পদাবলি

পদাবলি



প্রদীপের সলতে
অসীম মালিক

অস্থির হাওয়ায় ,
লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে প্রদীপের শিখা;
শিখাকে নয় যেন হাওয়াকেই বরণ করে নিচ্ছে-
প্রদীপের সলতে...

নির্লিপ্ত সলতেটা পুড়ছে ,
যে হাত সলতেকে দিয়েছে দহন-
অদ্ভুতভাবেই তার হাতে এসে লাগছে;
অহংকারী শিখার আঁচ ।

বিশ্বাসের আগুনে হু হু করে ফুরিয়ে আসছে-
বুক থেকে সাঁঝ প্রদীপে গড়িয়ে পড়া ওম ।

নীরব শিখাটা লাফিয়ে উঠে গ্রহণ করছে ,
অস্থির সময়ের সাহচর্য...

শুধু একাকী দগ্ধ সলতে
মাটির প্রদীপের সাহচর্য পেয়ে
সন্ধ্যাকে শেখাচ্ছে দহন...

পায়ের কাছে
ঊষার মাহমুদ

মেয়েটা হেঁটে যায় পাহাড়ি পথে
নূপুরের শব্দে থেমে যায় পিঁপড়ার পা;
শালিক নয়নে স্বপ্নের কোলাহল!
বাতাস আর লাল আঁচলে শরীর খোলা বিকেলের সঙ্গম;
ঘাসফড়িং চিত্তের না বলা কথার আক্ষেপ
ঝরাপাতা হয় রোজ,
চঞ্চলা পা ছুঁয়ে যাবার অভিলাষে পথে বেঁধেছে ঘর...!

বড্ড বেখেয়ালি তবে চঞ্চলা বটে.
উড়ন্ত বলাকার বাঁকা সারিতে স্বপ্ন জমা রাখে.!
অথচ; বুঝেনা পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাতার আর্তনাদ ।

মেয়েটা কারণ হোক তীব্র কোলাহলের
সাদিক আল আমিন

উঠোনবাঁকা কোমরে নাচতে কেমন পারো?
হারিকেন রেখে যদি দেই টাটকা তেলের কুপি!
নাচবে কি বালিকা তুমি ? শেষ নিশিতে আরো?
এই সুবাদে মাল্লা-মাঝি, সর্দার-কাজি, বৌমা-বুড়ো
সবাই হলো জড়ো, নাচবে কি বালিকা আরো?

উঠোনবাঁকা কোমরে নাচতে কেমন পারো?
রুপোর ঘুঙুর দেখবে কি চেয়ে সোনারোদের আলো!
চোখের কোণে লুকোনো জল করবে কি টলোমলো!
চাইবে কি নিরীহ নদী, নিযুত বন্দরের ভালো!
নাচবে কি বালিকা তুমি? হাসবে খলোখলো?

এক বাংলাদেশ কিভাবে তুমি একাই কাঁপাতে পারো!
বুকের ভীরু ঘরের আমন্ত্রণ, ‘বাহির ঘরে চলো’
জলের নীচে চাঁদ উঠেছে, লাগছে কি যে ভালো!
তোমার আমার দস্যিপনা রুখবে কে আজ বলো
নাচবে কি গো তুমি? জোছনা রাতের আলো?


ঘ্রাণ
পরান জহির

খুপড়ির চারপাশে পালক ঝরিয়েছে কতিপয় জ্বালালী কবুতর। তুলতুলে ছানাগুলির চোখ ফোঁটেছে, তারাও শিখে নিয়েছে বাকবাকুম স্বর...

ঘুঘু সরিষার দানাগুলিতে লুকিয়ে পড়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ ঋতু। ডানায় ডানায় খচিত হয়েছে হীমবাহের কঙ্কাল; দু’হাতে আঁধার পোড়াই। তবু কি আর এত সহজেই মিটে পিতৃপ্রদত্ত ক্ষুধা? ভেসে আসে নাসিকামূলে ভূতুরে ছায়াদের অস্তিত্বের ঘ্রাণ। নির্মল চিন্তনছায়াগুলিকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত ছুরিকাঘাত করে কারা যেন পালিয়ে যায় ধুঁধু আঁধারের পথরেখা ধরে ।


শিরোনামহীন
পার্থ কর্মকার

চাঁদের মতোই একা আছি;
আলো ছড়াচ্ছি,
আবার আঁধারে হাড়িয়ে যাচ্ছি।
নিয়মিত না হলেও,
একটা আবর্তনের মধ্যে দিয়ে
পাড় করছি জীবন ।

অসুখ-বিসুখ
মাহমুদ নোমান

টাকি মাছের নাড়ানিতে বিলের জল ঘোলা
মিথ্যে বলো না-
শাপলা তুলতে গিয়ে হেঁটে গিয়েছো;
সূর্য ডিম ভাঙা হলে
আর অন্ধকারে পায়ের গোড়ালিতে
জোঁকে রক্ত চুষছে তাও জানলে না !

গাছ
মিসির হাছনাইন

আমার প্রেম, গাছের ফুলের মতো
স্বয়ং গাছ হয়ে- বছরের পর বছর
তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, তুমি আসো নাই;
মনে হয় পৃথিবীতে, এরচেয়ে বড় কষ্ট আর নাই।


শুধু তুমি আসোনি...
সুমন আহমেদ

লীলাবতী, মনে পড়ে সেদিনের কথা !
হাতে-হাত রেখে কুয়াশার চাদর জড়ানো শিউলি ঝরা
ভোরে- হেঁটে যেতাম দু’জন গায়ের সবুজ মেঠোপথে।
দূর্বাঘাসের আভায় জড়িয়ে থাকা শিশির বিন্দু;
ছুঁয়ে দিতো তোমার দুধে আলতা স্পর্শহীন দু’চরণ।
ভোরের সূর্যটাও আর নিজেকে আড়াল করে রাখতে পারতোনা,
তার সোনালি রোদ্দুর মিষ্টি কিরণে রাঙিয়ে দিতো তোমায়।
তোমার অঙ্গে জড়িয়ে থাকা লাল-সাদা শাড়ির মুগ্ধতা,
আর মৃদু সমীরণে ভেসে যাওয়া খোলা চুলের গন্ধ
বড়ই প্রানবন্ত লাগতো সেই মূহুর্ত গুলো।
জানো লীলাবতী,
আজ আবার সেই মূহুর্তটা ফিরে এসেছে; শুধু তুমি আসোনি।

বিচ্ছেদ
সুমনা পাল

‘তুমি’ শব্দে বিচ্ছেদ বেশি।
আমি দেখেছি,বহুবার।
আমার অসংখ্য প্রেমিকের সাথে
বিচ্ছেদ হয়েছে ‘তুমি’ শব্দে।


তোমার সন্তানেরা কোন পথে হাটবে ?
ইকরামুল হাসান শাকিল

আলতা রাঙা নগ্ন পা এখন আর নেই তোমার
বিকাশিত হয়েছে তোমাদের সভ্যতা
উন্নত হয়েছে মর্যদা
আজ তোমরা নও ভিন্ন সমাজের বাসিন্দা
ভবিষ্যৎ উজ্জল নিঃশ্চিতÑ
রাজনৈতিককর্মী, সমাজকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, নাট্যকর্মী
ইত্যাদি ইত্যাদি কত শত  কর্মী-
তেমনি তোমার নামের পদোন্নতি হয়েছে।
আজ আর তোমরা বেশ্যা  কিংবা পতিতা নও
নবসংস্কারে নাম হয়েছে যৌনকর্মী।
গাঢ় মেকাপের আড়ালে এইডসের
মরণ ভয়কে করেছ জয়
তোমার সভ্যতা বিলীন হবার সম্ভাবনা নেই
তোমার সন্তানেরা কোন পথে হাটবে ?


