ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২১৫

ইপেপার : ধানশালিক : সংখ্যা ২১৫

 তারুণ্যের শিল্প সরোবর ।। বর্ষ ৮ম ।। সংখ্যা ২১৫,

শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউল সানী ১৪৪৫।






















হেলাল হাফিজ রচিত কবিতা

হেলাল হাফিজ রচিত কবিতা

 


হেলাল হাফিজ রচিত কবিতা 

কবি হেলাল হাফিজ (জন্ম : ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮- মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)। কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)- এর পরে হেলাল হাফিজ একমাত্র নিভৃতচারী কবি যিনি অতি অল্প লিখেও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। হেলাল হাফিজ মূলত জাতকবি। 


যাতায়াত


কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।

কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না

রাত কাটে তো ভোর দেখি না,

কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না; কেউ জানেনা।


নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম

পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,

কেউ বলেনি ভালো থেকো, সুখেই থেকো।

যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি

মাথার কসম আবার এসো।


জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো

শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,

চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি

বললো না কেউ তরুণ তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।

ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়

আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর

শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ

একলা এলাম শুশ্রুষাহীন।

কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।


উৎসর্গ 


আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো

আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?

কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?

কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা-সেলুন?

কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো

চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,

তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে

খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে

কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।

মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,

সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,

তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।

কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,

নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,

পথিক এ পথে নয়

‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।


হেলাল হাফিজের কবিতা : সময়ের স্বতন্ত্রস্বর

হেলাল হাফিজের কবিতা : সময়ের স্বতন্ত্রস্বর

 


হেলাল হাফিজের কবিতা : সময়ের স্বতন্ত্রস্বর

অনন্ত পৃথ্বীরাজ


বাংলা ভাষার এক বিরল প্রতিভা কবি হেলাল হাফিজ (জন্ম : ৭ অক্টোবর, ১৯৪৮- মৃত্যু : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪)। কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)-এর পরে হেলাল হাফিজ একমাত্র নিভৃতচারী কবি যিনি অতি অল্প লিখেও তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। হেলাল হাফিজ মূলত জাতকবি। তিনি আসলে কবিতা উদযাপন করেছেন। তাই তাঁর কবিতা কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগেই কালোত্তীর্ণ হয়েছে। দ্রোহ-প্রেম ও যৌবনের কবি হেলাল হাফিজ ছিলেন একজন নির্মোহ ও সাদা মনের মানুষ। কর্মজীবনে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু নেশা ছিল কবিতার অনুধ্যান। কবিতায় রাজনীতির স্বর থাকলেও কবিকে কোনো রাজনৈতিক দলের মোড়ক পড়তে দেখা যায়নি। তিনি জানতেন লেখা শুরু করে কোথায় থামতে হবে। কবি হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার পরও দীর্ঘ সতেরো বছর লেগেছে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) প্রকাশিত হতে। তারপর আড়াই যুগের স্বেচ্ছা নির্বাসন। কালপরিক্রমায় দ্রোহের শিল্পভাষ্য থেকে কবি নিজেকে প্রেম ও ধ্রুপদীসত্তায় নিজেকে স্থানান্তরিত করেন। তাই তাঁর কবিতায় নারী কখনো মমতাময়ী, আবার কখনো সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ধরা দিয়েছে।

বাংলা কাব্যের বহুল পঠিত কবি হেলাল হাফিজ। মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ লিখে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়-তার অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। ব্যক্তিজীবনে খোলসবদ্ধ, মিতব্যয়ী, স্বল্পভাষী এবং প্রচ- আবেগপ্রবণ এই কবির জীবনই যেন এক রহস্যের ঘেঁরাটোপ। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া কবি হেলাল হাফিজ-পরবর্তী জীবনকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বোনাস বিসেবে বিবেচনা করতেন।  তিনি কম লিখতে। তবে যা লিখতেন তা ছিল সময়ের স্বতন্ত্রস্বর। কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় বাংলাদেশের মানুষ, এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো, অন্যায়-বিচার, নির্যাতন, দ্রোহ-বিদ্রোহ, প্রেম-প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয় অবলীলায় এসেছে। 


হেলাল হাফিজ বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি। তিনি কবিতা লিখে বিংশ শতাব্দী শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এক সময় বাংলাদেশের কবিতাপ্রেমী পাঠকের মুখে মুখে তার কবিতা উচ্চারিত হত। কবি হেলাল হাফিজের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলা। তাঁর পিতার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার। মাতার কোকিলা বেগম। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই বছর হেলাল হাফিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৭২ সালে তিনি তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র ‘দৈনিক পূর্বদেশ’-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন দৈনিক পূর্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি ‘দৈনিক দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক পদে যোগদান করেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। সে রাতে ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় পড়ে সেখানেই থেকে যান। রাতে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক) থাকার কথা ছিল। সেখানে থাকলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তুপ, লাশ আর লাশ। হলের গেট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী পরিণতি ঘটেছে তা জানবার জন্য সেদিন আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন কবি নির্লেন্দু গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দু’জনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।

প্রথম বই প্রকাশের সতেরো বছর আগেই হেলাল হাফিজ কবি খেতাপ পেয়ে যান-তাঁর কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লেখার জন্য। এ সময় কবিতাটি ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ওই কবিতার প্রথম দুইটি লাইন ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়; এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, ‘রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হয় এবং এখনো পর্যন্ত এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিবার ব্যবহৃত রাজনৈতিক স্লোগান এটি।


কবি হেলাল হাফিজের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দীর্ঘ সময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়ে ছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। উদ্দেশ্য পাঠক নতুন কিছু দেওয়া। কারণ, কবিতাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। হেলাল হাফিজ কবিতার মানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তাই বছর বছর গ্রন্থ প্রকাশের উচ্ছ্বাস তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল না। আড়াই দশক পরে তিনি পাঠকদের জন্য লেখেন দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা ৭১’ (২০১২), তৃতীয় এবং সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদোনা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে অমর একুশে বইমেলায়।

