গল্পটি শুনতে চেয়ো না- ৫ম কিস্তি

গল্পটি শুনতে চেয়ো না- ৫ম কিস্তি




গল্পটি শুনতে চেয়ো না
 সোহেল নওরোজ

(গত সংখ্যার পর)
কিছুই করার না থাকার সময়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। হাফিজুল হক নিজের জীবনে অনেকবার এ সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোকেও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি করাবেন এটা পূর্বানুমিত ছিল। তাদেরকে কঠিন বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। জীবনকে জানতে হবে। জীবনের দুই পিঠ। এক পিঠে তীব্র আলোর রোশনাই। অপর পিঠে গাঢ় অন্ধকার। যে কোনো এক পিঠে দীর্ঘদিন বসবাস করতে থাকা মানুষদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। অনুভূতি হয়ে পড়ে ভোঁতা। সেখান থেকে তাই বের হয়ে আসার পথও খুঁজতে হয় দ্রুত। নাহিদ ও অনিকেত যখন বেঁচে থাকার সব চেষ্টা করে যাচ্ছে তখনই এগিয়ে আসে অনিকেতের স্বল্প পরিচিত এক কাকী। কবিতা তার নাম। হাফিজুল হকের হাতের ছবিটি কবিতার।

অনিকেত চরিত্রটিকে এ সময়ে সবচেয়ে বেশি ঘঁষামাজা করতে হয়েছে। হাফিজুল হক চেয়েছিলেন আবেগকে পাত্তা দিবেন না। নির্মোহ থেকে লিখবেন। অনিকেতের ক্ষেত্রে তিনি তা পারেননি বলেই অর্পার ধারণা।
     ‘অনিকেতের প্রতি তোমার মমতা ছিল, একটা দায় ছিল। একজন লেখক হয়েও সে দায়কে তুমি অগ্রাহ্য করতে পারনি।’
     ‘দেখ মা, নাহিদের প্রতি আলো ফেলতে গিয়ে অনিকেতের প্রতি সত্যিই আমি অবিচার করিনি। করলে সে আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। হয়তো কোথাও গিয়ে নাহিদকেও থামিয়ে দিতে হতো। আমি তা চাইনি।’
     ‘এমন একজন অনিকেতকে তুমি কখনো কোথাও দেখেছ?’
     ‘কত জনই তো আছে অনিকেতের মতো। যারা নিজেদেরকে ভাঙতে-গড়তে পছন্দ করে। অদ্ভুত খেলা করে। এই ভাঙা-গড়ায় কখনো কেউ জড়িয়ে গেলে তার জন্য কিছু করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।’
     ‘অনিকেত এরপর আর কখনোই তোমার লেখায় আসবে না বাবা?’
হাফিজুল হক জবাব দেন না। ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির রেখা নিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সে হাসির অর্থ হতে পারে, তুইও কি অনিকেতের প্রতি মমতা অনুভব করছিস!’ অর্পা তার বাবার এ হাসি খুব পছন্দ করে। সে মুগ্ধ হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবাকে তখন উপন্যাসের চরিত্রের চেয়েও বেশি রহস্যময় মনে হয়।

একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল বলেই সবিতার কাছে আশ্রয় চেয়েছিল অনিকেত। নিজের জন্য না, নাহিদের জন্য। তার ভবিষ্যত কারো হাতে নেই। সে নিজেও নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। নিজের কথা সে ভাবেওনি। তার ভাবনা ছিল নাহিদের জন্য। অনিশ্চিত এ পরিস্থিতির জন্য অনিকেত ছাড়া আর কেউ দায়ী নয়। জীবনের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসিয়ে দিয়ে স্বার্থপরের মতো সে সরে পড়তে পারে না। নাহিদের একটা গতি করার জন্য সে কম চেষ্টা করেনি! কাছের অনেকের কাছে গিয়েছে। সবাই ফিরিয়ে দিয়েছে। তার কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। আস্থার জায়গাটা নড়বড়ে তা অনিকেতও জানত। তাই সম্ভাব্য সব জায়গায় চেষ্টা করেছে। শেষমেশ এখানে এসে ঠাঁয় মিলেছে।
কবিতারা শহরে থাকে। তার একটা গানের স্কুলে আছে। সেখানে গানের ব্যাকরণ শেখায়। একবার একটা অনুষ্ঠানে অনিকেতদের গ্রামে গিয়েছিল। সেখান থেকেই পরিচয়। শহরের গল্প শোনায়। এ জীবনে তাকে অল্প কিছু মানুষই তাকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। কাকী তাদের একজন। আরেকজন অবশ্যই অনিকেত। প্রথম পরিচয়েই এত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল যে সে কবিতাকে কাকী ডেকেছিল। কবিতারা বড় হৃদয়ের মানুষ হয়। সমগ্র পৃথিবীটাই তাদের ঘর। তার স্বামী বড় চাকরি করত। মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার ছোটখাটো সংসার। নানা কাজে একটা ছেলের অভাব প্রায়ই অনুভূত হয়। তিনি চেয়েছিলেন অনিকেত ও নাহিদ দুজনই তাদের সঙ্গে থাকুক। দুদিন না পেরোতেই নাহিদকে রেখে অনিকেত চলে যায়। বালিশের তলে ফেলে রাখা চিঠিটা পড়ে নাহিদ প্রায়ই কাঁদে। অনিকেত হয়তো দূর থেকেও তা দেখতে পায়। তখন কি খুব আনন্দ হয় তার?

অনিকেতে লিখেছিল, ‘জীবনকে দেখার তীব্র নেশা আমার। তবে আমি জানি এর পরিণতি ভালো হবে না। কোথাও গিয়ে ঠিকই তীব্র হোঁচট খাব। তখন আর উঠে দাঁড়াতে পারব কিনা জানি না। যেদিন থেকে তোকে আমি সঙ্গী বনিয়েছি, খারাপ অভ্যাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি; সেদিন থেকে ভেতরে তীব্র অস্বস্তি অনুভব করেছি। আমার কারণে তোকে অপরাধী হতে দেখে একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। সেদিন যদি শুধু আমার শাস্তি হতো তবে কখনোই তোকে নিয়ে এতিমখানা থেকে এভাবে পালাতাম না। আমিও তোকে ভীষণ মিস করব। কিন্তু আমার সরে যাওয়াটাই ভালো হবে জেনেই চলে যাচ্ছি। জানি তুই এখানে ভালো থাকবি। কাকী খুব ভালো রে! এই দুঃসময়ে তিনি এগিয়ে না এলে আমাদের কী হতো ভাবতে পারছিস! কাকীকে ভুলেও কষ্ট দিবি না। যদি পারিস, তোর জীবনকে কঠিন আর এলোমেলো করার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস। আবার যদি কখনো দেখা হয় তোকে সফল মানুষ হিসেবেই দেকতে চাইব। ভালো থাকিস।’
চিঠিটা সে কবিতা কাকীকেও দেখিয়েছিল। তিনি কেবল একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। তার চোখে বিষাদের রেখা ফুটে উঠেছিল। স্বল্প পরিচিত কারো জন্য এই মায়ার সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। সেদিন খুব বিস্মিত হয়েছিল নাহিদ।

