বইমেলার নতুন বই

বইমেলার নতুন বই

বইমেলার নতুন বই


ডোম সিরিজ, গিরিশ গৈরিক


কাদামাটি, ইমাম মেহেদী ।


একদিন জলপাইবেন হারিয়েছিলাম, রেবেকা ইসলাম


প্রেমের গল্পইমদাদুল হক মিলন ।

 
 অলৌকিক ঘ্রাণ, দেলোয়ার হোসাইন


কথামালা, শেখ মেহেদী হাসান ।



সময়ের কণ্ঠস্বর, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ।


রাত্রি নামাই ভালোবেসে, রাহাত রাব্বানী । 

প্রেমেরে পদাবলি

প্রেমেরে পদাবলি



বোমা বিষয়ক
শেখর দেব

নিজের ভেতর ক্ষয়ে যায় আদিম পাথর এক
কোথাও কোন আগুন জ্বলেনি তবু
বিন¤্র বোমা পুঁতে চলে গেছো দূরের কোলাহলে
বিকট সশব্দ আস্ফালন শুনিনি কখনো
ফুলকির স্বভাবে তিলতিল ক্ষয়ে যায় সভ্যতা
তীব্র আগুন-আঁচে ক্লান্ত পৃথিবী শুয়ে আছে আজ।

একটি বিশদ বেমালুম বিস্ফোরণ শেষে
চূর্ণ হয়ে যাক রাত আর সমগ্র দিবস
রাগ ও অনুরাগ সমৃদ্ধ কয়েকটা প্রেম
শুনতে পাবে না কেউ।

তোমাকে না-ছুঁয়ে কলঙ্ক লেগেছে গায়ে
ভেবেছিÑ চুমু খেলে গোপন বোমার আকারে
ধ্বসে পড়তো সভ্যতার খোলস!
কে তুমি অসভ্য হতে বলো?
সভ্যতার সুন্দরে পুড়ে পুড়ে ম্লান হয়ে আছে
নিরালম্ব কংকাল আমার।

সভ্যতা বুঝি, বোমা বুঝি
প্রেম তবে রয়ে যায় অবুঝ আঁধার!


কাট গোলাপের ঘ্রাণ
শাহীন মাহমুদ

তোর কানে দিবো নয়নতারা সোনালুর দুল
খোপায় দিবো কৃষ্ণচূড়া -কনকচাঁপা ফুল
কোমরেতে পড়িয়ে দিবো কুর্চি ফুলের বিছা
ভ্রমর হয়ে হুল ফোটাবো পাবি না যে দিশা ।
ফাগুনের এই লগন না হয় উজাড় করে দিলাম
ভালোবাসে ফতুর হতে তাইতো ফিরে এলাম।
তোর অধরে বইছে আজি কাট গোলাপের ঘ্রাণ
আমার ঠোঁটে চোট লেগে হায় হল যে খান খান ।



ঈশ্বরের অপেক্ষায়
মোকসেদুল ইসলাম

গোপন অন্ধকারে যে বাঁশি বাজে সে নয় প্রত্যাখ্যানের সুর
আলগোছে রাখা বুকের পাখিটা উড়ে গেলে
অযথা চিন্তা বাড়ে আমার
শুধু হাতদুটি তুলে ধরো
উড়াল জাহাজে পার হবো আগুনজ্বলা নদী

আমাদের যাত্রা শুরু হয় মূলত মাটি থেকেই
সত্য কিনা জানি না তবে পতিতার সাথে আমাদের
শারীরিক গঠনে কোন পার্থক্য নেই
আর এই নির্মম সত্যটি জানার পরেই ঈশ্বর ছুটি নিলেন আগাম সাতদিনের
এবং ঘোষণা দিলেন পৃথিবীতে কেউ কেউ মানুষ হয়ও জন্ম নেয়

কড়া পৌষ মাস
উনুনে অঙ্গার জ্বালিযে আমরা তার ফেরার অপেক্ষায় থাকি।


তিতাস পাড়ের মেয়ে
উষার মাহমুদ

শেষ কবে দেখেছিলাম হুবহু মনে নেই,
একদা তুমি ঠিল্লার পিঠে চড়ে মাঝ নদীতে ভাসতে তিতাসের জলে।
চলন্ত লঞ্চ রেখে যাওয়া ঢেউগুলো খেলতো তোমাকে নিয়ে।
আলতো চুমু খেত তোমার শরীরে! সুমিতা,
হয়তো তুমিও জানতে না কতবার পায়ের বদল হতো-
নদী থেকে তোমার ঘর অবদি পৌছতে।

আমি গনেছি, আর তোমার জলে ভিজা পায়ের ছাপে পা মিলিয়ে হেঁটেছি।
পেছন থেকে দেখেছি, মাটির কলস ভেয়ে ঝরেপড়া টিপ টিপ জলকণা,
আলতা রাঙা উদলা পায়ে কয়েক বিন্দু স্বপ্ন।
জলসিক্ত কামিজের আড়ালে কোমরের ভাজ, লাল ডোরা কাটা গামছায় মোড়ানো চুল!
 প্রক্ষালনে তুমি আসতে; তবে আর দেখিনি তোমার দূরন্তপনা
তুমি বেড়ে উঠার সাথে সাথে প্রস্থান হয়েছে অনেক কিছুর।



উপমা তোমাকে বিদায়
শাহিন আলম

আমার কবিতারা তোমার দরজা জানালা খুলে লুট করেছে সর্বস্ব
সে অভিযোগে তুমি মামলা করেছো দায়ের।

আমার কবিতারা ফেরারি আসামী হয়ে
অন্ধকার গলিতে বেড়ায় ঘুরে।

তোমার রুপের সুধা পান করে যে কবিতারা বড় হয়েছে
যার ডালপালায় ফুটে আছে তোমার স্পর্শের ফুল
তারা আজ জমটুপি পরে পায়চারী করে হৃদয়ে আমার।

মরা নদীর মতো আমার কবিতারা পড়ে থাক
আমার কবিতার শরীর থেকে উপমা তোমাকে বিদায়।


হৃৎপিণ্ড তুমি নিয়ে যাও
এসএম নূরনবী সোহাগ

তুমি না থাকলে; এর আর দরকার হবে না আমার
নিঃশ্বাসের ওঠা নামা, আমি ফুসফুস দিয়ে চালিয়ে নিতে পারবো।
হৃৎপি- বরং তুমি নিয়ে যাও!
হৃৎপি-ের যা কিছু কাজ সব তোমায় ঘিরেই
তুমি কি করছো, কি করবে, কি ভাবছো, কি ভাববে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যৌক্তিক অযৌক্তিক সকল চিন্তায়, ও তোমায় নিয়ে আসে
শরীরের এটুকুই কেবল আমার অবাধ্যে চলে আসছে বরাবর।
তোমার জন্য, ও শরীর জুড়ে অবরোধ করে
চোখকে পোড়ায়, মস্তিষ্ক বিকল করে দেয়
হাত পায়ে ঢালে অবশের মত ব্যামো।
হৃৎপি- বরং তুমি নিয়ে যাও
তোমায় ছাড়া ও  থাকতে চাইবে না; আমার পাঁজরের বেষ্টনীতে!


ক্রিয়া
পরান জহির

কাঁসরধ্বনির সম্পাদনা শেষে,
তুমি ছুঁয়ে থাকো রাত্রির মতো

আকাঙ্খার স্তনযুগলে, ভ্রমতিলকের ফোঁটা
পেশিবহুল স্বপ্নের চোখে, কুসুমরঙা প্রভাত!

কুহকের নিতম্বে তোমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়,
যৌবনপ্রাপ্ত ষোড়শী বাতাসের মত!

তুমি কল্পনা করে চলো নারী আর পুরুষেরর,
বেয়াব্রু অজ্ঞতার কলেবর!

তুমি, এখানেই ইতি টানো সমস্ত দুরাশার...



কতদিন দেখিনা তোমায় !

কতদিন দেখিনা তোমায় !


কতদিন দেখিনা তোমায় !
আহমদ মেহেদী

 শীতের দিনের রোদ খুব কড়া হয়, সকালে গোসল কওে বের হয়েছি বলে একটু আরাম পাচ্ছি। বাবাকে বলেই বাড়ি থেকে বের হলাম। যেদিন রিকশার প্রয়োজন সেদিন রিকশা সহজে পাওয়া যায় না। দুএকজন রিকশা ড্রাইভারের নাম্বার সেভ করা আছে। কল দিতে একজনের নাম্বার বন্ধ অন্যজন ভাড়া নিয়ে চলে গেছে। মেজাজটা গেল খারাপ হয়ে। অফিসের প্রমোশনের একটা পরীক্ষা আছে কুমিল্লায়। পরীক্ষার আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি। বাড়ি থেকে ষ্টেশন  আসতে আধা ঘন্টা শেষ। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি। পাপিয়া বাস ছেড়ে দিবে দিবে করছে। দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লাম তা না হলে আরও দশ মিনিট লেইট হবে। পিছনের সিটে বসতে গিয়ে হকচকিয়ে গেলাম। স্কুল জীবনের ক্লাসমেট সামিয়া তার বাচ্চা কোলে বসে আছে ! সেও আমাকে দেখে সেই পুরনো হাসি দিয়ে বলল ।
-কেমন আছ জাকির?
-ভালো। তোমার কী খবর?
-আছি ভালোই, কোথায় যাও? এখন কি কর? বিয়ে করেছ?
-কুমিল্লায় যাব অফিসের কাজে, গত জানুয়ারিতে বিয়ে করেছি।
-কেমন তোমার বউ, তার পড়াশুনা কতটুকু?
-হ্যাঁ, ভালো। বউ এবার এসএসসি দিবে। তা শুনে সামিয়া হেসে ফেলল আর বলল ।
-আর কারো সাথে কন্ডাক্ট হয় তোমার?
-না, এখন আর কারও সাথে তেমন কন্ডাক্ট নেই!
-তোমার কন্ডাক্ট  হয়? খালেদা, শিরিন ও নাজমাদের সাথে?
-না আমারো হয় না। শুনেছি ওয়ালিউল্লার সাথে কন্ডাক্ট হয় শিরিনের! কুমিল্লায় যেতে যেতে অনেক কথা  হল, কত পবিত্র স্মৃতির কথা মনে ভেসে উঠলো শিরিনের কথা  শুনেই নিজের ভিতরটা কেমন জানি হু হু করে কেঁদে উঠল। কোন রকম পরীক্ষা দিয়ে চলে এলাম সোজা ধর্মসাগর পাড়ে। সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে ভাবতে লাগলাম-  যে ওয়ালিউল্লা আমাদের দুজনের সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে বেড়াত সেকিনা আজ আমার প্রিয়তমার সাথে ফোনে  কথা বলে । সত্য যে আকড়ে ধরে তাকে মনের মসজিদে ভালবেসে যায় তার এখন কোনো দাম নেই, মিথ্যা ছলচাতুরীর জালে আটকে সে সব ভুলে গেছে! তার দেওয়া চিঠি গুলো দেখলেও কি এই কথাগুলো আজ আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? চিঠির কথাগুলো কি সব মিথ্যা ছিল? আমাকে কি মিথ্যাই মনের রাজা বানিয়েছিল সে? আমাকে নিয়েই কি অকুল সাগর পাড়ি দিতে চেয়েছিল ! আমৃত্যু কি আমার ভালবাসাই কামনা করেছিল? আমার জন্য কি এই শিরিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল? আমার জন্যই তো তুমি তোমার প্রিয় মাকে পর্যন্ত ছাড়তে চেয়েছিলে? তুমি তো চেয়েছিলে যেন আমি তোমার বিয়েতে বাধা না হয়ে দাড়াই, তোমার মৌলানা বাবার মানহানি যাতে না হয়, তুমি ভালবাসার কসম দিয়ে তোমার এই কথা রাখতে বলেছিলা কেন? কেন! কেন! তুমি ভালো করেই জানতে আমি চাইলে  বিধাতা ছাড়া কারও সাধ্য ছিল না আমাদের ভালবাসার পথে বাধা হয়ে দাড়ায়! সরলতা কে কেন তুমি আমার দূর্বলতা ভেবে ভেবে দিব্যি পরের ঘরে আলো জ্বালাচ্ছ।
-না, আমি বিশ্বাস করিনা আর করতে চাইও না। আমার প্রিয়তমা  শিরিন এমন করতেই পারেনা। অনেক বছর তো হয়ে গেল একটিবার ও আমার খোজ নেওনি ভালো কথা  তাতে কি হয়েছে! কিন্তু যে আমার শত্রু তার সাথে নাকি তুমি কন্ডাক্ট করছ। এসব কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না আমি।  সরলতার মানুষটিও ইচ্ছে করলে তোমার হতে পারত, তুমিই পরিবারের মান রক্ষায় তাছাড়া সদ্য এসএসসি পাশ করা একজনের সাথে নিজেকে নিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়েছিলা। তোমার বিয়ের কথা শুনতে হয় অন্যের কাছে এর থেকে দুঃখ জীবনে আর কি হতে পারে!
সামিয়ার সাথে দেখা হয়ে নিজেও টালমাটাল হয়ে গেলাম। কত কথা বলতে ইচ্ছে করে,কত স্মৃতি আজও আমাকে ঘুম পাড়ায়, চমকে দেয়।  কত মানুষকে প্রতিদিন দেখি শুধু আমার প্রিয়তমা ছাড়া! সামিয়ার মতো যদি দেখা পেয়ে যেতাম  আরেকবার  কোন অচেনা ষ্টেশনে, অভিমান ভুলে বলতাম- প্রিয়তমা, কতদিন দেখিনা তোমায় !


ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা : পাঠ ও পর্যালোচনা

 ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা : পাঠ ও পর্যালোচনা


 ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা : পাঠ ও পর্যালোচনা
অনন্ত পৃথ্বীরাজ 

ছোটবেলায় একটি গল্প পড়েছিলাম। নাম ‘পটু’। একটি দুর্বল ও মৃত্যুপথযাত্রী ছাগশিশুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গল্পের পটভূমি। বাড়ির কর্তীর ধারণা ছিল ছাগীর চার নম্বর বাচ্চার আর বাঁচার আশা নেই। কিন্তু ছেলের ঐকান্তিক  প্রচেষ্টা ও আগ্রহে পটু ধীরে ধীরে সুস্থ-সবল হয়ে ওঠে। এক সময় সেই ছোট্ট ছাগশিশুটি খাশি ছাগলে পরিণত হয়। এ পর্যন্ত বলা যায় গল্পের কাহিনি সরল পথেই ছিল। কিন্তু ঘটনার বাঁক শুরু হয় কুরবানীর জন্য পটুকে বলীদানের সিদ্ধান্তে। তখন পটু কেবল একটি খাশি ছাগল থাকে নাÑ এই প্রাণীটি হয়ে ওঠে মানবতার মূর্ত প্রতীক।
‘পটু’ গল্পটি লিখেছেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। তখন অবশ্য ইবরাহীম খাঁ’র প্রতিভা ও সাহিত্য সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। সময় পরিক্রমায় এখন উপলব্ধি করি খাঁ সাহেব কত বড় একজন মনীষী ছিলেন! বাংলা কথাসাহিত্যকে অঙ্কুর থেকে মহীরুহ পর্যায় নিয়ে আসতে যে সকল সাহিত্যিক বিশেষ অবদান রেখেছেন ইবরাহীম খাঁ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সমকালীন লেখক ও বিদগ্ধ গবেষক ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান তাঁর ‘ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা’ গ্রন্থে ইবরাহীম খাঁ’র ব্যক্তিজীবন, সাহিত্যকর্ম, চিন্তা, দেশপ্রেম, রাজনীতিসহÑ সকল বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলা ভাষার উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক।  সাড়ে ছত্রিশ ফর্মার বিশাল কলেবরে এই গ্রন্থটি ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নানের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। এই গবেষণাকর্মটি ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ’ থেকে বই আকারে মুদ্রিত হয়েছে।


ইবরাহীম খাঁ পেশায় ছিলেন অধ্যক্ষ। লোকে তাঁকে সম্মান করে ‘প্রিন্সিপাল’ সাহেব বলে ডাকতেন। পরবর্তীতে এই প্রিন্সিপাল শব্দটি তাঁর উপাধি হিসেবে নামের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে।  ইবরাহীম খাঁ ছিলেন একাধারে শিক্ষক, সংগঠক, সংস্কারক, সাহিত্যিক ও চিন্তক। সমাজ সেবা ও সাহিত্যকর্ম ছিল তাঁর প্রিয় কাজ। তিনি সমকালীন রাজনীতির সাথেও ঘনিষ্ট ছিলেন। পশ্চাৎপদ সমাজকে উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করার মাধ্যমে গণমানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। ইবরাহীম খাঁ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সাািহত্য সাধক। দেশ ও দেশের মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তাই জাতির দুর্দিনে, সময়ের ডাকে তিনি ঘরে খিল এঁকে রুদ্ধ হয়ে বসে থাকেন নি। তৎকালীন খেলাফত আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বদেশি আন্দোলন, ভারত বিভাগ আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখ করার মত।
সাহিত্যিক ইবরাহীম খাঁ’র প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮২ টি। অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির সংখ্যা ২৪ টি। এছাড়া বাঁধাই করা খাতায় বিপুল পরিমাণ রচনা অপ্রকাশিত রয়েছে। ইবরাহীম খাঁ’কে বোঝার জন্য গবেষক পুরো গ্রন্থটিকে ছয়টি অধ্যায় ও কয়েকটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করেছেন। বলা যায়, কালের গর্ভে বিলীনপ্রায় ইবরাহীম খাঁর সাহিত্যকর্মকে এ গ্রন্থের মাধ্যমে নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াস। ইবরাহীম খাঁর সমসাময়িক সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিকে জানার জন্য লেখক প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইবরাহীম খাঁর জীবন ও মানস যেমন : জন্ম, পরিচয়, লেখাপড়া, চাকরি ও চিন্তারস্বরূপ আলোচিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক ইবরাহীম খাঁর কথাসাহিত্য: উপন্যাস ও ছোটগল্প নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যে মুসলমানেরা নিজেদের আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখেছিলেন। ফলে পূর্ব বাংলার বেশিরভাগ বিত্তবান মুসলমান সামাজিকভাবে হেয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়িষ্ণুতার ভেতর পড়ে যান। মুসলমানদের সেই বিক্ষুব্ধ সময়ে ইবরাহীম খাঁয়ের আবির্ভাব যেন আলোকবর্তিকার মতো। মীর মোশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকের রচনার প্রভাবে গড়ে উঠেছে ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য মানস। গবেষক ইয়াহ্ইয়া মান্নান গ্রন্থটির চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে ইবরাহীম খাঁর নাটক, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, প্রবন্ধ ও পত্রসাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরবর্তী গবেষকদের জন্য উপসংহার, পরিশিষ্ট, গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট সংযোজন করে বইটির গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছেন।
অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ইবরাহীম খাঁর চিন্তা ও কর্মে সর্বদা খেলা করত মানুষের মঙ্গল। তিনি যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসা-বিদ্বেষ একদম পছন্দ করতেন না। তাই যুদ্ধ, হানাহানি, হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা বন্ধের জন্য তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে বলেছিলেন :
“আমাদের আজ কর্তব্য সর্বপ্রকার উপায়ে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের অলঙ্ঘনীয় দেয়াল গড়ে তোলা। মানুষের সমাজ হতে যুদ্ধকে যে দিন নির্বাসনে দেওয়া সম্ভব হবে, মানবীয় সাধনার চরম সাফল্যের শুভক্ষণ বলে সেদিন মানুষের কীর্তির ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা পড়বে।”
উপরিউক্ত মন্তব্য থেকে উপলব্ধি করতে পারি যে, ইবরাহীম খাঁ কেবল দেশে নয়, তাঁর গুরুত্ব ছিল বিশ্বজনীন।
গ্রন্থ : ইবরাহীম খাঁর সাহিত্য সাধনা ও চিন্তাধারা * লেখক : ড. ইয়াহ্ইয়া মান্নান * প্রচ্ছদ : সোহেল আনাম * প্রকাশনী : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ * মূল্য : ৮০০ টাকা।


অধরা থেকে যায় সে...

অধরা থেকে যায় সে...