হেলাল হাফিজ এক নির্মোহ কবির নাম। কবিতা ছিল তাঁর কাছে আনন্দ-বেদনা যাপনের মাধ্যম। কবিতাকে তিনি কখনো উপার্জন অথবা খ্যাতির হাতিয়ার করে তোলেন নি। তাই পুরস্কারের প্রতি তার ছিল বরাবরই বিতৃষ্ণা। তারপরও বিভিন্ন সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন কবিকে বিভিন্ন পুরস্কার, সম্মাননা দিয়ে নিজেদের সম্মানিত করেছেন। এসবের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ বৈশাখী মেলা উদ্যাপন কমিটি কর্তৃক ‘কবি সংবর্ধনা’ (১৯৮৫), ‘যশোহর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার’ (১৯৮৬), ‘আবুল মুনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার’ (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজ কর্তৃক ‘কবি খালেদদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদক সম্মাননা’ এবং ‘বাসাসপ কাব্যরতœ’ (২০১৯) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কবিতায় কবি হেলাল হাফিজ ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

‘জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় কবির প্রতিভার স্ফূরণ লক্ষ্য করা যায়। পরাধীনতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তারুণ্যকে মিছিলে এবং যুদ্ধে যেতে কবি আহ্বান জানিয়েছিলেন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়কালে। কবি কী তবে মুক্তিযুদ্ধের আভাস আগেই পেয়েছিলেন। কারণ, কবিরা ত্রিকালদর্শী হয়ে থাকেন। তাছাড়া কবিগণ জানেন আত্মত্যাগের বিনিময়েই অর্জন করা যায় কাক্সিক্ষত সাফল্য। তাই তারুণ্যকে কবি স্বাগত জানিয়েছেন। কবির ভাষায়, 

যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান

তাই হয়ে যান

উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।

এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।


কালজয়ী কবিতার এই পঙ্ক্তি দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। পরবর্তীতে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন- দাবী আদায়ের স্লোগান হিসেবে কবিতাটি গণমানুষের মনে তুমুল সাড়া জাগায়। কবি হেলাল হাফিজের জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬)। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিভাষা আর মানুষের হৃদয়ে সঞ্চিত আবেগের মিশেলে রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যেন হয়ে উঠেছিল গণমানুষের প্রেম ও দ্রোহের শিল্প প্রতিভাষ। তাই গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তুমুল জনপ্রিয় পায় এবং পাঠক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। গ্রন্থটি নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ থাকায় ১৯৮৬ সালে এখন পর্যন্ত বইটির বৈধ মুদ্রণ হয়েছে ৩৩ বারের বেশি। রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে হেলাল হাফিজের কবিতার পঙ্ক্তি যেমন ব্যবহৃত হয়েছে-তেমনি আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও পারিবারিক টানাপোড়নে প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। কেবল কবিতার পাঠকের নিরিখে নয়, যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের খোঁজ-খবর করেন না, এমন অনেকের হৃদয়েও দোলা দিয়েছে হেলাল হাফিজের পঙ্ক্তি।


কবি হেলাল হাফিজ নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কবিতাটি ওই সময় কোনো পত্রিকা প্রকাশ করার সাহস পায়নি। কিন্তু কবিতার প্রথম দুটি লাইন আহমদ ছফা এবং কবি হুমায়ুন কবির ১৯৬৯ সালে এক রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়াল লিখন করে দিয়েছিলেন।’ কবি শামীম আজাদ বন্ধু-প্রতিম এবং সমসাময়িক সাহিত্যিক হেলাল হাফিজকে ‘বিরল-প্রজ’ কবি আখ্যা দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘উনি কম লিখেছেন; কিন্তু প্রবল জনপ্রিয় ছিলেন। কবিতা ছিল ছোট, কিন্তু ব্যাপক ভাব প্রকাশ করতো সেগুলো।’ লড়াইয়ে, সংগ্রামে, প্রেমে-বিরহে, দ্রোহে-বিদ্রোহে যাপিত জীবনের পরতে পরতে হেলাল হাফিজ স্পর্শ দিয়ে যান। ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন,

 

ছিল তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি

সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে? 

জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে

রক্তঋণে স্বদেশ হলো, তোমার দিকে চোখ ছিল না

জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’ 


কেবল মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গণ-অভ্যুত্থানের মতো প্রেক্ষাপটে নয়, যেকোনো অন্যায়ে-শোষণে-অবিচারে হেলাল হাফিজের এ উচ্চারণ সবার হয়ে ওঠে। ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় দেশ স্বাধীনের কথা বলেছেন। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস বয়ে আসে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মাধ্যমে পাওয়া যায় দীর্ঘ পরাধীনতা থেকে মুক্তি, একটি স্বাধীন ভূখ- এবং একটি পতাকা। যা জাতির বীরত্ব ও সার্বভৌমত্বের পরিচয় বহন করে। কবি লিখেছেন : 


কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস

ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’।


‘ফেরিঅলা’ কবিতায় হরেক রকম কষ্টের কথা বলেছেন। একজন ফেরিঅলা যাপিত জীবনের নানা রকম কষ্ট বিক্রি করতে চান। জগৎ সংসারে কষ্টের নানা প্রকারভেদ রয়েছে। প্রেমের কষ্ট, ঘৃণার কষ্ট, নদী এবং নারীর কষ্ট, অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট, ভুল রমণী ভালোবাসার, ভুল নেতাদের জনসভার হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে। আরও বিভিন্ন প্রকার কষ্টের কথা কবি বলেছেন। কেউ কষ্টের ভার নিতে চাইলে কবি অনায়াতে তা দিতে পারেন। কবি বলেছেন :  

লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট

পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,

আলোর মাঝে কালোর কষ্ট

‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট।

 

‘ইচ্ছে ছিলো’ নিটল প্রেমের এক রোমান্টিক কবিতা। এ কবিতায় কবি তাঁর মানস প্রতিমাকে সাজাতে চান নিজস্ব ঢংয়ে। বাংলার ষড়ঋতুর সৌন্দর্য এনে ঢেলে দেবেন প্রিয়ার শরীরে। প্রয়োজনে নিয়োগ করা হবে সুদক্ষ মেকাপম্যান। তাঁর প্রিয়াকে অনিন্দ্য হতেই হবে। কবির ইচ্ছে ছিলো প্রেমিকাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবেন। প্রেম দিয়ে বাজাবেন বিশ্বভুবন। কবি লিখেছেন: 


ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো

ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে

কান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।

ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো

সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা

পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।

 

‘নেত্রকোনা’ কবিতায় কবি যেন ফিরে তাকিয়ে দেখছেন ফেলে আসা অতীতপুরে। আবহমান বাংলার চির-সবুজ গ্রাম; বাল্যস্মৃতিতে ফিরে গেছেন কবি। নাগরিক করপোরেট জীবন মানুষকে অসাড় করে দেয়। ভালোবাসা, মায়া-মমতাহীন ইট, পাথরের শহর এক সময় বিষণœ লাগে। ইচ্ছে করে গ্রামে ফিরতে। যেখানে বাড়ির প্রাঙ্গণে নিষ্পলক কেউ একজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। কেউ ট্রেনের হুইসেলের শব্দে তোলপাড় করে ওঠে। মায়ের কথা মনে পড়ে। অথচ জীবনের পাশাপাশি ওতোপ্রোতভাবে থাকে অদ্ভুত মরণ। কবির ভাষায় : 


কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?

কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?

তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল।

মগড়ার ক্ষীণ কলরোল

অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,

তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,

যে রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে

জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।

 

‘প্রস্থান’ কবিতায় কবি তাঁর মানস প্রিয়ার কাছে পত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন। কারণ, প্রিয়জনের চিন্তা সব সময় মনকে ব্যথাতুর করে রাখে। যেখানে একটা চিঠি পাওয়া মানে মনের প্রশান্তি। একটা সময় ছিল-যখন যোগাযোগের অন্যতম প্রধান বাহন ছিল চিঠিপত্র। দূরে অবস্থানকারী আপন জনেরা চিঠির মাধ্যমে খবরা-খবর আদান-প্রদান করতেন। কবি তাই চিঠিকেই প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। প্রিয়জনকে বার বার অনুরোধ করেছেন পত্র দিতে। কবির লিখেছেন : 


এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।

এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা

খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।

ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত

ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো।

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।


হেলাল হাফিজ সেই দুর্লক্ষ, দুর্লভ কবিদের একজন, যিনি নিতান্ত স্বল্প সৃষ্টি-সম্ভার সত্ত্বেও জয় করেছেন তুঙ্গস্পর্শী জনমানস। সমান্তরালে শিল্প-সিদ্ধিতেও যা পরিপ্লুত। তাঁর কবিতার বিষয় ও প্রকরণ যুগপৎ মেলবন্ধনে সার্থক, কালোত্তীর্ণ। স্বল্প সৃজনেও তিনি বরাবরই প্রাসঙ্গিক এবং প্রোজ্জ্বল। হেলাল হাফিজের কবিতার প্রাণশক্তি বস্তুত ব্যক্তিক মনোলোকের নিগূঢ় অন্তর্বীক্ষণে। আবার ব্যষ্টির অনুভব, চারিত্র, সংক্ষোভ-দ্রোহও তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র। নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না কিংবা ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’- জনশ্রুতি বা প্রবাদবাক্যে রূপান্তরিত এরকম পঙ্ক্তিসমূহ কাল ছাপিয়ে কালান্তরের দরজায় কড়া নাড়ে। কবি হেলাল হাফিজ বেঁচে থাকবেন স্বীয় কর্মের মাধ্যমে। কবির মহাপ্রয়াণে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। 

কবি ও গবেষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর। 


মানুষ একা; হেলাল হাফিজের মত একা

 মানুষ একা; হেলাল হাফিজের মত একা



মানুষ একা; হেলাল হাফিজের মত একা!

জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


মানুষ মূলত একা। ভীষণ রকমের একা। কতটা একা সেটা অনুমান করা কঠিন  তবে কিছু আনদাচ করা যায় আমাদের প্রিয় কবি হেলাল হাফিজকে দেখে। জীবন ঠিক কতটা নিঃসঙ্গতায় ভরপুর; কতটা বিরহে ভরপুর; কতটা এলোমেলো; কতটা দিক-বেদিক; তার নিখাদ উদাহরণ হলো হেলাল হাফিজ। আমরা আমাদের এই ছোট্ট ঝরাপাতার মত জীবন নিয়ে কত আনন্দিত; কত উচ্ছাসিত; কতটা বেসামাল সময়ের ভেতর ডুবে গিয়ে কিছুটা একটা ভুলে যাই। আমরা মানুষ আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চাই; স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চাই; স্বাদ নিয়ে বাঁচতে চাই কিন্তু কোথায় যেন কিছু একটার তীব্র অভাববোধ থেকে যায়; যেটা কাটিয়ে ওঠা বড় ধরনের কষ্টকর। আমি বরাবর’ই জীবন ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। কিছুটা হেলাল হাফিজের সাথে মিলে যায় অকপটে। তবে এই মিলের ভেতর রয়েছে কেমন একটা দাহ। আমার কাছে জীবনটা ঠিক সকাল বেলার মত। দেখতে দেখতে রোদ উঠে যায়; দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়; দেখতে দেখতে নির্মলতা হারিয়ে যায়; দেখতে দেখতে দেখায় হয়না; দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায় কিন্তু কেন এমন ! চিন্তা করেছি অনেক। তবে ভেবে পাইনা। এর উত্তর কি; এর ভেতর অনেক প্রশ্ন । আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি । খুঁজতে খুঁজতে হেলাল হাফিজদের মত কিছু একটা পেয়ে যাই। তখন কিছুটা থমকে যাই। আমার সেই থমকে যাওয়া আমাকে অবাক করে দেয়। কিছু হতভম্ব করে দেয়। জানি না কেন এই নিরুত্তর তীব্র দাহ ভেতরে। এই নষ্ট সময়ে আমাকে কিছু দিয়েছে; কি দিবে কিংবা কি নিয়ে আমাকে এই জীবন কাছে হাজির হতে হবে; আমি ঠিক জানি না। একজন হেলাল হাফিজ এই জীবন অনেক কিছু বলে দেয়। একজন হেলাল হাফিজ জীবন নিয়ে অনেক অভিযোগ করে যায় । একজন হেলাল হাফিজ জীবন নিয়ে অনেক বিরহ জাগিয়ে দেয়। একটা হেলেন একজন হেলাল হাফিজকে জীবন চিনিয়ে দেয়। জীবন কি স্বাদ তা বুঝিয়ে দেয়। আমরা কেউ কেউ জীবন স্বাদ বুঝতে বুঝতে জীবন হারিয়ে ফেলি। একজন হেলাল হাফিজ তেমন হারিয়ে যায়। আমরা ঠিক তার মত জীবন চাই না; আমরা ঠিক তার মত বেদনা না চাইনা; আমরা তার মত বিরহ চাইনা । তবে এই জীবনে বিরহ, বেদনা, নিঃসঙ্গতা কেমন একটা স্বাদ দেয়; একজন হেলাল হাফিজ বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। আমাদের কেন জানি মনে হয়; আমাদের অনেক কিছু বলার ছিল; আমাদের অনেক কিছু বলার থাকে । বাহিরের তাগাদা সেটা ঢেকে দেয়; আমরা ঘুমিয়ে পড়ি রোদের তাপে; আমরা জেগে থাকি রাতের শরীরে। একজন হেলাল হাফিজ পুড়িয়ে দেয় আমাদের; একজন হেলাল হাফিজ অনেক প্রশ্ন রেখে যায় জীবন নিয়ে; আমরা কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনা; আমরা কেউ তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনা; কিন্তু কেন ! আমাদের কাছে একজন হেলাল হাফিজ  ঠিক ফেরিওয়ালার মত থেকে যায়-