নাহিদকে দ্রুতই পছন্দ করতে শুরু করে কবিতা। এটা ভালো লক্ষণ। নাহিদের স্বাভাবিক হওয়ার জন্য এটা খুব প্রয়োজন। তার সামনে অবারিত দুয়ার খোলা। ভালো না মন্দÑ কোনটা দিয়ে যাবে তা নির্ধারণ করার জন্য এমন একটা আশ্রয়ের ভূমিকা অনেক। নাহিদ ভাগ্যবান বলেই তা পেয়েছিল।
                                                                                                  (.....ক্রমশ)

গল্প- চুড়ি

গল্প- চুড়ি
চুড়ি

লুৎফুন নাহার লোপা




কবির বাসের জানালা দিয়ে একটা ছোট ছেলেকে খেয়াল করছিল। ছেলেটি শসা মাথায় করে বিক্রি করতে এনেছে। এই  ছোট বয়সে তার হাব ভাব একজন বয়স্ক মানুষের মত হয়ে গিয়েছে। ছেলেটি তার ক্রেতাকে বলছে- ‘দুনিয়ার খবর কি কিছু রাখেন, আজকাল সব জিনিসের দাম বাড়তি। বাস ছেড়ে দিলো,  ছেলেটির শসা বিক্রি আর দেখা হলো না। কবির পাশে ফিরে দেখলো একটি মেয়ে তার পাশের সিটে বসেছে। মেয়েটির চেহারা তাকে আকর্ষণ করতে পারলো না কিন্তু তার দুহাত ভরতি চুড়ি মন ছুঁয়ে গেলো।
কবির তার নতুন গন্তব্য এ এসে পৌছালো। অনেকগুলো  পরিক্ষা দিয়েও সরকারি কোন চাকরি না পেয়ে তাকে পাড়াগাঁয়ে এক এন জি ও তে জয়েন করতে হলো। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও কয়েক মাসের মধ্যেই তার চাকরির প্রতি বিরক্তি এসে গেল। যদিওবা সে ম্যানেজার পদে চাকরি করে তবে অফিসে কেরানিদের কথার বাইরে সে কোন কাজ করতে পারে না। কারন এম ডি স্যারের সাথে কেরানিরই সুসম্পর্ক। কবির অফিসে ২ মিনিট লেট এ গেলেও তার কৈফিয়ত কেরানিদের দিতে হয়। সে অফিসে ঢোকামাত্রই দারোয়ান জিজ্ঞেস করল - স্যার এতো দেরি হইল কেন?
কবিরের মনে অনেক বকাঝকা এলেও সে তা প্রকাশ করল না, রাগ সংবরণ করে সে ভেতরে গিয়ে নিজের টেবিলে বসে পড়ল।
কাজের ভিরে তার সব রাগ হারিয়ে গেল সে টের পেলো না। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে সে দেখল তার মুখোমুখি টেবিল এ এক মেয়ে বসে আছে। কিন্তু লাঞ্চ করে আসার পর যখন দেখতে পেল মেয়েটি সেখানেই বসে আছে তখন সে  বুঝল মেয়েটির দীর্ঘস্থায়ী বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েটি তাকে দেখে মুচকি হাসলো এবং হাত নেড়ে হ্যালো বলতে চাইলো।  কিন্তু কবির কিছুই বলল না। তার রাগ হলো অফিসে নতুন সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অথচ আমাকে জানানো হলো না কেন ?

রুনা নতুন অফিসে গিয়ে আনন্দে কাজ করতে লাগলো।  সবার সাথে সে ভাব জমিয়ে ফেলল। শুধু মাত্র ভাব হলো না ম্যানেজার সাহেবের সাথে। ম্যানেজার সাহেবের সাথে আলাপ করার অভিপ্রায় নিয়ে সে অনেকক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তাতেও কাজ হলো না, তাই সে উঠে গিয়ে কবির কে বলল - স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন?
-হ্যা, অফিসে নতুন জয়েন করেছেন
-স্যার, আমাকে মনে আছে আপনার?
-আর কিভাবে মনে থাকবে?
-ওই যে ভাইবার দিন আমাকে গান গাইতে বলেছিলেন। আমার নাম রুনা দেখে বলেছিলেন রুনা লায়লার একটা গান করতে, আর আপনার কথা শুনে বড় স্যার হেসে ফেলেছিল ।
-ওহ.. মনে পরেছে;  হাহাহা...
কবির হেসে ফেলল, তার মনে পরল এই মেয়েকে নিয়োগের ব্যাপারে তাকে একবারে যে কিছু জানানো হয়নি তা না। তবে এই মেয়ে যে কেরানির রিকোয়েস্ট এ এসেছে তা বুঝতে তার বাকি রইল না। কারন কবির নিজেই তাকে রিজেক্ট করে দিয়েছিল।  তবে এখন সে বুঝল মেয়েটির রেজাল্ট যেমনি হোক না কেন, সে অফিস টাকে হাসিখুশি রাখতে পারবে।
 ৩
আজ অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়েছে। অফিসের ক্লান্তি দূর করতে কবির বাইরে বের হল। হেমন্তের শেষ, কদিন পরেই শীত এসে পরবে। বিকেলের হালকা কুয়াশায় হাটতে সব রাস্তাই মায়াবী মনে হয়। কবির হাটতে হাটতে তার মায়াবী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কার অভিশাপে যেন সেই মায়াবী রাস্তা দূর্গম মনে হল। নিচে তাকিয়ে সে দেখলো সে গোবরে পা দিয়ে তার নতুন জুতার বারো টা বাজিয়েছে। পাশেই একটা পুকুর দেখে সে পা ধুতে গেলো।  সাতটা সিঁড়ি মাড়িয়ে সে পা ধুয়ে উপরে উঠবে এমন সময় তার চোখ আরেক জোড়া চোখের সাথে ধাক্কা খেল। একটি মেয়ে তার দিকে গম্ভির মুখে তাকিয়ে আছে। যেন সে পা ধুয়ে অনেক অন্যায় করে ফেলেছে।  কবির কিছু না বলে তাড়াতাড়ি কেটে পরল।
 ৪
পরদিন অফিস যাওয়ার পথে মেয়েটিকে আবার দেখা গেল পুকুর ঘাটে। তার গায়ে কালো চাদর জড়ানো, খোলা চুলের অর্ধেক টা চাদরের ভেতর দিয়ে বের হয়ে আছে, বাকি অর্ধেকটা চাদরের ভেতরে। গ্রীষ্মকালে তাকে কেমন দেখায় তা আন্দাজ করা গেলো না, তবে শীতে তার সৌন্দর্য  কবিরের চোখে লেগে গেল।
কবির বিকেলে ফেরার পথে পুকুরপাড় পরিদর্শন  করতে লাগলো। কিন্তু সাহস করে মেয়েটিকে ডেকে কথা বলতে ইচ্ছা করলো না। একদিন পুকুর পাড়ে এক মহিলার শেফালি নাম ধরে চিৎকার করে ডাকতে শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরে সেই চাদর পরা মেয়েটি এসে তাকে মা বলে ডাকল। তাতে বোঝা গেলো মেয়েটির নাম শেফালি।
পরের দিন মেয়েটি নিজে ডেকে তার সাথে আলাপ করল। বলল, আপনি কি পুকুর দেখতে খুব ভালোবাসেন?
-হ্যা, অনেক।
-রোজ পুকুর পাড়ে আসেন?
-হ্যা
-কাল বিকেলে আসবেন, আপনাকে বড় পুকুরঘাটে নিয়ে যাবো।

