ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১২৯

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১২৯
তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। ধানশালিক ।। সংখ্যা ১২৯
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০১৯



















সঞ্জীব চৌধুরী : যাঁর কবিতাই গান, গানেই বিপ্লব

সঞ্জীব চৌধুরী  : যাঁর কবিতাই গান, গানেই বিপ্লব


সঞ্জীব চৌধুরী
যাঁর কবিতাই গান, গানেই বিপ্লব

মনসুর আহমেদ

আমি তোমাকেই বলে দেব/কী যে একা দীর্ঘ রাত/আমি হেটে গেছি বিরান পথে/আমি তোমাকেই বলে দেব/সেই ভুলে ভরা গল্প/কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়/ছুয়ে কান্নার রঙ ছুয়ে জোছনার ছায়া!
সঞ্জীব চৌধুরী
জন্ম: ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৫- মৃত্যু: ১৯ নভেম্বর, ২০০৭)

হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে যে টগবগে তরুণ রাজপথে গণমানুষের কথা বলেছে সে আর কেউ নয়, আমাদের সঞ্জীব চৌধুরী। কবি, সাংবাদিক, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, নাট্যকার এবং সংগঠক হিসেবে খ্যাতি ছিল মেধাবী সব্যসাচী মানুষ সঞ্জীব চৌধুরীর। গানে গানে তিনি যেভাবে প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করেছিলেন তা বাংলা সংগীতে বিরল! শাসকদের চোখ রাঙানিতে যখন কম্পিত গোটা বাংলা, প্রত্যেক সাধারণ মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপ যেখানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করা হচ্ছে সেখানে তিনি ঠিকই শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ তোলেন তার গানের মধ্য দিয়ে। এবং তিনি গানে গানে বলে গেছেন মানব জীবনের গাঁথা প্রেম, বিরহ, সমাজ, রাজনীতি, প্রতিবাদ, দ্রোহ সমানভাবে তার গানে লেপ্টে আছে। নব্বই দশকে গনতন্ত্র যখন যাদুঘরে আর মানুষের অধিকার যখন শাসক গোষ্ঠীর হাতে তালুবন্দি, গান আর কবিতা পাগল সঞ্জীব চৌধুরী রাজচক্ষুকে বৃদ্ধাআঙ্গুলি দেখিয়ে দলবল নিয়ে আন্দোলনে সরব ছিলেন। মানুষের কথা বলার অধিকার সবাই রাখে কিন্তু সবার হিম্মত হয়না জেগে উঠার। অনেকটা একরোখা মনোভাবের সঞ্জীব চৌধুরী পৃথিবীর স্বপ্নবিলাসী মানুষের কথাই বলেছেন গানে গানে। তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রথাগত সৃষ্টিতে কখনও বিশ্বাসী ছিলেন না। গান এবং কবিতা কে উচ্চমাত্রার আধুনিকতার ছোঁয়ায় পৌঁছে দিয়েছেন ভক্ত হৃদয়ে। মেধাবী কিশোর সঞ্জীব পারিবারিক আড্ডা বেশ জমিয়ে তুলতেন নিজের বানানো ভূতের গল্প শুনিয়ে। কোন কিছুই তাঁর কাছে কঠিন হয়ে উঠেনি। স্বাভাবিক সাদামাটা ভাবেই কাটিয়ে দিলেন ছোট্ট জীবনটা। ঝলমলে আকাশের একটি তাঁরা হঠাৎই আলোকরশ্মি থেকে দূরে চলে গেল। চারদিকে কেমন জানি অন্ধকার, আহা রে! এভাবেই পৃথিবীর আলো বাতাস ছেড়ে অকালে চলে গেলেন আমাদের সঞ্জীব চৌধুরী। বিশাল শূন্যতার মাঝে আজও অনেক চিৎকার, চেচামেচি শুনি, তবুও নীল আকাশের কান্না থামেনি।

সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং এর জলবান লক্ষ্মী বাউলের পাশের মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনাদের আদিনিবাস সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে। সেখানকার জমিদার শরৎ রায় চৌধুরী ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরীর পিতামহ। উনার মামার বাড়ী মাকালকান্দি গ্রামে জমি ক্রয় করে পিতা ননীগোপাল চৌধুরী এবং মাতা প্রভাষিনী চৌধুরী বসতি স্থাপন করেন। নয় ভাই বোনের  মধ্যে এ তাঁর অবস্থান সপ্তম। শরীরে জমিদার বংশের রক্ত থাকার পরও সঞ্জীব চৌধুরী পুঁজিবাদ আর সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। প্রতিটি লড়াই সংগ্রামে তার সক্রিয় অবস্থান ছিল। সঞ্জীব চৌধুরী হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা পড়া করেন, পরিবারের সবাই ঢাকায় চলে যাওয়ায় তিনি বকসি বাজার নবকুমার ইনস্টিটিউট ভর্তি হয়ে ১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্ট্যান্ড মার্ক পেয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অর্জন করেন। উনার এই রেজাল্টে খুশি হয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ একদিন স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেন এবং ১৯৮০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, এমনকি বড় বোন ড. নীলিমা চৌধুরীর মাধ্যমে ব্যাঙ্গালোরে স্কলারশিপ এ ভর্তির সুযোগ পেয়েও ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে। পরে বিষয় পাল্টে মনের বিষয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সঞ্জীব চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে। কাজ করেছেন আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও যায়যায়দিনসহ বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায়। ফিচার সাংবাদিকতায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল তার সৃষ্টিশীলতা। বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত ফিচার বিভাগ শুরু হয় তাঁর হাত ধরেই। বাংলাদেশে ফিচার সাংবাদিকতার জনক বলা চলে তাকে।

সঞ্জীব চৌধুরীর মধ্যে কাব্যপ্রতিভাও ফুটে উঠে অসাধারণ ভাবে। নিজেও কবিতা লিখতেন আবার আবৃত্তিতেও বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। শুধু কবিতাই নয়, বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছিলেন তিনি। তার লেখা গল্পগ্রন্থ ‘রাশপ্রিন্ট’ আশির দশকে বাংলা একাডেমী কর্তৃক সেরা গল্পগ্রন্থ হিসেবে নির্বাচিত হয়। আহমদ ছফাও সঞ্জীব চৌধুরীর লেখনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমনিতে নাটকের স্ক্রিপ্টও লিখতেন সঞ্জীব চৌধুরী। নীল ক্লিনিক, রাশপ্রিন্ট, কোলাজ নামের তিনটি  কবিতা, ছোট গল্প, নাটক এর পান্ডুলিপি কে একত্রিত করে এসময়ে বরেণ্য আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মোস্তফা ১৯৯০ সালে ‘রাশপ্রিন্ট’ নামে সঞ্জীব চৌধুরীর একমাত্র গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করেন। সঞ্জীব চৌধুরীর ছোট বোন বাবলী চৌধুরী জানান, বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দলছুট’ এর প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জীব চৌধুরীর সংগীত জগতের কোন উস্তাদ নেই। নিজে নিজেই শিখেছেন গান, তবে উনার মা প্রভাষিনী চৌধুরী ভাল ধামাইল গান ও ধর্মীয় গান জানতেন, মায়ের কন্ঠে শোনা গানই সঞ্জীব চৌধুরীর প্রেরণা। সঞ্জীব চৌধুরীর কথা বলতেই গেলে চলে আসে আরেকটি নাম বাপ্পা মজুমদার। ১৯৯৫ সালে ছন্নছাড়া তরুণ বাপ্পা মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ‘দলছুট’ ব্যান্ডের জন্ম দেন। ১৯৯৭ সালে দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’ প্রকাশিত হওয়ার পরেই চারদিকে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। এরপর ‘হৃদয়পুর’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আকাশচুরি’, ‘জ্যোছনা বিহার’, ‘টুকরো কথা’, ‘আয় আমন্ত্রণ’ নামে আরো কয়েকটি অ্যালবাম বেরিয়েছে এই ব্যান্ড থেকে। এর মধ্যে এ  ‘স্বপ্নবাজি’ ছিলো সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম।

হাওর বাঁওড় সবুজ প্রকৃতির বুকে বেড়ে উঠা সঞ্জীব চৌধুরী নব্বই দশকের উত্তপ্ত রাজনৈতিক বাংলাদেশ উত্তাপ ছড়িয়েছেন নিজের খেয়াল খুশি মত, বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত সঞ্জীব চৌধুরীর ভিতরে কখনও ভয় বাসা বাঁধেনি। এই পঁচা-গলা পোষাকি সিস্টেম এবং শ্রেণী বৈষম্যের সমাজের বিপরীতে সঞ্জীব চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন একরোখা তেজী বিপ্লবীর মত, স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যবাদী সমাজের, পা বাড়িয়ে ছিলেন আলোকিত পথে, বেঁচে থাকার কথা বলার জন্য রাজপথে ছিলেন সরব। কখনও দেশের রাষ্ট্র প্রধান, আবার কখনও উনাদের চামচাদের মুখোশ উন্মোচনে সোচ্চার ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। অবরুদ্ধ সময়েও তার গান থামে না। চারদিকে যখন বেয়নেট আর জলপাই রঙের ওড়াওড়ি, তখনও তিনি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেছেন স্বপ্নের কথা, আর্তনাদের কথা, শান্তির কথা। পৃথিবীর পথে পথে শান্তিকামী সঞ্জীব চৌধুরীর স্বপ্ন পিচ ঢালা পথে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত। বিশ^ মুড়লরা চিবিয়ে খাচ্ছে একে অন্যের হাড়। তবুও স্বপ্নরা পাখির দলে, উড়ছে আকাশে বাতাসে। প্যারোডি গানের এর মধ্য দিয়েও তিনি সমাজে মানুষের জন্য প্রেরণা জাগিয়েছেন অনেক শক্তিশালী ভাবে। কবিতা এবং গানে প্রতিনিয়তই বলে গেছেন গণমানুষের কথা। শ্রম ঘাম বিক্রি করে খেটেখুটে খাওয়া মানুষের কথা সঞ্জীব বলেছেন অনেক বেশি। এখনও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে চিয়ারম্যান মেম্বররা সুবিধামত লুট করছে গরীবদের রিলিফ, খাবিখা, খাবিটা সহ বিভিন্ন প্রজেক্টের টাকা। সঞ্জীব চৌধুরীর দেখানো পথে কিছু মানুষ এখনও প্রতিবাদী আন্দোলনে থাকলেও সংখ্যায় অনেক কম। স্বপ্নের কাছে কথা রেখে বলতে পারি অথবা একদিন অসংখ্য সঞ্জীব; বুর্জোয়া জনপ্রতিনিধির গলা টিপে ধরবে। মুক্ত আকাশে, মুক্ত মনে ঘুরে ভেড়াবে খেটে খাওয়া মানুষের হৃদয়ে। কতটা সহজই বলে দিয়েছেন এক পলকেই চলে গেল, রিক্সা কেন আস্তে চলে না।

চাপ চাপ কষ্ট, ফালি ফালি বেদনা গানের ভিতর, দীর্ঘ রাতের বুকের প্রান্তে আমাদের ফেলে দিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী হেটে যায় বিরান পথে, কবির হাজার বছরের পথে! তিনি গানের মধ্যে বলে যান সম্পর্কের অভিজ্ঞানের ভুল ইতিহাসে, কান্নার রং আর জোছনার ছায়ার ভিতর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়! “চোখটা এতো পোড়ায় কেন/ ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও/ সমুদ্র কী তোমার ছেলে/ আদর দিয়ে চোখে মাখাও?” শুধু কী বিরহ? প্রেমের আকুল আবেদনও ফুটে উঠেছে তার গানে। প্রেমিকার প্রতি এক পাগল প্রেমিকের আবেদন প্রকাশ করতেই গানে গানে উজ্জীবিত সঞ্জীব চৌধুরী। “গাড়ি চলে না চলে না/চলে না রে, গাড়ি চলে না/ চড়িয়া মানব গাড়ি/ যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি/ মধ্য পথে ঠেকলো গাড়ি/ উপায়-বুদ্ধি মেলে না।” বাউল শাহ আব্দুল করিমের লেখা এ গানের কথাগুলোর মতো সত্যিই থেমে গেছে সঞ্জীব চৌধুরীর জীবন গাড়ি। সে কণ্ঠ দিয়ে তার আর কোনো নতুন গান জন্ম নেয় না। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

সঞ্জীব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য কিছু জনপ্রিয় গান, ‘আমি তোমাকেই বলে দেব’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘চল বুবাইজান’, ‘আকাশচুরি’, ‘হৃদয়পুর’, ‘গাড়ী চলে না’, ‘সমুদ্র সন্তান’, ‘তোমার ভাঁজ খোলো'’, ‘আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ’, ‘স্বপ্নবাজি’, ‘আমি ফিরে পেতে চাই’, ‘সমুদ্র সন্তান’ প্রভৃতি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের রাত জাগা তরুণেরা তার গান গেয়ে হলে ফেরে, ঘরে ফেরে কিংবা তারা আর ঘরে ফেরেই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সবুজ ঘাস গালিচায় এখন আর রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সঞ্জীব চৌধুরী, শিমুল মোস্তফা, কামরুজ্জামান কামু সহ একদল গান ও কবিতা পাগলদের প্রাণবন্ত আড্ডা নেই। সঞ্জীব চৌধুরীর গিটারের সুরে রুদ্র আর শিমুল কবিতা আবৃত্তি করেননা। কামু মনের সুখে কাগজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নতুন কবিতার গন্ধ পাচ্ছেন না। তবে হে, টিএসসির ‘সঞ্জীব চত্বরে’ সঞ্জীব উৎসব উদ্যাপন করে প্রতি বৎসর সঞ্জীব ভক্তরা। তিনি তাঁর ভক্তদের হৃদয়ে পরম শ্রদ্ধায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে বেঁচে থাকবেন।

সম্পাদক, লিটলম্যাগ ‘শব্দকথা’।
রামকৃষ্ণ মিশন রোড, হবিগঞ্জ।

নীরার নীল শাড়ি ও কয়েকটা কদমফুল

নীরার নীল শাড়ি ও কয়েকটা কদমফুল


নীরার নীল শাড়ি ও কয়েকটা কদমফুল
রফিকুল নাজিম



শাওয়ার ছেড়ে আসা নীরাকে আয়নার সামনে সদ্য ফোটা পদ্মফুলের মতোই লাগে। আজও লাগছে। এই দিনে নীরা খুব সাজতে পছন্দ করে। প্রতিবারই নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পরে, সাথে সাদা ব্লাউজ, হাতে পরে সাদা-নীল রেশমি চুড়ি। টানা টানা চোখের পাতায় লেপ্টে থাকে মায়ার কাজল, ঠোঁটে জড়িয়ে যায় গাঢ় লাল লিপস্টিক এবং কপালের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট একটা কালো টিপ পরে। ঠিক যেন অমরাবতী, অনন্যা। অদ্ভুত এক আলো ঠিকরে পরে তার চোখে মুখে। নীরার চোখে শতাব্দীর ব্যাকুলতা, সমানতালে পায়ে পায়ে হাঁটে অস্থিরতা। নীরা কিছু একটা খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। রাগে গজগজ করে ডাকছে তমালকে। এদিকে তমাল কানে তালা দিয়ে বিভোর ঘুমে ডুবে আছে। রাগে কটমট করতে করতে বেড রুমে ঢুকে তমালের শরীর ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করছে
তমাল, আমার বেলি কোথায়? এই তমাল, শুনছো-আমার বেলিফুল কোথায়?
তমাল আড়মোড়া দিয়ে আধেক চোখ খুলে দেখে নীরার অগ্নিমূর্তি। তমালের বুঝতে আর বাকি রইলো না-আজ ০২ শ্রাবণ। আজ নীরার দিন। এই দিনে নীরার বেলী ফুলের মালা চাই-ই চাই। তমাল কিছু না বলেই ডাইনিং রুমের দিকে ছুটে গেলো। সাদা একটা কাগজের ঠোঙা নীরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এই নাও তোমার বেলি ফুলের মালা।’
ঠোঙা থেকে মালাটা বের করে নীরা দেখলো ফুলগুলো একদম তাজা। মনে হলো কেউ মাত্র বাগান থেকে তুলে এনে মালা গেঁথে রেখেছে। কিছুটা অবাকই হয় নীরা। কিন্তু নীরা এইদিনে অহেতুক কোন কথা বলতে পছন্দ করে না। নীরা খোঁপায় মালাটা পরেছে। এইদিনে নীরা ক্রমেই হুমায়ুন আহমেদের রূপার মতোই সুন্দরীতমা হয়ে উঠে। আজ ০২ শ্রাবণ ; আবীরের সাথে দেখা করতে যাবে নীরা।


নীরা আবীরকে প্রথম দেখেছিলো এক আবৃত্তি সন্ধ্যায়। টিএসসির মিলনায়তনে। হাবাগোবা টাইপের একটা ছেলে। অনেকদিনের অত্যাচারে রঙ পোড়া জিন্স, গায়ে হলুদ পাঞ্জাবি, পায়ে চটি স্যান্ডেল, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তার ডান কানে গোজা রক্তজবা। সবেমাত্র আবীর নিজের লেখা ‘নীরা, তোমাকেই ভালোবাসি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে মঞ্চ থেকে নেমে আসছে। কী ছান্দসিক ছন্দে হাঁটছে একজন কবি ও বাচিক শিল্পী! নীরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আবীরের যাদুকরী কন্ঠ, কবিতার পুংক্তিতে লুকানো সম্মোহনী টান পুরোপুরি গ্রাস করেছে তাকে। নীরা পাথরমূর্তির মতো নিশ্চল। নীরার খুব ইচ্ছে করছে কবিকে একবার শুকনো মুখে ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু নীরা নড়তে পারছে না। দ্রুত পায়ে আবীর বের হয়ে গেলো। তবুও পুরো হল রুম জুড়ে থেকে গেলো আর থেকে গেলো নীরার মনের সংরক্ষিত এলাকা জুড়ে।

তারপর থেকে নীরা কতশত বার আবীরকে ফেসবুকে খুঁজেছে। ক্যাম্পাসে ইতিউতি করে খুঁজেছে আবীরকে। দেখা পায়নি প্রিয় মানুষটার। হঠাৎ একদিন নীরার হলের বড় আপু একটি কবিতা ফেসবুকে শেয়ার করে। তিনি কবিতাটি শেয়ার করেছেন ‘খড়ের মানুষ’ নামের একটি পেইজ থেকে। ‘খড়ের মানুষ’ কবি আবীর রুদ্রের কবিতার পেইজ। নীরা এই কবিতাটির আবৃত্তি শুনেছিলো বন্ধুদের আড্ডায়। তারপর থেকে নিয়মিতই নীরা পেইজটিতে লাইক কমেন্ট করে সক্রিয় থাকে। তারপর শুরু হয় ম্যাসেঞ্জারে কবিতার ব্যবচ্ছেদ। চলে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন পাল্টা প্রশ্ন। এভাবেই হৃদয়ে কড়া নাড়ে দু’জন দু’জনকে। শুরু হয় আবীর ও নীরার অধ্যায়।

আবীরের বাড়ি নরসিংদী। বাবা নেই। কোনো রকম টিউশন করে চলে পড়াশোনা। ক্যাম্পাসে খুব একটা আড্ডা দিতে দেখা যায় না তাকে। ক্লাশ পরীক্ষা, টিউশন আর পত্রিকা অফিসে দৌঁড়াদৌড়ি করেই কাটে আবীরের দিন। আবীর কিন্তু বেশ সুদর্শন ছেলে। তবে এলোমেলো থাকতে পছন্দ করে সে। মনে হয় চুলে চিরুনি পড়ে না অনেকদিন। কখনো ফেয়ার এন্ড লাভলির প্রলেপ পড়েনি মুখে। তবুও খুব একটা মন্দ লাগে না দেখতে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো-আবীরের শরীরে এখনো কাঁদামাটির সোঁদা গন্ধটা লেগে আছে।

নীরার বাড়ি পটুয়াখালী। খুব আদুরে একটা মেয়ে। চমৎকার গান করে। দু’তিনবার ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক মঞ্চে নৃত্যও করেছে। ছিপছিপে গড়নের নীরা। উচ্চতা, ফিগার, ত্বকের রঙ-সব মিলিয়ে অনন্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ১ম বর্ষে কত সিনিয়র ভাই যে নীরাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছে! আল্লাহ্ মালুম। কিন্তু ব্যবসায়ীর মেয়ে হিসেবে নীরা হয়তো আগে থেকেই লাভ ক্ষতির অংকে পটু। তাই কারো ইশারার সাড়া দেয়নি। এখন তো ৩য় বর্ষের এই নীরাকে ক্যাম্পাসের ছোটবড় সবাই ভয় পায়। পাশ দিয়ে গেলেও কেউ মনে মনে শিষ দিতেও ভয় পায়। মনে মনে মন কলা খেতেও আঁতকে উঠে সবাই। ক্যাম্পাসে এমন গল্পও প্রচলিত আছে যে, কয়েকজনের নাকি অমাবস্যা পূর্ণিমা আসলে কানের নিচে এখনো ব্যথা করে খুব। দস্যি মেয়ে বলতে যা বুঝায় আর কি!


সেই নীরাই কিনা একটা গেঁয়ো আনস্মার্ট ভূতের প্রেমে পড়েছে! পুরোটা সময় নীরার সর্বস্ব জুড়ে থাকে এই ভূত। নীরা রোকেয়া হলের ৩১১ এর বাসিন্দা। এখন নীরা নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। মনটা ভীষণ অবসন্ন-ক্লান্ত। গত ৪ মাস ৯ দিন হয় আবীরের সাথে মোবাইলেও কথা হয় নীরার। কিন্তু কোনো ভাবেই নীরা বুঝতে পারছে না আবীর তাকে পছন্দ করে কিনা। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে তার। নিজেও বলতে পারছে না মনের লুকানো কথাগুলো। আর বলবেই বা কি করে!
ফেসবুকে বন্ধুত্ব করার পর এখনো তো সামনাসামনি তাদের দেখাই হয়নি। ক্যাফেটেরিয়ার কফির শূন্য পেয়ালা হুদাই পড়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড মাইগ্রেইনের পেইন হচ্ছে নীরার। নাহ, আজ অজ্ঞাতনামা এই সম্পর্কের একটা নাম দিয়েই ছাড়বে  সে। নীরা খুব কটকটা স্বভাবের, বড্ডো জেদি মেয়ে। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো আবীরকে-
-হুম। কোথায় আছেন? গত দু’দিন ধরে আপনার কোন হদিস নেই। কল রিসিভ করেন না। আমার সাথে এমন করছেন কেন?’ রাগে অভিমানে এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে নীরা। ওপাশ থেকে কোন রা নেই। উত্তর নেই। খুব নির্লিপ্তভাবে শুনেই যাচ্ছে আবীর। নীরা এবার একটু আদুরে গলায় বলতে শুরু করে, ‘আমার বুঝি কষ্ট হয় না? কারো জন্য মনটা খুব পোড়ে-কেউ কি সেটা অনুভব করতে পারে? যদি আমাকে কেউ উটকো ঝামেলা মনে করে- সরাসরিই তো বলতে পারে। তখন না হয় আমি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি হয়ে যেতাম।’ এবার মুখ খুলে আবীর, ‘এসব কি আজেবাজে বকছেন! নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি হবেন কেন? আমি এতো খুঁজতে পারবো না তখন। এতো ধৈর্য্য আমার নেই। আমি চাই আপনি থাকেন। ঠিক এভাবেই। আমার কবিতার শক্তি হয়ে। ছান্দসিক পঙক্তি হয়ে।’ কথাগুলো নীরার কাছে একজীবনের আরাধ্য। এই মুহূর্তে সে নীল একটা আকাশে সাঁই সাঁই করে উড়ছে। নীরার চোখে প্রজাপতি ডানা মেলেছে। আজ সে আবীরের গলায় অন্য কিছু পাচ্ছে। ভিন্ন এক আকুলতা।
আবীরের মনেও অযুত কবিতা এসে ভীড় করে আছে। পরিচিত ব্যবহারিক ভালোবাসার শব্দগুলো মানবিক স্বীকৃতি চাচ্ছে। নীরবতার প্রাচীর ভেঙে নীরা বললো, ‘তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। সন্ধ্যায় তোমার সময় হবে? ‘নিজের অজান্তেই নীরা আবীরকে তুমি বলে সম্বোধন করে ফেলছে। আবীর মুচকি হেসে বললো, ‘হুম, দেখা হলে খারাপ হবে না।’
হুম। আমাদের দেখা হবে কবে? প্রশ্ন করে নীরা।
‎হুমমমম, ০২ শ্রাবণ।’
কিছুটা চিন্তা করে জানালো আবীর।
‎আজ তো আষাঢ়ের ২৭ তারিখ। ০২ শ্রাবণ আসতে তো আরো অনেক দেরী। চলো আজই দেখা করি।
‎না। অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়।
‎সেদিন কিন্তু আমি তোমার পাশে বসবো।
‎হুম। সেদিন দেখা যাবে।
‎আমার একটা আবদার আছে। বলবো?
‎বলেন।
‎আমাদের প্রথম সাক্ষাতে তুমি ‘নীরা, তোমাকেই ভালোবাসি’ কবিতাটি আবৃত্তি করে শুনাবে। তোমার এ কবিতা আমার খুব প্রিয়।
‎হুম। সেদিন আপনার সব ইচ্ছে পূরণ করতে চেষ্টা করবো।
‎সত্যি? বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে নীরা। ‘আমার সব ইচ্ছে  কিছু পূরণ করবে!’ আবীর জিহ্বায় কামড় দিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললো, ‘কবিরা সচরাচর উদারপন্থীই হয়। ‘তারপর তাদের মৌনতায় কেটে যায় আরো কিছু সময়। নীরবতা ভেঙে নীরা জিজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা, তুমি সেদিন কি পরে আসবে?’
‎আমি তো সবসময় পাঞ্জাবিই পরি। আপনি কি পরবেন?
‎তুমিই বলো।
‎জানেন নীরা- সেই কবে থেকে আমার মনে গোপনে এক মায়াবতী বাস করে!
‎মানে! মায়াবতী! কে সে? তোমার গার্লফ্রেন্ড?
‎আরে না। আমার কল্পনায় প্রায়ই একটা মেয়ে হুটহাট চলে আসে। আবার ফিরে যায়। আলেয়ার মতোই তার আসা যাওয়া। ইচ্ছে করেই সে মুখটা আড়াল করে রাখে। আমাদের মধ্যে মায়া হয় কিন্তু সে মায়া নক্ষত্রের মতোই হঠাৎ ছিটকে পড়ে অন্ধকারে।
‎মনে হয় কোনো খারাপ জ্বীন তোমাকে আছর করেছে! সাবধানে থেকো। দেখবে কোনদিন তোমার আবার ঘাড় না মটকে দেয়! মিষ্টি একটা হাসির ছলাৎ শব্দ ভেসে আসে দূরালাপনি যন্ত্রে। আবীর চোখ বুজে অনুভব করতে পারে নীরার উপস্থিতি। যেনো খুব কাছেই আছে নীরা।
-‎আচ্ছা নীরা, আপনি বর্ষা রাণী সেজে আসবেন।
-‎কি বলছো- আমি তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতেছি না! ক্লিয়ারকাট বলো।
-‎হুম। তুমি নীল শাড়ি পরবে। কাজল আঁকবে চোখের পাতায়, সাথে সাদা ব্লাউজ, হাতে নীল সাদা রেশমি চুড়ি, কপালের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট কালো টিপ পরবে। আমি তোমার কানে গুঁজে দিবো একটা লাল টকটকে রক্তজবা।
নীরা আবীরের কথাগুলো শুনে অবাকই হয়। তবুও মেনে নেয়। নীরা রুমমেট পিউকে নিয়ে নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে কিনে নীল সুতি শাড়ি, চারুকলার গেইট থেকে কিনে নীল সাদা রেশমি চুড়ি। বাতেনের দোকান থেকে কিনে গলার মালা। নীরার যেনো আর তর সইছে না। আর একটা রাত সকালের ছোঁয়া পেলেই আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নীরা আর আবীরের দিন। পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটবে। মনে অজান্তেই আবীরের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিবে। আবীর বাম হাত দিয়ে নীরার চুলে হাত বুলিয়ে দিবে। নীরার চোখ বুজে আসবে। মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যাবে দ্রুত। আরো কত ভাবনা যে আসে মাথায়! নীরা নিজেই বোকার মতো একা একা হাসে। নিজেই নিজের মাথায় ঢুস দেয়। যেনো মাথা থেকে পাগলা এক ভূতকে তাড়াচ্ছে।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি নীরার। সকাল থেকেই রেডি হচ্ছে সে। কয়েকবার কল করেছে আবীরকে। কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। হয়তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। তাই আবীরকে আর বিরক্ত করেনি নীরা। গোসল সেরে এসেই সাজতে শুরু করেছে সে। আজই প্রথম শাড়ি পরবে নীরা। তার পছন্দের পোশাক জিন্স, টপস্, আর সামাজিকতার খাতিরে কালেভদ্রে থ্রি-পিস পরে। তার রুমমেট পিউ সুন্দর করে শাড়ি পরাতে পারে। হলের এ ব্লকের সবাই পিউর কাছে শাড়ি পরতে আসে। হ্যাঁ, নীরাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ। মনে হচ্ছে আবহমানকালের শুদ্ধ বাঙালিয়ানার মূর্ত প্রতীক হলো আজকের নীরা!
নীরার ফোন বেজে উঠলো। আবীর কল করেছে। ঘুম ঘুম গলায় আবীর নীরাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘নীরা, এত্তো সকালে এত্তোগুলো কল! কোনো সমস্যা হয়েছে আপনার?’ আবীরের এমন উজবুকের মতো কথা শুনে নীরার শরীরে আগুন ধরে গেলো। মেজাজটা পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেলো। তবুও রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে বললো, ‘আজ ০২ শ্রাবণ। আমাদের দেখা করার কথা। মনে পড়েছে? ‘আবীর আমতা আমতা করে বললো, ‘আপনি কি রেডি হয়ে গেছেন?’ নীরা শান্ত গলায় বললো, জ্বি,জনাব। আমি সেই কখন রেডি হয়ে বসে আছি। তোমার আর কতক্ষণ লাগবে?’ আবীর অপরাধীর মতো আত্মসমর্পণ করার মতো বললো, সরি, নীরা। আমি আসলেই আমাদের দেখা করার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা, আমি এক ঘন্টার মধ্যেই আসছি।’ নীরা রাগে গজগজ করতে করতে কলটা কেটে বিছানায় মোবাইল ছুঁড়ে ফেলে। পিউ বিষয়টা আঁচ করতে পেরে বললো,‘আপু, ভাইয়া হয়তো রাত জেগে লেখালেখি করেছে। কবি মানুষ তো একটু ভুলো মনেরই হয়। চলে আসবে। এখানে শান্ত হয়ে বসো তো। সত্যি মাইরি, তোমাকে যে কি লাগছে না! আগুনফুল।’ এই রাগের ভিতরও মুচকি হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলে পড়লো।’ এই তো আমার লক্ষ্মী, আপুটা।’ পিউ নীরার গালটা টেনে দিয়ে বললো। সফট একটা রিং টোন সেট করা নীরার মোবাইলে। আবীরের জন্য বিশেষ এই রিং টোন। সেটাই বেজে উঠলো। দ্রুত পায়ে কলটা রিসিভ করলো নীরা। আবীর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,‘আপনার হল গেইটে দাঁড়িয়ে আছি। একা একা নিজেকে খুব ছেঁচড় মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি আসেন।’ নীরা তিনতলা থেকে মনে হলো উড়ে উড়ে নামলো। পেছন থেকে পিউ হাসতে হাসতে বললো,‘আপু, ধীরে যাও। পড়ে যাবে তো!’

গেইটে গিয়ে তো অবাক হয়ে গেলো নীরা। আবীর জিন্সের সাথে নতুন হলুদ পাঞ্জাবি পরেছে। চুলগুলো মোটামুটি গোছানো। কাঁধে ঝুল ব্যাগের এক কোণে একা একা হাসছে একটা রক্তজবা ফুল। তার মানে আবীর অভিনয় করেছে! নীরা মনে মনে ভাবে। নীরার হাসি দেখে আবীরও ১৬৪ ধারার মতো স্বীকারোক্তিমূলক চাপা একটা হাসি দেয়। নীরার পড়নে নীল সুতি শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, চোখের পাতায় কাজল টানা। হাতে সাদানীল কাচের চুড়িগুলো দূত্যি ছড়াচ্ছে। আবীর ব্যাগ থেকে রক্তজবাটা নিয়ে নীরার কানের কাছে গুঁজে দেয়। নীরার মনে হলো বুকের মধ্যে শত শতাব্দীর জমা বরফগুলো গলে গেলো। ভেসে গেলো তার অনাগত আগামীর চরাচর। ওরা হাঁটছে পাশাপাশি। নীরা আজ পুরোপুরি বোবা। কোনো কথাই তার আসছে না মুখে। বরং কোনো কথা না হোক। এভাবেই কেটে যাক অযুত বছর। আবীর নীরবতা ভেঙে বললো, ‘আজ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে। ঠিক যেন অপ্সরা। পদ্মবিলের পরী।’ কথাগুলো শুনে নীরা আরো বেশি লজ্জা পেলো।

হেঁটে হেঁটে ওরা গিয়ে বসলো শিখা চিরন্তনের ওপাশটায়। একটু নিরিবিলি এদিকে। আবীর নীরাকে জিজ্ঞেস করলো, কি যে জরুরি কথা বলবেন? ‘হুম। আপনাকে আমি ভালোবেসে ফেলছি।’ কোনরকম ভনিতা ছাড়াই  হাতের কাছের দূর্বাঘাসগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে দিলো নীরা। যেন সময় নষ্ট করতে চাচ্ছে না নীরা। আবীর কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নীরা এতোটা সহজে সরাসরি মনের কথাটা বলে দিবে- তার কল্পনায়ও ছিলো না। ‘কি, কিছু বলছো না কেন? তোমার কিছু বলার নেই?’ নীরা প্রশ্ন করে আবীরকে। আবীর ব্যাগ থেকে একটা পুরাতন ডায়রি বের করে। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো,‘গতরাতে ঘুম হয়নি একদম। সারারাত তোমার কথাই ভেবেছি। ভাবতে ভাবতে একটা কবিতা লিখেছি। শিরোনামঃ অন্ততঃ আমার একটা তুই থাকুক। শুনবে?’ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় নীরা। আরেকটু সরে এসে আরো কাছে এসে বসে নীরা। একটা সময় টুপ করে আবীরের হাত ধরে। আবীর মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবৃত্তি শুরু করে।

সারাদিন ঘুরাঘুরি করেছে দুজন। খাওয়া দাওয়া ও টুকিটাকি কেনাকাটা করে এখন বের হলো আজিজ সুপার মার্কেট থেকে। পৌনে পাঁচটা বাজে। সন্ধ্যায় নিকেতনে টিউশন আছে আবীরের। তাই তাড়াতাড়ি ফিরতে হচ্ছে। যদিও কারো ইচ্ছে করছে না এখনই ছেঁড়ে যেতে। তবুও অগত্যা মধুসূদন! যাদুঘরের দেয়াল ঘেষে সমান তালে হাঁটতে থাকে দু’জন। শাহবাগের কর্ণারে এসে নীরা খেয়াল করলো রাস্তার ঐ পাড়ে মাঝ বয়সী একজন মহিলা ছোট্ট বালতিতে কতগুলো কদমফুল নিয়ে বসে আছে। নীরা আবীরকে দেখিয়ে বললো, ‘আমার কদমফুল খুব পছন্দ। কয়েকটা এনে দিবে?’ আবীর বালতি থেকে সাতটা কদমফুল বেছে বেছে নিলো। খালার কোলে ঘুমিয়ে আছে একটা তুলতুলে ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটার হাতে ১০০ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলো। নীরা মোবাইলে তোলা সারাদিনের ছবিগুলো খুঁটেখুঁটে দেখছিলো। হঠাৎই একটা বিকট শব্দ হলো। কয়েকটা কদমফুল এসে ছিটকে পড়লো নীরার সামনে। এক্স করোলা একটা গাড়ি দ্রুতগতিতে চলে গেলো এলিফ্যান্ট রোডের দিকে। নীরা দেখছে সবকিছু। পাথর চোখে। রক্তাক্ত আবীর শুয়ে আছে কালো পিচের রাস্তায়। গলগল করে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে এলোমেলো। স্পট ডেট। লোকারণ্য শাহবাগ। পুলিশ। নীরা কেবল একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর নীরার নিজেকে আবিষ্কার করে হাসপাতালের বিছানায়।

৩.
গাড়িটা মূল রাস্তায় পার্ক করে তমাল। যেনো নীরা বিরক্ত না হয়। ডাক্তারের কড়া সাজেশন হলো নীরাকে নীরার মতো থাকতে দিতে হবে। না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই প্রতিবারই নীরার অগোচরে নীরার পেছনে পেছনে পলাশপুর আসে তমাল। এখানেই আবীরের পারিবারিক গোরস্তান। আজও নীরা নীল শাড়ি পরেছে। আবীরের চাওয়ার মতো করেই প্রতিবারই সেজে আসে এখানে। নীরা অনেকক্ষণ কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে হাউমাউ করে কাঁদে। হাঁটু গেড়ে বসে কবরের পাশে রাখে কয়েকটা কদমফুল। প্রতিবারই শ্রাবণের দ্বিতীয় দিন নীরা শিশুর মতো করে। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে আসে নীরার শরীর। ততোক্ষণ পর্যন্ত তমাল অপেক্ষা করে। বাঁশ ঝারের পাতায় পাতায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। প্রতিবারই নীরার ফেরার সময় বৃষ্টি শুরু হয়।এবারও তাই হলো। তমাল নীরাকে তুলে ধরে নিয়ে আসছে মূল রাস্তার দিকে। নীরা কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে। বৃষ্টির বেগটা মনে হয় কিছুটা বেড়ে গেলো! তমালের কাঁধে মাথা রেখে হাঁটছে নীরা। বাম হাতে নীরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে তমাল। নীরা কাঁদছে। তমালও ডান হাতে নিজের চোখটা মুছে সংগোপনে !

শ্যামলী আবাসিক এলাকা,
মাধবপুর,হবিগঞ্জ।

পদাবলি

পদাবলি


সৌভাগ্য
শোয়াইব শাহরিয়ার

বুকের ভেতর বৃষ্টি হয়ে, ক্রমাগত নামছো তুমি
বিষাদের দিনের
ফোঁটায় ফোঁটায় ডুবিয়ে দিচ্ছো রোজনামচা।
করুণ কাহিনী হয়ে—
শূন্যে মিলিয়ে দিচ্ছো ছায়ার কুণ্ডলী।

জুয়ার আসর ডিঙিয়ে, নামছো ক্রমশ স্বপ্নে
শব্দের অশ্লীলতায়—
ডুবে থাকা চোখে চোখ রাখছো
বিষণ্ণতায় বিকল হৃদয়ে প্রণয়ের ঢেউ তুলছো
তবুও তুমি বুকের ভেতর—
 ক্রমশ হয়ে উঠছো কবর!

কী পরম সৌভাগ্য আমার—
বুকের মধ্যে রেখে তোমাকে রোজ ভালোবাসছি...



মানুষের ডাক নাম জীবন না কবর?
জুবায়ের দুখু

দ্বিধাগ্রস্ত জননী-
ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রাত্তি পূর্ণিমা।
একটি নতুন লাশের কবরে।
ওটা মানুষের জীবন না’কি-কবরেরই কবর
এসব বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে চন্দ্র দেব।

প্রহর ক্রমে ক্রমে গহীন! ঝড়ে ঝড়ে ঝাড়ছে জোছনা শুক্রাণু। চির নিদ্রায় সমকক্ষ কয়েকটি কবর।
হতে পারে আবরার-নুশরাত অথবা তনু।
ওসব কবরের নাম বাংলাদেশ
ওসব আত্মার নাম জীবন নয়-জন্ম থেকেই কবর।

চিবুক ছুঁয়ে দেই
মজনু মিয়া

কামরসে রতœ সাগর ভরে গেলে হাবুডুবু
করে দেহের ভাঁজে জল
উষ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে জড়িয়ে
ধরি নরম হাত কালো কেশ

চুমুয় চুমুয় ভরে দেই ওষ্ঠদ্বয় বুকের উপর
জাপটে ধরি মায়াসুধার লালসায়
কাম সাগরে সাঁতরে কূল খুঁজি নিথর
দেহের অবায়রণ্যে

বিবস্ত্র কামতায় মগ্ন থেকে জয় হতে চেয়ে
নিরুপায় আদরের ছুঁয়া দেই চিবুকে
দুনিয়ার সারতম মৌল চাহিদার আর কি
হবে দগ্ধ মনে ভাবি নিরবধি!


বিনিদ্র রজনী
নীলিমা শামীম

দুপুরের খাবার শেষে অপেক্ষা রজনীর
মধুময় রাত্রির আপেক্ষিক সূর্যাস্থ ধমনীর
শুধু তোমার প্রতিক্ষা প্রিয়তম!

এতো মিষ্টি সময়ের কাছে আমি ঋণী
তোমার বক্ষের বোতামগুলো আমি প্রিয়
চোখের পাপড়িগুলো ছোবে হা হা হা!

বুকের বাম পাশ টায় চিন চিন করছি
ভুলতে দিবনা এই আমাকে তাই বলছি
হাতের মুঠোয় ধরে রেখ, পালাতে দিওনা!



নৈঃশব্দ্যে- সমুদ্রপাঠ
রুদ্র সাহাদাৎ

জলের উপর জলের ঢেউ
জলের ভাঁজে নীলজল জোয়ার ভাটার উচ্ছ্বাস
উৎসুক কিছু মুখ উৎস খুঁজে ভালোবাসার

ঝাউবনের বাতাসী সুরে লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি খেলা
পোয়াতি ইলিশও মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়

রুপচান্দার রুপে হাসে জলপুত
সোনাদিয়া, নাজিরারটেক দৌঁড়ে হোসেন মাঝি

পর্যটক হাসে সমুদ্র নিকটবর্তী হলে প্রতি ঢেউে ঢেউে
আমিও নৈঃশব্দ্যে- সমুদ্রপাঠ করি অজান্তে
 বালিচরে বসে

প্রেমিকা ছিনতাই
তারেকুর রহমান

কত বিনিদ্র রজনী কেটেছে আলেয়ার পেছনে
মফস্বল শহরে তখনও শীত নামেনি
ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপে ঠোঁট লেগেছিল
পেঁচার কণ্ঠে বিষাদের ছায়া
সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল এ্যাম্বুলেন্স
বুকের এক কোনে জমে ছিল একটুখানি কষ্ট
হৃদয়ের ভেতরের ঘুঘু পাখিটা মরে গিয়েছিল
কষ্টের পাহাড় বুকে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্ট
প্রেমিকার শীতল হাত কারো হাতের উষ্ণতা খুজছে
বিষাদের ছায়া নেমে এলো প্রেমিকের বুকে।

শুভ জন্মদিন আহমদ মেহেদী

শুভ জন্মদিন  আহমদ মেহেদী


শুভ জন্মদিন
আহমদ মেহেদী


 আবু সাঈদ রায়হান

আহমদ মেহেদী । পুরো নাম মোঃ মেহেদী হাসান মুন্সী । তিনি ২৬-১১-১৯৮৯ ইং তারিখে  কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার থানার নোয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহন করে ।  সঠিক জন্মতারিখ না জানার একটা আজন্ম কষ্ট আছে তার। এটা তার প্রাইমারি স্যারদের দেয়া সার্টিফিকিটের জন্মতারিখ।  জীবন-স্বপ্নের টানাপোড়েনে কয়েকবার হোচট খেলেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি.এস.এস. ডিগ্রী অর্জন করে । বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে । দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ‘প্রিয়জন’ পাতায় ‘পরিত্রান চাই’ কবিতা দিয়ে তার লেখালেখি শুরু। পরে নয়াদিগন্ত’র সাহিত্য পাতা ও অবকাশে লিখতে থাকে । তার প্রিয় লেখক  হুমায়ুন আহমেদ। গল্পপাঠ , গল্পকবিতা ডট কম সহ বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় তার লেখা কবিতা ও গল্প ছাপা হয়েছে । সুযোগ পেলে দেশের স্বনামধন্য কোন প্রকাশনা থেকে ২০২০ সালের মধ্যেই একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে তার । অবিচার  থেকে মুক্তি পেলেই সমাজ হবে সুশৃঙ্খল, কেটে যাবে সব অন্ধকার। ন্যায় আর মনুষ্যত্ব জেগে উঠার উঠবেই ;  মানুষের ভালোবাসাই পৃথিবীর দামী সম্পদ  যা পথ খুজেঁ দেয় সমাজের নিভু নিভু আলোগুলি কে। সেই আলোর ঝলকানিতে পুড়ে যাক ঘাপটি মেরে থাকা সকল আধার  মানুষের জীবনের! বদলে যাওয়া এই সমাজেরই স্বপ্ন দেখে এই লেখক । ধানশালিকের পক্ষ থেকে তার জন্মদিনে অজস্র শুভ কামনা এবং ভালোবাসা । তার জীবন সুন্দর এবং আলোকিত হউক ।



 

নুশরাত রুমু’র গল্পগ্রন্থ ‘আঁধারে জোনাকি’

নুশরাত রুমু’র গল্পগ্রন্থ ‘আঁধারে জোনাকি’


নুশরাত রুমু’র গল্পগ্রন্থ
‘আঁধারে জোনাকি’
মানবিকতার অন্য এক প্রতিচ্ছবি

রেজাউল রেজা

সাহিত্য হলো সমাজের দর্পণস্বরূপ।
“আঁধারের জোনাকি” বইটির লেখিকা নুশরাত রুমু তাঁর দক্ষ হাতে দর্পণের মতই সুচারুরূপে বর্তমান সমাজের নানা ধরণের অসংগতির কথা চিত্রিত করেছেন।
শুধু চিত্রিত করেই থেমে থাকেননি বরং এসব অসংগতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলে দিয়েছেন গল্পে গল্পে।
বইটিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো-এখানে স্থান পাওয়া ছয়টি গল্পের মধ্যে দুটি গল্পই আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক।
বইটি পড়ে পাঠকমহল যেমন সমাজের নানা সমস্যা ও অসংগতির কথা জানতে পারবে তেমনই জানতে পারবে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন খণ্ডচিত্র সম্পর্কে।

কে না সুখ পেতে চায়! মহাবিশ্বের সকল প্রাণীই সুখ বিলাসী। কিন্তু সবাই কি সুখ পায়? পায় না। যারা পায় তাদের মধ্যে কেউ বৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে সুখী হয় আবার কেউ সুখ নামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে অবশেষে অবৈধ পন্থা বেছে নেয়।
কিন্তু অবৈধ পথে অর্জিত সুখ কখনই স্থায়ী হয় না, তাতে তৃপ্তি থাকে না, মনে প্রশান্তি আসে না। অবৈধ পথে কেনা সুখের শেষ পরিণাম হয় ভয়াবহ।
বিজ্ঞ গল্পকার তাঁর ‘সুখের খোঁজে’ গল্পে এমনই একটি চমৎকার দৃশ্য অংকন করেছেন।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জামাল অবৈধ পথে টাকা রোজগার করে  যখন ভালো  খাওয়া-চলা শুরু করল তখন প্রতিবেশীদের মনে কৌতুহল জন্ম নিল। জামালের স্ত্রী রাহেলাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করতে লাগল। তাতে বিব্রতবোধ করে জামালের স্ত্রী রাহেলা তাকে জিজ্ঞেস করে:
এত টিয়া কোনাই হাও? রিশকা চলাই আর কত রুজি অয়।
তোর এত কতা জাননের কি দরকার।
তোরে আনি দিমু, রান্ধি বাড়ি খাবাবি, হোলা মাইয়া হাইলবি....
কথা টেনে নিয়ে রাহেলা বলে--
কা, বউ অইচি দেই হচি গেছি নি!
কোন কতা জাইনতাম হাইরতান্নো? মাইনসে কত কিছু জি¹ায়!
নিজ জেলা নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই গল্পটিতে নানা ঘটনায় ফুটে উঠেছে বর্তমান সমাজের মহামারী রোগ মাদকের কুফল।

ভিন্ন মানুষ মাত্রই ভিন্নরূপ।
কারো সাথে কারো মিল নেই। একই পরিবারের একেক জনের একেক রকম বৈশিষ্ট্য। লেখিকা তাঁর ‘টক-ঝাল-মিষ্টি’ গল্পে মানুষের এই বিচিত্ররূপ সুনিপুণ হস্তে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস চালিয়েছেন।

বইটিতে স্থান পাওয়া ‘রুবাই’ গল্পটি পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেবে বলে আমি মনে করি।
একজন সাহিত্যিকের কাছে নিজের সাহিত্যকর্ম সন্তানতুল্য।
সর্বস্ব হারানো রিক্ত জীবনেও সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্মকে আগলে ধরে কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে তারই প্রতিচিত্র অংকন করেছেন লেখিকা তাঁর এই গল্পে।
দীর্ঘদিন নিঃসন্তান থেকে নানা জনের নানা কথা হজম করে অবশেষে সন্তান এলো ঐশীর গর্ভে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলায় হেরে গেল সে। জন্মের আগেই সেই জীবনের প্রদীপ নিভে গেল। আরও  জানতে পারল জরায়ুর একপাশে ঐশীর টিউমার হয়েছে  যা অপারেশন করতে হবে।
যদি অপারেশন করা হয় তাহলে পরবর্তীতে সে আর মা হতে পারবে না। এমন খবরে ভেঙে পড়ল ঐশী।
ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠতে লাগল, সেইসাথে তার পুরোনো অভ্যাস লেখালেখির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো........
লেখিকা গল্পটির শেষপ্রান্তে এসে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ঐশী সম্পর্কে লিখেছেন-
গর্ভজাত সন্তান পৃথিবীতে না আসতে পারলেও মস্তিষ্কজাত অনেক সন্তানের মা হয়েছে সে। কবিতারাই তার ‘রুবাই’ নামের সন্তান। তাদের লালন করেই মা হিসাবে বেঁচে থাকতে চায় ঐশী।

ভাগ্য কিভাবে মানুষের স্বপ্নগুলোকে চুরমার করে টেনে হিঁচড়ে তাকে নিচে নামাতে পারে, কিভাবে একজন মানুষকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অসৎ কাজের দিকে পা বাড়াতে হয় তারই প্রতিচ্ছবি অংকিত হয়েছে ‘চম্পট’ গল্পে।

“ফেরার পথে নজরে পড়ল সেই দোকান যেখানে গফুর সাহেব তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল।
সেই সরল হাসি আজ কপটতার আড়ালে চাপা পড়েছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে মনে হলো
হায় টাকা! সবই তোমার মহিমা”।
বইটিতে স্থান পাওয়া ‘টাকার মহিমা’ গল্পের শেষ অংশ এটি।
লোভ মানুষের সবচেয়ে বড় একটি কুপ্রবৃত্তি।
লোভের বশবর্তী হয়ে মুহুর্তের মধ্যে একজন ভালো মানুষ খারাপ মানুষে পরিণত হতে পারে।
আর সেটা যদি হয় টাকার লোভ তাহলে তো কোন কথাই নেই।
সেটাকে সামলানো বড় কঠিন!
বর্তমানে সময়ে সবচেয়ে বড় নেশা টাকার নেশা। টাকার জন্য মানুষ সবকিছুই করতে পারে। পিতা-মাতার পবিত্র ভালোবাসাকেও তুচ্ছ করে তুলতে পারে এই নেশা। কিন্তু শেষ বেলায় এসে যখন মানুষ বুঝতে পারে টাকাই সবকিছু নয়, তখন আপসোসে বুক ভাসানো ছাড়া উপায় থাকে না।
এমন এক চমকপ্রদ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ‘টাকার মহিমা’ গল্পে।
বইটির ৫৬ নং পৃষ্ঠায় ‘কালো জন্ম’ নামক গল্পের একটি বাক্য “নারী-পুরুষের প্রেম-মাধুরী জানার আগেই দংশিত হয়েছে তার নারীত্ব”
তার কয়েক লাইন পরেই লিখেছেন- “ক্যাম্পের পাশবিক নির্যাতনের ফসল বেড়ে উঠছে মনোয়ারার গর্ভে” এমন চমৎকার কিছু বাক্যচয়ন দাগ কাটবে পাঠক হৃদয়ে।
যার ফলে পাঠকদের মনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান বেড়ে যাবে।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক বীরাঙ্গনা নারীর জীবনের করুণ কাহিনী এবং তার যুদ্ধ সন্তানের কথা গল্পের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন বইটির লেখিকা নুশরাত রুমু।

একদিকে সংসারের দায়ভার আর একদিকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ। সময়বয়সী অনেকেই যুদ্ধে যাচ্ছে। কিন্তু তরুণ স্কুল শিক্ষক আন্তু যেতে পারছে না। কারণ তার পুরো পরিবার নির্ভর করছে তার আয়ের উপর।
যুদ্ধে যেতে না পারার অনুতাপে জ¦লে-পুড়ে মরছে। কিন্তু সে নিরুপায়। সে যুদ্ধে গেলে তার বাবা-মা, ছোট ছোট ভাই-বোনেরা অনাহারে মরবে। এসব ভেবে যুদ্ধে যাওয়া হয়ে ওঠেনি দেশপ্রেমিক আন্তুর।
যুদ্ধ শেষে যখন দেশ স্বাধীন হলো তখন আন্তু ভাবতে লাগল তাকে সারাজীবন সবার কাছে ছোট হয়ে থাকতে হবে যখন কেউ জানতে চাইবে তুমি যুদ্ধ করতে গিয়েছিলে কিনা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনে মনে বলল--হে মাতৃভূমি তোমার বিপদে কোন কাজে লাগতে পারিনি কিন্তু দেশের সাথে বেইমানি করিনি এটুকুই সান্ত¡না....
এভাবেই এক অসহায় দেশপ্রেমিকের দেশপ্রেমের নমুনা তুলে ধরেছেন বইটির লেখিকা।

সব মিলিয়ে এটা বলা আবশ্যক যে, ‘আঁধারে জোনাকি’ অসাধারণ একটি গল্পগ্রন্থ।
এটি যেকোন বয়সের পাঠকের মন জয় করতে সক্ষম।
বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

মা ও মমতা

মা ও মমতা



মা ও মমতা
আনোয়ার রশীদ সাগর

এখনো সন্ধ্য নেমে আসেনি। খেয়াঘাটের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশবাগানে পাখিগুলো ফিরছে। এ বরষায় বাগানটি বন্যায় ভেসে যাবে অথবা নতুন আয়ু পাবে।
বাগানের পাশে বেড়ায় ঘেরা বাড়িটিতে “এ্যাঁ-ম্যাঁ-এ” শব্দ করে গরুর বাছুরটি ডাকছে। জরিনার বিরহ মনে বার বার বলছে, আহা বাছুরটি মা-মা বলে ডাকছে। বাছুরটির মা কয়েকদিন আগে, রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে, সেই রাতদুপুরে ঘুম থেকে উঠে, বিছানা ছেড়ে  দৌড়ে এসে, রামদা দিয়ে গলাটা কেটে ফেলে, গা’র চামড়া ছুলে ধম-ধম করে মাংসগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে, সকালে বিক্রি করে দেয় রুনু মন্ডল। জরিনার স্বামী রুনু মন্ডল, খুব খামখেয়ালি। মাথায় যখন যা আসে, তখন তাই করে ফেলে, আগে-পিছে ভাবে না। বাছুরটার ডাক শুনে জরিনার মনটা পুড়ে যায়, কাঁদে সে, গরম কড়ায় তেলের উপর ঝাল দিয়ে ভাজার মত ছ্যাৎ-ছ্যাৎ করে মনের মধ্যে । গোপনেই আঁচলে চোখ মোছে, রুনু মন্ডলের চোখের সামনে চোখ মুছলে বিপদ, বলে ফেলে কুনকার ফ্যাতকাইন্দি শালিরে বিয়ি কইরি নিয়ি আনু, মাগীর মায়া দেকলি শরীরডা জ্বইলি যায়।
জরিনা তখন বলে, মিন্সির ময়া-দয়া কিছু নাই, পাষানডা যিন্ মিন্সির হৃদয়।
রুনু মন্ডল জরিনার কথা শুনে চেঁচিয়ে ওঠে, ইসরে-গরুডা মইরি গেলি, ট্যাকাগুণ তোর বাপে দিবিন, শর্-শর্ হারামী মাগী, আমারে ধ্বংস করতি আইয়িস।
জরিনা নীরব হয়ে, দূরে সরে যায়।
বাপের বাড়ি বলতে তো কিছু নেই, যার বাপ-মা নেই, তার দুনিয়া হাহাকার, জলশূন্য পদ্মারচর।
বাড়ি দুটো সৎ ভাই রয়েছে। যাকে বৈমাত্রিক ভাই বলে। তাদের জমিবাড়ি ঘর পদ্মার ভাঙনে ভেসে গেছে। এখন রেললাইনের উঁচু ঢালে ছোট ঝুপড়ি ঘর করে থাকে। তাদের দেখলেও জরিনার পরাণডা হুঁ-হুঁ করে কেঁদে ওঠে।
মা মারা গেলে, মায়ের ছোট বোনটার সাথে বাপজান আবার বিয়ে করেছিল, প্যান্ট ছিড়ে গেলে, যে রকম করে তালি দেয়, সে রকম করে বাপজান, সংসারে খালাকে এনে, তালি দিয়েছিল। খালা খুব ভালো বাসতো জরিনাকে, মা’র মতই আদর-যতœ নিয়ে, খোঁজ-খবর রেখে, বড় করে তোলে। জরিনার বয়স যখন ১২ বছর তখন ভাই দুটো খালার পেটে ছিল। সেই সময় জরিনার বিয়ের কথা হচ্ছিল। ছেলে ব্যবসা করে করিমপুর বাজারে। বিয়ের দিন ঠিক হবে, মঙ্গলবার রাতে। দূর্ভাগ্য জরিনার।

আগের দিন, সোমবার রাতে, খালার প্রসাব বেদনা ওঠে। ওরে বাবারে-মারে বলে, খালা চিৎকার করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পাড়া-প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে, সেই গভীর রাতে। মুরুব্বীগোছের দু’জন মহিলাও ছিল। তারা নাকি প্রসব বেদনা উঠলে, সন্তান হতে সাহ্য্যা করে, টাকাও নেই। ওদের এলাকার মানুষ ‘দায়’ বলে জানে।
প্রায় ভোর হয়ে আসছিল, তবুও খালার জ্ঞান ফেরে না। শেষ-মেষ সেই “দায়” মহিলাদের পরামর্শে খালাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে জরিনা ও তার বাপজান যায়। বাপ-বেটি গালে হাত দিয়ে ঘরের বাইরে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে ছিল। পূর্বদিকে রাঙা হয়ে আসছিল। সূর্য উঠবো উঠবো মুহূর্তে দুটি শিশু ট্যা-ট্যা করে একসাথে চিৎকার করে উঠলে, জরিনার বাপ হাত তুলে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করতে থাকে, আল্লাহ তুমি আমার রক্ষাকবজ, তুমি দয়াময়।
এর কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলে, স্যাড-ভেরি স্যাড; জুমকা ছেলে হয়েছে, কিন্তু বাচ্চা দুটোর মাকে বাঁচানো যায়নি। জরিনা কিছু বুঝে উঠার আগেই, গলা ফুঁপড়ে কেঁদে ওঠে বাপজান, আমার কি হইলুরে মা! আমার সংসারডা আবার ভাইসি গেলো। আহা-হাহা, আমি একুন কী কইরবুরে, কি কইরবু?
জরিনাও বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাও-মাও করে কাঁদতে থাকে।
জরিনা বাড়ি এসে ছোট গ্যাঁদ-গ্যাঁদি মাংসপিণ্ড সর্বোস্ব ভাই দুটোকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। শেষ-মেষ পাড়া-প্রতিবেশি ও মুরুব্বীদের সহযোগিতা ও পরামর্শে, ছোট ভাই দুটিকে যতœ করতে থাকে, যেন মা হয়ে যায় জরিনা।
বাবা গা থেকে গরুর দুধ কিনে নিয়ে আসে, সে দুধ গরম করে, আবার হালকা ঠান্ডা করে খাওয়াতে থাকে। পাতাড়ে পড়া জীবন, গলাই দড়ি বাধা ছাগলের মত ছুটাছুটি করলেও খুঁটির সাথেই থাকতেই হয়। ঘানিগাছের গরুর মত একই দিকে ঘুরে ঘুরে একই জায়গায় থাকা,তেল বের হলো কী, দুফোঁটা পড়লো, তা দেখার সুযোগ থাকে না, চোখে ঠুসি দেওয়া গরুর মত জীবন চলতে থাকে। এভাবে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে দশটি বছর কেটে যায় জরিনার। বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে, বন্যার ভয়াবহ ¯্রােত দেখে, নৌকায় উঠে, কোনোক্রমে আশ্রয় নেওয়ার মত সংসারের আটপৌড়ে কোণায় বসে থাকে জরিনা। তখন ভাই দুটি বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মাঠে-ঘাটেও যায়-আবার সকালে স্কুলেও যায়। জরিনায় ভাই দুটিকে আলাল ও দুলাল বলে ডাকে। ডাকতে ডাকতে আলাল ও দুলাল নাম দুটিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরও কিছুদিন পর রুনু মন্ডল এক দূরন্তপনা স্বভাবের যুবক, বাবার চাচাতো বোনের ছেলে পরিচয় দিয়ে এ বাড়িতে এসে থাকা শুরু করে। হেলে পড়া গাছের সাথে ররুনু মন্ডল যেন, বিদ্যুতের খুঁটি হয়ে দাঁড়ায়। এ খুঁটির সাথে ঠ্যাস দিয়ে আলাল-দুলাল ও জরিনা মাজা সোজা করে, খাঁড়া হয়ে, চলতে থাকে। জরিনা বুঝে উঠতেই পারেনি, রুনু মন্ডল তার অর্ধাংগ হয়ে গেছে। হাব-ভাব বুঝে, জরিনার বাবা গ্রামের মৌলভী ডেকে ও দু-দশজন প্রতিবেশীকে দাওয়াত দিয়ে, রুনু মন্ডলের হাতে জরিনাকে তুলে দেয়। জরিনা লাল শাড়ি প’রে ঘুম্টা দিয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রুনু মন্ডলের বাপের বাড়ি ওঠে।
শশুর বাড়ি যাওয়ার আগে ভাই দুটিকে জড়িয়ে ধরে হুঁহুঁ-উহুঁউহুঁ স্বরে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিল।
মাত্র দু’মাসের মাথায় পদ্মার ধার ভাঙতে ভাঙতে এসে, জরিনার বাপের জায়গা-জমি ও বাগান-বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জরিনা রুনু মন্ডলকে সঙ্গে করে দেখতে এসে, সর্বনাশা পদ্মার ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া ¯্রােতের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল, মানুষের জীবন কিছু না-এই আছে এই নেই!
অভাব অনটনে চারদিকে বড় হাহাকার শুরু হয়ে যায়। জরিনা রুনু মন্ডলের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসে। আসার সময়, আলাল আর দুলাল জরিনার পিছু পিছু অনেক পথ হেটে এসেছিল। এক সময় হাটতে হাটতে রুনু মন্ডল ঘাড় উঁচু করে ধমক দেয়, এই শালারা কন্ যায়ছি, বাড়ি যা!
রুনু মন্ডলের খেকানো গলার চানকা ধমক শুনে, আলাল আর দুলাল বাপের কাছে চলে আসে এবং রেললাইনের ধারে, উঁচু ধার কেটে কেটে কাশবনের বেড়া দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে। রুনু মন্ডলের এ রকম ধমক আর নির্দয় ব্যবহারের মধ্যেও জরিনা সংসার করছে, যাওয়ার যে কোনো পথই নেই?
বিয়ের আগেই জরিনার পেটে যে ভ্রুণ এসে রুনু মন্ডল আর জরিনার সংসার করার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিল, সে ভ্রুণ ধীরে ধীরে বড় হতে ছিল। জরিনার ভালোই দিন কাটছিল। তবে দুঃখ যে চিরসাথী, সে কথা বুঝলো, যখন মাঠ  থেকে এসে, রুনু মন্ডল হাতের কাছে খাওয়া পানি না পেয়ে, জরিনাকে
কিল-ঘুসি মারা শুরু করে। মার খেতে খেতে জরিনা কাইত হয়ে পড়ে গেলে, রুনু মন্ডল জরিনার পেটে ফুটবলে লাথি মারার মত একটা লাথি মারে। জরিনা ককিয়ে ওঠে, ও বাবাগো-মাগো।
রক্তে ভেসে যায় ঘরের মেঝে।
বহুকষ্টে গ্রাম্য ডাক্তারের চিকিৎসায় বেঁচে যায় জরিনা। সেই থেকে চৈত্রমাসে দূরে মাঠে বাবলা গাছে ঘুঘু পাখি, ঘুঘু সুর করে ডাকলে জরিনার মনটা পুড়ে যায়, কান্নার সুর ভেসে আসে তার কানে। সে জানে না, কেন মনটা কাঁদে।
বাছুরটা হাম্বা-হাম্বা ডাকছে। অথচ জরিনার কানে ভেসে আসছে, ম্যায়ে-ম্যায়ে শব্দ, আহারে মা’হারা বাছুরডা...