সে বলতে লাগলো, তুই ইচ্ছে করলে পারতি কিন্তু আমি? আমার তো সে-ক্ষমতাও নেই। তুই তো সবই জানিস, কীভাবে যে আমাদের সংসারটা...কথাটা শেষ করতে পারে না ছেলেটা, তার আগেই বুক উঁচু করে একটা লম্বাশ্বাস ফেলে কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। 
     টের পাচ্ছেন, ছেলেদের কথাগুলো কোথায় যেনো নড়ে-চড়ে উঠছে। একে একে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। সবার চোখে-মুখেই সেঁটে রয়েছে এক ধরনের বঞ্চনার প্রচ্ছদ। মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেন, কোনো লাবণ্য নেই। একজন তরুণকে মোহাবিষ্ট করে রাখার মতো কোনো লক্ষণই তাদের চোখে-মুখে নেই। যতোই দেখছেন ততোই শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠছে। সে-সাথে হাত-পাও অবাধ্য স্প্রিং-এর মতো কাঁপতে লাগলো। কী হচ্ছে এসব? কোথায় যাচ্ছি? ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন বটে; কিন্তু কিছুতেই নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। কেবলই মনে হতে লাগলো, কোথায় যাচ্ছি আমরা! এজন্যই কি একদিন রাইফেল কাঁধে হারিয়ে গিয়েছিলাম ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের পরতে পরতে? সব সম্ভাবনা এভাবে দীর্ঘশ্বাসে তলিয়ে যাওয়ার জন্যেই কি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম দানবের মুখে?
    আর ভাবতে পারছেন না। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এমনিতেই ডায়াবেটিসের রোগী, তার ওপর সারাদিনের ধকল। তিনদিন ধরে ঢাকায়। ফাইল-পত্র তৈরি, এ-অফিস থেকে ও-অফিসে কখনো রিক্সায়, কখনো হেঁটে বারবার ছুটে যাওয়া, কীসের খাওয়া কীসের কী? তিনদিন ধরে ঠিক মতো ঘুমোতেও পারেননি। তারপরও স্ত্রী রোকেয়ার মামাতো ভাই শিকদার সাহেব ছিলো বলে রক্ষা। তা না হলে হোটেলে থাকতে হতো। ঢাকা শহরের হোটেলে থাকা-খাওয়ায় কত যেতো, ভাবা যায়!
    চোখ বুজে কপালের বামপাশ টিপতে থাকেন।
    ঠিক এসময় গা ঘেঁষে দাঁড়ায় টিকেট চেকার।
    তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেন, উঠতি বয়সের যুবক। বুকের বাঁপাশে মুক্তিযুদ্ধের মনোগ্রাম অঙ্কিত ব্যাজ থাকা সত্ত্বেও পাশের ভদ্রলোকের কাছে টিকেট আছে কিনা জানতে চায়। পূর্ব অভিজ্ঞতায় তিনিও জেনে ফেলেছেন, এমনটিই হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ট্রেনে যাতায়াত ফ্রি হলেও টিকেটের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত হয়নি। যে-কারণে এ-ধরনের বিড়ম্বনা কিছুতেই পাছ ছাড়ছে না। টিকেট চেকার একটা না একটা কথা শোনাবেই। সে অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি কখনো এ-ভুলটি করেন না। শত কষ্ট হলেও টিকেট সংগ্রহ করেন। আজকেও করেছেন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে বাত ধরে এসেছিলো, তারপরও টিকেট ছাড়া ট্রেনে উঠার নাম করেননি।
    পাশের ভদ্রলোক মনে হয় টিকেট করেনি। তাই কণ্ঠে যদ্দূর সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে বললেন, আমি এফ এফ। ‘এফ এফ’ শব্দটা শুনেই টিকেট চেকার এমনভাবে তাকালো, যেনো তিনি বিরক্তিকর কিছু একটা উচ্চারণ করে ফেললেন। সে-সাথে তিনি ছেলেদের দিকেও তাকালেন। ভাবলেন, ওরা নিশ্চয়ই টিকেট চেকারের উদ্দেশ্যে কোনো প্রতিকার দেখাবে। কিন্তু না, ওরা টু শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।
   তখন ভাবলেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়, এ-বিষয়ে নিজেই দাঁড়িয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দেবেন।  পরক্ষণেই মনে হলো, এটা স্কুল নয়। আর ওরাও তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থী নয়। তাছাড়া ওরা একটা স্বাধীন দেশের সন্তান হয়ে একটা নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর খাবি খেয়ে মরছে। এই অন্ধকার ভেদ করে কখন তাদের জীবনে ভোরের সূর্য উঁকি দেবে, তারও কোনো সম্ভাবনা আপাতত চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে কোন ভরসায় নীতিবাক্য আউড়াতে যাবেন?
    এ আশঙ্কায় আর দাঁড়াতে সাহস করলেন না। বসে বসেই ভাবতে লাগলেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা মিসিং হয়ে গেছে। কিন্তু মিসিংটা কোথা থেকে শুরু হলো? প্রশ্ন মাথায় রেখে যখন অনুসন্ধান চালাতে যাবেন, এমন সময় কে যেনো ডেকে উঠলো, কী ভাবছো?
    কে আপনি?
    তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? আমি আবুল হাসান। বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল হাসান। যে কোনোদিন কারো কাছে ছোট হয়নি। বহরমপুরে যার জনপ্রিয়তায় চেয়ারম্যান সাহেব পর্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়; তুমি এখনো চিনতে পারলে না আমাকে?
    চিনবো না কেনো? হা চিনেছি। তুমি বহরমপুর হাই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শত্রুর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে। বিশ্বাস না হয়, এই দেখো তোমার পরিচয়। মনে মনে উচ্চারণ করেই হাতের ফাইলটা জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলেন। ট্রেন তখন টঙ্গী-পোবাইল-আড়িখোলা পেরিয়ে শীতলক্ষার ব্রীজের উপর দিয়ে সোজা ছুটে যাচ্ছে নরসিংদীমুখী। বিষয়টা যারা খেয়াল করলো, তারা দেখলো ফাইলটা পানিতে পড়ে ঢেউয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সার্ফিং করতে করতে চোখের অন্তরালে চলে যাচ্ছে।
     তরুণ-তরুণীরাও  অবাক। বললো, আঙ্কেল, এইটা কী ফেললেন?
     মুখে এখন দেবতার হাসি। ছেলেদের উদ্দেশ্যে ভ্রু নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগলেন, ওটা তেমন কিছু নয় বাবারা। অনাবশ্যক কিছু কাগজ ছিলো, ফেলে দিলাম। যেতে হবে অনেক দূর, শুধু শুধু পথের বাগড়া বাড়িয়ে লাভ কি।