অধরা থেকে যায় সে...
ইসলাম তরিক

- না তোকে আর এক পয়সাও দিতে পারব না। এইতো দুদিন আগেই দুশ টাকা নিলি। কী করিস এত টাকা?
- টাকা কী থাকার জিনিস বল? ওটা খরচের জন্যই।
- তাই বলে এভাবে খরচ করবি?
- আচ্ছা ঠিক আছে আর ফালতু খরচ করব না। আজ একশ টাকা দে।
- না দিতে পারব না। তুই প্রতিদিনই এমন কথা বলিস।
আমিও নাছোড়বান্দা। জোর করে ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একশ টাকা নিয়ে চম্পট দিলাম। সেও কম যায় না। মুখটা পেঁচার মতো করে অভিমানের সুরে আমাকে ইচ্ছেমতো বকা দিলো। সে আর কেউ না । সোমা। আমার বন্ধু-বান্ধবী দুটোই । ঘনিষ্ঠ বন্ধ কাকে বলে সেই সজ্ঞা হয়তো আমি দিতে পারব না। তবে সোমা আমার এত কাছের কেউ, যেন দুটি দেহের এক আত্মা।
সোমা আমাদের গ্রামেরই মেয়ে। সেই প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল, তারপর কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও সোমা আমার পাশে ছিল। প্রাইমারিতে আমরাই ছিলাম প্রথম ও দ্বিতীয়। হাইস্কুলেও তাই। জুনিয়র বৃত্তি আমি মিস করলেও সোমা মিস করেনি। সোমা ছিল ডানপিটে মেয়ে। কিছুটা পুরুষ স্বভাবের। আমরা দুজন মিলে সমস্ত গ্রামটা চষে বেড়াতাম। আমি গাছে ওঠতে ভয় পেতাম। কিন্তু সোমার কোনও ভয়ডর ছিল না। সে বানরের মতো লাফিয়ে গাছে ওঠত। আমি সাঁতার জানি না, সোমা আমাকে সাঁতার শিখিয়েছিল।
 সে আমাকে পদ্মফুল তুলে দিতে বলেনি। উল্টো সোমাই আমাকে পদ্ম, শাপলা তুলে দিত। আম, কদবেল আমাকে চুরি করতে হয়নি। সোমাই সব করত। আমি শুধু ওর পিছুপিছু ছুটতাম। সোমা আমাকে বলত, ইস! আমি যদি ছেলে হতাম আর তুই যদি মেয়ে হতিস তাহলে আরও ভালো হত। ওর কথা শুনে আমি হাসতাম। শৈশবের সেই বয়সটা পেরিয়ে আমরা আজ অনেক বড় হয়েছি। পরিবর্তন এসেছে আমাদের শরীরে। আজ সোমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে হাজারও কাব্যিক ছন্দ দোল খায়। তবুও কেন যেন আমার প্রতি সোমার আচরণ সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।
আমাদের দুজনার মেস ছিল পাশাপাশি। আমার মেসে মহিলা গেস্ট নিষিদ্ধ হলেও সোমার জন্য সিদ্ধ ছিল। আমাদের দুজনার আচরণ দেখে আমার বন্ধুমহল বলত সোমা তোর বান্ধবী নয়, তোর বউ। তাদের কথায় আমি খানিকটা লজ্জা পেলেও সোমা হাসত। হ্যাঁ, বন্ধুরা অবশ্য ঠিকই বলেছে। সোমা আমার বউ। আচ্ছা বউ তার স্বামীর জন্য কী কী করে? শুধু সেক্সচুয়াল দিকটি বাদ দিয়ে সোমা তো তার সব কিছুই করে আমার জন্য।
আমি ছোট থেকেই অগোছালো ছিলাম। সোমাই সব গুছিয়ে দিয়েছে। গুছিয়ে দিয়েছে আমার ছাত্রত্বের বিশৃঙ্খল দীর্ঘ জীবন। তার অনুপ্রেরণায়ই আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি। আমি ছিলাম বরাবরই খাপছাড়া বাউ-েলে। সোমাই আমাকে সুগঠিত উজ্জ¦ল আলোকবর্তিকা নিয়ে পথ দেখিয়েছে। আমার পরিধেয় কাপড় আমি ধুতে পারতাম না । তাই মাস শেষে ময়লা কাপড়গুলো ব্যাগভর্তি করে বাড়ি নিয়ে আসতাম। আমার মায়ের কষ্ট হবে ভেবে সোমাই সেসব কাপড় ধুয়ে দিত। রান্না ভালো হয়নি এই অজুহাতে সে গ্যাসের চুলায় ডিম ভেজে আমাকে খাওয়াত। আমাকে খাওয়াতে পেরে তার যেন রাজ্যের তৃপ্তিতে হৃদয় ভরে যেত। কারণে-অকারণে, সময়ে-অসময়ে সে আমার রুমে এসে আমার শিয়রে বসে কপালে হাত রাখত। আমিও মাঝে মধ্যেই মাথাব্যথার অজুহাতে  তাকে দিয়ে মাথ ম্যাসেজ করে নিতাম। সোমা দারুণ ম্যাসেজ করতে পারত।
তার নরম হাতের স্পর্শে আমি এক সময় ঘুমিয়ে যেতাম। আর সোমা আমার পাশে বসে গুনগুন করে গান গাইত। ঘুম থেকে জেগেও যখন সোমাকে দেখতে পেতাম তখন অজানা এক অনুভূতিতে তাকে জরিয়ে ধরতাম। আমার ভেতরে-বাহিরে  সোমাই সব। কেবল সজ্জাসঙ্গিনী ছিল না সোমা। সে কী দেয়নি আমাকে ? নিজের শরীরটা বাদ দিয়ে সে সবকিছুই আমাকে উজার করে দিয়েছে। সোমাকে একদিন ঠাট্টাছলে বলেছিলাম, তুই আমার জন্য এত কিছু করিস কেন রে? তুই কী আমার অর্ধেক বউ?
প্রতিত্তোরে সে বলেছিল, অর্ধেক কেন রে? আমাকে পূর্ণ বউ ভাবতে পারিস না? সেদিন ঠাট্টাচ্ছলে সোমা যে তার মনের কথাটি প্রকাশ করেছিল সেটা বুঝিনি।কিন্তু অনার্স থার্ড ইয়ার থেকে ফাইনাল ইয়ারে ওঠতেই হঠাৎ সোমার বিয়ে হয়ে গেল। মহাধুমধামে বিয়েটা পার হলো। সোমা হয়ে গেল  অন্যের ঘরণী। সোমাহীনা আমার জীবনেও নেমে এলো একাকীত্বের ঘনকুয়াশা। সোমার বিয়ের পর আমাকে এত কষ্ট পেতে হবে ভাবিনি কখনও। প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেদনার কাঁপন ওঠবে তাও কখন কল্পনাও করিনি। প্রতিটি মুহূর্তে তার কথায় আমি ভাবতাম। হঠাৎ একদিন সোমা আমার মেসে এসে হাজির হলো। তাকে দেখে  যেন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। ছুটে গিয়ে বললাম,
- কেমন আছিস তুই?
- তুই যেমন রেখেছিস?
- ঠাট্টা বাদ দে। তোকে এত রুগ্ণ দেখাচ্ছে  কেন রে?
- ঠাট্টা নয়রে। সত্যিই বলছি তুই তোর সোমাকে যেমন রেখেছিস, সোমা ঠিক সেরকমই আছে।
 সোমার কথার মাথামু- আমি কিছুই বুঝলাম না। কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকলাম সোমার দিকে। সোমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কিছু একটা হয়েছে ভেবে আমি ভয় পেলাম।
সোমা আমার চোখে চোখে রেখে বলল,
-তুই পারলি নারে আমাকে তোর পূর্ণ বউ করতে। সারাজীবন আমি তোর অর্ধেক বউই থেকে গেলাম। এই জীবনে তোকে ছাড়া আমি আর কাউকেই চাইনি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার চাওয়া পূর্ণ করল না।
 সোমার কথা শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সত্যিই আমি এক জড়পুরুষ, যে কি না সোমার এত কাছে থেকেও তার হৃদয় বুঝতে পারেনি।



অশান্ত পৃথিবীর বুক ভালোবাসায় ভরে উঠুক, প্রেমের বীণায় বাজুক তবে মিলনের সুর...

অশান্ত পৃথিবীর বুক ভালোবাসায় ভরে উঠুক, প্রেমের বীণায় বাজুক তবে মিলনের সুর...

অশান্ত পৃথিবীর বুক ভালোবাসায় ভরে উঠুক, 
প্রেমের বীণায় বাজুক তবে মিলনের সুর...
 
ইলিয়াস বাবর

কৈশোরেÑ তখনো বাড়ন্ত গাছটির মতো সবুজাভ আর চাঞ্চল্য ঘেষাঘেষি করে আছে আমাদের সাথে; আমরা ক্লাস নামক বন্ধনের চার দেয়ালে দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রায় পুরোটাই বিসর্জন দেইÑ একদিন টুপ করে মাধ্যমিক জীবনের একেবারে মাঝখানের ক্লাসের শ্রেণিশিক্ষক পাঠদানের শুরুতে বললেন, এই শিরিন দাঁড়াও, তোমার জীবনের লক্ষ্য কী বলো তো? আমাদের তখন মাথায় বাজ পড়ার দশা! পাশের জনের দিকে তড়িৎ তাকাই, তারাও স্যারের আতিক্কা প্রশ্নে বিহ্বল। বলা নেই, কওয়া নেই, এমন প্রশ্ন কেউ করে? তার উপর, আমাদের তো কেউ বলেনি, বাচাধন স্কুলে গেলা, তা হবেটা কী? এমন বোধ কিংবা জিজ্ঞাসা জাগরুক করার পরিবেশ তখনো আমরা পাইনি; ফলে, সহপাঠীরা আশ্চর্যের অধিক বিস্ময়ে চুপ মেরে গেলাম এই ভেবে, যাক বাবা, বাঁচা গেল! শিরিনকেই জিজ্ঞেস করলেন স্যার। স্যার বাংলা পড়ান কিন্তু তার মেজাজ গণিতের শিক্ষক কি তারও জটিল বিষয়ের শিক্ষকদের মতোন। শিরিন খানিক চুপ থেকে হয়তো দম নেয়, তারপরই সে উত্তর দেয়, আমি একজন আদর্শ মা হতে চাই স্যার! একেবারে কবরের নিরবতা তখন, আমরা হাসবো না কাঁদবো এমন পরিস্থিতে স্যারও এক প্রকার বোবা হয়ে গেলেন বোধহয়। পেছন থেকে আশিক, যে কি না অষ্টম শ্রেণিতেই তিনবার ফেল করে আদুভাইয়ের নামকে আমাদের বাপদাদার আমলের পর আরেকবার স্মরণ করেই ছাড়ে যেন সেÑ গা-গতরে আমাদের চেয়ে বেশ এগিয়ে, সে-ই দাঁড়িয়ে সিনা টানটান করে বলে, স্যার, আমি শিরিনের সন্তানের আর্দশ পিতা হতে চাই! এবার আর পায় কে? আমাদের কৈশোরের জমাটবাঁধা হাসির দলাটা একেবারে ন্যাংটো হয়ে যায়, স্যারের কড়া মেজাজ আর টেবিলে রাখা বেত উপেক্ষা করে। শিরিনও তখন হাসিতে বেসামাল, স্যারও! এক পর্ব হাসি সেরে পাশের জনের দিকে তাকাই, সে হাসছে, চলমান হাসি দিয়েই সে তাকাচ্ছে শিরিনের দিকে। হয়তো তখন থেকেই আমাদের বোধে প্রেম জাগ্রত হতে থাকে, বিশেষ করে ভিন্ন লিঙ্গের প্রতি। স্যারের মেজাজেও সেদিনের পর থেকে আমূল পরিবর্তন দেখতে পাই আমরা। তিনি আগের মতো পেটান না, বেঞ্চে দাঁড় করান না অকারণে। অথচ শিরিন বেচারি টানা তিনদিন স্কুলে না এলে আমাদের পরানে কে যেন এঁকে দেয় কবিতার এমন লাইনÑ ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।’ আশিকের মনেও কি এমন বোধ কেউ পলে পলে জাগরুক করাতো তখন! অপ্রকাশ্য যাই থাক এতোদিনের, আশিকই উসকে দিল মুহূর্তেÑ সেখান থেকে আমাদের অষ্টমশ্রেণিপড়ৃয়া মনে হঠাৎ করে প্রেম আমদানি হয়, বিনা নোটিশে। তারও বছর দুয়েক পরে আমি পড়ে উঠিÑ ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি,/ বোলোনাকে কথা ওই যুবকের সাথে;/ ফিরে এসো সুরঞ্জনা:/ নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;/ ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;/ ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;/ দূর থেকে দূরেÑ আরো দূরে/ যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর।’ প্রেম করলে কি মানুষ স্বার্থপর হয়ে যায়? একান্তই নিজের করে চায় সবটুকু? কিংবা যুবকের সাথে কথা বললেই কি প্রেম ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে? যুবতি যেতে চায় যাক না, যুবকের প্রতি প্রতিহিংসাই এমন কথা? সম্ভবত প্রেমিকই চায় না, তার প্রেমিকা অন্যের সাথে যাক, অন্যের হাত ধরে হাঁটুক। হৃদয়ের অবারিত আবেগ আর জোড়-বাসনার ফলেই তো প্রেম! ‘প্রেম আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর’Ñ এমন বাণী আমাদের কানে এসেছে সেই কবে! প্রেমের জন্য আত্মহত্যা, ভালোবাসার দাবি আদায়ে আমরণ অনশনের কাহিনিতে ভরা আমাদের দৈনিক, আমরা প্রেম শিখি, চালাক হই। অথচ তারো আগে ক্লাসরুমেই পড়ে উঠিÑ ‘আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।/ যে মোরে করিল পথের বিবাগী;/ পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;/ দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;/ আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।’ যুবতি যাক না তবে যুবকের সাথে! ভয় কেন যুবকের? প্রেমিকহৃদয় বড় বেশি স্বাস্থ্যবান, বড় বেশি কৃপন। তার যাপনের সবটুকু অন্যে নিয়ে যাক, তার পার্থিবতায় ভাগ বসাক অন্য পুরুষÑ হোক সহোদর কি আত্মজ অথচ যুবতিকে, আরো স্পষ্ট করে বললে প্রেমিকার ওদিকে যাওয়াই তার প্রাণে সয় না, কেঁপে কেঁপে ওঠে যেনবা, বিশ^াস আর অবিশ^াসের দোলাচলে নির্মাণ করতে থাকে প্রেমের কোরাস।
এখন, বলা যায়Ñ প্রেমের আকালে আমাদের সমুখে পৃথিবীব্যাপি দৃশ্যমান হতে থাকে প্রেমহীন হৃদয়ের তান্ডব। ধ্বংস আর রক্তের হুলিখেলায় কে কত বড় মোড়ল তারই নিয়মিত প্রচার হয় সংবাদ মাধ্যমগুলোয়। দেশহীন মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে, উদ্বাস্তুদের বেশুমার আহাজারিতে, সাগর পাড়ি আর প্রাকৃতিক ঝড়ে মারা পড়ছে কত মানুষ! ভালোবাসার অভাবে এমন পরিস্থিতে কেঁদে ওঠে যেকোন মানবিক মানুষ। কবি হয়তো রুমের আধো আঁধারে, নিজেরই ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলেÑ ‘আমার এখন লাশের ঋতু লাশের বারোমাসÑ/ ডুব সাঁতারে বাঁচার ইচ্ছে প্রাণান্ত হাঁসফাঁস/ ছায়ার বেশে আসছে ধেয়ে মৃত্যু পরোয়ানা,/ শিশির ভেজা ঘাসের রৌদ্র মিথ্যে ষোল আনা।’ ভেতরের মানুষটি বড় স্বার্থপর হয়ে গেছে এখন, নিজের প্রতিই নেই প্রেম। আপন প্রেমের অভাব যার অন্তরে সে অপরকে ভালোবাসে কিভাবে? প্রথমে নিজেকে ভালোবাসা চাই, তারপর পরিবার, প্রতিবেশ, সমাজ এমনকি তা দেশ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে পৃথিবীর সকল মানুষের দুয়ারে। অথচ আমাদেরই সুদৃশ্য ফ্ল্যাটের পাশে গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম! কি নির্মম আমাদের সময়! কতোটা অমানবিক হলে আমাদের ঘর হতে পারে মা-বাবাশূন্য? এরকম বাস্তবতার মাঝেই আমরা প্রেমিক হচ্ছি সময়ের তুচ্ছ মোহের। ক্রমশ কমে যাচ্ছে শ্রদ্ধাবোধ, গোপনীয়তার আড়াল। প্রাযুক্তিক সুবিধা আরো গোঁয়ার করে তুলছে আমাদের। সম্পর্ক হচ্ছে দ্রুত, ভাঙছে আরো দ্রুত। পারস্পরিক বোঝাপড়ার আগেই জীবনের খেরোখাতায় যোগ হতে থাকে তিক্ততা, বাড়ছে হৃদয়ঘটিত মৃত্যু। পেছনে তাকালে দেখি, সভ্যতার অগ্রগতি, দারুন সব আবিষ্কার, জীবনকে উপভোগ করার নানা উপকরণ। অথচ ভালোবাসার জগতটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে তার দিকে নজর দিয়েছি কেউ? মা তার আদরের সন্তানকে, সন্তান তার মা-বাবাকে খুন করছে, এরকম সম্পর্কের বাইরে তো অহরহ অবিশ^াস্য কা- প্রতিদিন দেখা যায় দৈনিকের পাতায়। আইন-আদালত সবই থাক, মনের আদালতটি যদি অপবিত্র হয়ে যায় কোন কারণে, কালিমা যদি পড়ে যায় কোন অজুহাতেÑ তা বাড়তে থাকে। পরিবারের আয়তন ভেদ করে তা এখন পৃথিবীর সর্বপ্রান্তেÑ কত নামে, কত গোষ্ঠির আবরণে।


