ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৭

ই-পেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ১৪৭
তারুণ্যের শিল্প সরোবর : : ধানশালিক : : সংখ্যা ১৪৭
শুক্রবার, ০১ মে ২০২০





















প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতায় কর্মমুখী শিক্ষা

 প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতায় কর্মমুখী শিক্ষা


 প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতায়
 কর্মমুখী শিক্ষা

এ আই জাজাকী

কয়েকদিন আগে একটি সরকারি চাকরির লিখিত পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। তখন এক ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয় হয়। দেশের চাকরির বাজার আর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা বলছিলাম। কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনি প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থায় বললেন, ভাই গত পাঁচ বছর আগে মাস্টার্স শেষ করেছি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির চেষ্টা করছি কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আমি যেমন চাকরি চাই বা যে বিষয়ের ওপর আমি অনার্স-মাস্টার্স করেছি সে অনুযায়ী কোনো চাকরিই মিলছে না। সার্কুলারে যে স্বল্পসংখ্যক নিয়োগ হয় তাও পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। লিখিত পরীক্ষা দিই তো ভাইভার ডাক আসে না, ভাইভা দিই তো পরে যোগাযোগ করা হবে বলে বিদায় করা হয়। পরে আর কোনো খোঁজ-খবর পাই না। দীর্ঘ সতেরো-আঠারো বছর পড়ালেখা করে কি একটা চাকরির যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি? তাছাড়া আমি তো আর এত খারাপ ছাত্রও না। যদি তাই হতাম তাহলে কি আর এতদূর আসতে পারতাম? এ বছরই আমার চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হবে। এমনও হতে পারে যে, এটাই আমার শেষ চাকরির পরীক্ষা। কারণ আর যে কয়েকমাস বাকি আছে এর মধ্যে তো নতুন সার্কুলার নাও হতে পারে। কথাটুকু বলেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আমি মনে মনে বললাম, এক কাঙাল বলে আরেক কাঙালকে। আমার নিজেরও তো এই হাল। তারপরও পাশের লোকটিকে সামান্য সান্ত¦নার উদ্দেশ্যে বললাম, ভাই শুধু শুধু সময়গুলো কেন নষ্ট করছেন? উদ্যোক্তা হোন, নিজে কিছু করুন। বাংলাদেশে তো এখন অনেককিছু করার সুযোগ আছে। শুধু সরকারি চাকরির পেছনে ছুটে জীবন পার করলে চলবে? লোকটি আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ভাই আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু কী করব বলুন? দীর্ঘ দেড়যুগ বাপ-মার কাঁধের ওপর বসে খেয়েছি, পরেছি, লেখাপড়া করেছি। শত কষ্ট হলেও লক্ষ লক্ষ টাকা তারা আমার পেছনে ব্যয় করেছে। তাদের তো এখন আমার ওপর একটা দাবি আছে, আশা আছে। পুরোটা পরিবার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা ভাবছে, ছেলে এতদূর লেখাপড়া করেছে। এবার নিশ্চয়ই ভালো একটা চাকরি পাবে। সংসারের হাল ধরবে। এত লেখাপড়া করে গ্রামে গিয়ে চাষবাস করলে সেটা তাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। আর ছোট চাকরিও আমার যোগ্যতার সাথে যায় না। তারপরও করতাম। পেটে ভাত না থাকলে মান-সম্মান দিয়ে কী হবে? কিন্তু পরিবার পরিজনের কথা চিন্তা করেই তা করতে পারি না। কারণ তারা একটা সমাজে থাকে। যারা আমার সাথে একই বছর এসএসসি পাশ করে বেরিয়ে গার্মেন্টসে ঢুকেছে তারাও এখন মাসে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকা আয় করে। আর আমি যদি এত লেখাপড়া করে এখন ছোট কিছু করতে যাই তাহলে সমাজে পরিবার পরিজনরা মুখ দেখাতেই লজ্জা পাবে।  কথাটুকু বলতে বলতে দেখলাম উনি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে টিস্যু বের করে চোখ মুছছে। আমি যেন খেই হারিয়ে ফেললাম। ছোট মানুষের চোখে পানি দেখলে সহ্য করা যায় কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চোখে পানি দেখলে নিজেকে সামলানোই দায় হয়ে পড়ে। তারপরও নিজেকে সামলে বললাম, ভাই ছাড়–ন তো। সরকারি চাকরি কি সবার কপালে জোটে? যাদের মামা-চাচার জোর আছে তারা পড়ালেখা যেমনই করুন না কেন সময়মতো একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা তাদের হয়েই যায়। আপনি বরং এক কাজ করুন, বেসরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করুন আর নাহয় নিজে উদ্যোক্তা হোন। তিনি বললেন, বেসরকারি চাকরিইবা এখন কম সোনার হরিণ? ইন্টারভিউ দিতে গেলেই আগে জিজ্ঞেস করে, আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? আরে ভাই, একটা মান্ষু পড়ালেখা করবে নাকি চাকরি করে অভিজ্ঞতা অর্জন করবে? তারপরও যদি কোনোরকমে চাকরিটা হয় তখন একটা মাস্টার্স পাশ ব্যক্তিকে বেতন দেয় দশ থেকে বারো হাজার। এ যুগে একজন মানুষের কোনোরকমে চলতেই তো পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার প্রয়োজন পড়ে। আর উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বললেন না? সেটা কীভাবে করব। পড়ালেখা করেছি এক বিষয়ে এখন যদি অন্য একটা বিষয় ভালো করে বুঝতে যাই তাহলেই তো পাঁচ বছর লেগে যাবে। আমি বললাম, তা বলেছেন ঠিক। তাই বলে কি মানুষ বেসরকারি চাকরি করছে না? উদ্যোক্তা হচ্ছে না? অহরহ অনার্স, মাস্টার্স করা মানুষ সেসব দশ, বারো হাজারী চাকরিই করছে কিংবা উদ্যোক্তা হচ্ছে। এছাড়া আর উপায় কী?
এ তো গেল একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা। এবার আসল কথায় আসি। বাংলাদেশে এরকম হাজার হাজার প্রমাণ আছে। লাখো লাখো  বেকার আছে যারা উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও পাচ্ছে না যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো চাকরি। আর এর আধিক্য বেড়েই চলেছে দিনের পর দিন। এর প্রধান কারণ হিসেবে আমি যেটাকে দাবি করব সেটা হলো কর্মমুখী শিক্ষার অভাব। এরূপ পরিস্থিতি ও একঘেয়ে শিক্ষার ধারণা আমাদের মধ্যে প্রবল হয়ে গেছে। আমরা মনে করছি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের চলার পথ সুগম করে দেবে। আসলে তা নয়। যদি তাই হত তাহলে দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার থাকার প্রশ্নই আসত না। অথচ বাস্তবে আমরা তাই দেখছি। আজ কর্মক্ষেত্র নেই অথচ বড় বড় সার্টিফিকেটধারীর কোনো অভাব নেই। অথচ একটা সময় ছিল যখন মানুষকে ডেকে ডেকে চাকরি দেয়া হত। জনসংখ্যার আধিক্য, প্রচলিত একঘেয়ে শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মক্ষেত্রের অপ্রতুলতার জন্য এখন লক্ষ তরুণ ফাইল হাতে ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে। আমি একটা কথা সবসময় বলি যে, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। আর সে সুযোগটা আমাদের তৈরি করতে হবে। মানুষ তো ফেলনা জিনিস নয় বা দেশের জন্য বোঝাও নয়। হ্যাঁ, আমাদের দেশ একটি ছোট্ট ও উন্নয়নশীল দেশ। আর এ সুযোগটাকেই আমাদের কাজে লাগাতে হবে। জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের দায়িত্বটা প্রথমত সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। আর সেটার একমাত্র ও প্রধান উপায় হলো কর্মমুখী তথা বহুমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানো। এখানে প্রচলন শব্দটি ব্যবহার করা যেত কিন্তু তা না করে প্রসার শব্দটির ব্যবহার করার কারণ হলো, ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বহুমুখী শিক্ষার প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু তা খুবই স্বল্প পরিসরে। যা পুরোপুরি প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের ধারাণাকে পাল্টে বাস্তবধর্মী তথা কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারই একমাত্র দেশের বেকার সমস্যার সমাধান করতে পারে। ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা। এখনও বেকারজনিত সমস্যা লক্ষের ঘরেই রয়েছে। তবে তা যে হারে বাড়ছে তাতে কোটির ঘরে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে আমার মনে হয় না। তবে এখনই যদি সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তাহলে লক্ষ তরুণের মেধাকে কাজে লাগানো সম্ভব এবং কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে ভবিষ্যতের এরূপ সমস্যারও সমাধান করা সম্ভব। দেশে বর্তমানে প্রতিবছর ১০টি বোর্ডে ২০ থেকে ২২ লক্ষ এসএসসি পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে। সেখানে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীই সন্তোষজনক ফলাফল করে পাশ করছে। আবার প্রতিবছর ১১ থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ পর্যন্ত পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে। সেখানেও পাশের হার সন্তোষজনক। কিন্তু একটি বিষয় খেয়াল করবেন যে, প্রতিবছর এসএসসি থেকে এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কিন্তু প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তারপর এইচএসির পর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারছে তারও অর্ধেক। কিন্তু তারা যাচ্ছে কোথায়? অবশ্যই অনেকে চাকরির পেছনে ছুটছে। অনেকে ছোটখাট ব্যবসার চিন্তা করছে। আবার অনেকে বাবা-মায়ের কাঁধের ওপর বসে খাচ্ছে। চেয়ে আছে ভাগ্যের দিকে। আর যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে তারাই কি পড়ালেখা শেষ করে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারছে? অনেকে নির্দিষ্ট বয়সসীমা পর্যন্ত চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে যখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত তখন নিজের যোগ্যতার চেয়ে কয়েকগুণ ছোট বেসরকারি চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য হয়। আর যারা সে সুযোগটুকুও পান না তারা যোগ হয়ে যান বেকারদের তালিকায়। এর মধ্য খেকে কিছু লোক বের হয় যারা নিজে উদ্যোক্তা হতে পারে। তবে বেশিসংখ্যকদেরই সে সুযোগ বা সামর্থ্য থাকে না। গত কয়েকদিন পূর্বে একটি ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরাঘুরি করছিল যেখানে আমিনুল ইসলাম নামে একজন বিসিএস পাশ নন ক্যাডার ব্যক্তি একটি ফেস্টুন বুকে ঝুলিয়ে ঘুরছিলেন একটি উত্তরের জন্য যে, বিসিএস পাশ করেও কেন তিনি বেকার? তার এ প্রশ্ন ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। তো এখন কী বলবেন? যেখানে বিসিএস পাশ করেও চাকরি নিশ্চিত হয় না সেখানে আপনি এ সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে কী করবেন? এর কোনো সদুত্তর আছে কি! অথচ লক্ষ লক্ষ তরুণ প্রতিবছর চাকরির আশায় বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং এর মধ্যে বেশিরভাগেরই ধারণা যে বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করলেই চাকরি মিলবে। কিন্তু বাস্তব তো তা দেখাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জনগণের প্রয়োজন হয় যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। আর বাকি শিক্ষিতদের আর গতি হয় না। তাই এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো কর্মমুখী শিক্ষা। যে পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণ করলে দেশে একটি মানুষও বেকার থাকবে না। আমার মনে হয় না প্রতিবছর ১০ বা ২০ লক্ষ পরীক্ষার্থীর এসএসসি বা এইচএসসি  পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বরং উন্নত বিশ্বের মতো প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পর তাদের অ্যাপটিচ্যুড টেস্ট করে তাদের পছন্দের বিষয়গুলোর উপরে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। যাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তারা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী হিসেবে বের হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম যে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নাকি প্রাথমিক শিক্ষা করা হবে। হ্যাঁ, যদি তা হয় তাহলে খারাপ হয় না বরং এতে কর্মমুখী শিক্ষার পথ আরও সুগম হয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের পর প্রতিটি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। যারা অবহেলিত ও দরিদ্র শিশু রয়েছে তাদেরও সরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা হোক। আর এর ভেতরেই সে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা লাভ করবে। প্রাথমিক শিক্ষা স্তর শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজের পছন্দ, ইচ্ছা, অনিচ্ছা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তখন তাদের আগ্রহের ভিত্তিতে বিভিন্ন কারিগরি, কর্মমুখী ও সাধারণ শিক্ষা প্রদান করা যাবে। সেই সময় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের শুধুমাত্র সেই একটি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ (হাতে-কলমে শিক্ষা) দিয়ে তাদের দক্ষ করে তোলা যাবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা দক্ষ হয়ে ওঠার পর বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের মেধার মূল্যায়ন করা যেতে পারে। তারপর তাদের অনায়াসেই রাষ্ট্র কাজে লাগাতে পারে আর তারাও পেতে পারে সুনিশ্চিত ভবিষ্যত।
এখন প্রশ্ন হতে পারে তাহলে রাষ্ট্র এত কর্মক্ষেত্র পাবে কোথায়? এর উত্তরে বলব, যেহেতু প্রতিটি শিক্ষার্থী বিশেষ বিশেষ কাজে দক্ষ হয়ে ওঠবে তখন তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে অবশ্যই তারা অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হবে। আর তাদের সে কর্মসংস্থানের জন্য সরকারকে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। বেসরকারি শিল্প-কারখানা স্থাপন পদ্ধতি সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে লোন পাওয়ার উপায়ও সহজ করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন  করতে হবে। প্রয়োজনে সেসব পরিচালনার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় বা দপ্তর স্থাপন করা যেতে পারে। যা একটি নিখুঁত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। কারণ যে দেশের জনশক্তি রয়েছে সে দেশে বেকার শব্দটি থাকা সমীচীন নয়। কেননা, তা শুধু আমাদের অর্থনীতিকেই পঙ্গু করে না বরং বিশ্বের দরবারে দেশটির মান ক্ষুণœ করে। বয়ে নিয়ে আসে লজ্জার মহাপ্লাবন।

নকল মানুষ

নকল মানুষ


নকল মানুষ
যাহিদ সুবহান

কয়েকটা দিন খুব খারাপ যাচ্ছে আজগর আলীর। কাজকর্ম সব সিকেয় ওঠার জো। চাটমোহর স্টেশনে ভিক্ষা করে দিনাপাত করে সে। কিন্তু কয়েকটা দিন আজগর আলী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও দাঁড়াতে পারছে না। স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে আনসার-কুলি-হকার এমনকি ওর জাতভাই ভিক্ষুকরাও ওকে দেখলেই তেড়ে আসছে। ওর স্টেশনে আসা নিষেধ! আজগর আলী বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত। এভাবে চললে তো বেঁচে থাকা দায়। সবার ভাব এমন যে সে একাই সবার পেটে লাথি মেরেছে। আজগর তো কিছুই করে নি! আরে বাবা এই স্টেশনে আজগর আলী কি কোন কুকর্মের সাতেপাঁচে থাকে? প্রতিদিন দুইবেলা এই স্টেশনে লোকান ট্রেন আসে। এই ট্রেনেই সে ভিক্ষা করে। আট-দশটা ইন্টার সিটি ট্রেন থামে চাটমোহরে, কেউ কোনদিন এসব ট্রেনে আজগর আলীকে উঠতে দেখেছে? কেউ বলতে পারবে? তোমরা তো বাপু লাফ দিয়ে ওঠো। যতো ভীড়ই থাকুক চিৎকার চেঁচামেচি করে ট্রেনের যাত্রীগুলোকে অস্থির করে তোল। আজগর তো এসব করে না। তারপরও এই আজগরই খারাপ; তোমাদের চোখের বালি! কখনো দেখেছো আজগর আলী কোন যাত্রীর কাছে গরম গলায় ভিক্ষা চেয়েছে? নরম গলায় পায়ে ধরে ধরে ভিক্ষা চাই। কান্নাকাটি করে ভিক্ষা করি বেটা। চোখের পানি ঝরানো যে কত কষ্ট তা শুধু আমিই জানি!

আজগর আলী নিজেকে দুর্বল মানুষ মনে করে। প্রতিবন্ধী মানুষ সে। অথচ এই দুর্বল মানুষটার উপরই সবাই শক্তি খাটায়; কু-নজর দেয়। এই যে হিজড়াদের দল প্রায় প্রতিটি ট্রেনে জোড় করে সন্ত্রাসীদের মতো তাদের কেউ কিছু বলে না। বরং সবাই ওদের ভয় করে। কী যাত্রী কী লোকজন সবাই জানে হিজড়ারা চাওয়ামাত্র টাকা না দিলে কিংবা ওদের ক্ষ্যাপালে কপালে দুর্গতি আছে। ওরা সম্মানহানী করে, এমন কি গায়ে হাত তুলতেও দুইবার ভাবে না। এসব বিষয় সবই জানে রেলের কর্তারা। কিন্তু কোনা সুরাহা নেই। চাওয়ামাত্র তাই হিজড়াদের দাবী মেনে নেয় সবাই অথচ যত অভিযোগ আজগর আলীর বিরুদ্ধে। আজগর আলী হাত পেতে অঝরে কান্নাকাটি করেও কারো পকেট থেকে দুই টাকা বের করতে পারে না। কেউ কেউ টাকা তো দেয়ই না বরং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দেয় আর বলে ‘যা ব্যাটা দুর হ!’

দুপুর বারোটায় বাড়ি থেকে বের হয় আজগর। সমস্যার সমাধান করা জরুরী। ভিক্ষা ছাড়া কিছুই জানে না সে। ভিক্ষার মতো টাকা কামানোর সহজ উপায় পৃথিবীর কোথাও নেই। স্টেশনের বড় বাবু মানে স্টেশন মাস্টার ছাড়া কোন উপায় নেই সমস্যা সমাধানের। তিনি বলে দিলেই আর কোন সমস্যা নেই। স্টেশন মাস্টারকে এখন গেলেই ফাঁকা পাওয়া যাবে। তার পায়ে ধরে হলেও সমাধান আজ করতেই হবে। পথে দেখা হয় শুকুরের সাথে। সে স্টেশনের দিক থেকেই আসছে।
Ñ আইজক্যি অবেলায় বাইর হইলে ক্যা আজগর ভাই? এহোন তো আর কোন লোকাল ট্রেন নাই। ভোরের ট্রেন তো চইলি গেছে, আর বিকালের ট্রেন তো অনেক দেরী। তুমি তো ইন্টারসিটিত ওটো না।
Ñ আর কইস নি ভাই, ইস্টিশনের সব শালা তো আমার পিচনে লাগেছে! ট্রেনে উটা তো দূরে থাক আমাক পিলাটফরমেই দাঁড়াতি দেয় না। যাচ্ছি একটু বড় বাবুর সাথে দেহা করতি।
Ñ ক্যা, সব তোমার পিচনে লাইগলি ক্যা?
Ñ কী জিনি রে ভাই, আমি আবার কার পাহা ধানে মই দিলেম!
কথা শেস করেই স্টেশনের দিকে হাঁটা দেয় আজগর আলী। ডান পায়ের উপর ভর করে বাঁ পা টা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে সে। শুকুর আরী তার হাটার পথে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে আর মিটমিট করে হাসে। শুকুর আলীর এই হাসির যথেষ্ঠ কারণ আছে। শুধু শুকুর আলী নয় এখানকার সবাই ইদানিং আজগর আলীকে দেখলে এভাবেই হাসে। এই হাসির যথেষ্ঠ কারণও আছে।

আজগর আলী হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌছে যায়। এখন কোন ট্রেন নেই তাই নিজের খাস কামড়ায় এক কাপ রং চায়ের কাপে মনের তৃপ্তিতে চুমুক দিচ্ছেন স্টেশন মাষ্টার। আজগর আলী সোজা গিয়ে স্টেশন মাস্টারের পায়ে পরে যায়। ওকে দেখে স্টেশন মাস্টার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। উনার চোখে ক্রোধের অনল জ্বলছে বোঝাই যাচ্ছে। থতমত খেয়ে স্টেশন মাস্টার আজগরের দিকে তাকিয়ে বলেÑ
Ñ কী রে আজগর নেংড়া, এখানে কী? তোকে না বলেছি প্ল্যাটফর্মে পা না রাখতে।
Ñ স্যার, আপনের দয়ায় বাঁইচি আছি। প্ল্যাটফর্মে না আসলি খাবো কী? বাঁচপো ক্যামা কই রি!
স্টেশন মাস্টার পা টা ছাড়িয়ে ওকে বাইরে বসতে বলে। আজগর আলী সুবোধ বালকের মতো বাইরে যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে বসে থাকে।