পদাবলি

পদাবলি


জ্যোৎস্না
শারমিন আক্তার

এখনো; এখনো দূর কোন মরুভূমে মরীচিকা ওঁৎ পাতে। কাগজের নৌকোয় পাল তোলে খেঁয়ালী স্বপ্ন যত। কাঁচা রোদে চোখ মেলে যে নকশিকাঁথার পোঁড়া গ্রাম,  সেখানে সন্ধ্যেবেলায় পাহাড় ঘেঁষে নীরবতা নামে। ওদিকে জোৎস্না কোন সুবোধ বালকের মত খুলে বসে নিযুত কবিতার পাঠ্যবই। এখনো তুমি হেঁটে যাও মেঠোপথ আমার চোখের ভাঁজ গলে, সেখানে আমার কত জনমের মেঘ জল হয়ে গড়ায় বিশ্বচরাচর। এখনো...



শীতের বিকেল
মাহমুদ নোমান

পাখিদের ডাকাডাকিতে
পথ হারিয়ে
যাদুটোনার ছলে
ওয়াবীলতা ফুলের ঝলওয়া
দস্তানায় দিলখুশÑ
প্রজাপতির খেলা দেখতে দেখতে
পেটকাটা ধানগাছের ফুঁঝায়
দুলে উঠে নাইওরির
পাঁজরে আটকা কষ্ট,
কদমে কদমে এগোয় অন্ধকার



তুমি এবং তোমরা
সৈয়দ শরীফ

তোমার চোখে স্বপ্ন দেখি-
স্বপ্ন ভেঙে হৃদয়টিতে হচ্ছে এ কী?
প্রায় সেখানে কোরছে ব্যথা; কান্না শোনো?
ছিঃ ছিঃ কীসব বলছি, আজব !
তুমি তো আজ অন্য চোখে স্বপ্ন বোনো..

যাচ্ছে কেমন দিন তোমাদের?
চাঁদনী রাতে- জ্যোৎস্না মেখে;
ওর দু’হাতে হাতটি রেখে-
থাকছো কেমন? বড্ড সুখী?
কষ্ট কভু সুখটা ভেঙে দেয় না উঁকি?

এই তো আমার চাওয়া ছিলো-
দু’চোখ মেলে দেখবো তোমায়
সুখেই আছো.. সুখেই আছো..
আজ আমার আর কষ্ট তো নেই;
কারণ- তুমি সুখী হয়ে
আমার মতো আরেকজনার
বুকেই আছো ! বুকেই আছো !


বাসস্ট্যান্ড
অসীম মালিক

আগমন ও প্রস্থানের কোলাহল গায়ে মেখে
রাস্তাগুলি ছড়িয়ে গ্যাছে চাদ্দিকে ...

যারা এসেছিল ,
কাজ সেরে ফিরে গ্যাছে ঘরেÑ
বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, প্যাসেঞ্জার ও ফেরিওয়ালার ডাকে,
বাসস্ট্যান্ডের অলিতে-গলিতে
থেকে গ্যাছে কিছু নমুনা .....

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাস্তাগুলিকে
এক ছাতার তলায় এনে
আদর্শ হিন্দু হোটেলের গলিতে হারিয়ে যায়নি বাসস্ট্যান্ড !

সম্প্রীতির ঈপ্সিত ইচ্ছেগুলি
বাসের সিটে সিটে ছড়িয়ে দিয়ে
ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে
একাকী , নীরব বাসস্ট্যান্ড...

প্যাসেঞ্জার ঘরে নিয়ে আসেনি বাসস্ট্যান্ডের মুখ !

মৃত্যুর ডাকপিয়ন
শাহিন আলম

মেহেদী রাঙা বউয়ের মতো মৃত্যুকে বেসেছি ভালো
মাঝরাতে জোনাকীর আলোয় হেঁটে হেঁটে
মৃত্যুর শহরে গড়েছি ঠিকানা।
এ শহরের প্রতিটি কলোনীতে
সকালের রোদের সাথে নেমে আসে মৃত্যুদূত
দস্ত আর নখের ভিতরে গেঁথে রাখে
শত মানুষের প্রাণ।
প্রতিটি গলির মোড়ে মৃত্যুর ডাকপিয়ন থাকে দাঁড়িয়ে
নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে দেয় চিঠি।
আমি দরজার কপাট রেখেছি খুলে
রঙিন খামের অপেক্ষায় চেয়ে আছি পথ।



কামনা
নাবিল তুরাব

তারচেয়ে ভালো তুমি ঘুমিয়ে পড়ো; হে রজনীসন্ন্যাসী... অলুকপাড়ায় সূর্য নামে যখন। রমণীর মুখ চেয়ে কাটানো যায় যখন কয়েক প্রশস্ত রাত্রি এবং অনাহারে কাটানো যায় কয়েক তুচ্ছ মাঝারি জীবন। ফুসফুসের কষ্টে ভোগা রজনী, তৃষ্ণাতুর বালকের গড়াগড়ি করা। এ সবই জরাজীর্ণ মূর্তির সবল পরশ্রীকাতর কামনার ফসল।


পাপ
অপু সরকার

ভালোবেসে বিছানায় গেলে পাপ হবে!
তোমার হবে যা, তাও কী আমার?
কোন এক সূর্য খুনের পরে
বুকের ভেতরে লেগে থাকা তামাটে অন্ধকার
আমি ভাবি; তুমি কার !
আমি কার !
আমাদের পাপগুলো
কীভাবে কেন শুধু আমার।
এভাবে দিন গেলে
নিঃসঙ্গ হতে আর কতো দেরী?
সঙ্গী কী কখনো ছিলে আমার ?
জলের প্রথম ভাগে পাপ ধুতে যেয়ে
হে প্রতিবিম্ব সঙ্গী প্রশ্ন আমার...




শব্দের পাঠ
মীর সাহাবুদ্দীন

পৃথিবীর মুদ্রনচলে
প্রতি পৃষ্ঠা জুড়ে পাঠ হয় উচু উচু দালান।
এ বাংলায় ধান, পাট নিচু হতে থাকে
ডুবতে থাকে রেডিমেড গার্মেন্টস।
মানুষ গুলো ছুটে চলে আরব, নিউইয়ার্ক,
লন্ডন বা আরো কোন প্রবাসী পথে
চিটা ধানের মত ঝড়ে পরে উড়ে চলে বাতাসে বেগে...
তবুও কম্পন বাড়তে থাকে,
গাড়ির হর্ন ছুতে থাকে বহুতল ভবন।
জাপানের উপকূল বা দক্ষিণ প্রশান্ত
পাঠ না হতেই ফেটে যায় লাভা
আমাজানের গভীরের মতই মধ্যে
দুপুরে শব্দগুলো দ্রুত ছুঁতে পেয়ে বাংলা
ধান গম কিংবা জবের মাঠগুলো হয়ে উঠে উত্তপ্ত বালি।



ভরাডুবি
অভিষেক ঘোষ

প্রত্যুষের বিভূতি ছড়ানো, আভিজাত্য
আলোতে মাখামাখি নৈঋত কোণ
ঘেঁষে বয়ে যাওয়া আমার কল্পনার নদীতে
ভ্রাম্যমাণ শখের পানসীটার
ভরাডুবি ঘটলো আকস্মিকভাবে।।


পথিক
পাপুল চৌধুরী

অজানা দূরের দেশে আমি এক গন্তব্যহীন পথিক,
হাঁটিতেছি অচেনা পৃথিবীর পথে ভাগ্যের সন্ধানে,
সমাপ্তির জীবনে অসমাপ্ত ইচ্ছে পূরণে;
দিগন্তরেখার সীমান্ত পানে খুঁজেছি অবিচল, চির প্রশান্তির স্থল।
পথে মাঠে ঘাটে, সুদূর সাগর ললাটে
হেঁটেছি বহুদূর, চির প্রশান্তির খোঁজে;
ভোরের সূর্যোদয় থেকে, প্রিয় গোধূলির সাঁঝে
খুঁজে খুঁজে নিরাশায়, আমি আজ ক্লান্তির দলে।
পথকেই বানিয়েছি আশ্রয়, দুদ- বিশ্রামের ছলে
শয্যাতল রেখেছি মাটি,উপরে নীল আকাশ পরিপাটি।
আহার করিবো কিসে! ক্ষণিকের তৃষ্ণা মেটাই
অপূর্ণ এক ঘটি জলে।
চোখের চাহনিতে ঝাঁপসা আলোয়,
স্বলকিত জ্যোৎস্নার পর, নিশিথের কালোয়;
তবুও খুঁজেছি, খুঁজে চলেছি পৃথিবীর দ্বারে
চেয়েছি অনুরোধে, কড়া নেড়েছি শান্তির দুয়ারে;
আমায় একটু শান্তি দাও! হোক না সে ক্ষণিকের
তবুও আমার চাই; কিন্তু সে কোথায়?
চারদিকে শুধু হিংসা আর প্রতিহিংসার আগুন;
জ্বালিয়ে দিচ্ছে বিবেক, জ্বলছে মনষত্ব পৃথিবীর রোষানলে!
প্রেমিকের ভালোবাসায়, আসেনা প্রেম বসন্তের ফাগুন।
এ কেমন স্বার্থান্বেষী পৃথিবী!
চির প্রশান্তির আশায়, যেদিকেই তাকাই
শেষ থেকে সূচনায়, শুধু স্বার্থের সমারোহ;
স্বার্থান্ধ মনুষ্য কূলে, হিংসা- প্রতিহিংসা ভুলে
খুশির বার্তাবাহী প্রতিটি ফুলে,
এই তৃষ্ণার্ত মনের সাধ মেটাবো;
এমন দুদ- শান্তি এই পৃথিবীর কোথাও নাই।



একবার যদি ডাকো
অনার্য আমিন

একবার যদি ডাকো দেখবে তুমি
কতোটা উচাটন হৃদয় আমার
কতোটা কাঙাল ভালোবাসার।

দেখবে তুমি রিক্ত ভূমি
সেজেছে আবার সবুজে
ফুল ফুটবে; মধুপায়ীর অবাধ বিচরণে
মাতবে মালী।

শত কষ্ট ভুলে ছুটে চলে আসব
ছুঁতে সেই প্রণয়ের মুকুট।

একটি ডাক পেলে সবকিছু ফেলে
পাড়ি দেব সাত সমুদ্দুর,
হবো নাবিক নয়তো পাখি
দেখবো তোমায় ভালোবাসায়
জুড়িয়ে যুগল আঁখি।