কবির অফিসে এসে ভাবল আজ আগেই বের হয়ে যাবে, বিকেলে বড় পুকুর দেখার নিমন্ত্রণ আছে। কিন্তু কাজের চাপে তার কিছুই মনে রইল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল।  রাতে বাসায় এসে মনে পড়ল সে কি ভুলে গিয়েছিল। এক অপরিচিতার পুকুর দেখার নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করে সারা রাত তার অসস্তিতে কাটল।
পরদিন বিকেল বেলা সে মেয়েটিকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাছে গিয়ে বলল-আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, কাল আসতে পারিনি...।
মেয়েটি গম্ভির মুখে তাকিয়ে রইল, তারপর হেসে বলল, কাল আমিও আসতে পারি নাই। চলুন আজ দেখে আসি....
প্রায়ই তাদের পুকুর পরিদর্শন চলতে লাগলো। তাদের সখ্যতা বাড়তে লাগলো। ধীওে ধীরে শীত বাড়তে লাগলো এবং এক সময় আবার কমতে শুরু করল।
হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে ফোন আসল কবিরের সরকারি চাকরি হয়ে গেছে। তার বাড়িতে প্রতিরক্ষা  মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কবির খুশিতে অভিভূত হয়ে উঠলো।  সবাই কে জানানো হলো, শুধু পুকুর ঘাটে যাওয়া হলো না। পরের দিন পুকুর পাড় দিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ল তার কথা। দেখল মেয়েটি বসে আছে। কবির কাছে গিয়ে বলল - আমার সরকারি চাকরি হয়ে গেছে,  ২ দিন পর চলে যাব।
-সত্যি চলে যাবেন?
-হ্যা
-আমাকে ভুলে যাবেন তাইনা?
-ভুলবো কেন? ছুটি পেলেই এসে পুকুরঘাট দেখে জাবো
-শুুধুই কি পুকুর ঘাট?
-আর কি দেখার আছে বলো...।
-ওহ..ঠিকাছে।  আমার একটা কথা রাখবেন?
-কি?
-আপনি চলে যাওয়ার আগে আমাকে একটা উপহার দিয়ে যাবেন?
কবির দেখল মেয়েটি চোখে জল এসে গেছে। তার চোখে মুখে অদ্ভুত ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।  কবির এর বুকেও একটা অদ্ভুত টান অনূভুত হলো। সে আর সহ্য করতে পারল না। তাকে বলে ফেলল যদি যাই তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো। সেই আবেগ আপ্লুত বিকেলটা ভালোবাসার জন্ম দিল।

কবির সাড়া দিন ঘুরে চুড়ি কিনল। দুপুরে ভাবলো শেফালি কে সাথে নিতে হলে তার মা বাবার অনুমতির প্রয়োজন।  তাই খোজ নিয়ে শেফালিদের বাড়ী খুজে বের করল। শেফালির মা তার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল- তোমার পরিবার আমার মেয়েকে মেনে নেবে তো?
- কেন নেবেনা?
- না মানে ওর হাত দুটো অকেজো তো। জম্ন থেকেই ওর হাত পোলিও রোগীর মত বিকলাঙ্গ।
কবির কিছু বলতে পারল না। আসি বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসল। তার সকল আবেগ, সকল ভালোবাসা  এক নিমিষে শেষ হয়ে গেলো।  মনে হল কি করে আমি এমন একটা মেয়েকে পছন্দ করতে পারলাম। সে আমার যোগ্য নয়। মেয়েটি চাদর দিয়ে তার সত্যি লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন। আমার মা বাবার ঘারে এই মেয়ের বোঝা আমি কিছুতেই চাপিয়ে দিতে পারিনা। রাগে দুঃখে সে অসহ্য হয়ে উঠল। ফেরার পথে সে পুকুর পাড়ে চুড়িগুলো রেখে নিরবে চলে এলো।

প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে কবিরের নতুন  চাকরির বয়স। সময়ের সাথে সব কিছু বদলে যায়। সেও আবার যান্ত্রিক মানুষে পরিনত হল।
কদিন পর তার এক কলিগ এর বাসায় তার দাওয়াত হলো।  তার সহকর্মী তাকে তার স্ত্রী এর সাথে আলাপ করিয়ে দিল। সহকর্মীর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কবির অবাক হইল..... এত তার পুকুর ঘাটের প্রিয় মুখ। কিন্তু আজ তার গায়ে চাদর নেই। তার হাত ভরা চুড়ি কবির কে বিদ্রুপ করতে লাগল। এত সেই কবিরের ফেলে আসা চুড়ি। মেয়েটি তার ভালোবাসার ভার এখনো অতি যতেœ বয়ে বেড়াচ্ছে।  কবিরের দম বন্ধ হয়ে আসলো।  বাইরে ফোন দিলো সেই আগের অফিসের দারোয়ান কে। জানতে পারলো  তার ভালোবাসার মানুষের নাম শেফালি নয়, তার বড় বোন শেফালি এবং তার হাত নেই। আর যাকে সে এতদিন ভালোবেসেছে তার নাম চামেলি। সে নিজেই বুঝলো সে ভালোবাসার কতটুকু অপমান করেছে। কবির নিজেকে শান্ত করতে চাইল কিন্তু তার বুকে বিধে রইলো চামেলির হাত ভরা চুড়ি।

৫৩তম সংখ্যার পদাবলি-২

৫৩তম সংখ্যার পদাবলি-২

প্যারিস, অভিমানী শস্যের মন
ফকির ইলিয়াস


অভিমানগুলো নদীজন্মকে  ঢেকে দেয়। অথবা নদীগুলো
ঢেকে দেয় হাতে লেখা হলুদ ডায়েরি। যারা প্যারিসের
পথে পথে লিখে যায় নিজেদের নাম; কিংবা যারা ঊননিদ্রা
সেরে আবার মুখ মুছে দুপুরের সূর্যে, তারা গায়ে পরতে
ভালোবাসে দুঃখের পরিধান।