আজগর আলী এই চাটমোহরেই থাকে। পয়তাল্লিশ বছর বয়সী আজগর আলীর বাড়ি এখান থেকে কয়েকগ্রাম পরে। খুব ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়ে সে। গরীব মানুষের ছেলে তাই গ্রামের মানুষ ওকে নানাভাবে সাহায্য করতে থাকে। গ্রামের একটি আবাসিক এতিমখানা ও মাদ্রাসায় সবাই ওকে ভর্তি করে দেয়। এানেই সে বড় হতে থাকে। অসহায় হলেও ছোটবেলা থেকেই আজগর আলী অত্যন্ত দুষ্টু স্বভাবের মানুষ। মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া, এর ওর গাছে আম আর বড়ই গাছে ঢিল ছোড়া, ছোট ছেলেপুলেদের ধরে মারধর করা ইত্যাদি ছিল আজগর আলীর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়ায় বার বার একই ক্লাসে সে পড়তে থাকে। আজগর আলীর উধাও হয়ে যাওয়ার দিনগুলোতে তাকে আবিষ্কার করা যেত সিনেমা হলে। চাটমোহরের সিনেমা হলগুলোতে সে খুব পরিচিত মুখ। সিনেমা হলে কোন নতুন ছবি এবং তাতে সামান্য গরমদৃশ্য থাকলে তা মিস হতো না তার। একই টিকিটে ডাবল প্রোগ্রামে বিদেশি সিনেমার গরম গরম দৃশ্যের প্রথম সারির দর্শক আজগর আলী। আর এসব সিনেমার টিকিটের টাকা জোগাড় হতো বিশেষ উপায়ে। হাটবাজারে মাদ্রাসার জন্য টাকা তুলতে যেতে হতো। এসব উত্তোলনকৃত টাকা থেকে কিছু টাকা সরিয়ে রাখতো আজগর আলী। তার এসব কুকীর্তি ধরা পরে যায় মাদ্রাসার হুজুরের কাছে। তাই মাদ্রাসা ছাড়তে হয় তাকে। মাদ্রাসা ছাড়তে হলেও মাদ্রাসার লেবাস ছাড়ে না আজগর আলী। থুতনির নিচে সামান্য দাড়ি, মাথায় সুতার একটা ছোট টুপি আর গায়ে ময়লা একটা পাঞ্জাবি পড়েই থাকে সবসময়। তবে মসজিদে নামাজের জামাতে শেষ কবে তাকে দেখা গিয়েছিল তা কেউ ঠিক বলতে পারে না।

 গ্রামের মানুষের সহযোগীতা আর এই সেই করে চলতে থাকে আজগর আলী। তবে তার স্বভাব পাল্টায় না। একবার আলেয়া নামে এক বিধবার দিকে কু-নজর দেয়। আলেয়া আজগর আলীর চেয়ে বয়সে বড় হলেও আজগর আলী তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। অনেকবার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হয় একদিন সন্ধ্যার পর আলেয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে সে। আলেয়ার চেঁচামেচিতে এলাকার মানুষ আজগরকে ধরে ফেলে। হাত-পা বেধে বেদম মারপিট করে। চড়-থাপ্পড়-কিল-ঘুষি আর চেলাকাঠের বাড়ির চোটে আজগর আলীকে আধমরা হয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়। কয়েকদিন ডান পাটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। কয়েকদিন এভাবে চলতে থাকায় খুড়িয়ে হাঁটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। একসময় খুড়িয়ে হাঁটা হয়ে যায় তার উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। সেই থেকে চাটমোহর স্টেশনে ঠাঁই হয় আজগর আলীর। খুড়িয়ে হাঁটার অভিনয়টা খুব রপ্ত করে আজগর আলী।

এসব ঘটনার সবটাই জানে চাটমোহরের লোকজন। স্টেশন মাস্টার-আনসার-কুলি-হকার-ভিক্ষুক সবাই। তবে তার উপর সকলে ক্ষ্যাপা অন্য কারণে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নুরজাহান নামে একটা আধপাগলি মহিলাকে ইদানিং সে না কি খুব বিরক্ত করছে। নুরজাহান প্লাটফর্মের পাশে পলিথিনে তৈরী খুপড়ি ঘরে থাকে। হাতে নাতে ধরাও পড়েছে কয়েকবার। আজগর আলীকে চাটমোহরে থাকতে দেওয়া হবে না। কোন ট্রেনেও উঠতে দেওয়া যাবে না। সবাই এ ব্যাপারে একাট্টা।

স্টেশন মাস্টারের মৌন সম্মতি পেয়ে আজগর আলী প্ল্যাটফর্মে আসে। আজ সে যেন তার হারিয়ে যাওয়া রাজত্ব ফিরে পেয়েছে। অনেকদিন পরে আজগর আলীর যেন সুদিন ফিরে এসেছে। আজ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আজগর আলী মনের আনন্দে। কুলি-হকার-ভিক্ষুকদের কাছে আকার ইঙ্গিতে সে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। একটা সমঝোতাও হয়ে গেছে। স্টেশন মাস্টার সবাইকে বলে দিয়েছেন অন্তত এবাবের জন্য ওকে মাফ করে দিতে। একটু পরেই স্টেশনের আউটারে ঢুকবে লোকাল ট্রেন। পা টা আগের মতই ঠিকমত খোড়াতে পারছে কি না সেটা খতিয়ে দেখছে বারবার। আগের মত আবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে প্ল্যাটফর্মে আসা যাত্রীদের দিকে। নরম সুরে ভিক্ষা চাইছে। কেউ কেউ দুই টাকা, পাঁচ টাকা দিচ্ছে। কেউ কেউ টাকা তো দিচ্ছেই না বরং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে আর বলছে  ‘যা ব্যাটা দুর হ!’