বৃষ্টি সেতো কবেই থেমে গেছে
ঊষার মাহমুদ

ঝুমবৃষ্টিময় একটি দুপুর গুঁজে রাখি হৃদয়ের সিলিং জুড়ে;
খোলা বাতায়ন, উন্মুক্ত পথ; স্নিগ্ধবাতাসে বোতাম খোলা বুক।
ভেজাকাকের নয়নের কাতরতায় ভরাডুবি স্বপ্ন আমার;
দেয়ালের কার্নিশে বেড়েউঠা বটপাতার সংসারে
আটকে থাকা দৃষ্টি হতাশার ঘোর।
যোগল পাখির লেনাদেনায় ইচ্ছেগুলো ফেরারি হয়
অস্তিত্ব জুড়ে অচেনা স্পর্শে মাতাল ঘোড়ার ছুটেচলা;
বৃষ্টি, তুমি আরো জোরে আসো, অন্ধকার করে আসো
একটি লালশাড়ি আর নীল শার্টের বিনিময় হোক তোমার গভীরতায়....
চড়–ই পাখি উড়ে যাওয়ার শব্দে ধ্যান ভাঙে, 
বৃষ্টি সেতো কবেই থেমে গেছে, দ্যাখো, 
বাঁশপাতা চুয়ে চুয়ে এখনো ঝরছে জল কণা;
আমার আকাঙ্খা শেষ হয়েও হয়না...


অণুগল্প- বিলকিছ

অণুগল্প- বিলকিছ


বিলকিস
অনন্ত পৃথ্বীরাজ

বিলকিসের বয়স সাত বছর। তবে ওর কোনো জন্মদিন পালন হয় না। সবাই যখন স্কুলে বান্ধবীদের বার্থডে উইস করেÑ তখন ওর খুব মন খারাপ হয়। বিলকিসের বাবা মা কেউ নেই।
বিলকিস গ্রামের এক কোণে  নানির সাথে থাকে। ওর  নানিও খুব অভাগী। কলেরা রোগে আপন সবাইকে হারিয়েছে। নানি অন্যের বাড়িতে সারাদিন কাজ করে। বিলকিস স্কুলে যায়। বাড়ির সব ছোট ছোট কাজ সে একা করে। নানি তাকে সব কাজ শিখিয়ে দিয়েছে। তবে সে আগুন আর পানির কাছে ঘেঁষে না। বিপদ হতে পারে।
 বর্ষাকাল। খুব বৃষ্টি। বিলকিস স্কুলে যায়নি। ঘরের মধ্যে একাকী তার ভালো লাগছে না। বৃষ্টি থেমে গেলে সে বাইরে বেড়িয়ে আসে। একদিনের বৃষ্টিতে চারদিকে যেন বন্যা হয়ে গেছে। অনেকেই মাছ ধরছে। ছোট বড় কত রকম মাছ।
হাঁটতে হাঁটতে বিলকিস রেললাইনের কাছে চলে আসে। সামনে নদী। রেলসেতুর নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে পানির প্রবাহ ছুটছে। সারাদিন বৃষ্টি ছিল। আজ এ দিকটায় কেউ আসেনি। এখন তার রেলগাড়ি দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
বিলকিস দেখতে পায় তীব্র ¯্রােতে রেলসেতুর পাশে মাটি সরে গেছে। চাপচাপ মাটি ভেঙ্গে পড়ছে নদীতে। রেললাইন আগলা হয়ে ঝুলে আছে। বিলকিস ট্রেনের হুইসেল শুনতে পায়। সে দূরে রেলগাড়িটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এখন কী করবে সে ঠিক বুঝতে পারছে না!
সর্বনাশ! এখন সেতুর উপর ট্রেন উঠলে সেতু ভেঙ্গে সবাই মারা যাবে। বিলকিস আশেপাশে কাউকে দেখতে পায় না। এখন সে কী করে! কিন্তু এত ভাবনার সময় এখন নাই। সে একটু সামনে এগিয়ে যায়। পরনের লাল জামাটি খুলে উঁচু করে তুলে ধরে।
রেল চালক সামনে লাল বিপদ সংকেত পেয়ে ট্রেন থামিয়ে দেয়। নির্ঘাত দুর্ঘটনা হাত থেকে ট্রেনটি রক্ষা পায়। বেঁচে যায় শত প্রাণ। তখন বিলকিসের আনন্দ যেন আর ধরে না!
উপদেশ : আমরা সর্বদা ভালো কাজ করার চেষ্টা করব।