‘তোমার নয়ন হতে এক বিন্দু তপ্ত অশ্রুজল,/ আমারে দানিলে বন্ধু! জীবনের পাথেয় সম্বল।/ তোমার অন্তর হতে উৎসারিত অমৃত মাধুরী/ দিল মোর রিক্ততারে ভরি।/ লভিনু পরম ধন। মোর রিক্ত জীবনের দিন/ সার্থক সুন্দর হল কী দিয়া শুধিব এর ঋণ?’ ভালোবাসার এ ঋণ শোধ হয় না বলেই তাজমহল দাঁড়িয়ে থাকে ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে। শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃঞ্চ, ইউসুফ-জুলেখা প্রমুখ জুটির খবর বাসি হয় না; উল্টো ভার্সিটি ক্যাম্পাসে সহপাঠীরা কারো কারো প্রেমকে ভিন্ন সব নামে ডাকতে শুরু করে। তাতে কিছুই হয় না কারো, তবে প্রেমের পরম্পরাকে সামনে নিয়ে আসে প্রজন্মেরই প্রেমিকেরা। পার্কে-বিনোদন কেন্দ্রে-প্রাকৃতির সান্নিধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকারা হারিয়ে যায়। মিতালি করে প্রকৃতির সাথে। কখনোসখনো মনের প্রেম অতীত হয়ে শরীরে মজে যায় কেউবা। প্রেম অনুভবের, প্রেম হৃদয়েরÑ এমন কথার প্রেক্ষিতে কেউ বলবে, প্রেম শরীরনির্ভর চাহিদা। শরীর ছাড়া মনের অস্তিস্থ কেউ যেমন কল্পনা করতে পারে না, মন ছাড়া শরীরেরও। পতিতা দেহ দেয় মন নয়, প্রেমিকা মন দেয়। জোরাজুরির অপ্রীতিকর কা-ে মন ভাঙে, হৃদয় চুরমার হয়ে যায়। হৃদয়ের যতœ নেয়ার মতো কঠিন কাজ জগতে কে করেছে! প্রেমিক-প্রেমিকাকে হরহামেশাই তা করতে হয়, কখনো অভিনয়ের নিপুনতায়, কখনো বাস্তবতার ঘেরাটোপে। কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেনÑ ‘তোমারে বন্দনা করি/ স্বপ্ন-সহচরী/ লো আমার অনাগত প্রিয়া,/ আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃঞ্চা-জাগানিয়া!/ তোমারে বন্দনা করি.../ হে আমার মানস-রঙ্গিণী,/ অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তর বাসনা-সঙ্গিনী!’ স্বপ্নের সহচর বা সহচরীকে কেমন যতœ করা চাই, তা ভুলে গেছে আমাদের সময়! প্রেম প্রেম খেলায়, ভ্যালেন্টাইন দিবসের প্রেক্ষিতে নিরবে কাঁদে কত মানুষ। কারো বিসর্জন, কারো বা বুঝতে না পারার বেদনাÑ এই অপার অসংজ্ঞায়িত অনুভবের ভেতর দিয়ে দরোজায় কড়া নাড়ে ভালোবাসার দিবস। আলাদা দিবস লাগে না বলে যতই নাক চিটানো হোক, বাঙালি তো বটেই মানুষ মূলত উপলক্ষ না পেলে দাঁড়াতে চায় না। বাঙালির ভালোবাসার ইতিহাস জাতিয় জীবনের সাথে লেপ্টে থাকা রক্তেরই অনুবাদ। শেকড়কে ভালোবসার দায় আঁছড়ে পড়ে আমাদের অন্তরে, যেহেতু আমরা আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত, আমাদেরই আপনজনেরা ভ্রাতৃহন্তারকে পরিণত হচ্ছে দিনকে দিন। সুন্দর একটি হাসির সাথে কখনো তুলনা চলে না রাজ্য জয়ের, একটি বুক খালি করার বিনিময়ে অর্থের থলি বদল যেন আমাদের নিত্য কামনায় স্থান করে নিতে না পারে। এক জীবনে কী আর চাওয়ার থাকে? ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ এরচেয়ে বড় প্রার্থনা সঙ্গীত আর কী হতে পারে আমাদের! সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা, সৌহার্দ্যময় পরিবেশে জীবন যাপন করাটা হোক দীর্ঘ, বিয়োগের ব্যথায় নয়, মিলনের সুরে একিভূত হোক আকাক্সক্ষার সেতু।
গাছের শরীরে কৈশোরে দুষ্টমতি কেউ এঁকে দিত তার নামের সাথে যোগ চিহ্ন দিয়ে তারই ক্লাসে পড়–য়া পছন্দের বা নিচের-উপরের কারো নামের অক্ষর। রাস্তার ধুলোয়ও দেখা যেত এমনতর চিহ্ন। আহা, যদি একবার সে দেখে! একবার যদি তার নেকনজরে পড়ে! এই ধুলোমাখা আবেগ এখন বিদেয় নিয়েছে স্মার্টফোনের রাতজাগা সময়। চেনা নেই, জানা নেই, হৃদয়ের দরদাম করা নেইÑ টুপ করে হয়ে যায় যুগল! কেউবা অনেককেই একসাথে ধরে রাখে প্রেমের সম্পর্ক নামক জালে। আর্ন্তজালিক এ জ¦ালাময় বিভায় আমাদের প্রেম এখন অনেকটাই এমনÑ ‘সুরঞ্জনা,/ তোমার হৃদয় আজ ঘাস/ বাতাসের ওপারে বাতাস/ আকাশের ওপারে আকাশ।’ আকাশের ঠিকানায় চিঠি না লেখুক, ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে না রাখুক তবুও ঠিকানাহীন হচ্ছে সময়ের মানুষের মানুষগুলো। আবেগের বাড়াবাড়িতে গদগদ হয়ে হাতে-পায়ে ধরতে গিয়ে দিব্যি ভুলে যাই মনে ধরার কথা। অথচ মানুষের চেয়ে বড়, মানুষের চেয়ে মহিয়ান আছে আর কে? এরচেয়ে বড় জাদুকর আর কে হতে পারে তবে? ‘সে তোমার পাওনা এতটুকু পরোয়া করে না,/ খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানোর ইচ্ছায় দেখায়,/ ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,/ সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায়।/ এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভিতর।’ প্রেমিকের সুগন্ধি রুমালে জড়িয়ে থাকে প্রেমিকার নিঃশ^াসের সবটুকু, প্রেমিকার আঁচলে লুকিয়ে থাকে প্রেমিকের কবিতার খাতা। তা না হলে কেন এমন বলে কবিÑ ‘তোমার দু’হাত মেলে দেখিনি কখনো/ এখানে যে ফুটে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলাপ,/ তোমার দু’হাত মেলে দেখিনি কখনো/ এখানে যে লেখা আছে হৃদয়ে গাঢ় পঙক্তিগুলি।’ প্রেম করে কেউ কবি হয়, কেউবা বোবা, কেউবা চালাক। তবুও প্রেমিকের হৃদয়ের আর্তি এক পৃথিবীর স্পর্ধা নিয়ে আমাদের শোনায়Ñ ‘ভালোবাসতে বাসতে ফতুর হয়ে যাবো/ ভালোবাসতে বাসতে ফতুর করে দেব।’

ভালোবাসা থেকেই এই পৃথিবীর জন্ম। ভালোবাসা থেকেই আমাদের আগমন। অশান্ত পৃথিবীর বুক ভালোবাসায় ভরে উঠুক, প্রেমের বীণায় বাজুক তবে মিলনের সুর। আমাদের ছোট অথচ প্রেমময় জীবনটা হোক ভালোবাসাময়। পৃথিবীর কোন বালুচরে শিশুর লাশÑ আমার ভায়েরই লাশ! পৃথিবীর কোথাও লাঞ্চিত নারীর কান্নাÑ আমার বোনরেই আহাজারি! পৃথিবীর কোন স্বাধীন দেশের মানুষ গৃহহীন হওয়া মানেইÑ আমার সভ্যতার অপমান। আমাদের প্রথমে নিজেকে ভালোবাসতে হবে, তারপর অন্যকে। নিজের প্রতি, স্বজাতির প্রতি, স্বদেশের প্রতি, সমগ্র মানবজাতির প্রতি ভালোবাসই হোক আমাদের পরিচয়ের হাতিয়ার, চলনের মূলমন্ত্র। প্রকৃতিনিধনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই আমাদের ভালোবাসা, পরিবেশ রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতাই আমাদের ভালোবাসা, দেশের চালিকাশক্তিগুলো ঠিক রাখাই আমাদের ভালোবাসা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেয়াই আমাদের ভালোবাসা। ¯্রষ্টা তো বলেই দিয়েছেন, তিনি জগতমাজারে বিরাজমান। তারই সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসাই হোক আমাদের অহংকার। কবি তাই বলেনÑ ‘তোমাকে দেখার ছলে যতোবার আকাশে তাকাই/ ততোবার দিগন্তের মেঘ এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সম্মুখে।’