ফেরিওয়ালা


কষ্ট নেবে কষ্ট

হরেক রকম কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট !


লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট

পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,

আলোর মাঝে কালোর কষ্ট

‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট

দাড়ির কষ্ট

চোখের বুকের নখের কষ্ট,

একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট

অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,

ভুল রমণী ভালোবাসার

ভুল নেতাদের জনসভার

হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট

পথের এবং পায়ের কষ্ট

অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরিওয়ালার কষ্ট

কষ্ট নেবে কষ্ট ।


আর কে দেবে আমি ছাড়া

আসল শোভন কষ্ট,

কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন

আমার মত ক’জনের আর

সব হয়েছে নষ্ট,

আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট ।


বিরহে পুড়ে; বেদনায় জ্বলে একটা মানুষের জীবন কতটা নিখাদ হতে পারে; কতটা শুনশান নীরব হতে পারে; কতটা শান্ত সমুদ্রের হতে পারে; সেটা কেবল’ই হেলাল হাফিজ বিশাল উদাহরণ। 


বারবার আমরা একটা জিনিস চিন্তা করলে সহজেই বুঝতে পারবো; জীবনে যত সমস্যা’ই থাকুক না কেন; সেটা সাময়িক। তবে আমরা কিন্তু সব মানুষ’ই চাই যে; জীবনটা সহজ হোক; সাবলীল হোক; সুন্দর হোক। জীবন সুখে ভরপুর থাকুক; সুন্দরের ছেয়ে থাকুক । কোনো ধরনের দুঃখ, বেদনা, বিরহ স্পর্শ না করুক; কোনো অস্থিরতা ভর না করুক। তবে হেলাল হাফিজ তার জীবনটা কেন জানি মনে হয় বেদনার হাতে তুলে দিয়েছেন; বিরহের হাতে তুলে দিয়েছেন। হয়ত সে সেই বিরহেই তাবৎ সুখ খুঁজে পেয়েছে; কেন জানি- বেদনাকে সে খুব কাছের মানুষের মত মনে করে; এক কথায় বিরহ আর বেদনা দিয়ে জীবনটা দারুণ ভাবে সাজিয়েছিল। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যপার যে; একজন হেলাল হাফিজ বিরহে পুড়িয়ে দেয়া একটা প্রেমিকাকে বুকে ধারণ করে জীবন পার করেছে; কি সাংঘাতিক। আহ; ভালোবাসা মানুষকে এভাবেও রাখে; ভালোবাসা মানুষ জীবন্ত মমী বানিয়ে রাখে; কি অদ্ভুত না! তাবৎ বিরহ বেদনা বুকে ধারণ করে জীবন পার দেয়া মানুষটা শেষে একা হয়ে চলে গেল আমাদের ছেড়ে। বেদনাকে আত্মার আত্মীয় করে বেদনাকে শান্তনাও দিয়ে সময় যাপন করে গেছেন। আর আমার দূরে দাড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাকে দেখে গেছি নিভৃত্বে...


বেদনাকে বলেছি কেঁদো না


আমাকে দুঃখের শ্লোক কে শোনাবে?

কে দেখাবে আমাকে দুঃখের চিহ্ন কী এমন,

দুঃখ তো আমার সেই জন্ম থেকে জীবনের

একমাত্র মৌলিক কাহিনী।


আমার শৈশব বলে কিছু নেই

আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,

আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।

দুঃখ তো আমার হাত- হাতের আঙুল- আঙুলের নখ

দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।


আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুঃখী নই,

দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয় যে, আমাকে দুঃখ দেবে।

আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,

অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,

পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে

সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফটি-ম্যাচের মতো বুকে।


হেলাল হাফিজ নিবেদিত কবিতা

হেলাল হাফিজ নিবেদিত কবিতা

 



কলিযুগের কবি

মিসির হাছনাইন 

[হেলাল হাফিজ স্মরণে]


সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবে... সময়,

রাতের অন্ধকারে শিশিরভেজা রাতে

যেমন টুপ করে ঝরে যায় একজন মানুষ।

কলিযুগের দোযখে পুড়েছে তাঁর হৃদয়

একাকী চোখের ভিতরে দেখা গেছে মৃত্যুপথ;

সেখানে হাস্নাহেনার সৌরভ কথা বলে ওঠেছিল।

পৃথিবীর সবুজে মিশে ছিল সবুজ চোখ

জীবনের পিছে দৌড়ে যে পা দুটো হয়রান;

সেখানেই ফেরে পেয়েছে যৌবনের শ্রেষ্ঠ যৌবন?