তৃতীয় কার্ড
মীর সাহাবুদ্দীন

লঞ্চ বা ট্রেনের মতই ঘুরে বেড়াই
আজ আর কেউ বলেনা দাড়াও
গন্তব্যে একবার ফিরেই গান ধরে ছুঁটছি
এখন আর আমার নিজস্ব আলো নেই বলে
শেষ রাতের আলো থেকে ধার নিয়ে
কচি ধান গাছের মধ্যে হেঁটে নিজেকে ভেজাই।

জানি এ পথে তুমি হেঁটে যাও
খোঁজ আমায়, ভাব শীত বসন্ত বা দ্বিতীয় ফাল্গুনে।

সূর্য উঠলে হাসগুলো পুকুরে নামে
আমি অন্ধকারে ফিরি
তোমার ভরপুর আলো নিয়েও ঘরে বসে ভুল তাসে
রঙের বাসর সাজাও।
অথচ আমিও কখনো কার্ড ছিলাম !

গুচ্ছকবিতা

গুচ্ছকবিতা


গুচ্ছকবিতা
নাবিল তুরাব


বাহুমূলপীড়িত কম্পন

তোমার বাহুমূলের অতি নিবিড়ে সন্ধ্যাতারার মতো শতবর্ষীয় প্রেম দেখতে পেয়েছিলাম, যা অঙ্কুরোদগম হয়ে জোরালো স্বপ্নের মতো তীব্র কম্পন সৃষ্টি করেছিলো আমার হৃদযন্ত্রে, উদ্যত পেশীকোষে। এমনই প্রবল যাচ্ঞা ও ঝঞ্ঝায় আর সুচিন্তিত কামনায় পুরোটি দিবস-রাত মধ্য দিবাকরের মতো আমি জ্বলেছিলাম, কামনায়, প্রচ- দাপুটে কামনায়।



বৃক্ষপত্র

কোনো কোনো বৃক্ষপত্র ঝরে যায় অকালে,
গভীর সম্ভাবনাময় এবং বহুদূর এগুনোর কথা যার।
যেহেতু শীতের রাতগুলো কষ্টের, নিয়তি বড়ো নির্দয়;
এবং বৃষ্টিফোটাগুলো ঝরে পড়ে কম্বলে।
ফলত, এক একটি মানুষ একএকটি বৃক্ষপত্র।

গ্রাম ও শহর

আনন্দচিৎকারে এক ঝাঁক শালিক উড়ে যায়,
পাকা ধানের মাথায় পোকারা বসত গড়ে,
আর আমি কথানির্ভর বিশ্বাসে দু’িট কবুতর উড়িয়ে দিই শূন্যে।
দুঃখিনী মায়ের মতো যদিও গ্রামটি শব্দহীন অথবা বোবার মতো যদিও ভাষাহীন প্রতিবাদী;
কিন্তু, মা-প্রকৃতি জানেন, শহর কখনো গ্রামের
অপার সৌন্দর্য বা রক্তঝরা ঘামের চিহ্ন বয়ে চলে না, চলতে পারে না।

স্বপ্নমুখর লাশ 

ভেজা নর্তকীর মতো আমাদের সড়কে একদিন ঢুকে যায় প্রবল কৃষ্ণ তুফান, কম্পমান দালানকোঠাগুলির গায়ে লাগে আসন্ন ধ্বংসের ঝড়োহাওয়া; আকাশে চাপা-কালো মেঘ। বাস ট্রাক রিক্সা সবই জলের নিচে চাপা পড়ে যায়। একটি চড়ুইদম্পতি আর দু’চারটি অভিজাত কবুতর তাদের জীবনের অবিশ্বাস্য মৃত্যু দেখে কোনো রকমের পূর্বকসংকেত বা অ্যালার্মছাড়াই তোলে এক সুখদ গভীর প্রার্থনা। চলমান  ট্রেন তার যাত্রীদের উগলে ফেলে ঘোষণা করে অনির্দিষ্টকালের কিম্ভূত হরতাল; ডুবন্ত লালচে ট্রেনলাইন। ঘাটের নৌকো আর ঘাটে ফেরে না; তলিয়ে যায় ভাটিয়ালি গানের পদ্মার মাঝি। ধ্বংসস্তুপ থেকে আবিষ্কার হয় এক একটি স্বপ্নমুখর লাশ।


আগন্তুক সকালে একদিন

মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বাদলা সকাল, প্রতœভাষার মতো সগৌরবে ক্ষণেক্ষণে করে মিছিল।
বলে, এ আকাশ আমার, এ বাতাস শুধুই মরীচিকা, যখন তারকাবিদরা চিৎকার করে ওঠে।
কিন্তু হ্যাঁ, এ কাঁটাতারের ভূলোক তোমার নয়।
ও উত্থিত সত্য, দেখা হয় না কখনো পরমাদরের কল্পিত শহর?
পাকশালায় অনাহারী ভুবন আর একটি একাহারী চামচ পড়ে থাকে।
কে তুলবে তাকে? কার হয় অমন দরদ?
টেবিলে ভেসে থাকে কিছু প্রাচীন নোটপ্যাড, সোফাসেটে গতকালের না পড়া বাসি পত্রিকা।
অমন ঘৃণার সকালে পত্রিকা হাতে নিতে কারো ইচ্ছে হয়?
মৌমাছি এসে বসুক আমার চেয়ারে, হতাশাগুলো চুষে খাক। আমায় একটু বিষমুক্ত করো মাছি!
দু ঘণ্টা ধরে খোলা পড়ে থাকা অপঠিত পাঠ্যবইয়ে মাকড়সা বাসা বাঁধুক, আমার আপত্তি েেনই।
আজ দিন নয় আপত্তি করার।



গল্প- একজন রব মিয়ার গল্প

গল্প-  একজন রব মিয়ার গল্প


 একজন রব মিয়ার গল্প         
 টি এম আমান উল্লাহ্

চারিদিকে বানের পানি থৈ থৈ করছে। এবার আগাম বন্যা হয়েছে। গ্রামের সবার ধান ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। রব মিয়ার দু’কানি জমি পানিতে ডুবে গেছে। রব মিয়ার কথায়, “ধানের থোরে পানি ঢুকছে, এহনও যদি পানি নাইম্যা যায়, তয় কিছু চিটা-মিটা পাইতাম। ধান না পাইলেও কিছু খড়-বিচালি পাইতাম, গরু দুইডা খাইয়া বাঁচত। অবশ্য বানে ডুবা ধান গাছ থেকে ভালো খড় পাওয়া যায় না, মোটা-ফাঁপা হয়, মলন দিয়েও খড় হয় না, নাড়া নাড়া হয়, গরু খাইতে চায় না।"

রব মিয়া গরীব মানুষ। বসতবাটির বাইরে তার সামান্য জমি জিরাত আছে।  জমিতে সে মৌসুমে দু'বার ধান চাষ করে। তার জমিগুলোতে সবজিও চাষ করা যায়।  কিন্তু সে জমিতে শুধু ধানই চাষ করে। রব মিয়ার কথায়, "সবজি ক্ষেতে ম্যালা খরচ, এক সপ্তাহ পর পর নিড়াতে হয়, সার দিতে হয়, বিষ দিতে হয়, বাঁশ কিনো বেড়া দেও...কত কী; এত টাকা পাই কনে? তার চেয়ে ধান চাষ করাই ভালো, একবারে মহাজনের থিকা টাকা নিয়া তেল-সার-বীজ কিন্না লই, ফসল কাইট্যা পরে মহাজনকে টাকা শোধ দিলেই হয়। আবার ধর যে, আমন ধানে খরচ কম। আল¬ায় বাদল দিলে পানি সেচতে হয় না। খড়-জাবা গুলো গরুরে খাওয়াইয়া কিছু দুধও বিক্কিরি করতে পারি; মাইয়াডারে ইশকুলে পাঠাইতে পারি।"

