ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৭৩

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৭৩

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর : ধানশালিক : সংখ্যা ১৭৩

শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১


















মানবতা, ধর্ম, রাজনীতি ও বিপ্লবের এক সুসম মিশ্রণ

মানবতা, ধর্ম, রাজনীতি ও বিপ্লবের এক সুসম মিশ্রণ


 


মানবতা, ধর্ম, রাজনীতি ও বিপ্লবের এক সুসম মিশ্রণ

কাজী নজরুল ইসলাম


আকিব শিকদার


কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্পর্শকাতর মনের মানুষ ছিলেন। তাই মানুষের দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে নির্বিকার

থাকতে পারতেন না। বৈষম্য মানতে পারতেন না। কোনো মানুষের ওপরই অত্যাচার, অবিচার, অসম্মান করা হলে সেটা মানতে পারতেন না। এসব ব্যাপারে নির্বিকার এবং উদাসীন থেকে শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি করার কথা ভাবতে পারতেন না। সে জন্য তাঁর সাহিত্য সাধনা তার কাছে কোনো বিলাসিতার বিষয় ছিল না। শিল্পের জন্য শিল্প সৃষ্টি করার বিলাসিতা তার ছিল না। সাম্য ও সহাবস্থানকামী মানুষ হিসেবে অত্যন্ত সংবেদনশীল মন এবং গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টি করার জন্য অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের সংস্থান সৃষ্টি করা হোক, এটাই তিনি চাইতেন। কাজী নজরুল ছিলেন একজন খাঁটি রোমান্টিক কবি। রোমান্টিক যুগ বাংলা সাহিত্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আর তা আসে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের হাত ধরে। রোমান্টিসিজম পরিবর্তন নিয়ে আসে মানসিকতায়, মননে, চিন্তায় ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধে। ব্যক্তি যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন।

পুরাতন ও ক্লিশে ধারণার বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে রোমান্টিকতা ব্যক্তি মননে দেয় স্বাধীনতা, নতুনত্বের

আভাস। আবার অন্যদিকে সমতা, স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাও রোমান্টিকদের মাঝে এক

অপূর্ব প্রচেষ্টা হয়ে থাকে। এই দিক বিবেচনায় নজরুল আর বাকি সব রোমান্টিকদের চেয়ে অনেক বেশি

অগ্রগামী, তার প্রদীপ্ত কবিতা, জ্বালাময়ী গান মানুষে মানুষে সমতার বারতা রেখে গেছে । আমরা এর

প্রমাণ নজরুলের ‘বিষের বাঁশী’ ও ‘কামাল পাশা’তে দেখতে পারি। আর বিদ্রোহী’ কবিতাটি বিশ্ব

মানবতার মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার। কবিযে একই সাথে বিদ্রোহী আর প্রেমিক হৃদয়-পুরুষ তা বিদ্রোহী কবিতাতেই বলে যান। কারণ তার এক হাতে প্রেমের বাঁশরী আর এক হাতে থাকে রণ-তূর্য।

এভাবেই নজরুল তার অসামান্য রোমান্টিক প্রতিভা দিয়ে বিদ্রোহের দীপ্ত শিখা জ্বালিয়ে চলেন কখনো

কোমলভাবে আবার কখনো স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়ে।

রাষ্ট্র বা সমাজ প্রভৃতির আমূল ও অতি দ্রুত পরিবর্তন করার কাজটা বিপ্লবী কাজ। নজরুল সমাজহীন

মুসলমান সমাজকে একটি সুসংঘবদ্ধ সমাজ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। নজরুল বলেন, ‘আমাদের

বাঙালি মুসলমানের সমাজ, নামাজ পড়ার সমাজ। যত রকম পাপ আছে করে যাও, তার জবাবদিহি করতে হয় না এ সমাজে, কিন্তু নামাজ না পড়লে তার কৈফিয়ত তলব হয়। অথচ কোরানে ৯৯৯ জায়গায় জেহাদের কথা এবং ৩৩ জায়গায় সালাতের কথা বলা হয়েছে।’ মুসলমানদের সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা চেয়েছিলেন। মুসলিম নারী স্বাধীন, শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাবেন, মুসলমানরা ইসলামের গৌরবোজ্জল ইতিহাস থেকে প্রেরণা পাবেন এবং শিক্ষা নেবেন এটা তিনি চেয়েছিলেন।

এসবই বিপ্লবী মানসিকতার মানুষের চাওয়া।


নজরুল সাহিত্য-সঙ্গীতের মাধ্যমে বাংলার মানুষরা ইসলামের এত ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছে। তাই নজরুল শুধু কবি, সাহিত্যিক সঙ্গীত ও প্রাবন্ধিকই নন, তিনি একজন ওলামাও। সঠিক পথে ইসলামকে মানুষের মনকে উদ্বেলিত করা, সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা, মানবতার অবদান-মানবতা শব্দটিতো ইসলামই জগতে এনেছে। নিপীড়িত, নিষ্পেষিতের দমন তো ইসলামই শিখিয়েছে।

নজরুল কোরান পড়েছেন। আত্মস্ত করেছেন এবং বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছেন,

শিখিয়েছেন। কুরআন মুখস্থ করা মুসলমান আছে চারিদিকে, কিন্তু তাদের অনেকেরই বাংলা অর্থ জানা

নেই এবং এই জানা না থাকায় ‘বিভ্রান্তি’ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বদিকে। নজরুল সাহিত্য-সঙ্গীতে প্রবেশ

করলে ইসলাম ধর্মকে অতি নিকটে পাওয়া যাবে। ইসলাম ধর্মকে জানা যাবে। নবী (সা.) জীবন জানা যাবে নজরুলের গানে হামদ-নাত-এ। ঐতিহাসিক সবকিছু। কুরআন-হাদীস সম্পর্কে সত্য-উপলব্ধি এবং আত্মস্থ করে এ অঞ্চলের মুসলমানদের অন্ধত্ব করতে যে পরিশ্রম করেছেন তার তুলনা কোথায়?

মানুষে মানুষে ভাই ভাই, এতো ইসলামেরই শিক্ষা। নজরুলের মাধ্যমে এসব উঠে এসেছে। নজরুল উদ্বুদ্ধ করেছেন এ অঞ্চলের মানুষদেরকে খাঁটি পথের সন্ধানে।

নজরুল বলেন, ‘মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু আমি দুঃখ

করিনি বা নিরাশ হইনি। তার কারণ, বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা

ঈর্ষাপরায়ণ।’

নজরুল কারো সমালোচনা থেকে শুরু করে গালি-গালাজকে সামান্যতম ভয় পেতেন না। সাহসের সাথে

মোকাবিলা করতেন। জবাব দিতেন হিম্মতের সাথে, সেখানেও সাহিত্য ফুটে উঠতো।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজনীতি সচেতন কবি ছিলেন। তাঁর বিপ্লবী কাজের অনেক কিছুই পলেটিক্স

করার লক্ষ্যে করেননি। আবার পলেটিক্স করাটাও আদৌ তার লক্ষ্যও ছিল না। গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা সম্পন্ন অত্যন্ত সংবেদনশীল মনের মানুষ ছিলেন তিনি। মানুষের অধিকার বঞ্চিত হয়ে থাকাটা, অবদমিত হয়ে থাকাটা এবং নির্যাতিত, অধ:পতিত এবং অসম্মানিত হয়ে থাকাটা তিনি স্বাভাবিক ব্যাপার ব’লে মেনে নিতে পারতেন না। তাই এ অবস্থার অতিদ্রুত আমুল পরিবর্তন ঘটনোর বিপ্লবী কাজ তিনি করতে চেয়ে ছিলেন।

নজরুল তার কর্মেও জন্য মানুষের মননে চির অম্লান হয়ে রইবেন।




পিঁপড়ে জীবন

পিঁপড়ে জীবন

 



পিঁপড়ে জীবন

যাহিদ সুবহান


বাজার স্টেশনে আজ খুব হল্লা। এই ভরদুপুরে এমনিতেই রেলের যাত্রী আর নানা পেশার মানুষের চিৎকারে মুখোর থাকে। আজ আরো বেশি হট্টগোল। ধনুকের মতো বাঁকা প্ল্যাটফর্মটার পূর্বধারে একরকম জটলা বেধে গেছে। যারা নতুন এই স্টেশনে পা রাখবেন তারা মনে করতে পারেন হয়তো কোন ঝামেলা হয়েছে। ভয়ে তারা হয়তো এদিকে আসবেন না। দৈনিক যারা এই প্ল্যাটফর্মে আসেন তারা সহজেই ভেবে নেন এটা সাইফুল কবিরাজের ওষুধ বেঁচার মজমা হবে হয়তো। তবে আজকের ঘটনা ভীন্ন। আজকের ঘটনা রিক্সাচালক আলমকে নিয়ে।

ঘটনা দেখতে উৎসুক অন্যান্য মানুষের মতো আফজাল নেংড়া তার অবশ আর লুলা পা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে শুধুমাত্র কোমরের উপর ভর করে ভীড়ের দিকে এগিয়ে যায়। তবে মূল ঘটনা কী সে তা আবিষ্কার করতে পারে না। একজনকে জিজ্ঞেস করেÑ

-কী অইছে বাই, এইহানে?

-বুজা যাইতাছে না। তয় আলমরে নিয়া কী জানি ক্যাঁচাল বাইনছে!

-আলমরে নিয়া ক্যাঁচাল? ওই হালায় কী করছে? সাগরীরে কি বিয়া কইরা ফালাইছে? আমি জানতাম হালায় একখান জামেলা বাধাইবো! হালায় এইবার মাইনক্যা চিপায় পড়বো গো!

আফজাল নেংড়া তার কাঙ্খিত উত্তর পায় না। ভীড় ঠেলে মানুষের পায়ের ফাঁক গলে মুল ঘটনা আবিষ্কার করার চেষ্টায় ক্ষান্তি দেয়। ঘটনা উন্মোচন করতে না পারলেও সে দেখতে পায় এক মহিলা হাতে ইয়া বড় চেলা কাঠ নিয়ে অগ্নিমূর্তি হয়ে বারবার আলমের দিকে তেড়ে যাচ্ছে আর মুখে খিস্তি দিচ্চে, ‘গোলামের ঘরের গোলাম, আইজ তোরে খুন কইরা ফালাইমু!’

সাইফুল কবিরাজ আজ মজমা বসায় নি। লোকটা বিচিত্র রকমের। খুব মেধাবী। ওর প্রতিভা প্রশংসা করার মতো। প্রাথমিকের গন্ডি পেরুতে না পারলেও খুব সুন্দর করে বাংলা আর ভুলভাল ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলতে পারে। ওর সম্মোহন শক্তি খুব প্রখর। শুধু  কি বাংলা ইংরেজি; হিন্দি-আরবী মিলিয়ে এতো সুন্দর করে কথা বলে যে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা শোনে। শ্রীপুরী টেবলেট, এলার্জি চুলকানি, বাত-বাথার ওষুধ বেঁচে সে। যৌনরোগ-জটিল রোগ আদৌ সারেু কিনা জানা যায় নি। তবে সাইফুল কবিরাজের কথার যাদু থেকে কেউ বের হতে পারে না। ওষুধ প্রয়োজন নেই, অথবা ইচ্ছে করেই ওর ওষুধ কেনে না এমন লোকও ওর কথা দাঁড়িয়ে শোনে। সাইফুল কবিরাজের কথার যাদুর সাথে যোগ হয় দেখতে সুন্দর নয় অথচ অল্প বয়সী সাজগোজ করা মেয়েদের হেরে গলার বে-সুরো গান আর হিন্দিগানের সাথে অশ্লীল এবং মুদ্রাহীন নৃত্য। নি¤œ শ্রেণির মানুষের জন্য এ এক বিশেষ বিনোদন!

বাজার স্টেশনের প্লাটফর্মটা বিচিত্র জায়গা। সারাদিনে মাত্র দুটি ট্রেন এই স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। একটি আন্তনগর ট্রেন আর একটি লোকাল ট্রেন। শতবর্ষী স্টেশনটা পাশের শতবর্ষী কড়ই গাছটার মতোই প্রায় নেতিয়ে যাওয়ার জোঁ। অথচ যৌবনবতী রমণীর মতো এই স্টেশনটারও ছিল জৌলুস। কচি কলাপাতার গায়ে বৃষ্টির ছোয়া পেলে যেমন সজীব দেখায়, সদ্য ¯œান সেরে আসা ভেজা চুলে যুবতীর শরীরের মতো বাজার স্টেশনও সজীব ছিল। সে যেন এখন ভগ্নস্বাস্থ্যের বৃদ্ধা নারীর মতো। সেই সুদিন আর নেই। তবে বাজার স্টেশনের আছে শত বছরের নানা গৌরবের ইতিহাস। 

শুধু সাইফুল কবিরাজ নয় এই স্টেশনের উপর নির্ভর করে অনেক মানুষের রুটি-রুজি। সারাদিন কুলি, রিক্সাওয়ালা-চা ওয়ালা-হকার-পিঠা বিক্রেতা-ঝাল মুড়ি বিক্রেতা-বাদাম বিক্রেতা-ভিক্ষুক-উদ্বাস্তু এমনকি গোপনে ভাম্যমান বেশ্যা আর মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনায় মুখর থাকে স্টেশন এলাকা। ভোরে হাঁটার জন্য কিংবা বিকেল বা সন্ধ্যায় সুশীল সমাজ এখানে আসেন এককাপ চা খেতে। দুপুরে ক্লান্ত হয়ে প্লাটফর্মে বসে একটু শ্রান্তির আশায় আসেন বিভিন্ন বে-সরকারী কোম্পানির বিক্রয়কর্মীরা। পুলিশ আসে টহল দিতে। 

আলম স্টেশনের পাশে একটি খুপরি ঘরে থাকে। রিক্সা চালায়। রেলওয়ের সরকারি জায়গায় কয়েকটি টিন দিয়ে কোনমতে একটা খুপড়ি ঘর করেছে। বউ আর চার বয়সী ছেলেকে নিয়ে সেখানেই তার বসবাস। আলমের জীবনের গল্পটা বিচিত্র রকমের। আটাশির বন্যায় সর্বনাশা নদী যমুনা যখন ওদের সবকিছু গ্রাস করেছিল দশ বছর বয়সে বাপের হাত ধরে এই স্টেশনেই ঠাঁই নিয়েছিল ওরা। পানি নেমে গেলে বাড়ি ফেরা হয় নি। এখানেই থেকে গেছে ওরা। মা আর ছোট ভাইটাকে নিয়ে বাবার মতো রিক্সার হ্যান্ডেল ধরেছিল। যে বয়সের নরম হাত বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সেই আলম হয়েছিল রিক্সাচালক। ত্রিশ বছর ধরে এই শহরে সে রিক্স্রা চালায়। কালিবাড়ি-মালশাপাড়া-হোসেনপুর এই শহরের প্রতি ইঞ্চি রাস্তা ওর চেনা। ওকেও সবাই চেনে। এই শহরের রাস্তা আর অলিগলি আলমের ঘামের স্মারক বহন করছে। বাবা মারা গেছেন। ছোট ভাইটা বড় হয়েছে। সে একটা অটো চালায়। মা ওর সাথেই থাকে পাশের একটি খুপড়ি ঘরে। আলমের বউ রিনাও ওর মতো ভাগ্য বিড়ম্বিত। বাপটা অল্প বয়সে মারা গেলে মা ওকে কষ্ট করে মানুষ করেছে। কখনো প্লাটফর্মে পিঠা বিক্রি করে, কখনো সবজি বিক্রি করে। রিনা যথেষ্ঠ সুন্দরী নারী। নানা অভাব-অনটন আর অযতেœ ওর সৌন্দর্যে সামান্য ভাঁটা পড়ে নি। আলমের বাবা অনেক চেষ্টা করে রিনাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এনেছিল। মা যেমন মহাসংকটে পড়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন; রিনাও আলমের সংসারের হাল ধরে। শীতে প্লাটফর্মে চিতই পিঠা-ভাঁপা পিঠা বিক্রি করে। এতে সংসারে কিছু পয়সা আসে।

কয়েকদিন ধরে ছেলেটার ভীষণ জ্বর। সেই সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়ই রিনা আলমকে বলেছে যেন ইসমাইলের ওষুধের দোকান থেকে জ্বরের একটা সিরাপ নিয়ে আসে। ছেলেটা জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল করছে। ওকে একা ঘরে রেখে দোকানে যাওয়া রিনার সম্ভব নয়। এছাড়া ঘরে কোন টাকা-পয়সা নেই। ইদানিং ঘরে কোন পয়সা রাখার জোঁ নেই। আলম কেমন যেন হয়ে গেছে। ঠিকমতো কাজকর্ম করে না। সকাল দশটা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমায়। কিছু বলতে গেলে ক্ষেপে যায়। মাঝেমধ্যেই দুজনের এসব বিষয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ঘটে। অনেক রাতে বাড়ি ফেরে নেশা করে। রিনা প্রতিবাদ করলেই গায়ে হাত তোলে। আলম কী করে কোথায় যায় এসব রিনার কানে আসে। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে পারে না। আলম এখন ফেন্সিডিল খোর আর জুয়াড়ীদের সাথে খুব মিশছে। চারপাশে ধারদেনা করে ভরে ফেলেছে। রোজগারপাতির টাকা কোথায় কী করে কোন হিসেব নেই। পাওনাদাররা ইদানিং বাড়িতেও হানা দেয়। সমিতির ঋণের টাকা তোলা রিনার নামে। তাই কিস্তির জন্য এনজিওর সাহেবরা রিনাকেই চাপ য়ে। রিনার কাছে দিনদিন এসব অসহ্য হয়ে উঠছে। 

ছেলের অসুখের কথা বেমালুম ভুলে গেছে আলম। রিনা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। বিকেল শেষ সন্ধ্যা নামবে এমন সময় বাড়িতে আসে আলেয়ার মা। আলেয়ার মা মাহমুদপুর গ্রামের বাসিন্দা। সুদের ব্যবসা করে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই সে উচ্চস্বরে চেঁচাতে থাকে আর হাঁক দিয়ে আলমকে ডাকতে থাকে।

-আলম, এ আলম চিটার, বাড়িত আছিস?

-সে তো নাই। সকালে কামে গেছে। ফিরে নাই।

Ñফিরে নাই, না ডাইল খাইয়া কোন জায়গায় পইরা আছে। গেল মাসে আমার টাহা নিল। আসল তো দূরের কথ, সুদের টাহাও তো দিল না। দ্যাহা পর্যন্ত করে না। চিটারে ঘরের চিটার! চ্যাংড়া তো খুব হারামি! আমার টাহা নিয়া জুয়ার ফরে বইছে। আবার হুনি সাগরী মাগীরে লইয়া রং ঢং করে। ভাবছে কী। আমার ট্যাহা হজম করবো? গলার ভিত্রে হাত দিয়া টাহা বাইর কইরা আনমু!

আলেয়ার মা’র শেষ কথাটা বজ্রের মতো আঘাত করে রিনাকে। বুকে শেলের মতো বেঁধে। আলম ইদানিং ফেন্সিডিল খায়, জুয়া খেলে এসবই জানে সে। কায়মনে সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার স্বামীর জন্য। সে অনেক সহ্য করে। সাগরীকে ভাল করেই চেনে রিনা। মেয়েটা ভাল নয়। কিন্তু আলম এতো নিচে নামতে পারে রিনা কল্পনাও করতে পারে না। রিনার মাথায় আগুন চড়ে। নিজের জায়গায় অন্য নারীর উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না সে। আলমের উপর খুব রাগ হয়। উঠোনে রাখা চেলা কাঠের দিকে চোখ যায় তার। ঘরে অবিরাম জ্বরে কাতরাতে থাকা ছেলেটার কান্না রীনাকে আরো ভয়ঙ্কর করে তোলে। রিনা ছুটতে থাকে বাজার স্টেশনের দিকে...


পদাবলি

পদাবলি

 



গুপ্তচর

অনন্ত পৃথ্বীরাজ


মাটি সবাইকে খায় না, কফিনে বরফ আটা প্রলেপ; ওটাকে ঠিক মমি বলা যাবে না।ডিপ ফ্রিজারেটর থেকে সদ্য বের করা একটি কাটা লাশ; নিথর, ঠান্ডা, খুব শীতল। একটুও ঘ্রাণ নেই একদা বাবরি চুল ছিল; অথচ মাথা থেকে ঘিলু, চোখ সব মেডিকেলে জমা রেখে দেহ পাঠানো হয় গোরস্থানে। গভীর অন্ধকার নিঃসীম রাতে বাতাশের স্পর্শ পেয়ে ক্ষণিক লাশটি জেগে ওঠে। তারপর কবর থেকে বের হয়ে উঠে আসে মাটির পৃথিবীতে। হাত, পা, মাথারখুলি সব ঠিকঠাক অথচ চোখ, ভেতরের নাড়ি, পাকস্থলি, মাথার মগজ, রক্ত এসব কিচ্ছু নেই; নেই। শুধু হৃদয় আছে। একখানা প্রেমিক মন। আজকের এই লাশটা একদা একটা মেয়েকে ভালোবাসত। হৃদয় স্পন্দনে এখনো সেই প্রেম প্রবাহ রুধির ধারার বেগে। ভালোবাসা মৃত্যু বেদনাকে জয় করে। মনের গুপ্ত বাসনা প্রকাশ করেছিল ছেলেটা। ভালোবাসি, ভালোবাসি নিঃসীম। মানেনি তা মহাকাল। ক্ষণকালে চলে গেল সেই ভালোবাসা; গুপ্তচর।



বেয়াদব

বিটুল দেব


অসুস্থ সমাজ

তুই কবে সুস্থ হবি ?

তোদের ভদ্র সমাজে

যুক্তি তর্কে যে হেরে যায়,

সে পরাজয়ের পতাকা বহন করতে রাজি না!

বরং তরুণ অরুণকে পুরুষ্কার দাও

বেয়াদব! চরম বেয়াদব...




তোমাকে খুঁজি

মো. শাহাজাহান হোসেন


তুমি আকাশের তারা হয়ে প্রতি রাতে জ্বলো!

আমি শুধু চেয়ে থাাকি, কল্পনায় পাড়ি জমাই;

আমিও যদি তারা হতাম!

কিন্তু চাইলে কি আর তারা হওয়া যায়?


তাই শুধু অনুভবের প্রসারতা বাড়িয়ে

নিশ্চুপ আকাশের ভীড়ে তোমাকে খুঁজি!



আলোকরশ্মি 

সাদিয়া আফরিন 


আমাকে যদি বলো- সূর্য ও চাঁদের মধ্যে পার্থক্য কী?

তাহলে আমি বলবো- দুটোই এক!

যদি অবাক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করো-

‘দুটো এক কেনো?’

আমি বলবো- চাঁদ ও সূর্যে ‘আলোকরশ্মি’ থাকে;

আর সেই ‘আলোকরশ্মি’ দিয়ে আমি না হয়-

তোমার সব অন্ধকার গ্রাস করে 

তোমাকে আলোকিত করে দিলাম!


পাতা পতনের শব্দ

রফিকুল নাজিম 


পাতাদের উন্মাদনা বাড়ন্ত হয় দখিনা হাওয়ায়

দূরের বনে চলে স্বাগত কোরাস গান

পাখিদের ঠোঁটে ভীড় করে তুমুল সমৃদ্ধি

কৃষাণীর চোখে স্বর্গের ছবিখানা ছানির মত লেপ্টে থাকে

সুখ সুখ অনুভবে দোলে শরতের কাশফুল; মেঘপুঞ্জ,

বিলে শাপলার কত্থকনাচে অনিন্দ্য লাগে যাপিত জীবন। 


কেবল আমি পাতা পতনের শব্দ শুনি দূরের বনে

যেখানে তোমরা কেবলই দেখো ফুল, ফল দেখো।

অভিমানে ঝরে পড়া পাতার খোঁজ ক’জনই রাখে

অথচ হরদম পাতার গান চলে ঝরা পাতার শাখে!



ধরো আমার অন্তিম যাত্রাও তোমার দিকে

জোবায়ের সরকার

[নিবেদিত : তাসনিম ফারিয়া আশা]


ধরো, আইজ থিকা আরও কুড়ি বছর পার

এমনই বাতাস

হিম রাত

ঘেঙর ঘ্যাঙ

ব্যাঙের ডাক


ধরো

চাঁদ

কুয়াশা

অবশ হাইওয়ে


ধরো

ছুটছি

প্রিয়গান ধরে

বরাবরের মতো

তোমার দিকে


ধরো

ফোন

ক্রিং ক্রিং

ব্রেকফেইল

মৃত্যুসংবাদ হয়ে।


চোখে দেখা নীলকণ্ঠ !

চোখে দেখা নীলকণ্ঠ !

 



চোখে দেখা নীলকণ্ঠ

শফিক নহোর 


ক.

আজ থেকে প্রায় সাতাশ আটাশ বছর আগে ফাগুনের একসকালে স্কুলে যাওয়ার পথে দেখলাম। পাঁচজন মানুষ বাঁশের সঙ্গে বেঁধে একটি মরা গরু নিয়ে যাচ্ছে।

তা দেখে গফুর ভাইকে প্রশ্ন করলাম, 

কথা প্রসঙ্গে বিভিন্ন কথা বলল, জানতে পারলাম। ফকির বাড়ির গাভিন গাই মরে গিয়েছে, তা বাড়ির পাশের হালটের দক্ষিণ দিকে চেয়ারম্যানর বাড়ি যাওয়ার পথে ফেলে দিতে যাচ্ছে ছোট জঙ্গলে।

আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি আকাশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন নেমে পড়ছে। নখ দিয়ে ছিঁড়ে খেতে দেখে আমি অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। আশপাশের গ্রামের লোকজন শকুন দেখার জন্য ঢল নেমেছিল সেদিন। একদৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে মানুষ কাচা গোসত কী ভাবে খাচ্ছে। কেউ কেউ হাহুতাস করছে; ‘আহা রে !' 

-তাই গরুটা মরে গেছে।

-কয়দিন পরেই বাছুর হত; ‘ধূর গাধা খালি বাছুর নাকি?' তার সঙ্গে যে দুই ভাঁড় করে দুধ দিত এই কালো গরুটা।

আমি আরোও দেখলাম মানুষও ঠিক এভাবেই গরুর গোশত খায়। 


ফকির সাহেবের স্ত্রী চোখের জলে ছোট্ট একটা নদী  বানাইয়া ফেলেছে। পুত্র সন্তান হারানোর মতো বিলাপ করে কান্নাকাটি করছে, পাশের বাড়ির সদ্য বিবাহিত বউ, বেটি মানুষ এসে শাড়ির আঁচল ধরে ফকির সাহেবের বউরে কইল,

-বু চুবি, বু চুবি, কাঁদিস না। আল¬øাহর মাল আল¬øাহই নিয়ে গেছে। মন খারাপ করিস না। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ফকির সাহেব এর স্ত্রী কইল,

-কত আউশ করছিলাম, গাই বিয়ান দিবার পর, গরুর দুধ দিয়ে খেজুর-গাছের রস দিয়ে পায়েস রান্না করে ছোট বেটির শুশ্বর বাড়ি পাঠাব।

-বু আফসোস করিস নি,

-আমা গের গাই বিয়াইছে, আমি তোর খেজুর গাছের রস দিয়ে পায়েস রান্না করে দিবো। এখন চাঁদির উপর একটু নারকেল তেল নিয়ে পুকুরে কয়ডা ডুব দিয়ে লায়া-নে।

-উঠ বু বেশি কাঁদলে তোর মাথা ধরবে। কাঁদিস না, পালের গরু মরলে তার ব্যথা আমি বুঝি। গরুডা দুই ভাঁড় করে দুধ দিত, সংসারে তোর কাছের মানুষ কই, এক ছাওয়াল বিয়ে দিচ্ছিস, শ্বশুর বাড়ি ছিড়াব্যাগ ভরছে, বাপ মা কি খাইয়া আছে খবর নেয় তোর লো বু।

-কালটি মাগি তো আমার কাছেই থাহে, ওর চোপা আমার দেখপির মনে কয়না।

-গোসল দিয়ে দুডি ভাত মুহি দে, সারাদিন না খেয়ে কি হয়েছিস যা বু উঠ।

-ইলো শিউলি মাগি, বড় দেহি একখান পান বানাইয়া নিয়া আয়, সঙ্গে একটু পানের পাতা নিয়ে আয়। ত, গোরে বাড়ির পর আসলাম; খালি মুহি ক্যামবা জানি লাগতেছে।


- সেলিনা বু , নে লো তোর পান। 

-ইলো মাগি তোর পেট সুন্নি দেখতেছি, আবার কিছু হবি না কি?’

-তোমার যে আবার কথা মিনসির বাড়ি আসার খোঁজ নাই, ছয় মাস। ইরাকের সাথে যুদ্ধ লাগছে, মিলিটারি গরে না কি এখন ছুটি দিচ্ছে না। নিয়ে ফেলাইছে খাগড়াছড়ি, চিঠির জন্ন্যি পিয়নের বাড়ি গেলাম সে নাকি বিলে গেছে ধান লাগাতি।

-তোর মিনসি কবে আসবিলো?

-সে আসলিই কি আর না আসলিই কী দুদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসলে, মায়ের পাছ ছাড়ে না। বাড়ির সাথেই তো তার আবার বোনের বাড়ি। আসার পথেই বোনরে নিয়ো আসবি, একপাল ছাওয়ালপল নিয়ে। মিনসি আসলে রাতে তো আর আমার কাছে থাহে না। বোনের কথা মায়ের কথা শোনে। 

চৈত্র মাসের শুকনা মাঠের মতো যৌবন শুকিয়ে গেছে মনের ধুলোবালির মতো উড়ে গেছে মনের আবেগ। সহজতর জীবনের বলিরেখার মতো ভাঁজেভাঁজে লুকিয়ে থাকে গোপন পারমাণবিক বিমান ধ্বংসের চূর্ণ কণিকার ধোঁয়া ধরা। অভিশপ্ত অনূঢার মত একদলা অবজ্ঞা।

উপেক্ষার দেয়াল ডিঙিয়ে ও অবহেলার লাল দাগ মুছে জীবনের কোনো সীমারেখা ভাঙতে পারিনি আমি। নিজের স্বামী তার পরিবারের কাছে বন্ধি আমি তো আমার শশুড়-শাশুড়ি থেকে আলাদা করতে পারি না। 

-আজ যাই লো, বেলা চলে গেল। এ বলে সেলিনা সেদিন শিউলির কাছ থেকে বিদায় নিল। গ্রামের অনেকই সে সময় সরকারি চাকরি করত, তবে গ্রামের নতুন বউদের মনের ভেতরে একধরনের কষ্ট ছিল! শশুর-শাশুড়ি তেমন একটা গুরুত্ব দিত না বউদের। ছেলেকে গরুর মতো সংসারের জন্য খাটতে হত, সংসারের সমস্ত দায়িত্ব চলে আসত; সে সময় যে চাকরি করত তার উপর। আর সবচেয়ে অনাদরে থাকত বাড়ির নতুন বউ। 


‘এই নাইমেন , এই না-মেন , চন্দ্রার যাত্রী নামেন।

গাড়ির ভেতর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাসের  কন্ট্রাক্টরের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও বসে একটু চা খাওয়া যায় কী- না। চা খেলে ঘুমঘুম ভাবটা কেটে যাবে। রাস্তার পাশের টং দোকানে বসে এক কাপ রঙ চা, খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।

একজন সুন্দরী বেটিরে দিকে চোখ আটকে গেল। পেছন থেকে একজন তাকে ধাক্কা দিচ্ছে, সামনে থেকে একজন টানছে, আর একজন বুকের উপর দিয়ে হাত দিয়ে বেটির হাত ধরবার চেষ্টা করছে, তখন ঠিক আমার স্কুলে যাওয়ার পথে ফকির সাহেবের মরা গরু ফেলানোর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল।

শকুন গুলো কী ভাবে গরুর দেহ থেকে গোশত ছিঁড়ে খাচ্ছিল। কিছুদিন আগে বাসের ভেতর রুপা নামের একটি বেটিকে গাড়ির ড্রাইভার ও কন্টাকটার মিলে ভোগ করেছিল। অজ্ঞান অবস্থায় বেটিকে ঘাটাইল জঙ্গলের পাশে ফেলে রাখতে দেখে একটি ছেলে কৌতূহল বশত ছবি তুলেছিল। চলন্ত গাড়ি থেকে এমন একটি বেটিকে মাটিতে ছুড়ে ফেলতে দেখে তার কিছুক্ষণ পরে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিল। তখন বেটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে শান্তির খোঁজে সপ্তম আসমানে চলে গেছে। আর একজন  আমার হাতের পত্রিকার দিকে তাকিয়ে যতটুকু দেখা যায় পড়বার চেষ্টা করছে। বাঙালি সহজে পত্রিকা পড়বে না কিনবেও না। পথেঘাটে পড়ে থাকলে শকুনের চোখ দিয়ে দেখবে। এদের দেখেই তৃপ্তি। এই কাগজে কত খবর আসে প্রতিদিন। একজন চেয়ে বসল ভাই,

- দেখি খেলার পাতায় তামিম না কি আজ খুব ভাল করছে।’

ইচ্ছা না থাকা শর্তেও দিতে হল ভদ্রতার খাতিরে। মনের ভিতের থেকে কে যেন বলতে লাগল , এই ফকিন্নির বাচ্চা জামা কাপড় তো ভালোই গায় দিছে। হাতে দামি ফোন নিয়ে ছাতার ফেসবুক চালায়,তার না কি ডাটা না থাকায় নিউজ ফিডে যেতে পারছে না। ফ্রি কোনো বেটির সঙ্গে পিরিতের খায়খাতির মার্কা কথা বলে পটানোর চেস্টা করছে। ছেলে জাত। মানুষ যত সহজ ভাবুক এত সহজ না। ‘এরা মুতে চোখ ধোয়ানো মানুষ।’

আমরা এখন সহজে মানুষের কাছে সাধু সেজে যাই, নিজেরে ভেতরে যে মানুষত্ব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তা দেখছি না। শুধু অন্য মানুষের দিকে নজর। বিড়বিড় করে পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, 

-ভাই রাস্তা জুড়ে দাড়াই আছেন ক্যান। একটু সরে খাড়ান। এতক্ষণে হুস আসল আমার। ভেতরে ভেতরে ঘুমের একটা ভাব রয়ে গেছে। 

-ভাই, আমি আর দেরি করতে পারছি না। পত্রিকাটি দিন। আমার গাড়ি চলে আসছে।  




খ.

সেলিনা চরিত্রের মানুষটি আমার পাশের বাড়ির। স্বামী সংসার নিয়ে তিনি এখন ঢাকার শহরে থাকেন। রংপুর শহরে তিনি প্রথম যখন বাড়ি করেন। বাবা যে খাটে ঘুমাতো তা নিয়ে যেতে সেলিনা ভাবি, যে পরিমাণ কুট কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। ইরাক  আমেরিকায় যুদ্ধ করবোর সময় প্রেসিডেন্ট বুশ এমন কুট কৌশল অবলম্বন করেছিল না। বাবা মনে মনে  ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু করো কাছে কখনো মন খুলে কিছু বলেনি। অন্য ছেলের বউ যদি কিছু বলে। বাবা শুধু সন্তানের সুখের জন্য ব্যস্ত ছিল। বউমার কুট কৌশলে পরিবারের সবার কাছে নিজেকে সে এমন একজন খারাপ মানুষ হিসেবে বহি প্রকাশ করেছে; এ বাড়ির কাকপক্ষী তো দূরের কথা। কুত্তাও তার মুখের দিকে তাকাবে না। ঢাকার শহরে এখন বাড়ি। বাবা মাটির নিচে চাপা পরে আছে বছর সাতেক হল। একদিনও মনের ভুলে বাড়ির সদর দরজায় বউকে নিয়ে বাড়ি আসা ত দূরের কথা ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সে নষ্ট করছে একের পর এক কুট কৌশলে।


সোনালি বাড়ির উঠোনে আগুনের স্তুপ হৃদয়ে নাড়া দেয় গভীর থেকে। বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে হাজারো সাজানো স্বপ্ন মৃত শামুকের মতন পড়ে থাকে বিস্তৃত মাঠ জুড়ে। হালচাষের লাঙলের ফলার মতো বুকে দাগ কেটে যায় প্রতিনিয়ত। সেলিনা ভাবির কুট কৌশলে।  আত্মীয়স্বজন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ছিল। কেউ কী সেচ্ছায় নিজেরে খারাপ মানুষ হিসাবে দাঁড় করাতে চায়? হয়তো কখনো চায় না। চাওয়া বেড়ে গেলে হয়তো কষ্ট বা ব্যথা বেড়ে যায়। সংসারের প্রতি সেলিনা ভাবির  প্রেম ছিল ঘৃণ্যতম ভাবনার এক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তার প্রত্যেকটি আচার-আচরণে। শহরমুখী হয়েছিল সেলিনা ভাবি।  গ্রাম, গ্রামের মানুষ, বাড়ির সদর দরজা তার কাছে সব সময় মনে হত জঙ্গল। গ্রামের প্রতি ঘৃণা থেকেই পরিবার ও আত্মীয়স্বজন থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেও তা ছিল শুধুই মাত্র মানুষ দেখানো মেকি সবকিছু।

একটা সময় তার আলিশান বাড়ি হয় রাজধানীর বুকে একাধিক। সেখানে সুখের শহর গড়ে উঠবার কথা হলে দাবানল বহমান ছিল মনের গহিনে। সংসারের কোনো মানুষকে মা-বাবা, ভাইকে অবহেলা করে নিজে কখনো সুখি হওয়া যায় না। চাকচিক্য অভিজাত্যের ভেতরে নিজে সে কথা নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিল। একবিন্দু অনুসূচনা তার ঠোঁটের কিণার দিয়ে উচ্চারিত হয়নি কখনো। 


গ.

বিশাল জমিদারি ফকির সাহেবের কিন্তু এ সম্পত্তি ভাগের জন্য ছেলের বউ রাত নেই দিন নেই। জমি ভাগের জন্য একটা সময় মরিয়া হয়ে ওঠে। শকুনের মতন সামনে পেলেই বুঝি ছিঁড়ে খাবে এ সংসার এ সংসারের মানুষকে।

‘মনের ভেতরে ঘৃণা ঢুকে গেলে মানুষকে খেয়ে ফেলতে পারে মানুষ।’ 

শিউলি এখন ঠিক তেমনটি হয়েছে। একটা সময় স্বামী সংসার, শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে এমন হয়েছিল স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায়। চলে যাওয়ার পরে সে বুঝতে পারে মা হতে চলছে। তখন না ফিরে যেতে পারছে না পেটের? ভেতরের মানুষটাকে বড় করতে পারছে। দিনদিন পেটে ভেসে উঠতে লাগল, মানুষের চোখ শকুনের চোখের মত পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগল, একটা সময়। লোকজন দিয়ে সমঝোতা করবার একটা মাধ্যম খুঁজে বের করবার জন্য চেষ্টা করে শেষ অবদি ব্যর্থ হয়েছিল শিউলি।

অনেক দিন হয়ে গেল। শ্বশুর বাড়িতে কেউ কখনো খোঁজ নেয়নি। স্বামী হয়তো চক্ষু লজ্জায় কখনো কারও কাছে কিছু খুলে বলেনি। আষাঢ় মাসের বৃষ্টির দিনে শিউলির কোল জুড়ে সুজন আসে। সেদিন রাতে এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। মনে হয়েছিল আকাশ ফুঁটা হয়ে গিয়েছিল। কাঁচা রাস্তায় কাদা মাড়িয়ে দাই বেটিকে আনতে যেতে হয়েছিল। সেই সব পুরোনো দিনের স্মৃতির পাতা খুলে বসেছিল সেদিন পুকুর ঘাটে ফকির সাহেব এর স্ত্রী । আমি ঢাকা থেকে আজই কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসেছি, সেকথা কোন ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। অনর্গল কথা বলে যেতে লাগল। আমি বধির ব্যক্তির মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলাম। 

-চাচি, তোমার ঘরে নাতি আসলো শোনলাম। তারে এবার ঘর আনতে হবে না?

-ঘরে কি করে আনবো রে বাজান। হারামজাদি তো কোনো রাস্তা রাখেনি।

-আমি তোমার নাতির ছবি দেখছি কী সুন্দর পরীর মতো মুখ। 

- তোমার ছেলে তো একটা অমানুষ, তোমরা কি তার সঙ্গে বউয়ের মতো আচরণ করছো কোনোদিন। 

ফকির সাহেবের  স্ত্রীর মুখ কালো হয়ে গেল। পৃথিবীর যে কোন মানুষকে তার মুখের সামনে সত্য কথা বললে তার মুখ মেঘের মতো কালো হয়ে ওঠে। ঠিক তেমনি ফকির সাহেবের স্ত্রীর মুখ কালো মেঘের মত হয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরের দিন চাচি আমার খুব কাছে এসে বলল, 

-খোদার দোহাই লাগে, তোর হাত জোড় করে বলছি, আমার নাতিরে তুই এনেদে। এক নজর আমার বংশের আলো আমি দেখব। 

-এতকাল তো তোমরা বলছো বন্ধ্যা বউমা। তোমরা তো কম নাজেহাল করোনি তাকে। তোমার ছাওয়াল হয়েছে, তোমাদের দলের নেতা। চাচি একখান কথা কই, কিছু মনো কইরো না। ছাওয়াল বিয়ে করলে তাদেরকে নিজেদের মত করে সংসার করতে দেওয়া উচিত। তোমার ছাওয়াল বাড়ি আসলে, তোমার বেটি, মেয়ের জামাই তোমার বাড়ি দখল করে রাখে। তোমার বাড়িতে ঘর একটা তোমার বাড়িতে তোমার ছেলের, বউ আগে। হ্যাঁ ঠিক আছে তোমার বেটি আসবে, জামাই আসবে, থাকবে খাবে। তোমরা কি করো, বউরে পাশের রুমে রেখে তোমারা সবাই মিলে এক রুমে থাকো। এ গুলো অন্যায়। তোমরা শুধু নিজের স্বার্থ দেখছো। এমন ঠিক না চাচি। ছেলের টাকা পয়সা বউকে না দিয়ে সব সময় বেটির দিকে দেখছো কেন?’

তোমার বেটির জামাই জুয়া খেলে, মদ খায় তাকে তো একটা কাজের কথা তোমরা বলতে পারতে, নিজের বেলায় তোমরা ষোলো আনা বুঝ। 

এমন করলে তোমার সংসারে কোন বেটি সংসার করবে  কও তো দেহি? 

শিউলি ভাবি তো তাও এত বছর সংসার করছে। ছেলের মা হয়েছে, তোমরা তাকে জবরদস্তি করে বাধ্য করছো ডিভোর্স দিতে। 

-বাপ রে আমার নাতির জন্ন্যি আমার অন্তর পুড়ে তারে একবার চোখে দেখা যাতে দেখতে পারি সে ব্যবস্থা করে দে না। 

-আমার কাছে কইয়ে কি লাভ চাচি! তোমার বেটার বউ ভালো মানুষ। কেউ তো তারে কখনো খারাপ বলেনি। শুধু তোমার বেটির কথা শুনে আর এক মায়ের বেটিরে স্বামীর ভাত-কাপড় থেকে পৃথক করে দিছো। 

আমি তখন কামারহাট স্কুলে পড়তাম, ভাবি দেখতাম গরুর চাড়িতে পানি দিবার জন্য পুকুর থেকে পানি নিত, তোমার গরু বাছুর সেই তো দেখত, সংসারটা একেবারে নিজের করে নিয়েছিল কিন্তু তোমারা সবাই তার বিপক্ষে ছিলে। সংসারে নতুন বউ কী বাঘ না সাপ তার সঙ্গে সবাই মিলে কুত্তার ল্যাহান ব্যবহার করছো।


গরমে ঘেমে বৃষ্টিতে ভিজে উঠত রোদে পুড়ে সারা দিন ধান শুকাতো, সংসারী মেয়ে ছিল। তার কপালে ডিভোর্স জুটছে। যেখানে কাচ আর হিরের একই দাম হয়, সেখানে নিজেকে প্রকাশ করতে যাওয়াও একটা বোকামি।

স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে শিউলি ভাবির সেই ডাক , সেলিম স্কুলে যাবার পথে তুই আমার তেঁতুল আর একটা ডাব পেড়ে দিবি ভাই। মনে হতো এই মানুষটা আমার আপন আমার শত জনমের পরিচিত মানুষ।

আহা রে সত্যি তার এই বেদনাময় ব্যথার সাগরে ভেসে যায় না বলা কষ্টের স্রোত। আমি মনে মনে ভেবেছি, দু একের ভেতরে গিয়ে  শিউলি ভাবির হাত ধরে বলল,

-ভাবি আপনি আপনার ছেলে সহ আমার সঙ্গে চলেন। 

চাচি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছে। তাঁর নাতিকে দেখতে চায়। সাত পাঁচ ভেবে পরের দিন সকালে বাজারে যাব ঠিক সে সময় দেখলাম। আয়নাল ভাই একটা সুন্দরীর হাত ধরে বাড়ির অভিমুখে এগিয়ে আসছে, না-কি আমি ভুল দেখছি, হয়তো কোনো কোনো দেখা চোখের ভুল হতে পারে।  


শব্দমালা : শোয়াইব শাহরিয়ার

শব্দমালা : শোয়াইব শাহরিয়ার





বিচ্ছেদ


যাচ্ছো, যাও...

শব্দ করে যেও।

করাতের কাঠিন্যে—

রক্তনদী বয়ে যাক;

শব্দ হোক; শব্দ হোক

শব্দের বেয়াদবিতে-

প্রতিবেশীর ঘুম ভাঙুক!




বৃষ্টি শেষে 


বৃষ্টি শেষে-

পাতা ও পথের মতো যুবতী হয়ে উঠবে;

বৃষ্টি শেষে-

যুবতীর মতো ব্যথাতুর নদী হয়ে উঠবে!


অন্তঃপুরে যেদিন বৃষ্টি থেমে যাবে

শুকিয়ে যাবে জীবনের ঠোঁট

যেদিন ফুরিয়ে যাবে জলের যৌবন

মনে করে সেদিন ইশারা দিও...


আমি জীবনের রঙমহলে-

বৃষ্টির পরিবর্তে শষ্য হয়ে নামবো!



দূরত্ব 


দরোজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছো;

দূরত্ব যদিও তেমন না

এটুকু তো থাকেই-

যেটুকু থাকলে কোনো দূরত্বের প্রয়োজন পড়ে না!


...এটুকু থাকলে, জীবন আর জীবন থাকে না!


দূরত্ব কি জানে, তার অপর নাম প্রেম?

দুরত্ব কি জানে, তার অপর নাম নরক?


কেউ না জানুক, আমি তো জানি-

দূরত্বের অপর নাম বনমল্লিকা! 



খোঁজ 


ম্যালা দিন দেখিনা তোমারে, তুমি এখন কই?

বুকের মইধ্যে একগোছা ধানের চারা দেখিয়ে বলেছিলা

ধানেরা যেদিন গর্ভবতী হয়ে তোমার ঘরে উঠবে

ঐদিন আমারে খুঁইজা নিও; পারলে একবার ঘ্রাণ নিও;


কৃষকের বাছা আমি;

মাথার মইধ্যে ডুইবা থাকে কালবোশেখির ভয়

ডুইবা থাকে শীতকালের জ্বর!

তোমারে তবুও খুঁইজা বেড়াই; সাহস কইরা 

ধানের কাছে গিয়া, নাকের আগা বাড়াই দিলাম

তোমারে তবুও পাইলাম না; তুমি কই থাকো এখন?


বুকের মইধ্যে ঠোকা দিয়ে একবার বলেছিলা-

ঐখানে যদি না পাও, তবে এইখানেই পাবা, খুঁইজা নিও...


এখন আমি তোমারে খুঁইজা বেড়াই...

খুঁইজা বেড়াই নিজের ভেতর!



অবহেলাফুল 


মরে গেলে, পাতার ফাঁক দিয়ে যে ক’টি বৃষ্টিফোঁটা পড়বে, তা আমার কবরের উপর পড়তে দিও। মরে গেলে, অনন্ত হাহাকার ফুরিয়ে যাবে; আর নরকের জানালা দিয়ে পালাবে না জীবন!

মরে গেলে, সিনার উপর ফুঁটবে অবহেলাফুল। আয়নার মতো অবিকল দেখতে। যারা রোপণ করেছিল এই ফুল, কিছু পাপড়ি তাদের দিও। তারা কাঁদবে, তোমরা তাদের ভুলে যেও।

মরে গেলে, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও।