আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী বিপ্লবী কবি
আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী বিপ্লবী কবি
রোকে ডালটন
ভাষান্তর : আকিব শিকদার
রোকে ডালটন লাতিন আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী বিপ্লবী কবি, যাঁকে চে গুয়েভারার পরেই স্থান দেয় লাতিন বিশ্ব। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালে, সালভাদরের এক উচ্চবিত্ত পরিবারে। ১৯৫৫ সালে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৯-৬০ এ কৃষক অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ নিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তাঁর মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে স্বৈরাচারী একনায়ক সরকার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ফাঁসির দিনেই সেই স্বৈরশাসকের পতন ঘটে, আর তিনি বেঁচে যান। ১৯৬১ তে দেশত্যাগ করে মেক্সিকো চলে যান। সেখানেই তাঁর কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটে। এরপর তিনি চলে যান কিউবা, এবং লাতিন আমেরিকার একজন অন্যতম প্রধান বিপ্লবী কবি হয়ে ওঠেন। কিউবা থেকে যান প্যারাগুয়ে, সেখানে তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতা অনেককে চমৎকৃত করে।
১৯৬৫ তে ফিরে আসেন দেশে। সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৫ এর ১০ মে, বিপ্লবীদের মধ্যে চলা এক আন্তঃসংঘর্ষে।
কেবল তো শুরু
আমার সুহৃদু, এক সম্ভাব্য কবি,
মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর হা-হুতাশকে
এভাবে করলেন চিত্রায়িত:
‘আমি তো বুর্জোয়ার কয়েদবন্দী,
তা ছাড়া আমি আর কীই বা হতে পেরেছি।’
এদিকে মহান বের্টোল্ট ব্রেখট,
কম্যুনিস্ট, জর্মন নাট্যকার ও কবি
(পদবিক্রমটা ঠিক এমনি) লিখেছিলেন:
‘ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অপরাধের তুলনায়
ব্যাংক ডাকাতি তেমন কি আর মন্দ কাজ?’
এ থেকে আমি যে উপসংহার টানি, তা দাড়ায়:
নিজেকে অতিক্রম করতে গিয়ে
যদি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী
ব্যাংক ডাকাতি করেই ফেলে
তবে বলতে হবে সে তেমন কিছুই করেনি
কেবল নিজেকে একশ’ বছরের ক্ষমা
পাইয়ে দেওয়া ছাড়া।
লাল বিপ্লব
পাখিরা উড়ে যায়, রাঙা বিপ্লব ছড়িয়ে যায় চারপাশে-
রক্ত সবসময়ই লাল, লাল ডুবে যাওয়া সূর্য
বারুদের আগুনও লাল, ঈগলের ঠোঁটের আঘাতে
যে রক্ত বেরিয়ে আসে জংলি মেসের পিঠ থেকে-
লাল, শুধু লাল।
ডুবে যাওয়া সূর্যের দুহাই, জ্বলে ওঠা বারুদের দুহাই
আমাকে তোমরা ঈগলের মত হিংস্র হতে বলো না-
মেসের চামড়া উৎপাটনরে মত তোমাদের
বিপর্যয় ডেকে আনতে যেও না।
বাস্তুতন্ত্র
বাস্তুতন্ত্র
আহাদ আদনান
বন্যার জল আর আটকানো গেলো না। প্রতিবারই বাড়ির সামনের মাঠটা ডুবে যায়। এবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে জ্যৈষ্ঠ থেকে। উপোষী মাঠটা আষাঢ়ের গোড়াতেই টুইটুম্বুর। কাচপুরের পাশের খালটা বেয়ে জল চলে যায় শীতলক্ষ্যায়। গত শীতেই যখন ড্রেজার দিয়ে খাল ভরাট হচ্ছিল তখনই কুসুম তার স্বামী আয়নালকে বলেছিল, ‘এইবার বর্ষা আইলে ঘরে পানি ঢুকব, দেইখো তুমি। পানি নামার রাস্তা দিতাছে বন্ধ কইরা। ঘর পাল্টাইবা নাকি এইবার’?
‘এত কম খরচে ঘর পাবি কই তুই? সপ্তাখানেক ইট দিয়া ঠ্যাক দিলেই চলব’।
ঘরটা আসলেই সস্তা এই বাজারে। যাত্রামুড়ার মহাসড়কের ডান পাশ দিয়ে গেছে ছোট গলির মত এক রাস্তা। এটা মিলবে ভুলতার বড় রাস্তার সাথে। রাস্তার দুই পাশে খোলা মাঠ, ধানের জমি। আরেকটু এগুলেই ময়লার ভাগাড়। রাজধানীর বাড়িতে বাড়িতে জমে থাকা আবর্জনা প্রতিদিন নিয়ে আসে সিটি কর্পোরেশনের গাড়িগুলো। ফেলে দিয়ে যায় এই খোলা আকাশের নিচে। পচে পচে এরা দুর্গন্ধ ছড়ায়। বংশবিস্তার করে অতি উর্বর জীবাণুর দল। মাছি এসে পাখায়, পায়ে করে এই দূষিত কণা পৌঁছে দেয় বাসনে বাসনে। এই আবর্জনা যেন স্বাদ বাড়িয়ে দেয় পথের ধারের খুপরি দোকানগুলোর পুড়ি, চপ, চটপটি, ফুচকার। ছেলেদের দল হাঁক দেয়, ‘মামা, ফুচকার লগে টক মারো বেশি কইরা’।
আলতাফ চৌধুরী থাকেন তারাবোতে। প্রধান সড়কের পাশেই তার পাঁচতলা বাড়ি। কয়েক বিঘা ধানের খেত আছে এই মাঠের সাথেই। এর মাঝেই একটা একতলা ঘর বানিয়ে রেখেছেন। শরিকের জমি। গ-গোল লেগেই থাকে। বাড়িটা তাই এক ধরণের জমি দখলই বলা যায়। দুইটা থাকার ঘর, একটা রান্না ঘর আর একটা টয়লেট। পূব দিকের ঘরে থাকে বজলু। এক ছেলে আর বউ নিয়ে তিন জনের সংসার। বরপা’তে একটা ‘বাংলার তাজমহল’ তৈরি হয়েছে, তার পাশেই একটা চায়ের দোকান তার। আর পশ্চিম দিকের ঘরটা আয়নালের। পরিবারের সদস্য একজন বেশি, কিন্তু আয় কম। সুদের টাকায় একটা অটো-বাইক কিনে সে এই পথেই চালায়। কিস্তির টাকা দিয়ে হাতে থাকে সামান্যই। পাঁচ মাসের বাচ্চাটা রেখে তার বউ কুসুম ছুটা বুয়ার কাজ নিয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যাত্রামুড়া তিনটা ফ্ল্যাটে কাপড় কাঁচা আর ঘর মুছা। বড় মেয়েটার বয়স এগারো বছর। ছোট বোনকে সে দেখে রাখে ভালো মতোই। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ। সারাদিন কাটে তার বোনের সাথে খেলা করে।
বোনটা খুব ঠা-া মিষ্টি’র। মীনা কার্টুন দেখে আর নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখে দিয়েছে মিঠু। মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘কও, মিঠু। আমার নাম মিঠু’। মিঠু অবশ্য শুনে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ আছে যথেষ্টই। বাড়িতে ডেলিভারি করতে গিয়ে আটকে ছিল অনেকক্ষণ। জন্মের পর কান্না করেছে অনেক দেরিতে। খিঁচুনি হয়ে মরতে বসেছিল বাচ্চাটা। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বেঁচে গেলেও সারা জীবনের জন্য পিছিয়ে পড়েছে পাঁচ মাসের মিঠু। এখনও তার ঘাড় শক্ত হয়নি। মুখ দিয়ে কোন শব্দও করেনা। আয়নাল তিনটা মাজার থেকে তাবিজ এনে বেঁধে দিয়েছে গলায়, বাহুতে আর কোমরে। ফলাফল লবডঙ্কা।
আষাঢ়ের মাঝামাঝি। বৃষ্টি হচ্ছে বিকেল থেকে। বজলু ডাক দেয় আয়নালকে।
‘আয়নাল ভাই, এই পুরা বাড়ি তোমারে দিয়া দিলাম। এক তারিখেই আমি ঘর ছারুম। আর পোষাইতাছে না’।
‘ক্যান, কী অইছে? যাইবেন কই’?
‘দোকান বন্ধ হইতে হইতে মাঝ রাইত হয়া যায়। কাছাকাছি একটা বাসা নিছি। এই বাড়িতে মানুষ থাকে? জন-মানব নাই, দোকান-পাট নাই। সারাদিন গুয়ের গন্ধ আর মাক্ষি ঘুরঘুর করে। কোনদিন রাইতে চোর নাইলে ডাকাত আইয়া ল্যাংটা কইরা ফালায়া রাখব। আষাঢ় শেষ না হইতেই সিঁড়িতে পানি আইছে। এইবার ঘর ডুইবা যাইবই। ঘরে পানি হান্দাইলে যাইবা কই মিয়া’?
‘কথা ঠিকই কইছেন। তা আপনার আয় রোজগার মাশাল্লাহ ভালা। আমি এই বেজন্মা কিস্তির ফান্দে পইড়া গেছি। পানি উঠলে ইট দিতে হইব। কয়টা দিনের ব্যাপার’।
বিপদ এবার সব দিক থেকেই আসলো। করোনার জন্য আয় কমে গেছে আগে থেকেই, সাথে যোগ হয়েছে বন্যা। আষাঢ়ের শেষের দিকে ঘরে জল ঢুকে পড়ে। ইট দিয়ে খাট, টেবিল আর ওয়োরড্রৌব উঁচু করে দিয়েছিল আয়নাল। প্রথমে দুটো করে ইট। তারপর চারটা করে। রাতের আঁধারে তারাবো ইটের খোলা থেকে সে চুরি করে আনত ইট। শ্রাবণের বারো তারিখে স্বপরিবারে আয়নাল বাসা বাঁধে বাড়ির ছাদে।
চৌধুরীর কাছে গিয়েছিল আয়নাল। একটা নৌকা, মই আর ত্রিপলের জন্য। শুধু একটা মই দিয়ে দূরদূর করে তাকে বিদেয় করেছে চৌধুরী। নদীর মাঝখানে চরের মত জেগে থাকে বাড়ির ছাদটা। ত্রিপল জোগাড় করতে না পেরে সে লাগিয়ে নিয়েছে পলিথিন। ওঠানামা চলে মই দিয়ে। রোজ সকালে কাছা দিয়ে সাঁতার কেটে সে উঠে জেগে থাকা সড়কে। সাথে পলিথিনে থাকে শুকনো জামা আর লুঙি। সমস্যায় পড়ে কুসুম। ভেজা শাড়িতে ড্যাবড্যাব করে চোখ দিয়ে তাকে ছিঁড়ে খায় পুরুষের দল। এই বিপদে সেও জুটিয়ে ফেলে কালো পুরনো একটা বোরকা। সাঁতার শেষে পথে উঠেই ব্যাগ থেকে বোরকা বের করে নিজেকে দেয় সে ঢেকে। কাজের বাড়ির ম্যাডামকে বলে সে তার আরেকটা শুকনো জামা ওই বাসাতেই রাখার অনুমতি নিয়ে নেয়।
মিষ্টি এখন যেন আরও বড় হয়ে যায়। কত দায়িত্ব ছোট কাঁধে! বোনকে নিয়ে তার কত গবেষণা! মা বলেছে পানি গরম করে দুধ বানাতে হবে। এখনতো মাটির চুলার জ্বালানি পাওয়া কঠিন। কেরোসিনের স্টোভ কিনে ফেলেছে তাই আয়নাল। পানি কতটুকু গরম করতে হবে? বেশি গরম করলে মুখ পুড়ে যাবে মিঠু’র। মা বলেছে সাথে মিছরি দিতে। আজ একটু চিনি মেশালে কেমন হয়? মা বলেছে তিন ঘণ্টা পরপর খাওয়াতে। আচ্ছা, মাঝে আরেকবার দিলে কেমন হয়? বন্যার দিনগুলোতে মিষ্টি যেন মিঠু’র মা হয়ে যায়।
তার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু অবশ্য মিঠু’র থাকার জায়গা। বৃষ্টি লেগেই থাকে সারাদিন। জোরে বাতাস ছাড়লে পলিথিন ছিঁড়ে যেতে চায়। বৃষ্টির ছিটা এসে ভিজিয়ে দেয় ওদের। এই বৃষ্টির জল গায়ে লাগলেই জ্বর, ঠা-া লাগবে। ওষুধ কিনতে হবে। এত টাকা বাবা কোথায় পাবে? ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে ফেলে মিষ্টি। ওয়োরড্রৌবের ভেতর পিচ্চিটাকে ঢুকিয়ে রাখলে কেমন হয়? এর চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর হয়না। কাঠের ওয়োরড্রৌব। চারটা ড্রয়ার, একটার নিচে আরেকটা। পাশে আরেকটা লম্বা খুপরি। ওটাতে শীতের কম্বল, মশারি রেখে দিয়েছে কুসুম। চারটা ড্রয়ারের একটাতেই রাখতে হবে মিঠুকে।
ছোটখাটো মিষ্টি’র জন্য নিচের ড্রয়ারটাই সবচেয়ে সহজ। উপরেরটা সে নাগাল পেলেও উঁকি মেরে দেখতে পারে না। মিঠু কখন জাগবে, খাওয়াতে হবে, প্র¯্রাব করেছে কিনা সেটা বোঝা কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া একবার প্রস্রাব করে দিলে কাঠ বেয়ে বেয়ে নিচের ড্রয়ারগুলোতে চলে যাবে। কিন্তু নিচের ড্রয়ারটা ইঁদুরের আস্তানা। পুরনো ওয়োরড্রৌবের নিচের দিকে খুপরিতে ওরা থাকে। কোনভাবেই ওদের উৎপাত থেকে বাঁচা যায়না। এই বন্যাতেও ওরা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসে। ওরা নিশ্চয়ই মিঠুকে কামড় দিবে। নিচের ড্রয়ারে রাখা যাবে না ওকে।
নিচ থেকে দ্বিতীয় ড্রয়ারটাতে আবার প্রচ- আরশোলার উপদ্রব। ফ্রক বের করে পরার আগে মিষ্টি ভালো করে ঝেড়ে নেয় আগে। কালো কালো শুকনো আরশোলার বিষ্ঠা ছড়িয়ে থাকে মেঝেতে। এই বিষ্ঠা মিঠু’র পেটে গেলে নির্ঘাত ডায়রিয়া হবে। এর ঠিক উপরের ড্রয়ারেও আরশোলা হানা দেয়, তবে প্রতিদিনের পরার জামা সেখানে থাকে বলে খুব বেশি বিষ্ঠা জমেনা ওখানে। তবে সমস্যা হচ্ছে ওটাতে মিঠু প্রসাব করলে নিচের দুইটা ড্রয়ারেও চলে যাবে। অনেক চিন্তা করে মিষ্টি পলিথিন কেটে, আর ভাত ডলে ডলে আঠা বানিয়ে একটা ব্যাবস্থা করে ফেলে। হাফপ্যান্টের মত করে পলিথিন প্যাঁচিয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। কিছুক্ষণ পরপর দেখলেই হবে পলিথিনে মূত্র জমেছে কিনা। কোনো জামার সাথে প্র¯্রাবের মাখামাখি হওয়ার চিন্তা থাকবে না।
কত বড় একটা আবিষ্কার করে ফেলেছে সেটা মিষ্টি প্রথমে বুঝতে পারেনি। আগে ঝড়ো বৃষ্টি হলে বোনটাকে আগলে রাখতে বেশ বেগ পেতে হত তাকে। এখন ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিলেই খালাস। একটু অবশ্য ফাঁকা রাখতে হয়, না হলে দমবন্ধ হয়ে মরে যেতে পারে। তবে বৃষ্টির জলের একটা অণুও মিঠু’র গায়ে লাগার সম্ভাবনা নেই। আবার ওখানে রেখেই পানি গরম করা, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া, কিংবা ছাদে একা একা এক্কাদোক্কা খেলা সব সহজ হয়ে গেছে।
দুই দিনের দিন মিষ্টি কুসুমকে বলে তার কীর্তির কথা। কুসুম শুনে অবাক হয়।
‘কী কস তুই? পইড়া গেলে’?
‘পড়ব ক্যামনে? এইটাতো নড়েও না, চড়েও না। চিত হইয়া হুইয়া থাকে সারাদিন’।
‘দম বন্ধ হইয়া মইরা যায় যদি’?
‘তোমারে কইছে? আমি একটু ফাঁক রাখি বাতাস যাওয়ার লেগা। দম ঠিকই নেয় মিঠু’।
‘ফাঁক রাখস, আরশোলা ঢুকবোতো ভিতর। হাইগা নষ্ট করব সব’।
‘তুমি তো লাগাইয়া রাখো, তারপরও আরশোলা আটকাইতে পারছো? আমি বরং বইয়া বইয়া আরশোলা মারি। তুমি ড্রয়ার খুঁইজা দেখো। আরশোলা পাইবা না একটাও। কালো গু’ও নাই। সবকিছু আমিই পরিষ্কার কইরা রাখি’।
‘মুত লাইগা কাপড় গান্ধা হইয়া গেলে কিন্তু তোর বাপে চিল্লাইবো। আর হাগলে কী করছ তুই’?
মিষ্টি তার মাকে পলিথিনের ন্যাংটির মত জিনিসগুলো দেখায়। এই দেশে পলিথিনের মত সহজলভ্য বস্তু আর নেই। মানুষজন ইচ্ছেমতো পলিথিন ব্যবহার করে আর ফেলে দেয় যেখানে সেখানে। বন্যার জলে সেই পলিথিন ভেসে আসে। নিচে নামলেই শত শত পলিথিন। মিঠু’র পলিথিনের ন্যাংটিও তাই অসংখ্য। এতক্ষণে কুসুমের মুখে স্বস্তির হাসি আসে। সে এর মধ্যে বিকেলেও কাজ নিয়েছে। মেয়েটা না থাকলে, এত বুদ্ধি না থাকলে সমস্যায়ই পড়ে যেত সে।
দুই সপ্তাহেও বন্যার জল নামার নাম নেই। আয়নাল সেদিন বলছিল বন্যা এবার রেকর্ড করছে। এত বেশি দিন জল জমে থাকার নজির নেই গত ত্রিশ বছরে। তাদের সমস্যা হচ্ছে এই জল বদ্ধ জল। সহজে নামবে না। ছাদে বসবাস তাই চলতেই থাকে। সেদিন দুপুরের দিকে মিষ্টি নেমেছিল প্রাকৃতিক কাজ সারতে। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসে প্রথমেই ড্রয়ারে দেখতে গিয়েছে মিঠু প্রস্রাব করেছে কিনা। ড্রয়ার টান দিতেই সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। কালো একটা বিড়াল গুটিসুটি পাকিয়ে শুয়ে আছে মিঠু’র ঠিক পাশেই। ওর চিৎকার শুনেই এক লাফ দিয়ে পালালো চতুষ্পদ জন্তুটা। বিড়ালটা এলো কিভাবে? ওরা কি সাঁতার জানে? নাকি নিচের ঘরেই লুকিয়ে ছিল? এসব ভাবতে ভাবতেই সে মিঠু’কে কোলে নিয়ে উলটেপালটে দেখে। কামড় দেয়নি তো জানোয়ারটা? এই বোকা পিচ্চিতো কাঁদেও না। অক্ষত মিঠু’কে দেখে মিষ্টি হাফ ছেড়ে বাঁচে।
মিষ্টি দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এত শত্রু চারদিকে। ইঁদুর, আরশোলার সাথে যোগ দিয়েছে বিড়াল। এত শত্রু থেকে বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে। এটাই বাস্তুতন্ত্রের আদি সূত্র। এদের চেয়ে বড় শত্রু বন্যার জল। মিঠু ঘুমিয়ে গেলে মিষ্টি ছাদে বসে দেখে চারদিক। তাদের ছাদটাকে মনে হয় দ্বীপের মত। আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে। বৃষ্টি হবে যেকোনো সময়। মিঠু’কে আরেকবার দেখতে আসে সে। ঘুমিয়ে আছে লক্ষ্মী হয়ে। ভালো করে পলিথিন প্যাচিয়ে আবার আসে সে ছাদের কিনারায়। তাদের ঘরের সামনে একটা নৌকা ভিড়েছে। নৌকায় মাঝির সাথে একটা লোক। লোকটাকে ভালো করে চিনে মিষ্টি। চৌধুরী, ওদের বাড়ির মালিক। বিড়াল দেখার চেয়ে বেশি চমকে উঠে মিষ্টি। আতঙ্ক গ্রাস করে এগারো বছরের একলা মেয়েটাকে।
গত শীতের কথা। ওদের ক্লাসেই পড়ত সোনিয়া। বরপা’র এক বস্তিতে থাকত ওরা। একদিন রাতে হইচই পড়ে গেল। সন্ধ্যা থেকে পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটাকে। এদিকে সেদিকে কত খোঁজাখুঁজি হলো। মসজিদের মাইকে মাইকে ঘোষণা হলো। ‘একটি নিখোঁজ সংবাদ। সোনিয়া নামের একটি দশ-এগারো বছরের মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি দেখতে ফর্সা, চেহারা গোলগাল। উচ্চতা চার ফুটের কাছাকাছি। মেয়েটির পরনে ছিল লাল ফ্রক আর সবুজ পায়জামা। কোন সহৃদয় ব্যক্তি সোনিয়াকে খুঁজে পেলে কাছাকাছি যেকোনো মসজিদের ইমামের সাথে যোগাযোগ করবেন’। মাঝরাতে খুঁজে পাওয়া গেলো মেয়েটাকে। সিটি কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়ের পিছনে পড়ে ছিল নিথর দেহ। গায়ে একটা সুতোও নেই। পেশাবের জায়গাটা রক্তাক্ত আর ফোলা। জনস্রোতের সাথে দৌড়ে মিষ্টিও চলে গিয়েছিল সেখানে। রক্তাক্ত, ফোলা আর ছিঁড়ে যাওয়া পেশাবের রাস্তায় মাছি উড়ছিল ভনভন করে। সাথে সাথে বমি করে দিয়েছিল সে।
সে রাতে কাঁপিয়ে জ্বর আসে মিষ্টি’র। এরপরে আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিল রাতে পুলিশ এসেছিল। ওর চাচাতো এক ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সোহাগ ভাই। ওকেতো চিনে মিষ্টি। ক্লাস নাইনে থাকতেই স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। গত ঈদে সোনিয়ার সাথে ওকেও আইসক্রিম কিনে দিয়েছিল। সেই সোহাগ ভাই এমন করে সোনিয়াকে ‘মারল’। এমন বিবস্ত্র করে ‘মারা’কে কী বলে জানত না সে। ক্লাসের ইঁচড়ে পাকা কয়েকটা মেয়ে ওকে পরে বুঝিয়ে বলেছে। এটাকে বলে ‘ধর্ষণ’। পুরুষ মানুষ খুব ভয়ঙ্কর ধরণের জন্তু। একলা পেলেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েদের উপর। ছিঁড়েফুঁড়ে রক্তাক্ত করে ফেল দিয়ে যায় আবর্জনার ভাগাড়ে।
চৌধুরী লোকটাকে মিষ্টি ভয় পায় খুব। যে কয়বার ওদের এখানে এসেছে মিষ্টিকে আদর করেছেন তিনি। প্রতিবার বুকের এখানে আঙুল দিয়ে টিপে দিয়েছেন। ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়েছে মিষ্টি। ওর বাবা আর মা দেখেনি এসব। জানেনা কিছুই। শেষবার সিঁড়িতে মিষ্টিকে ডেকে নিয়ে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ওর পেশাবের রাস্তার উপরে। কুসুম লোকটার কথা উঠলেই বলে, ‘খানকির পুত একটা লুইচ্চা। নজর খারাপ শুয়ারের বাচ্চার’। ‘লুইচ্চা’ কথাটার মানে ততোদিনে শিখে গিয়েছে মিষ্টি। ওর মা কিভাবে জানে এসব? ভেবে কূল পায়নি মিষ্টি। ওর মা’কেও চৌধুরী ‘আদর’ করেনিতো? সেও তো একটা মেয়ে মানুষ।
আজ বাসায় মা’ও নেই, বাবা’ও নেই। সিংহের সামনে একলা খরগোশের গল্পটা জানে মিষ্টি। সে ভয়ে কাঁপতে থাকে। সোনিয়ার চেহারা বারবার চোখে ভাসে তার। দুই মাস সে ভাত খেতে পারেনি। ভাতের বাসনের সামনে মাছি দেখলেই মনে হতো এই বুঝি সোনিয়ার পেশাবের রাস্তা চেটে এসেছে। বমি আসত মুখ ভরে। সে যেন কানে শুনতে পায় সেই ভনভন শব্দ। নাকে ভেসে আসে ভাগাড়ের গন্ধ। শরীরে স্পর্শ পায় ভয়ঙ্কর কোন বিষাক্ত আরশোলার।
চৌধুরী মই বেয়ে চলে আসে ছাদে। আয়নালকে সে দেখে এসেছে অটো চালাতে। কুসুম নেই সেটাও জানে ভালো করে।
‘মিষ্টি মামনি, ও মিষ্টি মামনি। কই গেছো আম্মা? তোমার জন্য চকোলেট আনছি। খাইবা না। ক্যাডবারি চকোলেট। চুইষা চুইষা খাইতে হয়। কই পলাইছো আম্মা’?
ওয়োরড্রৌবের পাশের লম্বা খুপরিতে লেপ আর মশারির ভাঁজে লুকিয়ে আছে মিষ্টি। ভয়ে তার বুক কাঁপছে। চৌধুরীর প্রতিটা পায়ের শব্দ, শ্বাসের ফোঁসফোঁস শুনতে পাচ্ছে সে। পাশের মিঠু’র ড্রয়ারটাও সে বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। দম হয়তো বন্ধ হবেনা। কিছুটা বাতাসতো আছেই। বিড়াল, ইঁদুর আর আরশোলার মত জন্তুদের উপদ্রবের কথা সে ভুলেই গেছে।
একটা দোপেয়ে, মানুষের মত দেখতে জঘন্য অশ্লীল এক জানোয়ার গর্জন করছে তার কয়েক হাতের মধ্যে। পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে আসছে মিষ্টি’র। প্রতিটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে কুঁকড়ে যেতে থাকে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।
কবিতা...
আড়াল
ফাহাদ আজিজ
কিভাবে যাওয়াকে চলে যাওয়া বলে
বলতে পারো?
তুমি তো যাওয়ার নাম করে কেবল
আড়াল হয়েছো;
মূলত তুমি বাসা বেঁধেছো আমার হৃদয়ে।
চলে যদি যাও তবে একেবারেই যাও না;
সবকিছু ছিন্ন করে, সব স্মৃতি মুছে দিয়ে,
যেভাবে যাওয়াকে সত্যিই চলে যাওয়া বলে।
তোমার আড়াল হওয়ায় আমার চোখের কোণে
যে পানি জমেছে তা মোছার সঙ্গে সঙ্গে
যদি স্মৃতিরাও মুছে যেতো....
কাঙ্খিত ঘুমের অতিথি
দেলোয়ার হোসাইন
(অকস্মাৎ প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল মুকিত স্মরণে)
অলৌকিক সুখে লুটিয়ে
পড়েছে তোমার আয়ু,
মাবুদের দরবারে তুমি
কাঙ্খিত ঘুমের অতিথি।
আমাদের চোখে কেবল
জলের জায়নামাজ,
বিচ্ছিন্ন কথোপকথনে
শুধুই ফেরার তাড়া...!
চেয়েছি মানুষ হতে
সাজ্জাদুর রহমান
মানুষের প্রতিরূপ হতে চাইনি
চেয়েছি মানুষ হতে
ব্যাধ হয়ে জন্মাবার মধ্যে অভিশাপ
নরকের ছিঁচকাঁদুনে ভন্ডামী বিলাপ
মানুষ এমনটি করেনা কস্মিনকালে
মানুষ ফেরেশতার প্রতিরূপ।
নির্বোধ আততায়ী চোখে হলুদ সন্ধ্যাকে
ভোঁদকা মনে করে বুকপকেটে সেঁটে দেয়
পকেট ভরে থাকে জিন্দা লাশ
ইচ্ছে ভাঙা শব্দেরা ছটফট করে
অপাংক্তেয় ঋণের দীর্ঘ দ্বন্দ্বে
বৃক্ষ জড়িয়ে ধরে
পবিত্র মাটিতে অক্সিজেন খোঁজে
পাতার শরীরে পাখিপ্রেম, পরিণয়
মানুষ কে হতে পারে-
আমি মানুষ হতে এসেছি।
একাকিত্বের ষোড়শী
আব্দুল্লাহ আল আম্মার
পরমুহূর্তে পুনরায় বয়ে যায় দখিনা বাতাস
জান্লার কার্নিশে ভেসে উঠে পায়রার ভাবুক চিত্র,
অজানা করো চুল
সুডৌল অস্তিত্বের নুপুর ঝংকারে,
জমে থাকা বৃষ্টির শেষ ফোটাটিও
চায়ের সাথে মিলিত হয়।
পায়রার ভাবুক অস্তিত্বের দ্বিতীয়টি উড়ে আসে জান্লার কার্নিশে।
তাদের মিলনে,
নব যৌবন প্রাপ্ত কামুক দৃষ্টি জোড়া
সাঁতরে বেড়ায়
নেচে ওঠে ষোড়শী কন্যার গ্রীবা,
প্রশস্ত বক্ষ,
মাতাল ওষ্ঠা ধরের লজ্জাহীন হাসি।
ষোড়শী নাভিতে,
আমি নির্লজ্জ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি
অতঃপর সঙ্গম শেষে,
পায়রাদের শ্রান্ত দেহগুলো আঁধারে হারায়
চায়ের উষ্ণতা মেটাবার পর বৃষ্টিও থেমে যায়
বাদ মাগরেব
আমি তখনও,
নব যৌবনের একাকিত্বের জান্লায়,
কেবল নগ্ন যুবতীর তাম্শা দেখি!
তৃষিত মানবজমিন
সাজু কবীর
স্বপ্ন জাগানিয়া দুধেল আকাশ নেমেছে ধরাতে
ফিসফিস, কানাকানি, জড়াজড়ি সংগোপনে
কত কথা প্রেমময়, কত নির্ভয় সৃজনী-প্রণয়
শুকনো মাটির কোয়া ঠেলে মাথা চাড়া দেয়
ঝাঁক ঝাঁক কচি সবুজের স্বপ্নসুখ-ভরা মনে।
অথচ এ মানবজমিন পানিশূন্যতায় কাতরায়
অনাবাদী ঘর-দোর, ঘুঘু নাচে সুনসান আঙিনায়
আলোকসকাল কিংবা নক্ষত্রের রাত দূর অজানায়
আর কত দিন অপেক্ষায় থাকা দুঃখ-জানালায়!
তবে কি আকাশ নামবে না আমাদের এ তপ্ত ধারায়?
ওগো বনহংসিনী !
আদনান আল মিসবাহ
উন্মোচিত পর্দার আবরণ ভেদ করে আবারো কেঁদে দিলে তুমি
আমার খন্ডিত হৃদয়ের উপকূলে উর্মিমালা আছড়ে পড়েছে
সেই জ্বলন্ত অগ্নির লাভাযুক্ত উর্মিমালা
গোলাপের রং কেটে যার থেকে আগুন নিয়েছে-সুকুমার্য ঈগল
ওগো বনহংসিনী !
প্রণয়লীলার রক্ত স্রোতে আজও তোমার হিংসুটে মুখ ভাসে
আজও বানরের নাচ দেখে আমি প্রতারিত হই!
বিচ্ছিন্ন সুতাগুচ্ছ থেকে আমায় শিখতে হয়- বৈষয়িক জ্ঞান
নিবরাসের ছন্দহীন ঘুড়ি আমাকে ঘরহারা করেছে, শোনো
ছায়াবীথির মন্ত্র মুগ্ধতা, শুষ্ক মলিন গোলাপের নৈব্যক্তিক হাসি
ঈগল এখনো জীবিত প্রিয়তমা!
খানিক দূরেই হিংস্র নখরের আচরে অক্কা পেয়েছে গোলাপ ফুল
অথচ আমি বিলক্ষণ জানি,
বুর্জোয়াতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কাছে তোমার দায়বদ্ধতা ছিল না
পুঁজিপতিরা গণতন্ত্র ফলাবার আগেই তুমি কেঁদে দিলে
আজন্ম লালিত প্রণয়-ভেঙে দিলে
নির্বাপিত হলুদ পাতার শরীরে লিখে দিলে-তোমার নাম
তুমি জানোনা, ঝরাপাতার বিধানেও রয়েছে নিজস্ব শৈলী
এরা নির্দিষ্ট বাতায়ন পথে আপন শাখা বিস্তার করে
সত্যি বলতে কি !
পুঁথিগত বিদ্যা এখানে কাজে আসে না।
পোড়া শহরের বিষন্ন স্মৃতি
বশির আহমেদ
জলনিধি ঢেউ তুলে আলুথালু তুফান বাতাস
নির্মেদ আকাশে দোলা দিয়ে যায় চঞ্চল মেঘের বাসর
ঘুম চোখে স্বপ্ন দেখি প্রেমিকার ঠোঁটে অনুভূতির ফুল
নিথর দুপুর শেষে বিকেলের সুখ আসে সবুজ ঘাসে
জানিনা কেমন আছে পোড়া রোদের শহরে আদুরি পাখি।
নগরীর পথে পথে প্রিয় ক্যাম্পাসে আনন্দ ছড়ায়
কেশিয়া জাভানিকা অথবা গ্রীস্মের বাহারি প্রসূন।
গোধূলির নরম আলো রেখে যায় নন্দন ভিলার চিলেকোঠায়
পোড়া শহরের বিষন্ন স্মৃতি।
আমি চাইলে তোমার বাঁকা ঠোঁট
মিসির হাছনাইন
আমি চাইলে তোমার বাঁকা ঠোঁট কেটে দিতে পারি
যদিও আমি কোন চিত্রশিল্পী নই, আঁকতে পারিনি
সেই চিত্রকল্প যেখানে তুমি হয়ে ওঠো হীন, নিলর্জ্জ
বেহায়া সে রঙগুলো তবুও তো আকাশে ফুটেছিল
ঐ দেখো একটা নক্ষত্রে আমার বাড়ি, অচিন গাঙে
দুলে দুলে তুমি বিদেশিনী ঘোমটা পরা হেলেঞ্চা বধূ
এইবার আমি বাদশা- যখন-তখন চাইলেই পারি,
তোমার নাক কেটে পরিয়ে দিতে নক্ষত্র সোনার নথ
যে রূপের এতো অবহেলায় পরোনি তুলে রাখা শাড়ি,
আমি চাইলে সে শাড়িটা তোমাকে পরিয়ে দিতে পারি
লিখে রাখতে পারি- কতগুলো হতাশার সুর সম্ভাবনা
আর, এক ব্যস্ত পৃথিবীর বেঁচে থাকার স্নিগ্ধতা, শান্তি
লিখি- বুকভর্তি তুমিহীন নিরবতা বিষাদের গানে গানে
নিজ ভাষায় কারা যেনো গেয়ে ওঠে শ্রাবণের মাঠ জুড়ে..
মোড়লকে কেটে ফেলো
হিলারী হিটলার আভী
কুড়ানির অভিমত দরগাতলারশেওড়াগাছে ভূতের আড্ডাখানা
চৌকিদারেরও অভিমত তাই
মোড়ল সাহেব নাকি নিজের চোখে শেওড়াগাছে ভূত দেখেছে
সেন্টু গু-াও নাকি শেওড়াগাছে মাঝে মধ্যে ভূত দেখতে পায়।
তো এখন আর কি
কেউ বলছে শেওড়াগাছটিকেই কেটে ফেলতে হবে
কেউ বলছে দরগাতলাকেই নিশ্চিহ্ন করতে হবে
কেউ বলছে মাজারে মানত বন্ধ করলেই ভূত খাদ্যাভাবে পালিয়ে যাবে।
শুধু জটাধারী নগ্ন মইজু পাগল বলছে
মোড়লকে কেটে ফেলো তাহলে শেওড়াগাছের ভূত এমনই পালিয়ে যাবে।
এখন একটি জীবন্ত প্রশ্ন হচ্ছে
মোড়লকে কাটবে কে? কে কাটবে মোড়লকে?
মোড়লকে কাটার মতো অস্ত্র এ উপমহাদেশে নেই
একারণেই এ উপমহাদেশে মোড়ল শালা ছিল
মোড়ল শালা আছে
মোড়ল শালা-ই থাকবে!
শেষ কথা বলা হয়নি
শেষ কথা বলা হয়নি
আসহাবে কাহাফ
পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার সহজাত অভ্যাস প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন এবং অনাবিষ্কৃত হলেও ব্যথার অনুভূতিগুলো বরাবরই অভিন্ন! বুঝেছ রাশেদ? এমন একটা ব্যাক্যে গল্প শুরু করবো, রাশেদ কখনো ভাবেনি, তবুও শুরু করতেই হল। কারণ, যার সাথে আলাপ করতে যাচ্ছি, আমার সে বন্ধু পেশায় একজন মনোচিকিৎসক। ব্যক্তিগত স্ট্যাডি রুমে বসে, দীর্ঘদিন পরে তার সাথে আবার আড্ডা দিতে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সে আমার রুমমেট ছিল, এরপরে দুইজনের পেশাগত জীবনের ভিন্নতার জন্য, আলাদা হলেও মাঝে মাঝে দেখা স্বাক্ষাত হত। আর যখনই তার সাথে কথা হত, অবশ্যই কোনো না কোনো ভিন্ন টপিক নিয়ে আমাদের কথা হবেই। এ জীবনে যতটুকু উপলব্ধি করেছি, মনোচিকিৎসক, আধা-পাগল এবং সিদ্ধপুরুষ, এ তিন শ্রেণির মানুষের কাছে কখনোই গল্পের অভাব থাকে না। মনস্তুাত্ত্বিক সিদ্ধান্তের অভাব থাকে না। তারা জানুক বা না-জানুক, আপনাকে একটা সিদ্ধান্ত দিবেই। এ জন্যই আমি প্রায় সময় বিভিন্ন বিষয়ে রাশেদের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিই। আমি যে, সবসময় ওর সিদ্ধান্ত মেনে নিই তা নয়, তবে ওর সাথে আলোচনা করলে অনেক বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়, যার জন্য আমার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। যদিও আমার বন্ধুকে আজকেও দাওয়াত করেছি, অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য। তবুও ভাবলাম, সরাসরি সে বিষয় যাওয়ার আগে একটু ভণিতা করাই শ্রেয়। এতে ব্যক্তি এ পরিবেশের হালচাল কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। যেহেতু, মানুষের সমস্যার শেষ নেই, তাই কারও সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হলেই প্রথমেই কাজের কথা না বলে, অবস্থা বুঝেই কাজের কথা বলা উচিত। আমি লেখালেখি করি বলেই বলছি না, প্রতিটি মানুষের ভেতরেও একটা মানুষ থাকে! যখন ভেতরের মানুষ আর বাইরের মানুষ চিন্তাভাবনায় এক হতে পারে; তখন মানুষটা স্বাভাবিক থাকে। অন্যথায় ভেতরের মানুষ একজন বাইরের মানুষকে কখনোই স্বাভাবিক থাকতে দেয় না। সে কিছুটা নিচু স্বরে বলল- তুমি ঠিক বলেছে।’ আমি আবার তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘কীভাবে বুঝেছ, আমি ঠিক বলেছি?’ এবার সে আর প্রতিত্তোর করল না। কিছুটা সময় নিচ্ছে, হয়তো একটু পরেই সবিস্তারে বলবে। এটা ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গি! ভার্সিটি জীবনেই দেখেছি, ও যেকোনো বিষয়ে প্রথমে কিছুটা নিরব আছে মানেই, একটু পর গরগর করে নিজের সঞ্চিত সব জ্ঞান উগরে দিবে। আমিও তাকে সময় দেওয়ার জন্য বললাম, চা না কফি? সে বলল, কফি! আমার উদ্দেশ্য, ওকে চা খাওয়ানো বা সময় দেওয়া নয়, পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া। যার জন্য ‘ঠিক আছে’ বলে আমি কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি যখন কফির মগ হাতে ফিরে এলাম, দেখি সে কী যেন একটা লিখছে। আমার স্ট্যাডি টেবিলে সবসময় কাগজ-কলম থাকেই, সে একটু এগিয়ে এসেই হয়তো টেনে নিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী কর? সে শুধু এতটুকুই বলল, ‘কিছু না!’ আমি দুটো মগ টেবিলের উপর রাখতেই, সে একটা হাতে নিয়ে সে বলল, মানুষ সম্পর্কে তুমি কী জান?’ আমি একটু ইতস্ত বোধ করলাম। পরক্ষণেই বললাম, মানুষ সম্পর্কে আমি যা জানি, তুমি ত তার চেয়েও বেশি জানার কথা! হাজার হোক, তুমি একজন মনোচিকিৎসক। হঠাৎ আমাকে এ প্রশ্ন কেন? অবশ্যই এর কারণ আছে! তাই জিজ্ঞেস করলাম। না, এ মুহুর্তে আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া সম্ভব না। তুমিই বল। আচ্ছা, এবার বইমেলায় তোমার কোন বইটা আসবে? কেন? বল না। এবার আমি গল্প সমগ্র আনছি। ভাবছি, কিছু একটা হয়ে যাওয়ার আগে, সবগুলো গল্প একত্র করে পাঠকের হাতে তুলে দিই। ভালো, আচ্ছা, সে গল্প গুলোর মধ্যে এমন কোনো গল্প আছে, যেটার জন্য, তোমাকে এখনো ভাবতে হয়? হ্যাঁ, হয়। সে গল্পটা আগে বল, তারপর তোমার প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দিব। আসলে, আমরা কবি সাহিত্যিকরা যেভাবে মানুষকে যাচাই-বাছাই করি, ডাক্তার কিন্তু সেভাবে করে না! আবার ডাক্তার যেভাবে করে, পুলিশ কিংবা উকিলও আবার সে একইভাবে করে না। নিশ্চয় এর একটা কারণ আছে। আমি তাই গল্পটা বলা শুরু করলাম।
২০১৩ সালে ক্লোজ আপ কাছে আ্সার গল্প নামক ফেইসবুক পেইজে আমার লেখা ‘জোনাকির আলো’ নামের গল্পটি পোষ্ট করার প্রায় এক ঘন্টা পর আমার মোবাইলে একটা কল আসে। রিসিভ করতেই, ভাইয়া আপনার গল্পটি অনেক ভালো হয়েছে। আমি ধন্যবাদ দিয়ে প্রশ্ন করলাম, আপনি কে? ভাইয়া আমি আতসী। আমি আপনাকে আমার আর তন্ময়ের কাছে আসার গল্প শুনাতে চাই। আমি সহসাই উত্তর দিলাম, ‘ঠিক আছে,কাল শুনব।’ সারারাত আমার ঘুম হয়নি। পরের দিন যথারীতি সকাল হল। যদিও আমি কিছুটা সন্দিহান ছিলাম, আতসীর আমাকে ফোন করা নিয়ে। ঠিক দশটার সময় মোবাইলের রিং হতেই স্কিনে ভেসে ওঠে আতসী। নামটা আমি গত রাতেই সেইভ করে রেখেছিলাম। আমি হ্যালো বলতেই, ভাইয়া আমি আতসী। ভাইয়া আমি কি আপনার সাথে পরিচিত হতে পারি? দেখুন আমি কোন সেলিব্রেটি না, আগের গল্পে আমার পরিচয় দেওয়া আছে। প্লিজ আপনি গল্পটা বলুন। শুরু হল আতসীর গল্প।
আতসী সবেমাত্র রংপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হল। দশম শ্রেণী পর্যন্ত বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার কারণে কোনো ছেলেকে ভালোলাগার সুযোগ তার হয়ে ওঠেনি। ফলে, প্রথম দিনই কলেজের ক্যাম্পাসে তন্ময়কে দেখে আতসীর ভালো লেগে যায়। তন্ময় দেখতে এতটা সুদর্শন ছিল যে তাকে একবার দেখলে আর চোখ ফিরানো যেত না। পরের দিন আতসী যখন তার বড় ভাই রিমনের সাথে কলেজে যাচ্ছে পথিমধ্যে আবার তন্ময়ের সাথে দেখা। তন্ময়কে দেখে রিমন সালাম দিয়ে বলল, ভাইয়া ভাল আছেন? আতসী তার বড় ভাইকে তন্ময়ের সাথে কথা বলতে দেখে মনে মনে ভাবল ছেলেটা নিশ্চয় ভালোই হবে। যেহেতু, তার বড়োই নিজেই ছেলেটাকে সালাম দিচ্ছে, কথা বলছে। এক্ষেত্রে আতসী তন্ময়ের প্রতি আর বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে, প্রায় মাস তিনেক পরে ঈদ উল ফিতর চলে আসে। ঈদের পরের দিন আতসী তার ছোট ভাইকে নিয়ে ফুফির বাড়ি থেকে বাসে করে বাসায় ফিরতেছিল। মাঝপথে ঠিক একই গাড়িতে তন্ময় সহ আর ও দুইটা ছেলে ওঠে। তন্ময়কে গাড়িতে ওঠতে দেখে আতসীড় চোখ বার বার তাকে খুজে বেড়াচ্ছে। বিষয়টা কিছ্টুা বুঝতে পেরে তন্ময় আতসীর কাছাকাছি চলে আসে। সেদিন তন্ময় আতসীর মোবাইল নাম্বার চাইলে আতসী দেয়নি। পরে তন্ময় তার নাম্বার সংবলিত একটা কার্ড আতসীকে দেয়। তবে, কখনোই অতসী তন্ময়কে ফোন করেনি। কারণ, আতসীর এতদিন কোনো মোবাইল ছিল না, তাই সে তন্ময়কে কল করতে পারেনি। সেদিন থেকে প্রায় আরও আট মাস পরে আতসীর বাবা তাকে একটা মোবাইল কিনে দেয়। মোবাইল হাতে পাওয়ার পরের দিনই আতসী তন্ময়কে কল করে। এরপর থেকে দুজনের মধ্যে নিয়মিত কথা ও দেখা হত, তবে তন্ময় আতসীর সাথে দেখা করত যাতে রিমন কোনোভাবেই জানতে না পারে।
হঠাৎ একদিন আতসী অসুস্থ হয়ে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়। যেহেতু রিমনের সাথে তন্ময়ের পূব পরিচয় ছিল সেহেতু তন্ময় রিমনের সাথে নিয়মিত মেডিকেলে আসত এবং বিভিন্ন উপায়ে আতসীর সেবা করত। তন্ময়ের আসা-যাওয়া দেখে, রিমন তাদের দুজনের সম্পর্কের কথা বুঝতে পেরে আতসীকে বলল, বোন যা কিছু কর তুকে যেন কোনো দিন কাদতে না হয়। রিমন কেন এ কথা বলেছে, অতসী সেটা কিছুই বুঝতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যে আতসী সুস্থ হয়ে বাসায় চলে আসে। তন্ময় এখনও আগের মত আতসীকে দেখার প্রায় রিমনদের বাসায় চলে আসে। আতসীর মা-ও এখন তাদের সম্পর্কের কথা কিছুটা জেনে গেছে, কিন্তু তিনি কোনো বাধা দিলেন না। কারণ, তিনি মনে মনে ভেবে বসে আছে, ছেলেটা ইতিমধ্যে অনার্স ফাইনাল দিয়েছে। খারাপ কী! যদি ছেলেটার হাতেই মেয়েকে তুলে দেওয়া যায়। দেখতে দেখতে আতসী ও ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ফেলল। তন্ময়ের অনাসের্র রেজাল্ট হওয়ার পর ঢাকায় চলে যায় মাস্টার্স করার জন্য। আতসী ও রংপুর কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। এরমধ্যে আতসী সিদ্বান্ত নিল, সে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিবে। আতসীর ইচ্ছা ছিল অন্যান্য পরীক্ষার মত এইবারও তন্ময় তাকে পড়ালেখার ব্যাপারে সাহায্য করুক। তবে তন্ময় ব্যস্ততার কারণে আসতে পারবে না বলে আতসীকে বুঝাতে সক্ষম হয়। পরীক্ষার দিন যথাসময়ে আতসী আর তার বড় ভাই কেন্দ্রে যায়, যখন আতসী কেন্দ্রে ঢুকে যাচ্ছে তখনই পিছন থেকে ডাক আসে। রিমন, ওকে একা ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছ কেন? আতসী শুনেই বুঝতে পেরেছে, তন্ময়ের আওয়াজ। পিছনে ফিরে তাকাল আতসী, সেই আগের তন্ময় এখনও আছে।
সেদিনের মত তন্ময় আবার ঢাকায় ফিরে যায়। কিছু দিন পর আতসীর মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেলে, এবার তন্ময় আতসীর মা, চাচী সহ পরিচিত সবার কাছে ফোন দিয়ে আতসীর খোজ খবর নেওয়া শুরু করল। এই বিষয়টি নিয়ে একদিন আতসীর চাচা পরিবারের সবাইকে অনেক বকুনি দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আতসী তার এক বান্ধবীর নাম্বার থেকে তন্ময়কে ফোন করে বলে, আমার সাথে কিছুদিন কথা না বলে থাকতে পারনি? এইভাবে সবার মোবাইলে কল না দিলেও পারতে। তুমি কি জান তোমার জন্য আমাদের পরিবারে কত সমস্যা হয়েছে? আমিতো বলেছি, আমি ঢাকায় চলে আসি, তারপর দুজনে বিয়ে করে নিই। তখন ত কিছু বল না। এসব ধুনে তন্ময় শুধু একটি কথা বলল, তাহলে আমি তোমার পথের কাটা হয়ে গেছি? হ্যা, তুমি এখন তাই। অভিমানে ফোন কেটে দেয় তন্ময়।
পরের দিন সকালে তন্ময় তার বাবাকে, আতসীর কথা জানায় এবং সে এ কথাও বলছিল, আমি আতসীকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না। তন্ময়ের বাবা, ছেলেকে পাল্টা জবাব দেয়, আমার বড়ো ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেছি, প্রয়োজনে আর একটা আতœহত্যা করবে তবুও আমি এটা মেনে নিব না। ওদিকে সারা রাত থেকে আতসী তন্ময়কে ফোনে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু মোবাইল বন্ধ। সকালে আতসী তন্ময়কে একটা বার্তা পাঠায়, প্লিজ আমি সরি, আসলে গতকাল আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমি এখন তোমার সাথে কথা বলব, প্লিজ মোবাইল্টা অন কর। কোন উত্তর এল না। এদিকে সবাই যখন অফিসে চলে যায়, বাবার উপর রাগ করে, তন্ময় গলায় ফাঁস দিয়ে আতœহত্যা করে। সন্ধ্যায় আতসীর কাছে একটা কল আসে, তন্ময় আতœহত্যা করেছে। তন্ময় আতœহত্যা করার পুর্বে দুইটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে। একটা তার বাবাকে, অন্যটি আতসীর জন্য, অতসীর চিরকুটে লিখা ছিল, ‘আতসী আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি তোমাকেই ভালোবাসব, তুমি অন্য কাউকে নিয়ে সংসার কর, আমি ঐ পারে তোমার অপেক্ষায় থাকব।’ এতটুকু বলেই মেয়েটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আর কিছুই সে বলতে পারেনি।
আমি মনে মনে ভাবছি, হয়তো তন্ময় মরে গেছে অভিমানে! আতসী এখন পাহাড় সম চাপ নিয়ে বেঁচে আছে। কী করবে সে? তন্ময়ের কথা মত কাউকে বিয়ে করবে? না ঐ পারে অপেক্ষমান তন্ময়ের কাছে চলে যাবে? আমি অপেক্ষা করছি, অতসীর কান্না থামার জন্য, পাশাপাশি ভাবছি, আমিই আতসীকে বিয়ে করব। এটা তারুণ্যের একটা গুণ। তরুণ বয়সে যেকোনো কেউ যেকোনো পরিস্থিতি ও পরিবেশে নিজেকে যেকোনো ঘটনার নায়ক কিংবা ত্রাতা ভাবতে পছন্দ করে। অথচ, মানুষ তার নিয়তি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। অতসী কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে, আমি আবার আতসীকে প্রশ্ন করলাম, কি করতে চান এখন? আতসীর একটাই উত্তর, তন্ময়ের কাছে যাব। সেদিন আমার সে মনের সে গোপন কথাটা আর অতসীকে বলা হয়নি। পরে বিদায় নিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।
এ পর্যন্ত বলে, আমিও একটু থামলাম। এবার আমার দিকে তাকিয়ে রাশেদ একটু মুচকি হাসি হাসল! হাসিটার মধ্যে একটা রসবোধ আছে। দুজনেই বুঝেছি, কিন্তু কী সেই রসবোধ তা বুঝানোর সাধ্য কারও নেই। তারপর, সে প্রশ্ন করল; এর পরে কি তুমি গল্পটা লিখেছ? আমি জবাদ দিলাম। হ্যাঁ। ভালো, ত গল্প লিখে অতসীর সাথে কখনো যোগাযোগ করনি? আমি করেছি। সে কী বলল? সে আরও করুণ এক কাহিনি! আপাতত বলতে চাই না। আমি জানি না, মানুষ কেন অতীতকে সামনে আনতে চাই না। আমি জানি; অতীতের গল্পগুলো সবসময় নিদারুণ এবং কষ্টের। তারপরও রাশেদের জোরাজোরিতে আবার বলা শুরু করলাম।
২০১৪ সালে ‘ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প’ পেইজে যখন গল্পটি প্রকাশিত হল, আমিই আতসীকে ফোন করি। ফোনটা রিসিভ করেছে অন্য কেউ। রিসিভ করে আমার পরিচয় জানার পর, যে উত্তর দিয়েছে, আমি তার জন্য একেবারের অপ্রস্তুত। অতসী ২২শে ডিসেম্বর গত হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি আতসী তন্ময়ের কাছে গেছে, ঠিক যে তারিখে তন্ময় গত হয়েছিল। সেদিন বুঝলাম, কাউকে কিছু বলতে চাইলে, সে কথা সাথে সাথেই বলা উচিত। হোক সেটা গ্রহণযোগ্য অথবা না।’ কেননা, আজকের সে মানুষটা আগামী দিন নাও থাকতে পারে।
আচ্ছা, ঠিক যদি ঐদিন অতসীকে ফোনে পেতে, তবে কী বলতে?
কেবল এতটুকুই বলতাম, ‘আতসী তোমাকে নিয়ে লেখা গল্প প্রকাশিত হয়েছে, তুমি পড়বে না? এভাবে, আমার চোখেও জল এনে তুমিও তন্ময়ের কাছে চলে গেলে? হয়তো সেদিন আমি এও বলতে চেয়েছিলাম, আতসী তুমি আমাকেই বিয়ে কর, পারিনি। বুঝেছি, তন্ময় যেমন, তোমাকে শেষ কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেছে, তুমিও আমাকে সেই সুযোগ দিলে না। এক জীবনে হয়তো এ এক আপসোস থেকেই যাবে!
এখন কি তার কথা মনে পড়ে? আমি বললাম, ‘না!’ এই যে ‘না’ এটা যে কত বড়ো মিথ্যা তা রাশেদ বুঝতে পেরেই বলল, ঠিক আছে। এবার তোমার প্রশ্নের উত্তরে আসি। তুমি যে বললে, ‘ব্যথার অনুভূতি সব মানুষের কাছে এক!’ আজকের তুমিই তার প্রমাণ। হয়তো অতসী বেচে থাকলেও তন্ময়ের স্মৃতি আওড়াতো, চোখের জল ফেলত; সে একই কাজ এখন তুমিই করছ। যাক, বাদ দাও সেসব কথা! এখন বল, কেন আসতে বলেছ? সে মনোচিকিৎসক, সে বুঝে; আমি তাকে কিছু বলতে চাই, বলার জন্যই ডেকেছি। অথচ, এখন পরিস্থিতি এমন, আমার আর কিছুই বলার মতন নেই। তাই আর কিছু না ভেবেই বললাম, ‘থাক, অন্য একদিন!’ এ যে অন্য একদিন বলার জন্য যে কথা মানুষ চেপে যায়, তা কি সে সত্যিই অন্য একদিন বলতে পারে? পারবে?