দিন যায়, হপ্তা যায়, মাস পেরোয় না। রব মিয়ার বাড়িতে ওলা বিবির ন্যায় অভাব আসে। একমাত্র সম্বল গরু দুটিকে রব মিয়া মথুরাপুরের হাটে উঠায়। দু’মাস আগেও যে গরুর দাম পঁয়তালি¬শ হাজার টাকা হত, তা ছাব্বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে। ক’কেজি চাল কিনে সবজীর দোকানে যায়। পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা, কাঁচা মরিচ এক পোয়া ৪০ টাকা, বেগুন ৫৫ টাকা। কি কিনবে রব মিয়া ভেবে পায় না। পাশেই গোশতর দোকান। আলতা কসাই হাঁক-ডাক করে গোশত বিক্রি করছে। গরুর মাংশ ৩০০ টাকা, একদাম ৩০০ টাকা, দেইখ্যা নেন ৩০০ টাকা, লাল মাংস ৩০০ টাকা, তরতাজা ৩০০ টাকা। রব মিয়া অবাক হয়, ক’দিন আগেও গোশতর দোকানে মাছি ভিড়তে পারত না, প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, নিলে নাও, না নিলে যাও। রব মিয়া হাফ কেজি গোশত, আর এক পোয়া পেঁয়াজ নিয়ে বাড়ি ফেরে।
গোশত দেখে রব মিয়ার বউ গালাগালের গোলাবারুদ ছুঁড়তে থাকে। একটু ক্লান্ত হলে ব্যাগ থেকে গোশতের পোটলা নামায়। বাজারের ব্যাগে আদা-রসুন-মসলাদি না দেখে রব মিয়ার বউ গোশতের পোটলা ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়। রব মিয়া এবার রাগ সংবরণ না করতে পেরে তার বউয়ের কাঁধে-পিঠে সজোরে কতকগুলি কিল-ঘুষি দিয়ে কাঁধের ময়লা গামছার এক পাশ দিয়ে দু’ চোখের কোণা মুছে।



ইশার নামাজের আযান হয়ে গেছে। রব মিয়ার বউ রেশমা বেগম তার নয় বছরের মেয়ে রোজিনাকে খেতে ডাকে। কন্যার পাতে দু’ টুকরো গোশত তুলে দিয়ে রেশমা বেগমের স্বামীর কথা মনে পড়ে। সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে রোজিনাকে বলে, “তোর বাপকে খাইতে ডাক।" “আমি  পারব না, তুমি ডাকো।", মেয়ের ত্বরিত জবাব। অগত্যা রেশমা বেগম পিঁড়ি থেকে উঠে অন্ধকার ঘরখানির দরজায় দাঁড়ায়। “সে যাইব কই, ঝগড়া হইলে তো ওই বিছানায়ই গুটিসুটি হইয়া শুইয়া থাকে,” রেশমা বেগম মনে মনে ভাবতে থাকে। “ওগো হুনছেন? খাইতে আসেন,” বলতে গিয়েও রেশমা বেগমের গলা ধরে আসে। বিছানায় অন্ধকারে দু’হাত দিয়ে হাতড়িয়ে দু'টো বালিশ আর একটা ঘন সেলাইয়ের কাঁথা ছাড়া কিছু পায় না সে। চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যায় রেশমা বেগম।  

অন্ধকার রাত। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। ঝিরঝির বাতাস বইছে। ফিনফিনে চাদরে ঢাকা লিকলিকে শরীরটা কাঁপছে। রব মিয়া ঠাহর করতে পারে না, রাত কতটা পেরিয়ে গেছে। আনুমানিক দশটা বাজে। না আরও বেশী বাজে। মাত্র দশটা বাজলে তো রাস্তা-ঘাটে আরও বেশী গাড়ি-ঘোড়া থাকতো।

চান্দাইকোনার দিকে ধাবমান খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে রব মিয়া। পকেটে আছে মাত্র দুশো টাকা। বিড়ির প্যাকেট হাতড়িয়ে ঠোঁটে ধরানো বিড়ির আবছা আলোতে সে দেখতে পেল দুই টাকার আরও দুটি নোট। অবশ্য চাইলে পকেট ভরা টাকা নিয়ে বের হতে পারত রব মিয়া। আজই তো সে ছাব্বিশ হাজার টাকায় গরু বিক্রি করেছে। কিন্তু হতচ্ছাড়া মহাজন তাকে ক্ষমা করে নি। বন্যায় ফসল ডুবে গেলেও তার পাওনা ষোল আনা বুঝে নিয়েছে। তাই অবশিষ্ট দুইটা পঞ্চাশ টাকার ও একটি একশ টাকার নোট নিয়ে রব মিয়া বের হয়েছে এক অনন্ত যাত্রায়।
চান্দাইকোনা বাজারের সামনে লোকাল যাত্রীর বাসস্ট্যান্ড। এলাকায়  এটা মফিজ যাত্রীদের বাসস্ট্যান্ড নামেই পরিচিত। ঢাকা শহরে যারা পোশাক কারখানায় কাজ করে, অথবা যারা রিকশা চালাতে যায় তারাই এ বাসস্ট্যান্ড থেকে কম টাকায় জীবন বাজি রেখে লক্কর-ঝক্কড় বাস গুলোতে ওঠে। প্রায়ই এসব বাস এক্সিডেন্ট করে। মারা পড়ে সমাজে মূল্যহীন কতকগুলো মানুষ। এরা রানা প¬াজা ধ্বসে মরে। তাজরিনের অগ্নিকান্ডে মরে। রোডে-ঘাটেও মরে। বস্তাবন্দী হয়ে বিগলিত-বিকৃত এসব দেহের ঠাঁই হয় জুরাইনের  গোরস্থানে। পেতাত্মাগুলো বিচারের আশায় রোজকেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের দুর্ভেদ্য দেয়ালের বাইরে ভনভন করে  উড়ে বেড়ায়।
বাজারের উত্তর দিকে হোটেল 'ভোজন বিলাস'। তিন তারকা হোটেল। বিত্তশালীদের পানশালা। এখানে ডিলাক্স, সুপার ডিলাক্স, এসি, নন-এসি বাস থামে। এসব বাসের যাত্রীদের খানা-পিনা শেষ হলে বাসগুলো ছুটে চলে গন্তব্যর দিকে। রব মিয়া সেদিকে যাবার অবকাশ পায় না। দু'প্রস্থ না ভেবে  সে হাঁটতে থাকে মফিজ বাসস্ট্যান্ড-এর দিকে। 

ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে গেল। রাত বাড়ছে। কোন বাসের দেখা নাই। রব মিয়া ভেবেছিল ঢাকা যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে, কার কাছে উঠবে, কি কাজ করবে--- তা সে জানে না। কাজ বলতে চাষাবাদ ছাড়া তো সে কিছু জানে না। ঢাকা শহরে সে কোন দিন যায়নি। তাই সেখানে চাষাবাদ হয় কিনা সে জানে না। অবশ্য ইট-কাঠের শহরে যে চাষাবাদের জমি থাকার কথা নয়, তা ঠাহর করতে তার অসুবিধা হয় না। ঘুমে দু’ চোখ ভেঙ্গে পড়ছে। সে কিছু ভাবতে পারছে না। এতক্ষণেও কোন বাসের দেখা নাই। নাকি সে বাসায় ফিরে যাবে? মহাজনকে বলে কিছু টাকা নিয়ে জমিতে মাসকলাই বুনলে কেমন হয়? আবার যদি বানের পানি আসে, তাহলে মহাজনের টাকা শোধ দেব কি করে? না আর একটু অপেক্ষা করি।
প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। সামনে একটু হেঁটে একটা নিচু জায়গায় গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারে রব মিয়া। রাস্তায় উঠে সে দেখতে পেল একটি ছাই রঙের প্রাইভেট কার। ড্রাইভার মনে হয় প্রস্রাব করতে গিয়েছে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কোথায় যাবেন?” রব মিয়া চমকে উঠল। সে মনে মনে একটু খুশিও হল। আমতা আমতা করে সে বলল, “ঢাকা যামু।" 
ড্রাইভারঃ গাড়িতে উঠে বসেন।
রব মিয়াঃ কিন্তু, ভাড়া লাগব কত?
ড্রাইভারঃ আরে বিবেচনা করে দিয়েন?
রব মিয়াঃ কিন্তু আমার কাছে তো বেশী ট্যাহা নাই।
ড্রাইভারঃ কত আছে?
রব মিয়াঃ একশ ট্যাহা। সে মনে মনে ভাবছে পথে-ঘাটে খুধা লাগলে বাকি একশ টাকা দিয়ে কিছু কিনে
 খেতে পারবে। তাছাড়া বিপদ-আপদের কথাতো বলা যায় না।
ড্রাইভারঃ উঠেন, উঠেন। সামনের সিটে উঠেন। রব মিয়া গাড়ির দরজা খুলতে পারে না। ড্রাইভার দরজা খুললে সে ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটে বসে পড়ে।

ঘন কুয়াশার আস্তর ভেদ করে ছুটে চলছে রব মিয়ার গাড়ি। পেছনে পরিবার আর সামনে অনিশ্চিত যাত্রার কথা ভাবতে ভাবতে রব মিয়া এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। সামনেই বেলতলা বাসস্ট্যান্ড। টহল পুলিশের একটি দল থামার নির্দেশ দিলে ড্রাইভার এলোমেলোভেবে গাড়ি চালিয়ে সামনে আগ্রসর হয়। পুলিশ পেছন পেছন ধাওয়া করে অষ্টরশী বাসস্ট্যান্ড-এর নিকট ধরে ফেলে। ড্রাইভার পাশে বসে থাকা রব মিয়াকে দেখিয়ে দিয়ে পাশের ঘন জঙ্গলের দিকে ভোঁদৌড় দেয়।
ক’দিন আগে নিখোঁজ হওয়া কুদ্দুস মিয়ার অপহরণকারী ও হত্যাকারী হিসেবে  পুলিশ রব মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে।


গল্প- যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না

গল্প- যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না


যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না                                        
বাসার তাসাউফ

