ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৭২

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৭২

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৭২,

শুক্রবার ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১

















অমরি !

অমরি !

 



অমরি

মনিরুজ্জামান প্রমউখ


গল্পে’র মূখ্য চরিত্রের একটা নাম দেয়া দরকার । চরিত্র যার সে- একটা কুকুর । নাম দিলাম ‘অমরি’ । দেখতে সে- নিরীহ যথেষ্ট, অন্য হতে । সুন্দর- এর লুকে, মানানসই; এর ঘরে’র সদস্য নয় সে। দেখলে  ম্যামোথ্যামো লাগে, এমন । না তুচ্ছ, না স্বচ্ছ । মেদহীন দেহের গড়ন । কিছু-টা সাইক্লোন ঝড় যে ওর শরীর বেয়ে ছায়াবর্ত করে গেছে, তার ছাপ স্পষ্ট । তার কিছু হয়-তো অ-ভূক্ত থাকা’র নিয়ত ডোর। আর- কিছু হয়-তো বার বার সন্তান জন্ম-দানে, নিবার্য-তার জের । রংয়ের বিবরণ কী দরকার ? কুকুর-তো আর- মানবীয় রমনী নয়, যে- বিচারে সাদা, কালো কাঠি হবে- সমাজ তুতলে । 

আমার স্বভাবে মায়ার ভাগীদার সব- প্রাণী-কূলের মধ্যেই গোছানো । বাদ যায়-না দুই, চার, আট পা বিশিষ্ট তার অতি ক্ষুদ্র, বৃহৎ কোনো প্রাণী । সব মাখলুকাতে’ই আমার অতীব- দয়াদ্র মন । কেনো জানি-না । কেনো জানি- হিংসা’ই মনে ধরে-না । অথচ- অস্তগামী সূর্যের মতোই আমার জীবন-বিচরণ । না আয়, না ব্যয়। ব্যয় ধরে এগোলে, আয়ের কথা- মনে পড়ে যায় । দয়াদ্রের আকাশে তখন- মেঘ জমে । আমি অন্ধকারে ঢাকা পড়ি । নিজস্ব আলোয়- বেরিয়ে আসি । চারপাশে’র আলোয়- বিকশিত হবার প্রয়াস এখানে, বান-ভাসি মানুষের চুরমার আর্তনাদে’র মতো’ই । 

এখানকার মানুষদের আমি দেখেছি, পরিপূর্ণ জমিনকেও কিভাবে তারা- অনায়াসে অনুর্বর করে । পর্বতের চূড়ালোকন করে, বলে- এ আর- এমন কী ? নল দিয়ে, খল করলেই নেমে আসবে- ক্ষুদিরাম । নদীর বিকশিত ¯্রােত দেখে, বলে- এ জন্মে কতো... দেখেছি । হাওয়ার টাল সারলেই পরে যাবে- সিলসিলা । কোনো এক-টা নিরিহ প্রাণী চোখের সামনে পরলেই তারে দেয়- দৌড়ানি । হাতের কাছে যাই থাকুক তাই নিয়ে, তেড়ে যাবে মারতে, শত্রু-তার ঔরশ কাঁপিয়ে । এমন-কি কখনো কখনো- সবিস্তারে মৃত্যুর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেয় । যেনো- মানুষ ব্যতীত আর- অন্য কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার নেই, এই ধরণীতে ! কি আশ্চর্য বিড়ম্বনা ! দেখে- মুমূর্ষু-তা লাভ করি । খ-, বিখ- হই ! 

এই যেমন- মাছ ধরার নিমিত্তে জাল পেতে, জাল টেনে এনে, মাছ-গুলো নিয়ে, মাছের সাথে ভাই ভাই উঠে আসা- নিরিহ কাঁকড়া আর নির্বিষ ডোরা সাপ-গুলো মারা পরে, তাদের হাতের নিকটে পাওয়া যে- কোনো দন্ড, অ-দন্ড কিছু’র প্রহারে প্রহারে। 

আরেক যেমন- বাড়ির আশেপাশে, কিংবা- চলতি হাঁটোয়া পথে, দৃষ্টি’র নৈকট্যে একটা কুকুর বা- বিড়াল পরলো । ব্যস্ হুশহাশ করে, অথবা- নলখাগড়া জাতীয় কিছু মিললেই হলো । দিবে চপান্তর করে । যেনো- কতো জনমের শত্রু-তা ঐ পক্ষান্তর-হীন প্রাণী-গুলো’র বরবাদে ! যা- আরেক মানবের সাথে, চরম শত্রুতায়ও এমন মনস্খলন আচরণ লক্ষিত হয়ে, ওঠে-না ! কেননা- শত্রু-তারও এক-টা বেলা থাকে, এক-টা ভূমি থাকে । সময় অ-সময় থাকে । কিন্তু দেখার আড়ে দেখেছি, ঐ অসহায় প্রাণী-গুলো প্রায় সব হাড়ে’ই নিগৃহীত হয়। এ কেমন মানসিক-তা মনুষ্যজীবিদের ? গল্গের গায়ে প্রশ্ন । 

কুকুর এমন এক জাতীয় প্রাণী । যারা যৎ-সামান্য আহার, আর- একটু উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলে, সকলে’র খাতে পরম উপকারী । মেল-বন্ধনে’র এক বিরল উদাহরণ- সম্মত । যা- আমরা নানান ঘটনা’র উৎকর্ষে, তার সাক্ষী । পার্থক্য কেবল এই যে কেউ উপলব্ধির চাবি দিয়ে, তার সহানুভূতির তীরটা উন্মোচন করি । আর কেউ করিনা, বা করতে পারিনা, বোধের অ-সামাজিক দৈন্যতার কারণে । সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, আমরা এখন- সুদূরকেও কাছে টানি । পরকেও করি- আপনের আহব্বায়ক । বহুল কনটেন্টের মাধ্যমে দেখতে পাই, কুকুর কিভাবে- মানুষের জীবনের উত্তম সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে । একাকীত্ব ঘুচাতে, আরেক মানব সহকারীর বিকল্প রোল পে করে, সর্বোপরি- জীবন বাঁচাতে, তড়িৎ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে । অথচ- তাদের মানুষে’র কাছে, কোনো- চাওয়া পাওয়া নেই । জবর-দস্তি নেই । বাড়ির যে কোনো- এক প্রান্তে, পড়ে থাকা । সারাদিন এ-বাড়ি, ও-বাড়ি, অলি-গলি ঘুরে-ফিরে খাবারন্ত কিছু মিললে, আর- মানুষের ফেলে দেয়া- উচ্ছিষ্ট ঠুকরে বেঁচে থাকা ।  

অমরি’র দেখা মিলে এক-রকম আচমকা’ই বলা চলে । আচমকা এই অর্থে- জন্ম-সূত্র ধরে একটু একটু করে- বেড়ে উঠতে, দেখা এক। আর- চার পাঁচটা বাচ্চা বিয়ানো ক্ষয়, মানুষের ছিঃ ছিঃ প্রবৃত্তির ফলাফলের জের- খাদ্য ঘাটতি, ও পৃষ্ঠ-দেশের রোম ঝরে পরে অনাবৃত অংশ-সমূহের বৈকল্য দেখে- মনুষ্য অর্জিত যে কোনো মানবের হৃদয়ে, হাহাকার করে ওঠা আরেক । অমরির আরেক দেখায় আমি- মর্মাহত । জীর্ণ-শীর্ণ অমরির আপদমস্তক প্রাণ গেলো গেলো- পৃথিবীর রচনাকালে, আমি- মামু হয়ে উঠি । কিন্তু- হলে, কী- হবে ? আমিও ছিলাম- আর্থিক রুগ্নতায় পলেস্তরাহীন দিনযাপনের রাতহীন । কী করে, পারি- অমরির পেটের খাবারের চাহিদা পূরণে- সক্ষম হতে ? 

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা । গোনে নিলে- বছর দশেকের কম হবে-না । হলে, বেশি হবে । আমাদের ঘরের লাগোয়া সামনে দিয়ে, যে গলি পথ গিয়ে, বাকিলা বাজারে আসা-যাওয়ার রাস্তায়- গা জুড়েছে, সেই পথ ধরে’ই অমরির নিরর্থক যাওয়া-আসা হতো । আগ-দরজা বা- সদর-দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে, এই-বেলা না ঐ-বেলা অমরিকে দেখতে হতো । এই দেখার সিঁড়ি বেয়েই মমতার আলোড়ন ঘটলো- হৃদয়ের এ-পাশে, ও-পাশে । একদিন আলোড়ন ভরে, কি যেনো- এক-প্রকারের খাদ্যকণা ছিটিয়ে দিই, অমরির অ-ভূক্ত  দৃষ্টির সামনে । সে লুফে নেয় বদান্য নয়নে । 

কোথায় যেনো তার আস্তানা, জানা নেই । তার নিজস্ব বেলা করে, সে- আসতো । কখনো নিয়মিত, কখনো অ-নিয়মিত । আমার খাবারের অংশ হতেই তার- ভাগ্যের দানা । মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যেতো- অমরি কয়েক মাস, বছরের জন্য । লম্বা বিরতি নিয়ে ফিরে, আমাকে বিষ্ময়ের জানান দিয়ে চলেছে, অমরি । এইতো গেলো তিন মাসের বিরতি শেষে আসলো লাগাতার ছয়দিন । তার-পর আজ ধরে সাত-দিন উধাও । 

অমরি ভাত খায়-না, খায়-না রুটিও । খাওয়া’র মধ্যে সে শুধু- বিস্কুট-টা’ই খায়। খুব রসালো আস্বাদন তার বিস্কুটকে জীব্য করে । যদিও বিস্কুটে তার ভোগের দাবি- অচল, অ-পূর্ণ থাকে, আমার অ-সামর্থ্যের কারণে। যোগান দিতে পারি- হয়-তো তিনসংখ্যা । তার হয়তো নয় সংখ্যাও কম হয় । আর এই অমিলের কারণে, ভেতরে ভেতরে অমরি রেগে-মেগে, নিয়মের উধাও হয়ে যাওয়া’র চালটা হয়-তো চালে । যাতে পরের বার এলে, তার- ভাগ্যোন্নয়ন ঘটে । কিন্তু- দিন যায়, বছর যায়, আমার- ভাগ্যে’র চাকা সেই অনুপাতে ঘুরে-না। যেই অনুপাতে, অমরি ঘুচাতে পারতো, তার- ক্ষুধার বিজ্ঞান । 

মাঝে মাঝে উল্টো স্রোতের দাঁড় টেনে মনে হয়- অমরি এখন আর- ক্ষুধার টানে এখানে আসে-না । তার হয়তো এখন আর তেমন ক্ষুধা নেই । সে হয়তো আসে- ঋণের টানে । ঐ যে তার- জীর্ণ সময়ের কালে, বাঁচার সামান্যতম খোরাক হয়েছিলাম, সে জন্যে । মাঝে মাঝে হারিয়ে গিয়ে, পুণরায় এসে- নত মস্তকে, লেজের নম্র হেলুনিতে, সে তার ঋণের প্রতি শ্রদ্ধা- জানিয়ে যায়। খাওয়া’র মুখরোচক স্বাদ-টা তার কাছে, হয়তো এখন গৌণ । 

দীর্ঘ হায়াতের অমরি তার পরবর্তী আগমনের জের কখন টানবে, সেটা শুধু- অমরির একার খ-ন । একটা অপেক্ষা তার মোলহেড। 


হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর । 


সেদিন বর্ষাকাল !

সেদিন বর্ষাকাল !

 



সেদিন বর্ষাকাল

আহাদ আদনান


টানা বৃষ্টিতে উঠোনের মাটি মাখোমাখো হয়ে আছে। পা পড়লেই ছোট মত গর্ত হয়ে যায়। পাশের জল এসে সেই গর্ত আবার ভরিয়ে দেয় এক নিমিষে। বিকেল থেকেই আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। সূর্য লুকিয়েছে। কেমন যেন রাত রাত মনে হচ্ছে। সেই ক্ষীণ আলোতে উঠোনে আমি পদচিহ্ন আঁকছি। ‘পানি পাড়াসনে। ঠা-া লেগে যাবে’। মায়ের হাঁকে শেষ করে দিই খেলা।

দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বিদ্যালয় বন্ধ। সেটা না হলেও সমস্যা ছিল না। এমন বর্ষার সন্ধ্যায় বৃষ্টি মানেই ছুটি। কবিগুরু শিখিয়েছেন, ‘মেঘের কোলে রোদ’ এসে ‘বাদল গেছে টুটি’ দেখলেই ছুটি। আমার জন্য যে কোন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলেই ছুটি। আমরা বসে আছি রসুইঘরে। মা, চার বছরের ছোট বোন আর আমি। বোন আর আমি মিলে এখন নতুন একটা খেলা খেলছি। ‘কাগজ কাগজ খেলা’। ছোট ছোট কাগজ কেটে আমি পেন্সিলে ছবি আঁকছি। মুখের ছবি, ফুলের ছবি, নদীর ছবি। সেই কাগজটা পানিতে ভিজিয়ে সেঁটে দিতে হবে হ্যারিকেনের চিমনিতে। একটুপরে নাকে আসবে পোড়া পোড়া গন্ধ। কাগজ শুঁকিয়ে তখন মচমচ করবে। 

মা বসেছেন চিংড়িগুলো নিয়ে। দুপুরে বাবা বের হয়েছিলেন ডিঙি নৌকা করে বিলে। জালে ধরা পড়েছে অনেকগুলো টেংরা, বেলে, পুঁটি আর গুড়া চিংড়ি। দুপুরে আলু আর বেগুন পাতলা করে কেটে মা করেছিলেন চিংড়ি বাদে বাকি মাছগুলোর ঝোল। উপরে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন সবুজ সবুজ ধনেপাতা। সেই গন্ধে আমরা বাসন নিয়ে ছুটে এসেছিলাম রসুইঘরে। ‘তোদের বাজান গোসলটা করে আইলেই ভাত দিমু। পুরান চাল সেদ্ধ হইতে দেরি হবে’। হেসে বলেছিলেন মা। খেতে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিলাম, চিংড়ি গেল কই?

কুপি’র সলতেটা মা একটু নেড়ে দিলেন। জেগে ওঠা আলোতে দেখলাম পাটায় মা চিংড়ি বাটছে। সাথে লাল লঙ্কা, রসুন। চিংড়ি ভরতা হবে। খুশিতে মন লাফিয়ে উঠছে। কিন্তু ভরতা’তো মা করে দুপুর বেলায়। সাথে আর কিছু থাকবে? ‘ব্যাঙ, ভাইজান’ বলে চেচিয়ে ওঠে বোন। তিনটা ব্যাঙ ঢুকে পড়েছে বেড়ার নিচ দিয়ে। ওদের চিনি আমি। রোজই আসে। টুকটুক করে লাফ দেয়। আমরা ধরতে গেলে পালিয়ে যেতে চায়। এক দুইদিন ভয়ে পেশাব করে দেয়। বড্ড নিরীহ বেচারা এই ব্যাঙগুলো।

পাটাতে এখন ভিজিয়ে রাখা চাল আর ডাল। পাশে একটা বাসনে কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, পেয়াজ। আমার যেন চাঁদরাতের আনন্দ পেয়ে বসে। চাপটি হবে, আজ চাপটি বানানো হবে। এগুলো একসাথে মেখে তাওয়ায় দিয়ে ঢেকে দিবেন মা। একটু পর রুটির মত হলুদ মচমচে চাপটি। চিংড়ি ভরতা দিয়ে মজা করে খাব। আমার চোখের ভাষা পড়ে ফেলেছেন মা। ‘তুই তো চাপটি খাবি না, তাই না’? আমি ছুটে আসি, ‘ইশ, আমি দশটা চাপটি খামু। আর কত দেরি হইব মা’? ‘এই হইল বইলা। ছাতা আর হ্যারিকেনটা লইয়া তোর জ্যাঠাদের বাড়িতে যা তো বাপ। তোর বাজান গেছে রেডিও শুনতে। স্বাধীন বাংলা বেতার। গিয়া ক, মা’য় খাইতে ডাকছে’।

সেদিন বর্ষাকালের সন্ধ্যারাত। পানি-ভরতি উঠোনে পা ফেলছি মেপে মেপে। একটু এদিক সেদিক হলেই আলুর দম। রসুইঘর আর গোয়ালঘরের মাঝখান দিয়ে ছোট একটা সরু রাস্তা। সেটা পার হলে জ্যাঠাদের পালান। পালানের পানিতে আমার গোড়ালি ডুবে ডুবে যাচ্ছে। হঠাৎ আসা বাতাসে আমার ছাতা হাত থেকে যেন পড়ে যেতে চাচ্ছে। এইতো জ্যাঠাদের জোড়া কাঁঠাল গাছ। বাহির বাড়িতে আজ কেও নেই? বাড়ির ভিতরে ঢুকতে গিয়ে রেডিওতে শব্দ ভেসে আসে। একটি বজ্রকন্ঠ। ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়’। এই কণ্ঠস্বর আমার চেনা। এই ভাষণ আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। 

সবাই ছিল একটা ঘোরের মধ্যে, তাই বুঝি আমাকে খেয়াল করেনি। বাবাই প্রথমে দেখেন। ‘আরে বাজান এই বাদলার মধ্যে কেমনে আইলা? হায়, হায়, ভিজে কাক হয়ে গেছে দেখি। ঠা-া লাইগা যাবে। আসো, বাড়িতে যাই। আমি আইজ যাই ভাইজান’। আমাকে কোলে করে দশ মিনিটে আসা পথটা বাবা দুই মিনিটে পার হয়ে এসে পড়লেন।

গরম গরম চাপটি আর ভরতা বাসনে বাসনে। ছোট বোনটাও খাচ্ছে মজা করে। চোখে আমাদের খুশির ঝিলিক। ‘মিলিটারি ঢুইকা পড়ছে মোস্তফাপুরে। বাড়িঘর পুড়ায়া দিতাছে। গুলি কইরা সব শেষ করে দিতাচ্ছে। আর জোয়ান’, বাবার কণ্ঠ থেমে আসে। হয়ত খাদ্যনালীও চেপে আসে। বাবা মুখে দিতে পারেননি একটা টুকরোও। ‘রমিজ, হাসু, সিদ্দিক ওরা মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাইছে। এইভাবে ভীরুর মত বাঁচা যায় না। বঙ্গবন্ধু ঠিক কথা কইছে। আমাগোর যা কিছু আছে তাই নিয়াই মোকাবেলা করতে হইব’।

‘তুমি গেলে আমাদের কি হইব? আমরা যামু কই’? মা’র চোখে জল টলমল করছে। আমারও কেন যেন ভয় লাগছে।

‘আল্লাহ দেখব তোমাদের। দেশ স্বাধীন না কইরা আমি ফিরব না’।

সেদিন বর্ষাকাল। বেড়ার চালে বৃষ্টি পড়ছে ঝপঝপ করে। একটা হ্যারিকেন আর একটা কুপি জ্বলছে আমাদের রসুইঘরে। জলের ছিটা পড়ছে আমাদের গায়ে। তিনটা ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কালো বিড়ালটাও খাবারের লোভে ঘাপটি মেরে আছে। ছোট বোনটা ঘুমিয়ে গেছে। আমাদের তিনজনের সামনে বাসন। গরম চাপটি ঠা-া হয়ে গেছে। আমরা কিছুই খেতে পারছি না। আমাদের চোখে অনিশ্চয়তা, ভয় আর অসহায়ত্ব ভর করেছে। কুপিটার সলতের মত আমরা যুদ্ধ করছি মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে।


মাতুয়াইল, ঢাকা।


পদাবলি

পদাবলি

 



ভালোবাসা অফুরান

মিশির হাবিব


প্রথম দেখাতেই ‘ভালোবাসি’ বলে চিৎকার করে পিছনে দৌড়াতে নেই।

ভালোবাসার আগে বুকের মধ্যে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে হয়।

জমতে জমতে যখন এক মহাবিশ্ব ভালোবাসা হৃদয় উপচে পড়ে, তখন ভালোবাসার কথা ভাবতে হয়।


এমনভাবে ভালোবাসবে যেন- কাউকে ভালোবাসার পর জ্ঞানহীন হয়ে যাও।

তাকে অন্তত একপলক না দেখলে কথা ফুটে না মুখে,

হাঁটতে গেলে অন্ধ চোখে হুমড়ি খেয়ে পড়ো,

সে হাতটি ধরে না উঠালে উঠতে পারো না।

এমনভাবে ভালোবেসো যাতে ভালোবাসার মানুষটি শত ভুল করলে ‘টু’ শব্দটি করার শক্তি পাও না,

নিষ্ঠুররূপে চলে গেলে মুখ থেকে বের হবে না কোনো অভিশাপসূচক বাক্য।

ভালোবাসার আগে ভালোবাসার পরিমাণ পরীক্ষা করে নিও চোখে,

যেখানে তার সমলিঙ্গের মানুষ দেখলে ভালো  লাগে না,

হঠাৎ করে জেগে ওঠে না পুরনো সুপ্ত প্রেম

বারবার ভেসে ওঠে শুধু তার মায়াভরা মুখ- যা এঁকেছো হৃদয়ে।


সে মারুক, কাটুক, জ্বালাক কিংবা পোড়াক,

একবিন্দু ভাবার সুযোগ নেই ভালোবাসায়-

অসীম সহনশীল ভালোবাসা নিয়ে পা দিও ভালোবাসতে।

ভালোবাসা পারসেন্টেজ হিসাব করে হয় না,

ভালোবাসা সবসময় একশো ভাগের পরিমাপ;

এমনভাবে ভালোবেসো যেন

ভালো বাসতে বাসতে ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে হয়,

কাউকে ততটাই ভালোবেসো, যতটা ভালোবাসলে নিজের কাছে অবশিষ্ট থাকে না।


ভালোবাসা পৃথিবীর কঠিনতম কাজ,

ভালোবাসা এক সবহারানো নেশা,

সব হারিয়ে নিঃশেষ হওয়া ভালোবাসাই অর্থবোধক।

ভালোবাসার আগে কয়েক কোটিবার ভেবে নাও,

ভালোবাসার পর ভাবতে যেও না লোকসানের ক্যালকুলেশন;


এক মহাবিশ্ব ভালোবাসা হৃদয়ে জমিয়ে তারপর ভালোবাসতে যেও যেন ভালোবাসা ফুরাবার আগে তুমি’ই ফুরিয়ে যাও।



বিভাজন 

কামাল আহমেদ 


প্রিয়, মিথ্যে স্বপন করিনা বপন,

কারো খ্যাতি-চন্দন করিনা মোচন।


দেশ-মাতা-মাটি যত পরিপাটি,

স্বপনের হাঁটাহাটি রাখি তত খাঁটি। 

আপনারে তাই ছোট ভাবি ভাই, 

স্বপন সাজাই, ঘাস পথে যাই,

গালিচাতে হাঁটিনা ভাবি তা বারণ।


পথে পথে যার গালিচা সোনার , 

অধম কি আর পথ মাড়ে তার? 

তারই সুখ-গান করি বিরচন।


তুমি-আমি-ওরা সুখে-দুঃখে জোড়া, 

এক ভবে মোরা এক মাটি-গড়া। 

তবু কেন প্রিয়জন এতো বিভাজন? 



ফুঁ

সাইফুল ইসলাম 


পৃথিবীর সকল অবিশ্বাস পুরাতন ন্যাকড়া হয়ে পরে আছে ফ্লোরে; কুকুরের ঘেউ ঘেউ চিৎকারে মাধবীলতার বারান্দায় ঝুলে আছে বিশ্বাসের লাল জামা। আজকাল গোলাপের আত্মহত্যায় কান্না করে না কেউ। দিন ফুরিয়ে গেলে, মানুষের অনুভূতিও  ফিকে হয়ে যায়; মিলিয়ে যায় অদৃশ্যে। রাত বাড়তেই থাকে; লোনা ধরা হৃদয়ের অমীমাংসিত সন্ধির; গোপন সিন্দুকে লুকিয়ে রাখা বহুযতেœর রাত। ম্যাচ বাক্স হাতে নিয়ে বৃষ্টির রোমান্টিকতা ঘষতে থাকে কাঠি। জীবন কি তবে আগুন নিভিয়ে দেওয়ার মতোই; ঠোঁট গোল করে মুখ থেকে বের করে দেওয়া নির্গত বায়ু— ফুঁ?




বিশ্বাসের মহানদী

এনামুল হক রিয়াদ


এ যেনো বিশ্বাসের মহানদী, যেখানে

খর¯্রােতার মতো ভেসে যায় অবিশ্বাস।

দেখো, ঐ জলসরা লোকের গা

কী সফেদ, অমলিন ও স্বচ্ছসলিলা। 

পাঁচবার বিধৌত এই নির্মল তনুশ্রী।

যেন নির্মল সলিল ধোয়া তার দেহ।


বিশ্বাস যার হৃদয় সরোবরে হিল্লোল,

অবিশ্বাস সেখানে সফেন সমতুল্য-

জলের বুকে ভাসন্ত খড়কুটো, বুদবুদ। 

কাল শেষে এদের অস্তিত্ব শূণ্যতায়। 

অবাধে আস্পর্ধা থেকে নিস্কলুষ সে।

এতো পূত জীবনের সওগাত ও স্বচ্ছতা!


আযাযিল তাকে কুমন্ত্রণায় ব্যস্ত রাখে;

তাওবার সরোবরে ডুবিয়ে ডুবিয়ে-

সে আবার নিঃস্পৃহ ও নিষ্পাপ-সুবোধ!

আরাধনা মুখর জীবনে আর কী চাই,

আয়ুস্বল্পতা সেতো অলক্ষ্যেই বিধিবদ্ধ। 

মানুষ বুঝুক এটা মহামতীর পরওয়ানা। 


বার্ধক্য তার প্রথমা চিরকুট-পয়গাম!

মৃত্যুই শেষ ফয়সালা, আখের আঞ্জাম!

চলো, সিরাতে মুস্তাকিমের পথে এগোই,

যার শেষ সীমানা শাহাদাত ও জান্নাত। 

সেই তো মহাসাফল্যের মুকুট মাথায় !




হস্তশিল্প হোক আঁচলের ক্ষতস্থানে 

রুদ্র রাকিব 


তোমার পুরনো আঁচলের ক্ষত স্থানে; হস্তশিল্পের দক্ষতা লুকিয়ে নিজের মুখকে হাতে ঢেকে রাখা লাজুক রমনী। 

তোমাকে ভালোবাসি লক্ষী; তোমার হাতের বাঁকা সেলাইয়ের ফোঁড়ে তোমার জীবনের কত কাহিনি। 

তোমাকে দেখে কত নারী সেই নকশীকাঁথার মাঠে; জীবনের স্মৃতি গেঁথে রেখেছে; শখের বিলাসিতা বলে।

তুমি যা লুকিয়ে রেখেছিলে; লজ্জায় মাথা ঢেকেছিলে! সেটা নিয়ে কত সিঁদুর হারা নারী। একা জীবন সংগ্রাম করে; বাঁচতে শিখেছে।

ভালোবাসি তোমার পুরনো জামার গায়ে সুঁইয়ের সেলাই করা আলপনা। যেন হারিয়ে না যায়- এই দক্ষতার ললাট। সিঁদুর হারিয়ে যাক; কাজের মধ্যে দিয়ে হোক নতুন জীবন আবার।




সাধারণ ছেলে

জালাল উদ্দীন ইমন 


আমি যে গাঁয়ের সাধারণ এক আলাভোলা ছেলে

ময়না শালিক সোহেলি কাকেরা ডাকে বেশি ঘুম এলে।

পাহাড় চুড়ায় কমলা রঙের সূর্যটারে ধরে

হাতের মুঠোই ভরে।

সারা গায় মাখি দারুণ উৎসাহে,

যদিও পুড়িয়ে মারে সে আমারে তীব্র দাবদাহে। 

পিপুল বনের ঝাঁঝালো হাওয়ায় চোখ বুজে আসে

রাতের আকাশে জোনাকি মেয়েরা ঘুরে আশেপাশে। 

ঘুঘুরা গুবগুব ডেকে হয় সারা

হিম হিম সুরে চেয়ে থাকে দূরে লক্ষ্মীপ্যাঁচারা।

হলদে খেঁজুর থরেথরে সাজা যেন দাদিমার চুল

বাঁশঝাড়ে কাঁদে হাহাকার সুরে বুঝি বিরহে আকুল।

যদিও না বুঝি বাতাসের ভাষা, মন বুঝে ঠিক

সবাই ঘুমিয়ে গেলে তাই মন ছুটে চারিদিক।


জাদুর কুমড়োর বীজ

জাদুর কুমড়োর বীজ

 



জাদুর কুমড়োর বীজ

আহমাদ স্বাধীন


একজন বৃদ্ধ পিতার ছিলো দুইজন ছেলে। 

বৃদ্ধ ছিলো খুব গরিব। তার সন্তানদের মা বেঁচে ছিলেন না। দুই ছেলেকে নিয়ে একটা ভাঙাচোরা কুড়েঘরে ছিলো তার বাস। অন্যের জমিতে চাষ করে চলতো তাদের সংসার। কিন্তু যখন বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে গেলো, তখন তাদের অভাব আরো বেড়ে গেলো। 

কারণ তার ছেলে দুজন ছিলো এক একটা কুড়ের বাদশাহ্। সারাদিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো। 

কাজে মন ছিলো না কারোই। বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে যখন বিছানায় পরলো তখন হুস হলো ছেলেদের। 

বাবা একা কাজ করে প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এখন ঘরে খাবার নেই। 

তাদের বাবা অনেক বুঝিয়েও তাদের দিয়ে কোন কাজ করাতে পারে নি। এখন ছেলেরা ভাবনায় পড়লো।

তাদের বাবা মরে গেলে কী হবে ?

তারা এমন কোন কাজ শেখেনি যা করে জীবিকা চালাতে পারে। বাবার কাছেও এমন কোন সম্পদ নেই যা দিয়ে তাদের চলে যাবে। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরলো দুই ভাই। এদিকে তার বাবার অসুস্থ্যতা বেড়ে গেলো আরো। মৃত্যুর সময়ও ঘনিয়ে এলো প্রায়। তিনি দুই ছেলেকে কাছে ডাকলেন। বললেন, শোনো ছেলেরা। 

সম্ভবত আমার চলে যাবার সময় হয়ে গেছে। 

এতে আমার কষ্ট নেই। আমার কোন সম্পদ নেই তাতেও আমার কষ্ট নেই। কষ্ট হচ্ছে আমি তোমাদের কোন কাজ শিখিয়ে যেতে পারছি না, যা দিয়ে তোমরা জীবিকা চালাতে পারো। তোমাদের মা তোমাদেরকে ছোট রেখেই মারা যায়। আমি একাই তোমাদেরকে এতোটা বড় করে তুলেছি। 

তোমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কখোনো জোর করিনি এজন্য যে তোমরা কষ্ট পাবে। এখন মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। তোমাদেরকে কখনো কখনো আমার শাষন করা দরকার ছিলো। সেটা করলে তোমরা কিছুটা হলেও শিখতে পারতে। যাই হোক, তোমাদেরকে দিয়ে যাবার মতো কিছুই আমার নেই তা তোমরা জানো। 

তবে আমার কাছে দুটো কুমড়োর বীজ আছে। 

এ দুটো বীজ আমাকে দিয়েছে একজন সন্যাসী। 

তোমরা তখন ছোট, তাকে একবেলা আহার করানোর পর খুশি হয়ে তিনি এই বীজ দুটো আমাকে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন এ বীজ দুটোর মধ্যে একটা বিশেষ জাদুর বীজ আর একটা সাধারণ বীজ। তবে কোনটা জাদুর আর কোনটা সাধারণ তা আলাদা করা নেই। দুটি বীজ দেখতে এক রকম। 

এটা বোঝা যাবে তখনই যখন বীজ দুটো রোপণ করা হবে। জাদুর বীজ থেকে প্রতিদিন অনেক ফলন হবে। 

যা বিক্রি করে অনেক ধনী হয়ে যাবে। 

আর সাধারণ বীজ থেকে স্বাভাবিক ফলন যা হয় তাই হবে। এই বীজ দুটো আমি তোমাদের দিয়ে যাচ্ছি। তবে শোনো, শর্ত হচ্ছে আমি মরে যাবার পর তোমরা দুজন আলাদা হয়ে যাবে। দুটো বীজ তোমরা দুটো আলাদা গ্রামে রোপণ করবে।  

আমি জানি না তোমাদের কার ভাগ্যে জাদুর বীজ আছে আর কার ভাগ্যে সাধারণ বীজ। যে জাদুর বীজ পাবে সে কিন্তু নিজের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি গ্রামের গরীব লোকেদের সাহায্য করবে। তবে নিজের ভাইকে নয়। এই জাদুর বীজ পাওয়ার পরে যদি গরীব লোকেদের সাহায্য না করো অথবা ভাইকে এর কোন অংশ দাও তবে এই বীজের ফলন বন্ধ হয়ে যাবে।  

অপরদিকে যে সাধারণ বীজ পাবে সে এই বীজের ফলন ফলিয়ে পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করবে নিজের ভাগ্য 

ফেরাতে। 

আমি আরো আগেই তোমাদেরকে এই বীজ দুটো দিতে পারতাম, কিন্তু আমি এটা দেখতে চাইনি যে আমার এক ছেলে অনেক ধনী হয়ে উঠেছে আর এক ছেলে ভীষণ দরিদ্রতার সাথে দিন কাটাচ্ছে। 

আমি তোমাদের দুজনকেই সমানভাবে ভালোবাসি। 

তবে একটা কথা মনে রাখবে ছেলেরা। 

যদি পরিশ্রম করতে জানো তবে সৌভাগ্য কেউ ঠেকাতে পারবে না। বৃদ্ধ আর কোন কথা বলতে পারলেন না। মরে গেলেন তিনি। তার ছেলেরা বাবার লাশ কবর দিয়ে দিলো। দুজন দুটো বীজ নিয়ে পাশাপাশি দুটো আলাদা গ্রামে চলে গেলো। গিয়ে যার যার বীজ রোপণ করে যতœ নিতে থাকলো।  

ছোট ভাই সকাল বেলা তার বীজটা নিয়ে রোপণ করেছিলো একটা পাহাড়ের পাশে। 

অবাক হয়ে দেখতে পেলো বিকেলেই সেটা গাছ হয়ে গেছে। এরপর দেখা যায় গাছটি বড় হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ে। তারপর কুমড়ো হয়ে বড় হতে হতে এতো বড় হলো যে এই গ্রামে এতো বড় কুমড়ো আর কারো নেই। ছোট ভাই বুঝতে পারলো যে সৌভাগ্যের বীজটা সে পেয়েছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে জাদুর কুমড়ো তুলে নিতো লাগলো সে। সেই কুমড়ো বিক্রি করার জন্য নিয়ে গেলো বাজারে। এতো বড় আর মজার মিষ্টি কুমড়ো খুব সহজেই সব বিক্রি হয়ে গেলো সব। ভালো দামও পায় সে। পরের দিন দেখতে পায় আবার কুমড়ো ধরে আছে লতায়। আবার বিক্রি করলো সে।  

আবার কুমড়ো ধরে গেলা লতায়।  

আবার বিক্রি করলো। এমন করে প্রতিদিন কুমড়ো ধরে আর প্রতিদিন বিক্রি করে খুব তাড়াতাড়ি ধনী হয়ে যায় ছোট ভাই। 


অপরদিকে বড় ভাই তার কুমড়োর বীজটি নিয়ে একটা নদীর পাড়ের ক্ষেতে রোপণ করেছিলো। 

সেটা গাছ হতে অনেক দেরি হয়ে যায়। 

আর কুমড়ো ধরতেও সময় লেগে যায় অনেক। 

বড় ভাই বুঝতে পারে সে পেয়েছে সাধারণ বীজ। 

তবু সে মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে তার ছোট ভাই জাদুর বীজটা পেয়েছে। 

আর সেটি পেয়ে নিশ্চই সে ভালো আছে।  

বড় ভাই নিজের সাধারণ কুমড়ো লতার বেশ যতœ নেয়।  আর পরিশ্রম করে কাজ করে অন্যের  জমিতে। 

শুরুতে যদিও তার বেশ কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু ধিরে ধিরে সয়ে যায় তার পরিশ্রম। তার গাছে কুমড়ো ধরলে তা বিক্রি করে সে খুব সামান্যই টাকা পায়।  

তবু সে খুশি হয়। 

কারণ এটা তার বাবার দেয়াএকমাত্র সম্পদ। 

অন্যের জমিতে সে একটু বেশিই পরিশ্রম করে। 

আর কাজও করে বেশ গুছিয়ে। যে কারণে সবাই পছন্দ করে তাকে। সে একদিনও বসে না থেকে শুধু কাজ করে যায়। কাজের পারিশ্রমিক আর কুমড়ো বিক্রির টাকা জমিয়ে রাখে সে। এভাবে কেটে যায় কয়েকটা বছর। সে তার একটা কুমড়োর গাছ থেকে বীজ তুলে রাখে। জমানো টাকা দিয়ে একখন্ড জমি কিনে সেখানে সেই বীজ দিয়ে কুমড়োর চাষ শুরু করে। 

কুমড়ো ক্ষেতের প্রচুর যতœ নেয় সে। 

তাই সেখান থেকে অনেক ফলন পায়। 

তা বিক্রি করে বেশ ভালো টাকা আয় হয় তার।  

সে আরো জমিন কেনে।  আরো কুমড়োর বীজ রোপণ করে। তার যতেœ সেখান থেকেও অনেক অনেক কুমড়োর ফলন হয়। এমন করে অল্প কয়েক বছরেই বড় ভাই বিশাল জমিন কিনে খামার করে খামারের মালিক হয়ে যায়। 

এক সময়ে সে তার ছোট ভাইয়ের খোঁজ নিতে তার গ্রামে গেলে দেখতে পায় তার ছোট ভাই সেই গ্রামে নেই। অনেক খুঁজে খুঁজে তার সন্ধান পায় একটা বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করা অবস্থায়।

কী হয়েছে জাদুর বীজ পাওয়া ছোট ভাইটির! 

খবর নিতে গিয়ে জানতে পারে তার দুর্ভাগ্যের কথা।  যদিও সে পেয়েছিলো জাদুর কুমড়োর বীজ,  

তবে বেশিদিন সে সুখে থাকতে পারে নি। 

তার ছোট ভাই তাকে জানায়, আমি জাদুর কুমড়োর বীজ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম।  

ভুলে গিয়েছিলাম বাবার উপদেশ। তিনি বলেছিলেন, 

যে জাদুর বীজ পাবে সে যেন তার গ্রামের গরীব লোকদের নিয়ে ভালো থাকে।  

বাবা বলেছিলো আমার জাদুর কুমড়ো বিক্রি করা টাকার একটা অংশ যেন দান করি। আমি প্রথম কিছুদিন সামান্য কিছু দান করেছিলাম, তবে যখন কুমড়ো বিক্রি করে আমার অঢেল সম্পদ আসা শুরু হলো তখন সব ভুলে গেলাম। আমার কুমড়োর ক্ষেত অন্য কাজের লোককে দেখার দায়িত্ব দিয়ে আমি সারাদিন ঘুরে বেড়াতাম। রাতের বেলায়ও পরে থাকতাম সরাইখানায়, মদ আর জুয়ার আড্ডায়। 

তবুও এক বছরের বেশি সময় আমার জাদুর কুমড়োর গাছটা তার ফলন বন্ধ করে নি।  

একদিন এক অন্ধ ভিখিরি আমার কাছে সাহায্য চাইলো। আমি মাতাল অবস্থায় তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। বললাম, দূর হ সামনে থেকে। সেইদিন থেকেই আমার কুমড়ো গাছের ফলন বন্ধ হয়ে গেলো। 

কিন্তু আমি এতোটাই বেখবর ছিলাম যে তা বুঝতেও আমার লেগে গেলো অনেক দিন। 

যখন বুঝলাম তখন আর কিছুই করার নেই। 

আমার কুমড়োর ফলন বন্ধ। কোন আয় নেই। 

এদিকে আমার কাজের লোকদের বেতন বাকি। 

কিছু দেনাদার ছিলো আমার, তারাও টাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, তখন আমি বাড়ি বিক্রি করে দেনা ও কাজের লোকেদের টাকা পরিশোধ করলাম। 

এরপর খুব তাড়াতাড়িই আমি হয়ে গেলাম আগের মতো সহায় সম্বলহীন। চেষ্টা করলাম কোন কাজ করে পেট চালানো যায় কিনা, কিন্তু সেই যোগ্যতাও আমার নেই।  বুঝলাম যখন সামান্য কাজেও আমার প্রচুর সময় লাগছে আর অনেক ভুল হচ্ছে। কেউ আমাকে কোন কাজ দিলো না। পেটের ক্ষুধায় শেষে ভিক্ষাই শুরু করতে হলো আমাকে। 

ছোট ভাইয়ের ঘটনা শুনে খুবই কষ্ট পেলো বড় ভাই। বলল- যা হবার হয়ে গেছে, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার সাথে আমার দেখা তো হয়ে গেলো। 

এখন তোমাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না।  

তুমি আমার সাথে থাকবে আর আমার বিশাল খামারের দেখাশোনাও করবে। ছোট ভাই বলল, কিন্তু বাবা তো বলেছিলো আমরা কেউ যেন নিজেদের ভাইকে সাহায্য না করি।  বড় ভাই হেসে বলল,  বাবা ঠিক এ কথা বলেননি। তিনি বলেছিলেন যে জাদুর বীজ পাবে সে যেন ভাইকে সাহায্য না করে। 

আমি তো জাদুর বীজ পাইনি। 

আমি পেয়েছি পরিশ্রমের জাদুর বীজ। 

যে বীজের ফসল ফলাতে জানলে কখনোই ফুরিয়ে যায় না। তুমি আমার সাথে থাকলে সেই বীজ কি করে ফলাতে হয় তা শিখে যাবে। 

জাদুর বীজের উপর তোমাকে নির্ভর করতে হবে না। তারপর থেকে দুই ভাই একসাথে বসবাস করতে লাগলো। আর ফলাতে লাগলো পরিশ্রমের জাদুর বীজ। 


শব্দমালা : মো. আরিফুল হাসান

শব্দমালা : মো. আরিফুল হাসান


 


কলঙ্কিনী 


তুমি নাকি যাত্রাপালা দেইখ্যা আইছো নাগরের সাথে

এখন ক্যামনে নলা দিবা আমার ক্ষেতের ভাতে

শইলের রক্ত পানি কইরা তোমার লাগি তুলি নতুন ধান

সেই সব আমার স্বপ্ন ভাঙলারে খানখান!

তুমি নাকি পান খাইয়াছো রসিক জনের হাতে

এখন ক্যামনে আমার ক্ষেতের সালুন তুলো পাতে

রইদে পুইড়া মেঘে ভিইজ্যা সবজি ফলাই আমি

ক্যামনে তুমি করতে পারলা এরুইম্যা বদনামী?

তুমি নাকি ভিন্ নাগরের হাত ধরছো আজ

এখন ক্যামনে পাতে তুলো আমার পুইরের মাছ

মাঘ মাইস্যা শীতের রাইতে মাছ ধরিয়া আনি

তুমি ক্যামনে দিতে পাল্লা সতিত্বের কুরবানী?

তুমি নাকি লাঙের লগে ঘুরতে গেছো, হচ্ছে  কানাকানি

এখন তুমি ক্যামনে পি'বা আমার কুয়ার পানি

মাতার ঘাম পায়ে ফেইল্লা কুয়া খুড়ছি নিজে

ক্যামনে তুমি পারলা এমুন, কাপলা না কি লাজে?

তোমায় নাকি আইজ সারাদিন সঙ্গ দিছে নাগর

এখন কেমনে ফিইরা আইলা আমার কুড়ে ঘরে

উত্তরেত্তে ছন আনিয়া ঘরে দিছি ছানি

সেই ঘরেতে থান পাবে না কোনো কলঙ্কিনী।



তোমার চোখে আমিও বর্ষা হয়ে যাই 


বৃষ্টির ফাঁক গলে এক চিলতে কিরনের মতো চকচকে 

তোমার দুটো চোখ

ঝলসে দেবার মতো তীব্র নয় অথচ তাকানোও যায় না

কেমন যেনো হীরের ফলার মতো দৃষ্টিকে কেটে কুচি কুচি করে

দু'চোখে জল ঝরে পড়ে ওই চোখে চোখ রাখলে!


তোমার মনের আকাশজুড়ে মেঘ, মেঘের জোয়ার 

ঝমঝম সারাদিন

আনত চোখ তুলে যখনই তাকাও– মেঘার্ত আকাশের শুভ্রতা

কি অবলীলায় কাটে আমার দু'চোখ! আমিও বর্ষা হয়ে যাই।



খেয়া আমি বেয়ে যাবো


কিছুই পারিনি হতে, এ পথে এখনও আমি ছাত্রই নই

সুবিশাল জলমর্মরে, একবিন্দু শিশির যেনো হই।

দুপুরের টগবগে রোদে, দেশলাই কাঠি আজো হইনি

বুকেতে বারুদ ধরি, এই কথা সাহস করে কইনি।

আজও অন্ধ, মুঢ় আমি; অথচ দিগন্তভরা নান্দনিকতা

আজও আলস্য সখি, কাটলো না জ্ঞানের জড়তা।

সবুজের সমারোহে আমি ক্ষুদ্র পতঙ্গও হতে পারলাম না

ভেতরে বিষের বালি, এই কথা বলতেও যেনো মানা।

কবিতার অবারিত সপ্তাকাশে, আজও হইনিকো পাখি

এই দুঃখ কি দিয়ে নিভাই, কোনখানে এই ব্যাথা রাখি?

তবুও জানি চর্চা আমার সমুচ্চয়ী পথ, দৃঢ় করে হাল

সাহিত্যের খেয়া আমি বেয়ে যাবো, অনন্ত মহাকাল।



পাথরের মন


কতোটা পাষাণ তুমি হইয়া গেছো চিন্তা করতে পারো

আমার বিরহে চোখে একবিন্দুও জল ঝরে নাই

কতোটা নিদয়া তুমি হৃদয়ের কারবার করো

আমারে দহন দিলা পুড়াইয়া কইরা দিলা ছাই

কি করে এতোটা নিঠুর হইলা তুমি দয়া মায়াহীনা

আমারে কবর দিলা নিজ হাতে, তবু কাঁদলা না!


যখন আমি যাইতে চাইলাম খাঁচা ভাঙা পাখিটির মতো

নিজ হাতে দুয়ার খুইল্লা উড়াইয়া দিলা আমারে

আমিও আকাশ চিনি, পোড়া বুকে জন্মের ক্ষত

কি করে ফিরাই আনবা, যদি কেউ কোনোদিন না  ফিরে

এই যে চইলা গেলাম তবু তোমার হইল না শোক

বুঝলাম, সারাজীবন কাটাই দিছি বাইছা ভুল লোক।


নদীর ঢেউয়ের মতো পাড় ভাঙে আমার সর্বক্ষণ 

তবুও গলে না সখি তোমার ঐ পাথরের মন।