গল্প- মাকাল ভ্রমর

গল্প- মাকাল ভ্রমর




মাকাল ভ্রমর
বিবিকা দেব

নূর খালেক ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে । খুশিতে গদ গদ হয়ে বাঁশ ঝাড়ে একটা সোমত্ত বাঁশ কাটতে গেলেন । সামনে যাকে পাচ্ছে খুশির সংবাদ মুখে মুখে প্রচার করছে । নিকষ কালো রাত শেষে নতুন ভোরের মতো তার একখানা পুত্র সন্তান জন্ম নিয়েছে । তার আগের বার একটা মেয়ে জন্মে ছিল । মেয়ের নাম রেখে ছিল জুঁই ফুল ।  নূর খালেক ফুল বড় ভালোবাসে । যদিও পৃথিবীতে কোথাও পাওয়া যাবে না , এমন ব্যক্তি যেই ফুল ভালোবাসে না । ছোট বড় সকলেই ফুল খুব ভালোবাসে । ছেলে জন্মেছে বলে আনন্দে আহল্লাদে আটখানা । মেয়ে জন্মেছে শুনলে মনে হয় মেয়ের মুখ দর্শন করতো না । এই গ্রাম থেকে আশে পাশে প্রায় পাঁচ গ্রামে চাউর হয়ে গেছে । গোদা নূর খালেকের ঘরে পুত্র সন্তান জন্মেছে । এই গোদা নামটা নিয়ে নূর খালেকের ভারী আপত্তি । কে যে এই নামটা প্রচার করেছে । আজো নূর খালেকের অজানা । যাক ! এই নাম নিয়ে আপাতত কোন মাথা ব্যথা নেই ।
নূর খালেক এখন বেজায় খুশি । বাপ দাদার পর বংশ পরম্পরায় সেই সহায় সম্পত্তি পেল । তাতে খেয়ে পরে দিব্যি বেঁচে থাকা যাবে । কোন ধরনের অভাব থাকবে না । তবু নূর খালেক কৃপন ! ছেলে হয়েছে বলে পাড়ার সবাই ছেলের বাপকে উদ্দেশ্য করে বললো কি মিয়া, পয়লাবার মেয়ে ছিল কিছুই খাওয়ালে না । এই বার ছেলে আসলো । মিষ্টিমুখ করাও । নূর খালেক হ্যাঁ সূচক উত্তরে বললো । তা বাদ থাকবে কেন , নিশ্চয় মিষ্টিমুখ হবে । তবে দোয়া করেন চাচা ছেলে যেন আমার বীর হয় । বিকাল বেলা বাজার থেকে ফেরার পথে হিসাব কষতে থাকে ।  রসগোল্লা খাওয়ালে কত খরচ পড়বে । হাঁটার গতির প্রতি কদমের তালে তালে হিসাব করে । যদি রসগোল্লা খাওয়াই তাহলে পকেট থেকে নতুন কড়কড়ে হাজার টাকা বেড়িয়ে যাবে । আর জিলাপি, কচরি খাওয়াই তাতে খরচ কম পড়বে । কিছু অর্থ নিজের সঞ্চয়ে থাকবে । বাড়ী ফিরে উঠোন থেকে হাঁক ডাক শুরু করে । কইগো আমার মা, আমার জুঁইফুল কোথায় ?
বদনা করে পানি দিয়ে গেল শেফালী । শেফালী নূর খালেকের শ্যালিকা । বউয়ের নাম শিউলী । দুটো ফুলের নাম পছন্দের তালিকায় আছে । বউটা সুন্দরী বটে , বাচ্ছা দুটো জন্মানোর পর রুপের ভাটা পড়েছে । আগে ছিল বাঁধানো শরীর । সারাদিন খাটা খাটুনির পর রোদে গায়ের ঘাম পিছলে পড়তো । দেহখানা খাঁটি সোনার মতো চকচক করতো । এখন সেই সৌন্দর্য নেই । তবু শিউলীর মুখটা ভরাট ও মায়াতে পরিপূর্ণ ।
হাত মুখ ধুয়ে বেশ পুরানো গামছা দিয়ে মুখ মুছে বউয়ের পাশে মোড়া পেতে বসে । শিউলী তখন পরম মমতায় বুকের অমৃত পানে ব্যস্ত । ছেলের বাপ আসাতে শাড়ীর আঁচলটা সরিয়ে কচি মুখটা দেখিয়ে বলল, দেখো তোমার ঘরের মানিক , তোমার সন্তান এবং বংশধর । খুশিতে আত্মহারা নূর খালেক বলে হ... আমার বাপজান আইছে আমাকে শাসন করবার লাইগা । আমার বংশের বাতি । এই সময়ে শেফালী চা নিয়ে হাজির । মৃদু হেসে হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চা পান করে । দেখ শেফালী, আমার বাপজানের মুখ চান্দের লাহান । যেন চান্দের আলো ফকফকা হইয়া মাটিতে পড়ছে । এবার যাই গ্রামের সকলের জন্য একটু মিষ্টি মুখের ব্যবস্থা করি । আমার অনেক কাজ পড়ে আছে । নূর খালেক আঁতুড় ঘর থেকে বের হয়ে গেল । শেফালী বড়ো বোনের জর‌্য গরম ভাতের সাথে কচি লাউয়ের তরকারি খেতে দিল এবং বললো বেশী করে খেতে হবে । তুমি খেলে বাচ্চার শরীর ঠিক থাকবে । উত্তরে শিউলী বললো পাকা বুড়ি হয়েছিস না । এই সব কথা কোথা থেকে শিখলি । কেন আপু মা বলেছে এই সব কথা ।