    কোনো সুন্দর দৃশ্যের মালিক আসলেই সে-ই, যে সেটা প্রথমে দেখে। 
     ট্রেনে উঠে জানালার পাশের সিটটিতে বসেই হঠাৎ এমনটি মনে হল আমার। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ আছে। কারণটা গল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে জানা যাবে। আপাতত জানার বিষয় হল, আমি যে সিটে বসে আছি, তার থেকে ঠিক দু’টো সিট ডানে বসে আছে একজন মেয়ে। মাথায় দীঘল কালো চুল, পাখির নীড়ের মতো চোখ, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, সাদা কালো সালোয়ার-কামিজপরা মেয়েটিকে একেবারে পরীর মতো লাগছে ইত্যাদি অদ্ভুত বিশেষণে আমি তাকে বিশেষায়িত করব না। আমি শুধু এককথায় বলে দিতে চাই, মেয়েটি সুন্দরী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে ধার করেও বলা যায়- “নির্মল বুদ্ধির চেহারা ঝকঝক করছে যেন। সুুকুমার কপাল থেকে চুল উপরে তোলা, উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি ...।”
     আমার পাশের সিটটি খালি, খালি পড়ে আছে মেয়েটির পাশের সিটও। এখনো এ দু’টো সিটের টিকেটধারী ট্রেনে ওঠেনি। ট্রেন ছাড়তে বাকি দশ পনেরো মিনিট এখনো। জানালার পাশে সিট পেয়ে আমি খুশিই হয়েছি। চলন্ত ট্রেনে বসে বাইরের দৃশ্য দেখা যাবে। চোখ রাখলাম জানালার ওপারে। এ সময়ে কেউ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে আঁচ করতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে দেখি একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই আমাকে বলে, ‘এই সিট কি তোমার?’
     আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াই। 
     ‘তাহলে বাবা, তুমি আমার সিটে বসো, আমি বসব তোমার সিটে।’
     ‘কেন বলুন তো?’
     ‘আমার বমিটমির অভ্যেস আছে তো, তাই। জানালার পাশের সিটটাতে বসলে আমার একটু ভালো হয়।’
     আমি ভদ্রমহিলাকে আমার সিটটা ছেড়ে দিলাম। মহিলা বমি করে এ কারণে নয়। কারণ অন্য। আমি যদি এ সিট ছেড়ে ডান দিকের সিটটাতে বসি তাহলে মেয়েটার খুব কাছে চলে আসতে পারি। মাঝখানে শুধু একটা সিটের ব্যবধান। ভদ্রমহিলা দুুই সিটের প্রায় দেড়খানা দখল করে বসতে বসতে আবার বলে, ‘শোনো বাবা! সিট বড় কথা না, পৌঁছানোই হল আসল। নাও এবার বসে পড়ো।’
     ট্রেন ছাড়ি ছাড়ি করেও ছাড়ছে না। এদিকে ভদ্রমহিলা একে তো দেড়খানা সিট দখল করে বসে আছে, তার ওপরে অনবরত বলে চলেছে কথা, ‘এই যা! আজকাল যা গরম পড়েছে! ট্রেন কেন ছাড়ছে না? ড্রাইভার কি ঘুমাইয়া পড়েছে...? আচ্ছা বাবা! তুমি চাকরি কর না লেখা পড়া...? জানো! আমার দুই মেয়ে। বড়টার নাম ডেইজি। ওর স্বামীর সঙ্গে অষ্ট্রেলিয়া থাকে...। ছোট মেয়েটি ভার্সিটিতে পড়ে। আমার স্বামী বিজনেস করে। ঢাকা শহরে তার বিশাল বিজনেস...। আমি কখনো গ্রামে যাই নি...।’ 
     আগামী কয়েক ঘণ্টা এই মহিলা আমাকে কীরকম বিরক্ত করে ছাড়বে আমি আধখানা সিটে কোনো মতে বসে এ কথা ভাবছি যখন- তখনই ট্রেনটা ছাড়ল। ট্রেন কিছু দূর এগুতেই মহিলা পানির বোতল বের করে দু’টো   অ্যাভোমিন ট্যাবলেট হাতে নিয়ে আমাকে বলে, ‘তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
     আমি চুপ করে আছি। ট্যাবলেট খেয়ে ফের বলে, ‘তুমি খাবে একটা?’
     ‘না, গাড়িতে আমার বমি হয় না।’
     ‘আমারও হয় না। তবে আগে থেকে একটু সতর্ক হলাম। তা তোমার নাম কী বাবা?’
     আমি রীতিমতো হতবাক। বমি হয় বলে মহিলা আমার কাছ থেকে জানালার পাশের সিটটা কেড়ে নিল। এখন বলে তার নাকি গাড়িতে বমি হয় না। বমির ট্যাবলেটও খেল দু’টো। একটু আগে আমাকে গ্রামের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে এখন বাড়ির বদলে আমার নাম জিজ্ঞেস করছে। বড় অদ্ভুত মনে হয় আমার এই মহিলা সহযাত্রীটি। আমি মহিলার মুখের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলি, ‘আমার নাম আবিদ।’ 
     ‘বাহ্! খুব সুন্দর নাম। কী করো তুমি?’
     ‘লেখাপড়া।’ 
     ‘কোথায়?’
     ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, অনার্স থার্ড ইয়ার... সাবজেক্ট বাংলা... এখন যাচ্ছি গ্রামের বাড়ি, কুমিল্লায়।’
     আমি মহিলার সম্ভাব্য পরবর্তী প্রশ্নের আগাম জবাব দিয়ে দিলাম যেন সে আর কথা না বলে। কিন্তু মহিলা আরও কথা বলে যাচ্ছে, ‘আমিও তো যাচ্ছি কুমিল্লায়। অনন্তপুর নামব। প্রথমে বড় মেয়ের বাড়ি, তারপর যাব বাপের বাড়ি। তুমি অনন্তপুর নেমে মাজহার ভূঁইয়ার নাম বললেই যে কেউ আমাদের বাড়ি দেখিয়ে দেবে। আমার বাবার কয়েক’শ বিগা জমি আছে। জানো...।’
     মহিলার কথা আমি আর শুনছি না। একটু আগে বলেছে তার বড় মেয়ে অষ্ট্রেলিয়া থাকে। এখন বলে অনন্তপুর বড় মেয়ের বাড়ি যাবে। কোথায় অষ্ট্রেলিয়া, কোথায় অনন্তপুর? মহিলা কি পাগল না মিথ্যুক?
     ‘রাশিদ অ রাশিদ!’
     না, মহিলার কথা না শুনে উপায় নেই। ভুল নাম ধরে ডাকছে আমাকে। আমি শুধরে দিলাম, ‘আমার   নাম রাশিদ নয়, আবিদ।’
     ‘অ! আবিদ, তোমার কি বাবা মা দু’জনেই বেঁচে আছেন?’
     ‘হ্যাঁ, বেঁচে আছেন।’
     ‘মাশাল্লা! তোমার বাবা মা দু’জনকে আমার সালাম দিবা। আচ্ছা, বায়জিদ তুমি কি বিয়ে করেছ?’
     মহিলা আবারও নাম ভুল করল। এবার আর শুধরে দিলাম না। শুধরে দিতে ইচ্ছে হল না।
     ‘না, আমি বিয়ে করিনি।’ একটু বিরক্তমাখা গলায় বলি কথাটি।
     ‘গুড, আমার ছেলেকেও বিয়ে দিই নি। বড় মেয়েটার বিয়ে হোক আগে তারপর...।’
     ও মাই গড! মহিলা দেখি আসলেই পাগল। পাগল না বাচাল বুঝতে পাছি না। মিথ্যুক, মহা মিথ্যুক মহিলাটি! কখন কি বলে কোন ঠিক নেই। যে করেই হোক এই মহিলার কাছ থেকে আমাকে কেটে পড়তে হবে। ট্রেনে উঠেই পাশের সিটের ঐ সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে আমার মনে ভালো লাগার যে আমেজ তৈরি হয়ে ছিল, সেটি এখন এই মহিলার কারণে উধাও হয়ে যেতে উপক্রম হল। বিরক্ত হয়ে চুপচাপ বসে আছি। মহিলা বোধ হয় আমার বিরক্ত হওয়া বুঝতে পেরেছে। তাই সেও চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলে, ‘কেমন যেন লাগছে সাজিদ!’
     বলতে বলতেই হড়বড় করে বমি করে দিল। দু’টো অ্যাভোমিনেও কাজ হয়নি। বমি করবি তো কর জানালার বাইরে। তা না করে আমার দিকে অর্ধগলিত ভাত, মাংস, রুটি মুখ ভরে ঢেলে দিলি কী কারণে? গা গিনগিন করতে লাগল আমার। বমি করার পর মহিলা শান্ত হল। শুধু শান্ত নয়, একেবারে নেতিয়ে পড়ল। যাক, বাঁচা গেল।
     এর মধ্যে সেই মেয়েটির পাশের সিটটিতে একজন মাঝবয়েসী লোক উঠে বসে পড়েছে। ভীষণ ঈর্ষা হতে লাগল আমার। ...‘ইচ্ছে করছিল, অকারণে টুপিটা উড়িয়ে দিই তার মাথা থেকে- ঘাড় ধরে তাকে রাস্তায় দিই নামিয়ে, কোনো ছুতো পাই নে, হাত নিশপিশ করে...।’
     ট্রেন চলছে দ্রুত। ভদ্রমহিলা ঘুুমিয়ে পড়েছে শান্ত হয়ে। কিন্তু আমার মন অশান্ত এখন। মেয়েটি বসে আছে জানালার ওপাশে মুখ রেখে। পাশের লোকটি তার গা ঘেঁষে বসে আছে আরামে। আমার মনে ঈর্ষার আগুন জ্বলছে- ‘মনে ভাবি একটা কোন সংকট দেখা দেয় না কেন উদ্ধার করে জন্ম সার্থক করি- রাস্তা মধ্যে একটা কোনো উৎপাত, কোনো একজন গুন্ডার স্পর্ধা। এমন তো আজকাল ঘটেই থাকে...।’ যতই আমি মেয়েটিকে আমার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছি মেয়েটি ততই উদাসীন। ভুল করেও একবার তাকায় না আমার দিকে। কিন্তু আমি অপলক, অনিমেষ চোখে দেখছি। যেন ‘চোখে চোখ রেখে আমি দৃষ্টিবিহীন...।’ হঠাৎ আমার মনে হল, অহেতুক একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে এত হাপিত্যিস করার কী আছে? মেয়েটি আমার কে? ভেতর থেকে জবাব এল, ‘আর কোনো সম্বন্দ না থাক, ও তো আমার সহযাত্রীনী...।’