 

গল্প- পায়েল

গল্প- পায়েল

পায়েল
নূরে জান্নাত

ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশার মাঝে অলৌকিক সব দৃশ্য ফুটে উঠছে। দক্ষিনের বাতাস মাটির সর্পিল পথে আচ্ছাদন করে রাখা সবুজ দুর্বার ডগাকে হালকা কাঁপিয়ে তুলছে। দুর্বা ডগায় লেগে থাকা শিশির বিন্দুগুলো হিরের মত ঝলক মেরে ওঠে মাঝে মাঝে। দেবদারুর পাকা কালচে বীজগুলো পাকপাখালির উপাদেয় খাদ্য হয়ে দাড়িয়েছে। সকালের সকাল টিফিন কেরিয়ার হাতে বেরিয়ে পরেছে গ্রাম থেকে শহরে কাজে যাওয়া মানুষ গুলো। আলমগীর নামের যুবকটিকে প্রতিদিন এ পথে দেখা যায়। মোড়গ ডাকা ভোরে দুই ফিতার স্যান্ডেল, কাধে গামছা রেখে চট চট শব্দ করে পায়ে হেটে এগিয়ে চলে উপার্জনের উদ্দেশ্যে। খুব বেশিদিন হয়নি আলমগীরের বিয়ের বয়স। কাজের ফাকে ফাকে বার বার তার স্ত্রীর সুখটা স্বরনে এবরো থেবরো মচকা দাতে হেসে নেয়। হালকা পাতলা কুচকুচে কালো তার স্ত্রীর গায়ের রঙ। নাকে ফুর ফুর করে নেচে বেরানো নথ, সাদা দাতের হাসি, চুলের গুমোট গন্ধ, গোপন সৌন্দর্য, স্ত্রীর নরম হাতের পর্শ আলমগীরের কর্মোদ্দাম বাড়িয়ে দেয়। স্ত্রীর ভালবাসা থাকায় তার কাছে কাঠ ফাটা রোদ্দুরেও ক্লান্তি আসে না। কাজ শেষে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরার সময় ৮ টাকা দামের এমি ¯েœা, আতরের কৌটো, গন্ধরাজ তেল, সুগন্ধী সাবান মাঝে মাঝে তার হাতে দেখা যায়। আলমগীরের চাচাতো বোন ফুলীর জানার খুব ইচ্ছে আলমগীর তার স্ত্রীকে যে ভিউকার্ড গুলো এনে দেয় তাতে কি এমন আছে যা দেখে তার স্ত্রী ওভাবে হেসে ঢলে পরে? কি আছে ও ভিউকার্ডে?
ধীতপুর কানু গ্রামের সর্পিল মেঠো পথে শিশির সিক্ত দুর্বার চাদরে প্রায়ই পায়ের চিহ্ন দেখা যায়। আলমগীরের জানার ভীষণ ইচ্ছে চিহ্ন গুলো কার? একই রকম চিহ্ন একই ভঙ্গিতে পরে থাকে সবুজ মখমলে। কে হতে পারে এ পথে হেটে যাওয়া পদ চিহ্নের অধিকারী? কোন নারী, পুরুষ, নাকী ভূত? ভূতের তো পা থাকে না তবে কেমন করে পায়ের চিহ্ন আসবে?
ঠিক যে সময়ে কাজে যাবার কথা শুক্রবারে তার থেকে আরো সকাল করে বের হয় আলমগীর। পথে খুজতে থাকে পায়ের চিহ্ন। কেমন যেন ও চিহ্ন দেখতে দেখতে তার নেশাতে পরিণত হয়েছে। আলমগীর বিস্ময়ে পদ চিহ্নের পাশে পরে থাকা কটা শিউলী ফুল কুড়িয়ে গামছার গিটে রেখে দেয়। তবে কি কোন দেবী, লক্ষী নাকি পরীর পদ চিহ্ন?
রাতে আালমগীরের স্ত্রী ¯েœা মাখিয়ে, মোটা করে চোখে কাজল এঁকে, মাথায় চিপচিপে তেল দিয়ে প্লেন খোপা করে। কালো হাতে টকুটুকে লাল চুড়ি, খুব একটা মানায়নি, ঠোটে লাল লিপিস্টিকটার জন্য ভয়ংকর লাগছে। তবুও সে নির্দ্বিধায় স্বামীর সামনে এসে দাড়াতেই স্বামী তাকে বুকে টেনে নিয়ে-----

তুই আমার সব থেইকা সোন্দোর বউ।
আলমগীরের স্ত্রী লজ্জামাখা মুখে-
কি কন এগনাল? কালীমুত্তির মত দেহা যায়।
বউ তুই কি তুই নিজেও জানোস না। আমার চোখ খান খুইলা তোর চোহে নাগা, দেকপার পারবি তুই কত সোন্দর দেকতি। আর কালি মুত্তি হোলিও মুত্তি তো মুত্তিই। (মূলত আলমগীর এখানে প্রতিমা শব্দটির ব্যবহার বা প্রতিমার মূল্য বোঝাতে চেয়েছে)
টুকটাক কথপকথোন শেষে আলমগীর স্ত্রীকে বলে বসে-
দে তোর পাউ দে।
ক্যা?
দিবার কইতাছি, দে...।
দিমু না।
ছেরি বেশি বুজবিনা কইলাম, পাউদে.....?
অনেক সংকোচে আলমগীরের স্ত্রী পা বাড়ায়। আলমগীর আলতার কৌটোর মুখ খুলে নিজের হাতে স্ত্রীর পায়ে আলতা লাগানো শেষে গামছার গিট খুলে শুকিয়ে যাওয়া শিউলী ফুল গুলো পায়ের কাছে রেখে-
নে বউ, তোরে দেবির পায়ের ছাপের কাছে পাওয়া ফুল দিয়া পূজা দিলাম।
আলমগীরের স্ত্রী লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে-
আমার ফুল লাইগবোনা, আহ্্নেই আমার সব থেইকা বড় ফুল।

স্বামী স্ত্রীর মাখা মাখা ভালবাসার নীরব স্বাক্ষী হয়ে থাকে রাতের অন্ধকার, আকাশের তারা, জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকা বেড়েওঠা কাঠাল চারা, মরচে পরা টিনের ফুটো দিয়ে হুমরি খেয়ে পরা চাঁদের আলো, ঝিরিঝিরি বাতাসে নরে ওঠা গাছের পাতা, জোনাকির নিভু নিভু আলো, গাছের ঝোপে বসে থাকা নিশাচর।
পরদিন সকালে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দকেও উপেক্ষা করে আলমগীরদের চাপ কলের শব্দ। কলের পারে আলমগীর ও তার স্ত্রীকে একেবারে বৃষ্টি ভেজা দুটো চড়ুইয়ের মত লাগছিল। স্বামীর প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে নিলে ঘারের উপর ঝুলে আসা ভেজা চুল থেকে টপ টপ করে কয়েক ফোটা পানি পরে।
কিিদন হলো দুর্বা ঘাসে পায়ের চিহ্ন না দেখতে পেয়ে আলমগীরের মনটা বিষন্নতা ঘিরে ফেলে। তার ভাবনা মূখর মুখটা দেখে স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে-
কি অইছে? চুপ তাকেন ক্যা? কামের উহুনে কিছু অইছে?
আলমগীর দীর্ঘশ^াসে-
নারে, আমার মন বালা না।
ক্যা?
বেশি প্যাচর না হইরা গুমা গা যা।
গুমাইতাছি, তাইলে পেরতেক আইতের মতন আইজো আমারে সোনা বউ কইয়া ডাহেন?
আলমগীরের চোখে পায়ের চিহ্ন ভাসতে থাকে, দেঘল কালো এলোকেশী, পায়ে মল পরা আলতার রঙে ঝলকানী দিয়ে হেটে যাচ্ছে...........আস্তে আস্তে। আকাশ থেকে নেমে সিড়িতে পা রাখে, শাড়ীর আচল উড়ে ওঠে, মুখটা পুরো দেখা না গেলেও ডান চোখের পাশের তিল, আর নাকের ঝোলানো নথটা দেখা যায়। সিড়িটা শূন্যে মিলিয়ে যায়। আলমগীর দীর্ঘ শ^াস ফেলে বিছানায় খেয়াল করে দেখে এত তারাতাড়ি তার স্ত্রী ঘুমিয়ে পরেছে।
কাজে যাবার সময়ের অনেক আগেই টিফিন কেরিয়ার হাতে আনমনে পথ হাটছে আলমগীর। না দেখতে পেয়ে পেয়ে পায়ের চিহ্ন দেখার লোভটা খুব একটা নেই। ভুলেই গিয়েছে স্বর্গীয় দেবির কথা। পায়ের চিহ্ন!
আলমগীর চমকে ওঠে। বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচর দিয়ে ব্যাথ্যা করে ওঠে। টিফিন কেরিয়ার মাটিতে রেখে পদ চিহ্নটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে নেয়। চিহ্নের রেশ ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পদ চিহ্নের কোনো হোদিস না পেয়ে আশে পাশে চোখ বুলাতে থাকে। মাটির রাস্তা থেকে একটু দুরে কাঠ বাগানের মধ্যে শিউলীফুল তলায় কেউ একজন ফুল কুড়াচ্ছে। তবে কি...?
আলমগীর আগ্রহে এগিয়ে যায়। উজ্জল শ্যাম বর্ণের লম্বাটে এলোকেশী হালকা পাতলা গড়নের চঞ্চল এক কিশোরী গভীর মনযোগে মেহেদী রাঙ্গা আঙ্গুল দিয়ে পরম যতেœ মাটি থেকে একটি একটি করে শিউলী ফুল কুড়িয়ে ওরনার কোচে রাখছে। ফুল কুড়ানো শেষে দাড়িয়ে ঘুরে উঠতেই ফুলওয়ালী আলমগীরকে সামনে দেখে চিৎকার করে কোচের সব ফুল ফেলে ছুটে পালিয়ে যায়। আলমগীরকে দেখে ফুলওয়ালী ভয় পাওয়ায় আলমগীরের ভেতরটা পুরতে থাকে। কাজে গিয়ে সেদিন সারাটা বেলা চোখে ফুলওয়ালীর ভয় পাওয়া মুখটা ভাসতে থাকে। কাজকর্ম কোন দিকে খেয়াল থাকে না। আচমকা হাতুরীর বাড়িতে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ফেটে রক্ত পড়তে থাকে। বাড়ি ফিরে ভীষণ ভাবে কোকাতে থাকে। রাত গভীর হয়, দুর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে, কুকুর গুলোর অহেতুক ঘেউ ঘেউ রাতের নিস্তবদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। জানালার ফাক দিয়ে আসা চাঁদের আলোতে আলমগীর ফুলওয়ালীকে দেখতে পায়। আস্তে আস্তে ফুল ওয়ালীর পোশাক বদলে যায়। দেবীর সাজে সজ্জিত হয়ে ডাকতে থাকে আলমগীর কে। আলমগীর জানালার পাশে গিয়ে দাড়াতেই এক পলকে আশে পাশের সব কিছু বদলে যায় শিউলী ফুলের বাগানে অসংখ্য দেবী ফুল কুড়াচ্ছে।.....।
আলমগীরকে যেন তারা দেখতেই পাচ্ছে না। সবার কাছে আলমগীর ফকিরের মত হাত পাতে কটা শিউলীফুল নিতে। কেউই আলমগীরের ফাকা হাত ভড়িয়ে দেয় না শিউলী ফুলে। খালি হাতে ক্ষুন্ন মনে আলমগীরকে ফিরতে দেখে সবচেয়ে কম সুন্দরী, জীর্নসীর্ন পোশাক পরা মুখ ঢাকা এক ললনা আলমগীরকে ডেকে দুহাত ভরিয়ে দেয় শিউলীফুলে। আমলগীরের ভীষন মায়া হয় ফুলদানকারী ললনার প্রতি। অনুরোধ করে বলে ওঠে-
কেডা তুমি? এত দয়া তোমার মনে? দেহাও না তোমার মুকখান? খুব সাধ যে ও মুক দেহার।
মুখ থেকে ঘুমটা সরাতেই আলমগীরের চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। এযে আর কেউ না তার স্ত্রী। চোখ খুলে দেখে তার স্ত্রী নিষ্ঠার সাথে মাথায় জল পট্টি দিয়েই চলছে।
দিন আসে দিন যায়। আলমগীরের স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী। সারাদিন কাজ শেষে গ্রাম্য হাটখোলা থেকে গামছার গাটে বেধে চাল, ডাল, লবন কাধে করে বাড়ি ফেরে। আলমগীরদের জীবন মানে বাচ্চা উৎপাদন, সারাদিন খেটে খেটে সন্ধ্যেয় বাজার হাতে বাড়ি ফেরা, পরেরদিন কাজে যাবার প্রস্তুতি। কাজে যাওয়া ঘরে ফেরা পর্যন্ত তাদের সীমানা। আজ আর আলমগীর পায়ে হেটে কাজে যাবে না। অটোর অপেক্ষায় মেইন রোডে দাড়িয়ে। অটো এলে আলমগীর বসে পরে। অটো চলতে নিয়ে থেমে যায়।