জুঁই মায়ের কাছে আর ঘেষে বসে না । কিছুটা দূরত্বে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে । একবার মাকে দেখে , আরেক বার মায়ের খোলে ভাইটাকে দেখে । শিউলী বললো জুঁই এসো । দেহো তোমার ভাই তোমার দিকে চাইয়া আছে । জুঁই কিছু বলে না । অনড় হয়ে আছে । মায়ের ডাকাডাকিতে চুপটি করে বসে । এক হাতে ছেলে ঘুমাচ্ছে, অন্য হাতে শিউলী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পরম ¯েœহ মমতায় । অনেক দিন হয়ে গেছে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে না ।
জুঁই ছোট খালা শেফালীর সাথে ঘুমায় । শেফালী রাতের খাবার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত । এমন সময় নূর খালেক এসে জিলাপি ও কচরি  এনে বলে শেফা... ও ...শেফা... এই গুলান ধরোত । হাত আমার বেদনা হয়ে গেল । নূর খালেক কয়েক দিন ধরে শেফালীকে শেফা বলে ডাকে । শেফা নাম স্বামীর মুখে এই প্রথম শুনলো । মনে মনে ভাবলো নিজের কোন ছোড বইন নাই । তাই বোধয় আদর করে শেফা বলে ডাকে । সে স্বামীকে কিছুই বললো না । শেফালী প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে বলে এই গুলো আমি কি করবো ? কি করবা মানে ! গ্রামে সকলের ঘরে ঘরে পাঠায়া দিবা । আর লগে বলবা যেন আমার ছেলের জন্য দোয়া করে । বুঝছো , নাকি আবার বলতে হবে । শেফালী হ্যাঁ সূচক বললো জি বুঝেছি আর বলতে হবে না ।
আমি এক্ষুণি যাচ্ছি । তয় এত রাতে আমি একা যামু । আপনিও সঙ্গে চলেন । আপনি সাথে থাকলে আমার ভয় ডর কিছুই লাগবো না ।
কি বলো শেফা দেহো বাইরে দুধ শাদা চাঁদ উঠছে । চারদিকে ফকফকা আলোর নাচন । আর তুমি কিনা ভয় পাও ।
হেইডা ঠিক আছে তয় আপনি আমার লগে যাবেন । না হয় আমি একা একা যাইতে পারুম না ।
ঠিক আছে । লয় এহন যাই । হাতে জিলাপি ও কচরির প্যাকেট সমেত দুজনেই রওনা দেয় । যাওয়ার সময় শেফালী বোনকে খাবার দিয়ে যায় এবং আরো বললো বুবু তুমি তাড়াতাড়ি খাইয়া ঘুমাইয়া পড় । রাত জাইগো না । শরীর খারাপ হবে । আমি আর দুলাভাই যাচ্ছি মিষ্টি বিলি করতে । আমরা জলদি ফিরা আমু । উত্তরে শিউলী বলে যা তাড়াতাড়ি আইসো ।
শেফালী ও নূর খালেক একসাথে বের হয় । যথা শীঘ্রই মিষ্টি বিলি করে বাড়ীতে ফিরে । আসার সময় নূর খালেক বলে আচ্ছা শেফা আমি মানুষটা কি বদ ?
এই কথা কইলেন ক্যান ?
না এমনি কইতাছি। শেফা তুমি খুব সোন্দর ।
হ দুলাভাই । সকলে এই কথা কয় আমি নাকি সোন্দর আছি ।
ক্যান শেফা তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো না ।
করি তো । আপনি হইলেন গিয়া এক নম্বরে খাঁটি মানুষ । চাঁন্দের আলোয় শেফার মুখখান দুধের সরের মতো জমে আছে । আরো বেশি মায়াবী দেখাচ্ছে । কারো মুখে কোন বাক্যর ব্যবহার নেই । নিস্তব্ধ নির্বাক্ তাকিয়ে আছে ।
একসময় মৌনতা ভেঙে দুজনেই বাড়ী ফিরে আসে । শেফালী রাতের ভাত খেয়ে চটজলদী ঘুমিয়ে পড়ে । এপাশ ওপাশ করে কিন্তু চোখের পাতায় ঘুম আসে না । অনেক চেষ্টা করে কিছুতেই ঘুম আসে না । পাশে জুঁই ঘুমিয়ে আছে । গভীর ঘুমে জুঁইকে আরো বেশী সুন্দর দেখাচ্ছে । মনে হচ্ছে চাঁন্দের দেশের রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে আমার পাশে । জুঁইয়ের ঘুমের মৃদু মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দে শেফালী অনেক দূরে নিজেকে নিঃশ্বাসের পতঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । শেফালী গ্রামের আর দশ জন সুন্দরী মেয়েদের একজন ।
প্রথম যৌবনে শাহীন নামে প্রতিবেশীর মন কেড়ে নেয় । নিতান্তই চোখে চোখে এক পলক দেখা তার বেশী কিছুই নয়। মনের মধ্যে জমিয়ে রাখে একান্ত আত্মকথা । শাহীন ও কোন উদ্যোগ নেয় নি । ভাটা পড়ে এক তুবড়ি প্রেমের । আরো বিগত কিছু দিন পরে বড়ো বোনের বাড়ীতে রওনা দেয় । বড়োবোন গর্ভবতী তার দেখাশুনা  করার জন্য অস্থায়ী  ভাবে আছে । কয় মাস থাকতে হয় জানি না । অনেক দিন থাকাতে ঘরবাড়ী, গাছপালা, পুকুর, গরুবাছুর, মানুষজন সবাইকে আপন করে নিয়েছে । দিন কাটতে থাকে হাসিতে খুশিতে । বড়ো বোনের ছেলে হয়েছে । তাই আরো বেশী আনন্দে আছি । আত্মীয় স্বজন দুলাভাই সবাই খুশি । তবুও কোথাও শূন্যতা বিরাজমান !
চৈত্রের খাঁ খাঁ করা রোদ্দুর প্রভাব পড়েছে হৃদয়ে । যেন প্রথম বৈশাখী ঝড়ের এক ফোঁটা বৃষ্টির সজীবতা জীবনে আসবে । এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না । খুব ভোরে আকাশের এক চিলতে ফর্সাভাব বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি দেয় । তখন দড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসে । সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি ভর করে সারা শরীরে । ঢুলুঢুল চোখে প্রত্যহ কাজ করতে এগোয় । অবসন্ন বিষাদ মন ছুটে চলে শাল হিজলের বনে । ভরা পূর্ণিমা রাতে আকাশের চাঁদ অন্য রাতের থেকে আলাদা হয় । চাঁদের ষোলকলা পরিপূর্ণ । তেমনি এক চাঁদনী রাতে নূর খালেক শেফাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে ।  এবং বললো শেফা... ও শেফা... তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো ?
শেফালী ঘুম থেকে উত্তর দেয় জি শুনতে পাচ্ছি । তয় এতরাইতে আপনি না ঘুমাইয়া এইহানে কি ? নূর খালেক বললো কথা আছে বাইরে চলো । শেফালী বললো বাহিরে ক্যান যামু । নূর খালেক বলে বাহিরে এসে দেখ, আকাশে কি সোন্দর চাঁন উঠছে । না দেখলে আপসোস করবা । আপত্তি থাকার শর্ত্বেও শেফালী ঘুম থেকে উঠে । বাহিরে এসে শেফালী সত্যি অবাক হয়ে যায় । চাঁদকে কোন দিন এত গভীর রাতে উপভোগ করেনি । শেফালীর প্রতিমুহূর্ত গুলো ভালো লাগছে । নূর খালেক আরো বললো চলো সামনে হালদা নদী । নদীর বাঁকে চর জেগেছে । সেখানে একটি নৌকা বাঁধা আছে । তুমি আমি নৌকায় ঘুরে বেড়াব ।
দুরু দুরু বুকে শেফালী এগোয় দুলাভাইয়ের সাথে । বড়বোন শিউলী সন্তান বুকে পরম তৃপ্তিতে ঘুমোচ্ছে । এখন শেফালীর নূর খালেককে বোনের স্বামী হিসেবে মনে হয় না । চারদিকে চাঁদের দুধ শাদা জোসনা আলোকিত । নৌকায় উঠে শেফালী নদীর স্বচ্ছ জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নেয় । আরো মোহনীয় মায়াময়, দেখে বাতাসের আলিঙনে নদীর মৃদু মৃদু ঢেউ । চাঁদের রুপালী আলোয় ভাসমান । দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে । নূর খালেক বললো কি হইচে তোমার আমার লগে ঘুরতে শরম লাগে । শেফা আরো কাছে আসো । আমি তোমার শরম দূর করে দেবো । এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে নূর খালেক একজন প্রেমিক । যার স্পর্শের জন্য অনাদিকাল অপেক্ষায় থেকেছে ।
দুটো হৃদয় কাছাকাছি এসে নিবিষ্ট হতেই শরীরে লোমকূপে উদ্মাদনায় তরঙ্গে দুকুল ভাসিয়ে প্লাবন প্রবাহিত হয় । মানবে না কোন বাঁধা কেবল অথৈই প্লাবন । হঠাৎ বাচ্ছার কান্না শুনে শিউলী ঘুম চোখে ডান হাতের স্পর্শে ছেলের নকশী কাঁথার ছোপ ছোপ পানির স্বচ্ছ ধারা । তাড়াতাড়ি জবজবে ভেজা নকশী কাঁথা পরিবর্তন করে । কচি দুটো ঠোঁটের স্পর্শে অমৃত পানে আঁচলের নীচে আবদ্ধ । মা এবং ছেলে ঘুমের অতল গহ্বরে আড়াল হয় । এদিকে ভোর আসন্ন । শেফা নিজেকে ছাড়িয়ে শাড়ীটা ঠিক করে । বাড়ীর পথে পা বাড়ায় । শাড়ীর আঁচল টেনে ধরে নূর খালেক । অনেক দিন পর একটু তৃপ্তির স্বাদ পেলাম । লজ্জা রাঙানো মুখে শেফা কিছু বলতে পারেনি । শুধু শরীর জুড়ে কাঁপুনি । এত কাঁপুনি যে কোথায় থেকে আসে নিজেও জানে না ।
সকাল বেলা বিছানা ছাড়তেই শেফালী বুঝতে পারে শরীরে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে । তখনি মনে পড়ে গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা । তবুও কষ্টে রান্না করে বড়বোনকে সকালে খাবার দিতে যায় । হটাৎ শিউলী জিজ্ঞেস করে শেফা তুই কি রাতে ঘুমাসনি ? চোখ মুখ ফোলা ফোলা ক্যান ? শেফালী মাথা নিচু করে বলে কিছু না আপা । রাতে ঘুমাতে গিয়ে মা-বাবা ভাই সবার কথা মনে পড়ে । আসলে এহানে মেলাদিন আছি । তাই ওদের জন্য মনটা কেমন যেন করে । তাই ঘুম কম হইছে । ও কিছু হবে না । বুঝেছি দাঁড়া । তোর দুলাভাইকে দিয়ে খবর পাঠাব । মা-বাবা যেন আসে । তাহলে তোর ভালো লাগবে । কি বলিস ? জি আপা । তুমি যা ভালো মনে কর । শেফালীর মনে ভয় এবং লজ্জা ঢুকে পড়ে । কি করবে শেফালী বোনকে সব কিছু খোলে বলবে না গোপন রাখবে । অস্থিরতায় ভুগতে থাকে । এভাবে মাসের পর মাস পেরুতে থাকে । এদিকে নূর খালেকের প্রবৃত্তির ক্ষুধা দিন দিন বাড়তে থাকে । শেফালী রাতের পর রাত নিজেকে উজাড় করে । বোনের শিশু পুত্রটা বড় হতে থাকে ।