অভিনয়

অভিনয়


অভিনয়
মুহাম্মদ বরকত আলী 

রুমের ভিতর থেকে টেলিভিশনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সম্ভবত স্টার জলসা চ্যানেলে কোনো সিরিয়াল হচ্ছে। এই চ্যানেলের নাটকের আওয়াজ কানে এলেই নিঃসন্দেহে বলা যায় জলসা চলছে। প্রত্যেকটা সিরিয়ালের একই মিউজিক। একটা কথা বলার পর অন্তত কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হয় পরবর্তী কথা শোনার জন্য। একটা সংলাপ বলা মাত্র ক্যামেরায় উপস্থিত সকল অভিনেতাকে দুইবার করে ফস ফস শব্দ মিউজিক দিবে আর দেখাবে। ম্যাডাম একজন শিক্ষিত মার্জিত সচেতন নাগরিক হয়েও এসব সিরিয়াল দেখে তা আমার ধারনা ছিলো না। এরকম কয়েকটা চ্যানেল আছে, যে গুলো দেখলে শুধু পরিবারের কলহ ছাড়া কিছুই শেখা যায় না। আমাদের দেশের নাটক গুলো কত সুন্দর শিক্ষণীয়। বিজ্ঞাপন একটু বেশি দিয়ে থাকে এই আর কী।
ছেলেটা আমার কোলে তুলে দিয়ে বেশ মজা করেই সিরিয়াল দেখা হচ্ছে। একটুও আলগা বসে থাকতে দিবে না। কথায় বলে না, কাজ নেই তো করি কী, ছেড়া কাঁথায় ধাগা দিই। এজন্যই বড় লোকদের আমি দেখতে পারি না। এরা গরিবদের মানুষ বলে মনেই করে না। কিন্তু ওদের পিছনে না ঘুরে উপায় আছে? উপায় না দেখেই এখানে পড়ে থাকা। এক প্রকার বাধ্য হয়েই। এদিকে চাকুরির বাজার খুব গরম। বাবার অবসরে যাওয়ার আগে স্যারকে তেল মেরে অনেক আকুতি মিনতি করে আমাকে মাস্টাররুলে নিয়োগ দিলেন।
চব্বিশ ঘন্টাই ডিউটি। স্যারের বাড়িতে থাকতে হবে। আরও দুইজন সহকর্মী আছেন। ওরা দুজনই এস এস সি পাশ দিয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে ফেলেছে। আমি মাস্টার্স শেষ করে বাবার আদেশে এখন সেবা প্রদান করছি। যাদের আছে তারা আরও চায়। এত টাকার বেতন, তবুও কত সখ। গরু পালন, হাস মুরগি পালন, সজ্বি চাষ, ফুলের বাগান, আরও কত কী। সারাদিন দৌড়ের উপর থাকতে হয়। গরুর ঘাস কাটা, গোয়াল পরিষ্কার করা, গরুর গোসল করিয়ে দেওয়া, দুধ দহন করা। হাস মুরগি পালন। সব্জির চাষ করার জন্য আমাদেরকেই সব করতে হয়। কোপানো থেকে শুরু করে, নিড়ানি, পানি দেওয়া। নিজের খাওয়ার মত সব্জি করলেও একপ্রকার ভালোই ছিল। বাজারের সব খাবারে বিষ দেওয়া। অতিরিক্ত সার বিষ প্রয়োগে কোনো খাবার আজ নির্দিধায় খাওয়া যায় না। সবগুলো সমস্যা। এযেনো টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাচ্ছি। কিন্তু উপায় নেই গোলাম হোসেন। তাই যতটুকু সম্ভব নিজেই বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করতে হবে। সেই সুত্র ধরে সাহেবও চাষ শুর করেছে। এটা একটু বাড়াবাড়ি যে, নিজের প্রয়োজন মেটাতে যতটুকু চাষ করা দরকার, তার চেয়ে অনেক বেশি চাষ করান আমাদের দিয়ে। অতিরিক্ত সব্জি বাজারে বিক্রিও করতে হবে। ছাত্র বয়সে বাড়ির কোনো কাজে হাত লাগাইনি। বাবা চাকুরি করেন; সেই সুবাদে আমার কাজ ছিল খাওয়া, পড়াশোনা করা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। সেই আমি এখন কখনো রাখাল, কখনো মালি, কখনো চাষি, আবার কখনো কাজের বোয়া। দিন শেষে রাতে তিনজন পালা করে রাত পাহারা দেওয়া। প্রধান গেটে জোয়ান জোয়ান দুতিন জন পুলিশ সারা রাত পাহারা দেয়, তবুও আমাদের পাহারা দিতে হবে। চাকর, এক কথায় কামলা। এই যে এখন বিকেল বেলা তবুও একটু বিরাম নেই। ছেলেটা আমার কোলে দিয়ে উনারা সিরিয়াল দেখছে। সন্তানকে একটু সময় না দিলে মা বাবার প্রতি মোহাব্বত জন্মাবে কীভাবে? সন্তান লালন পালনে করতে  বাবা মাকেও একটু সময় দিতে হয়। সব কিছু চাকার বাকর দিয়ে হয়?  এজন্যইতো এদেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের কোনো দরদ নেই।
প্রায় ঘন্টা খানেক সময় হয়ে এল ম্যাডামের কোনো খবর নেই। কোল থেকে নামতেও চায় না। পুরুষ মানুষ হয়ে কতক্ষণ এভাবে কোলে নেওয়া যায়? কোনো বাবাকেও দেখিনি এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা তার নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে থাকতে।
এই যে, এবার একটু নিচে নেমে খেলা কর বাবা। চলেন, ঐ পাখিটা ধরতে হবে। কোল থেকে নামাতেই আকড়ে ধরল। না, এভাবে কাজ হবে না। বাবার কৌশলটা প্রয়োগ করতে হবে। বাবাকে বলতে শুনেছি, এক সাহেবের ছেলে বাবাকে খুব পছন্দ করত। বাবার কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে উঠত না। সময় সুযোগ পেলেই বাবার কোলে তুলে দিয়ে ওনারা আরাম আয়েশ করতো। তাই বাবা একটা উপায় বের করেছিল। চিমটি। হ্যা, চিমটি দিয়ে ধরত। তবে মৃদ্য ভাবে। এতেই কেঁদে উঠত  আর ম্যাডাম বাধ্য হয়ে বাবারকে মুক্তি দিতো। বাবাও সস্তির বাতাসে গা ভাসিয়ে বাড়ি ফিরত। উপায় ছিলো না। অফিস শেষে বাবাকে স্যারের পিছনে পিছনে যেত হতো স্যারের বাড়ি।
আমাকেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। দাঁড়া বাবা, তোর মায়ের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। তোরও তো বাবা-মায়ের আদর নেওয়ার অধিকার আছে। একটু সহ্য কর। তোর জন্যই করছি। হালকা চিমটি দিতেই কেঁদে উঠল। ম্যাডামকে শোনানোর জন্য রুমের নিকটে নিয়ে গিয়ে আরও একবার দিলাম একটু ভলিউম বাড়িয়ে। চ্যাঁ চ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করল। ম্যাডাম রুম থেকে শুনতে পেয়ে হাঁক ছাড়লেন।
‘কী ব্যাপার, কাঁদছে কেন?’
‘থাকতে চাইছে না ম্যাডাম। কত কিছু দেখাচ্ছি, আদর করছি, তবুও থাকতে চাইছে না।’
স্যার বললেন, ‘অনেক্ষণ তোমাকে দেখিনিতো।’
স্যারের কথায় কথা দিয়ে বললাম, ‘জ্বী স্যার, সঠিক রোগ ধরেছেন।’
ম্যাডাম কোলে নিতেই কাঁন্না থেমে গেল। আপাতত আমার মুক্তি।
আমার সহকর্মীরা বাগানে কাজ করছে। কেউ ফুল গাছে পানি দিচ্ছে, কেউ গরু গুলোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছে।
স্যারের বড় ছেলে অন্তর। এবার আট ক্লাসে পড়ছে। বড় লোকের ছেলেরা সাধারণত খুব মেধাবী হয়। কেন যে ওরাই মেধাবী হয় এর নির্দিষ্ট কোনো কারণ আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলা যায় যে, গরিবের ছেলেমেয়েরা নানান অভাবে থাকে। খাদ্যের অভাব, জামাকাপড়ের অভাব, খেলাধূলা করার অভাব, এক কথাই নিজের মত করে কিছুই তারা পায় না। এই এতকিছু অভাবের মধ্যে তাদের কছে লেখাপড়াটা আশা করা খুব কষ্ট সাধ্য। খিদে পেটে লেখাপড়া কেন, কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে করে না।
আর বড় লোকের টাকার অভাব নেই। ছেলেমেয়ে কিছু চাওয়ার আগেই পেয়ে যায়। তাই তাদের কাজ বলতে ঐ একটাই, লেখাপড়া।
আমার সহকর্মীরা এস এসসি পাস হলেও আমি কিন্তু মাষ্ট্রার্স শেষ করেছি। বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে এল এল বি করাবেন। দুর্ভাগ্যটা বাবার না আমার তা বলা মুশকিল। বাবার পচ্ছন্দ হলেও আমার ওপেশা একদম পছন্দ না। তাই সরকারি চাকুরির বয়স শেষে এখানে এসে গরুর ঘাষ কাটা আর চাকুরির নামে চাকরের চাকুরির প্রার্থী হয়ে কামলা খাটা। উপায় কী? ঘুষ দিয়ে চাকুরি নেওয়ার পক্ষে বাবা যেমন ঘোর বিরোধী ঠিক তেমনি আমিও। যাই হোক, স্যারের ছেলে অন্তরের কথা না বললেই নয়। অন্তর গণিতে বেশ কাঁচা। বাসায় পড়ানোর জন্য একটা হোম টিচার ঠিক করার দ্বয়িত্ব পড়ল আমার কাঁধে। মসিক কিছু সম্মানি আর একবেলা পেটে খাওয়ার শর্তে নিয়োগ পাবেন। কিন্তু বি এস সি শিক্ষকের বেশ অভাব। একটু চেষ্টা করলে পাওয়া যেত, কিন্তু অতটা গুরুত্ব দিলাম না। অন্য কেউ এসে স্যারের মন জয় করুক সেটা আমি হতে দিব না। আগ বাড়িয়ে আমিই একদিন গণিত করাতে বসে গেলাম। স্যার বললেন, ‘তুমি প্রতিদিন সময় দিতে পারলে বাইরের শিক্ষকের প্রয়োজন কি? তুমি একটু সময় দিতে পারবে না?’
‘জ্বী স্যার, পারবো। কোনো চিন্তা করার দরকার নেই। কত প্রাইভেট পড়িয়েছি।’ ম্যাডাম এসে বললেন, ‘সেই বেশ হবে, রাতের বেলা তুমি একটু সময় দিও। তাছাড়া বাইরে থেকে কে আসবে না আসবে। বেতনটা তাকে দেওয়ার চাইতে তোমাকেই দিলাম।’
‘ম্যাডাম, আমার একটা কথা রাখতে হবে। অনুগ্রহ করে টাকার কথা বলবেন না। আমিতো আপনাদের খেদমতে এখানে আছি। তাছাড়া মাস শেষে কিছু পাচ্ছি। বাবুকে পড়ানোর জন্য একটি টাকাও নিবো না।’
স্যার বললেন, ‘আচ্ছা, সে পরে আলাপ হবে। এখন পড়াও।’
মাস্টাররুলে থেকে যা বেতন পাই তাতে অতি নগণ্য। কিন্তু সাহেবের কাছ থেকে টিউশনির বেতন নেওয়া যাবে না। শুনেছি, সাহেবেরা ফাউ ফাউ কারো কাছ থেকে কিছুই নিতে চায় না। যাদি নিয়েও থাকে, তবে তার একটা প্রতিদান দিয়ে যায়। তাহলে এই সুযোগ হাত ছাড়া করি কোন আক্কেলে? এখানে একটা চরম মিথ্যে বলেছি। আমার ছাত্র জীবনে কখনো একটি টিউশনিও করিনি। টিউশনি না করলে কি পড়ানো যায় না? এস এস সিতে বিজ্ঞান শাখার ছাত্র ছিলাম। গণিতে বরাবরি ভালোই ছিলাম। এখনো চোখ বন্ধ করে সব সমাধান করে দিতে পারব। তারপরও একটা কথা থেকে যায়, জে এস সি পরিক্ষা মানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও এই চ্যালেঞ্জ আমাকে নিতে হবে। অন্যান্য কাজের শেষে রাতের বেলা দু’এক ঘন্টা সময় দিলাম। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম গণিত শেখাতে। সারাদিন কাজের শেষে পড়াতে খুব বিরক্ত হলেও নিয়মিত বসতাম। মাস শেষে বেতন দিতে কতই না জোর করল। কত অনুরোধ, তারপর আমার জয় হলো। পড়ানোর মাসিক বেতন না নেওয়াতে ম্যাডাম আমার প্রতি আলাদা একটা ভালো নজর দিলেন। অন্তরেরও প্রিয় হয়ে উঠলাম। আমার অন্য সহকর্মীরা অতিরিক্ত কাজ করতে আলস্য দেখাত। যেহেতু আমি মাস্টারুলে আছি, সেহেতু দিন রাত সব সময় স্যারের বাড়িতেই থাকতে হতো। সকাল দশটার পর সাহেব অফিসে যাওয়ার পর  কিছুটা সময় অবসর পেতাম। কিন্তু চেষ্টে করতাম অবসর সময় না কাটানো। স্যার, ম্যাডাম আর নিষ্পাপ দুটি ছেলের নিকট সবার থেকে আমিই প্রিয় হয়ে উঠলাম। 
সকালবেলা স্যারের গাড়ি ধোয়ামুছা, অন্তরকে স্কুলে পৌছে দেওয়া, ছোট বাবুকে কোলে করে ঘুরে বেড়ানো, হাকডাক পড়তেই সবার আগে উপস্থিত হওয়া, আমার নিত্যকাজ। সব সময় বাবার উপদেশটা অনুসরন করতাম। তিনি কঠর ভাবে বলে দিয়েছেন, সাহেবের মন জয় করতে হবে। যেভাবে পারবি স্যার, ম্যাডামের মন জয় করতে পারলেই তুই তোর সাফল্য আসবে। আমিও সাধ্যমত চেষ্টা করতে লাগলাম। জীবনে যা করেছি সেটাও করলাম, যা কখনো করিনি সেটাও করলাম। মূল উদ্দেশ্য স্যার, ম্যাডামকে খুশি করা। দুজনেই আমার ব্যবহারে খুশি। মাঝে মধ্যে বাজার থেকে অন্তর আর ছোট বাবুর জন্য নানা জিনিস নিয়ে আসতাম। স্যার, ম্যাডাম টাকা দিলে ভিষণ মন খারাপ করতাম। এভাবেই বছর পার হয়ে গেল। অন্তরের জে এস সি ফলাফল দিলো। অন্তর এপ্লাস পেয়ে উত্তির্ণ হল। গণিতের ফলাফল দেখে সাহেব, ম্যাডাম মহাখুশি। এই এক বছরে সে গণিতে অনেক উন্নতি করেছে।
হঠাৎ স্যারের বদলির চিঠি এল। আগামি সপ্তাহে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। তোড়জোড়ে চলছে আসবাবপত্র গোছানোর কাজ। গরু, হাস মুরগি বিক্রি করা হয়েছে।
আমার মনটা তেমন ভালো নেই। এতকিছু করার পরও কোনো ফলাফল না পেতেই এভাবে হঠাৎ সাহেব চলে যাবেন তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমার জানা ছিল অন্তত চার বছরের আগে কোনো বদলি নাই।
পরের দিন সকালে সারের অফিসে ডাক পড়ল আমার। কিসের জন্য ডেকেছে তা অজানা। সকাল সকাল উপস্থিত হলাম। স্যার চেম্বারে বসে আছেন। আমি ধীর পারে টেবিলের নিকট দাঁড়ালাম। স্যার মৃদু স্বরে বললেন, ‘তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। বসো।’
নিঃশব্দে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম।
স্যার চেয়ারটা একটু দুলুনি দিয়ে শরীরটা সামনে পিছনে করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘সবকিছু গোছানো শেষ হয়েছে?’
‘জ্বী স্যার। মালামাল বহনের জন্য একটা ট্রাক রিজার্ভ করা হয়েছে। আমার এলাকার ড্রাইভার, কোনো সমস্যা হবে না।’
‘আচ্ছা কাজের কথায় আসি। এখানে তোমাকে মূলত ডেকেছি একটা সুসংবাদ দেওয়ার জন্য। যে সুসংবাদটা পাওয়া জন্য লক্ষ লক্ষ বেকার ছাত্ররা অধির অপেক্ষায় থাকে।’
স্যার ঠোটে একচিলতে হাসি নিয়ে একটা কাগজ দেখি বললেন, ‘এটা কি জানো? এটা তোমার নিয়োগ পত্র। তোমার কাজ আর আমার পরিবারের প্রতি তোমার ভালোবাসায় আমার দিল খুশ। একজন এম এল এসকে প্রমোশন দিয়ে একটা পদ খালি করা হয়েছে। তোমাকে মাস্টারুল থেকে এম এল এসে নিয়োগ দেওয়া হয়েবে।,
আমার বুকটা ধক করে উঠল। কোনো কথা খুজে পাচ্ছি না, কথা আটকিয়ে আসছে। স্যারের হাতের কাগজটা নিছক একটা কাগজ হলেও সেটা এখন আমার সৌভাগ্য। এই কাগজটার জন্য কি না করতে হয়েছে আমাকে। যে কাজ আমার বাবা মা করিয়ে নেয়নি কখনো সেই কাজ এখানে করেছি। গোয়াল ঘর থেকে অন্তরের পড়ার ঘর। গরুর ঘাস কাটা থেকে সব্জী চাষ। কুলি কাজ, ধোপার কাজ, সব সব করেছি নির্দিধায়। ইচ্ছের বিরুদ্ধ্যে, দিন রাত হুকুম শুনেছি আর মিথ্যে হাসি হেসেছি স্যার ম্যাডামের সামনে। অন্তরকে ও ছোট বাবুকে ভালোবেসেছি এই একটি দিনের জন্য। সব ছিল অভিনয়। যা করেছি সব ছিলো ইচ্ছের বিরুদ্ধ্যে।
স্যার বললেন, ‘কি ভাবছো? আমাদের চলে যাওয়া নিয়ে কষ্ট পাচ্ছো? সময় করে ঘুরে এসো ওখানে। এই নাও তোমার নিয়োগ পত্র। এখানে সাক্ষর কর।’
এগিয়ে দিলেন কাগজটা। কাগজটা হাতে নিতেই কানের কাছে কে যেনো বলতে লাগল, ‘তুই বড় অভিনেতা। চাকুরি পাওয়ার লোভে তুই আজ এদের সাথে অভিনয় করেছিস। নিষ্পাপ দুটি ছেলের সাথেও তুই মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় করেছিস। তুই পাপ করেছিস। বড় অন্যায় করেছিস।’
ঠিকইত। আমি যেটা করেছি সেটা এই কাগজটার জন্যই করেছি। অভিনয় করেছি, মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয়। মানুষকে ভালোবাসা এতটা সোজা কথা না। নিস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা যে খুব কঠিক কাজ।
স্যারের দিকে এগিয়ে দিলাম কাজটা।
‘স্যার, নিয়োগ পত্রটা রাখেন। আপনি যে আমার উপর খুশি হয়ে এই নিয়োগটা দিচ্ছেন তা ভুল। আমি আপনাদের কাউকেই মন থেকে ভালোবাসতে পারিনি। যা করেছি তা ছিল আমার চরম অভিনয়।’
স্যার, আবারও হাসলেন। বললেন, ‘তুমি অভিনয় কর আর নাই কর, তোমার কাজগুলোতো আর মিথ্যে ছিল না। তোমার কাজ ছিল আমাকে খুশি করা।’
‘না স্যার, আমার কাজ ছিল আমার অবস্থানে থেকে সাধ্যমত আপনাদের সেবা দেওয়া।’
‘তুমিতো সেটাই করেছো।’
‘করেছি, তবে অতিরিক্ত অভিনয়ের সাথে। দ্বায়িত্ব নিয়ে না। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করেছি আর দিন শেষে বিরক্ত হয়েছি।’
‘এরকম তুমি কেন, সবাই করে আসছে।’
‘কিন্তু স্যার, আমি করতে চাই না। এই মিথ্যে ভালোবাসার অভিনয় থেকে আমি মুক্তি চাই।’
‘এরচে বেশি ভালোবাসতে পারবে না। পাগলামো করো না। তোমার ব্যবহার আর আমার স্ত্রী, সন্তানের প্রতি ভালোবাস মিথ্যে হলেও সেটা আমাকে ও আমাদের মন জয় করেছে। তার পুরুষ্কার দেওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করছো কেন?’
আর বেশি কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। আমি আর যোগদান করিনি। পরবর্তীতে আমার সহকর্মীদের মধ্যে একটা পরিক্ষা নিয়ে একজনকে নিয়োগ দিয়ে স্যার বিদায় দিয়েছিলেন। যেদিন স্যার এখান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সেদিন কারো সামনে যেতে পারিনি আমি। শুনেছি সেদিন অন্তর আমার জন্য খুব কেঁদেছিল। যাওয়ার পূর্বে ও আমাকে একটা হাত ঘড়ি উপহার দিয়ে গিয়েছিল। একটা চিরকুটে লিখে দিয়ে ছিল, ‘আপনি আমার গণিতের গুরু, আমি যেদিন চাকুরি পাব সেদিন আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। ঘড়িটা হাতে পরবেন স্যার, এটা স্যারের প্রতি আমার ভালোবাসা। জানি অন্তর, তোর এই ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই।