কালো যুগের অন্ধকারে হাসে কুমারী নদী

কুয়াশার চাদরে জমে থাকা শিশিরজল,

শোকের মাতমে কতগুলো ফুল ঘরছাড়া 

কতজনের ভেজা চোখের অগ্রহায়ণ শীত

জ্যোৎস্নার শাড়িতে হেঁটে চলে মৃত শরীর।

দেখি- আরো একটা জীবন কেমন করে চলে যায়

চুপচাপ অন্ধকারে ঝরে পরা শিশিরের টুপটাপ শব্দে 

চোখের নীরবতায় একাকী, পরাজিত রাজ্যের রাজত্ব ছেড়ে

কোন এক দিনের গভীরে বিষন্ন একা ঝরাপাতা হৃদয় নিয়ে

চোখ বন্ধ অন্ধকারে ঘুমিয়ে পড়েন কলিযুগের তরুণ কবি



বিদায় কবি হেলাল হাফিজ 

রফিকুল ইসলাম মানিক


তুম রবে কবিতার চরণে

রাজপথে উত্তাল শ্লোগানে।

বিরহে যাপনের অনুষঙ্গে 

ব্রহ্মপুত্রের কন্যার বিষে নীল।

অব্যক্ত যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে 

যাচ্ছে নদের পাড়, শোকে

ঝড়ছে কুয়াশা বৃষ্টি। 

অনন্তলোকে ভালো থেকো প্রেমিক!




ঝরা পাতা ও কবি 

রহমতুল্লাহ শিহাব 


কুয়াশার দেহজুড়ে কনকনে শীত,

হলুদ সাজে ঝরে আমড়াগাছের ক্লান্ত পাতা,

ঠান্ডা বাতাসে ভেসে আসে বিষাদ,

পাতাশূন্য ডালে চির মলিন হাহাকার।

ভাবি- পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়,

সময় বয়ে চলে স্রোতের মতো


আমড়াপাতার সাথে ঝরে কিছু স্মৃতি

ঝরে পড়েন কবি হেলাল হাফিজ।

তার কবরে মাটি দিতে দিতে দেখি-

শব্দেরা কাঁদছে, কবিতারা স্তব্ধ,

বাংলার আকাশে এক টুকরো আলো,

ভালোবাসার অভাবে একাকী নিভে যায়।


কিন্তু কবিরা তো অমর,

তারা বেঁচে থাকে প্রতিবাদের মিছিলে,

অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা স্লোগানে,

কালজয়ী সেই আহ্বানের মতো-

এখন যৌবন যার, মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়;

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।



হেলাল হাফিজের জীবন, কবিতা, জীবনযাপন এবং রাষ্ট্রচিন্তা

হেলাল হাফিজের জীবন, কবিতা, জীবনযাপন এবং রাষ্ট্রচিন্তা

 



হেলাল হাফিজের জীবন, কবিতা, জীবনযাপন এবং রাষ্ট্রচিন্তা

ইসরাফিল আকন্দ রুদ্র 


বাংলা কবিতার ভুবনে হেলাল হাফিজ অনন্য উজ্জ্বল ধ্রুব নক্ষত্র, যিনি তাঁর অমর রচনায় সময়, সমাজ, প্রেম এবং রাষ্ট্রের জটিলতাকে গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতা যেমন পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে, তেমনি বোধে আনে জাগরণ । 


হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে পিতা খোরশেদ আলী তালুকদারের ঔরসে, মাতা কোকিলা খাতুনের গর্ভে। বয়স যখন তিন তখনই হারিয়েছেন মাকে। মাতৃহীনতার বেদনাই তাকে ক্রমান্বয়ে কবি করে তুলেছে। মাকে খুঁজে ফিরেছেন সবখানে। তাঁর জীবন ছিল নিঃসঙ্গতায় ভরা। এই নিঃসঙ্গতা কখনো তাঁকে কবিতার গভীরতায় ডুবিয়েছে, আবার কখনো সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে।


হেলাল হাফিজের কবিতা শুধু শব্দ নয়, এটি যেন তাঁর হৃদয়ের ভাষা, অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) তাঁকে পাঠকের কাছে এনে দেয় অপরিসীম জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের কবিতার বইয়ে সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত এ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের কবিতা সমূহ শুধু প্রেম নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সমাজের গভীর অনিয়মের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ।


হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম একধরনের চিরন্তন অভিব্যক্তি পায়। তাঁর প্রেমিকসত্তা গভীর, কিন্তু তা কখনো আবেগের ফাঁদে আটকা পড়ে না।

হেলাল হাফিজের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কয়েক প্রজন্মের প্রতিবাদী মন্ত্র হয়ে উঠেছে। 

এই কবিতায় হেলাল হাফিজ সময়ের চেতনাকে ধারণ করেছেন। এটি একদিকে রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে জাগ্রত করেছে, অন্যদিকে প্রেম ও সংগ্রামের মিলিত রূপে সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।


হেলাল হাফিজের কবিতার ভাষা সহজ, কিন্তু গভীর। তাঁর কবিতায় আধুনিকতার ছোঁয়া স্পষ্ট। তিনি কবিতায় প্রচলিত ছন্দ ও আঙ্গিক ভেঙেছেন এবং নতুন শৈলী নিয়ে এসেছেন। শব্দ চয়ন এবং বাক্য গঠনে তাঁর প্রতিটি কবিতা পাঠকের মনে অমর হয়ে থাকে।


তাঁর জীবনযাপন ছিল কঠিন, কিন্তু তা সৃজনশীলতায় ভরপুর। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা এবং প্রেমের ব্যর্থতা তাঁকে যেমন আঘাত করেছে, তেমনি সেগুলো তাঁর কবিতার রসদ হয়ে উঠেছে।


কবিতার জগতে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও একাকীত্বের মানসিক যন্ত্রণা তাঁকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়িয়েছে। তিনি সংবাদপত্রের সম্পাদনা, পত্রিকায় লেখালেখি এবং কখনো কখনো বেকার জীবনের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন।