একসময় আমারও রোজনামচা লেখার অভ্যেস ছিল। পারিনি
শিখা'র উজানে দাঁড়িয়ে লিখে যেতে সকল বিরহের প্রণালী।
যে মেয়েটি ম্যাপল বৃক্ষের নীচে বসে বড় ক্যানভাসে লিখে
রাখছে তার অভিমান, তাকে আমার কোনো চিত্রশিল্পী বলে
মনে হয় না। বরং নিজের নাম ভুলে যাওয়া মানুষটির মতো
তাকে প্রতিস্থাপিত কোনো মূর্তি মনে হয়। ভর দুপুরেও কী
তবে চাঁদ নেমে আসে মাটিতে! লিডো ডি প্যারিস- নামক
শো’টির আলোর সিম্ফনি আবার আমার চোখে মুখে এসে
পড়ে। ‘হানি লোকাস্ট’ বৃক্ষের যে পাতাটি সবুজের আভা
ধারণ করে আছে এই আগস্টে, তা-ও হলুদ হয়ে ঝরে
পড়বে আসছে অক্টোবরে। মেঘশস্যের মন নিয়ে খেলছে
যে ‘খিলাড়ি’- একদিন বৃক্ষও তাকে থামতে বলবে। দাঁড়াতে
বলবে আকাশের অধিক উচ্চতায়।


বিজ্ঞাপন
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

একদিন আমার বইয়ের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাবে তোমার শহর।
বিলবোর্ডে বিলবোর্ডে কবিতার চরণ,
চকলেট কিংবা কনডমের পাশে বইয়ের প্রচ্ছদ-
প্রচারের মাধ্যম হবে বিশ্বসুন্দরী।

তোমার অন্তর্বাস আকর্ষণীয় হলে আমার শিল্পও প্রচারযোগ্য।
বই বিক্রিতে আমিও হতে পারি কর্পোরেট,
তোমার শহরের দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাবে আমার ছবি।

যমক বেতের অভিশাপ 
শাহীন মাহমুদ

স্যার সেই সকাল থেক্কা রিক্সাখান চিৎ কইরা ফালাই রাখলেন
সূর্য এখন মাথার উপর
এই বারের মতন মাফ কইরা দেন স্যার
আপনে কত বড় বিদ্বান- আইনের মানুষ
ভুল না হয় করছি-মাফ কইরাদেন স্যার
ঘরে দুইডা ছাওয়াল, ক্যানসার রুগী মা
রিক্সা চালাইতে না পারলে মহাজন মাফ করবোনা  ।
ঘরের ছাওয়াল গুলান না খাইয়া মরবো
মা আমার ঔষধ না পাইলে মইরা যাইব ।
আপনে আমার  আল্লা খোদা সবি
রিক্সার গদির নীচে দুইডা যমক বেত আছে
পাগলা কুত্তা আর শরাবখোরের হাত থেইকা বাঁচার জন্য রাখছি
ঐ বেত দুইডা দিয়া আমারে যতো খুশি মারেন
আমারে রিক্সাটা দিয়ে দেন স্যার ।
-এই শালা ফকিরনীর বাচ্চা
খালি পকেটে বের হস কেন?
পকেটে দশ বিশ টাকা রাখতে পারিস না ?
শালা .........।
 
অন্য এমন দিনে
শারমিন আক্তার

তোমার আমার অন্য এমন দিনে  মেঘেদের অভিসারে আর্দ্র শহর;
বৃষ্টিযাপন; সূর্যমলিন চাদোয়ায় আড়মোড়া, বাসি ঘুম-
ফোঁটা ফোঁটা জল চোখে বিরহিত, অভিমানী দিন । ‘বিকেলটানে সলতে ফুরলো;
যেতে পথে ফেলে গেছে প্রিয় পঙ্ক্তিমালা’ । সংক্রমিত আকাশ জুড়ে আমি-তুমি
কাঁদাখচিত জলছাপে সিক্ত, দুঃখবিলাসী ।

ডানা ঝাপটানো, পিচ্ছিল বাতাসে পথ ভুলি যেন ‘তবে তাই হোক’
হারানো ডায়েরীর সহজাত পিছুটান ঐ কবিতাটা আবার একটু পড়বে ?


মধ্যবর্তী চোখ
সিয়ামুল হায়াত সৈকত

একিলিসের ঘোড়া যখন ফুল
মধ্যবর্তী চোখে সেসব চোখদই
আজ, বিপ্রতীপ দুঃখ পোষে মনের শহর
যেনো হারিয়ে ফেললেই তুমি নয়!

এক জলজ্যান্ত শহর, মিথের মতো
ভাঁজওয়ালা পৃষ্ঠাগুলো অতীতের
আর আমরা যা রাখি
                             চোখে তুলে সব
বিস্কুটের ঠোঙায় সব দৈত্যের শহর
এসে, দ্যাখো মুখ তুমি ও তুমি।

ভালোবাসি যতো অসুখের মতো



৫৩তম সংখ্যার পদাবলি

৫৩তম সংখ্যার পদাবলি
মানুষের প্রকৃতি
আবু ইউসুফ সুমন


হাঁটতে গিয়ে একরাশ অসম্পূর্ণতা পথের সামনে  রাস্তা আগলে দাঁড়ায়
উপহাস করতে থাকে না মেলাতে পারা গোলমেলে গাণিতিক রাশিমালা!

ভাবনার মাঝে ভীড় করতে থাকে হাজারো সীমাবদ্ধতার কালিমা
আমি এক মুমূর্ষু রোগীর মত নিস্তব্ধতার সাড়াহীন ¯্রােতে গাঁ ভাসিয়ে দেই।

আলোকিত সভ্যতাতে আমি আমাবস্যার অন্ধকার খুঁজতে থাকি
ভুলে যেতে বসি আমার ও কিছু স্বপ্ন আছে যেগুলো উজ্জ্বল-রঙিন।

নিজের প্রতি আক্ষেপের জঞ্জাল নিজেই বহন করতে পারি না
তাই কেউ দেখা না দেখার মাঝে নির্জনে কান্নায় ফেটে পড়ি।

এমন অলক্ষুণে সময়ে নিজের মাঝে এক সংগ্রামী অনুভূতি জন্ম নেই
মনে পড়তে থাকে অসম্পূর্ণতা আর সীমাবদ্ধতাই সব মানুষের প্রকৃতি!

এখনো সময় খেলে যায়
সাদিক আল আমিন

নিরবধি জেগে জোছনা এখনও, মনভোলানো রাতে
তার শাদারঙা মুখের ওপর ফুটে আছে সতরঞ্চির চাল
গেরুয়া প্রজাপতি অবচেতনে খুঁটে খেয়ে মগজ
ঢেঁকুর তোলে কৃতজ্ঞ বাসনায়; তার হারিয়ে যাওয়া,
হলদে পাঞ্জাবির কলারে লেখে গল্প; হ্যাঙ্কারে ঝোলে সুখ
আড়ালে বসে চড়কা কাটে রসিক রহস্যের মানুষ
আমি খুঁজি তাকে অনন্ত, বলি দেখা পেলে আড়ালে
‘মিসির আলি, আপনি কোথায়? আমিও অপ্রকৃতস্থ’
তিনি অন্য ভূ-লোকে বসে হাসেন মৃদু, কখনো বলেন,
‘শোনো কবি, রহস্যের সাথে আবেগ মেশানো দুষ্কর’
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে খুঁজি সন্ধানী প্রেম
তিনি জন্ম নিলেই আমি কবিতা লিখি, উৎসর্গী তাকে
রুপার মতো নীলাদ্রিও আমাকে খামবন্দি প্রণয় পাঠায়
‘বলো কবি, যদি হিমু আরেকটু ভবঘুরে হতো, তবে
ঢাকা শহরটাতে বেশি কি একটা অনিয়ম হতো?’
আমি থাকি চেয়ে চুপ, দূরে সোনালি ফ্রেমের চশমা
আরো দূরে সোনালি বিকেল, ঝুলে আছে মেঘের সাথে
প্রত্যাশা, একদিন সে ফিরবে আমাদের সোনাঘরে ।

বিদায় পৃথিবী
সুমন আহমেদ

প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়ে আছে আমার পৃথিবী, রাত্রির কমল
বিছানায়; হাতে হাত রেখে, একটা অবয়বের মাঝে
নিজেকে বিলিন করে; দুইয়ে মিলে এক হয়ে।

পৃথিবীটার ঠিকানা বদল হয়েছে- সংসার নামের ঠিকানায়;
ধূসর স্বপ্নগুলো প্রতিনিয়ত গুমরে গুমরে কেঁদে মরে
বারবার সীমান্ত ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে অবুঝ মন,
পাওয়া না পাওয়ার যন্ত্রণায়- বেলা অবেলায়।
চাই না আর, রাত্রির ঘুমন্ত শহরের নিদ্রাহীন প্রহরী জীবন;
আর কত, বেচেঁ থেকেও প্রতিমূহুর্ত মিথ্যের সাধ?

বিদায় পৃথিবী,
আর হবেনা দ্যাখা, হেমন্তের কুয়াশার চাদর জড়ানো ভোরে,
দূর্বাঘাস আর শিশির বিন্দুর দুইয়ে মিলে এক হওয়া 
মধুর মিলন লগ্নে; বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে নীড়হারা ছুটন্ত
পথিক- অসহায় ভেজা কাক জীবনে।

কথার কথা
নীল মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

অনর্গল কথা বলে চলে বাতাস, কি কথা কয় কি কথা গোপন করে
কথার পিঠে কথা এসে হামলে পড়ে আমার ঘরে।
আমার এখন অনেক কথাই ঠোঁটের কোণে চেপে যাই,
মৃদু হেসে চলতে কেমন পথটাকে রোজ মেপে যাই।
অনেক কথাই চোখের মধ্যে ডুবিয়ে দেই অকারণ,
অকথিত সকল কথা দু’চোখ আমার করছে ধারণ।
অনেক কথাই কথার কথা, অনেক কথাই ফসকে গেছে-
কিছু কথা খুব গোপনের, সে সব বলতে বারণ আছে।
এমন কিছু কথা আছে, যে সব কথা জীবন্ত-
কেউ না জানুক সে সব কথা, ও সব আমার একান্ত।
কিছু কথার দায় থেকে যায়, কিছু কথার ওজন ভারি-
কিছু কথা মিথ্যে ছিল, কিছু কথা বাড়াবাড়ি।
সত্য মিথ্যে কথার সুতোয় সেলাই করা নকশি কাঁথা প্রেম;
তোমার হাতেই আমার বাসর শয্যা রচেছিলেম,
চিকন হাতের দক্ষতাতে নিগূঢ় ব্যথা লুকিয়েছিলে কাঁথার ভাজে-
সেসব কথা কাঁটা হয়ে বাজে, আমার বুকের মাঝে।


আমি পারি প্রিয়তমা
নাবিল তুরাব

তোমাকে ভুলে যাওয়া কঠিন নয়, যখন আমি ঈশ্বরকেও ভুলতে পারি।
তোমাকে ঘৃণা করাও তীব্র কঠিন নয়, যখন আমি পূর্বসূরিদেরও ঘৃণা করতে পারি।
তোমাকে স্মৃতি থেকে আজন্ম ঝেড়ে ফেলাও দুঃসাধ্য নয়,
যখন পৃথিবীর ভুল মানচিত্র মুছে দিতে পারি সমূলে।

গ্রহ থেকে গ্রহে ঘুরে আমি সৃষ্টি করতে পারি যখন নতুন পৃথিবীর মানচিত্র;
পূর্বসূরিদের আবিষ্কার করতে পারি স্বর্গে, কাউকে নরকে;
সীমাহীন অনন্ত ঈশ্বরকে দেখতে পাই নিষ্ঠুর সুকোমল সহাস্যমুখÑ
আমি পারি প্রিয়তমা তোমাকে ভুলতে, ঘৃণা করতে, এমনকি মুছে দিতে।

আমিও আজ পথিক
স্বপন শর্মা

ব্যাগ ভর্তি দুঃখ নিয়ে, বাঁশের সাঁকো পার হয়ে;
নগ্ন পা’য়ে মেঠো পথে আমিও আজ পথিক
শিশির ভেজা দূর্বা ঘাস, ধানহীন ধানক্ষেত
সরিষার কচি সবুজ পাতা-
খেসারী কলাই’র এলোমেলো ডালে
আটকে থাকা পা;

সাথী হওয়ার বাহানা তোমার,
আমার কালক্ষেপণ।
অতঃপর আমি পথের খোঁজে, একলা পথিক।

সুখের পা-ুলিপি সাজাই, ছিড়ে ফেলি
আবার মগ্ন হই, গুছিয়ে রাখি বিশ্রাম নেয়ার জন্য-
শিশির কুড়িয়ে যখন তপ্ত হৃদয় শীতল হবে
কুয়াশা ভেদ করে আবার হয়ত আশা জাগবে।
ততদিনে ভৈরবী মন্দিরে, পুরোহিতের পাশে বসে
মন্ত্র জপে ঈষ্ট দেবতার সন্তুষ্টি চাব।

বিফল মনোরথে, আজ আমি পথিক
ব্যাগ ভর্তি দুঃখ নিয়ে আবার হাঁটি গাঁয়ের পথে মাগন নিতে।




বিষ গরলের নেশায়
পার্থ কর্মকার

হেমন্তে কালো মেঘের অস্তিত্বকে তুচ্ছ করে আকাশে সাদা মেঘের ছুটাছুটি...
আকাশের নীলে প্রাণ জাগিয়ে একঝাক পাখির ডানা ঝাপটানো।
ঠিক এমনি সমুদ্র মন্থনের কোন এক ক্ষণে মেঘবালিকা ঈশ্বরী তোমার জন্ম,
তুমি একা ছিলে না, তোমার সাথে ছিল বিষ গরলের একটি রুপার কৌটা;
নীলকণ্ঠের মতো দেবতাদের মৃত্যুর শংকা কাটিয়ে আমি তোমার রৌপ্য কৌটার বিষ,
কণ্ঠে ধারন করে তোমায় অমর বন্ধুত্ব দিয়েছি। আজ তুমি বন্ধুত্ব নিয়ে খুশি,
আমি তোমার বিষ-গরলের নেশায়।



বিরহ ও রাজনীতির একুশ বছর

জাহিদ আল হাসান

হৃদয়ের এমন ক্রান্তিকালে যদি
নিরপেক্ষ শান্তিকামীরা মুক্তির জন্য মিছিলে নামে
মূহুর্তে অবরোধ করে ফেলে
নিঃসঙ্গতার ২১টি অন্ধকার মহাসড়ক
‘তবে তাই হোক’ এমন সকল কর্মসূচিতে
একাত্মতা প্রকাশ করবো আমি।

যদি প্রেম পিপাসু জনতা শ্লোগানে শ্লোগানে
মুখরিত করে তোলে বুকের বামপাশ,
প্রতিবাদে গায় ভালোবাসার গান
প্রেমের ভেতরে চায় সুখ আহবান
যদি অসুখ ভুলে সুখের দাবি জানায়
আর বিষাদ ভুলে ভালোবাসার,

এবং যদি স্মারক লিপির প্রথম লাইনেই
বিলুপ্ত ঘোষণা করতে চায়, ‘একাকীত্ব’
নামের অবাঞ্চিত শব্দের কথা
তবে গণতান্তিক নিয়মে লাখো জনতার
মাঝে আমি বলতে চাই,
এই লড়াইয়ের দিনে তোমরা যাকে
বিলুপ্তির জন্য চিৎকার করো,
যার জন্য তোমাদের হৃদয়ে সুখ নাই,
পথে পথে সুখ চাই
তাকে ছাড়তে পারি না আমি,
সে আমার ছায়া হয়ে থাকে মনের ঘরে
রাত দিন যন্ত্রণা করে এ বুকের পাঁজরে।


তুমি এসেছিলে
জালাল জয়

তুমি এসেছিলে
ঝরাপাতায় লেপটে বসন্তের কালে
মর্মর শব্দে পথের ধারে পড়ে থাকা
পাতাদের কন্ঠে। মধুময় কোকিল সুরে 
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুমি এসেছিলে
শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে, জলে ভিজিয়ে
আষাঢ়ের তুমূল গানে। ঝাপটা
মেরে বৈশাখী ঝড়ে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুমি এসেছিলে
শরতের কাশফুলে হৃদয় ছুঁয়ে
নীলের মেঘে এঁকে প্রাণে শিউলি
ভোরে। অতি আদরের মেঘে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুুমি এসেছিলে
হেমন্তের শিশির হয়ে- ঘাসময় হৃদয়টাকে
কুয়াশায় ভিজিয়ে। নবান্নের উৎসবে
অগ্রহায়ণের নতুন ধানে, কৃষাণির হাসিমুখে
পিঠা পায়েসে-মধুমাখা তৃপ্ত সুরে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে

তুমি এসেছিলে
হাড়কাঁপা শীতের কুয়াশা ভোরে
ঝিমঝিম ঘুমে পেীষ-মাঘে কিংবা
ফাগুনের শেষ প্রভাতে
তুমি এসেছিলে, তুমি এসেছিলে


ঈশ্বরের হৃদয়
রাহাত রাব্বানী

তোমাকে ভেবে ভেবে মধ্যরাতে আকাশ খুলে বসি।
দেখি- নক্ষত্রদের মিছিল-সমাবেশ। তোমাকে ভেবে ছুঁয়ে দেই-
মানিপ্ল্যান্টের কোমল দেহ। ঘাসফুল। অলকানন্দা।
নেতিয়ে পড়া ভাঁট ফুলের আসরে-
তোমার যুগল চোখ খেলে ভালোবাসার খেলা।
মূলত তুমি আর প্রকৃতি একই কক্ষে ঘূর্ণায়মান।
আমি যতবার তোমাকে ভাবি,ততবারই ভাবি-
ঈশ্বরের হৃদয়। দেখি, তার গুছানো পৃথিবী।




বুকপকেট নেই কবি বলে
ইকরামুল হাসান শাকিল

নন্দিতা, তুমি নদীর সামনে দাঁড়াও, রৌদ্রে ভিজে শুকাও একাকিত্বটুকু
সেতুহীন সেই ¯্রােতস্বিনী দেখো সাজসজ্জা ছেড়ে; নিজের গভীরতায়
তোমার ভিতরেই চন্দনকাঠের আলমারিতে শীতের আগমনী
কানের দুল রাখা কাচের তালার ভাস্কর্যের লাবণ্য;
নদীর নবীন জল, জলজউদ্ভিদ, হারানো রুপার নুপুর, খোলা চুলের
মাতাল ভাঁজ, জলপাইকাঠের নৌকো, যতটুকু আকাশ
অই ওড়নার সীমানায় সেই সবটুকু তুমি
নেই কোন সীমারেখা কিংবা কাঁটাতারের অসভ্য বেহায়পানা।
কাটাকুটির শহরে সেই কবেই হেঁটে গেছো শুকনো বটপাতা ভাঙার  শব্দে
পায়ের চিহ্ন মাখা শালিকের ভাঙা ডিমের খোসা তুলে রেখেছি বুকপকেটে
আজ সেই বুকপকেট  নেই কবি বলে, দারুণ অভাবে বিক্রি করেছি নিলামে
নিদারুণ মূল্যে কলম কিনেছি একটি নৌকোর জন্য কবিতার জন্ম হবে বলে।



ঘুমন্ত মানব পৃথিবী
নাফছি জাহান

ঘুমে কাতর মানব পৃথিবী- প্রাণহীন জীবিত প্রাণ নিয়ে
আধমরা হয়ে বেঁচে আছে,
তাদের অন্তদৃষ্টি চক্ষু বন্ধ করে- অবিবেচকের আবরণ
আষ্টেপৃষ্ঠে যতœ সহকারে জড়িয়ে রেখেছে।
প্রলোভনের অশ্রুতিমধুর শব্দবিন্যাস
কোমলতাকে বিতাড়িত করে, কঠোরতাকে নিত্যসঙ্গী করেছে,
সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা হয়তো তাদের বিড়ম্বনা করছে
তাইতো চক্রাকারে বিন্যস্ত, প্রাক্তন বিবেকহীন চিন্তাধারার
তাদের হৃদয়ের অন্তস্থলে পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
বিবেকের এ অন্তিম দশা প্রত্যক্ষ করে-
মানব পৃথিবী যেনো আনন্দে মেতে আছে,
হায়রে জীবন! ঘুমিয়ে থাকা মানব জীবন।


গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ: ম্যাজিক রিয়েলিজমের গুরু

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ: ম্যাজিক রিয়েলিজমের গুরু
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
ম্যাজিক রিয়েলিজমের গুরু
ফুয়াদ আল আবির



“মানুষ নাকি বুড়ো হয়ে যায় তাই স্বপ্ন দেখে না। ডাহা মিথ্যে কথা!
মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যায় তাই সে বুড়ো হয়ে যায়।”
ম্যাজিকাল রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতা, সাহিত্যের এমন এক মোহনীয় ধারার সাথে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেন এ সময়ের একজন শক্তিশালী লেখক। তাকে সময়ের গন্ডিতে বেঁধে ফেলা অবশ্য ভুল হলো। কেননা, মোটে চল্লিশ বছর বয়েসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শতবছরের নিঃসঙ্গতাকে। স্প্যানিশ ভাষায় তার সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়েছিলো তার জীবদ্দশাতেই, পেয়েছেন তার স্বীকৃতিও। চতুর্থ লাতিন আমেরিকান হিসেবে নোবেল পান তিনি।
তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ডাকনাম গ্যাবো, জন্ম ১৯২৭ সালের ৬ই মার্চ, উত্তর কলম্বিয়ার এরাকাতাকা শহরে। ফার্মাসিস্ট বাবার কাজের কারণে শৈশবে নানা-নানীর কাছে মানুষ। গ্যাবোর নানী ছিলেন একজন অসাধারণ গল্পবলিয়ে। অদ্ভূতুড়ে জিনিসকে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যেন মনে হত তিনি তা চাক্ষুষ দেখেছেন। নানারকম ভূত-প্রেত, আত্মা, অলৌকিক বিষয়াদির বইয়ে ভর্তি ছিলো তাদের বাড়ি। গ্যাবো তার সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতার যে প্রকাশ করেছেন, তার প্রথম পাঠ নেন এভাবেই, নানীর কাছে। নানীর এই গল্প বলার ধরণ তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব- কে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো বলে মনে করেন গ্যাবো।
গ্যাবোর নানাও কিন্তু কম যান না! ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধে তিনি লিবারেল পাট্রি কর্নেলের দায়িত্ব পালন করেন। স্বভাবতই তার শেখানোর পদ্ধতি ছিলো ভিন্ন। তিনি শেখাতেন বিভিন্ন অভিধান থেকে, সার্কাসে নিয়ে যেতেন প্রতি বছর। গ্যাবো তার নানাকে ডাকতেন ‘পাপালেও’ বলে। পাপালেও প্রায়ই একটা কথা বলতেন গ্যাবোকে-
‘তুমি কল্পনা করতে পারবে না, একটা লাশ কতটা ভারি হতে পারে!’
শিশু গ্যাবোর মনে এই কথাটি গভীরভাবে দাগ কাটে। নানার সৈনিক জীবন থেকে পাওয়া এমন আরো অনেক উপলব্ধি পুনরাবৃত্তি হয়েছে মার্কেজের রচনায়।
‘গ্যাবো’ কিংবা পরিণত বয়েসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিশ্বসাহিত্যের আরেক কিংবদন্তী ফ্রানৎজ কাফকার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন মার্কেজ। ১৯৪৭ সালে গ্যাবো ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া’য় আইনে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছায়। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় কাফকার সাহিত্যের সাথে, ‘লা মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’-এর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু না, কাফকার লেখার ধরণ তাকে আন্দোলিত করে, যেন শৈশবের নানা-নানীর কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো ফিরে আসে তার কাছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অগণিত পাঠক আর সাহিত্যবোদ্ধাদের মত মার্কেজও আন্দোলিত হয়েছিলেন মেটামরফোসিসের প্রথম বাক্যটি পড়ে:
“ঘুম থেকে উঠে গ্রেগস সামসা দেখলো সে পোঁকা হয়ে গেছে!”
এরপর থেকেই মার্কেজ সিরিয়াস সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং কিছুদিন পর ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকায় ‘তৃতীয় পদত্যাগ’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। স্কুলে থাকতেই লেখালেখির শুরু হলেও গ্যাবোর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার শুরুটা তখন থেকে।
আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি মার্কেজ। ভর্তি হওয়ার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কলম্বিয়া। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং তার পেনশনের কার্ডটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরে তিনি চলে যান ‘ইউনিভার্সিটি অব কার্টেগানা’য়। সেখানে সাংবাদিকতায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ‘এল ইউনিভার্সাল’ পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকতায় এতোটাই ঝুঁকে পড়েন যে, পাশ করবার আগেই লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে চলে যান বারাঙ্কুইলিয়া শহরে, ‘এল হেরাল্ডো’ পত্রিকার সাংবাদিক হয়ে।
তার প্রথম বড় কাজ, ঞযব ঝঃড়ৎু ড়ভ ধ ঝযরঢ়ৎিবপশবফ ঝধরষড়ৎ। মূলত ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার জন্য লেখাটি মোট চৌদ্দ কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। কলম্বিয়া নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চোরাচালানির পণ্যের অতিরিক্ত ভারে ডুবে গিয়েছিল। সে জাহাজের একজন নাবিক ছিলেন লুইস আলেজান্দ্রো ভ্যালেসকো। সাগরের বুকে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম লেখাটির মূল উপজীব্য। মার্কেজ পুরো উপাখ্যানটি লিখেছিলেন উত্তম পুরুষে এবং বেনামে! লেখাটি প্রকাশ পেয়েছিলো নাবিক ভ্যালেসকোর সাক্ষর নিয়ে। পরে ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বই আকারে লেখাটি প্রকাশিত হলে তাতে গ্যাবোর নাম দেখা যায়। এটি মূলত তার সাংবাদিক জীবনের কাজ, সাহিত্যিক কিংবা ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি তা লেখেননি। তিনি ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার হয়ে ভ্যালেসকোর সাক্ষাৎকার নেন এবং তার পরবর্তীতে উত্তম পুরুষে পুনর্লিখন করেন। বইটি প্রসঙ্গে গ্যাবো বলেন, ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব লেখার পূর্বে কোনো সম্পাদক কিংবা সাহিত্য সমালোচক লেখাটিকে দামই দেননি!
লেখাটি ১৯৫৫-তে প্রথম প্রকাশের পর মার্কেজ তৎকালীন জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়া সরকারের চক্ষুশূল হন এবং তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। তখন তিনি বেশ কিছু বছর রোম, প্যারিস, বার্সেলোনাসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিদেশী সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।
নিঃসঙ্গতার একশ বছর বা ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব গার্সিয়া মার্কেজের শ্রেষ্ঠ রচনা। মূলত এ উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান। এ বইটি লেখার পেছনের গল্পটি ভারি চমৎকার। আঠারো বছর বয়সে গ্যাবোর ইচ্ছে হয় তার শৈশবের নানা বাড়ি এবং সেই মানুষজন-আসেপাশের অনুসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু কলমে লেখা আসছিলো না ঠিক যেমনটি তিনি চাচ্ছিলেন। তাই তিনি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেক বছর বাদে, তিনি তার পরিবার নিয়ে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন গাড়ি করে। হঠাৎ তাঁর মনে হয় সেই সঠিক সময়টি এসে পড়েছে, তিনি হয়তো পেয়ে গেছেন তার লেখার সকল উপজীব্য আর ঢঙ। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসেন এবং লিখতে বসেন। তিনি এতোটাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেয়েছিলেন যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং পরিবারের খরচ মেটাবার জন্য গাড়িটি বিক্রি করে দেন।
যদিও তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় লেগেছিলো উপন্যাসটি শেষ করতে। টানা আটারো মাস লেখার পর ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী বইটি বিক্রির পরিমাণ ৩০ মিলিয়নেরও অধিক কপি এবং অনুবাদিত হয়েছে ৩৭ ভাষায়। গোটা বিশ্বসাহিত্যে এমন আর কোনো বই দেখা যায়নি যা প্রকাশের পরপরই পাঠকপ্রিয়তার এমন তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলো, সাথে সাথে অনেক বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলো ক্রিটিকদের দ্বারা। বাংলায় বইটির অনুবাদ করেন জি এইচ হাবিব, ২০০০ সালে প্রথম বের হয় বইটি।

মার্কেজ তার শৈশবের শহরের আদলে তৈরি করেছিলেন একটি শহর ‘মাকোন্দো’। সেই শহরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্ম নিয়ে তৈরি হয় গল্পের কাঠামো। শুরুতে আমাদের সামনে আসে জোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া আর তার স্ত্রী উরসুলা ইগোরান। তারা ঠিক করেছিলেন কলম্বিয়া ছেড়ে যাবেন নতুন আবাসের খোঁজে। পথে এক নদীর ধারে রাত্রিযাপনের জন্য অবস্থান করেন তারা এবং জোসে এক অদ্ভূত শহর ‘মাকোন্দো’ স্বপ্নে দেখেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি স্থির করেন, নদীর তীরেই তিনি তৈরি করবেন সেই শহরটি। এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাতে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনী। ইতিহাস, সংস্কার – কুসংস্কার, বাস্তব – অবাস্তব – কল্পনা, যৌনাতা – অযাচার, ফ্যান্টিসি আর পরাবাস্তব জগতের এমন মিশেল পাঠক এবং সাহিত্যবোদ্ধা দুইকেই নিয়ে যায় উপলব্ধির চূড়ায়।
অনেক সাহিত্যবোদ্ধা মনে করেন, ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব এর পর খড়াব রহ ঃযব ঞরসব ড়ভ ঈযড়ষবৎধ বা ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ মার্কেজের সেরা কাজ। বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৮৫ সালে স্প্যানিশে এবং ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় তার তিন বছর পর। বইটি থেকে ২০০৭ সালে মুভি অ্যাডাপশান করা হয় একই নামে। মার্কেজ বলেছেন, এ গল্পেরও সূচনা তার ব্যক্তি জীবনে। মূলত তার বাবা-মায়ের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন বইটি। এ উপন্যাসটি ছাড়াও মার্কেজের অন্যান্য উপন্যাস এবং ছোটগল্প থেকে থিয়েটার এবং ফিল্মে অ্যাডাপশন হয়েছে বহুবার। এমনকি ঞযব ইষঁব খড়নংঃবৎ এর পরিচালক ছিলেন স্বয়ং মার্কেজ।

তবে গ্যাবো মনে করেন, ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয তাঁর সেরা কাজ। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ পায় বইটি। এ উপন্যাসে তিনি বর্ণনা করেছেন এক ক্যারিবিয় একনায়কের কথা। সাহিত্যবোদ্ধাদের মত, এ স্বৈরশাসককে কলম্বিয়ার কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল গুস্তাভো রোহাস পিনিয়ার আদলে রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন মার্কেজ, যার কারণে বাধ্য হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করতে হয় মার্কেজকে।
ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয বইয়ের মলাট

ঞযব অঁঃঁসহ ড়ভ ঃযব চধঃৎরধৎপয; ছবিসত্ত্ব: ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্লগ

কিউবার সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রনায়ক ফিদের ক্যাস্ট্রোর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন গ্যাবো। ছিলেন কলম্বিয়ার বামঘেষা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। এই অভিযোগে বহুবছর যাবৎ তাকে ভিসা দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শেষে বিল ক্লিনটন প্রশাসন নব্বইয়ের দশকে মার্কেজের উপর থেকে এই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ক্লিনটন মার্কেজের লেখার একজন একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ছিলেন। কৈশোরের উচ্ছাসপূর্ণ দিনগুলোতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও সঙ্গী হতো মার্কেজের বই।

মার্কেজের মার্কেজ হয়ে ওঠার পেছনে একটা বড় নিয়ামক তার ছোটগল্পগুলো। জাদু বাস্তবতার যে বিস্তর প্রয়োগ তিনি উপন্যাসে করেছেন, ছোটগল্পে অতোটা করেননি কিংবা বলা যায়, ছোটগল্পে সেভাবে করার সুযোগ হয়নি। তিনি বলতেন এভাবে,

“ছোটগল্প হলো আর্চার বোর্ডে নিশানা করা আর ঠিক সময় ঠিক জায়গায় আঘাত করা এবং উপন্যাস হলো বিশাল দূর্গম কোনো বনে একটা খরগোশের খোঁজ করতে থাকা।”

১৯৯৯ সালে গার্সিয়া মাকের্জের লিম্ফাটিক ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ২০১২ সালের দিকে স্মৃতি বিলোপ হতে শুরু করে। তার দুই বছর বাদেই ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই কথাশিল্পী। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস তাঁকে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কলম্বিয়ান’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার মৃত্যুতে তিনদিনের রাষ্টীয় শোক পালন করেন কলম্বিয়াবাসী। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কালোত্তীর্ণ এই কলমশিল্পীকে।