সৈয়দ শামসুল হকের রচিত কবিতা
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে। আট ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন সৈয়দ হক। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয় সৈয়দ শামসুল হক ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
একেই বুঝি মানুষ বলে
নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।
তুমিই শুধু তুমি
তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।
করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভূমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।
বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি-
নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।
এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব-
যেদিকে যাই-তুমিই শুধু-তুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!
এপিটাফ
আমি কে তা নাইবা জানলে।
আমাকে মনে রাখবার দরকার কি আছে?
আমাকে মনে রাখবার?
বরং মনে রেখো নকল দাঁতের পাটি,
সন্ধ্যার চলচ্চিত্র আর জন্মহর জেলি।
আমি এসেছি, দেখেছি, কিন্তু জয় করতে পারিনি।
যে কোনো কাকতাড়–য়ার আন্দোলনে,
পথিক, বাংলায় যদি জন্ম তোমার,
আমার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাবে।
তালাক
তালাক
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
১
কলমি সারাদিন গতর খেটে খায়। কেউ কেউ আবার এই গতর খেটে খাওয়ার অন্যরকম মানে খুঁজতে যাবেন না যেন। এই গতর খেটে খাওয়ার মানে হল, কায়িক পরিশ্রম করে খাওয়া। সম্রাট নাসিরুদ্দিন হোজ্জা সহ অনেক রাজা বাদশাগণই রাজকোষ থেকে কোন অর্থ গ্রহণ না করে নিজেরা কায়িক পরিশ্রম করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। রাজা কিংবা বাদশা হয়েও যখন কোনো ব্যক্তি টুপি অথবা মানুষের জুতো সেলাই করেন, তখন বিষয়টি আর সাধারণ থাকে না। আর এই অসাধারণ মানুষেরাই মরে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকেন, বেঁচে থাকবেন। অবশ্য আমাদের কলমি তেমনি অসাধারণ কেউ নন। সে একজন অতি সাধারণ গাঁও-গেরামের গরীরের ঘরের মেয়ে। অবশ্য এখন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল, এখন সে ছক্কু মিয়ার বউ। এখানেও কেউ ভুল বুঝবেন না। ছক্কু মিয়া এমন কোনো বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ব্যক্তি না যে, নাম নেয়া মাত্রই তাকে সারা বাংলাদেশ চিনতে পারবে! আচ্ছা যাক। সে বৃত্তান্তে আমরা পরে আসব। আপাতত কলমির গন্ধভরা জলের ইতিবৃত্ত কিছুটা অন্তত জেনে নেওয়া যাক।
কলমিকে সারাদিন কেবল ঘানি টানার মধ্যেই থাকতে হয়। এই যেমনি স্বামীর সংসারের ঘানি তেমনি পাড়া প্রতিবেশিদের ঘানি। আরও উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করতে চাইলে বলতে হবে মরা ঘাটের পানি। যদিও এই ঘানি টানার দৃশ্য এখন আর সচরাচর চোখে পড়ে না। সুতরাং সংগত কারণেই আমাদের এই প্রজন্ম ঘানি কি জিনিস হাতি না বলদ তা জানে না। তাদের জানার কথাও নও। অবশ্য তারাও মাঝে মধ্যে হয়ত বাপ-চাচাদের মুখে কুলুর বদলের নাম শুনে থাকবে। কারণ আজকাল অনেক পুরুষ মানুষকেই সংসারের প্রতি বেজায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলতে দেখা যায়, সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি রে ভাই। অনেকটা ‘মনমাঝি তো বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারছি না.... এই টাইপ কথাবার্তা। কলমির যাপিত জীবনও এইরকমই। তারও হররোজ একই রুটিন। রোজই নাকের জল আর চোখের জল সামনাসামনি হয়। কাপড় কাছো, ঘর-দোর মোছো, বাটনা বাটো, সবজি কাটো, উনুনে হাড়ি চাপাও, চাল, তেল-জল, মশলা, লবণ দাও...! শুধু এখানেই শেষ নয়; গোছগাছ কর, দোকান থেকে এইটা সেইটা কিনে দিয়ে যাও ইত্যাদি ইত্যাদি। অতঃপর স্বামী সন্তানের সেবায় লেগে যাও। আবার রাঁধ, আবার বাড়, সবাইকে খাওয়াও। অত:পর পাতিলের নিচে অবশিষ্ট কিছু পড়ে থাকলে নিজে খাও। আর না থাকলে না খাও। শুধু এইটুকুতে শেষ অইলে কলমি অখুশি অইতো না। এইসবের সাথে যখন যুক্ত হয় সাহেবদের বউ-ঝিদের বকুনি খাও, সাহেবের কামুক চোখের চাহনি খাও, পথে-ঘাটে হাজারো মানুষের দুই চক্ষের বিজলি খাও, স্বামীর মন জুগাও; তিন তিনটা সাওয়াল-পাওয়াল সামলাও, ইভ টিজিং সামলাও, বাচ্চাদের ইস্কুলে নিয়ে যাও, নিয়ে আসো... আরও কত্ত কী! এসব কেচ্ছা কাহিনি একদিন প্রাগৈতিহাসিক ছিলো, এখন প্রতিদিনই নগদা-নগদি হয়। কানের লতি ঘেঁষে সবেগে তেরছা বুলেট যেভাবে ক্ষিপ্র গতিতে সাঁই করে চলে যায়, কলমিরও সেভাবেই দিনলিপি লেখা হয়। কলমির অসুখ-বিমুখ কেবল নামেই হয়। বাস্তবে সুস্থ থাকুক আর অসুস্থ থাকুক- কাজ করেই যেতে হয়। কাজ করেই খেতে হয়। অবশ্য তার অভ্যস্ত শরীর কোনোদিন না করে না। যেমন পেটানো লোহা কামারকে না বলতে জানে না তেমন।
একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, আমরা বাঙালিরা সাধারণত সবকিছুই সাদৃশ্যপূর্ণ এবং মিলঝিল পর্যায়ের আশা করে থাকি। এই যেমন আমরা বলি, যেমনে তেমন মিলে শুটকি মাছ আর বেগুনে মিলে। এই ধরনের আরও অনেক কথা আমাদের সামাজিক জীবনে প্রচলিত আছে এবং আমরা এইসবের বাইরে যেতেও খুব একটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করিনা। এর একটি বড় উদাহরণ হল, কলমি এবং ছক্কু মিয়ার বিবাহ। পাড়ার লোকজন এই বিবাহ কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি। কারণ এই বিবাহ নাকি শুটকি মাছ আর বেগুনের মত মানানসই হয় নাই। পাড়ার ছেলেছোকরা তো এই বিবাহ আটকানোর জন্য রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত নামিয়েছিল। কিন্তু মিয়া বিবি রাজি তো কিয়া করবে কাজি? কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত ছক্কু মিয়ার গলাতেই কলমির মত নগদ মুক্তার মালা উঠল। কিন্তু কী এমন কারণ যার জন্য এতো কা--কারখানা? আসল কথা হল, সবাই মনে করে আধা ল্যাংড়া ছক্কু মিয়া কলমির সোয়ামি হওয়ার যোগ্যতা রাখেনা। কলমি হইল আসমানের একটা পূর্ণিমা চান। এই চান কি যার-তার ঘরে মানায়? কোনোদিন না। কলমির রূপ মাধুরীর বর্ণনা করতে গিয়ে কতজন যে কতরূপে তাকে প্রকাশ করেছে; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গণমানুষের মতামত অইল ছক্কুর ঘরে কলমি যেন শুধুই কলমি না। সরোবরে পদ্মফুল ফুটে থাকলে এই দৃশ্য যেমন মনোহর লাগে কলমিকেও ঠিক ঠিক তেমনি মনোরমা লাগে। সরাসরি বললে কলমি একটা ফুটন্ত গোলাপ। গাঢ় উজ্জ্বল গায়ের রঙ। সাড়ে পাঁচ ফিটের একটু বেশি উচ্চতা। তার নাক-মুখ-চোখের উপর কে যেন লাবণ্যের পর লাবণ্য মাখিয়ে দিয়েছে। গোল-গাল মুখখানি যেনো কোনো শিল্পীর হাতে তৈরি পুতুলের চেয়ে কোনোঅংশে কম নয়। তাই সবার ধারণা হল, কলমির মত অপরুপা সুন্দরী মেয়ে কোনো রাজা-বাদশাহর ঘরেই কেবল মানায়। এই ল্যাংড়া ছক্কু মিয়ার ঘরে কোনোমতেই কলমি রে মানায় না। কিন্তু মানুষের চাওয়া আর না চাওয়ায় কি সবকিছু হয়? হয় না। আসল কথা হইল, ভাগ্য। আমরা চাই বা না চাই একটা পর্যায়ে ভাগ্য আমাদের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। আমরা মূলত ভাগ্যের হাতের পুতুল।
এই ভাগ্যের নির্মম রসিকতায় কলমি নিজেই তার নিজের শত্রু। বলতে পারেন, এইটা আবার কেমন কথা বাপু? কিন্তু এইটাই আসল কথা। কলমির এই বেপরোয়া রূপ-যৌবনই তার আসল প্রতিপক্ষ। কলমি যদি আরেকটু কম সুন্দরী অইত... তাইলে কিন্তু এইসব কোনো ঝামেলাই তাকে মোকাবেলা করতে হতো না। এজন্যই জ্ঞানী মানুষেরা বলে থাকেন, কলমির এই বেসামাল রুপটাই হয়েছে তার সাক্ষাৎ কালপুরুষ। এখানে কালপুরুষ মানে কাল জয়ী মহাপুরুষ নন। কাল কেউটের মতোন পুরুষ। কলমি রাস্তাঘাটে হাঁটতে পারে না...ছেলে-বুড়ো সবাই মিলে তাকে যেন ঢক ঢক কইরা গিইল্যা খায়। গিইল্যা খাইতে চায়। কৈশোর কাল থেকে এইসব অত্যাচার সহ্য করতে করতে কলমির একেবারে অসহ্য হয়ে গেছে। তার আর এসব ভাল্লাগে না। রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় শরীর ঘিন ঘিন লাগে। মাঝে মধ্যে অজপাড়া গাঁয়ের কলমিও বিদ্রোহী অইতে চায়। সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। তার কেবলই ফুলন দেবী অইতে মন চায়। কেউ তাকালেই চোখ দুটি খুইল্লা নিতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজে সে কিছুই পারে না। মাথা নিঁচু করে রাস্তার একধার ঘেঁষে নীরবে- নিভৃতে হেঁটে যায়। আর মনে মনে বলে, ছক্কু আর তার বাপ ছাড়া পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষেরা যদি কানা অইয়া যাইতো!
২
ছক্কু মিয়া আধা ল্যাংড়া হলেও মানুষ হিসাবে তেমন একটা খারাপ না। সারাদিন একপায়ে রিকশা চালায়। বিয়ের পর পর এই বিষয়টা কলমিকে খুব কষ্ট দিত। তাই একদিন রাইতে স্বামীর বুকের উপর আধশোয়া অবস্থায় কলমি ছক্কু মিয়াকে বলল, একখান কথা কইলে রাখবেন?
ছক্কু মিয়া বলল, কি কথা ক হে কলমি...
আপনের কিন্তু আমার কথা রাখতেই হবে। আমার কথা কিন্তু ফেলাইয়া দেওয়া যাব না।
ঠিক আছে তুই ক দেহি। রাখবার মত কথা অইলে তো রাখবই
কলমি স্বামীর আরও ঘনিষ্ঠ হল। তার বুকে পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আপনি আর রিকশা চালাইতে পারবেন না কইলাম। আপনার শরীরের যে অবস্থা তাতে রিকশা চালানোর কাজ আপনার জন্য না।
কলমির কথা শোনে ছক্কু মিয়ার এক ফালে আসমানে উইঠা যাওয়ার উপক্রম অইল। তার প্রতি কলমির এই যে ভালোবাসার প্রকাশ ছক্কু মিয়া নিজের কানে শুনলো, নিজের চক্ষে দেখলো... তার ঋণ সে কোনোদিন পরিশোধ করতে পারবে না। তবুও যদি কিছু টা শোধ হয়, সেই আশায় কলমিকে বুকের সাথে সাথে পিষতে পিষতে বলল, আমি রিকশা না চালাইলে কি খাবি রে কলমি?
কলমি বলল, সে চিন্তা আপনার করতে হবে না। আমি আগে থাইক্যাই সেই ভাবনা কইরা রাখছি।
ছক্কু মিয়া বলল, কী ভাবনা?
কলমি বলল, আমি মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করমু।
কাজ কইরা যে টাকা পাইমু সেখান থাইক্যা সংসার খরচের পরে কিছু কিছু জমাবো। সেই জমানো টাকা দিয়া আপনে একটা দোকান দিবেন। তাইলে আপনার আর রিকশা চালাইতে অইব না।
কলমির পরিকল্পনা শোনে ছক্কু মিয়ার পরানডা খুশিতে ভইরা গেল। আধা ল্যাংড়া সোমামির প্রতি কলমির এই যে ভালোবাসা তা কম বড় কথা নয়। অন্তত ছক্কুর কাছে তো এর দাম সমগ্র দুনিয়ার চাইতেও বেশি। মনে মনে সে নিজেকে বড় ভাগ্যবান ভাবতে ভাবতে কলমি কে আরও জোরে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর বুদ্ধিটা অনেক সুন্দর কলমি। কিন্তু মাননের উপায় নেই। সারাদিন দোকানে বইসা থাকলে আমার যে ডায়াবেটিস হইয়া যাইব। তাছাড়া লোকে আমারে এমনিতেই ল্যাংড়া বলে ডাকে, তখন বাদাইম্যা বলেও ডাকবে।
কলমি বলল, লোকের কথায় আমাদের কিছু আসব-যাব না। মানুষে আমাদেরকে না খাওয়াবে আর না পরাবে। আমার কথা আপনাকে রাখতেই হবে বইল্যা দিলাম কিন্তু!
কলমির এই আলটিমেটাম শুনে ছক্কুর মন আরও অনেক অনেক বড় হয়ে গেল। কিন্তু নিজের বউ মানুষের বাসায় কাজ করে খাবে, এটা সে কিছুতেই মেনে নিবে না। যত গরীবই হোক না কেন; সে তার আত্মমর্যাদা কখনও বিসর্জন দিতে পারবে না। তবে মুখে বলল, ভিন্ন কথা। আচ্ছা, তুই যখন এত কইরা কইতাছিস তাহলে তোর কথাটা ভেবে দেখব নে।
ছক্কুর মিয়ার কথা শোনে কলমি নিজেকে বিজয়ী ভাবতে লাগলো আর বিড়ালের মতো ছক্কুর শরীরে নিজের মুখ ঘষতে লাগলো।
৩
এভাবেই ছক্কু মিয়া আর কলমির সংসারে ডালপালা গজাইতে লাগলো। অসুখের কারণে ছক্কু মিয়া তার আত্মমর্যাদা হাওড়ের পানিতে বিসর্জন দিতে বাধ্য অইল। আর যা-ই হোক নিজেরা না হয় দুই, একবেলা না খেয়ে থাকা যায় কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের তো আর উপোস রাখা যায় না। তার উপর রোগ-শোকের ব্যাপার আছে। এইসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে কলমি এখন মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে। যদিও ছক্কু এখনো রিকশা চালানো বাদ দেয় নাই। দুইজনের সম্মিলিত ইনকামে এখন আর তাদের কপোত- কপোতীর সংসারে কোনো দু:খ নাই। অবশ্য এমনিতেও কলমি খুব শক্ত নার্ভের মানুষ। তার গোটা জীবনে খুব বেশি দু:খ নেই। সব মিলিয়ে মাত্র একটা দু:খ আছে। আর তা হল, তার দিকে পুরুষ লোকদের চোখ মারা।
অবশ্য এখন এইসব দু:খও একপ্রকার গা সওয়ার মত হয়ে গেছে। কলমির সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে এইজন্য যে, প্রায় সব পুরুষ মানুষই কোনো না কোনোভাবে লুইচ্চা। কেউ মুখ লুইচ্চা, কেউ চোখ লুইচ্চা, কেউ হাত লুইচ্চা, আবার কেউ কেউ আছে যে একেবারে আপাদমস্তক লুইচ্চা। তবে দুই একটা যে ভালো নাই ব্যাপারটা এমনও নয়। যেমন ছক্কুর কথা ধরা যাইতে পারে। সে একজন কমপ্লিট ভদ্র এবং ভালো মানুষ। তার মধ্যে লুইচ্চামি তো দুরের কথা; এর লেশ মাত্রও নাই। সে সারাদিন গতর খাটে। রাইত- বিরাইতে বাসায় ফিরে আসে। ফিরেই একটা হাঁক দেয়, আমার পরী কইরে..। পরী হল কলমির ছোটমেয়ের নাম। যেমন বুদ্ধিমতী তেমন মায়ের মতন রুপবতী। এই একরত্তি বয়সেই বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পকেট হাতড়ায়। খাবার খুঁজে। খেলনা খুঁজে। ছক্কু কিছুক্ষণ বাচ্চাদের সময় দেয়। তারপর সবাই মিলে একত্রে খায়। তারপর চলে বাচ্চাদের ঘুমানোর জন্য অপেক্ষার পালা। কলমি ঘুম পাড়ানি গান গায়। এই ফাঁকে ছক্কু মিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি টানে। কিছুদিন ধরে বিড়ি টানলে ছক্কুর কাশি হয়। তবুও বিড়ি টানা ছাড়ে না। ছাড়তে পারে না। কলমি তারে রোজ রাইতে শপথ করায়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। আজ বিড়ি টানতে টানতে ছক্কু হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়। কী সুন্দর আর নির্মল! বিড়ি টানা শেষ করে ছক্কু ঘরের ভেতরে ঢুকে। কলমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাধ্য চুলে বিনুনি দিচ্ছে। কলমিকে যেন রুপকথার রাজকন্যার মতন দেখতে লাগছে। ছক্কু মিয়ার আর সহ্য হয় না। রোজকার মতন কলমির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্য আদরে আদরে কলমি প্রতিদিনই স্বর্গের সুখ পায়। অতঃপর কোথা থেকে ক্লান্তি আর অবসাদ আসে। দু’চোখের সুড়ঙ্গে রাজ্যের ঘুম ঢেলে দিয়ে যায়।
৪
যদিও ছক্কু মিয়া রিকশা চালায়; তবুও একটি পুরনো জরাজীর্ণ ভবনের দোতলায় থাকে। যদিও মাথার উপর ছাদ নেই। টিনের শেড দেওয়া। দুটি ছোট ছোট রুম। পাঁচ ফিট বাই দেড় ফিটের একটি মিনি বারান্দাও আছে। একটি টয়লেট। রান্না ঘর নেই। গ্যাস, কারেন্টও নেই। নিচতলা থেকে রান্না করে উপরে আনতে হয়। চরম বিরক্তিকর ব্যাপার। তবুও ভাড়া অনেক কম বলে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। সবকিছু ছাপিয়ে বারান্দাটি অসাধারণ। যেখান থেকে আকাশ ছোঁয়া যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশের মতন বিশাল বড় স্বপ্ন দেখা যায়। রাতের আকাশের নক্ষত্রের সাথে কথা বলা যায়। তারা খসা কিংবা উল্কা পতনের দৃশ্যও দেখা যায়। এখানেই কলমি আর ছক্কু মিয়ার স্বপ্নেরা বড় হচ্ছে। এই স্বপ্নদের নাম পরী, তিতলি আর জোহরা। এরাই একদিন বড় হবে। পুরুষ শাসিত সমাজের ঘাড় থেকে ধর আলাদা করবে। এসব ভাবতেই তাদের ভাঙা নৌকোর পালে হাওয়া লাগে। জোড়া শালিক পতপত করে উড়ে। ভালোবাসারা আরও মজবুত হয়ে তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। আর এই ভালোবাসা নিয়েই কলমির যত ভয়। কলমি জানে, ভালোবাসা যত বেশি, তার জ্বালাও তত বেশি। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে থাকবে না। সন্দেহের বিষবৃক্ষ সমস্ত জগত সংসার পুড়ে ছাইপাঁশ করে দিবে।
খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলমি এসব ভাবতে ভাবতে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেও ঘামছে। কলমি জানে, তার এই একরত্তি মনে কোনো পাপ নেই। তার হৃদয়াকাশে ছক্কু মিয়া ছাড়া আর কারো কোনো স্থান নেই। লুলা হোক, ল্যাংড়া হোক...ছক্কুই তার প্রাণপতি। ছক্কুতেই বাঁচা, ছক্কুতেই মরা। ছোটবেলায় কলমি দাদীর মুখে শোনেছিল, লজ্জাস্থান মানুষ কয়জনকে দেখায়!! এইটুকু পর্যন্ত ভাবতে না ভাবতেই দরজায় ঠকঠক করে তিনবার শব্দ হয়। ছক্কু এসেছে ভেবে কলমি দৌড়ে যায়। সাথে সাথে আবার এটাও মনে হয় এখন তো ছক্কুর আসার কথা নয়। সে তো গ্রামের বাড়িতে যাবে বলে গিয়েছে। একটা সন্দেহের বীজ কলমির মনে দলা পাকে। তাহলে সেই খসরু কুত্তাটা নাতো? আজ সকালে তার বাসায় কাজ করার সময় কী জানি একটা বিড় বিড় করে বলেছিল! কলমি একেবারেই পাত্তা দেয়নি। তবুও একটা বাক্য তার কানের ছিদ্রের ভেতর বিষ ঢেলে দিয়েছিল-আজ রাইতে তোর বাসায় আসব কলমি। তোর দুখের দিন শেষ। আমি তরে রাণী করে রাখব। আল্লাহর কসম দিলাম, আমার কথা মিথ্যা না।
কলমি কোনো জবাব দেয়নি। রাগে, দু:খে, ঘৃণায় হাতের কাজ শেষ না করেই হনহন করে চলে এসেছিলো। আসতে আসতে মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল, এই শুয়োরটার বাসায় আর কাজ করবে না। এখন দেখি সত্যি সত্যি সে এসে হাজির! এতোকিছুর পরেও কলমিও বুকে সাহস সঞ্চার করে। হাতে একটি পুরনো বটি। দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে?
সাথে সাথে জবাব পাওয়া গেলো, কলমি দরজা খুল। আমি খসরু চৌধুরী।
কলমির মাথায় খুন চড়ে বসলো। তড়াক করে দরজা খুলে দিয়ে বলল, হাতের বটিটা দেখতে পাচ্ছিস তো শুয়োরের বাচ্চা... এক কোপে ধর থেকে মাথা আলাদা কইরা দিমু।
কলমির এহেন রুদ্র মূর্তি দেখে খসরু আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। এমন সময় ছক্কু মিয়া বাসায় ঢুকলো। সিঁড়িতে খসরু চৌধুরীর সাথে তার দেখা। একটা সন্দেহের ঘুর্ণিঝড় তার আপাদমস্তকে তীরের মত বিদ্ধ হল। কিন্তু খসরুকে কিছুই বলল না। যা বলার কলমিকেই বলবে ভেবে দরজায় কড়া নাড়ল। কলমি জিজ্ঞেস করলো, কে?