তাঁর জীবন একদিকে সংগ্রামের প্রতীক, অন্যদিকে সৃজনশীলতায় ভরা। তিনি কখনো জীবনের এই বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাননি। বরং কবিতায় জীবনযাত্রার এই দিকগুলো স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।


হেলাল হাফিজ রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টিপাত করেছেন। তাঁর কবিতাগুলোতে বারবার উঠে এসেছে শোষণ, বৈষম্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।


বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কবির কাজ শুধু সৌন্দর্যের প্রশংসা নয়, বরং সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা। হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতায় শাসক শ্রেণির অন্যায়কে কটাক্ষ করেছেন প্রতিনিয়ত। 


হেলাল হাফিজের কবিতায় প্রেম এবং রাষ্ট্রচিন্তা একসাথে জায়গা করে নিয়েছে। প্রেম তাঁর কাছে শুধু ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এটি বৃহৎ চেতনার অংশ। তাঁর মতে, প্রেম একধরনের প্রতিবাদ, যা অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে মানবিকতার শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কবিতায় প্রেম এবং রাষ্ট্রের সংঘাত একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। 


হেলাল হাফিজ একাধারে প্রেমিক, বিদ্রোহী এবং স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর কবিতায় জীবনের গভীর অনুভূতি, রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচার এবং সমাজের অসঙ্গতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ পাওয়া যায়।


তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামময়, কিন্তু তাঁর কবিতা চিরন্তন। ব্যক্তি হেলাল হাফিজ হয়তো একা ছিলেন, কিন্তু তাঁর রচনাগুলো কোটি পাঠকের মনে স্থায়ী আসন পেয়েছে। তিনি শুধু এক প্রজন্মের কবি নন; তিনি সকল সময়ের কবি। তাঁর কবিতা পড়লে মনে হয়, জীবন এবং রাষ্ট্রের সমস্ত জটিলতা সত্ত্বেও, প্রেম এবং মানবতা চিরকাল জয়ী হবে।


এইভাবেই হেলাল হাফিজের কবিতায় জীবন, কবিতা, জীবনযাপন এবং রাষ্ট্রচিন্তার অনন্য মেলবন্ধন রচিত হয়েছে। তাঁর প্রতিটি পঙ্ক্তি আমাদের চিন্তাকে জাগ্রত করে এবং হৃদয়কে আন্দোলিত করে।


পদাবলি

পদাবলি

 



বারো মাইস্যা পোয়াতির খোঁজে 

মোস্তফা হায়দার 


এসো নিজেকে খোঁজে বের করার মাস্তিতে হাত বাড়াই,

মনুষ্য সময়ের কোলে বসে নিস্তার খোঁজার চেয়ে

ঝিঁঝিঁ পোকা অথবা নিন্দাপতির সূত্রে ডাকো।


ঘন বরষার কোলা ব্যাঙ চৈত্রে ডাকে জল পেতে

সবুজ পাতায় শিশির পরে চৈতের বিদায় দেখে 

তা যেন আরেক কান্নারপিঠে চড়া ঘোড়দৌড়।


বারো মাইস্যা পোয়াতির খোঁজে আর কত নাচবে

আর কত নিন্দ্রা ভাঙবে ব্যাংকের ভল্ট খোলে!

ভেবে দেখো এক নিমিষেই সব সেতারা হারিয়ে গেছে।


এখন আর রাতদিন হিশেব করে লাভ নেই

প্রিয়ার ঠোঁটে বিশ্বাস জমা রেখে পরীমনি হতে চেয়োনা

দেখে নিও মানুষের পৃথিবী বড্ড মাতাল পদ্যে নাচছে!


সঙ্গমের অঙ্গহানিতে কেদারার পাদুকা গেছে ঘেঁড়ে

মধ্যরাতটাকে আপন করে তালাশ করো বিশ্বাসের তরীখানি।



আকাশ বলতে আমি আপনাকেই বুঝি

মারজানা মার্জিয়া 


তারপর অনেক অনেক দিন। আপনার আর আমায় মনে পড়েনা। মনে পড়ার কথাও না। অতি নগন্য কেউ যে আমি। মানুষ যাকে সুন্দর ভেবে শান্তি পায়, তারা খুব দ্রুত প্রস্থান নেয়। জানেন? আকাশের বিশালতা কে খালি সদ্য চোখ দিয়ে বহু বহু দূর থেকে দর্শন করতে পারি। আকাশের সাথে দূরত্ব বাড়ার ভয় নেই, কারণ আকাশ যে কাছেই আসে না। আপনি আকাশ হলে মন্দ না!



নরোম রঙের ছায়া 

সাব্বির আহমাদ 


প্রতি রাতে আমার শিয়রেই পড়ে থাকে একটা নরোম রঙের ছায়া। নির্লিপ্ত চোখের ভিতর কয়েকটা গভীর দাগ- চুম্বনের আবেশ মাখা ক্ষত’র মতো বিছিয়ে থাকে। আমার পাশেই এক নরোম রঙের ছায়া আর আমি ভাবলেশ শূন্য এক প্রজাপতি উড়তে থাকি। 

সারা রাত্র জুড়ে এইসব মূহুর্ত কাঁপানো শীতল রাতের শরীরে গেঁথে দেই কম্পিত ডানার মায়া। তবুও দ্যাখি-

খুব দূরে কেউ একা একা জ্বালাচ্ছে প্রতœতত্ত্ব গায়ের ওঁম। আর তার গালের রেখাচিত্র ধরে আলগোছে বেরিয়ে পড়ছে নির্মেঘ ভাবনার গতর। এক লম্বাটে হাতে; বিভক্ত ঠোঁট। একসাথে অনেক গুলো ব্যস্ত মানুশেন পা।