বড়বোন আগের তুলনায় অনেক সুস্থ । একটু মোটা হয়ে গেছে। তবে আগের থেকে মুখের লাবণ্যতা বেড়েছে। আর এদিকে শেফালী ধীরেধীরে মলিনতা ও দুর্বলতা বেড়েছে । তলপেটে যেন কারো বসবাস শুরু হয়েছে । মাঝে মাঝে এমন মোচড় দেয় যে, শরীরের নাড়িভুড়ি এখনি বেরিয়ে আসবে । খাবার খেতে পারে না ঠিক মতো । কাউকে কিছু খুলে বলতে পারে না । গোপান কথা গোপন রয়ে গেল । হঠাৎ একদিন সকালে ছোট ভাই সোহেল উপস্থিত । শেফালী বুঝতে পারে সোহেল তাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবে । বিকেলে নিজের জামা কাপড় গুছিয়ে ভাইয়ে সাথে বাড়ী ফিরে যায় । শেফাকে দেখে মা বলে কি রে , তোর কি শরীর খারাপ ? প্রতিউত্তরে শেফালী না বলে । তাহলে মুখ চোখ এত শুকিয়ে গেছে ক্যান ? শেফা বললো তেমন কিছু হয়নি । আসলে অনেক কাজ করছি । ছেলে জন্য রাত জাগছি আর অনেক দিন পর বাড়ী আসছি । তো তাই তোমার এই রহম মনে হইতেছে । আইচ্ছা যা আর কিছু বলা লাগবে না । ভাত রান্দা আছে খাইয়া ঘুমাইয়া পর সব ঠিক হইয়া যাইবে ।  
আসার বেশ কয়েক দিন পর শেফালীকে ঘন ঘন বমি করতে দেখে । খাবার খেতে দিলে বলে আমার খেতে ভালো লাগে না । ঘরের কাজ তেমন করে না । উদাস হয়ে বসে থাকে । কখনো ঘুমিয়ে থাকে । মায়ের মনে সন্দেহ হয় । পলকা শরীরটা দিনদিন বাড়তে থাকে । পেটটা ফুলে উঠে । হঠাৎ একদিন শেফালী দুপুর বেলা শুয়ে আছে । মা চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে বললো হারামজাদী বল কে তোর সর্বনাশ করেছে ? আইজকে তোকে মেরেই ফেলব । বংশের মুখে চুনকালি দিলি । বিয়ে না হইতে পোয়াতি হইছিস । এই বাচ্চার বাপ কেডা হবে বল ? এই কথা উচ্চারণ করতে করতে সমান তালে মারতে থাকে । শেফালী নির্বাক্ তাকিয়ে আছে । চোখের কোণে কান্নার জল নেই । বাবা মাঠের কাজ শেষ করে দুপুরে বাড়ীতে ভাত খেতে আসে । দেখে শেফালী মাটিতে বসে আছে । মায়ের মুখ থেকে সব শুনে জিভ কামড়ে ধরে । যেন এখনি মৃত্যু হোক । মাটির সাথে মিশে যাক !
এক কান দুই কান করে সমস্ত গ্রামে শেফালী পোয়াতি হওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে । পুকুর ঘাটে, কলতলায়, গ্রামের বৌ-ঝিদের ফিসফিসানি শুরু হয় । এমনকি চায়ের দোকানে পর্যন্ত সমালোচনা হতে থাকে । নূর খালেক খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস । প্রথমে মাঠের ফসলি জমি দেখতে যাই। তারপর গোয়ালের বাঁধা গরু , পুকুর পাড় আশে পাশে ঘুরে বাড়ী ফিরে আসে । এসেই ছেলেকে কোলে নেয় । আয়েশ করে বসে চা-রুটি শেষ করে এবং পান চিবুতে থাকে । এমন সময় শশুড়-শাশুড়ী সাথে শেফা । শেফার চোখের নীচে কালি জমেছে । দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ঘুমাইনি । বুকে হাড় ভেসে উঠেছে । কিন্তু পেট ফুলে উঠেছে । শাশুড়ি ঘরে ডুকেই শিউলীকে ডাকে । শিউলী মা-বাবা আর ছোট বোন শেফাকে দেখে বলে তোমরা কহন আইছো ? কেমুন আছো ? মা-বাবা তোমরা বস । বোন শেফা তুই কেমন আছিস ? উত্তরে কেউ কিছু বলে না । সবাই চুপচাপ !
মা শিউলীকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে । ফোঁপাতে ফোঁপাতে বিলাপ করে আর কাঁদে । মায়ের মুখ থেকে সমস্ত কথা শুনে শিউলী নিস্তব্ধ হয়ে যায় । চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে । এত কিছু ঘটে গেল আমি কিছুই জানতে পারলাম না । মা বলল শেফাকে আমরা কিছুতেই বাড়ী নিয়ে যাবো না । নূর খালেক যখন এক মেয়ে ঘরে থাকতে আরেক মেয়ের দিকে নজর দিছে । নূর খালেক শেফার দায়িত্ব নিবে । শিউলী স্বামীর মুখোমুখি হয়ে বলে তুমি ক্যামুন পুরুষ মানুষ তোমার কোন ধৈর্য নাই । ঘরে বউ থাকতে তুমি শালীর দিকে নজর দাও । তোমাকে আমি খুব ভালো মনে করতাম । চরিত্রবান মানুষ বলে জানতাম । আর অহন তুমি ভালো মানুষের সুন্দর পরিচয় দিলে ?
আর কথা বাড়াইনি । এভাবে কেটে গেলো কয়েকদিন । করো সাথে কেউ কথা বলে না । বাড়ীতে কোন জনমানব নেই বলে মনে হয় । হঠাৎ ছেলেটা কান্নার শব্দ শোনা যায় । সকালে স্বামী নূর খালেককে উদ্দেশ্য বলে আমি তুমার কাছে থাকতে পারব না । তুমি আমার বইনকে নিয়ে থাক । সুখে সংসার করো । জুঁই আর ছেলেটা তোমার কাছে থাকল । আমি বাড়ী ছেড়ে চলে যাচ্ছি । ভেবো না বাপের বাড়ীতে যাবো । ছেলে মেয়ে বড় হয়ে যখন মায়ের প্রয়োজন হবে । তখন আমার কাছে যাবে । এই কয়েকটা কথা বলে এক কাপড়ে শিউলী স্বামীর বাড়ী ত্যাগ করে । পরের দিন সকাল বেলা  নূর খালেক আট মাসের পোয়াতি শেফাকে বিয়ে করে । একজনের হৃদয় নতুন কিছু পাবার আনন্দে পূর্ণ হলো । আর অন্যজন সব কিছু পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে গেলো । অন্ধকার কষ্টের অতল গহ্বরে ।