     এর মধ্যে ট্রেন কসবা স্টেশনে এসে পৌঁছে গেছে। এই স্টেশনে মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হবে। এতক্ষণ আমার সব মনোযোগ মেয়েটিকে ঘিরে ছিল। এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, পুরো প্লাটফর্মে মানুষের ভিড় জমে আছে। ট্রেন থেকে যাত্রীরা নামছে, এখান থেকেও ওঠছে। আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনে। ট্রেনে বসে একঘেয়ে ইঞ্জিনের শব্দ আর মহিলার অর্থহীন প্রলাপ শুনে শুনে বেশ ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছি। মাথা ব্যথাও হয়েছে শুরু। এখন এককাপ চা খেতে পারলে ভালো হত। ট্রেনে পানসে চা আর নোনতা বিস্কুট ছাড়া কিছুই নেই। এসব কি খাওয়া যায়? স্টেশনের কাছাকাছি একটা চায়ের দোকান চোখে পড়ল। ট্রেন থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে স্টেশনের এ পাশটা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। সবুজ বৃক্ষরাজি আর আকাশ-ছোঁয়া রাঙ্গা মাটির পাহাড়ের উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে বালিহাঁস উড়ে যাচ্ছে। আমি আগে কখনো এতগুলো বালিহাঁস একসঙ্গে দেখিনি।
     আমাদের অনন্তপুর স্টেশনে পৌঁছুতে আরও একঘণ্টা সময় লাগতে পারে। চা খেতে না খেতেই ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এল। বার বার বাঁশি বেজে উঠল ট্রেনে। আমি ট্রেনে উঠার জন্য ছুটলাম।
     ‘এক্সকিউজমি!’ হঠাৎ এ সময়ে পেছন থেকে একটা মেয়েলি গলা শোনে থমকে দাঁড়ালাম। অকস্মাৎ পেছনে ফিরে দেখি আমার পাশের সিটে বসা সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ধরা ট্রলি ব্যাগ। গভীর মায়াবী চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখে কাজল আর কপালে নীল টিপপরা। ট্রেনে বসে আমি এগুলো লক্ষ করি নি। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আমাকে বলছেন?’
     ‘জ্বি, আপনাকেই বলছি।’
      ‘বলুন...!’   
     ‘ট্রেনে আপনি যার পাশে বসেছিলেন, যে আপনাকে সারা পথে বিরক্ত করতে করতে এসেছে, সে আমার আম্মু। মানসিক ভারসাম্যহীন। তার পাশে যে বসে তাকেই এ রকম বিরক্ত করে থাকে। তাই আমি ইচ্ছে করেই তার পাশের সিটে না বসে অন্য সিটে বসেছি। আম্মু আপনাকে বিরক্ত করেছে, এ জন্য আমি মাফ চাচ্ছি, সরি।’ বলেই মেয়েটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্শার দিকে পা বাড়ালো। রিক্শায় মহিলাটি বসে আছে। আমি নিঃশব্দে দু’চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে আছি। ওদিকে ট্রেন থেকে বার বার বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেবে ট্রেনটা। মানুষের ভিড়টা এখন আর নেই। প্রায় সবাই উঠে পড়েছে ট্রেনে। এখনই আমাকে ট্রেনে গিয়ে উঠতে হবে। নইলে ট্রেন আমাকে ফেলেই চলে যাবে। মেয়েটা চলে গেছে, ট্রেনটাও চলে যাক আমি তা চাই না। আমি ট্রেনে উঠে জানালার পাশের সিটটাতে বসলাম। পুরো ট্রেনটাকে আমার কাছে শূন্য মনে হল। শুধু একজন মানুষ চলে গেছে ট্রেন থেকে, তার জন্য এমনটা মনে হবার কীর কারণ থাকতে পারে? আচ্ছা, যে চলে যায়, সে কি একেবারেই যায়?  কখনো কি ফিরে আসে না? নাকি যে চলে যায়, সে একেবারেই যায়, ফিরে আসার জন্য যায় না...?