মায়াজাল

হোসেইন দিলওয়ার


ভাবতেই যেন খুলে যায় স্মৃতিপট

টুকরো সুখের তালাশে অশুচি নেই,

আমার আমিতে লাগুক না যত জট

কিছু বিস্মৃতি ঠিক ভেসে উঠবেই।


বুক ভাঙা ঢেউ রোজ তুলে শিহরন


ফাগুন আসেনি আর এই চরাচরে,

ফেরারি ঢেউয়ে পাক খায় নিউরন

পিছুটান করে রব শুধু অগোচরে।


গাঙশালিকের মতো শিষ দিয়েছিলে

বুঝিনি তোমার ছিল কাপালিক নখ,

শ্বাসরোধী ডানা। প্রাণ হরে তিলে তিলে

তারপর লক অবজ্ঞাপূর্বক।


ভাঙে এ হৃদয় পাড় নিরবধি তোড়ে

তবুও রেখেছি ধরে দেই নাকো যেতে,

কিছু শোক পোঁতা থাক বেদনার মোড়ে

তাতেই রইবো পড়ে তোমাতেই মেতে।


কাল হোক গত তবুও রইবো আমি

মায়াজালে বাঁধা। বিচ্যুত নহে বিষে,

প্রেমের পৃথিবী ভালোবেসে হয় দামি

এভাবেই প্রিয় তোমাতেই রবো মিশে।



এখনো পোষ্ট অফিসের সামনে আছি 

শেলী সেলিনা


আমার, তোমার, আমাদের শুভাকাক্সক্ষীদের সমবেত প্রার্থনার অর্ঘ্য আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটাবে কি?  

পেনেলোপ এর মতো বিশ বছর অপেক্ষা করবো তোমার জন্য, হয়তো তার চেয়ে বেশি! অনন্তকাল!

উদ্দাম উড়ন্ত হামিং বার্ডের মতো

ছুটে চলতে চলতে কখন যে পরবাসে

চলে গেলে, হে পরবাসী!

যারা বলে পৃথিবী সুন্দর তাদের সাথে প্রায়ই আমার তর্ক-যুদ্ধ হয়!

একটা তুমি ছাড়া কি পৃথিবী সুন্দর হয়?

সব ধান্ধাবাজ, শালা উন্মাদের দল!

সাধক না হয় ধ্যানে মগ্ন হয়ে বলে পৃথিবী সুন্দর!

আমি কোনো সাধিকা নই

আমি রাধিকা

প্রেমই আমার বিন্দাবন

আমার প্রেম চাই প্রেমিকের সাথে

নষ্ঠ হওয়াই আমার স্রষ্টার সান্নিধ্য

অনুরক্তগন,

প্রেমিকের সঙ্গ ছাড়া সব ভঙ্গ!

তুমি ছাড়া পৃথিবীর সব আপ্যায়ন

আমি দুপায়ে ঠেলে দেই!

আমি এখনো অপেক্ষমান তোমার নিযুক্ত

পোষ্ট মাষ্টারের পোষ্ট অফিসের সামনে! 


মৃত্যুর দিনলিপি

জিয়া হক


নবজাতক হাসপাতালের ব্রিফিং-

‘তাওহিদ, স্ত্রী সুলতানা

আল্লাহর দিকে তাকান

তিনি বাঁচালে বাঁচবে

চিকিৎসা নেই

সিঙ্গাপুর নিতে পারেন

আমাদের দেশেই একজন চিকিৎসা করে এসেছে

২২ কোটি টাকা লেগেছে

মাত্র ২২ কোটি 

অনেকের টাকা আছে

আপনার-আমার নাই হয় তো।’


আমরা এক আল্লাহর ভরসাতেই বেঁচে আছি 

ফুল যেমন ভাবতে পারে না কেন বেঁচে আছে

আমরাও তেমন।


ফুল না, ফুলের সৌরভ

কাঁঠালচাঁপার মতো গন্ধ

হাসপাতালের দখিন ফ্লাটের বারান্দায়

কে বসে আছে

আমাদের মৃত্যুর দিনলিপিতে

কে হাসছে অমন মুখে-বুকে টোলপড়া গালে?


আমাদের সময়

রহিত ঘোষাল


আমরা যেতাম প্রান্তরের ওপারে

ওখানে আমাদের মুক্তি আঁকা থাকত

পথের দুধারে চটপটে খাবার দোকান

আমরা হাত ধুয়ে খেতাম কিনা মনে নেই

তবু আমাদের শরীরে থাকত সুঘ্রাণ

তালা খুলে ঘরে ঢুকিয়ে নিতাম তাপ উত্তাপ 

এক অন্যরকম ভিড় নেমে আসত

আমাদের চোখের সামনে ভিড় হালকা হয়ে আসত

আমাদের পকেটে থাকত লাইটার-আগুন

চটের তাঁবুর তলায় উষ্ণ আলিঙ্গন 

দোতারা বেজে উঠতো বেখেয়ালি সন্ধ্যেরাত

এক অদ্ভুত দ্যুতি ছেিড়য়ে পড়তো

অর্জুন গাছের পাতা লাল হয়ে ঝরে যেত

আমাদের আশ্চর্য যৌবনের বিস্তীর্ণ সীমান্তে



বিবর্ণ হৃদয়

মোখতারুল ইসলাম মিলন 


বিবর্ণ হৃদয়, ক্লান্তি ভরা,

মনের কোণে জমে থাকা কষ্টের ধারা।

হাসির আলো ম্লান হয়ে গেছে,

স্বপ্নগুলো যেন দূরে সরে পড়েছে।

দৃষ্টি হারায়, খোঁজে সান্ত¡না,

শূন্যতার মাঝে একটুকরো বাসনা।

দিন যায়, রাত আসে ছায়া মেলে,

কিন্তু মন কি আর সুখের পথে চলে?

কাঁপা কণ্ঠে বলি কথা,

কিন্তু হৃদয় বোঝে না তার ব্যথা।

আলো নিবে যায়, অন্ধকার বাড়ে,

বিবর্ণ হৃদয় শুধুই বেদনার ছায়ায় হারায়।

তবু আশা আছে, রঙ ফিরে পাবে,

জীবন একদিন নতুন করে জাগবে।

বিবর্ণ হৃদয় রাঙাবে নতুন আলোয়,

দুঃখ পেরিয়ে সুখের পথে চলবে কালোয়।




চোখের আড়ালে কাঁদে চোখ 

রফিকুল নাজিম 


হঠাৎ দেখা। বিহ্বলতায় তাকিয়ে ছিলাম আমি

তুমিও নির্লিপ্ত চোখে অপলক তাকিয়ে ছিলে,

ভেজা মনে খুব গোপনে মন খারাপের আনাগোনা 

স্মৃতির সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছি আমরা দু’জন মিলে!


ঠোঁটে আমি শুকনো হাসির সহজ প্রলেপ মেখে

জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে, ‘কেমন আছো?’

সুচিত্রা সেনের মতো একগাল হেসে বললে, 

‘বেশ আছি। খুব সুখেই আছি আজও।’


অস্থির গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলে আমায়

‘এখনো কি তুমি রাত জেগে কবিতা লেখো?

হেসে বললাম, ‘চোখের পাতায় রোজ ঘন হয়ে আসে ঘুম

চোখ দুটো কেমন ফোলে আছে- দ্যাখো দ্যাখো!


তারপর নিরবতা। তারপর ফের তাকিয়ে থাকা

বুলেট ট্রেনের মতো সময় দ্রুত গড়িয়ে যায় একা

তবুও প্ল্যাটফর্ম স্বাক্ষী- গোপন ব্যথার দীর্ঘশ্বাস

সুচতুর অভিনয়ে প্রাণবন্ত হয়- মেকি ভালো থাকা!


তারপর ফিরতি ট্রেনের হুইশেল- ঝকঝকা ঝকঝক

অথচ মনে কথার উতল হাওয়া; গল্পরা করে বকবক, 

অভিনয় দেখে দিচ্ছেন তালি- অন্তর্যামীই নিরব দর্শক

চোখের আড়ালে কাঁদছে গোপন- দু’জনের পাথুরে চোখ!


আকাশ আর সমুদ্রের পরোয়ানা জারি

আকাশ আর সমুদ্রের পরোয়ানা জারি

 


আকাশ আর সমুদ্রের পরোয়ানা জারি

ইমদাদ উল্লাহ ফিরদাউস


কোনো এক গোধূলিবেলায় পাড়ার সমুদ্রতটে হাঁটতে গিয়েছিলাম। অন্তহীন সমুদ্রকে নিজের বাঁ-পাশে রেখে তার একদম কূলঘেষে হাঁটতে থাকলাম আনমনে। হাঁটতে হাঁটতে যেন কোনো এক অজানা ভাবনার ঘোরে হারিয়ে গেলাম। সংবিৎ ফিরতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা উঁচু ঢিবির ওপর উপবিষ্ট অবস্থায়।


ভাবনার ঘোর কাটিয়ে মনোযোগ ফেরালাম মাথার ওপর খুঁটিহীন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নীলাকাশপানে, বুক জুড়ে তার ছড়িয়ে থাকা শিমুল তুলোর মতো মুঠো মুঠো মেঘরাশি। ক্রমাগত প্রবহমান জলধারার মতো করে সেসব মেঘপুঞ্জ ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমার আড়ালে। ওসবের কোনোটাকে দেখতে মনে হচ্ছে যেন, খোদিতকোনো প্রাণীর কায়া বা প্রতিবিম্বিত কোনো মানবছায়া। কিংবা যেন কোনো মূর্ত বস্তুর প্রতিকৃতি বা অঙ্কিত কোনো দেহমূর্তি।


চোখ সরিয়ে এবার তাকালাম স্রোতস্বিনী সমুদ্রের দিকে,  এ কী! না জানি, তার সে যে কি রাগ-ক্ষোভ; বিরামহীন তার ঢেউগুলো প্রবল গতিতে একটি অন্যটির ওপর ভীষণ ক্রোধের সাথে আছড়ে পড়ছে। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা যেন আজ পুঞ্জিভূত দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ করছে। ওরা যেন আজ বিক্ষোভ-মিছিল ডেকেছে। আন্দোলিত সমুদ্দুর যেন উদগীরণ করছে নিজের ভেতর পুষে রাখা এতদিনকার সব ক্ষোভ-যন্ত্রণা। জানান দিচ্ছে চূড়ান্ত বিপ্লবের ঘোষণা। ধীরে ধীরে বেড়েই চলল কল্লোলিত সমুদ্রের বেপরোয়া আন্দোলন।


দ্রোহের অনলে তপ্ত ও তরঙ্গোদ্বেলিত সমুদ্রকে দেখে তখন নিজের ভেতরকার অনুসন্ধিৎসু সত্তা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। প্রশ্নকারী আত্মা আমা ব্যাকুল হয়ে উঠল। অমনি জিজ্ঞেস করে বসলাম। সীমাহীন আকাশের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললাম,


-আচ্ছা আকাশ! এইসব অগণিত মেঘ-রোদ্দুর, গ্রহ-নক্ষত্র, চাঁদ-সুরুজ-তারকারাজি এত সবকিছুকে যে সারাটাক্ষণ নিঃস্বার্থভাবে আগলে রেখেছ নিজের বুকে কোনোরকম মাইনে ছাড়াই- এতো উদার কী করে হলে? কার কাছে শিখলে এমন উদারতা?


প্রত্যুত্তরে আকাশ শুধু বলল - পরার্থপরতা ও পরোপকারিতা এবং মাত্রাতিরিক্ত সহনক্ষমতাই আমাকে এমন উদার করে তুলেছে।

উত্তাল সমুদ্রকে শুধালাম, এতো যন্ত্রণা-ক্ষোভ কেনো তোমার? কীসের এতো বিদ্রোহ আর বিক্ষোভ? এতটা বেপরোয়া সাহস কোথায় পেলে?


সমুদ্রর তখন উত্তর করল- আমার ওপর কৃত  সীমাতিরিক্ত অত্যাচার-শোষণ  এবং আমার সামনে ঘটিত সীমাহীন অন্যায়-অবিচার আমায় এমন বেপরোয়া সাহসী করে তুলেছে।


সেদিন আমি জানলাম নতুন একটি বিষয়। শিখলাম নতুন এক পাঠ। আকাশ ও সমুদ্রের পরষ্পর বিপরীতমুখী আচরণ থেকে আমি বুঝলাম, কোনো কিছুতে মাত্রাতিরিক্ত সহনক্ষমতা যেমন কাউকে বেহদ্দ উদারচেতা বানিয়ে তুলে আবার কোনো কাজ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেটা তাকে বেশ বেপরোয়া ও বিদ্রোহী করে তোলে।


শিক্ষার্থী