সময়ের পদাবলি





 আমার বয়স
খালেদ হোসাইন

আমাকে তুমি মনে করিয়ে দাও আমার বেশ বয়স হয়েছে। শুনে আমার হাসি পায়। আমি এই তো সেদিন জন্মালাম। আমার মা উঠোনের কোনায়- ছটিঘরে- মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করলো। চিরবিদায় নিলো সবার কাছ থেকে। আমি ভুবনডাঙার আলায় চিৎকার করে উঠলাম। মা নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকলো। পুকুরের পাড়ে তালগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে কেউ আজান দিলো। এই তো সেদিনের কথা, আমার সব মনে আছে।

তুমি বলো, আমার গোঁফ পেকে গেছে- একটি-দুটি চুল। শরীর কত ভারী হয়ে গেছে। তুমি চাও আমি আমার সকল আকাক্সক্ষার মাথা মুড়ে দিই। তাদের ডানা ছেঁটে দিই। তাদের পায়ে শেকল পড়াই। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব তা আমি বুঝতেই পারি না! এই দেখ, আমার শরীর এখনো ভেজা- বাবা আমাকে পুকুরের জলে সাঁতার শেখালেন একটু আগে। আমি তাঁকে জোর করে ধরে রাখতে চাইলাম, তিনি আমাকে ঠেলে দিলেন গভীর জলে- আমি হাত-পা ছুঁড়তে থাকলাম। ভাবলাম, বাবা আমাকে মৃত্যুর কাছে সঁপে দিলেন। না, তিনি বড় একটা মাছের মতো আমাকে পাঁজা কোলে করে তুলে আনলেন, মুখে হাসি।
আমি যখন ডুবে যেতে থাকি, কেউ আর এখন আমাকে রক্ষা করে না। তবু দেখ, আমার পায়ে পুকুরপাড়ের সেই কাদা।

না, আমার তেমন বয়স হয়নি। এই তো কিছুক্ষণ আগে আমার বড় বোন আমাকে পরীদের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গেল। বিশাল সরোবরের চারপাশে আমরা পরীদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম। তারা আমাকে খাওয়ালো টকটকে লাল সিরাপ-দেয়া পাঙ্খা-বরফ- ছুঁয়ে দেখো, কলজেটা এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে। তারা আমাকে বানিয়ে দিলো ফিনফিনে ফড়িঙের পাখার মতো কাগজের ঘুড়ি- তাকাও আকাশে, ওই যে-  এখনো তা মেঘলোক স্পর্শ করেনি। এই যে আমার পায়ে ঘাসের চপ্পল- তা পরীদের দেয়া। আমার কপালের চুল যখন হঠাৎ উড়ে যায়, তুমি বুঝতে পারো না, আয়াতুল কুরসি পড়ে মা আমার কপালে ফুঁ দিচ্ছেন।

আসলে, আমার জন্মানোর কথা ছিলো অনেক আগে। অন্তত কয়েক শতক। যখন আকাশ আরো নীল ছিলো, ঘাসে আরো গন্ধ, নদীতে আরো জল, বুকে আরো ভালোবাসবার তৃষ্ণা। কিন্তু আমার দেরি হলো, তাই আমার বয়স হলো না।      


ফাদি আবু সালাহ্
লতিফুল ইসলাম শিবলী

তোমাকে দেখার আগে জানা ছিল না-
মানুষের পা কেড়ে নিলে তার পিঠে গজায় ডানা,
আর হাঁটতে বাধা দিলে মানুষ শিখে যায় উড়তে।

ওরা শুরু করেছিল তোমার পায়ের নিচের মাটি থেকে,
তাই প্রথমে ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার জমিন।

দেশ নামের যে এক চিলতে জেলখানায় তুমি থাকতে
সে জমিন শত শত শহীদের ভিড়ে কবেই হয়ে গেছে মর্ত্যের জান্নাত।

এরপর ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার শৈশব,
অথচ তুমি কখনোই শিশু ছিলে না,
তুমি ছিলে সেই জান্নাতের সবুজ আবাবিল।

আব্রাহার হস্তি বাহিনীর উপর কঙ্কর ছুড়ে যেভাবে তছনছ করে দিয়েছিল,
আজ তাবৎ পৃথিবী জানে তুমিই সেই আবাবিল,
একই কায়দায় ছুড়ে মারো কঙ্কর আব্রাহাম ব্যাটেল ট্যাঙ্কের দিকে।