ছক্কু মিয়া বলল, দরজা খুল মাগি। আমি তোর যম।
কলমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। হাত থেকে বটিটি নিচে পড়ে গেল। কলমিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছক্কু মিয়া রেগে-মেগে বলল, তোর সতীপনার প্রমাণ আজ আমি হাতে-নাতে পাইলাম কালনাগিনী। আমার খাস, আমার পড়স.... আর চৌধুরীর সাথে পরকিয়া করছ! তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যা মাগি। আমি তোরে তালাক দিলাম... এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক... বাইন তালাক।
এ যেন ভোজবাজির খেলা! কোথা থেকে বিজলির মতোন কী ঘটে গেল! কলমির আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনেক কিছুই বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। হঠাৎ এক ঝড় এসে কলমির সমস্ত আকাশ-বাতাস চুরমার করে দিয়ে গেল। ইতোমধ্যে পরী, তিতলি, জোহরা এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। কী ঘটেছে... ওরা কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ওদের এতটুকু বয়স হয়নি। ছক্কু মিয়া আবারও হুংকার ছাড়লো, বের হয়ে যা হারামজাদী। তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা...তোর মত ছেনালি মাগি যেন আল্লাহ আর কারো কপালে না দেয়-- !
৫
কলমি যেন একখ- পাথর। কিছুক্ষণ মাথানত করে নখ খুঁটল। এরপর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় কলমি দরজার দিকে পা বাড়ায়। পরী এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। কলমি পরীকে কোলে নিতে চাইতেই ছক্কু মিয়া জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুই বের হয়ে যা নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার...পরী আমার মেয়ে, সে আমার সাথেই থাকবে।
কলমির অনেক কিছুই বলার ছিলো। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বলেনি। বলা চলে বলতে পারেনি। কেবল দুচোখের কোণে আলোড়িত জলোচ্ছ্বাস নিয়ে নিরবে-নিভৃতে বের হয়ে গেলো।
পাদটীকা: প্রিয় পাঠক, আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, ঘটনার কয়েকদিন পরেই ছক্কু মিয়ার ভুল ভাঙে। কলমি কে আবার নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করে। কাকুতি মিনতি করে। এমন কি হাতে পায়েও ধরে। কিন্তু কলমির আর মন গলেনি। তার এক কথা, যে থুতু একবার মাটিতে পড়ে গেছে; সেই থুতু আর মুখ নেবো না।।
পরিচিতিঃ সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ
পদাবলি
ভিখারি
নাসরিন জাহান মাধুরী
ভেতরের অবদমিত প্রতিজ্ঞা
শপথের বাক্য
যাও যাও যাও, এই বেলা তুমি যাও
তারপর যেতে থাকি যত দূরে যাওয়া যায়
যত দূরেই যাই
তোমার বৃত্তের পরিধি, ব্যাস, ব্যাসার্ধ
কিছুই ডিঙাতে পারি না
সাত রঙা পাহাড় ডিঙাই
ময়ূরাক্ষী নদীতে ভাসি
সাত সমুদ্র তেরো নদী
অনন্ত নক্ষত্র বহুকাল আগে যার আলো
কৃষ্ণ গহ্বরে বদলে গেছে তার আলো ডিঙাই..
যাও যাও যাও, এই বেলা তুমি যাও
তারপরও যেতেই থাকি
ব্যথার রাগিণী বেজেই চলে
যাও যাও যাও এই বেলা তুমি যাও
যেতেই হবে! যেতে হবেই!
চোখে বিস্ময় মনে বিস্ময় নিয়ে
চলে যাই চলে যাই অজানায়
সব অগ্রাহ্য করে
আর কোন মোহ নেই
নেই মায়া পাখি
নেই পিছু ডাক
কোন সীমা রেখা আর আটকাতে পারে না...
ভুলে যেয়ো আমাকে
ম্স্তুফা হাবীব
মানবিকা, আমাকে ভুলে যেয়ো।
তুমি চেয়েছিলে স্বপ্নের গাছটিতে ফুল ফুটুক,
সুবাস ছড়াক বসন্তের সুহাসিনী বাতাসে।
আড়িয়াল খাঁর উন্মত্ত ঢেউয়ে
স্বপ্নগাছটির শেকড় থেকে মাটি সরে গেছে
আজও ফেরারি আসামির মতো সেই দুর্ভাগা স্বপ্ন
অচেনা প্রান্তরে পালিয়ে বেড়ায়।
তোমার রূপনগর আর দেখা হল না আমার
তিল শোভিত পাতাবাহার গালে হল না চুমু খাওয়া
জংধরা আরশিতে চোখ রেখে শুধু স্মৃতির আবাদ।
মানবিকা, চার দশকেরও অধিক সময়
বেয়ে যাচ্ছি কালের বৈঠা
আগুনমুখা নদীর উপাখ্যান লিখেও
আজও ভিড়তে পারিনি তোমার ঘাটে।
মানবিকা, ভুলে যেয়ো আমাকে
হৃদয়ের বিলবোর্ডে কেনো লিখে রাখো মুস্তফা হাবীব !
অস্তিত্ব
মুহম্মদ মহসিন হাবিব
একদিন তরতাজা কলমিলতা হয়ে
খাদকে রূপান্তরিত হবো
আর আমার স্বজাতিরা পোকা মাকড়ের কামড়ে জর্জরিত হবে
ফিরেও তাকাবে না কেউ
জীবন খিদে মেটাতে আমাকেও
রান্নার রেসিপি হতে হবে কোনো এক পছন্দের থালিতে
কিম্বা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ধুলি মাখা দেহে শিউলি পচা হয়ে
ঠাই মিলবে আস্তাকুড়ের লুকানো ঠিকানায়
ফুল মালার সমারোহ থাকবেনা;
থাকবেনা মাটি উৎসবের সমারোহ
শুধু থাকবে অন্ধকার আকাশে এক ফালি চাঁদের বিরাজমানতা।
কীর্তিনাশা নদীটি
নাঈমুর রহমান
কীর্তিনাশা নদীটি তারে আমি চিনি
চিনি আমি আগন্তুকের নাম।
চোখ জুড়ে তাঁর বনলতার কালিমা
কীর্তিনাশার ঢেউয়ে বহে কাজলরেখা।
সন্ধ্যা এলে আবার ফিরে শিরীষ গাছের বনে
হলুদ রঙের ডানা মেলে
কীর্তিনাশার বিস্তীর্ণ বুক জুড়ে।
আমি চিনি তাই,
চিনি আমি আগন্তুকের এলোচুলের হিজল-কমল।
কীর্তিনাশা গাহে, বহে অপরাহ্ণের সমুষ্ণ বাতাস,
খুব কাছাকাছি কলমির ফুলের দলে
সে আগন্তুক শাশ্বত নদীর মেয়েটি।
চিনি আমি কীর্তিনাশা
চিনি আমি আগন্তুকের নাম।
মুক্ত করে দিলাম
প্রণব কুমার চক্রবর্তী
স্বপ্ন তোকে আর পারছি না
চোখের সামনে ধরে রাখতে ...
ভাবনা তোকেও পারবো না
মনের ভেতরে দু হাতে ধরে রাখতে
খুব বেশী দিন...
আলো গিলে খাওয়া
অন্ধকারছন্ন মেঘের টুকরোটা
ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে-
সামনে
পেছনে
আমার চারপাশে ......
যাহ্ মন
তোকে পাখি করে উড়িয়ে দিলাম আজ
খুঁজে নিস
উড়ে গিয়ে
তোর বাসা বাঁধার মতো
নোতুন কোনও
সবুজ উন্মক্ত মাঠ
শালিকের মতো গুটি গুটি পায়ে
খুঁটে তুলে নিস
ঘাসের নীচে লুকিয়ে থাকা
জীবনের যথার্থ বর্ণমালা...
সময়গুলো বড় নিষ্ঠুর
জহিরুল হক বিদ্যুৎ
সময়গুলো বড় নিষ্ঠুর মমতায় হাত বাড়ায়
কখনো প্রচ- খরা হয়ে, কখনো ঘন কুয়াশা হয়ে।
দৃষ্টি নত হয়, দুর্ভেদ্য মনে হয় দূরের পারাপার
পথ হারায় কুহক চাদরে একঝাঁক শুভ্রকপোত।
বসুধায় কে আছে, যে বুক পেতে রাখে?
খুঁজি তারে, দেখি না তারে,
সে হারায় পথে-ঘাটে-প্রান্তরে, দূরের আবছা আলোয়
নিঃসঙ্গ খুঁজে যায় স্বর্গের অনন্ত সৌরভ,
চাতক পিপাসায় চেয়ে থাকে আকাশপানে
হায়! চোখের জলে কী স্বপ্নভাঙ্গার তৃষ্ণা মেটে?
স্বার্থের সূচকে বিশ্বে ভালোবাসার দরপতন
অসংখ্য কবিতারা দিয়ে যায় আত্মাহুতি;
শেষ ভগ্নাংশগুলো আর্তনাদ করে ওঠে বেদনায়
কবে ফুটবে ফুল কোন বসন্তে, শুদ্ধ মানবচেতনায়?
ঘৃণাগুলো আরো ঘৃণিত হয়ে উঠছে
বিষাদের কালোরঙে লেপ্টে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র।
বর্ণবৈষম্যে আজো জ্বলে পুড়ে মরে মানুষ
জাতিগত ভেদে সাম্প্রদায়িক নীল-নকশা আঁকে;
স্বাস্থ্য নিয়ে স্বার্থ খোঁজে অসুস্থ পুঁজিবাদিরা
মেতে ওঠে বিধ্বংসী অনুজীবের উত্থান-পতনে;
হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অচেনা অনুক্ষণ
কে তারে চিনতে পারে বিক্ষুব্ধ নগরে?
বিশ্বাস বিশ্বাস খেলা
ইয়াসিন আরাফাত
ক্যারম খেলায় অনেকের ভয় হতো আমার সাথে দাঁড়াতে।
বিস্তৃত হাওরের কিনারে ফুটবল খেলেছি বহু
গোল করিনি কখনও তবুও জিতেছি সতীর্থের গোলে।
আর অপ্রিয় খেলা ক্রিকেটে আমি পাকাপোক্ত নই।
এমন আরও অনেক খেলা খেলেছি আমি
গোল্লাছুট, চোর পুলিশ, বউচি, লাই, কপালটুকি আরও কত কী!
প্রচলিত বিধান অনুসারে কখনও হেরেছি কখনোবা জিতেছি।
সেইসব ভুলে গেছি শৈশবমূখর রাত পোহানোর আগে।
কেবল ভুলতে পারি না সহস্র রাত ধরে, বিশ্বাস বিশ্বাস খেলায়
মানুষকে বিশ্বাস করে জিততে পারিনি আজও!
মধ্যবিত্তনামা
মাজহারুল ইসলাম
তোমাকে লিখবো লিখবো করে
কত দিন কেটে যায় আমার!
সকাল দুপুর বিকেল গড়িয়ে
রাতের আঁধার সবকিছু কেমন গ্রাস করে নেয়
মোটা ভাত মোটা কাপড়ের অধিকারটুকু ও।
বেঁচে থাকার জন্য এই যা-
একমাত্র ‘মধ্যবিত্ত’ তকমাটা ছাড়া
আর কিছুই যে থাকে না !
তাইতো আগ-পিছ ভেবে-চিন্তে
তোমাকে আর লেখা হয় না!
জানো তো-
মধ্যবিত্তের জমি-জিরাত ঘর-দোর সবই থাকে
বাড়ির দক্ষিণকোণে শান বাঁধানো পুকুর থাকে
সুখ দুঃখ হাসি-কান্নার রক্ষণশীল গল্প থাকে
উন্মুখ প্রাপক থাকে শুধু প্রেরক থাকে মধ্যবিত্ত মননের !
নীরব নামতা
জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ
ফুরিয়ে যাওয়া একটা দুপুরের মত
ফুরিয়েই যাচ্ছি, কোনো রকম আছি;
এটাকে বেঁচে থাকা বলে; ভালো থাকা নয়।
কিছু খুঁচরো আলো ছুঁতে গিয়ে
একশ জোনাকির মৃত্যু হয়েছিল; কেউ জানেনা-
সকালের ইতিহাস মনে রাখিনা; এভাবেও যে
পাঠ করে নিতে হয় নীরব নামতা; জানা ছিল না।
তুমি হয়ে গেলে আমার ভালো থাকা; বিরহ-
আমার নির্বাক কবিতার নির্মহ ঘ্রাণ;
তুমি ভাবো না কষ্মিন সময়ে-
অথচ কেউ না হওয়া এই আমি তোমার কেউ একজন।
হৃদয়পুরে ঘুঘুর বাসা
হৃদয়পুরে ঘুঘুর বাসা
রবীন বসু
ঘুঘু খুব সুন্দর আর শান্ত পাখি। কী মিষ্টি মায়াবী ডাক। দুপুরের অবসরে সে ডাক আমাদের আকুল করে। তবু কেন লোক যে বলে, ঘুঘুর বাসা! ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখনি! এই নেগেটিভ চিন্তা থেকে একটা সূত্র খুঁজে পাই। তাহলে কি আপাত শান্ত নিরীহ সরল দেখতে কোনও মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে গোপন সত্তা। যা রহস্যময় অচেনা। যেমন আমার মধ্যে। আমার মাঝেই তো লুকিয়ে আছে অন্য এক রজত। দায়িত্ববান গোবেচারা স্বামী নয়, এক ঘাঘু গোপন দুর্বার পরকীয়া প্রেমিক। অনেক বার সংযত হবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।
মেধাকে ভালবেসে বিয়ে করি, কিন্তু মেধার বন্ধু তৃষার শরীর আমাকে টানে। মেধার শরীরে যদি লাবণ্য থাকে, স্নিগ্ধতা থাকে, তবে তৃষার শরীর যেন মোহময় আগুন। সে আগুনে পুড়ে মরতে ইচ্ছে করে। তৃষা সেটা বোঝে। আর বোঝে বলেই আমাকে খেলায়। দুই চোখের অপাঙ্গে, উন্মুক্ত ক্লিভেজে সে উদ্দাম ইশারা ধরে রাখে। আমি অস্থির হই, পতঙ্গের মতো পুড়ে মরতে চাই। সেদিন অফিস ফেরতা স্টেশনে হঠাৎ তৃষার সঙ্গে দেখা। সে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছিল। ডাকল, এ্যাই জামাইবাবু, আসুন না, এক রিক্সায় যাই।
আমার পরকীয়া দ্বিতীয় সত্তা তড়াক করে লাফ দিল। তৃষা আমাকে মজা করে জামাইবাবু ডাকে। আবার জাম্বোও বলে।
-অবশ্যই যাব, এ সুযোগ কি ছাড়া যায়! তবে তুমি আমাকে জামাইবাবু বলবে না। রজত বলে ডাকবে।
-সে না হয় হল। কিন্তু যদি মেধা জানতে পারে, আপনি আর আমি এক রিক্সায়
-কেন জানবে। তুমি না বললেই হল।
-আপনি বলবেন না!
-মাথা খারাপ! আমি বলি আর ঝাড়– খাই। একদম না।
-যদি চেনা কেউ দেখে ফেলে, আর মেধাকে বলে দেয়!
-সে দেখা যাবে! তুমি এসো তো। রিক্সার হুড তুলে দিচ্ছি। কেউ দেখতে পাবে না।
-আমি রিক্সায় উঠে বসি। তৃষা উঠতে রিক্সা চলতে শুরু করল। হুড অবশ্য তুলি না। এই পায়ে চালানো রিক্সাগুলোর সিট বেশ ছোট হয়। আমি তৃষার শরীরের সঙ্গে লেপটে আছি। ওর মেদহীন পেটের উষ্ণ ছোঁয়ায় যেন আগুন। পুড়ে যাচ্ছি। নিজেকে শান্ত করতে বাঁ-হাতটা তুলে তৃষার কাঁধের উপর রাখি। তাতে আরও ছ্যাঁকা খাই। ঘাম আসে শরীরে। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়। তৃষা আমার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। ব্যাঙ্ক মোড় পেরিয়ে ভাঙা বটতলায় আসতেই সে চেঁচিয়ে ওঠে, এ্যাই রিক্সা দাঁড়াও।
রিক্সা দাঁড়াতে বলে, রজতদা, একটা উপকার করবেন? ওই সামনের দোকান থেকে এই বডি লোশনটা এনে দেবেন। শেষ হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে একটা খালি কৌটো বের করে আমার হাতে দেয়। আমি বুঝতে পারি রিক্সা ভাড়ার সঙ্গে এটার দামও মাশুল হিসেবে দিতে হবে এই সামান্য উষ্ণ সঙ্গ লাভের জন্য। তবু হাসিমুখে নেমে যাই। নিস্তরঙ্গ বদ্ধ জীবনে একটু পরকীয়ার চনমনে ভাব। বেঁচে থাকার রসদ।
নিজের পাড়ার মোড়ে এসে রিক্সা থেকে নামি। তৃষা আর একটু এগিয়ে সামনের মোড়ে নামবে। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে এগোতে যাব, কানে আসে তৃষার গলা।
-সামনে সতেরো তারিখে আপনার জন্মদিন। মেধা আর আমাকে কিন্তু ট্রিট দিতে হবে।
ট্রিট দেবার কথা কানে আসতেই মনে পড়ে গেল অফিসের অদিতির কথা। তার টেবিলের দুটো টেবিল পরে ও বসে। বছর খানেক বিয়ে হয়েছে। তবু কারণে অকারণে সে আমার টেবিলে আসে। অন্য কলিগরা একটু বাঁকা ভাবে তাকায়। তাতে অবশ্য অদিতির কিচ্ছু যায় আসে না। বেশি ঝুঁকে কথা বলে। স্মিøমফিট জিন্সে ওকে দারুণ মোহময়ী লাগে। আমি পলকহীন ভাবে ওকে দেখি। তাতে অদিতি রাগ করে না, বরং উপভোগ করে। একবার বলেছিল, আপনার কোন জিনিসটা আমার ভাল লাগে জানেন?
-জানি না, বল।
আপনি ডাইরেক্ট আমাকে দেখেন। মানে আমার শরীরকে। লুকিয়ে বা ভনিতা না করে। এতে আমি খুশি হই। আনন্দ পাই। ভাবি, তাহলে আমি বেশ সুন্দরী।
একবার ক্যান্টিনে কফি খেতে খেতে আচমকা জানতে চেয়েছিল, আপনি আমাকে পছন্দ করেন? ভালবাসেন?
আমার মতো ঘোড়েল থতমত খেয়ে গেল। ঘেমেনেয়ে একশা। কী উত্তর দেব! জিভ জড়িয়ে আসছে। তোতলাতে তোতলাতে বলি, পছন্দ করি বটে, তবে ভালবাসা- সেটা কী করে সম্ভব! তুমি না বিবাহিত!
কেন? বিবাহিত হলে কি ভালবাসতে নেই! ভালবাসার কি কোন নির্দিষ্ট বয়স আছে বা সীমা! ভাল আমি যে কাউকে বাসতে পারি। ভালবাসা আর সেক্স কিন্তু আলাদা।
অদিতির কথার কী উত্তর দেব! আমি তো ভালবাসার সঙ্গে সেক্স গুলিয়ে ফেলি। মনে হয় দুটোই টাকার এপিঠ -ওপিঠ। কিন্তু অদিতি আমার সে ভুল ভাঙিয়ে দেয়। বলে, এই দেখুন রজতদা, আমি আমার স্বামী অয়নের সঙ্গে সেক্স করি, কিন্তু আপনাকে ভালবাসি মনে মনে। আপনার মধ্যে একটা সরল উদাস বালককে আমি দেখতে পাই। তাকেই ভালবাসি। আপনার সঙ্গ আমার ভাল লাগে। কথা বলে আনন্দ পাই।
আমি মনে মনে লজ্জায় পড়ে যাই। অদিতির এই ব্যাখ্যা আমার মনে ঘুঘুর বাসাকে ভেঙে দিল। আমি উদাস দুপুরে নীড়হারা হয়ে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে কোনোক্রমে এসে চেয়ারে বসেছি। আমাকে জব্দ করে কিংবা নীড়হারা করে ও খুব মজা পেয়েছে। হাসছে ঠোঁট টিপে। আমি লজ্জায় ওর হাসিমুখ থেকে চোখ সরিয়ে রাখি।
অদিতিও গতকাল বলেছিল, রজতদা সতেরোয় তো আপনার জন্মদিন। আমি সন্ধেবেলা আপনার আর বৌদিকে ট্রিট দেব। জন্মদিনে সবাই খেতে চায়, অদিতি খাওয়াতে চাইছে -এটা আমার খুব ভাল লাগে। উৎসাহ নিয়ে বলি, বেশ বেশ। তুমি সত্যি-ই আমাকে ভালবাস।
বাড়ি ঢুকতেই আকাশ মেঘলা। মেধার মুখ কালো। আশঙ্কার মেঘ। ও জিজ্ঞেস করে, আমার মলমটা এনেছ?
সর্বনাশ। গতকাল বাথরুমে পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল মেধা। গোড়ালিতে বেশ লেগেছে। আজ সকালে বার বার বলে দিয়েছিল, আমি আজ স্কুলে যাব না। পায়ে ব্যথা। তুমি আসার সময় অবশ্যই মনে করে একটা ব্যথার মলম নিয়ে আসবে।
উত্তেজনায় বেমালুম ভুলে গেছি। অথচ তৃষার বডি লোশন কিনে দিলাম, ওই দোকানেই তো মুভ মলমটা ছিল। অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এবার ঝড়ের ঝাপটা মুখের উপর। -আননি তো! বলবে ভুলে গেছি! তা রিক্সা চেপে বেশ তো রাসলীলা করছিলে। ওষুধটা আনতে ভুলে গেলে! কাল স্কুলে যাব কীভাবে!
-আমি কেঁপে উঠি। সত্যি ভুল হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে বলি, সরি। আমি এখনই এনে দিচ্ছি।
-থাক্ আর যেতে হবে না। আমি পলাশকে দিয়ে আনিয়েছি। আর ওই তো দেখে এসে বলল-
-পলাশ আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে। কলেজে পড়ে। ও দরকারে বৌদি মেধার অনেক কাজ করে দেয়। এখন বুঝতে পারলুম, আমার আর তৃষার রিক্সা বিলাস ওই মলম কিনতে গিয়ে দেখে ফেলেছে আর বৌদিকে রিপোর্ট করেছে।
-না মানে, তৃষা বলল-
-আর মানে বোঝাতে হবে না। তোমার এই ছুঁক ছুঁক হ্যাংলাপনা আমি ভাল বুঝি। বয়স হচ্ছে, ওয়েট বাড়ছে, সুগার তো উপরে- বলেছি না, স্টেশনে নেমে হেঁটে আসবে -শরীর ভাল থাকবে।
-আচ্ছা, আর ভুল হবে না। হেঁটেই আসব।
-মনে থাকে যেন।
ঝড় থামে। আমি ঘরে ঢুকি। রাতে খাওয়ার পর সিগারেট টানতে টানতে ভাবি, আজ তো পনেরো তারিখ। একদিন পরেই তো সতেরো। তৃষাকে ট্রিট দিতে হবে, আবার ওই একই দিনে সন্ধ্যায় অদিতি তাদের ট্রিট দেবে বলেছে। মেধা বাড়িতে যদি কোনও অনুষ্ঠান করে! ব্যাপারটা ম্যানেজ করব কীভাবে!
-মেধা ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকাল। -খুব চিন্তায় পড়েছ দেখছি। কী ব্যাপার?
পরশু তো আমার জন্মদিন, তাই ভাবছি। আমার অফিস কলিগ অদিতি বলেছে সন্ধ্যায় আমাদের ট্রিট দেবে। আবার তোমার বন্ধু তৃষা ট্রিট চেয়েছে। কী করে ম্যানেজ করি বল তো!
বিছানায় বসতে বসতে মেধা বলে, ওঃ! এই ব্যাপার! কোন্ কূল রাখবে! তাইতো?
-আমি মাথা নিচু করি। মেধা আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, ভাবার কিছু নেই। তোমার জন্মদিন এবার আমি আমার মতো পালন করব। আমার এই বাড়িতে । তোমার দুই নর্মসহচরীকে নিমন্ত্রণ করব। আমরা চার জনে মিলে সলিব্রেট করব।
-আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যায় অদিতি তৃষা আর মেধা মিলে আমার জন্মদিনের পার্টি জমিয়ে দিল। অদিতি মেধাকে রিকোয়েস্ট করল, একটু বিয়ার খেতে। কী মনে করে মেধা হাতে পেগের গ্লাস তুলে নেয় এই প্রথম। তৃষা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। তারপর আমরা চারজন গেলাসে গেলাস ঠেকিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলি। অদিতি আমার কাছে সরে এসে বলে, দেখলেন তো রজতদা, ভালবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে। তারপর মেধার দিকে তাকিয়ে বলে, ম্যাডাম স্বামীকে একটু স্পেস দিলে দেখবেন ভালবাসা বাড়ে।
তৃষা এগিয়ে আসে। বলে, মেধা, আমি এখনও বেকার। তাই জাম্বোকে একটু ঝাড়ি। রাগ করিস না।
মেধা হাসে। নির্মল তার হাসি। সে হাসিতে সব মালিন্য সব ভয় উড়ে যায়। আর আমার হৃদয়পুরে বাস করত যে ঘোড়েল ঘুঘু, সে তার বাসা নিজ হাতে ভেঙে দিল। এখন তার অবাধ মুক্তির উড়ান!
ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২১৫
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২১৫,
শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউল সানী ১৪৪৫।
হেলাল হাফিজ রচিত কবিতা
হেলাল হাফিজ রচিত কবিতা
কবি হেলাল হাফিজ (জন্ম : ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮- মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)। কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)- এর পরে হেলাল হাফিজ একমাত্র নিভৃতচারী কবি যিনি অতি অল্প লিখেও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। হেলাল হাফিজ মূলত জাতকবি।
যাতায়াত
কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না,
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না; কেউ জানেনা।
নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেউ বলেনি ভালো থেকো, সুখেই থেকো।
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো।
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।
ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর
শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ
একলা এলাম শুশ্রুষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।
উৎসর্গ
আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।
কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা-সেলুন?
কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।
কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।
কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,
পথিক এ পথে নয়
‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।
হেলাল হাফিজের কবিতা : সময়ের স্বতন্ত্রস্বর
হেলাল হাফিজের কবিতা : সময়ের স্বতন্ত্রস্বর
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
বাংলা ভাষার এক বিরল প্রতিভা কবি হেলাল হাফিজ (জন্ম : ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮- মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)। কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)-এর পরে হেলাল হাফিজ একমাত্র নিভৃতচারী কবি যিনি অতি অল্প লিখেও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। হেলাল হাফিজ মূলত জাতকবি। তিনি আসলে কবিতা উদযাপন করেছেন। তাই তাঁর কবিতা কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই কালোত্তীর্ণ হয়েছে। দ্রোহ-প্রেম ও যৌবনের কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন একজন নির্মোহ ও সাদা মনের মানুষ। কর্মজীবনে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু নেশা ছিল কবিতার অনুধ্যান। কবিতায় রাজনীতির স্বর থাকলেও কবিকে কোনো রাজনৈতিক দলের মোড়ক পড়তে দেখা যায়নি। তিনি জানতেন লেখা শুরু করে কোথায় থামতে হবে। কবি হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার পরও দীর্ঘ সতেরো বছর লেগেছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) প্রকাশিত হতে। তারপর আড়াই যুগের স্বেচ্ছা নির্বাসন। কালপরিক্রমায় দ্রোহের শিল্পভাষ্য থেকে কবি নিজেকে প্রেম ও ধ্রুপদীসত্তায় নিজেকে স্থানান্তরিত করেন। তাই তাঁর কবিতায় নারী কখনো মমতাময়ী, আবার কখনো সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ধরা দিয়েছে।
বাংলা কাব্যের বহুল পঠিত কবি হেলাল হাফিজ। মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ লিখে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়-তার অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। ব্যক্তিজীবনে খোলসবদ্ধ, মিতব্যয়ী, স্বল্পভাষী এবং প্রচ- আবেগপ্রবণ এই কবির জীবনই যেন এক রহস্যের ঘেঁরাটোপ। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া কবি হেলাল হাফিজ-পরবর্তী জীবনকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বোনাস বিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি কম লিখতে। তবে যা লিখতেন তা ছিল সময়ের স্বতন্ত্রস্বর। কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় বাংলাদেশের মানুষ, এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো, অন্যায়-বিচার, নির্যাতন, দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রেম-প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় অবলীলায় এসেছে।
হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি। তিনি কবিতা লিখে বিংশ শতাব্দী শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এক সময় বাংলাদেশের কবিতাপ্রেমী পাঠকের মুখে মুখে তার কবিতা উচ্চারিত হত। কবি হেলাল হাফিজের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলা। তাঁর পিতার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার। মাতার কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই বছর হেলাল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তুপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সেদিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি নির্লেন্দু গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দু’জনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।
প্রথম বই প্রকাশের সতেরো বছর আগেই হেলাল হাফিজ কবি খেতাপ পেয়ে যান-তাঁর কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লেখার জন্য। এ সময় কবিতাটি ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ওই কবিতার প্রথম দুইটি লাইন ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, ‘রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয় এবং এখনো পর্যন্ত এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত রাজনৈতিক স্লোগান এটি।
কবি হেলাল হাফিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দীর্ঘ সময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়ে ছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। উদ্দেশ্য পাঠক নতুন কিছু দেওয়া। কারণ, কবিতাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। হেলাল হাফিজ কবিতার মানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাই বছর বছর গ্রন্থ প্রকাশের উচ্ছ্বাস তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল না। আড়াই দশক পরে তিনি পাঠকদের জন্য লেখেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’ (২০১২), তৃতীয় এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে অমর একুশে বইমেলায়।
হেলাল হাফিজ এক নির্মোহ কবির নাম। কবিতা ছিল তাঁর কাছে আনন্দ-বেদনা যাপনের মাধ্যম। কবিতাকে তিনি কখনো উপার্জন অথবা খ্যাতির হাতিয়ার করে তোলেন নি। তাই পুরস্কারের প্রতি তার ছিল বরাবরই বিতৃষ্ণা। তারপরও বিভিন্ন সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন কবিকে বিভিন্ন পুরস্কার, সম্মাননা দিয়ে নিজেদের সম্মানিত করেছেন। এসবের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদ্যাপন কমিটি কর্তৃক ‘কবি সংবর্ধনা’ (১৯৮৫), ‘যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার’ (১৯৮৬), ‘আবুল মুনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ কর্তৃক ‘কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননা’ এবং ‘বাসাসপ কাব্যরতœ’ (২০১৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
‘জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় কবির প্রতিভার স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়। পরাধীনতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তারুণ্যকে মিছিলে এবং যুদ্ধে যেতে কবি আহ্বান জানিয়েছিলেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়কালে। কবি কী তবে মুক্তিযুদ্ধের আভাস আগেই পেয়েছিলেন। কারণ, কবিরা ত্রিকালদর্শী হয়ে থাকেন। তাছাড়া কবিগণ জানেন আত্মত্যাগের বিনিময়েই অর্জন করা যায় কাক্সিক্ষত সাফল্য। তাই তারুণ্যকে কবি স্বাগত জানিয়েছেন। কবির ভাষায়,
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।
এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
কালজয়ী কবিতার এই পঙ্ক্তি দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। পরবর্তীতে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন- দাবী আদায়ের স্লোগান হিসেবে কবিতাটি গণমানুষের মনে তুমুল সাড়া জাগায়। কবি হেলাল হাফিজের জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬)। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিভাষা আর মানুষের হৃদয়ে সঞ্চিত আবেগের মিশেলে রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যেন হয়ে উঠেছিল গণমানুষের প্রেম ও দ্রোহের শিল্প প্রতিভাষ। তাই গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তুমুল জনপ্রিয় পায় এবং পাঠক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। গ্রন্থটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ থাকায় ১৯৮৬ সালে এখন পর্যন্ত বইটির বৈধ মুদ্রণ হয়েছে ৩৩ বারের বেশি। রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে হেলাল হাফিজের কবিতার পঙ্ক্তি যেমন ব্যবহৃত হয়েছে-তেমনি আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও পারিবারিক টানাপোড়নে প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের খোঁজ-খবর করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের পঙ্ক্তি।
কবি হেলাল হাফিজ নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কবিতাটি ওই সময় কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার সাহস পায়নি। কিন্তু কবিতার প্রথম দুটি লাইন আহমদ ছফা এবং কবি হুমায়ুন কবির ১৯৬৯ সালে এক রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়াল লিখন করে দিয়েছিলেন।’ কবি শামীম আজাদ বন্ধু-প্রতিম এবং সমসাময়িক সাহিত্যিক হেলাল হাফিজকে ‘বিরল-প্রজ’ কবি আখ্যা দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘উনি কম লিখেছেন; কিন্তু প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন। কবিতা ছিল ছোট, কিন্তু ব্যাপক ভাব প্রকাশ করতো সেগুলো।’ লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে-বিদ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে যান। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন,
ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে?
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্তঋণে স্বদেশ হলো, তোমার দিকে চোখ ছিল না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’
কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে। ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় দেশ স্বাধীনের কথা বলেছেন। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস বয়ে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মাধ্যমে পাওয়া যায় দীর্ঘ পরাধীনতা থেকে মুক্তি, একটি স্বাধীন ভূখ- এবং একটি পতাকা। যা জাতির বীরত্ব ও সার্বভৌমত্বের পরিচয় বহন করে। কবি লিখেছেন :
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা
কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে
ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস
ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’।
‘ফেরিঅলা’ কবিতায় হরেক রকম কষ্টের কথা বলেছেন। একজন ফেরিঅলা যাপিত জীবনের নানা রকম কষ্ট বিক্রি করতে চান। জগৎ সংসারে কষ্টের নানা প্রকারভেদ রয়েছে। প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট, অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট, ভুল রমণী ভালোবাসার, ভুল নেতাদের জনসভার হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে। আরও বিভিন্ন প্রকার কষ্টের কথা কবি বলেছেন। কেউ কষ্টের ভার নিতে চাইলে কবি অনায়াতে তা দিতে পারেন। কবি বলেছেন :
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট।
‘ইচ্ছে ছিলো’ নিটল প্রেমের এক রোমান্টিক কবিতা। এ কবিতায় কবি তাঁর মানস প্রতিমাকে সাজাতে চান নিজস্ব ঢংয়ে। বাংলার ষড়ঋতুর সৌন্দর্য এনে ঢেলে দেবেন প্রিয়ার শরীরে। প্রয়োজনে নিয়োগ করা হবে সুদক্ষ মেকাপম্যান। তাঁর প্রিয়াকে অনিন্দ্য হতেই হবে। কবির ইচ্ছে ছিলো প্রেমিকাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবেন। প্রেম দিয়ে বাজাবেন বিশ্বভুবন। কবি লিখেছেন:
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
কান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।
ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।
‘নেত্রকোনা’ কবিতায় কবি যেন ফিরে তাকিয়ে দেখছেন ফেলে আসা অতীতপুরে। আবহমান বাংলার চির-সবুজ গ্রাম; বাল্যস্মৃতিতে ফিরে গেছেন কবি। নাগরিক করপোরেট জীবন মানুষকে অসাড় করে দেয়। ভালোবাসা, মায়া-মমতাহীন ইট, পাথরের শহর এক সময় বিষণœ লাগে। ইচ্ছে করে গ্রামে ফিরতে। যেখানে বাড়ির প্রাঙ্গণে নিষ্পলক কেউ একজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কেউ ট্রেনের হুইসেলের শব্দে তোলপাড় করে ওঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। অথচ জীবনের পাশাপাশি ওতোপ্রোতভাবে থাকে অদ্ভুত মরণ। কবির ভাষায় :
কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?
কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?
তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল।
মগড়ার ক্ষীণ কলরোল
অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,
তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,
যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে
জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।
‘প্রস্থান’ কবিতায় কবি তাঁর মানস প্রিয়ার কাছে পত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন। কারণ, প্রিয়জনের চিন্তা সব সময় মনকে ব্যথাতুর করে রাখে। যেখানে একটা চিঠি পাওয়া মানে মনের প্রশান্তি। একটা সময় ছিল-যখন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান বাহন ছিল চিঠিপত্র। দূরে অবস্থানকারী আপন জনেরা চিঠির মাধ্যমে খবরা-খবর আদান-প্রদান করতেন। কবি তাই চিঠিকেই প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। প্রিয়জনকে বার বার অনুরোধ করেছেন পত্র দিতে। কবির লিখেছেন :
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।
হেলাল হাফিজ সেই দুর্লক্ষ, দুর্লভ কবিদের একজন, যিনি নিতান্ত স্বল্প সৃষ্টি-সম্ভার সত্ত্বেও জয় করেছেন তুঙ্গস্পর্শী জনমানস। সমান্তরালে শিল্প-সিদ্ধিতেও যা পরিপ্লুত। তাঁর কবিতার বিষয় ও প্রকরণ যুগপৎ মেলবন্ধনে সার্থক, কালোত্তীর্ণ। স্বল্প সৃজনেও তিনি বরাবরই প্রাসঙ্গিক এবং প্রোজ্জ্বল। হেলাল হাফিজের কবিতার প্রাণশক্তি বস্তুত ব্যক্তিক মনোলোকের নিগূঢ় অন্তর্বীক্ষণে। আবার ব্যষ্টির অনুভব, চারিত্র, সংক্ষোভ-দ্রোহও তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র। নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না কিংবা ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’- জনশ্রুতি বা প্রবাদবাক্যে রূপান্তরিত এরকম পঙ্ক্তিসমূহ কাল ছাপিয়ে কালান্তরের দরজায় কড়া নাড়ে। কবি হেলাল হাফিজ বেঁচে থাকবেন স্বীয় কর্মের মাধ্যমে। কবির মহাপ্রয়াণে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
কবি ও গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।