পদাবলি : ০১

পদাবলি : ০১


পরকাল
তমসুর হোসেন

অনেক বড় বিপদ উপেক্ষা করে আমি হতে পারছি না অন্ধ উদাস
পারছি না পৃথিবী থেকে পালিয়ে অচেনা কোন জগতে লুকিয়ে থাকতে
মৃত্যু এসে সর্বগ্রাসী রূপে সুমুখে দাঁড়ালে কি করে করব প্রতিরোধ
বিভীষিকাময় অন্ধকার সুড়ঙ্গে একা একা কেমন করে যাব হেঁটে
স্বজন হতে বঞ্চিত হয়ে কবরের স্তব্ধতায় কী করে কাটবে দিন
কষ্টের যতিহীন প্রমত্ত হাহাকার হৃদয়ের সব স্বপ্ন মুছে দেবে।

কোটি কোটি বছর মাটির ঘরে অচেতন হয়ে থাকা কী করে সম্ভব!
সেখানে প্রদীপ নেই কথা বলার সাথী নেই পাখি নেই বাতাস নেই
নেই রঙিন কুসুমে ভ্রমরের গুঞ্জরণ, সীমাহীন নীলাভ আকাশ।
মৃত্তিকার জঠরে মিশে দেহহীন অনস্তিত্বে কি করে থাকব ঘুমিয়ে ।
প্রকাশের উদ্দাম তরঙ্গময় ললিত কাব্যকথা হারাবে কত দূরে
ব্যথিত বিহঙ্গ হয়ে বন থেকে বনান্তরে উড়ে যাব দূর অজানায়।

আকাশ দরোজা হবে ধূনিত তুলা হয়ে ওড়বে পাহাড় খসবে তারা
মহাসাগর উথলাবে কবর ফেঁটে ছুটবে মানুষ আরশের দিকে
জানবেনা কিছু কোনখানে গন্তব্য তাদের পিছু নেবে আগুনের শিখা
হাশর ময়দানে ঘামে গলবে দেহ কাটবে সাঁতার বাঁচার আশ^াসে
ওৎ পেতে থাকবে পুলসেরাতে ভয়াল গুপ্ত জাহান্নাম অগ্নি গহ্বর
জনক জননী ভ্রাতা আদরের সহোদরাসেদিন হবেনা সহায়ক।

চুলচেরা বিচার হবে তামারঙ মাঠে প্রচ- তাপে কতকাল ধরে
দ- হাতে বসবে ক্রুদ্ধ বিচারক একচ্ছত্র অধিপতি জাল্লেজালাল
বড়ই শক্ত আর নিরপেক্ষ যাচাই হবে খুটে খুটে বিগত আমল
নত হবে পাপী মলিন কদাক চেহারায় পড়ে রবে মৃত্তিকায়
আমার জায়গা হবে কোথায় লুকাব কৃত গুনাহরাশি কোন কর্দমে
বিপুল গ্রাসে খোদাদ্রোহী পাপীদের পেটে টেনে নেবে উন্মত্ত জাহান্নাম ।


কৌশলহীন হৃদয় মেলো
আশ্রাফ বাবু

যতোটা শব্দে ভালোবাসে
ততোটা হৃদয় স্পর্শ করে নাই,
অনেক কৌশলী।
কতটুকু হৃদয় প্রয়োজন ছিল?
যতোটা গ্রহণ করি ততোটা তার জায়গা নেই
কিছুটা বিশ্বাস করে স্বার্থে মিল হলে।
কিছুটা বিশ্বাস চাই।
এতো প্রশংসার প্রয়োজন নেই যা আড়ালে ডুবে যায়।
কিছুটা আঘাত,
অবহেলা চাই?
প্রত্যাখান।

সাহস আমাকে পথ দেখায়
মিথ্যার হাতছানি দেখি অবেলায়
কতটুক ফুলের প্রয়োজন ছিল।
প্রয়োজন নেই, নেই প্রয়োজন।
করুণাকাতর বিশ্বাসের সত্যতা আঁধার ঘরে।

নষ্ট হৃদয় বাঁচো আঁধারে একাথাকো কিছুদিন,
মন মমতায় জাগো;
আরো কিছুদিন দেখো তোমাকে।
নিরীহ  উষ্ণতা সমৃদ্ধ করো
কৌশলহীন হৃদয় মেলো।


ডুব দেয় অসমাপ্ত চাওয়া 
শরীফ সাথী 

আমার চাওয়াগুলো যেন অসমাপ্ত থেকে যায়।
সেই কবে চেয়ে দেখছি তোমায়
মুচকি হাসির ফোয়ারা ভেজা ঠোঁট
নীল নয়না চোখ। মসৃণ গালে তিলক ছোঁয়া
পুষ্প ফোঁটা মুখয়বে অনুরাগের অনুভুতি
লম্বা কেশে ঢেউ তোলা বিন্দি
মেহেদী সাজানো হাত
জোছনা রাতে হেলেদুলে হাঁটা মনে পড়ে খুব।
ক্ষণে ক্ষণে ডুব দেয় মনে আমার অসমাপ্ত চাওয়া।


সৌদামিনী
রামপ্রসাদ সূত্রধর

তুমি সুন্দর তুমি মুগ্ধকর তুমি চমকসৃষ্টি
ফেরাতে পারি না আমার চোখের দৃষ্টি।
আমি তুমি সোমত্ত বিরহ ঘুচায়ে সকল দূরত্ব
এসো হই আজি প্রাণবন্ত, খুঁজে লই অস্তিত্ব।



আখর
সিত্তুল মুনা সিদ্দিকা

সাত সতের ভেবে ভেবে কাটাই জীবনভর,
আশার কঠিন জলরঙেতে রাঙানো বালুচর!
নিপুণ হাতে গড়েছি কেবল কল্পলোকের ঘর!
দুরন্ত এই নিঝুম প্রহর, অসীম শক্তিধর!
মাঝে মাঝে ভাবের ঘোরের চুপটি করে থাকি
মনের কোনের অলীক অভাব ঘুম পাড়িয়ে রাখি।
শুভ্র কাগজে আবেগটুকু কালির সাথে মাখি।
আখর দিয়ে সাজায়ে নেয়া কাব্য নেবে নাকি?




শোবার ঘর
শেখ একেএম জাকারিয়া

সামনে গাঁজার ছিলিম
নেশায় বুঁদ পিস লিলি ক্রিসেনথিমাম
এই হেমন্তে জনসমাগম তুলনামূলক বেশি।

ছোট প্রজাতির
স্নে প্ল্যান্ট নির্গত অক্সিজেন
মানসিক চাপ আর দূষিত বাতাস
সরাতে দিনরাত পাম্প করেথ

খুব সাহসী পদক্ষেপ
হৃদপিণ্ড হেসে ওঠে শোবার ঘরে
ফিকাস বা বস্টন ফার্ন
ফিগ প্ল্যান্ট অথবা স্পাইডার প্ল্যান্ট
দিনের আলোর মত সুখ বিলায়।

ওয়্যারড্রোবের ওপরে
বেড সাইড টেবিলে রাখাথ
ছোট আকারের চলনসই মানিপ্ল্যান্ট
নতুন বধুঁর মত দুগালে চুমু খেয়ে
শীৎকার দেয়

চোখবুজে লেমন বাম খুশবু
ফার্ন অর্কিড এলোভেরা
অথবা চায়নিজ এভারগ্রিনের মত।



বিজয়ের দাবিগুলো
আহমদ মেহেদী

আমি যদি বাংলাদেশের আটান্ন হাজার
বর্গমাইলের এক লক্ষ ভাগের একটি অংশ হয়ে থাকি,
তাহলে আমি চাই এদেশে আর একটিও বিনা কারনে লাশ না পড়ুক ,
বাংলাদেশের এই বিজয়ের লক্ষ-কোটি ভাগের একটি অংশও হয়ে থাকি
তাহলে আমি চাই এবারের বিজয়ের পর এদেশে আর একটি মেয়ে কিংবা নারী ধর্ষিত না হউক ,
এদেশে আর একটিও শিশু হাসপাতাল গুলোর লোভের কারনে অবেহেলায় না মরুক,
আমি যদি এদেশের হাজার-কোটি বালুকনার এক বিন্দুর অংশও হয়ে থাকি,
তাহলে আমি চাই এদেশের মানুষ নিরাপদে বাস করুক, ন্যায়বিচার পাক,
মানুষের পথচলা হোক আরো নিরাপদে,সড়কে অকালে কোন স্বপ্ন জড়ে না
পড়–ক,
বিজয়ের দাবিগুলো- সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়–ক, বাংলাদেশের সুনাম বিশে^ ভাইরাল হোক।

পদাবলি : ০২

পদাবলি : ০২


চুপ
আকিব শিকদার

চুপ করে রও চুপ-
এখন আমি জ্বলছি ভীষণ
অগ্নিগিরির চূড়ায় যেমন ভয়াল অগ্নিকূপ।

চুপ করে রও চুপ-
আমার দহন দিচ্ছে পোড়ে
মিথ্যে কুহক, কুশ্রী শ্বাপদ, আবর্জনার স্তূপ।

চুপ করে রও চুপ-
আমার হাতের স্পর্শ পেলে
কটুগন্ধী ঘুঁটে পোড়ে হয় গন্ধমধুর ধূপ।



তোমাকে দূরে রাখব
মোহাম্মদ আবদূর রহমান

তোমার বুকের উপর সারাক্ষন খেলা করি
ভুলে যায় নিজের কর্তব্য
তুমি আমাকে কাছে পেয়ে
বাড়িয়ে দাও
তোমার লাল পাপড়ির মত ঠোঁট
অনায়াসে চুম্বন করতে থাকি
তুমি নিজেকে ধর্ষিত হতে ভালোবাস
আসলে তুমি তো ভাবনা
তোমার নিজের কথা
ক্ষতি চাও আমার
আমি বুঝিনি কোনদিন।

তোমার অভিনিত নাটক
কেড়ে নিয়েছ আমার অবুজ হৃদয়
স্ত্রী ছেলে মেয়ে ছেড়ে
তোমাকেই জড়িয়ে থাকি
সব সময় তোমাকে খাওয়ার খায়িয়ে রাখি।
বৃষ্টির সময় খাবারের অভাবে
তুমি না খেয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে থাকলে
বুকের ভেতর সৃষ্টি হয় অদ্ভুত শিহরন
বারবার অপেক্ষা করি তোমার খাবারের
খাবার পেলে
খাবার খায়িয়ে
তোমাকে আবার জড়িয়ে থাকি
এখন তো তোমার খাবারের ব্যাংক কিনে ফেলেছি।

আর কত দিন পরে বুজব তোমাকে
ভাবি একথা
তোমাকে ছাড়া তো ভালোই ছিলাম
সবার সাথে সম্পর্ক ছিল
সবার সাথে গল্প করে কেটে যেত সময়
তুমি জাতিকে করেছ রুগ্ন
ছিঁড়ে ফেলেছ অনেক বন্ধন।

জানি তোমাকে ছুড়ে ফেলতে পারবনা
তবে তোমাকে আর ভালোবাসিনা
তোমাকে আসতে আসতে দূরে রাখব
আমার থেকে
অনেক অনেক সময় ।


মনের অভিলাষ 
মিনহাজ উদ্দীন শরীফ

ইচ্ছা করে হাওয়ায় দোলে তেপান্তরে যেতে;
পাখি মতো উড়ে বেড়াই পাকা ধানের ক্ষেতে।
ইচ্ছা করে মায়ের হাতে দুধ কলা ভাত খেতে;
যাই ফিরে যাই শৈশবের-ই রঙিন পালের নায়ে;
ইচ্ছা করে তিমির রাতে- যেতে চাঁদের গাঁয়ে।
হেমন্তের ঐ ভেজা ঘাসে- হাঁটতে খালি পায়ে।

ইচ্ছা করে বইয়ের বাড়ি, বাঁধি আমার বাসা;
সূর্যের সাথে খেলি বসে, এক টেবিলে পাশা।
ইচ্ছা করে জোনাক হয়ে বন-বাদাড়ে জ্বলি;
বাবা মায়ের স্বপ্নের পথে দিবানিশি চলি।
ইচ্ছা করে প্রজাপতির রঙে মেতে উঠি;
শিশির ভেজা গোলাপ হয়ে ভোর সকালে ফুটি।

ইচ্ছা করে দেশের ছবি লাল সবুজে আঁকি; 
মাতৃভূমির কপালের টিপ হয়ে, চিরকাল থাকি।
ইচ্ছা করে নদীর বুকে শাপলা বেশে ফুটতে;
দেশের জন্য যুদ্ধে আবার বীরের নামে ছুটতে।
ইচ্ছা করে ‘নজরুল’ রূপে দ্রোহের বাণী বলতে;
হাতে হাতটা রেখে সবাই একই সাথে চলতে।

ইচ্ছা করে কবির মতো ছন্দ ছড়া বলি;
কোমল মতি শিশির মতো হই বাগানের কলি।
ইচ্ছা করে ‘শেখ মুজিবের’ প্রতিচ্ছবি হতে;
দীপ্ত পায়ে টগবগিয়ে চড়তে ঘোড়ার রথে।


গৃহবন্দি খাবো কি?
শরিফুল ইসলাম

পৃথিবীটা আজ মৃত্যুপুরী-
চারিদিকে শুধু নিদারুণ লাশের মিছিল!
উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল লাশেদের খুব ভিড়ে-
কুৎসিত কদাকার লাশেরা আছে ঘিরে
মৃত্যুর স্বাদ নিবে তাদেরই অখিল!

পৃথিবীটা আজ বধ্যভূমি-
কফিন বিহীন লাশ গুলো আছে আলুথালু!
তবুও নেই শেয়ালে লাশ খাবে- সেই ভয়,
কুৎসিত মানুষ গুলো আজ, তারা শুধু কয়-
আমরা গৃহবন্দি খাবো কি রোধ আছে চালু?



গোধূলি
অনিন্দিতা মিত্র  

গোধূলি বেলার শেষ কমলা রঙের রোদ্দুর এসে দাঁড়িয়েছিল তোমার বারান্দায়। একটা ছাই রঙা কাক ঠোঁট ঘষছিল আরো একটা কাকের ঠোঁটে। জিয়ল গাছের পাতা নাচছিল তার মতো করে, দুঃখগুলো সুখের সীমানা পেরিয়ে হয়ে উঠেছিল উত্তাল বসন্তদিনের ¯্রােত। তোমার আঙুলে লেগেছিল আমার স্মৃতির ভার, লুকিয়ে লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলাম সেদিন, পাশে ছিল না কেউ, তাই সমস্ত ব্যথা উজাড় করে ঢেলে দিতে চেয়েছিলাম আকাশকে।শোকের রঙ আছে, নিজস্ব রঙ। শোকের নিস্তব্ধ ঢেউ আলো জ্বালায় মনের গোপন ঘরে। মৃত্যু মাঝে মাঝে বিলি কাটতে চায় চুলে, প্রশ্ন করি না তাকে।  জীবন তো মেলাতে পারলো না, হয়তো মৃত্যু মিলিয়ে দেবে তোমাকে আমাকে। 

সাংবাদিক মুনশী ইকবাল’র ‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’

সাংবাদিক মুনশী ইকবাল’র ‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’


সাংবাদিক মুনশী ইকবাল’র 
‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’

মোহাম্মদ অংকন


বিশ্বের বেশিরভাগ সফল এবং ধনী মানুষের মধ্যে একটি জায়গায় দারুণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তা হল- তাঁরা প্রায় সবাই প্রচুর বই পড়েন। ওয়ারেন বাফেট একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি  দিনের শতকরা আশি ভাগ সময় বই পড়ে ব্যয় করেন, প্রতিদিন প্রায় পাঁচশ পাতা পড়েন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ বছরে পঞ্চাশের অধিক বই পড়ে থাকেন। বিশ্ববরেণ্য কোটিপতিদের সাফল্যের পিছনে তাদের পড়া বিভিন্ন বইয়ের অবদান কোনো অংশে কম নয়। পাঠকদের বই পড়ার দারুণ আগ্রহবোধ থেকে লেখকরা প্রতিনিয়ত বই লিখছেন। শুধু বইমেলা উপলক্ষ্য নয়, সারাবছরই কমবেশি বই প্রকাশ হচ্ছে। মৌসুমি লেখকদের আড়াল থেকে বেরিয়ে সেপ্টেম্বর (২০১৯) মাসে বই প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক মুনশী ইকবাল। তিনি বই লিখেছেন গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান নিয়ে। বইটির নামকরণ করেছেন- ‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’।

লেখক মুনশী ইকবাল মূলত একজন সাংবাদিক। তিনি সাংবাদিকতা বিষয়ক একজন দক্ষ প্রশিক্ষকও।  এর বাইরে তিনি একজন লেখক ও কবি। কর্মরত আছেন উত্তরপূর্ব জনপদের প্রভাবশালী দৈনিক জালালাবাদের ক্রাইম ও কারেন্ট বিটে। এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন দৈনিক জালালাবাদের সাহিত্য বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। লেখক সময় পেলেই বেরিয়ে যান মাঠে প্রান্তের। চলে যান পাহাড়, নদী আর বন-বনানীর কাছে। ঘুরে বেড়ান জনপদ থেকে জনপদে,  কথা বলেন সাধারণ মানুষের সাথে। রিপোর্টিংয়ের বাইরে তাঁর লেখালেখির মূল রসদ আসে এখান থেকেই। ‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’ বইটির মূল উপাদান তাঁর এই ঘুরে বেড়ানো থেকে নেওয়া। তিনি বইটিতে শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে সহজভাবে তুলে এনেছেন হারিয়ে যাওয়া সেইসব ঐতিহ্যের কথা যা কিছুদিন আগেও আমাদের চোখে পড়তো। ‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’ বইটি পালকি, ঢেঁকি, হুক্কা, গ্রামোফোন, গরুর গাড়ি, হ্যাজাক বাতি, চিঠি, কাঠের লাঙল, নৌকাবাইচ, মাটির পাত্র নিয়ে লেখা তথ্যনির্ভর প্রবন্ধ দিয়ে সাজিয়েছেন। এসব জিনিসপত্র আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু কিভাবে এসব আজ বিলুপ্তির পথে, তা বইটি পাঠের মাধ্যমে জানা সম্ভব।


‘গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য’ বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন সত্তরের দশকের খ্যাতনামা কবি ও সাংবাদিক, গবেষক নিজাম উদ্দীন সালেহ। প্রচ্ছদ করেছেন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, ডিজাইনার ও প্রকাশক আহমেদ ফারুক। ‘শ্রীহট্ট’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আশি পৃষ্ঠার বইটির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র দুইশত টাকা। প্রকাশনীর প্রদর্শনী উপলক্ষে বিশেষ ছাড়ে ৪০% কমিশনে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া রকমারি ডটকম থেকেও বইটি সংগ্রহ করা যাবে। আমি বইটি পাঠ করেছি। ভীষণ ভালো লেগেছে। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যচর্চা ও রক্ষায় এ ধরণের বইয়ের বিকল্প নেই।

শব্দমালা : সোহেল রানা

শব্দমালা : সোহেল রানা


শব্দমালা
সোহেল রানা


আমার সুখ

আমি প্রত্যুষের সূর্যস্নানে, স্নাত চোখে
দু চোখ মেলে সবুজ দিগন্ত দেখি;
ফুলের সৌরভ, পাখির কিচিরমিচির ধ্বনি
হৃদয়ে মাখি।

শিশিরভেজা দূর্বাদলে, ভিজিয়ে পায়ের গোছা
মিটায় আমার তৃষ্ণা।
কলমিলতা, হেলেঞ্চা, মটরশুঁটির সুমিষ্ট ঘ্রাণে
জুড়ায় আমার প্রাণ।

আমি ভালোবাসি বাংলার মা-মাটি, ধুলোবালি
ঝিলের জলের পাথর কুচি,

মায়ের কোলে শিশুর খুশি।
আমি ভালোবাসি কৃষান-কৃষানির ঘামে ঝরা
সোনা ফলানো হাসি।

ভালোলাগে চাঁদের আলোয়, নদীর জলে হৃদয় রাঙিয়ে
রাখাল মোহন বাঁশির সুর;
মাঝির কন্ঠে জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া আর
পল্লিগাঁয়ের পল্লিগীতি।

আমি ভালোবাসি বাংলা... বাংলা আমার ভাষা--
আমি বাংলায় কথা কই-- স্বপ্ন দেখি বাংলায়

আমি বাংলায় বুনি বীজ।
বাংলা আমার ঘ্রাণ, বাংলা আমার রূপ,
বাংলা'ই আমার সুখ।


ভালোবাসার বিশেষত্ব


আবেগ জন্ম দেয় ভালোবাসার,
আর আবেগ যেমন চিরস্থায়ী না
ভালোবাসাও তেমনি চিরস্থায়ী না।


আর মানুষ তার প্রয়োজনকেই ভালোবাসে,
প্রয়োজনই হল ভালোবাসার বিশেষত্ব
সেক্ষেত্রে পিতা-পুত্র, আত্মীয়-স্বজন, কিংবা
ঈাড়াপ্রতিবেশীর সম্পর্ক, তা কেউই তার বাহিরে না।
অবশ্য জ্ঞানপ্রাপ্ত বা করুণার আধারে যারা অধিষ্ঠিত
তাদের ব্যাপারটা আলাদা; তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সম্পন্ন বিপরীতমুখী
তাদের থেকে, যারা নাকি নিজের প্রয়োজনকেই মনে করে ভালোবাসা।


ভালোবাসা হল--সৌন্দর্যমণ্ডিত চোখে দেখা
আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করা--
ভালোবাসা হল একটা মোহ,
আর এই মোহ যখন থাকবে না
তখন তোমার কাছে-পৃথিবীর সব স্বাদ
অনর্থক হয়ে যাবে।
       


রোদ্দুরমাখা দিনগুলি 
     
এইতো মনে হয় সেদিনেরই কথা: শুভ্র সকাল,
পাখির ডানায় পরিভ্রমণ।
শিশুর হামাগুড়ি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো, তারপর
তার অবাধ বিচরণ।
হরিৎ শস্য প্রান্তরে-

উপরন্তু মায়ের কোলের মমতা,
বাবার স্নেহশীতল বটের ছায়া,
পাড়াপ্রতিবেশীর আদা মেশান, এবং স্বজনদের সাথে
আনন্দঘন দিনগুলি...আর ভালোবাসা-আর- ভালোবাসায়
সিক্ত হয়ে, পথ চলতে শেখা।

আর চলতে চলতে চলতে চলতে
‘জীবননদীর’ অববাহিকায় জীবন নামের
ঘানি, টানতে-টানতে-টানতে
নিষ্পেষিত এ-ই জীবনে! আজ শুধুই মনে পড়ে
সেইসব দিনগুলির কথা: প্রভাতের রবিময়
চকচকে-ঝকঝকে সকালটা,
অথবা দ্বিপ্রহরের কড়কড়ে-মচমচে দুপুরটা,
কিংবা অপরাহ্নের সৌন্দর্যময় ডালিভর্তি বিকেলটা,
নতুবা বৃষ্টিভেজা-শিহরণে-শিহরিত সমস্ত বেলাটা...।

জীবনটা ছিল এক-আনন্দঘন হোলিখেলা:
কলমি-হেলেঞ্চা-মটরশুঁটির লকলকে ডগার দোল,
কলকাকলি মুখরিত পাখির গান, স্নিগ্ধ সকাল!
শুভ্রতা আর পরিশুদ্ধতায় নিঃশ্বাসে-নিশ্বাস
নিয়ে নিয়ে পথ চলা।

অক্লান্ত বহতা পাখির ডানার মতন
এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তর, দূর থেকে দূরান্তর
ছুটে চলা দুপুর: অজস্র কমলা রঙের উজ্জ্বলতায় দিগন্তজোড়া এক সাগর রোদ্দুর;
আর রোদ্দুর ঝাঁপিয়ে উপভোগ্য শরীর ও মন
হারিয়ে যায় যেন রোদ্দুরে-ই পাখনায় দূর অজানায়...।

সবুজের গাঁয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া
বহমান নদীর হাওয়ায়, উল্লাসিত হৃদয়!
মাঝির কণ্ঠে জারি-সারি, পল্লিগাঁয়ের পল্লিগীতি,
ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি-- আর
প্রজাপতির ডানার মতোই ছিল সেই রঙমাখা বিকেল!

প্রাণের সাথে প্রাণ, সুরের সাথে সুর,
ঝঙ্কারময় ছিল সেইসব ‘রোদ্দুরমাখা’ দিনগুলি।

আজ জীবনবেলার অপরাহ্নের প্রান্তে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়!
শুধুই মনে পড়ে সেইসব দিনগুলি...


রঞ্জিত 

পরম্পরা সৌন্দর্যমণ্ডিত কিছু মুহূর্ত:

পড়ন্ত বিকেলে পড়ে গেছে সূর্যের আঁচ
নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে শীতল
হাওয়া
শান্ত শরীর ও মনে ফাগুনের দোলা,
বসন্তের হাওয়ায় করছে খেলা।
গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ, হেমন্ত-শীত-ও-বসন্তের
সমুদয় ভালোলাগা-ভালোবাসার, অনুভূতিগুলো একাকার করেছে যেন আমার!

উড়ন্ত বাতাসে উড়ছে তো উড়ছেই রমনীদের
অবিন্যস্ত চুল-
ওষ্ঠে লেগে আছে প্রেমের আভা,
ষোড়শীদের যুগল চক্ষু থেকে তীর ছুড়ে আসা
প্রেমের আহ্বানে আমি হয়ে গেলাম পাগলপারা!
এখানে নিত্যদিন বসে রমনীদের মেলা-
হেঁটে হেঁটে বেড়ায় একরাশ প্রেম! যেন স্বর্গীয় সুধায়!

তারপর;
গোধূলি আবীরে-- পশ্চিম আকাশের রঙে রঙে রঙিল হলো
সমস্ত নদীর এপার-ওপার-
আর অজস্র- অপার মণিমুক্তারা যেন নদীর তরঙ্গে- তরঙ্গে করছে খেলা!
আহা! কি এক অদ্ভুত রহস্যময় সৌন্দর্যে
হারিয়ে গেলো মন-- ঢেউয়ে ঢেউয়ে সাতসমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে!
যেন পৃথিবীর সমস্ত রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে একীভূত হয়ে গেলাম!

তারপর
হঠাৎ এক আগন্তক--পদ্মা নদীর পরশে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে এসে লাগলো আমার শরীরে,
আমার চোখ চলে গেলো ওই পুব আকাশে-
জীর্ণ বেলের পাতার ফাঁকে যুবতী চাঁদ রয়েছে দাঁড়িয়ে!
যেন ডাকে আমায় হাত বাড়িয়ে
কইবে কথা আমার সাথে
ভরাপূর্ণিমায় নিয়ে যাবে চাঁদের দেশে।

জীবনটা যদি এমন পরম্পরা সৌন্দর্যমণ্ডিত হতো-
গোধূলির রঙে রঙে রাঙিয়ে থাকতো
অথবা ভরাপূর্ণিমার চাঁদের মতো,
কিংবা নদীর মতো।

‘নাই’- কো বা তা-ও নাই হলো--
যদি প্রকৃতির এক টুকরো দূর্বার রঙে-ও রাঙিয়ে থাকতো,
তাহলে থাকতো না আর মানুষজীবনের
না-পাওয়া এ-ই টুকরো টুকরো কষ্ট!

মৌটুসির মাটির ঘোড়া

মৌটুসির মাটির ঘোড়া


মৌটুসির মাটির ঘোড়া
ইয়াকুব শাহরিয়ার 

মঙ্গলিকে নিয়ে সারাদিন কামৌটুসির। মঙ্গলি মৌটুসির মেদি কুকুরীর নাম। মৌটুসির যা বয়স তার থেকে চার বছরের ছোট মঙ্গলি। দুজনের গলায় গলায় ভাব। মৌটুসি ক্লাস ফোরে পড়ে। তার একটাই ইচ্ছা সে বড় হয়ে ইশকুল মাস্টারনী হবে। ছাত্রদের ধমকাবে, ইচ্ছা মতো ক্লাসে ঢুকবে বেরোবে। সবাইকে মিথ্যা বলতে বারণ করবে। তবে মঙ্গলিকে অবশ্যই পাশে থাকতে হবে। মঙ্গলিকে ছেড়ে আজ পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা করেনি মৌটুসি। মৌটুসির আরেকটা প্রিয় জিনিসও আছে। একটা মাটির ঘোড়া। গেলো বছর তার মা হারিয়ে যাওয়ার আগে মেলা থেকে ঘোড়াটি কিনে দিয়েছিলেন। মৌটুসির মা হারিয়ে যান নি। মেলা থেকে ফিরে রাতে যে ঘুমিয়েছিলেন-আর ঘুম ভাঙেনি। বিলেত ফেরত রকিব উদ্দিন আর বিয়েও করেননি, বিদেশও যাননি। একমাত্র মেয়েকে নিয়েই আছেন। তবে মৌটুসি জানে তার মা হারিয়েছেন। ফিরে আসবেন।

মঙ্গলি ব্রেড খেতে খুব পছন্দ করে। অনেকদিন ধরে ব্রেড খায় নি সে। বাজার থেকে মাঝে মাঝে দোকানির ব্রেড চুরি করে নিয়ে আসতো বলে গলায় ভাড়ি জিঞ্জির পড়েছে তার। তার প্রতি অনেক মায়া হয় মৌটুসির। মনে মনে ভাবে স্কুলের নাম করে দোকানে গিয়ে মিথ্যা বলে হলেও মঙ্গলিকে ব্রেড খাওয়াবে সে।

আজ স্কুলে গিয়ে তারাতারি বাড়ি ফিরেছে মৌটুসি। মঙ্গলি তাকে দেখে দৌঁড়ে এগিয়ে এসে হাপিয় হাপিয়ে লেজ নারাচ্ছে। মৌটুসি ব্যাগ থেকে দশ টাকা দামের একটা ব্রেড বের করে মঙ্গলিকে একটুরো দিলো। মঙ্গলির প্রিয় ব্রেড, অথচ খাচ্ছে না দেখে বাজে ধরণের মন খারাপ হয় মৌটুসির। খারাপ মন নিয়ে ঘরে ঢুকেই দেখে মাটির ঘোড়াটি ভেঙে খান খান! চোখ কপালে উঠে যায় মৌটুসির। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। মাকে হারিয়ে কান্নার মতো অবস্থা! ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। মঙ্গলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে করুণ চোখে মৌটুসিকে দেখছে। একবার মঙ্গলির উপর চোখ পড়ে মৌটুসির। দেখে তারও চোখ ভিজছে।

হঠাৎ কান্না থেমে গেলো তার। ভাবছে কি দরকার ছিলো মিথ্যা কথা বলার? বাবার কথা বলে কেনই বা ব্রেডটা আনতে গেলাম। আমার দোষেই তো এমন হয়েছে। যদি মিথ্যা না বলতাম, তাহলে তো মায়ের দেওয়া ঘোড়াটা ভাঙতো না। মিথ্যা বললে এমন ক্ষতি হয়, মা একবার বলেছিলেন। তাই তো এমন হয়েছে। এমন ভাবতে ভাবতে কিছুটা কষ্ট হাল্কা হতে লাগলো মৌটুসির। তখন বাবা রকিব উদ্দিনের উচ্চ গলায় ডাক শুনে ফিরে তাকায় সে। বাবা বলেন- তোমার মা আবার একটা ঘোড়া পাঠিয়েছে। হুবহু ঘোড়া দেখে আনন্দ আর ধরে না যেনো। সারা বাড়ি জুড়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে আনন্দ উদযাপন করছে মৌটুসি। সাথে মঙ্গলিও। মৌটুসি মনে মনে শপথ করে আর কখনই মিথ্যা বলবে না সে। আর মায়ের প্রতি ভালবাসা বেড়ে যায় মৌটুসির।


প্রিয় সেঁজুতি

প্রিয় সেঁজুতি

প্রিয় সেঁজুতি 
মনসুর আহমেদ 

প্রিয় সেঁজুতি,
ক্লাস সিক্সই তোমার সাথে ঠোকাঠুকি ও আড়াআড়ি চোখে অনেক অজানা কথাই বলা হয়ে যেত। জয়নুল আবেদীনের রং তুলির আঁচড় লেপটে আছে তোমার মুখে। না-কি ঈশ্বরই নিজ হাতে এঁকেছেন তোমার প্রতিচ্ছবি! বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যাই প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের মতই তোমার চঞ্চল উদ্দীপনাময় হৃদয়ে। মাত্র কয়েকদিন পরেই আমাদের অনেক ভাল বুঝাপড়া হয়ে গেল। টিফিনের সময় যখন সবাই সবুজ ঘাসে মিশে যায়, আমরা তখন চোখের সমুদ্রে ডুবে যেতাম। অনেক কিছু বুঝার আগেই হঠাৎ একদিন গোলাপের পাপড়ি মিশানো একটি চিঠি বইয়ের ভাঁজে খুঁজে পেলাম। ফরমালিন মুক্ত গোলাপের ঘ্রাণ বিমোহিত করেছে চারপাশ। নাকের ডগায় দীর্ঘশ্বাস নিয়েই প্রথম কোন চিঠির ভাঁজ ভাঙতে ভাঙতে একটি কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। এ যেন প্রথম ভালবাসা।

একটি নদী, নাম তার খোয়াই। দু’পাড়ের মানুষকে আলাদা করে রাখলেও মনকে আলাদা করতে পারেনি। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে উত্তাল খোয়াইয়ের পাড়ঘেঁষা থৈথৈ পানি। প্রয়োজন ছাড়া অনেকটা বিচ্ছিন্ন দু’পাড়ের মানুষ। বেশ কয়দিন হল তুমি আর স্কুলে আসোনি। ছটফটে মনকে বারণ করলে কি হবে? বুঝে-না সে। ডিঙি নৌকা চেপে পৌঁছে গেল তোমার উঠানে। আসমান জুড়ে রংধনু যখন শাড়ী বদলায়, খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তোমার পরান মন।

বৃন্দাবন সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসেও আমরা একসাথে। কলেজ ক্যান্টিন যখন বন্ধুরা মাতিয়ে রাখতো, আমরা তখন  অনেকগুলো চোখ ফাঁকি দিতাম। চষে বেড়িয়েছি নাগুড়া, সাতছড়ি ও লাউয়াছড়া উদ্যান। লাউয়াছড়ার মূল আকর্ষণ ছিল রেললাইন ধরে আমরা অনায়াসেই মিশে যেতাম সারি সারি পথে। ক্লান্ত শরীরে ছায়াবীথিতে আমরা আশ্রিত হতাম। আহারে! পাখির কিচিমিচি আর শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দে আমার উরুতে মাথা রেখে তুমি আকাশনীলায় মিশে যেতে। আর আমি সোনালি চুলে বেনি কেটে দিতাম, কপালে ছুঁয়ে দিতাম অদৃশ্য চুম্বন।

একবার খেয়াল করে দেখো, চমৎকার একটি মিল ছিল আমাদের। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একসাথেই আছি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ পাওয়ায় আমরা চেঁচিয়ে উল্লাস করেছি। একটি স্বপ্নকে পাড়ি দিয়ে আমরা তৈরি হয়ে গেলাম। ঢাকার অলিগলি পরিচিত না হলেও পরিচিত হয়ে গেলাম। আহসান মঞ্জিল, লালবাগকেল্লা, জাদুঘর, ধানমন্ডি বত্রিশ, বুড়িগঙ্গার দূষিত বাতাস, কোন কিছুই অদেখা রইল না।

পহেলা ফাল্গুন আর ভ্যালেনস্টাইন ডের  সাথে পরিচিত হলেও উৎসব দেখা হয়নি। তুমি বাসন্তী জমিন, লাল পাড় আর গাঢ লীল রঙের আঁচলের শাড়ী পড়ে রিক্সায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ফাল্গুনী দমকা বাতাসে শাড়ীর আচঁল আকাশনীলায় মিশে যাচ্ছে। আমার পাঞ্জাবিটাও শাড়ির সাথে বেশ মানিয়ে ছিল। আহা! কি আনন্দ মনের কিনারায়। বেশ কয়জন ফটো সাংবাদিকের ক্যামেরায় আমরা ছিলাম অনেকটা আকর্ষণীয়। জীবনের প্রথম বেশকিছু খবরের কাগজে ক্যাপশনও হয়ে গেলাম, এ যেন অন্যরকম অনুভূতি।

তিলোত্তমা ঢাকা নগরীর রঙ ঢংয়ে হঠাৎ তুমি বদলে গেলে। গ্রামের সুধাময়ী মাটির গন্ধ আর বাঙালিয়ানার বৃত্ত ভেঙে দিলে। আমি একটুও অবাক হয়নি পাজারো গাড়িতে তোমাকে দেখে, এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে জাহিদ ইশতিয়াক এখন তোমার ভাল বন্ধু। তুমি এখন হোটেল রেডিসন ব্লু, গুলশান ক্লাবের মত জায়গায় নিয়মিত যাতায়াত কর। টিএসসির সবুজ ঘাসে বসে এখন আর ঝালমুড়ি তোমার মুখে রুচে না। শহীদ মিনারে বসে ফুচকা খেতে খেতে কবিতা ও গান শোনা যেন বোরিং টাইম পাস। বহু স্মৃতি আজও মনে পড়ে, যা মিশে আছে হৃদয়ে। সবকিছুই শূন্য হয়ে গেল, আমার শূন্য মনে। দূরদূরান্তরের ধূলিকণার মত আমিও আজ বাতাসে ভাসি। বলতে কখনো সুযোগ হয়ে উঠেনি কিংবা পাইনি, আমিও তোমাকে ভালোবাসি, জাহিদের চেয়েও অনেক বেশি ভালবাসি।

ইতি -
রুদ্র শাহরিয়ার।

রামকৃষ্ণ মিশন রোড, হবিগঞ্জ।