গল্প- কুসুম স্বপ্নের বিরহী সমীরন

গল্প- কুসুম স্বপ্নের বিরহী সমীরন




কুসুম স্বপ্নের বিরহী সমীরন
জাহিদ হোসেন

‘শালা শ্বশুরবাড়ি’- জেল থেকে বেরিয়ে গা চাঁড়া দিয়ে হাফ ছাড়ে সাদেক আলী। গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শহরের ব্যস্ততম সড়কটা পেছনে ফেলে শহরকে বিদায় জানিয়ে ছোট্ট রূপচাঁদা নদীটি ডিঙ্গি নৌকায় পার হয়েই গ্রামকে স্বাগত জানায় সাদেক আলী। আজ অনেকদিন পর এই মাটি ও পরিচিত গ্রামের সাথে দেখা হয়ে আনন্দে মনটা নেচে উঠছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে গ্রামের। রাস্তার ধারের গাছগুলো দশ বছর আগেই কত ছোট ছিল। এখন সে গাছগুলো এত বড় হয়েছে যে, তেজী সূর্যের  আলোকে আটকে দিয়েছে উপরেই। গাছের পাতাগুলো সীমান্তরক্ষী হয়ে সড়কের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে চলছে অবিরত। তবুও জেদী সূর্য সংবিধান ভেঙে পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে অবৈধভাবে সড়কে প্রবেশ করেছে। গ্রামের এই গাছঘেরা, ছায়াঢাকা পথে হাটতে ভালোই লাগছে তার। বেলা পড়ে আসছে। সড়ক থেকে আলপথে মোড় নেয় সে। চীনা ক্ষেতের সবুজ গালিচার মধ্যদিয়ে  এঁকে বেঁকে চলে গেছে পায়ে হাঁটা পথ ঐ দূরের গ্রামে। আজ দশ বছর পরে তার স্ত্রী-সন্তানের সাথে দেখা হবে,এই আনন্দে আত্মহারা হয়ে কণ্ঠে মধুমালতি ছায়াছবির গান গুনগুনিয়ে সজোরে পা চালায় সাদেক আলী। কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। যে পথ সে দশ বছর আগে রেখে গিয়েছিলো সে পথ যেন দিগন্তের কোল ঘেঁষে সবুজ বনানীর সীমারেখায়,কাঁশবনের উদ্দাম ইশারায় কোন এক সুদূর স্বপ্নরাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। পথের সাথে তার সখ্য হতে কিছুটা দেরি হলেও ক্ষেতে গঙ্গা-ফড়িংগুলো সখ্য গড়তে মোটের দেরি করেনি। তার মৃদু পদধ্বনিতে গঙ্গা-ফড়িংগুলো স্বাগত জানিয়ে লাফালাফি করছে। দুর্বাঘাসের সঞ্চিত শিশিরবিন্দুগুলো তাকে অভিনন্দন জানিয়ে পা ধুয়ে দিচ্ছে। বিকেলের শান্ত পরিবেশ ও প্রকৃতি আরো বেশী মোহনীয় করে তুলেছে নরম সোনালি রোদ্দুর।
    বাড়ির সীমানায় পা রেখেই হাক দেয় সাদেক আলি- ‘বউ, বউরে- কই গেলি তুই।’ করিমন সদ্য মেম্বারের বাড়ি থেকে ফিরেছে। করিমনের মনে আচমকা জিজ্ঞাসা- ‘জেল থিকা আজি ছাড়া পাইলেন ?’ সাদেক আলি যথাসম্ভব গাম্ভীর্য  রেখে বলে- ‘হ, শালাদের মনে একটুও দয়ামায়া নাই।’ করিমনের মনে আনন্দ ধরে না। অনেকদিন তাকে ‘খুনির বউ, খুনির বউ’ বলে উপহাস করেছে গ্রামের লোক। এমনকি খুনির বউ বলে কারো বাড়িতে একখানা ঝি এর কাজ পর্যন্ত পায় নাই। শেষে মেম্বার সাহেব দয়া করে তার বাড়িতে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন তার স্বামী ফিরে এসেছে। তাকে এখন আর দু’মুঠো ভাতের জন্যে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হবে না। মানুষের উপহাস, তিরস্কার, লাঞ্ছনা আর তাকে শুনতে হবে না। স্বামীকে পেয়ে মরা নদীতে জোয়ার এলো বলে তার সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। করিমন স্বহাস্য বদনে স্বামীর যতœ-আত্মি করতে লাগলো। সাদেক আলি জিজ্ঞাসা করে- ‘সখিনা কই ? ওরে দেখিনা ক্যান ? করিমন উত্তর দেয়- ‘এই দশ বছরে আমাদের সখিনা অনেক বড় হইচে। অহনে জানি কই গেল । স্থির হইয়া কোন হানে  থাহে না। শুধু উড়াং পাড়াং করে।’ মেয়ের কথা শুনতে শুনতে চিন্তার জালে আটকে যায় সাদেক আলী। সেই সখিনাকে পাঁচ বছরের রেখে জেলে গিয়েছিলো সে। এখন তার মেয়ে বড় হয়েছে। একটা ভালো জামাই দেখে বিয়ে দিতে হবে। অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার। সে এখন কী করবে। এই চিন্তায় ঘুম আসে না। চিন্তাগুলো যেন তার ঘুমের শত্র“। সারাক্ষণ ঘুমকে তাড়া করে ফিরছে। কিন্তু তবু কোন কূল কিনারা পায় না। অবশেষে চিন্তা আর ঘুমের প্রচন্ড ধস্তাধস্তির পর জয় হয় ঘুমের।
    পরদিন সকালে উঠোনে বসে তার চিন্তা রীতিমতো থমকে দাঁড়ায়। সেই দশ বছর আগে অযতেœ অবহেলায় রেখে যাওয়া বাড়ির চারদিকের তালগাছগুলো আজ যৌবনবতী হয়েছে। তাদের শরীরে রস ডগমগ করছে। সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তালগাছগুলোর পরিচর্যা করতে থাকে সে। চোখে মুখে তার নতুন আশার স্বপ্ন। সন্ধ্যা হতে না হতেই তালগাছগুলোতে পাত্র লাগানোর কাজ শেষ করে। তার কাছে পৃথিবীটা সুন্দর বলে মনে হয়। তাই এই সুন্দরের পৃথিবীতে আবেহায়াত ছায়াছবির গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়ে নতুন প্রভাতের নতুন সকালের আশায়। এদিকে সারারাত অবধি তালগাছের কাটা ডালের কাঁচা রস বাতাসে দুর্মর সুগন্ধ সংবরণ করে একেকটি বৃহৎ আনন্দ অশ্রু হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পাত্রের ভিতরে জায়গা দখল করতে থাকলো। রাতারাতি রসের ব্যবসায়ী বনে যায় সাদেক আলী।
    পরদিন প্রভাতে পাখিদের কলকাকলীতে ঘুম ভাঙে তার। ঘুম থেকে উঠে গাছ থেকে পাত্র নামিয়ে মুগ্ধ হয় সে। একটা নিষ্কণ্ঠক আত্মতৃপ্তিতে মন ভরে ওঠে তার। কী যে নেশা ধরানো রঙ,¯িœগ্ধ মোলায়েম তার সুগন্ধি আমেজ। সারাটা উঠোন যেন মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠলো। এদিকে খাদকরা দেয়া খবরের ভিত্তিতে বেশ আগে ভাগেই সাদেক আলীর উঠোন ভারি করতে থাকলো। আস্তে আস্তে এত খাদকের উপস্থিতি সেখানে ঘটলো যে, সে রীতিমত ব্যস্ততার চরম পর্যায়ে চলে গেল। তবে সাদেক আলী সব খদ্দেরকে তেমন বসার উপকরণ যোগান দিতে পারলো না। কেউবা মাদুর পেতে প্রথম শ্রেণীর আরামদায়ক জায়গা পেয়ে জমিদারের রঙমহলের মতো শুয়ে বসে রস পান করছে। কেউবা টুল বা পিঁড়েতে বসে  রস গিলছে। কারো ভাগ্যে জুটেছে খড়, তার উপরে বসেই অবাধে পেটে রপ্তানি করে চলছে তালের পাকানো রস। আবার কেউবা মাদুর, টুল, পিঁড়ে, খড় কোনটাই না পেয়ে সেন্ডেলে বসেই ঢক-ঢক করে গলায় ঢালছে। এখানে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় সাদেক আলীর উঠোন ধুমায়িত হয়ে উঠেছে। খদ্দেররা রস পানের বিরতিতে মুখরোচক বঠ ব্যবহার করে। একটু বড় মাপের খাদকরা বঠ হিসেবে গরু বা খাসীর মাংস খায়। কেউবা ঝাল চানাচুর, কেউবা ছোলা। আর যার ভাগ্যে কোনটাই জোটে না তারা শুধু লবন মরিচ ব্যবহার করে। কোন খদ্দের রসের অর্ডার দিচ্ছে আর কেউ তা ডেলিভেরি নিতে ব্যস্ত।
    এভাবেই রস খাদকদের কাছে সাদেক আলীর মান-সম্মান, প্রতিপত্তি দিনে দিনে বাড়তে থাকে। সখিনার বিয়ের সম্মন্ধ বড় বড় ঘর থেকে আসতে শুরু করে। রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক কিছু চিন্তা করে সে। চিন্তাগুলো আবার তাকে গ্রাস করে ঘুমের বদলে। মাটিতে লাগানো গাছের জীবন জাগানো রসের সাথে মিশে গেছে তার জীবিকা। প্রকৃতিই তাকে নতুন পথ দেখিয়েছে। তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে। এইতো কদিন আগেই তাকে চুরি করতে হয়েছে। ঘটনাক্রমে খুন করে জেলের ঘানি টানতে হয়েছে। তবুও এ জগৎ সংসারের বিচিত্র মানুষ তাকে ক্ষমা করতে না পারলেও প্রকৃতি সত্যিই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। দিয়েছে মান-সম্মান আর বেঁচে থাকার অনাবিল আনন্দ। এসব চিন্তা করতে করতে কখন ঘুম এসে যায় টেরও পায় না।
    গাইবান্ধা কেন্দ্রীয় কারাগার। ভোরের আযান শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে জেলের ঘন্টিও বাজছে। সেক্টর ম্যাট সব কয়েদী, হাজতীদের ডেকে তুলছে। ঘুম ভেঙে গেল সাদেক আলীর। যথারীতি প্রত্যেক দিনের মতো আজও লাইনে যেতে হবে। ফাইল গুনতি হবে। সবার সাথে সাদেক আলীও ঘুম জড়ানো চোখে লাইনে এসে বসে। এদিকে ম্যাট ও রাইটার মাথা গণনা নিয়ে ব্যস্ত। সূর্যটা তখনও ছাড়পত্র পায়নি। সাদেক আলী তাকিয়ে আছে দূরের নিঃসঙ্গ আবছা অন্ধকারের দিকে।




গল্প- নিশ্চুপ হেঁটে চলে...

গল্প- নিশ্চুপ হেঁটে চলে...


নিশ্চুপ হেঁটে চলে...
শাহমুব জুয়েল

একটু আগে খবর এলো। ঘরে থাকার দিন ফুরিয়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরে জল ঘুরছে। ঢেউয়ের চিৎকারে নদীগুলো বেশ সরগরম। এই তো হেঁকে উঠলো। জল আর জল। জল উপরে উঠলে বাঁচার স্বাদ হজম হয়ে যাবে। তাও আবার পাঁচ ছয় ফুট। উপচিয়ে পড়লে গলাচিপে ধরবে। কী আর করা। দু চারটে জিনিসপত্র বোগলতলে নিয়ে দৌড় দেয় বেদে সুরত মিঞা।
      ডাকাতিয়া নদী। ছোট ছোট নৌকায় জীবনযাপন করে একটি জনগোষ্ঠী। সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম সে তো নাগালের বাহিরে। তারা তো তারা বোঝে না। দিনভর চিপ ঝাঁঝরা বা জাল দিয়ে মাছ ধরে দেহের সাথে প্রাণ লটকে থাকে। তাদের এ লকরঝকর জীবনের উপর দখলদারদের লাঠি পড়েছে। বালির নল ওঠানামা করছে। ঝোঁপঝাড় কেটে নদীর বাঁকে বাঁকে তৈরি হয়েছে চিংড়িখের। স্বাভাবিকভাবে তারা চলতে পারছে না। সব নৌকা তুলে নেয়া হয়েছে। কোথায় থাকবে তারা। রাস্তার কার্ণিশে ঘুড়ির চাউনি তুলে কোনরকমে বসবাস করে। তাতেও শান্তি নেই। বালি ব্যবসায়ীদের উৎপাতে তাতেও রক্ষা নেই। তাড়া খেয়ে খেয়ে রীতি চালু হয়েছে। এ বেলা এখানে ওবেলা ওখানে। কথায় বলে- একখানে সাত দিনের বেশি থাকতে নেই। নদীতে পড়ে থাকে সুরত মিঞা। ভাঙ্গাচোরা ডিঙি ।
মাছ ধরা তো দুরের কথা নৌকা থামিয়ে একটু রান্না করবে তারও জো নেই। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে তারা থাকে বাঁকে। খিদের তোড়ে পেট চো চো করে। বডি ঝুইল্যা পড়ে তবুও মাছ ধরা ছাড়ে না। যার তবিয়তে জীবন বাঁচে। রান্না করতে বসে সুরত মিঞার স্ত্রী খুপরি। বয়স কম লাউয়ের ডগার লাহান শরীর। কাপড় পরলে ঝুলে থাকে। তাদের কেউ দোষ ধরার নেই। চোখে পড়লে তো ধরা পড়বে। চোখের দিকে তাকালে দরদ লাগে। বাতাসে নৌকা ঘুরছে ছাউনিতে ফাত ফাত শব্দ। রান্না বসায়, আরেক পারে রান্না শেষ হয়। এবার বউকে শুনায়। একপাড়েতে রান্ধি বাড়ি আরেক পাড়ে খাই সুখের সীমা নাইরে বন্ধু সুখের সীমা নাই।তাই সুরত।
কচুরিপানার ভাঁজে ভাঁজে চিপ ফেলে মাছ ধরে সুরত মিঞা। দেশীয় নানানপদের মাছ পায়। এতে নড়েবড়ে সংসার চলে।
ডাকাতিয়ার উপর গাড়ির ফা ফা শব্দ। দুধারে রঙিন লাইট। দিনে নজরে তেমন আসে না। রাতে শব্দের পাশাপাশি রঙিন আলো। নাম ডাকাতিয়া সেতু। নদীর মাঝখান থেকে তীরের মত আটকে যায়। সেতুর দিকে যেদিন চাঁদের আলো নিরুদ্দেশ হয়। সরকারি আলোতে খুপরির মুখখানা ভারি মিষ্টি লাগে। বুকখসা কাপড় লজ্জায় লাফিয়ে ওঠে। ভাত খায় । হাত মোছে আঁচলে। তারপর গাড়ি চলে রাস্তায়। তারাও গাড়ি হাঁকায় রাতের যৌবনে তারা তৃপ্তির ডেকুর তোলে। তারা পাড়ি দেয়। যার যার পথ।
চারদিকে অন্ধকার। রাত নাকি। না রাত তো হয় নি। এই তো রেললাইনে খাটু মিঞার দোকানে মাছের টাকা আনার সময় দেখলাম দশটা বাজে। তাহলে এখন সময় কত? অন্ধকারে ডাকাতিয়া ব্রিজ দেখা যায় না। বাবারে- মোরিয়ে মোরিয়ে আসছে কী আসছে সব উড়ে যাচ্ছে। শোঁ- শোঁ-বাতাস। বিদৎুকেন্দ্রে লাইনম্যান হয়তো আছে। বাতি জ্বলছে না। বাতাসের তোড়ে সব চিন্ন বিচ্ছিন্ন। গত বর্ষায় একদিনের মাছ বিক্রি করে কেনা স্মার্টফোন আছে। পারের দোকানে দশটাকায় চার্জ দেয়া যায়। সেভাবে চার্জ দেয়া।কিন্তু বিদৎুতের মতিগতিতে চার্জ কম।টিপ টিপ করে লালবাতি জ্বলছে। এইতো বন্ধ হয়ে গেল।
    গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রাস্তায় গাড়ি নেই। জলে জেলে নেই, মাঝি নেই । টলার নেই। রাস্তা ফাঁকা জনমানব নেই। কেবল একটি অটো দেখা য়ায়। দুপাশে মাইক ঝুলানো। বলা হচ্ছে -সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি : ১০ নম্বর বিপদ সংকেত। সাবধানে থাকুন, অমুক যায়গায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয় নিন। নিরাপদ স্থানে আসুন। খুপরি চেঁচায় ও সুরত তুমি কোনহানে। শুন কী কহে । সুরত বুঝেশুনে বলে। বলুক। আমেেগা কী আর যায়গা আছে। কি কও।সুরত মনে পড়ে। বছর তিনেক আগে ভারী বন্যা হয়েছিলো।
     প্রাণের ভয়ে ছুটছিলাম আশ্রয় কে›্দ্ের। দরজায় মুখ দিতেই ছালামত মিঞা তেড়ে ওঠে। ঐ কেরে তুই বাইদ্যার ঘরের বাইদ্যা। এহানে কী হারামির বাচ্চা হারামি। জন্মের ঠিক নাই। সে আবার বাঁচতে চায়। তোরে আইতে কইছে কে।যা ডিঙ্গায় যা।অমনি নজর দেয় খুপরি।বলে কী ভাই আমগোরে মানুষ মনে হয় না।জ্বিভা হাঁকায়। ঘনঘন ডোক গিলে ছালামত। চোখ লাল। তুমি আবার কে, সেরকম তো। আইয়্যো। সুরত বলে। ঐ। এ বলে নৌকায় ফিরে। পথে চোখ বাড়ায় ছেলামত। গো গো করে সুরত মিঞা মইরা যামু। আর আমু না।
     এবার কী হবে। যা হবার হবে। খুপরি আল্লাহরে ডাক। ঝড়োহাওয়া শুরু হয়। ধুমড়েমুচড়ে সব চারখার হয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খুপরির।খুপরি চিল্লায় আল্লাহরে; আল্লাহরে। ফুঁপে কাঁদে। আর চিল্লায়। কেরামত নদীতে নেমেছে শব্দ শুনে কিন্তু দুধারি শব্দে ঠিক ঠাহর হয় না। কী শব্দ। হঠাৎ জল ফুঁপে ওঠে। জল চাঙ্গিতোলা করে। একটা নৌকায় বাড়ি খায় সুরত মিঞা।কার নৌকা এটি। নৌকাটি কোত্থেকে এলো। সে দেখলো নৌকাটি দ্রুত চলে যাচ্ছে। বামে তার নৌকাটি ডুকরে ডুকরে কাঁন্নার শোনা যাচ্ছে। নদীতে শাড়ির আঁচল দোল খাচ্ছে। পাটাতনে দেহ। নজরে এলে দেখা গেলো খুপরি।কী হলো খুপরির।
হঠাৎ জল নেমে গেলো। নৌকা আঁটকে গেলো। মাটিতে। মাটি বলতে-এ যে ঘাটের রাস্তা। রাস্তায় জলের দাগ। পায়ের চাপ। কিন্তু কোথাও তো জনমানব নেই।তাহলে এ মহুর্তে কে গেলো এপথে। মনে হয় এইমাত্র সদ্যস্নাত কেউ গিয়েছে। অনেকক্ষণ খুপরির সন্ধান করছিলো সুরত। চোখের জল বৃষ্টির জল একসাথেই গাল বেয়ে পড়ছিলো। কিন্তু কারো খোঁজ মেলেনি। মাথা উপরে উঠলো।মচোখ তুলতেই দেখা গেলো অর্ধবস্ত্র পরিহিতা রমনী। হঠাৎ ঘোর অন্ধকার। মেঘের তা-ব। বিজলীতে আধো দেখা কে যায় কিন্তু বোঝা গেল না। নি:শব্দে দেহ হেঁটে যায় ।