তোমাকে তো ছেড়ে দেয়া যায় না-
এরপর ওরা কেড়ে নিলো তোমার তারুণ্য,
তোমাকে জেলে পুরে ওরা ভেবেছিলো
শুকনা পাতার নিচে ওরা লুকিয়ে রাখবে আগুন।

আটলান্টিকের এপার ওপার হয়ে সে আগুন ছড়িয়ে পরেছে
সাতটি সাগর মহাসাগরের কুলে উপকুলে

আর তোমার দৃপ্ত পদভারে যখন কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করেছে
জেরুজালেমের প্রাচীন দেয়াল
ঠিক তখনি ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার অনিন্দ্য সুন্দর পা জোড়া।

সাধ্য আছে কার
কি ভাবে থামাবে ওরা তোমার চার চাকার হুইল চেয়ার,
ওরা জানত হুইল চেয়ারে বসেও বৃদ্ধ ইমাম শেখ ইয়াসিন ছিলেন কতটা অপ্রতিরোধ্য,
সেই বৃদ্ধকে হত্যা করতে যারা হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে মিজাইল ছুড়তে পারে,
তারা তোমার এই উদ্ধত যৌবনের কাছে কেমন অসহায় কাপুরুষ।

ওরা জেনে গেছে তোমার প্রাণশক্তির উৎস,
ওরা জেনে গেছে এই ফিলিস্তিনের মাটিতেই ডেভিডের ছোড়া ঢিলের আঘাতে
কি ভাবে পরাজিত হয়েছে জালিম গোলিয়াথ

হে ফাদি আবু সালাহ্, হে পাথর ছোড়া আবাবিল-
তাই আজ ওরা কেড়ে নিলো তোমার জীবন।

আহা, জান্নাতের সবুজ পাখি
তোমাকে দেখার আগে জানা ছিলো না
পা’হীন মানুষের পিঠে গজায় এমন উড়াল ডানা।

আমরা জানি তুমি ফিরে আসবে বলেই দিয়েছ এই উজাড় উড়াল,
আমরা প্রতীক্ষায় আছি, ঝাঁকে ঝাঁকে
ফিরে আসো, আবাবিল; ঝাঁকে ঝাঁকে...

একমুঠো শৈশব
সোহেল বীর

দু’হাত পেতে আছি, একমুঠো শৈশব পাওয়ার আশায়-
হলুদ সর্ষে ক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে চলা শৈশব
ছেলেমেয়ের প্রভেদ ভুলে বউছি আর গোল্লাছুট খেলার শৈশব
পুতুলের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার শৈশব
বর্ষায় কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দেওয়ার শৈশব
কাগজের উড়োজাহাজ বানিয়ে আকাশ ছোঁয়ার শৈশব
বাবার কাঁধে চড়ে বাজারে যাওয়ার শৈশব
মায়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানোর শৈশব
নানীর কাছে রূপকথার গল্প শোনার শৈশব!

একমুঠো শৈশব আমায় ভুলিয়ে দেয় যান্ত্রিকতার দহন
আমি ভুলে যাই এই শহরের যত সব কৃত্রিমতা
ভুলে যাই নন্দিনীর বিশ্বাস ঘাতকতা !

কথা আছে
সাজ্জাক হোসেন শিহাব

বুক ভরা ভালোবাসা । অথচ আমার
দু’চোখ দেখেনা আজ জবার পাপড়ি !
অপেক্ষায় দিন চলে যায়, আত্নভোলে
রক্তজবা ফুল ! আমি জেগে থাকি একা,
একটা পুরনো পত্র পড়বো বলে ! এ-
চোখের কোণায় জমা হয় অশ্রুজল !
সেই জলে, যে জলের প্রেম বাতাসের
বুকে আয়ু নিয়ে ছোটে । বহুদিন একা
শুনি নাকো জীবনের এমন মায়াবী গল্প ।
আমার আকাশে আসেনি মানুষী;
আত্না-আত্না বিনিময় দিয়ে মুছে দিবে
বলে চির খরা দশা ! অথচ সময়
ঠিক জানে- কতো কথা তোমার আমার !



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট