প্রেমিকার জন্য লেখা পদাবলি

প্রেমিকার জন্য লেখা পদাবলি

 
নির্বাসিত কন্যা
সুজন বিশ্বাস

কন্যা,
তুমি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে আছ!
তোমার অহংকারী ওই দুর্গম পাহাড়
অতিক্রম করার দুঃসাহস করিনা;
তাইতো তোমার কাছে চিরকালই আমি-
শীতার্ত রজনীতে ঝরে পড়া
শুকনো পাতার মতো দৃশ্যমান।

অথচ, তোমার ওই
অভিমানের পাহাড় ডিঙিয়ে,
সমতলের ঋজুপথে নেমে আসলেই দেখতে;
তোমার জন্য অজস্র চন্দ্রিমায়-
একশো আটটি নীলপদ্ম একত্র করেছি।

সেই সমস্ত যূথবদ্ধ নীলপদ্মরাজি,
আমাদের স্পর্শের আশায় আজো অপেক্ষমাণ।


মৃত্যুদুয়ার
দীপঙ্কর পাড়ুই

মৃত্যুদুয়ার বুঝি ধাপে ধাপ এগিয়ে আসে। মুখাগ্নি যে হাতে হয় ‘ঘি’ এর গন্ধ তোমার শেষ স্পর্শ পেয়ে
ভাসিয়ে দেয় ছাই।

ধূনোগন্ধে ঈশ্বর বুঝি। হাড়ের প্রবল সফলতার পর
জলে ভাসে অধিকার। তুমি তো মিশবে বলেই জন্মেছ

থিতু সময়ে একখ- আলো এসে পড়ে। আবছা হয় স্মৃতিগন্ধ। তর্পণে জুড়োয় ক্ষতের মুখ, মনে পড়ে বাঁচার কথা কি কি বলেছ

 শূন্যগোলা
 মোঃ রফিকুল ইসলাম

তোমার প্রস্থানে সুনামির তোড়ে ভাঙ্গে
আমার ঘর গেরস্থালি; মরি শূণ্যতায়।
বাতাসের আদ্রতার গভীর চুম্বনে
জং ধরেছে লাঙ্গলের ফলায়।

হালচাষহীন আবাদি জমি বিষাদে কাঁদে,
ফসলের মাঠে দুষ্টু বাতাস দেয় না দোলা।
গুহার আঁধারে পোঁকায় কাটে বীজপত্র,
করুণ চিৎকারে আর্তনাদ করে শূণ্যগোলা।
এক পশলা বৃষ্টি
পার্থ কর্মকার

মেঘগুলো এখন শুধু আমার ভেতরেই বৃষ্টি হয়ে ঝরবে।
কাঁদবে, অশ্রুজলে সিক্ত হবে, হয়তো কখনো অগ্নি উদগিরণ করবে,
তবুও সব আমার থাকবে।
আমার অগ্নি কিংবা বৃষ্টি কোনটাই আর তোমার ঠিকানায় কড়া নাড়বে না।

যদি কখনো তোমার ওড়না ছুয়ে যায় আমার কান,
শুধুমাত্র তখনি এক পশলা  ভিজিয়ে দিয়ে যাব তোমার চুল।



জীবন্ত প্রেমিকা চাই
সোলায়মান আহমাদ

স্বপ্নের গন্ধমাখা ভোর দিয়ে মৃত্যুর শেষটানে হৃদয়
প্রথম নিশ্বাসে অক্সিজেনের সাথে লেগে থাকে
ত্রয়োদশ তম প্রেমিকার শরীরী অগ্নিউল্কা!

নেকড়ের মত আঁচড় কেটেছিল ঠোঁটে
আর স্বপ্নের উপর হয়েছিল গ্রেনেড হামলা!

কিন্তু এখন হৃদয় বেঁচে উঠেছে
এবার একটা জীবন্ত প্রেমিকা চাই

যেখানে থাকবে তাজা শরীরী ঘামের গন্ধ,
ঠোঁট কামড়ালে বের হবে রক্তের মত মধু
অঙ্গের আড়ালে থাকবে সুন্দরের লালসা
চোখের আগুনে বার পুড়বে হৃদয়।

রাত্রিতে উন্মেষ হবে রূপবদলের স্বৈরশহর
গরম দুধে নয়
গরম রক্ত পানে ভেসে যাবে অপেক্ষার যন্ত্রণা

আকাশ হয়েছে ক্লান্ত
এবার ঘুমাবে সূর্য
এবার একটা জীবন্ত প্রেমিকা চাই।


একগুচ্ছ প্রেমাণুকাব্য
ফখরুল ইসলাম ওমর

১.
ইচ্ছেগুলো কিচ্ছে হয়ে
উড়ে গেলো আকাশে,
স্বপ্ন আমার ফ্যাকাসে-
একবার পেলাম ভালোবাসা
প্রিয়ার শাড়ীর বাতাসে!
২.
ইচ্ছেরা সব ডানামেলে
উড়ে মিছে ছন্দে,
কামনাটাই মন্দে-
আবার প্রেমিক হতে চাই
প্রেমের সুধার গন্ধে!
৩.
মন মননে নিত্য তুমি
উঠাও প্রেমের সুর,
তুমি আমার হুর-
কাছে ডাকো নেশার চোখে
থেকোনা আর দূর!
৪.
নীল মনের নীলাঞ্জনা
নীল তোমারে ডাকে,
সুখ ঝাঁকে ঝাঁকে-
কাছে এলেই বুঝতে পাবে
প্রেম বলে কাকে!
৫.
কামনারই অন্তমিল
থাকে যদি রোজ,
নিতে হয়না খোঁজ-
যখন তখন প্রেমাদরে
নেয়া যায় তার ডোজ!
৬.
কোথায় তুমি ডাকো আমায়
আরো কাছে আসতে,
তোমায় ভালোবাসতে-
ভালোবাসার সুখ মোহনায়
তোমার বুকে ভাসতে!


প্রেম
মিসির হাছনাইন

কোন এক কৈশোরে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমার ভিজে গেছে শরীর।
মায়ের ছায়ায় মাথা নিচু করে দৌড়ে  লাফিয়ে পড়ি নদীর ঘোলা জলে।
নদীর কিনারের মস্ত বড় লাল সূর্যটা মাথায় দিয়ে, শ্রাবণের  আকাশে
থেমে থাকা ঘন কালো চুল বাতাসে উড়িয়ে,
বুকের উপরের কালো তিল গোলাপী ওড়নায় ঢেকে, নদীর নরম ঢেউের মতো স্মিত হেসে,
ভেজা ঘাসের উপর আলতা পায়ে জীবন্ত হেঁটে...
আমার ঘোলাটে লাল চোখের
সম্মত পৌরষ নিয়ে দৌঁড়ে যায় কুমারী হরিণী...

হঠাৎ, একদিন অনুভব করলাম আমার শরীরে
ঢুকে গেছে হেমলক বিষ। যৌবনের ঈশ্বরকে সেজদা করে-
মরে যাওয়ার আগে আমি যেন না দেখি আমার হরিণীকে কোন হিং¯্র বাঘের মুখে।

সমাপ্তি
মহসীন আলম শুভ্র

আমি নেই
আমাকে পাবে না আর খুঁজে
রেখে গেছি কবিতা হারানো দিন আর তোমার চিবুকে।
আয়নায় দাঁড়াও যদি অথবা শীতলক্ষ্যার তীরে
দেখো, জুঁই ভেসে যায় ভারত বা রামায়ণে।
নদীমুখী হও, ঋতুমুখী হও
সন্ধ্যার দীপ, তপ’ নত হও যত
কিছুই হবে না আর
চোখের যন্ত্রণায় এপার-ওপার
বিসর্জনের সিলমোহর শেষে আর কি থাকে অধিকার?
আমি নেই; আলবিদা, আলবিদা।
ভালো থেকো, হে শাহাজাদি গুলবাহার!



এখানে ক্লান্তির ছুটি
সৌর শাইন

আঁধারকে কুৎসিত বলার অধিকার আমার নেই।
তুমি কি জানো না কিছু অসীম সুখ তৃপ্তি ওখানেই লুকিয়ে থাকে,
লাজুক আলো তাই মুখ ফিরিয়ে থাকতে ইচ্ছুক!

পৃথিবীর আহ্নিক গতি, এখানে ক্লান্তির ছুটি!
তন্দ্রা বিলাসে সুখ উদযাপন।
জীবনের কিছু শ্রেষ্ঠ তেষ্টা ওখানেই সঞ্চিত,
এসো, সে তেষ্টা করি দূর!



খোঁজ
রূপক সেনগুপ্ত

আমার আমিকে খোঁজ করছিলে?
চাইলেই পেয়ে যেতে লাল শরীরের ওপর
উজাড়ের জজ্ঞ চলে যেখানে দিনরাত
তারই পাশে বসে সবটা দেখছি এক ধ্যানে
চিৎকার করে বলে উঠি ফালতু নাটক, পর্দা পড়ে
নতুন দল  নীল, লাল,কমলা, রকমারি পোষাক
পর্দা ওঠে নাটক শুরু 
ভালো হবে নিশ্চিত এটা
ওই চিৎকার, ফুঁপিয়ে কাঁদছে বুঝি শ্রাবণ
সেদিন বাড়িতে কাজ ছিলো খুবই জরুরি
পাস কাটানো ছাড়া উপায়
সেদিন পেয়ে যেতে বাড়িতে খোঁজ করছিলে ? 
ছারপোকা ও আমি পাশাপাশি শুয়ে থাকি
পোকা হয়ে থাকি
আমার আমিকে খোঁজ করছিলে!




তুমি
হাবিবাতুল উম্মে

আমাকে ভেঙ্গে চুরমার করলে
যা পাই-
তার সবটুকু’ই তুমি ।

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০১

ধারাবাহিক উপন্যাস : উর্মিলা নগরে থাকে : পর্ব ০১


১.
ক্ষিপ্র স্পার্টনের মতো বাসের হ্যান্ডেল ধরে উর্মিলা নগরে চলে যায়। ওর গাঢ় হলুদ ওড়না বাসের  দরজায় কতক্ষণ ওড়াউড়ি করে। তারপর আর দেখা যায় না। বাসটি গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে আবছায়ার মতো মুখ দেখিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। উর্মিলা চলে যাওয়া নিয়ে জগৎ-সংসারের কোনো মাথাব্যথা নেই। ভাবেও না। ভেবে লাভ কী? দয়ার্দ্র, মমতাবান, করুণ কোনো মুখ ওকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়েও দেয়নি। বিক্রমহাটির এই অখ্যাত স্টেশন অজানা থেকে গেল। উর্মিলা নামক একজন নারী এ শান্ত নির্জন গ্রামের কোনো কিছুই গ্রহণ করতে পারেনি। কেন? কারণ ওর এখন দহনকাল চলছে। গ্রামের সবচেয়ে উঁচু ঝাউগাছের মাথায় গোল চাঁদ ঝুলে থাকে, তা উর্মিলার কাছে অর্থহীন। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী বংশাইর মতো মাতঙ্গিনী রূপ, বিস্মরণের ওপারে ডুব-সাঁতারের গল্প পেছনে পড়ে থাকে। যেখানে কোনো আশা নেই। স্বপ্নহীন প্রজাতি সে। বাল্য এবং কৈশোরের স্মৃতির দাপাদাপি আছে। বংশাই নদীর বাঁক, ওপাড়া চন্দবাড়ির মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, উন্মাতাল ছোটাছুটি, অতি তুচ্ছ চাওয়া-পাওয়ার আনন্দের মুগ্ধতা। নীরব নীলাভ দহন। এ দহন উর্মিলা বিস্মৃত হতে পারলে ভালো হতো। আকস্মিক এসব উর্মিলার নিকট মূল্যহীন, ধোঁয়াশা।
বিক্রমহাটি স্টেশনে অন্য কাউকে কি আশা করেছিল? করতে পারে। উর্মিলা এখন নগরে যাচ্ছে এ খবর খুব মানুষ কি জানে? না জানলেও ক্ষতি নেই। তবে স্কুলফেরত উর্মিলা হঠাৎ হঠাৎ যার মুখোমুখিতে থমকে যেত। বিহ্বল চিত্তে প্রতিনিয়ত প্রণয়ভিক্ষায় কাতর সে তরুণের মুখ মনে পড়ে। ইতিউতি স্টেশনে তার মুখের উপস্থিতি খুঁজে দেখেছিল। সেও উর্মিলার নগরে চলে যাওয়া দেখেনি। তাই শূন্যতায় আক্রান্ত একজন দুঃখী নারীর কষ্ট ভাগ করতে পারেনি। উর্মিলা থেকে গেল একক।
বাবা পরেশ পালও আসেনি। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার পথ। একটা টিনের ট্রাংকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উর্মিলা স্টেশনের পথ ধরেছিল। পরেশ পাল উর্মিলার ওপর ভরসা করতে পারেনি। কেন কী কারণে উর্মিলা নগরে যাবে তা তো জানে না।
উর্মিলা বলেছে, ‘বাবা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। মানুষের পক্ষে থাকব।’ পরেশ পাল অবাক। উর্মিলার কী ভাতের কষ্ট করেছে। অথবা অন্য কিছু। এতটুকু মেয়ে কী যে বলে! মেয়ের চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে হয় বিশদ জানার।
উর্মিলা তাকে সে সুযোগ দেয়নি। কী বলেছিল তা বোঝার আগেই তার মেয়ে পথে নেমে যায়। পরেশ পাল অনেকটা স্থবির বসেছিল বাড়ির আঙিনায়। উর্মিলা খালপাড় পেরিয়ে স্টেশনের পথ ধরে।
পরেশ পাল স্কুলশিক্ষক। উর্মিলাকে জন্ম দেওয়ার চার বছরের মাথায় স্ত্রী মিনা বালা কলেরায় মারা যায়। পরেশ পাল অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। চিতায় মুখাগ্নির সময় চার বছরের উর্মিলা কিছু বোঝার আগেই মা মিনা বালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরেশ পাল দ্বিতীয় বিবাহ করেনি। তখন উর্মিলাকেই মনে হয়েছে এক জনমের কঠিন জিজ্ঞাসা! তাই আগামী জীবন উর্মিলাকে নিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্পে অনড় থেকে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। সহস্র আশা-আকাক্সক্ষায় বঞ্চিত বাবা পরেশ পাল মাতৃহীন উর্মিলাকে নিয়ে একাকী সংসারে শক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সতের বছর অতিক্রম করে যে স্বপ্ন লালন করেছে, তার সেই বিশ্বাসে গলদ ছিল না। কিন্তু বাঁধ সাধে উর্মিলা নামক পরীর মতো রূপবতী স্কুল-উত্তর তরুণীর স্বপ্নতাড়িত দ্রোহ। যে  সমাজ-সংসার, চাওয়া-পাওয়া, ন্যায়-অন্যায়, মানবিক অধিকারগুলোর ঊর্দ্ধে ন্যায্য হিস্যায় তেজদীপ্ত ব্যতিক্রমী নারীরূপিনী। তাই জন্মের পর যে শিশু অসহায়, কাঙাল, অতি সাধারণ, বয়স বাড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এ শিক্ষা পরেশ পাল দিয়েছিল তাকে।
উর্মিলাকে নিয়ে পরেশ পালের কোনোরূপ কষ্ট হয়নি। না গোত্র না ধর্ম না সমাজ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উর্মিলা নিজেকে প্রস্তুত করেছিল অন্য এক বিভায়। শুভপুরের তাবদ বাসিন্দা জানে উর্মিলা সহজ মেয়ে নয়। চলনে-বলনে আর দশটা নারী-চরিত্রের সঙ্গে মিল খায় না। ওর অনিন্দ্য মুখশ্রী, মায়াময় আঁখির বিস্ময়কর দৃষ্টি,  যে কেউ বিহ্বল হতে বাধ্য। তারপরও ওরকম কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়নি উর্মিলাকে। শুভপুর জানে উর্মিলা তাদের কন্যা। উর্মিলা জানে, বালিকা হতে হতে অজানা পৃথিবী স্বপ্নময় অর্গলে দাঁড়িয়ে আছে। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় দাহ্য হৃদয়পুর। না! কোনো দহন তাকে পরাস্ত করেনি। বয়সের প্রাকৃতিক গ্রাম তাকে ছুঁয়ে দেখে। নইলে কাঙাল তরুণের জন্য ঘর ছেড়ে গেলে কিবা বলার ছিল। তাই শুভপুরের আশ্চর্য কন্যা উর্মিলা পাল একবার নক্ষত্রের পানে, একবার বেদনার পানে অনুভূতির আলোকে আবিষ্কার করে।

বেবী আপা ঢাকা থেকে এসেছে।  মানবাধিকার কর্মী। দেশে দেশে যুদ্ধের কারণে যে মানবিক বিপর্যয়, তা সিংহভাগ শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করে। পঞ্চাশ উত্তর মহিলা। আশ্চর্য মমতায়, সুললিত ভাষায় নারীত্বের ভেলা নিয়ে নিজের বাড়ির ফারাকটুকু বর্ণনা করছিল। এ অজপাড়া গাঁয়ে বেবী আপাকে কেউ আবিষ্কার করতে পারিনি। শুধু সতেরোর উর্মিলার মনে হয়েছিল বেবী আপা তো সাধারণ নয়, চারদিকে ভূলুণ্ঠিত সত্তা কেবলি জানান দিতে থাকে, উর্মিলা পাল। শুভপুরে কোনো আদমসুরত নেই। নিস্তরঙ্গ, সহজ, বঙ্গীয় গ্রাম। এখানে ঘুণপোকা বাসা বাঁধতে পারে না। গ্রামের সীমানা ঘিরে যে দেয়াল তার পরতে পরতে সবুজ, পাখির কলরব, কৃষকবধূর সরল স্বীকারোক্তি। আর নবান্নের উৎসব।
শুভপুরের বাইরের পৃথিবী অন্ধকার, ধোঁয়াশা। উর্মিলা রূপান্তরিত জীবন পাঠের খেরোখাতায় লিখে ফেলে, দ্রোহ। বেবী আপা প্রথমেই বলে, ‘এই মেয়ে, শরীরের কাল ক্ষীণ, মেধা অনন্তের পালকি। তুমি কোনটা গ্রহণ করবে?’
উর্মিলা বেবী আপাকে বুঝতে পারেনি। অসহায় উর্মিলাকে কিছুই বলতে হয়নি। স্কুল গভর্নিংবডি চেয়ারম্যান মকবুল কাকু বলেছিল, ‘বেবী মাগো,  তুমি ঠিক ধরেছ, তোমার যোগ্য একমাত্র উর্মিলা।’
তিন দিন পর বেবী আপা ঢাকায় ফিরে যায়। উর্মিলার জন্য রেখে যায় বর্ণিল রঙধনুর সহস্র আশা এবং আলোকিত পথ। নিস্তব্ধ ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে উর্মিলা আর নারী থাকে না, নিজেকে অতৃপ্ত অসহায় ভাবতে চায় না। বুকের ভেতর বসতি গড়ে তোলে বেবী আপার স্বপ্নজাল।
সাত দিন পর ডাকে একটি পত্র পায় উর্মিলা। বেবী আপা লিখেছে, ‘স্কুল পাস না করলে মেয়েদের খুব সাধারণ জ্ঞান থাকে। তোমার এখন ওই পিরিয়ড চলছে। তুমি যেখানে জন্ম নিয়েছ ওইটা একটি সহজ, সরল গ্রাম। ভূস্বামী, মহাজন, রাজনৈতিক লুম্ফেন চরিত্রগুলো বিরাজমান। সব ঘরে সুখ আছে তাও বলা যাবে না। নানাবিধ পীড়নের মাঝে তুমি নামক নারী নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে পেরেছ তাতেই আমরা আগামীর নতুন বীজ উদ্গমের স্বপ্ন দেখতেই পারি। তুমি সত্যিই শুধু শুভপুরের নও। বাড়ির সীমানা থেকে বেরিয়ে দেখ, বিস্তৃত মাঠ, ধানি জমি। জমির পর তোমার অতি পরিচিত নদী। যে নদীতে অবগাহনের স্মৃতি তুমি আজন্ম লালন করবে। তারপর থেকে যে গ্রামগুলো তা ক্রমাগত অচেনা মনে হবে। সীমাবদ্ধ জীবনের এই দোষ। চিন্তা এবং যাপিত জীবন ছোট করে দেয়। আমি তোমাকে তা ভাবিনি। ভেবেছি, স্বপ্নতাড়িত। যদি বেঁচে থাকি তোমার সংবাদ রাখব। বিপন্ন পৃথিবীর পাশে দাঁড়ালে লাভ আছে, ক্ষতি নেই। তার সন্তান হিসেবে একদিন নিজকে ঋণী মনে হবে। স্কুল পাস করে নগরে চলে আসতে পারো। আমাদের সংস্থা তোমার অপেক্ষা করছে। প্রতিটি সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সময় গ্রাম থেকে নগর দখল করার জন্য মানুষ ছুটে আসত। এখন নগর থেকে গ্রামে যেতে হয়। আগামী নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়।’
উর্মিলা ভাবে, এ এক বছর কি নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছে? অথবা বেবী আপার কিছুই বুঝতে পারেনি। কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে একজন বালিকা উড়নি উড়িয়ে দৌঁড়ে যায়। ব্যস, ওইটুকুই। শুধু অন্তরে গভীর গোপনে তিমির হননের গান শুনতে শুনতে এক সময় আবিষ্কার করে ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’
একদিন মধ্যরাতে বাবাকে বলে, ‘পরীক্ষা শেষ, আমি নগরে যাব।’
বাবা খুব অবাক হয়। অপলক উর্মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথমে উর্মিলার কথা বুঝতে পারে না বাবা।
বলে, ‘কেনরে মা?’
‘আমি বেবী আপার কাছে যাব।’
‘কেন?’
‘ভাত এবং মানুষের পক্ষে দাঁড়াব? তুমি আমাকে সাহায্য করো বাবা।’
পরেশ পাল বুঝতে পারে না। বিস্ময় নিয়ে ভাবে আমার উর্মিলা তো অন্যরকম। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে এ সত্যটুকু বহু আগেই আবিষ্কার করে রেখেছি।
তারপর উর্মিলা বাসে চড়ে, উড়নি উড়িয়ে নগরে চলে যায়।


গল্প : শুভ জন্মদিন

গল্প : শুভ জন্মদিন




শুভ জন্মদিন
আরিফুর রহমান

ক. মেঘ স্বভাবের মেয়ে

    ও বলল, কি সব কথা বল না ! আজাইড়া।
আমি শুদ্ধ করে দিলাম, উঁহু, অযথা।
ওঃ সরি।
আমিঃ সরি বলে কোন লাভ নেই। আপনি কোনওদিন ঠিক হবেন না।
ওঃ হবো, ঠিক হবো।
আমিঃ ওপারে গিয়ে।
ও সাথে সাথে বিষম খেল। চোখ-মুখ লাল করে হাঁস-ফাঁস করতে লাগল। আমি জিভ কাটলাম। ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। করুণ স্বরে বললাম, পানি খাবেন স্যার, পানি? জরীকে পানি দিতে বলি?
    আমি জানি মা আশে পাশেই আছে। হয়ত দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার দিকে লক্ষ রাখছে। কারণ কিছুদিন থেকেই মা আমাকে চোখে চোখে রাখছে। এই যে স্যার বিষম খেল আর আমি পানির কথা বললাম, জরীকে দিয়ে মা-ই এক্ষুণি পানি পাঠাবে। আমাকে উঠে গিয়ে বলে আসতে হবে না।
    জরী চলে এসেছে। ওর হাতে পিরিচের উপর এক গ্লাস শরবত। টেবিলে রাখতে রাখতে সে বলল, নেন ছার নেবুর শরবত খান। গরমের দিনে নেবুর শরবত খুউব ভালা ছার।
    আমি বললাম, জরী তুই যা।
জরীঃ আমি তো এহানে থাকতে আসি নাই আপা। গেলাস খালি হইলেই নিয়া চলে যাব।
স্যারঃ জরী তুমি একটু বেশি কথা বলো। অবশ্য যারা বেশি কথা বলে তাদের মন সহজ-সরল হয়।
জরীঃ জ্বী, ছার। আসি। দোয়া রাইখেন।
আশ্চর্য! প্রশংসা শুনে জরীরাও কেমন গলে যায়! অবশ্য স্যার তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে নরম সুরে কথা বলে। আমি ওই কথাগুলোই জরীকে বললে সে এতক্ষণে আরেক প্রস্থ বক্তৃতা চালিয়ে দিত।
আর কয়েক ঘন্টা পরই আমার জন্মদিনটা শুরু হবে। বারটা এক মিনিটে একসাথে আমার জন্য অনেক চমক চলে আসবে। সব সময় বড় চমক আসে বাবার কাছ থেকে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে বাবাকে ছাড়িযে যাচ্ছে স্যারের কর্মকান্ড। এবার আমার জন্মদিনের কথা ওর মনে আছে কিনা তাই তো বুঝতে পারছি না। আচ্ছা স্যার সম্পর্কে কি কেউ ও, ওর এগুলো বলে? আমি বলি। মনে মনেই তো বলি। সরাসরি বলতে পারি না। আগে মনের কথা না বলে কিভাবে ওকে ও বা তুমি বলি?
ওঃ কি ভাবছো এতো? আর পড়তে হবে না আজ। এই টেবুলার এনালাইসিস তিনটি করে রাখবে, ঠিকাছে?
আমিঃ জ্বী।
এই হলো আমার সহজ-সরল, সোজা-সাপটা স্যার। অথবা মনে মনে আমার মনের মানুষ। একটা ফোঁটা আবেগের চিহ্ন কোথাও নেই।

গত জন্মদিনে বাবা দিয়েছে স্মার্টফোন। ফোন একটা প্রত্যাশিত ছিল কারণ আমার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ পর্যন্ত মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল পরিবার ও কলেজ উভয় পক্ষ থেকেই। অনার্সে ভর্তির পরের জন্মদিনে মোবাইল তাই প্রত্যাশিতই ছিল। তবে স্মার্টফোন পেয়ে খুশি হয়ে ছিলাম।
আগের দুই জন্মদিনের মতো গত জন্মদিনেও আমাকে অবাক করে দিয়েছিল ওর গিফ্ট। আব্বু, আম্মু, ছোট কাকা, জরীরও পরে ও এসেছে। আমার অপেক্ষা দীর্ঘ করাই যেন ওর একমাত্র কাজ। উইশ্ করার পর আমার দিকে বাড়িয়ে দিল র‌্যাপিং করা দুটো জিনিস। ভাবলাম বই আর লম্বা কলমটা হবে। অংকে ভুলের জন্য মারার সুবিধার্থে লম্বা কলম! যখনই আমি হাতে নিয়েছি হঠাৎ ও বইয়ের উপর থেকে লম্বা জিনিসটা নিয়ে সোজা লম্বালম্বি মেঝেতে ফেলল। সাথে সাথে সেটা একটা ফুল হয়ে গেল। আমি অবাক মুগ্ধ চোখে তাকালাম ওর দিকে। সবাই হাততালি দিচ্ছিল। ও নির্বিকার ফুলটা তুলে আমার হাতে দিয়ে চলে গিয়েছিল। যেন কিছুই হয়নি।
মাঃ তোর মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন?
আমিঃ কেমন?
মাঃ তোকে অনেক অস্থির লাগছে। কি হয়েছে আমাকে বল শুনি।
আমিঃ অতি সুখে অস্থির লাগছে। সরে দাঁড়াও, সুখ কমিয়ে আসি।
মাঃ কথা ঘোরাস না। কি হয়েছে বল। সবুজ কিছু বলেছে?
আমিঃ শুধু শুধু সন্দেহ করো না। তুমি তো জানোই স্যার কিছু বলেনি। সময় সুযোগ পেলে আমিই ওকে বলব।
মাঃ কি বলবি!
আমিঃ সেটাও তুমি জানো মা। তুমি সবই বুঝতে পারো। আমি জানি...
বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। এখন আমি ঝরনা ছেড়ে গোসল করতে করতে কাঁদবো। অকারণ অভিমানের কান্না। ঝরনার জলে ধুয়ে নেব আমার সব অভিমান। তারপর ওর ঘরে গিয়ে বলে আসবো আমার যত কথা। ওর ঘরটা খুব বেশি দূরে নয়।

খ. মেঘের আশ্রয়
    আমাদের মেয়েটা আজকের এই দিনেই জন্মেছে। আজ ওর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। দেখতে দেখতে সতের বছর পূর্ণ হয়ে গেল ওর। অথচ দৃষ্টি স্থির করে স্মৃতির পাতা উল্টালে সব দেখতে পাই। খুব একটা মলিন হয়নি। সেদিনও এমনই ছিল আকাশ ভরা মেঘ। জলজ দমকা হাওয়া আমার টেনশন উড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছিল বারবার। এই তো সেদিনের কথা।
আমার প্রিয়তমা বধূটি প্রিয়তর হয়ে উঠা সন্তানকে ঠিকঠাক পৃথিবীর আলোয় নিয়ে আসতে প্রাণপণ লড়াই করছে। সকাল থেকে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। সূর্যের দেখা নেই ঠিক, কিন্তু সময় তো বসে নেই। ঘড়ির কাঁটা তিনটার দাগ ছুঁই ছুঁই।
বাবাঃ এই, ফজলুকে দুই ঘন্টা আগে পাঠিয়েছি নৌকা আনতে। এখনো কোন খবর নেই। ব্যাটা আসলেই একটা কচ্ছপ।
বাবা হঠাৎ গম গম করে উঠলেন। বারান্দায় হাতলঅলা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। বেশ বড়সড় মানুষ। একটু জোরে কথা বললেই গম গম আওয়াজ উঠে যায়। আমি টেনশনে পায়চারি করছিলাম। বাবার কথা শুনে আমার পা দুটো থেমে গেছে। তাই তো, প্রায় দু’ঘন্টা হতে চলল, ফজলুর দেখা নেই। সাবিরাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। এভাবে আর কতক্ষণ কষ্ট করবে সে।
আমাদের বাড়ি থেকে পাকা সড়ক দেড় কিলোমিটার দূরে। গত কদিনের টানা বর্ষণে কাঁচা রাস্তাটুকুর অবস্থা বেগতিক। রিকশা-ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই বাবা ফজলুকে পাঠিয়েছেন ছলু মাঝির নৌকা নিয়ে আসতে। কিন্তু ফজলুটার আসলেই কচ্ছপ গতি।
ঘর ভরা মেয়ে মানুষ। এ বাড়ির ও বাড়ির। আকাশ ভরা মেঘ। জড়াজড়ি করে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা দূরীভূত করে ফজলু মিয়া ছলু মাঝিকে নিয়ে হাজির হলো। বাবা ফজলুর দিকে চোখ মটকে তাকালেন শুধু। আমাকে তাড়া দিলেন।
বাবাঃ যা তো, যা। বউমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। নৌকা ছাড়তে হবে। বৃষ্টি নেমে যাবে যেকোন সময়। যা, তাড়াতাড়ি যা।
আমিঃ জ্বী, আব্বা। আপনি ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে নৌকায় যান।
বাবাঃ ঠিকাছে। ছলু, নৌকার ছই ঠিকঠাক আছে তো?
আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। ভিড় ঠেলে সাবিরার কাছে গিয়ে দেখলাম অবস্থা সুবিধাজনক না।
তারপর আমাদের পাড়ার একমাত্র দাইকে নিয়ে নৌকা ছাড়া হলো। নৌকায় উঠার সাথে সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। নৌকা যত চলল বৃষ্টির বেগ তত বাড়তে লাগল। একই সাথে বেড়ে চলল সাবিরার ব্যথা।
নৌকার ছই-এর মুখ দুপাশে মোটা পর্দায় ঢাকা। একসময় দাই আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল।
দাইঃ নাও ঘাটে কোন বাড়ির কাছে নিবার কও। বাচ্চা এহনই হয়া যাবো।
আমিঃ আশে পাশে কোন বাড়ি নাই দাদি। এইটা শিমুলতলীর পাথার।
দাইঃ তাইলে নাও থামাইতে কও আর দোয়া পরতে কও সবাইরে। তুমি আমার কাছেই থাহ। তোমার বউরে ধরন লাগব।
সে এক কঠিন সময় গিয়েছে। নৌকা থামিয়ে বাবা আর ছলু মাঝি দুই গলুইয়ে বসে দোয়া পড়ছে। আমি চেষ্টা করছি দাই দাদির কাজে সাহায্য করতে।
সেই মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে, সেই ভরা নদীটার মাঝখানে, নৌকার ছইয়ের মধ্যে ভরা বর্ষণের সময় জন্ম নিল আমার মেয়ে। একটা ‘ওঁয়াও’ চিৎকার যেন সেদিন পৃথিবীর সব রঙিন সুখ আমার ভেতর, সাবিরার ভেতর ঢেলে দিয়েছিল।
তাই মেয়ের নাম দিয়েছি তটিনী বিনতে বর্ষণ। প্রবল বর্ষায় নদীর মধ্যে জন্ম যার, এর চেয়ে ভালো আর কি নাম হতে পারে তার!
আমার বর্ষণ নামটাও হয়েছে প্রবল বৃষ্টির দিনে জন্মেছি বলে। বাবা বলতেন।
বাবা-মেয়ের জন্মের সময়টার কত মিল। অথচ সেই মেয়ে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত একাই নিতে এতটুকুও অপেক্ষা করেনি। আসলেই সত্যÑসময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নাম যে তার তটিনী। স্বভাবও হয়েছে ঠিক তেমনি।

পরিশিষ্ট

গতরাতে কান্না-গোসল শেষে তটিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাড়ি থেকে একেবারে বের হয়ে যাবে।
...তারপর মাত্র একঘন্টার আয়োজনে রাত সাড়ে এগারটায় বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। জন্ম তারিখে বিয়ে শুভ নয় বলে। সবুজের বন্ধুরা গোপনে খেটেছে প্রচুর।
বর্ষণ চৌধুরী তটিনীর পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল বারান্দায়। সারারাত। তটিনীর ছোট কাকা লোকজন নিয়ে ওদের খুঁজতে বের হয়ে গেছে। ফেরেনি।
শেষ পর্যন্ত সবুজের বন্ধুরা ওদের জন্য বাসর সাজিয়েছে নৌকায়।
বড় একটা নৌকার গলুইয়ে যখন সবুজ আর তটিনী পা রেখেছে তখন রাত ঠিক বারটা। আকাশ ভরা মেঘ। ওরা ছইয়ের ভারী পর্দা সরিয়ে যখনই ভেতরে প্রবেশ করেছে সাথে সাথে জ্বলে উঠেছে আলো। বাইরে তুমুল বৃষ্টি।
সবুজের বন্ধুরা দুটো বার ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে ছইয়ের ভেতরে হালকা আলোকসজ্জা করেছে। হয়েছে পুষ্পশয্যাও। শয্যার পাশে লেখা হয়েছে ‘শুভ জন্মদিন’ তার নিচে ‘বাসর নৌকা’। অথচ সেখানে লেখা থাকার কথা ‘শুভ বিবাহ’ আর নিচে ‘বাসর ঘর’।
বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ভেতরে বাসর শয্যায় বসে ওরা দুজন। সবুজের দুজন বন্ধু ইঞ্জিন চালিত নৌকাটা চালাচ্ছে ছোট্ট নদীটা পেরিয়ে যমুনার দিকে। প্রেম যমুনা।
তটিনী ভাবছে জন্মদিনে এর চেয়ে বড় উপহার আর কোন দিন সে পাবে না। আজ পৃথিবী বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও মন্দ হবে না। যেমন একটুও খারাপ লাগছে না নৌকার ইঞ্জিনটার ফট ফট ভট ভট শব্দ। যা সব সময় তটিনীর কাছে বিরক্তিকর।
সে সবুজের কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু বলল, আজ এই বৃষ্টিভরা জন্মদিনের বাসরে কোন কিছুই মন্দ নয়।
কথাটা শুনামাত্র সবুজ নিজের মুখটা নামিয়ে নিয়ে গেল তটিনীর মুখের কাছে।  

প্রিয় প্রমিকার মতো অন্তর জুড়ে থাকে ফুল

প্রিয় প্রমিকার মতো অন্তর জুড়ে থাকে ফুল


প্রিয় প্রমিকার মতো অন্তর জুড়ে থাকে ফুল
মাজহারুল ইসলাম লালন

ফুল কার না ভালো লাগে। ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা প্রকৃতিগত। শত সহস্র বছর ধরে ফুলের সাথে মানুষের আজন্মের টান। ফুল যেন গত জন্মের প্রিয় প্রেমিকা  । প্রেমিকার মতো মানুষের অন্তর জুড়ে বিরাজ করে।
সৃষ্টিগতভাবেই মানুষ সুন্দরের পূজারী। ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক।
মানুষ ফুল কেন ভালোবাসে কিংবা ফুল কেনো মানুষকে কাছে টানে এরকম কোনো প্রশ্ন করলে বরাবরই চিহ্নহীন বিলুপ্তি ঘটবে প্রশ্নের! ফুলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কিংবা যে টান এটা বরাবরই অসংজ্ঞায়িত, ব্যাখ্যাহীন।

মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী আর ফুল প্রকৃতির সবচেয়ে পবিত্র ও সুন্দরতম সৃষ্টি।
কথায় আছে, যে ফুল পছন্দ করে না সে নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করতে পারে।
ফুল বলতেই এক অপার মুগ্ধতা যা মানুষের মনকে ক্ষণিকেই শীতল করে তোলে। ফুল ভালো লাগা ও ভালোবাসার প্রতীক। ফুল মানুষের মনকে আনন্দিত করে তোলে। কাননের মায়া ত্যাগ করে ফুলেরা নিজের স্থান করে নেয় প্রেয়সীর খোঁপায়, গৃহসজ্জায়ও ফুলের কোনো জুড়ি নেই। ফুল সর্বদা পবিত্রতার বহিঃপ্রকাশ করে, পবিত্রতা সকলকেই আকৃষ্ট করে। প্রকৃতি ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর প্রকৃতিতে রং আর সুগন্ধের বাহক একমাত্র ফুল। ফুলের সৌন্দর্য আর সুগন্ধ মানুষকে সর্বদাই বিমোহিত করে।

নানা প্রজাতির ফুল প্রকৃতির সৌন্দর্যকে বহুগুন বৃদ্ধি করে প্রতিনিয়ন ফুটে থাকে। কোনোটা লাল, কোনোটা হলুদ, সাদা কালো আরোও অসংখ্য নাম না জানা রঙ বেরঙের ফুল প্রকৃতির নিসর্গ হয়ে ফুটে আছে বিশ্বময়। এসব রঙের উপর ভিত্তি করে মানুষ একেক ফুলকে আবার একেকটা হৃদ-বন্ধনের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।

নানা রঙের ফুলের মধ্যে কোনোটা টকটকে লাল, কোনোটা নীল। তবে সব ফুলই আকর্ষণ করে মানুষকে। এই ফুলেরও আছে নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি। লাল ফুল যেমন ভালোবাসা প্রকাশ করে, তেমনি ভাঙা সম্পর্ক জোড়া দিতে নাকি হলুদ ফুলের জুড়ি নেই। নানা রঙের ফুলের সঙ্গে থাকা মানুষের অনুভূতিগুলো সু-শৃঙ্খল প্রকাশ দেখেও অভিভূত হই আমরা।

টকটকে লাল গোলাপ। প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে এই ফুল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
কমলা রঙের ফুল দিয়ে অনুভূতির সুন্দর উপস্থাপন। তারুণ্য আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ পায় কমলা রঙের ফুলে।
বুদ্ধিবৃত্তি প্রকাশ ও ভাঙা সম্পর্ক জোড়া দিতে হলুদ ফুল নাকি টনিক হিসেবে কাজ করে। অফিসে সহকর্মীকেও চমকে দিতে পারেন একগুচ্ছ হলুদ জারবেরা দিয়ে। জীবনে সজীবতা ও ছন্দ ফিরিয়ে আনতে সবুজ ফুল, প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য আকাশি রঙের ফুল হতে পারে সমাধান।

এরকম অসংখ্য সম্পর্কের মেলবন্ধন স্থাপনে বহুকাল ধরে চলে আসছে ফুলের ব্যবহার। প্রিয় মানুষের হাতে একগুচ্ছ প্রিয় ফুল তোলে দিয়ে জন্মের সার্থকতা খোঁজে পান অনেকেই। এমনি করে মানুষের আত্মার সাথে ফুলের এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দিনে দিনে বাড়ছে এর নানাবিধ ব্যবহার।
‘ফুলের আকুল করা গন্ধে,
মন ভরে যায় ছন্দে!’

এমনি করে ফুলে জীবনে ছন্দ ফিরিয়ে আনে। ফুলের যেমস নৈসর্গিক আবেদন রয়েছে, বর্তমানে ফুল মানুষের জীবিকার অবলম্বনও হয়ে উঠছে।
সারা বিশ্বে বহুবিধ ফুল চাষ অনেক আগে থেকেই প্রচলিত হয়ে আসলেও আমাদের দেশে বর্তমানে ফুলচাষ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চলেছে। আমাদের দেশের মানুষের মনের খোরাক মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে বাংলাদেশে চাষকৃত ফুল।
ফলে অনেকেই ফুল চাষ ও ফুল ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে।

সৃষ্টিশীল সৌখিন মানুষদের পছন্দের শীর্ষে অবস্থান করছে ফুল। কতো কবি, লেখক, জ্ঞানী গুনী ফুলকে ঘিরে লিখেছেন সহস্র কাব্য। নিজস্ব ভাবধারায় ফুটিয়ে তোলেছেন ফুলের সৌন্দর্য।
অসংজ্ঞায়িত ব্যাখ্যাতীত কারনেই ফুল মানুষের হৃদয়ে এক সুখকর অনুভূতি জাগ্রত করে।
প্রেয়সীর সৌন্দর্য বর্ণনায় ফুলের উপমা না হলে যেনো অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায় প্রিয় মানুষটি।
ফুল সুন্দর, মানুষ সুন্দরের পূজারী।
ফুল পবিত্র, মানুষের স্বত্বাও পবিত্র।

সৃষ্টিগত ভাবেই ফুলের সাথে মানুষে হৃদয়ের অমোঘ বন্ধন। তাই ফুলের যাদুকরী বৈশিষ্ট মানুষকে সহসাই কাছে টানে।
মানুষ ফুল ভালোবেসে সুন্দর হয়ে উঠতে পারে ফুলের মতোই!



প্রেমিকা সমাচার

প্রেমিকা সমাচার


প্রেমিকা সমাচার
জাহিদ আল হাসান

প্রেমিকা নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমে যে জিনিস সম্পর্কে জানতে হবে সেটি হচ্ছে প্রেম । বিশ্ব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই দেশীয় ও ধর্মীয় বিভিন্ন প্রকার মিথ- এ প্রেমের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ অনুভূতির উপস্থিতি পাওয়া যায় ।  যুগে যুগে অনেক কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবীগণ প্রেমের নানাবিধ সংজ্ঞায়ন করেছেন। ইংরেজি ৎড়সধহপব শব্দের বাংলা অর্থ হিসেবে প্রেম ও ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত একটি উত্তেজনাপূর্ণ ও রহস্যময় অনুভূতিকে বোঝায় । প্রেম মূলত মানবিক শক্তি, ঈশ্বর একাধিক মানুষ ও বিভিন্ন বিষয়ের উপর হতে পারে । তবে তথাকথিত নারী ও পুরুষের প্রেমই আমাদের আলোচ্য বিষয়। এক প্রকার অদ্ভূত মানসিক আকর্ষণ যা বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি আনার আকাক্সক্ষা তৈরি করে তাই প্রেম । এই মানসিক আকর্ষণের ভেতর আবেগ, অনুভূতি, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয় জড়িত । নদীর মোহনার মতো নিবিড় মানসিক আকর্ষণের আরেকটি সংযোগ রেখা হচ্ছে কাম । শারীরিক আকর্ষণের সাথে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দুটোই প্রেম মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তবে প্রেম দীর্ঘদিন বেচেঁ থাকা বৃক্ষের মতো; মনের ভেতরে ছায়া দিয়ে যায় অনন্তকাল ধরে। কাম মরে যায়-লজ্জাবতী গাছের মতো আলতো ছোঁয়াতেই।
প্রেমিকা বলতে নারী চরিত্রকে বোঝায়৷ স্বভাবজাত একজন পুরুষের বিপরীত লিঙ্গের যেসব মানুষের প্রতি মানসিক ও উহ্য যৌন আকর্ষণ থাকে তারাই প্রেমিকা৷ এই প্রেমিকা মানুষের জীবনে সময় ও কালের আবর্তে ঘুরতে থাকে৷

প্রেমিকা - সময়ের ট্রেনে চড়ে জীবনের পথে চলতে থাকে। কখনো স্বশরীরে, কখনো স্ব অন্তরে কিংবা কখনো পুরোপুরি শিল্পীর আঁকা কাল্পনিক চিত্রকর্মের মতো; জীবনের শৈশব পেড়িয়ে কৈশোরে এসে আমার কাছে প্রেমিকা ছিল এমন । রাতের বেলায় চোখ বুজে থাকা নারীর মুখ । স্বপ্নে আঁকা ষোড়শী শরীর আর ঝাঁঝালো হৃদয়ের নারী। সেই প্রেমিকা আমার নিজের লেখা কবিতার বই। আমি যাকে রোজ রাতে পাঠ করতাম । আমার হৃদয়ে তুফান আনা সুর। যাকে গুণগুণ করে আমি গাইতাম।
তবে মানুষ প্রতিনিয়ত বদলায়। নিজেকে ভাঙে, তৈরি করে। সামাজিকতা পরিবর্তন হয়। জীবনের বেপরোয়া গাড়িকে কল্পনার জগত থেকে টেনে এনে বাস্তবে এসে নিয়ম অনুযায়ী চলতে হয়। সে সময়ের প্রেমিকা আমার বাস্তব সঙ্গী। আমার আসল প্রেম । যিনি দৃশ্যমান, যিনি স্পষ্ট । মনের মৃত্তিকায় প্রেমিকা হিসেবে রোপণ করার পর যাকে নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়, সেই প্রেমিকাই গাছ হয়ে নিঃস্বার্থভাবে ছায়ায় আটকে রাখবে প্রেমিক কে। প্রেমিকা যদি অতিরিক্ত নেশা হয়ে যায় তবে প্রেমের মাঝের অধিকাংশ সময়ই এক অন্য জগতের ভেতর থাকতে হয় ; যা জীবনের জন্য কোনো ধ্বংসের কারণ ও হতে পারে । তবে অবশ্যই প্রেমিকাকে নেশার মতোই গ্রহণ করতে হয়, শুধু ঘোরের সময়ে সচেতন থাকতে হয় জীবন নিয়ে। কেননা প্রেমিকা জীবনেরই অংশ, জীবন প্রেমিকার অংশ নয় । যে প্রেম নিজের স্বকীয়তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে প্রেম সার্বজনীন। প্রেমিকার হাসি যার কাছে হিমেল বাতাসের মতো শীতল লাগে তিনিই একজন প্রকৃত প্রেমিক। প্রেমিকার মন বোঝা জগতের সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য হলেও বুঝতে পারার যে পথ সে পথে হাঁটতে পারাটাই সফলতা । আর প্রেম ও প্রেমিকা জীবনকে খুব কঠিনভাবে ধরে রাখে স্মৃতি কিংবা বিস্মৃতির পাতায়। এই শ্বাশ্বত প্রেম ও প্রেমিকা যদি প্রেমিক কে একেবারেই বুঝতে না পারে তবে তা এরুপেই থাকে । কখনো একটা প্রশান্তির দোল দিতে পারে না প্রেমিকের মনে। প্রেম প্রাকৃতিক, প্রেম ঐশ্বরিক। এই প্রেমের ভেতরেই সুখের আলো জ্বেলে দুঃখের আঁধার আনে প্রেমিকা। কেননা প্রেম, প্রেমিকা, সুখ ও দুঃখ একই নদীতে চলে। একই নদীতে সঙ্গম করে স্রোতের মোহনায় ।