ধান ক্ষেতের পানিতে পা ধুয়ে কোনো রকমের জুতোটা পায়ে দিয়ে স্কুল ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে এক কিশোরী হাপাতে হাপাতে অটোতে এসে বসে। আলমগীর হা করে কিশোরীর দিকে চেয়ে থাকে। মুখের দিক থেকে চোখ সরিয়ে বার বার কিশোরীর পায়ের  দিকে তাকানো দেখে কিশোরী খেয়াল করে তার সালোয়ার গীরা থেকে উপরে উঠে আছে। শিশিরের ভিজে যাওয়া থেকে বাচাতে কিশোরী গীরার উপরে গুটিয়ে রেখেছিল সালোয়ার। কিশোরী হাসির আড়ালে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করে, আস্তে সালোয়ার পায়ের পাতা পর্যন্ত নামিয়ে দেয়। কিছু পথ যাবার পর আলমগীর আবার কিশোরীর পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিশোরী বিরক্তবোধ করে। আলমগীর কিশোরীর বিরক্তমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আগবাড়িয়ে কথা বলে-
তোংগা বাড়ি আংগো গায়ে, তায়ন্যা?
কিশোরী বিরক্তিমাখা সুরে-
-জি?
হেদিন ভ্যানা তুমিই ফুলতালা ফুল খুইটপার আছিলা না?
-জি।
আমারে ডরাইছিলা, তাই দোর দিছিলা?
জি।
এহন কি ইকসুলে যেইত্যাছো?
হিহিহি.....না কলেজ যাচ্ছি। আপনি ইকসুল বল্লেন না উচ্চারণটা ভুল। শুদ্ধ উচ্চারণ হল ইশকুল বা স্কুল।
ও..... মুক্য মানুষতো অতো বুল ঠিক বুজিনা। এককান কতা কই, কিছু মাইন (মাইন্ড) হইরো না?
জি বলুন?
তোমার পায়ে ওডো কি পিন্দিছো?
কিশোরী পায়ের দিকে চেয়ে....
জুতো।
না না, ঐ যে একখান যে..?
কিশোরী বুঝতে না পারায় আলমগীর তার পায়ে হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিশোরী আলমগীর কে ভাসমান সেলাম করে হেসে পায়ের দিকে আঙ্গুলউচিয়ে-
এটা?
হ, ঐডো।
পায়ের গহনা।
বুচ্চি, ঐডো নিপুর, তা একখান পিন্দিছো ক্যা, আরেকখান কি আইরা (হারিয়ে) গ্যাছে?
নিপুর  অশুদ্ধ, শুদ্ধ উচ্চারণ হল নুপুর। আর আমি যেটা পরেছি এটা নুপুর নয়। এটাকে পায়েল বলে। পায়েল একটাই পরতে হয়।
কি জানি বাপু। দুনিয়ায় কত কি বাইরোইছে যে আল্লাই জানে!
হু, এখন অনেক কিছুই বেরিয়েছে, সব কিছু স্টাইলেস।
সব কিছু স্টিলের, কও কি? সোনা উপা নাই?
হিহিহি....উপা নয় রুপা হবে। সোনা রুপা আছে, আমি স্টিল বলিনি, স্টাইলেস বলেছি।
ও....তোমার পায়ের ওডো কত নাগে (লাগে) কিনতি?
একেকটার একেক দাম?
কোন থেকা কিনছো?
মুক্তা প্লাজার, রুপা স্টোর থেকে?
হেতা কোনে?
উফ.....এ তো প্রশ্ন কেন হ্যা?
আগ হইরো না, তোমার ভাবির নেইগা একখান কিনলামনী।
কে বারণ করেছে, কিনে নিন?
আলমগীর কোন কথা না বলে নেমে যাবার আগমূহুর্তে লুঙ্গীর ডোরের উল্টাপিঠে গুজে রাখা ১০০ টাকার নোট বের করে কিশোরীর ব্যাগের উপর দিয়ে-
আফামনি আমার, দয়া হইরা তোমার পায়ে পিন্দুইনা (পরিধান করা) অগুনা একখানা কিনা এইনা দিয়ো। আমাক কাইলদিন ভেনা ফুল তালার উহুনে পেইবা হেদিন যে সমায়ে পাছিলা।
আলমগীর এক মুহুর্ত দেরি না করে গটগটিয়ে চলে যায়। কিশোরী ভ্যাবা চ্যাকা খেয়ে ১০০ টাকার নোটের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। পরদিন সকালে ফুলতলায় আলমগীরের অপেক্ষা ব্যর্থ কিশোরীর না আসার ফলে। পরপর এভাবে তিনদিন আলমগীর ফুলতলায় অপক্ষো করে। কিন্তু কিশোরীর কোন হোদিস নেই। আলমগীরকে আজ একটু বেশিই রাগান্বিত মনে হচ্ছে। রাতের খাবার খেতে খেতে স্ত্রীকে স্বাক্ষী করে-
জানোস বউ মাইনসের চোপা দেইহা বিশ^াস হরতে নাই।
ক্যা কি অইছে?
হালা মিয়া নোক যে এত খারাপ জাইনতাম না। থুঃ, ফহিন্নির জাত- কোনহানকার। বাপের জন্মে ট্যাহা দেহে নাই।
কেডা ট্যাহা দেহে নাই?
ঐ বদ সোন্দোর ছেমরি ডা।
মাইনে? তুমি কি কোনে মিয়ার নগে পেম হরো?
মাতায় গুমার তুলবিনা কইলাম। না জেইনা একখান কতা কলি? তোর নেয়গা পায়ে পেন্দার গয়না কেনার জইন্যে ঐ ছেমরিরে ১০০ ট্যাহা দিছিলাম। হের পরের থন হাওয়া, কুনাহানি নেইংকা। বজ্জাদের বেডি বজ্জাত ছেরি।
পঞ্চম দিনের দিন যে সময় আলমগীর আশা ছেরে দেয় তার স্ত্রীর পায়ে গহনা পড়ানোর ঠিক সে সময় পথের মাঝে কলেজ থেকে ফেরার পথে আলমগীরের সাথে কিশোরীর দেখা হয়ে যায়। আলমগীর ঠিক করে কিশোরী সামনে এলে জুতো খুলে পিটাবে আচ্ছামত। তারপর যে বিচার হয় হবে। কিশোরীর জন্য তার স্ত্রীকে পায়ে গহনা পরানোর স্বপ্ন বার বার দেখানোর পর ও বাস্তবে রুপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিশোরী আলমগীরের কাছাকাছি আসতেই আলমগীর তার ডান পায়ের স্যান্ডেল খুলে ফেলে। কিশোরীকে আঘাত করবে করবে শব্দে কিশোরী বাস কাগজে মোরানো একটা প্যাকেট আলমগীরের দিকে তুলে ধরে। আমগীর স্যান্ডেল ফেলে দিয়ে প্যাকেট টি হাতে নেয়। কিশোরী জিজ্ঞাসা করে-
জুতো হাতে নিয়েছিলন কেন?
আলমগীর থতোমত খেয়ে-
্ওই কইয়ো না, জুতার ফিতাহান হারার জন্যে নিছিলাম। তা প্যাকেডের মদ্যে কি?
পায়েল।
মাইনে?
পায়ের পরার গহনা যেটি আমায় কিনতে দিয়েছিলেন। দেরি হলো আপনাকে দিতে। আসলে একদিন কলেজ বন্ধ ছিলোতো তাই যাওয়া হয়নি। কিছু মনে নেবেন না।
আলমগীর নিজেকে মনে মনে অপরাধী ভাবে। কিশোরীর সম্পর্কে যা নয় তাই ভেবেছিল। তার ভাবনা পুরোটা ভুল প্রমাণ হয়ে গেলো রাতে বাস কাগজের প্যাকেট খোলার পর। অবাক ব্যাপার পায়েলতো আছেই সঙ্গে ১০০ টাকার নোটটি অক্ষত আছে। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের বাইরে থেকে একরকম ভাবা হলেও ভেতরটা একেবারে ভিন্ন রকম, সবার থেকে আলাদা।


ফোন কানে অন্যপ্রান্ত থেকে দেওয়া ডিরেকশন মনযোগে শুনছে........
“শোন টুকুটুকে নীল জরজেট শাড়ী পরবে। সুন্দর করে চোখ আঁকাবে। হাত ভর্তি নীল কাছের চুড়ি পরবে। চুলটা পাম্পিং করবে মাথার উপর দিকটায়, বাকিটা ছেরে দেওয়া থাকবে। শ্যাম্পু করা সিল্কি যেন থাকে চুল। আমার আঙ্গুলে একটু জট বাধলে না এক দম ন্যাড়া করে দেবো। দরকার পরলে পাঁচটা কন্ডিশনার মাখবে। ব্লাউজের গলাটায় যেন কলার থাকে। ইশ তুমিতো আবার লিপিস্টিক, মেকাপ, টিপ, নেইলপলিশ, আইস্যাডো পছন্দ করো না। থাক এ চ্যাপ্টার বাদ দিলাম। ফ্লাট স্যান্ডেল পরবে, আর পায়ে যেন আলতা থাকে, হাতের আঙ্গুল গুলোতেও। আঙ্গুলে আলতা না থাকলে না কেটে ফেলবো, একদম আঙ্গুল কেটে ফেবো বুঝেছো। আর শোনো কানে ঝোলা দুল পরবে। এই না না তুমিতো আবার ঝোলা টাইপের দুল পছন্দ করো না। ঠিক আছে নীল স্টোনের টপ পোরো। হাতের পার্স, ডাইরি, কলম, রুমালটাও নীল হওয়া চাই। মনে থাকে যেন, আগামিদিন তিনটেয় ট্রেন থেকে নেমে প্রথমেই তোমাকে দেখতে চাই। এক মিনিট এদিক সেদিক হলে.... আমাকেতো চেনোই।
ওপাশে ফোনে এতক্ষণ যে কথাবলছিল সে হলো সুহৃদ। ৩৭তম বিসিএস এ উত্তীর্ন হয়ে আগামী দিন গ্রামে ফিরছে। এ পাশ থেকে কথাগুলো গভীর মনযোগে যে শুনছিল সে হলো গ্রামের চঞ্চলা কলেজ পড়ুয়া কিশোরী সুনয়না। সুহৃদ সুনয়নার সম্পর্ক হবু স্বামী স্ত্রী। সুহৃদ সুনয়নাকে পাগলের মত ভালোবাসে। কথায় কথায় হুমকি দেওয়া সুহৃদ সুনয়নার প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
ষ্টেশনে অপেক্ষমান নীল শাড়ী পরা রমনীর দিকে সবার চোখ। হাত ভর্তি নীল গোলাপ, চুড়ি, শাড়ী সব কিছু নীল। মাইকে এনাউন্স শুনে উঠে দারায় সুনয়না। ষ্টেশনে ট্রেন থামে। ফাস্টক্লাশ কামরার দিকে এগিয়ে গিয়ে ট্রেনের দরজায় চোখ রাখে। তাকে দেখতে পয়েছে। নীল জীন্স, নীল শার্ট, নীল গ্লাস চোখে, হাতে নীল ঘড়ি, নীল ট্রলিব্যাগের হাতল টেনে সুনয়নার দিকে এগিয়ে আসে সুঠাম সুপুরুষ। বাতাসে সুনয়নার চুল গুলো উড়ে ওঠে , সঙ্গে শাড়ীর আচল। সুহাদর চোখে লাগানো গ্লাসের আড়ালে চুপি সারে প্রাণ ভরে দেখে নেয় ও প্রিয় মুখ। ঠিক যেন কোন নীল পড়ি তার জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনের সবাই, ট্রেনের সকল যাত্রী বিষ্ময়ের চোখে দেখছিল নীল জুটিটিকে।!! একে বারে পারফেক্ট। সুনয়না সুহদর হাতে ফুলগুলো তুলে দেয়। সুহৃদ ফুল গুলো বুকের সাথে জড়িয়ে গালের সাথে লাগিয়ে চুমো আঁকে ও ফুলে বহুবার। পুনারায় ফুলগুলো সুনয়নার হাতে দিয়ে প্লাটফর্মে বসে পরে। নিজের হাটুর উপর সুনয়নার পা চায়তে সুনয়না সংকোচ করলে সুহৃদ সুনয়নার দিকে বড় বড় চোখে চাইতেই লাজ লজ্জা ফেলে সুহৃদর হাটুতে পা রাখে সুনয়না। সুহৃদ বুক পাকেট থেকে নীল পাথরের একটি পায়েল বের করে পরিয়ে দেয় সুনয়নার পায়ে। ডান পায়ের গীরার নীচের তিল টা মাদকতাময় সুন্দর। এক হাতে ট্রলির হাতল, গোলাপতোরা, অন্য হাতে সুনয়নার হাত ধরে স্টেশনকে পেছনে রেখে আসে তারা দুজন। গাড়িতে পাশাপাশি, গা ঘেসে বসা, হাতে হাত রাখা অথচ কারো মুখে কোন কথা নেই।
অনেক্ষন পর সুহৃদ জিজ্ঞাসা করে-
কেমন আছ সোনা বউ আমার?
সুনয়না লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলে। সুহৃদ সুনয়নার চিবুক ধরে মুখটা উপরদিকে তুলে-
কি বৌ, উত্তর পেলাম না?
ভালো, আপনি?
এতক্ষণ ভাল ছিলামনা, শুধু আতœাটা ছটফট ছটফট করছিল। কখন আমার পিচ্চি বউ কে দেখবো। এখন আমি এত্ত ভালো আছি বলে বোঝাতে পারব না।
তাই?
হ্যা।
কি করে বুঝলেন আমি আপনার কাছে এমন কিছুই আশা করেছিলাম?
যেমন?
পায়েল।
ও....হা....হা....হা...তুমি এখনো এত বোকা?
মোটেও না আমি অনেক ক্লেভার।
সুহৃদ সুনয়নার নাক টিপে তোতলামো করে বলতে থাকে-
ওলে বাবালে, আমাল পিচ্চি বউ নাকি ক্লেভারের ডিব্বা! হা....হা...হা..
সুনয়না সিরিয়াস হয়ে-
হাসি থামান, কি বিশ্রি উদ্ভট স্টাইলে হাসেন আপনি।
হা....হা....হা...তাই?
জি, বল্লেন নাতো কি করে বুঝলেন পা...য়ে...ল?
তুমি ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছিলে না, গ্রাম্য আলমগীরের স্ত্রীর জন্য পায়েল কিনতে গিয়ে তোমার পায়ে পরা পায়েলের মত পায়েল খুজে না পাওয়ায় নিজের পায়েলটাই দিয়ে দিয়েছো। তাই ভাবলাম....।
জানেন ঐ পায়েলটা দিতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো।
কেন?
ওটা ছিলো আপনার দেওয়া আমাকে প্রথম উপহার। ওটার সাথে আপনার ছোঁয়া ছিল।
রিলেশনের প্রথমটা পায়েল দিয়ে, শেষটাও পায়েল দিয়ে অদ্ভুত না!
শেষ মানে, রিলেশনের শেষ মানে কি?
সুহৃদ সুনয়নার মাথায় খোচা দিয়ে-
আরে বুদ্ধ আমরাতো রিলেশনে থাকছিনা, এবার সংসার জীবনে ইলভল্ব হচ্ছি।

সমাপ্ত


পদাবলি

পদাবলি


আমাকে একা ফেলে
রেবেকা ইসলাম

পড়ি মরি করে দ্রুত দৌড়ে এসেও
অহংকারী ট্রেনটাকে ধরা গেলনা
চলে গেল, হ্যাঁ সে চলে গেল
দাম্ভিকতার ধূলিকণা ছড়িয়ে
অবহেলার হুইসেল বাজাতে বাজাতে
অবজ্ঞার ধূসর ঝড় উড়িয়ে
কালো মিশমিশে ধোঁয়ার কু-লী পাকিয়ে
আমাকে ব্যঙ্গ করে, উপহাসেরঅট্টহাসি হেসে।
আমার মুষ্ঠিবদ্ধ আঙ্গুলগুলো শিথিল হয়ে এলো
নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ক্রমাগত ওঠানামা
উষ্ণ গরম, ওতে চৈত্র মাসের উত্তাপ
বুকের মরু ভূমিতে সারি সারি যন্ত্রণার ক্যাকটাস
দুচোখে হতাশার টুকরো টুকরো মেঘ
একটা সময় ট্রেনটা রেখায় রূপ নিল
তারপর ছোট্ট একটি বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল
আমাকে একা ফেলে, এই জং ধরা জংশনে।

আলোর বিপরীতে
লুৎফুন নাহার লোপা

তুমি ভালোবাসো বলে
নিঃসঙ্গ পুকুরটায় ডুবে যায় মাছ,
তার পরিমাপকৃত জলে ভেসে উঠে
কোন জ্যোৎস্না রাতের অশান্ত প্রতিচ্ছবি,
যখন মাটির ভেতরে প্রবাহিত হয়
অদেখা তার গোপন সমুদ্রের কথা।

আকাশের ঝরে পরা জল এখনো
মিশে যায় গজারির নিভৃত বনে;
তুমি ভালোবাসো বলে
রাত হয় দিনের অজানা অভিপ্রায়,
পাখির ডানায় ওড়ে পরিচিত সুখ,
এখনো কষ্ট হয় মানুষের মৌনতায়
দীর্ঘকাল কেটে যায় আলোর বিপরীতে।

বছর পাঁচেক পর
মাইশা রুহী

আজ বছর পাঁচেক পর-
আমার ভালোবাসা তোমার জেলখানা...

নিজ থেকেই তো এসেছিলে;
ভালোই তো বেসেছিলে;
হঠাৎ মুক্তির আবেদনপত্র-
তোমার হাতে কেনো?

শুধু তো তোমাকে আগলে
রাখতে চেয়েছি! শুধু তো...
তোমাকে আপন করতে চেয়েছি।
তবুও ভালোবাসা না চেয়ে,
চেয়েছো মুক্তি... চেয়েছো স্বাধীনতা...
তুমিই বলো-
‘স্বাধীনতা মানে কি ভালোবাসা ছেড়ে
অন্য কাউকে খুঁজতে যাওয়া?’

পাঁচ বছর বসে বানানো ঘর এখন জেলখানা?


পরাজিত সুখ
লাভলী ইসলাম

প্রদীপের এতো আলো
অন্যের তরে জ্বালো

নিঃস্ব করে নিজেকে
জ্বালিয়ে অন্যের তরে
কি সুখ পাও কালো?
কি ভাবো অবসরে
কেন ভিজে চোখ,
হারিয়েও কেন পাও
পরাজয়ে সুখ !

তার নাম জপি
মাহবুবা নাছরিন শিশির

রাতে একা দিনে একা ভোরে একা গোরে একা,
দুপুরের সঙ্গী তোমরা দিয়োনা আর দেখা।
আমি জপি এক নামেতে সেও থাকে সদা একা
হৃদয়ে বাস করে সে তবু যায়না তারে দেখা।
এতদিন ভুল করে আমি খেয়েছি যে কত ধোকা
এতো কাছে বাস করে সে খুঁজিনি হায়! ছিলাম বোকা।
ঠেকে ঠেকে শেখে মানুষ আমার এবার হলো শেখা
পেয়ে গেছি সন্ধান তার থাক না সে থাক, থাক অদেখা।
যাকে স্তরে এই হৃদয়ে শান্তি নামে সুখের রেখা
সবার মনে দীপ্ত আভা ফুটে ওঠে ললাট লেখা!
যার নামে তসবি পড়ি যদি পেয়ে যাই তার দেখা
কী হবে মন, রিপুর তাড়ন, ভ্রষ্ট জীবন; জগৎ একা!


বইমেলার নতুন বই

বইমেলার নতুন বই
ইমেলার নতুন ব

গল্পে গল্পে ব্যাকরণ
যতীন সরকার



রূপান্তরের অর্থনীতি
মামুন রশীদ 

আগুনের একটি স্ফুলিঙ্গ চুপ করে বসে আছে
খালেদ হোসাইন



ছড়া করে মস্করা
সৈয়দ শরীফ
স্বল্প দৈর্ঘে্্যর গল্প
সোহেল নওরোজ
নিশি সুন্দরী
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ


হাওয়াই ডাঙা ট্রেন
বঙ্গ রাখাল

তুমি আমার শুদ্ধতম পাপ
হাবীবাহ্ নাসরীন
মুনিয়ানামা ও কয়েকটি ক্যাকটাস
তন্ময় আলমগীর





মহাদেশ- মহাকাল
সাজ্জাক হোসেন শিহাব

 

ECONOMIC PERSPECTIVE
ZAHID HUSSAIN

মনীষা বীক্ষণ ও অন্যান্য
বঙ্গ রাখাল


লিউ জিয়াবোর স্মরণে চায়না কবিতা- সমুদ্র উপাখ্যান

লিউ জিয়াবোর স্মরণে চায়না কবিতা- সমুদ্র উপাখ্যান


লিউ জিয়াবোর স্মরণে চায়না কবিতা
সমুদ্র উপাখ্যান

মূলঃ লিউ জিয়া
ইংলিশঃ মিং ডি
বাংলায় রুপান্তরঃ মীম মিজান


১.
সে সৈকতে হাঁটু গেরে
মাছ শিকারের একটি জাল বুনছে,
তার পেটটি উঁচু।
সে সাগর দেখার জন্য একটু জিরিয়ে নিলো,
একটি সাগর কী সীমাহীন! কোনো কিনারা নেই।
মাছ শিকারের জালটি তার দৃষ্টিকে বাঁধা দিল একটি ছোট্ট বর্গাকার ক্ষেত্রের দিকে।
সে একজন ধীবরের স্ত্রী।
সে সবসময় এই দ্বীপেই বসবাস করছে,
কখনোই বাইরে যায়নি।
তার একটি লালরংয়ের পোশাক আছে যেটি সে মাত্র একবারই পরেছে
মূল্য নির্দেশিকা এখনো লাগানোই আছে,
যেটি এখন বাক্সের একবারে তলায় আছে।
সে শহরের স্বপ্ন দেখেছিল।
আর শহরের জাঁকজমক আলোর।
কিন্তু এটা আর হবেনা। সে তার স্বপ্ন জানাতে পারবেনা।
সেদিনগুলোতে তার স্বামী যখন সাগরে যেত
সে তার ছেলের সঙ্গে কথোপকথন করত-
সে নিশ্চিত যে সেটি তার গর্ভের বাচ্চাটি ছেলেই হবে
সে তার সঙ্গে নিঃশব্দে কথা বলে।
সে একজন ধীবরের স্ত্রী।


২.
গোধুলি লগ্নে একটি বালক সাগরে যাচ্ছে
তার দাদার হাতটি ধরে।
সেখানে বিভিন্ন আকারের সমাধি আছে
রাস্তাটির পাশ ধরে ছোট ও বড়,
পোশাকাদি, তোষক ও বাটিসহ
যেগুলি সেই বৃদ্ধলোকটির বন্ধুর-
তারা সাগরে গেল
কিন্তু আর কখনোই ফিরলোনা।
বৃদ্ধলোকটি এই সমাধিগুলো গড়েছে
আর তার অনুসারী ধীবরদের জন্য অশ্রু ফেলে দুঃখ করেছে।
সে নিজে কখনো সাগরে যায়নি।
বালকটি তার সঙ্গে হাঁটছে, একটি সমাধি থেকে অন্য সমাধিতে লাফ দিচ্ছে,
সমাধিগুলো ঘাসে ছেয়ে গেছে
বালকটির পায়ের আঘাতে ঘাসগুলোতে ঢেউ উঠেছে।
প্রত্যেকদিন বালকটি তার দাদার সঙ্গে সাগরে যাবে
সে সৈকতে বসবে
অতিপরিচিত কিন্তু আশ্চর্য সাগরের দিকে থাকিয়ে থাকবে।
যখন পরিপূর্ণ আধার নামবে তারা উভয়েই
ঢেউয়ের শব্দের কলতান ছেড়ে
নিরবেই ঘরে ফিরবে
দু’টো সাম্পানের সাগর পারি দেয়ার ন্যায়।

৩.
সেকতের উপরে কিছু নৌকো ছড়িয়ে আছে,
পুরাতন ও শৈবালযুক্ত।
একটি ছোট্ট বালক অনাবৃত কাঠের গুড়িতে খেলছিল
হঠাৎ কিছু একটা দেখতে পেল।
সে কাঁদতে কাঁদতে খাড়া বাঁধে থাকা বৃদ্ধলোকটির দিকে
প্রাপ্ত বস্তুটিসহ দৌঁড় দিল।
এটি দেখে বৃদ্ধলোকটি কেঁপে উঠল
একটি হাতে তৈরি দাঁতভাঙ্গা চিরুনি।
সেই কাঠের চিরুনিটি সে একটি মেয়েকে দিয়েছিল,
কী চমৎকার ও প্রাণবন্ত মেয়েটি!
অতপর মেয়েটির সঙ্গে এখনকার ভগ্ন নৌকোগুলোর একটায় অভিসার করেছিল,
একটি তৈল প্রদীপ তাদের যুবায়বে আলো দিচ্ছিল।
এখন তার অর্ধাঙ্গি গত।
এখন আর কোনো চুল লম্বা ও কালো হবেনা,
তাদের ইটের তৈরি শয্যায়।
বৃদ্ধলোকটি বোবাহয়ে মাথা নড়াচ্ছে।
সে চিরুনিটিকে সাগরে ছুড়ে মারলো,
দূরে সেটাকে দুলতে দেখল।


ভূমিকা
লিউ জিয়া(জন্ম-১৯৬১) শান্তিতে নোবেলজয়ী লিউ জিয়াবো(২৮ ডিসেম্বর, ১৯৫৫- ১৩ জুলাই, ২০১৭) এর স্ত্রী। লিউ জিয়া একজন চীনা কবি ও চিত্রশিল্পী। তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে কবিতা লিখলেও গত তিরিশ বছর ধরে আলোচনায় আছেন। তিনি তিনশতাধিক তৈলচিত্র ও বিভিন্ন ধরনের চমকপ্রদ সাদা-কালো ছবি এঁকেছেন। ২০১৪ সালে ‘পূর্ব-পশ্চিম উঔঝ কবিতা’ পদকে ভূষিত হন। কবিতাটি লিউ জি তার প্রয়াত স্বামী লিউ জিয়াবো এর ভালোবাসায় লিখেছেন।

উল্লেখ্য যে, লিউ জিয়াবো চীনের একজন নামকরা কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক, কমিউনিস্ট বিরোধী ও সমাজকর্মী। তিনি একনায়কতন্ত্রী কমিউনিজম অবসানের জন্য আন্দোলন করেছেন। এজন্য ২০১০ সালে শান্তিতে নোবেল পান।






সনাতনের মধ্যেও স্বতন্ত্র এক কথাশিল্পী

 সনাতনের মধ্যেও স্বতন্ত্র এক কথাশিল্পী




 বাসার তাসাউফ
 সনাতনের মধ্যেও স্বতন্ত্র এক কথাশিল্পী
   
সুলতানা ইসলাম হিমু


বাসার তাসাউফ তরুণ প্রজন্মের লেখক। জন্ম ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি। কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার অনন্তপুর গ্রামে।
তার প্রথম বই ‘কার কাছে যাবো’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে। বইমেলায়। এ পর্যন্ত  প্রকাশিত গ্রন্থ ১০টি। এর মধ্যে ‘সূর্যঘড়ি’ ‘ছুঁয়ে দিলাম তোমাকে’ ‘চন্দ্রাহত পুরুষ’ উল্লেখযোগ্য। তিনি শিশুদের জন্যও লিখেন। ‘স্কুল থেকে পালিয়ে’ নামে তার একটি কিশোর উপন্যাস রয়েছে। জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ব্লগ এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে তিনি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। ‘জীবিত অথবা মৃত’ ‘একটা কাকের মৃত্যুতেও শোক হয়’ ‘যখন সবকিছুতে অন্ধকার থাকে’ ‘ফুল-কাঁটা’ ‘ডাকপিয়ন ঠিকানা পেল মানুষটা পেল না’ বিভিন্ন দৈনিকে ছাপা হওয়া তার উল্লেযোগ্য কিছু গল্প।
 ২০১৫ বইমেলায় প্রকাশিত ‘সূর্যঘড়ি’ নামের উপন্যাসটি পাঠক ও সূধীজনের মাঝে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ির সামনের বিস্তৃত ফসলের মাঠ থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক, নারিকেল গাছের চিরল পাতার ফাঁকে জেগে থাকা পূর্ণিমার চাঁদের অবারিত আলোর উন্মাদনা, অরণ্য আঁধারে জোনাকীর সিম্ফনী, কেরোসিন তেল ও লবণ নিয়ে প্রাক-সন্ধ্যায় হাট থেকে বাড়ি ফেরা কিষাণের নাকের ডগায় লেগে থাকা শীতের শিশিরের মতো ঘামের ফোঁটা, রঙিন ফিতে দিয়ে মাথার চুল দুই ভাগ করে বেঁধে পাঠশালায় যাওয়া কোনো বালিকা অথবা কোনো পল্লীবধূর কপালে সকালের উদীয়মান সূর্যের মতো টকটকে লাল টিপ দেখে তিনি আপ্লুত হয়েছেন আর গ্রামীণ এসব ‘সিম্বলিক’ বিষয়আশয় নিয়ে লিখেছেন ‘সূর্যঘড়ি’ উপন্যাসটি। এ বইটি পাঠ করলে পাঠক বোহেমিয়ান জনাকীর্ণ নগরজীবন ছেড়ে ফিরে যায় ফেলে আসা গ্রামে, জন্মভিটায়Ñযেখানে শেকর, উৎসমূল এবং  যেখান থেকে জীবনযাপনের সূূচনা। সেখানে ফেলে আসা নানা স্মৃতি আবার নতুন করে উঁকি দেয় মনের আয়নায়। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের বাবা-কাকারা লাঙ্গল-জোয়াল আর গরু দিয়ে জমিনে হালচাষ করতো। এখন ইঞ্জিন চালিত ট্রাক্টরে খুব অল্প সময়ে হালচাষের কাজ সারা হয়। তখন চিঠির মাধ্যমেই দেশ-বিদেশে যোগাযোগ করা হতো। এখন এসএমএস, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইমু, ভাইভার, হোয়াটসআপ আর স্কাইপির মাধ্যমে যোগাযোগ করতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। যেখানে পুরো গ্রামে হাতেগোনা দুয়েকটা সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল আর তাতে অ্যালুমিনিয়ামের অ্যান্টেনায় সিলভারের পাতিলের ঢাকনা লাগিয়ে রীতিমতো সাধনা করে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘আলিফ লায়লা’ ‘টিপু সুলতান’ ‘ম্যাকগাইভার’ ‘আকবর দা গ্রেট’ ও ‘ছায়াছন্দ’ দেখতে হত, সেই গ্রামে এখন প্রায় প্রতি ঘরেই রঙিন টেলিভিশন আছে। স্যাটেলাইট সংযোগে কত চ্যানেল দেখা যায়! বাবার আঙ্গুল ধরে হেঁটে হেঁটে গঞ্জের হাটে যাওয়া, হাটের মধ্যস্থলে ডালপালা মেলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বটবৃক্ষের তলে লোকজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাপ-বেজিতে লড়াই দেখার প্রত্যাশায় বড় বড় দাড়ি-গোঁফঅলা লোকটিকে কি কখনও ভোলা যায়? তার লেখায় যাপিত জীবনের সেই সব সিম্বলিক বিষয়ের বহুমাত্রিক পর্যবেক্ষণ আমাদের সচকিত করে। কম্পিউটার মোবাইল আর ইন্টারনেটের যুগে এসেও গ্রামের সেই সময়ের স্মৃতিতে সে আমাদের বুঁদ করে রাখে, যে সময়ে রাত্রি শেষে ভোর বেলায় মোরগের ডাকে মানুষের ঘুম ভাঙ্গত। নামাযের সময় হয়েছে কিনা সেটা বুঝতে হলেও আকাশের দিকে তাকাতে হতো।


তখন ঘড়ি ছিল না। সূর্যঘড়িই ছিল সময় নির্ধারণের একমাত্র উপায়। কিন্তু ‘পৃথিবী সে যুগ পার হইয়া আসিয়াছে।’ তবু ফেলে আসা পৃথিবীর দিকে একবার উঁকি দিয়ে কার না দেখতে ইচ্ছে করে! সেই যে খেলার সাথিরা মিলে বালুচরে খেলাঘর বানানো, পাটকাঠির মাথায় মাদার গাছের আঠা লাগিয়ে পুঁই আর লাউয়ের মাচায় ফড়িং ধরা, চৈতালি দুপুরে তেপান্তরের মাঠে ঘুড়ি উড়ানো, বনে বনে ঘুরে পাখির বাসা ভেঙ্গে ছানা এনে বাড়িতে পোষা, দিঘির জলে ডুবসাঁতার, দল বেঁধে জলকেলি করাÑ সেই সব আমাদের শুধু উঁকি দিয়ে নয়, একেবারে ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে বাধ্য করেছে এই উপন্যাসের কাহিনির পরতে পরতে। আমাদের দেখা না দেখা পুরনো সেই পৃথিবী, সেই সময়ের মানুষ ও তাদের জীবনাচরণ সম্পর্কে অবহিত করেছে। তার লেখায় গ্রামীণ জনজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনার কথা বর্ণিত হয়েছে সুচারু রূপে। এবারের বইমেলায় ‘স্বরচিত নির্বাসন’ নামে তার একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছে ‘বেহুলাবাংলা প্রকাশন।’